এক নম্বর
আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে শুভ্রই এখন সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। নানা দিক দিয়ে। আমরা ডাক্তারি পড়তাম ওর সঙ্গে মেডিকেল কলেজে। আমি জেনারেল ফিজিশিয়ান হই। ভবানীপুরে বাবার চেম্বারেই বসা শুরু করি হাউসসার্জন-এর পিরিয়ড শেষ করার পরে। বাবার সময়ে ভবানীপুর ছিল বড়োলোকদের পাড়া। তখনও ঢাকুরিয়া লেক, যোধপুর পার্কই হয়নি, সল্টলেকের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তাই প্র্যাকটিস ভালোই ছিল। ভালো মানে, অর্থাগম ভালো ছিল। রোগী এখনও কম নেই এবং বেশ শাঁসালো কিছু গুজরাটি ও সর্দারজি পেশেন্টও আছে আমার। এ পাড়াতে বাঙালিরাই এখন সবচেয়ে গরিব।
তবে যেহেতু রোগীকে মিছিমিছি দশরকম পরীক্ষা করতে পাঠিয়ে আর নার্সিং হোমে ভরতি করে প্রতিদিন কমিশন নেবার সহজ রোজগারে বিশ্বাস করার মানসিকতাতে, যাকে বলে ‘সামল’ হওয়া, তা হতে পারিনি তাই আমার রোজগার কম। গাড়িও নেই। পৈতৃক বাড়িতেই থাকি। তাই চলে যায় ছানাপোনা নিয়ে।
শুভ্র মেডিকেল কলেজ থেকে বেরিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যাণ্ডে এবং ইওরোপেও গেছিল। আমাদের সময়ে আমেরিকাই পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করত না।
খুব বড়ো ইউরোলজিস্ট হয়ে ফিরেছিল শুভ্র। তারপর ওকে আর পেছনে চেয়ে দেখতে হয়নি। সল্টলেক-এ এখন বিরাট নিজস্ব নার্সিং হোমও করেছে। ওর চেম্বারে রোগীদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়, এতই চাহিদা ওর। নার্সিংহোমেও আই সি সি ইউ ছাড়া অন্য জায়গায় তিনমাস আগে বুক করলেই ভালো। সবরকম ফেসিলিটি আছে। কার্ডিয়াক, সেরিব্রাল, অ্যাবডমিনাল, ইওরোলজিকাল, নিউরোজিকাল কোনো সমস্যার জন্যেই রোগীদের অন্যত্র যেতে হয় না। রোগীরাও ডা. শুভ্র রায়ের জন্যে ‘কেবা আগে প্রাণ করিবেক দান’ এই মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সারিবদ্ধ হয়ে।
কিন্তু শুভ্র যে তার লাইনে এত বড়ো হয়েছে এই বয়সে এতই বড়ো একটা জিনিস গড়ে তুলেছে এটাও কোনো খবর নয়। কারণ ডাক্তারির অন্যান্য লাইনে শুভ্রর মতন সফল আরও অনেকে হয়তো থাকতে পারেন, আছেনও। কিন্তু বাল্যবন্ধু (আমরা ভবানীপুরে সাউথ সুবার্বানে পড়তাম) হওয়া ছাড়াও শুভ্রর জন্যে, শুভ্রর অসাধারণত্বে আমি অত্যন্ত গর্বিত ছিলাম। তারচেয়েও বড়ো কথা এই যে শুভ্র তার নিজের পেশাতে এইরকম ব্যস্ত থাকার পরও নিজের সাহিত্যপ্রীতি নষ্ট করেনি। সংগীতপ্রীতিও নয়। শুধু প্রীতিও নয়, সে রীতিমতো চর্চা করে। ড. নীহাররঞ্জন গুপ্তর মতন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যয়ের মতন সেও সাহিত্যজগতে তার নিজের পরিচয়েই পরিচিত। গানের জগতেও। অনেক পাঠক এবং শ্রোতা জানেনও না যে, সে লেখা ছাড়া অন্য কিছু করে। বা গান ছাড়া অন্য কিছু।
আমাদের মতন মানুষেরা যখন এক ছেলে এক মেয়ে নিয়েই ল্যাজেগোবরে হয়ে থাকি, সংসার চালাতেই জিভ বের হয়ে যায় অতিসাধারণ ‘পাড়ার ডাক্তার’ হিসেবে, শুভ্র কী প্রক্রিয়াতে ওর পেশার কাজে ষোলো ঘণ্টা ব্যয় করেও শুধু প্রথম সারিরই নয়, এক নম্বর লেখক হতে পারে এই কথা ভেবেই অবাক হয়ে যাই।
গান যারা বোঝেন এমন অনেক মানুষদের সঙ্গেও কথা বলে দেখেছি তারা ওর গান সম্বন্ধেও এক বিশেষ শ্রদ্ধা পোষণ করেন।
আজকাল তো কাক-চিলও গায়ক। গড়ে দিনে কলকাতা থেকেই হয়তো কুড়ি-পঁচিশটি ক্যাসেট বের হচ্ছে নতুন গায়ক-গায়িকাদের লাল-নীল পাঞ্জাবি অথবা বালুচরি শাড়ি-পরা ছবি নিয়ে ক্যাসেটের মলাটে।
পরশু দিন গজেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল রাসবিহারীর মোড়ে। সে মাহিন্দ্রতে কাজ করত। ডাক্তার নয়। স্কুল থেকে বেরিয়ে বি. এস. সি পাশ করেছিল। তারপর Social Climbing-এর জন্যে এক নামি Artist পরিবারের এক মেয়েকে বিয়ে করে জাতে উঠেছিল। কিন্তু যে বজ্জাত, সে সজাতে বেশিদিন থাকতে পারে না। কাকের গায়ের ময়ূরপুচ্ছ বেশি দিন থাকে না। Araldite দিয়ে জুড়লেও। তাই খুলে পড়ে গেছিল তার ক-দিন পরেই। মুদির দোকান দিয়েছে নিজেদের বাড়ির গ্যারেজে। চুরি করে চাকরি যায় বিয়ের পর পরই। বাজারে রটিয়ে দেয় চাকরিতে পয়সা নেই তাই সে তার উচ্চাসন ছেড়ে ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’তে বিশ্বাস করে বাণিজ্য করছে।
রমেন বলেছিল, ওই দোকানটা নাকি নিউ মার্কেটের অনেক সিন্ধ্রি দোকানদারদের মতন। আসল ব্যবসা চোরা-চালানের। An Apology for a shop. স্মাগলড-গুডস কেনা-বেচা করে। হাশিস-ফাশিসও করতে পারে নাকি।
প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার কারণ হল, গজেন বলল, ছাড়-তো। সব শালাকে জানা আছে! অনেস্ট ডাক্তার আবার আছে নাকি? আর ও আবার লেখক? শালা, একজন বাংলাতে এম. এ সাঁটুলি রেখেছে ওর জন্যে। আর ওর পয়সার তো মা-বাবা নেই। এয়ার কণ্ডিশাণ্ড সিএলো চড়ে শালা হারাম-এর পয়সাতে। আর আজকালকার সব সম্পাদকদের তো জানিসই! কারওকে পাঁচশো টাকার নোটের প্যাকেট, কারওকে স্কচ-হুইস্কির ক্রেট, কারওকে ছুকরি, সুন্দরী ডবকা কোনো মেয়ে (নিজেরই তো নার্সিং হোম, বুঝলি না। কত অভাবী মেয়ে কাজ করে।) দিয়ে লেখা ছাপায়।
শালার শুভ্র রায়ও সাহিত্যিক হয়ে গেল! যে, সেদিনও পিও বানান লিখতে ‘‘পিত্ত’’ লিখেছিল। ও-এর ওপরে মাত্রা দিলে যে তা ‘ও’ হয় না তাও জানত না। মাল চেনো না বিশ্বেশ্বর, তুমি আমাকে শুভ্র রায় সম্বন্ধে কিছু বলতে এসো না।
আমি বলেছিলাম, আর নিজের গলার গান? সেটাও কি অন্যে গেয়ে দেয়?
তাও হতে পারে। যার পয়সা আছে তার পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব।
আমি খুবই আহত হয়েছিলাম গজেনের কথা শুনে। শুভ্র শুধু আমার একারই নয়, আমাদের সব সহপাঠীরই গর্ব। কোথায় গর্বিত হবে গজেন, তা নয়, সে ঈর্ষা আর বিদ্বেষ থেকে কত কী বলল। বড়োলোকের ওপরে সকলেরই প্রচন্ড রাগ দেখতে পাই অথচ নিরানব্বুই ভাগ মানুষই বড়োলোক হবার, যেন-তেন প্রকারেণ বড়োলোক হবার স্বপ্ন দেখে। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার! সত্যি!
এর পরেও আরেকটি ঘটনাতে আমিও কিন্তু শুভ্রর ওপরে একটু বিরক্ত হয়ে রয়েছি।
প্রসূনের কাছে, শুনলাম যে, অসীমের লিভারে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। অথচ সে কোনোদিনও চা-পানও করেনি, মদ-টদ তো দূরস্থান। অসীম নাকি বছরখানেক আগে শুভ্রর কাছে গেছিল দেখাতে। শুভ্র সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। সরোজ গুপ্তর কাছেও পাঠিয়েছিল, যাতে পয়সাও না লাগে।
অসীম একটি মারোয়ারি ফার্মে সামান্য কেরানির কাজ করে।
কিন্তু প্রসূনের কাছে শুনলাম যে, তারপর শুভ্র একদিনও ফোন করে পর্যন্ত খোঁজ নেয়নি অসীমের। অসীমও অভিমানে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ছেলেকে পাঠাতে পারত, তাও পাঠায়নি শুভ্রর কাছে। মৃত্যুর জন্যে নীরবে অপেক্ষা করছে অপার যন্ত্রণাতে।
প্রসূন বলল, সাকসেফুল হলেই যে মানুষকে অমানুষ হয়ে যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। মনুষ্যত্ব না থাকলে আর মানুষের বাকি কী থাকল?
প্রসূন আমাদের বন্ধুদের মধ্যে খুব সোবার। কখনো বিনাকারণে কারও নিন্দা করে না। প্রসূনের মুখেও শুভ্রর নিন্দা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম শুভ্র কি সত্যিই অমানুষ হয়ে গেল!
আজই সকালে জগুবাবুর বাজারে হিতেনের সঙ্গে দেখা হল। বহুদিন পরে। ও চিত্তরঞ্জনে থাকে। ছুটি-ছাটাতে যখন আসে, তখন দেখা হয়।
হিতেন বলল, শুভ্রটা একটা চালিয়াত হয়ে গেছে।
কেন?
ফোন করলাম। নাসিং হোম থেকে বলল, হি ইজ ইন দ্যা অপ্যারেশন থিয়েটার।
দু-ঘন্টা পরে করলাম, ওর পি. এ. বলল, হি ইজ ইন আ কনফারেন্স।
বাড়িতে করলাম রাতে। ওর স্ত্রী রুমি তো প্রায় চিনতেই পারল না। তারপর অনেক কষ্টে চেনবার পরে বলল, ও তো এখন ওর স্টাডিতে রয়েছে। লিখছে। আপনাকে কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে ওর কোনো সেক্রেটারি?
আমি বললাম না।
প্রসূন বলল।
তারপর ফোন ছেড়ে দিলাম। স্কুলের বন্ধু ছুটিতে এলাম। কোথায় একটু গ্যাঁজাব। তা না-কী গেরো! শুভ্র রায় যেন আমাকে চেনেই না এমনিই ভাব।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা আমার এক পেশেন্ট আছেন গোপেনবাবু, গোপেন সেন। কলেজ স্ট্রিটে ছোটো প্রকাশনার ব্যবসা করেন। আনন্দবাজার কাগজে মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন বই-এর। তাই আনন্দ পুরস্কারের অনুষ্ঠানে ওঁকে আনন্দবাজার গোষ্ঠী কার্ড পাঠান। অনুষ্ঠানের আগে ও পরে গান হয়। বড়ো বড়ো শিল্পীরা গান করেন। আর অনুষ্ঠানের শেষে দারুণ খাওয়া হয়! সিঙারা ও মিষ্টির যা সাইজ তা কলকাতার কোনো দোকানেই এমনিতে পাওয়া যায় না। স্বাদও তেমনি।
উনি নিজে যান না, প্রতিবারই কার্ডটা আমাকে দিয়ে দেন। এবারেও গেছিলাম। আজই ছিল সে অনুষ্ঠান গ্র্যাণ্ড হোটেলে। শুভ্রর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ও গেছে সেখানে সাহিত্যিক হিসেবে নিমন্ত্রিত হয়ে। আমার হাত জড়িয়ে ধরে কথা বলল। সীমার কথা, আমার মেয়ে মীনাক্ষীর কথা উল্লেখ করল। মনে হল ও একটুও বদলায়নি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তাহলে?
তাহলে কী? এসব শো। দশজনের সামনে দেখাল ও কত উদার। সব ভেক। চালিয়াত এক নম্বরের। বড়োলোক, তার ওপর নাম-যশ হয়েছে বলেই যে ছেলেবেলার সব বন্ধুদের ত্যাগ করতে হবে তার কী মানে আছে?
আমি বললাম, আরে ওকে কত কাজ করতে হয় সেটা তো বোঝা উচিত। আমাদের মতন উদবৃত্ত সময় কোথায় ওর? নইলে ভুলে গেলে চলবে কেন যে, ওর মতো হাসিখুশি আড্ডাবাজ মানুষ তো বন্ধুদের মধ্যে কমই ছিল। হাসি-ঠাট্টা গান এসবে ও যেখানে থাকে সেখানের আসর তো জমে যায়। সেই মানুষটাই ইচ্ছে করে আমাদের এড়িয়ে যায় একথা কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না।
প্রসূন বলল, তুই যা-ই বলিস আমি মানতে রাজি নই। বাল্যবন্ধুর ক্যানসার হয়েছে তারও কি একটা খোঁজ নিতে পারে না ফোন করে?
কার কথা বলছিস?
অসীমের কথা। আর কার কথা?
তাই?
আমি দুঃখিত হয়ে বললাম।
দুই
ক-দিন পরে হিতেন আমার চেম্বারে এলো। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমে গেছে। রুগি-টুগি নেই। এমনিতেই তো মাছিই মারি বসে বসে। আমি চেম্বারে বসে ‘‘দেশ’’ পড়ছিলাম।
হিতেন বলল, শোন, নতুন খবর নিয়ে এলাম তোর জন্যে। এখন কর শুভ্রকে ডিফেণ্ড।
তুই কি এবারে চিত্তরঞ্জন থেকে শুভ্রকে ডিভাস্টেট করবি বলেই এসেছিস? আমি বললাম, একটু বিরক্ত হয়েই।
হিতেন বলল, শোন! ওর মেজমামা, যিনি ওর হাতেখড়ি দিয়েছিলেন, বাংলা শিখিয়েছিলেন, তিনি রেনাল ফেইলিওর হয়ে দেবল সেনের লাইফলাইন-এ রয়েছেন। শুভ্র একবার দেখতেও নাকি যায়নি। যা-ই করছে তা ওর ছোটোভাই রজত। রাত-দিন সে আর তার স্ত্রী নার্সিং হোমেই আছে বলতে গেলে। বড়ো বড়ো ডাক্তার এনে দেখাচ্ছে।
তুই কী করে জানলি যে, শুভ্র ফোন করে খবর নিচ্ছে না?
সেই তো হচ্ছে কথা। তাও নিচ্ছে না। সে এখন পুজো-সংখ্যার উপন্যাস লিখছে। তার নাকি এখন যম ডাকলেও যাবার সময় নেই। গেছে। গেছে। একেবারেই গেছে। মানি অ্যাণ্ড ফেম হ্যাজ গান টু হিজ হেড। ওকে আমাদের সম্মিলিতভাবেই বয়কট করা উচিত।
আমি চুপ করেই রইলাম। কিন্তু ঠিক করলাম যে আজ আমি নিজে ওকে রাতে একটা ফোন করব। সত্যিই কি শুভ্র এরকম হয়ে গেছে? যাকে নিয়ে আমাদের এত গর্ব সে যদি আমাদের মানুষ বলেই গণ্য না করে, তাহলে সত্যিই তো আমাদেরও উচিত ওর জন্যে গর্বিত না হয়ে উলটে ওকে ডিজওন করা।
নীলকুঠির কাছের দোকান থেকে পেঁয়াজি আনলাম আর মুড়ি। চা-এর সঙ্গে পেঁয়াজি আর মুড়ি খেতে খেতে হিতেন বলল, যা-ই বল, তাই বল, বাঙালির ঐতিহ্য হচ্ছে আড্ডা, মুড়ি, পেঁয়াজি, কফি হাউস, এসব বাদ দিয়ে বড়ো হওয়ার কোনো মানে হয় না। আফটার অল, বাঙালি তো আমরা। আমাদের আড্ডার একটা হেরিটেজ আছে না? আমার শুভ্রর মতন বড়ো হওয়ার কোনো দরকার নেই।
তা ঠিক। আমি বললাম।
কিন্তু মনে মনে বললাম, আমি আর তুই কি ইচ্ছে করলেই শুভ্র হতে পারতাম!
সেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর একটি ফোন করলাম শুভ্রকে। আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে। রুমি আমাকে চিনতে যে পারল তা-ই না, অনুযোগ করল, আপনার বন্ধু না হয় ব্যস্ত থাকে, আমি তো ব্যস্ত নই। আমার খবর তো নিতে পারেন কখনো!
আমি বললাম, শুভ্র কি খুবই ব্যস্ত? স্টাডিতেই আছে?
না, না, আপনার বন্ধু আজ বৃষ্টি হয়েছে বলে খিচুড়ি খেতে চেয়েছিল। খিচুড়ি আর ইলিশমাছ ভাজা খাচ্ছে জম্পেশ করে। ধরুন আপনি। আমি কর্ডলেস ফোনটা নিয়ে যাচ্ছি।
শুভ্র সেই আগের মতনই বলল, কী রে শালা। জিতু! তুই বেঁচে আছিস এখনও? আমি তো ভেবেছি মরেই গেছিস।
আমি হেসে বললাম, তা যেতে পারতাম। আমি মরলে তো আর খবরের কাগজের খবর হব না তোর মতন। কোন দিন টুপ করে মরে যাব টেরই পাবি না।
ওসব বলিস না রে। অসীমের কথা জানিস তো? মনটা এত খারাপ লাগে কী বলব। দ্যাখ আমি এমনই হতভাগা ওকে একদিন দেখতে যেতে পর্যন্ত পারলাম না। আমার সেজমামার রেনাল ফেইলিওর হয়েছে। তাঁকেই একদিনও দেখতে যেতে পারিনি। দেবলের নার্সিং হোমে আছেন। কাল সকালে যাবই ঠিক করেছি।
কেন যাসনি কেন?
আমি অমানুষ হয়ে গেছি রে!
কেন?
কেন?
তারপর একটু চুপ করে থেকে শুভ্র বলল, জানিস জিতু, এই পৃথিবীতে সমস্ত জিনিসের গায়েই একটি করে প্রাইসট্যাগ থাকে। সব কিছু পেতে হলে সেই পাওয়ার জন্যে যে মূল্য নির্ধারিত রয়েছে তা দিতে হয়ই! শুধুমাত্র রবিবারটাতেই রুমিকে একটু সঙ্গ দিতে পারি, মেয়েটাকেও। নইলে আমার পার্সোনাল লাইফ বলেও কিছু নেই।
এইভাবে বেঁচে কী লাভ? বন্ধুহীন, আত্মীয়হীন হয়ে নিজের নাম-যশ আর অর্থর পেছনে দৌড়েই কি জীবনটা শেষ করে দিবি? তোর জীবনের প্রার্থিত কি এই ছিল? এ কথা একবারও ভাবিস না কি তুই? তোর সম্বন্ধে এবং তোর বিরুদ্ধে নানা জনে নানা কথা বলে, আমার শুনতে খারাপ লাগে বলেই তোকে একথা বলছি। তোর জন্যে তোর হয়ে একা হাতে আর কত লড়ব বল?
লড়িস না রে! যারা আমাকে বাতিল করে দিতে চায় তারা তা দিক। আমি জানি, আমার বন্ধু-বান্ধব, আমার আত্মীয়স্বজন সবাই আমাকে বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু সেই মূল্যের বিনিময়ে অর্জনও হয়েছে কিছু। বড়ো কিছু পেতে হলে তার জন্যে বড়ো দামও দিতে হয় রে জিতু। রবীন্দ্রনাথ কি সত্যজিৎ রায় যদি সাধারণের মতন জীবনযাপন করতেন, সামাজিক, বন্ধুবৎসল, আড্ডাবাজ, তাহলে কি তাঁরা যা হয়েছিলেন, তা হতে পারতেন? তুই-ই বল!
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, একদিন আসিস ফোন করে। কত যে ইচ্ছে করে আগের মতন তোর সঙ্গে আড্ডা দিই! একদিন।
আমি বললাম, খাওয়ার সময়ে তোকে বিরক্ত করলাম। ছাড়ছি এখন।
শুভ্র বলল, ছাড়িস না।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, একটা কথা কী জানিস জিতু? আমি যা-কিছুই করি না কেন জীবনের সব ক্ষেত্রেই একনম্বর হতে চাই। দু-নম্বর তিন-নম্বর নয়। এক নম্বর। হয়েওছি। তোদের মতো অগণ্য বন্ধুর শুভকামনাতে। আর কী জন্যে হয়েছি, সে কথা নাই বা বললাম। কিন্তু একনম্বর হতে চাইব আর তার জন্যে দাম দেব না কোনো, তা কি হয় রে জিতু? আমি আমারই মতো। আমাকে যদি ক্ষমা করতে পারিস তো করিস। যদি না করতে পারিস তাহলেও আমার কিছু করার নেই রে। অনেক আত্মীয় এবং বন্ধুকে হারিয়েছি যেমন এই লক্ষ্যে পৌঁছোতে, তেমন আবার লক্ষ লক্ষ অনাত্মীয় অপরিচিতকে নিজের আপনজন হিসেবে পেয়েওছি। একনম্বর হওয়ার জেদ যে করবে, তাকে অনেক কিছু হারাবার জন্যে তৈরি হয়েই সেই লক্ষ্যের দিকে এগোতে হবে।
একটু চুপ করে থেকে বলল জানিস জিতু মানুষে আমার টাকা, আমার বাড়ি আমার গাড়ি আমার মান এবং যশই দেখে। আমার এই নি:স্ব দুঃখী অবকাশহীন বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই, দিনে কুড়িঘণ্টা কাজ করা মানুষটার কষ্টর কথা কেউই বোঝে না। বুঝবে না যে, সেটাও এই লক্ষ্যে এগোনোর সময়ে মেনেই নিয়েছিলাম। আমাকে তোরা ক্ষমা করিস রে জিতু।
মনে হল, যেন কাঁদছে শুভ্র।
আমি বললাম, আমি বুঝেছি। বুঝতাম বলেই তোর হয়ে সকলের সঙ্গে লড়েছি। আমাদের কে-ই বা চেনে জানে! তুই তো আমাদের গর্ব রে শুভ্র। তুই যে ক্লাসে একবেঞ্চে আমার সঙ্গে একদিন বসতিস সাউথ সুবার্বান স্কুলে, সেকথা মাঝে মাঝে স্বপ্ন বলে মনে হয়। সত্যি বলছি রে! আমি তোকে ভুল বুঝিনি। তুই তোর একনম্বর হবার সাধনাতেই লেগে থাক। আমাদের মতো ফালতুরা কী বলল, কী ভাবল তা নিয়ে একটুও মাথা ঘামাস না। সকলেই যে বোঝে না, এমন নয়। আমি যেমন বুঝি, তেমন অন্য আরও অনেকেই হয়তো বোঝে। আমরা যে বাঙালি! আমাদের জাতের মজ্জার গভীরে যেসব দোষ, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা ঢুকে গেছে, তা তো অত সহজে যাবে না। আমরা আমাদের মতনই থাকব। তুই তোর মতন থাক।
বলতে বলতে আমার গলা বুজে এলো।
শুভ্র বলল, কিছু কি বলবি রে জিতু?
আমি বললাম, আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ। আই মীন ইট। এভরী ওয়ার্ড অফ ইট।
বলেই, রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম।
রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ভাবছিলাম যে, আমরা মানে, আমাদের মতন লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি সাধারণ মানুষ যুগে যুগে জন্মেছি, লেখাপড়া করেছি, কিছু একটা করেছি জীবিকার জন্যে, তারপর বিয়ে করেছি, ছেলে-মেয়ে হয়েছে। মাসি-পিসি, জ্যাঠা-খুড়ো, শ্বশুর-শাশুড়ি, শালা-ভায়রাভাই নিয়ে, অথবা ক্লাব নিয়ে বা তাস খেলে বা আড্ডা মেরে জন্মের পর জন্ম সাধারণ হয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। আমরাই তো মেজরিটি। আর এই শুভ্রর বা তার মতন অন্য যাঁরা আছেন তাঁরা মাইনরিটি। তাঁদের কথা, তাঁদের দুঃখ বোঝার প্রয়োজন আমাদের কোনোদিনও ছিল না।
তোদের আমরা চিরদিনই ঈর্ষা করেছি, গাল পেড়েছি, অথচ দশজনকে তোর উল্লেখ করে সগর্বে বলেছি ‘‘হি ইজ অ্যান ওল্ড ফ্রেণ্ড অফ মাইন’’। বিপদে-আপদে তোর বা তোদের সঙ্গে আত্মীয়তা যে আছে, এই পরিচয় দিয়ে অবস্থার ‘‘মুশকিল আসান’’ করেছি কিন্তু কী করলে, কীভাবে যে, তোদের মতন হওয়া যায়, কোন মূল্যে যে এই সম্মানের আসন কিনতে হয়, তার কোনো খোঁজই তো আমরা রাখিনি। উলটে প্রসূনের মতন, গজেনের মতন, রমেনের মতন, তোকে এবং তোর মতন অন্যদের অশ্রদ্ধাই করেছি চিরদিন।
ক্ষমা করে দিস তুই আমাদের, শুভ্র, ক্ষমা করে দিস।
আমার চোখদুটি ছলছল করে উঠল এইসব কথা ভাবতে ভাবতে।
এমন সময় মিনতি ঘরে ঢুকল।
বলল, কী হয়েছে তোমার? কেউ বুঝি অপমান করেছে? চোখে জল কেন তোমার?
আমি ওকে হাত তুলে, একটি ভঙ্গি করে, থামালাম।
তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, অপমান করেনি কেউ।
তবে?
আনন্দ হয়েছে খুব। হেরে যাওয়ার আনন্দ। শুভ্রর কাছে হেরে যাওয়ার আনন্দে…
মিনতি বোবার মতন আমার মুখে চেয়ে রইল। কথা বলল না কোনো।
ভাবছিলাম, আমি শুভ্রর মতন একনম্বর তো দূরস্থান, হাজার নম্বরও হতে পারিনি জীবনের পরীক্ষাতে, কিন্তু একনম্বরকে যে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পেরেছি এইটাও তো এক বিশেষ ধরনের বন্ধুকৃত্য।
আমি, গজেন বা অসীম বা প্রসূনের মতন শুভ্রকে যাচাই না করেই বাতিল করিনি। এই তো আমার মতো অতিসাধারণ, আনসাকসেসফুল, মাছি-তাড়ানো ডাক্তারের পক্ষে এক মস্ত কিছু হওয়া!