এবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি

এবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি

আমার শৈশবের একটি অংশ নাপিতের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে কেটেছে। বাবা এক হিন্দুস্তানি (ভোজপুরি নাপিতের ব্যবস্থা করেছিলেন যে বাসায় এসে বাচ্চাদের চুল কেটে দিত। নরুন দিয়ে নখ কাটত। নাপিতের স্বাস্থ্য এবং গোঁফ ছিল দেখার মতো। তাকে দেখামাত্র পালিয়ে যাওয়া ছিল আমার প্রথম রিফ্লেক্স অ্যাকশান। পালিয়ে রক্ষা নেই, নাপিতই আমাকে ধরে আনত। মাটিতে বসিয়ে দুই হাঁটু দিয়ে মাথা চেপে ধরত। কান্নাকাটি চিৎকারে কোনো লাভ হতো না। ছেলেমেয়েদের কান্না এবং চিৎকারকে মা কোনোরকম গুরুত্ব দিতেন না। তার থিওরি হলো বাচ্চারা কাদবে, চিৎকার করবে, এটা তাদের ধর্ম। হাত-পা না ভাঙলেই হলো।

ক্লাস ফোরে ওঠার পর ভোজপুরি নাপিতের হাত থেকে মুক্তি পেলাম। মা এক দিন হাতে একটা সিকি (পঁচিশ পয়সা) ধরিয়ে দিয়ে বললেন, যা সেলুনে চুল কেটে আয়। জীবনের প্রথম সেলুনে চুল কাটতে গেলাম। নাপিতের প্রথম প্রশ্ন, পয়সা এনেছ?

আমি হাতের মুঠি খুলে সিকি দেখালাম।

চুপ কইরা বইসা থাকো। পাও নাড়াবা না। সেলুন কোনো দুষ্টামির জায়গা না।

আমি চুপ করে বসে দোকানের সাজসজ্জা দেখতে লাগলাম। বোররাক নামক এক প্রাণীর বাঁধানো ছবি। বোররাক হচ্ছে একটা পাখাওয়ালা ঘোড়া। এর পিঠে চড়েই নবিজী (দঃ) মেরাজ শরীফে গিয়েছিলেন।

 দ্বিতীয় ছবিটি ক্ষুদিরামের। তাঁর গলায় ফাঁসের দড়ি। কয়েকজন ইংরেজ তাকে ঘিরে তাকিয়ে আছে। একজনের হাতে ঘড়ি। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় ঘড়ি দেখে ইশারা দেওয়ার পর ফাঁসি কার্যকর হবে।

ক্ষুদিরামের ফাঁসি নিয়েই অতি বিখ্যাত গান–এবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। গানের প্রসঙ্গ আনলাম। কারণ আমি বিদায় নিতে চাচ্ছি–পাঠকদের কাছ থেকে। ফাউনটেনপেন অনেকদিন লেখা হলো, কালি শেষ হয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।

ছবির কাজে হাত দিচ্ছি। এখন ব্যস্ততা ছবি নিয়ে। ছবির নাম ঘেঁটুপুত্র কমলা। ছবি নিয়ে বলি, আমার মতো প্রবীণরা ‘ঘেটু’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত। এই সময়ের তরুণরা না।

সুনামগঞ্জ এলাকার জলসুখা গ্রামের বাউল আখড়ায় প্রথম ঘেঁটুগান শুরু হয়। নাচ-বাজনা এবং গান। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, গানের সুর হলো ক্লাসিক্যাল ধারায়।

একটি রূপবান বালককে মেয়ে সাজানো হতো। সে নেচে নেচে গান করত। মাঝে মাঝে দর্শকদের কোলে বসে তাদের গলা জড়িয়ে ধরত।

সংগীতের এই ধারায় অতি দ্রুত কদর্যতা ঢুকে যায়। নারীবেশী কিশোরদের জন্যে পুরুষরা লালায়িত হতে শুরু করেন। একসময় বিত্তবানদের মধ্যে ঘেঁটুপুত্র কিছুদিনের জন্যে বাড়িতে এনে রাখা রেওয়াজে পরিণত হয়। বিশেষ করে সিলেট ময়মনসিংহের হাওর অঞ্চলে তিন মাসের জন্যে ঘেঁটু রাখা রেওয়াজে পরিণত হয়। কারণ এই তিনমাস হাওর থাকে জলমগ্ন। আমোদ-ফুর্তিতে সময় কাটানো ছাড়া কিছু করার নেই। আমজনতা সময় কাটায় তাস খেলে, ‘দবা’ (দাবা) খেলে, গানবাজনা করে। শৌখিনদার বিত্তবানরা তিনমাসের জন্যে ঘেঁটুপুত্র নিয়ে আসেন। ঘেঁটুপুত্র রাত্রিযাপন করে শৌখিনদের সঙ্গে। শৌখিনদারের স্ত্রী চোখের জল ফেলেন। স্ত্রী ঘেঁটুপুত্রকে দেখেন তার সতীন হিসেবে। প্রাচীন সাহিত্যেও বিষয়টা উঠে এসেছে

“আইছে সতীন ঘেঁটুপুলা
তোরা আমারে বাইন্ধা
ফেল হাওরে নিয়া…”

প্রকাশ্য সমকামিতার বিষয়টা সেই সময়ের সমাজ কী করে স্বীকার করে নিয়েছিল আমি জানি না। তবে আনন্দের বিষয় ঘেঁটুগান আজ বিলুপ্ত। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত সংগীতের একটি অপূর্ব ধারা।

আমার সংগ্রহের ঘেঁটুগানগুলো ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’য় ব্যবহার করব। প্রাচীন আবহ তৈরির চেষ্টা করব। কেন জানি মনে হচ্ছে এটিই হবে আমার শেষ ছবি।

ইচ্ছা ছিল সম্পূর্ণ নিজের টাকায় ছবিটা করব। অন্যের টাকায় ছবি করার অর্থ নিজেকে কিছুটা হলেও বন্ধক রাখা। দুঃখের ব্যাপার হলো ছবি তৈরিতে যে বিপুল অংকের অর্থ লাগে তা আমার নেই।

ছবি বানাতে গিয়ে টাকার সমস্যায় পড়লেই আমি আসাদুজ্জামান নূরের কাছে। যাই। নূর প্রথম যে বাক্যটি বলেন তা হলো, টাকা কোনো ব্যাপারই না। আপনার কত টাকা লাগবে?

এবারও অতীতের মতো একই কথা বলে আমার হাত থেকে বাচার জন্যেই হয়তো জার্মানিতে গিয়ে বসে রইলেন। তাঁর আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

 IDLC নামক এক অর্থ-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ছবি বানানোর জন্যে তারা আমাকে টাকা ধার দেবে কি না। তাদের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ছবি বানানোর জন্যে আমরা টাকা দিই না। তবে আপনাকে অবশ্যই দেব।

এদের কথা শুনে আমার প্রাথমিক শঙ্কা দূর হয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা, শেষ খুঁটি চ্যানেল আইয়ের সাগর তো আছেই। সাগরের সঙ্গে প্রচলিত একটি গল্প এরকম—

পত্রিকায় ফিল্মের ওপর ফ্রিল্যান্স লেখা লেখে এমন এক সাংবাদিক গিয়েছে। মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছে, সাগর ভাই, একটা ছবি বানানোর খুবই শখ।

সাগর : নাটক, সিনেমা এইসব আগে কখনো বানিয়েছ?

সাংবাদিক; না। তবে এইসব বিষয়ে আমার ব্যাপক পড়াশোনা।

সাগর : চিত্রনাট্য কি তৈরি?

সাংবাদিক : শুরু করেছি, এখনো শেষ হয় নাই।

 সাগর : ছবির বাজেট কত?

সাংবাদিক : আপনি যা দেন তার মধ্যে শেষ করে ফেলব ইনশাআল্লাহ।

সাগর : খোঁজ নাও তো শেরাটনের বলরুম কবে খালি।

সাংবাদিক : কেন সাগর ভাই?

সাগর : ছবির মহরত করবে না?

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, জীবন শুকায়ে গেলে করুণাধারায় যেতে হয়। ফিল্মমেকারের জীবন শুকায়ে গেলে তারা যায় সাগরের কাছে। লোনা পানির সাগর না, চ্যানেল আইয়ের সাগর।

‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবি নিয়ে ব্যস্ততার পর্ব চলছে এখন। ফাউনটেনপেনের আর কোনো পর্ব লেখা এই কারণেই বন্ধ।

পাদটিকা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কিন্তু ঘেঁটুগানের ফসল (লেটো গান, জিনিস একই)। তাঁর সংগীতের প্রথম পাঠ হয় লেটো গানের দলে।

কুইজ

 বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হয়েছে। আমরা সাপ-লুডু ছাড়া তেমন কিছু খেলতে পারি না। তাতে কী হয়েছে? আমাদের আহাদের সীমা নেই। পাড়ায় পাড়ায় ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার ফ্ল্যাগ উড়ছে। অনেক বছর আগে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে হেরে গিয়েছিল। আমি তখন ময়মনসিংহে ‘অয়োময়’ নামের ধারাবাহিক নাটকের ইউনিটের সঙ্গে আছি। আর্জেন্টিনার পরাজয়ের পর পর বিশাল জঙ্গি মিছিল বের হলো। স্লোগান–আর্জেন্টিনার পরাজয় মানি না, মানি না।

এক দড়িতে দুজনের ফাঁসিও চাওয়া হলো। একজন রেফারি, আরেকজন হচ্ছে আর্জেন্টিার বিপক্ষের গোলদাতা। তাঁর নাম মনে নেই।

বিশ্বকাপ উপলক্ষে কুইজ বিশ্বকাপ নিয়েই হওয়া উচিত।

প্রশ্ন : ফুটবল খেলার শুরুটা কীভাবে হয়?

উত্তর : চীনের মিং ডায়ানাষ্টির গোড়ার দিকে শুরু। মিং রাজাদের হাতে পরাজিত সেনাপতিদের কাটা মুণ্ড সম্রাটের সামনে রাখা হতো। সম্রাট কাটা মুণ্ডুতে লাথি দিতেন। মুণ্ডু গড়িয়ে যেত, সম্রাট আনন্দ পেতেন। তাঁর আনন্দ থেকেই– ফুটবল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *