এখন বেদ মানলে পিছিয়ে পড়ব
একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে আমাদের নাকি বৈদিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে হবে। বেদ জানতে হবে, সংস্কৃতে কথা বলা রপ্ত করতে হবে, চর্চা করতে হবে জ্যোতিষশাস্ত্রের। ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এ তো পিছনে হাঁটার শামিল। অবশ্য, এ সবই কেন্দ্রের বর্তমান বিজেপি-জোট সরকারের ফতোয়া। ওরা হিন্দুত্বের সংহতি চাইছে বেদের নামে। বলছে, বেদ অপৌরুষের, স্বয়ংসম্পূর্ণ। সভ্যতা, বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্রের ২৫০০ বছরের প্রভূত অগ্রগতির পর কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের নির্দেশনামা মেনে নেওয়ার অর্থই সমাজটাকে আরও কয়েকশো বছরে পিছিয়ে দেওয়া। এটা বাঞ্ছনীয় নয়। মেনেও নেওয়া যায় না, মানলে সব তালগোল পাকিয়ে যাবে।
বেদ মানব কেন? বহুতর বিজ্ঞানের উন্নতির যুগে বেদের এ ধরনের চর্চা বাঞ্ছনীয়ও নয়। এর আগে অবশ্য বৈদিক জীবনযাত্রার ধারণাগুলি বুঝে নিতে হবে। বহু জীবনমুখী ধারণার সঙ্গে এমন কথাও আছে যে, পুরুষ খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবে। বেদকে মানতে গেলে আজকের যুগে কোনও স্ত্রী এই শর্তে স্বামীর সঙ্গে ঘর করবেন? এটা তো যুক্তি বুদ্ধিতেও মেনে নেওয়া যায় না। বলা আছে, ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য জামা, জুতো, ছাতা ভৃত্যকে দিতে হবে। এই শর্তেও কি কেউ আজ কাজ করতে রাজি হবেন? বেদের কথা অনুযায়ী, যে কোনও নারীর পক্ষে একজন পুরুষই যথেষ্ট; অথচ একটি পুরুষের জন্যে অন্তত দু’জন নারীর প্রয়োজন। এই উদ্ভট যুক্তি নারীরা কোনও ভাবেই মেনে নেবেন না, এটা ভারতীয় সংবিধানেও আটকাবে। নারী আন্দোলনে তোলপাড় হবে দেশ। যেমন আর এক জায়গায় বলা আছে, ছুঁচো, পেঁচা, কালো সাপ, শকুন, নারী এবং শূদ্র একই ধরনের অশুচি; এদের দেখলেও পাপ হয়। এদের মারলে একই প্রায়শ্চিত্ত— এক বেলা উপবাস। বলা আছে, শিক্ষিতা বা ধনবতী নারী পুরুষের সমান। এই অধিকার একমাত্র পুরুষেরই। এমনকী নারীর দেহের উপরও তার কোনও নিজস্ব অধিকার নেই। এ সব মানলে তো ক্রমশ পিছিয়ে পড়বে সমাজ। আর মানতে যাবেই বা কেন?
অনেকটাই এগিয়ে চলা সমাজের উপর জোর করে বহু পশ্চাতের বৈদিক ভাবনাচিন্তা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক ও অনৈতিহাসিকও। হিন্দুত্বের নামে বেদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলেও বেদের সঙ্গে হিন্দুধর্মের অমিল নেহাত কম নয়। প্রথমত, হিন্দুধর্ম সেই অর্থে বেদ বিরোধী। বেদের যজ্ঞে মন্দির, মূর্তির স্থান ছিল না। পশুবলি দেওয়া হত পশুর শ্বাসরোধ করে। নৈবেদ্যে ব্যবহার করা হত যবের রুটি, দুধ, ঘি, গো-মাংস, দই, পায়স, সুরা ইত্যাদি। হিন্দুদের নৈবেদ্যের সঙ্গে এ সবের কোনও মিলই নেই। হিন্দুর মন্দির, মূর্তি আছে। আর নৈবেদ্যের ডালি সাজানো হয় ফল, আতপ চাল, দুগ্ধজাত মিষ্টান্ন দিয়ে।
দ্বিতীয়ত, হিন্দুধর্মে ব্রত, তীর্থ, মানত, ধ্যান, জপ-তপ প্রচলন অধিকমাত্রায় লক্ষ করা যায়; বেদে এ সবের কোনও উল্লেখই নেই।
তৃতীয়ত, হিন্দুদের পুজোর মন্ত্রগুলি প্রায়শই অস্থানপ্রযুক্ত বৈদিক ও পৌরাণিক মন্ত্রের জগাখিচুড়ি। তবে প্রার্থনার ক্ষেত্রে মিল আছে, দুই ক্ষেত্রেই প্রার্থনা ঐহিকসুখের জন্য।
হিন্দুধর্মের সঙ্গে বেদের মিল আছে আর একটি বিষয়ে। বেদ এবং হিন্দুধর্মের মূল শাস্ত্রগুলিতে নৈতিকতার কোনও বালাই নেই। মানুষের জীবন, নীতি, আদর্শের কথা ভাবতে হলে, বেদে বিশেষ কোনও নির্দেশ পাব না। হিন্দুধর্মেও একই অবস্থা। দু’ক্ষেত্রেই বার ব্রত পাব, চিহ্ন মিলবে না নৈতিকতার।
অন্য দিকে, সমাজ এগিয়েছে নীতিশাস্ত্রের উপর ভর করেই। ‘ethics’ নিয়ে দুশো বছর ধরে বিস্তর চর্চা হয়েছে। আর বেদের নামে অত সহজে ছেড়ে দিতে হবে ‘ethics’ বা নীতিশাস্ত্রকে? সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি ত্যাগ করতে হবে শুধুমাত্র একজন ‘হিন্দু’ বা ‘নববৈদিক’ হবার লিপ্সায়?
তা হলে কি বেদের কোনওই প্রয়োজন নেই? আছে, অবশ্যই আছে।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকের বড় সাহিত্য হল বেদ। পরিপূর্ণ দশ হাজারের বেশি শ্লোকের সমাহার। সমাজজীবনের সম্পূর্ণ চিত্রও মেলে বেদে। মানুষে মানুষে প্রকারভেদে আজও তেমন কোনও তারতম্য ঘটেনি। মানব প্রকৃতির চিত্রও এক। ‘সাংমনস্য’ শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে রচিত সূত্র পারিবারিক, অর্থাৎ তখনও সব পরিবারে নিরন্তর সুখ, শান্তি ছিল না। যা আজও তেমনই আছে। বৈদিক চরিত্রগুলিও ছিল বিশ্বাসযোগ্য। বেদে বহু তথ্যও আমরা পাই। উদ্ভিজ, প্রাণিজ, খনিজ, কর্মবিভাগ, জাতিভেদ, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, অবিশ্বাস সবই পাই বেদে। প্রকৃতি, সমাজ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন সাধনার সন্ধানও মেলে। দুঃখ দারিদ্র্যও স্মরণ করতে হলে ঋষি বামদেবের কথা বলা যায়। তিনি বলছেন, ‘অভাবে কুকুরের নাড়িভুঁড়ি রান্না করে খেয়েছি।’ চণ্ডালের পরিত্যক্ত ওই নাড়িভুঁড়ি খেতে হয়েছে ঋষিকে। অর্থাৎ, বেদে ক্ষুধা, অনাহারের কথা বহু বহু বার উচ্চারিত যা আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বৈদিক সমাজব্যবস্থার বিশেষ বিশেষ অংশে বর্তমানের সঙ্গে সাযুজ্য আছে।
বেদের পঁচাত্তর ভাগ সূক্তই (শ্লোকসমষ্টি) প্রার্থনা-নির্ভর। বাকি পঁচিশ ভাগের মধ্যে বেশ কিছু অংশ উন্নত চিন্তার পরিচায়ক। সে অর্থে, সব দিক থেকেই বেদ প্রাচীনকালের অনবদ্য প্রতিরূপ। বেদেই প্রথম ভারতীয় ভাষায় সাহিত্য চিন্তাধারার বিকাশ। এক কথায় বেদ এক অপরিহার্য উত্তরাধিকার।
বেদের জ্যোতিষচর্চা নিয়ে এখন বেশ হইচই হচ্ছে। এমনকী বৈদিক হিন্দুরা আজ জ্যোতিষশাস্ত্রকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করেছে। হ্যাঁ, বেদে জ্যোতিষচর্চা উল্লেখ আছে বইকি। গ্রহ, নক্ষত্রের অবস্থান নিয়ে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদে প্রায় পঞ্চাশের মতো শ্লোক পাওয়া যায়। যজ্ঞের কাল নির্ণয়ের জন্য গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থা জেনে যজ্ঞের তিথি ঠিক করবার জন্যই এই চর্চা করা হত। প্রয়োজনের তাগিদে এই চর্চা। তবে এটা জ্যোতিষচর্চা নয়, জ্যোতির্বিজ্ঞান। এখন জ্যোতিষচর্চার কথা বলা হচ্ছে। এই চর্চার উদ্ভব মধ্যযুগের শেষে। গ্রহরত্ন, হস্তরেখা বিচার, কোষ্ঠিবিচার এই সমস্ত বৈদিক যুগে প্রয়োজনই ছিল না। এখন অবশ্য এ-নিয়ে ফলাও ব্যবসা চলছে তথাপি এই বিদ্যা কোনও মতেই বিজ্ঞান নয়। এটি একটি অর্বাচীন বিদ্যা। এই অবিদ্যা শিখতেই বা যাব কেন?
কথা চলছে কথ্য সংস্কৃত চালু করা নিয়েও। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সম্প্রতি এ বিষয়ে ফলাও বিজ্ঞাপন ছেপেছে। বলা হয়েছে, স্নাতকদের মধ্যে থেকেই নেওয়া হবে কথ্য সংস্কৃতের অধ্যাপক। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এর জন্য পদও থাকছে। পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচন হবে না, মনোনায়ন করা হবে। এ সবই সম্পূর্ণ অবাস্তব বেআইনি প্রক্রিয়া।
প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ কথ্য সংস্কৃত কেন?
আসলে কট্টরপন্থীরা মনে করছেন, ভারত হিন্দুদের দেশ আর সংস্কৃতই হিন্দুর আদি ভাষা। দুটোই ভুল।
ভারতে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সন্দেহ নেই। তবে অন্য বহু ধর্মের মানুষও তো এখানে বসবাস করেন। মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখরা বাস করছেন এক সঙ্গে। ফলে ভারতবর্ষ শুধুমাত্র হিন্দুদের দেশ হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, হিন্দুর ভাষা একমাত্র সংস্কৃত নয়। সংস্কৃত প্রাচীনকালের শিক্ষিত মানুষের ভাষা। প্রকৃত দেশীয় কথ্য ভাষা হল বৈদিকযুগ থেকেই প্রাকৃত। কালের বিবর্তনে পালি ও খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতকে কথ্যভাষাগুলির উদ্ভব, এ সব ভাষার বিবর্তন এখনও চলছে। আমরা যে ভাষায় কথা বলি, তা মূলত প্রাকৃত থেকেই উদ্ভূত।
সর্বশেষ আদমসুমারিতে কৃত্রিম ভাবে কিছু সংখ্যক সংস্কৃতভাষীর কথা নথিবদ্ধ করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন, এই তথাকথিত সংস্কৃতভাষীরা বাজারে গিয়ে আলু, পটল কী ভাষায় কেনেন? আসলে এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আজকের ভারতীয়রা সংস্কৃতভাষী নন, অঞ্চলিক ভাষাভাষী।
বলা হচ্ছে, সংস্কৃতকে সম্মান জানাতে তাকে মাতৃ ভাষা বলা চলবে না। স্পষ্টই বলা যায়, যে ভাষায় স্বাভাবিক ভাবে মানুষ কথা বলেন, শুধু সেটাই জীবিত ভাষা। রবীন্দ্রনাথকে সম্মান জানাতে কি বলতে হবে যে, তিনি বেঁচে আছেন? মৃত ভাষাকেও সম্মান জানানো যায়। গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রুকে মৃত ভাষা বলে স্বীকার করেও এখনও সেগুলির অনেক উন্নতমানের চর্চা চলছে। সংস্কৃত নিয়ে যত উচ্চগ্রামে চিৎকার চলছে, চর্চা চলছে না অনুরূপ উন্নতমানের। কিছু মৃত্যু স্বীকার করতেই হয়। প্রাচীন আসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, মিশরীয় ভাষা মৃত হলেও এগুলির চর্চা হয়। সংস্কৃতকে মৃত ভাষা বলে স্বীকার করেও একে সম্মান করে ওঁরা চর্চা করবেন।
আমরা সহজ এবং বলিষ্ঠ মনোভাব থেকেই সংস্কৃত চর্চা করতে পারি। এর জন্য হুলিয়া জারির প্রয়োজন নেই। খোলা চোখে ভারতবর্ষে হিন্দুর উদ্ভব, অবস্থান দেখে আলোচনা করলে এবং বৈদিক ও আদিমধ্যযুগীয় সংস্কৃত ভাষার চর্চা করলে হয়তো সঙ্ঘীদের মতে আদর্শ হিন্দু হওয়া যাবে না, কিন্তু শিক্ষিত ভারতবাসী হওয়া যাবে।