এক যে ছিল চোর (গল্প)
সোমপ্রকাশ চুপচাপ বিছানায় শুয়ে ছিলেন৷ গায়ে জড়ানো শাল৷
ঘর অন্ধকার৷ মাথার কাছে একটা জানলা খোলা৷ জানলা দিয়ে গাছের কয়েকটা পাতা, ডালপালা দেখা যাচ্ছিল৷ তাদের ফাঁকফোকর দিয়ে চোখে পড়ছিল একটুকরো রাতের আকাশ৷ আর সেই আকাশে দু-একটা ফুটফুটে তারা৷
শীতের সময়েও সোমপ্রকাশের অন্তত একটা জানলা খোলা রাখা চাই৷ নইলে ওঁর মনে হয় দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে৷
কিন্তু এখন, একটা জানলা হাট করে খুলে রাখা সত্ত্বেও, সোমপ্রকাশের দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷
ওঁর এমনটা হওয়ার কথা নয়৷ আর সন্ধে সাতটায় ঘর আঁধার করে বিছানায় শুয়ে পড়ার কথাও নয়৷
এমনটা হয়েছে একটা কবিতার লাইন শুনে৷
পাশের ঘরে ছেলে সুমিতাভকে ওর মা কবিতা মুখস্থ করাচ্ছেন৷ এসময়টায় সুমিতাভ মায়ের কাছে পড়তে বসে, আর সোমপ্রকাশ পাশের বেডরুমে জুত করে টিভি দেখতে বসেন৷
আজও তাই বসেছিলেন, কিন্তু ওই কবিতার লাইনগুলো সব এলোমেলো করে দিল৷ মনটা ফিরে গেল অনেক পুরোনো সময়ে৷ সোমপ্রকাশ যখন সুমিতাভর বয়েসে ছিলেন৷ ক্লাস সিক্সে পড়তেন৷ গ্রামের স্কুলে৷
সে প্রায় বত্রিশ-তেত্রিশ বছর আগের কথা৷
বেড়ার ঘর৷ টালির চাল৷ ঘরের সামনে বড় উঠোন৷ উঠোনে বড়-বড় আমগাছ, জামগাছ আর কাঁঠালগাছ৷ একপাশে টিউবওয়েল৷ টিউবওয়েল ডিঙিয়ে গোয়ালঘর৷ গোয়ালঘরে গোরু-বাছুর৷
সেসব কথা মনে পড়তেই সোমপ্রকাশ আলো-টালো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন৷ খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে পুরোনো দিনের ছবি দেখতে লাগলেন৷ গ্রামের বাড়িটা চোখের সামনে ভেসে উঠল৷
সেদিনটাও ছিল শীতের রাত৷ সন্ধে সাতটা কি সওয়া সাতটা হবে৷ ছেঁড়া ফুলহাতা সোয়েটার গায়ে দিয়ে খাটের ওপরে বসে হ্যারিকেনের আলোয় পড়ছিলেন সোমপ্রকাশ৷ পড়ছিলেন মানে দুলে-দুলে কবিতা মুখস্থ করছিলেনঃ
‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?’
ওঁর কাছ থেকে হাতখানেক দূরে বসে ছোটভাই জয়প্রকাশ ‘কিশলয়’ বই নিয়ে বাংলা পড়া তৈরি করছিল৷ ও ক্লাস ফোরে পড়ে৷
একটু আগেই দু-ভাই টিফিন খাওয়া শেষ করেছে৷ তেল দিয়ে মাখা মুড়ি আর পেঁয়াজের টুকরো৷ খালি বাটি দুটো মা এখনও নিয়ে যাননি৷ মা রান্নাঘরে রান্না করছেন৷ কোলের ছোটবোনটা মায়ের কাছে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও, কেন কে জানে, চেঁচিয়ে কাঁদছে৷ এ-ঘর থেকে সোমপ্রকাশ ছোটবোনের কান্না দিব্যি শুনতে পাচ্ছিলেন৷
‘ভাই, যা তো—বোনুকে একটু ধর গিয়ে৷ মা-কে জ্বালাচ্ছে…৷’
দাদার কথায় বারকয়েক গাঁইগুঁই করে জয় বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিয়েছে কি দেয়নি, হঠাৎই শোনা গেল কয়েকজনের চিৎকার: ‘চোর! চোর!’
চিৎকারটা ভেসে এল খুব কাছ থেকেই৷ যেন সামনের দাওয়া কিংবা উঠোন থেকে৷
সোমপ্রকাশ আর দেরি করেননি৷ ‘চোর! চোর!’ চিৎকারের সঙ্গে নিজের কচি গলার চিৎকার মিলিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমেই দে ছুট৷
ঘরের দরজা খুলে বেরোনোর সময় ওঁর মনে হয়েছিল রাতের অন্ধকারে চোরের মোকাবিলা করতে গেলে যা হোক একটা হাতিয়ার সঙ্গে থাকা দরকার৷ তাই যেতে-যেতেই দরজার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা নিজের ক্রিকেট ব্যাটটা এক ছোবলে তুলে নিয়েছিলেন৷
পিছন থেকে জয় ‘দাদা! দাদা!’ বলে চেঁচাচ্ছিল, কিন্তু সে-ডাকে সোমপ্রকাশ ফিরে পর্যন্ত তাকাননি৷
ছোটবেলায় সোমপ্রকাশ খুব দুরন্ত এবং ডাকাবুকো ছিলেন৷ সবসময় অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ করতেন৷ গ্রামের হরিমোহন সরখেল স্মৃতি পাঠাগার থেকে নিয়মিত অ্যাডভেঞ্চারের বই নিয়ে আসতেন৷ লাইব্রেরির মেম্বার ছিলেন বাবা, কিন্তু সেই মেম্বারশিপের দৌলতে বাবার হয়ে সোমপ্রকাশই লাইব্রেরিতে যাতায়াত করতেন এবং নিজের পছন্দসই বই নিয়ে এসে গোগ্রাসে গিলতেন৷ বই পড়তে-পড়তে ওঁর সাহসটা বেশ শক্তপোক্ত হয়ে গিয়েছিল৷
তাই এখন চোখের পলকে ঘর পেরিয়ে দাওয়া, দাওয়া পেরিয়ে অন্ধকার উঠোন৷
কিন্তু কেউ তো নেই! তা হলে চিৎকারটা শোনা গেল কোত্থেকে? প্রথমবার শুনে তো মনে হয়েছিল খুব কাছ থেকেই আওয়াজটা এসেছে!
ঘরের তুলনায় বাইরের খোলা উঠোনে শীত অনেক বেশি৷ কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারে সামিল হওয়ার আগ্রহে শীতের ব্যাপারটা সোমপ্রকাশের মাথাতেই ছিল না৷
উঠোনের বাঁ-দিকে আম, জাম আর কাঁঠালের বড়-বড় গাছ৷ সেদিকটায় অন্ধকার আরও গাঢ়, আরও মিশকালো৷ টিউবওয়েলটাকে দেখা যাচ্ছে না৷
উঠোনে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন সোম৷ না, ওঁর ভূত-টুতের ভয় ছিল না৷ বাবা সেই ছোট্ট বয়েস থেকে ওঁকে চার লাইনের একটা ছড়া শিখিয়ে দিয়েছেন৷ সেই ছড়ায় রাম-লক্ষ্মণ থাকায় ভূত কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে পারবে না৷
শুধু বাবা কেন, ছোটকাকা, মেজকাকা, মা—সব্বাই সোমকে একই আশ্বাস দিয়েছেন৷
এখন উঠোনে দাঁড়িয়ে সোম সেই চারলাইনের ছড়াটাই মনে-মনে আওড়াচ্ছিলেন এবং অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিলেন৷
ঠিক সেই সময়েই আবার ‘চোর! চোর!’
এবারের সমবেত চিৎকারে গলার সংখ্যা অনেক বেশি—তাই শব্দের ডেসিবেল মাত্রাও অনেক বেশি৷
চিৎকারটা সোমদের বাড়ির সামনের পথ দিয়ে ছুটে চলে গেল৷ চিৎকারের সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে গেল অনেকগুলো টর্চের আলো৷ ছোটার তালে-তালে আলোগুলো নাচছে৷
সোমপ্রকাশ আর দেরি করলেন না৷ অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ তিনি পেয়ে গেছেন৷
উঠোন ঘিরে বাঁশের বেড়া৷ তারই এক জায়গায় বাখারি দিয়ে তৈরি বাউন্ডারি গেট—তারের হুড়কো দিয়ে আটকানো৷
দু-সেকেন্ডে সেই হুড়কো খুলে সোমপ্রকাশ বেরিয়ে এলেন কাঁচা রাস্তায় এবং টর্চের আলোগুলো একটু আগে যেদিকে ছুটে গেছে সেদিকে ছুটতে শুরু করলেন৷
রাস্তার দু’পাশে নানারকম গাছপালা৷ তাদের ডালপালায় কুয়াশার ফুল ফুটে আছে৷ রাস্তার কোথাও-কোথাও শালের খুঁটিতে উলঙ্গ বালব জ্বলছে৷
চেনা রাস্তা ধরে ছুটলেন সোম৷ এই রাস্তাটা শ্রীমানীদের পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের দিকে৷ দু-বছর আগে সোম ওই প্রাইমারি স্কুলেই পড়তেন৷
সোমপ্রকাশ ছুটোছুটির ব্যাপারে বেশ দক্ষ৷ স্কুলের স্পোর্টসে তিনবার ছোট-ছোট কাপ পেয়েছেন৷ সুতরাং একটু পরেই তিনি ‘চোর! চোর!’ চিৎকার করা দলটাকে ধরে ফেললেন৷ তখন সবাই শ্রীমানীদের পুকুরের লাগোয়া একটা বড়সড় ফাঁকা জমিতে চলে এসেছেন৷
এই জমিটার চরিত্র ভারী অদ্ভুত৷ জমির মালিকানা শ্রীমানীদের হলেও তাঁরা এ জমির দিকে নজর দেন না৷ ফলে গ্রামের গরিব মানুষরা এই জমির ছোট-ছোট টুকরোয় যে-যার মরজি মতন চাষবাস করে৷ ফলে এই জমিতে পাঁচ-সাত রকম ফসল দেখা যায়৷
‘ওই যে! ব্যাটা পুকুরপাড়ের দিকে যাচ্ছে৷ ওই যে…৷’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—দেখতে পেয়েছি…৷’
টর্চের আলোয় সোম একঝলক দেখতে পেলেন একটা ছেলেকে৷ রোগাটে সরু চেহারা৷ গায়ে একটা সাদা হাফশার্ট আর কালচে হাফপ্যান্ট৷ একহাতে একটা ছোট প্যাকেট গোছের কিছু রয়েছে৷
ছেলেটা তিরবেগে ছুটছে৷
পুকুরপাড়ে অনেকগুলো বড়-বড় গাছ৷ তাদের পাতা বেশিরভাগটাই ঝরে গেছে৷ শুধু কালো-কালো ডালপালা মেলে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার মধ্যে দুটো গাছ আবার হেলে পড়েছে পুকুরের ওপরে৷ এমনভাবে হেলে পড়েছে যেন গাছের ডালপালাগুলো পুকুরের জলের কানে-কানে কিছু বলতে চায়৷
পাঁচমিশেলি খেতের ছোট-ছোট গাছ আর ভিজে মাটি মাড়িয়ে সবাই ছুটল পুকুরের দিকে৷
একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই যে, ওই যে! ব্যাটা ওই গাছটায় উঠছে!’ এবং একইসঙ্গে তার হাতের টর্চের আলো গিয়ে পড়ল একটা বড়সড় গাছের ওপরে৷ গাছটা পুকুরের ওপরে বেশ খানিকটা হেলে রয়েছে৷
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে…!’
‘ওই যে, বেয়ে ওপরে উঠছে—৷’
গাছের ডালপালা আর অল্পস্বল্প পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে সাদা শার্টের অংশ দু-এক পলকের জন্য চোখে পড়ল৷ তবে ছেলেটা গাছ বেয়ে ওপরে উঠছে কি না সেটা খুব স্পষ্টভাবে ঠাহর হল না৷
গাছটার কাছ থেকে খানিকটা দূরে ছুটন্ত ভিড়টা থমকে দাঁড়াল৷ সোমপ্রকাশ খেয়াল করলেন, ভিড়টা এর মধ্যে একটু পরিপুষ্ট হয়েছে৷ হইচই চেঁচামেচি শুনে গাঁয়ের আরও কিছু লোক চোর-তাড়া-করা দঙ্গলে নাম লিখিয়েছে৷ তার মধ্যে দু-চারজন কিশোর এবং বালকও রয়েছে৷
উত্তেজিত জনতা নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলছিল, উত্তেজনায় হাত নাড়ছিল৷ সেইসব কথাবার্তা থেকে সোম চোরের ‘গল্প’-টা কম-বেশি উদ্ধার করলেন৷ সেইসঙ্গে নানান টর্চের ছিটকে পড়া টুকরো-টুকরো আলোয় এটাও দেখতে পেলেন, ওই দঙ্গলের মধ্যে ওঁর বাবা, মেজকাকা এবং ছোটকাকাও রয়েছেন৷ তাঁদের সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটা চেনা মুখ নজরে পড়ল৷ যেমন সমীরকাকু—বেনিয়ামোড়ে ওঁর সাইকেল সারানোর দোকান আছে৷ পরেশ রায়চৌধুরী—গাঁয়ের একমাত্র পুরুতমশাই—গৃহপ্রবেশ থেকে শুরু করে অন্নপ্রাশন, বিয়ে, কিংবা শ্রাদ্ধ—সবকিছুতেই ওঁর ডাক পড়ে৷ হূদয়দা— গ্রামে ওঁর মুদিখানা দোকানটাই সবচেয়ে চালু দোকান৷ রঘু পোরেল—রঘুদা ঢাক বাজায়, দুর্গাপুজোয় কালীপুজোয় কলকাতায় বাজাতে যায়৷ ওর বাড়িতে তিনটে ঢাক আছে, সোমপ্রকাশ দেখেছেন৷
‘চোর! চোর!’ আওয়াজ শুনে যে যেমন পোশাকে ছিলেন সেই পোশাকেই পথে নেমে এসেছেন৷ কেউ ফুলপ্যান্ট, কেউ লুঙ্গি, কেউ বা নিতান্ত গামছা পরে আছেন৷ তবে শীত ঠেকাতে গায়ে সোয়েটার, চাদর কিংবা শাল জড়ানো৷
ভিড়ের মধ্যে বেশ কয়েকজনের হাতে নানানরকম অস্ত্র: যেমন, লাঠি, শাবল, উনুন খোঁচানোর বাঁকানো শিক, বাখারির টুকরো, আর এপাশ-ওপাশ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া আধলা ইটের টুকরো৷
সোমপ্রকাশ ভিড়ের মধ্যে এমনভাবে মিশে ছিলেন যাতে ওঁর বাবা অথবা কাকারা ওঁকে দেখতে না পান৷
সোমদের বাড়ির দু’পাশে ওঁর দু-কাকার বাড়ি৷ তার মধ্যে ছোটকাকার বাড়ির ওপাশে মিত্যুনকাকুর বাড়ি৷ মিত্যুনকাকু পেট্রোল-পাম্পে চাকরি করেন৷ ওঁর বাড়িতেই চুরির ঘটনাটা ঘটেছে৷
মিত্যুনকাকুর দাওয়াতে অনেকরকম জিনিস একজায়গায় জড়ো করে রাখা ছিল৷ মুদিখানার জিনিস আর টুকিটাকি খাওয়ার জিনিস৷ সেখান থেকেই এই চোর কীসের একটা প্যাকেট তুলে নিয়ে পালায়৷ মিত্যুনকাকুর স্ত্রী ছেলেটাকে উঠোনের ওপর দিয়ে ছুটে পালাতে দেখেন এবং ‘চোর! চোর!’ বলে চিৎকার করে ওঠেন৷ তারপরই শোরগোল শুরু হয়ে যায়৷ মিত্যুনকাকু চিৎকার করতে-করতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন৷ এবং ওঁর চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে জড়ো হয়ে যায় এবং ছেলেটা যেদিকে ছুটে পালিয়েছে সেদিক লক্ষ্য করে দৌড়োতে শুরু করে৷
সোমপ্রকাশের দু-কাকা ঘরেই ছিলেন৷ ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ‘সার্চ পার্টি’-তে জয়েন করতে ওঁদের দেরি হয়নি৷ তবে সোমের বাবার ছুটে আসতে একটু সময় লেগেছে, কারণ তিনি কালীতলার মন্দিরের চাতালে বসে তাস খেলছিলেন৷ মন্দিরের দরজা দিয়ে উপচে পড়া আলোয় তাস পেতে রোজ সন্ধেবেলায় এই আসর বসে৷
সোমপ্রকাশদের গ্রামে সবার জীবনই খুব শান্ত ছন্দে চলে৷ সে-চলায় কখনও কোনও ঢেউ ওঠে না৷ সেই কারণেই বোধহয় জীবনগুলো একটু একঘেয়ে ম্যাড়মেড়ে হয়ে গিয়েছিল৷ তাই ওই সন্ধেবেলার উত্তেজনার ঢেউটা চুম্বকের মতো টানে সব্বাইকে টেনে নামিয়েছে শীতের রাস্তায়৷ বোধহয় শীতের রাতে সবাই একটু উত্তেজনার ওম পেতে চাইছিল৷
সন্দেহজনক গাছটা লক্ষ্য করে কেউ একজন একটা আধলা ইট ছুড়ে মারল৷ অনেকে বোধহয় এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষায় ছিল৷ কারণ, প্রথম ইটটা বাতাস কেটে রওনা হতেই তার পিছু-পিছু পরপর কয়েকটা ইট গাছ লক্ষ্য করে উড়ে গেল৷ দু-চারটে ইট গাছে লাগল, বাকিগুলো এদিক-সেদিক দিয়ে উড়ে গিয়ে অন্ধকার পুকুরের জলে পৌঁছে তাদের উড়ান শেষ করল৷
চোরটার গায়ে যে একটা ইটও লাগেনি সেটা সবাই বুঝতে পারল৷ সেইজন্যই হয়তো বেশ কয়েকজন জমির কিনারায় গিয়ে এদিক-ওদিক টর্চের আলো ফেলে নতুন ইটের টুকরোর সন্ধান করতে লাগল৷
সোমপ্রকাশ শুনছিলেন, চোর ছেলেটার হাতে কী-কী অস্ত্র থাকতে পারে সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে৷ অনেক তর্কবিতর্কের পর সকলে সিদ্ধান্তে এলেন যে, ছেলেটার কাছে ছুরি অথবা পিস্তল থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ, এই অস্ত্র দুটো হাফপ্যান্টের পকেটেও লুকিয়ে রাখা যায়৷
এই জটলার মধ্যে অনেকেই বারবার মিত্যুনকাকুকে জিগ্যেস করছিলেন, ‘কী চুরি হয়েছে? কী চুরি হয়েছে?’
মিত্যুনকাকু দু-চারবার ঢোঁক গিলে বললেন, ‘টাকা…টাকা৷ একটা প্যাকেটে প্রায় শ’ দেড়েক টাকা ছিল…৷’
সত্যিই তো, চুরিটা তা হলে নেহাত চাট্টিখানি ব্যাপার নয়! অতগুলো টাকা বলে কথা!
জটলার মধ্যে বেশ কয়েকজন হা-ডু-ডু খেলার মতন সতর্ক ভঙ্গিতে গাছটার দিকে এগোচ্ছিল৷ তাদের সকলের হাতেই টর্চ, আর ছোট কিংবা বড় হাতিয়ার৷
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের ভিড় থেকে আরও দু-একটা বড়সড় ঢেলা ছুটে গেল গাছ লক্ষ্য করে৷ চোর ছেলেটাকে ভয় দেখানোর জন্য ‘চোর! চোর!’ ‘ধর ব্যাটাকে!’ ‘মার ব্যাটাকে!’ ইত্যাদি নানানরকম চিৎকার শোনা যেতে লাগল৷ কেউ-কেউ বলতে লাগল, ‘বদমাশটাকে একবার হাতে পেলে হয়! পিটিয়ে ছালচামড়া গুটিয়ে নেব৷’
সাহসী যে-কয়েকজন গাছের কাছে এগিয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে দুজন তরতর করে গাছ বেয়ে উঠতে শুরু করল৷ তাদের সুবিধের জন্য গাছের ডালপালায়, তাদের বেয়ে ওঠার পথে, টর্চের আলো ফেলতে লাগল কয়েকজন৷ একইসঙ্গে হইচই চেঁচামেচিও চলতে লাগল৷
তারই মধ্যে আচমকা ‘ঝপাং’৷
এই শীতের রাতে চোরবাবাজি পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছে৷
একজন বলল, ‘কী সাংঘাতিক! এই ঠান্ডায় পুকুরের জলে কেউ ঝাঁপ দেয়!’
উত্তর পাওয়া গেল প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই: ‘হ্যাঁ—দেয়৷ চোররা দেয়৷ ওদের চামড়া বেজায় মোটা৷ ঠান্ডায় ওদের কিস্যু হয় না৷’
চোর ছেলেটি পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ায় জনগণ বেশ অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেল৷ হইহই করে পুকুরপাড় বরাবর ছড়িয়ে গিয়ে পুকুরের জলে ঢিল মারতে লাগল৷ টর্চের অনেকগুলো আলো চোর ছেলেটাকে তাক করে চলে বেড়াচ্ছে৷ আর চোর ঠান্ডা জলের পুকুরে পাগলের মতো, কিংবা জলে পড়া ইঁদুরের মতো এলোমেলো সাঁতার কাটছে৷ তারই মধ্যে দেখা গেল ছেলেটা ওর বাঁ-হাতটা জলের ওপরে সামান্য উঁচু করে আছে৷ আর সেই হাতে একটা সাদাটে প্যাকেট না কী যেন!
পুকুরের জলে বৃষ্টির মতো ঢিল পড়ছিল৷ তার বেশ কয়েকটা মনে হয় ছেলেটার গায়ে-মাথায় লাগল৷ কিন্তু কোনও যন্ত্রণার চিৎকার শোনা গেল না পুকুরের জল থেকে৷ হয়তো সে-চিৎকার এতই চাপা যে, কারও কানে পৌঁছোনোর মতন নয়৷
অন্ধকারে মাছের মতো সাঁতার কাটছিল ছেলেটা৷ জল কেটে-কেটে ও পশ্চিম পাড়ে উঠে পড়ল৷ ভিজে জামা গায়ে লেপটে আছে৷ হাফপ্যান্ট থেকে টপটপ করে জল পড়ছে৷ ও হয়তো ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছিল, কিন্তু টর্চের আলো-ছায়ায় সেটা ভালো করে বোঝা গেল না৷
পাড় বেয়ে আগাছার ঝোপঝাড় ঠেলে সরিয়ে ও আবার ছুটতে শুরু করল৷ চিৎকার করতে-করতে জনগণ তাড়া করল ওকে৷
ছেলেটা যেদিকে দৌড়চ্ছে সেদিকে কয়েক বিঘে জুড়ে সনাতন নাহাদের বাঁশবাগান৷ বাঁকা চাঁদের আলো এসে পড়েছে সেই বাগানে৷ এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মাথা তুলে আছে কালো-কালো বাঁশঝাড়৷
পুকুর ছাড়িয়ে এদিকটায় আসামাত্রই তাপমাত্রা যেন আরও দু-এক ডিগ্রি নেমে গেল৷ সোমপ্রকাশ এবার শীতটা ভালোরকম টের পেলেন৷
কয়েকটা বাঁশঝাড়কে এঁকেবেঁকে পাশ কাটিয়ে রোগাসোগা ছেলেটা আচমকা একটা বাঁশঝাড়ের ভেতরে সেঁধিয়ে গেল৷ ব্যাপারটা খুব দ্রুত ঘটলেও ওর পিছু ধাওয়া করা দঙ্গলের দু-তিনজন সেটা খেয়াল করল৷
‘এইখানে! এইখানে! এই বাঁশঝাড়টার ভেতরে লুকিয়েছে! এই যে—এটার ভেতরে…৷’ কয়েকজন উঁচু গলায় শোরগোল শুরু করল৷
সেই বিশেষ বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে লোকজন ভিড় জমাল৷ সবক’টা টর্চের আলো বাঁশঝাড়ের ওপরে গিয়ে পড়ল৷
এতক্ষণ ধরে ব্যবহারের ফলে টর্চের আলোগুলো বেশ হলদেটে আর মলিন হয়ে গেছে৷ কিন্তু সেই স্তিমিত আলোতেও ছবিটা দেখা গেল৷
বাঁশঝাড় থেকে লম্বা-লম্বা বাঁশ ফোয়ারার মতো মাথা তুলেছে৷ দুটো বাঁশ তো এতটাই লম্বা যে, আকাশে অধিবৃত্ত এঁকে ঝুঁকে পড়েছে অন্ধকার মাঠের দিকে৷
শীতের সময়৷ বাঁশগাছের সব পাতাই প্রায় খসে পড়েছে৷ বাঁশগাছগুলো কঙ্কালের হাতের আঙুলের মতন দেখাচ্ছে৷ ওপরদিকে আঙুলগুলো ফাঁক-ফাঁক দেখালেও নীচের দিকে এসে জট পাকিয়ে গেছে৷ এ ছাড়া বাঁশঝাড়ের গোড়ায় জমে আছে, ছড়িয়ে আছে, অসংখ্য শুকনো বাঁশপাতা৷
দেখা গেল, অনেক বাঁশের জটলার মধ্যে ছেলেটা একটা বাঁশ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ মাথাটা নীচের দিকে ঝুঁকে আছে৷ থরথর করে কাঁপছে৷
লোকজন অন্ধকারে বেশি কাছে এগোতে সাহস পেল না৷ কে জানে, ছেলেটার সঙ্গে কী না কী অস্ত্র আছে! তাই একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তারা চেঁচামেচি করতে লাগল, নানান হুমকি দিতে লাগল৷ আবার কেউ-কেউ ঢিল ছুড়তে লাগল৷
ব্যাপারটা সোমপ্রকাশের ভালো লাগছিল না৷
অথচ চোরকে তাড়া করে বেড়ানোর এই আধঘণ্টা কি চল্লিশ মিনিট সময়ের মধ্যে দুবার কি তিনবার ওঁর মনে হয়েছিল, হাতের ক্রিকেট ব্যাটটা চোরকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারেন৷
এখন সে-কথা মনে পড়ে ওঁর খারাপ লাগল৷
চারপাশে অন্ধকার আর শীত৷ বাঁশবাগানের এখানে-ওখানে কুয়াশা দিয়ে তৈরি হাওয়ামিঠাই ভাসছে৷ আকাশে ফ্যাকাশে সরু চাঁদ৷
সোমপ্রকাশ ছোট-ছোট ছেলেদের ভিড়ে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে বড়-বড় লোকদের দেখছিলেন৷ বাবা, মেজকাকা, ছোটকাকা, সমীর-কাকু, ঠাকুরমশাই, মিত্যুনকাকু, হূদয়দা, রঘুদা—এ ছাড়া আরও অনেক চেনা-অচেনা মুখ৷ তাদেরই কেউ-কেউ চোরকে লক্ষ্য করে হুঙ্কার ছাড়ছে৷
‘এই ছোঁড়া, বেরিয়ে আয়—বেরিয়ে আয় বলছি!’
‘ফাঁড়িতে একটা খবর দিলে হয় না? পুলিশের ডান্ডা খেলে ব্যাটা সিধে হয়ে যাবে…!’
‘এই শীতে ওর কষ্ট হচ্ছে না?’ কে একজন প্রশ্ন করল—যে-প্রশ্নটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল৷
উত্তরে আর-একজন দুরছাই ঢঙে জবাব দিল, ‘হুঁ! চোরদের আবার শীত! দেখলেন না, পুকুরের ঠান্ডা জলে সাঁতরে দিব্যি উঠে এল!’
‘টাকার প্যাকেটটা উঁচু করে ধরে রেখেছিল—যাতে জলে না ভেজে৷’
‘বাঁশঝাড়ের মধ্যে কেমন নিশ্চিন্তে ঘাপটি মেরে আছে—ব্যাটার সাপখোপের ভয়ও নেই৷’
‘এই শীতে সাপ আর কোথায়! সব তো গর্তে সেঁধিয়ে আছে…৷’
‘অ্যাই, বেরো—বেরিয়ে আয়! চুপচাপ যদি বেরিয়ে আসিস তা হলে কিচ্ছু বলব না৷ আয়, বেরিয়ে আয়…৷’
কিন্তু এসব কথায় চোর ছেলেটা তেমন কর্ণপাত করল বলে মনে হল না৷ বাঁশ আঁকড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়েই রইল—যেন একটা পাথরের মূর্তি৷ তবে ওর শরীরটা উঁচু কম্পাঙ্কে কাঁপছিল৷
রাত ক্রমে বাড়ছিল৷ বড়রা নিজেদের মধ্যে নানান আলোচনা করছিল৷ আলোচনার মূল বিষয় ছিল: এখন কী করা যায়? এভাবে তো আর সারারাত দাঁড়িয়ে থাকা যায় না৷
বেশ কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কের পর ঠিক হল, ছ’জন এই বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে পাহারা দেবে৷ এবং পালা করে এই পাহারা চলবে ভোর পর্যন্ত৷ তারপর সকালবেলা চোরটাকে টেনে বের করে একটা হেস্তনেস্ত করা হবে৷ মিত্যুনবাবুর টাকাটা যে করে হোক উদ্ধার করতে হবে৷
ব্যস, লাঠিসোঁটা নিয়ে ছ’জন জোয়ান বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ খোলা জায়গায় শীত ঠেকানোর জন্য কয়েকজন তাদের চাদর-শাল ইত্যাদি ওই ছ’জনকে ধার দিলেন৷ কোন দলের পর কোন দল পাহারা দেবে সেসব আলোচনাও করে নিল বড়রা৷ তারপর সবাই ফেরার পথ ধরল৷
সোমপ্রকাশও বাবা-কাকার নজর এড়িয়ে বাড়ির পথ ধরেছিলেন৷ অন্ধকার রাস্তা ধরে ছুটে যাওয়ার সময় ঝিঁঝিঁর শব্দ কানে এসেছিল, আর কয়েক ঝাঁক জোনাকির সঙ্গে সোমের দেখা হয়েছিল৷
বাড়ি ফিরে মা-কে প্রথমে ম্যানেজ করেছিলেন সোমপ্রকাশ৷ চোর ধরার রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের গল্প মা-কে শুনিয়েছিলেন৷ তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলেন—কারণ, কাল ভোরবেলা তো আবার ওই বাঁশবাগানে যেতে হবে!
চোখ বুজে শুয়ে থাকলেও বাঁশঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা চোরের ছবিটা সোম যেন দেখতে পাচ্ছিলেন৷ ছবিটা কিছুতেই সরতে চাইছিল না৷
পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় সোমপ্রকাশের আবার এক অ্যাডভেঞ্চার৷
বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই সোম চুপিসাড়ে তৈরি হলেন৷ তারপর ঘুমন্ত মা-কে ফাঁকি দিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে৷
ভোরের কুয়াশা সরিয়ে সোম বাঁশবাগানের দিকে চললেন৷ অন্ধকার সবে ফিকে হতে শুরু করেছে৷ আলো ফুটছে আকাশে৷ কিন্তু আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ দেখা যাচ্ছে৷ মাঝ-আকাশ থেকে বেশ খানিকটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে৷
ভোরের শীত ঠেকাতে সোয়েটারের ওপরে মায়ের একটা শাল জড়িয়ে নিয়েছেন সোম৷
বাঁশবাগানের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ কাল রাতের বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে প্রায় বারো-চোদ্দোজন লোক জড়ো হয়ে গেছে৷ হাতে লাঠিসোঁটা আর টর্চ৷ কিন্তু সেখানে কোনও ছোট ছেলে নেই৷
দৃশ্যটা সোমপ্রকাশের মনে চিরকাল বেঁচে থাকবে৷
বাঁশবাগানের মাথার ওপরে বাঁকা চাঁদ৷ চারপাশ ঠান্ডা, শান্ত৷ অসংখ্য বাঁশঝাড় কাছাকাছি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে—যেন সব ভাই-ভাই৷ তারই একটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে চোর-শিকারির দল৷
বাবার নজর এড়াতে আসল বাঁশঝাড়টার পাশের একটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন সোম৷ বাঁশের কাটাকুটির ফাঁকফোকর দিয়ে সব দেখতে লাগলেন, শুনতে লাগলেন৷
ভোরের আলো ফুটেছে৷ তার সঙ্গে-সঙ্গে শিকারিদের সাহসও বেড়েছে৷ বাঁশঝাড়টার খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে তারা এখন ছেলেটাকে লাঠির খোঁচাখুঁচি দিচ্ছে৷ শাসাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে, এমনকী পিটিয়ে মেরে ফেলার হুমকিও দিচ্ছে৷
ছেলেটা সেই একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে৷ একটা বাঁশকে জড়িয়ে ধরে আছে৷ শুধু মাথাটা কাল রাতের তুলনায় আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছে৷
ছেলেটা এখন আর শীতে কাঁপছে না৷
সাহস করে মিত্যুনবাবু ওকে লাঠি দিয়ে জোরালো একটা খোঁচা দিলেন৷ ছেলেটা সঙ্গে-সঙ্গে কাত হয়ে গেল৷ হেলে পড়ল একজোড়া বাঁশের ওপরে৷
‘ব্যাটা ঠান্ডায় অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি?’
‘দেখুন, দেখুন—মিত্যুনবাবুর প্যাকেটটা এখনও হাতে ধরে আছে৷ মিত্যুনবাবু, আপনি খুব লাকি—আপনার টাকা ফেরত পেয়ে গেলেন৷ ব্যাটা ওটা হজম করতে পারেনি—৷’
সকলে সেই কথায় সায় দিয়ে ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ করে উঠল৷
আরও কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচির পর সবাই যখন বুঝতে পারল ছেলেটা একেবারে নিস্তেজ, তখন তারা ওর কাছে এগিয়ে গেল৷ ওকে ধরে চ্যাংদোলা করে বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে বের করে নিয়ে এল বাইরে৷ শুইয়ে দিল মাটিতে৷
এবং সবাই চমকে উঠল—একেবারে ভূত দেখার মতো৷
এ তো বোবা কানাই! বেনিয়ামোড়ের কাছে নরসিং জানার চায়ের স্টলের পাশে বসে ভিক্ষে করে!
সেইজন্যই কাল রাত থেকে ও কোনও কথা বলেনি—বলতে পারেনি৷
ঝুঁকে পড়ে ওকে পরীক্ষা করল কয়েকজন৷ হাত রাখল নাকের নীচে, কানের নীচে৷ একজন তো ছেলেটার বুকে কান চেপে ধরল৷
তারপর, ধীরে-ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল৷
এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল সবাই৷ না, কানাই আর বেঁচে নেই৷
মিত্যুনকাকু হঠাৎই নীচু হয়ে কানাইয়ের ডানহাতে ধরা কাগজের প্যাকেটটা নিতে হাত বাড়ালেন৷ কিন্তু তার আগেই কৌতূহলী আর-একজন প্যাকেটটা তুলে নিয়ে খুলতে শুরু করেছে৷
কে একজন বলল, ‘যাক, মিত্যুন—তোমার টাকাটা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হল…৷’
ততক্ষণে প্যাকেট খোলা হয়ে গেছে৷ প্যাকেট বলতে সাধারণ কাগজের ঠোঙা—কয়েকটা ভাঁজ দেওয়া৷
প্যাকেট খুলতেই সবাই আরও অবাক৷
প্যাকেট থেকে বেরিয়ে পড়েছে টাকা নয়—কয়েকটা হাতে গড়া আটার রুটি৷
সবাই অবাক চোখে মিত্যুনবাবুর দিকে তাকাল৷
মিত্যুনবাবু তখন চোখ নামিয়ে মাথা নীচু করে ফেলেছেন৷
সোমের বাবা বললেন, ‘মিত্যুন, তুমি এত বড় মিথ্যুক! চুরিটাকে বড় করে দেখানোর জন্যে এরকম মিথ্যে কথা বললে! তোমার মিথ্যের জন্যে একটা ছেলের…একটা ছেলের প্রাণ গেল!’
মিত্যুনবাবু একেবারে চুপ৷ মাথা নীচু৷
শুধু মিত্যুনবাবু কেন, কানাইয়ের মৃতদেহ ঘিরে সবাই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল৷ দেখে মনে হচ্ছিল, কানাই নয়, ওরা ওদের বিবেকের মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ওরাই যেন আসলে চোর—কানাই ওদের হাতেনাতে ধরে ফেলেছে৷