পাঁচ
১
ডোর বেল বেজে উঠতেই শমি দরজার আই হোল দিয়ে সতর্কভাবে উকি দিল। শীতল। নিশ্চিস্ত হয়ে সে দরজা খুলে দিল।
শীতল বলল, ‘একটু দেরি হয়ে গেল বোধহয়।
‘আমি তো ভাবলাম আপনি আর এলেনই না।’
শমি দরজা বন্ধ করার জন্য পাশ ঘেঁষে এসে দাঁড়াতেই শীতল শমির শরীরের সেই মিষ্টি গন্ধটা পেল।
‘কেন?’
‘যে রকম ব্যস্ত মানুষ।
শমি শীতলকে নিয়ে বসবার ঘরে ঢুকে গেল।
‘ভাবলাম কোনও গুরুতর কাজে ফেঁসে গেছেন নিশ্চয়ই।’
শীতল হাসল। ঘরখানা বেশ সাজানো। একটা বড় ল্যাম্প, স্ট্যানডের পাশে ছোট নিচু টেবিল। শমির সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, একটা বই পাতা খুলে উপুড় করা, একজোড়া চশমা তার উপর পড়ে আছে। অ্যাশট্রেতে ধোঁয়া ওঠা সিগারেট। শমি পড়ছিল।
‘বসুন। চা দেব? না কি ঠাণ্ডা কিছু?’
‘এখন কিচ্ছু না।’
শীতল একটা বেতের আরাম চেয়ারে ‘আঃ’ বলে শরীরটাকে এলিয়ে দিল।
‘কী ব্যাপার? যুদ্ধ করে এলেন না কি?’
‘যুদ্ধ? ঠিক বলেছেন। অথচ দেখুন এই কথাটা আমার মনে পড়েনি।’
‘যে যা নিয়ে থাকে তার কাছে সেই কথাটাই আগে মনে আসে। আপনি বসুন। আমি দুটো অরেঞ্জ জুস নিয়ে আসি।
বাধা দেবার আগেই শমি উঠে গেল। শীতল দেখল ছোট ঘরটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো। একপাশে কয়েকটা বই-এর শেলফ। অন্যদিকে একটা ছোট স্টিরিও। তার পাশে থাকে থাকে রেকর্ড। একটা ট্রানজিসটার। একটা টেপ রেকডার। দেওয়ালে দুটো আধুনিক অয়েল। একটা শেলফের মাথায় ব্রোঞ্জের একটা নটরাজ।
ছিমছাম পরিপাটি এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিজ্ঞাপনের এই ভাষা, শীতল ভাবল, শমির এই ঘরখানা সম্পর্কে যেমন খাটে তেমনি শমির সম্পর্কেও।
শমি একটা ট্রেতে দু গ্লাস অরেঞ্জ জুস ফ্রিজ থেকে বার করে এনে সামনে রাখল।
‘বরফ লাগলে বলবেন। আজ অবিশ্যি লোডশেডিং হয়নি তাই রক্ষে।’
শমি একটা গ্লাস তুলে নিল। শীতলও।
যথেষ্ট ঠাণ্ডা, বরফ লাগবে না।
‘আমি খুব খুশি হয়েছি শীতল। আপনি এসেছেন। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।’
‘কেন?’ শীতল বিস্মিত হল।
‘আমার একটা ফাইটে আপনার সম্মতি না নিয়েই আপনার নামটা টেনে এনেছিলাম। এটাই যথেষ্ট অন্যায়। আরও খারাপ যে আপনাকে ভাল করে নেমন্তন্নও করিনি। এরকম লেফট হ্যানডেড নেমন্তন্ন আমাকে কেউ করলে আমি তো অপমান বোধ করতাম।’
‘কেউ আর বিশেষ কেউ-কে আমি ঠিক এক নজরে দেখিনে।’
শমি হেসে উঠল।
‘আপনি মন ভেজাতে ওস্তাদ। আপনার ডিপলোম্যাটিক সারভিসে যাওয়া উচিত ছিল শীতল।’
‘জবসন কি ওদের পরামর্শ দেয়? হাসতে গিয়ে শমির গলায় অরেনজ জুস ঢুকে গেল। বিষম খেয়ে খক খক করে কাশতে থাকল। তার গেলাস থেকে খানিকটা
জুস চলকে শাড়িতে পড়ল। শমি একবার কোনওমতে বলল, ‘সরি’, আবার কাশতে শুরু করল। শীতল শমির হাত থেকে গেলাসটা নিয়ে ধীরভাবে ট্রের উপর রেখে দিল। অতি কষ্টে সামলে নিল শমি।
‘ইউ আর এ কিলার। আপনি মানুষ খুন করতে পারেন।’
শমি প্রচণ্ড ভাবে হাসতে লাগল। তার জীবনে আজকের দিনটা একেবারে নতুন ধরনের। হঠাৎ তার চোখমুখ করুণ হয়ে গেল। জুসের গেলাসটা হাতে নিয়ে সে কী ভাবতে লাগল।
‘শীতল!’
শমির ডাকে শীতল চেয়ে দেখল তার মুখ থমথমে। চোখ চিকচিক করছে।
‘মানুষের জগতটা অবলুপ্ত হয়ে যায়নি আপনি তার প্রমাণ দিলেন। আজকাল কারও সঙ্গে কথা বলতে হলে এত সিঁটিয়ে থাকতে হয়, অসহ্য। কখনও রিল্যাকস করতে পারিনে।’
শীতল চুপ করে অরেঞ্জ জুস খেতে লাগল।
‘কেউ কাউকে বোঝে না। বুঝতে চায়ও না। দুম দাম করে কেবলই আঘাত করে, কেবলই আঘাত করে যায়। কেন বলুন তো?’
‘এ তো খুব সহজ ব্যাপার শমি। রেডিও টিভি সিনেমা খবরের কাগজ অর্থাৎ মোহনবাবুদের কমিউনিকেশন ইনড্রাসট্রি মানুষের ভাষাটাকে এমনই সস্তা আর সহজলভ্য করে তুলেছে যে, এটা এখন যারা অমানুষ তারাও ব্যবহার করতে শিখে ফেলেছে।’
শমি হেসে ফেলল।
শীতল বলছে, ‘এখন আমার আর আপনার প্রধান কাজ হচ্ছে সেগমেনটেশনটা বুঝে নিয়ে পোজিশনিং অফ প্রডাকট কীভাবে করলে মারকেটে ওদের পেনিট্রেশনটা একেবারে স্বচ্ছন্দ হয় তার একটা স্ট্যাটেজি ঠিক করে দেওয়া। কী, ঠিক ঠিক বলতে পেরেছি তো?
‘একেবারে ফুল মার্কস।
শমি আবার প্রাণ খুলে হাসতে শুরু করল। কতদিন পরে সে আবার স্বাভাবিক হতে পারল। শীতল যে এমন একটা অসম্ভব ধরনের তাজা মানুষ, শমি তার পরিচয় পেয়ে অবাক হল। সে হাসতে হাসতে অরেনজের গেলাসটা ঠোঁটে ঠেকাতে গৈল। শীতল বাধা দিল।
‘না, অনুগ্রহ করে সুইসাইড করবেন না। হয় আগে ওটা শেষ করুন পরে হাসবেন। আর না হয় আগে হাসিটা শেষ করুন পরে ওটা খাবেন।’
শমি ঠকাস করে গেলাসটা টেবিলে রেখে বলল, ‘তবে আমি হেসেই নিই শীতল। সাবালক হওয়া অব্দি এমন মুহূর্ত আমার জীবনে আর এসেছে কি না মনে করতে পারিনে। আমি দিন রাত এমনই একটা মুহূর্তকে পেতে চেয়েছি। স্বপ্ন দেখেছি। কল্পনায় জাল বুনেছি। একটা সকাল। একটা দুপুর। একটা বিকেল। একটা সন্ধ্যা। একটা পুরুষ। একটা বন্ধু। একটা মানুষ। এমনিভাবে হাল্কা করে দেবে আমাকে। আজও স্বপ্ন দেখছি কি না কে জানে!
শমির শোবার ঘর থেকে টেলিফোন বেজে উঠল।
শমি চমকে উঠে স্নান হেসে বলল, ‘যা ভেবেছি তা-ই, এটা স্বপ্নই শীতল। আমাদের জীবনে ভাল স্বপ্নও বেশিক্ষণ টেকে না।’
শমি গেলাসটা উঁচু করে তুলে বলল, ‘চিয়ারস।’
টেলিফোন বেজেই চলল। শমির ওঠার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। সে নিশ্চিন্ত মনে অরেনঙ্গ জুসে অল্প অল্প করে চুমুক দিতে লাগল।
শীতল শমিকে শুধু দেখছিল। বলল, ‘শমি, ফোন ধরব?’
‘থাক শীতল। ওটা দুঃস্বপ্ন, ও তো আছেই।’
শমিকে দেখেই শীতলের মায়ের কথা মনে পড়েছিল। কেন তা ধরতে পারছিল না। এখন কারণটা সে জেনে গেল। প্রতিকূলতা প্রবল জেনেও তাকে অস্বীকার করার জোর। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও বশ্যতা স্বীকার না করার জেদ। এই তার মা, শমিও তা-ই, মিলটা তা হলে এইখানে, শীতল বেশ মজা পেল।
এই কারণেই শমির কাছে তার এত সহজ লাগে। হ্যাঁ, আরও একটা মিল সে খুঁজে পেল। মা তার সহায় হিসেবে তাকে পাশে পেতে চেয়েছিল। সে কি থাকেনি? তার উপর মায়ের আস্থা ছিল না। শমিও তার সহায় হিসেবে শীতলকে পাশে পেতে চাইছে। সে কি থাকবে? তার উপর শমি কি আস্থা রাখে?
টেলিফোনটা থেমেছিল। আবার বাজতে শুরু করল। শমি এক মনে অরেনজের গেলাসে চুমুক দিয়ে চলেছে। শীতল শমির দিকে চাইল। শমিও। দুজনের চোখে দুজন চোখ রাখল। কিছুক্ষণ। শীতল ধীরে ধীরে অরেনজের গেলাসে চুমুক দিতে শুরু করল।
‘আপনার মধ্যে আমার মায়ের চেহারা খুঁজে পাই শামি।’
শীতল একটু থামল। শমি ওর মুখের দিকে চাইল। শীতল অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরাল, কাঠিটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিবিয়ে ফেলল।
বলল, ‘চেহারা না বলে চরিত্র বলাই ভাল।
শীতল ধোঁয়ানো কাঠিটার দিকে চেয়ে থাকল। কী ভাবল।
বলল, ‘ভাঙবে তবু মচকাবে না। মা বলত, ভিক্ষের অম্ল কুকুর-বেড়ালে খায়। মানুষই শুধু তার মান মর্যাদা রক্ষার জন্য দরকার হলে উপোস দিয়ে মরতে ভয় পায় না। মানুষে আর কুকুর-বেড়ালে এইখানে তফাত শীতল।’
সিগারেটে টান দিয়ে শীতল আপন মনেই হাসল।
‘আরও সব অদ্ভুত কথা বলত মা, জানেন। বলত সব মানুষ মানুষ নয় শীতল, কেউ কেউ মানুষ। বাকি সব দু-পেয়ে জীব।’
শীতল আবার হাসল। খুব মৃদু ম্লান হাসি।
‘আপনার এখানে আসতে দেরি হল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আপনি আর এলেন না।’
‘আমি গিয়েছিলাম একটা দু-পেয়ে জীব দেখতে, তাই দেরি হল।’
‘দু-পেয়ে জীব?’
‘একজন অ্যাটর্নি।
‘অ্যাটর্নি?’
‘হ্যাঁ, ওই যে কাল যোগীন বলল ফোনে।’
‘সে তো রবিবারে যাওয়ার কথা। তা-ই না?
‘কাল পর্যন্ত সেই কথাই ছিল। আজ যোগীন জানাল যে, জটাই মিত্তিরের আর তর সইছে না। আমাকে নিয়ে যাবার জন্য তিনি গাড়ি পাঠাচ্ছেন। ইংরেজিতে একেই বোধহয় ভ্যালুয়েবল কারগো বলে, তাই না?’
‘কে জটাই মিত্তির?’
‘আমার বাবার বাল্যবন্ধু। আমাদের অ্যাটর্নি। আমার উকিল কাকা। আমার মা যাঁর উপর বিশ্বাস করে তার মামলা সঁপে দিয়েছিল। যিনি আমার মাকে পথে বসিয়েছিলেন। এবং যাঁর কারণে আমার মায়ের চরিত্রদোষ রটেছিল।’
‘আপনি তাকে দেখতে গেলেন! শমি বিস্ময়ে ফেটে পড়ল।
‘সেখানে গিয়েই তো দেরি হল।’
‘আপনি আশ্চর্য। আপনাকে আমি বুঝতে পারিনে।’
‘আমিও না শমি। যোগীনের প্রস্তাবে আমি প্রথমে সায় দিইনি। তারপর নিমরাজি হই। ভেবেছিলাম নাছোড় যোগীনকে এড়াবার জন্য এখন তো হ্যাঁ করি। তারপর না গেলেই হল। কিন্তু যতই সময় যেতে লাগল ততই দেখি আমার মন বদলাতে শুরু করল। তারপর আজ যোগীন এ কথা পাড়তেই এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
‘তা হলে আপনারও আর তর সইছিল না বলুন।’
শমির খোঁচাটা শীতল গায়ে মাখল না।
বলল, ‘হ্যাঁ, তা-ই। তর সইছিল না।’
‘অনেক সম্পত্তি বুঝি?
‘সম্পত্তি? ও হ্যাঁ সম্পত্তি। কত তা তো জানিনে।’
‘অত তাড়া করে গেলেন আর আসল কথাটাই জেনে এলেন না?’
শমির কথাবার্তা ক্রমেই তীক্ষ্ণ হয়ে আসছে। শীতল এতক্ষণে বুঝল শমি তার উপর চটে উঠেছে। সে হেসে ফেলল।
বলল, ‘আপনার সিগারেট একটা দিন তো। দেখলাম জটাই এখন ব্রান্ডটাই ধরেছেন।’ শমি নিঃশব্দে প্যাকেটটা ওর দিকে ঠেলে দিল। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে নিল শীতল। ধরাল।
বলল, ‘থ্যাংকস।’
শমি উত্তর দিল না। শীতল লক্ষ করল সে অন্য দিকে চেয়ে রয়েছে।
বলল, ‘না শমি, বিষয় সম্পত্তির কথা জিজ্ঞেস করিনি। এবারকার সাক্ষাৎকারটা অনেকটা কামগন্ধহীন বলা যেতে পারে। আসলে কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই স্বপ্নটাই আমার কৌতূহলকে দুর্বার করে তুলেছিল। সত্যি বলতে কী, সেই স্বপ্নটাই আমাকে যেন ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল।
‘স্বপ্নে আপনার মা এসে বললেন, যাও বাছা, শমি যেন তলোয়ার চালাচ্ছে, ‘যাও। তোমার জিনিস তুমি দৌড়ে গিয়ে বুঝে নাও। দেরি করলে ফস্কে যেতে পারে।’
শীতল চুপ করে খোঁচাটা হজম করল। কী একটু ভাবল।
বলল, ‘স্বপ্নটা অত স্পষ্ট নয় শমি। খানিকটা আবছা। আসলে আমি দরজার ফুটো দিয়ে দৃশ্যটা দেখেছিলাম। দেখছিলাম একটা বারো-তেরো বছরের ছেলের চোখ দিয়ে। ঘরটা বেশ পরিপাটি। এখন মনে হচ্ছে অনেকটা এই ঘরটারই মতো। কেন এ কথা মনে হল বলতে পারব না।’
শমি এবার শীতলের দিকে চাইল। শীতলের মুখ-চোখ কথা বলার ভঙ্গি সব বদলে যাচ্ছে। শমি যেন একটা ভূতের গল্প শুনবে। ওর গা ছমছম করতে লাগল।
‘ঘরের ভেতর মা, বেশ ছিমছাম। অনেকটা যেন আপনারই ধরন। মা দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোনো। চুল বিপর্যন্ত। কিন্তু মা কী শান্ত, কী কঠিন। একটা পাহাড়ের উপর দিয়ে একটু আগেই বাতাসের এক দুরস্ত দমকা বয়ে গেছে। একটা লোক দু’ পা এগিয়ে এল মায়ের দিকে। লোকটা খুব শৌখিন। ঘাড় উঁচু করে ছাঁটা। একটা হাতির দাঁতের হোলডার মুখে। সিগারেট ছিল বোধহয়, একটু আগেই পড়ে গিয়েছে। লোকটার বোধহয় খেয়াল নেই। লোকটা মায়ের নাগালের মধ্যে এসে গেল। মা একচুলও নড়ল না। মায়ের মুখে ভয়ের লেশ মাত্র নেই। কিন্তু ভয়ে আমার বুকে সে কী টিপটিপানি। মায়ের সেই শান্ত ভঙ্গি দেখে লোকটাও থমকে দাঁড়াল। আর তক্ষুনি লোকটার গালে মা মারল প্রচণ্ড এক চড়। লোকটা টলে পড়ছিল। টেবিল ধরে টাল সামলাতে গেল। তার হাতের ধাক্কা লেগে সিগারেটের টিনটা মেঝেয় ঠন করে উল্টে পড়ল। সিগারেটগুলো চতুর্দিকে ছিটকে গেল। আর আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে দরজার কড়া দুটো দারুণ জোরে খটখট করে নাড়িয়ে দিলাম। তারপর ঘুম ভেঙে গেল।’
শীতল থামল। দেখল শমি বড় বড় চোখ করে তার দিকে চেয়ে আছে।
শীতল বলল, ‘সেই শৌখিন লোকটাকেই আজ দেখতে গিয়েছিলাম। না গিয়ে পারলাম না।’
শমি বলল, ‘আমি আমি সরি শীতল।
শীতল বলল, ‘কী ব্যাপার, বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার পাট নেই না কি? আমাকে কিন্তু অনেক দূর যেতে হবে।’
শমি ভেবেছিল শীতল বুঝি তাড়াহুড়ো করবে। কিন্তু তাকে ধীরে সুস্থে খেতে দেখে শমি, খুশি হল। সে নিজেও আজ খেয়ে সুখ পাচ্ছিল। অনেকদিন শমি এমন গা এলিয়ে নিশ্চিন্ত মনে খাওয়ার সুখের আস্বাদ পায়নি। আর গা এলিয়ে খাওয়ার সময়ই বা কোথায়? সোম থেকে শনি। কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সকালে কাজের মেয়েটা এসে কাজ শুরু করার আগেই তার সকালের চা খাওয়া সারা হয়ে যায়। চান-টান সারতে তার একটু দেরি হয়। নতুন ঝিটা বেশ কাজের। ওকে সকালে খেতে দেয় শমি। তাই সে শমিকে তার কাপড়জামা কাচতে দেয় না। চুলটাও রোজ আঁচড়ে দেয় সকালে। ওইটুকুই যা শমির গা এলানোর সময়। স্নানের ঘর থেকে সায়ার উপর শাড়িটা কোনওমতে জড়িয়ে সে বিছানায় এসে বসে। কুসুম চিরুনি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। সে প্রথমে শমির বুকে পিঠে বেশ করে পাউডার ছড়িয়ে দেয়। তারপর ব্রা-এর হুকটা এঁটে দিয়ে শমির চুল নিয়ে পড়ে। শমি চুল ছেঁটে বাবরি রেখেছে বলে কুসুমের আফসোস। শমি চোখ বুজে এই আরামটুকু উপভোগ করে। এই সময়টুকুই যা তার। একেবারে তার নিজের। এখন শীতলের সঙ্গে খেতে খেতে তার মনে হতে লাগল সেই সময়টাই এখন বুঝি ফিরে এসেছে। সোম থেকে শনি। তবু সময়টা কেটে যায়। সকালে নমো নমো করে খেয়ে সে বেরিয়ে যায়। সারাদিন কাজ গুঁতোগুঁতি আক্রমণ পাল্টা-আক্রমণ সফলতা ব্যর্থতা। র্যাট রেস। পুরুষের জগতে সম মর্যাদা অর্জনের দাবিদার এক অবিরাম সংগ্রামরত নারী সারাদিন পরে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় ঘরে ফেরে সন্ধ্যায়। সোম থেকে শনি। সোম থেকে শনি। এই হল শমি। মাঝখানে তার জীবনে অবিশ্যি জিতু এসেছিল। কিন্তু সে অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। বিয়ের আগে জিতু কতদিন না বলেছে, শমি আমরা হব ইকোয়াল পার্টনার। কিন্তু বিয়ের পরে সেই জিতুরই কী সর্বগ্রাসী রাক্ষসী রূপ! বাবা! কী তার প্রভুত্ববোধ!
সব চাই জিতুর। শমির দেহ, শমির মন, শমির আত্মা। শমি যেন এ যুগের শিক্ষিত মেয়ে নয়। সে যেন ব্যক্তি নয়। জিতুর চোখে সে শুধুমাত্র ক্রীতদাসী। জিতু তার জীবনে এক বিভীষিকা। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার এই, শমি যখন বিপন্ন হয়ে জিতুর গ্রাস থেকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিল, কাউকে সে তার পক্ষে পায়নি। এমন কি আইন, আইনের রক্ষক আদালত, হ্যাঁ, আদালতও প্রকারান্তরে জিতুর কোলেই ঝোল টেনেছে। মনুষ্যত্বের অবমাননা, মনুষ্যত্বের অমর্যাদা এসব নাকি আমাদের সভ্য সমাজের আইনে বিচারালয়ের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কোনও অপরাধই নয়। মেয়েরা যেন মনুষ্য সমাজের বাইরের জীব। শেষ পর্যন্ত জিতুর টার্মেই তাকে বিবাহবিচ্ছেদ মেনে নিতে হয়েছে। তাতেও জিতুর রাগ মেটেনি। শমি যে জিতুর প্রভুত্ব অস্বীকার করে দাঁড়িয়ে আছে, জিতুর পুরুষালি অহংকার তা আর ভুলতে পারছে না।
ওদের খাওয়া যখন মাঝপথে তখন লোডশেডিং হল। টেবিলের উপর দুটো মোমবাতি বসানোই ছিল। শমি জ্বেলে দিল। একা থাকলে শমি ভয় পেত। অন্য কেউ থাকলে একটা অস্বস্তি তার পেটের মধ্যে বুকের ভিতর ঘোরাফেরা করত। সদাসতর্ক হয়ে থাকতে হত। শীতলের উপস্থিতিতে সে আশ্চর্য নিশ্চিন্ত বোধ করতে লাগল।
শীতল বলল, ‘আপনি ভাল রাঁধেন।’
‘আমি ভাল চুলও বাঁধি।’
‘কার? আপনার?’
‘না। অফিসের। তাই তো আমার উপর আপনাদের এ রাগ।’
‘শমি, আমরা সব সাধারণ মানুষ। আমাদের সাদামাটা হিসেব দিয়ে যাকে বুঝতে পারিনে আমরা তাদের ভয় পাই। নতুন কোনও কিছু বুঝতে, তাকে মেনে নিতে
আমাদের অনেক সময় লাগে।
শমি একটু সময় নিল। তারপর নিজেকেই যেন বলতে লাগল, ‘ভয় আমিও পাই শীতল। বিশেষত যখন হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসে। আমার মনে হয় অন্ধকার নয়, যেন কোনও আততায়ীই আমার উপর লাফিয়ে পড়ল। একা থাকি। সব সময় মনে হয় যেন দরজাটা ভাল করে দেওয়া হয়নি। জানালাগুলো, বাথরুমটা, খাটের নীচে, রান্নাঘর যেন ভাল করে দেখা হয়নি। বুঝতে পারি এত ভয় যে, আমার চারিদিকে হানা মারছে তা শুধু আমি একা বলে নয় আমি মেয়ে বলে। একজন বন্ধু পেতে এই সময় খুব ইচ্ছে হয়।’
শমি থামল। কিন্তু আবার বলে উঠল, ‘জিতু, ভেবেছিলাম আমার বন্ধু হবে। কিন্তু সে আমার প্রভু হতে চাইল।’
মোমবাতির আলোয় শমি হারিয়ে গেল না, বরং উজ্জ্বল হয়ে উঠল শীতলের চোখে। অফিসের ইলেকট্রনিক টর্চের থিয়েটারি আলোয় প্রথম দিন শমিকে দেখে হঠাৎ ওর সঙ্গম করার স্পৃহা জেগে উঠেছিল। সে কথা মনে পড়ায় শীতল এখন লজ্জিত হল।
শমি বলছে, ‘আপনি বললেন, আমি ভাল রাঁধি। সত্যিই আমি রান্নাটা জানি। আমি যত্ন করে শিখেছি, আমি শিখতে খুব ভালবাসি। আমি গান জানি। যত্ন করে শিখেছিলাম। আমি লেখাপড়াটাও যত্ন করে শিখেছি। আমার বাপের বাড়ি গেলে দেখবেন আমার গুণপনার কত নিদর্শন সব থরে থরে সাজানো আছে। ভাল পাত্রে গাঁথবেন বলে বাবা-মা’ই সেসব সাজিয়ে রেখেছিলেন। তাঁরা সব আমাকে শিখিয়েছেন আমার ভাল বিয়ে দেবেন বলে। আমি ভাল ককটেল তৈরি করতেও জানি। বাবা মা কোনও চানসই ছাড়তে চাননি। কিন্তু আমি বিয়ের পিঁড়িতে বউ হয়ে বসবার জন্য এসব শিখিনি শীতল। শিখেছিলাম নিজেকে তৈরি করতে। বাবা মা’র অমতে জিতুকে বিয়ে করলাম। কিন্তু জিতু চাইল কেরিয়ারের বাজারে তার দাম তোলবার
জন্য আমাকে ব্যবহার করতে।
ওদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। তবু ওরা বসে ছিল।
শমি বলল, ‘আর কিছু নেই, উঠুন। আজ আপনাকে গান শোনাতে ইচ্ছে করছিল।’ শমি জোর করে হেসে উঠল। বলল, ‘তার বদলে আপনাকে শমি সিনহার পাঁচালি শুনিয়েই সময়টা নষ্ট করলাম।’
শীতল বলল, ‘আমারই দুর্ভাগ্য।’
‘কোনটা? শমি সিনহার গান না শোনাটা? না, তাঁর পাঁচালি শোনাটা?’
‘সব মন্তব্য এক সন্ধেয় শেষ করতে নেই।’
শমি এবার খিলখিল করে হেসে উঠল।
‘জব্সন দেখছি রতন চেনে।’
শমির কথায় শীতল না হেসে পারল না।
‘শুধু জব্সন? রতন দেখছি শমিও চেনে।’
‘শীতল।’ শমি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। ‘ঠাট্টা নয়। আমরা দুজনে ভাল জুটি হব। মন বলছে শীতল। আপনি কাছে থাকলে আমি জোর পাই। আমি দেখেছি শীতল। আপনি কাছে থাকলে আমি আমাকে যেন ফিরে পাই। আমি আপনি একসঙ্গে মিললে আমরা কোথাও পৌঁছাব শীতল। আপনাকে আমার দরকার।’
এ যেন শমির প্রার্থনা নয়, দাবি।
.
২
রুবি চলে গেলে যত কষ্ট হবে ভেবেছিল, এখন শীতল দেখল তার আর অত কষ্ট হচ্ছে না। রুবির কষ্ট হচ্ছে কিনা শীতল বুঝতে পারছে না। যেমন দাপাদাপি করা তার স্বভাব রুবি এখন তা-ই করছে। শুধু সঙ্গী বদলেছে। আজ রুবির দৌরাত্ম্য সহ্য করছে রুবিরই বয়সী এক জোয়ান ছেলে, রুবির ক্লাসমেট জয়ন্ত। ওরা দুজনে রুবির ঘরে হুল্লোড় করছে। জিনিসপত্র গোছগাছ করছে। হাসছে, ঝগড়া করছে। রুবি মাঝে মাঝে চেঁচাচ্ছে, ‘অসভ্যতা করলে থাপ্পড় খাবি জয়ন্ত।’ কখনও বা চেঁচিয়ে উঠছে, ‘মা, দ্যাখো, এই জন্তুটা কী করল।’ জয়ন্ত অমনি জন্তুর মতো গোঁ গোঁ করছে। কষ্ট পাচ্ছে করবী। রান্না ঘরে সে বড় ব্যস্ত। শুধু শীতলেরই এখন এ বাড়িতে কোনও কাজ নেই। সে নিশ্চিন্ত মনে তার ঘরে অবসর যাপন করছে।
বাইরে কী আশ্চর্য উজ্জ্বল দিন। রাস্তার ওপারে পাঁচিলের ওপিঠে ঝাঁকড়া নিমের পাতায় পাতায় নতুন যৌবনের ঢল নেমেছে। আকাশ গাঢ় নীল। বাতাসে উচ্ছলতা। ছেঁড়া মেঘ ফূর্তিতে ভেসে চলেছে। তাজা সবুজ নিমের ডালে হুটোপুটি চলেছে। সূর্যের আলোয় কেমন স্নেহময় প্রসন্নতার প্রশ্রয়।
করবী শীতলের ঘরে ঢুকল। সে কেমন বিভ্রান্ত। তার হিসেবেই আজ সব কিছু গরমিল। জয়ন্তর সঙ্গে রুবির খুনসুটি, কথায় কথায় মা মা বলে চিৎকার, শীতলের নির্বিকার নিশ্চিন্ত ভাব। একমাত্র করবীকেই স্বস্তি দিচ্ছে না।
করবী বলল, ‘চা খাবে?
শীতল বলল, ‘চা? হ্যাঁ তা হতে পারে।’
করবী তবু ইতস্তত করতে লাগল।
‘ছেলেটা কি চা খাবে?’
‘জয়ন্ত? তা রুবিকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো?’
করবী তবু ইতস্তত করছে। শীতল ওর দিকে চাইল।
শীতল হঠাৎ বলে ফেলল, ‘ওদের এই বয়েসটা দারুণ করবী, না? ওদের এনার্জি অফুরন্ত।’
করবী বিভ্রান্ত চোখে শীতলকে একটুক্ষণ দেখে নিল। তারপর কোনও কথা না বলে বেরিয়ে গেল।
শীতল ভাবল জয়ন্তর যা বয়েস তাকে ওই বয়েসেই চাকরিতে ঢুকতে হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে শীতলের মনে পড়ল, আরে, সেই পিকনিকের ফটোটায় তো তার সেই চেহারা ধরা আছে। শীতলের মনে হঠাৎ নিজের সেদিনের চেহারাটা দেখবার ইচ্ছেটা দাউ দাউ করে জেগে উঠল। কাল যেমন জেগেছিল উকিল কাকাকে দেখবার ইচ্ছেটা। সে ড্রয়ার থেকে ফটোটা বের করে দেখতে লাগল ঠাকুরের পাশে সে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমেই তার মনে হল, জয়ন্তর সঙ্গে কোনওই মিল নেই। কত স্মার্ট জয়ন্ত। কত তাজা। নিজের চেহারা দেখে সে খুশি হল না। তার উকিল কাকাকে দেখেও সে এমনই হতাশ হয়েছিল। সেই উঁচু করে ঘাড় ছাঁটা শৌখিন লোকটাকে কোথাও খুঁজে পায়নি কাল। চিমড়ে আশি বছুরে চামচিকে তাকে দেখেই বলে উঠেছিল, ব্যস ব্যস, আর কোনও প্রমাণের দরকার নেই হাবুল, এ যে একেবারে শিবচরণ। আমাদের অ্যালবামটা নিয়ে আয়। মিলিয়ে দ্যাখ তোরা।
তার চেহারা তার নিজের নয়, একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের, এ কথা জেনে শীতলের অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। এ যদি শীতল হয়, শীতল ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল, আর আমি যদি শিবচরণ হই, তবে শীতল কোথায় গেল? হারিয়ে গেছে। যেমন হারিয়ে গেছে তার উকিল কাকা, সেই শৌখিন জটাধর। কে এদের গাপ করল? বয়েস?
করবী চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। দেখল শীতল মনোযোগ দিয়ে একটা ফটোগ্রাফ দেখছে। সে টেবিলে চায়ের কাপটা আস্তে করে রাখল। শীতল মুখ তুলে করবীর দিকে চাইল।
করবী অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘চা।’
‘দ্যাখো তো করবী কাউকে চিনতে পার কি না?’
ফটোটায় নজর দিয়েই করবী বলে উঠল, ‘চক্কোত্তি কাকা।’
‘হ্যা। আর?’ শীতলের চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে।
করবীর চোখে বিভ্রান্ত দৃষ্টি। সে যেন শীতলের প্রশ্নটা ধরতে পারছে না।
শীতল অসহিষ্ণু হয়ে বলে উঠল, ‘রুবির বাবাকে তুমি চিনতে পারছ না?’
রুবির বাবা! শীতল যেন করবীর পাথরের মত স্থিরতার উপর হাতুড়ির এক ঘা মারল জোরে।
রুবির বাবা! অসহায় করবী শীতলের মুখের দিকে চাইল।
‘অনিলকে চিনতে পারছ না তুমি? আশ্চর্য।’
অনিল। একটা শোনা নাম বহুদিন পরে শুনল করবী। রুবির বাবা অনিল। করবীর বিভ্রান্তি বেড়েই চলল। কার কথা বলছে শীতল? করবী ফটোটা আবার দেখল। এই ফটোয় দেখা একটা লোককে আবছাভাবে চিনতে পারছে করবী। এই নাকি অনিল?
‘মাসিমা।’
ওরা দুজনে চমকে দরজার দিকে চাইল। জয়ন্ত। শীতল দেখল বেশ বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটা। দিব্যি জোয়ান। ছেলেটাকে বড় ভাল লেগে গেল শীতলের।
ওদের একাগ্রতা ভেঙে দেওয়ায় জয়ন্ত একেবারে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘আরে এসো এসো জয়ন্ত।’ শীতল সোৎসাহে বলে উঠল। ‘আমি আর তোমার মাসিমা এতক্ষণ মেমরি গেম খেলছিলাম। বুড়ো-বুড়ির খেলা। তোমার মাসিমার মেমরি এমন যাচ্ছেতাই রকমের খারাপ তা আগে বুঝতে পারিনি। ডাহা ফেল।’
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
শীতলের এই হাসিতে করবীর ভয় করতে লাগল। জয়ন্তর অপ্রস্তুত ভাবটা তাতে কিন্তু কেটে গেল। সেও হাসতে লাগল।
‘মাসিমা, আমাদের কিন্তু কমপ্লিট।
আমাদের বাড়ি কমপ্লিট করবী। আজ লাইট এসে গেল। বাবাঃ। এবার একটা দিন দেখে চলো শিফট করি। অস্নাত অভুক্ত ঝোড়োকাকের মতো একটা স্মৃতি, একটা আবছা পর্দা যেন করবীর মনে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ছবিটা কিছুতেই স্থির হচ্ছে না।
‘অপারেশন সাকসেসফুল।’ শীতল হাসতে হাসতে বলল, ‘কী যেন কথাটা তোমরা ডাক্তাররা বলো?’
জয়ন্ত হেসে বলল, ‘বাট দ্য পেশেন্ট ইজ নট্ ডেড্ মেসোমশাই, উই হ্যাভ ডেলিভারড দ্য বেবি। কিন্তু রুবির সঙ্গে কাজ করা। উঃ, হরিবল! জান কয়লা করে দিয়েছে!
‘রুবি ওই রকম।’ শীতল হাসতে হাসতে সস্নেহে বলল, ‘যাদের ও ভালবাসে তাদের একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। কি বল করবী।
করবী বলল, ‘চলো তবে, খেতে দিই।’
বলেই সে উঠে গেল। সেও ঘর থেকে পালাতে চাইছিল। দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকে গেল। রুবি। করবী দেখল রুবি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
রুবি ম্লান মুখে বলল, ‘ভোম্বল অত জোরে হাসছিল কেন মা?
‘রুবি!’ করবী রুবিকে বুকে টেনে নিল।
‘আমি বুঝতে পারছিনে রুবি। করবীর গলা কাঁপতে লাগল। ‘আমি ওর কিছুই বুঝতে পারিনে। আজ ও এত শান্ত, এত নির্বিকার, আমার মনে হচ্ছে ও যেন আর আমাদের মধ্যে নেই। যেন কত দূরে সরে গিয়েছে। এ যেন অন্য কেউ। আমার
কেমন ভয় করছে।
রুবি ওর মা’র বুকে মুখ গুঁজে কিছুক্ষণ শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। করবী সামলে নিল।
রুবি বলল, ‘ভোম্বল আমাদের জন্য সব দিয়েছে মা। আমরা কিন্তু ওকে কিছুই দিতে পারিনি।
রুবির কথায় যে দুঃখ ঝরে পড়ল, করবীর কানের মধ্যে তা কেবলই ঘুরপাক খেতে থাকল। করবীর মনে হল রুবি হঠাৎ যেন তার সমান বয়সী হয়ে উঠেছে।
.
৩
শীতলের হঠাৎ মনে হল সে চলে গেলে করবী একেবারে একা হয়ে পড়বে। কে দেখবে তাকে? আশ্চর্য, এ কথাটা সে এতদিন ভাবেনি কেন? অনিল কেন এ বাড়ির দোতলার প্ল্যান পাশ করিয়ে রেখে গিয়েছে, শীতল যেন তা এইমাত্র বুঝল। অনিলও ভেবেছিল সে চলে গেলে করবী একা হয়ে পড়বে। তাই সে দোতলার কথা ভেবেছিল। হয়তো ভেবেছিল দোতলাটা হয়ে গেলে ওরা উপরে যাবে। নীচেরতলাটায় একটা ভাল ভাড়াটে বসাবে। করবীর কোনও ভাবনা থাকবে না। অনিল তার কাজ পুরো করতে পারেনি। এ বাড়িতে আসার দু’ মাসের মধ্যেই মারা গেল। দোতলা করে দেওয়াটা শীতলেরই দায়িত্ব ছিল। সত্যিই তো এমন একটা বাড়িতে কারও একার পক্ষে থাকা কি সম্ভব? বিশেষত সে যদি মেয়ে হয়?
শমির ভয়-কাতর মুখটা তার মনে পড়ল। শমি বলেছিল, অন্ধকার হয়ে গেলে তার খুব ভয় লাগে। বিশেষত লোডশেডিং হলে। তার মনে হয় আততায়ী বুঝি লাফিয়ে পড়ার জন্য লুকিয়ে বসে আছে। শীতল যদি শমির পেয়িং গেস্ট থাকতে রাজি হয়, শমি রাখবে? এই আজগুবি ভাবনাটা মাথায় ঢুকতেই শীতল মনে মনে হাসতে লাগল। বৃষ্টি এল। শীতল চেয়ে দেখল পড়ন্ত বিকেলের বিষণ্ণতা মুড়ি দিয়ে নিমগাছের ডালে কতকগুলো কাক ভিজছে। একটা কাক ওকে গতকালের উকিল কাকার কথা মনে পড়িয়ে দিল।
করবী চা নিয়ে ঢুকল। রবিবারে রুবিরই চা করার কথা। রুবিরা খাওয়া দাওয়া সেরেই হসটেলে চলে গিয়েছে। রুবিরই তাড়া ছিল বেশি।
‘বাবা, আসি।’ রুবি সহজভাবেই তার থেকে বিদায় নেবার চেষ্টা করেছে।
রুবিকে বুকে টেনে নেবার, তার কপালে চুমু খাবার একটা প্রবল বাসনা শীতলের জেগেছিল। শীতল সামলে নিয়েছিল। রুবিকে বুকে ধরতে শীতলের কেমন বাধো বাধো ঠেকল। এই প্রথম।
শীতল শুধু বলল, ‘শরীরের যত্ন নিয়ো।’
রুবিও যেন স্বস্তি পেয়েছিল। করবীও এসেছিল সে সময়। করবীকে দেখেই বদলে গেল রুবি। মুহূর্তে সে পুরনো রুবি হয়ে উঠল।
‘তুই কিন্তু আমার হসটেলে যাসনি ভোম্বল। জয়ন্তরা খ্যাপারে। আর গেলেও, উচ্ছ্বসিত রুবি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল, ‘আমি তোর সঙ্গে দেখা করব না।
রুবি বেরিয়ে গিয়েছিল।
করবী শীতলের ঘরে। শীতলের মুখের দিকে চেয়ে ছিল। স্থির হয়ে
করবী শীতলের মুখের দিকে চেয়ে কী যেন খুঁজছে সেখানে। শীতল তার দিকে চোখ তুলতেই করবী বলল, ‘চা।’
শীতল বলল, ‘এবার দোতলাটা তাড়াতাড়ি তুলে ফেলতে হয় করবী।’
‘দোতলা?’ করবী কিছুই বুঝতে পারল না। শীতলের টেবিলে সে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখল। ‘কিসের দোতলা?
করবীর প্রশ্ন শুনে শীতল হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর করবীর বিমূঢ় মুখের দিকে চেয়ে অপ্রস্তুত শীতল একটু হাসল। কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিল।
একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আজ একটা ভাবনা মাথায় এল।
শীতল চায়ে চুমুক দিল। চায়ের দিকে চোখ রেখেই বলল, ‘তুমি ঢোকবার আগেই ভাবছিলাম।’ শীতলের খেই হারিয়ে গেল। শীতল বিব্রত হয়ে উঠল। সে চুপ করে চায়ে চুমুক দিতে লাগল। কী ভাবছিলাম আমি? উকিল কাকার কথা। কাল উকিল কাকা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বিয়ে থা হয়েছে? যোগীনকে বিস্মিত করে সে জবাব দিয়েছিল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
‘কী ভাবছিলে?’ করবী জিজ্ঞেস করল। ছেলেপুলে আছে? উকিল কাকার প্রশ্ন।
‘তেমন কিছু নয় করবী। যত সব এলোমেলো কথা।’ শীতল স্পষ্টতই এখন পিছু হটছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ। এক মেয়ে।
‘দোতলার কথা কী বলছিলে? করবী জিজ্ঞেস করল।
‘দোতলা? ওঃ দোতলা।’ শীতলের মনে পড়ল। ‘তুমি চা খাবে না করবী? তোমার চা কোথায়?
শীতলের কথাবার্তার ধরনে করবীর উদ্বেগ বেড়ে গেল। শীতলকে সে বুঝতে পারছে না। শীতল আর করবী, এই প্রথম মুখোমুখি হল। এতদিন ওদের মাঝখানে ছিল রুবি। আজ রুবির আড়াল সরে গিয়েছে। শীতল কি তাকে কিছু গোপন করতে চাইছে? শীতল কি তাকে মেনে নিতে পারছে না? শীতল কি ভাবছে রুবিকে এ বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছে করবী?
‘বলতে না চাও বোলো না। আমি তো শুনতে চাইনি। কথাটা তুমিই তুলেছিলে। করবী থেমে থেমে কথাগুলো বলল।
শীতল বিপন্ন হয়ে উঠল। কেন সে কথাটা তুলল? এখন কী বলবে করবীকে? করবী, এ বাড়ির দোতলাটা এবার তুলে ফেলা ভাল।
কেন?
তা হলে তুমি একতলায় একটা ভাল ভাড়াটে বসাতে পারবে।
ভাড়াটে বসাব! কেন?
বাঃ। না হলে তুমি একা এ বাড়িতে থাকবে কী করে?
আমি তো একা-একাই সারাদিন থাকি। তুমি থাকো না। রুবি কলেজে চলে
যায়। তখন কে থাকে আমার কাছে?
কিন্তু রুবি তো আর এখন কলেজ থেকে ফিরে আসবে না। রাত্তিরে তুমি একা এ বাড়িতে কী করে থাকবে?
রাত্তিরে আমি একা থাকব! কেন?
কেন?
এই প্রশ্নের কী জবাব দেবে শীতল?
‘করবী! শীতল কাতরভাবে বলল, ‘আমি একটু চা খাব করবী।’
করবী উঠে যেতেই শীতল একটু স্বস্তি পেল।
সে করবীর শূন্যস্থানটাকে লক্ষ করে এবার অনেক সহজেই বলতে পারল, আমাকে এবার যে চলে যেতে হবে করবী।
কোথায় যাবে শীতল? প্রশ্নটা শীতল নিজেকেই করল।
শমি সিনহার কাছে। উত্তরটাও সে নিজেই দিল।
শমি সিনহার কাছে? পেয়িং গেস্ট?
এখানে আমি কী শীতল?
শীতল নিরুত্তর।
না, আর না। অনেকক্ষণ পরে শীতলের মন আবার ক্রিয়াশীল হয়ে উঠল। আর শুধু ভেসে যাওয়া নয়। এবার সিদ্ধান্ত একটা নিতে হবে। এবার থেকে নিজের সিদ্ধান্তে চলতে হবে।
শীতল পিছন ফিরে চাইল। কেবলই স্রোতের টানে ভেসে চলার ইতিহাস। তাকে পরিবার থেকে টেনে এনেছে মা। তাকে অনিলের সংসারে হাতে ধরে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে চক্কোত্তিদা। এখানে তাকে টেনে রেখেছিল রুবি। শমির কাছে তাকে পৌঁছে দিয়েছে জব্সন। উকিল কাকার বাড়িতে তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে যোগীন। আর সে? শীতল? স্রোতের শ্যাওলার মতো ঘাট থেকে ঘাটে গিয়ে ঠেকেছে। এই তার জীবনের ইতিহাস। জীবনটা কার? শীতলের? তার ভূমিকা কী? শুধু ভেসে চলা। চলা নয়, চালিত হওয়া।
এক লহমায় নিজের জীবনটাকে দেখে নিয়ে শীতল স্তম্ভিত হয়ে গেল। সে কি সাবালক নয়? সে কি মানুষ নয়? মানুষের কাজ কি জীবনভর শুধু অন্যের ইচ্ছায় চালিত হওয়া? শীতলের ভয় হতে লাগল। করবীর এই সংসারটাকে, তার এই জীবনটাকে, তার এতদিনের অভ্যাসকে, তার তৃপ্তিবোধকে শীতলের এখন সূক্ষ্ম একটা মাকড়শার ভয়াবহ জাল বলে মনে হতে লাগল।
শমিকে তার ভাল লেগেছে এই জন্য যে, সে নিজের ইচ্ছেয় চলতে শিখেছে। শমি তার জন্য ঝুঁকি নিয়েছে যথেষ্ট। শমি অসুখী। শমি সুখ কেনবার জন্য তার স্বাতন্ত্র্যবোধকে বাজারে বেচে দেয়নি। শমি তার মায়ের মতো।
করবী চা নিয়ে ঢুকল।
কিন্তু করবীর কী হবে?
শীতলের এতক্ষণের সব বিচার করবীর মুখের দিকে চাইতেই এলোমেলো হয়ে গেল। শমির কাউকে তেমন দরকার হয় না। কিন্তু শীতলকে ছাড়া করবীর চলবে কী করে? করবীকে এখন ছেড়ে যাওয়া কি অমানুষের মতো কাজ হবে না?
শীতলের কেমন মায়া হল। অন্ধ আবেগ তার মনের মধ্যে তোলপাড় করে উঠল।
‘করবী, তোমার চা?
শীতলের গলার স্বরে এমন একটা আন্তরিক স্নিগ্ধতা ফুটে উঠল যা করবীর শরীরটাকে কাঁপিয়ে দিল।
‘এটা তো আমাদের চা খাবার সময়। এসো না, একসঙ্গেই চা খাই।’
করবী কাপটা শীতলের সামনে রেখে বলল, ‘আমারটা আনছি।’
‘জানো করবী, রুবি কলেজে ভর্তি হবার পর, এই রবিবারটাই শুধু আমাদের নিজেদের ছিল, শীতল স্বপ্নের ভিতর ঢুকে গেল, ‘এই দিনটার জন্য আমি সারা সপ্তাহ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম। সকাল থেকে রাত। রুবি আর তুমি। কী হুল্লোড়টাই না হত!’
একটা দীর্ঘশ্বাস শীতলের বুক ঠেলে বেরিয়ে এল।
‘কিছুই থাকে না করবী! ‘
.
৪
বৃষ্টির ছাঁট এবার শীতলের ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল। গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে উঠল। রুবির ঘরের জানালাগুলো খোলা নেই তো? করবী ভাবল, একবার ওঠে। দেখে আসে। কিন্তু উঠতে তার ইচ্ছে করল না। অন্যদিন হলে এই রকম বৃষ্টিতে রুবির কথা ভাবত। এটা তার কলেজ থেকে ফেরার সময়। রুবি আজ হসটেলে। ওর কথা ভাবছে না করবী। সে ভাবছিল রুবির চলে যাওয়াটা কীভাবে নিতে পারছে শীতল। রুবিকে যে শীতলের জন্যই যেতে হল তা কি সে বুঝতে পেরেছে? ওর ভাব দেখে তো মনে হয় না। কতকগুলো বিষয়ে শীতল একেবারে সরল। বালকের যতটুকু বোধবুদ্ধি থাকে, শীতলের তাও আছে কি? রুবি যে বড় হয়ে গেছে সে কথা সে এখনও বুঝেছে কি না সন্দেহ। তবে রুবি আর কিছুদিন থাকলে একটা দারুণ কিছু হয়ে যেত। সে বিষয়ে ভুল নেই। করবীর ঘুম হত না চিন্তায়। রুবি মেয়ে, তাই সে সর্বনাশের আভাস আগেই পেয়ে গিয়েছিল। সেই দিন থেকেই হসটেলে যাবার জন্য ছটফট করছিল রুবি। রুবিও কষ্ট পাচ্ছে খুব। শীতলকে ছেড়ে থাকা তার পক্ষে যে কী কঠিন কাজ করবী তা জানে।
আঙুলে ছুঁচের খোঁচা লাগতেই করবী সেলাই থেকে মুখ তুলল। বৃষ্টির অঝোর ধারায় বাইরেটা ঝাপসা হয়ে এসেছে। করবী আনমনা হয়ে গেল। শীতলের বুকে মুখ গুঁজে রুবি ‘বাবা বাবা করে কাতরাচ্ছে। শীতলের চোখে-মুখে ক্ষিধে জেগে উঠেছে। ছবিটা চট করে তার চোখে ফুটে উঠেই আবার তক্ষুনি মিলিয়ে গেল। আর তক্ষুনি বুকের ভিতর কুট করে একটা কামড় খেল করবী। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জা এসে তাকে ধাক্কা দিল। সে আবার সেলাই-এ মন দিল।
মাথার উপর পাখাটা ঘুরে উঠল।
শীতল বলল, ‘কারেনট এল।’
সে উঠে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে দিল।
‘তুমি অন্ধকারে দেখতে পাও করবী? আমার তো পড়তে এখন দিনের বেলাতেও চশমা লাগে।’
আলো জ্বলতেই করবী কেমন অস্বস্তি বোধ করতে থাকল। চোখের কোণ দিয়ে দেখল শীতল একমনে বৃষ্টি দেখছে।
রুবির কথা ভাবছে শীতল?
‘জয়ন্তটা বেশ ছেলে, না করবী?’
‘একেবারে ছেলেমানুষ, করবী দাঁত দিয়ে সুতো কাটল।
‘দুজনে খুবই বন্ধু।’
শীতল এগিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরাল। বসল চেয়ারে। করবীর খুব কাছে। করবীর অস্বস্তি হতে লাগল।
‘মনে নেই করবী? সেই ফারসট ইয়ার থেকে রুবি বলে আসছে, জয়ন্ত এই, জয়ন্ত সেই। জয়ন্ত এই করেছে, জয়ন্ত সেই করেছে। বলেনি তোমাকে? আমার তো কানের পোকা নড়িয়ে দিত রুবি।
শীতলের এখনকার এই উৎসাহ করবীর অস্বস্তিকে বাড়িয়েই তুলল। ঠিক বুঝতে পারছিল না শীতল কোন দিকে যেতে চাইছে।
‘কোনও কোনও লোকের ভাগ্যই এমন থাকে, জানো করবী, যে যেখানেই থাক না কেন বোঝা বইবার লোক তার জুটে যাবেই।
‘তোমাকে খুব জ্বালিয়েছে রুবি। সেই প্রথম দিন থেকেই।
‘তোমাকেও।’
‘আমাকে আর কী জ্বালাল? তোমার কোলে পিঠেই না ও মানুষ। তুমিই ওর মা।’
‘না। আমি ওর বাবা।’
করবীর কানের ডগা গরম হয়ে উঠল। এই রকমই কিছু একটা আশঙ্কা করছিল সে।
‘প্রথম প্রথম তুমি কেমন রেগে উঠতে। আমিও খুব লজ্জা পেতাম। তুমি ওকে ধমকাতে। আমি বলতাম, এইটুকু মেয়ে বলছে, বলতে দিন না। আমি তোমাকে আপনি বলতাম তখন।’
মেয়েটা ভারী পাজি। করবী আনমনা হয়ে গেল। বরাবরই পাকা পাকা ভাব। একবার ইস্কুল থেকে মাথায় জেদ নিয়ে বাড়ি ফিরল রুবি। আমার কোনও বন্ধুর বাবা মা আপনি আপনি করে না। সবাই তুমি বলে। তবে তোমরা কেন আপনি আপনি করো? আবার এসব কথা খাবার টেবিলে বলা চাই। শীতলকেও সাক্ষী মানা চাই। কী রে ভোম্বল, মাকে তুমি বলতে পারিসনে? শীতলও অদ্ভুত। সঙ্গে সঙ্গে বলে দিল আমার আর অসুবিধে কী? তোমার মায়ের যদি আপত্তি না থাকে তা হলেই হল।
শীতল হাসল। বলল, ‘রুবিই কিন্তু আমাদের আপনি আপনি ছাড়িয়েছে।
‘এর মধ্যে তোমার হাত কি কিছুই ছিল না?’ করবীর মুখ দিয়ে হঠাৎ কথাটা এমনভাবে বেরিয়ে যাবে, করবী নিজেই ভাবেনি।
‘আমার হাত? না করবী, কিছুই ছিল না। তুমি বিশ্বাস করো।’
‘আমার এক সময় ধারণা হয়েছিল, তুমিই যে রুবির বাবা এই বিশ্বাসটা তুমিই ওর মাথায় ঢুকিয়েছ।’
‘তোমার ধারণা ভুল করবী।’
করবী দেখল শীতলের চোখ দুটো ব্যথায় টনটন করছে।
‘রুবি ভাল করেই জানত, আমি রুবির সত্যিকারের বাবা নই।
‘হ্যাঁ আমি ওকে বলেছিলাম সে কথা।’
‘হ্যাঁ করবী, তুমি বলেছিলে। কিন্তু রুবি সে কথা বিশ্বাস করেনি।’
‘বিশ্বাস করেনি?’
‘না করবী, করেনি। তারপর যখন ওর বুঝবার বয়েস হল তখন আমি ওকে বললাম তোমার মা তোমাকে যা বলেছিলেন রুবি, তা-ই ঠিক। তোমার বাবা, তুমি যখন খুব ছোট্ট, তখন মারা গিয়েছেন। আমি তোমার বাবা নই।’
‘তুমি ওকে এ কথা বলেছ? করবী যেন অথৈ জলে গিয়ে পড়ল।
‘না বলে উপায় কী করবী?’
‘কেন?’
‘রুবির স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপ করতে হবে তো?’
করবী নিথর হয়ে বসে রইল। শীতলও চুপ। সিগারেট টানতে লাগল। করবীর চোখে আরেকটা ছবি ভেসে উঠল। একটা ভোরের ছবি। বাথরুম থেকে ফিরছে করবী। শীতল ঘুমুচ্ছে। রুবি তার শিয়রে হাঁটু গেড়ে বসে। রুবির কীরকম একটা উত্তেজিত চেহারা। যেন নিশিতে ধরা মেয়ে। চোখ দুটো তার অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। নাক ফুলে ফুলে উঠছে। ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে। মুখ নিচু করে শীতলের ঠোঁটে রুবি তার ঠোঁট ঠেকাল। আর তারপরই রুবি চমকে জেগে উঠল। শীতলের চুল ধরে টানছে আর ডাকছে ভোম্বল ভোম্বল। ওঠ। চা। একেবারে স্বাভাবিক রুবি। তার পরেই তো করবী রুবিকে হসটেলে পাঠাতে অত জোর করেছিল। রুবি জানত শীতল তার বাবা নয়!
‘আমাদের একটা সিক্রেট প্যাক্ট হয়েছিল করবী। আমার আর রুবির মধ্যে।
‘সিক্রেট প্যাকট্?’
‘তোমার সামনে রুবি কখনওই আমাকে বাবা বলে ডাকবে না। তোমার আড়ালে বলবে, এই প্যাকট্। আজ রুবি সে চুক্তি ভাঙল। তোমার সামনেই বলে গেল, বাবা আসি।’
‘রুবি আজ আমাকেও একটা কথা বলেছে শীতল। করবী কথাটা না শুনিয়ে পারল না।’
করবীর মুখে ‘শীতল’ শুনে শীতল চমকে করবীর মুখের দিকে চাইল। করবীর চোখ দুটো টলটলে হয়ে উঠেছে। শীতল দেখল নিজেকে সামলাতে করবীকে কী পরিশ্রমই না করতে হচ্ছে।
‘রুবি বলল, মা, ভোম্বল আমাদের জন্য সব দিয়েছে। আমরা ওকে কিছুই দিইনি।’
করবী আঁচল দিয়ে মুখটা একবার মুছে নিল।
‘রুবির খুব বুদ্ধি করবী। রুবিই এই জগতে আমার বড় বন্ধু ছিল। কেন জানো?’
করবী কথা বলতে পারল না। মাথা নাড়ল শুধু।
‘রুবির মতো আমিও আমার বাবাকে হারিয়েছি সেই কোন ছেলে বয়সে। এইটাই ছিল আমাদের বড় বন্ধন। আজ তা ঢুকল।
‘চুকল!’ করবী চমকে উঠে শীতলের দিকে চাইল।
‘হ্যাঁ করবী, চুকল। রুবিই চুকিয়ে দেবার জন্য ছটফট করছিল। কেন, জানো?’
করবী বিস্ফারিত চোখে একটা সাংঘাতিক কিছু শোনবার জন্য অপেক্ষা করে রইল।
‘সর্বনাশের আভাস রুবিই আগে টের পেয়েছিল। বলেছি না করবী, ওর খুব বুদ্ধি।’
রুবির বুদ্ধির জন্য শীতল যেন গর্বিত বোধ করল।
‘আমি পরে জেনেছি।
‘কখন জানলে?’ করবী যেন নিশ্চিন্ত হতে চায়।
‘পরশু রাতে করবী।’ শীতলের স্বর খুব করুণ হয়ে এল। ‘রুবি যখন আমার ঘরে এল। আমি অসহায় হয়ে পড়েছিলাম করবী। আর একেবারে উন্মাদ। আমাকে আর রুবিকে বাঁচাবার কোনও ক্ষমতাই তখন আমার ছিল না। বাঁচিয়ে দিলে তুমি।
‘আমি!’
‘হ্যাঁ করবী তুমি। তুমি যদি দরজায় এসে না দাঁড়াতে—’
শীতল দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। সে তখন ভয়ে কাঁপছিল।
‘না শীতল, তুমি ঠিক বুঝতে পারোনি।’
করবীর এই স্পষ্ট দৃঢ় গলার স্বরে শীতল মুখ তুলে চাইল।
‘আমি সবটা দেখেছি বলেই বলছি। তোমাদের দেখে মনে হচ্ছিল তোমরা যেন হাবুডুবু খাচ্ছ। তোমরা যেন ডুবতে চলেছ, কিন্তু তোমাদের চেষ্টা ছিল বাঁচবার দিকে।
‘এটা কি সান্ত্বনা করবী?
‘না।’
‘কিন্তু কিছুই বাঁচেনি করবী। রুবির আর আমার মধ্যে এতদিন ধরে যা কিছু আমরা তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলাম তার সব কিছু ভরাডুবি হয়ে গেছে। আমি আর রুবি, আমরা দুজনেই আজ জ্ঞানী হয়ে উঠেছি। রুবি আর কোনওদিন বাবা বলে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না। রুবি যে আমার রুবি নয়, সে যে নারী, আমি তাও কোনওদিন ভুলতে পারব না।