এখানে কেউ দেবতা নয়

এখানে কেউ দেবতা নয়

সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এন্তার খিস্তির আওয়াজ কানে এল বিশাখার, এই সময়ে নবজ্যাঠা সকালের কাগজ নিয়ে বসেন, এবং খিস্তি করেন৷ মানে রোজ যেমন খবর থাকে আর কী, কখনও সরকারপক্ষ, কখনও বিরোধী পক্ষ, কখনও ডাক্তারদের, আবার কখনও সকালের ঝি না এলে মায়ের চিলচিৎকারে গলা মেলান, ‘ছাড়িয়ে দাও না মাগিকে, পয়সাকড়ি যা বাকি আছে, মুখে ফেলে দূর করে দাও… কাজের ঝি, তার আবার ট্যাঙস-ট্যাঙস কথা…’

মোট কথা, রোজই এই খেউড় শুনতে শুনতে বাড়ি থেকে বের হয় বিশাখা, সেই সময়ে উকিলপাড়ার কতকগুলো হারামি ছেলে বাড়ির সামনে দিয়ে পড়তে যায়, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভেসে-আসা গালাগালি উপভোগ করে ওরা৷ গালির মাত্রা কমে এলে আবার সামনের পথে পা বাড়ায়৷ আজও ছেলেগুলোকে দেখতে পেল বিশাখা৷ অন্যদিন দেখেও দ্যাখে না, আজ মাথাটা গরম ছিল, গলা তুলে বলল, ‘কাজ নেই শালা তোদের, বুড়ো ঢোকনাটার গালাগালিতে এত রসের কী আছে কে জানে?’

দলের মধ্যে থেকে একটা ফাজিল ছেলে ঘাড় চুলকে বলে, ‘কাল আমাদের পাড়ার কাউন্সিলরকে হারামি বলেছে, আজ ফোন নিয়ে এসেছি, রেকর্ড করব বলে, লাগিয়ে দিলে শালা হেব্বি কিচাইন হবে… হেঁ হেঁ…’

বিশাখা আর কান দেয় না এসবে৷ আজ মাথাটা ঠান্ডা রাখা দরকার৷ চাকরির একটা ইন্টারভিউ আছে৷ তা ছাড়া সেটা হয়ে গেল আরও দু-এক জায়গায় যেতে হবে৷ এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে সময় আর মুড দুটোরই বারোটা বাজবে৷ কলতলা ছেড়ে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এল সে৷ বাইরে চাঁদিফাটানো রোদ, সেই তাপে সমস্ত রাস্তাটাও গরম তাওয়ার মতো তেতে রয়েছে৷ আজ বুট পরেছে বিশাখা, পায়ের তলাতে ক্রমাগত আগুনের হলকার মতো তাপ লাগছে৷ রাস্তা ধরে খানিকটা এগোনোর পর নবজ্যাঠার চিৎকারটা কমে এল৷ সেই জায়গাটা দখল করল গাড়িঘোড়া আর লোকজনের হইহল্লা৷ দুপুরের ব্যস্ত কলকাতা, নোংরা ঠ্যালাগাড়িতে ছেঁড়া-গামছা ঢাকা কলকবজা, অটো, রিকশা আর ট্যাক্সির অনবরত কানফাটানো হর্ন৷ এই শহরে প্রতিদিন লাথি-খাওয়া ফ্রাস্ট্রেটেড আম-আদমি হর্ন বাজিয়ে নিজেদের জমানো ফ্রাস্ট্রেশন বের করে, কেউ থুতু ফ্যালে, কেউ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করে, শিক্ষিত ছোটোলোকদের এক আজব চিড়িয়াখানা৷

বিশাখা মোড়ের মাথায় দোকানে সিগারেট কেনে৷ গোল্ডফ্লেক, তারপর দোকান থেকে দেশলাই নিয়ে সেটা ধরিয়ে একটা বড়োসড়ো টান দেয়৷ পান কিনতে আসা একটা মাড়োয়ারি আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ফিচকে ফিচকে হাসতে থাকে৷ খানিকটা বিশাখাকে শুনিয়েই দোকানদারকে বলে, ‘ক্যা জমানা আয়া রে বাবু, লেড়কি ভি পিতি হ্যায়…’

বিশাখা আগেও লক্ষ করেছে পান-বিড়ির দোকানদারদের কোনও পারসোনাল ওপিনিয়ন নেই৷ দোকানের কাস্টমার যা বলছে, সেটাকেই তারা তাৎক্ষণিক ওপিনিয়ন করে নেয়, তারপর মাথা দোলায়৷ এটাও ওদের ব্যবসার অঙ্গ, ওরা সহমত ব্যাচে৷ এই মুহূর্তে বিশাখা দূরে দাঁড়িয়ে আছে এবং সিগারেটের থেকে পানের দাম বেশি বলে মাথা নাড়ায় দোকানদার৷ বিশাখা ব্যাপারটা গায়ে না মেখে আরও কিছু দূর এগিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে সরে আসে৷

অফিস টাইম, গিজগিজ করছে লোক৷ সেই সঙ্গে কয়েকটা ভিখারি৷ ভিখারিদের গো-অ্যাজ-ইউ-লাইক৷ কেউ কানা-খোঁড়া সেজেছে, কেউ সামনে ছেলের ক্যানসারের কাগজপত্র রেখেছে, আবার কেউ গলায় রুদ্রাক্ষের মালা কি তাবিজ বেঁধে ধার্মিক সেজেছে৷ এক শিড়িঙ্গে মহিলা বাঁ হাতে মা শীতলার ছবি তুলে ধরে ডান হাতটা বিশাখার দিকে বাড়িয়ে দেয়, ‘শ্যাতলা মায়ের পুজো, কিছু সাহায্য করো মা৷’

‘মাপ করো’ কপালে হাত ঠেকিয়ে এগিয়ে যায় বিশাখা, সঙ্গে সঙ্গে পায়ে ল্যাং খায়, একটা নোংরাটে বুড়ো লোক বিশাখার দু-পায়ের মাঝখান দিয়ে হাত গলিয়ে ল্যাং মেরেছে, মিটিমিটি চেয়ে আছে ওর মুখের দিকে, ‘আল্লা কে নাম পে…’

‘ধুর বালটা…’

বিরক্ত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসে সে৷ বাস এলে এখানেই এসে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা বেশি৷ তবে আগে থেকে গ্যারান্টি দিয়ে কিছু বলা যায় না৷ একটা সময় ছিল যখন রাস্তার যে জায়গাটায় বেশি লোক জটলা করে থাকত, সেইখানে দরজাটা রেখেই বাস দাঁড় করাত ড্রাইভার৷ এখন সে-ও ফ্রাস্ট্রেশন বের করে, জটলা থেকে খানিকটা এগিয়ে দাঁড় করায়, আর অমনি ভ্যাদভেদে মোটা বাঙালি পড়ি কি মরি করে দৌড়োতে থাকে৷ বাস ড্রাইভার দাঁত ক্যালায়৷ বিশাখা জটলা থেকে একটু এগিয়েই দাঁড়াল৷ এই সমাজে খাপ খাওয়ানোর একটা বড়ো উপায় হল নিজেকে অন্যের ফ্রাস্ট্রেশনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া৷ বাপ-মা, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বয়ফ্রেন্ড৷ ফ্রয়েড বলেছিলেন সমাজকে চালায় সেক্স, মার্কস বলেছিলেন পয়সা, বিশাখা বুঝে নিয়েছে, সমাজের চালিকা-শক্তি হল ফ্রাস্ট্রেশন৷ যেটা জন্ম নেয় গতকালের ফ্রাস্ট্রেশন থেকে৷

দূর থেকে একটা বাস আসতে দেখেই জনতা সতর্ক হয়ে ওঠে৷ কেউ কেউ পিঠের ব্যাগ খুলে সদ্যোজাত শিশুর মতো বুকে ঝুলিয়ে নেয়, মানিব্যাগ আর চশমা খুলে ব্যাগের ভিতরে চালান করে, বিশাখাও৷ ওর ব্যাগে মহার্ঘ কিছু নেই৷ তবে অবাঞ্ছিত হাতের থেকে বুক আড়াল করা দরকার৷ বাস এসে দাঁড়াতে আবার শুরু হল র‌্যাটরেস৷ বাসে ওঠার নিয়ম বেশ সিম্পল৷ মাঝামাঝি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পিঠ পেতে দাও, হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দাও, কী ধরছ, সেটা দেখার দরকার নেই৷ এরপর পিঠের উপরে চাপ, গুঁতো, কিল, ঠেলা, কনুইয়ের তোড়ে বাসে না উঠে থাকে কারও বাবার সাধ্য নেই৷ সোজা কথা হল, এখানে বাসে ওঠার প্রধান অস্ত্র হল পিছনের লোকের বাসে ওঠার ইচ্ছে৷ সেইভাবেই উঠে পড়ল বিশাখা৷

বাসের ভিতরটা তেমন একটা ভিড় নেই৷ লেডিজ সিটে দুটো জায়গা ফাঁকা পেয়ে দু-জন মাঝবয়সি লোক সেগুলো আগলে বসে ছিল৷ বিশাখা সামনে গিয়ে দাঁড়াতে তারা দু-জনের চোখাচোখি করল একবার৷ কার সিট ছেড়ে দেওয়া উচিত সেই নিয়ে খানিক নীরব মুহূর্ত কাটল, তারপর যার বয়স অপেক্ষাকৃত কম, সেই উঠে দাঁড়াতে বিশাখা সেখানে গিয়ে বসে পড়ল৷ বাস ভরতি হয়ে যেতে কনডাকটর চিৎকার শুরু হল, ‘মানিকতলা, ডালহৌসি, খালি গাড়ি খালি গাড়ি…’

রুমাল দিয়ে মুখ মুছল বিশাখা৷ এতক্ষণে খানিকটা শান্তিতে বসে থাকা যাবে৷ আশপাশে নানারকম ব্যাপার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে৷ রাজনীতি, খেলাধুলা, মানুষ সকালবেলা কষ্ট করে খবরের কাগজ পড়ে সমালোচনা করার জন্য৷ আনন্দবাজার পাঁচ টাকা৷ করবে না-ই বা কেন? এর মাঝে কেউ কেউ কানে ইয়ারফোন গুঁজে কী যেন শুনছে৷ পাশ থেকে কয়েকটা হ্যালেহেলে বুড়ো নাক সিটকাচ্ছে, ‘এখন সব হয়েছে এই কানে তার৷ এত গান শুনতে ইচ্ছা হয় তো বাড়িতে শোন৷’ এইখানে আলোচনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না৷ আবার সমালোচনা, সরকার, রাস্তাঘাট, হিন্দু-মুসলমান লেগে যা নারদ নারদ৷ দু-দিন আগে বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তার ধারে ধারে খানিকটা জল জমেছে, সেই নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা শুরু করেছে, আচমকা একটা মজার ব্যাপার চোখে পড়ল বিশাখার৷ জমা জলের পাশ দিয়ে কয়েকটা ঠেলাওয়ালা কী যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের খালি পা, রোদে পুড়তে পুড়তে গা পিচের মতো কালো হয়ে গিয়েছে, মাথার বাঁধা গামছা থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়ছে৷ ব্যাপারটা দেখে বাসের কনডাকটরের দাঁতের ফাঁকে একটা সরু হাসি খেলে গেল, সে চিৎকার থামিয়ে মুখ তুলে ড্রাইভারকে বলল, ‘দিবি নাকি রে শালাদের?’

ড্রাইভার পিছনে মুখ ঘুরিয়ে দেঁতো হাসি হেসে রাস্তার একপাশে নিয়ে এল বাসটা, তারপর সুযোগ বুঝে ঠেলাওলাদের কিছু বুঝে ওঠার আগেই জলের উপর দিয়ে সবেগে চালিয়ে দিল গাড়িটা৷ নোংরা জল প্রায় এক মানুষ সমান লাফিয়ে উঠে ভিজিয়ে দিল ঘর্মাক্ত লোকগুলোকে৷ তাদের ছাদহীন ঠেলাগাড়িগুলোকেও নোংরা করে দিল বর্ষার জল৷ লোকগুলো উঁচু গলায় কী একটা খিস্তি দিয়ে উঠল৷ কনডাকটর দরজায় ঝুলতে ঝুলতে পিছন ফিরে গলা তুলে বলল, ‘কতদিন চান করিস না শালারা, একটু ধুইয়ে দিয়ে গেলাম৷’

মজা লাগল বিশাখার, সে অল্প হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা চেনা মুখ চোখে পড়তেই মনটা খিঁচিয়ে গেল বাণীমাসি ও তার হাজব্যান্ড নিলুদা৷ ছোটোবেলায় একবার নিলুদার কাছে ইংরেজি পড়তে গিয়েছিল বিশাখা৷ তখন নিলুদা বেকার, টিউশনি পড়িয়ে কোনওরকমে পড়াশোনা চালাত৷ আর সুযোগ পেলে বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গে ইন্টুমিন্টু করত৷ বাণীমাসির সঙ্গে প্রেমটা ছিল বহুদিনের৷ বিয়ের আগে আগে জামাকাপড়ের একটা দোকান দেয় নিলুদা৷ সেটা বেশ লাভের মুখ দেখায় টিউশনিগুলো ছেড়ে দেয়৷ শোনা যায় বেশ কিছু কর্মচারীর টাকা মেরে দিয়েছে নিলুদা৷ রাস্তায় একদিন ক্যালানিও খেতে যাচ্ছিল কিন্তু পার্টি লেভেলে জানাশোনা থাকায় পার পেয়ে যায়৷ এই মুহূর্তে বিশাখার ঠিক পিছনের সিটে বসেছে দু-জনে, বাণীমাসির হাতটা বিশাখার চুলের উপরে রাখা৷ কেউ চুলে হাত দিলে মাথা গরম হয়ে যায় বিশাখার, সে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করল৷

‘অপিস যাচ্চিস নাকি?’ ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল বাণীমাসি৷ বিশাখার মাথাটা একপরত বেশি গরম হল৷ এই জানোয়ারগুলো ভালো করে জানে, বিশাখা চাকরি করে না৷ চাকরির চেষ্টায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়৷ এবং জানে বলেই বারবার জিজ্ঞেস করে৷

‘না না৷ একটু দরকার ছিল আসলে৷’ কথাটা বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় বিশাখা৷ প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷

‘তা কী করছিস এখন?’ জুতোর নীচে আটকে-যাওয়া চিউয়িংগামের মতো প্রশ্ন থেকে নড়তে চায় না বাণীমাসি৷

‘সেরকম কিছুই তো করছি না৷ এই দেখি কী করা যায়৷’

বিশাখা জানে, এ উত্তরটা মধ্যবিত্ত পাশের বাড়ির কাকু-কাকিমাকে স্বর্গীয় আনন্দ দেয়৷ সেই আনন্দে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে বাণীমাসি৷ নিলুদা নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, ‘তুই তো আবার সেই কবিতা-টোবিতা লিখতিস না? পড়েছিলাম এককালে৷ বেশ ভালো লিখতিস৷’

‘গানও তো গাইতিস, রেওয়াজ করতে শুনেছি কত৷’

বাইরে গনগনে রোদ আরও তীব্র হয়ে ওঠে৷ বিশাখার মাথার ভিতরে চাপা যন্ত্রণা শুরু হয়৷ ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যায়৷ নিলুদার কাছে কোচিং সেরে ফিরে গান নিয়ে বসত সে৷ তখন মাথার দু-পাশে দুলন্ত ঝুঁটি বাঁধা থাকত৷ বিকেলের শেষে একটু একটু করে ঠান্ডা হয়ে আসত শরীর৷ পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসত শাঁখের আওয়াজ, সন্ধের কাঁসর, বিশাখা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইত৷ কারও কাছে শেখেনি সে৷ না নাচ, না গান, না ছবি আঁকা৷ সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, সত্যিকারের শেখা শুধু সেইটুকুনি, যেটুকু আমরা নিজেরা শিখি৷ বিশাখার মনে গুনগুন করে একটা গান ভেসে এল৷ এই উৎকট গরমে, ভিড়ে, অফিসযাত্রীদের ঘামের গন্ধে, পিছনে নিলুদা আর বাণীমাসির কটাক্ষেও গান ভেসে এল বিশাখার মনে, ‘আ চলকে তুঝে ম্যায় লেকে চালু…’

ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে ইয়ারফোনটা খুঁজে পেল না ও৷ আজ তাড়াহুড়োতে ঢোকাতে ভুলে গিয়েছে৷ হতাশ হয়ে চেন আটকে দিল৷ পিছন থেকে আবার প্রশ্ন ভেসে এল৷

‘তা টিকিট কাটিসনি তো?’

বিশাখা মাথা নাড়ায়৷

‘বেশ, আমরা কেটে নিচ্ছি৷ কোথায় নামবি?’

‘আমহার্স্ট স্ট্রিট৷’

আমহার্স্ট স্ট্রিট আসতে বাস থেকে নেমে পড়ে বিশাখা৷ এবারে সবার আগে দরকার মৈনাক এজেন্সির অফিসটা খুঁজে বের করা৷ ফোনে লোকটা বলেছিল, খুঁজে পেতে বেশি সমস্যা হবে না৷ মোড়ে নেমে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে৷ চারদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে দেখতে পেল না বিশাখা৷ আবার সেই একই হর্নের পোঁ পোঁ, চড়া রোদের তাপ আর অফিসযাত্রীদের দৌড়োদৌড়ি৷ ভিতরের একটা গলিতে ঢুকে হাঁটতে লাগল ও৷ গলির ভিতরে লোকজন অপেক্ষাকৃত কম৷ একপাশে লাইন দিয়ে খাবারদাবার বিক্রি হচ্ছে, কোথাও কচুরি, কোথাও শিঙাড়া, আবার কোথাও লেবুর জল৷

একদিন নবজ্যাঠা লেবুর জলওয়ালাদের খুব খিস্তি করেছিলেন৷ সেদিন নাকি খবরে দিয়েছিল, লেবুর জলে যে বরফ দেওয়া হয়, সেটা নাকি মর্গ থেকে খুলে আনা৷ তারপর থেকে বাইরে এইসব খায় না বিশাখা৷ এমনিতেই ওর রোগাটে শুকিয়ে যাওয়া চেহারা৷ তার উপরে আরও পেটের রোগ বাঁধলে আর কিছুই থাকবে না৷ খানিক এগোতে পকেটে মোবাইলটা বেজে উঠল ওর৷ দাঁড়িয়ে সেটা পকেট থেকে বের করে বিশাখা দেখল, বাবা ফোন করেছে৷ ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল ও, ওপাশ থেকে মায়ের গলা শোনা গেল, ‘পৌঁছে গিয়েছিস?’

 ‘না, সামনে৷’

‘কাউকে জিজ্ঞেস করে নে, না পেলে৷’

‘হ্যাঁ নেব৷’

‘আর কিছু খেয়ে নিস৷’

‘নেব৷’

‘হয়ে গেলে জানাস৷’

‘হ্যাঁ জানাব৷’

ফোনটা রাখতে গিয়ে টাইমটা দ্যাখে নীল বিশাখা৷ এগারোটা বাজতে আর মিনিট কুড়ি বাকি৷ তার মধ্যে গিয়ে সই করতে হবে৷ না হলে ইন্টারভিউ থেকে বাদ পড়বে৷ একটা রিটন পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারভিউতে কোয়ালিফাই করেছে৷ টাইমে পৌঁছোতে না পারলে পুরোটা বরবাদ হবে৷ চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে জামায় মুছে নেয় বিশাখা৷ রুমালে মুখ মোছে৷ তারপর দ্রুত পা চালায়৷

দু-একটা গলি হেঁটে আসতে বোর্ডটা চোখে পড়ে, মৈনাক প্যাকারস অ্যান্ড মুভারস৷ নীচে একটা ঝুলন্ত কাগজে লেখা, ‘ইন্টারভিউ অন থার্ড ফ্লোর’৷ বড়োসড়ো একটা নিঃশ্বাস নেয় বিশাখা৷ এই প্রথম খানিকটা নার্ভাস লাগে ওর৷ বাণীমাসি আর নিলুদার মুখটা মনে পড়ে যায়৷ আরও অনেকগুলো মুখ৷ চারপাশে কেউ নেই অথচ সবাই যেন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওই থার্ড ফ্লোরের দিকে৷ মনে মনে ভাবে, বাস স্ট্যান্ডে ভিখারিগুলোকে কিছু দিয়ে আসলেই হত৷ কে জানে, হয়তো ওদের আশীর্বাদ কাজে লেগে যায়৷ বেশি পয়সা নিয়ে বেরোয়নি আজ৷ সামনে পুজো, বেশি টাকা নিয়ে বেরোলেই খরচ হয়ে যাবে৷ গাড়ি ভাড়া ছাড়া আর কুড়ি টাকা আছে এক্সট্রা খরচ করার মতো৷

সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে বিশাখা৷ এবং আসতেই দ্বিতীয়বার ভয়ে ওর বুক দুরুদুরু করে ওঠে৷ চারপাশে ওর বয়সি ছেলেমেয়ের ছড়াছড়ি৷ কেউ সোফার উপরে, কেউ টুলে আবার কেউ দরজার ঠিক বাইরেটায় ওঁত পেতে রয়েছে৷ কেউ স্যুট-বুট পরে অফিসবাবুটি সেজে এসেছে, সঙ্গে টাই৷ ওদের গ্ল্যামারই আলাদা৷ মেরুদণ্ড একচিলতে বেঁকে নেই৷ এমন চেঁচেপুঁছে দাড়ি কাটা যে কোনওকালে দাড়ি গজায়নি বলে সন্দেহ হয়৷ মেয়েদের মধ্যে কয়েকজন ঢাউস সাইজের কয়েকটা খাতা খুলে কী যেন বিড়বিড় করছে৷ এরা আদৌ কিছু পড়ছে না৷ পড়তে দেখে অন্য ক্যান্ডিডেটরা যাতে নার্ভাস হয়ে পড়ে, সেই চেষ্টায় আছে৷ সব মিলিয়ে ছোটো খাঁচার মতো ঘরে কোল্ড ওয়ার শুরু হয়েছে৷ মৈনাক এজেন্সির স্বয়ংবরসভা৷

বিশাখা লক্ষ করল, একপাশে একটা ঘেরা টেবিলের পিছনে একটা মাঝবয়সি ছেলে খাতা বাগিয়ে বসেছে৷ নতুন কেউ ঢুকলে তাদের নামধাম লিখে নিচ্ছে রেজিস্টার৷ গুটিগুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল বিশাখা৷ সামনের জন সরে যেতে হাতের ফাইলটা নীচে নামিয়ে রাখল৷ ছেলেটাকে ভালো করে একনজরে দেখে নিল৷ ঢ্যাঙা কাঠির মতো চেহারা, থুতনিতে অল্প দাড়ি৷ গলা দিয়ে নীল ফিতে নেমে এসে পকেটে ঢুকেছে৷ সেই ফিতেয় লেখা আছে, ‘মৈনাক এজেন্সি’৷ বিশাখাকে দেখে সে চোখ তুলে বলল, ‘কল লেটার?’

বিশাখা ব্যাগ খুলে কল লেটার এগিয়ে দিল৷ ছেলেটা সেটা খতিয়ে দেখে রেজিস্টারের খাতাটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখানে সই আর ওইখানে ঠিকানা আর মোবাইল নম্বর, টোয়েন্টি নাইন৷’

টোকেনটা নিয়ে সোফার উপরে একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে পড়ল বিশাখা৷ ঘরের ভিতরটা এসি করা৷ একটু আগে রোদ থেকে এসে এমনিতেই মাথাটা ধরে ছিল৷ এই ফাঁকে সেটা আরও খানিকটা বেড়ে গেছে৷ বাসে যে গানটা শুনতে ইচ্ছা করছিল, সেটা এখনও ঘুরেফিরে আসছে মাথার ভিতরে৷ শরীরটা কেমন যেন ঝিমিয়ে আসছে৷ ইচ্ছা করছে, এক্ষুনি ছুটে পালায় এখান থেকে৷ হাতের ঘামে ভিজে-যাওয়া ফাইলটা একটু একটু করে খসে পড়ছে হাত থেকে৷ মুহূর্তে সোজা হয়ে বসে সে, না, হাল ছেড়ে দিলে হবে না৷

একটা চাকরি দরকার, ইমিডিয়েটলি৷ না হলে ওই পৈশাচিক আগ্রহে তাকিয়ে-থাকা চোখগুলো কিছুতেই বন্ধ হবে না৷ অবাধ্য টলমল পায়ে বাড়ি ফিরতে মন চাইবে না৷ শিরদাঁড়াটা সোজা করে নেয় ও৷ ফাইলটা খুলে একটা ছোটো খাতা বের করে আনে৷ কী কী প্রশ্ন ইন্টারভিউয়ার করতে পারে, তার একটা লিস্ট৷ সেটা মুখের সামনে মেলে ধরে একমনে পড়তে থাকে৷

সেভাবেই খানিকটা সময় কেটে যায়৷ একবার উঠে দাঁড়ায় বিশাখা, টেবিলের ওপারে বসে-থাকা ছেলেটাকে বাথরুম কোথায় জিজ্ঞেস করতে গিয়েও শুধরে নেয়৷ ভদ্রলোকেরা বাথরুমকে ওয়াশরুম বলে৷ সেকেলে হাগু-মুতু টাইপের ভাষা ছোটোলোকেদের জন্য, শুধু বোতল থেকে জল খেতে গিয়ে গায়ে পড়ে গেলে ‘শিট’ বলতে আপত্তি নেই৷ ফিরে আসতে বিশাখা দেখল, ভিড়টা খানিকটা পাতলা হয়েছে৷ আটাশ নম্বরে একটা টাই-পরা ছেলে হাসিমুখে দুলতে দুলতে বেরিয়ে আসতে ওর উৎসুক বাবা ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলের উপরে, ‘কী রে, কিছু অ্যাকনলেজ করল?’

‘অলমোস্ট, একজন বেশ ইম্প্রেসড মনে হল তো, বাট দি আদার ওয়াজ অ্যান অ্যাসহোল৷’

এরা কলকাতার নতুন গজিয়ে-ওঠা বাংলা বাপের অ্যাংলো সন্তান৷ শখের খিস্তি-খেউড়, প্রেম-নিবেদন এবং মত প্রকাশ এরা ইংরেজিতে করে থাকে৷ ভৌগোলিক কারণের জন্যে ইংরেজরা সাধারণত জোরে কথা বলে না৷ কিন্তু এরা ইংরেজি বলে বেশ গলা তুলে, সঙ্গে যেগুলো রগরগে, সেগুলো আর-একটু জোরে৷ যেমন এই মুহূর্তে ‘অ্যাসহোল’ শব্দটা বেশ উঁচু গলায় বলেছে ছেলেটা৷ সেটা কানে নিয়েই দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে এল বিশাখা৷ এখানে এসি-র জোর আর-একটু বেশি৷ আগের ঘরটার তুলনায় এই ঘরটা বেশ বড়ো৷ ঘরের মাঝ বরাবর একটা লম্বা টেবিল৷ টেবিলের ওপারে দু-জন লোক বসে কাগজে কী যেন লিখছে৷ একজন বেশ বৃদ্ধ, নাকের উপরে বসানো চশমাটা প্রায় নেমে এসেছে৷ মনটা খারাপ হয়ে গেল বিশাখার, যার বয়স যত বেশি, তার তত বেশি ফ্রাস্ট্রেশনের চাপ৷

বুড়োটাকে দেখেই বোঝা যায় লাথখোর৷ বাড়িতে ছেলে-বউয়ের কাছে লাঠি-ঝাঁটা খায় দিনরাত৷ এখানে ইন্টারভিউয়ের নাম করে লোকের উপরে চোখ রাঙায়৷ আর-একজন বছর পঞ্চাশেক৷ একবার চোখ তুলে বিশাখার দিকে দেখে নিল লোকটা, তারপর আবার মাথা নামিয়ে বলল, ‘কাম ইন৷’

দুরুদুরু পায়ে ভিতরে ঢুকে এল বিশাখা৷ সামনের একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘গুড আফটারনুন স্যার৷’

‘কই, সিভি-টা দেখি৷’ অল্পবয়সি লোকটা হাত বাড়িয়ে দেয়৷ ফাইল খুলে সিভি-টা এগিয়ে দেয় বিশাখা, বৃদ্ধ-লোকটা সেটা নিয়ে চশমাটা ঠিক করে নিয়ে পড়তে থাকে৷ পাশের জন জিজ্ঞেস করেন, ‘তো তুমি ইকনমিক্স নিয়ে পড়েছ?’

‘হ্যাঁ স্যার৷’ বিশাখা মুখ তুলে জবাব দেয়৷ হাত দুটোকে কোলের উপরে ফেলে রাখে৷ এটাই নিয়ম৷ অকারণেই মাথায় সেই কিশোরকুমারের গানটা বাজতে থাকে৷

‘হঠাৎ এই কোম্পানিতে চাকরি করতে চাও কেন?’

মনে মনে অল্প হাসি পায় বিশাখার৷ মানুষ চাকরি করতে চায় কেন? এই ঘরে বা ওই পাশের হলঘরে যারা বসে আছে, তাদের সবাইকে ছোটোবেলায় প্রশ্ন করা হত, ‘তুমি বড়ো হয়ে কী হতে চাও?’

তাদের কেউই উত্তর দেয়নি, ‘আমি মৈনাক প্যাকারস অ্যান্ড মুভারস কোম্পানির অন্যতম কর্ণধার হতে চাই৷’ স্কুল আমাদের শেখায়, কী করে পয়সা রোজগার করতে হয়, ওই পান বিড়ির দোকানদারের মতো, যে তার সহমত ব্যাচে, এই বিরাট শিক্ষা নামের কারখানাটা আসলে একটা স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্র৷ আজ কয়েকজনের ভাঙবে, ভাঙা স্বপ্নও মাসের শেষে স্যালারির বদলে বিক্রি হবে, শুধু দামটা লেখা থাকবে না৷

বিশাখা কাঁধ শক্ত করে বলে, ‘কাজটা ইন্টারেস্টিং, তা ছাড়া এ ধরনের কাজ আমার ভালোও লাগে৷’

‘রাতে কাজ করতে পারবে?’

বুড়োটা এবার মুখ খোলে, চশমার উপর দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে৷ অস্বস্তি হয় বিশাখার, কেমন যেন কুমিরের মতো দৃষ্টি লোকটার৷ কাল যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত তাহলে আজই একটা ছুরি ওই চোখে ঢুকিয়ে দিত বিশাখা৷

‘চেষ্টা করব স্যার, তবে এরকম তো কিছু লেখা ছিল না আপনাদের…’

‘সব কিছু কি লেখা যায় ওইভাবে? অনেকে তো আবার ডোনেশন চায়৷’

বিশাখা আর কিছু বলে না, মাথা নামিয়ে নেয়৷ এই কড়া এসি-তেও ওর গরম লাগতে শুরু করেছে৷ কানের পাশ গরম হয়ে উঠেছে৷ এই চাকরিটা সম্ভবত হবে না৷ কষ্টেসৃষ্টে রিটনটা পাশ করেও লাভ হল না৷ সামনে আর কোনও ইন্টারভিউ নেই৷

দম নিয়ে আর একবার মাথা তোলে সে৷ ভালো করে সিভি-টা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে বুড়োটা৷ শেষ পাতায় গিয়ে মন দিয়ে কী যেন দেখছে, বানান ভুল হয়েছে নাকি কিছু?

আরও কয়েকটা প্রশ্ন করে লোকটা৷ বিশাখা ভেবেচিন্তে উত্তর দেয়৷ খুব একটা খুশি সে নিজেও হয় না৷ মাথার গুনগুন যন্ত্রণাটা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে৷ কে যেন ক্রমাগত বলে চলেছে এই দরজার বাইরে যে চোখগুলো ওর হারের অপেক্ষা করে চলেছে, ওরা আজ উৎসব পালন করবে৷

‘হবি আছে দেখছি অনেকগুলো, বাঃ, গান জানো!’

বুড়োটা সিভি-টা বন্ধ করে বলল৷ তার ঠোঁটের কোনায় কুমিরের হাসি ফুটে উঠেছে, বেশ মজার কিছু একটা খুঁজে পেয়েছে লোকটা৷

‘তা কীরকম গান? রবীন্দ্রসংগীত নাকি উচ্চাঙ্গ?’

পাশের লোকটা এবার চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দেয়৷

বলে, ‘আমার মেয়েটাকেও তো ভরতি করে দিয়েছি, সকালবেলা তো ও-ই রেওয়াজ করে ঘুম ভাঙায়, বুঝলেন কানাইদা, আমার তো যন্ত্রপাতি ঠেলেই জীবন কেটে যাচ্ছে, ওকে এসবের মধ্যে আনব না৷’

বুড়োটা এবার শ্রীচৈতন্যের মতো হাত দুটো উপরে তুলে দিয়ে রিল্যাক্স করেন, ‘আমারও তো সেই কথা, শুধু পড়াশোনা করলেই হবে না, সঙ্গে এইসব কো-কারিকুলার… আরে, তুমি গানটা শুরু করলে না… লজ্জার কিছু নেই, সিভি-তে লিখেছ যখন, এটাও একটা ডেমোনস্ট্রেশন… করো করো…’ আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় বিশাখা, মুখের সামনে এসে-পড়া চুলগুলো সরাতে সরাতে বলে, ‘এক্সকিউজ মি, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে স্যার৷ আমার চাকরিটা লাগবে না৷’

‘ও, বেশ, গেট আউট অফ হিয়ার৷’

সবেগে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বিশাখা৷ বাইরের ঘরে কয়েকটা উৎসুক মুখ তাকিয়েছিল ওর দিকে৷ মুখে হাসি দেখলে খানিকটা হতাশ হত ওরা৷ বিশাখার মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল৷ সেই শিড়িঙ্গে ছেলেটা ওকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে উঠে দাঁড়াল, ‘মিস, সাইন আউটের একটা সই…’

একপলকের জন্যে থমকে দাঁড়াল ও, ঘুরে তাকাল ছেলেটার দিকে, ‘আপনারা বাল ছিঁড়ুন৷’ চিৎকার করে কথাটা বলেই দ্রুত বেরিয়ে এল ও৷ বাইরে বেরোতেই বিশাখার মনে হল, কে যেন তাড়া করে আসছে ওর পিছনে৷ তবে কি গালাগালি দেওয়ার জন্যেই ছুটে এসেছে কেউ? নাকি এই গোটা শহরটাই ঘিরে ধরেছে ওকে? বাসের সুযোগসন্ধানী বুড়োগুলোর মতো আড়চোখে তাকিয়ে আছে ওর বুকের দিকে, ওর খালি পকেটের দিকে, ওর রোদে পোড়া তামাটে চামড়ার দিকে? বিশাখার মনে হল, দানবের মতো বিরাট এই শহর গ্রাস করছে ওকে৷ এক্ষুনি ছুটে পালানো দরকার, কিন্তু কোথায়? শেষ সিগারেটটা ফুরিয়ে আসতে বাস থেকে নামল বিশাখা৷ আজ বাড়ির বাস ধরেনি৷ সাতটার আগে বাড়ি ফিরলেই হবে৷ এমনিতেও ফিরতে ইচ্ছা করে না ওর৷ বাস ধরে বাগবাজারে নেমেছে৷ বিকেল হয়ে এসেছে৷ একটু একটু করে মরে আসছে রোদটা৷ একটু দূরেই নিমতলা মহাশ্মশান৷ ওর পাশ দিয়ে বিকেলের ঘোলাটে জলে ভরা গঙ্গা বয়ে গেছে৷ শ্মশানের পাশের রাস্তাটায় নেমে আসে বিশাখা৷ বিডন স্ট্রিটের উপরে বেশ কয়েকটা আইসক্রিমের দোকান৷ বিকেলের দিকটা অনেক লোক এদিকটায় হাঁটতে আসে, কেউ কেউ আসে প্রেম করতে৷ রাস্তার পাশের একটা দোকান থেকে খানিকটা চিনাবাদাম কেনে সে৷ পকেটে আর মাত্র বাড়ি যাওয়ার মতো টাকা আছে৷

হাঁটতে হাঁটতে একটা মোটামুটি নির্জন ঘাট খুঁজে নেয় বিশাখা৷ সিঁড়ির দু-পাশে দু’জন দু-জন করে মোট চারজন বসে আছে৷ ছেলেগুলোর হাত মেয়েগুলোর কাঁধে৷ মুখের উপর মুখ এনে কী যেন বলাবলি করছে ওরা৷

নাকি চুম্মাচাটি করছে? যা-ই হোক, এদের দেখে এতক্ষণে অস্বস্তিটা কেটে যায় ওর৷ কোথা থেকে যেন একটা দাঁড়কাক ডেকে চলেছে৷ দূরে লঞ্চের শব্দ আর ঘাটের নীচে জলের ছলাত ছলাত৷

একদম নীচের সিঁড়ি অবধি নেমে যায় বিশাখা৷ পা-টা ধুয়ে নেয়৷ তারপর আঁজলা করে তুলে জল ছিটিয়ে দেয় মুখে, ঘাড়ে, গলায়৷ ঘাড় বেয়ে সেই জল নামে পিঠে৷ বেশ আরাম লাগে বিশাখার৷ চিনাবাদামের প্যাকেট শক্ত করে ধরে দুটো সিঁড়ি উঠে এসে বসে পড়ে ও৷ শ্মশানে এতক্ষণে মরা পোড়ানো শুরু হয়েছে৷ হালকা গুঞ্জনের আওয়াজ ভেসে আসে সেখান থেকে৷ একমনে চিনাবাদামের খোসা ছাড়াতে থাকে বিশাখা৷ আচমকাই কী মনে হতে পকেট থেকে মোবাইল বের করে আনে ও৷ কাউকে ফোন করে না৷ মিউজিক প্লেয়ারে গিয়ে একটা বিশেষ গান চালিয়ে দেয়, স্পিকারে বেজে ওঠে, ‘আ চলকে তুঝে ম্যায়…’

ফোনটা পাশে রেখে ঘাটের একদিকের দেওয়ালে মাথা এলিয়ে দেয়৷ ধীরে ধীরে কমে আসছে মাথার যন্ত্রণাটা৷ একটু একটু করে ঠান্ডা হাওয়ায় শীতল হয়ে আসছে শরীর৷ জলের ওপারে দুপুরের ক্লান্ত সূর্যটা একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে৷ বিশাখার মনে হয়, এই শহর ওকে কিছুই দেয়নি, ওর শরীর, টাকা, যন্ত্রণা একটু একটু করে কিনে নিতে চেয়েছে সব৷ শুধু ওই লাল সূর্যটা ওর নিজের, এই গঙ্গার ঘাট ওর নিজের, পিছনে বসে-থাকা প্রেমিক-প্রেমিকা, আইসক্রিমওয়ালা, এই দিগন্তবিস্তৃত জল, ওই লঞ্চ, ওই একচিলতে রঙিন নৌকাগুলো ওর নিজের৷

গঙ্গার জলের উপর দিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার মতো একচিলতে শান্তির ঢেউ এসে জাপটে ধরে বিশাখাকে৷

The best and most beautiful thing in the world cannot be seen or even touched, they must be felt with the heart.

–Helen Keller

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *