এক রাতের ইতিহাস
ক
গাঁয়ের বন্ধু চাটুজ্জে বেঁচে থেকে সবাইকে যেমন জ্বালিয়েছিল, মরেও আমাদের ক-জনকে তেমনি জ্বালিয়ে গেল। তার মরা উচিত ছিল ফাঁসিকাঠে, কিন্তু সে মরল বিছানায় শুয়ে।
আজ ক-দিন ধরে বিষম বাদলা নেমেছে। মেঘের আড়ালে সুয্যিঠাকুর দিব্বি ঘুম দিচ্ছেন। থেকে থেকে বাজের গুড়গুড়ুনি; তবে তা সুয্যিঠাকুরের নাক ডাকার আওয়াজ বোধকরি নয়। দিন-রাত বৃষ্টির কামাই নেই— কখনো মুষলধারে, কখনো টিপটিপ করে।
দিনেই চারিদিক ঘুটঘুট করছে, রাতের তো কথাই নেই। এই ভিজে অন্ধকার রাতে দুর্দান্ত রঘু চাটুজ্জে হঠাৎ পটল তুলে বসল।
রঘুকে সবাই ভয় আর ঘেন্না করত। তার ওপরে এই দুর্যোগ; আর শ্মশান হচ্ছে গাঁ থেকে চার মাইল দূরে। কাজেই মড়া নিয়ে যেতে কেউই রাজি হতে চাইলে না।
নরকে নিয়ে যাওয়ার সময়ে যমদূতেরা যদি রঘুর দেহটাকেও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে নরকের অগ্নিকুণ্ডে ফেলে দিত, তাহলে আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচতুম। কিন্তু তা যখন হল না, তখন কী আর করি, রঘুর বুড়ি মায়ের কান্নাকাটি শুনে আমরা চারজনেই মড়া নিয়ে শ্মশানে যেতে রাজি হলুম।
খ
টিপটিপ করে ইলশে গুঁড়ি ঝরছে আর ঝরছেই। পথে প্যাচপ্যাচ করছে কাদা আর চারিদিকে থমথম করছে মিশমিশে কালো রাত। একটা ভারী মড়া কাঁধে করে আমাদের চারজনকে এই চার মাইল দুর্গম বনপথ পার হতে যে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হবে, সে বিষয়ে আর কোনোই সন্দেহ নেই।
বাইরে পা দিতে-না-দিতেই মাথার ওপরকার বট গাছের ডাল থেকে চ্যাঁ-চ্যাঁ করে একটা প্যাঁচা চেঁচিয়ে উঠল।
সেই অলুক্ষুণে ডাক শুনে মধু খুড়ো ‘হরিবোল’ ‘হরিবোল’ বলে প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগলেন।
মাধব বললে, ‘রোঘো আমাদের সহজে নিষ্কৃতি দেবে বলে মনে হচ্ছে না। আজকের রাতটা ভালোয় ভালোয় কাটলে বাঁচি!’
মানিক অস্ফুট কণ্ঠে বললে, ‘রাম, রাম!’
আমি মুখে আর কিছু বললুম না।
রঘুর চাকর খ্যাঁদা লণ্ঠন নিয়ে আগে আগে চলল, তার পিছনে পিছনে পিছল পথে খুব সাবধানে মড়ার খাট কাঁধে আমরা অগ্রসর হলুম। এই খ্যাঁদা শুধু রঘুর চাকর নয়, সে ছিল তার সমস্ত পাপ কাজের সঙ্গী। তার চেহারা যেমন দুষমন, তার স্বভাবও তেমনি কুৎসিত। তার ওই দু-খানা কালো কালো হাত যে কত ডাকাতি, রাহাজানি আর চুরি জোচ্চুরি করেছে সে আর হিসাব করে বলা যায় না। রঘু ছাড়া আর কেউ তাকে ভালোবাসত না।
গাঁ ছেড়ে মাঠ, তারপর বনের ভিতর দিয়ে পথ, তারপর আবার মাঠ, তারপর নদীর ধারে শ্মশান। কিন্তু আজকের ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাঠ আর বন, আকাশ আর পৃথিবী সব একসা হয়ে গেছে। তাদের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছিল শুধু মাঝে মাঝে জ্বলে ওঠা বিদ্যুতের আলোয়। খ্যাঁদার লণ্ঠনের আলো মিটমিট করে জ্বলে অন্ধকারের নিবিড়তাই যেন আরও ভালো করে দেখিয়ে দিচ্ছিল। মাঠ দিয়ে খানিক এগুবার পরেই পিছন থেকে খুড়ো হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, আমাদের পিছনে-পিছনে কে যেন আসছে!’
খ্যাঁদা লণ্ঠনটা মাথার ওপরে তুলে সেই ম্লান আলোর সাহায্যে পিছন দিকটা দেখবার চেষ্টা করে বললে, ‘কই, কেউ তো নেই কর্তা!’
আমি বললুম, ‘খুড়ো, এই দুর্যোগে আর অন্ধকারে কে আর শখ করে মাঠের মধ্যিখানে ভিজতে আর হোঁচট খেতে আসবে!’
মাধব বললে, ‘কারুকে আর ভূতে পায়নি তো!’
মানিক শুকনো গলায় বললে, ‘আঃ, আবার ও নাম কেন? রাম, রাম!’
মাঠ ছেড়ে বনে এসে পড়লুম। চলতে চলতে মনে হতে লাগল, বনের গাছপালার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ায় অন্ধকার যেন দোল খাচ্ছে। চলতে চলতে আমাদের সকলেরই গা ছমছম করতে লাগল।
মধু খুড়ো ফের বললেন, ‘নিশ্চয় কেউ আমাদের পিছু-পিছু আসছে! এবারে আমি খুব কাছের পায়ের শব্দ পেলুম!’
খ্যাঁদা আবার পিছন দিকটা দেখে ঘাড় নেড়ে বললে, ‘কেউ নেই কর্তা।’
আমি বললুম, ‘ভুল শুনেছ খুড়ো।’
মাধব বললে, ‘ভুল নাও হতে পারে। শুনেছি এই বনে ব্রহ্মদৈত্যের বাস আছে।’
মানিক মৃদু স্বরে বললে, ‘রাম, রাম!’।
গ
বনের মাঝখানে এসে কাঁধ থেকে খাট নামিয়ে আমরা একটু জিরুতে লাগলুম। আমরা ক-জন ছাড়া পৃথিবীতে যে আরও প্রাণী আছে, এতক্ষণ পরে তার সাড়া পাওয়া গেল। কিছু পরেই শুনতে পেলুম সেই অসময়ে বনের ভেতরে হেঁড়ে গলায় কে গান গাইছে
খাটে শুয়ে কে যায় রে কে যায় রে,
কে যায় রে ওই!
পায়ে হেঁটে চলে আয়, বসে-বসে
দুটো কথা কই!
বন ডাকে সোঁ-সোঁ করে,
মন আছে আঁধি ভরে,
দুধু ভাতি খাবি যদি কাছে আয়,
বলি পই-পই!
গানের আওয়াজ ক্রমেই আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
আমরা সবাই ভয়ে হরিবোল দিয়ে উঠলুম। মানিক শুধু ‘রাম, রাম’ বলে চ্যাঁচাতে লাগল। গান চলল
পচা মড়া ভালো নয়,
পোকা কার পেটে সয়?
বুড়ো হাড়ে নড়ে চড়ে যেতে পড়ে
আমি রাজি নই!
ডালে উঠে রাত দিন
নাচি আয় ধিন-ধিন
আর খালি গীত গাই— নিয়ে আয়
গাছে-চড়া মই।
ব্যাঙাচিরা ডাকবে না,
ফিঙে জেগে থাকবে না,
এত রোদে ঘুরে-ঘুরে হোস কেন
জলে-ভেজা খই!
ও মামদো! ওরে পেঁচো!
কেন মিছে খাস কেঁচো?
আকাশকে দে মাড়িয়ে পা বাড়িয়ে
কর হই-চই!
খাবি আয় টিকটিকি
হাঁচি আসে দ্যাখ দিকি!
হাঁস-ফাঁস মরা হাঁস, কোথা যাস—
চই-চই-চই!
ঠ্যাং চলে শুয়ে-শুয়ে,
কার পোলা পেলে পুঁয়ে?
পাতে মোর কাঁচা মাথা দিবি নাকি?
বেশ, তাই সই!
খাটে শুয়ে কে যায় রে, কে যায় রে,
কে যায় রে ওই।
—এ কী অদ্ভুত গান। এ কী ভয়ানক সুর! তাড়াতাড়ি মড়ার খাট নিয়ে আমরা শ্মশানের দিকে ছুটে চললুম!
ঘ
শ্মশানে এসে খাট নামিয়ে আগে খুব খানিকটা হাঁপিয়ে নিলুম।
তারপর মাধব বললে, ‘বনের ভেতরে যে গান গাইছিল সে মানুষ নয়।’
মধুখুড়ো বললে, ‘নরক থেকে রঘুর স্যাঙাতরা বোধ হয় তাকে আগ বাড়িয়ে নিয়ে যেতে এসেছে!’
রঘুর চাকর খ্যাঁদা রেগে খুড়োর দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইল।
মানিক এত ভয় পেয়েছিল যে, কথা চুলোয় যাক তার মুখ দিয়ে আর ‘রাম, রাম’ শব্দ পর্যন্ত বেরুল না।
আমি বললুম, ‘ও-সব বাজে কথা বন্ধ করো। এখন জঙ্গলে গিয়ে আবার কাঠ কেটে আনতে হবে।’
মধুখুড়ো বললেন, ‘অদৃষ্টে আজ অনেক কষ্টই আছে। এই ক-দিনের বর্ষায় ভেজা কাঠ দিয়ে কী করে যে চিতা জ্বালাব, তা জানি না।’
আমি বললুম, ‘তবু চেষ্টা তো করতে হবে। নাও, উঠে পড়ো।’
মানিক বললে, ‘আমি আর কোথাও যাচ্ছি না।’
‘তবে তুমি এখানেই থাকো।’
‘একলাই?’
‘কাজে-কাজেই।’
‘ওরে বাপরে! একলা বসে আবার যদি সেই গান শুনতে পাই, তাহলে আমি আর বাঁচব না।… খ্যাঁদা আমার সঙ্গে থাক।’
অগত্যা সেই ব্যবস্থাই করতে হল। আমি, মধুখুড়ো আর মাধব লণ্ঠন আর কুড়ুল নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে কাঠ কাটতে চললুম।
অন্ধকারের সঙ্গে কোলাকুলি করে আকাশ তখনও ক্রমাগত জল ঢেলে যাচ্ছিল। আমাদের ডানদিকে অদৃশ্য নদী বয়ে যাচ্ছে— তার জলকল্লোল শোনাচ্ছে ঠিক যেন ডাইনির কান্নার মতন। বাঁ-দিকে এক মাঠ-ভরা অন্ধকারের ভেতর থেকে বাতাসের হাহাকার শোনাচ্ছে যেন কোনো মরো-মরো রোগির আর্তনাদের মতন। পিছনে শ্মশান, তার বুকে চেপে বসে কালরাত্রির স্তব্ধতাও যেন আজ ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে।
আচম্বিতে একদল শেয়ালও আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দেখলুম, একটা মানুষের মূর্তি মাঠের অন্ধকার ভেদ করে একেবারে আমাদের সামনে আবির্ভূত হল। বেজায় ঢ্যাঙা আর লিকলিকে সরু তার দেহ। একরাশ পাকা গোঁফ-দাড়ি আর তিন-চার হাত লম্বা জটায় ঘেরা মুখের ভিতরে খুব বড়ো বড়ো ড্যাবডেবে চোখদুটো যেন দপদপিয়ে জ্বলে জ্বলে উঠছে!
লোকটা আমাদের দিকে ফিরেও তাকালে না। হন-হন করে শ্মশানের দিকে এগিয়ে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
আমি চুপি চুপি বললুম, ‘পাগল!’
ঠক-ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মাধব বললে, ‘ভূত! ভূত! ব্রহ্মদৈত্য!’
মধুখুড়ো সভয়ে বললেন, ‘চুপ, চুপ, ওই শোনো।’
আবার সেই গান
ঠ্যাং চলে শুয়ে-শুয়ে
কার পোলা পেলে পুঁয়ে?
পাতে মোর কাঁচা মাথা দিবি নাকি?
বেশ, তাই সই!’
ঙ
প্রত্যেকে এক-এক বোঝা কাঠ ঘাড়ে করে আবার শ্মশানের দিকে ফিরলুম।
মধুখুড়ো বললেন, ‘শ্মশানের দিকে যেতে আর পা উঠছে না। ফের যদি সেই মূর্তির সঙ্গে দেখা হয়?’
মাধব বললে, ‘কাজ নেই আর শ্মশানে গিয়ে। চলো, আমরা এইখান থেকেই পালাই চলো।’
আমি বললুম, ‘তাও কি হয়? শ্মশানে আমাদের লোকেরা বসে আছে!’
মধুখুড়ো হতাশভাবে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘শ্মশানে তারা কি আর এতক্ষণ আছে? গিয়ে দেখবে, তারা কোন কালে লম্বা দিয়েছে, আর সেই মূর্তিটা দিব্যি আরামে দু-পা ছড়িয়ে বসে রঘুর মড়া চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।’
আমি বিরক্তি কণ্ঠে বললুম, ‘পাগলের মতন যা তা বোকো না খুড়ো!’
হঠাৎ আবার শোনা গেল
ডালে উঠে রাতদিন
নাচি আয় ধিন-ধিন
আর খালি গীত গাই,— নিয়ে আয়
গাছে চড়া মই!
আমরা ভয়ে কাঠ হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম। শ্মশানের দিক থেকে আসছে— এবারে আর একটা নয়, দু-দুটো মূর্তি!
প্রথম মূর্তিটার মুখের পানে তাকিয়েই আমার বুকের কাছটা যেন হিম হয়ে গেল! এ যে রঘু চাটুজ্জে— যার মড়া আমরা কাঁধে করে শ্মশানে বয়ে এনেছি!— হ্যাঁ, রঘু-রঘু— এ রঘু ছাড়া আর কেউ নয়!
আর রঘুর পিছনে-পিছনে চলেছে পোষা কুকুরের মতন তার চাকর খ্যাঁদা। দেখতে দেখতে অন্ধকারের ভিতরে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল।
চ
ছুটতে ছুটতে তিনজনে আবার শ্মশানে এসে পড়লুম। দেখলুম, মড়ার খাটের পাশে বসে একলা মানিক বলির পাঁঠার মতো কেঁপে-কেঁপে মরছে!
মধুখুড়ো তাড়াতাড়ি শুধোলেন, ‘মানিক, মানিক, ব্যাপার কী?’
আধমরার মতন ধুঁকতে-ধুঁকতে মানিক বললে, ‘কিছু জানি না খুড়ো, আমি আর এখানে থাকব না! আবার সেই গান শুনে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলুম। জ্ঞান হয়ে দেখি, আমাকে এখানে একলা ফেলে খ্যাঁদা রাস্কেল লম্বা দিয়েছে।
খাটের ওপরে কাপড়-ঢাকা মড়া তো ঠিকই রয়েছে! তবে কি আমরা যা দেখেছি তা চোখের ভুল?
মধুখুড়ো এক টানে মড়ার কাপড়খানা সরিয়ে দিলেন। সবিস্ময়ে দেখলুম, খাটের ওপরে মড়া আছে বটে, কিন্তু তা রঘু চাটুজ্জের মৃতদেহ নয়! এই খানিক আগে মাঠের ভেতরে যে জটাদাড়িওয়ালা, রোগা ও ঢাঙা মূর্তিটাকে দেখেছিলুম, এটা হচ্ছে তারই দেহ— মরে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে খাটের ওপরে পড়ে রয়েছে!
আমরা সবাই একসঙ্গে আর্তনাদ করে শ্মশান থেকে পলায়ন করলুম!
ছ
বাড়িতে ফিরে নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিলুম।
শেষরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বিছানার ওপরে উঠে বসে শুনলুম, সদর-দরজার কড়া নাড়তে নাড়তে আমার নাম ধরে কে তীক্ষ্নস্বরে ডাকছে— ‘অবনী! অবনী! অবনী!’
এই অসময়ে কে আবার জ্বালাতে এল? বিরক্ত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরে এসেই শুনলুম, পথের ওপরে দাঁড়িয়ে কে গান গাইছে
খাবি আয় টিকটিকি,
আসে হাঁচি দ্যাখ, দিকি!
হাঁস ফাঁস মরা হাঁস, কোথা যাস,
চই-চই-চই।
শিউরে উঠে আবার ঘরে ঢুকে দরজায় খিল লাগিয়ে দিলুম।
পরদিন সকালেই খবর পেলুম, মধুখুড়ো, মাধব আর মানিকের নাম ধরেও কাল শেষ রাতে কে ডেকে ওই গান গেয়েছিল! বলা বাহুল্য, তারা কেউই সাড়া দেয়নি।
রঘু চাটুজ্জে আর খ্যাঁদারও কোনো খবর পেলুম না। তাদের সঙ্গে আর দেখা হয়নি, না হওয়াই ভালো।