এক রাত্রি

এক রাত্রি

ঘটনাটির সূত্রপাত হয় মোকামাঘাটে।

ভিড় ছিল, তবে এমন নয় যে, উঠিতেই পারিতাম না। একলা লোক, তায় লটবহর নাই। স্থান হইল না অন্য কারণে; আসলে মনটা কাব্যরসে সিক্ত হইয়া অত্যন্ত উদার হইয়া পড়িয়াছিল; কেমন যেন মনে হইতেছিল, এ পর্যন্ত পৃথিবীর যথেষ্ট উপকার করা হয় নাই। তাই নিজে সরিয়া দাঁড়াইয়া আর সকলকেই উঠিবার সুবিধা করিয়া দিতেছিলাম।

এমন সময় গাড়িটা ছাড়িয়া দিল। যে বাবুটিকে সকলের শেষে সপরিবারে উঠিতে সাহায্য করি, তিনি চলতি গাড়ির দুয়ার আগলাইয়া বলিলেন, “খবরদার মশায়, ঠেলে দিতেও পেছপা হব না। হ্যাঁ, দেখছেন গাড়ির অবস্থা? এতক্ষণ হাঁদার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করছিলেন কি?”

এক্সপ্রেসটা মিস করিলাম, বলিলাম, “যাকগে, প্যাসেঞ্জারে দিব্যি শুয়ে শুয়ে যাওয়া যাবে।” স্টীমারের জেটির উপর গিয়া আসন্ন স্তিমিত আলোকে বইটা খুলিয়া আবার পড়িতে লাগিয়া গেলাম। রবিবাবুর ‘গল্পগুচ্ছ’। “এক রাত্রি” গল্পটা চলিতেছিল, যেখানটায় নূতন স্কুল-মাস্টারি লইয়া আবার সুরবালার বড় কাছাকাছি অসিয়া পড়িয়াছি, সেইখানটা। নিজেকেই নায়কের পদে বসাইয়া দিলাম বলিয়া কেহ যেন কিছু মনে না করেন। অবস্থাটা তখন প্রায় এমনই হইয়া পড়িয়াছে।

গাড়ি আসিলে বইয়ের পাতায় আঙুল গুঁজিয়া দিয়া অলস গতিতে গিয়া এক ইন্টার- ক্লাসে উঠিলাম। গুছাইয়া বসিয়া এইবার বইটি খুলিব, এমন সময় সামনের দিকে নজর পড়ায় একটু সচকিত হইয়া উঠিলাম। গাড়ির ওই পাশটায় কোণে জড়সড় হইয়া একটি রমণী বসিয়া। ভাবে এবং বিদ্যুতের আলোয় সযত্ন-আচ্ছাদিত হস্তপদাদির যেটুকু দেখা গেল তাহা হইতেও বোঝা গেল, রমণী যুবতী। পোশাকপরিচ্ছদ সম্বন্ধে কোন ধারণা পাওয়া গেল না, তবে সমস্ত অঙ্গটি বেড়িয়া আলগাভাবে যে একখানা রেশমী চাদর জড়ানো ছিল তাহা হইতে বেশ বোঝা গেল যে, কোন অবস্থাপন্ন ঘরেরই মহিলা; ইন্টারক্লাসে বসার ব্যাপারটাও এ অনুমানটুকুর পরিপোষণ করিল।

ভাবিলাম, মরুক গিয়া, আমার এ কৌতূহলের অধিকার কি। মনের লাগাম কষিয়া পুস্তকের অক্ষর-পথে চালিত করিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু ক্রমেই বিষয়টার অপূর্ব ত্ব আমাকে যেন নাছোড়বান্দা হইয়া পাইয়া বসিল। তখন অধিকার লইয়া তর্কটুকুই অন্য আকারে আসিয়া দেখা দিল; মনে হইল, এক্ষেত্রে এমন উদাসীনভাবে বসিয়া থাকিবারই কি আমার কোন অধিকার আছে? এই বেটাছেলেদের গাড়িতে আমি আর একটিমাত্র স্ত্রীলোক—সে অপরিচিতা। এই তো গাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমি উঠিয়া বসিয়াছি, কই, কেহ তো নামিয়া যায় নাই! তবে এ অভিভাবকহীনা কে? যদিই বা অভিভাবক ছিল, দৈবযোগে সঙ্গচ্যুত হইয়া পড়িয়াছে, তাহা হইলে একবার প্রশ্ন করিয়া বিষয়টা জানা উচিত নয় কি আমার?

ইহাতেও একটু সন্দেহ হইল। এই কি বিপদে পড়ার ভাব? বিশেষ করিয়া স্ত্রীলোকের পক্ষে? যাহা হউক, ভাবিলাম, গাড়িটা ছাড়িয়া যাক না, শেষ পর্যন্ত যদি কেহ না আসিয়া পৌঁছায় তো ব্যাপারটা তখন একদিকে স্পষ্ট হইয়া উঠিতে পারে। প্যাসেঞ্জার ট্রেন, পরের স্টেশনেই তো থামিতেছে, এত তাড়াতাড়ি কিসের?

গাড়ি ছাড়িল, কেহ আসিল না। আমার রহস্যময়ী সঙ্গিনী একটু নড়িয়াচড়িয়া বস্ত্রাবরণে একটা হিল্লোল তুলিয়া আবার সেরূপ জড়বৎ নিশ্চল হইয়া রহিলেন। গাড়িটা শুধু গতিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই মৃদু দোল দিতে আরম্ভ করিয়া দিল।

ব্যবধানটা একটু বেশি ছিল বলিয়া গাড়ির আওয়াজটা বাড়িবার পূর্বেই প্রশ্ন করিলাম, “আপনি কি একা—”  

শেষ করিতে পারিলাম না, কারণ ছাঁৎ করিয়া মনে হইল, ‘একা’ কথাটা ব্যবহার করা বড় ভুল এবং নিতান্ত অসঙ্গত হইয়া গিয়াছে, বিশেষ করিয়া জিজ্ঞাসার আকারে।

আমি মনের ভাবটা গুছাইয়া বলিবার জন্য ভাষা খুঁজিতে লাগিলাম, তরুণী উত্তরস্বরূপ বাম হাতখানি বাহির করিয়া ঘোমটাটা একটু টানিয়া দিলেন। একখানি পেলব নধর ভুজলতা—তুলিতেই একগাছি রুলি আর গুটিকয়েক রেশমী চুড়ি ঠুনঠুন শব্দে মণিবন্ধ ছাড়িয়া হাতের মাঝখানে নামিয়া আসিল। মনে হইল, যেন আমার ভাবগতিক দেখিয়া তাহারা একে অন্যের গায়ে হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল।

ব্যাপারটুকু সামান্যই এবং সত্যই কিছু আমাকে বিদ্রূপ করিবার জন্য চুড়িমহলে মাথাব্যথা পড়িয়া যায় নাই। কিন্তু আমার একটু চমক ভাঙিল। হাসিয়া মনে মনে বলিলাম, মিছে নয়, জড়ের মুখে হাসি ফুটাইবার মতই অবস্থা দাঁড়াইয়াছে বটে। তখন পৌরুষকে জাগ্রত করিয়া বেশ স্পষ্ট সবল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি একলা এ অবস্থায় রয়েছেন, কোন বিপদ-আপদ ঘটে নি তো? কোনরকম সাহায্য করতে পারি কি? সব কথা খুলে বলুন, কোন দ্বিধা করবেন না।”—এই অকুণ্ঠিত কথাগুলিতে মনে মনে বেশ একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করিলাম, যেন এক মুহূর্তে বিশ্বের নারীর দায়িত্ব লইয়া আমি পুরুষ, সর্ববধি অলস লঘুত্বের উপর আত্মপ্রতিষ্ঠা করিয়া ফেলিলাম। বোঝা শক্ত হইয়া উঠিল যে আমরা এই স্বল্পপ্রাণা জাতিটার কাছে হঠাৎ থাকিয়া থাকিয়া এমন দুর্বল হইয়া পড়ি কোথা হইতে, যাহাতে এমন গোটাকতক সোজা কথা বলিতেও জিহ্বা জড়াইয়া আসে?

আমার স্বল্পপ্রাণা সঙ্গিনী কিন্তু কোন উত্তর দিলেন না, তাহার পরিবর্তে যাহা করিলেন তাহাতে জটিল সমস্যাটি আরও নিবিড়ভাবে জটিল হইয়া উঠিল মাত্র। অবগুণ্ঠনের অন্তরালে চাপা ক্রন্দনের আভাস পাওয়া যাইতে লাগিল। ফোঁপাইয়া কান্না, মাঝে মাঝে সমস্ত শরীরটা কাঁপিয়া উঠিতেছে! যুবতী কখন বা বস্ত্রাঞ্চলে, কখন বা ঘোমটার অল্পপরিসর কাপড়টুকু দিয়াই অশ্রুমোচন করিতেছে। মনটা বড়ই ব্যথিত হইয়া উঠিল, কিন্তু কি উপায় আমার? আমার ক্ষুব্ধ পৌরুষ লইয়া ওর নীরবতার গণ্ডির বাহিরে বিফল উদ্বেগে বসিয়া থাকা ভিন্ন আর উপায় ছিল না। বসিয়া বসিয়া নানা রকম সম্ভব অসম্ভব কল্পনা করিতে লাগিলাম, কিন্তু কোনটাকেই একটা সন্তোষজনক মীমাংসায় লইয়া যাইতে পারা গেল না।

এই অবস্থাতেই কয়েকটা স্টেশন পার হইয়া গেল। গাড়ির এক কোণে পৃথিবীর চির- রহস্যময়ী নারী-রহস্যের এ একটা নূতনতর আবরণে, আর অন্য কোণে চির-মূঢ় পুরুষের প্রতিভূ আমি এই এক নূতনবিধ ফাঁপরে পড়িয়া। গতিকটা মোটেই বলিবার বুঝাইবার যোগ্য নহে।

অবশেষে ঘটনাটা ক্রমশ একঘেয়ে এবং অল্পবিস্তর ভয়াবহ হইয়া পড়ার দরুন তাহা হইতে কাব্যের অংশটুকু উবিয়া যাওয়ার জন্যই হোক, আর যাই হোক, মাথায় একটু বুদ্ধি আসিয়া জুটিল। একটা স্টেশনে গাড়ি আসিয়া থামিলে বলিলাম, “আপনি না হয় স্ত্রীলোকের কামরায় চলুন না, সঙ্গে ক’রে দিয়ে আসছি। সেখানে সব কথা খুলে বলতে পারবেন।”

আশ্চর্যের বিষয়, রমণী ইহাতে তীব্র আপত্তির সহিত সঘনে হাত নাড়িয়া উঠিল; অনামিকাতে একটি নীলার আংটি যেন কয়েকটি মিনতির অশ্রুকণা বর্ষাইয়া ঝিক ঝিক করিয়া উঠিল।

তখনও বুদ্ধিটার কিছু অবশিষ্ট ছিল বলিতে হইবে। বলিলাম, “বেশ, না হয় কোন স্ত্রীলোককে ডেকেই আনছি, মেয়ে-গাড়িতে অনেক বয়স্থা স্ত্রীলোকও তো থাকেন।”

এবার ত্রস্ত শঙ্কিত ভাবে রমণীর মাথা পর্যন্ত নড়িয়া উঠিল, এবং অস্ফুটস্বরে দুই- তিনবার শোনা গেল, “না—না—না।”

তখন আমি কড়া হইয়া বলিলাম, “তা হ’লে আমাকেই বলতে হবে, ব্যাপারটা কি! কেন কাঁদছিলেন বলুন তো?”

আবার সেইরূপ জড়বৎ নিশ্চল নীরব। প্রশ্ন করিলাম, “বাড়ি কোথায় আপনার?”

উত্তর না পাইয়া আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, “স্বামীর নাম?”

মাথাটি না-এর ভঙ্গীতে নড়িয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, “বিবাহ হয় নি?”

মাথা নাড়িয়া জানাইল, “না।”

একটু থামিয়া কথাটা যথাসম্ভব গুছাইয়া বলিলাম, “কোন দুর্বৃত্তের হাতে পড়েছেন কি?”

আর কোন উত্তর পাওয়া গেল না, অস্ফুট স্বরের মধ্য দিয়াও নয়, কিংবা ঘোমটা- ঢাকা মাথার মৃদু সঞ্চালনেও নয়। এত কাছাকাছি, অথচ সমস্ত রাত্রের ভিতর কথার মধ্যে পাওয়া গেল ওই তিনটি ত্রস্ত চাপা——না—নানা’; আর পরিচয়—ওই দুইটি ইঙ্গিত হইতে যাহা চিনিয়া লওয়া যায়। ইহাতে অন্তরের উদ্বেগ তো শীতল হইলই না, বরং কল্পনার উত্তাপ সৃষ্টি করিয়া মনটাকে ক্রমে একটা ব্যথা-আশঙ্কার বাষ্পে ভরিয়া দিল।

গাড়ি নক্ষত্রবেগে ছুটিয়াছে। মুখ বাহির করিয়া নৈশ প্রকৃতির দিকে চাহিলাম। স্তব্ধ অপরিস্ফুট জ্যোৎস্না প্রাণময় জগৎকে আপনার মোহ-আলিঙ্গনে বন্ধ করিয়া যেন ঘুমাইয়া আছে। বিরলনক্ষত্র আকাশ! চাঁদের উপর একখণ্ড মন্থরগতি মেঘের আবরণ পড়িয়াছে। একটিমাত্র তারা চোখে পড়ে; সে যেন তাহার সমস্ত দীপ্তি দিয়া ওই মেঘাবগুণ্ঠনের ওপারে তাহার কৌতুকদৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে চায়।

বলিতে কি, বেশ বুঝিতে পারিলাম, আমি পরাভূত হইয়া আসিতেছি। একেই পড়িতেছিলাম “এক রাত্রি”, তাহার উপর একরাত্রিব্যাপী একখানি খণ্ডকাব্যের এই অতি- বাস্তব আয়োজন; এ ক্ষেত্রে পরাভব হওয়া ছাড়া আর উপায়ান্তর ছিল না। মনে হইল, কিই বা ক্ষতি এমন? জীবনের এই নিরুদ্দেশ যাত্রাপথে শুধু একটি রজনীর জন্য আমরা অপরিচিত। দুইটিতে যদি এত কাছাকাছি আসিয়াই পড়িয়া থাকি তো এমন বিরসভাবে পাশ কাটাইয়া যাইবারই বা সার্থকতা কোথায়? কি জানি, আমার এ সাহচর্য ওর মনে কি ভাব তুলিয়াছে; কোন ভাবই তুলিয়াছে কি না, তাহারই বা স্থিরতা কি? কিন্তু তাহা ভাবিয়া আজিকার রাত্রে তীব্র গতির এই মাদকতা ও নিথর জ্যোৎস্নার মধুর অবসাদের মধ্যে উহাকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া যদি খানিকটা ভাবের পুঁজি সংগ্রহ করিয়া লইতে পারি তো কাহার তাতে আসিয়া যায়? ওর দুইটি বাণী, কি এতটুকু দৃষ্টি যদি আমার সে কল্পনাকে পুষ্ট করেই তো সেটা এতই আশঙ্কার বিষয় হইয়া পড়িবে?

বিধাতার দয়াই হউক আর চক্রান্তই হউক, সব দিক দিয়াই যেন কাব্যটুকু জমিয়া উঠিতে লাগিল।

লক্ষ্মীসরাই স্টেশনে একজন শুভ্রশ্মশ্রু প্রাচীনপন্থী মুসলমান উঠিলেন। আদবকায়দামত অভিবাদনাদি শেষ হইলে ও-কোণে নজর পড়িতে অতিমাত্র সঙ্কুচিত হইয়া পড়িলেন, বলিলেন, “এঃ আপনার বিবিসাহেবা এ গাড়িতে রয়েছেন, না দেখে প্রবেশ ক’রে বড়ই বেয়াদবি ক’রে ফেলেছি, মাপ করবেন। আপনি বারণ করে দিলেই পারতেন। আমি নেমে অন্য গাড়িতে যাই। বেয়াদবিটা মাপ করতে হবে। কুলী!”

আমি এক অদ্ভুত উত্তর দিয়া বসিলাম, “না না, সে কি? যখন উঠে পড়েছেন থাকুন। আপনি আমাদের পিতার বয়সী।

বিবিসাহেবার প্রতিবাদ তো করা হইলই না, অধিকন্তু মুখ হইতে বেশ সরলভাবে বাহির হইয়া গেল—আপনি আমাদের পিতার বয়সী!

এবার সেই জড়মূর্তির উপর আপনি দৃষ্টিটা গিয়া পড়িল। না, অনুমোদনের সুস্পষ্ট আভাস না থাকিলেও, আপত্তিকরও কোন ইঙ্গিত নাই!

রহস্য অতল।

.

কিউলে গাড়ি থামিলে হঠাৎ একটু বড়মানুষি করিয়া কেনারের হোটেল হইতে খানা সারিয়া আসিবার ইচ্ছাটা বলবতী হইয়া উঠিল। কেন, তাহা ঠিক বলিতে পারি না। তবে নিজেকে যেন আজ রাত্রে ইতরসাধারণের অপেক্ষা বিশিষ্ট বলিয়া মনে হইতে লাগিল। নীচেকার রাস্তা দিয়া ও-প্লাটফর্মে গিয়া উঠিলাম, সদর্পে হোটেলের সম্মুখ পর্যন্তও গেলাম, তার পর ভিতরে ভোজনরত লালমুখের ভিড় দেখিয়া আস্তে আস্তে শিস দিতে দিতে ফিরিয়া আসিলাম। প্ল্যাটফর্মের ভেন্ডারের নিকট এক পেয়ালা চা পান করিয়া কোরের শখ মিটানো গেল। তাহার পর ইতরসাধারণের মত কিঞ্চিৎ পুরি ও মিষ্টান্ন সংগ্রহ করিয়া গাড়িতে আসিয়া উঠিলাম। সব মিলিয়া একটু বিলম্ব হইয়া গিয়াছিল।

আসিয়া দেখি ব্যাপার গুরুতর। আমার সঙ্গিনী গাড়ির কোণে বস্ত্রের একটি পুঁটুলিবিশেষ হইয়া ক্ৰন্দনরতা। সামনে দুইজন পুরুষ এবং একটি স্ত্রীলোক টিকিট-কালেক্টর। মেম বলিতেছে, “জলদি বোলো, নেহি তো উতার দেঙ্গি, আভি গাড়ি খুলতি হ্যায়; টিকিট আপনে পাস কেঁউ নহি রখি?

একজন টিকিট-কালেক্টর ফিরিঙ্গী। হাত ঘুরাইয়া রিস্টওয়াচটা দেখিয়া ইংরাজিতে বলিল, “আচ্ছা ফেসাদে পড়া গেল তো, সময় যে হয়ে এল!”

অপরটি হিন্দুস্থানী, বলিল, “আপনি কি বাঙ্গালীন আছে? কোন্ ভাষায় কোথা বলতে পারবেন? আমাদের তিনজোনারহি বোলি সোমঝাতে পারছেন না?”

আমাকে উহারা কেহ দেখিতে পায় নাই, এদিকে পিছন ফিরিয়া ছিল। বুঝিলাম সঙ্গিনী টিকিটহীনাও। যাহা হউক, ভাবিবার সময় ছিল না, যেন এইমাত্র ঢুকিয়াছি এইভাবে বলিলাম, “এ কি! কি বাপার মেমসাহেব?”

আমার দিকে চাহিয়া একসঙ্গে ফিরিঙ্গি ইংরেজিতে, মেমসাহেব হিন্দিতে ব্যাপারটা বুঝাইতে শুরু করিয়া দিল। হিন্দুস্থানীটি তাড়াতাড়ি বারণ-স্বরূপ হাত দুইখানা তাহাদের মুখের কাছে ধরিয়া বলিল, “সব বাঙ্গালী মাশা, হিন্দি ইংলিশ নেহি জানতা।। am under- standing him in Bengali। এই আওরাৎ লোকটির সাথমে—”  

আমি তাহার বাংলার স্রোতে বাধা দিয়া শুদ্ধ হিন্দিতে বলিলাম, “বুঝেছি; তা মেয়েছেলেদের টিকিট তাঁদের অভিভাবকদের কাছে থাকে, এটা বুঝে আপনারা একটু অপেক্ষা করতে পারতেন। এই নিন, তবে ব্যাপার এই যে, আর একখানা অর্থাৎ এক হিসেবে আমার টিকিটখানা আপনাদের দেখাতে পারলাম না। দু-তিন জায়গায় দাম চোকাবার জন্যে ব্যাগ খুলতে একখানা কোথায় প’ড়ে গেছে, সেই খোঁজেই এতটা দেরিও হয়ে গেল। মোতিয়ারি থেকে বর্ধমান, এই টিকিট দেখলেই বুঝতে পারবেন! কত দিতে হবে?”

আবার নূতন ওয়ার্ডের দিকে একবার চাহিলাম। ঘোমটা-টানা মুখটা এদিকে ফিরানো রহিয়াছে। ঘোমটার পাশের কাপড়টা ঘুরাইয়া মুখের নিম্নভাগটা চাপিয়া আছেন। ঠিক চক্ষু দুইটির পরিমাণে সামান্য একটু অবকাশ। চক্ষু দেখা যায় না, বোধ হয় কালো চোখের দীর্ঘ পল্লবে ঘোমটার ছায়াটা আরও নিবিড় করিয়া দিয়া থাকিবে! কিন্তু নাই দেখি, বেশ অনুভব করিতেছিলাম, দুই ডাগর চোখের স্নিগ্ধ দৃষ্টি আমার সমস্ত শরীরের প্রসন্নতা বর্ষণ করিতেছে। সারা দেহ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল! ভাবিলাম, কৃপণের মত এই অতি-সংযত দান; কিন্তু এটুকুরই জন্য কিই না দেওয়া যায়, কিই না করা যায় এই প্রসাদকণিকার জন্য নিজের সমস্ত দেওয়া-করাকে কতই না তুচ্ছ বলিয়া মনে হয়!

আমি শুদ্ধ হিন্দি বলিতে পারি, বোধ হয়, সেই অপরাধে হিন্দুস্থানী টিকিট কালেক্টর জরিমানার জন্য জিদ করিলেও, ফিরিঙ্গী মোতিহারি হইতে বর্ধমান পর্যন্ত নিছক ভাড়া লইয়াই ছাড়িয়া দিল। দলটা নামিয়া গেলে একটু নিকটে গিয়া বলিলাম, “এই রাখুন টিকিটটা। আগে বলেন নি কেন? টিকিটের জন্য কত বিড়ম্বিত হলেন দেখুন তো—”, একটু অভিমানের সুরেই কথাগুলো বাহির হইল। আঘাতটা আমারই বেশ লাগিয়াছিল কি না।

ডান হাতের শুধু আঙুল কয়টা কাপড়ের রাশির মধ্য হইতে বাহির করিয়া প্রসারিত করিয়া ধরিলেন। রাঙা টিকিটখানি মাঝখানে আলগোছে রাখিয়া দিয়া কহিলাম, ‘কই, আপনার তো কিছু খাবার কেনা দেখছি না?”

এই সময় গার্ড হুইস্ দিল। দুয়ারের কাছে তাড়াতাড়ি আসিয়া ‘খাবারওয়ালা, খাবারওয়ালা’ বলিয়া চিৎকার করিলাম।

কেহ উত্তর দিল না। নিকটে একটা ছিল, ভ্রু নাচাইয়া বলিল, “বড়া চালাক হ্যায়, হুইসিল দিয়া আউর–খাবারওয়ালা, খাবারওয়ালা।”

ডাকিলাম, “পানিপাঁড়ে!”

সঙ্গিনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ঘটি আছে?”

বেঞ্চের নিচের দিকে তর্জনীর সঙ্কেত হইল—একটি সুদৃশ্য জার্মানসিলভারের ঘটি। বাহির করিয়া পানিপাড়ের নিকট জল লইলাম। তাড়াতাড়িতে খঞ্চেতে একটা আট আনি দিয়া চার দোনা অর্থাৎ এক আনার পান লইলাম। পয়সা ফেরত পাইলাম না, কারণ খঞ্চের মাঝখানে চোখের সামনে এক কাঁড়ি পয়সা থাকিলেও পানওয়ালার হঠাৎ বিশ্রী রকম দৃষ্টিবিভ্রম আসিয়া পড়ল। সেই অবসরে গাড়ির বেগ বাড়ায় আমরা প্ল্যাটফর্মের বাহিরে আসিয়া পড়িলাম।

সাত আনা পয়সা গেল, কিন্তু সাত আনা পয়সা অথবা পয়সা মাত্রই গ্রাহ্য করি, মনটা সে সময় এরূপ বস্তুতান্ত্রিক ছিল না। সঙ্গিনীকে উদ্দেশ করিয়া বলিলাম, “এ সব তো হ’ল, কিন্তু খাবার আপনার নেওয়া হ’ল না তো! তা নাই হোক, আমার এগুলো দরকার হবে না। চা-টা খেয়েছি!—” বলিয়া সমস্ত খাবার, জল, তিন দোনা পান সামনের বেঞ্চের উপর রাখিয়া দিলাম। একটু ক্ষুব্ধভাবে বলিলাম, “অনেকক্ষণ খান নি নিশ্চয়। খাবার খুবই সামান্য হ’ল। এ পর্যন্ত মুখ ফুটে কিছু বললেন না তো—আমার দোষ কি বলুন?”

এখানে সুন্দরী আমায় একটু কৃতার্থ করিলেন। খাবারের ঠোঙাটি লইয়া আমার দিকে পশ্চাৎ করিয়া বসিলেন। ঘটি হইতে জল লইয়া মুখ ধুইয়া আহারে প্রবৃত্ত হইলেন এবং দুই- চারি মিনিটের মধ্যেই ঠোঙাটি খালি করিয়া জানালা গলাইয়া বাহিরে ফেলিয়া দিয়া ঘটির প্রায় অর্ধেক জল ঢকঢক করিয়া পান করিয়া ফেলিলেন।

বলিতে কি, আমি ঠিক এ রকমটি আশা করি নাই। আশা যাহা করিয়াছিলাম তাহা বরং এই যে, আহার্যের কিছু অংশ দরদভরে আমি শ্রীহস্ত হইতে লাভ করিব।

আমার কাব্যের অতি-কোমল অঙ্গে একটি রূঢ় আঘাত লাগিল। কিন্তু সুখের বিষয় হউক আর নাই হউক, ব্যথাটা স্থায়ী হইল না। সঙ্গিনীর গ্রহণ এবং ভোজনের মধ্যে যে একটা নগ্ন স্থূলতা ছিল, একটু চেষ্টা করিয়া ভাবিতেই সেইটাই আমার চক্ষে সুন্দর হইয়া ফুটিয়া উঠিল। মনকে বুঝাইলাম—প্রত্যেক মানুষটির মধ্যে একটি পশু বর্তমান। আমরা তাহাকে চাপড়াইয়া-চুপড়াইয়া শিষ্ট এবং সংযত করিয়া রাখি, এবং লোকচক্ষুতে এই শিষ্টতাটি হয় সৌন্দর্য। এ এক ধরণের সৌন্দর্য বটে। কিন্তু ইহার মধ্যে সৌন্দর্যের পূর্ণ রূপটি তো পাওয়া যায় না। যে রূপ পাওয়া যায়, যখন প্রকৃতির তাড়নায় সেই পশুটি সংযমের এবং আচারের সমস্ত শৃঙ্খল ঝনঝনাইয়া তাহার সমগ্র বীভৎসতায় বাহির হইয়া আসে, তখন মানুষের কোমলতা ও পশুর কঠোরতা মিলিয়া এক অপরূপ রসের সৃষ্টি হয়, সেই পূর্ণ ঝরনার শ্রী যেমন শুধু স্নিগ্ধ স্বচ্ছ কালো জল বলিয়াই হয় না, তাহার সঙ্গে গর্জন চাই, আর চাই উপলবিক্ষুব্ধ ফেনার আবিলতা।

এই রহস্যময়ী কোমলাঙ্গীর ক্ষুধা-উগ্র আহারের মধ্যে আমি এই রকম গোছের একটা মাধুর্য দেখিয়া নিজেকে কৃতার্থ মনে করিলাম।

দেখিলাম, সুন্দরী পানের দোনা হইতে পান বাহির করিয়া হাতে ধরিয়া নিশ্চলভাবে বসিয়া আছেন। প্রশ্ন করিলাম, “জরদা খান?”

ঘোমটাটি সম্মতির ভঙ্গীতে দুলিল। মৌন হইলেও এ উত্তরটুকু শব্দের এত কাছাকাছি যে, আমি প্রায় আত্মবিস্মৃত হইয়া গেলাম। পকেটে বন্ধুর দেওয়া বিদায়ের স্মৃতিচিহ্ন খাঁটি রূপার একটা জরদার কৌটা ছিল—মিনার কাজ করা এবং মাঝখানে সোনার একটি পান বসানো। একটু জরদা নিজের জন্য ঢালিয়া রাখিয়া কৌটাটা দিবার জন্য উঠিয়া গেলাম; বলিলাম, “রাখুন আপনার কাছে, পান খাওয়া হয়ে গেলে দিলেই হবে।”

আবার একবার পাঁচটি সোনার আঙুল প্রসারিত হইল। সামান্য একটা রাঙা রেলটিকিট পড়িয়া যেখানে অপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করিয়াছিল, সেখানে কারুমণ্ডিত শৌখিন সেই সোনা-রূপার পাত্রটি যে কি মোহ রচনা করিল, কি করিয়া জানাই! দেখিলাম একটু। কিন্তু আশ মিটিবার পূর্বেই আঙুল কয়টি চাদরের মধ্যে অন্তর্হিত হইল। আর কতক্ষণে— কতদিনেই বা মানুষের এ আশা মিটে? কবেই বা মিটিয়াছে?

একটি দীর্ঘনিশ্বাস আপনি বাহির হইয়া আসিল।

নিজের সীটে আসিয়া বসিলাম, এবং বেদনাটাকে চাপা দিবার জন্য বইটা খুলিয়া বসিলাম। গল্প শেষ হইয়া আসিয়াছে, পড়িয়া চলিয়াছি, “…আর সমস্ত জলমগ্ন হইয়া গেছে। কেবল হাত পাঁচ-ছয় দ্বীপের উপর আমরা দুইটি প্রাণী আসিয়া দাঁড়াইলাম।…আজ সমস্ত বিশ্বসংসার ছাড়িয়া সুরবালা আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। আজ আমি ছাড়া সুরবালার আর কেহ নাই। আমি এই এক রাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি!…আমার পরমায়ুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে এই একটিমাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।”

বই মুড়িলাম। ভাবিতে লাগিলাম সেই মহাসঙ্কট পৃথিবীর আর সমস্ত সত্য মিথ্যা বন্ধন মুছাইয়া দিয়া কয়েকবার একটা তুচ্ছ সম্বন্ধকে মৃত্যুর চিরান্ধকারের সম্মুখে মুহূর্তের জন্য এ উজ্জ্বলভাবে সত্যের আলোক ফুটাইয়া তুলিল কেন? কোন্ রহস্যময়ের ইঙ্গিতে সুরবালা আজ সমস্ত জীবনে সম্বলরূপ একটি রাত্রির নিবিড় সান্নিধ্যের উপহার দিবার জন্য সেই ব্যর্থজীবন স্কুলশিক্ষকের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল? সেই অদৃশ্য শক্তির নির্দেশেই কি আজিকার রাত্রে এই মায়ারূপিণী আমার পথে আসিয়া পড়িয়াছে? কয়েক দণ্ড মাত্র লইয়া এই যে নীরব মিলন, ইহার মধ্যে কত যুগ, কত জন্মজন্মান্তরব্যাপী সাধারণ সিদ্ধি কি পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিয়াছে? কে জানে!

আমার “সুরবালা” তখন একেবারে মাথা উল্টাইয়া চার আঙুল মোটা রকম জরদা লইয়া একটু গদ্যময় ভঙ্গিমায় মুখবিবরে চালান দিতেছিলেন। কিন্তু তাহাতে আমার কাব্যের রসটুকুকে একটুও বিস্বাদ করিতে পারিল না। অত কথা কি, ক্ষুধায় যে নাড়ীতে জট পাকাইয়া যাইতেছিল, সেই দিকেও বড় একটা ভূক্ষেপ ছিল না!

জামুই স্টেশনে নামিয়া একটু দূরে গিয়া তাড়াতাড়ি এক ঠোঙা ছোলার অখাদ্য ঘুগনি চিবাইয়া লইলাম, তাহার পর গাড়ি ছাড়িলে সঙ্গিনীর নিকট জলের ঘটিটি ভিক্ষা করিয়া লইয়া তাঁহার পানের পর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সমস্ত দেহমন দিয়া সেটুকু পান করিয়া লইলাম। তিনি আলগোছে পান করিলেও জলটুকু এক হিসাবে উচ্ছিষ্টই ছিল মানি, এবং হয়তো সেইজন্যেই তখন বোধ হইল যেন দুইটি প্রাণীর মধ্যে একটা সুস্পষ্ট যোগ স্থাপিত হইয়া গেল, আমাদের মধ্যে কোথায় একটা পার্থক্যের রেখা ছিল, ওই এক ঘটি জলে সেটা ধুইয়া মুছিয়া গেল।

নিজেকে একটু প্রশ্রয় দিবার ফল এই হইল যে, এই যোগটুকুকে আরও ঘনিষ্ঠ করিয়া লইবার জন্য মনটা উৎকট রকম চঞ্চল হইয়া উঠিল। জলপান করিয়াই যে ফিরিয়া আসা উচিত ছিল, সেটা মনেই পড়িল না। পড়িবে কোথা হইতে? তখন সমস্ত মন জুড়িয়া এই একটা আকাঙ্ক্ষাই তোলপাড় করিতেছিল—হে সুন্দরি, আর কিছু নয়, দুইটি কথা দাও, তা সে যেমনই হউক না, তাহাতে আমার এ কাব্য-রজনীর রঙিন স্বপ্ন এক নিমেষে চুরমার হইয়াই যাক বা সে স্বপ্নের মোহ আমায় আরও-আরও হতচেতন করিয়া দিক, কিছুই যায় আসে না। সমস্তের উপরে আমি ওই দুইটি বাণী পাওয়াকে আমার জীবনের পরম সত্য করিয়া রাখিব।

হঠাৎ চেতনা হইল। তাহাকে চেতনা বলি, কি ক্ষুণ্ণ অভিমান বলি, কি নিরাশার আত্মগ্লানি বলি? নিজের জায়গায় আসিয়া বসিলাম। মনে বলিলাম, “না, এ ঠিক করিয়াছ। আমার এক রাত্রির সমস্ত প্রগল্ভতা এই বজ্রশাসনেই তুমি খর্ব করিয়া রাখ। হে সম্রাজ্ঞি, আমার কি অধিকার তোমার বাণীতে? আর তোমার ধ্যানেই বা আমি তৃপ্তি খুজি কিসের জোরে? তোমার এই বিধানই উপযুক্ত। এই কঠিন নীরবতার বাঁধ দিয়া আমার এই তোমামুখী চিন্তাস্রোতকে সারা রজনী এমনই করিয়াই নিরুব্ধ করিয়া রাখ।

নিজেকে ভাগ্যহীন তো মনে হইলই, সেই সঙ্গে এই অভিমানটা বুকের মধ্যে গুমরিয়া উঠিয়া নিজেকে প্রবল অপরাধী সাব্যস্ত করিয়া তবে শান্ত হইলাম। নিজেকে লইয়া এই দারুণ দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়িয়া এমনই শ্রান্ত হইয়া পড়িলাম যে, স্থির করিলাম, পরের স্টেশনে নিজে হইতেই কোন সঙ্গী ডাকিয়া লইব; কিংবা এই কামরাটাই ত্যাগ করিয়া যাইব। এই গাড়ির মধ্যকার অসহ্য গুমট আর যেন বরদাস্ত হয় না।

হায় রে, মানুষের এত আত্মজ্ঞান আর এত আড়ম্বরের আত্মবিশ্বাস!

পরের স্টেশনে একটি বাঙালি যুবক বোধ হয় তাহার বৃদ্ধ পিতামাতা, স্ত্রী, একটি ছোট কন্যা ও দুই-কুলি মালপত্র লইয়া খানিক দূর ছুটাছুটি করিয়া, শেষে আমার গাড়ির সামনে আসিয়া হন্তদন্ত হইয়া বলিল, “মশায়, আর বোধ হয় এক মিনিটও সময় নেই, থার্ড ক্লাসে তো উঠতে পারলাম না, একটু দয়া করে যদি—। নাও বাবা, তুমি আগে ওঠ—”

আমি একটু ভাবিলাম, কি যে মাথামুণ্ডু ভাবিলাম জানি না। পকেট হইতে রেলের চাবিটা বাহির করিয়া আস্তে আস্তে কুলুপে ভরিয়া মোচড় দিতে দিতে নির্বিকার ভাবে বলিলাম, “আজ্ঞে না, এখানে ভিড় করলে চলবে না, এগিয়ে দেখুন।”

ঈশ্বর আমার অসহ্য অবস্থায় করুণা করিয়া সঙ্গী দিলেন অকার্পণ্যের সহিত, আর আমি এমনই করিয়া সেই মহাদান প্রত্যাখ্যান করিলাম। আজ ভাবি, কি ভূত যে মাথায় চাপিয়াছিল সেদিন!

সমস্ত রাত্রি এই রকমে কাটিল, কখনও আশার তীব্র উন্মাদনায় সমস্ত শরীরমন জাগ্রত, এতটুকু তন্দ্রার লেশ নাই যে কল্পনার মধ্যে অস্পষ্টতা আনিতে পারে; আবার কখনও বা হতাশার অবসাদে, যাহাতে জাগরণটাকেও যেন নিদ্রার মতই শিথিল বলিয়া বোধ হয়।

সঙ্গিনী খানিকটা দিব্য ঘুমাইয়া লইলেন। একটু হিংসা হইল, ভাবিলাম, ‘দিব্য আছ তোমরা, যত মাথাব্যথা কি ভগবান আমাদেরই দিয়াছেন!’

.

এই আমার এক রাত্রির ইতিহাস। আমার অন্তরের বাসনা রাত্রির সামান্য ঘটনা-সমাবেশের গায়ে যেমন ভাবে রঙ ধরাইয়া আসিয়াছিল, যথাযথভাবে তাহা লিপিবদ্ধ করিবার প্রয়াস করিয়াছি।

শেষ পর্যন্ত একটা গভীর নিরাশার কাহিনী। এ শুনাইয়া কাহাকেও বিড়ম্বিত না করিলেই ভাল হইত, তবে আমরা সবাই মায়াসঙ্কুল সংসারপথের যাত্রী, আর যাত্রাটা অনেক সময় আবার রেলপথে সারিতে হয়, যেখানে মায়ারাক্ষসী সহস্র রূপে সদাই ওত পাতিয়া আছে। সেইজন্য, যতটা পারিলাম, সেই রাত্রে আমার দুর্বল মনের ভাবটা লিখিয়া গেলাম তখন ভাবিয়াছিলাম, ‘এ কাহিনী এমনই অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে? দিনের আলো একে কি একটা বিপুল সার্থকতার মধ্যে পূর্ণ করিয়া দিয়া যাইবে না?’

আর এখন ভাবি—। যাক, সে কথা তুলিতে আর প্রবৃত্তি নাই। সামান্য ভুলে সেদিন কি দুর্লভ সম্পদকে হারাইলাম, কী তীব্র একটা অনুশোচনার দাগ যে সে আমার মনে মুদ্রিত করিয়া গিয়াছে, সে কথা ভাবিতে এখনও নিজের পৌরুষে ধিক্কার জন্মে।

তাই এই দুঃখের কাহিনীটা শেষ করিতে চাই।

খুব ভোর থাকিতে, তখনও অন্ধকারের পর্দাটা একেবারে গুটাইয়া যায় নাই, ট্রেনটা আসিয়া পানাগড় স্টেশনে দাঁড়াইল। সঙ্গে সঙ্গে সেই মূর্তিটি আপাদমস্তক বস্ত্রাবরণে ঢাকিয়া গাড়ির দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল এবং মুহূর্তমাত্র বিলম্ব করিয়া ধীরে ধীরে নামিয়া গেল।

ঘটনাটা লিখিতে সামান্য, কিন্তু তখন আমার কাছে সামান্য ছিল না। একবার মনে হইল, সারা রাত্রের সমস্ত অসার তর্কবিতর্ক ছিন্নভিন্ন লণ্ডভণ্ড করিয়া শেষবারের মত একবার ননীর হাত দুইখানি ধরিয়া নামাইয়া দিয়া এই জীবনের প্রথম এবং শেষ স্পর্শের একটা আভাস লই; তাহা কিন্তু করা হইল না।

মূর্তি নামিয়া দুই পদ অগ্রসর হইয়া, আমি যেখানটায় বসিয়াছিলাম প্ল্যাটফর্মে ঠিক তাহার নীচে আসিয়া দাঁড়াইল। বুঝলাম, নতমুখী কৃতজ্ঞতা জানাইতে চাহে, নারীহৃদয়ের অসীম কৃতজ্ঞতার দুইটি কথায় বিদায়ের শঙ্কাশরমহীন লগ্নটুকু ভরিয়া যাইতে চাহে।

তখনও বিনিদ্র রজনীর নেশা মাথার মধ্যে পাক দিতেছিল। মনে মনে এই ব্রীড়ানতা কুণ্ঠিতা মূর্তিকে ডাকিয়া বলিলাম, ‘না হে সুন্দরি, আর কৃতজ্ঞতার আবশ্যক নাই। একটি রাত্রির জন্য তুমি যে আমার দেহের এত কাছে এবং মনের এমন গভীর অন্তস্থলে প্রবাস করিয়া গেলে, সেই আমার মহা পুরস্কার। হে মৌনে, আকাশের ওই অস্তমান নক্ষত্রের মত তুমি রজনীর এক প্রান্ত হইতে উদয় হইয়া অন্য প্রান্তে বিলীন হইতে চলিয়াছ। তোমার আদি রহস্যে, তোমার অবসান রহস্যে—এই দুই সীমাহীন রহস্যের মাঝখান একটি রাতের আধবাস্তবতার মধ্যে তুমি আমার কাছে যে জাগিয়া উঠিয়াছিলে, সেই আমার মহাসম্পদ, সেজন্য তুমিই আমার সমস্ত মনপ্রাণের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ কর।’

গার্ড হুইস্‌ দিল, সঙ্গে সঙ্গে অবগুণ্ঠন উন্মুক্ত হইল এবং ফিক করিয়া একটু হাসি।—

ইয়া গোঁফ, একমুখ ছাঁটা দাড়ি, ক্ষুর দিয়া কামানো মাথা, রগ বসা, গাল তোবড়ানো, দুশমন কালো এবং হাত পায়ে সুকৌশলে ঈষৎ হলুদরঙের সঙ্গে খড়ি মাখানো।

হাসিটা কান হইতে কান পর্যন্ত প্রসারিত করিয়া বলিল, “সেলাম আলেকুম কর্তা; গোস্তাকি লেবেন না, আওরাতের ওপর কর্তার বেজায় নেকনজর দেখি—হি—হি-হি সব খোদার মরজি, মাঝ হতে আমার একটু ফায়দা হয়ে গেল—হি-হি-হি।”

গাড়ি ছাড়িয়া দিল। লোক ডাকিব কি, আমার বাকরোধ হইয়া গিয়াছিল। চেন টানিবার কথাটা তো মনেই আসিল না। ভ্যাবাগঙ্গারাম হইয়া বসিয়া রহিলাম

সেই উৎকট হাসি লইয়া গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে দুই পা চলিতে চলিতে বলিল, “আবার সেলাম আলেকুম, চললাম, জরদার কৌটোটা আশনাইয়ের নেসানা ক’রে রাখলাম কর্তা, এই চাদর আর সিল্ভারের ঘটির সাথে খুব মানাবে—হি—হি—হি। অধীনের নাম অছিমুদ্দিন, মেহেরবানি ক’রে ইয়াদ রাখবেন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *