এমনও তো হতে পারে
তারপরেই মাত্র দু-সেকেন্ড… দু-সেকেন্ডের মধ্যেই পৃথিবী আবার ফিরে যাবে তার জন্ম মুহূর্তে। জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে রপান্তরিত হয়ে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাবে আমাদের পৃথিবী… বলতে বলতে গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠল বিজ্ঞানীর মুখমণ্ডল।
সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে ওয়ার্ল্ড রিসার্চ সেন্টারের চারপাশে। চায়ের টেবিলের সামনে মুখোমুখি বসে আছে বিজ্ঞানী ও তার স্ত্রী।
মাত্র দু-সেকেন্ড… তারপরেই সব শেষ…
বিশ্বাস করতে পারছ না তো… তুমি কেন, কেউই পারবে না। চোখ ঝলসানো উজ্জ্বল আলোর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে একটা গ্রহ৷ সৌরমণ্ডল শুধু থরথর করে কেঁপে উঠবে কয়েকবার, ভারসাম্য হারিয়ে সৌরমণ্ডলের পরিণতি এখন আমাদের গবেষণার বস্তু।
কিন্তু এই অসম্ভব ঘটনা ঘটবে কেমন করে?
খুব সোজা, খুব সাধারণ। এই ঘরের মধ্যে বসেই করা যায়, শুধু তিনটি বস্তুর মিশ্রণ ঘটাতে হবে। অবশ্য যেমনভাবে বললাম এতটা সোজা নয় সমস্ত ব্যাপারটা। তাহলেও বলব, খুবই সোজা এখন আমাদের কাছে। প্রায় হাতের কাছে পাওয়া যায় সব, তারপরে শুধু জটিল এক ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়া…
শোনো, শোনো, যেমন করেই হোক না কেন সরিয়ে ফেলা যায় না ওই মারাত্মক তিনটে বস্তুকে? ভয়ার্ত স্বরে প্রশ্ন করল বিজ্ঞানীর স্ত্রী।
না, হয়তো যায় না, এমন সব বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো বস্তুগুলো… তা ছাড়া সর্বসাধারণের কাজেও লাগে এগুলো। তাই সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়।
তার মানে, কোনও পাগল যদি জানতে পারে অথবা মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত কোনও খুনি যদি জেল ভেঙে বেরিয়ে আসে আর এই ফরমুলা যদি… তা হলে তো এক নিমেষে ধ্বংস করে ফেলবে সম্পূর্ণ মানব সমাজ… সমস্ত পৃথিবী… এক কথায়।
জানি জানি, তুমি কল্পনা করতে ভালোবাসো বেশি। কিন্তু ফরমুলা জানা এত সোজা নয়। শুধু আমরা ক-জনই মানে মোট পঁচিশ জন জানি। শুধু তাই নয়। পৃথিবীর নামে গোপনতা রক্ষার শপথ নিতে হয়েছে আমাদের। আর সে জন্যেই তোমার কাছেও বলতে পারব না ফরমুলার কথা। শুধু…
প্রতিজ্ঞা, শপথ, সব বুঝলাম। তা সত্ত্বেও কেউ যদি…
হ্যাঁ, সে কথাটাই বলতে চাইছিলাম আমাদের মধ্যে কেউ যদি কোনও দুর্বলতম মুহূর্তেও বলে ফেলে, বা ভবিষ্যতেও যদি কেউ…
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না, তোমাদের মধ্যে এত লোক জানল কী করে।
সাপ্তাহান্তিক মিটিং-এ শুধুমাত্র এর সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তখন আমরা পঁচিশ জনই ছিলাম সেদিন। তারপর কয়েকটা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আমরা এক্সপেরিমেন্ট করতে শুরু করি। শেষটা অবশ্য নির্ভর করতে হয়েছে ম্যাথেমেটিক্সের ক্যালকুলেশনের উপর। সত্যিকারের পরীক্ষা করতে গেলে তো ধ্বংস হয়ে যেত পৃথিবী। আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানো, একই ফল পাওয়া গেল সব এক্সপেরিমেন্টের। প্রমাণ হল সিদ্ধান্ত এক এবং অভ্রান্ত।
এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! যে কোনও উপায়ে তোমরা তো ভুলে যেতে পার ওই সব মারাত্মক আবিষ্কারের ঘটনা। যেমন করেই হোক তোমাদের মন থেকে মুছে ফেলতে হবে আবিষ্কারের ফরমুলাগুলো। আর তার ফলেই ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তি পাবে পৃথিবী।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আমরাও আলাচনা করেছি এ-বিষয়ে। আগামীকাল সকালে এক বিশেষ মিটিং ডেকে এ বিষয়ে আলোচনার জন্যে.. তবে কী জানো, বেশ কিছু হয়তো রাজি হবে এ প্রস্তাবে, কিন্তু দ্বিমত হওয়াও বিচিত্র নয়। আর আমাদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী মত পোষণ তো স্বাভাবিক। এই তো সেদিনের মিটিং-এ তিনজন সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করল। বলল, বিজ্ঞানের এত বড় আবিষ্কার লুকিয়ে রাখার কোনও অধিকার নেই আমাদের। সমস্ত পৃথিবীর জানা উচিত আসল ব্যাপার। কী জানেনা, ক্যালকুলেশনগুলো না হয় ধ্বংস করা গেল, কিন্তু প্রসেস আর বস্তুগুলো এতই সাধারণ যে একরকম অসম্ভব মন থেকে মুছে ফেলা–বিশেষত আমাদের মন থেকে।
বুদ্ধিমান লোকমাত্র এ-কথা বলবে ভুলে যাওয়া বা মন থেকে মুছে ফেলাই পথ। আচ্ছা, ওই তিনজন বিজ্ঞানীকে বন্দি করে রাখলে তো আর কাউকে বলার সময় পাবে না। প্রয়োজনে মেরে ফেলাও…
চুপ চুপ, কী বলছ তুমি? কেউ শুনে ফেললে… তোমার সঙ্গে আলোচনা করাই উচিত হয়নি আমার।
উঠে পড়লেন বিজ্ঞানী। আর নয়–কাল সকালের কাগজগুলো দেখে নিতে হবে একবার। ভোরেই আরজেন্ট মিটিং।
রাতেও বেশি কথা হল না। স্ত্রীর মুখ চিন্তান্বিত।
বিছানায় শুয়েও বিজ্ঞানীর চোখে ঘুম এল না। স্ত্রীর কথাগুলোই বাজতে লাগল কানের কাছে। সম্ভাবনাময় নানান ঘটনা ভেসে উঠতে লাগল চোখের সামনে। দাবি মেটাও, নয়তো ধ্বংস করে দেব পৃথিবীকে। অসম্ভব নয় কারুর পক্ষে। একমাত্র পথ, ভুলে যাওয়া। কিন্তু তাও বা সম্ভব কী করে। আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে দিনে দিনে। যে কোনও একজন আত্মহত্যাকারী যদি জানতে পারে এ ফরমুলা তাহলে তাহলে মুহূর্তের মধ্যে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাবে পৃথিবী।
ভোরবেলায় হাসিখুশি দেখাল বিজ্ঞানীর স্ত্রীকে বিছানায় শুয়েছিল ওদের একমাত্র সন্তান, ছ-মাসের শিশু রুদ্রনীল, কী পরম আনন্দে হাত পা ছুঁড়ে খেলায় মত্ত। সেই দিকে তাকিয়ে বলে উঠল বিজ্ঞানীর স্ত্রী, শোনো, ওই পঁচিশ জনকেই যদি মেরে ফেলা যায় তাহলে তো বেঁচে যাবে পৃথিবী, পরম নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারে আমার রুদ্রর মতো হাজার হাজার শিশু, এমন সুন্দর পৃথিবী।
আবার, আবার, শুরু হল তোমার পাগলামি, কারা আছেন ওই পঁচিশ জনের মধ্যে জানো তুমি? ড. পুরঞ্জয় ব্যানার্জী, ড. ওমপ্রকাশ, ড. শীলার।
রাখো, রাখো তোমার কথা, কী হবে ওইসব বড় বড় বিজ্ঞানীদের নিয়ে, বিজ্ঞান আর তোমাদের মতো তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের জন্যে কি ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী, অকালে ঝরে পড়বে রুদ্রের মতো কচি কচি শিশুরা, না না, এ হতে পারে না, হতে পারে না।
অনেক কষ্টে স্ত্রীকে শান্ত করলেন বিজ্ঞানী। অবশেষে যা হবার তাই হল, সৃষ্টির শুরু থেকে পুরুষকে ভুলিয়ে এসেছে নারী, এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না, রাজি হলেন বিজ্ঞানী।
পরিকল্পনা সামান্য, ত্রুটিহীন, অথচ নির্ভুল অব্যর্থ। সামনের সপ্তাহে জরুরি মিটিং আছে পঁচিশ জনের মধ্যে। ঘরের এক কোনায় তাকের ওপর রাখা আছে গত মাসে আবিষ্কৃত ভয়াবহ বিষাক্ত গ্যাসের ছোট্ট সিলিন্ডার। কয়েকশো বাঁদর শেষ হয়ে গেছিল মাত্র দু মিনিটের মধ্যে। সময়মতো টাইম অ্যাডজাস্ট করে মাইক্রো-ইলেকট্রনিক যন্ত্রটা লাগিয়ে দিতে হবে সিলিন্ডারের মুখে। আর ঠিক সেইদিন প্রচণ্ড অসুস্থতার জন্যে মিটিং-এ অনুপস্থিত থাকবে বিজ্ঞানী, তারপর।
তারপর মিটিং-এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চব্বিশ জন বিজ্ঞানী, পৃথিবী ধ্বংসের সম্ভাবনা।
কেউ সন্দেহ করল না বিজ্ঞানীকে। করার উপায়ও ছিল না। সেদিন রাতে খাবার টেবিলে গল্প করছিলেন বিজ্ঞানী ওর স্ত্রীর সঙ্গে।
এবার নিশ্চিন্ত হলে তো? রুদ্র রুদ্র করে পাগল হয়ে যাবে তুমি।
যা বলেছ, রুদ্রের মুখের দিকে তাকালে সব ভুলে যাই, মনে হয় আমার রুদ্রের মতো পৃথিবী জুড়ে হাজার রুদ্র চেয়ে আছে আমার দিকে, বলছে, বাঁচতে দাও, বাঁচতে দাও আমাদের।
কী যে বলো তুমি, জানো তোমার জন্যে যা করলাম? যাক, ভালোই হল একরকম, এবার আমিই একমাত্র জানি ফরমুলাটা, পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতা এখন আমার মুঠোর মধ্যে। গর্বে উত্তেজনায় চকচক করে উঠল চোখ দুটো।
স্তম্ভিত হয়ে গেল স্ত্রী। আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকাল একবার। কুঁচকে উঠল ভ্র দুটো। কিন্তু কয়েক মুহর্তের মধ্যে সামলে নিল স্ত্রী।
তা যা বলেছ তুমি, তুমিই একমাত্র জানো পৃথিবী ধ্বংসের ফরমুলা, পৃথিবীর প্রেসিডেন্টেরও নেই এত ক্ষমতা, উঃ কী যে ভালো লাগছে ভাবতে। গর্বের সঙ্গে কথাগুলো বলল বিজ্ঞানীর স্ত্রী।
সারা রাত ঘুম এল না স্ত্রীর চোখে, বারে বারে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল ঘুমন্ত রুদ্রকে, এক রুদ্র হাজার রুদ্র হয়ে ধরা পড়ল মায়ের চোখে, বিশ্ব চরাচর ভরে উঠল মাতৃস্নেহে, পৃথিবীকে বাঁচাবার গুরু দায়িত্ব অনুভব করল সে।
বিষ পাওয়া খুবই স্বাভাবিক বিজ্ঞানীর ঘরে। বেড টি-র কাপে চুমুক দেবার সঙ্গে সঙ্গে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়লেন বিজ্ঞানী। কোনও অবকাশ নেই সন্দেহের। চব্বিশ জন সহকর্মীর মৃত্যুতে মানসিক ভারসাম্য হারানো খুবই স্বাভাবিক, আর তার ফলেই…
রুদ্রকে কোলে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল বিজ্ঞানীর স্ত্রী, টপ টপ করে দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল বিজ্ঞানীর প্রাণহীন দেহের উপর।
রুদ্রকে নামিয়ে রেখে প্রাণহীন দেহের উপর লুটিয়ে পড়ল, দু-হাতে জড়িয়ে ধরল পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিকে, কান্নার আবেগে ফুলে ফুলে উঠল সমস্ত শরীর, খিল খিল করে হেসে চলেছে নিষ্পাপ রুদ্র।
অবশেষে জয়ী হল মাতৃস্নেহ।
[প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, বার্ষিকী ১৯৮৩]