এবং সেই সূত্রের ভুলগুলো

এবং সেই সূত্রের ভুলগুলো 

চার মিনিট পরে। 

তীলকের চোখের পলক পড়ছে না। এক দৃষ্টিতে তিনি ছোট টিভি স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে আছেন। স্ক্রিনটা অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে তিনি টিম নিয়ে ভবনের ভেতরে ঢুকবেন। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, একটা লোক ফিরোজের দিকে বন্দুক তাক করে আছেন। বশির জামানকে দেখা যাচ্ছে। তাদের ভেতরে কিছু একটা নিয়ে কথা হচ্ছে। তীলক সেগুলো নিয়ে আগ্রহ বোধ করছেন না। যেকোন মুহূর্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ফিরোজ এখনও কেন ক্যামেরাটা বন্ধ করছেন না? 

গুলি চলার শব্দ হল। অন্ধকার হয়ে গেল স্ক্রিন! 

“শিট”। তীলক ওয়াকিটকিতে বললেন, “অল টিম। মেজর জেনারেল ইজ ডাউন। ব্রিচ। আই রিপিট। ব্রিচ।” 

কালো ছায়াগুলো সারিবদ্ধভাবে মূল ভবনের ভেতরে ঢুকতে শুরু করল ক্ষীপ্র গতিতে। 

***** 

চার মিনিট আগে 

ফিরোজের ভেতরে কোন মৃত্যু ভয় দেখা গেল না। তিনি বশিরের কথাগুলো সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে শংকরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ শংকর, তোমার মেয়ে সুতপা একটা নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। আমি নিজে ওকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। তোমার স্ত্রী এবং কন্যা অনেক ভালো আছে। আর আমি ছাড়া আর কেউ জানে না তারা কোথায় আছে।” 

শংকর গর্জে উঠলেন, “মিথ্যা কথা। আপনি নিজে সুলেখাকে আর সুতপাকে গুলি করে মেরেছেন। আপনিই আমাকে মেরে ফেলার হুকুম দিয়েছিলেন। যেন আমি কোন কথা ফাঁস করতে না পারি।” 

বশির এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “দেরি করো না শংকর। এই লোকটা তোমার মেয়েকে কুকুরের মত গুলি করে মেরেছে। দেরি কর না।” 

ট্রিগারের ওপরে চেপে বসা শংকরের নখগুলো সাদা হতে শুরু করল।

ফিরোজের ভেতরে বিন্দুমাত্র উত্তেজনা নেই। তিনি বললেন, “শংকর আমার কথা শোন। তোমার কাছে প্রমাণ আছে শংকর? বশির তোমাকে কোন প্রমাণ দিয়েছে? আমি তোমাকে হত্যার হুকুম দেইনি। বশিরই আমাকে বলেছিল তুমি পালানোর সময় পাহাড় থেকে পড়ে মারা গিয়েছ। 

শংকর একটা আর্ত চিৎকার দিল। কি করবে বুঝতে পারছেনা সে। যেকোন মুহূর্তে ট্রিগার চেপে দেবে সে। 

বশির বললেন, “এই মানুষটাকে ছেড়ে দিও না শংকর। যে বাচ্চা একটা মেয়েকে গুলি করে মারতে পারে সে মানুষ না।” 

ফিরোজ বললেন, “শংকর, তোমার পরিবারের কাছে যাওয়ার একমাত্র উপায় আমি। আই এম দ্য অনলি অপশন। তুমি নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরে পুলিশি হয়রানি থেকে বাঁচাতে আমিই ওদেরকে……..”

ফিরোজের কথা শেষ হল না। গুলি চলল। বিকট শব্দে কেঁপে উঠল হল ঘর। ফিরোজ ছিটকে পড়লেন মেঝেতে। শংকর ট্রিগারে আঙুল চেপে মূর্তির মত বসে থাকলেন। গুলি শংকর চালায়নি। গুলি চলেছে ছায়ার ভেতর থেকে। গুলি চালিয়েছে অন্য কেউ 

অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই সবার দিকে পিস্তল তাক করল। এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে আরও একটা গুলি চলল। বিকাশের আর্তনাদ শোনা গেল অন্ধকারে। বশির মেরিলিনাকে কাছে টেনে নিলেন। চিৎকার করে বললেন, “কেউ গুলি চালাবে না। অন্ধকারে কেউ গুলি চালাবে না।” 

গুলি চলল। 

বশির মেরিলিনার ঘামে ভেজা হাত ধরে হলরুমের চেয়ারগুলোর আড়ালে গিয়ে লুকালেন। অনবরত গুলি চলছে। কে কাকে গুলি করছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। 

অন্ধকারের ভেতর থেকে কিছুক্ষণ পর পর গুলি চলতে শুরু করল। কে গুলি করছে বোঝা যাচ্ছে না। মেরিলিনা কান বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। হলঘরে গুলির শব্দ তার কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। সে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোতে শুরু করল। হঠাৎ একটা হাত মেরিলিনার পিঠে এসে পড়তেই মেরিলিনা চিৎকার করে পেছনে ঘুরল। 

হঠাৎ হ্যান্ডমাইকে একটা কণ্ঠ বলে উঠল, “এলিট ফোর্স। কেউ নড়বে না। এলিট ফোর্স। অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য দায়ী হবে না কেউ। অস্ত্র ফেলে দিতে বলা হচ্ছে। অস্ত্র ফেলে দিতে বলা হচ্ছে। আবার বলছি অস্ত্র ফেলে দিতে বলা হচ্ছে।” 

টিয়ার শেল গড়িয়ে পড়ল হলঘরের ভেতরে। 

বশির জামান মেরিলিনার হাত ধরে হলরুমের পেছন দিকে যেতে শুরু করলেন। গোলাগুলির শব্দে মেরিলিনার কানে তালা লেগে গিয়েছে। মেরিলিনা একবার চিৎকার করে বলল, “বাবা।” 

বশির জামান শুনতে পেলেন না। একরকম টেনে মেরিলিনাকে নিয়ে অন্ধকারের দিকে যেতে থাকলেন। 

সারি সারি মৃত্যুদূত প্রবেশ করতে শুরু করল হল ঘরে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র গর্জে উঠল। 

বশির জামান একটা ছোট দরজা খুললেন।”তাড়াতাড়ি মেরিলিনা। তাড়াতাড়ি।” মেরিলিনার হাত ধরে দরজার দিকে টানতে লাগলেন বশির জামান। মেরিলিনা হাঁচড়ে পাঁচড়ে ছোট দরজাটা দিয়ে বের হল। একটা দমকা শীতল বাতাস এসে ধাক্কা মারল তার মুখে। মেরিলিনা দরজার কপাট খামচে ধরল। 

এই দরজাটা সোজা একটা কার্ণিশে গিয়ে পড়েছে! 

বশির বললেন, “কিচ্ছু হবে না। কার্ণিশ বেয়ে আমরা নিচতলায় নেমে যেতে পারব। ভরসা রাখ মেরিলিনা। যাও”। 

***

পেছনে সারিবদ্ধ বুটের আওয়াজ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। 

মেরিলিনা একবার নিচে তাকানোর চেষ্টা করল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই বোঝা গেল না। বশির এক রকম ধাক্কা দিয়েই মেরিলিনাকে কার্ণিশে দিকে ঠেকে দিলেন। তারপর নিজে কার্ণিশের ওপরে নামলেন। 

মেরিলিনা কার্ণিশের ওপরে পা বুলিয়ে বুঝতে পারল, কার্ণিশটা সে যতটা ছোট মনে করেছিল, ততটা ছোট না। তাও সে ঝুঁকি নিল না। দেয়ালের সাথে একেবারে মিশে দাঁড়িয়ে থাকল। 

বশির জামান দ্রুত হাতে ছোট দরজাটা বন্ধ করতে গেলেন। 

এরপর যেটা হল, তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। না মেরিলিনা, না বশির জামান। দরজার ভেতরের অন্ধকার থেকে একটা হাত সপাটে বশির জামানের চোয়াল বরাবর ঘুষি চালালো। 

বশির জামান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কার্ণিশের ওপরে পড়ে গেলেন। অন্ধকারে কি হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই আরেকটা ঘুষি এসে পড়ল তার সোলার প্লেক্সাসে। বুকের ভেতর থেকে সব বাতাস বেরিয়ে গেল বশির জামানের। পেছনে ছিটকে একেবারে কার্ণিশের কিনারে গিয়ে পড়লেন তিনি। 

মেরিলিনা দেখল একটা ছায়া তার দিকে এগিয়ে আসছে। মেরিলিনা চিৎকার দিতে গেল। ছায়াটা মেরিলিনার কাঁধ খামচে ধরে বলল, “মেরিলিনা, মেরিলিনা আমি খাইরুল। ঠিক আছ?” 

মেরিলিনার এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করতে কষ্ট হল যে এই ছায়ামুর্তিটাই খাইরুল। অন্ধকারে মেরিলিনা মাথা নাড়ল। তার গলা গিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। অন্ধকারে কেউই কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। শুধু বেয়াড়া গতিতে স্পন্দিত হতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা জানিয়ে দিচ্ছে যে দুজনেই এখনও বেঁচে আছে। 

বশির জামান হোলস্টারে হাত দিলেন তার রোগার আলাস্কানটার জন্য। নেই। পড়ে গিয়েছে। দ্রুত কিন্তু খুব সাবধানে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আর কয়েক ইঞ্চি দূরে ছিটকে পড়লেই নির্ঘাত মৃত্যু হত। তিনি অন্ধকারে ছায়ামুর্তিটাকে অনুমান করে একটা লাথি চালালেন। 

লাথিটা গিয়ে লাগল খাইরুলের বাম দিকের কোমরে। অকস্মাৎ আক্রমণে খাইরুল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। ছিটকে পড়লেন কার্নিশের কিনারে। দুই হাতে কোন রকমে কার্নিশের কিনারা খামচে ধরলেন। 

“না!” মেরিলিনা চিৎকার করে উঠল। 

অন্ধকারে দৃষ্টি সহ্য হয়ে গিয়েছে অনেকটা। বশির পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে খাইরুল কার্নিশ ধরে ঝুলে আছে। নিচে পড়লেই মৃত্যু। বুক ভরে শ্বাস নিলেন তিনি। জুতা দিয়ে হাতদুটোয় পাড়া দিলেই খেলা শেষ। কিন্তু তার আগে জানতে হবে কে এই লোক? 

হু হু করে বাতাস বয়ে গেল। বশির জামান বললেন, “কে তুই?”

খাইরুল প্রাণপণে অভিকর্ষ বলের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বললেন, “যেই হই, মেরিলিনাকে বাঁচানোর জন্য আমি যথেষ্ট।” 

“মেরিলিনাকে বাঁচাতে এসেছ মানে?” 

“আপনি মেরিলিনাকে নিয়ে পালাচ্ছিলেন কেন?” 

“মেরিলিনাকে নিয়ে পালাচ্ছিলাম, কারণ ওকে আমি বাঁচাতে চাই। আমি চাই না ওর কোন ক্ষতি হোক। ও আমার মেয়ে।” 

খাইরুল এই কঠিন পরিস্থিতিতেও বজ্রাহতের মত তার হাতের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। এই সেই লোক যার জন্য মেরিলিনা এই দেশে এসেছে! 

“না!” অন্ধকারে মেরিলিনা চিৎকার করে উঠল। ক্লিচ। আলাস্কান রোগারের সেফটি ক্যাঁচ খোলার শব্দ শোনা গেল। বশির চমকে পেছনে তাকালেন। অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখতে পেলেন, মেরিলিনা তার দিকে আলাস্কান রাগার তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। তার আর মেরিলিনার দুরত্ব ফুট দুয়েক। অপটু হাতের শ্যুটারের রেঞ্জের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। 

“না। এই জানোয়ারটা আমার বাবা না। এই জানোয়ারটা আমার মাকে মেরেছে। এই নোংরা গবেষণা করতে গিয়ে এই জানোয়ারটা আমার মাকে মেরে ফেলেছে। আমি জন্মের পর থেকে নিজের খালাকে মা বলে জেনে এসেছি।” মেরিলিনা চিৎকার করে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল, “বল? বল এগুলো সত্যি না?” 

বশির জামান নীরব। শুধু খাইরুল নিজেকে টেনে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। হাত ফসকে গেলেই সোজা নিচে পড়বেন তিনি। 

মেরিলিনা আবার বলল, “তুমি কেন আমার মাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলে? মেলিসা আমার মা ছিলেন না। কেন আমার খালাকে আমার নিজের মা সাজিয়ে রেখেছিলে বছরের পর বছর?”

বশির জামান বললেন, “ওটা একটা দুর্ঘটনা ছিল মেরিলিনা। তুমি রিভলভারটা আমাকে দাও। আমি সব বুঝিয়ে বলছি। তুমি এভাবে চিৎকার করলে আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে পারব না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ঝামেলা হয়ে যাবে। স্পেশাল ফোর্সের লোকজন চলে আসবে।” 

“তুমি অস্বীকার করতে পারবে? পারবে অস্বীকার করতে যে তুমি আমার সাথে বছরের পর বছর শুধু প্রতারণা করে গিয়েছ? আমার মায়ের সাথে তোমার কোন বিয়ে হয়নি। তুমি শুধু মাত্র তাকে শারীরিকভাবে ব্যবহার করেছ বশির জামান। তারপর তার আপন বোনকে মা সাজিয়ে বছরের পর বছর আমাকে ধোঁকা দিয়েছ।” 

“আমি সেটা ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি মেরিলিনা। তোমার মায়ের মৃত্যু আমাকেও সব সময় অপরাধবোধে ভোগাত। আমি, আমি, আমি আনাতোলিকে ভালোবাসতাম। সত্যি বলছি। আমি আনাতোলিকে ভালোবাসতাম। গবেষণার কাজটা শেষ হয়ে গেলে আমরা বিয়েও করতাম। কিন্তু একটা দুর্ঘটনায় সব ওলটপালট হয়ে গেল। আমি তোমাকে সব বলতাম মেরিলিনা। আমি আনাতোলির থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবেসেছিলাম। এখনও বাসি।” 

“মিথ্যা কথা। অপরাধবোধ থাকলে তুমি কখনওই আমাকে না বলে এখানে চলে আসতে না। আমাকে সব কথা খুলে বলতে। এতদিন লুকিয়ে রাখতে না। ভালোবাসা দিয়ে তুমি আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়েছ বশির জামান। আর আমি আমার মায়ের প্রতিশোধ নিতেই তোমাকে খুঁজেছি। ফিরোজের সাথে থেকেছি কারণ আমি জানতাম সেই একমাত্র লোক যে তোমাকে খুঁজে বের করতে পারবে। 

“ভুলে যেও না আমি তোমার বাবা। রিভলভারটা দাও মেরিলিনা। মাথা ঠাণ্ডা কর। তুমি এগুলো কিভাবে জানলে?” 

“তুমি চলে আসার পরে খালামনি সুইসাইড করেছে। তার সুইসাইড নোটে সব কিছু লেখা ছিল, সব কিছু। তোমার জন্য সে বছরের পর বছর হতাশার যন্ত্রণা ভোগ করে সুইসাইড করেছে সে। একটা খুনির কাছে নিজের বোনের মেয়েকে বড় হতে দেখার মত অভিশাপ আর একটাও নেই। তুমি একটা খুনি। হ্যাঁ, তুমি একটা খুনি।” 

খাইরুল প্রাণপণে দুই পা দিয়ে নিচের একটা জানালার গ্রিলে পা বাঁধানোর চেষ্টা করছিলেন। দুই হাতের শক্তি খুব দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। অবশ হয়ে আসছে। আর কিছুক্ষন। তারপরে এই হাত দুটো তাকে আর কোন সাহায্য করতে পারবে না। 

বশির এক পা সামনে এগোতে গেলেন। মেরিলিনা বলল, “এগোনোর চেষ্টা করবে না। একদম না। তুমি আমাকে মারতে পারবে না বশির। আমি অনেক আগেই মরে গিয়েছি। সুইসাইড নোটটা থেকে আসল সত্যিটা জানার পরেই আমি মরে গিয়েছি।” 

বশির এক পা বাড়িয়ে বললেন, “মেরিলিনা, জানি না তুমি কি পড়ে……”

রোগার আলাস্কানটা গর্জে উঠল। বশির জামানের শরীরটা কার্নিশ থেকে ছিটকে নিচের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। অস্ফুট গাছপালার ডাল ভাঙ্গার শব্দ হল। একটা ভোঁতা শব্দ। তারপরই সব নিশ্চুপ। অন্ধকারে ঝট পট করে পাখা ঝাপটে উড়ে গেল কয়েকটা বাদুড়। 

মেরিলিনা রোগারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কোন রকমে টেনে তুলল খাইরুলকে। তারপর তাকে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে বলল, “আপনি ঠিক আছেন? দেখি, হাত দেখি।” 

খাইরুল তখনও বুঝতে পারছেন না কি হচ্ছে। হাত দুটোতে কোন অনুভূতি নেই। কোমরের কাছে অসহ্য যন্ত্রণা। এর মধ্যেও খাইরুল অবাক হয়ে ভাবছেন, যেই মানুষটার খোঁজে দেশে এসেছিল সেই মানুষটাকেই অবলীলায় গুলি করে মেরে ফেলল মেয়েটা! অনেকক্ষণ শূন্যে ঝুলে থাকার ফলে খাইরুলের শরীরের নিচের অংশ কাঁপতে শুরু করল। বললেন, “নিজের বাবাকে এভাবে গুলি করলে?” 

মেরিলিনা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমার মা আর বশিরের কখনও বিয়ে হয়নি। ওটা একটা জানোয়ার ছিল।” 

খাইরুল কোন কথা খুঁজে পেলেন না। তারপর হঠাৎ স্পেশাল ফোর্সের কথা মনে পড়ল তার। তিনি বললেন, “মেরিলিনা, এখান থেকে আমাদেরকে বের হতে হবে। গুলির শব্দ এতক্ষণে স্পেশাল ফোর্স শুনে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি।” 

মেরিলিনার কাঁধে ভর দিয়ে খাইরুল উঠে দাঁড়ালেন। মেরিলিনার ঘামে ভেজা হাতটা ধরে কার্নিশ বেয়ে সামনে যেতে লাগলেন। 

মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ উঠল। নরম জ্যোৎস্নার আবছা আলোতে মেরিলিনা একবার খাইরুলকে দেখার চেষ্টা করল। 

পেছনে ছোট দরজাটা খুলে যাওয়ার শব্দ হল। স্পেশাল ফোর্স।

দুইটা ছায়ামুর্তি কার্নিশ বেয়ে আরও দ্রুত নিচের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। 

***

পুরো হলঘরটা পোর্টেবল ফ্লাডলাইটে আলোকিত করা হল। চেয়ারে আর দেয়ালে এলোমেলোভাবে রক্তের দাগ। ফিরোজকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হল নিকটস্থ অ্যাম্বুলেন্সে। এখনও তার নিঃশ্বাস চলছে। বুকের খানিকটা নিচে পাকস্থলীর কাছে গুলিটা লেগেছে। আর ইঞ্চি তিনেক ওপরে গুলিটা লাগলেই হৃৎপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যেত। 

পুরো হলঘর থেকে ছয়টা লাশ বের করা হল। ডঃ বশির জামান, বিকাশ, নিখিল। বাকি তিনজন যুবককে চেনা গেল না। কিন্তু প্রত্যেকেই ছিল অস্ত্রধারী। 

মেরিলিনা, খাইরুল, শংকর আর প্রমিতকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *