এজমালি
জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে একটু আগেই। দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে একবার দেখল সূর্য। না:। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে একেবারে।
দশ ট্রাক জ্বালানি-কাঠ ঢেনকানল থেকে এনে আজই গোলার হাতার মধ্যে আনলোড করেছে হরজিৎ সিং ট্রাকওয়ালা। সেগুলো শেড-এর নীচে নেওয়া গেল না কুলিরা সব পরবের জন্যে ছুটি নিয়ে চলে গেল বলে। কাঠগুলো সব ভিজে একসা হয়ে গেল। দু-তিন দিনের কড়া রোদ পেলে তবেই শুকোবে না-শুকোলে শেড-এর নীচে তোলাও যাবে না। ফরেস্ট কর্পোরেশনের কাঠগুলোও এসে যাবে মনে হয় কালকের মতোই। এদিকে বৃষ্টিরও ছাড় নেই। কতদিন পরে যে আকাশ আজ পরিষ্কার হল! আবার কখন নামবে কে জানে!
চালান করে মালগুলো পারিজাবাবুর আর শশধরবাবুর করাত-কলে পাঠাতে হবে পরশু-তরশুর মধ্যেই। কতরকম যে কাজ থাকে তা বলার নয়। দিনের শেষে নিজেকে মনে হয় ঝড়ের মধ্যে-পড়া ডানা-ভাঙা কোনো পাখি।
মেজোভাই চাঁদ চলে গেছে পাঁচটার সময়ে। পুজোর নাটকের মহড়া শুরু হয়ে গেছে ওদের ক্লাবের। বাখরাবাদ ক্লাব এবারে ভদ্রক থেকে খুব ভালো যাত্রা আনছে। চাঁদরা ‘ছত্রপতি শিবাজি’ করবে। এখন থেকেই রোজই বিকেল পাঁচটাতেই চলে যাবে চাঁদ। পুজোর মাত্র দেড়মাস বাকি। সবচেয়ে ছোটোভাই তারা তো রোজ আসেই না। খুশি হলে আসে, নইলে নয়। যেদিন আসে সেদিন দুজনেই খেতে যায় বাড়িতে বারোটা নাগাদ। ঘুমিয়ে-টুমিয়ে ফেরে তিনটে নাগাদ।
দোকানের দরজা বন্ধ করে তালাগুলো সব লাগাল সূর্য। তার পর তালাগুলোর ওপরে পাকানো-কাগজে আগুন জ্বেলে আরতির মতো করল। বাবা ব্রহ্মা সেন হাতে ধরে তাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছিলেন। এই রিচুয়াল। বিশ্বাস করে কি না জানে না নিজেই, তবু করে আসছে তিরিশ বছরের চেয়ে বেশি। কৃপাসিন্ধু আর বাইধর তালাগুলোটেনেটুনে দেখে নিল ঠিকমতো আটকেছে কি না। চাবির তোড়াটা থলেতে পুরে সাইকেলের ক্যারিয়ারের স্প্রিং-লাগানো ঢাকনার নীচে রাখল। তার পর বলল, কাল সকাল আটটার সময়ে আসব রে বাইধর।
কৃপাসিন্ধু বলল, আমিও চলে আসব আটটারই মধ্যে। কেন্দ্রাপাড়া আর নুয়াগড় থেকে মালও যে আসবে কাল সকাল আটটা নাগাদ।
ক-ট্রাক? আগে তা বলোনি কৃপাসিন্ধু!
সূর্য শুধোল।
বলব কী বড়োবাবু! আপনার কি নি:শ্বাস ফেলার সময় ছিল?
কেন্দ্রাপাড়া থেকে দু-ট্রাক আর নুয়াগড় থেকে তিন ট্রাক।
কী কাঠ রে?
ভালো কাঠ আর কোথায় আছে বাবু দেশে? সরু সরু শাল আর কিছু রসসি আসবে কেন্দ্রাপাড়া থেকে। মিটকুনিয়া, সাহাজ আর বুনো আম আসতে পারে নুয়াগড় থেকে।
হুঁ।
সূর্য স্বগতোক্তি করল। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় প্রকৃতির দেবতা বোধ হয় কোনোদিন তাদের পুরো পরিবারকেই সাংঘাতিক শাস্তি দেবেন নিবিড় অরণ্যকে দুই পুরুষ ধরে এমনভাবে নষ্ট করার জন্যে! নষ্ট এমনিতেই হত। ওরা নিমিত্তমাত্র। মানুষের লোভ আর মানুষের সংখ্যাই সুন্দর সব কিছুকেই একেবারেই নষ্ট করে দেবে যে, সে বিষয়ে সূর্যর কোনোই সন্দেহ নেই।
সাইকেলে উঠল সূর্য। ওরাও যার যার সাইকেলে উঠল। কাঠগোলা প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গেছে। ওই মহল্লা ছাড়িয়ে এসে অন্য মহল্লাতে পড়ল। সেখানেরও প্রায় সব দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। পথে বেশি লোকজনও নেই। কাঠজুরি নদীর পারের রাস্তায় কিছু লোক আর ফেরিওয়ালা আছে। বেশিই কলেজের ছেলে-মেয়ে। নদীপারের চওড়া রাস্তা ছেড়ে দিয়ে ওদের পাড়ার কাঁচারাস্তাতে ঢুকতেই নদীর জলের আর নদীর পারের রাস্তার মিশ্র কলরোল আর কোলাহল থেমে গেল।
নায়েকবাবুর বড়োমেয়ে সরস্বতী রোজকার মতো আজও রিয়াজ করছে। পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হল কাফি ঠাটের কোনো রাগ। এখন আর তেমন ধরতে পারে না সূর্য। সুনন্দা পট্টনায়েকের কাছে নাড়া বেঁধেছে সরস্বতী।
রোজই দোকান বন্ধ করে ফেরার সময় যখন নায়েকবাবুর বাড়ির সামনে আসে তখনই ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়। ও নিজেও ক্লাসিক্যাল গান শিখত একসময়। র্যাভেনশও কলেজে পড়াশোনাও করত। পড়াশুনোতে কিছু খারাপও ছিল না। বাবার একবার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হল। তখনই কলেজ ছাড়িয়ে ওকে ব্যাবসাতে ঢোকালেন উনি। বাবা, ব্রহ্মা সেন বলতেন, ব্যাবসারদের ছেলেরা বেশি পড়াশুনো করলে তাদের গুমোর হয়ে যায়। আর গুমোর হলেই ব্যাবসা মাটি। বেশি বিদ্বান ছেলেরা কি আর দোকানে বসতে চায়?
ফলে, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাটা পর্যন্ত দেওয়া হল না সূর্যর। গান-বাজনা করা তো দূরের কথা। বাবা বলতেন, ব্যাটাছেলে আবার গান গাইবে কী? গান তো গায় বাইজিরা! সেই ব্রহ্মা সেনেরই অনেক পরিবর্তন এসেছিল পরবর্তী জীবনে।
মেজোভাই চাঁদ ওই কলেজ থেকেই বি এ করেছিল। কটকের নামকরা কলেজ। আর ছোটোভাই ওই কলেজ থেকেই বি এ করে ইউনিভার্সিটি থেকে পোলিটিক্যাল সায়ান্স-এ এম এ করেছিল।
চাঁদ ও তারা যে বড়োভাই সূর্যর থেকে বেশি পড়াশুনো করেছে এ কারণে মাঝে মাঝে সূর্যকে অপ্রস্তুত হতে হয়। ভাইয়েরা কিছু বলে না কিন্তু ভায়েদের স্ত্রীদের কথাবার্তায় মাঝেমধ্যে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। সূর্যর স্ত্রী সাবিত্রী স্কুল-ফাইনাল পাস। উত্তর কলকাতার এক ভালো বংশের পড়ে-যাওয়া-অবস্থার বাড়ির মেয়ে সে। মেজোভাই চাঁদের বউ ঝুমরিদের বাড়ি ভুবনেশ্বরে। ঝুমরির বাবা ভুবনেশ্বরের একজন বড়ো ঠিকাদার। বেশ পয়সাওয়ালা পরিবার। ঝুমরি নিজেও বি এ পাস। ঝুমরির বাবা অনেকই দিয়ে থুয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন বলে ঝুমরির দেমাকও খুব। একটি ফিয়াট গাড়িও দিয়েছিলেন। সেটি বিক্রি করে দিয়েছে চাঁদ ক-দিন হল। মারুতি বুক করেছিল, অ্যালটমেন্টের চিঠি পেয়ে গেছে।
ছোটোভাই তারার স্ত্রী চুমকি দক্ষিণ কলকাতার মেয়ে। সেখানকার কলেজেই পড়া। রবীন্দ্রসংগীতের স্কুলের ডিপ্লোমাও আছে। তার পয়সার দেমাক নেই কিন্তু সংস্কৃতি এবং আধুনিকতার দেমাক আছে। ওড়িশাপ্রবাসী এই কাঠ-ব্যবসায়ী পরিবারে চুমকি যেন দয়া করেই এসেছে বউ হয়ে এমনই একটা ভাব।
সূর্য, নারায়ণের কাছ থেকে দুটি পান নিয়ে প্রায় জোর করেই গগনবাবুকে খাওয়াল। গুন্ডির পিক ফেলে বলল আরে, ওরা আজকালকার ছেলে, ওরকমই! যাইহোক, আমিই ওর কাছে ক্ষমা চাইছি। মার্জনা করে দেবেন। আমি তো আপনাকে কখনো অপমান করিনি।
আরে, আপনার কথা কে বলছে? আমি তো আমার ছোটোভায়েদের বলি সবসময়ই!
কী বলেন?
বলি, আমাদের এই কারবারে মানুষ ওই একটাই আছে। সততা আর বিনয় আর কথার দামের আরেক নামই তো ব্যাবসা! না কি? সেই যে সেবার পারাদীপের অত বড়ো সাপ্লাইয়ে কয়েক লাখ টাকা লোকসান দিলেন সে তো কথার দামেরই জন্যে, না কি? সবসময়ই বলি!
সূর্য হেসে বলল, কীসের লোকসান গগনবাবু? যে-সাপ্লাইয়ে লাভের কথা থাকে তাতে হয়ে যায় লোকসান আর যাতে লোকসানের কথা, তাতে লাভ। ডানহাতের তর্জনী তুলে ওপরে দেখিয়ে সূর্য বলল, দাঁড়িপাল্লা নিয়ে ওই ওপরে একজন যে বসে থাকেন, খতিয়ান মেলে; উনিই হরেদরে রেওয়া ঠিকই মিল করে দেন। ওঁর ওপরে ভরসা রাখুন গগনবাবু, চিন্তাভাবনা ওঁর ওপরে ছেড়ে দিন। নিজের বোঝা হালকা লাগবে। আমাদের নিজেদের হাতে কতটুকু আছে?
পান খেতে খেতে গগনবাবু বললেন, ছোটোভাই তারাও কি আলাদা ফার্ম করল নাকি? তারাও শুনি প্রায়ই জাজপুরে যায়। জাজপুরে আমার শ্বশুরবাড়ি তো! ও-ও ওখানে একটা ধান্দা করছে মনে হয়। আপনি কি জানেন এসব? একটু খোঁজখবর রাখবেন সূর্যবাবু। দশটা গাধা মরে একটা বড়োছেলে হয়। আমাকে দেখে শিখুন। কী করলাম সংসারের জন্যে আর কী পেলাম!
সূর্য অনেকখানি গুন্ডির পিক একেবারেই গিলে ফেলল। বলল, আরে, গগনবাবু আমিই তো ওদের পাঠাই। একঝুড়িতে সব ক-টি ডিম রাখা কি ভালো? তা ছাড়া, ওরা তো আমার মতো পুরোনো আমলের লোক নয়। ওদের ভাবনাচিন্তা আলাদা; মডার্ন। তারাটা তো বলেছিল, কম্পিউটারের এজেন্সি নেবে। বিজনেস অফ দ্য ফিউচার। আমি না হয় তেমন লেখাপড়া শিখিনি, ইংরেজি বলতে পারি না ফটাফট করে, খালপাড়ের এই কাঠগোলায় পড়ে থাকা ছাড়া আমার না হয় আর কোনোই উপায় নেই, তা বলে ওরা অন্য কিছু নতুন করবে না কেন! ওদের বুদ্ধিসুদ্ধিই আলাদা!
গগনবাবু সূর্যর কথাতে একটু মনমরা হয়ে গেলেন। ভেবেছিলেন, ভায়েদের এই স্বার্থপরতাতে সূর্য আহত হবে। দু-চার কথা বলেও দেবে ভায়েদের নামে।
বললেন, ও। আপনি তাহলে জানেনই সব! তাহলে তো ভালোই। খুবই ভালো! খুবই ভালো! ডাইভার্সিফাই করা তো ভালোই।
গগনবাবুর জিপ চলে গেলে সূর্য সাইকেলে উঠল। মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল। এসব কোনো কিছুই সূর্য জানত না। ভাইয়েরা পারিবারিক ব্যবসায়ে তাকে সাহায্য না করে, ব্যাবসাতে ঢুকতে না ঢুকতেই নিজেদের আলাদা রোজগারের ধান্দা করতে শুরু করেছে অথচ ব্রহ্মা সেনের কারবারে তিনজনেরই সমান অংশ। কী করবে! বাবা বেঁচে থাকলে অভিমান করে বাবাকে কিছু বলতে পারত। কিন্তু বলেও লাভ বোধ হয় হত না। স্নেহ চিরদিনই নিম্নগামী। বাবা থাকাকালীনই সেকথা সূর্য বুঝতে পেত। ছোটোভায়েদের ব্রহ্মা সেন আলাদা চোখে দেখতেন। মাঝে মাঝেই সূর্যর মনে হত ও বোধ হয় বাবার সৎ ছেলে।
মা ও বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের সিন্দুকে কী ছিল না ছিল তা ভায়েরা সূর্যকে কেউই কিছু বলেনি। সূর্যর জানবার কোনো ঔৎসুক্যও হয়নি কখনো। বাবার মৃত্যুর পরে বলেছিল, মায়ের বাপের বাড়ি সম্বলপুর থেকে বাবাকে লেখা মায়ের কিছু চিঠি ছাড়া বাবার আলমারিতে আর কিছুই ছিল না। মায়ের অসংখ্য দামি গয়না ছিল, মা সাবিত্রীকে দেখিয়ে রেখেছিলেন, এই যে সাবু এইটে আর এইগুলো তোমার, আর এইগুলো হল আমার বড়োছেলের মেয়ের, আমার ছায়া নাতনির! কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর চাঁদ ও তারা বলেছিল, মায়ের কোনো গয়নাই ছিল না। যতটুকু ছিল তা তো একমাত্র বোন দরিয়ার বিয়ের সময়েই সব দিয়ে-থুয়েই গেছেন। ইনকামট্যাক্সের উকিল পাণিগ্রাহীবাবুকে দিয়ে সাফাই গাইয়েছিল।
‘মিসেস সেন-এর ওয়েলথ ট্যাক্স এর রিটার্ন-এ তো কোনো জুয়েলারি দেখানো ছিল না কোনোদিনও। গয়না থাকলে তো দেখানোই হত।’
সূর্য একটিও কথা বলেনি। মনে মনে হেসেছিল। কিন্তু যারা চোখের পাতা একটুও না-কাঁপিয়ে ডাহা মিথ্যে বলতে পারে তাদের কাছে সত্য নিয়ে তর্ক করার মতো নোংরামির মধ্যে সূর্য যায়নি।
সাবিত্রী বিস্ময়ের চোখে চেয়েছিল সূর্যর দিকে, মায়ের কাজের সময়ে। সূর্য চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
সম্পত্তি, জমিজমা, দলিলপত্র ইত্যাদি কোনো বিষয়েই ব্রহ্মা সেন কোনোদিনও বড়োছেলের সঙ্গে পরামর্শ বা আলোচনা করেননি। সবই ছোটোদের সঙ্গে। শুধু ব্যাবসাটার পুরো ভারটা তার কাঁধে চাপিয়ে তাঁকে প্রথমযৌবন থেকেই ন্যুব্জ করে রেখেছিলেন। সেই বোঝার ভার আজও লাঘব হয়নি।
গগনবাবুরই মতন বহু পরিচিত মানুষই বলেছেন সূর্যকে, জমি-বাড়ির দলিল চোখে দেখেননি? আশ্চর্য! অথচ আপনি বড়োছেলে! আপনি আলাদা হয়ে নিজের কারবার করছেন না কেন? আপনিই তো সব!
সূর্য হেসে বলত, আমিই কেন সব হতে যাব? এজমালি ব্যাবসা। আমি বড়োভাই, তাই ঝক্কিটা আমার বেশি। অনেক পরিবারে এই ঝক্কি মেজোভাই বা ছোটোভাইকেও পোহাতে হয়। তা ছাড়া সত্যি বলতে কী, আমার মোটা বুদ্ধিতে এই ব্যাবসাটুকুই আমি বুঝি। বাবার মতো বুদ্ধিমান মানুষ কমই দেখেছি। বাবা ভালো মনে করেছিলেন বলেই ছোটোভায়েদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। মায়ের পেটের ভাইয়েরা কি আমাকে ঠকাবে? তা ছাড়া ওদের বিষয়বুদ্ধি আমার চেয়ে অনেকই বেশি। কাজেরও ওরা অনেক। ছোটোবোন দরিয়ার বিয়ের সময় বিয়ের নিমন্ত্রণের চিঠি ছাপা থেকে, প্যাণ্ডেল বাঁধা থেকে, রসুই ভিয়েন সব কিছু তো ওরাই সামলেছে। সূর্য তো শুধু করেছে আসুন-বসুন। ওরাই তো সব কিছু করে, সবসময়ই। তার পরই ওপরে আঙুল দেখিয়ে তাদের প্রত্যেককেই বলেছে, ওপরওয়ালা আছেন। কারো কপাল তো কেউ নিতে পারে না মশাই। নিতেও পারে না, দিতেও পারে না। ওখানে যেটুকু পাওয়ার কথা লেখা আছে শুধু ওটুকুই আমার বরাদ্দ।
কিন্তু আজকে গগনবাবুর কথা শুনে মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছিল সূর্যর। সেই আগের সূর্য তো আর নেই! অস্তমিত হবার সময় ক্রমশ এগিয়ে আসছে। রক্তের তেমন তেজও আর নেই। নিজের কোনো ছেলেও নেই। একটিমাত্র মেয়ে, ছায়া, তাও বিয়ের বহুদিন পরে হয়েছে। তার বয়েস এখন বারো। মাঝে মাঝে এখন মনে হয় যে তার, সাবিত্রীর এবং ছায়ার ভবিষ্যতের কথা একটু ভাবা হয়তো উচিত এখন।
এইসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ি পৌঁছোল সূর্য। গেট দিয়ে ঢুকেই সাইকেলের ঘণ্টা বাজাল কিরিং-কিরিং করে। চাঁদ-এর ছেলে জ্যোৎস্না আর তারার মেয়ে দ্যুতি দৌড়ে এল ‘জেটু’! ‘জেটু’! করতে করতে। সাইকেলটা রেখে সূর্য তাদের দু-কাঁধে তুলে নিয়ে চকোলেট বার করে দিল।
চাঁদের ছেলে জ্যোৎস্না বলল, জেটু! বাবার মারুতি গাড়ি আসবে সোমবারে।
বা:। তাই না কি? কী রং-এর রে?
সাদা। মা পছন্দ করেছে।
বা:।
ছোটোভাই তারার মেয়ে দ্যুতি বলল, আমাল বাবা মোটলথাইকেল কিনেতে দেতু। দেকবে? দেকো, দেকো! তলো আমাল থঙ্গে তলো। বলেই সূর্যের শার্ট-এর কোনা ধরে টেনে নিয়ে গেল ভাইঝি।
সূর্য দেখল, বাবার আমলে যেখানে বাবার বেবি-অস্টিন গাড়িটা থাকত সেই চালাঘরের নীচে ঝকঝকে জোড়া সাইলেন্সার লাগানো নীল-রঙা হণ্ডা মোটোরবাইক দাঁড়িয়ে আছে।
জ্যোৎস্না বলল, কটকচন্ডী দেবীর কাছে পুজো দিয়ে নিয়ে এসেছে কাকু। ওই দেখো না, জবাফুলের মালা!
আবাল হেলমেট আতে বাবাল!
দ্যুতি বলল।
তাই? বা: কী মজা! আমাদের একটা সাইকেল, একটা মোটরসাইকেল আর একটা মারুতি গাড়ি হল।
দ্যুতি বলল, তোমাল ভাঙা থাইকেলটা ফেলে দাও জেতু।
সূর্য হাসতে হাসতে বলল, দেব রে দেব। নিজেকেও ফেলে দেব এবারে। সাইকেলটার মতো আমিও তো বুড়ো হয়েছি, ভেঙে গেছি।
সূর্যর মেয়ে ছায়া বসবার ঘরে বসে স্কুলের পড়া করছিল। সে একবার ওদের দিকে মুখ তুলে চাইল। মেয়েটার মুখটা বড়ো করুণ দেখাল সূর্যর চোখে।
সাবিত্রীর ওপরেই রান্নাঘরের সব ভার। যদিও রাঁধুনি ও চাকর আছে। মা কোনোদিনই পছন্দ করতেন না যে ছেলেরা রাঁধুনি ও চাকরের রান্না খাক। ডাল-ভাত হয়তো তারা নামিয়ে দিত কিন্তু ভালো পদ এবং ছুটির দিনে শৌখিন পদ মা নিজে রাঁধতেন। বড়োবউ হিসেবে সাবিত্রীকেও অনেক রান্না শিখিয়েছিলেন। সাবিত্রীও শিখে নিয়েছে। আর তো কোনো গুণ নেই বড়োবউ-এর।
ঝুমরি গিটার বাজায়, গাড়ি চালাতে জানে, ইংরিজি গান গায়। চুমকি রবিঠাকুর, হিন্দি ছবি ও বাংলা সাহিত্য গুলে খেয়েছে। কলকাতার অনেক লেখকের সঙ্গেই তার আলাপ আছে। কলকাতায় গেলেই সে তাঁদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে। শুনেও তাজ্জব হয়ে যায় সূর্য। কলকাতার বাঘা বাঘা সাহিত্যিক এবং চিড়িয়াখানার গণ্ডার তার কাছে সমান বিস্ময়ের। এপর্যন্ত দুয়ের একটিও দেখা হয়নি তার। দেখার সাহস এবং সুযোগও নেই। ‘রবিঠাকুর’ও গুলে খেয়েছে ও। ওদের ‘ক্লাস’-ই আলাদা। সূর্য আর সাবিত্রীরা সম্পূর্ণ অন্য ‘ক্লাসের’।
ঘরে এসে শার্টটা হ্যাঙ্গারে টাঙিয়ে রেখে, ধুতিটা কুঁচিয়ে তুলে রাখতে যাবে এমন সময় সাবিত্রী এসে ঘরে ঢুকল। সূর্য বাড়ি ফেরার আগেই সাবিত্রী গা ধুয়ে নেয়, বাড়িতে কাচা ইস্তিরিবিহীন টাটকা শাড়ি পরে। চুল বাঁধে। সিঁদুরের টিপ পরে, বড়ো করে। সূর্য ছাড়া, সাবিত্রীর যে অন্য কোনো গুণ নেই, অবলম্বন নেই, প্রত্যাশা নেই, সেই কথাটাই তার মস্তবড়ো সিঁদুরের টিপ-এর মধ্য দিয়ে প্রচন্ড ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে প্রতিভাত হয়, নীরব বিদ্রোহের মতো।
এই নাও তোমার পান।
সূর্য বলল।
খাব না।
কেন? কী হল!
তুমি কী গো?
কীসের কী?
সেই সাতসকালে আধসেদ্ধ দুটি মুখে দিয়ে দোকানে দৌড়োও সাইকেল ঠেঙিয়ে আর এই আটটা সাড়ে-আটটাতে ফিরে আসো, আর তোমার ছোটোভায়েরা…
সূর্য বলল, আরে ওরা তো ছোটো। ছোটো বলেই না…
কাজের বেলায় তুমি, আর…
আরে, কাউকে তো কাজ করতে হবে। বাবার দোকান নইলে যে উঠে যাবে।
উঠলে তোমার কী ক্ষতি? থেকেই বা তোমার কী লাভ? পাশের বাড়ির ময়নাদি বলেন, তোমার যে ওই বন্ধুরা, ওই হরেনবাবু আর জগদীশবাবু তাঁরাও তো বাবার বড়োছেলে। ব্যাবসাতে তো ছোটোভাইদের একটি চেয়ারও দেয়নি তাতে। তেমন করলেই বোধ হয় ভালো করতে তুমিও।
সূর্য একটু বিরক্তিমাখা গলায় বলল, আমার ভালো নিয়ে তুমি মাথা ঘামিয়ো না। হরেন আর জগদীশ আমার বাল্যবন্ধু হতে পারে কিন্তু ওরা ওদের ছোটোভাইদের প্রতি যে ব্যবহার করেছে তার জন্যে ঈশ্বরের কাছে তাদের শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
ঈশ্বরের সঙ্গে কি তোমার কথা হয় নাকি?
শুধু আমার সঙ্গেই কেন, যাদেরই বিশ্বাস গভীর তাদের সকলের সঙ্গেই হয়। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া জীবনের কোনো প্রাপ্তিই থাকে না সাবিত্রী। এটা ঘোর কলি। ধূর্ত-ধাউড়ে-কুচক্রীতে পৃথিবী ছেয়ে গেছে। কিন্তু তারা কতদূর যায় তুমি এই জীবনেই দেখে নিয়ো। ঈশ্বর-বিশ্বাসের চেয়ে বড়ো সম্পত্তি আর কিছুই হতে পারে না।
তুমি যে কী, তা তুমিই জানো! কটকচন্ডীর মন্দিরে প্রতিসপ্তাহে আমি যাই না?
নিশ্চয়ই যাও। কিন্তু তোমার দৌড় মন্দির অবধিই। কটকচন্ডীর কাছে পৌঁছোনো তোমার হবে কি না জানা নেই। কথাটা বললাম বলে রাগ কোরো না। চানে যাব এবারে। লুঙ্গি-ফতুয়া-গামছা দিয়েছ তো?
দেওয়া আছে।
চান সেরে এসে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসল সূর্য। রোজই বসে। খুব খিদে পেলেও, অফিস থেকে ফিরে চান করে একটু কিছু খেয়ে নেয় ও। তার পর ভায়েদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খাবে বলে অপেক্ষা করে।
কিন্তু আজকাল বেশিরভাগ দিনই ছোটোভাই তারা আর চুমকি, হয় নিজেদের ঘরে খায়, নয় বাইরে কোথাও না কোথাও তাদের নেমন্তন্ন থাকে। ওরা আজকাল ঘরে বসে, খাওয়ার আগে একটু ড্রিঙ্ক করে। চুমকিও খায়। দ্যুতি একদিন বলে দিয়েছিল সূর্যকে। শিশুরা সব ঈশ্বর-ঈশ্বরী। কোনো কোনো দিন হাওয়াটা এইদিকে মোচড় দিলে বারান্দায় বসে গন্ধও পাওয়া যায়।
ওরা খেলে থাক। ওরা মডার্ন, উচ্চশিক্ষিত, ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলে পড়া। চুয়ান্ন বছরের বুড়ো, অশিক্ষিত সূর্য কী বলবে ওদের?
চাঁদ আর ঝুমরিও আজকাল হয় আগে-আগেই খেয়ে নেয়, নয়তো সূর্যর খাওয়া হয়ে গেলে তার পর খায়। যতক্ষণ না সকলে খাচ্ছে ততক্ষণ সাবিত্রীর ডিউটি শেষ হয় না। কোনো কোনো দিন সব কাজ সেরে ঘরে আসতে রাত এগারোটা বেজে যায় তার।
সূর্য তাই কিছুদিন হলই ভাবছে যে ওদের সঙ্গে খাবে বলে খিদে-পেটে বসে না-থেকে, ও-ও দোকান থেকে ফিরেই চান করে খেয়ে নেবে। দুপুরের খাবার তো থাকেই। রাতের রান্না না হলেও তাতেই চলে যাবে।
কিন্তু ভাবছেই। পারে না। ওরা আসুক খাওয়ার ঘরে আর নাই বসুক, এ বাড়ির একতলার এই রান্নাঘরের লাগোয়া এই খাওয়ার ঘরের বড়ো বড়ো পিঁড়িতে, ব্রহ্মা সেনের আমলে যেমন ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় রাত সাড়ে ন-টার সময় বাড়ির সব পুরুষেরা, বাবা ব্রহ্মা সেন, সূর্য, চাঁদ, তারা, গোমস্তা গিরিমশায়, বড়ো বড়ো কাঁটালকাঠের পিঁড়িতে একসঙ্গে খেতে বসতেন, আজও সূর্য তেমনি কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ন-টার সময়েই এসে বসে। ফাঁকা, খাওয়ার ঘরে। বাচ্চারা ন-টার সময়েই খেয়ে নেয়। সূর্য সেন একা বসে খায়। সাবিত্রী, সাবিত্রীরই মতো সামনে বসে থাকে। বামুনদি খাবার এনে দেয়। সাদা বেড়ালটা খাওয়ার ঘরের দরজায় বাঘের মতো বুক ফুলিয়ে বসে পাহারা দেয়। ব্রহ্মা সেনের আমলেও এর পূর্বপুরুষেরা, কালো-ধলো-কি-বাদামি, এমনি করেই বসে থাকত। পুরোনো কথা মনে পড়ে যায় সূর্যর খেতে খেতে। বাবার আমলে খাবার সময়ে খাওয়ার ঘর, রান্নাঘর গমগম করত। বাবা, তিন ছেলে, গিরিবাবু খেতেন আর মা, সাবিত্রী, ঠাকুর, চাকরেরা তত্ত্বাবধান করত! এখন বাইরের উঠোনের পেঁপে গাছে তক্ষক ডাকে। বলে ঠিক। ঠিক। ঠিক। নি:শব্দ খাওয়ার ঘরে তক্ষকের ডাকটা ঠিকরে আসে। সূর্য যখন খায়, তখন কোনোদিন চাঁদের ঘর থেকে ক্যাসেট প্লেয়ারে ইংরিজি গান ভেসে আসে। কোনো কোনোদিন ভি সি আর-এ ছবি দেখে ওরা। কোনো কোনো দিন দরজা-জানালা বন্ধ করে জ্যোৎস্নাকে সাবিত্রীর জিম্মায় পাঠিয়ে দিয়ে দেখে। কী ছবি, কে জানে!
চুমকি আর তারার ঘর থেকে বিখ্যাত কবিদের স্বরচিত কবিতার আবৃত্তি ভেসে আসে। ক্যাসেটের মাধ্যমে। কোনো কোনো দিন বাণী ঠাকুর বা গীতা ঘটকের রবীন্দ্রসংগীত।
সাবিত্রী বলল, কিছু একটা করা উচিত তোমার। পেছোতে পেছোতে, দাম বইতে বইতে তুমি তো একেবারে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছ। তোমাদের দোকানের লাভের অংশ তো সকলেরই সমান কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমি অন্যদের চাকর। এটা আমার কথা নয় পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সকলেই এই কথা বলে।
সব পরিবারেই কাউকে চাকর হতে হয় সাবিত্রী, প্রত্যেক যৌথ-পরিবারেই। নইলে কারবার থাকে না। নিজেকে চাকর ভাবলেই চাকর, আর মালিক, ভাবলেই মালিক! এ তো ভাবাভাবিরই ব্যাপার।
আচ্ছা, আমি না হয় বাঁদি, আমার জায়েদের ঝি! কিন্তু তুমিও কি কেউ নও? তোমার কি মানুষের মতো বাঁচতে ইচ্ছে করে না একদিনের জন্যে? ধুতি-জামা, তাও দু-দিন পরা চাই। বাহন, সেই মান্ধাতার আমলের ভাঙা সাইকেল। পায়ে তালি-মারা কাবলি-জুতো। বয়েস যার দশ।
সূর্য হেসে বলল, বাবা কী বলতেন জানো? বলতেন, ‘আ রুপি সেভড ইজ আ রুপি আর্নড।’ বুঝেছ? যতক্ষণ জুতো পা থেকে খুলে না পড়ে যায় ততক্ষণ বদলাতে যাব কোন দুঃখে? তা ছাড়া ‘আমার আমার’ করো কেন? সব তো আমাদেরই। মোটরসাইকেল, গাড়ি সবই তো আছে আমাদের বাড়িতে। এটা ব্রহ্মা সেনের বাড়ি। তাঁর ব্যাবসা, তাঁর জমিজমা থেকেই সবকিছু হয়েছে এটা ভুলে যেয়ো না।
ঠিক আছে। আমাদেরই যদি সব তবে সে গাড়িতে একদিনও কি আমি তুমি চড়েছি? আমার দরকারও নেই। তোমার মতো নই আমি। আমার আত্মসম্মান আছে।
আমার কথা ছাড়ো, তোমার মেয়ের কী হবে? এরা যেরকম স্বার্থপর দেখছি, মেয়েটার যে বিয়ে পর্যন্ত দিতে পারব না। তুমি যদি হঠাৎ চলে যাও, আমার যে কী হবে!
সূর্য হাসল। বলল, হঠাৎ? শুধু আমি কেন? সকলকেই তো হঠাৎই চলে যেতে হবে। বলে কয়ে আর ক-জন যেতে পারে বলো? তবে তোমার মেয়ের কথা? এই শুনে নাও সাবিত্রী। তোমার মেয়েকে বাড়ি বয়ে এসে খুবই ভালো পরিবারের ছেলে উপযাচক হয়ে নিয়ে যাবে। দেনা-পাওনার কথা তুলবে পর্যন্ত না। কোনো চিন্তা কোরো না। তোমার কীসের অভাব? তোমার কী নেই যে, আমার ছোটোভায়েদের তুমি ঈর্ষা করো?
ঈর্ষা করি? ছি:। আমার কী আছে? আমার জায়েদের তো পা থেকে মাথা পর্যন্ত গয়নায় মোড়া। এত গয়না তারা পেল কোথায়? পায় কোথায়? আর আমি, তোমার স্ত্রী!
গয়না? গয়না একটা ঈর্ষা করার জিনিস হল সাবিত্রী? গয়না নিয়ে গর্ব করে শুধু নির্গুণ আর অশিক্ষিতরা! ছি:!
বেশি শিক্ষা দেখিয়ো না। নিজে তো ইন্টারমিডিয়েটও পাস না করে কলেজ ছেড়েছিলে। আমি স্কুল ফাইনাল! আমার চেয়ে তুমি বেশি কী?
সাবিত্রী খুবই রেগে গিয়ে বলল।
অবশ্য নীচু গলায়।
কিছুক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে থেকে সূর্য বলল, শিক্ষার অনেকই রকম হয়। এক ধরনের শিক্ষা মানুষ প্রতিষ্ঠান থেকে; মানে, ভালো স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পায় আর অন্য এক ধরনের শিক্ষা নিজের ভেতরে ভেতরে গড়ে নেয়। পাঁচটা পাস দিয়েও মানুষ অশিক্ষিত থাকতে পারে আবার একটাও পাস না দিয়েও উচ্চশিক্ষিত হতে পারে। শিক্ষা আর ডিগ্রির পাকানো কাগজ এককথা নয়। বিশেষ করে, এই দেশে।
তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই না।
তোমার মন আজ ভালো নেই, কোনো কারণে। এসো সাবু, আমার পাশে এসে বোসো, মোড়াটা নিয়ে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে, দেখো, আকাশটা। মনে হচ্ছে, পুজো বুঝি এসেই গেছে। কী নীল আকাশ! চাঁদ ছমছম করছে পেঁজা-তুলোর মতো সাদা মেঘে মেঘে। ও ভালোকথা। পুজোর লিস্টিটা বানিয়ে ফেলো। আর তো দেড়মাসও বাকি নেই। চাকর-বাকর, দোকানের কর্মচারীরা, আত্মীয়স্বজন, কেউই যেন বাদ না যায়। এ বছর তোমাকে পাঁচ হাজার টাকা বেশি দেব।
সাবিত্রী বলল, তোমাকে বলব বলব করে বলা হয়নি, ঝুমরি আর চুমকি বলেছে যে ওদের পুজোর টাকা আলাদা করে দিতে। মানে স্বামীদের অংশ। ওদের বাপের বাড়ির লোকজন, বন্ধুবান্ধব, চাকরবাকর সব ওরা নিজেরাই নিজেদের হিসেবমতো দেবে। বলেছে, তা ছাড়া রুচিরও একটা ব্যাপার আছে। আমি যা কিনি তা প্রায় কারোরই পছন্দ হয় না।
সূর্য চেয়ারে উঠে বসল। বলল, তাই! তা হবে। মানে, হতেই পারে। রুচি ব্যাপারটা তো নিশ্চয়ই নিজস্ব। আমাদেরই উচিত ছিল এই ব্যাপারটার কথা ভাবা অনেক আগে। তা ছাড়া ওরাও তো বড়ো হয়েছে। সত্যিই তো! এবারে তাই দিয়ো। ওদের টাকাটা আলাদা করেই ধরে নিয়ো। ভালোই হল, তোমার ঝক্কি কমে গেল।
তোমার বোন দরিয়াও রাগ করে চিঠি দিয়েছে যে দাদা কাজে এতই কি ব্যস্ত থাকে যে মাঝে মাঝে চিঠি লিখে খোঁজ নিতেও পারে না। টাকাই সব নয় সংসারে। পয়লা বৈশাখে, আর পুজোয় আর ভাইফোঁটায় টাকা পাঠালেই ভালোবাসা দেখানো হয় না। টাকা পাঠাতে তোমাকে মানা করেছে দরিয়া।
সূর্যর গলা এবারে গম্ভীর শোনাল। বলল, তাই বলেছে। দরিয়া? চিঠি লেখার অভ্যেসই যে নেই আমার। কাউকেই তো লিখি না। যাক। টাকা ওকে আর কারা পাঠায়? টাকা বুঝি কষ্ট করে রোজগার করতে হয় না? কাউকে কিছু দেওয়া মানেই নিজেকে কিছু থেকে বঞ্চিত করা। নিজেকে; নিজের পরিবারকে।
তার পর স্বগতোক্তির মতো বলল সূর্য, সংসারে অনেকেরই অনেক থাকে হয়তো কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেরই অন্যকে স্বার্থহীনভাবে দেওয়ার মন থাকে না। এ তো জানাই ছিল। আজকে জানলাম, এ সংসারে নেওয়ার মন নিয়েও কম লোকই আসে। হৃদয়ের অতটুকু ঔদার্যও যে কেন বিধাতা তাঁদের দেন না। ভারি মজার জায়গা কিন্তু এই পৃথিবী!
সাবিত্রী বলল, তোমার ভায়েরা বলেছে যে, দোকানের কর্মচারীদের আলাদা করে কিছু দেওয়ার রেওয়াজটাও আদিখ্যেতা। ওরা তো বোনাস পায়ই!
হা:। সে আর ক-টা টাকা! এই বাজারে! কিন্তু ওরা বলেছে একথা? কবে?
পরশু।
ঠিক আছে। ওদের টাকা আলাদা করে দিয়ে দেব। আমি আমার একার অংশ থেকেই দোকানের কর্মচারীদের দেব পুজোতে। এতদিন দিয়ে এসেছি, আর…
বাবার আমলেও নাকি এইসব কোনোদিনও দেওয়া হয়নি? তুমিই বা কেন…
সূর্য অবাক হল। বলল, একথাও বলেছে ওরা তোমাকে? একথাটা ভুল বলেনি। বাবার আমলে দেওয়া হয়নি যে তা ঠিকই। কিন্তু এটা যে আমারই আমল সাবিত্রী!
আর হাসিয়ো না। তোমার আমল! যেন কোনো সাম্রাজ্যের মহারাজ তুমি! তুমি তো বান্দা! তুমি অন্ধ। তুমি কী…তুমি কি মানুষ? না ভগবান? না, তুমি ভূত?
সূর্য হো হো করে হেসে উঠল জোরে।
তার পর পাশে-বসা অবাক-হওয়া স্ত্রীর হাতের ওপর নিজের হাতটি রেখে বলল, সাবিত্রী, আমি দাদা! আমি দাদা যে!