এক সর্দারের গল্প (২)
সর্দার খুশবন্ত সিং তাঁর জোকবুক আরম্ভ করেছেন যে রসিকতাটা দিয়ে সেটি তাঁর নিজস্ব নয়, এক সর্দারণী তাকে সেটা প্রেরণ করেছেন।
গল্পটি এক দাড়িওলা বাঙালি ভদ্রলোক এবং এক সর্দারজিকে নিয়ে।
যেমন হয় এইসব গল্পে, এই দু’জনের মধ্যে খুব বাদানুবাদ চলছিল, বাদানুবাদের বিষয় আর কিছু নয়, বাঙালি না পাঞ্জাবি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কারা বেশি আত্মাহুতি দিয়েছে, শহিদ হয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ কলহকোলাহলের পর দু’জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন যে একেকজন তাঁর জাতির একজন করে শহিদের নাম করবেন আর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীর গাল থেকে একটা দাড়ি উপড়িয়ে নেবেন।
শুরু হল ভয়ানক দাড়ি ছেঁড়া লড়াই। দাড়িওয়ালা বাঙালি ভদ্রলোকটি প্রথমেই ‘ক্ষুদিরাম’ বলে সর্দারজির গাল থেকে একটা দাড়ি ছিঁড়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সর্দারজি ‘ভকত সিং’ বলে বাঙালি ভদ্রলোকের একটি দাড়ি উৎপাটন করলেন।
ভালই চলছিল, হঠাৎ বাঙালি ভদ্রলোকের কী মতিভ্রম হল। এক নিশ্বাসে ‘বিনয়-বাদল-দীনেশ’ বলে একটানে সর্দারজির তিনটে দাড়ি তুলে ফেললেন। এবং এখানেই হল বাঙালি ভদ্রলোকের প্রকৃত সর্বনাশ। ক্ষিপ্ত সর্দারজি হাতের বিশাল থাবায় বাঙালি ভদ্রলোকের গালের সমস্ত দাড়ি একসঙ্গে ধরে ‘জালিয়ানওয়ালা বাগ’ বলে একটানে যথাসাধ্য উপড়িয়ে ফেললেন।
সে এক রক্তারক্তি কাণ্ড। সেদিনের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি ভদ্রলোক অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
খুশবন্ত সিং তাঁর দ্বিতীয় গল্পটি পেয়েছেন নয়াদিল্লির প্রেম খান্না নামে এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে।
গল্পটি বেশ জটিল।
এক গোহাটায় এক চাষি গিয়েছেন একটা ভাল গোরু কিনতে।
গোরুর পাইকার একটা নধরকান্তি যুবতী গাভী দেখিয়ে বলল, ‘এর দাম পাঁচ হাজার টাকা। সদ্য যুবতী। বছরে একবার বিয়োবে, দৈনিক দশ কিলো করে ঘন মিষ্টি দুধ দেবে।’
দামটা একটু বেশি মনে হওয়ায় গোরুর ক্রেতা চাষি ভদ্রলোক পাশের অন্য একটা গোরু দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এটার দাম কত হবে?’
বিক্রেতা বললেন, ‘এর দাম হবে দশ হাজার। এর বেশ বয়স হয়েছে, বিগত যৌবনাই বলা যায়। এখনও পর্যন্ত কোনও বাচ্চা দেয়নি। দুধ হওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
এই শুনে স্তম্ভিত হয়ে ক্রেতা বললেন, ‘আপনি কী ধরনের গোরুর পাইকার। একটা বাঁজা, বুড়ি গোরুর ডাবল দাম চাইছেন।’
এই শুনে পাইকার গম্ভীর হয়ে বলল, ‘দাদা আপনার কাছে না থাকুক আমার কাছে চরিত্রের তো একটা দাম আছে।’
খুশবন্ত সাহেবের জোকবুকে চরিত্রঘটিত গল্পের ছড়াছড়ি, আসলে সর্দারজির ঝোঁকটা একটু ওই দিকে।
এই বইতেই দুই ব্যক্তির পরলোকে দেখা হওয়ার গল্প। পৃথিবীতে থাকার সময়ে দু’জনের মধ্যে স্বল্প পরিচয় ছিল।
এখন ওপারে দেখা হতে একজন অন্যজনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাই, আপনি কীভাবে মারা গেলেন?’
দ্বিতীয় ব্যক্তি বললেন, ‘আমি মারা গিয়েছিলাম অতিরিক্ত ঠান্ডায় জমে। আপনি কী ভাবে মারা গিয়েছিলেন?’
প্রথম ব্যক্তি উত্তর দিলেন, ‘সে বড় দুঃখের গল্প। একদিন সন্ধ্যায় একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আমার মনে হল আমার স্ত্রী যেন কার সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁর ঘরে যেন অন্য কোনও লোক রয়েছে। তারপর আমি তো ঘরে ঢুকে ঘরের আনাচেকানাচে, বারান্দায়, সিঁড়ির নীচে আলমারির পেছনে সব জায়গায় খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও কাউকে খুঁজে পেলাম না। তখন আমার মনটা খুব ভেঙে গেল। ছিঃ, ছিঃ, আমি আমার স্ত্রীকে চরিত্রহীনা ভেবেছি। মনের দুঃখে হার্টফেল করে মারা গেলাম আমি।’
এই শুনে দ্বিতীয় ব্যক্তি বললেন, ‘দাদা, একটু বুদ্ধি করে আপনাদের বড় রেফ্রিজারেটারটা যদি একটু খুলে দেখতেন, আমিও ঠান্ডায় জমে মারা যেতাম না, আপনিও হার্টফেল করে মারা পড়তেন না।’
চরিত্রের পরে শিক্ষা।
সর্দার খুশবন্ত সিংহের পরবর্তী গল্পটি, তাঁর নিজস্ব, এটা কেউ তাঁকে ধার দেয়নি, তবে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য শ্রীযুক্ত হাসিম আলি একদা এক বক্তৃতায় এই গল্পটি বলেছিলেন।
এ গল্পটিও পরলোকের। মৃত্যুর পরে এক উপাচার্য পরলোকে পৌঁছতে চিত্রগুপ্ত তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি পৃথিবীতে কী করতেন?’
উপাচার্য বললেন, ‘মৃত্যুর আগে অল্প কিছুকাল আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলাম। তার আগে…’
উপাচার্যের কথা শেষ না হতে চিত্রগুপ্ত বললেন, ‘তার আগে আর জেনে দরকার নেই। আপনার যথেষ্ট পাপভোগ হয়ে গেছে, আপনি এই সামনের দরজা দিয়ে স্বর্গে চলে যান।’
পিছনেই অন্য এক আগন্তুক দাঁড়িয়েছিলেন, তিনিও চিত্রগুপ্তের নির্দেশ শুনে সামনের উপাচার্য ভদ্রলোকের পিছু পিছু স্বর্গের দরজার দিকে রওনা হলেন।
চিত্রগুপ্ত দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘একী আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
দ্বিতীয় ব্যক্তি বললেন, ‘আমিও উপাচার্য ছিলাম। একবার নয়, পর পর তিনবার তিনটে বিশ্ববিদ্যালয়ে।’
চিত্রগুপ্ত মৃদু হেসে বললেন, ‘তা হলে তো আপনার নরক ভোগ অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনি পিছনের দরজা দিয়ে নরকে চলে যান।’
অবশেষে আরেকটি বিশুদ্ধ খুশবন্তীয় গল্প।
ইস্কুলের সবচেয়ে নিচু ক্লাসে একটি ছোট বাচ্চা ভরতি হতে এসেছে, তার বড় ভাই শিবু ওই ইস্কুলেই ক্লাস টেনে পড়ে। বড় ছেলেটি এই বাচ্চাটিকে নিজের ভাই বলে হেডমাস্টারের কাছে ভরতি করাতে এসেছে। কিন্তু বাচ্চাটিকে যখন হেডমাস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শিবু তোমার কী হয়?’ সে বলল, ‘দূর সম্পর্কের আত্মীয়।’
হেডমাস্টার মশায় অবাক হয়ে বললেন, ‘শিবু তুমি বলছ আপন ভাই, আর এ বলছে দূর সম্পর্ক।’
শিবু বলল, ‘স্যার, কারণ আছে। আমরা হলাম দশ ভাই বোন। আমি সবচেয়ে বড়, এ সবচেয়ে ছোট, আমাদের মধ্যে আর আট ভাইবোন আছে। তাই ও বলছে দূর সম্পর্ক।’