1 of 2

এখন ফোঁটার সময়

এখন ফোঁটার সময়

কোনো কোনো দিন কাকে যে কীভাবে মুখর করে তোলে। চারপাশে মনে হয়। ব্যাপ্ত জীবন-আকাশ গভীর নীল, পৃথিবীর অদূরে শুকতারা জ্বলে। দখিনের হাওয়া বয়—মনের মধ্যে কারা কেবল কথা কয়ে যায়—জীবনের চারপাশে অপার এক সৌন্দর্য খেলা করতে থাকে। এরই নাম বোধ হয় জীবনের সুষম্য—কখনো অতর্কিতে সে আসে। আবার গভীর এক রহস্য লোকে সে হারিয়ে যায়।

আজ জানালা খুলতেই পূর্বার এমনটি মনে হল। শীত যাই যাই করেও যাচ্ছে না। বাগানে বড়ো বড়ো ডালিয়া, ক্রিসেন্থিমাম সব ফুটে আছে। শিশির ভেজা। সকাল সকাল তার আজ ঘুম ভেঙে গেছে। এত সকালে তার ওঠার অভ্যাস নেই। মা গায়ের লেপ সরিয়ে না দিলে সে উঠতেই চায় না। সকাল থেকে বাবা ডেকে যান, মা ডেকে যায়, আরে ওঠ। কত ঘুমাবি।

মা বলবে, ঘুম না ছাই। লেপে মাথা ঢেকে শুয়ে আছে। পড়ার ভয়ে উঠছে না।

বাবা বলবেন, উঠে পড়। শুনছিস তো কী বলছে তোর মা।

আসলে পূর্বা জানে বাবা বিশ্বাসই করেন না, সে পড়ার ভয়ে না ওঠার মেয়ে। বাবা কি টের পান, ভোরে জেগে জেগে সে একটা স্বপ্ন দেখে। বাবা না হলে বেসিন থেকে হয়ত মুখ ধুয়ে আসার সময় চোখে পড়ে গেলে মিষ্টি করে হাসেন কেন!

তার ভাবতে লজ্জা লাগছিল।

বাবা এ-সব জানবেন কী করে!

মা জানতে পারে। মার কাছে তার এখনকার পৃথিবীটা পুরোনো পৃথিবী।

কিন্তু বাবা!

সে কেমন তাড়াতাড়ি গা ঢেকে ফেলল। চাদর মুড়ি দিয়ে অলস চোখে বাগানের ফুল ফোঁটা দেখছিল।

সে ভাবল, ফুল ফোটে।

সে ভাবল, তার এখন ফোঁটার বয়স।

সে জানালায় দাঁড়িয়ে গাছপালার ফাঁকে সূর্য ওঠা দেখল। কত সব পাখি উড়ে যাচ্ছে দূরের আকাশে। সবাই বের হয়ে পড়েছে। সে টের পায় সুদূরের সব সৌন্দর্য এখন তার সারা গায়ে শীত হয়ে জড়িয়ে আছে। সে ভিতরে ভিতরে আজ ভারি শীত অনুভব করল।

বাবা সকাল আটটায় বের হয়ে যান।

বাবা বোধহয় বাথরুমে। ঘড়িতে সে দেখল সত্যি বেলা হয়ে গেছে। সাতটা বাজে। শীতের সকালে সাতটা খুব বেলা নয়। তবু বাড়িতে সকালের দিকে খুব তাড়াহুড়ো থাকে। বাবা বের না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এটা চলে। সে দরজা ভেজিয়ে দেয়, দরজা বন্ধ করে শুতে তার কেমন এখনো ভয় লাগে। বাড়িতে সে মা বাবা, আর দুজন কাজের লোক। ওরা রান্নাঘরের ওদিকটার থাকে। সবার আগে ঘুম ভাঙে মার। মারই কাজ সবাইকে ডেকেডুকে তোলা। করিডোরে হাঁটাহাঁটির শব্দ হলেই তার ঘুম ভেঙে যায়। মার ডাকাডাকিতেও ঘুম ভাঙে। তাদের দিকটার কোলাপসিবল গেট। রাতে শোবার সময় মা সেটা বন্ধ করে দেয়। কারণ বাবা-মা কেউ বোধ হয় কাজের লোক দুজনকে বিশ্বাস করে না। মেয়ে বড়ো হয়ে উঠছে, না চোর বাটপাড়ের ভয় কোনটা, সে বোঝে না। সুদামদা নিরীহ গোবেচারা মানুষ, আর নন্দ তো বুড়ো হয়ে গেছে। কতকাল হল আছে!

আজ নিনি মাসিরা আসবে। শীতের সময় নিনি মাসি, মেলোমশাই, অরূপদা এখানে একবার বেড়াতে আসেন। ফুল ফোঁটা দেখার সময় এ-কথাটা মনে হতেই ভেতরে সে কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল। এমন চাঞ্চল্য সে কেন জানি কোনোদিন অনুভব করেনি! তার হাই উঠছিল।

আসলে বড়ো হবার সময় কত অকারণে মনের মধ্যে নিশিদিন কি যেন এক রপকথার জগৎ ভেসে থাকে। অরূপদার ভারি ফাজিল স্বভাব। মাথায় গাঁট্টা মেয়ে কথা বলবে। বছর খানেকের বড়ো। তবু যেন তার কত খবরদারি।-এই পূর্বা, আবার জানালায় মুখ বাড়াচ্ছিস!

গাড়িতে যাবার সময় বাবা মেসো সামনে। সে মাসি অরূপদা আর মা পেছনে। সব সময় সে জানলার পাশে বসতে ভালোবাসে। অরূপদা তার সঙ্গে। সে দশ ক্লাশে উঠেছে। এবার। অরূপদার দশ ক্লাস শেষ। অথচ খবরদারিতে একেবারে বাবা মেসোর মতো!

আবার!

পূর্বা জানালার কাচ নামিয়ে মুখ বাড়িয়ে চারপাশের বাড়িঘর গাছপালা দেখতে ভালোবাসে। হু হু করে হাওয়া বয়। চুল ওড়ে, যেন এক ড্যাং ড্যাং বাজনা শুরু হয় ভিতরে। আর তখনই অরূপদার শাসনের গলা, ইস আবার!

চার পাশে তখন রা রা করে যেন বাজনা বাজতে থাকে আবার মিউজিক–ক্যান ইউ হিয়ার দ্য ড্রামস ফারনানডেজ। ওর তখন চোখ বুজে আসে। আবার কানে ভাসতে থাকে সেই অলৌকিক জগতের বাজনা-কিংবা সংগীত-সিনস মেনি ইয়ারস আই হ্যাভেন্ট সিন ইউ লাইং ফোল্ডিং ইউর হ্যাণ্ডস। অথবা নিল ডায়মন্ডের সেই সব সঙ্গীতমালা, ইউ আর দ্য সান, আই অ্যাম দ্য মুন, ইউ আর দ্য ওয়ার্ডস, আই অ্যাম দ্য টিউন। প্লে মি।

আসলে বাবা কী বুঝতে পারেন, এই খেলা তার জীবনে শুরু হয়ে গেছে। নতুবা আয়নায় এবার মুখ দেখে কেন! বাথরুমে ঢুকলে বের হতে ইচ্ছে হয় না। আয়নায় সে কত ভাবে যে নিজেকে এই বছর দুইয়ের মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলেছে। সারা শরীর দেখার মধ্যে আশ্চর্য এক মজা পায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে আয়নার সামনে ভালোবাসে। বাবা কি টের পেয়ে গেছেন কেউ তার জীবনে সকালের সব পবিত্রতা নিয়ে জেগে উঠছে। ঠিক সূর্যের মতো। যেন লালা আভা, দিগন্তবিস্তৃত শস্যক্ষেত্র, কীটপতঙ্গের আওয়াজ, ঝাঁকে ঝাঁকে নিরন্তর পাখিদের ওড়াউড়ি কোন এক সুদূরের জগতে নিয়ে চলে যায় বাবা কি সকালে মুখ দেখলেই এ-সব টের পান। এবারে সরস্বতী পূজার সময় বাবা না হলে তার জন্য হলুদ পাড়ের সাদা জমিনের শাড়ি কিনে আনলেন কেন! বললেন কেন, পূর্বা তুমি এই শাড়িটা পরে অঞ্জলি দেবে!

তখনই মার গলা পেল।

— কীরে এয়ারপোর্টে যাবি নাকি!

পূর্বার মনে হল মাসিদের আনার জন্য এয়ারপোর্টে গাড়ি যাবে। সব বারই সে মা-বাবার সঙ্গে যায়। নিনি মাসি মার বোন নয়। ছেলেবেলায় একসঙ্গে মানুষ, মার তো আর কেউ নেই। তার একটা মামা পর্যন্ত নেই। নিনি মাসিকেও দেখে বোঝা যাবে না, কথায়-বার্তায় এমনকী ব্যবহারে, নিজের বোনের চেয়েও বেশি। বোম্বেতে গেলে ওদের মাসি ছাড়তেই চায় না। যেমন কলকাতায় এসে মাও ছাড়তে চায় না নিনি মাসিকে। কটা দিন বাবার চেম্বার, নাসিংহোম সব কেমন ঢিলেঢালা। কখনও দীঘা, কখনো মুর্শিদাবাদ, আবার কখনো পিকনিক করতে চিড়িয়াখানায়। নানা রকম প্রোগ্রামে দিনগুলি ঠাসা থাকে।

কেন জানি সে বলল, আমি যাব না মা। তোমরা যাও।

মার কথা বলার সময় নেই। বাবার ঘরে উঁকি দিয়ে বলে গেল পূর্বা যাচ্ছে না। শরীরটা বোধ হয় ভালো নেই।

শরীর ভালো নেই বললেই বাবা সব বোঝেন। তখন আর কেউ তাকে পীড়াপীড়ি করতে সাহস পায় না।

এই শরীর ভালো না থাকার মধ্যেও সে দেখেছে বাবা মজা পান। সে যে গিয়ে বলবে, ধূস, তোমরা যে কী না, আমার শরীর ভালো নেই কে বলল! এমনি যেতে ইচ্ছে করছে না। দু-বছরে সে কত বড় হয়ে গেছে বাবা-মা বুঝবে কী করে। এই তো সেবারে অরূপদারা এল, তার ঘরে অরূপদা সব কিছু নিয়ে টানাটানি করত। তার ছবির খাতা, অ্যালবাম, ক্যাসেট, রেকর্ডপ্লেয়ার যা কিছু সবই হাঁটকাত। এটা না, ওটা। কী কেবল ‘আবা’র রেকর্ড দিচ্ছিস। বনি-এমে’র রেকর্ড দে না শুনি। সেই গানটা বাই দ্য বিভারস অব ব্যাবিলন, অথবা সেই রেকর্ডটা, নেভার চেঞ্জ লাভার এট মিড-নাইট। কেন যে এ গানটা এত ভালোবাসত অরূপদা। না দিলে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিত। অরূপদা রেকর্ডটা বাজাবেই। সে কিছুতেই দেবে না— কী বিশ্রী গান! না ওটা না। এটা শোন, আবার সেই রেকর্ড দিলে, অরূপদা সুইচ অফ করে দিত। এটা তোর খুব ভালো গান, না! ইউ আর দ্য ওয়ার্ডস, আই অ্যাম দ্য টিউন! এই একটাই বুঝেছিস!

হ্যাঁ বুঝেছি। যাও। ভাল লাগে না শুনবে না। তোমাকে কে শুনতে বলেছে! জোর করে পূর্বা সুইচ টিপে দিলে অরূপদা ফের ওটা আল্পা করে দেবেই। সে যতবার দেবে ততবার। তখন দুজনেরই গলা সপ্তমে। মাসি দেখ অরূপদা আমার সঙ্গে কী করছে!

ডাইনিং টেবিলে দুই বন্ধুতে ছেলেবেলার গল্পে মশগুল–মাঝে মাঝেই পূর্বার ঘর থেকে হাঁক আসছে—ওরা দু’জনেই চিক্কার করে ওঠে এখন, আবার শুরু হলো শম্ভ-নিশুম্ভ যুদ্ধ।

আমাকে মারছে।

এই অরূপ মারছিস কেন?

না মা, মারছি না। মিছে কথা বলছে। তারপর আরম্ভ হতো দু-জনের মধ্যে রেকর্ড নিয়ে কাড়াকাড়ি-ধস্তাধস্তি।

সে কিছুতেই রেকর্ডটা বাজাতে চাইত না। গানটার মধ্যে কি যেন এক নগ্ন নির্জনতা লুকিয়ে আছে। অরূপদাটা যে কী! কিছু বোঝে না! ছেলেমানুষির চুড়ান্ত। পাশের ডাইনিং স্পেসে মা–মাসি, ঘরে সে আর অরূপদা—এমন একটা গান বাজছে শুনলে মা-মাসি কী না মনে করবে। নেভার চেঞ্জ লাভার এট মিড-নাইট। এই মিড-নাইট কথাটাই কেন জানি আজকাল তাকে ভারি হন্ট করে। কতদিন ঘুম আসে না। ছটফট করে। কখনো মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসতে চায় না। দুবছরে সে বুঝেছে, কেন অরূপদা গানটা এত ভালোবাসে। মধ্যরাতে মানুষের ভিতর এক আশ্চর্য নির্জনতা জেগে ওঠে। বোধ হয় এই বয়সে এটা বেশি হয়। মনে হয় সে এবং কেউ কোনো নদীর ধারে, কিংবা গভীর বনের অভ্যন্তরে হেঁটে চলে যাচ্ছে। সব সবুজ বৃক্ষ, লাল নীল ফুল ফুটে আছে চারপাশে–আবার খড়ের বন, বন পার হলে নদীর চরা—বালিয়াড়ি, দু-পা বালির ভিতর ঢুকিয়ে নদীর জলকল্লোল শুনতে পায়। শরীর তখন তার অবশ হয়ে আসে। অথবা স্বপ্নে সে এমন সব কিছু দেখে ফেলে যা ঘুম ভাঙলে মনে হয় কি যে একটা অসভ্যতা সে করে ফেলেছে। বাবা কি তার চোখ দেখলে, রাতের স্বপ্নের কথাও টের পান। তখন সে কেন জানি বাবার দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারে না। আশ্চর্য এক অপরাধবোধে সে বাবাকে দেখলেই মুখ নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

বাবা দরজার পাশে এসে বললেন, তুমি তবে যাচ্ছ না।

তোমরা যাও। আমার যেতে ভালো লাগছে না।

বাবা এরপর আর কোনো প্রশ্ন করবেন না সে জানে। মায়ের মতো বলবে না, তোমার কি শরীর খারাপ! জ্বরজ্বালা না হলে বাবা তার শরীর খারাপ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে না। শরীর খারাপ কথাটা একজন নারীর পক্ষে কত দূরের খবর যে বয়ে আনে বাবা বুঝবে কী করে! যদিও ভারি অস্বস্তি হয় তার তখন। কেবল শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়—অথবা র‍্যাক থেকে গল্পের বই নিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে ইচ্ছে হয়—কেমন এক আলস্য সারা শরীরে জড়িয়ে থাকে তখন। আজ তার সে সবের কিছুই হয়নি। বরং সে আজ একটু বেশি ছিমছাম। এক হপ্তাও হয়নি, সময়টা পার হয়ে গেছে। দু-তিন হপ্তার জন্য নিশ্চিত। সে ইচ্ছে করলে সহজেই বের হয়ে পড়তে পারে।

কিন্তু কেন যে সে বলল, যাবে না, মাথায় কিছুতেই আসছে না। তার খুবই ইচ্ছে করছে, বলে, সে যাবে। কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম বাধা তাকে আটকে রাখছে। কেন এই সংকোচ সে ঠিক বুঝতেও পারছে না। দু-বছরে সে কতটা যে বদলে গেল! আগে সে এতটা ভাবতই না। সবার আগে গিয়ে সেজেগুঁজে বসে থাকত। ফ্রক গায়, বব করা চুল, সাদা মোজা, আর হালকা প্রসাধন মুখে। মেসো গাড়িতে ওঠার সময় তার দিকে তাকিয়ে বলত, ব্লমিং মাই গার্ল। এবারে কী বলত! অরূপদা প্রথম দিকে কেমন একটা আলগাভাব দেখাত। যেন চেনেই না। তারপর দিন যেতে না যেতেই অসুরের মতো উপদ্রব শুরু করে দিত। কোথায় কোনো সিনেমায় কোন নায়ক কীভাবে হাঁটাচলা করে, কিংবা কথা বলে সব নকল করে দেখাত। তারপর মজা করার জন্য বলত, মার দেঙ্গা। কেইসে তুম হো! আর তখনই তার রাগ বাড়ত। একদম হিন্দি বলবে না। তোমার এমন কথা শুনলে আমার বন্ধুরা হাসবে। আসলে পূর্ব বাংলা মিডিয়ামে পড়ে। ইংরেজিটা ভালো আসে না। অরূপদার সব কথাই হয় ইংরেজি না হয় হিন্দিতে। সে বলে দিয়েছে, আড়ি। এ কীরে বাবা, বাংলা বলতে পার না।

পারি। ঘোড়া হোড়া।

আবার ইয়ার্কি হচ্ছে!

আচ্ছা বাবা বাংলাই বলব। তোর এত রাগ কেন বুঝি না!

রাগ আবার কী! ও-ভাবে কথা বললে, কাছের মানুষ তোমরা মনেই হয় না।

কত সহজে সে বলতে পেরেছে অরূপদাকে, কাছের মানুষ! অরূপদার সেই থেকে কেমন একটা অধিকার জন্মে গেছে। মতো তার ঘরে এসে এটা ওটা ধরে টানাটানি করত। তুই আজকাল খুব হালকা নভেল পড়ছিস দেখছি। তারপর হেডলি চেজ থেকে আরম্ভ করে হ্যারল্ড রবিনস, আরভিং ওয়ালেস, এমনকী আরও আধুনিক লেখকদের নাম করে বলত, পড়বি। একটা বই দিয়েছিল অরূপদা, দু পাতা পড়েই শরীর কেমন গোলাচ্ছিল। মেয়েদের এ-সব কথা এ-ভাবে লেখা যায়। নোংরা! তুমি এ-সব পড়ো। ছি!

পড়তে বারণ করছিস!

একদম পড়বে না।

কেন পড়লে কী হয়!

নষ্ট হয়ে যায়।

নষ্ট হওয়াটা কী মজার তুই বুঝিস না।

আমি বুঝি। বুঝিস! আরে ব্বাস, মাই গড, তুই এত বুঝিস জানতামই না।

এবারে তবে জেনে রাখ।

কথাগুলো বলতে হয় বলে বলা। সে এত কিছু ভেবে বলেনি। শুধু বলেছিল, এসব বই পড়লে তুমি নষ্ট হয়ে গেছ ভাবব।

বাবা মাও তো পড়ে।

যা!

সত্যি বলছি।

পূর্বা কেমন অবাক হয়ে যায়। মানুষের কাছে এটা তো এক মুগ্ধ জীবনের প্রকাশ। ভারি গোপন। সবাইকে জানিয়ে দিলে এর সব স্নিগ্ধতা যেন নষ্ট হয়ে যায়। গভীর গোপন এই সৌন্দর্যকে নিয়ে চটকালে ফুলটা বিবর্ণ হয়ে যাবে না! এমনই ভাবে পূর্বা। অরূপদা ভালোবাসে বলেই ‘আবা’র বনি-এমের রেকর্ড কিনে এনেছিল—এই কী বাজাচ্ছিস, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। কী গান রে বাবা। চল তোকে আবা’র রেকর্ড কিনে দিচ্ছি। আশ্চর্য মিউজিক। রেকর্ডগুলো এনে বাজাবার সময়, আঙুলে তুড়ি মেরে কেমন গলা মিলিয়ে গাইত। পূর্বার মনে হত অরূপদা বড়ো কম বয়সে অনেক বেশি জেনে গেছে। মাঝে মাঝে রাগ হলে বলত, হঁচড়ে পক্ক।

সেই অরূপদারা আসছে।

গাড়ি বের হয়ে যাবার শব্দ পেল পূর্বা।

পূর্বা এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে নিলে হয়।

নন্দ বলল, দিদিমণি চা।

সে চা না খেয়েই বাথরুমে ঢুকে গেল। সেই বড়ো আয়না। সে ছোটোবেলা থেকেই আয়নাটা দেখে আসছে। মাথা সমান একটা উঁচ আয়না দেয়ালের সঙ্গে সাঁটা আগে বুঝত না, বাথরুমে এত বড়ো একটা আয়নার কী দরকার! যত বড়ো হচ্ছে তত বুঝতে পারছে আয়না আছে বলেই সে নিজের সব কিছু এত খোলামেলা দেখতে পায়। আগে সে বাথরুমে ফ্রক প্যান্টি খুলতে পর্যন্ত লজ্জা পেত। সে খুলত না। বাবাকে মনে হত, বুদ্ধির চেঁকি। আর জায়গা পেলে না! এত বড়ো আয়না এখানে! এখন বুঝতে পারে আয়নার রহস্য! আয়নাটা না থাকলে বাথরুমের আসল সৌন্দর্যটা নষ্ট হয়ে যেত। বাথরুমে ঢুকলেই আয়নায় সে তার নারী মহিমা টের পায়।

সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আজ নিজেকে একটু বেশি মনোযোগ দিয়ে দেখল। আশ্চর্য, আয়নার অদুরে কেউ দাঁড়িয়ে হাসছে। এই ফাজিল ছেলে, ওখানে কেন। মারব। সরে যাও বলছি। ছিঃ তুমি কী! যাওনা। নানা। ও-ভাবে না। আমি ওভাবে ভালোবাসি না।—পাশ থেকে? না না আমি মরে যাব। ও-ভাবে না! তুমি কী বোকা। এই পাগলের মতো কী করছ! আঃ।

সে কতক্ষণ আয়নার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল জানে না। কখনো চড়াই উত্রাই পার হয়ে গেছে কারো হাত ধরে, কখনো কোনো নির্জন দ্বীপে সে আর অরূপদা। একটা বোটে করে চলে গেছে। এক উলঙ্গ পৃথিবীর বাসিন্দা দুজনে। সবুজ প্রান্তর পার হয়ে ছুটে গেছে প্রজাপতি ধরতে। আবার কখনো সমুদ্রের তরঙ্গমালায় ভেসে যেতে যেতে চিৎকার করে উঠেছে, আমি ডুবে যাচ্ছি কেন। আমাকে কে তলিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের গভীরতা খুঁজে পাচ্ছি না অরূপদা! আর তখন অরূপদার ক্ষীণ গলা শুনতে পাচ্ছে, গভীরতার খবর আমি রাখি। আমি আছি বলেই তোমার এই গভীরতার সন্ধান দিতে পারব। আমরা আছি বলেই তোমার এই রহস্যময় গভীরতা পৃথিবীতে জন্মের ইশারা ডেকে আনে।

নন্দ ডাকছে তখন, ও দিদিমণি, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

তার হুঁশ ফেরে।

সে বের হয়ে এল শাড়ি পরে।

নন্দ বলল, কী সুন্দর লাগছে দিদিমণি! সরস্বতী ঠাকরুণ একেবারে।

এই মারব।

তুমি একেবারে দুগগা ঠাকুর হয়ে গেছ দিদিমণি!

মারব বলছি।

আসলে পূর্বার মনে হচ্ছিল দুগগা ঠাকরুণ না ছাই। বাথরুমে কত রকমের অসভ্য চিন্তা করেছে। ওটা ভালো না। নিজেকে বড়ো ছোটো মনে হয়। অথচ না ভেবেও কেন যে থাকতে পারে না। অসভ্যতা ভেবেও সে স্থির থাকতে পারে না। ভাবতে ভাবতে কখন অবশ হয়ে আসে শরীর। পিচ্ছিল এক নদীপথে ভাসমান নক্ষত্রমালার স্বপ্ন দেখতে দেখতে তার ঘুম চলে আসে। নন্দ তা বুঝবে কী করে! সে খুব সাহসী না। সে এখনও দরজা ভেজিয়ে শোয়। বন্ধ করে শুতে ভয় পায়।

আর তখনই সিঁড়িতে হৈ-চৈ করে উঠে আসছে কারা। অরূপদার গলা পাওয়া যাচ্ছে। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলেই দেখতে পাবে তাকে। তাড়াতাড়ি নিজেকে কেমন লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হল। কেন যে সোজাসুজি ছুটে গিয়ে বলতে পারছে না—অরূপ-দা, কি মজা, তোমরা এসে গেছো! এবারে তোমাকে নিয়ে কাকুলিয়া পার হয়ে চলে যাব। কাঁচা রাস্তা, তারপর আর গাড়ি চলে না। আমরা হেঁটে যাব। গ্রামটা কী সুন্দর! সব গরিব মানুষের বাস। ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে। বাবা তার পড়ার খরচ চালান। বড়ো হোস্টেলে থাকে। বাবা মাঝে মাঝে আমাদের ওখানে নিয়ে যান। এবার আমি তোমার সেখানে নিয়ে যাব। ওর বাবা মা কী ভালো। সামনে পুকুর, তেঁতুল গাছ কী প্রকাণ্ড, তার ছায়া কী গভীর আর কী ঠাণ্ডা! তেঁতুল গাছের নীচে আমরা দুজনে চুপচাপ বসে থাকব।

আর তখনই গলা পাওয়া গেল, এই পূর্বা তুই কোথায়।

সে আয়নায় নিজের মুখ দেখে চুলে সামান্য চিরুনি চালিয়ে বের হয়ে বলল, তালে এসে গেলে!

আমরা ভাবলুম, তোর আবার কোনো অসুখ-বিসুখ নাকি!

তুই গেলি না!

পূর্বা কিছু বলল না।

অরূপদাকে কিছু না বললেও আসে যায় না। নিজেই অজস্র কথা বলে যাবে। কে কী কথার জবাব দিল তোয়াক্কা করে না। দু-বছরে মানুষ সত্যি দ্রুত বদল হয়ে যায়। অরূপদা আরও লম্বা হয়েছে। ঢ্যাঙা, লম্বু। চুল ব্যাকব্রাস করা। নরম নীলাভ দাড়ি গালে অল্প অল্প। প্রায় নবীন সন্ন্যাসী গেরুয়া পরলে। পূর্বা ঠিক চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।

আবার অরূপদার কথা, এই আর। তোকে মা ডাকছে বাবা খোঁজাখুঁজি করছেন।

পূর্বা জানে ওরা এখন বসার ঘরে। বসার ঘরটা করিডোরের শেষ প্রান্তে। সিঁড়ির মুখেই। মা ওদের জলখাবার করার জন্য ব্যস্ত। বাবা বসে শহরের যানজট নিয়ে কথা বলছেন। বাবার এক কথা, যে ভাবে পপুলেশন বাড়ছে, বামফ্রন্ট কেন, কোনো সরকারেরই ক্ষমতা নেই সমস্যার সমাধান করতে পারে।

প্রায় যেন অরূপদাই তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। সে যেতেই মেসো বলল, দেন মাই ফেয়ার লেডি, কেমন আছ!

পূর্বা হেসে বলল, ভালো।

— পড়াশোনা কি রকম চলছে?

— ভালো। আসলে পূর্বা এর চেয়ে বেশি জবাব দিতে পারছে না। এবারে মাই ব্লমিং গার্ল না বলে, মাই ফেয়ার লেডি বলছে। সে কেমন নিজের মধ্যে অতর্কিতে ড্রাম পেটানোর শব্দ শুনতে পায়। সে বড় হয়ে গেছে। শাড়ি পরলে বড়ো দেখায়। আর বোধ হয় ঠিক ফ্রক গায় সে আর তাদের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। আসলে মেয়েরা শাড়ি পরলে অনেক বড়ো হয়ে যায়। সে প্রায় ছুটেই বের হয়ে গেল। বলল, আসছি।

আসলে জীবনের এই মাধুর্য কেউ জানে না কখন জেগে ওঠে। রান্নাঘরে এসে সে এটা-ওটা মাকে এগিয়ে দিচ্ছে।

মা অবাক!—কী রে তুই। তোকে এ-সব কে করতে বলল! যা ওদের সঙ্গে গল্প করগে। ওরা কী ভাববে!

অরূপ রান্নাঘরে ঢুকে বলল, আন্টি তোমার মেয়ে পালিয়ে এল কেন?

কী জানি! জিজ্ঞেস করে দ্যাখ, কেন পালিয়ে এল।

আমার ইচ্ছে। বলে সে আবার মাকে কাজে সাহায্য করতে গেলে তার মা কেমন বিরূপ হয়ে উঠল।—সব ভাঙবে। ইস তোমাকে কে বলেছে! কবে ঢুকেছ। মেসোকে গিয়ে বল হাত মুখ ধুয়ে নিতে। ওদের ঘরগুলো দেখ ঠিক আছে কি না!

পূর্বা ঘর হয়ে এল। মা বুঝতেই পারছে না, সবার কাছে সে ধরা পড়ে গেছে। অরূপদার চোখ কি রকমের বন্য, মেসোর চোখে অপার প্রশান্তি, মাসির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মতো যেন বলা, যাক তবে বড়ো হয়ে গেলি! অরূপদার বন্য চোখ দেখলে সে কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। অরূপদার ঘরটায় সব ঠিক আছে কি না–পার্ট করা সাদা চাদর বের করল, বালিশের ওয়াড় পাল্টে দিল, সামান্য ঝুল ছিল কোণায়, নিজেই তা পরিষ্কার করার সময় দেখল অরূপদা হাজির। তাকে অরূপদা এক দণ্ড কোথাও একা থাকতে দিচ্ছে না।

এই।

বল!

এখানে এ-সব কী হচ্ছে!

কী করব।

চল না সেই রেকর্ডটা বাজাই।

কোনটা?

কিস মি, কিস মি।

না।

কেন না।

বললাম তো না।

অরূপ বলল, দেন লেট মি কিস ইয়ু বলে হাত ধরে টানতেই পূর্বা কেমন ক্ষেপে গেল, ছোটোলোক! ইতর!

অরূপ কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। সে মাথা নীচু করে বসে থাকল। পূর্ব ছুটে বের হয়ে গেছে।

পূর্বা নিজের ঘরে এসে কেমন হাঁপাতে থাকল। সে বলতে চায়নি। সে এত ছোটো নয়, তবু কেন যে এমন কুৎসিত ভাবে অরূপদাকে অপমান করল! কী তার হয়েছে! সে তো চায় কোনো কাশবনের গভীরে অরূপদাকে নিয়ে প্রবেশ করতে সে তো চায়, আকাশের নীচে একজন মানুষই তার সর্বস্ব কেড়ে নিক— তবু কেন, সে এ-ভাবে মানুষটার খোলামেলা স্বভাবে আঘাত দিতে গেল। নিজের মধ্যে এত সব বৈপরীত্য কাজ করে কেন! কেন! সে প্রায় বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বালিশে মুখ চাপা দিল। এমন সুন্দর মানুষটাকে অপমান করে এসে বিষের জ্বালায় নিজেই জ্বলছে।

সে-দিনই রাতে প্রথম পূর্বা তার দরজার ছিটকিনি আটকে ঘুমাতে গেল। জীবনে আর একটা নতুন ভয় এবার তার সামনে হাজির। সবাই জেনে গেছে এই বয়সেই বালিকারা নারী হয়ে যায়। আর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে শুনতে পেল সুদুরে সেই মিউজিক বাজছে, আই অ্যাম দ্য সান, ইউ আর দ্য মুন, আই অ্যাম দ্য ওয়ার্ডস, ইউ আর দ্য টিউন। মিউজিক শুনতে শুনতে নারীমহিমায় চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল পূর্বা।– প্লে মি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *