এক
সুদামার আবার সাধ হয়েছিল মা হওয়ার। হ্যাঁ, চোদ্দ বছর বাদেও। শুনে কৃষ্ণেন্দুর কী হাসি। হাসতে হাসতেই তুচ্ছ করে দিল সুদামার ইচ্ছেকে, মাথা খারাপ।
কেন, আমি তো তোমাকে বলেইছিলাম।
শুনে কৃষ্ণেন্দু আবার হাসে, বলেছিলে। কবে বলেছিলে? বলার কী আছে? এই বয়সে আবার ওই হ্যাপা কাঁধে নেয় কেউ?
তুমি সব জানতে, আমি বলিনি? সুদামার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে প্রায়।
বলেছিলে? সত্যি বলেছিলে? আমি কি তখন অফিসে, না ঘুমিয়ে? কৃষ্ণেন্দুর চোখের তারায় কী রকম তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা। সুদামার অচেনা মনে হয় তার প্রেমিক, স্বামীকে। কৃষ্ণেন্দু তো সব জানে। সে সম্মতি দিয়েছিল, এত বছর বাদে! তোমার যা ইচ্ছে —!
কৃষ্ণেন্দু বলল, সম্ভব নয়।
সম্ভব নয় তো হ্যাঁ বলেছিলে কেন? সুদামা কাঁপছে।
কৃষ্ণেন্দু বলল, কী আবোল-তাবোল বকছ! এত বছর বাদে আবার চেকআপ, আবার নার্সিংহোম, টেনসড হয়ে থাকা, ডাক্তার, বাচ্চা — ইস!
সুদামা অবাক হয়। আশ্চর্য! কৃষ্ণেন্দু নিজের কথা নিজে কেমন খেয়ে ফেলছে। অস্বীকার করছে সব। অথচ তার কথাতেই না সুদামা সাহস পেয়ে যাবতীয় নিরোধক ত্যাগ করে বসে আছে এই তিনমাস। সে কৃষ্ণেন্দুকে বুঝতে চেষ্টা করে ক্রমাগত।
কৃষ্ণেন্দু ঈষৎ বিরক্ত, বলল, তোমার কি সব কাণ্ডজ্ঞান উধাও হয়ে যাচ্ছে, য়্যু আর থার্টি সেভেন প্লাস, আটত্রিশে পা দিয়েছ। এই বয়সে কেউ মা হয়? তুমি কোলে বাচ্চা নিয়ে বেরোবে, পারবে!
সুদামা বলে, চিন্তা আমি করেই নিয়েছি আগে, তুমি সব জেনেও না জানার ভান করছ। রাখব বলেই কনসিভ করেছি আমি।
কৃষ্ণেন্দু উষ্মা প্রকাশ করল এবার, আমি জানি! তুমি সত্যি বলছ না সুদামা।
গলা উঠেছিল দুজনেরই। বাইরে মধ্য ফেব্রুয়ারির রাত। কৃষ্ণেন্দু আজ অনেক তাড়াতাড়ি বেরিয়েছিল। নতুন প্রজেক্ট আসছে পরপর। আসছে নানা দেশি বিদেশি কোম্পানি, বণিকেরা। কেউ ফুড প্রডাক্ট, কেউ টিভি, মোটরগাড়ি, কেউ ঠাণ্ডা পানীয়, কেউ কম্পিউটার, কেউ হাসপাতাল নার্সিংহোম বানানোর প্রস্তাব নিয়ে আসছে। রূপায়িত করার অনেকটা দায়িত্ব কৃষ্ণেন্দুর। প্রাথমিক ব্যবস্থা করবে তো সে-ই। এই সব প্রজেক্টের সাফল্যের সঙ্গে কৃষ্ণেন্দুর জীবনের সাফল্যও যে জড়িয়ে গেছে। রাজারামপুর বলে একটা গ্রামে তিনশো বিঘের উপর বেসরকারি এক পেট্রোলিয়াম গ্যাস কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ব্যাপারে কৃষ্ণেন্দু এখন খুব ব্যস্ত। ঘুমের ভিতরেও অফিস নিয়ে থাকছে যেন সে।
কৃষ্ণেন্দু বলে, এত ঝামেলা নিয়ে আছি।
ঝামেলা তো আমার জন্য নয়।
কৃষ্ণেন্দুর বিরক্ত হয়। কিছু বলতে যাচ্ছিল চড়া গলায়, কিন্তু তখনই ফোন বাজল। সে এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তোলে।
কৃষ্ণেন্দু ফোন ধরেছে। সুদামা কঠিন হয়ে বসে আছে খাটের এক কোণে। চাপা গলায় বলল, আমার কি স্বাধীনতা নেই নাকি, ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছুই নেই…।
কৃষ্ণেন্দু রিসিভার হাতের পাতায় চেপে ধরে বিরক্ত মুখে তাকায় সুদামার দিকে। ইঙ্গিতে তাকে চুপ করতে বলে। সুদামার কথা ওপারের মানুষের কানে চলে যেতে পারে। সুদামা উঠল। ধীর পায়ে ব্যালকনির অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনের রাস্তাটা আবছা অন্ধকার। আলো আছে বটে, কিন্তু সেই আলো পথ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।
কে কথা বলছে? না সুহাস বোস, কৃষ্ণেন্দুর জুনিয়র। সে আজ রাজারামপুর গিয়েছিল প্রজেক্ট সাইট দেখতে, রিপোর্ট দিচ্ছে। সুদামা কান পাতে। কিন্তু তার কৌতূহল সামান্যতেই উবে যায়। ল্যান্ড-কমপেনসেশন এইসব নিয়ে কথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে সুহাস নতুন কিছু বলছে। নতুন কোনো প্রজেক্টের কথা। কৃষ্ণেন্দু খুব উৎসাহী।
সুদামা অন্ধকার আকাশে তাকায়। এখানে আকাশ অনেক পরিষ্কার। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে তো আকাশ তারায় তারায় ছয়লাপ। ছায়াপথ দেখা যায়। খুব নজর করলে অচেনা কোনো গ্রহও হয়তো। হ্যাঁ, কথাটা কৃষ্ণেন্দুর। বছর সাত আগে যখন এই ফ্ল্যাট কিনে তারা বেহালার সরকারি আবাসন থেকে উঠে আসে, কৃষ্ণেন্দু বলেছিল তার সাত বছরের ছেলে নীলাঞ্জনকে। পাশে দাঁড়িয়েছিল সুদামা। রাত হয়েছিল অনেক। গৃহপ্রবেশের দিন ছোটো মতো উৎসব হয়েছিল এই ফ্ল্যাটে। এসেছিল অর্ধেন্দু, যূথিকা, যূথিকার মেয়ে টুম্পা। সব এখন কেমন অলীক মনে হয়।
অলীক-ই তো! সুদামা বলেছিল, নতুন গ্রহ মানে, নয় গ্রহের বাইরে?
তাই-ই তো! কৃষ্ণেন্দুর তার ছেলেকে দু-হাতে বেড় দিয়ে বলেছিল, নটি গ্রহ তো সূর্যের, অন্য নক্ষত্রের গ্রহের কথা বলছি, এই বারান্দায় টেলিস্কোপ বসিয়ে দেব নীল, তোর জন্যে, তুই গ্যালিলিও কোপার্নিকাসের মতো টেলিস্কোপে চোখ দিয়ে বসে থাকবি। কী চমৎকার হয়েছে ফ্ল্যাটটা। আমাদের বাড়ি।
তখন অফিস থেকে এসে নীলকে নিয়ে বারান্দায় বসত কৃষ্ণেন্দু। নতুন ফ্ল্যাট কেনার ধাক্কা সামলাতে হচ্ছিল সেই সময় স্বামী-স্ত্রীকে। সুদামার সব গয়না তো বেচেই দিতে হয়েছিল, তা ছাড়া ছিল ঋণ। কিন্তু কোনো অসুবিধেই যেন হয়নি। কোনোদিন তারা কেউ মুখ অন্ধকার করেনি। বেহালার সরকারি আবাসন খারাপ ছিল না। সেখানে তারা গিয়েছিল বেলগাছিয়ার আলো-অন্ধকারে ছাওয়া ঘর ছেড়ে। না গিয়ে উপায় ছিল না। কৃষ্ণেন্দুর কাছে অফিসের কেউ এলে বসতে দেওয়ার জায়গা পর্যন্ত ছিল না। একটাই তো ঘর। আবার তিন ঘরের ফ্ল্যাটের ভিতরে ওই ঘরটিই ছিল সবচেয়ে কম আলোর কম বাতাসের, একটু স্যাঁতসেঁতে মতো। বাড়ির ভালো ঘর দুটি ছিল কৃষ্ণেন্দুর বাবা-মা আর বড়োভাই অর্ধেন্দুর দখলে। তখন তো উপায়ও ছিল না। অন্ধকার ঘরটি কাউকে না কাউকে নিতে হত, অর্ধেন্দু-যূথিকা কিংবা কৃষ্ণেন্দু-সুদামা। বাবা-মায়ের ঘরটি ছিল সবচেয়ে ভালো। দুই ভাইয়ের ব্যবস্থা ছিল না এটি। আপনা-আপনি হয়ে গিয়েছিল। ওই ফ্ল্যাটে তো অর্ধেন্দুর বাবা-মা চারটি সন্তান নিয়ে এসে উঠেছিলেন অনেক বছর আগে। মেয়েরা বিয়ের পর চলে যাওয়ায় ঘর ভাগ স্বাভাবিকভাবেই হয়ে গিয়েছিল।
এই তো কদিন আগে সুদামা গিয়েছিল বেলগাছিয়ায়। ওই ঘরটিতে ঢুকেছিল। বিশ্বাসই হয় না ওখানে সে আর কৃষ্ণেন্দু বিয়ের পর প্রথম দেড় বছর ছিল। দিনের বেলাতেও আলো জ্বালিয়ে রাখতে হত। জানালা যে খুলে রাখবে, লাভ কী? জানালা দুটি যেদিকে তার দশ ফুট ওপারে আর একটি বাড়ির পুরোনো দেওয়া, ময়লা কার্নিশ। ঠিক তাদের ঘরের জানলার মুখোমুখি ছিল পাশের তিনতলা বাড়ির দোতলার রান্নাঘর। একান্নবর্তী সেই বাড়ির রান্নাঘরে কড়া চাপত ভোরবেলা, সারাদিনই ছ্যাঁক-ছ্যাঁক, ধোঁয়াকালি, শেষ হতে হতে রাত এগারোটা। দুপুরে ঘন্টা দুয়েকের মতো থামত কখন তা টেরও পাওয়া যেত না। সুদামা জানালা খুললেই নাকে পেত তেল-মশলার ঝাঁঝালো গন্ধ। ঘরে বসে শীতকালটাই টের পাওয়া যেত, অন্য কোনো ঋতু ধরাই যেত না। না বাদল, না শরৎ, না বসন্ত। হ্যাঁ গরমের দিনে যখন আলো-পাখা থাকত না, টের পাওয়া যেত দমবন্ধ ভাবটি। বৈশাখে বিয়ে হয়েছিল সুদামার। তখন ছিল অনবরত লোডশেডিং — সে যেন বন্দিশিবিরে এসে পড়েছিল। ডালিমতলার বাপের বাড়িও খুব আলো-হাওয়ার ছিল না, কিন্তু সে যে ঘরটিতে থাকত আর এক বোনের সঙ্গে, সেই ঘরের জানালা ছিল দখিনমুখী। হাওয়া আসত। শ্বশুরবাড়ির ঘরটি ছিল যেন জেলখানা, বড়ো প্রাচীরে ঘেরা অন্ধকার কুঠুরি। সুদামা ধূপ জ্বেলে রাখত ঘরে প্রায়ই সময়। বোটকা গন্ধটা যাতে যায়। এখন আর বিশ্বাসই হয় না ওই ঘরে তারা বিবাহের পর রাতের পর রাত জেগেছে, ঘুমিয়েছে। ওই ঘরে তাদের ভিতরে ভালোবাসা নিবিড় হয়েছিল। ওই ঘরে তারা পরস্পরকে চিনেছিল পরম নিশ্চিন্তে। এখন এই আটশো স্ক্যোয়ার ফুটের অঢেল আলো বাতাসে বসে ওই ঘরের কথা মনে হয় অসত্য, অন্য জন্মের কথা।
ডাকলে কৃষ্ণেন্দু, সুদামা তোমাকে ডাকছে সুহাস।
সুদামা ব্যালকনি থেকে সরে ঘরের দরজায়। ভ্রু-কুঞ্চিত মুখে তাকিয়ে আছে টেলিফোন হাতে কৃষ্ণেন্দুর দিকে। কৃষ্ণেন্দু আবার ডাকল, এসো, ও কতক্ষণ ধরে থাকবে।
সুদামা এগিয়ে গিয়ে টেলিফোন ধরল, আমি তো আপনার বস নই বোসবাবু, আমাকেও কি ওইসব প্রজেক্ট বোঝাবেন?
ওপারে হো হো হাসি, না ম্যাডাম, আসলে কী জানেন ম্যাডামকে খুশি না করলে বস খুশি হয় না, তাই।
আমি খুশি হলাম না।
না হন, বসকে বলবেন না, তাহলেই হল। আপনি বলছিলেন না আমাদের প্রজেক্ট সাইটে যাবেন একবার, রাজারামপুর দেখবেন।
সুদামা বলল, এখন আর বলছি না।
সুহাস বলল, স্যার বলতে বললেন, তাই।
সুদামা কঠিন হল, এখন আর যেতে ইচ্ছে নেই। আপনারা ওসব নিয়ে থাকুন, সায়েব, কোম্পানি, জমি, ফ্যাক্টরি, অফিসের ফাইল।
কী করব বলুন, চাকরি তো, কবে যাবেন বলুন।
সুদামা বলল, ঠিক আছে ওকে বলে দেব, রাখছি।
টেলিফোন রেখে সুদামা ঘুরল কৃষ্ণেন্দুর দিকে। কৃষ্ণেন্দু সিগারেট ধরিয়ে হাতে একটা হেডলি চেজ — কভারে রিভলবার হাতে প্রায় নিরাবরণ যুবতি, বিদেশিনী। এখন কৃষ্ণেন্দুর অবসর কাটানো মানে হেডলি চেজ, নিক কার্টার, আরভিং ওয়ালেস — সফট পর্ণো কাম থ্রিলার। এইসব পুস্তক ওর যাবতীয় অবসাদ কাটিয়ে দেয়। সারাদিন অফিসে থেকে মাথা ভার হয়। ভারমুক্ত করে হেডলি চেজ কিংবা টেলিভিশনে। টেলিভিশনের অভ্যাস ক্রমশ বাড়ছে কৃষ্ণেন্দুর।
সুদামা বলল, কেন তুমি বলতে পারলে না?
চমকে ওঠে কৃষ্ণেন্দু, কী!
ওই যে রাজারামপুর যাওয়ার কথা, সুহাস বোসকে দিয়ে বলাতে হবে!
কৃষ্ণেন্দু হাসে, আমি বললেই বলতে পারতাম, কিন্তু সুহাস তো তোমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, রাজি তুমি হবেই।
সুদামা অবাক, সুহাস বললে রাজি হব কেন?
ওটা কথার কথা, তবে এই মুহূর্তে আমার কথায় যে রাজি হতে না তুমি, তা তো আমি জানতাম, তাই সুহাসকে বলতে বললাম।
সুদামা বলল, এখন তো আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।
কেন? অবাক হয় কৃষ্ণেন্দু।
কেন তা বুঝতে পারছ না, এখন সাবধানে থাকতে হবে প্রথম কটা মাস।
হা হা করে হাসে কৃষ্ণেন্দু, প্রথম কটা মাস! পাগল! ও তো একদিনের ব্যাপার, সকালে যাবে, বিকেলে নার্সিংহোম থেকে ক্লিন হয়ে ফিরে আসবে।
সুদামার চোখ-মুখ থরথর করে, সে যেন অন্ধের মতো বাতাস হাতড়ায়। সত্যি বলছ তুমি?
সত্যি ছাড়া কি মিথ্যে? এ বয়সে আমি আবার বাবা হব, নীল কী ভাববে?
ওর আর ভাবার কী আছে, থাকে তো দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে! সুদামা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, ও তো এরপর ভুলেই যাবে আমাদের, এবার সামারে আসবে না উটি যাবে, সাউথ ইন্ডিয়া নিয়ে যাবে স্কুল থেকে, ওর মায়া চলে যাচ্ছে।
মায়া যাওয়ার কি আছে, বড়ো হচ্ছে। ছেলেরা তো ডিটাচড হয়ে যেতেই ভালোবাসে এই বয়সে। আবার ফিরেও আসে আরও বড়ো হলে। সামারে না আসুক দেওয়ালিতে, শীতে তো আসবে। না হলে আমরাই যাব মুসৌরি, তুমি ওসব মাথা থেকে তাড়াও দেখি। এখন আর নার্সিংহোমে দৌড়োদৌড়ি করা যায় না। সময়ও তো নেই।
সুদামা চুপ করে থাকে। মুখ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণেন্দু খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ, যা বলে তাই করে। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছে। ঘন অন্ধকার। অন্ধকারে কী যেন খুঁজতে থাকে তার চোখ। সে যুক্তি খুঁজে বের করতে চাইছিল। পেয়েও গেল বোধহয়।
সুদামা বলে, নীল ছেলেবেলায় কী রকম বোন চাইত মনে আছে?
হাসে কৃষ্ণেন্দু, ছেলেবেলায় সবাই ওরকম চায়। এখন ও অবাক হবে। অ্যাডাল্ট হয়ে যাচ্ছে তো! আজকাল চোদ্দ বছরেই ছেলেরা অনেক কিছু বুঝে ফেলে, তারপর যে স্কুলে পড়ে। তুমি তো নীলের পরেও দুবার কনসিভ করেছ, তখন রাখার কথা তো বলোনি।
সুদামা আবার অন্ধকারে তাকায়। কথাটা অসত্য নয়। কিন্তু তখন যে নীল-নীলাঞ্জন ছিল কাছে। এখন সে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে উত্তরপ্রদেশের পাহাড়ে, শীতের ভিতরে। সেখানে গিয়ে প্রথম এক বছর মন খারাপ হত ছেলের। চিঠি লিখত খুব, আচমকা ফোন করত। এখন মন বসে গেছে। তার মানে সুদামার জন্য, মায়ের জন্য এখন আর তার ব্যস্ততা নেই, মন খারাপ নেই। নীল বাড়ি ছেড়েছে দু-বছর। কবে বাড়ি ফিরবে জানা নেই। ওই স্কুল থেকে বেরিয়ে আই আই টি — সেই রকমই প্ল্যান কৃষ্ণেন্দুর। তারপর বিদেশ। কলকাতায় পড়বেই না নীল। সুদামা তা হলে তার ছেলেকে কদিন কাছে রাখতে পারল? সন্তান প্রতিপালন করল কদিন? চোদ্দ বছরে অ্যাডাল্ট! এত তাড়াতাড়ি বাচ্চাটা বেড়ে উঠলে তার কী হবে? এত বড়ো ফ্ল্যাটে দিনভর সে একা। একটি শিশু এলে ফ্ল্যাটে চেহারাই বদলে যাবে।
কৃষ্ণেন্দুর ফোন এসেছে আবার। কথা বলছে অনিলবরণ ঘোষচৌধুরীর সঙ্গে। তারই সহকর্মী, অদ্ভুত এক রহস্য উপন্যাস লেখক। …কী বলছ, চেজের খুন। থার্ড মার্ডার — আমি অত দূর পর্যন্ত যাইনি… হ্যাঁ, প্রথম মার্ডারটা থ্রিলিং… লিফটে ভিতরে গলাকাটা ক্যাবারে গার্ল…। কৃষ্ণেন্দু মার্ডার নিয়ে গল্প করতে লাগল অনিলবরণের সঙ্গে, সেক্স মার্ডার ভায়োলেন্স —! চেজ থেকে নিক কার্টার তা থেকে অতিসাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড, এইসব।
সুদামা ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে যায়। ঘাড় উঁচু করে আকাশে তাকায়। পাতলা শীত আছে এখনও। সে আঁচল টানল গায়ে। ভাবছিল আর কী বলা যায়। কৃষ্ণেন্দুর কাছে কীভাবে ব্যক্ত করে সে নিজেকে।
দুই
আবার আমার সাধ হয়েছিল মা হই। হ্যাঁ চোদ্দ বছর বাদেও। শুনে কৃষ্ণেন্দু মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, এখন আর ওসবের সময় নেই, মানুষের জীবনে এক একটি বয়স এক একটি অনুভূতির জন্য নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। সেই দিন আমাদের চলে গেছে। এক এক বয়সে এক এক রকম অনুভূতি, এক এক রকম জীবন। এখন এই বয়সে ও সব ঝামেলা নিয়ে কাজ কী? এখন তো কৃষ্ণেন্দু সেই চোদ্দ-পনেরো বছর আগের মতো সন্তানের মুখ দেখার প্রতীক্ষা করে থাকতে পারবে না। এখন প্রতি মাসে, প্রতি পক্ষে কৃষ্ণেন্দু আমাকে অতি সাবধানে কাঁচা মাটির পুতুলের মতো নিয়ে যেতে পারবে না সুখ্যাত ডাক্তারের কাছে, অপেক্ষা করতে পারবে না কখন ডাক্তারের সময় হয়। এখন অত সময় নেই। ওই রকম মনও নেই।
কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে রাতে অনেক সময় ধরে কথা কাটাকাটি। আমি ছিলাম আমার সিদ্ধান্তে স্থির নিশ্চিত, সন্তান ধারণ করবই। আমার ভেতরে জেদ চেপে গিয়েছিল, বলতে লাগলাম রাখবই একে। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর সেই এক কথা, এই বয়সে এসব আর হয় না। আমার এই বয়স পুনর্বার মা হওয়ার উপযোগী নয়। সন্তান তো রয়েইছে, আবার কেন?
কৃষ্ণেন্দু কিন্তু ভুলে যাচ্ছে গত ছ-মাসের কথা। আমি যখন এই বাসনার কথা তার কাছে প্রকাশ করি, কৃষ্ণেন্দু ঘাড় কাত করেছিল, হবে তো হবে। আমি তখন সাবধান হইনি। কৃষ্ণেন্দুকেও সাবধান করিনি। আসলে কৃষ্ণেন্দু তার ছ-মাস আগের মত বদলাচ্ছে। ছ-মাসে কী হয়েছে ওর? নতুন এক দায়িত্ব পেয়েছে, যে দায়িত্বে ওর অনেক সম্ভাবনার চিহ্ন লুকিয়ে আছে। কিছু বলে না, কিন্তু আচমকা ব্যক্ত করে ফেলে। নানান স্বদেশি-বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে, বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে ওর যোগাযোগ হচ্ছে নিয়মিত। ওর দায়িত্ব হল এদেশে তাদের প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করা। ও তা নিষ্ঠার সঙ্গে করছে। করতে গিয়ে প্রকৃত অর্থে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছুটির দিনও ছুটি নেই, সন্ধের পরও ছুটি নেই। মিটিঙের পর মিটিং, ফোনের পর ফোন। হ্যাঁ, সাগরপারের ফোনও আসে। কৃষ্ণেন্দু বলছে, তেমন কোনো অফার পেলে ও ছেড়ে দেবে সরকারি দায়িত্ব — এখন টাকার বাজার তৈরি হচ্ছে, টাকা সংগ্রহ করার প্রকৃষ্ট সময়ই তো এইটা।
অনেক বাক্য-বিনিময়েও কিছু হল না। শেষ পর্যন্ত ওর জিত হল, হার হল আমার। কৃষ্ণেন্দুর একটিই যুক্তি, এখন যদি রাখতে চাইছি তো আগে দুবার নষ্ট করেছি কেন নীলের পরে?
কী বলি! তখন তো নীল ছিল ঘরে। আমার তো বাসনা শিখর-প্রমাণ নয়। নীলকে নিয়েই আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম, সন্তুষ্ট ছিলাম। নীল মিশন স্কুলে যাওয়ার পর আমি কী নিয়ে থাকি! কাকে নিয়ে থাকি!
কৃষ্ণেন্দু আমাকে সময় দিল। এখন মনে হচ্ছে এ-ই আমার ভবিতব্য। আমাকে সাবধানে, মাটির পুতুলের মতো নিয়ে গেল সেই পরিচিত নার্সিংহোমে, বুড়ো ডাক্তারকে গিয়ে বলল, পেশেন্ট নিয়ে এলাম ডাঃ দেব, আচ্ছা এই বয়সে মা হয় কেউ?
যে কথাটা ফ্ল্যাটে বলেছে আমাকে কৃষ্ণেন্দু, সেই কথা ডাক্তারকেও বলল। এই বয়সে যে কনসিভ করে সে নিতান্তই পেশেন্ট, আর কিছু নয়। আমার শরীরের অভ্যন্তরে যে প্রাণটি জন্ম নিচ্ছে, তা-ই হল আমার অসুখের কারণ। ভ্রূণমোচন করলেই আমার অসুখটি যাবে।
হাসতে হাসতে আমাকে ফ্ল্যাটে ফিরিয়ে আনল আমার স্বামী। নিশ্চিন্ত। বউয়ের শরীর ধুয়েমুছে সাফ করে এনেছে, অনেকদিন বাদে আমার মাথার চুলে হাত দিয়ে খোপা ভাঙতে ভাঙতে বলল, খুকি, এই রকম কেউ করে, দিস ইজ দা হাই টাইম টু আরন মানি, টু অ্যাচিভ মোর—এখন আমাদের সেই বয়স নেই, লোকে হাসবে।
আমি চুপ করে থাকলাম। কী করে বোঝাই যে সাধ হয়েছিল সত্যি। হ্যাঁ আমার মাথার ভিতরে খুঁজলে কোথাও না কোথাও রুপোলি রেখা চোখে পড়বেই। একটি দুটি। বয়স হয়েইছে। তা জেনেও তো চেয়েছিলাম আবার সেই স্বাদ নিই। সেই চোদ্দ বছর আগের শিহরণে শিহরিত হই। আবার আমার শূন্য শরীর ভরে উঠুক সন্তানের রক্তমাংসে, দশ মাস ধরে আমি বহন করি তার ভার। আমার দুই স্তনে দুধ আসুক। দুধের ভারে তা স্ফীত হোক, ব্লাউজ ভিজে যাক প্রাণের টানে। আমার গা দিয়ে দুধের গন্ধ বেরোতে থাকুক।
কী করে বোঝাই কৃষ্ণেন্দুকে এত বড়ো এই ফ্ল্যাট আর সহ্য হয় না। একা একা ভয় লাগে। হ্যাঁ সত্যিই। তাই আমি চেয়েছিলাম ফ্ল্যাটের বাতাসে ঘুরুক শিশুর গায়ের গন্ধ। ঘর-বিছানা ভরে যাক কাঁথা-কাপড়-দোলনা-ফিডিং-বোতল আর খালি দুধের কৌটোয়। খেলনা চাই না, সেই খালি দুধের কৌটো গড়িয়ে দিতে দিতে বড়ো হয়ে উঠুক সে। যেমন খেলত নীল। তখন আমরা বেহালার সরকারি আবাসনে। সবে স্টেট সার্ভিস — সরকারি চাকরিতে ঢুকেছে কৃষ্ণেন্দু। বিয়ে যখন হল তখন তো সে কাগজের অফিসের প্রুফ-রিডার, আর দু-চার পাতা লেখে মাত্র …।
যদি ডায়েরি লিখত, এভাবেই যেন লিখত সুদামা। এখন আবার সেই অভ্যাস, যে অভ্যাস কৃষ্ণেন্দু তাকে দিয়েছিল আবার কৃষ্ণেন্দুই হরণ করেছিল, ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। ডায়েরি লিখতে বলত তাকে কৃষ্ণেন্দু, পরিচয়ের পর থেকে, কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বলত, ডায়েরি লিখলে তোমার লেখার অভ্যাস হয়ে যাবে, আমরা দুজনেই লিখব।
সুদামা বলত, আমার যে ডায়েরি লিখতে ভয় করে।
কেন?
যদি কেউ সেই ডায়েরি খুঁজে পায়, দেখে ফেলে, বাড়িতে কত লোক!
হা হা করে হাসত কৃষ্ণেন্দু। তারা তখন হয়তো হাঁটছে রোদে ডোবা গ্রীষ্মের ময়দান দিয়ে। তারা তখন হয়তো আসছে ধর্মতলা থেকে কলেজ স্ট্রিটের দিকে। তারা তখন হয়তো বসে আছে কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিনে। তারা তখন হয়তো কলেজ স্ট্রিট থেকে বিবেকানন্দ রোডের দিকে হাঁটছে, ডালিমতলায় সুদামাকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরার বাস ধরবে কৃষ্ণেন্দু।
কৃষ্ণেন্দু বলেছে, দেখলে দেখবে।
তাতে যে তোমার কথা থাকবে।
থাকলে থাকবে, হ্যাঁ থাকবেই তো, আমার ডায়েরিতে তোমার কথা সব আছে।
কী আছে?
সে কী করে জানাব এখন, যদি কোনোদিন খুঁজে পাও, দেখে নেবে। শোনো খুকি, কবে তোমার হাত ছুঁয়েছি সেই কথাও, কবে কোনদিনে কোনক্ষণে তোমাকে চুম্বন করেছি, তাও।
ইস! তুমি আমার নাম লিখেছ?
লিখেছি তো খুকির কথা। কৃষ্ণেন্দু তার হাতের আঙুলে চাপ দিয়ে বলেছে।
অভ্যাস করছিল সুদামা। অভ্যাসটা ত্যাগও করেছে। আচমকা বিয়ে। বিয়ের কথাও লিখেছিল সুদামা। তারপর লিখতে গেলে হাত কাঁপে। লিখতে ইচ্ছে হয় অনেক কথা, কিন্তু লেখা হয়নি। লেখা হত না এই জন্য যে কৃষ্ণেন্দু টেনে টেনে পড়ত, আর হাসত। আশ্চর্য! কৃষ্ণেন্দু কী লিখেছিল তার ডায়েরিতে তা সে জানতেই পারেনি। কোথায় তার ডায়েরি! কৃষ্ণেন্দু বলত, তুমি খুঁজে বের করো।
সুদামার ফ্ল্যাটের বাইরে এখন প্রথম মার্চের দুপুর। আজ ভোরে কৃষ্ণেন্দু বেরিয়েছে রাজারামপুরের দিকে। তিনশো বিঘে জমি অধিগ্রহণের যে নোটিশ পড়েছে, তা দখল করা হবে আজ। কৃষ্ণেন্দু, সুহাস গেছে। গেছে পুলিশের বড়োকর্তা, বহু পুলিশ, রাইফেলধারী। কৃষ্ণেন্দু কদিন ধরে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। নির্বিঘ্নে জমি দখল করে সীমানা চিহ্নিত করে কাঁটাতারে বেড়ো দিয়ে দিতে পারলে তার প্রাথমিক দায়িত্ব শেষ। দায়িত্ব শেষ তো নয়। এই রকম প্রজেক্ট পরপর আসছে। এটি পেট্রোলিয়াম গ্যাস প্রজেক্ট, এরপর আছে হসপিটাল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, ফুড পার্ক…। কদিন ধরে দেরিতে ফিরছে সে। জেলা শাসকের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক, পুলিশ কর্তার সঙ্গে বৈঠক, গ্যাস কোম্পানির উচ্চ পদাধিকারিদের সঙ্গে বৈঠক। তারা আরও পেট্রোলিয়াম প্রডাক্ট করতে নামছে, কৃষ্ণেন্দুকে সব দেখতে হবে। কৃষ্ণেন্দুর মুখে এখন ওই গল্প। এখন জুতো কোম্পানি শার্ট তৈরি করছে, ওষুধ কোম্পানি করছে টিভি-র বিজনেস। একটা ব্যবসায়ে কেউ পড়ে থাকছে না। বড়ো বিমার কোম্পানি হাসপাতাল করতে নেমেছে, এরপর তারা তৈরি করবে ফিলম ল্যাবরেটরি, ফুড পার্ক। গ্যাস কোম্পানিও নানারকম বিজনেস করে এ দেশে, বিদেশে। তারা দ্রুত কাজ চায়। ঘড়ির সঙ্গে হাঁটে, ঘড়ি ধরে কথা বলে, ঘড়ি ধরে ঘুমোয়। কৃষ্ণেন্দু হাসতে হাসতে বলেছে, তোমার ছেলে যদি প্রেম করে, করতেই পারে। তাহলেও ঘড়ি ধরে করবে, বুঝলে সুদামা।
টের পাচ্ছে সুদামা, ছ-মাসেই ঘড়ির কাঁটায় সতর্ক চোখ রেখে হাঁটার অভ্যেস করে ফেলেছে কৃষ্ণেন্দু। সেই অভ্যাস থেকেই যেন ভ্রূণমোচন করানো। অতদিন সন্তানের জন্য প্রতীক্ষা করার অভ্যেসই চলে গেছে তার। কৃষ্ণেন্দু বলে সে যদি এখন ছাব্বিশ বছরের যুবক, আর সুদামা উনিশ বছরের হত, তাহলে তারা কি আগের মতো ঘন্টার পর ঘন্টা গঙ্গাতীরে জাহাজ দেখার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারত? না পায়ে হেঁটে আউট্রাম ঘাট থেকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত আসতে পারত? প্রেমের প্রকাশও বদলে গেছে, যাচ্ছে।
কৃষ্ণেন্দু বলে, এরপর দেখবে হয়তো সন্তানের জন্য দশ মাস ওয়েটই করতে হবে না, অত সময় কে দেবে…
কৃষ্ণেন্দু বলে, আমাদের দেশে সারপ্লাস লেবার, যদি সন্তান চাও, তুমি কষ্ট করবে কেন অতদিন, জানো ইউরোপ-আমেরিকায় উম্ব হায়ার করা যায়।
কৃষ্ণেন্দু বলে, ডায়েরি! তা লেখার সময় কখন পাবে এই সময়ের যুবক।
অবাক হয়ে সুদামা তার স্বামীকে দ্যাখে বিড়বিড় করে বলে, সল্টলেক থেকে সেদিন বেলগাছিয়া গেলাম, সেই তো আগের মতো, পথের ধারে চায়ের দোকানে, খালি বারান্দায় বসে আছে চব্বিশ-কুড়ি, নানা রকম বয়স!
ওরা খোঁজ রাখে না?
খোঁজ রাখে না মানে?
পালটে যাচ্ছে সব, দ্রুত পালটে যাচ্ছে, ওরা কি জানে উত্তর মেরুতে এবার বরফ গলবে বেশি, প্রতি বছর তাই হচ্ছে।
এ কথার সঙ্গে তোমার আগের কথার মিল কোথায়?
পালটে যাচ্ছে পৃথিবী।
সুদামা হেসে ফেলেছিল। যুক্তি প্রতিষ্ঠার কী অক্ষম প্রয়াস। উত্তর মেরুতে বরফ বেশি গলছে গ্রীষ্মে, তাই মানুষ হয়ে উঠছে ঘড়ির কাঁটার দাস! সে বলেছিল, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে তো দেখছি না আমি।
কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, প্রকৃতি পালটালে মানুষ পালটাবে না?
হ্যাঁ পালটাবে তো বটেই, তাপমাত্রা বাড়বে, কোনো কোনো বিষয়ের অভাব হবে। কোনো কোনো বিষয়ের প্রাচুর্য হবে, কিন্তু তার মানে কি মানুষ নিজের কথা ভাববে না?
ভাববে, বেশি করে ভাববে।
তোমার সেই ডায়েরি কোথায়?
অবাক হয়েছিল কৃষ্ণেন্দু, এতবছর বাদে আবার ডায়েরির কথা উঠতে। তখন সুদামা বলেছে, ডায়েরিতে এসব লিখে রাখো।
হা হা করে হেসেছিল কৃষ্ণেন্দু, ডায়েরি লেখার সময় কই মানুষের? দিস ইজ দ্য হাই টাইম টু অ্যাচিভ মোর, মোর অ্যান্ড মোর। আরও বেশি ভিটামিনের মতো, মানুষের এখন আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠা দরকার। বহু বছর আমরা অনর্থক নষ্ট করেছি। সময় চলে গেছে হু-হু করে। এখন সবচেয়ে বড়ো সঙ্গী হল ঘড়ি।
সময় নষ্ট হয়েছে! কিসে? প্রেমে ভালোবাসায়, সুদামার জন্য নিদ্রাহীনতায়, কৃষ্ণেন্দুর জন্য রাত জাগায়। ঘড়ি কি প্রেমের সময়টুকুও কেড়ে নিচ্ছে? নিয়েছে?
ঘুম এসে যাচ্ছিল সুদামার। তখন ফোন বাজতে আরম্ভ করল। নতুন বছরের ডায়েরি পেন একধারে পড়ে আছে। আজই প্রথম পাখা চলল এই ঘরে।
সল্টলেক সিটির বালির মাঠ তপ্ত হতে আরম্ভ করেছে মধ্য বসন্তেই। সুদামা টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ায় একটু সময় নিয়ে। বেজে বেজে যদি থেমে যায় তো যাক। ফোনটা তো কৃষ্ণেন্দুর। ভোরে বেরোনোর সময় সে-ই কৃষ্ণেন্দুকে বলে দিয়েছিল, কী হল জানায় যেন। আজকের দিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি হল, আরও বেশি ভিটামিন, ‘টু অ্যাচিভ মোর, মোর অ্যান্ড মোর’-এর প্রথম নির্দিষ্ট পদক্ষেপ। তিনশো বিঘে দো-ফসলি চাষের জমি অধিগ্রহণ করা তো সহজ কথা নয়। জমির অবস্থানটি ভালো, ইনফ্রাস্ট্রাকচার — জল, বিদ্যুৎ, বড়ো পাকা রাস্তা সবই আছে। জমি দেখে গ্যাস কোম্পানি খুশি। দেওয়া নেওয়া নিয়ে টানাপোড়েন চলছিল অনেকদিন। পঞ্চায়েত, গ্রামবাসীকে নানাভাবে বোঝাতে হয়েছে। ক্ষতিপূরণের নানারকম প্যাকেজ ঘোষণা করতে হয়েছে। নানারকম স্বপ্ন দেখাতে হয়েছে। রং চড়াতে হয়েছে। সব করেছে কৃষ্ণেন্দু, আর তার সহকারী সুহাস বোস।
ফোনটা কৃষ্ণেন্দুর। জানাবে, সব কাজ পিসফুলি, ওকে। ফিরতে দেরি হবে। সুদামা নিশ্চয় উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। পুলিশ বন্দুক নিয়ে ফসল ভরা জমি দখল তো সামান্য বিষয় নয়। ফোনটা তুলল সে আধো ঘুম চোখে। টেনে নিয়ে অলস গলায় বলল, হ্যাঁ বলছি, সব হয়ে গেছে তো?
ম্যাডাম আপনি ঘুমোচ্ছিলেন, ডিস্টার্ব করলাম ম্যাডাম?
চোখ খুলে যায় সুদামার ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সে। না, কৃষ্ণেন্দু তো নেই ওপাশে। সুহাস বোস, তার সহকারী, খুবই বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করছে, তার ঘুম ভাঙাল কিনা। সুহাস রাজারামপুর পুলিশ স্টেশন থেকে ফোন করছে। স্যার জানাতে বললেন….
তিন
ফোন রেখে দিয়েছিল সুদামা ওপারের মানুষ কিছু আন্দাজ করার আগেই। বোধহয় আরও একটু কথা বলার ইচ্ছে ছিল সুহাসের। সুদামার সঙ্গে সুযোগ পেলেই আলাপ দীর্ঘ করতে চায় সে। বসের স্ত্রীকে খুশি রাখার নিয়মেই হয়তো। এটা লক্ষ না করে পারেনি সুদামা। কারণ যাই হোক, সুহাস আলাপ থামাতে চায় না। হ্যাঁ খুবই বিনীত। কৃষ্ণেন্দুই সুহাসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সুহাস না থাকলে সে দম ফেলতে পারত না। তার অনেক কাজই তো সুহাস করে দেয়। যোগ্য সহকারী।
সেই যোগ্য সহকারী কৃষ্ণেন্দুর মুখ থেকে বাক্য স্ফুরণের অপেক্ষাটুকুই করে শুধু। বাকিটা বুঝে নেয়। মাঝে-মধ্যে সুদামাকে টেলিফোনে জানায়, কৃষ্ণেন্দু দেরিতে ফিরবে, কাজে ফেঁসে গেছে তারা। এখনই বড়ো একটা রিপোর্ট পাঠাতে হবে বাইরে। কম্পিউটার রুমে কেরানির সঙ্গে বসে আছে সাহেব। কখন যে শেষ হবে! সে ফ্যাক্স করল এখনই, রিপোর্ট যাচ্ছে।
কৃষ্ণেন্দু বলে, সুহাস আন্দাজ করতে পারে চমৎকার। ফলে কাজ এগিয়ে থাকে। এখন এই সন্ধ্যায়, রাজারামপুর থেকে সুহাস এবং অনিলবরণ ঘোষচৌধুরীকে নিয়ে ফিরেছে কৃষ্ণেন্দু তার ফ্ল্যাটে। সারাদিন খুব পরিশ্রম গেছে, সন্ধেতে রিল্যাক্স করবে।
রাজারামপুরে তিনশো বিঘে জমি দখল করা হয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। হ্যাঁ, একেবারে নিঃশব্দে। গ্রামে কোনো মানুষ ছিল বলে ধরাও যায়নি। গ্রামের লোককে বারণ করা সত্বেও ওরা জমিতে ধান রুয়ে দিয়েছিল উচ্চ ফলনশীল।
এইরকমই হচ্ছে গত বছর দেড়েক ধরে। বার বার বারণ করা হচ্ছে গ্রামের মানুষকে জমিতে ফসল না ফলাতে। কিন্তু নির্দেশ অমান্য করে রোয়া বোনার সিজিনে মানুষ প্রতিবার নেমে পড়ছে জমিতে। জমিকে বিশ্রাম দিচ্ছে না। উচ্চ পর্যায়ে মিটিং করে জমি দখলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে অনেকদিন। গ্যাস কোম্পানি জমির দামও জমা দিয়ে রেখেছে সরকারি কোষাগারে। সেই টাকাতেই ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা। সব-ই ঠিকঠাক। কিন্তু জমি দখলের তারিখই বদলে গেছে বার বার। জমি কখনও ফাঁকা থাকছে না। ফসল ভরা জমির দখল নেওয়া একটু সমস্যার। তাতে প্রতিক্রিয়া খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। সেই সুযোগটিই নিয়েছে রাজারামপুরের মানুষ। ফসল ফলানোর প্রক্রিয়া কখনও থামিয়ে রাখেনি তারা। বীজতলা তৈরি, ধান বোনা, ধান রোয়া — এইসব ক্রিয়া কর্মগুলিকে ব্যবহার করছে জমি রক্ষার জন্য। অথচ ধান বোনা, রোয়ার অধিকারের জন্যই তো মানুষ জমি রক্ষার লড়াই-এ শামিল হয়। চিরকাল তাই হয়েছে। যাবতীয় কৃষক আন্দোলন, জমি দখলের আন্দোলন তো ফসল ফলানোর অধিকার অর্জনের জন্য। এখানে জমির অধিকার কায়েম রাখার জন্য রোয়া বোনা চলেছে। গত সিজিনে বারণ করা হল চাষিদের জমিতে নামতে, রোয়া বোনা করতে। নোটিশ করে দেওয়া হল জমির পজেশন নেওয়ার তারিখ জানিয়ে। কিন্তু চাষিরা জমিতে আগে-ভাগে নেমে পড়ে চাষ করে দিল। চাষের জল তো ওই এলাকায় সহজ লভ্য। রাজারামপুরের গা দিয়ে তিরিশ বছর আগে কাটা ইরিগেশন ক্যানেল। সেই ক্যানেল জল দেয় প্রচুর। সেই জলই জমির প্রকৃতি বদলে দিয়েছে। এক ফসলি থেকে দো-ফসলি, দুবার ফসল করেও তৃতীয়বারের চাষে গত দেড় বছর ধরে ব্যাপক মানুষ শামিল হয়ে পড়েছে। দু-বার ধান, একবার নানান সবজি, কলাই। ফসল দিয়েই তারা জমির দখল কায়েম রাখতে চেষ্টা করছে। এছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না, ভূমি রক্ষার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিল কিছু মানুষ। কিন্তু রাজনৈতিক সমর্থনবিহীন আন্দোলন এগোতে পারেনি। আর আন্দোলনের নেতাদের খুব সহজেই গ্যাস কোম্পানি কিনে নিতে পেরেছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে। বটলিং প্ল্যান্ট মানে তো শুধুই তা-ই নয়। আরও ছোটো ছোটো শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে এ দিয়ে। রোজগারের নানারকম পথ খুলে যাবে। গ্যাস ডিলারশিপ, কন্ট্রাক্টরির সম্ভাবনা অনেক। আন্দোলন ভেঙে গেল বটে, কিন্তু গ্রামের মানুষের নিঃশব্দ প্রতিরোধ বন্ধ হল না। কতবার যে মিটিং হল, তারিখ ঠিক হল জমি দখলের। কিন্তু ফসলের প্রতিরোধে তারিখ বদলে যায় বারবার। শেষে পুলিশের তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ক্যানেলের জল বন্ধ করে দেওয়ার। ছ-মাসের জন্য রাজারামপুর ইরিগেশন ক্যানেলের জলপ্রবাহ বন্ধ থাকুক। তা সম্ভব নয়। কেননা, ওই ক্যানেল তো শুধু তিনশো বিঘেতে জল দেয় না। বিস্তীর্ণ এলাকাকে সবুজ করেছে ওই ক্যানেলের জল যা হুগলি নদী থেকে আসে। গ্রামের মানুষ নিশ্চুপে তাদের কাজ করে যাচ্ছিল। জমির লড়াই চলছিল গোপনে। এবারও ধানকাটা হয়েছিল ডিসেম্বরে। তারপর আবার জানানো হয়েছিল নোটিশ করা জমিতে যেন ফসল না-রোপন করে চাষিরা। জানুয়ারি মাসে প্রশাসন অন্য বিষয়ে ব্যস্ত থাকে। পুলিশ পাওয়া সম্ভব হয় না, সরকারি কর্মীও অপ্রতুল হয়ে ওঠে সাগর মেলার কারণে। সেই সুযোগ নিয়েছে গ্রামের মানুষ। সুতরাং, শেষ অবধি নতুন রোয়া ধান সমেত জমি দখল করা হল। চাষিদের ফসলের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এল পি জি সংস্থা আর দেরি করতে রাজি হচ্ছিল না।
ফসল সমেত জমি দখল করতে যে হাঙ্গামার কথা আন্দাজ করে প্রায় শ-ছয়েক রাইফেলধারী নামানো হয়েছিল আজ, তাদের রাইফেলের একটি গুলিও খরচ করতে হয়নি। সুদামাকে সব জানতে হচ্ছে এক একজনের মুখ থেকে। সে এখন এই মুহূর্তে ব্যালকনিতে, চেয়ার ঘুরিয়ে তিন পুরুষের দিকে তাকিয়ে। সুহাসের চোখ তার চোখে। সুহাস মদ্যপান করে না, করলেও বড়োজোর এক পেগ; অভ্যাসটা তাকে ধরাচ্ছে কৃষ্ণেন্দু। অন্য দু-জন তো রীতিমতো অভ্যাসের দাস।
সুহাস বলল, ম্যাডাম ফোনটা রেখে দিলেন তখন।
সুদামা কিছু বলল না সঙ্গে সঙ্গে, একটু সময় নিয়ে বলল, জেনে গেলাম তো, আবার কী? আপনাদের অফিসের কাজে আমার কোনো কৌতূহল নেই।
সুহাস চুপ করে যায়। সুদামা চেয়ার ঘুরিয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে। এখন এই লবণ হ্রদ উপনগরীতে ফুল ফোটে অনেক। মার্চের সন্ধে চমৎকার। পথে বেরোলেই দু-পাশে কাঠগোলাপের গাছ, ফুটফুটে সাদা পাখির মতো ফুলে ভরে গেছে। একবার বাই-কার পুরুলিয়া যাওয়ার পথে আচমকা গাড়ি বিগড়ে ছিল বাঁকুড়ার কোনো এক গ্রামের কাছে। পথের ধারে মস্ত তেঁতুল গাছে বিকেলে হাজার বক। গাছ সাদা হয়েছিল। অবাক হয়ে সেই আশ্চর্য বকের গাছ দেখেছিল সে। সন্ধেয় উপনগরীর আধা নির্জন পথের দু-পাশে মাঝারি উচ্চতার অনেক হাত ছড়ানো হাত বাঁকানো কাঠগোলাপ গাছ দেখলে সেই স্মৃতি ঘুরে আসে। ফুল নয় যেন সাদা পাখি এসে বসে আছে ডালে ডালে। কত রকম গন্ধ এখন হাওয়ায়। নিম, কাঠগোলাপ, আচমকা আম-মুকুল। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে সব টের পাওয়া যায়। সুহাসের কন্ঠস্বরে সুদামা উৎকর্ণ হল। কী বলছে!
সুহাস বলছে, ওই জমি না দেখানোই ঠিক ছিল, গ্রিন দেখেই ওদের পছন্দ হল, অথচ গ্রিন তো নষ্ট করবেই।
জমিটা কী দোষ করল? প্রশ্ন অনিলবরণের।
ওদের তো দরকার জমি, গ্রিন নয়। সুহাস বলে।
অনিলবরণ বিরক্ত হল, ভ্যাকান্ট ল্যান্ড, ফ্যালো ল্যান্ড তুমি পাবে কোথায়?
সার্চ করতে পারতাম, দেখলাম আর দিয়ে দিলাম, এটা ঠিক নয়। সুহাস বলে।
অনিলবরণ আচমকা হেসে ওঠে, তুমি যেমন! ও কৃষ্ণেন্দু, এ যে চাঁদের গায়ে চাঁদ, সোনার চাঁদ লেগেছে আমি করব কী?
সুহাস বলে, ঠাট্টার ব্যাপার নয় স্যার, আসলে এই কথা এতদিনে আমারও মনে হয়নি। আজ অনেকদিন বাদে রাজারামপুর গেলাম। আজ জমি পজেশন নেওয়া হল। চাষির জমি চলে গেলে যে কী হয় আমি তো কিছুটা বুঝি, শিকড় এখনও ছেঁড়েনি, যখন প্রথম গিয়েছিলাম তখন হাই-ইল্ডিং ক্রপ তোলা হয়ে গেছে। আমন ছিল না, চাষ হয়নি তখনও, ফাঁকা শুকনো মাঠ, আজ ক্রপ দেখে যে কী হল?
কী হল? অনিলবরণ মোটা গোঁফের ফাঁকে হাসে, কী হল বলো?
ফসল দেখলে আপনার ভালো লাগে না? পালটা প্রশ্ন করল সুহাস।
ফসল না ফসলভরা জমি? অনিলবরণ জিগ্যেস করে।
জমি। সুহাস উচ্চারণ করে।
অনিলবরণ বলে, না, বরং মরুভূমি চমৎকার লাগে। পতিত লালমাটির ডিহি, মাঠ।
সুহাস বলে, আপনার সঙ্গে আমার মেলে না। কারওরই মেলে না।
মেলে না কেননা সবাই একইরকম ভাবে ভাবতে ভালোবাসে, আরে বাবা ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা — সেই পাঁচবছর বয়স থেকে শুনছি। এর ভেতরে নতুন কী আছে। মরুভূমিতে গেছ কখনও?
সুহাস মাথা নাড়ে।
তাহলে আর কী বুঝবে। এক ভয়ংকর সৌন্দর্য। রোদে পুড়তে পুড়তে জল না পেয়ে মরেই গেলে হয়তো। তুমি ম্যাকেনাস গোল্ড দেখেছিলে?
দেখেছিলাম বোধহয়। নিস্পৃহে উত্তর দেয় সুহাস।
চোরাবালিতে ডুবে মৃত্যু দেখেছিল?
সুদামা অবাক হয়ে দুজনের কথোপকথান শুনছে। দেখছিল কীভাবে অনিলবরণ ফসল ভরা জমিকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় রাজারামপুরের সবুজ কৃষি ভূমি, কোথায় মরুভূমির বালি, চোরাবালি, মৃত্যু। চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়া সেই স্বর্ণসন্ধানীর কথা শোনাচ্ছে অনিলবরণ। পারেও বটে মানুষটা ঘুরে ফিরে তার নিজের পছন্দের দিকে চলে যাবেই। চোরাবালির ভেতরে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে স্বর্ণসন্ধানীর দেহ। পা থেকে হাঁটু, হাঁটু থেকে কোমর, কোমর থেকে বুক…। মানুষটি আঁকড়ে ধরতে চাইছে মাটি। মাটি মানেই তো বালি, চোরাবালি, তার কোনো ভার নেই। সর সর করে সরে যাচ্ছে হাত। মানুষটার চোখমুখে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে আতঙ্ক। তার সহযাত্রী স্বর্ণসন্ধানী, তিনি বোধ হয় ছিলেন গ্রেগরি পেক, নিরাপদ দূরত্ব থেকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন দড়ি। দড়ি হাতের নাগালে এসেও আসছে না। আস্তে আস্তে মানুষটি তলিয়ে গেল বালির ভেতরে। বালি আবার শান্ত, নিশ্চুপ। একেবারে নিরাপদ চেহারা নিয়ে পড়ে থাকল মরুভূমির ভেতরে। অপেক্ষা করতে লাগল আর একটি শিকারের জন্য। আর একটি মানুষের মরণ হয়ে পড়ে থাকল হিলহিলে রোদ্দুর।
সুহাস বলল, এসব আমার মনে আছে।
তবে বোঝো, মৃত্যুর অমন চেহারা কি কখনও দেখেছ? যাচ্ছিল সোনার সন্ধানে, হারিয়ে গেল বালির ভেতরে —
সুহাসের মুখখানি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে হাত তুলল, আমার ভালো লাগছে না এসব শুনতে।
ভালো না লাগলে হবে, দেখো ভায়া এসবই হল রিয়ালিটি।
আপনি থামুন।
হা হা করে হাসে অনিলবরণ, বলে, গেল সোনার সন্ধানে, পেয়ে গেল মৃত্যুর সন্ধান। অবশ্য শেষপর্যন্ত সবাই তো মরে না, কেউ কেউ মরে। যারা মরে তাদের মৃত্যু ওইরকম হয়, ভয়ংকর সুন্দর —
সুহাস বলে, আমি বলছিলাম গ্রিনের কথা, সবুজ ফসলের জমি, যা আমরা আজ দখল করেছি — আমরা কি ঠিক করেছি ওই ইরিগেটেড জমি প্রজেক্টের জন্য অ্যাকোয়ার করে?
অনিলবরণ বলে, বাজে কথা বলছ, তোমার নেশা হয়ে গেছে।
না, না আমি ঠিক আছি, আমি বলছি গ্রিইন….।
ঠিক নেই তুমি। অনিলবরণ ঢুলছে, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে স্বর্ণসন্ধানী, সোনার খোঁজে বেরিয়েছ।
স্টপ ইট। সুহাস চিৎকার করে ওঠে, চুপ করুন মিঃ ঘোষচৌধুরী।
অনিলবরণ হাসে। সুহাসের কাঁধে হাত রাখে। বিড়বিড় করে, আমি কিন্তু ভুল বলছি না।
হ্যাঁ বলছেন।
তাহলে বলছি। উদাসীন হয়ে যায় অনিলবরণ।
সুহাস মুখ গম্ভীর করে টলতে থাকে। বিড়বিড় করতে থাকে, গ্রিইনের মূল্য কে বুঝবে, যারা চাষ বাস করেনি, ফসল ভরতি জমির মর্ম বুঝতে ফসল ফলানোর কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে হয়….। সুহাস আপন মনে বকবক করতে থাকে।
চার
সুদামা ক্রমশ কৌতূহলী হয়ে ওঠে সুহাসের প্রতি। একত্রিশ বত্রিশের বীরভুমের এই যুবককে তার মনে হয় অতি সাধারণ, অফিস কর্তার পিছনে ঘুর-ঘুর করা আর পাঁচটা চাকুরের একজন, যে বড়ো সায়েবের ফোন এলে ক্রমাগত স্যার, স্যার, ইয়েস স্যার উচ্চারণ করে কৃষ্ণেন্দুর মতো, যে বড়োকর্তার ফাইফরমাশ খেটেও নিজের উন্নতির পথ প্রশস্ত করতে চায়। কিন্তু কী বলছে সেই সুহাস? ও বীরভূমের গ্রামের ছেলে, বাবা প্রাইমারি স্কুলের টিচার, ওদের চাষের জমি আছে দশবিঘের মতো। প্রতি অঘ্রানে ধান ওঠে। না, দুটো ক্রপ ওদের জমিতে হয় না। ওখানে সেচের ব্যবস্থা নেই। সেচের সুফল পাওয়া দু-ফসলি জমি তারা আজ দখল করল, মন খারাপ হয়ে গেছে সুহাসের। এই সময়ে তাদের খয়রাশোল ব্লকের সব গ্রাম রোদে পোড়ে, শুধুই পোড়ে। জমির হাড়গোড় বেরিয়ে যায়। ধুলো ওড়ে শুধু …
অনিলবরণ হাসে, হুইস্কি কিক করছে তোমাকে সুহাস, জমি বাদ দিয়ে গান গাও দেখি, চাঁদের গায়ে ….।
মাথা নাড়ে সুহাস, নো স্যার, আমার মনে পড়ছে চাষি বউটার কথা, কিষাণী। ওই যে বলছিলাম চাষিরাই বোঝে সবুজের মর্ম ….।
হা হা করে হাসে অনিলবরণ। কিষাণী, চাষি বউ। দারুণ বলেছে তো সুহাস। এত পুলিশ, অফিসার গেল, মনে পড়ল শুধু চাষি বউকে, হ্যাঁ বয়স অবশ্য কমই ছিল! সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী, কৃষিকর্ম নিপুণা ….।
অনিলবরণ একটু ভোঁতা প্রকৃতির। নেশা করলে বেসামাল হয়। তার কথার আগল থাকে না কোনো। লোকটা কৃষ্ণেন্দুর সহকর্মী। এই ফ্ল্যাটে এসেছে অনেক, বউ নিয়েও এসেছে, কিন্তু সুদামার ওকে একদম পছন্দ হয় না। হৃদয়হীন মানুষ, অফিসেও নাকি খুব বদনাম ওর। কারওর সঙ্গেই ভালো করে কথা বলে না। সাব-অর্ডিনেট স্টাফরা তো ক্ষেপেই থাকে সর্বক্ষণ। ওর বউও নাকি ওকে ছেড়ে চলে গেছে। ওইরকম লোকের সঙ্গে কেউ সংসার করতে পারে। সারাক্ষণই খুন জখম মৃত্যু রক্তপাত নিয়ে কথা বলে রহস্য ঔপন্যাসিক অনিলবরণ। হা হা করে হাসে।
অনিল বলল, চাষি বউটার জন্য কষ্ট হচ্ছে তোমার, আরে বাবা বললে না কেন, পুলিশ দিয়ে তো তোলাই যেত আজ। থানায় ভরে দিতাম। তারপর তোমাকে সুযোগ দিতাম, হ্যা হ্যা হ্যা, আলাপ করতে লকআপে ঢুকে। হা হা হা, তুমিই হলে আসল স্বর্ণসন্ধানী সোনাটা চিনেছ, চোরাবালিতে পড়া না-পড়া তোমার ইচ্ছে।
সুদামা অন্ধকারে সরে গেছে আরও। সে যদি আলোয় থাকে দরজার গোড়ায় তো ওরা ইচ্ছে মতো আলাপ করতে পারবে না। তার কৌতূহল বাড়ছিল। সে আন্দাজ করছিল, করতে চেষ্টা করছিল কী হয়েছে আজ। কে সেই চাষি বউ, যাকে নিয়ে অনিলবরণের রসিকতা।
কৃষ্ণেন্দুকে বলছে সুহাস। কৃষ্ণেন্দু ওই সামান্য ঘটনাটির কথা জানে না। সে তখন ওই স্পটে উপস্থিত ছিল না। উপস্থিত থাকার কথাও ছিল না তার। সে ছিল রাস্তার ধারে, একটি ক্লাব ঘরে এল পি জি সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে ব্যস্ত। দু-একটা প্রয়োজনীয় বিনিময়, সামান্য সময় খোস-গল্প, ইত্যাদিতে মগ্ন। আজ তো গ্রামের মানুষকে ঘরেই রেখে দিয়েছিল পুলিশ প্রশাসন। ভোরবেলায় রাজারামপুর গ্রামে রাইফেলধারীরা নেমে গিয়েছিল। ওই গ্রামে যত পুরুষ মানুষ ছিল, তার দশগুণ ছিল রাইফেলধারী, টিয়ার গ্যাস, লাঠি-ঢাল সমেত পুলিশ। সাবধানতার কোনো ত্রুটি ছিল না। অত উর্দি রাইফেল দেখে পুরুষ মানুষরা ঘর থেকে বেরোয়নি। পাড়ার মুখে মুখে, রাস্তার প্রতিটি বাঁকে, ঝোপেঝাড়েও পুলিশ বসিয়ে দিয়েছিল প্রশাসন। এইভাবেই হয়ে থাকে। মানুষের বেরোনোর সব পথ বন্ধ করে গ্রাম জনবিরল করে দেওয়া হয়েছিল। আগে কতকগুলি জোনে ভাগ করে ফেলা হয়েছিল গোটা বসতিকে, সেইভাবে পাহারা বসানো হয়েছিল। একটা মানুষও বেরোয়নি, দু-একজন বৃদ্ধ প্রশ্ন করতে এলেই তাদের ঝটপট করে সরিয়ে দিয়েছিল রাইফেলধারীরা চোখ রাঙিয়ে।
কিন্তু এত সতর্কতার ভিতরে ও মাঠে চলে গিয়েছিল দু-চারজন। তাদেরও সরিয়ে দিতে অসুবিধে হয়নি। অসুবিধে হয়েছিল এক চাষি বউয়ের বেলায়। পুরুষ মানুষ ঘরে, সে বেরিয়েছিল। রাইফেলধারীদের নজর এড়িয়ে আড়াল-আবডাল দিয়ে রোয়া জমিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার হয়তো ক্ষীণ আশা ছিল জমিতে যখন ধান, জমি দখল করবে না গ্যাস কোম্পানি। জমির ধানই জমিকে তো রক্ষা করেছে এতদিন, এবারও তাই হবে। এইভাবেই যেন জমি চিরকাল রক্ষা করা যাবে। ধানকাটা পর্যন্ত সময় দেবে। ধানকাটার পর আবার ফসল ফলানোর আয়োজন করে পিছিয়ে দেওয়া যাবে অধিগ্রহণের দিন। কিন্তু তা যখন হচ্ছে না, শাল-খুঁটি পোঁতা হয়ে যাচ্ছে জমির সীমায়, তখন বউটি জমির আলে বসে পড়েছিল। একটু গলা তুলে বলেছিল, কাঁচা ধান যেন নষ্ট না করে পুলিশ, জমিতে যেন না নামে মজুররা, যারা শাল-খুঁটি কাঁধে নিয়ে সার্ভে পার্টির পিছনে পিছনে হাঁটছিল। কিন্তু কথা হল এই, মেয়েমানুষটা এল কী করে এতদূর? চাষ করতে কে বলেছিল তাকে? পুলিশের কথা হল এই রকম।
সুহাস বলছে, মানুষের কৃষিকর্মের অভ্যাস তো বহুকালের। মানুষ তো অভ্যাসে চাষ করে। আকাশে মেঘ উঠলে সবচেয়ে খুশি হয় কে? আকাশের পাখি, গাছ আর চাষি মানুষ। পুলিশ খুব খারাপ ব্যবহার করছে ওই বউটির সঙ্গে। অশ্লীল ভাষায় তাকে গালিগালাজ করেছিল।
কী রকম! না এক রাইফেলধারী কনেস্টবল প্রথমে বলল, উঠে যান জমি থেকে, ক্রপ কমপেনসেশন তো দেবে! আমাদের কাজে বাধা দেবেন না।
বউটি শোনেনি। তার বয়স কম। তার রাগও তাই বেশি। তেজও। তেজেই বলেছিল, তার জমি বাদ দিয়ে দিক বাবুরা। ধান নষ্ট করে যেন কোনো কাজ না হয়।
তখন পুলিশ ভয় পাওয়াল বউটিকে। ভয় দেখানো প্রয়োজন ছিল। না হলে সে জমি থেকে উঠতই না। এক রাইফেলধারী বলেছিল, যদি জমি থেকে না ওঠে সে, তবে তুলে নিয়ে গিয়ে লকআপে ভরে কেসে ঝুলিয়ে দেবে।
আর একজন আর একটু বাড়িয়ে বলল, তাতে ছ-মাস জেল, দশ হাজার টাকা জরিমানা।
চোখ রাঙানো তৃতীয় রাইফেলধারী, গর্জে উঠেছিল, যা ভাগ, লকআপে চোর-ছ্যাঁচোড়ের সঙ্গে গুণ্ডা বদমাশের সঙ্গে যদি সারা রাত্তির থাকিস তো কী হাত পারে জানিস! বেটাছেলেদের ঘরে থাকবি রাতভর।
অনিলবরণের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বলল, ঠিকই তো বলেছে, মেয়েছেলের জন্য যদি আলাদা লকআপ না থাকে তো কোথায় রাখবে, দারোগাবাবুর ঘরে?
সুহাস বলল, কথাগুলো বলাই তো ঠিক নয়, কোনো মহিলাকে সন্ধের পর থানা আটকে রাখতে পারে না। আর কথাগুলো খুব খারাপভাবে বলেছিল স্যার।
অনিলবরণ নিশ্চুপে মদ্যপান করে। বলল, তুমি একেবারে বাচ্চা। পুলিশকে ভয় না দেখালে চলে। আরে বাবা গায়ে তো হাত দেয়নি, আঁচল ধরে তো টানেনি। আর মেয়েটাই-বা কী রকম! অত পুলিশের ভেতরে চলে গেল? ভয় করল না?
বাহ! জমিটা তো তার।
হা হা করে হাসে অনিলবরণ, জমি আমাদের। মানে গভমেন্টের। আমরা ইচ্ছে হলেই নিয়ে নেব। স্টেট প্রয়োজন হলে সব কিছু করতে পারে, মানুষ মারতে পারে, মানুষকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে পারে। ওর স্বামীই-বা কীরকম, বউকে পাঠিয়ে দিল পুলিশের ভেতর? জানে না পুলিশ কোনো সুবোধ বালক নয়।
সুহাস বিড়বিড় করে, আমরা ওই রকম এ ক্লাস ল্যান্ড না নিতেই পারতাম, কী চমৎকার ফসল হয়। দেখুন স্যার চাষিরাই এদেশে একমাত্র কাজ করে, সময়ের কাজ সময়ে করে, শ্রাবণে অঘ্রানে বৈশাখে জ্যৈষ্ঠে, তারা ধান রোয়া ধানকাটা বন্ধ রেখে ঘরে বসে তাস খেলে না, সিনেমার নায়িকার শরীর নিয়ে গল্প করে না, রহস্য উপন্যাসের খুনের বিচিত্র উপায় নিয়ে ভাবেও না। দে আর ডিসিপ্লিনড, পাঞ্চুয়াল, লেবোরিয়াস।
অনিলবরণ ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছে নেশার টানে, মাথাটা তুলে বলল, রহস্য উপন্যাসে খুনের উপায়! হোয়াট ডু য়্যু ওয়ান্ট টু টেল, ওটা কোনো কাজ নয়। তুমি কি জানো মার্ডার ইজ অ্যান আর্ট, মূর্তি মার্ডার সম্পর্কে কী জানো, জানো মানুষের ভেতরে সবচেয়ে প্রখর দুটো ইনসটিঙ্কট, সেক্স অ্যান্ড মার্ডার, ছেলেবেলায় পিঁপড়ে টিপে মারতে না?
অনিলবরণ আবার তার প্রসঙ্গে চলে গেছে। মার্ডার নিয়ে বক্তৃতা করতে আরম্ভ করল। কেউ শুনছে কিনা সে বিষয়ে তার কোনো কৌতূহল নেই, নেশার ঘোরে তা থাকার কথাও নয়। সুহাস সরে গেল কৃষ্ণেন্দুর কাছে, সে বোঝাচ্ছে কৃষ্ণেন্দুকে, স্যার, আমার মন খারাপ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমরা আমাদের ডিউটি ঠিকমতো করিনি। জমি চাইছে বিভিন্ন সংস্থা, ডেভেলপমেন্ট হবে। আমরা তো পরিশ্রম করে পতিত জমি, ফসলহীন জমি খোঁজ করে তাদের দেখাব। তা না করে চাষের জমি দিয়ে দিলাম, চাষই হওয়া উচিত আমাদের ডেভেলপমেন্টের হাতিয়ার, আমাদের চাষিরা কী চমৎকার ফসল ফলায়, যখন ধান ওঠে, কী ধান কী ধান! যখন, ধরুন শীতের সবজি, কপি ওঠে, কপির পাহাড়, এত ফসল কোথায় হয়? অথচ এসব আমরা ভাবছি না, এটাই হল ব্যুরোক্রেসির দোষ, ক্ষমতাকে ঠিকভাবে ব্যবহার করি না আমরা।
কৃষ্ণেন্দু গম্ভীর। তার নেশা হয় না। নেশা হলেও অচঞ্চল থাকে সে। সে সুহাসের কথা শোনে, কিন্তু মন্তব্য করে না। মাতালের কথার কোনো মানে নেই, তাই। সুহাস সাড়া না পেয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ানো সুদামাকে খোঁজে। সে তার যুক্তির সমর্থক খুঁজে পেতে চাইছিল। আর তখন অনিলবরণ তা বক্তৃতায় কোনো সাড়া না পেয়ে আচমকা সুহাসের পিঠ চাপড়ে দেয়, তুমি বড্ড বেশি কথা বল, বেশি ভাব, বেশি বুদ্ধিমান মনে কর নিজেকে, বেশি চালাক, চাষি-দরদী! অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হচ্ছ এইভাবে? আরে শালা, পুলিশ তো অত্যন্ত ভদ্র-সভ্যের মতো কাজ করেছে আজ, সেই রকম ডিরেকশন ছিল। তা যদি না করত তাতেই-বা কী ক্ষতি হত, পুলিশকে লোকের ভয় করা উচিত, তা না হলে শাসনই থাকে না, তখন তোমার আমার মূল্য কী! পুলিশ দিয়েই তো রাজ্য শাসন হয়, মন্ত্রী, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কমিশনার, বিচারপতি সবার ক্ষমতার উৎসই তো পুলিশ। দরকারেই আমরা পুলিশ ডাকি। আরে বাবা পুলিশের প্রতি যদি ভয় না থাকবে, কাজ হবে কী করে? ভয় পাওয়ানোর জন্য একটা দুটো রেপ, লকআপে থার্ড ডিগ্রি দরকার। আই সাপোর্ট ইট। এসব ঘটে বলেই না মানুষ পুলিশকে যমের মতো ভয় করে — বলে হা হা করে হাসতে থাকে অনিলবরণ, শোনো সুহাস, মার্ডারের নানান কেস হিসট্রি আমি পুলিশের কাছ থেকে নিচ্ছি, যদি শুনতে তুমি।
সুদামা এইসব শুনতে থাকে। বাধ্য হয় শুনতে।