এডোয়ার্ড জেমস করবেট : পরিচিতি
এক
এডোয়ার্ড জেমস করবেট বা জিম করবেট, ১৮৭৫ সালের ২৫শে জুলাই নৈনিতালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম ক্রিস্টোফার গার্নি, মায়ের নাম মেরী জেন। ওঁদের প্রথম সন্তান টমাস; দ্বিতীয় ও তৃতীয় সন্তান মেয়ে— তৃতীয় সন্তানের নাম মার্গারেট বা ম্যাগি; চতুর্থ জেমস বা জিম; পঞ্চম আরেকটি ছেলে। দাদা টমের নাম ‘জাঙ্গল লোর’ ও ‘মাই ইন্ডিয়া’য় দেখা যাবে। ম্যাগির উল্লেখ সব বইয়েই আছে। সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের নাম ‘ম্যানইটার্স অফ কুমায়ুন’ (১৯৪৬) বইয়ের ‘রবিন’ লেখায় আছে।
করবেটের বাবা ছিলেন আইরিশ। তিনি নৈনিতালে পোস্টমাস্টার ছিলেন। করবেটের চার বছর বয়সে বাবা মারা যান। টম নৈনিতালের পোস্টাপিসে চাকরি পান। তিনিই পরিবারের অভিভাবক হন। ওঁদের বাড়ি নৈনিতালের আয়ার পাটায়, বাড়ির নাম ‘গার্নি হাউস’। করবেটের লেখা থেকে জানা যায় টম তাঁকে শিকারে প্রথম উৎসাহ দেন। নৈনিতালের স্কুলে করবেট বন্দুক চালনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন।
নৈনিতাল ছিল করবেট পরিবারের গ্রীষ্মাবাস। করবেট লিখেছেন নৈনিতাল হ্রদের (তাল : হ্রদ) পাশের নৈনি দেবীর মন্দিরের চার মাইলের মধ্যে তিনি অন্যান্য প্রাণী সহ বাঘ, চিতা, ভাল্লুক ও সম্বর দেখেছেন এবং ওই একই জায়গায় একশো আটাশ জাতের পাখি চিনতে পেরেছেন। করবেট পরিবারের শীতাবাস নৈনিতাল থেকে পনের মাইল দূরে কালাধুঙ্গি নামক গ্রাম সমষ্টির অন্তর্গত ছোটি হলদোয়ানি নামক গ্রামে, তবে করবেট জায়গাটিকে বারবার কালাধুঙ্গি বলেই উল্লেখ করেছেন। করবেটের জীবনের প্রথম দিকটি যে জায়গায় ও পরিবেশে, যাদের মধ্যে কেটেছিল, সে পরিচয় পাবার জন্যে আগ্রহী পাঠক ‘আমার ভারত’ (১৯৫২) ও ‘জাঙ্গল লোর’ (১৯৫৩) পড়ে দেখতে পারেন। ১৯৬৪ সালে বালকৃষ্ণ শেষাদ্রি কালাধুঙ্গিতে করবেটের বাড়িটি দেখতে যান। তখন বাড়িটি জরাজীর্ণ, কামরার জানালাগুলি বন্ধ। দেওয়াল থেকে আস্তর খসে পড়ছে। শেষাদ্রিকে একজন গ্রামীণ বলেছিলেন, বাড়িটির নতুন মালিক শহরে থাকেন, বাড়িটি এক তত্ত্বাবধায়কের হেফাজতে আছে। বাড়ির হাতা গ্রামবাসীরাই পরিচ্ছন্ন রাখেন। ১৯৬৫ সালে ইন্ডিয়ান বোর্ড অফ ওয়াইল্ড লাইফের এক অধিবেশনে উত্তরপ্রদেশ সরকার কালাধুঙ্গির বাড়িটিকে মিউজিয়াম হিসাবে গ্রহণ করে করবেটের স্মৃতিরক্ষা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৯৬৭ সালে উত্তরপ্রদেশ সরকার বাড়িটি নেন ও করবেট মিউজিয়ামের কাজ শুরু করেন। বুনো শুয়োর, হরিণ ও ময়ূরের হাত থেকে গ্রামের ফল বাঁচাবার জন্য করবেট তাঁর সামান্য উপার্জন থেকে ছোটি-হলদোয়ানি গ্রাম ঘিরে তিন মাইলব্যাপী যে পাঁচিল তুলেছিলেন, শেষাদ্রি সেটিও দেখেছিলেন।
ক্রিস্টোফার গার্নির নাগরিক সংজ্ঞা ছিল, ভারতে ‘domiciled Englishman. ‘ জিম করবেটের নাগরিকত্ব অনুরূপই ছিল। ওই সংজ্ঞার জন্যেই জিম করবেট, নৈনিতালের সবচেয়ে গর্বের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজদের সম্মানিত বোটহাউস ক্লাবের সদস্য হতে পারেন নি।
ক্রিস্টোফার গার্নি যখন মারা যান, তখন জিম করবেট নিতান্ত নাবালক। জিম করবেট স্থানীয় স্কুলের পাঠটুকুই সমাপ্ত করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য সময় ও অর্থব্যয় সেদিন সকল শ্বেতাঙ্গেরও সাধ্যে কুলোত না। অত্যন্ত মেধাবী না হলে শ্বেতাঙ্গ ছেলেরা উচ্চশিক্ষার কথা ভাবতেন না। মেধাবী ও উচ্চশ্রেণীর ছেলেরা যেতেন বাছাই করা সরকারী কাজে। এবং করবেট পরিবার খুবই সাধারণ চালচলতির গৃহস্থ ছিলেন। জিম করবেট স্ব-রচনায় নিজের বিষয়ে অত্যন্ত নীরব, সংকুচিত ও নম্র। যে লোক নিজের কথা কিছুই বলে যান নি, যাঁর কথা অন্যরাও বলেন নি, তাঁর বাকিজীবন সম্পর্কে কম কথাই আমরা জানতে পারি। তবে মনে হয় না করবেট উচ্চশিক্ষার কথা আদৌ ভেবেছিলেন। ১৮৯৫ সালে কুড়ি বছর বয়সে করবেট বেঙ্গল অ্যান্ড নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে এক সময় শর্তাধীন কাজে ঢুকে পড়েন। কুড়ি বছর বয়সের মধ্যেই তাঁর স্বভাব ও মানসিক চরিত্র স্থায়ী রূপ নিয়েছিল। কি রকম স্বভাবের এক যুবক মান্কাপুরে কাজ করতে যান? তিনি লাজুক, স্বল্পভাষী, কঠোর পরিশ্রমী। স্বল্পভাষিতার অন্যতম কারণ হল, ছোটবেলা থেকেই দাদা টম ও চোরাশিকারী কুনওয়ার সিংয়ের নির্দেশে নিজের কৌতূহলেও বটে, তিনি জঙ্গলে ঘুরেছেন। একটি গাদাবন্দুক ভরসা করে দশ বছর বয়স থেকে জঙ্গলে একা রাতও কাটিয়েছেন। জঙ্গল ও জঙ্গলের বাসিন্দাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে, তাদের পরিচয় লাভেই তাঁর আনন্দ, সেই উদ্দেশ্যেই জঙ্গলে ঘোরাঘুরি। আর, আরণ্যজীবনে প্রবেশাধিকারের প্রথম অলিখিত শর্তই হল একেবারে নির্বাক নিঃশব্দ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতে জানা। জঙ্গলের বাসিন্দাদের নিজস্ব ভাষা ও চালচলন আছে। গাছের পাতা পড়ার শব্দ, বাঘের শরীরের চাপে নুয়ে পড়া ঘাস সোজা হবার ভঙ্গি, বনের রাজার খবর জানতে বানর ও পাখির কিচিরমিচির ঠাহর করে শোনা, এ সব বুঝতে-দেখতে-জানতে হলে যত ধীর, নীরব ও ইস্পাত-নজর হতে হয়, করবেট তা হয়েছিলেন। তাই তিনি কোনো দিনই গল্পে, কথাকইয়ে মানুষ হতে পারেন নি। খুবই লাজুক ছিলেন সেই বিশ বছরের যুবক। শুধু নিজের পরিবার, পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কয়জন, আর কালাধুঙ্গি গ্রামের মানুষদের নিয়ে তাঁর সমাজ। আবাল্য সঙ্গী ইবটসনও তাঁরই মত জঙ্গলে মানুষ, জঙ্গলের চালচতিতে পাকাদখল, ভারতীয় সমাজে, বিশেষ গ্রামসমাজে করবেট খুব সহজ। বাইরে, খুব অন্তরঙ্গ মহলের বাইরে তেমন নন। আর সততা, সকর্ম, কর্তব্যপরায়ণতা তাঁর সহজাতও বটে, গ্রামসমাজে থেকেও আবাল্য তাই শিখেছেন। তাই সময় শর্তাধীন কাজ শেষ হলে যে টাকা বেঁচেছিল তা নিজে তো নেনই নি, ফেরত দেবেন কি বলে তাই ভেবে তাঁর চোখের ঘুম ছুটে গিয়েছিল। তখনি যে জন্য জিম করবেট, কুমায়ুন – গাড়োয়ালের গ্রামসমাজের ঘরের মানুষ, তাদের ‘শ্বেতাঙ্গ সাধু’ সে স্বভাব তাঁর রক্তে বসে গিয়েছিল। তখনি তিনি এমন মানুষ, যে শুধু নিঃস্বার্থে ভালবাসতে, পরের জন্যে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে জানে। যে সমালোচনা করতে বা তিক্ত হতে জানে না। খুব সাধারণ অবস্থার দরিদ্র মানুষ হয়েও যে জীবনের অন্ধকার দিকটা স্বীকারও করে না, আমলও দেয় না। সত্যিকারের ধার্মিক মানুষ বলতে আমরা যদি সর্বজীবে দয়া, সকলকে ক্ষমা, সকলের প্রতি মমতা, এই সব গুণ সংবলিত মানুষের কথা ভাবি, তবে করবেট সেই বৃহত্তর, মানবিক অর্থে ধার্মিক মানুষ ছিলেন। কুমায়ুনী গাড়োয়ালীরা তাঁকে প্রভুর জাতের প্রতিভূ ভাবতেন না, ‘সাদা সাধু’ বলে গোঁড়া ব্রাহ্মণ-পূজারীদের মেয়েরা তাঁর এঁটো বাসন ধুয়ে দিতেন। করবেটের জীবনের এই সব সময়ের কথা ‘মাই ইন্ডিয়া’ বইয়ে খুব বিস্তারিত লেখা আছে।
মাকাপুরের সময়-শর্তাধীন কাজটি খুবই পরিশ্রমের আবার করবেটের মনোমতও বটে। ট্রেনের বাষ্পীয় এঞ্জিন চালাতে তখনো কয়লা ব্যাপক ব্যবহার হয় না। এঞ্জিনের বয়লারে কাঠও জ্বালানো হয়। মান্কাপুরে তখন প্রচুর জঙ্গল। করবেটের কাজ ছিল জঙ্গলে গাছ কাটানো, একটি বিশেষ মাপে সে কাঠ টুকরো করে কাটিয়ে থাকবন্দী করে চালান দেওয়া। এই কাজ করার সময়েই তাঁর জঙ্গলের তাঁবুতে একটি হরিণ ছানা ও একটি অজগর আশ্রয় নেয়। একই তাঁবুতে খাদ্য-খাদক ও করবেট ঘুমোতেন। কোনো অপ্রীতিকর কাণ্ড ঘটে নি। আরণ্যপ্রাণী যে মানুষের চেয়ে সহাবস্থানে বিশ্বাসী, এই প্রসঙ্গটিই তার প্রমাণ।
সময় ফুরোতে কাজ ফুরোল। এঞ্জিনের বাষ্পশক্তি যোগাতে থাকল খনিজ কয়লা। করবেট বাড়তি টাকা আপিসে জমা দিয়ে এলেন। কিছু বলতেই পারলেন না খোলসা করে, কথা আটকে গেল। তবে কর্মকর্তারা তার-সততায় মুগ্ধ হয়েছিলেন নিশ্চয়ই।
দেখা যাচ্ছে তারপরও বছরখানেক করবেট ওই রেলওয়েতেই নানা জাতের কাজ করেছেন। এঞ্জিনের ফুটপ্লেটে দাঁড়িয়ে কত কয়লা পুড়ছে সে খবর নিয়ে কর্তৃপক্ষকে দেওয়ার কাজটি খুব পছন্দসই ছিল তাঁর, কেননা তখন এঞ্জিন চালাতে পেতেন। মালগাড়ির গার্ড, সহকারী গুদামরক্ষক, সহকারী স্টেশনমাস্টার, নানারকম কাজই করেন এই সময়ে।
তারপরই মোকামাঘাটে তিনি ব্রডগেজ থেকে মিটার গেজে মাল চালান দেবার কন্ট্রাক্টের কাজ পেলেন। মনে রাখতে হবে তখন রেলদপ্তর সম্পূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত ছিল না। বহু ব্রিটিশ ফার্ম বিভিন্ন রেলপথের মালিক ছিলেন এবং সংশ্লিষ্ট কাজে কন্ট্রাক্টর নিয়োগ করা হত। সে কাজে করবেট একেবারেই নতুন। কিন্তু শ্রমিক দল রংরুট করে তিনি অসীম যোগ্যতায় কাজ চালান। মোকামাঘাটের জীবনের বিশদ বিবরণী ‘মাই ইন্ডিয়া’ বইয়ে আছে। এই কাজের সামান্য রোজগার থেকেই তিনি ছোটি-হলুদোয়ানি গ্রাম-ঘেরাও করে এক পাঁচিল তোলেন বহু বছর ধরে, একটু একটু করে। এই টাকা থেকেই তিনি গ্রামের সকল অধিবাসীদের দেয় খাজনার টাকা দিয়ে চলতেন। মোকামাঘাটে তার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে পরিচয় হয়। কুমায়ুন-গাড়োয়ালের মানুষ অরণ্য ও কৃষিনির্ভর। এরা রেলশ্রমিক, যদিচ দেশে সামান্য ক্ষেতগৃহস্থী অনেকেরই আছে। করবেট নিজের কথা কমই বলেছেন। তবু মোকামাঘাটের চামারি, বুধুয়া ও বিদেশী লালাজীর কথা তিনি বলেছেন। চামারি জাতিতে অন্ত্যজ। কিন্তু করবেটের চেষ্টায় সে খুব দায়িত্বপূর্ণ কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠায় করেছিল এবং করবেটের সকল মানবসেবার কাজে ডান হাত ছিল। বুধুয়ার জীবন আজকের সমাজবিজ্ঞানীর কাছেও আকর্ষণীয় বোধ হবে। কেননা সে ছিল মহাজনের শিকার, ‘বেঠবেগারী’ প্রথার যন্ত্রে পিষ্ট অন্যতম এক দরিদ্র ভারতীয় গ্রামীণ। করবেট তাকে মহাজনের গ্রাস থেকে উদ্ধার করেন। আর লালাজীর প্রসঙ্গটি করবেটকে বোঝার পক্ষে সবচেয়ে ভাল চাবিকাঠি। লালাজী বিদেশী, অচেনা। তাঁকে করবেট কলেরার গ্রাস থেকে বাঁচান, বাড়িতে রাখেন, নিজের সমস্ত সঞ্চয় নিঃশেষ করে তাঁকে পাঁচশো টাকা দেন। কোন বিশ্বাসে দেন? ভারতীয়রা কখনো ঠকায় না, এই বিশ্বাসে। সময়ে সে টাকা তিনি ঠিকই ফেরত পেয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে যে জিম করবেটকে এইভাবে চেনা যাচ্ছে, তিনি টাকা না পেলেও সমগ্র মানবজাতির ওপর বিশ্বাস হারাতেন না। মাথায় বেল পড়লেও কোনো কোনো ন্যাড়া বেলতলাতেই যায় বারবার। জিম করবেট সেই জাতের মানুষ ছিলেন। এ রকম মানুষ ভারতের মাটিতেই হওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি। নিশ্চয়ই সকল ভারতীয় এ রকম নন। আর আজকাল মূল্যনিরূপণের যে মাপকাঠি তাতে জিম করবেট একান্তই বরবাদী বলে গণ্য হবেন। তবু এই রকম মানুষদের জন্যই ‘মানুষ’ শব্দটি যা-কিছু সম্মান ও শ্রদ্ধা পেয়ে থাকে। এই মোকামাঘাটের কাজ করতে করতেই তিনি কুমায়ুন ও গাড়োয়ালের মানুষখেকো বাঘ শিকার শুরু করেন।
এই তো কর্মজীবন। ব্যক্তিজীবন কি রকম ছিল? এখানেই জিম করবেট নামক আইডিয়াকে শক্ত হাতে চেপে ধরতে গেলে ভদ্রলোক পারার মতো পিছলে বেরিয়ে যায়। যে জিম করবেট বাল্যের সুহৃদ ও অরণ্য পাঠের গুরু কুনওয়ার সিংকে আপিমের নেশাজনিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচান। রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতাকে মারেন, মোকামাঘাটে মাল খালাস করেন। তাঁরা তিনজন জিম করবেট বলতে পারলে আমার কাজ সহজ হত। আধুনিক মানসের কাছেও তিনি বোধ্য হতেন। কিন্তু করবেট এমনই সৃষ্টিছাড়া মানুষ, যে জটিল ও বহুসত্তাধারী হতে তিনি জানতেনই না। অতএব তাঁর প্রত্যেকটি জীবনই অপর প্রত্যেক জীবনের পরিপূরক। মানুষটি একই রকম স্বল্পভাষী, সংযত, নম্র ও নিরীহ থাকেন, যখন তিনি মোকামাঘাটে মাল খালাস করেন। অথবা শত শত মাইল হেঁটে রুদ্রপ্রয়াগের চিতাকে একদিন একটি গুলিতে মারেন, কোনো নরখাদক বাঘ মারার পর বিশ্রাম না করে চল্লিশ, পঞ্চাশ বা সত্তর মাইল পথ হেঁটে বাড়ি ফেরেন নৈনিতালে, অথবা, যে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে, অরণ্য ও আরণ্যপ্রাণী বাঁচাবার জন্যে প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেন, কিংবা বড়বোনের সঙ্গে গ্রামের বাংলোর বারান্দায় বসে গ্রামীণ মানুষদের ওষুধ-পথ্য-সুশ্রুষার ব্যবস্থা করেন। সব সময়েই ভাবখানা হচ্ছে, কোনো কৃতিত্বই তাঁর নয়, সব কৃতিত্বের দাবীই অন্যদের। তাঁর ভাগে তবু যে সম্মান, প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জুটছে সেজন্য তিনি অতিশয় লজ্জিত। প্রশংসা না পাবার জন্য করবেটের চেষ্টার অন্ত নেই। মোহনের মানুষখেকো বাঘ বহুজনকে মেরেছে, এবং বেঁচে থাকলে আরো মানুষ মারত, সেইজন্যেই তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় মারার জন্য আত্মপক্ষে তিনি কিছু যুক্তি খুঁজে পান। অন্যথায় এবংবিধ কাপুরুষী কাজের জন্য তিনি খুবই লজ্জিত। অন্যান্য নরখাদক বাঘ ও চিতা মারার পর তিনি প্রায়ই যুক্তি দিয়ে বোঝান, দেখ, এই এই ব্যাপারগুলো যথাযথ ঘটেছিল বলেই জানোয়ারটা মারা পড়ল। তিনি ‘যদি একা ঝোপের সামনে অন্ধকারে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রুদ্রপ্রয়াগের চিতার জন্য অপেক্ষা করেন, সেটা কোনো সাহসের কাজ নয়। কিন্তু দূর থেকে ঘরের দরজা খুলে তাঁর কোনো অনুচর যদি হেঁকে তাঁকে ডাকে, তার সাহসের প্রশংসায় করবেট মুক্ত কণ্ঠ। সবচেয়ে মজার কথা হল, করবেট কোন কোন সময়ে যে জানোয়ারকে শিকার করলেন, তার দিক থেকে মানুষ মারার ব্যাপারটি ব্যাখা করতে থাকেন। প্রায় প্রতিটি বাঘ বা চিতা মারার পর তিনি বলেন, চামড়া ছাড়াতে গিয়ে গুলির ঘায়ে পুরনো জখম অথবা মাংসে বেঁধা শজারুর কাঁটা দেখা গেল। এই জন্যেই ও মানুষ খেতে শুরু করে। রুদ্রপ্রয়াগের চিতার বেলায় তিনি তাকে মারেন। কিন্তু অত্যন্ত মানবিকভাবে বলেন, সামনে শায়িত মৃত জানোয়ারটি দানো বা পিশাচ নয়। প্রকৃতির আইনও সে ভাঙে নি। তার একমাত্র দোষ, সে মানুষ মেরেছিল, মানুষের আরোপিত আইন ভেঙেছিল। করবেটের চরিত্রের মানবিকতা যে কত অখণ্ড, সম্পূর্ণ, তাঁর ব্যক্তিত্ব যে কত সমগ্র ভাবে মানবিক, এতেই তা বোঝা যায়।
কিন্তু কি রকম ছিল তাঁর জীবন? ১৯০৭ থেকে ১৯৩৮ অবধি তিনি বারবার মানুষখেকো শ্বাপদ মারতে যান, সে সব বই পড়েই জানা গেছে। হ্যাঁ, তিনি মোকামাঘাটে মালও খালাস করেন। কিন্তু মধ্যবর্তী সময় কি করেন?
মজা হল, নাটকীয় কিছুই করেন না। নাটকীয়, ব্যক্তিজীবনকে প্রভাবকারী কোনো ঘটনা ঘটে কি না আমরা জানতে পারব না। কেন না করবেট নাটক বা রোমাঞ্চ খুঁজে পান অন্যত্র। হিমালয়ের তুষারগলা নদীতে মহাশোল মাছ ধরতে গিয়ে জেন ইবটসন উলটে জলে পড়ে গেলে একটা হাসির ঘটনা ঘটে। বড় বাজ যখন পেঁচা ধরতে গিয়ে বিফল হয় তখন অত্যন্ত নাটকীয় উত্তেজনার সঞ্চার হয়। আর কোনো শিশিরভেজা হেমন্তের সকালে প্রিয় কুকুর রবিন কোনো চিতার হদিশ পেলে সে খুবই উত্তেজনার ব্যাপার। আমাদের কাছে তাঁর একেকটি নরখাদক শিকার চরম নাটকীয় উত্তেজনা ও রোমাঞ্চের ব্যাপার, কিন্তু করবেটের কাছে তা অবশ্য কর্তব্য এক কাজ মাত্র, এবং কাজটি শেষ হলেই তিনি প্রচুর দুধ ও গুড়ে সিদ্ধ চা এবং প্রাণদায়ী সিগারেটের ধোঁয়া পান করতে পারেন। করবেট রোমাঞ্চ ও আনন্দ পান নীরবে জঙ্গলে হেঁটে, জঙ্গলের পুঁথির কথা বারবার গ্রহণ করেন, অরণ্যপ্রাণীর স্বভাব ও আচার আচরণ লক্ষ করেন, শিকারের চেয়ে অনেক আনন্দ পান তিনি চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে বাঘের ছবি তুলে।
এই তো করবেট। কি ঘটে তাঁর জীবনে? ১৯৩৮ সালে তিনি থাকের মানুষখেকো বাঘিনী মারেন। তাঁর শেষ নরখাদক শিকার। ১৯৪৭ সালে ভারত ছেড়ে আফ্রিকা যান। অন্য সময়ে কি করেন? কাজ যখন করতেন, তখনই বেশি বাঘ বা চিতা মারলেন। যেমন, পানারের চিতা মারার প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমাদের জীবনটা যত সুখেরই হোক না কেন, আসলে কোনো কোনো সময়কে আমরা বিশেষ কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি। ১৯১০ সাল আমার জীবনে তেমনি এক স্মরণীয় সময়। কেননা সে বছরই আমি মুক্তেশ্বরের মানুষখেকো বাঘ এবং পামারের মানুষখেকো চিতাকে মারি। আমার কাছে, এবং মধ্যবর্তী সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, আমি ও আমার সহকর্মীরা যন্ত্রীর সহায়তা ব্যতিরেকেই মোকামাঘাটে একেক দিনে পাঁচ হাজার পাঁচশো টন মাল খালাস করি।’ এ ছাড়া তিনি কি করেন? কিছুই নয়। কাজের ফাঁকে সময় পেলে গ্রীষ্মে নৈনিতাল বা শীতে কালাধুঙ্গি চলে যান। আজীবন সঙ্গিনী বড়দিদি ম্যাগি এবং প্রিয় কুকুর রবিনের সঙ্গে জঙ্গলে ঘোরেন; জঙ্গলের স্বাদ নেন ইন্দ্রিয়ে; পাখির কাকলি-ঝরনার ঝর্ঝর-পাতার মর্মর-হরিণ বা ঘুরাল বা বানরের ডাক— বাঘের গম্ভীর গর্জনের মিশ্র সঙ্গীত শোনেন; বন্দুক হাতে গ্রামবাসীদের খেত পাহারা দেন; মাছ ধরেন—তাঁর অতি প্রিয় নেশা; খাওয়ার জন্যে হরিণ বা পাখি মারেন; কালাধুঙ্গি ও অন্য গ্রামের বাসিন্দাদের জন্য যা পারেন করেন; নৈনিতাল পৌরসভার কাজকর্ম করেন। খুবই দুর্বোধ্য তিনি আমাদের কাছে, কেননা এত সামান্যেই তিনি অসীম আনন্দ পান।
আরো দুর্বোধ্য হয়ে ওঠেন তিনি, যখন জানা যায়, ১৯১৫-১৬ সালেই, যথেষ্ট রোজগার করেছি বিবেচনায় তিনি মোকামাঘাটের কাজ ছেড়ে দেন। তখন তাঁর কত টাকা জমেছিল আমাদের জানতে ইচ্ছে করে বই কি। তখনকার হিসেবেও তা মোটা টাকা হতে পারে না। কেন না করবেট জানতেন কি না সন্দেহ। সম্প্রতি করবেট জমি কেনাবেচার কাজ করেছিলেন বলে যে সংবাদ জানা গেছে সে বিষয়ে সমগ্র তথ্য এখনো আমরা জানতে পাই নি। পরবর্তী সংস্করণে সে তথ্য বিষয়ে আরো জানানো যাবে বলে আশা করি।
তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। কালাধুঙ্গি ও নৈনিতালে পছন্দমত শান্ত জীবন কাটাবেন বলেই তাঁর অবসর গ্রহণ, কিন্তু করবেট যুদ্ধের কাজে যাওয়া কর্তব্য মনে করলেন। জিম করবেট যে ব্রিটিশ সিংহের প্রতি অনুগত ছিলেন, তা নিয়ে মাঝে মাঝে বিরূপ মন্তব্য শুনেছি। কিন্তু তাঁর আনুগত্য শ্বেতাঙ্গের স্বভাবোচিত নয়, নিরীহ গ্রামীণ-স্বভাবের ভারতীয়ের আনুগত্য। করবেট তাঁর রাজানুগত্যের জন্য বহু ভারতীয়ের মত স্বাধীনতাসংগ্রামী ভারতীয়দের বিরুদ্ধতা করে ধনী হন নি একথা যেন আমরা কখনোই ভুলে না যাই।
প্রথম মহাযুদ্ধে তিনি কুমায়ুনী ফৌজ রংরুটে সাহায্য করেন ও একটি লেবার-ইউনিট নিয়ে ফ্রান্সে এবং ওয়াজিরিস্তানে যান। সেবারই তিনি লন্ডনেও গিয়েছিলেন। তাঁর বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলতেন, জিমের কাণ্ড জান? ওয়াটারলু স্টেশনে নেমেছিল হাতে হারিকেন-লন্ঠন ঝুলিয়ে। নেমেই বলেছিল, লন্ডনের ডাকবাংলো কোথায় বলতে পারেন?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর একবার তিনি টাঙ্গানাইকা যান বাড়ি তৈরি করতে বলে লিখেছেন বটে, কিন্তু শেষ জীবনে গিয়েছেলেন কেনিয়ায়। তাই মনে হয় সে বাড়ি তৈরি ও’র হয়ে ওঠে নি। যুদ্ধবিরতির পর করবেট ভারতে ফিরে আসেন এবং যুদ্ধের বোনাসলব্ধ টাকা কুমায়ুনী সৈন্যদের পুনর্বাসন-প্রকল্পে দান করেন। এরপর কালাধুঙ্গিতে ফিরে এসে তিনি সঞ্চয়লব্ধ টাকার অধিকাংশই গ্রামের লোকদের দেয় খাজনা দিয়ে ব্যয় করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ত্যাগের পরও এই বাবদে কালাধুঙ্গিতে তিনি টাকা পাঠাতেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি সমরবিভাগককে স্বেচ্ছায় সহায়তা করতে চান। তখন করবেট কোনো বই লেখেন নি, সাধারণ্যে তাঁর কোনো পরিচিতিও নেই। তবে ওয়াকিবহাল মহল ও শিকারীরা তাঁর নাম জানতেন, জানতেন করবেট মুখ্যত এক অন্যন্য শিকারী। ভারতে অরণ্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে করবেটের ভূমিকার কথা সবাই জানতেন না। জঙ্গলে নিঃশব্দে চলাফেরার কায়দা, জঙ্গল চেনা, এতে তাঁর অসামান্য দক্ষতার কথা সরকারী মহল জানতেন। সেইজন্য, বর্মার জঙ্গলে যুদ্ধের জন্য নির্বাচিত সৈন্যদের অরণ্যে চলাফেরা বিষয়ে প্রশিক্ষাদানের ভার করবেটকে দেওয়া হয়। এই প্রশিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল মধ্যভারতের সামরিক ছাউনি মাউয়ে। সে সময়ে সেখানে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এক প্রাক্তন সামরিক অফিসারের কাছে করবেট বিষয়ে এই স্মৃতিচারণটুকু শুনেছি।
জিম করবেটই যে প্রশিক্ষা দিচ্ছেন, একথা সবাই জানতেন না। করবেট অত্যন্ত আত্মপ্রচার বিমুখ ছিলেন। এই গ্রন্থের অন্যান্য, রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতা শিকারপ্রসঙ্গে সমকালীন সংবাদপত্রের বিবরণীতেও তা বোঝা যাবে। সেনাবিভাগে এক ভারতীয় রাজ্যের যুবরাজ ছিলেন। সবাই তাঁকে ‘প্রিন্স’ বলত। প্রিন্স রাজকীয় শিকারী। ভারতকে যাঁরা বাঘশূন্য করতে চেষ্টা করেছেন, তাঁদের মধ্যে তাঁর বংশের এবং তাঁর ব্যক্তিগত অবদান কিছু কম নয়। স্ব-কৃতিত্ব ও নৈপুণ্য বিষয়ে প্রিন্সের যথেষ্ট গর্ব ছিল। বিকালে সকলে ক্লাব ঘরে মিলিত হতেন এবং খুশগল্প ও আড্ডা চলত।
একদিন, শিকারে অব্যর্থ হতে হলে কি দরকার, নিমেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, না তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, না অব্যর্থ নিশানা, না তিনটি অথবা দুটির যোগফল তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছিল। প্রিন্স বলেন, অব্যর্থ নিশানাই শেষ কথা নয়। বিতর্কে যখন তুফান উঠেছে তখন ছাউনির ভারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ অফিসার বললেন, শোনা যাক, এক্সপার্ট কি বলেন। কর্নেল করবেট, আপনি কি বলেন?
অব্যর্থ নিশানা, রোদেপোড়া, শক্ত চেহারার বলিষ্ঠ এক প্রৌঢ় সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন।
প্রিন্স তা মানবেন কেন? প্রৌঢ় বললেন, ওই দূরের গাছটি দেখ। একটি ‘Y’ আকারের সরু ডালের মাঝের খাঁজে একটি পাখি বসে আছে। ডালটি ভাঙবে না, পাখিটিকে মারতে হবে।
তখন বিকেলের আলো পড়ে আসছে। সব ধোঁয়াটে ধূসর। প্রিন্স বললেন, এ অসম্ভব। নজরই চলে না, পাখি মারব কি করে?
প্রৌঢ় তাঁর গাড়োয়ালী অনুচরের কাছ থেকে রাইফেল নিলেন, তুললেন, গুলি ছুঁড়লেন, বললেন, কেন, এমনি করে? সবাই ছুটে গেলেন। ডালটি অভগ্ন, পাখিটি মৃত। এ কাজ সম্ভব হল কি করে তাই যখন বলছেন সবাই, প্রৌঢ় বললেন, যখন রুদ্রপ্রয়াগের চিতা মারি………
তখন সকলের মাথায় ঢুকল ইনিই জিম করবেট। প্রিন্স তো ঔদ্ধত্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে বাঁচেন না।
এরপরেই করবেটের কয়েকজন ভক্ত তাঁকে শিকার-স্মৃতি লিখতে পীড়াপীড়ি করেন। করবেট নিশ্চয় খুবই আশ্চর্য হয়েছিলেন। হ্যাঁ, প্রয়োজনে কয়েকটি নরখাদক শ্বাপদ মারতে হয়েছিল। কিন্তু শেষ নরখাদক তো ১৯৩৮ সালেই মারা হয়ে গেছে। তাছাড়া সে শিকার বিষয়ে তাঁর গর্বও নেই কিছু। লিখে কি হবে? নিশ্চয় এইসব কথাই ভেবেছিলেন তিনি।
বহু বছর ধরে জিম করবেটের আগ্রহের ফলে নানা জায়গায় তাঁর বিষয়ে নানা কথা শুনেছি, কেউ কেউ এমন কথাও বলেছেন, ও করবেটের নিজের লেখা নয়। যাঁরা আগ্রহী, তাঁর ইচ্ছে হলে এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে, ১৯২৬ সালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত করবেটের রুদ্রপ্রয়াগের চিতা বিষয়ে সরকারের কাছে প্রদত্ত ইংরেজী বিবরণী পড়ে দেখতে পারেন। বিবরণটির একটি আকর্ষণ হল, প্রকাশিত ইংরেজী বইয়ের সঙ্গে ওটির কিছু কিছু তথ্যগত ও বর্ণনাগত পার্থক্য। তার চেয়েও বড় কথা হল, সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবরণীর ভাষা, স্টাইল, প্রকাশভঙ্গী এমনই, যে পড়ে নাম না দেখেও বলা যায় তা করবেটেরই লেখা। সে লেখা যখন লিখছেন, তার আঠার বছর বাদে তাঁর প্রথম বই বেরোয়। তাও অপরের জোরাজোরিতে লেখা। তাই, রিপোর্ট লেখার সময়ে করবেটের যে ভবিষ্যতে গ্রন্থকার হবার কোনো পরিকল্পনাই নেই, তা বলা চলে। সে পরিকল্পনা থাকলে করবেট ডায়েরি বা নোট রাখতেন। তাহলে যখন চিতার পেছনে ঘুরছেন, তখনকার বর্ণনা আর উক্ত প্রসঙ্গে লেখা বইয়ে সামান্য হলেও করবেট-গবেষকদের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক ছোট ছোট পার্থক্যগুলো ঘটত না। ‘ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ বেরোয় ১৯৪৭ সালে। তখন করবেটের বয়স তিয়াত্তর। ডায়েরি বা নোট নয়, স্মৃতিনির্ভর বলেই কি লেখাতে এইসব পার্থক্য? যাই হ’ক, সেই বিবরণী পড়েও বোঝা যাবে করবেটের লেখার ক্ষমতা যথেষ্টই ছিল।
যাঁরা তাঁকে বই লিখতে রাজী করান, তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ থাকতে পারি। কৃতজ্ঞ থাকতে পারি করবেটের প্রকাশক অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেসের কাছেও। প্রথম বই ‘ম্যান ইটার্স অফ কুমায়ুন’ বেরোল ১৯৪৬ সালে। বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই বইটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এ পর্যন্ত বইটির বহু লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। প্রকাশকের পীড়াপীড়িতে ‘ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ (১৯৪৭); ‘মাই ইন্ডিয়া’ (১৯৫২); ‘জাংগল লোর’ (১৯৫৩) এবং ‘দি টেম্পল্ টাইগার অ্যান্ড মোর ম্যান ইটার্স অফ কুমায়ুন’ (১৯৫৪) প্রকাশিত হয়। শেষ বই ‘ট্রী টস’ মৃত্যুর পর বেরোয়। পাঠক জেনে আগ্রহী হবেন, করবেটের সকল বইয়ের গ্রন্থস্বত্ব অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেসের কর্মীদের জন্য এক ফান্ডে জমা হয়। প্রথম বইয়ের প্রথম সংস্করণের টাকা তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে ভারতীয় সৈন্যদের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁদের দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারের চিকিৎসাকল্পে দান করেন। টাকার প্রয়োজন করবেট কোনোদিনই বোঝেন নি।
আজ করবেটের ভাষা ও স্টাইল ইংরেজীর জগতে স্বাধিকারে সম্মানের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু করবেটের কৃতিত্ব কোথায়? তাঁর চেয়েও বড় শিকারী নিশ্চয় আরো জন্মেছেন। অনেকেই বই লিখেছেন, অনেকে লিখবেনও। তবু সর্বকালে করবেটের লেখা সম্মান পাবে। তা শুধু তাঁর সাহিত্যকৃতির জন্য নয়। শিকার ব্যাপারটা এমনই, যে ভাগ্যচক্রে ঘটনার সমাপতনের ফলে সাফল্য তাতে একবার কি দুবার আসতে পারে। করবেট যে শিকারের কথা লিখে গেছেন, সেই নরখাদক শ্বাপদ শিকারে সাফল্য আনতে পারে মনের জোর, বুকের সাহস, অপরাজেয় উদ্দাম ও শ্রম করার ক্ষমতা। অব্যর্থ নিশানা, অবস্থা ও পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি ও প্রখর শ্রবণক্ষমতা নিশ্চল নিশ্চুপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার ক্ষমতা, অনিয়মিত আহার ও নিদ্রায় অভ্যস্ত করা শরীর। এর প্রত্যেকটিই আবশ্যিক। এই সব কিছুর যোগাযোগ ঘটলে তবে সার্থক নরখাদক-শিকারী হওয়া চলে। যে শিকারী এরকম হবেন, তিনি শিকারকাহিনী লিখতে বসলে নিজের কৃতিত্বের কথা তাঁকে বলতেই হবে, তা অনায্যও হবে না। কেন না শিকার তো তিনি একাই করেছেন। তাঁর কথা আর কে বলবে?
কিন্তু শেষ অবধি লেখনী লেখে না, লেখে মানুষ। করবেটের বৈশিষ্ট্য হল, মানুষ হিসেবে তিনি নম্র, বিনয়ী, পরগুণগ্রাহী, আত্মপ্রচারবিমুখ, নিরহংকার। প্রকৃতি ও মানুষকে তিনি ভালবাসেন। অনর্থক রক্তপাতে বা হিংসায় তিনি বিশ্বাস করেন না। সেই মানুষই নরখাদক মেরেছেন, দুর্ধর্ষ দস্যু সুলতানাকে ধরার জন্য পুলিসবাহিনীর সঙ্গে গেছেন। কিন্তু সর্বদাই, সকল বিবরণীতে, অপরপক্ষের দিক থেকেও প্রসঙ্গটি বিচার করতে চেষ্টা করেছেন। ফলে শিকার কাহিনী নিছক রোমাঞ্চকর একক ব্যক্তির গৌরব কাহিনী হয় নি। মানবিক গুণে তা আন্তরিক হয়েছে। খুব একটি হার্দ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন করবেট। পাঠককে একেবারে জড়িত করে ফেলতে পারেন সুলতানার জীবন কাহিনী কিংবা পিপলপানির বাঘের ব্যাপারে। সংযত, শোভন ও নির্মল কৌতুকের সুরের আবহ সৃজনে কখনো ভুল হয় না তাঁর। সেই সঙ্গেই, তাঁর আমিকে তিনি কখনই প্রশ্রয় দেন না। হামবড়াই দূরে থাকুক, অহংএর যথাসাধ্য বিলুপ্তিই তাঁর কাম্য। যিনি লিখছেন, তাঁকেই ভালবাসতে থাকেন পাঠক। হাতগুনতি ছয়খানি বই পড়ার পর, শিকার কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে লেখকের সঙ্গেও অনুরাগী পাঠক চিরতরে একাত্ম হয়ে থাকেন। এ রকমটি যখন ঘটে, তখন পাঠকের ভাল লাগে, নিশ্চিন্ত মনে হয়। কেননা এরকম লেখকের কাছে বারবার ফিরে যাওয়া যায়, জীবনের বিভিন্ন সময়ে, নিরাশ হতে হয় না একবারও। এখানেই করবেটের দারুণ জিত, বহু লেখকের ওপরে। পুনর্গঠন মূল্য না থাকলে কোনো বই সাহিত্যের দরবারে টেকে না। যাঁরা ইংরেজীতে করবেট পড়েছেন তাঁরা আমার কথা বুঝবেন। করবেটের লেখক-সাফল্য অনেকের চেয়ে মূল্যবান এইজন্য, যে তিনি কোনো বিশাল মহান-উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিষয়বস্তু নিয়ে সাহিত্য করতে বসেন নি, শিকারের কথা লিখছেন, অথচ শিকার সাহিত্যকে তুলে দিচ্ছেন শ্রেষ্ঠ সৃজনী সাহিত্যের আমদরবারে। রবার্ট লুই স্টীভেনসনের ‘ট্রাভেল উইথ এ ডংকি’ বা ড্যু, এইচ ডেভিসের ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ এ সুপার ট্র্যাম্প’ পড়লেও অনুরূপ বিমল আনন্দ পাই বটে, তবে তাঁরা দুজনেই সৃজনশীল সাহিত্যিক। স্টীভেসন তো বিশ্ববিখ্যাত, আর ডেভিসও প্রখ্যাত কবি। করবেটের ভাষা, স্টাইল, বর্ণনা যে কত সুন্দর, জাত লেখকের মত তিনি যথাস্থানে থামতেও জানেন, একথা করবেট অনুরাগী মাত্রেই জানেন। খুবই দুঃখ হয়, তাঁর বই পড়তে পড়তে। মনে হয় চেনা জীবন ও জগৎ নিয়ে তিনি শিকার ছাড়াও এমনি স্মৃতিচারণাও যদি করতেন, আমরা লাভবান হতাম। দুঃখই হয়, আবার বলছি, কেননা করবেটের কুমায়ুনেও তো তাঁর ‘মাই ইন্ডিয়া’র চেহারা পালটে গেছে। তিনি লিখলে সেই জগৎ, সেই জীবন, সেই ভারতকে আমরা জানতে পেতাম কোনো কোনো সময়ে রাগও হয়। চম্পাবতের মানুষখেকো বাঘ মারতে গিয়ে বাংলোতে কি অলৌকিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা খোলসা করে লিখতে কি হয়েছিল? আর রাগ হয়, পাওয়ালগড়ের ব্যাচেলর আর পিপলপানির বাঘ, এদের না মারলেই কি চলছিল না? করবেট কখনো নরখাদক ছাড়া অন্য বাঘও মেরেছেন জানলে পরে যেন আমরা একটু লজ্জাই পাই। ঘরের মানুষ, প্রিয় মানুষের বিষয়ে যেমনটি মনে হয়, করবেটের বেলাও তাই।
১৯৪৪-এ প্রথম বই বেরোল। ১৯৪৭-এ ভারত স্বাধীন হল। করবেট ভারত ছাড়া অন্য দেশ জানতেন না। করবেট থাকতেন নৈনিতালে তাঁর বড় বোন ম্যাগির সঙ্গে। ম্যাগি ও করবেট কেউই বিয়ে করেন নি। নৈনিতালের ‘গার্নি হাউস’ বাড়িটি, করবেটের মা মেরি জেন করবেট (মৃত্যু ৬.৫.১৯২৪) উইল করে ম্যাগিকে দিয়ে যান। ‘গার্নি হাউস’ এবং মায়ের পিয়ানো ম্যাগি পেয়েছিলেন। নৈনিতালের বাড়িতে করবেট চিরকাল থেকে যাবেন এই জানতেন। নৈনিতালে গ্রীষ্মকালে তিনি ও ম্যাগি থাকতেন। শহরে সবাই চেনা জানা। পনের বছর ধরে করবেট স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের সদস্য ছিলেন। শীতকালে কালাধুঙ্গি থেকে পনের মাইল হেঁটে তিনি বোর্ডের মিটিঙে আসতেন। নৈনিতালে ব্যান্ড-স্ট্যান্ডের নির্মাণ স্থানটি তাঁর পছন্দে বাছাই করা হয়েছিল। খুবই ভারতীয় ছিলেন তিনি। জনৈক পরিচিত ভদ্রলোক বলেছেন করবেট জ্যোতিয়ে বিশ্বাসী ছিলেন, নিজের কোষ্ঠীপত্র তৈরি করিয়েছিলেন। তাঁর জগৎ ও জীবনের সবরকম বিশ্বাসে যে তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তা তো তাঁর লেখাতেই বোঝা যায়। চামারির মৃত্যুকালে কাশীর সাধুর আগমন (মাই ইন্ডিয়া); সারদা নদীর তীরবর্তী পাহাড়ে অলৌকিক আলোর মিছিল (দি টেম্পল টাইগার অ্যান্ড মোর ম্যান ইটার্স অফ কুমায়ুন); বালা সিংয়ের পেটে ত্রিশূলের দানো ঢুকে যাওয়া (ঐ), এই সব প্রসঙ্গ আমার উক্তিকে সমর্থন করবে। শহরে সকলেই বিশেষ করে ছোটরা তাঁকে ভালবাসত। করবেট তাদের আনন্দ দিতে গল্প বলতেন, পাখির ডাক নকল করতেন, জীবজন্তুর, বিশেষ করে বাঘের ডাক নকল করে শোনাতেন। তাঁর প্রকাশক সংস্থার বর্তমান ভারতে সর্বাধক্ষ শ্রীরবি দয়ালের দেশ নৈনিতাল শহরে। ছোটবেলায় সকলের কাছে ‘ম্যান ইটার’ ও ‘জিম করবেট’ শুনে শুনে তাঁর ধারণা হয়েছিল জিম করবেটই বুঝি মানুষ ধরে খান। স্কুলে যাবার সময়ে করবেটকে তিনি রোজই দেখেন, আর করবেটকে দূরে রেখে ঘুর পথে স্কুলে যান। করবেট একদিন তাঁকে ধরে ফেললেন। তখন সেই শিশুর মাথায় ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।
এইভাবে যিনি বসবাস করছেন, তাঁর পরিত্যক্ত আবাসগৃহের যে বর্ণনা আমার পাচ্ছি তাও এক প্রাচীন গৃহস্থালির, তিনি যে হঠাৎ তাঁর প্রিয় ভারত ছেড়ে আফ্রিকা চলে যাবেন, সেটি খুবই অপ্রত্যাশিত এবং বিস্ময়কর। করবেট কেন ভারত ছেড়ে গেলেন? তিনি যাকে ‘স্বদেশ’ বলছেন, সে দেশ তাঁর নয়, এ কথা কি করবেট সত্তর বছরে একবারও সন্দেহ করেছিলেন? মনে তো হয় না। ‘আমাদের দেশ, আমাদের গ্রাম, আমাদের মেয়েরা, আমাদের পাহাড়ীরা, আমাদের শব্দের ছড়াছড়ি। তাঁর ভারত ছেড়ে তিনি গেলেন কেন? তাঁর নাগরিকত্ব ‘ডমিসাইল্ড ইংলিশম্যান’-এর, সেই জন্য? নাগরিকত্বের জন্য কোনো অসুবিধা হয়েছিল? অত্যন্ত হালে এক সাংবাদিক লিখেছেন, হেইলি-ন্যাশনাল পার্ক, উত্তর করবেট মৃত্যুতে যা করবেট-ন্যাশনাল পার্ক নামে পরিচিত, করবেট তা স্থাপনে খুব উদ্যোগী ছিলেন এবং এই কারণেই উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে করবেটের মনান্তর হয়। সেইজন্যই করবেট দেশ ছেড়ে চলে যান। বিভিন্ন ব্যক্তিকে তিনি আফ্রিকা থেকে লিখেছেন, তাঁর প্রাণ পড়ে আছে ভারতে। তিনি দু-বছর বাদে ফিরবেন। এ বিষয়ে আরো তথ্য প্রকাশ না হওয়া অবধি বরং আমাদের এই দুঃখভার প্রশ্নটি নিরুত্তর থাকুক, যা জানা গেছে তাই বলা যাক আপাতত। দেখা যাচ্ছে মৃত্যুর আট বছর আগে জিম করবেট বাহাত্তর বছর বয়সে, স্বাধীনতার বয়স তিন মাস হতেই ‘গার্নি হাউস’ বন্ধু শ্রীযুক্ত পি. কে. বর্মাকে বিক্রি করে দিচ্ছেন ২১.১১.১৯৪৭ তারিখে এবং বড় বোন ম্যাগি সহ চলে যাচ্ছে আফ্রিকার কেনিয়ায়। যাবার আগে বাড়ির বাগানে এক গাছ পুঁতে দিচ্ছেন। ঊনত্রিশ বছরে সে গাছ এখন বয়স্ক, পল্লবিত। যাবার আগে দুই অনুরক্ত অনুচরের সহায়তায় নৈনিতালের কোথাও, গভীরে গোপনে পুঁতে রেখে যাচ্ছেন তাঁর তিনটি রাইফেল ও দুটি শটগান। নৈনিতালে, আজ যাঁরা করবেটকে নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁদের একজনের মত, ভারত ত্যাগের আগে করবেট শিকারজীবনে এইভাবে, আনুষ্ঠানিক পূর্ণচ্ছেদ টেনে দেন। কথাটি আমরা গ্রহণ করি কি করে? শেষ নরখাদক ত ১৯৩৮-এ .মারা হয়ে গেল। তারপর কখনো খাবার জন্য কিছু মেরেছেন কিনা তার রেকর্ড নেই। প্রমাণ আছে ছড়ানো ছেটানো, চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে তিনি বাঘের ছবি তুলে বেড়িয়ে শিকারের চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছেন। শিকারে যবনিকা কি আগেই টেনে দেন নি তবে?
‘গার্নি হাউস’ আজ শ্রীযুক্তা কলাবতী বর্মার দখলে। খুবই কৃতজ্ঞ আমরা বর্মা পরিবারের কাছে। ঊনত্রিশ বছর ধরে তারা তাঁদের আবাসগৃহকে এমন ভাবে রেখেছেন, যেন তা জিম ও ম্যাগি করবেটেরই বাড়ি, তাঁরা সেখানে গৌণ নৈনিতালের এক কোণে এক (স্থানীয় নাম বান্ধ) ও অন্যান্য গাছে ঢাকা এই পুরনো কেতার বাংলোবাড়ি। তিনটি ঘরে জিম করবেটের সব জিনিসপত্র বোঝাই হয়ে আছে। তাঁর টিনের নৌকো, মাছ ধরার ছিপ। ধিকালায় নিহত এক হাতির দাঁত, দুটি বাঘের খুলি, করবেটের নন্দাদেবী সফরকালে ১৪,০০০ ফিট উঁচুতে নিহত একটি হিমালয়ান থর-এর চামড়ামোড়া জীবনাননুগ মূর্তি। দর্শক ইচ্ছে হলে শ্রীযুক্তা বর্মার কাছ থেকে করবেটের মায়ের উইল ও এই বাড়ির বিক্রি দলিল দেখতে পারেন।
কালো পিয়ানোটি আজও শ্রীযুক্তা বর্মার যত্নে নিরেখ, ঝকঝকে। করবেটরা চলে যাবার পর পিয়ানো সুরে বাঁধা হয় না, বাজানোও হয় নি। ডাইনিং ঘরের কাচের বাসন-রাখা আলমারিটি করবেট মোকামাঘাট থেকে পাকা কাঠ এনে করিয়েছিলেন। শ্রীযুক্তা বর্মার মতে করবেট নিজের ডিজাইনে আসবাব করিয়ে নিতে ভালবাসতেন। ড্রয়িংরুমে আফ্রিকান আদিবাসী ড্রাম, দুটি কামানগোলার খোল। ওদুটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে করবেট নাকি কর্মা থেকে আনেন। তবে বর্মায় যুদ্ধার্থীদের প্রশিক্ষণই দেন নি তিনি শুধু? নিজেও গিয়েছিলেন? করবেট নিজের কথা বলে যায় নি কেন? ঘরে তাঁর ফোটো, ছবি। সংলগ্ন কামরায় তাঁর পুরনো কেতায় রোলটপ্ লেখার ডেক্স-টেবিল, তাঁর ইস্পাতের আলমারি। লাইব্রেরিতে তাঁর এবং পরিবারের বই। সাহিত্যের এনসাইক্লোপিডিয়া, স্টীভেনসনের ‘কিডন্যাপড’, ১৮৭০-এ মুদ্রিত এক ইংরেজ মেয়েদের গার্হস্থ্য ম্যাগাজিন, দুই খণ্ড ‘ট্রেজারি অফ বটানি’, নৈনিতালের ম্যাপ, ১৮৭২ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ের। যেন হঠাৎ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন দুই ভাইবোন সব কিছু, যা নিয়ে তাঁদের জীবন, সংসার, গৃহস্থালি। নাকি ভারতকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন মন থেকে? নৈনিতালে আজও যারা করবেট বিষয়ে আগ্রহী, তাঁদের কারো কারো পিতাকে করবেট না কি নিয়মিত চিঠি লিখতেন, দু বছর বাদে ফেরার সংকল্প জানাতেন। ‘দু বছর’ কেন? করবেট কেন ভারত ছেড়ে যান, সে বিষয়ে সব কথা যেদিন জানা যাবে, সেদিন ছাড়া বহু প্রশ্নের উত্তর মিলবে না।
কেনিয়ার নিয়েরিতে ১৯৪৭-এ নবাগত সাদা শিকারীরা পাকা আস্তানা না পাওয়া অবধি ‘আউটপ্ল্যান’ হোটেলে থাকতেন। করবেটরাও সেখানেই প্রথমটা ওঠেন। বারান্দায় বসে ঋজু দেহ, ছিপছিপে বলিষ্ঠ মানুষটি লিখছেন, এ অনেকেই দেখেছেন। তাঁরা হয়তো ভাবেনও নি, স্বল্পভাষী মানুষটি যে-সব লেখা লিখেছেন, বই হয়ে বেরোলে অচিরে তা বিশ্বপরিচিতি পাবে। প্রতি বিকেলে পাখিরা তাঁর গায়ে মাথায় বসত, হাত থেকে রুটি ও কেক খেত। যখন তিনি সারু গেম পার্ক-এ যেতেন, তখনো পাখিরা বিকেলে আসত প্রত্যাশায়। তাঁর নির্দেশে তাঁর ভাগের কেক ও সান্ডুইচ হোটেলের লোকরা পাখিদের দিত।
পরে করবেট একটি ছোট কটেজ কেনেন। বাংলোটি একদা লর্ড বডেন পাওয়েলের ছিল। বডেন পাওয়েল বিশ্ব-স্কাউট আন্দোলনের স্থাপয়িতা। এই বাড়ির সামনে করবেট একটি ছোট বাঁধানো জলাশয় তৈরি করে দেন পাখিদের জন্য। তাঁর মৃত্যুর পর যতদিন বেঁচেছিলেন, ম্যাগি পাখিদের নিয়মিত খেতে দিতেন।
এখানেই থেকে গেলেন করবেট ও ম্যাগি। মাঝে মাঝে করবেট সামবুরু গেম পার্ক দেখতে যেতেন। ১৯৫২ সালে ইংলন্ডের যুবরাণী এলিজাবেথ ও ডিউক অফ এডিনবরাকে নিয়ে তিনি ট্রী টপ্স-এ একটি রাত কাটান। সে অভিজ্ঞতার কথা তাঁর শেষ বই ‘ট্ৰী টপস’-এ লেখা আছে। কিন্তু এ রকম ঘটনা প্রত্যহ ঘটে নি। নিয়েরিতে প্রত্যহের জীবনে তিনি সাধারণের কাছে প্রায় অজানা ছিলেন। তখনো তিনি বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কাজ করেছেন, পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, লিখেছেন। জনৈকা ইংরেজ মহিলা রুথ ইডেন ১৯৬৯-এ এক ভারতীয় সাংবাদিককে বলেছিলেন করবেটরা তাঁর বন্ধু ছিলেন। তাঁর ‘ম্যান ইটার্স অফ কুমায়ুন’ বইয়ে করবেট লিখে গিয়েছিলেন, ‘তোমাকে আমি বন্ধু বলে সম্ভাষণ করি, কেননা যাঁরা আমার বই পড়েন, সবাই আমার বন্ধু। মৃত্যুর দু-দিন আগে এক তরুণ বন্ধুকে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিটি দিন এমনভাবে বাঁচো, যেন এটি তোমার জীবনের শেষ দিন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে লিখেছিলেন, ‘আমি, বা আমার দিদি ম্যাগি, কেউই বহু মানুষের ভিড়ে ভাল থাকি না।’ ১৯৫৫ সালের ১৯শে এপ্রিল নিয়েরিতে তাঁর মৃত্যু হয়। তখন কুমায়ুনে বৈশাখ মাস। তুষারগলা ঝরনায় মাছের রুপোলী ঝলক, পাহাড়ের সানুদেশে পলাশে আগুন জ্বলছে, যাযাবর পাখিরা আবাসে ফিরবে বলে ভাবছে, হিমালয়ের ওপরের আকাশ উজ্জ্বল নীল, আর কোনো কোনো পাহাড় এমন চোখে মায়া লাগায়, যে মনে হয় পা বাড়ালেই কাছে পৌঁছে যাব, অথচ পাহাড় বহু দূরেই থাকে। সেন্ট পিটার্স অ্যাংলিকল চার্চ সিমেট্রিতে এক নিরাভরণ সমাধিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ২৫.১২.৬৩-তে একই সমাধিতে ম্যাগিকেও সমাহিত করা হয়। শ্রীযুক্তা বর্মা বলেছেন, ‘জিম ও ম্যাগি পরস্পরের জন্য বাঁচতেন।’ সমাধির ওপর লেখা আছে ‘Until the daybreak and the shadows flee away. ‘
দুই
মৃত্যুর পর জিম করবেট, অন্তত পশ্চিমবঙ্গের অতি সামান্য মনোযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালের ২৯শে এপ্রিলের ‘দি স্টেটসম্যান’ কাগজে শ্রী বি. এম. কর্নেলিয়াস এক সংক্ষিপ্ত দেড়শো শব্দের বিবরণীতে করবেটের মৃত্যুর প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ও বলেন, তাঁর মতে, চাঁদা তুলে নৈনিতালে এক প্রমাণ মাপের মূর্তি স্থাপনা করে করবেটকে শ্রদ্ধা জানানো হ’ক। আমি একটি মোটামুটি বড় প্রবন্ধ লিখেছিলাম সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এ (৪.৬.১৯৫৫)। আজ তার পাতা উলটে দেখছি করবেটের অরণ্য ও আরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণে অবদানের ওপর খুব জোর দিয়েছিলাম। আসলে জিম করবেট আমার অতি প্রিয় লেখক, অরণ্য ও আরণ্য প্রাণীতে আমার চিরকালের আগ্রহ এবং তখনি অধুনা দুষ্প্রাপ্য, করবেট ও জাফরি সম্পাদিত ‘ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ’ পত্রিকা পড়েছি।
যেহেতু করবেট উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা ছিলেন, সেহেতু তাঁর বিষয়ে উত্তরাঞ্চলে আগ্রহ বেশি থাকবে, এই স্বাভাবিক। দেরাদুন থেকে ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রিজারভেশ্যন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার জার্নাল ‘চিতল’ এর সব কপি আমি পাই নি। যা যা পেয়েছি, তাতে করবেট প্রসঙ্গ যেভাবে এসেছে তাই বলি। ‘চিতল’ বেরোতে শুরু করে ১৯৫৮ সাল থেকে। প্রথম সংখ্যাতেই দেখছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ভারতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে যা যা কাজ হয়েছে, তাতে ‘চিতল’ আগ্রহী। প্রথম সংখ্যার ‘চিতল’ বলছেন, প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয় ১৯৩৫ সালে। সে বছর নয়া দিল্লিতে ভারত সরকার এক ‘ওয়াইল্ড লাইফ’ কনভেনশন’-এর ব্যবস্থা করেন এবং সকল প্রদেশের প্রতিভূদের সেখানে গৃহীত প্রস্তাবে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর দিতে বলা হয়। সেই বছরেই সংযুক্ত প্রদেশে (বর্তমানের উত্তরপ্রদেশ) ‘হেইলি ন্যাশনাল পার্ক’ স্থাপিত হয়। ‘চিতল’-এর সম্পাদক-মণ্ডলী এক আবেদনে জানান, ‘প্রিজারভেশ্যন অফ ওয়াইল্ড লাইফ’ অ্যাসোসিয়েশ্যন ইন্ দ্য য়ুনাইটেড প্রভিনসেস্’-এর পক্ষে অবৈতনিক সম্পাদকদ্বয় কর্নেল জিম করবেট ও হাসান আবিদ জাফ্রি সম্পাদিত ‘ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ’ পত্রিকা (১৯৩৬-৩৮) বিষয়ে কেউ কোনো খবর দিতে পারলে সম্পাদক-মণ্ডলী অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকবেন।’
১৯৫৯ সালের এপ্রিল সংখ্যার ‘চিতল’-এর খবরটি চিত্তাকর্ষক। তাতে লেখা হয়েছে, ‘পরলোকগত জিম করবেটের বোন মিস ম্যাগি করবেট ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রিজারভেশান সোসাইটি অফ নর্দান ইন্ডিয়া’কে পাঁচশো টাকা দান করেছেন। বন্য প্রাণী সংরক্ষণে সর্বোত্তম প্রচেষ্টার জন্য উত্তর ভারতের যে কোনো বালক/বালিকাকে ‘করবেট পুরস্কার’ নামে এক সাংবাৎসরিক পুরস্কার প্রদান প্রকল্পে সোসাইটি এই টাকা খরচ করবেন।’
১৯৫৯ সালের অক্টোবরে ‘চিতল’ এক খবরে জানাচ্ছেন, ‘করবেট ন্যাশনাল পার্ক বিপন্ন। কেননা রামগঙ্গা নদীতে বাঁধ বেঁধে উক্ত ‘পার্কের বৃহদাংশকে এক হ্রদে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা হচ্ছে।’
১৯৬০ সালের এপ্রিলে ‘চিতল’ বলছেন, ‘কিছুকাল আগে তদীয় বিখ্যাত ভাইয়ের স্মৃতিতে এক পুরস্কারের জন্য পরলোকগত জিম করবেটের বোন ম্যাগি করবেটের কাছে আবেদন জানানো হয়। তিনি তৎক্ষণাৎ সে আবেদনে সাড়া দেন এবং আমাদের পাঁচশো টাকা দেন। সোসাইটি তার সঙ্গে সমান অঙ্কের টাকা যোগ করেন এবং বন্যপ্রাণী বিষয়ে করবেট স্মৃতি পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন। এই পুরস্কারের বিষয়ে জানিতব্য সকল বিশদ সঙ্গের পরিপত্রে দেওয়া হল। আশা করা যায় পরিপত্রটি উত্তর ভারতের সকল বিদ্যালয়ে পৌঁছবে এবং এই প্রতিযোগিতায় উৎসাহ আকর্ষণে সমর্থ হবে।
পরিপত্র
উত্তর ভারতের সকল রাজ্যের শিক্ষাধিকর্তা সমীপে।।
বিষয় : আরণ্যপ্রাণী বিষয়ে করবেট স্মৃতি পুরস্কার।।
প্রিয় মহাশয়,
প্রখ্যাত শিকারী ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রবক্তা পরলোকগত জিম করবেটের স্মৃতিরক্ষার এবং বন্যপ্রাণী বিষয়ে ভারতে আগ্রহে উৎসাহদানের জন্য। করবেটের বোন মিস ম্যাগি করবেটের সহায়তায় ‘দি ওয়াইল্ড লাইফ প্রিজারভেশান সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’ এক সাংবাৎসরিক পুরস্কার দেওয়া স্থির করেছেন। উত্তর ভারতের যে কোনো বিদ্যালয়ের উচ্চ শ্রেণীর (নবম, দশম ও একাদশ একক শিক্ষার্থীকে অথবা দলবদ্ধ শিক্ষার্থীদের, বন্যপ্রাণী সংবর্ধনে শ্রেষ্ঠ হতে কলমী কাজের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হবে।
এই রূপায়ণীর প্রকল্পে, অন্যান্য অনুরূপ বিষয়সহ নিচের একটি/দুটি বিষয় থাকতে পাৱে :-
(১) সম্পূর্ণ প্রজন-বৃত্তের সময়কাল ধরে দুজোড়া পাখিকে পর্যবেক্ষণ।
(২) বন্যপ্রাণীর আলোকচিত্র গ্রহণ (অন্তত দুটি জাতের)।
(৩) দুটি বন্যপশু বা পাখির পদচিহ্নের মাপ গ্রহণ, তার রেকর্ড রাখা এবং প্লাস্টারে সে চিহ্নের ছাঁচ নেওয়া।
(৪) নয় মাস থেকে বারোমাস কাল ধরে অন্তত দুটি প্রজাতির বন্য পাখি বা পশুর অভ্যাস-আচরণ পর্যবেক্ষণ।
(৫) পাখির জন্য বাসা তৈরি, ফলের গাছ লাগানো। পাখির স্নানাধার তৈরি, মাছের চাষ ও জীবজন্তুর পানের জন্য বাঁধ বেঁধে জল সঞ্চয় করা ইত্যাদি।
পুরস্কারের জন্য পেশকৃত সকল প্রকল্পই হয় কোনো একক শিক্ষার্থী, অথবা সর্বাদিক পাঁচজন শিক্ষার্থীর এক মিলিত দলের কাজ হতে হবে। বিদ্যালয়ের প্রধান এই মর্মে অনুমোদন সূচক স্বাক্ষর করবেন।
৩১.৮.১৯৬০-এর মধ্যে নিম্ন স্বাক্ষরকারীর কাছে সকল নাম পৌঁছানো চাই। ১৯৬০ সালের অক্টোবরে পুরস্কার দেওয়া হবে।
শিক্ষার্থীদের বা বিদ্যালয়গুলির উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলি প্রসঙ্গে আরো জানা প্রয়োজন। তাঁরা নিম্ন স্বাক্ষরকারীকে লিখতে পারেন।
বিদ্যালয় সমূহে ব্যাপক প্রচারের জন্য উপরের বিশদ-তথ্যাবলী, আপনার অধীনস্থ জেলা-বিদ্যালয়-পরিদর্শকদের অবগতিতে আনলে আমি খুবই কৃতজ্ঞ হব। এই চিঠির দুশো কপি পাঠালাম। আপনার আধিক্ষেত্রিক বিদ্যালয়গুলিতে এগুলি দয়া করে প্রচার করবেন। এ বিধির কপি আরো দরকার হলে নিম্নস্বাক্ষরকারী সানন্দে তা পাঠাবেন।
বন্যপ্রাণী বিষয়ে আগ্রহ উদ্দীপনে এই প্রচেষ্টায় আমাদের সহায়তা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অবৈতনিক সম্পাদক ওয়াইল্ড লাইফ প্রিজারভেশ্যন সোসাইটি অফ নর্দার্ন ইন্ডিয়া।
১৯৬১ সালের এপ্রিল সংখ্যা ‘চিতল’-এ মি. ব্র্যাম্লিকে লেখা জিম করবেটের চিঠির অংশ বিশেষ ছাপা হয়। ১৯৫৫ সালে ১০ই মে ‘লন্ডন টাইম্স’-এ চিঠিটা বেরিয়েছিল। অংশটি এইরকম, ‘কুড়ি বছর ধরে বন্যপ্রাণীর সপক্ষে আমি লড়ছি। যাঁরা সাহায্য করবেন, বিরোধিতা করবেন না বলে আশা করা যায়, বরাবর তেমন লোকরাই আমার প্রতিপক্ষতা করেছেন। রক্তপিপাসু পুরুষরা, বহু ক্ষেত্রে মেয়েরাও সবাই কোনো না কোনো অছিলা নিয়ে হাজির থেকেছেন এটি কালে মানুষখেকো হবে, এটি হয় তো গৃহপালিত পশু খাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা আমাদের সময়ে যে সব অজুহাত দেখিয়েছি, আমাদের উত্তরাধিকারীরা এখন সেই সব অজুহাত দেখাচ্ছে। বাঘের বিষয়ে আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, দু বছর আগে জেনারাল ওয়াভেল সেই এক প্রশ্নই করেছিলেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম, আমার মতে ভারতে ২০০০ বাঘ আছে। যখন তিনি জিগ্যেস করলেন, বাঘ কতদিন টিকবে বলে আমি মনে করি, আমি বলেছিলাম—’অভয়ারণ্য এবং একটি বা দুটি ভারতীয় রাজ্য বাদ দিলে অন্যত্র দশ বছরের মধ্যে বাঘ লোপ পাবে।’
করবেটের চিঠিটি বাঘের ভবিষ্যৎ বিষয়ে এক আলোচনা সভা সংশ্লেষে প্রকাশিত হয়। আলোচনার শুরুতে লেখা হয়েছিল, ‘ভারতে বাঘ অবলুপ্ত হতে চলেছে এমন আশঙ্কা আছে কি? মাঝে মাঝেই এ প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ইদানীং প্রশ্নটি বেশি উঠছে, যখন এদেশে ‘বন্যপ্রাণী অবলুপ্তি বেড়ে চলেছে।’
১৯৫৫ সালের আগস্টে, ভারত সরকারের অবসরপ্রাপ্ত অরণ্য পরিদর্শক প্রধান এম. ডি. চতুর্বেদী করবেটের যুক্তিগুলি বিশ্লেষণ করেন। তাঁর নিজের সংগৃহীত কিছু পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ভারতে বাঘ নিজেকে টিকিয়ে রাখছে। কিছুদিন আগে, বাঘ শিকারের জন্য ভারতে আবার এসে এক সামরিক অফিসার বলেন, এখনো প্রচুর বাঘ আছে। গভীর সন্দেহ করা হচ্ছে, আসল উত্তরটি এই দুয়ের মাঝামাঝি কোথাও লুকিয়ে আছে।
১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসের ‘চিতল’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্য দেখা যাক।
“ভারত ত্যাগের পর পূর্ব আফ্রিকায় বসবাস শুরু করার পর পরলোকগত জিম করবেট কেনিয়ার নিয়েরিতে এক বন্যপ্রাণী সংরক্ষা সমিতি স্থাপন করেন এবং ১৯৪৯ সালে তিনি নিজেই তার অবৈতনিক সম্পাদক হন, এটি কৌতুহলোদ্দীপক এবং লক্ষণীয়। সে সময়ে করবেট নিশ্চয় সত্তর ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। ত্রিশের দশকে জিম করবেট ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রিজারভেশ্যন সোসাইটি অফ দ্য য়ুনাইটেড প্রভিন্সেস’ স্থাপনে সহায়তা করেন এবং হাসান আবিদ জাফ্রির সঙ্গে উক্ত সংস্থার সহযোগী অবৈতনিক সম্পাদক থাকেন, ‘ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ’ পত্রিকা বহু বছর সম্পাদনা করেন, এ কথা পুনস্মরণ করা যেতে পারে। যুদ্ধ, পরবর্তী ঘটনাবলী এবং করবেটের আফ্রিকা যাত্রা, এই সব কিছুর যোগফল বন্যপ্রাণীর জন্য এই সব প্রচেষ্টার উপর যবনিকা ফেলে দেয়। জিম করবেটের দৃষ্টান্ত : বৃদ্ধ বয়সেও বন্যপ্রাণীর জন্য তাঁর কাজ প্রশংসাযোগ্য। যখন তাঁরা সক্ষম ছিলেন, তখন আরণ্যজগৎ থেকে বহু আনন্দ আহরণের পর বহু প্রাচীন শিকারী এবং নির্বেদে অবসর গ্রহণ করেন, যে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে দেখেও সাহায্যার্থে তাঁরা একটি আঙুলও নাড়ান না। বস্তুত, যে সব প্রাচীন ‘কোই হ্যায়’দের আমরা চিনি, তাঁদের অনেকেই ভারতের বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে যে কোনো প্রচেষ্টা বিষয়ে এতই উদাসীন ও নৈরাশ্যবাদী যে তাঁরা আমাদের সোসাইটিতে যোগ অবধি দেন না। শিকার করে, মাছ ধরে যে সব আনন্দময় সময় কাটিয়েছেন তা তাঁরা একেবারে ভুলে যান। উত্তরপুরুষের জন্য তাঁরা কোনো উত্তরাধিকারই রেখে যেতে চান না।”
৭.৬.১৯৬৫ তারিখের ‘দি স্টেটসম্যান’ কাগজে এই খবরটি বেরোয় : ‘চিকালা :-করবেট ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত কালাধুঙ্গিতে জিম করবেটের বাড়িটিকে উত্তরপ্রদেশ সরকার, এক মিউজিয়াম হিসেবে সংস্কার ও সংরক্ষা করতে চান। গত সপ্তাহে ইন্ডিয়ান বোর্ড অফ ওয়াইল্ড লাইফের এক সভায় এই সংকল্প ঘোষণা করা হয়।’
‘চিতল’ পত্রিকায় বক্তব্যগুলি আমি যথাযত পাঠকের সামনে উপস্থাপিত করলাম। লেখাগুলি থেকে বোঝা যাচ্ছে করবেট অরণ্য ও আরণ্যপ্রাণী সংরক্ষায় আগ্রহী ছিলেন। এখানে, করবেট কেন ভারত ও ভারতবাসীর স্মর্তব্য, সেই প্রসঙ্গটি আসছে। শুধু শিকারের কৃতিত্বের জন্য করবেটের সকল গৌরব হলে আমরা তাঁকে এমন করে মনে করতাম না এবং করবেটও আধুনিক ভারতমানসে সংশ্লিষ্ট তাৎপর্য হারাতেন। সে বন, সে বনচারী নেই। করবেটের বইয়ে বর্ণিত প্রায় সকল অরণ্যাঞ্চল এখন বাঁধানো রাস্তা, জীপ-ট্রাক-বাস-মোটর-ট্যাক্সি, ট্রানজিস্টর ও জনতার দ্বারা আক্রান্ত এবং বিজিত। নরখাদক শ্বাপদ দূরে থাকুক, জঙ্গলে জঙ্গলে ফিরলে বাঘের দেখা মেলাই দুর্লভ। আজ সেই দর্শক সংরক্ষিত বনে বা অভয়ারণ্যে বাঘ দেখেন, যাঁর ‘টাইগার লাক’ আছে।
এখানেই জানা যাচ্ছে করবেট কেন আমাদের স্মর্তব্য। কিছুই করার নেই আমাদের। করবেট আফ্রিকার গিয়ে মরে যান আর যাই করুন, অবাধ্য জেদে তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন কেন তাঁকেই শ্রদ্ধা জানাতে হবে। তাঁর উদ্ভট কৌতুকপ্রিয়তাও টের পাওয়া যাচ্ছে। কেন না তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, বলতে গেলে তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি কথা না বলে, একটি হরফ না লিখে তিনি সর্বশক্তি-সাধ্য-উপার্জন খরচ করে বনের মোষ তাড়িয়ে গেছেন। বহু জনের স্মৃতি-বহু চিঠি বহু নথিপত্র থেকে তাঁর কাজ সম্পর্কে তথ্য বের করার ভার রেখে গেছেন আগ্রহীদের ওপর। এ কাজটি দুঃসাধ্য হবে, তাঁর তা মনেও হয় নি নিশ্চয়। পরকে বাঁচাতে যে পঁচাত্তর মাইল পাহাড় ঠেঙাতে পারে সে অন্যের ভবিষ্যৎ অসুবিধার কথা ভাববে কেন? করবেটের নিজের বিষয়ে নিশ্ছিদ্র নীরবতার সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন। আশাকরি বোঝাতে পেরেছি, শিকারী করবেটকে শ্রদ্ধা জানিয়ে শিকারী করবেটের শতবার্ষিকী করে আমরা ঠিক করি নি? কেন না হস্তা করবেট নন, অবশ্য ও আরণ্যপ্রাণীর সংরক্ষয়িতা করবেট আমাদের স্মরণীয়। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তিনি আমাদের কাছে আজ। কেন না ভারতের বন ও বন্যপশুপাখি আজ বন্যার মুখে বালুচরী পাখির বাসার চেয়েও বিপন্ন। কর্নেলিয়াস করবেটের মূর্তি করতে বলেছিলেন, আমরা ডাকটিকিট ছেপেছি, আরো আরো বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান করেছি। কিন্তু করবেটকে তাতে তাঁর প্রাপ্য শ্রদ্ধা জানানো হয় নি। এ জাতীয় শ্রদ্ধা জানাতে আমরা জাতিগতভাবে সদাই ব্যস্ত। এতে দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার সুবিধা অনেক। তা বুঝেছিলেন বলেই, জনশ্রুতি, গিরীশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘মূর্তি কোর না বাপ সকল, মাথায় কাক বসবে’।
দেশ বলতে যাঁরা নীরব অরণ্য এবং মানব ভাষানভিজ্ঞ আরণ্য প্রাণীর কথাও ভাবেন, এগুলির প্রয়োজন বোঝেন, তাঁরা জিম করবেটকে শিকারী হিসাবে যত শ্রদ্ধা করেন, তার চেয়ে অনেক শ্রদ্ধা করেন আরণ্য প্রাণী ও অরণ্যানীর সংরক্ষয়িতা হিসাবে।
করবেটের বই যাঁরা পড়েছেন, তাঁরাই জানেন শিকার কাহিনী লিখলে কি হয়, করবেটের জঙ্গল ও জীবজন্তু বিষয়ে আশ্চর্য মমতা ছিল। জীবন বিষয়ে এই শ্রদ্ধা মমতা তাঁর স্বভাবে সহজাত, পরিবারে, গ্রাম সমাজে, সর্বত্র তিনি সকল জীবিত প্রাণীকে ভালবাসার শিক্ষাই পেয়েছিলেন। সহজাত প্রবণতার সঙ্গে প্রতিবেশের অনুকূল প্রতিক্রিয়া যুক্ত হয়েছিল। যে বাঘ মারার জন্য করবেটের এত নাম, সেই বাঘ বিষয়ে তাঁর প্রখ্যাত ও বহুল উদ্ধৃত উক্তি স্মরণ করা যাক : ‘বাঘ হল দরাজ-কলিজা এক ভদ্রলোক, সীমাহীন তার সাহস। যেদিন বাঘকে বিলোপ করে দেওয়া হবে, আর যদি বাঘের সপক্ষে জনমত গড়ে না ওঠে বাঘ লোপ পাবেই—তাহলে ভারতের শ্রেষ্ঠতম প্রাণীর বিলোপে ভারত দরিদ্রতরই হবে।’
বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজন আজ পৃথিবী জুড়ে অনুভূত হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আবহাওয়া ও ভূগোল নির্বিশেষে দেশের এক তৃতীয়াংশ বা শতকরা ৩৩ ভাগ জমি বনভূমি হওয়া প্রয়োজন। বন কথা কয় না, সভাসমিতি করে না, বিধান ও রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয় না, কিন্তু আবহাওয়া অনুকূল করে, বৃষ্টিপাত সম্ভব করে, ভূ-ক্ষয় আটকায়, মাটির নিচে শিকড় চালিয়ে, শিকড়ে জল টেনে বন্যার প্রকোপকে বাধা দেয়, দেশকে কাঁচা মাল যোগায়, বহুজনের অন্নসংস্থান করে। ভারতে বনভূমি শতকরা বিশ থেকে তেইশ ভাগ। পশ্চিমবঙ্গে তা শতকরা তের ভাগ হবে। বন কেটে কৃষিভূমি হাসিল করা এবং জনবসত করানো চলছে তো চলছেই। বনের অবস্থা যখন এই, দেশের মানুষ যখন বনভূমির দরকারই বুঝতে নারাজ, তখন বন্যপ্রাণীর কথা কে ভাববে? আজ ভারতেও বন ও বন্যপ্রাণীর কথা ভাবা হচ্ছে। সেই প্রসঙ্গে এক অজানা জিম করবেটকে আমরা শ্রদ্ধা জানালে ঠিক হত।.ভারতে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জনমত গড়ে তোলার আন্দোলনে করবেটের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাঘ মেরেছেন বলে নয়, বাঘকে বাঁচাবার জন্য নীরবে পাহাড়-পাহাড় বাধা ঠেলে চেষ্টা করছেন দশকের পর দশক, তাই তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয়।
অবশ্যই শিকারী করবেটকে গৌণ করা চলে না। কিন্তু তাঁর শিকার শিকার। জঙ্গলে খেদিয়ে হাতির পিঠে, মাচানে বসে বা গাড়ি থেকে হত্যালীলা নয়। করবেটের সময়ে স্পোর্টের জন্যে শিকার তবু চলত, কেন না বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ছিল বেশি। আজও উন্নত অস্ত্রশস্ত্র এবং চোখধাঁধানো আলো এবং জীপ এবং ভারি পকেটের সহায়তায় শিকারী তৈরি হন, তাঁরা নিজেদের হেমিংওয়ের ইমেজে বসিয়ে। অরণ্য বনাম মানুষ, এই দৃষ্টিকোণ থেকে শিকার নিয়ে সাহিত্য লিখে পৌরুষ প্রতিমা মঞ্চে তোলেন। ট্রাজিডি এবং হাস্যকরতা হল, এখন একটি প্রাণী শিকার করাও অমানবিক, যদি না সে হন্তব্য বলে ঘোষিত হয় সরকারীভাবে। কেন না প্রাণী ও অরণ্য এখন ভারতে অস্ত যাচ্ছে। এঁরাই সংরক্ষণের বিপক্ষে কাজ করেন এবং দেশের বন্যপ্রাণী সম্পদ বিনাসে তৎপর থাকেন। এঁদের মত মানুষদের পূর্বসূরীরা নির্বোধ প্রাণীহত্যা করেছেন বলেই ভারতে প্রাণীজগৎ বিপন্ন হয়েছে। রাজারাজড়া, জমিদার, এঁদের শিকারের রেকর্ড হয়তো সাহসিকতার নয়, এক ধরনের অবিবেকী কাপুরুষতারই দলিল। করবেটের মত শিকারীর হাতে বাঘের অস্তিত্ব বিপন্ন হয় না, এঁদের হাতে হয়। অর্থবলে এঁরা পুরুষের পর পুরুষ ধরে ট্রফি সংগ্রহ করে চলেন। জন্তু দেখলেই মারতে হবে, এ মানুষ-প্রজাতির রক্তলীন বর্বর অসহিষ্ণুতা। সকল শক্তিশালী বন্যপ্রাণী মনে করে নি মানুষ দেখলেই মারতে হবে। প্রাণীজগতে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার শিক্ষা মানুষের চেয়ে বেশি। পশুরা যদি মানুষের মত রক্তপিপাসু হত, তাহলে শ্বাপদসংকুল ভারতে (গত শতকেও বাঘের সংখ্যা ভাবুন) জনসংখ্যা এমন পরমসুখে বৃদ্ধি পেত না। করবেট অন্যজাতের শিকারী। পৃথিবীতে কম প্রখ্যাত শিকারীই তাঁর সঙ্গে নমোচ্চারিত হতে পারেন।
করবেট, যখন নরখাদক মারছেন, তখন থেকেই, এমন কি রুদ্রপ্রয়াগের চিতাকে মারার আগে থেকেই সংরক্ষণের কাজে নেমেছিলেন। বাঘের ছবি তুলে যিনি অমর হয়ে আছেন, সেই এফ. ডব্লু. চ্যাম্পিঅনের ১৯৩৪ সালের এক লেখায় জানছি, সংরক্ষণের স্বপক্ষে জনমত গঠনে ‘য়ুনাইটেড প্রভিন্সেস ব্রাঞ্চ অফ দ্য প্রিজারভেশ্যন অফ দ্য ফনা অফ দ্য এম্পায়ার সোসাইটি’র স্থানীয় সচিব মেজর জিম করবেট বহু প্রচেষ্টা করছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে করবেট ‘মেজর’, ‘কর্নেল’ হন নি, এবং রুদ্রপ্রয়াগের চিতা মারার সময়ে সংবাদপত্রে তিনি ‘মেজর’ বলেই উল্লেখিত হয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে এই সোসাইটি বা সংস্থা ভারত সরকারের প্রচেষ্টিত বা অনুমোদিত এক সরকারী বা আধা-সরকারী সংস্থা।
এটি হল ১৯৩৪ সালের কথা। সংরক্ষণ কাজে ‘বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র ভূমিকা মহামূল্যবান। ১৯২৭ সালে সোসাইটির জার্নালের সম্পাদকমণ্ডলী ‘এম্পায়ার ফনা সোসাইটি’কে সহায়তা করতে এবং সংযুক্ত প্রদেশে উক্ত সোসাইটির সচিব মেজর করবেটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সকলকে অনুরোধ জানাচ্ছেন।
করবেট তাহলে বিশের দশক থেকেই এম্পায়ার সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সংরক্ষণের কাজে সবচেয়ে দরকার বন্যপ্রাণীরক্ষার স্বপক্ষে জনমত গঠন করা। এ কথা তিনি বুঝেছিলেন অনেক আগেই। আর এও বুঝেছিলেন, কতিপয় শ্বেতাঙ্গ বা সরকারী আধিকারিক একথা বোঝা যথেষ্ট নয়। জনসাধারণের বোঝা দরকার, আর সে দুরূহ কাজ কখনোই খোলাখুলিভাবে সরকারী ছাপমারা এক সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশের দশক ভারতের ইতিহাসে এক অস্থির, বিক্ষুব্ধ দশক। ১৯২০-২২ অসহযোগ আন্দোলন হয়, গান্ধীজী জেলে যান। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের পক্ষে দ্যোতক ঘটনা ঘটে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৪) এবং মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯), এই দুটি। ১৯২৭-এ সাইমন কমিশন বর্জন করে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯২৯ সালে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ আইন-অমান্য, খাজনা বন্ধ আন্দোলনের প্রস্তাব নেয়। এই বিক্ষুব্ধ অবস্থা বিশ থেকে তিরিশের দশকে পৌঁছে আরো জোরদার হয়। করবেট যে আন্দোলন করছিলেন, একেবারেই শিক্ষিতজনেরও এক দশমিকাংশের মধ্যে তার সম্ভাব্য পরিসরক্ষেত্র সীমাবদ্ধ। তবু, সাদা চামড়ার মানুষ তিনি, এম্পায়ার ফনা সোসাইটির টিকিট নিয়ে সেই সংকীর্ণ বৃত্তেও ঢোকা কঠিন হত। আর, বেসরকারী সংস্থা ছাড়া কোনো কাজই শেষ অবধি দাঁড়ায় না। সম্ভবত এই সব বুঝেশুনেই, করবেট তিরিশের দশকের শেষার্ধে আবিদ জাফ্রির সহযোগিতায় ‘দ্য অ্যাসোসিয়েশ্যন ফর দ্য প্রিজার্ভেশ্যন অফ গেম ইন্ দ্য য়ুনাইটেড প্রভিন্সেস’ গঠন করেন। এই সংস্থার নাম আমি দুরকম লিখেছি। ‘ইন্’ এবং ‘অফ’ জেনেশুনেই। যাঁরা যে-ভাবে লিখেছেন, তাঁদের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেবার সময়ে সে ভাবে লিখেছি। কোনো সরকারী প্রকাশনার সংস্থাটির নাম পাই নি, অতএব কোন নামটি আদিরূপে অবিকল, তা বলতে পারব না। এই সংস্থার মুখপত্র ‘ইনডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ’ ১৯৩৬–১৯৩৮, তিন বছর বেরোয়। এর প্রথম সংখ্যার প্রকাশকাল ও সংস্থা প্রতিষ্ঠার সময় এক। এই হিসাব ধরলে এই বেসরকারী সংস্থা ১৯৩৬ এ স্থাপিত হয়। আমার ধারণা ১৯৩৫এ। তখন ম্যালকম হেইলি সংযুক্তপ্রদেশের গভর্নর। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে তাঁর খুব উৎসাহ ছিল। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলনের সঙ্গে আমি ‘বন’ কথাটি অগাগোড়া ব্যবহার করলাম। কেননা বন সংরক্ষিত হলে তবেই বন্যপ্রাণী বাঁচে।
এই সংস্থা ভারতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কি ভূমিকা পালন করেছিল, তা ১৯৫৩ সালে প্রাক্তন সামরিক, সংরক্ষণ আন্দোলনের সক্রিয় উৎসাহী আর. ডব্যু, বার্টন সংকলিত ‘দ্য প্রিজার্ভেশ্যন অফ ওয়াইল্ড লাইফ ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে সংকলয়িত লিখিত এক প্রবন্ধ থেকে তুলে দিচ্ছি। ১৯৪৮ সালে লিখিত তাঁরই পুনর্মুদ্রিত প্রবন্ধে বার্টন বলছেন : ‘ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড/অর গেম অ্যাসোসিয়েশন্স – যদি সুসংগঠিত, সুপরিচালিত হয়, তাহলে যেখানে এ রকম সংস্থা আছে, সেখানে এগুলি সুফল দর্শায়। যেমন ধরা যাক ‘দ্য অ্যাসোসিয়েশ্যন ফর দ্য প্রিজার্ভেশ্যন অফ গেম ইন দ্য য়ুনাইটেড প্রভিন্সেস’। ১৯৩৫ সালের জানুয়ারিতে এই সংস্থার মাধ্যমেই দিল্লিতে সর্বভারতীয় বন্যপ্রাণী রক্ষা সম্মেলন হয়েছিল এবং কালাগড় ফরেস্ট ডিভিশনে হেইলি ন্যাশনাল পার্ক স্থাপিত হয়েছিল। সেই সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়, ‘একবার জনমতের সহযোগিতাতেই ভারতীয় বন্যপ্রাণীকে বাঁচানো যেতে পারে। আইন প্রণয়ন, সে যত দক্ষ নিপুণই হোক না কেন, জনসাধারণের সর্বান্তর সমর্থন ব্যতীত কাজে সামান্যই সফল হতে পারে।’
কত সত্যি সে কথা। কোথায় সেই জনমত? কোথায় জনসাধারণের সমর্থন? আজ তেরো বছর বাদে বন্যপ্রাণীর অবস্থা কি?
বার্টন যে কথা ভেবেছেন, একই বইয়ের অন্যত্র আরেকজন সে কথা ভাবেন নি। তিনি সব কৃতিত্ব দিচ্ছেন হেইলিকে। কারণ দ্বিবিধ। ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধু হলেও করবেট সামান্য জন, হেইলি গভর্নর। তাছাড়া, করবেট কাজ করেই খুশি, নাম জাহিরে ব্যস্ত নন। কে বা জানছে কে গড়েছিল সংস্থা, হেইলিকে আগ্রহী করেছিল, সর্বভারতীয় সম্মেলন ঘটিয়েছিল? করবেট পরলোককে বহু জায়গায় ‘Happy hunt- ing ground’ বলেছেন। করবেট ও হেইলি দুজনেই সেই আনন্দময় মৃগয়াক্ষেত্রে গেছেন। কার কৃতিত্ব কে নিল, সে কচকচিতে আর তাঁদের কিছু এসে যায় না আজ। যা হ’ক, সেই বইয়েই এম. এস. রণধাওয়া বলছেন : ‘ভারতে ন্যাশনাল পার্ক বিষয়ক তথ্যগুলির সংক্ষেপসার ডা. বেণীপ্রসাদ এইভাবে করেছেন, ‘প্রদেশের আলোকিতচেতন গভর্নর স্যার ম্যালকম হেইলির মহান ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ফলে ১৯৩৪ সালে সংযুক্তপ্রদেশে এ বিষয়ে বড় রকম অগ্রগতি ঘটেছিল। তার ফলে ১৯৩৪ সালের ন্যাশনাল পার্ক অ্যাক্ট পাস হয়। ন্যাশনাল পার্কসমূহ স্থাপন; বন্যপ্রাণী অথবা বিজ্ঞানের পক্ষে আগ্রহোদ্দীপক অন্যান্য বিষয়ের সংরক্ষণ এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গ; এই অ্যাক্টটিতে এই সব কিছুর ব্যবস্থাই ছিল। ফলে বিখ্যাত পাটলি দুন এবং তার দক্ষিণে প্রায় ৯৯.০৭ বর্গমাইল ব্যাপী পার্বত্য অরণ্যাঞ্চল নিয়ে গঠিত হেইলি পার্ককে ন্যাশনাল পার্ক অভিধায় চিহ্নিত করা হয়। এই আইনে প্রাণী শব্দটির সংজ্ঞা দেওয়া হয় ‘স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ অথবা পাখি।’ ন্যাশনাল পার্কে কোনো প্রাণীকে মারা, জখম করা, উত্যক্ত করা অথবা কোনো পাখির ডিম বা বাসা নষ্ট করা এই আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হয়। যে সব শর্তাধীনে মানুষকে ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশ বা বসবাস করতে দেওয়া হবে তা এই আইনে বলে দেওয়া হয় এবং বনবিভাগের উপর সেগুলি বলবৎ করার অধিকার বর্তায়।
এম. এস. রণধাওয়ার লেখাটি ১৯৫৩ সালে বার্টন সংকলিত বইয়ে বেরোয়। বোঝা যাচ্ছে স্বাধীনতা উত্তর ভারতে অরণ্য বিষয়ে যাঁদের ওয়াকিবহাল মনে করা হত, তাঁদের মন থেকেও জীবিতকালেই করবেটের ‘সংরক্ষিয়িতা’ ইমজেটি মুছে গিয়েছিল। গভর্নর হেইলি নিশ্চয় অরণ্যপ্রাণ ছিলেন, এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা খুবই সহায়ক হয়েছিল। তা বলে দিল্লির সম্মেলন আহ্বান, পাটলি দুনে হেইলি ন্যাশনাল পার্ক স্থাপন, এবং পিছনে করবেট ও জাফ্রি পরিচালিত সংস্থার অবদানের গুরুত্ব কমে না। রাধানাথ শিকদার এভারেস্টের উচ্চতা মাপেন। নামকরণ হয় স্যার জন এভারেস্টের নামে, এ ঘটনা সে আমলে ঘটতে পারে, সহৃদয় ও অনুকম্পায়ী গভর্নরের নামে ন্যাশনাল পার্কের নামকরণও হতে পারে, কেননা দুইটি দীর্ঘসময় আগে পরে ব্রিটিশ শাসনকালীন ঘটনা। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল রাধানাথের অবদান ভুলে যান না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মহল প্রাক্-স্বাধীনতা সংরক্ষণ- প্রয়াসী সংস্থাগুলির প্রতি যেন বড় বেশি উদাসীন ও সেগুলিকে কোনো কৃতিত্ব দিতে নারাজ। কিন্তু করবেট ভারত ত্যাগের পর আলোচ্য সংস্থাটি বোধকরি উঠে যায়। কেননা এদিকে দেখছি ১৯৪৯ সালে ইন্সপেক্টর জেনেরাল অফ ফরেস্টস এম. ডি. চতুর্বেদী বলছেন, ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষা কল্পে অতীতে সংগঠিত সংস্থাগুলি বলতে গেলে কার্যকরী ছিলই না। ‘দ্য অ্যাসোসিয়েশান ফর দ্য প্রিজার্ভেশ্যন অফ গেম ইন দ্য য়ুনাইটেড প্রভিসেস’ বলতে গেলে এক লুপ্তপ্রায় সংস্থা। বহু বছর পরে বনবিভাগ এই সংস্থাকে বছরে ১২০০ টাকার এক অঙ্ক দিয়ে আসছে সহায়তা গ্রান্ট হিসাবে। এ বছর বহু স্মারকপত্র পাঠানো সত্ত্বেও আমি এর সম্পাদকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে উঠতে পারি নি। আর, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত এই গ্রান্ট নিতেও কেউ এগিয়ে আসছে না।’
বোঝা যাচ্ছে ১৯৪৭এ করবেট ভারতত্যাগের পর খুব তাড়াতাড়ি সংস্থাটি উঠে যায়।
এ পর্যন্ত লব্ধ নথিপ্রমাণ থেকে তাহলে এইটুকু আমরা জানতে পারছি, বিশের দশকে করবেট ‘ফনা অফ দ্য এম্পায়ার সোসাইটি’র সদস্য ও স্থানীয় সচিব ছিলেন। তারপর, তিরিশের দশকে তিনিও হাসান আবিদ জাফ্রি ‘দ্য অ্যাসোসিয়েশ্যন ফর দ্য প্রিজার্ভেশ্যন অফ গেম ইন দ্য য়ুনাইটেড প্রভিসেস’ স্থাপন করেন এবং এই সংস্থার মুখপত্র ‘ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ’ প্রকাশ করতে থাকেন। বাঘের ছবি তুলে বিখ্যাত এফ. ডব্লু. চ্যাম্পিঅনের বই ‘উইথ এ ক্যামেরা ইন টাইগার-ল্যান্ড’ এবং ‘দ্য জাংগল ইন সানলাইট অ্যান্ড শ্যাডো’ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯২৭ ও ১৯৩৪ সালে। চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে করবেট ছবি তোলার সহায়তা করেন ও আগাগোড়াই সংরক্ষণ স্বপক্ষে জনমত গঠনের কাজে তাঁর সঙ্গে যুক্ত থাকেন। সর্বভারতীয় বন্যপ্রাণী সম্মেলন আহ্বানে করবেট ও তাঁর সংস্থা এক সক্রিয় ভূমিকা নেন। এই সম্মেলনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা এর পরই ১৯৩৫-এর ‘বন্যপ্রাণী আইন’ প্রণীত হয়। হেইলি ন্যাশনাল পার্ক ভারতের প্রথম ন্যাশনাল পার্ক এবং এটি স্থাপনে করবেটের ভূমিকা ছিল মুখ্য কর্মীর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়ে করবেট যুদ্ধের কাজে চলে যাবার পর ‘ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ’ আর বেরোয় নি।
মি. ব্র্যালিকে করবেটের লেখা যে চিঠির অংশ অন্যত্র উদ্ধৃত করেছি সে চিঠি করবেট ১৯৪৬-এ লেখেন বলে বালকৃষ্ণ শেষাদ্রির ‘দ্য টোয়াইলাইট অফ ইন্ডিয়া’জ ওয়াইল্ড লাইফ বই থেকে জানা যাচ্ছে। সেই চিঠিতেই গত বিশ বছর যাবৎ তিনি বন্যপ্রাণী বাঁচাতে লড়ছেন এই উক্তি আছে এবং ফলে করবেটের সংরক্ষণী কার্যকলাপের প্রারম্ভকালে দাঁড়াচ্ছে ১৯২৬, ১৯৪৬-এও তিনি সমান উদ্বিগ্ন থাকছেন বন্যপ্রাণীর ভবিষ্যৎ বিষয়ে, দেখাই যাচ্ছে। ১৯৪৭-এর নভেম্বরে করবেট আফ্রিকা যাচ্ছেন। ‘চিতল’-এ প্রকাশিত সংবাদ ও আমার পাওয়া অন্যান্য তথ্য সূত্রে জানা যাচ্ছে আফ্রিকাতে গিয়েও তিনি সংরক্ষণী সংস্থা স্থাপন করেছেন, কাগজ বের করেছেন, সে কাগজে লিখেছেন। এ বই পুনর্মুদ্রিত হলে আমরা করবেটের আফ্রিকা বাসকালীন সংরক্ষণী কাজকর্মের পরিচয় দিতে চেষ্টা করব। প্রত্যেকটি চেষ্টাই দেয়ালে মাথা কোটা কেননা একে করবেট স্ফিংক্স্ বা মোনালিজার চেয়েও স্ব-রহস্য গোপনে রাখায় দক্ষ, দ্বিতীয়ত, ১৯৫২ সাল থেকে ‘এ সেন্ট্রাল বোর্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ’ স্থাপন করে ভারত সরকার যখন সংরক্ষণের কাজ গুরুত্ব সহকারে শুরু করলেন, করবেটের সঙ্গে সে কাজের কোনো যোগাযোগও স্বাভাবিকভাবেই থাকে নি। তবে করবেট যে ভারতের সংরক্ষয়িতা ও বন্যপ্রাণী প্রেমীদের মধ্যে অন্যতম মুখ্য পুরুষ, তা বোধহয় বোঝাতে পেরেছি।
আজ সেই আলোতেই করবেটের নতুন, কালোপযোগী মূল্যায়ন প্রয়োজন। খুবই প্রয়োজন, কেননা আজ বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ একটি জাতীয় আবশ্যিকতা। এই একটি কথায় কেন আমি ফিরে ফিরে আসছি, কেন বলছি সংরক্ষয়িতা করবেটই মূখ্যত স্মরণীয় তাই বলি।
এ কথা বলতে গেলে ভারত বন ও বন্যপ্রাণীর কথা সংক্ষেপে না বলে উপায় নেই। বিশ বা দশ বছর আগের কথাও আমি বলব না। কেননা অরণ্য ও আরণ্য প্রাণীর অবস্থা দিন দিন মন্দ হচ্ছে। অবস্থা এমনই, যে দশ বছর আগের পরিসংখ্যায় দেখলেও মনে হবে এত প্রাণীও ছিল। আবার বাঘ, গণ্ডার, ইত্যাদি প্রাণীকে কঠোর প্ররক্ষায় বাঁচিয়ে সংরক্ষণ যেখানে সম্ভব হয়েছে, সেখানে তাদের সংখ্যাও কিছু বেড়েছে।
আজ ভারতের পরিস্থিতি হল, প্রথমত সমগ্র ভারত উপমহাদেশে যতখানি ভূ-সীমা জুড়ে বনাঞ্চল থাকা উচিত, সেই শতকরা তেত্রিশ ভাগে বন নেই। গড়পড়তায় হয়তো বিশ থেকে তেইশ ভাগ (শতকরা) জমিতে বন আছে। রাজ্য বিশেষে সে হিসাবও রেখে চলা যায় নি। যেমন পশ্চিমবঙ্গে বনভূমি আছে সমগ্র ভূসীমার শতকরা তেরভাগ জুড়ে। মানুষের প্রয়োজনে বনভূমির সংকোচন ভারতে কি দ্রুতহারে ঘটেছে, তা বালকৃষ্ণ শেষাদ্রি কয়েক কথায় সুন্দর বলেছেন। তিনি বলছেন, ‘ভারতে যে দ্রুত হারে, নিঃশেষে, প্রকৃতিসৃষ্ট অরণ্য, বন্যপ্রাণীর আবাসভূমির বিনাশ ঘটছে, পৃথিবীর অন্য কোথাও তা হয় নি। গত পঁচিশ বছরে অভয়ারণ্যের ভিতরে ও বাইরে ভারতের বন্যপ্রাণীর বিধ্বংসী ক্ষয় সাধনের জন্য বন-বিনাশ দায়ী। বিশিষ্ট ন্যাচারালিস্ট পিটার স্কট লিখেছেন, ‘আলুর খেত করার জন্য একটি মহান ক্যাথিড্রাল ভেঙে ফেলা যেমন অর্থহীন, তেমনি অর্থহীন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল বিনষ্ট করা।’
নানাবিধ জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প এই বন-বিনাশের জন্য মূখ্যত দায়ী। সেচ ও বিদ্যুৎশক্তি প্রকাশ; জমিতে পুনর্বাসন প্রকল্প; আবাদী হাসিল প্রকল্প; আবাদী জমি হাসিল প্রকল্প; কাঠ সংগ্রহ; বনকেন্দ্রিক শিল্প; সুগন্ধি দ্রব্যের জন্য বৃক্ষরোপণ; শৈল্পিক ও পরিবহণ ব্যবস্থা; এগুলি দেশে জালের মত ছড়িয়ে পড়েছে, ফলে বনভূমি সংকুচিত ও বিনষ্ট হয়েছে, বন্যপ্রাণী লোপ পেয়েছে অসংখ্য। আফ্রিকার বন্যপ্রাণী লোপ পাচ্ছে বলে বিশ্ব-জনমত গড়ে উঠেছে। ভারতের অবস্থা আফ্রিকার মতই সংকটাপন্ন। কিন্তু ভারতের বন্যপ্রাণীর স্বপক্ষে আজও ফলপ্রসূ বিশ্ব জনমত গড়ে ওঠে নি।
প্রকল্পের ফলে কি ভাবে বনভূমি বিনষ্ট হয়? একেকটি বাঁধ প্রকল্প সুবিস্তীর্ণ ভূ-অঞ্চল জুড়ে এক জলধারা সৃষ্টি হয়। ফলে বন বিনষ্ট হয়। প্রাণীজগৎ ধ্বংস হয়ে যায়। তুঙ্গভদ্রা বাঁধ তৈরি হতে সন্নিহিত বন ও বন্যপ্রাণী লোপ পেয়েছে। দাক্ষিণাত্যে নীলগিরি পর্বতাঞ্চলে মোয়ার নদীর কুলের অরণ্য বহুকাল যাবৎ বুনো হাতির স্বভাব-আবাসস্থল। এই নদীতে বাঁধ বেঁধে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি, বনবিনাশ, নির্বিচার গুলি চালনার ফলে বুনো হাতির জীবনযাত্রা, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। পাটলি দুনে রামগঙ্গা নদীর বাঁকে অবস্থিত করবেন ন্যাশনাল পার্ক এই একপেশে প্রকল্পের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। প্রথমে এর নাম ছিল হেইলি ন্যাশনাল পার্ক, তারপর এর নাম হয় রামগঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক, এবং ১৯৫৭-তে এর নাম হয় করবেট ন্যাশনাল পার্ক। ১২৫ বা ততোধিক বর্গমাইল বিস্তৃত, করবেটের স্ব-অঞ্চল এই ন্যাশনাল পার্কের নিসর্গ শোভা অতুলনীয়। রামগঙ্গা নদীতে কালাগড় বাঁধ তৈরি হলে এর অধিকাংশ এলাকা জলে ডুবে যাবে ও বহু বন্যপ্রাণী লোপ পাবে। প্রায় প্রতিটি বাঁধ প্রকল্পই অরণ্যজগতের প্রাণমূল্যে তৈরি বললে বেশি বলা হবে না। প্রকল্প নিশ্চয় প্রয়োজন। কিন্তু বন ও বন্যপ্রাণী কি নিষ্প্রয়োজন; দেশের পক্ষে সবই যদি সমান প্রয়োজন হয়, তবে প্রকল্প রূপায়নকালে ব্যাপারটি যেন মানুষ বনাম বন ও বন্যপ্রাণী। এ রকম রূপ নেয় কেন? শেষাদ্রির বইটি আমি সকল আগ্রহী পাঠককে পড়ে দেখতে বলি। কালাগড় বাঁধ তৈরির সঙ্গে যুক্ত কোনো সিদ্ধান্ত নির্দেশকারী আধিকারিককে বনবিভাগের এক প্রবীণ অফিসার সেই রূপবতী বনভূমি দেখিয়েছিলেন। ট্রাজেডি হল, অন্য জায়গায় বাঁধ তৈরি করা যেত এবং বনভূমি তাতে বিপন্ন হত না। কিন্তু সেই কর্তাব্যক্তি রায় দেন, আশপাশে, শিকারের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বন নিয়ে ন্যাশনাল পার্কের সঙ্গে যোগ করে সমস্যাটির সমাধান করা হবে। এখন তাই করা হচ্ছে। বাঁধ প্রকল্প পরিকল্পনা করেন, রূপায়নের সিদ্ধান্ত করেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী যখন এ রকম, তখন বন ও বন্যপ্রাণী জাতীয় প্রকল্প সমুহে সম্যক মনোযোগ পাবে মনে করা ভুল। অরণ্য থেকে রাজধানী দিল্লি দূর হস্ত। বন্যপ্রাণী সপ্তাহে রেডিওতে বিমূর্ত বন ও কৃষিবিভাগের মূর্ত বাণীরূপ শোনা যায়, প্রাণী হত্যা করতে বারণ করা হয় আবেদনে, বন বিনাশের কথা বলা হয় না। বছরের বাহান্ন সপ্তাহ ধরেই বনবিনাশ চলে। অন্যান্য দপ্তর তাকে স্বাগত জানান, কেননা এ নাকি প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ে মানুষের জিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই ঢালাও বনবিনাশ শুরু হয়। যুদ্ধের পর স্বাধীনতার সময় থেকে বন্দুক ও গুলি আরো সহজপ্রাপ্য হয়। ফলে অবাধ প্রাণীহত্যা চলতে থাকে। অরণ্যভূমে অবাধ গো-মহিষ ভেড়া ও ছাগল চারণের ফলে ভূমিক্ষয় বাড়তে থাকে। তাতে অরণ্যের উর্বরতা কমে। এতকাল গ্রামীণ মানুষ বা আদিবাসীরা মাংসের জন্য পশু মারত। শহুরে ব্যবসায়ীরা চোরাশিকারীদের কাজে লাগিয়ে বাঘ, হরিণের চামড়া ও গন্ডারের শিং সংগ্রহ করত। স্বাধীনতার পর সরকারী ও বেসরকারী লোকজন জীপে চড়ে শিকার শুরু করেন। রাতে জীপ চালিয়ে গুলি ছুঁড়ে সকল প্রাণীকে মারতে মারতে চলার এক নতুন শিকার পদ্ধতি দেখা গেল। এই নতুন জাতের বন্দুকখুশ শিকারী কোন জীবজন্তু মারছেন, এটি শিকারের সময় কিনা, এখন জীবজন্তুর বাচ্চা হবার ও বাচ্চাকে বড় করার সময় কি না, কি মারছেন—মদ্দা না মাদী না শাবক, তা কিছুই বিচার করেন নি। জখম জন্তুকে অনুসরণ করে মারার সময় এঁদের থাকে না। এঁদের এই শিকার রীতি এমন, যে ট্রফি বা মাংস সংগ্রহ তার উদ্দেশ্য নয়। এঁদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ বনবিভাগের সামান্য রেঞ্জার বা বিট অফিসার বা গেম ওয়ার্ডেনের সাধ্যাতীত। কেননা প্রায়ই এঁরা অনেক বেশি শক্তিধর মহলের পোষকতাপুষ্ট। বনবিভাগীয় আইনগুলিও দুর্বল। সেগুলি যথাযথ প্রযুক্ত হলেও দুষ্কৃতকারীর উপযুক্ত শাস্তি তাতে হয় না।
আইনের প্রযুক্তিও হয় না। ১৯৭২ সালের ১৯শে নভেম্বর বাঘ জাতীয় প্রাণী বলে ঘোষিত হয়। তার আগেই শেষাদ্রির বইয়ে দেখছি, ১৯৬৭-৬৮ সালের শীতে দিল্লিতে হাজারখানেক বাঘের চামড়া বিক্রি হয়। একেকটি চামড়া ন্যূনপক্ষে ৫,০০০ টাকায় বিক্রি হয়। বিদেশের বাজারে বাঘের চামড়ার কদর খুব বেশি। খবরটি নাকি ১৯৬৮ সালের মে মাসের ‘চিতল’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল। দিল্লিতেই সংরক্ষণ আইন প্রণীত হয়, দিল্লি রাজধানী, এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।
অবশ্য রাজধানীতে নয়, রাজ্য রাজধানীতেও কর্তৃপক্ষের দপ্তরের নিচেই চলে বর্বরতার ব্যবসা। নিউমার্কেটে সেদিনও বাঘের ছানা দু হাজার টাকায় নিয়মিত বিক্রি হয়েছে। অতি দুষ্প্রাপ্য রেড বা লেসার পান্ডা, যার রপ্তানী একেবারে নিষিদ্ধ তা এখানে বারবারই দেখা যায়। এই সেদিনও,নিউমার্কেটের দোকানে চামড়াঢাকা জীবনপ্রতিম স্টাফকরা বাঘ ও চিতার বড় থেকে শাবক, সব অবস্থার মূর্তি দেখা যেত। কোনোদিন মনেও হয় নি সে বিষয়ে কোনো নিষেধকারী আইন আছে। অথচ আইন হয়, আইন থাকে, ব্যবসা চলে, এরই নাম বুঝি সহাবস্থান।
ফলে ভারতে বন্যপ্রাণীর অবস্থা কি দাঁড়িয়েছে? ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইনে নিম্নোদ্ধৃত প্রাণীগুলি শিকার করা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে :
বিন্টুরং বা ভালুক-বিড়াল; কৃষ্ণসার; থামিন; কারাকাল; চিতা (Cheetah); আমচিতা; ডুগং; মেছোবিড়াল; সোনা বিড়াল; সোনালি হনুমান; বন খরগোশ; উল্লুক; সিংহ; জংলী গাধা; নেকড়ে; হাংগালু; পান্ডা, লাল পান্ডা; কেশরী বানর; কস্তুরী মৃগ; নয়ান; হাঁড়িমুখো বিড়াল; বনরুই; বাসন বরাহ; ভারতীয় এক শৃঙ্গী গন্ডার; নামালি বিড়াল; বড় লজ্জাবতী বানর; তুষার চিতা; চিত্রিত লিনসাং; বারসিঙ্গা; মিশমি টাকিন; তিব্বতী চিংকারা; তিব্বতী জংলী গাধা; বাঘ; উরিয়াল; বুনো মোষ; চিতা; নীলগিরি হনুমান; নীলগিরি থর; কুমির—মেছো কুমির, নোনা কুমির-ঘরিয়াল।
এ ছাড়াও এই তালিকায় আঠার রকমের পাখির নাম আছে। এই আইনে উল্লিখিত প্রাণীগুলি শিকার করা নিষিদ্ধ যেমন বলা হয়েছে, তেমনি কোন কোন পরিস্থিতিতে বা অবস্থায় এগুলি মারলে দণ্ডনীয় অপরাধ হবে না, তাও বলা হয়েছে। স্বার্থান্বেষী ইচ্ছা করলেই বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইনকে নিজের শিকারেচ্ছার স্বপক্ষে ব্যবহার করতে পারেন।
আজ শুধু বাঘ, সিংহ বা গন্ডার নয়, বনরুই বা পিপীলিকাভুককেও সংরক্ষণের আওতায় এনে বাঁচাতে হচ্ছে। ভারতে বন্যপ্রাণীর অবস্থা এত বিপন্ন বলেই জিম করবেটকে আমরা স্মরণ্য, শ্রদ্ধেয় মনে করছি। শিকারী জিম করবেট, লেখক জিম করবেট খুবই বড়। কিন্তু সংরক্ষয়িতা, অরণ্য ও আরণ্য প্রাণীর বন্ধু জিম করবেট আরো বড়। বন সৃজন করে, তৃষ্ণার্ত পাখির জন্য একটি জলাধার তৈরি করে, অরণ্যকে ভালবেসে তাঁর প্রতি আরো বেশি শ্রদ্ধা জানানো যায়। সব পূজা তো এক মন্ত্রে হ না। সকলের বেলা ডাকটিকিট চূড়ান্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি নাও হতে পারে। শুধু কালাগড় বাঁধপ্রকল্প সুবিবেচিত হলেও করবেটের স্মৃতির প্রতি সুবিচার করা হত।
আগেই বলেছি, জিম করবেট আমার প্রিয় মানুষ, বহুকাল ধরে তাঁর বইগুলি আমার বন্ধু। তাঁর শতবার্ষিকী স্মারক অমনিবাস সম্পাদনা করবার সময়েই আমি জানতাম আমি এ কাজের জন্য যোগ্যতম লোক নই। কিন্তু আমাকেই এ কাজ করতে হল। কাজটি করতে গিয়ে বুঝেছি কি দুরূহ কাজে হাত দিয়েছি। করবেট নিজের কথা বলে যান নি কোথাও। যেমন নীরবে বাস করতেন ভারতে, তেমনি নীরবে চলে গেলেন আফ্রিকা। মৃত্যুর কতদিন পরে কাগজে খবর বেরোল। তাও ঠিক কেতামাফিক শোকসংবাদ নয়। তাই কিসে মৃত্যু হল, কাকে কাকে রেখে গেলেন, সবই অস্পষ্ট রয়ে গেল, শুধু জানা গেল ম্যাগি তার পরেও বেঁচেছিলেন।
যেমন বলি ‘ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ’ পত্রিকার কথা। আমার স্পষ্ট মনে ছিল, ১৯৫০-৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগীয় গ্রন্থাগার থেকে সে পত্রিকা তিনটি একজনের সহায়তায় পেয়ে পড়েছিলাম। বড়লাটের শিকারের খেয়াল বা খায়েস মেটাতে গিয়ে বরোদা রাজ্যের স্বর্ণ ঈগল কিভাবে লোপ পায়, সে বিষয়ক প্রবন্ধটি আমার আজও মনে পড়ে। অথচ যখন এই পত্রিকার কথা বলি, কলকাতা শহরে বহু খুঁজে একটি মানুষকেও পেলাম না যিনি এ পত্রিকার কথা জানেন। আমাদের বনবিভাগের গ্রন্থাগার বোধ হয় সম্প্রতি নিরুদ্দিষ্ট। মানুষ নয়, যে ‘ভাই গ্রন্থাগার, ফিরে এস’ বলে বিজ্ঞাপন দেব। জাতীয় গ্রন্থাগারে এ বই ক্যাটালগে নেই। প্রায় সবাই বললেন, যাঃ, ও নামে কোনো পত্রিকা বেরোয় নি কখনো। কেন বললেন, তাও শুনলাম। কেননা যেহেতু তাঁরা দেখেন নি, সেহেতু জিনিসটি নিরস্তিত্ব। তখন আমারও ধারণা হল স্মৃতি ছলনা করেছে। অবশেষে ‘চিতল’ আমায় বাঁচাল। তাতে উল্লেখ দেখার পর হীনমন্যতা কেটে গেল। না, আছে সে পত্রিকা। জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে ‘চিতল’ কি করে ক্যাটালগ্ ছুট্ পত্রিকার এভারেস্ট থেকে পেলাম সদয় আধিকারিকের সহযোগিতায়, সে আরেক শিকার কাহিনী।
তবে বাঘ মারলাম এসপ্লানেডের জাতীয় গ্রন্থাগার : সংবাদপত্র বিভাগে গিয়ে। এ করবেটের কৃপা না হয়ে যায় না। ১৯২৬ সালের ‘দ্য পাইওনিয়ার’ সংবাদপত্রের পাতায় রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতার পিছনে ফিরতি অনামা শিকারীর রিপোর্টটি পড়ে দেখি এ করবেটের লেখা। কিন্তু বিশদ খুঁটিনাটিতে প্রকাশিত বইয়ের সঙ্গে তার রীতিমত বিশদতাগত পার্থক্য। দেখে অসম্ভব উত্তেজিত হয়েছিলাম। এটি এমন চিত্তাকর্ষক ঘটনা। লেখাটিকে করবেটের অপ্রকাশিত লেখা বললেও চলে। পাঠকের কৌতূহল মেটাবার জন্যে আমি সে রিপোর্টের যথাযথ ইংরেজী চেহারা ও বঙ্গানুবাদ, দুই-ই প্রথম খণ্ডে দিয়েছি। জানা গেল অধুনা বোম্বাইনিবাসী আর. ই. হকিন্স করবেটের বই ছাপার সময়ে অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেসে ছিলেন এবং করবেটকে জানতেন। তাঁকে চিঠি লিখলাম। তিনি লিখলেন,
৫৬ ভ্যালেন্টিনা
৫ গামাডিয়া রোড
বম্বে ৪০০ ০২৬,
২২.১২.৭৫
প্রিয় মহাশ্বেতা দেবী,
১৯৭৮ সালে অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেস তাঁদের পঞ্চম শতবার্ষিকী উৎসবের অঙ্গ হিসেবে জিম করবেটের লেখার এক নির্বাচিত সংকলন বের করতে চান। আমাকে ।এই সংকলন তৈরি করতে ও ভূমিকা লিখতে বলা হয়েছে। আমি এই কাজের জন্য সম্মান-মূল্য পাব। অতএব এ বইয়ের কপিরাইট অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেসের থাকছে। যদি আপনার কাজে লাগবে বলে মনে হয়, তাহলে যথাসময়ে আপনি ও য়ু. পি.’র কাছে আমার বইয়ের বঙ্গানুবাদের জন্য অনুমতি চাইবেন।
নৈনিতালের লন্ডন প্রেস জিম করবেটের হয়ে, যে তারিখ অনুল্লেখিত ১০৪ পৃষ্ঠায় ‘জাংগল স্টোরিজ’ ছাপেন, তা হয়তো আপনি দেখেছেন। ৩১.৮.১৯৩২-এর ‘রিভিউ অফ দ্য উইক’ থেকে পুনর্মুদ্রিত একটি লেখা এতে আছে। নাম ‘Wild Life in the Village, an appeal.’ করবেট যে সংরক্ষণের কাজে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন, লেখাটি তার এক প্রদীপ্ত উদাহরণ। তিনি লিখেছেন, ‘A country’s fauna is a sa- cred trust, and I appeal to you not to betray this trust.’ আমি জানি না এখানে কোন ‘রিভিউ অফ দ্য উইক’-এর কথা বলা হয়েছে। তবে জাতীয় গ্রন্থাগার হয়তো সহায়তা করতে পারে এবং করবেট লিখিত অন্য রচনাও আপনি সেখানে পেতে পারেন।
করবেট যে সময়ে ভারত ছেড়ে যান, সেই সময় নাগাদই ‘চিতল’ বেরোতে শুরু করে। তাই করবেট ‘চিতল’-এ লিখবেন সে সম্ভাবনা কম। ‘হগ-হান্টার্স অ্যানুয়েন্স’ ১৯৩০ বা ১৯৩১-এ ‘দি পিপলখানি টাইগার’-এর একটি ভার্শান ছেপেছিলেন। ওই কাগজ এবং ‘ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ’-এ করবেট কোনো লেখা দিয়ে থাকতে পারেন, তবে আমি কিছু দেখি নি।
করবেটের একমাত্র অপ্রকাশিত লেখা যার কথা আমি জানি, যা আমার কাছে আছে তা হল, ‘মাই ইন্ডিয়া’ থেকে বর্জিত একটি অধ্যায়। নৈনিতালের কাছে বছর চোদ্দর একটি বন্য মেয়েকে ধরা নিয়ে লেখা। ১৫.৭.১৯১৪-তে মেয়েটিকে ক্রথ্রোয়েইট হাসপাতালে দেওয়া হয়। কয়েক সপ্তাহ বাদে মেয়েটি বেরিলি অ্যাসাইলামে মারা যায়। সমকালীন সংবাদপত্রগুলি হয়তো মেয়েটিকে ‘নেকড়ে শিশু’ বলে উল্লেখ করে থাকবে। কিন্তু অনুসন্ধান নিয়ে করবেটের মনে হয়েছিল মেয়েটি হয়তো একা থাকত, নইলে সম্ভবত ভালুক বা বুনো কুকুরের সঙ্গে থাকত।
এই ছোট্ট লেখাটি ১৯৭৮ সালের সংকলনে নেব কি না এখনো স্থির করি নি, কবে কপিরাইট আমার নয় এবং এটি অনুবাদ করতে হলে আপনাকেও য়ু পি-র অনুমতি নিতে হবে।
এরমধ্যে, ‘দ্য পাইওনীয়র’ অথবা অন্যত্র করবেট বিষয়ে আপনি যে উল্লেখ পেয়েছেন তা আমাকেও দেখতে দিলে খুবই কৃতজ্ঞ থাকব।
স্বাঃ আর. ই. হকিন্স।
সুখের বিষয় বোম্বাইয়ের অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেসের সৌজন্যে আমরা হকিন্স উল্লিখিত লেখাটি পেয়েছি এবং এই খণ্ডে সন্নিবেশিত করতে পেরেছি। পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত করবেটের অন্যান্য যে সব লেখার সন্ধান পেয়েছি, সেগুলি পরে প্রকাশের ইচ্ছা আমাদের রইল। সুখের বিষয়, সংরক্ষয়িতা করবেট বিষয়ে আরো কেউ কেউ নৈনিতাল ও অন্যত্র কাজ করছেন। আশা করি তাঁদের কাছ থেকেও আমরা লাভবান হব। আমার অক্ষমতার কথা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। তবু, যদি জিম করবেটের জীবন, ব্যক্তিত্ব, সাহিত্য ও কাজের বর্হিরেখাও যদি পরিস্ফুট করতে পেরে থাকি, তাহলেও মনে করব আমার শ্রম সার্থক। আরো সার্থক বোধ করব যদি এই অমনিবাস পড়ে কেউ জিম করবেট বিষয়ে আগ্রহী হন, ভারতের অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী বিষয়ে কারো মমত্ব জাগ্রত হয়।
আমি জানতাম আমার ক্ষমতা কত কম। বহুজনের সহায়তা ব্যতীত একাজ করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল। গবেষণা, তথ্য উদ্ধার এবং করবেটকে পাবার চেষ্টায় প্রভূত সহায়তা পেয়েছি জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রধান ও সংবাদপত্র শাখা থেকে। আগ্রহী বন্ধুবান্ধব সর্বদা সহায়তা করেছেন এবং বিশেষ বলতে হয় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেসের কলকাতা-বোম্বাই-দিল্লী তিনটি অফিস অকুণ্ঠ সহযোগিতা না করলে এ বই কোনোদিন বেরোত না। এই প্রকাশ-সংস্থা শুধু করবেটের গ্রন্থ স্বত্বাধিকারী নন, জিম করবেট তাঁদের অতি প্রিয় মানুষ। অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির সহযোগিতা করেছেন ছবি এঁকে বইগুলি সুন্দর করেছেন খালেদ চৌধুরী।
করবেটের বইয়ের অনুবাদ প্রসঙ্গে একটি কথা। অনুবাদের প্রাথমিক শর্ত মূলানুগতা ও সুখপাঠ্যতা। এই কারণে প্রথম খণ্ডের বইগুলি আমরা পুনর্মাজন ও সংশোধন করি। এই খণ্ডে সন্নিবেশিত প্রতিটি বইই সম্পূর্ণ নতুন করে অনুবাদ করা হল। অনুবাদে সহায়তা করেছেন অনীশ ঘটক, নির্মল ঘোষ ও নন্দিতা মিত্র। এই খণ্ডে সংকলিত বইগুলির প্রথম বাংলা অনুবাদ গ্রন্থগুলির প্রকাশক হলেন মুকুন্দ পাবলিশার্স, সিগনেট প্রেস ও পত্রপুট। এই তিনটি সংস্থার শ্রীকানাই পাকড়াশী, শ্রীনীলিমা দেবী ও শ্রীবিজয় চক্রবর্তীকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
প্রথম খণ্ডে ও জ্যাকেটে দুটি বইয়ের প্রকাশ-বছরে ভুল সাল লেখা হয়েছিল। সেজন্য আমরা দুঃখিত এবং এই ভূমিকায় উল্লেখিত বৎসরাঙ্কগুলিই সঠিক।
এই খণ্ডে সন্নিবেশিত ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরীর নাম-নামান্তর সূচীটির এক বিশেষ মূল্য আছে। প্রত্যক্ষভাবে তার সঙ্গে করবেটের যোগ না থাকুক, যেহেতু করবেট ভারতের বন ও অরণ্য প্রাণী সংরক্ষণে, সাধারণ লোককে সে বিষয়ে জানাতে আগ্রহী ছিলেন, ভারতের বন্যপ্রাণী বিষয়ক এই নাম-সূচী সেই কারণেও করবেট নামাঙ্কিত সংকলনের পক্ষে প্রয়োজনীয় ছিল।
সর্বশেষ ধন্যবাদ প্রকাশকের প্রাপ্য। তাদের যা বলা হয়েছে, তাই করেছেন তারা, এবং সে কাজটি সব সময়ে সোজা ছিল না। বইটি পাঠকের সমর্থন পেলে আমরা মনে করব সকল শ্রম সার্থক, এবং পরের সংস্করণে আমাদের ভুলত্রুটি সংশোধনের সুযোগ পাব।
মহাশ্বেতা দেবী।