এক বোতল কাশাকা
সারা বিকেল তুমুল বৃষ্টি পড়েছিল রিও-ডি-জেনেরিও-তে। খুনটা হয়েছিল সেই রাতেই এবং তখনও জলের দাগ বুকে নিয়ে চিকচিক্ করছিল গোটা শহরটা। বেলাভূমি বরাবর অন্তহীন আলোর মালাটি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল নিস্তরঙ্গ শান্ত জলরাশির কালো কুচকুচে পটভূমিকায়। বন্দর অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসেছিল আরও একটা আলোর রেখা। আঁকাবাঁকা পথে না গিয়ে রেখাটা সিধে চলে গিয়েছিল শহরের বুক পর্যন্ত। আলোর ধারায় ঝকমক করছিল রাস্তাগুলো। কাদাজল ছিটিয়ে ছিটিয়ে ছুটে চলেছিল বড় বড় সব গাড়ি।
সুন্দর সুন্দর সব হোটেল, কারুকাজকরা বড় বড় বাড়ি আর কাঁচের দেওয়ালওলা প্রকোষ্ঠগুলোর খোলা জানালায় পাওয়া যাচ্ছিল আনন্দের উষ্ণতা; হালকা হাসির ঠুনকো আওয়াজ, ম্যারিমবা আর ম্যারাকাস-এর শব্দ, বেহালার তারে উখিত সঙ্গীত আর কক্টেল গেলাসের রিনিঝিনি আওয়াজ–সবই ভেসে আসছিল বাতায়নপথে। এ সময়ে এই রকমটি শোনাই তো স্বাভাবিক। স্বপ্ন দেখতে দেখতে হঠাৎ সুপ্তিভঙ্গ হওয়ায় জেগে উঠেছিল সারা শহরটা। নর এবং নারী, চটপটে তাদের প্রকৃতি, বিপুল তাদের অর্থ–প্রত্যেকেই এই ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে যেন আর একবার উপলব্ধি করছিল আনন্দের প্রতি, ফুর্তির প্রতি তাদের আতীব্র আকর্ষণ। নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মতোই তীব্র সে অনুভূতি।
শ্যাম্পেনের বুদবুদ আর মহার্ঘ সুগন্ধির বায়ুবহ সৌরভের আবেশে আবিষ্ট কেউই সে রাতে ক্ষণেকের জন্যেও ভাবেনি অপরূপ সুন্দর কোপকাবানার বালুকাবেলার কাছাকাছি পাহাড়ের সানুদেশের নিরানন্দ কুঁড়েঘরের শহরটির কথা। অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নজরে আসেছিল না; মাঝে মাঝে এই নিরন্ধ্র তমিস্রার মধ্যে জেগেছিল কয়েকটা আলোর শুধু কম্পমান বিন্দু-মোমবাতির শিখা। আর ছিল নিস্তব্ধতা। শুধু শোনা যাচ্ছিল টুপ টুপ করে জল পড়ার আওয়াজ–মর্চে ধরা টিনের চাল থেকে বিন্দু বিন্দু জল ঝরে পড়ছিল ধরিত্রীর বুকে। এছাড়া সবকিছুই হারিয়ে গিয়েছিল নৈঃশব্দ্যের অতলে।
আচম্বিতে একটা কুঁড়েঘর থেকে ভেসে এল ক্রুদ্ধ চাপা কণ্ঠস্বর এবং পরক্ষণেই একটা আর্ত চিৎকার। আর তার পরেই সব চুপ। অসহ্য থমথমে নীরবতা। কুঁড়েঘরের ভেতরকার মোমবাতিগুলো নিভে গেল একে একে। এক মুহূর্ত পরেই সুট করে একটা মুর্তি বেরিয়ে এল ভেতর থেকে–চটপট পা চালিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে। নিম্নমানের জীবনধারা প্রবাহিত সমাজের এই দরিদ্র অংশটিতে কেউই কারও খবর রাখত না এবং এখানে খুনজখম ছিল নেহাতই একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। কাজে কাজেই পরের দিন সকাল না হওয়া পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত রয়ে গেল রোগা একহারা মেয়েটির লাশ। এবং তার পরেই খবর চলে গেল পুলিশের দপ্তরে।
যে কুঁড়ের নীচে খুনটি হয়েছে বিস্তর লোক তার চারধারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সবার আগে আমার চোখে পড়ল কয়েকটা ছেঁড়া পোশাক পরা ছেলেমেয়ে। বাচ্চাগুলো এদিক সেদিক দৌড়ে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিল। জনতার এই জমাট প্রাচীর নাড়ায় কার সাধ্য। শেষকালে যখন চিৎকার করে উঠলাম ও পুলিশকে এগোতে দাও, তখনই চটপট পথ করে দিলে ওরা এবং কয়েকজনকে টুক করে সরে পড়তেও দেখলাম। কারণটা আমার অজানা নয়। সম্প্রতি এ অঞ্চলে পর পর কয়েকটা চুরি হয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে। কিন্তু এসব ব্যাপার নিয়ে পুলিশকে যতখানি মাথা ঘামাতে হয়েছে, তার চেয়েও যে বেশিমাত্রায় তৎপর হতে হবে এ কেস নিয়ে ওদের কারোরই জানতে বাকি নেই।
ঠেলেঠুলে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। টানের চোটে খুলে গেল কোটের সামনের বোতাম। পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে অতখানি ওঠার ফলে রীতিমতো ঘেমেও গিয়েছিলাম। তাই মুছে নিলাম কপালের ঘাম। এতখানি হেঁটে আসার ফলে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। নোংরা পরিবেশের মধ্যে এসে পড়ে একটু মুষড়েও পড়েছিলাম। কিন্তু খুন যখন হয়েছে তখন খুনিকে আমাদের খুঁজে বার করতেই হবে।
আধপোড়া সিগারেটটার দিকে একবার তাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম আমি। তার পরেই মাথা নীচু করতে হল একটু নীচু বরগার আক্রমণ থেকে মাথা সামলানোর জন্যে। নোংরা নীচু কুঁড়েঘরটার অন্ধকারের মধ্যে থেকে ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল বরগাটা।
শুনতে পেলাম বাইরে সিগারেটটার প্রান্তভাগ নিয়ে ছেলেমেয়েগুলো মহাবাগবিতণ্ডা জুড়েছে এবং হাতাহাতি শুরু করে দিয়েছে। রিও ফোর্সে আঠারো বছর রয়েছি আমি পুলিশ চিফ-এর পদে। কাজেকাজেই রুগিকে পরীক্ষা করার সময়ে ডাক্তারের মনে যে ধরনের আগ্রহের সঞ্চার হয়, ঠিক সেই ধরনের পুলিশ চিফ সুলভ আগ্রহ দুই চোখে নিয়ে তাকালাম ঘরটার চারপাশে। এর আগেও এরকম ধরনের কয়েকশো চালাঘরে হানা দিতে হয়েছিল আমাকে। সে সবের থেকে কোনও প্রভেদ দেখতে পেলাম না এ ঘরটায়। একই রকমের নড়বড়ে আসবাবপত্র, হাড়জিরজিরে টেবিল, গোটা দুই ঝপ-করে-ভেঙেপড়া চেয়ার এবং এক কোণে রাশীকৃত নোংরা কম্বল। সূর্যকিরণের প্রসাদবঞ্চিত হওয়ায় একই রকমের উৎকট গন্ধ আর মেঝের ওপর ধুলোর পুরু স্তর। কুঁড়ে ঘরের এই শহরে সবকটা চালাঘরেই যেমনটি দেখতে পাওয়া যায়, অর্থাৎ টিনের চাদর আর ধাতুর প্যানেল দিয়ে তৈরি বাঁধা-ছক-দেওয়াল আর ছাদ–এ ঘরের বৈশিষ্ট্যও দেখলাম তাই। হরেক রকমের এই জিনিসগুলো অবশ্য সবই চোরাই মাল–এক সময়ে যা ব্যবহৃত হত বিজ্ঞাপনের সাইনবোর্ড হিসেবে।
সেদিন সকালে অন্যান্য সবকটা চালাঘর থেকে এই ঘরটিকে একেবারে আলাদা করে ফেলেছিল যে জিনিসটি তা হল একটা দেহ। মেঝের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়েছিল দেহটা। স্ত্রীলোকের লাশ। মুখ থুবড়ে পড়েছিল সে দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে।
ঝুঁকে পড়ে চিৎ করে শুইয়ে দিলাম ওর দেহ। এক সময়ে সুন্দরী ছিল সে। কিন্তু এখন যার মুখের দিকে তাকালাম তাকে মাঝবয়েসি স্ত্রীলোক ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। বহু বছর ধরে জীবনকে জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে নেওয়ার নিদর্শন ফুটে ছিল তার নিষ্প্রাণ মুখের পরতে পরতে। বলিরেখা গম্ভীর হয়ে বসে গিয়েছিল তার চামড়ায়।
বিস্রস্ত কঁচাপাকা চুল এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল বিস্ফারিত চোখের ওপর। জবরদস্তির কোনও চিহ্ন দেখতে পেলাম না কোথাও। অথচ সমস্ত চালাঘরটা আর্তসুরে বলতে চাইছিল–খুন! খুন!
নতজানু হয়ে বসেছিলাম এতক্ষণ। এবার উঠে দাঁড়ালাম। দরজার কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল যারা, তাকালাম তাদের দিকে। ভিড়ের মধ্যে যে সব মুখ আমি দেখতে পেলাম, বহুদিন ধরে তাদের খোঁজ করছিল আমাদের দপ্তর। কিন্তু এখন সে সময় নয়। পরে এদের নিয়ে পড়া যাবে-খন।
প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। বেশি প্রশ্ন নয়। কেননা আমি জানতাম এদের কাছ থেকে বিশেষ সাহায্য আমি পাব না। আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা–এই দুইয়ের তাড়নায় ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে ওরা কেউই চায় না অপরকে ফাঁসিয়ে দিতে। তাছাড়া পাশের চালাঘরের লোক কতটা খবর রাখে, তা তো কেউই জানে না। ওরা নাকি কাউকেই দেখেনি এবং অস্বাভাবিক কিছু শোনেও নি। কিছু দেখলে বা শুনতে পেলে তখুনি পুলিশকে না জানিয়ে কি তারা বসে থাকে হাত-পা গুটিয়ে?
মনে মনেই বলি, তাই বটে আইনকে অক্ষরে অক্ষরে তোমরা মেনে চলো কিনা। পুলিশকে সাহায্য করতেও কসুর করো না। কিন্তু তবুও যদিও বা কোনওদিন পাকড়াও করতে পারি খুনিকে–জানি তোমাদের এককণা সাহায্যও থাকবে না তার মধ্যে।
ভিড়ের মধ্যে সামনে এগিয়ে গিয়ে এমনই একটা প্রশ্ন করলাম যার উত্তরে সত্য না বললেই নয়।
জিজ্ঞেস করলাম–নিহত স্ত্রীলোকটি কে? একজন উত্তর দিলে–এলসা।
পুরো নাম কী?
পুরো নাম কোনওদিনই আমাদের বলেনি ও।
পেট চলত কী করে? ভিক্ষে করে।
আর কোনওপথে টাকা রোজগার করতো কি?
আমরা অন্তত জানি না।
বিয়ে করেছে?
যদিও বা করে থাকে, কোনওদিন দেখিনি ওর স্বামীকে।
ওর সঙ্গে আর কেউ থাকত এখানে?
দেখিনি কোনওদিন।
তোমাদের মধ্যে কেউ কিছু জানে কি?
সিনর মার্টিনেলি, আপনি তো জানেনই এর চেয়ে বেশি আর কিছু জানলে কতখানি খুশি হতাম আমরা।
সেই একঘেয়ে পুরোনো গল্প। পেছন ফিরে আবার গেলাম চালাঘরটার ভেতরে। ওদের কাছ থেকে আর কোনও খবর জানার সম্ভাবনা নেই। সম্ভবত, বেশি কিছু জানেও না ওরা। খুনখারাপি করাটা চালাঘরবাসীদের আওতার মধ্যে পড়লেও জিনিসটা ওরা ফ্যামিলির চৌহদ্দির বাইরে সরিয়ে রাখাই পছন্দ করে।
পুলিশের ডাক্তার জানত নিছক পয়েন্ট নিয়ে লেখা খুব সংক্ষিপ্ত রিপোর্টই পছন্দ করি আমি। ফিরে এসে দেখি লাশ পরীক্ষাপর্ব সাঙ্গ করে ফেললে সে। আমাকে দেখেই বলল–মাথায় চোট লাগছিল। খুলি চুরমার হয়ে গেছে। মারা গেছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স মেয়েটার। পুষ্টিকর খাবার না খেতে পাওয়ায় চেহারা হয়েছে অস্থিসার। ঘণ্টা দশেক হল মারা গেছে।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে–এই যে গত রাতে দশটা নাগাদ খুন হয়েছে এলসা। ঠিক এই সময়টায় স্ত্রীকে নিয়ে আমি বাড়ির কাছাকাছি একটা সিনেমা হাউসে মিকিমাউজ-এর ছবি দেখতে দেখতে মনের আনন্দে হাসছিলাম। আবার ঠিক সেই সময়টাতেই কোপাকাবানায় শুরু হয়েছিল প্রথম ফ্লোর-শো এবং ঝলমলে আলোয় আনন্দে ফুর্তিতে উচ্ছল হয়ে উঠেছিল রিও-র একটা অংশ।
ডাক্তারকে শুধোলাম–এই কী সব? আর কিছু নেই?
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে যায় ডাক্তার দরজার কাছে। বলে–আর একটা খবর। আকণ্ঠ মদ গিলেছিল মেয়েটা।
মদ গিলেছিল! চিন্তার আনাগোনা শুরু হয় মস্তিষ্কের কোষগুলোয়। ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট। পয়সার লোভে নিশ্চয় একাজ কেউ করেনি। কেননা, পকেট হাতড়ে কয়েকটা ক্রুজিরোজও পাওয়া গেল না। তাছাড়া, নিজের পয়সায় সাধারণত কেউ মদ্য পান করে না। আর একবার চোখ বুলিয়ে দেখা যাক কী পাওয়া যায় আশেপাশে।
আর একবার তল্লাসি চালিয়ে নতুন তথ্য বলতে বিশেষ কিছুই পাওয়া গেল না শুধু একটা খালি বোতল ছাড়া। মেঝের ওপর গড়াগড়ি যাচ্ছিল বোতলটা। তর্জনীটা বোতলের মুখে আঁকশির মতো আটকে দিয়ে তুলে ধরলাম নাকের কাছে। তখনও কাশাকার বিশ্রি অস্বস্তিকর গন্ধ পাচ্ছিলাম বোতলের মধ্যে। কাশাকা এক রকমের সস্তা মদ। আখ থেকে এখানকার লোকেরা চোলাই করে নেয় কাশাকা। বিশেষ করে এই কাশাকাটি যে সবচেয়ে সস্তা আর সবচেয়ে মারাত্মক, সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহই ছিল না। সামান্য কয়েকটা ক্রুজিরোজ-এর বিনিময়ে ধীরে ধীরে নিভিয়ে দিতে পারে তা যত কিছু যন্ত্রণা-চিন্তা-উদ্বেগ-ক্লেশ।
সন্তর্পণে বোতলটাকে কাগজ দিয়ে মুড়ে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে নিলাম চারধারে। তারপর অ্যাসিস্ট্যান্টদের ডেকে হুকুম দিলাম লাশটাকে স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিতে। পাহাড়ের পাশেই দাঁড়িয়েছিল অ্যাম্বুলেন্স।
ভিড় ঠেলে এগুচ্ছি, আস্তে আস্তে পা ফেলে নেমে আসছি ঢালু পথ বেয়ে এমন সময় শ্লেষতীক্ষ্ণ সুরে কে যেন পেছন থেকে বলে উঠল–গুড মর্নিং, সিনর মার্টিনেলি।
কণ্ঠস্বরের অধিকারী যদি জানত যে আমার দুজন সহকারী ওইদিনই আবার ফিরে আসবে শহরে–হোল্ড-আপ চার্জের বলে তাকে গ্রেপ্তার করতে–তাহলে এতখানি চ্যাংড়ামি করতে সে যেত না।
.
এ ধরনের খুনের তদন্তের একটা বিরাট অংশই হচ্ছে নিরানন্দ কর্মসূচীর একঘেয়েমি। পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ফিরে আসার পরেই শুরু হল এই চক্রবৎ কর্মসূচীর পুনরাবর্তন।
লাশটা আনার পর আঙুলের ছাপ নিয়ে সনাক্ত করা হয়েছিল। এলসা কোয়েলহার বয়স সাতচল্লিশ। রেসিফি শহরের উত্তরাঞ্চল তার আদি নিবাস। বহু বছর ধরে ভিক্ষুক-বৃত্তি আর যাযাবর বৃত্তির অভিযোগের রেকর্ড পাওয়া গেল এলসার। তার সর্বশেষ জেলখাটার মেয়াদ ছিল দশ দিনের এবং সে মেয়াদ শেষ হয়েছে তার মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে।
কাশাকা বোতলের ল্যাবরেটরি রিপোর্ট তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আঙুলের ছাপ মৃত মেয়েটারই। নীল কাঁচের সরু হয়ে ওঠা ঘাড়ের কাছে একটা ধ্যাবড়া তালুর ছাপ পাওয়া গিয়েছিল। ব্যস আর কিছু না।
বেশ কিছুদিন একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম তালুর ছাপটার দিকে। হৃদয় রেখা আর আয়ু রেখাদুটো নিবিড় হয়ে নেমে এসেছিল বোতলের তলার দিকে। একটু আবেগের সঞ্চার হয় আমার মনে। ভাবি, হাতের এই রেখা দেখে কোনওও হস্তরেখাবিদ কী বলতে পারত আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে ছিল এলসার ললাটলিপি? কিন্তু দিবাস্বপ্নর অথবা অনুধ্যান করার সময় এটা নয়।
ভাবলাম, কী করা যায় এবার? আচ্ছা, এলসার তো পেশা ছিল ভিক্ষে করা। পৃথিবীর যে-কোনও বড় শহরে আছে এই বিপুল অথচ একান্ত ঘনিষ্ঠ সমাজটার উৎপাত। আমার সুযোগ খুবই ক্ষীণ ও সমপেশার কাউকে পাকড়াও করে আলাপ করা ছাড়া আপাতত আর কোনও উপায় আমি দেখি না।
.
নগরবাসী ভিখিরিরা সাধারণত মামুলি শ্রেণির বদমাশ হয়। খুনটুন করা এদের ইতিহাসে বড় একটা দেখা যায় না। শুধু তাই নয় নিজের পেশার কেউ যে খুন হয় এটাও কেউ চায় না।
ল্যাটিন ভিখিরি জানে খুনিরা অনায়াসেই খুন করতে পারে তাকে। কেননা, দু-একটা ভিখিরিকে নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় সাধারণত সমাজের নেই। কাজেকাজেই এলসার সহকর্মীরা যখন দেখলে যে ওর হত্যাকারীকে খুঁজে বার করার সমস্যা নিয়ে বেজায় দুশ্চিন্তায় পড়েছি আমি এবং এমনভাবে সেই খুনিটার সন্ধান করছি যেন একটা নামকরা লোককে খুন করে বসেছে সে, তখন ওরা আমায় সাহায্য করতে শুরু করল। ওদের কথার মধ্যে থেকেই এল অভীপ্সিত সাহায্য। এলসা সম্বন্ধে যা কিছু জানত সব বলল ওরা। এক সময়ে একটা রাঞ্চের পরিচারিকা ছিল সে। তখন তার যৌবন ছিল, রূপ ছিল, তারপর তাকে ব্যাভিচারের পথে নামিয়ে আনে রাঞ্চের মালিকের ছেলে এবং বাসনা পরিতৃপ্তির পর তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যায় ভাঙাচোরা লোহার টুকরোর একটা স্কুপের ওপর।
বন্ধুবান্ধব? প্রত্যেকেই ভালোবাসত ওকে। বিশেষ কোনও বন্ধু? আর্নেস্টো নামে একটা ভিখিরির সঙ্গে কিছুদিন ছিল এলসা। কিন্তু পরে ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়ে যায়।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। ভিখিরিদের মধ্যে ভালোবাসা, থ্যাবড়া চালাঘরের ভেতরে মদের বেঁকে কোদল, মাথার ওপর আচম্বিতে চোট.., এইভাবেই হয়তো ঘটেছে ব্যাপারটা।
কিন্তু আর্নেস্টো কোথায়? ভিখিরিরা তা জানে না। গত দিনদুয়েক ওকে দেখা যায়নি। কিন্তু সে নাকি রিও-র ব্রডওয়ে সিনেলাডিয়া ডিস্ট্রিক্ট-এর থিয়েটারের ভিড়ে কাজ করতো।
একজন ভিখিরি আমার সঙ্গে ফিরে এল পুলিশ হেডকোয়োর্টারে। জুয়াচোর বদমাশদের গ্যালারিতে আর্নেস্টোর ফোটোগ্রাফ দেখেই চিনতে পারল সে। সঙ্গে সঙ্গে হুলিয়া বেরিয়ে গেল তাকে গ্রেপ্তার করে আনার। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার তাকে। আর, তারপরেই শুরু হল আমাদের ডিপার্টমেন্টের সেই কাজটি, যে কাজ সব গোয়েন্দাদের জীবনের একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে এবং তা হচ্ছে প্রতীক্ষা–নিছক প্রতীক্ষা।
.
তিনদিন পরে নিয়ে আসা হল আর্নেস্টোকে।
ওর খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের কোনাগুলো লাল, আর নোংরা চেহারার সঙ্গে পুলিশের ফটোগ্রাফের সাদৃশ্য বার করাই মহামুশকিলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। জেলখানার মধ্যে দাড়ি-গোঁফ কামানোর পর এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার পর তোলা হয়েছিল ফোটোগ্রাফটি। সনাক্তকরণে একটু প্রাথমিক অসুবিধা দেখা গেলেও লোকটা আর্নেস্টোই বটে।
মানুষটি ছোটখাটো কৃশকায়। নার্ভাস চোখে মিটমিট করেও বার বার তাকাতে লাগল আমার পালিশকরা টেবিল আর অফিসের পুরোনো দেওয়ালের দিকে।
মেয়েটাকে চেনো? টেবিলের ওপর থেকে এলসার ছবি ঠেলে দিয়ে শুধোলাম আমি।
এক পলক ছবিটার দিকে তাকালে আর্নেস্টো।
তারপর জবাব দিলে মদে-ভাঙা গলায়–নিশ্চয়। আমরা–আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হলদে-হলদে দাঁত বার করে নার্ভাসভাবে একটু হাসবার চেষ্টা করল ও।
এলসা যে মারা গেছে, এ খবর তুমি পেয়েছ কি? প্রশ্নটা তিরের মতো ছুঁড়ে দিলাম ওকে লক্ষ্য করে।
বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে ওঠে আর্নেস্টোর চোখ।
মরবার আগে তোমার সঙ্গে তার একচোট হাতাহাতি হয়েছিল–খুন হওয়ার একটু আগেই, তাই নয় কি?
চুপ করে রইল আর্নেস্টো। অথবা মৃত্যুসংবাদ পেয়ে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলল
সে।
কী জন্যে এ কাজ করলে আর্নেস্টো?
আমি? দিব্যি কেটে বলছি, আমি ওকে খুন করিনি… কাশির ধমকে মাঝপথেই আটকে গেল বাকি কথাটা এবং তখনই দেখা গেল সে যক্ষ্মারোগগ্রস্ত।
সামলে না নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি। তারপর আবার শুরু করলাম–ঠিক আছে, ঠিক আছে, এবার আমি শুনতে চাই সব কিছু, গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত। এলসাকে তুমি কতদিন থেকে চিনতে? ঝগড়াই বা করলে কেন? সমস্ত বলো। বুঝেছ?
সাগ্রহে মাথা নেড়ে সায় দিলে আর্নেস্টো। কাহিনিটা চটপট বলে ফেলার খুব ইচ্ছে দেখা গেল ওর মধ্যে। চার কি পাঁচ বছর হল এলসার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তার। গত দু-বছর ওরা একসঙ্গে বাস করে এসেছে। কিন্তু ইদানীং ওর বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছিল আর্নেস্টোর মনে। হপ্তা তিনেক আগে পুলিশের জালে ধরা পড়ে আর্নেস্টো। তারপর জেলের মধ্যেই কাটাতে হয়েছে কয়েকটা দিন।
জেল থেকে বেরিয়েই এলসার খোঁজ করতে লাগল ও। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না ওকে। ও ভেবেছিল, নিশ্চয় অন্য কোনও ভিখিরির সঙ্গে সটকান দিয়েছে এলসা। তারপর কিন্তু এলসাকে আবার দেখতে পায় আর্নেস্টো। কিন্তু ওর অভিযোগ অস্বীকার করে এলসা। দারুণ ঝগড়া হয় দুজনের মধ্যে। তার বেশি কিছু নয়। এলসাকে খুন করেনি আর্নেস্টো।
শুধোলাম–সোমবার রাতে কোথায় ছিলে তুমি? ওই রাতেই খুন হয়েছে এলসা।
ঠোঁট চেটে নিলে আর্নেস্টো। বলল–বন্দর অঞ্চলে ছিলাম। সারারাত সেইখানেই ঘুমিয়েছি আমি।
কেউ দেখেছিল তোমাকে? প্রমাণ করতে পারো তোমার কথা?
না, পারব বলে মনে হয় না আমার।
সে রাতে তাহলে এলসার ধারে কাছে যাওনি তুমি?
দিব্যি গেলে বলছি যাইনি।
ঠিক তো?
বেঠিক কিছু বলিনি সিনর মার্টিনেলি। ওই রাতে ওকে আমি দেখিইনি। একাজও আমি করিনি।
আর্নেস্টোকে সেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দেওয়া ছাড়া করণীয় আর কিছুই ছিল না। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল, এই সেই লোক যাকে আমি খুঁজছি। ভিখিরিরা সবসময়ে জটলা পাকিয়ে বাস করে। সে রাতে যদি বন্দর অঞ্চলেই থাকত আর্নেস্টো, তাহলে সমশ্রেণির কেউ না কেউ ওকে ঠিকই দেখতে পেত। এবং সেক্ষেত্রে নিজে থেকেই ওর অ্যালিবি আমাকে জানিয়ে দিত আর্নেস্টো।
আর্নেস্টোই হত্যাকারী। কিন্তু কী করে তা প্রমাণ করা যায়? সন্দেহের অভিযোগ কাউকে যে ফাঁসিতে ঝোলানো যায় না, এ তথ্য আর্নেস্টো জানে। আদালতে হাজির করলে এই মস্ত সুবিধেটাই পেয়ে যাবে সে।
এর পর কিছুদিন ধরে অনেকভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিলাম আর্নেস্টোকে। যতই ওকে চাপ দিতে থাকি, ততই মনে হতে লাগল ও যেন বুঝতে পারছে যে অকাট্য কোনও প্রমাণ হাতে না নিয়ে স্রেফ সন্দেহের বশে জেরা করে চলেছি ওকে। এক এক দফা সওয়ালজবাব হয়ে যাবার পরে ক্রমে ক্রমে অত্যন্ত অসভ্য হয়ে উঠতে লাগল আর্নেস্টো এবং দফায় দফায় আমিও ভেঙে পড়তে লাগলাম, রেণু রেণু হয়ে যেতে থাকে আমার মনোবল।
খুনের প্রায় দিন-দশেক পরে এক রাত্রে আর একবার শুরু করলাম আমার নিষ্ফল প্রচেষ্টা। শেষকালে যখন বুঝলাম আমার সমস্ত উদ্যমই নিরর্থক এবং কোনও মতেই পরিস্থিতির এতটুকু উন্নতিসাধন সম্ভব নয়, তখন কোটটাকে খামচে তুলে নিয়ে সিধে রওনা হলাম বাড়িমুখো। রীতিমতো নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছিলাম আমি। শরীর-মন ভরে উঠেছিল অপরিসীম অবসাদে।
আমার ছোট্ট ফ্ল্যাটের দরজায় চৌকাঠ পেরোনোর আগেই লক্ষ্য করলাম পালটে গেছে সমস্ত আবহাওয়া রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছিল ভালো ভালো খাবার রাঁধার সুগন্ধ। দরজা খুলতেই ময়দা মাখা দু-হাত বাড়িয়ে সাদরে অভ্যর্থনা জানালে আমার স্ত্রী। হাতের তালুতে চারু অধরোষ্ঠের চুম্বন তুলে নিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে খুশি-উচ্ছল স্বরে বলে উঠল–দু-এক মিনিটের মধ্যেই সব তৈরি হয়ে যাবে।
আমার খুব খিদে পায়নি। আর্নেস্টোর ইস্পাত-কঠিন আত্মপ্রত্যয়ের কথা ভাবতে ভাবতে জবাব দিলাম আমি।
হেসে উঠল আমরা স্ত্রী, বলল–টেবিলে খাবার এসে পৌঁছোনোর আগে পর্যন্ত চিরকালই ওই কথাই বলেছ তুমি।
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লাম। দেখলাম, এক বোতল মদ তুলে নিয়ে একটা কেকের মিশ্রণের ওপর খানিকটা মদ ও ঢালছে। ঢালা শেষ হলে বোতলটা নামিয়ে রাখল ও। দেখলাম ওর ময়দা-মাখা তালুর পরিষ্কার ছাপ উঠে এসেছে বোতলটার ঘাড়ের কাছে।…হৃদয়রেখা আর আয়ুরেখা দুটি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে এসেছে ওপরে বোতলের মুখের দিকে।
আর একবার তাকালাম ছাপটার দিকে এবং তার পরেই বিদ্যুৎচমকের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু।
কোটটাকে ঝপ করে তুলে নিয়ে এমনভাবে বিকট চিৎকার করে উঠেছিলাম যা শুনলে মনে হত যেন একটা উন্মাদ তারস্বরে সম্বোধন করছে তার বউকে।
এখুনি ফিরে আসছি, বলেই বোঁ করে উধাও হয়ে গেলাম রান্নাঘর থেকে।
পিছু পিছু এল না আমার স্ত্রী। এমনকী ডিনার ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার অনুযোগ নিয়ে উন্মাও প্রকাশ করল না। বহুদিন ধরে ঘর করতে হয়েছে তাকে গোয়েন্দার সঙ্গে–তাই এসব তার গা-সওয়া।
আমি তিরবেগে ফিরে চললাম অফিসে। সেটার প্রমাণ রয়েছে সেইখানেই।
ঠোঁটের কোনে উপহাসের হাসি ঝুলিয়ে এল আর্নেস্টো। কিন্তু আমার চোখের দৃষ্টি দেখেই এ হাসি মিলোতে বিশেষ দেরি লাগল না।
শান্তস্বরে বললাম–খুনের চার্জ আনছি আমি তোমার বিরুদ্ধে।
বলে, টেবিলের ড্রয়ার থেকে বার করলাম কাশাকার বোতলটা–যে বোতলটা দিয়ে পরপারে পাঠানো হয়েছে এলসাকে।
বোতলটা দেখামাত্র আর্নেস্টো বুঝলে তার বরাত মন্দ। আমতা-আমতা করতে থাকে ও।, না, আমি ইচ্ছা করে করিনি ও কাজ। ভুল হয়ে গিয়েছিল।
আর একটা শব্দও সহ্য করার মতো মনের অবস্থা আমার ছিল না। এক ধমকে ওকে চুপ করিয়ে দিয়ে বললাম–হ্যাঁ, ভুলই বটে, তোমারই ভুল। বোতলটাকে ওখানে ফেলে যাওয়াটাই হয়েছে। মহাভুল। বোতলের ওপর তালুর ছাপটা দেখে প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ও ছাপ এলসার।
জিনিসটা আরও লক্ষ্য করা উচিত ছিল আমার। তালুর লম্বা লম্বা রেখাগুলো নীচের দিকে নামতে নামতে কাছাকাছি চলে এসেছে। তার মানে এই যে, বোতলটা যার হাতে ছিল, সে মদ ঢালবার জন্যে বোতল ধরেনি, ধরেছিল উল্টোভাবে হাতিয়ার হিসেবে, ঠিক এইভাবে।
মুগুর ভঁজার মতো বোতলটাকে এক পা ঘোরাতেই সে রাতের স্মৃতি হু-হুঁ করে ভাসিয়ে দিল আর্নেস্টোর মনের দুকূল। শুরু হল দয়াভিক্ষার পালা। এলসার সঙ্গে মদ্যপান করার সময়ে নাকি কথা কাটাকাটি শুরু হয় ওর সঙ্গে আর্নেস্টোর। ঝগড়ার বিষয় সেই একই–এলসার ওপর সন্দেহ। তখনই, বোতল দিয়ে ওর মাথায় দড়াম করে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাই আমি–স্বীকার করলে আর্নেস্টো।
আর্নেস্টার তালুর ছাপের সঙ্গে বোতলের ছাপ মিলিয়ে দেখলাম। না দেখলেও চলত। কিন্তু নিয়মের খাতিরে এটুকু করতে হল। দেখলাম, অবিকল মিলে গেল দুটি ছাপ।
কেসের পরিসমাপ্তি শুনে কিন্তু অবাক হয়ে গিয়েছিল আর্নেস্টো। বিচারপতির মুখে যাবজ্জীবন কারাবাসের দন্ডাজ্ঞা শুনেও কিন্তু যতখানি বিচলিত হওয়া উচিত ছিল, তার অর্ধেকও হয়নি আর্নেস্টো। কারণ কী জানেন? ওকে আমি বলেছিলাম, এলসা কোনওদিনই বিশ্বাসঘাতকতা করেনি তার সঙ্গে। আর্নেস্টো জেল খেটে বেরিয়ে আসার পর এলসাকে খুঁজতে গিয়ে তাকে পায়নি। কেননা, এলসাও তো তখন ভিক্ষুকবৃত্তির অপরাধে শ্রীঘরে চালান হয়েছে । আর্নেসেটা ভেবেছিল এলসা বুঝি কোনও প্রেমিকের সঙ্গে ফুর্তি লুটতে গেছে–আসলে সে তখন ছিল পুলিশেরই হেফাজতে।
চার বছর পরে আজ আমার শুধু বয়সই বাড়েনি, রিও-ডি-জেনেরিও-র সি আই ডি-র চিফ হিসেবে নতুন খেতাবও পেয়েছি। কিন্তু আজও আমি মনে করতে পারি সেই রাতটির কথা যখন বাড়ি ফিরে আসার পর দেখেছিলাম ডিনার সাজিয়ে বসে রয়েছে আমার স্ত্রী। খাবার যে এত সুস্বাদু হতে পারে, তা আগে জানতাম না। স্ত্রীর পাকা হাতের কেক তৈরির সূত্ৰ-কাহিনি যখন বললাম, তখন তো হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল ও। হাসিমুখে গিন্নি সেদিন বলেছিল–অফিসে যে সময়টা কাটাও, তার চাইতে বেশি সময় যদি আমার রান্নাঘরে খরচ করো, তাহলে হয়তো দেখা যাবে আরও অনেক কেস সমাধান করতে পারছ তুমি।
* আলফোনসো মার্তিনেল্লি (ব্রাজিল) রচিত কাহিনি অবলম্বনে।