এপিঠ ওপিঠ
তরুণ আই-সি-এস্ সুখেন্দু গুপ্ত প্রেমে পড়িয়াছে; তাহার ইস্পাতের ফ্রেমে-আঁটা মজবুত হৃদয় নড়বড়ে হইয়া গিয়াছে।
শুধু প্রেমে পড়িলে দুঃখ ছিল না; কিন্তু এই চিত্তবিকারের সঙ্গে সঙ্গে আর এক উপসর্গ জুটিয়াছে। বিলাতে থাকাকালীন সে ডুবিয়া ডুবিয়া কয়েক ঢোক জল খাইয়াছিল, সেই অনুতাপের জ্বালা আজ তাহার হৃদয় দগ্ধ করিতেছে।
সুখেন্দু ছেলে খারাপ নয়। তবে, মুনীনাঞ্চ মতিভ্রমঃ, অতিবড় সাধু ব্যক্তিরও মাঝে মাঝে পা পিছলাইয়া যায়। বিশেষত বিলাতে পথঘাট একটু বেশি পিছল; তাই সুখেন্দুর পদঙ্খলনকে আমাদের উদার-চক্ষে দেখিতে হইবে। আমাদের একটা বদ্-অভ্যাস আছে, ঐ জাতীয় ক্রটিকে আমরা একটু বড় করিয়া দেখি এবং ক্রমাগত সেইদিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করিতে থাকি। যাঁহারা বিলাত ঘুরিয়া আসিয়াছেন তাঁহারা কিন্তু এ বিষয়ে ঢের বেশি সংস্কার-মুক্ত।
যা হোক, সুখেন্দুর মনস্তাপ যে আন্তরিক তাহাতে সন্দেহ নাই। বিলাত হইতে সে গোটা হৃদয় লইয়াই দেশে ফিরিয়াছিল। তারপর তিন বছর কাটিয়াছে; হৃদয় কোনও গোলমাল করে নাই। বাংলাদেশের এক মহকুমায় সগৌরবে রাজত্ব করিতে করিতে অন্য এক মহকুমায় বদলি হওয়া উপলক্ষে কিছুদিনের ছুটি পাইয়া সে কলিকাতায় আসিয়াছিল। এখানে আসিয়াই তাহার হৃদয় হঠাৎ জাঁতিকলে পড়িয়া গিয়াছে।
যুবতীটির নাম এণা; বাংলা সরকারের একজন মহামান্য অফিসারের কন্যা। বয়স কুড়ি হইতে বাইশের মধ্যে— তন্বী, রূপসী, কুহকময়ী— এণা সত্যই অনন্যা। সে গভর্নরের পার্টিতে বল্নাচ নাচিতে পারে, কিন্তু তাহার ব্যবহারে কোথাও প্রগল্ভতার ইসারা পর্যন্ত নাই; কথায়-বার্তায় সে পরম নিপুণা, কিন্তু তাহার প্রকৃতিটি বড় মোলায়েম; সে ইংরেজীতে রসিকতা করিতে পারে, আবার বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের পদাবলী গাহিয়া চিত্তহরণ করিতেও জানে। দর্পণে সে যে- দেহটি দেখিতে পায় তাহা যৌবনের অকলঙ্ক লাবণ্যে ঝলমল, কিন্তু দর্পণে যাহা দেখিতে পাওয়া যায় না সেই অন্তরটি কত নিবিড় রহস্যের জালে ছায়াময় হইয়া আছে তাহা কে অনুমান করিবে?
প্রথম দৃষ্টি-বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গেই সুখেন্দু ঘাড় মুচড়াইয়া পড়িয়াছিল, তাহার আর কোনও আশা ছিল না। ওদিকে অপর পক্ষও একেবারে অনাহত অবস্থায় আত্মরক্ষা করিতে পারে নাই। সুখেন্দু অতি সুপুরুষ এবং অত্যন্ত স্মার্ট্; কোনও দিক দিয়াই তাহার যোগ্যতায় এতটুকু খুঁত ছিল না। তাই অন্তরের গহন বনে এণাও বিলক্ষণ ঘা খাইয়াছিল।
তারপর আলাপ যত ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিতে লাগিল, দু’জনের মধ্যে আকর্ষণও তেমনি দুর্নিবার হইয়া উঠিল। মুখের কথা যখন সাধারণ আলোচনায় ব্যাপৃত থাকে, চোখের ভাষা তখন আকাঙ্ক্ষায় তৃষিত হইয়া উঠে। চোখের ভাষা নীরব হইলে কি হইবে, উহা বুঝিতে কাহারও বিলম্ব হয় না। সুখেন্দু দেখিতে পায়, এণার নরম চোখ দুটি মিনতিভরা উৎকণ্ঠায় তাহার স্বীকারোক্তির প্রতীক্ষা করিয়া আছে; এণা দেখে, সুখেন্দুর ঠোঁটের কাছে কথাগুলি কঁপিতেছে, কিন্তু তাহারা আবেগের বাঁধনহারা প্লাবনে বাহির হইয়া আসে না। লগ্নভ্রষ্ট হইয়া যায়। সুখেন্দু বিরসমুখে অন্য কথা পাড়ে।
এইভাবে কয়েকটা অন্তৰ্গূঢ় অগ্নিগর্ভ দিন কাটিয়া গেল, সুখেন্দুর ছুটি ফুরাইয়া আসিল।
আর সময় নাই; দু’দিন পরেই তাহাকে কর্মস্থলে ফিরিয়া যাইতে হইবে। অথচ যে কথাটি বলিবার জন্য তাহার অন্তরাত্মা আকুলি-বিকুলি করিতেছে, তাহা সে কিছুতেই বলিতে পারিতেছে না। তাহার হৃদয় মন্থন করিয়া অনুতাপের হলাহল বাহির হইয়াছে। যতবার সে বলিবার জন্য মুখ খুলিয়াছে ততবার বিবেক আসিয়া তাহার গলা টিপিয়া ধরিয়াছে।
গ্র্যাণ্ড হোটেলে নিজের কক্ষে উদ্ভ্রান্তভাবে পায়চারি করিতে করিতে সুখেন্দু ভাবিতেছিল, ‘কী করি! আমি জানি ও আমাকে চায়— কিন্তু ওকে ঠকাবো? না না, অনাঘ্রাত ফুলের মতো ওর মন, অনাবিদ্ধ রত্নের মতো ওর দেহ। আর আমি! না— কিছুতেই না।’
মন স্থির করিয়া সুখেন্দু চিঠি লিখিতে বসিল। মুখে যাহা ফুটি-ফুটি করিয়াও ফোটে না, কাগজে কলমে তাহা ভালই ফোটে।
‘— আমি তোমাকে ভালবাসি।
‘একথা জানতে তোমার বাকি নেই। আমিও তোমার চোখের নীরব বার্তা পেয়েছি, বুঝতে পেরেছি তোমার মন। কিন্তু তবু মুখ ফুটে তোমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করতে পারিনি। আমার অপরাধী মন কুণ্ঠায় নীরব থেকেছে।
‘তোমাকে আমি ঠকাতে পারব না। যা কোনও দিন কারুর কাছে স্বীকার করিনি, আজ তোমাকে জানাচ্ছি। বিলেতে যখন ছিলুম, তখন একেবারে নিষ্কলঙ্ক জীবন যাপন করতে পারিনি। কিন্তু তখন তো তোমাকে চিনতুম না। ভাবিও নি যে তোমার দেখা পাব।
‘ক্ষমা করতে পারবে না কি? শুনেছি ভালবাসা সব অপরাধ ক্ষমা করতে পারে। যদি ক্ষমা করতে পারো, চিঠির জবাব দিও। যদি না পারো— বিদায়। আমার হৃদয় চিরদিন তোমারই থাকবে।’
চিঠি ডাকে পাঠাইয়া দিয়া সুখেন্দু হোটেলেই বসিয়া রহিল; সেদিন আর কোথাও বাহির হইতে পারিল না।
পরদিন বিকালে চিঠির উত্তর আসিল।
‘— তুমি এসো— শীগ্গির এসো। দু’দিন তোমাকে দেখিনি।
‘তুমি তোমার মনের গোপন কথা বলতে পেরেছ— তাতে আমারও মনের রুদ্ধ কবাট আজ খুলে গেছে। আজ আর আমার লজ্জা নেই; নিজের মন দিয়ে বুঝেছি, ভালবাসা সব অপরাধ ক্ষমা করতে পারে।
‘আমিও জীবনে একবার ভুল করেছি। কিন্তু আজ তা মনে হচ্ছে কোন্ জন্মান্তরের দুঃস্বপ্ন।
‘তুমি লিখেছ তুমি আমাকে ঠকাতে পারবে না। আমিও পারলুম কই? আর ক্ষমা! তুমি এসো— তখন ক্ষমার কথা হবে।’
উষ্ণ নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে মেল ট্রেন রাত্রির অন্ধকারে ছুটিয়া চলিয়াছে।
একটি প্রথম শ্রেণীর কামরায় সুখেন্দু নিজের বাঙ্কে শুইয়া একদৃষ্টে আলোর পানে তাকাইয়া আছে; নির্বাপিত পাইপটা ঠোঁটের কোণ হইতে ঝুলিতেছে।
গভীর রাত্রি; কামরায় আর কেহ নাই।
সুখেন্দু পাইপটা বালিশের তলায় রাখিয়া সুইচ্ টিপিয়া আলো নিবাইয়া দিল। তারপর যেন অন্ধকারকে উদ্দেশ করিয়াই বলিল, ‘বাপ্! খুব বেঁচে গেছি!’
৬ শ্রাবণ ১৩৫১