ছয়
১
শীতল বলল, এর আর নড়চড় হবে না শমি।
শমি ঠাট্টা করে করল, মানুষ যদি এত সহজে মায়া কাটাতে পারত!
আমি পারব শমি। আমি মনস্থির করে ফেলেছি।
শীতল, তুমি একট চিরকেলে বুদ্ধ!
শমি!
বুদ্ধু!
শমি ফুঃ করে শীতলের নাকে মুখে একরাশ সিগারেটের ধোঁয়া ছুঁড়ে দিল।
শীতলের মুখের উপর গরম বাতাসের ঝাপটা লাগল। শীতল চমকে উঠে মুখ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই ওর ঘুম ভেঙে গেল। এবং চোখ মেলতেই দেখল অন্ধকারে এক ছায়ামূর্তি শীতলের মুখের উপর ঝুঁকে রয়েছে। তার মুখে কার গরম নিশ্বাস পড়ল। প্রচণ্ড ভয়ে আঁতকে উঠল শীতল।
‘কে!’
‘আমি।’
‘করবী!’ শীতলের বুক প্রচণ্ডভাবে ধক ধক করছে।
‘শমি কে?’
‘করবী তুমি!’ শীতল যেন একটু একটু করে চেতনায় ফিরে আসছে। করবী এখানে কী করছে? অসুস্থ হয়ে পড়েনি তো?
‘করবী তুমি! হঠাৎ শীতল ধড়মড় করে উঠতে গেল। কিন্তু তার ডানা ধরে করবী তাকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিল। করবীর গায়ে বেশ জোর।
‘শমি কে?’ করবীর গলা মৃদু অথচ বেশ দৃঢ়।
‘শমি? কে শমি?’ শীতলের সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কোন শমির কথা জানতে চাইছে করবী? শীতল জেগে আছে তো? শীতল সুস্থ আছে তো?
‘তুমি ঘুমের ঘোরে শমি শমি করছিলে। কে সে শীতল?
ঘুমের ঘোরে? শমি? হ্যাঁ, শীতল যেন কী একটা স্বপ্ন দেখছিল বটে। কিন্তু কী, সেটা এখন মনে করতে পারল না। শমিকে কোন একটা কথা যেন বোঝাতে চাইছিল শীতল। আর শমি ফুঃ ফুঃ করে উড়িয়ে দিচ্ছিল।
‘আমি বোধহয় স্বপ্ন দেখছিলাম করবী। শমি আমাদের অফিসেরই এক মেয়ে। আমাদের এক সহকর্মী। যার সঙ্গে আমাকে এখন কাজ করতে হচ্ছে।’
‘যার বাড়িতে কাল তুমি খেয়ে এলে?’
‘হ্যাঁ, তা-ই।’
ঘরটায় অন্ধকার। বাইরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওদের এদিকে বেশ ব্যাঙ ডাকে। রাত কত হল?
‘করবী, আলো জ্বালো।’
‘আলো চলে গেছে শীতল।’
‘করবী, এত রাতে এই অন্ধকারে এ ঘরে তুমি কী করছ?
‘আমিও এক স্বপ্ন দেখছি শীতল। খুব খারাপ স্বপ্ন। ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছি এখানে।’
রুবি যখন ছোট ছিল, মাঝে মাঝে করবীর কাছ থেকে মাঝরাতে পালিয়ে আসত তার কাছে। বুকের উপর লেপটে শুয়ে থাকত। করবী তার হাত ছাড়েনি। তার মুঠি থেকে নারীর শরীরের উষ্ণতা শীতলের শরীরে বিকিরিত হচ্ছে। রুবি করবী শমি, এদের সকলের শরীরের উষ্ণতাই এক জাতের। শীতল কোনও তফাত ধরতে পারল না। একবার শীতলের মনে হল করবীর মাথাটাকে সে তার বুকে টেনে নেয়। কিন্তু সাহস পেল না।
শীতল বলল, ‘জানো তো করবী, স্বপ্নের কথা বলে ফেললে সে স্বপ্ন আর ফলে না। তুমি কী দেখেছ আমাকে বলো।’
‘আমি দেখলাম তুমি ছাদে উঠে দোতলা তুলছ। তোমার হাতে রাজমিস্ত্রির যন্ত্রপাতি।’
অন্ধকারের মধ্যে করবী একেবারে মিশে রয়েছে। করবী এখনও মুঠো করে ধরে আছে শীতলের ডানা। শরীরে। অন্ধকারের বুক চিরে ভেসে উঠছে করবীর কাঁপা-কাঁপা।
শীতল দেখতে পাচ্ছে না। একটা উষ্ণ স্রোত বইছে তার গলার চাপা স্বর। চাপা এবং
‘আমি তোমাকে ক্রমাগত বাধা দেবার চেষ্টা করছিলাম। বলছিলাম, নেমে এসো শীতল। দোতলা তুলতে তোমাকে হবে না। বাড়ি ঘর সকলের সয় না শীতল। অনিলের সয়নি।’
করবীর মুঠি শীতলের হাতে কাঁপতে শুরু করেছে। শীতলের কেমন কষ্ট হতে লাগল করবীর জন্য।
‘তারপর করবী? বলো, বলো। সব বলে ফ্যালো।
‘তুমি কিছুতেই কথা শুনলে না শীতল। আমাকে বললে—’
করবী মাঝপথে থেমে গেল।
‘তারপর?’ শীতলের শোনার আগ্রহ ক্রমশ উদ্দাম হয়ে উঠেছে। ‘আমি তোমাকে কী বললাম করবী?
‘তুমি বললে,’ অন্ধকার থেকে করবীর স্বর ভেসে এল, ‘আমি তো এ বাড়ির মালিক নই করবী। আমার কী ভয়? আমি রাজমিস্ত্রি। বায়না নিই, কাজ করি। দাও ইট দাও, করবী। আমার সময় নেই। আমি আরেকটা বায়না ধরেছি।’
করবী চুপ করল। ওর মুঠি থরথর করে কেঁপেই চলেছে।
‘আমি এই কথা বললাম? নিজের উপর শীতল যেন খুশি হয়ে উঠল।
‘হ্যাঁ শীতল, তুমি বললে।’
শীতল ক্রমশই খুশি হয়ে উঠতে লাগল।
‘তারপর করবী?’ শীতলের স্বরে কিঞ্চিৎ উত্তেজনা প্রকাশ পেল।
‘আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। তুমি বললে, ইট দাও করবী, আমি আমার কাজটা শেষ করে দিয়ে যাই। আমি বললাম, আমার দোতলা চাই না শীতল। এই সময় নীচে থেকে একটা মেয়ের গলা চেঁচিয়ে উঠল, এখানে আর কত দেরি শীতল? আমার ঘর কখন গাঁথবে? তুমি রেগে গেলে। আমি ভয় পেয়ে সব ইট লুকিয়ে ফেলতে চাইলাম। তুমি জোর করে কেড়ে নিতে লাগলে। ধাক্কাধাক্কি শুরু হল শীতল। তারপর উঃ!’
করবী থেমে গেল। শীতল উত্তেজনায় ফেটে পড়বে। সে আগ্রহে ফুটছে। শীতল বিছানার উপর তড়াক করে উঠে বসল। করবীর কাঁধ দুটো চেপে ধরে শীতল তার মুখটাকে একেবারে মুখের কাছে নিয়ে গেল।
উত্তেজিত চাপা স্বরে শীতল জিজ্ঞেস করল, ‘বলো করবী, বলো। তারপর কী হল?’
‘তারপর তুমি ছাদ থেকে পড়ে গেলে। রুবি চেঁচিয়ে উঠল, মা, ভোম্বল মরে গেছে।’
এই কথা বলেই করবী শীতলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু’হাতে পাগলের মতো শীতলকে জড়িয়ে ধরে প্রচণ্ড কান্নায় কাঁপতে থাকল।
রুবি চেঁচিয়ে উঠল, মা ভোম্বল মরে গেছে। করবীর থরথর ভারী শরীরটা শীতলের বুকের উপরে, তথাপি ভিতরটা তার একেবারে হাল্কা। ভোম্বল মরে গেছে ঠিক। শীতলকে আর ভোম্বলের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে না।
কিন্তু করবীকে নিয়ে সে এখন কী করবে? তার তো নতুন বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে। শীতলের সে ডাকও এসে গেছে। এবং, আশ্চর্যের কথা, করবীর কানেও পৌঁছে গেছে। কিন্তু এখন আর আগের মতো অতটা উৎসাহ পাচ্ছে না শীতল। এখন যখন করবী তার বুকে। এবং করবীর ভারী দেহটার চাপ যখন শীতলের চেতনায় ঘা দিচ্ছে। করবীর ভয়ে ভাবনায় আন্দোলিত দুটো বিশাল স্তন, কিঞ্চিৎ শিথিল, সিংহের থাবার মতো শীতলের বুকের পাঁজরায় গিয়ে ঘা মারছে। এবং করবীর চুলের ঘামের পাউডারের এবং দেহস্থিত অন্যান্য গন্ধ মিলে মিশে এক হয়ে শীতলের নাসারন্ধ্রকে পীড়িত করছে। তখন শীতল অনুভব করল, তার পক্ষে আগের মতো উল্লসিত হয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। করবী স্পষ্টতই তার কাছে আশ্রয় চাইছে। এখন?
বুন্ধু!
হঠাৎ বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো শীতলের নিজের স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি শমি।
যথাসম্ভব দৃঢ়ভাবেই কথাটা উচ্চারণ করার চেষ্টা করল শীতল।
বুদ্ধু!
এর নড়চড় হবে না।
বুদ্ধু!
আমাকে এখান থেকে বেরুতে হবেই, শমি
করবীর ভারী দেহটা বুকে ধরে শীতল যেন আর্তনাদ করে উঠল।
শমি ফুঁ করে শীতলের মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মিলিয়ে গেল।
অসহায় শীতল পড়ে যাচ্ছে। করবীর চওড়া পিঠে হাত রেখে সে পতন রোধ করতে চাইল। কিন্তু করবীর পিঠ ভর্তি এলো চুল। কী মসৃণ! শীতলের দুটো হাতই পিছলে নেমে পড়ছে নীচের দিকে। কিছুতেই সে ঠেকাতে পারছে না।
.
বৃষ্টি বোধহয় থামবে না। আলোও বোধহয় আর আসবে না। ওরা দুজনে এখন শীতলের বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে। শীতল ওকে টেনে নিয়েছিল। করবী একটুও দ্বিধা করেনি। ব্যাঙগুলো বিরামহীন ডেকে চলেছে। পরপর দু’বার মেঘ ডেকে উঠল ক্কড় কড় করে। ঠিক যেন ওদের মাথার উপরে। একই সঙ্গে চমকে উঠল দু’জন। একই সঙ্গে ওরা সরে গেল দুজনের কাছে। ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল আবার।
শীতল করবীর চুলে আঙুল চালাল কিছুক্ষণ। তর্জনী দিয়ে ওর মসৃণ এবং গাঢ় ভুরু দুটো পালিশ করে দিল। নাকের উপর দিয়ে অতি ধীরে আঙুলটা ওষ্ঠের উপর পিছলে পড়ল। থামল। একটু ইতস্তত করল। তারপর মনস্থির করে আবার সফর শুরু করল। করবীর আধবোজা ঠোঁটের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত মন্থরগতিতে টহল মারল একবার। তারপর থামল। তারপর নেমে এল চিবুকে। থামল। শাবাশ বল্লভভাই নেড়ে দিলে গান্ধির চিবুক। কথাটা কার মুখ থেকে শুনেছিল শীতল, এখন মনে নেই। যোগীন আর সে কথাটা এক সময় যখন তখন বলত। করবীর মুখের ডৌলের সীমানা ধরে এ কান থেকে ও কান ঘুরে এসে শীতলের তর্জনী হঠাৎ যেন সরে পড়ল।
শীতল করবীর কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলল, ‘আমরা বিয়ে করব না কেন, করবী?’
‘বিয়ে? তেমনি আস্তে জবাব দিল করবী, ‘কখনও তো ভাবিনি আগে।’
‘কেন?’
‘কেন? হয়তো যখন সময় ছিল তখন কথাটা কারও মনে পড়েনি। ত
শীতল চুপ করে গেল।
যেন শীতলের মনের কথাটা টের পেল করবী। বলল, ‘আজ আর হয় না।’
‘কেন?’ সসঙ্কোচে শীতল বলল, ‘রুবি?’
‘রুবি? না শীতল। রুবি নয়। আমরা বিয়ে করলে রুবি বরং খুশি হত। রুবি তখন ছোট। ইসকুলে পড়ে। ওর এক বন্ধুর দাদুর পঞ্চাশ বছরের বিবাহ বার্ষিকীতে বুড়োবুড়িকে নতুন করে বিয়ে দিয়েছিল নাতি নাতনীরা। পুরুতে মত্তর পড়েছিল। কনে সম্প্রদান করছিল বুড়োর এক ছেলে। নান্দীমুখ সাতপাক বাসর ঘর কিছুই বাদ যায়নি। বিয়ের পদ্যগুলো হয়তো রুবির বাক্সে এখনও আছে।’
একটা মেঘ মৃদুস্বরে গড়গড় করে অনেকক্ষণ ধরে ডেকে গেল।
‘তাই দেখে এসে রুবি বলেছিল, তুমি ভোম্বলকে বিয়ে করো না মা? কথাটা শুনে রাগে আমি জ্ঞানগম্যি হারিয়ে ফেলেছিলাম। ওর গালে কষে মেরেছিলাম এক চড়।’
‘কেন?’
‘কেন? সে কথা আজ আলোচনা করে কী লাভ? আজ আর হয় না।’
‘হয় না কেন করবী? বাধা কোথায়? অনিল?’
‘অনিল!’
‘হ্যাঁ। অনিল। তোমার স্বামী করবী।’
করবী চুপ করে ভাবতে লাগল। শীতলের এই প্রশ্নটার মানে সে যেন ধরতে পারছে না।
‘বলো করবী? অনিলের স্মৃতিই কি তা হলে আমাদের পথে বাধা?’
‘রুবির বাবার সঙ্গে মাত্র বছর চারেক ঘর করেছিলাম। দু’বছরের ভিতরেই রুবি এসে গেল। আমার সেই ঘরকন্নার কথা বিশেষ কিছুই মনে নেই। তখন তো খুবই ছেলেমানুষ ছিলাম। তারপর সেটা ছিল একটা ব্যস্ত মানুষের সংসার। কতটুকু সময়ই বা তার দেখা পাওয়া যেত।’
‘তা হলে করবী?’
‘শীতল, তুমি আজ একটা ফটো দেখিয়েছিলে দুপুরে।’
শীতল বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘চক্কোত্তি কাকাকে চিনতে একটুও দেরি হয়নি আমার। রুবির বাবাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। এই রুবির বাবা! বাড়িতে ওর কোনও ফটো নেই। এ সব জিনিস ওর ছিল না। টাকা রোজগারের চিন্তা ছিল খালি। আর ধ্যানজ্ঞান ছিল বাড়ি। তাও সাদামাটা। আমাদের বাড়িতে যা কিছু শখ শৌখিনতা সে সব করেছ তুমি আর রুবি। তুমি কেবলই জিজ্ঞেস করছিলে রুবির বাবাকে চিনতে পারছ না? জবাব দেব কী, আমি নিজেই হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। ফটোতে যে লোকটাকে রুবির বাবা বলে চেনাতে চাইছিলে, সেই যদি রুবির বাবা হয়, তবে আমার মনে যাকে ধরে বেঁচে আছি কুড়ি বছরের উপর, তা হলে সে কে? সে তো এ নয়। এ রুবির বাবা ও চেহারার নয়, ও লোক নয়। তাই তোমার কথার জবাব দিতে পারছিলাম না।’
ওরা দুজনেই চুপ করে গেল। বৃষ্টি কি একটু থামছে? শীতল আবার পিছলে পড়তে লাগল।
‘রুবির এ বাবা তুমি শীতল।’
‘আমি!’
‘হ্যাঁ। ফটোর তুমি নও। এই তুমি। মনের সঙ্গে বারবার মিলিয়ে দেখি, সে তুমি। অথচ আমি তা বুঝতেও পারিনি।’
‘কিন্তু এ তো শীতল নয় করবী। এ নাকি শিবচরণ।’
প্রচণ্ড কৌতুকে হেসে উঠল শীতল।
‘শিবচরণ?’
‘হ্যাঁ করবী, শিবচরণ। এর বাড়ি পাথুরেঘাটা। এর পদবি ঘোষ সরকার। এর বাড়ির নাম শিবালয়। এ টম ম্যাকননের কেরানি নয়। হিউম্যান উইকনেস ফিরি করার উঁচু বেতনের দালাল নয় করবী। এ বিষয়-সম্পত্তির মালিক। এ এতদিন ফেরার ছিল। কাল ধরা পড়ে গিয়েছে। গতকাল বললাম না করবী, এটর্নির বাড়ি যেতে হবে। গিয়েছিলাম। আমাকে দেখা মাত্র বুড়ো এটর্নি, আমার উকিল কাকা, বলে উঠলেন এ যে শিবচরণ।’
করবী প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল শীতল বোধহয় খেপে গেছে। আবোল তাবোল বকছে। কিন্তু ক্রমে করবী এর একটা মানে ধরতে পারল।
‘শিবচরণ কে?’
‘আমার বাবা করবী।
শীতল একটানা এতগুলো কথা বলে একটু শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল যেন। চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল।
‘তোমার নিজের কে আছে করবী?’
‘নিজের?’
‘মানে আত্মীয় স্বজন আর কি?’
‘কই, কেউ তো কখনও খোঁজ নেয়নি। কী করে বুঝব?’
‘হয়তো খোঁজ করেছে। খোঁজ করছে। পায়নি। পাচ্ছে না। এই আমার ব্যাপারটাই দ্যাখ না। আমি কি জানতাম দীর্ঘদিন ধরে আমার খোঁজ চলেছে। আমি কি জানতাম আমার বিষয়-সম্পত্তি আছে? আমি কি জানতাম আমার এত ভাই বোন আত্মীয়-কুটুম আছে? সেই ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি এ জগতে আমি আর আমার মা। কিন্তু আজ যদি আমার সঙ্গে যেতে করবী তো দেখতে পেতে আমাকে দেখার জন্য আমার আত্মীয় স্বজনের কত বড় মেলা বসে গিয়েছিল।
‘কোথায়? কখন?
‘আমার উকিল কাকার বাড়ি। বিকেল পাঁচটা থেকে মেলা বসার কথা। আমিই প্রধান আকর্ষণ।’
‘সে কী! বলোনি তো? তুমি যে বড় গেলে না?’
‘আমার মনে হল আমি তোমার কাছে থাকি করবী। রুবি আজ চলে গেল। আবার আমিও যদি বেরিয়ে যাই, বাড়িটা বড্ড ফাঁকা লাগবে। তুমি একেবারে একা হয়ে যাবে। এটা আমার ভাল লাগল না।’
‘তাই তুমি গেলে না? আমার খারাপ লাগবে, তাই?’
‘হ্যাঁ করবী, তাই। আচ্ছা বলো তোমার খারাপ লাগত কি না?’
‘লাগত শীতল।’ করবীর ঠোঁট দুটো থরথর কাঁপছে।
‘এই যে আমি রইলাম বাড়িতে, বিশেষ করে আজকের দিনটায়, তোমার ভাল লাগেনি? বলো করবী?’
‘খুব ভাল লেগেছে। তুমি না থাকলে আমার খুব খারাপ লাগত শীতল।’ করবী নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল।
‘এই অভাবগুলো পূরণের জন্যই তো মানুষকে মানুষের দরকার লাগে করবী। টাকা দিয়ে যশ ক্ষমতা দিয়ে আর যা-ই পাওয়া যাক করবী, মানুষের মনের এই সব ফাঁক ভরানো যায় না।’
‘শীতল তুমি কী?’
‘বুদ্ধু।’
‘বুদ্ধু?’
‘লোকে আমাকে তা-ই বলে করবী। বলে শীতলটা বোকা। স্বপ্নবিলাসী। প্র্যাকটিক্যাল নয়।’
‘যারা বলে তারা তোমাকে জানে না শীতল।’
‘জানুক বা না জানুক কেউ, আমি তো জানি এসব স্বপ্নবিলাসিতা নয় করবী। এ সত্য। এই হচ্ছে মানুষের সমাজে সব চাইতে দামি জিনিস। আমি জানি বলেই এসব জিনিস রক্ষার জন্য এত প্রাণপাত করি। তাই আমাকে একবার এক স্নেহভাজন, তাকে আমি খুব স্নেহ করি করবী, বলেছিল, এসব হচ্ছে শেতলবাবুর অ্যাটিকস। আমি তার চাইতে বয়সে অনেক বড় করবী, তবু সে ছোকরা আমার মুখের উপর কথাটা অম্লানভাবে ছুঁড়ে দিয়ে এমনভাবে হাসতে লাগল যেন আমাকে খুব গৌরব দান করেছে।’
‘শেতলবাবুর অ্যানটিকস!’ কথাটা আপন মনেই আরেকবার উচ্চারণ করল শীতল।
‘অ্যানটিকস? মানে কী?
‘ভাঁড়ামি। সঙ সেজে যা করা হয় তা-ই।’ শীতল অন্ধকারে একটু শব্দ করে হেসে উঠল। ‘আমি এসব কথা গায়ে মাখিনে।’
সত্যিই তো, করবী ভেবে দেখল, রুবি ঠিক বলেছে। শীতলকে আমরা কেউ কিছু দিইনি। একেবারে খাঁটি কথা। শীতল করবীর কাছে একটা দাবি পেশ করেছে।
‘আমি জানি করবী, শীতল আপন মনে বলে চলেছে, ‘কাল তুমি নিজেকে অনেকটা সামলে নেবে।’
শীতল আমাকে চাইছে এতদিন পরে। শীতলকে বিমুখ করা ওর প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা।
‘আমি জানি করবী সে জোর তোমার মধ্যে আছে।’
কিন্তু শীতলকে ঠকানো
‘পরশু এদিনটা আরও সরে যাবে। পাঁচ বছর পরে নানা অভিজ্ঞতার তলায় আজকের এই অনুভূতি, এই বেদনা, এই শূন্যতাবোধ, পরস্পরের প্রতি আজকের এই নির্ভরতার স্মৃতি চাপা পড়ে যাবে।’
শীতলকে ঠকানো মহাপাপ। না না, করবী শীতলকে ঠকাতে পারবে না।
‘জগৎ সংসারের এই নিয়ম। আমি জানি করবী। এ হচ্ছে বাস্তব সত্য। তুমিই তো বললে করবী অনিলকে তুমি তোমার মনের মধ্যে খুঁজে পেলে না। এটাই জগতের সত্যি। কিন্তু যেদিন খবর পেয়ে অফিস থেকে আমরা ছুটে এলাম? তুমি অনিলের মড়া আগলে বসে ছিলে এই বাড়িতে। সেদিনও অনিল কত তাজা ছিল ভাবো? সেটাও জগতের সত্যি করবী। সব সত্যকে স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। আজ যে আমি বেরুইনি সে শুধু তোমার একার কথা ভেবে নয় করবী। আজ তুমি ছাড়া আর কারও সঙ্গ আমারও ভাল লাগত না।’
কিন্তু আমি যে নিঃস্ব শীতল। আমার যে আর কিছু নেই। তুমি এতক্ষণেও বুঝতে পারোনি? তোমরা সেদিন এসে অনিলের মড়াকে এই বাড়ি থেকেই বের করে নিয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু আমার মন থেকে সেটাকে বের করে নিয়ে যাবার কথা তোমার কেন মনে পড়েনি শীতল? তাই তো অনিলের মড়া আগলে বসে থেকে থেকে আমার যা কিছু দেবার তা ফুরিয়ে গেল। তুমি আজ আমাকে চাইছ। কিন্তু আজ তোমাকে আমি কী দেব?
‘কাল শমি বলেছিল, আমাকে তার গান শোনাতে ইচ্ছে হচ্ছিল।’
শমি! করবীর শরীরটা হঠাৎ একটা চাপা উত্তেজনায় টান টান হয়ে উঠল।
‘সে অবিশ্যি শোনায়নি। কিন্তু আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম।’
‘শমি বুঝি ভাল গান জানে।’
‘শুধু গান? শমি সব জানে।’
করবী চুপ করে গেল। সে গভীর ভাবনায় তলিয়ে গেল। করবী একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে চাইছে। খুব কঠিন খুবই পীড়াদায়ক সে সিদ্ধান্ত। এবং করবীর পক্ষে খুব মর্মান্তিক। করবী জানে শীতল এ বাড়ি থেকে চলে গেলে তার পক্ষে সেটা কী নিদারুণ ঘটনা হবে। করবী নিজেকে শক্ত করে নিল। এবং এতক্ষণে শীতলের গায়ে তার শান্ত হাতটাকে রাখল। রুবিকে যেন আশ্বস্ত করছে করবী। তার তবু আছে। কিন্তু শীতলের?
‘শীতল!’ শান্ত সংযত কণ্ঠে অত্যন্ত নরমভাবে ডাকল করবী।
‘বলো।’ শীতল বিস্মিত হল। যেন কত দূরে সরে গেছে করবী। কী হল?
‘তুমি বিয়ে করতে চাইছিলে না?’
করবীর কথায় শীতলের কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল। এ কোন করবী?
‘তুমি তো বললে না, তোমার বাধা কোথায়?’
‘তোমাকে দেবার মতো আমার আজ কিছু নেই শীতল।’
‘না!’
‘যা সত্যি তা-ই বলছি।’
‘কী সত্যি! তুমি কী জানো? এ তোমার অজুহাত।’
শীতল হঠাৎ রেগে উঠল।
‘করবী, তুমিও আমাকে ভাঁড় ভাবছ! তুমিও ভাবছ আমি, আমি একটা সঙ! তুমি রুবি তোমরা আমাকে ভেবেছ কী!
প্রচণ্ড রাগে থরথর করে কাঁপছে শীতল।
করবী নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল।
শীতল করবীর হাতটা সরিয়ে দিতে গিয়েই ওর হাতে জল লাগল। শীতল চুপসে গেল।
‘করবী তুমি কাঁদছ?’
শীতলের মাথাটা ভারি হয়ে এল।
‘শীতল, কতক্ষণ আমরা শুয়ে আছি?’
‘অনেকক্ষণ করবী। কেন—’
‘তোমাকে টানার ক্ষমতা আমার নেই, শীতল, তুমি এতক্ষণেও তা বুঝতে পারলে না?’
করবী এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। এবং সঙ্গে সঙ্গে শীতলের কাছে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। চমকে উঠে শীতল ভাবল, তাই তো, এতক্ষণ পাশাপাশি তবে দুটো কী শুয়ে ছিল? দুটো রক্তমাংসের শরীর? না দুটো নিথর নদী? করবী! করবী! শীতল তবু করবীকে আশ্রয় করে দাঁড়াতে চাইল প্রাণপণে। কিন্তু কেবলই সে পিছলে পড়ছে! দাঁড়াতে পারছে না কোথাও।
‘অনিলের মড়া আগলে বসে থেকে আমার শরীরের সব আগুন নিবে গেছে শীতল। আমি এখন পোড়া কাঠ। আমি আর কাউকে পোড়াতে পারব না। তুমি দেরি করে ফেলেছ।’
‘দেরি করে ফেলেছি?’
‘হ্যাঁ, বড্ড দেরি। শুধু তোমার নয় শীতল। আমারও। কুড়ি বছর ধরে অনিল যে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে, তার জায়গায় ধাপে ধাপে তুমি এসে গেছ, এ আমি বুঝতে পারিনি। ভেবে এসেছি এ শুধু রুবিরই খেয়াল। আজ যখন বুঝলাম তখন আমার আর কিছুই নেই। সব আকাঙ্ক্ষা সব ইচ্ছে আমি টুটি টিপে মেরে ফেলেছি শীতল। কিচ্ছু নেই।’
‘তা হলে তুমি আজ এখানে কী করে এলে? আমার বিছানায় কী জন্য এলে?’
‘প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম শীতল, তাই। ঘুম ভাঙার পরও ভয় গেল না। আমার মনে হল তুমি সত্যিই বুঝি মরে গিয়েছ। সেই ভয়ে সেই আতঙ্কে ছুটে এসেছি। যদি আমরা এক বাড়িতে থাকি তবে দেখবে এমনই ভয় বা আতঙ্কের তাড়া খেয়েই হয়তো আবার কোনওদিন এসে পাশে শোব। আর কোনও টানে নয় শীতল। তুমি কোনওদিনই আমাকে রুবির মত উপড়ে এনে তোমার বুকে আছড়ে ফেলতে পারবে না। সে আগুন তোমার আছে শীতল। আমি দেখেছি। রুবির আছে। আমার নেই। আমি জেনে শুনে এমন জীবন তোমাকে দিতে পারিনে। যার কিছু দেবার আছে শীতল তুমি তেমন কাউকে বেছে নাও।’
ঝি এসে কড়া নাড়ছিল। শীতল চমকে উঠল। সকাল হয়ে গেল?
করবী ধীরে ধীরে শীতলের বিছানা থেকে নেমে পড়ল। যাবার আগে শীতলের দিকে চাইল। শীতলও করবীকে খাঁ খাঁ চোখে চেয়ে দেখল। আশ্চর্য, করবীর যেন কোথাও পাট ভাঙেনি।
করবী তার স্বভাবসিদ্ধ শান্ত স্বরে বলল, ‘তুমি এখন উঠো না শীতল। আমি চা এনে দিচ্ছি।’
চোখে মুখে জল ছিটিয়ে করবী দরজা খুলতে গেল।
শীতল করবীর কথা শুনল না। সে শুয়ে থাকতে পারল না। বিছানার উপর উঠে বসে একটা সিগারেট ধরাল।
.
২
যথাসময়ে রাস্তায় নামল শীতল। সে অফিসে চলেছে। দরজা খুলে করবী চেয়ে রইল তার দিকে। শীতলও চাইল করবীর দিকে। করবীর দৃষ্টি স্থির। আজকের মেঘলা সকালের মত তেজহীন, স্নিগ্ধ। করবী চেয়ে রইল কিন্তু শীতল দৃষ্টি নামিয়ে নিল। সেই যেন অপরাধী। মুখ নিচু করে শীতল চলতে শুরু করল। তার মাথাটা আজ বড় ভারী। তখন বৃষ্টি ছিল না। রোদও না। বড্ড গুমোট। সে ছাতা খুলল না। গলিটা বাঁক নিতেই করবীর বাড়িটা হারিয়ে গেল। করবী এখন তার পিছনে। বড় রাস্তায় পড়ল সে। করবী দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। তার সামনে এখন শমি। একটা গাড়ির ছিটকানো কাদার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তাকে কাপড় তুলে পাশে লাফ দিয়ে পড়তে হল। সে শমির কাছেই চলেছে। যদিও দূর, তবু পথ তো জানা। এখান থেকে ট্রাম ডিপো। তারপর অফিস। সামনের দিক থেকে একটা মিনিবাস প্রচণ্ড জোরে ছুটে এল। আবার রাস্তার পাশে লাফ দিল সে। তারপর শমি।
পরিপার্শ্বের আক্রমণ থেকে ক্রমাগত নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতে এগিয়ে চলেছে সে। তার পিছন থেকে হুড়মুড় করে বাস আসছে। সে সতর্ক হচ্ছে। সামনে থেকে ছুটে আসছে বাস, লরি, ট্যাকসি টেমপো প্রাইভেট। সব ঊর্ধ্বশ্বাসে। সে লাফাচ্ছে ঝাঁপাচ্ছে। ডাইনে বাঁয়ে। এ পাশ থেকে সাইকেল রিকশা, ওপাশ থেকে ঠ্যালা, সাইকেল, ষাঁড়। এখানে গর্ত জল, ওখানে আবর্জনার স্তূপ, কাদা নর্দমা। সে চলেছে। অত্যন্ত সতর্ক। অত্যন্ত সচেতন। অতিশয় তৎপর। পিছনে করবীর দূরত্ব একটু একটু করে বাড়ছে। অবসাদ গ্লানি একটু একটু করে কমছে। সামনে শমি। দূরত্ব একটু একটু করে কমছে। উৎসাহ উদ্যোগ একটু একটু করে বাড়ছে।
ট্রাম ডিপোতে সে পৌঁছল। জলে কাদায় জুতোটা একেবারে ন্যাতা হয়ে গেছে। কাপড় জামা ঘামে ভিজে লদলদে। একটা ফাঁকা ট্রামে সে উঠে বসল। ড্রাইভারের পিছনে জানালার পাশে তার মনোমত সীটে। সে জুতো খুলে তার উপর গোড়ালি রেখে পায়ের পাতাটা ট্রামের দেওয়ালে চেপে ধরল। কাপড় টেনে একেবারে হাঁটু অবধি তুলল। ছাতাটা আজ ভেজেনি। ছাতাটাকে দুই হাঁটুর মাঝখানে এনে তার বাঁটে দু’ হাত রেখে আরাম করে বসল। সিগারেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। সে পকেট থেকে একটা সুপুরির টুকরো বের করে মুখে পুরল। ট্রাম ছাড়তে দেরি আছে। আগে গোটা দুই যাবে তারপর এটা। অন্যদিন এই সময়টা বুক পকেট থেকে ফর্দটা টেনে বের করে পড়ে নেয়। আজ কোনও ফর্দ নেই। রুবি আর কোনওদিন তাকে কোনও ফরমায়েশ করবে না। করবী? আজ কোনও ফর্দ সেও দেয়নি। ভুলে গেছে? তার বুক পকেটটা ফাঁকা ফাঁকা লাগল। তার নীচেটাও। সে জানালার বাইরে চাইল। অনেকগুলো কাক ডিপোর ফাঁকা চত্বরে গোল হয়ে বসে আছে। তার মনে পড়ল কাল বিকেলে তার আত্মীয়রা এটর্নির বাড়িতে জড়ো হয়েছিল। তাকে দেখবে বলে। তাকে দেখবে বলে? না টাইপ করা একটা দলিলে তার সই নেবে বলে? সে যায়নি। সে কাকগুলোর দিকে চেয়ে রইল। একটা কাক লাফিয়ে এগিয়ে এল। এতে আর ভেবে দেখার কী আছে? উকিল কাকার তীক্ষ্ণম্বর তার কানে বেজে উঠল। তার মনে হল আলো কমে আসছে। তোমার উত্তরাধিকার তুমি বুঝে নেবে, এতে ভাবার কী আছে? বৃষ্টি আসবে বোধহয়। সে আকাশের দিকে চাইল। সব তৈরিই থাকবে, হাবুল মিত্তির বলেছিল, ওরাও সব কাল হাজির থাকবেন। সবাইকে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। অনেক দিন ধরেই তো ঝুলে আছে ব্যাপারটা। সকলেই এখন ফয়সালা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। উকিল কাকা বললেন, হ্যাঁ, কাল এসো। তোমার ব্যাপারে আমি যা বলব সবাই তা মেনে নেবেন। তুমি কি এগরিমেন্টের কপি দেখতে চাও? হাবুল দিতে পারে কপি। তুমি যোগীনের পরামর্শ নিতে পারো। ও আমার ছেলেরই মতো। তোমার প্রতি অবিচার হয়েছে? তা তুমি বলতে পারো। কিন্তু তার জন্য দায়ী তোমার মা। তাঁর ফুলিশ জেদ। কোনও প্র্যাকটিক্যাল সেনস ছিল না তাঁর। শীতল দেখল কাকগুলোর ভিতর তুমুল কলরব শুরু হয়েছে। কা কা কা কা। শীতল কাল ওদের কলরবে গলা মেলাতে যায়নি। ফুলিশ জেদ। তারও কোনও প্র্যাকটিক্যাল সেনস নেই। এসবই শেতলবাবুর অ্যানটিকস। কা কা কা কা।
সব ফয়সালা করে দিয়েছে করবী। অত্যন্ত শান্তভাবে সে একটা সত্যকে উদ্ঘাটিত করে দিয়েছে। রুবি আর করবী তার পায়ের শিকলি কেটে দিয়েছে। ট্রামটা ভর্তি হতে শুরু করেছে। কিন্তু তবু সে উড়তে ফূর্তি পাচ্ছে না কেন? তার মাথাটা আবার টিপটিপ করতে শুরু করল। কেমন ভারী ভারী লাগছে আবার। শিকলটা সে নিজেই টেনে পরেছিল, সেইজন্য কি? জোলো বাতাস বইতে শুরু করল। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। তার ঘুম আসছে। তার পাশে কে যেন এসে বসল। ট্রাম ছাড়ল।
ঘুমুচ্ছে সে। ঘুমুতে ঘুমুতেই সে পকেট থেকে মানথলি বের করে কনডারটরকে দেখিয়ে পকেটে রাখল। বৃষ্টির ছাঁট আসছিল। ঘুমুতে ঘুমুতেই সে জানালাটা বন্ধ করে দিল। সার্কাসে সে এখন ট্রাপিজের খেলা দেখছে। না দেখছে না। সে খেলছে। সে নিজেই জোকার। করবী একদিকে দাঁড়িয়ে দুলিয়ে দিল ট্রাপিজ। সে কোনওমতে সেটা ধরে শূন্যে দাপাদাপি করছে। তার পাতলুন খুলে এসেছে প্রায়। শমি আরেকদিকে দাঁড়িয়ে আরেকটা ট্রাপিজ ছুঁড়ে দিল। সে সেটাও ধরে ফেলল। কিন্তু কোনওটাই ছাড়তে পারছে না। খুব দাপাদাপি করছে শূন্যে। তার দু’ হাতে দুটো ট্রাপিজ। সে একেবারে মাঝখানে। সে যেন কত বিপন্ন। তার পাতলুন খুলে গেল। লোকে হা হা করে হেসে উঠল। শমি হাসছে। করবী হাসছে। শমি আর করবী তাকে দুর্দশার হাত থেকে মুক্তি দেবার জন্য একসঙ্গে ট্রাপিজ দুটো নিজের প্ল্যাটফরমের দিকে টেনে আনতে চাইল। তার মাথাটা ঝুঁকতে ঝুঁকতে ওর ছাতার বাঁটের উপর নেমে এল। শমি আর করবী তাকে একসঙ্গে টানছে। ধীরে ধীরে
ফুস্ ফুস্ করে তার নাক ডাকতে শুরু করল। পাশের লোকটা তার কাণ্ড দেখে মিচকে মিচকে হাসতে লাগল। তার হাতের মুঠো দুটো ট্রাপিজেই আটকে গেছে। দুমুখো টানে সে মাঝখান থেকে একটুও সরল না। তার হাত দুটো টেলিস্কোপের মত লম্বা হয়ে গেল। হৈহৈ কাণ্ড। লোকে হো-হো করে হেসে উঠল। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, শেতলবাবুর অ্যানটিকস। উঃ! কী দারুণ!
বেশ জোরেই নাক ডাকছে তার। সে অঘোরে ঘুমুচ্ছে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। ট্রাম থেমে থেমে চলেছে। ঘড়ড়াত করে শব্দ হল তার নাকে। পাশের লোকটা হেসে উঠল। পাশের লোকদের শুনিয়ে সে বেশ রসিয়ে বলে উঠল, ‘ওঃ, দাদা আমার আয়েশি বটে একজন! গুরুদেব লোক!’ লোকেরা হো হো করে হেসে উঠল
শীতলের কোনও কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই। নাক ডাকতে ডাকতে, স্বপ্ন দেখতে দেখতে, সে নিজেও মাঝে মাঝে মিচকি মিচকি হাসতে লাগল। গোটা ব্যাপারটায় তার এখন যেন দারুণ মজা লাগছে।
***