চার
১
আজ একটু বিশেষভাবে সেজে এসেছিল শমি। কোথাও কোনও বাহুল্য ছিল না। তবে বৈশিষ্ট্য ছিল। নিপুণ কৌশলে সে তার যা কিছু আকর্ষণ সবটুকু ফুটিয়ে নিয়ে বের হয়েছিল। আজকেই ওরা দুজন ওদের নতুন পার্টির সঙ্গে প্রথম দেখা করল। আড়াই ঘন্টা ধরে কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা হল দু পক্ষে। শমির মুখ দেখে শীতলের মনে হল ফলাফলে শমি খুশিই হয়েছে। এয়ার কনডিশন করা ঘর থেকে পথে এসে যখন দাঁড়াল ওরা, তখন শমির ঘড়িতে সাড়ে বারোটা এবং পথে খাঁ খাঁ রোদ্দুর। শমিই বেশি ঘামছিল।
‘প্রথম দিনের পক্ষে প্রগ্রেস খুব খারাপ নয়। কী বলেন?’ ছোট্ট রুমালটা মুখের কাছে ঘোরাতে ঘোরাতে শমি বলল। ‘মোহন দত্ত আপনার কথাবার্তায় বেশ ইমপ্রেসড হয়েছেন।
‘আমি আর কী করলাম।’ শীতল অবাক হল। ‘যা করবার আপনিই তো করলেন। আমি যে এসব ব্যাপারে কত কাঁচা তারই বরং প্রমাণ দিয়ে এলাম।’
‘মোহন জেনে গেলেন আপনি শুধু বুদ্ধিমান নন, শমি মুখে কপালে রুমালটা ঘন ঘন চেপে ধরতে লাগল, ‘আপনার অনেসটি আছে।’
হঠাৎ শমি ‘ট্যাকসি বলে এগিয়ে গেল। ট্যাকসি দাঁড়াল না। বিরক্ত হল শমি। ‘লানচ আওয়ার শুরু হল। ট্যাকসি পাওয়া ইমপসিবল।’
এদিক ওদিক চাইতে লাগল শমি। শীতল কাছে এসে দাঁড়াল
শমিকে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কী মনে হয়, আমাকে দিয়ে কি চলবে?’
‘আপনার কী মনে হয়?’
শীতল উত্তর দিল না।
শমি বলল, ‘পিনটু হলে এ-কথা জিজ্ঞেস করত না। বিশেষত কোনও ফিমেল কলিগকে। এই ট্যাকসি।’
একটা ট্যাকসি দাঁড়াল!
দরজা খুলে উঠে পড়ল শমি। শীতলও।
‘কোথায়?’ শমির প্রশ্নে শীতল তার দিকে চাইল।
ড্রাইভারও মিটার ডাউন করে চাইল ওদের দিকে।
শমি নিশ্চিন্ত মনে এবার বলল, ‘এখন আমরা সারা কলকাতার মালিক। কোথায় গিয়ে লানচ খাব বলুন।’
শীতল অনেক দিন সিনেমা দেখেনি। তার মনে হল, সে যেন এখন সেইরকম একটা-কিছু দেখছে।
‘হাঁ করে চেয়ে আছেন কেন? আমি খুব একটা সুখাদ্য নই।’ শমি খুব হাল্কা হয়ে উঠেছে। ‘কোথায় যেতে চান?’
শীতল বলল, ‘আপনি যে বললেন আপনার একটা অ্যাপয়েনটমেনট আছে?’
‘সে তো মিঃ দত্তকে। ওটা আমাদের একটা স্ট্যানডার্ড প্র্যাকটিস।’ শমি হাসল।
‘দত্ত জেনে গেলেন আমি একজন প্রো।’
‘প্রো?’
‘প্রোফেশন্যাল।’ শমি বলল, ‘ওঁর লানচের নেমন্তন্ন বলা মাত্র অ্যাকসেপট করলে উনি আমাকে চিপ ভাবতেন। যদি আমি ওকে পালটা নেমন্তন্ন করতাম তা হলে সেটা ওর ইগোতে লাগত। আমাদের কেস খারাপ হয়ে যেত। বুঝেছেন?’
‘বুঝেছি।’
‘কী বুঝলেন?’
‘ওটা আপনার ইউ এস পি।’
‘ইউ এস পি?’ শমি শীতলের মুখের দিকে চাইল।
‘ইউনিক সেলিং পয়েনট।’
শমি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ‘আপনার হবে। একেবারে লাইনে এসে গেছেন। এই জন্যেই বলছিলাম না, দত্তের কাছে আপনার মতো মানুষই অ্যাকসেপটে হবে। হি লাইকড ইউ। বলুন কোথায় যাব?’
‘অফিস।’
‘অফিস। কেন?’
শীতল বলল, ‘যোগীনের সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে। ও বেরিয়ে যাবার আগেই ওকে ধরতে হবে।’
শমি হতাশার ভঙ্গি করে ড্রাইভারকে অফিসের রাস্তা বলে দিল।
‘আপনি একটা যা তা।’ শমি শান্তভাবে তার ঘাড় কপাল মুখ ভিজে রুমালটা দিয়ে মুছতে শুরু করল।
গাড়ি থামতেই শীতল ‘আচ্ছা যাই’ বলে ট্যাকসির দরজা খুলেই লম্বা পায়ে অফিসে ঢুকে পড়ল। শমি ভাড়া মেটাতে মেটাতে শীতলের দিকে চাইল। তারপর সে নিজের ঘরে ঢুকে চেয়ারের উপর শ্রান্ত দেহটা এলিয়ে দিল। ওদের নতুন ঘরের সাজসজ্জা সোমবারের আগে সম্পূর্ণ হবে না। আপাতত এই ছোট ঘরেই সে আর শীতল। দুটো সাদা কাক।
সাদা কাক!
শীতলের উপমাটা খুব মনে লেগেছে শমির। কাল রাতে থেকে থেকেই কথাটা ঘুরপাক খেয়েছে তার মনে। শীতল আর সে দুজনেই সাদা কাক। তাই দুজনেই কাল ঠোকর খেয়েছে অফিসে। এই উপমাটাই কাল শমিকে শীতলের খুব কাছে এনে দিয়েছিল। কিন্তু এখন সে ভাবছে এই পুরুষের জগতে শীতল কেন সাদা কাক হতে যাবে? শীতলও তো পুরুষ। শীতলের মাকে নিশ্চয়ই সাদা কাক বলা যায়। কারণ তিনি মেয়ে।
আজকের ঘটনাই ধরা যাক। আজ তাদের নতুন ক্লায়েনটের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। সকাল থেকেই শমি একটু নারভাস ছিল। তার প্রধান চিন্তা ছিল সে কীভাবে কাজ করবে তা-ই। কেননা মোহনকে ইমপ্রেস করতেই হবে। শমি চোখ বুজে নিজেকে ড্রেসিং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। শুধু ব্রা আর সায়া পরা। বিছানার উপর কয়েকটা শাড়ি ছড়ানো। পাশে পাট-করা বিভিন্ন রঙের কয়েকটা ব্লাউজ। ড্রেসিং টেবিলে বিভিন্ন শেডের নানা পেনসিল। কোনটা ঠোঁটে কোনটা ভুরুতে ঘষার। আজ কোন রঙের শাড়ির সঙ্গে কোন রঙের ব্লাউজ ম্যাচ করবে, আবার তার সঙ্গে ম্যাচ করবে পেনসিলের রং, শুধু এই ভাবনায় সকালের সময়টা তার নষ্ট হয়েছে। খুব সতর্কভাবে তার আকর্ষণকে জোরদার করে তোলবার জন্য কতগুলো সিগারেট পোড়াতে হয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের অ্যাশট্রেটায় স্তূপীকৃত পোড়া সিগারেট তার চোখে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে ভেসে উঠতে লাগল। অ্যাশট্রেটা যেন শ্মশানের চুল্লি। সিগারেটগুলো যেন পোড়া পোড়া কাঠ। তার আত্মমর্যাদাকে যেন দাহ করেছে শমি অফিসে বেরুবার আগে। কেন? সে মেয়ে। কই শীতলকে তো দত্তকে ইমপ্রেস করার জন্য শরীরটাকে ডালায় সাজিয়ে নিয়ে বের হতে হয়নি? জসন তো শীতলের ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিকস নিয়ে মাথা ঘামায়নি? কেন না শীতল পুরুষ।
আজ মোহন দত্তকে ওরা ইমপ্রেস করে এসেছে। অতএব এই অ্যাকাউনট ওদের থাকবে। শমি হাত গুনতে পারে না, কিন্তু পুরুষকে সে পড়তে পারে। মোহন দত্ত শমির শরীরে মোলায়েম চোখ বুলিয়ে শীতলকে বোঝাবার জন্য যখন বারবার ‘পেনিট্রেশন’
‘পেনিট্রেশন’ করছিল তখনই শমি বুঝে নিয়েছে এই কমিউনিকেশন ইনডাসট্রির অ্যাকাউনট তাদের হাতে এসে গিয়েছে।
‘কমিউনিকেশন ইনডাসট্রি।’ শীতল বেরুবার মুখে শমির মুখে কথাটা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়েছিল। ‘আপনি যে বললেন, আমাদের ক্লায়েনট খবরের কাগজ?’
শীতল একেবারে ছেলেমানুষের মতো সরল, না সত্যিকারের একটি ঘুঘু? এখনও শমি বুঝতে পারছে না।
শমি বলেছিল, ‘পিতা আদমের যুগে যাকে খবরের কাগজ বলা হত একালে তাকেই কমিউনিকেশন ইনডাসট্রি বলে। চলুন চলুন আরও অনেক কিছু শুনবেন।
সত্যিই চিফ মার্কেটিং একজিকিউটিভের মুখে শীতল আজ অনেক নতুন কথা শুনেছে। যদিও শমি আজকাল কমার্শিয়াল জগতের এই সব শাব্দিক উদগারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। মোহন দত্তকে আজ ওরা দুজনেই খুশি করতে পেরেছে। শমি তার চেহারার বাহার দিয়ে মোহনের যৌন অনুভূতিকে একটু চুমরে দিয়েছে। আর শীতল? তার আপাত আনাড়িপনা দিয়ে মোহনের ইগোকে তৃপ্ত করেছে। কিন্তু এখানেও দুজনের মধ্যে কত তফাত। শমিকে ডালায় সাজিয়ে নিয়ে বেরুতে হয়েছে তার শরীরের আকর্ষণীয় সবগুলো উপকরণ। সে যেন তপসে মাছ ফেরি করে এইমাত্র ফিরল। শরীর-সর্বস্বতার বাইরে এসে তাকে তার বোধবুদ্ধির মূল্যে কি প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া হবে না? কেন হবে না? এই সব সময়ে একটা অকারণ রাগে শমি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এই সব সময়ে খুব ক্লান্ত মনে হয় শমির। তার সামনে যেন অপার সমুদ্র, একা তাকে সাঁতার কেটে পাড়ি দিতে হচ্ছে। আর কোনও বিকল্প নেই তার। এইসব সময়ে তার একজনকে বন্ধু পেতে ইচ্ছে হয়। শমি খুঁজতে লাগল। তার কলেজ ইউনিভারসিটি জীবনের সহপাঠিনীরা কেউ আর মানুষ নেই, সব উদ্ভিদ হয়ে গেছে। মানুষের বুদ্ধি থাকে অনুভূতি থাকে। উদ্ভিদের শুধু অনুভূতি। মানুষ গতিশীল। সে থামতে জানে না। উদ্ভিদ শিকড় গাড়ে। মানুষ বুদ্ধিতাড়িত জীব, সে সন্তুষ্ট হতে জানে না। উদ্ভিদ শিকড় গজাবার অনুকূল পরিবেশ পেলেই তুষ্ট। শমি তার সব সহপাঠিনীকে একে একে দেখল। সবাই এখন বোটানিক্যাল গারডেনের নানান ধরনের লেবেল মারা টবে শিকড় গজিয়ে ফুলে ফলে বাহারি পাতায় বাগান আলো করে বসে আছে। ইনি মা। উনি মিসেস। মাতা জায়া ভগিনী কন্যা। এক এক টবে এক এক জন। মানুষ কেউ নয়। কারও উদ্দেশ্য নেই গতি নেই ইচ্ছা নেই সংঘাত নেই সংগ্রাম নেই। সারে জলে পুষ্ট হওয়া সব একান্ত উদ্ভিদ। শমির গা গুলিয়ে উঠল। সে-ই একমাত্র মেয়ে ওই মানুষের জগতে, কিংবা আরও কেউ হয়তো থাকতে পারে সে জানে না, যে মানুষ হিসাবে তার পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। তাই এত নাকানি চুবানি খেতে হচ্ছে তাকে। জিতু তাকে জোর করে টবে পুঁততে চেয়েছিল। ছিটকে বেরিয়ে এসেছে শমি।
কিন্তু যাকে সে মানুষের জগৎ ভেবেছিল, এখন প্রতি পদে বুঝতে পারছে শমি সেটা একটা নিষ্ঠুর অনুভূতিহীন বলদর্শী পুরুষের জগৎ। অথবা এটা মানুষেরই জগৎ। পুরুষেরা নিছক দৈহিক বলের দ্বারা এই মানুষের জগৎটাকে সাম্রাজ্যবাদীর মতো দখল করে রেখে দিয়েছে। এখানে যা কিছু মানবিক, ধর্ম, সাহিত্য, সঙ্গীত শিল্পকলা, সংস্কৃতি ভাবনা-ধারণা, মায় ভাষা শব্দ ক্রিয়াকর্ম পর্যন্ত পুরুষের নির্বঢ় স্বত্ব চিরস্থায়ী করার দিকে চোখ রেখে সৃষ্টি করা হয়েছে, অথবা পুরুষের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সে সব বিকৃত করা হয়েছে। এই জগতে শমি, শমিই সাদা কাক। শীতল তা নয়। সেও পুরুষই।
তবুও শীতলকে তার ঠিক জিতু পিনটুর মতো মনে হয়নি। অবিশ্যি কাল কতটুকুই বা শীতলকে বুঝতে পেরেছে শমি। শীতল এ অফিসের দীর্ঘদিনের কেরানি শমি তা জানে। তাই পরশু বাড়ি যাবার আগে বস্ যখন তাকে ডেকে বললেন, তিনি একজন জিনিয়াসকে খুঁজে বের করেছেন এই অফিসে, কনসালটারট ফার্মের কমপিউটার ইভ্যালুয়েশন পদ্ধতি যাকে ফাইভ স্টার বলে বেছে দিয়েছে, সে এই অফিসেই কর্তার আমল থেকে কেরানি হিসাবে রট করছিল, তার নাম শীতল সরকার, তাকে তিনি উইথ ইমিডিয়েট এফেকট শমিদের বিভাগে এনে দিচ্ছেন, এবং নতুন অ্যাকাউনট হ্যানডুল করার জন্য তাকে শমির পার্টনার করে দিয়েছেন তখন শমি তা বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছিল। সে শীতলকে একটু চিনতও। একবার একটা পুরনো অ্যাকাউনট চুকিয়ে দেবার ব্যাপারে শমিকে শীতলের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। শীতলের শান্ত সংযত কর্মদক্ষতা তার ভাল লেগেছিল। সে জানত শীতল অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাজ করে। পিনটু ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে ওকে জ্বালাচ্ছিল। তাই তাকে জব্দ করার জন্য শীতলের সঙ্গে তেমন পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও পিনটুকে শুনিয়ে শুনিয়ে শীতলের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে কথা বলেছিল। ফল যা আশা করেছিল শমি, তা-ই হয়েছিল। পিনটু একেবারে আসে। ওয়ান এগেনসট দ্য আদার। একটা পুরুষের বিরুদ্ধে আরেকটা পুরুষকে লেলিয়ে দাও, এই হচ্ছে শমির রণনীতি। কিন্তু কাল শীতলের সঙ্গে কথা বলে শমির মনে হয়েছিল লোকটা সংবেদনশীল। বিবেচনা-সম্পন্ন। বন্ধু হিসাবে এমন একটা লোক পেলে মন্দ হয় না। কিন্তু শীতলকেই বা সে তার উদ্ধারকর্তা ভাবছে কেন? উদ্ধারকর্তা। ননসেনস।
এমন একটা অদ্ভুত ধারণা শমির মনে এল দেখে সে নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে উঠল। শমি কি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে? তাই এখন তার হিন্দি ফিলমের হিরোইন সাজবার সাধ গজাচ্ছে মনে?
এক ধাক্কায় শমি নিজেকে জাগিয়ে তুলল। এতক্ষণ পরে সিগারেট খাবার ইচ্ছে হল তার। একটা সিগারেট ধরিয়ে সে যেন নিজেকে ফিরে পেল। ফিরে এল তার নিজের সত্তায়।
হিন্দি ফিলমের হিরোইন?
রসালো গোলালো এক চিরকেলে অবলা। জীবনে যার একটাই মাত্র কাজ—ধর্ষণোদ্যত এক পুরুষের, ভিলেনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারস্বরে ‘মুঝে বচাও, মুঝে বচাও’ চিৎকার তুলে সারা ফিলম দাপিয়ে বেড়িয়ে পরিশেষে উদ্ধারকর্তা এক পুরুষের, হিরোর, গলায় গিয়ে ঝুলে পড়া। বলাই বাহুল্য, সেখানে আমাদের রূপসী হিরোইনের জন্য পরিপাটি করে পাতা আছে একটা ফুল-বিছানা। মেয়েদের পারমানেনট অ্যাড্রেস।
পুরুষের লেখা মেয়েদের জন্য
হিন্দি ফিলমের সব চাইতে লোভনীয় নারী-চরিত্রের এই হচ্ছে ছাঁচে-ঢালাই চেহারা। এবং এই হচ্ছে তার গন্তব্যস্থল। পুরুষের বিছানা। উপাখ্যান, পুরষের লেখা চিত্রনাট্য, পুরুষের দেওয়া ডিরেকশান। পুরুষেরা শুধু এই একটি ভূমিকা বেছে রেখেছে।
শুধু হিন্দি ফিলমেই নয় শমি, বাস্তব জীবনেও তোমার জন্য এই ভূমিকা বরাদ্দ। টেক ইট অর কুইট। হয় এটা মেনে নাও নয় কেটে পড়ো। তোমার সামনে শুধু এই বিকল্প আছে।
শমি সিগারেট শেষ না করেই অ্যাশট্রেতে টিপে দিল।
এই যে শমি, স্ক্রিপটটা দ্যাখো।
না না। শমি দু হাতের তালুতে মুখ গুজে ফেলল।
পড়ো শমি, পড়ো।
না না।
তুমি স্টার শমি। তুমিই সে চিরন্তন অবলা। তোমার সুন্দর মুখের, তোমার নিটোল বুকের, তোমার শরীরের সেকস অ্যাপিলের, সমস্ত উৎসের ক্লোজ আপ আছে এই চিত্রনাট্যে। দ্যাখো স্ক্রিপটটা পড়ো।
না না।
ইউ আর কোয়াইট এ ডিশ শমি।
না না।
না! হোয়াট ডু ইউ মিন বাই না? তুমি কি জানো না বস্ তোমাকে কত ফেভার করেন?
জানি।
তবে? তিনি কি তোমার সব কমপিটিটারকে ওভাররাইড করে নতুন অ্যাকাউনটটা তোমাকে দেননি?
দিয়েছেন। কেন না শীতলের দক্ষতা সম্পর্কে তিনি ওভার সিওর।
কিন্তু বিশ্বের প্রথম হিউমাপিউটারের মা হবার গৌরব? কমপিউটারকে দেহদানের প্রথম সুযোগ? এটা তিনি কাকে অফার করেছেন? তোমাকে নয়?
হ্যাঁ। আমি শীতনকে সে-কথা বলেছি। শীতল প্রচণ্ড রেগে উঠেছিল। উঃ সে কী ভায়োলেনস! আমি কিছুতেই তা ভুলতে পারছি না।
কিন্তু পিনটু শুনলে কী বলত?
একটা অশ্লীল মন্তব্য করত। বড় জোর বস্তাপচা একটা স্মার্ট জোক আমাকে উপহার দিত। হয়তো বলত হ্যাপি ড্রিম শমি। আমি শিগগিরই নিজেকে কমপিউটারে চেনজ করে ফেলছি। এ কমপিউটার উইথ এ রিয়েল হিউম্যান কক। এই তো পিনটুর বিদ্যেবুদ্ধির দৌড়। ভাবে ইংরাজিতে বললেই বোধ হয় সব বোকামি রসিকতা হয়ে ওঠে।
কিন্তু শীতল অত রেগে গেল কেন?
এই প্রশ্নের মুখে শমি থমকে গেল। সহসা সে কোনও উত্তর খুঁজে পেল না। সে কেমন বিভ্রান্ত বোধ করতে লাগল। মুখ তুলে ফাঁকা ঘরখানার দিকে টালুমালু চাইতে লাগল। অবশেষে একটা সিগারেট ধরাল।
উত্তর দাও। শীতল হঠাৎ খ্যাপার মত দপ করে রেগে উঠল কেন?
আমি জানিনে। কাল থেকে ভাবছি। একটা কথাই শুধু ভাবছি। কিন্তু প্রাণ ধরে তা বিশ্বাস করতে পারছিনে। তাই তো আজ ওকে লানচে নিয়ে যেতে চাইছিলাম। ভেবেছিলাম সংশয়টা মিটিয়ে নেব। কিন্তু শীতলকে তো পাওয়াই গেল না। আমাকে এড়িয়ে গেল কি না কে জানে?
শমি ওর লাইটারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল।
আমার হিউমিলিয়েশনে শীতলের রাগ হবার হেতু কী? বস্-এর ওই রকম একটা অপমানজনক প্রস্তাবে তার গালে তক্ষুনি একটা থাপ্পড় মারা আমার উচিত ছিল। তা না মেরে যে অপমান আমি হজম করলাম সেই অপমান শীতলের গায়ে জ্বালা ধরাল, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? না সবটাই আমার কল্পনার সৃষ্টি? এটাই আমাকে জানতে হবে।
কিন্তু এর তো আরও ব্যাখ্যা থাকা সম্ভব শমি।
কী ব্যাখ্যা?
সব চাইতে সহজ ব্যাখ্যা যেটা তা এই। পিনটু জিতুদের সম্পর্কে তোমার মোহভঙ্গ সম্পূর্ণ হয়েছে। তুমি দেখেছ শীতল ওদের মত নয়। তাই তোমার শীতলের মত একটা অবলম্বন দরকার হয়ে পড়েছে।
শীতল অনেক বেশি ম্যাচিওর।
শীতল একটা ছাপোষা সাধারণ কেরানি ছাড়া কিচ্ছু নয়।
শীতল অনেক সোবার।
এই বয়সের লোককে বাইরে থেকে অনেক সময় এ রকম মনে হতে পারে।
শীতল অনেক নির্ভরযোগ্য।
এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ তোমার হাতে নেই।
শীতল একটা মূল্যবোধে বিশ্বাস করে।
শীতল একটা বুদ্ধু।
শীতল ওপর-চালাক নয়।
শমি, তোমার স্ক্রিপট আমি পড়ে ফেলেছি। এটাও আদতে সেই হিন্দি ফিলমের স্ক্রিপট শমি।
হিন্দি ফিলমের স্ক্রিপট?
হ্যাঁ। আধুনিক শহরের একটা ক্লান্ত ওয়ারকিং গার্ল এর নায়িকা। শহুরেপনা যার ভিলেন। গ্রাম্য সরলতা যার হিরো। আর হিরোইন সেই চিরন্তন এক ড্যামজেল ইন ডিসট্রেস। অফিসে চাকুরিরত এক মেয়ে নিঃসঙ্গতা থেকে, প্রাত্যহিক গ্লানির হাত থেকে, মুক্তি পেতে চাইছে শমি। বয়স্ক এক নায়ক এখানে তোমার সেই বিপন্না নায়িকার উদ্ধারকর্তা। খুব কাঁচা গল্প।
কাঁচা গল্প?
হ্যাঁ শমি, তা-ই। একেবারে অবাস্তব এক ইচ্ছাপূরণের কাহিনী।
একেবারে অবাস্তব?
একেবারে অবাস্তব? আমাদের জীবনে কোনও কিছুর থেকেই আমাদের মুক্তি নেই। আমাদের উদ্ধার করার জন্য স্বর্গ মর্ত পাতালে কোথাও কোনও ত্রাণকর্তা নেই।
কোথাও নেই?
নেই শমি। নেই।
.
২
যোগীনের ঘরে লোক ছিল। শীতল ভাবল চলে যায়। যোগীন তাকে পাশের
ঘরে বসতে বলল।
বলরাম, যোগীনের দফতরে এক ক্লাস থ্রি, তাকে যত্ন করে বসাল।
বলরাম বলল, ইউনিয়ন। কোমপানির সঙ্গে নতুন করে লেখাপড়া হচ্ছে। সই হয়ে গেছে, এখন এগ্রিমেনট ক বছরের জন্য হবে, তিন বছর না পাঁচ বছর, তাই নিয়ে হ্যাঁচকা-হেঁচকি।
বলরামকে শীতল চেনে।
বলল, ‘তা হলে কিছু পাওয়া যাবে, কী বলো?’
বলরাম হাসল। ‘তাতে আপনার কী স্যর?’
স্যর! বলরাম বেশ শিষ্টতা দুরস্ত। ক’দিন আগে হলে সে দাদা বলত।
‘অফিসাররা ইউনিয়নের বাইরে।’ বলরাম একটা ফাইল ওলটাতে ওলটাতে বলল, ‘আমিই তো স্যর আপনার চিঠিখানা টাইপ করলুম।’
বলরাম পকেট থেকে সুপুরি বের করে মুখে পুরে দিল। এয়ার কনডিশনে এসে শীতল বেশ আরাম বোধ করছিল। শমির সঙ্গে লানচটা খেয়ে এলেই বোধ হয় ভাল হত।
কিন্তু যোগীনের সঙ্গে তার দরকার আরও জরুরি। তার প্রভিডেনট ফানড গ্র্যাচুইটির ব্যবস্থা সে করেই ফেলতে চায়। কিন্তু তার জন্য এত তাড়াই বা কেন? যোগীন কিছু পালিয়ে যাচ্ছে না। টিফিনের পরে এলেও হত। না, তখন শমির সঙ্গে সে কাজে থাকবে। তখন ওঠা যেত না। সে যোগীনের ঘর থেকে একবার ঘুরে আসতে চায়। শমি জিজ্ঞেস করত, কেন?
এ-কথা সে জানতে চাইতেই পারে। কী জবাব দিত শীতল। করবীর ব্যাপারটা এত গোলমেলে যে, অল্প কথায় ব্যাখ্যাও করা যায় না।
তার নিজের কাছেই কি ব্যাপারটা পরিষ্কার? না। মোটেই না। করবী কে? এই প্রশ্নের একটিই নির্ভুল উত্তর শীতলের জানা। করবী রুবির মা। এই উত্তর মেলাতে কোনওই অসুবিধে নেই। কিন্তু করবী শীতলের কে? এ প্রশ্নের কী উত্তর? শীতল বোবা। কেন না এ প্রশ্নের উত্তর নেই।
তবে আপনি আমাকে মিথ্যে কথা বলছিলেন কেন? শমি বলতে পারে। আপনি ওকে আমার কাছে আপনার মিসেস বলে পরিচয় দিয়েছিলেন কেন?
আমি? না, কক্ষনো না।
ইউ আর এ লায়ার। আপনি আমাকে বলেছেন। আপনার মিসেস আছে। আপনার এক মেয়ে আছে।
আর আপনি বলেছিলেন ছোট পরিবার সুখী পরিবার।
এখন তো দেখছি বেশ মনে পড়ছে। ইউ আর এ চিট।
কিন্তু কথাটা দেখছি আপনারই মনে নেই। আপনিই আমাকে টেলিফোনে জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনাদের বাড়িতে মিসেস ছাড়া আর কে আছেন? প্রশ্নটা আমি করিনি।
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি তার উত্তরে বলেছিলেন, আর এক মেয়ে।
হ্যাঁ, যা সত্যি তা-ই বলেছি। ও বাড়িতে করবী রুবি আর আমি-আমরা এই তিনজনই থাকি। করবীরই বাড়ি ওটা।
কে করবী?
করবী রুবির মা?
আপনি ওদের কে?
রুবি আমাকে বাবা বলে। খুব ছোট বয়সে রুবির বাবা মারা যায়।
আপনার এই হেঁয়ালি আমি কিছুই বুঝতে পারছিনে।
পারার কথাও নয় শমি। তবে আমি যা বলছি তার সবটাই সত্য।
যোগীনের ঘর থেকে ইউনিয়নের লোকেরা রেরিয়ে যেতেই যোগীন ওকে ডাকল।
শীতল সামনের একটা চেয়ারে বসতেই যোগীন বলল, ‘আয়, দুজনে দুটো সিগারেট ধরিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ গুষ্টিসুখ উপভোগ করি। ত
সিগারেট ধরিয়ে যোগীন বলল, ‘গুষ্টিসুখ কথাটা কার মুখে শুনি তোর মনে আছে?’
শীতল হাসল। বলল, ‘সৈয়দ মুজতবা আলির মুখে।
যোগীন বলল, ‘কোনও কোনও লোকের কিছু কিছু কথা বোধহয় সর্বদাই বেঁচে থাকে।
শীতল এবার চুপ করে সিগারেট টানতে লাগল।
যোগীন বলল, ‘নে বল, কী বলবি?’
শীতল বলল, ‘দ্যাখ হঠাৎ আমার মনে পড়ল আমার গ্র্যাচুইটি কি প্রভিডেনট ফানডের নমিনি করিনি।’
‘সে কী রে।’ যোগীন বেল টিপতেই বলরাম ঢুকল। ‘দ্যাখো তো এর প্রভিডেনট ফানড গ্র্যাচুইটির নমিনেশন অরডারে আছে কি না?’
বলরাম একটু পরেই শীতলের ফাইলটা এনে যোগীনের সামনে খুলে রেখে দিল।
‘না স্যর, নমিনি করা নেই।’
যোগীন বলল, ‘নে তবে করে ফ্যাল।’
‘এই ব্যাপারেই তোর একুট পরামর্শ চাই।’
যোগীন বলল, ‘কী পরামর্শ?
শীতল বলল, ‘ধর, আমি এমন কাউকে আমার নমিনি করতে চাই, যার সঙ্গে আমার কোনওদিক থেকেই কোনও সম্পর্ক নেই, তারপর ধর, রিটায়ার করার আগে যদি মারা যাই আর আমার রক্তের সম্পর্কের নিকটাত্মীয় কেউ এসে যদি দাবি তোলে, তা হলে আমি যাকে নমিনি করলাম টাকাটা সে পাবে কি না? তোদের আইন কী বলে সেইটে আমাকে বলে দে।’
যোগীন বলল, ‘দেখতে হবে। ওহে, প্রভিডেনট ফানড গ্র্যাচুইটির অ্যাকট দুটো আন তো।
বলরাম বেরিয়ে যেতেই যোগীন বলল, ‘পাঁয়তারা তো হল। কাকে নমিনি করতে চাস এখন তা-ই বল তো।’
শীতল সোজাসুজি বলল, ‘অনিলের বউকে!
বলরাম দুখানা বই নিয়ে যোগীনের সামনে রাখতেই যোগীন বলল, ‘শোনো, এখন আর আমার কোনও দরকার নেই। তুমি বরং খেয়ে এসো।’
‘স্যর, আপনার জন্য কিছু আনব?’
যোগীন জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে ধোসা টোসা খেতে চাস?’ শীতল বলল, ‘মন্দ কী।’
বলরামের হাতে টাকা দিতে দিতে যোগীন বলল, ‘তা হলে আমাদের জন্য দুটো মসলা ধোসা এনো। তাড়াহুড়োর দরকার নেই। বুঝেছ?’
ঘাড় নেড়ে বলরাম চলে গেল। যোগীন প্রথমে গ্র্যাচুইটি অ্যাকটের পাতা ওল্টাতে লাগল। এক জায়গায় এসে বলল, ‘নমিনেশন… নমিনি… হ্যাঁ, এই যে।’
শীতল হঠাৎ খুব নারভাস হয়ে পড়ল। যেন অন্য কোনও রকম রায় দিয়ে দেবে যোগীন। বলবে, না শীতল, হয় না। তার বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। সে কী করবে বুঝতে না পেরে একটা নতুন সিগারেট ধরাল।
যোগীন বলল, ‘আনম্যারেড এমপ্লয়ি যাকে ইচ্ছে নমিনি করতে পারে। এনি পারসন বলে গ্র্যাচুইটি অ্যাকটে বলা আছে।
শীতলের বুক থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে ওর বুকে খচ করে একটা খোঁচা লাগল। করবীকে সে অনিলের বউ বলল কেন?
বা রে। করবীকে না হলে যোগীন চিনবে কী করে?
একটা কৈফিয়ত খাড়া করে তুলল বটে শীতল, কিন্তু তাতে তার মনের খচখচানি গেল না। আইনের বয়ানে এনি পারসন বলতে যা বোঝায় করবী কি তার কাছে তা-ই। শীতলের কেমন যেন মনে হতে লাগল, সে করবীর প্রতি নিষ্ঠুরের মতো আচরণ করেছে। করবী কি তার এনি পারসন্?
যোগীন শব্দ করে প্রভিডেনট ফানড অ্যাকট অ্যামেনডমেনটস অ্যানড ইনটারপ্রিটেশনস-এর মোটা বইখানা বন্ধ করে বলল, ‘নে, তোর সমস্যা মিটল। এখানেও সেই একই বয়ান। কাজেই তুই এবার নিশ্চিন্তমনে শ্রীমতী করবী গাঙ্গুলিকে তোর নমিনি করে দে। আজই করে দিয়ে যা।’
শীতল চমকে উঠল।
‘করবীর নাম তোর মনে আছে?’
যোগীন বলল, ‘তা থাকবে না কেন? এখন বলরাম যা তখন তো আমি এই ডিপারমেন্টে তা-ই। ইন ফ্যাকট অনিল গাঙ্গুলির পাওনাগণ্ডা তার বিধবার হাতে তুলে দেওয়ার ব্যাপারটাতেই আমার হাতে খড়ি। চক্কোত্তিদা আমাকে প্রায় পাগলা করে ছেড়েছিলেন।’
শীতলকে যোগীন যেন চাবকে দিল। না না যোগীন নয় যোগীন নয়, করবী। করবীকে সে কিনা অনায়াসে অনিলের বউ বলে দিল। শীতলের মুখে আটকাল না। একটা ক্ষতকে শীতল যেন আঁচড়ে দিয়েছে। তার প্রচণ্ড যন্ত্রণায় শীতল অস্থির হয়ে উঠল।
‘আচ্ছা শীতল, যোগীন একটা সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই মিত্তির অ্যান্ড ডাটসন বলে কোনও ফারমের নাম শুনেছিস?’
‘আবার সন?’ শীতল ক্লান্ত স্বরে জবাব দিল। ‘এক জবসনের ঠ্যালাতেই অস্থির।’
‘কেন জবসন তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে?’
মই নয়, বামবু দিয়েছে আমাকে। শীতল রাগে ফেটে পড়ল। আমার এতদিনকার সব কিছু একেবারে তচনচ করে দিয়েছে। তার সব রাগ জবসনের উপরে গিয়ে পড়ল।
শীতলকে নিরুত্তর দেখে যোগীন জিজ্ঞেস করল, ‘জটাই মিত্তির বলে কাউকে চিনিস?’
শীতল যোগীনের দিকে একবার ফ্যালফ্যাল করে চাইল। জটাই মিত্তির? নামটা ওকে ঘা মারছে কেন?
‘মিত্তির অ্যান্ড ডাটসন হচ্ছে একটা অ্যাটর্নি ফার্ম। আমি ওদের কিছু কাজ করি। যোগীন বলল, ‘জটাই মিত্তির ওই ফার্মের মালিক। ওঁর ছেলে হাবুল আমার বন্ধু।’
জটাই মিত্তির? নামটা শীতলের মাথায় ক্রমাগত গুঁতো মারছে।
‘আচ্ছা, পাথুরেঘাটায় তোদের কেউ থাকে?
উকিল কাকা! যোগীন পাথুরেঘাটার নাম করতেই শীতলের মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে উঠল। জটাই। জটাধর মিত্র। শীতলের গলা বুক শুকিয়ে কাঠ।
শীতলকে এতদিনে খুঁজে পেয়েছে ওরা। প্রচণ্ড ভয়ে কুঁকড়ে গেল শীতল। মাকে ওরা পথে বসিয়েছিল। এবার করবী রুবিকে ওরা পথে বসাবে। এবার পালাতে চাইল শীতল। পারল না।
তুই তোর বাবার মতই আয়েসি শীতল। এত ঝক্কি তোর পোষাবে না। শুধু ক’টা দিন সবুর কর।
কলকাতায় দরিদ্রতম এক হাসপাতালের ফ্রি বেডের পূতিগন্ধে শীতলের পেট গুলিয়ে উঠল। ওয়াক ওয়াক। মায়ের পাশের বেডে এক পেসনটের মুখ দিয়ে বড় একটা ক্রিমি বমির সঙ্গে বেরুল। বিছানায় পড়ে সেটা কিলবিল করছে।
ওদিকে তাকাসনি শীতল। মা এখন নাকি সুরে কথা বলে। গলার জোর আর কিছুই নেই। আমাকে পুড়িয়ে টুড়িয়ে শ্রাদ্ধটা সেরে তুই ও বাড়ি চলে যাস। সুখে থাকবি।
‘তোর ফাইলটা আগে আমি দেখিনি’ যোগীন বলল। ‘আজ দেখলাম। দেখে মনে হল ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও আমরা কত কম চিনি। তুই যে শীতলচরণ তা আমি আজ জানলাম। আমার ধারণা ছিল তুই শীতলচন্দ্র। তোরা যে ঘোষ সরকার তাও তো তোর ফাইলটায় নজর না পড়লে এখন জানতে পারতাম না। আশ্চর্য। আমার ধারণা ছিল তুই সরকার।
কেমন একটা ছমছম ভয়ে শীতলের শরীরে মাঝে মাঝে কাঁটা দিচ্ছে। সে চুপ করে বসে আছে। সতর্কভাবে লক্ষ করে যাচ্ছে যোগীনের প্রত্যেকটি কাজ। যোগীনের কাছে এ ব্যাপারে পরামর্শ নিতে আসাটা উচিত হয়েছে কি না সে বুঝতেও পারছে না।
‘তোর বাবার নাম তো দেখলাম শিবচরণ।’
তাতে কি কোনও অপরাধ হয়েছে যোগীন? আমার বাবা শিবচরণ, সেই কারণে আমি কি করবীকে আমার নমিনি করতে পারব না? যোগীন কী বলতে চায়? কী করতেই বা চায় সে? একটা ব্যাপার তো পরিষ্কার বুঝতে পারছে শীতল যে, যোগীন তার পুরো পরিচয়টা উদ্ঘাটিত করতে চাইছে।
যোগীন শীতলের দিকে চোখ রেখে বলল, ‘তুই শীতলচরণ, তোর পিতা স্বর্গত শিবচরণ, এবং তোরা ঘোষ সরকার। এতগুলো জিনিস একসঙ্গে মিলে যাওয়াটা নিছক একটা দৈব ঘটনা হতে পারে না।’
‘যোগীন তোর মতলব কী, খুলে বল তো?’ শীতলের গলা চিরে এমন একটা শুকনো আওয়াজ বের হল যাতে শুধু যোগীনই নয় শীতল নিজেও চমকে উঠল। গলাটা পরিষ্কার করবার জন্য শীতল বার বার কাশতে লাগল।
‘কোনও কুমতলব নেই তা বলতে পারি।’ যোগীন হাসল। তারপর আবহাওয়াটা হালকা করার জন্য ঠাট্টা করে বলল, ‘ধরে নিতে পারিস আমি এখন ব্যোমকেশের মতো সত্যান্বেষণে ব্যাপৃত। তোর উপরেই হাত পাকাতে শুরু করেছি। কী, কো-অপারেট করবি তো?’
যোগীন এমনভাবে কথাটা বলল যে, শীতলের মনের মেঘ অনেকটা কেটে গেল। ‘কেন, শীতল ম্লান হেসে যেন আত্মসমর্পণ করল, ‘আমি কি ফেরারি আসামি?’ যোগীন হাসতে হাসতে বলল, ‘আসামি কি না জানিনে। তুমি সেই লোক কি না তাও জানিনে। তবে একজন ফেরারি লোকের সন্ধানেই আমরা আছি বটে। নে, সিগারেট ধরা।’
‘গোয়েন্দাদের সিগারেটে শুনেছি এমন সব আরক মেশানো থাকে যা ধোঁয়ার সঙ্গে পেটে ঢুকলে সন্দেহভাজন ব্যক্তির পেটের কথা টেনে বের করে আনে। অতএব সত্যান্বেষীর সিগারেট খেয়ে আমার দরকার নেই। আমি আমারটা খাই। তুইও বরং এটা ট্রাই করে দ্যাখ।’
শীতল অনেকটা সামলে নিয়েছে। সে প্যাকেটটা যোগীনের দিকে এগিয়ে দিল। নিজে একটা ধরাল।
যোগীন কথা বলতে গিয়ে দেখে শীতল হঠাৎ আনমনা হয়ে গিয়েছে। তার ঠোঁটে বিচিত্র একটা হাসি খেলে বেড়াচ্ছে। যোগীন চুপ করে রইল।
শীতল বলল, ‘কোইনসিডেনসকে একেবারে উড়িয়ে দিস নে যোগীন। পরশু সন্ধ্যায় শমি সিনহা ফোনে আমার সঙ্গে কথা কইছিলেন। তখন লোডশেডিং হয়েছে। তাই শুনে তিনি বলে বসলেন এই অন্ধকারে অফিসে বসে কী করছেন? অফিসের সিকরেট পাচার করছেন না কি? তার মানে তার চোখে আমি এক সাসপেকট। আবার সেই অফিসেই আজ, এখন, সেই আমাকেই আরেকজন অফিসারের সামনে সাসপেকট হয়ে বসে থাকতে হয়েছে। এটাকে কী বলবি?’
যোগীন হাসল।’তোর বরাত। আর কী বলব।’
‘নে। এবারে তা হলে তোর সত্যান্বেষণ শুরু কর। বরাতে কী আছে দেখি।’
যোগীনের বেয়ারা দুটো প্লেটে দুজনকে মসলা ধোসা সাজিয়ে দিয়ে গেল। আর জল। যোগীন তাকে বলল, ‘বলরামকে বল, এখন ঘরে যেন কেউ না ঢোকে।’
ধোসা খেতে খেতে যোগীন বলল, ‘মিত্তির অ্যান্ড ডাটসন অ্যাটর্নি ফার্মের জটাই মিত্তির কিছুদিন ধরে একজন ফেরারি লোককে খুঁজছেন। তার মা ছোটবেলায় তাকে নিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।
যোগীনের কথা শুরু হতে না হতে শীতল অনুভব করল তার প্রত্যেকটি স্নায়ু যেন অত্যন্ত সজাগ হয়ে যোগীনের কথাগুলো শুনছে। এমন কি, যোগীন যে ‘পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান’ বলল, ‘বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান বলল না, সেটাও লক্ষ করল।
‘তারপর থেকে তাদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।’ যোগীন যেন ছেদ টেনে দিল। ‘এই হল কাহিনী। বা ঘটনা।
এবার জল খেল যোগীন। মুখ মুছল। তারপর সিগারেট ধরাল।
যোগীন বলল, ‘জটাই মিত্তির এখন সেই লোকটিকে চাইছেন। যে কোনও লোক প্রমাণ সহ যদি কয়েকটা শর্ত পূরণ করতে পারে তা হলে জটাই মিত্তির তাকে সেই লোক হিসাবে মেনে নেবেন।’
শীতলের খাওয়া শেষ হল। জল খেল গেলাস উপুড় করে। সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিল। শীতল প্রথম দিকে অত ভয় পেয়েছিল কেন?
শীতল শান্তভাবে ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘শর্তগুলো কী?’
‘যথা, যোগীন বলল, ‘তার নাম শীতলচরণ হতে হবে। তাকে স্বর্গত শিবচরণের ঔরসে এবং স্বর্গতা অথবা জীবিতা হিরণ্যপ্রভা ওরফে আশালতা ওরফে লাবু নাম্নী কোনও রমণীর গর্ভে জন্ম নিতে হবে। তার কৌলিক পদবি ঘোষ সরকার হতে হবে। এবং তাকে পাথুরিয়াঘাটার ঘোষ সরকার পরিবারের পৈতৃক ভদ্রাসন শিবালয়ে বাংলা সন ১৩৪২-এর ২০ আশ্বিন বৃহস্পতিবার দিবা ৯। ২৬। ৩৯-এ বৃশ্চিক রাশি বিপ্রবর্ণ দেবগণ অষ্টোত্তরি বিংশোত্তরী মতে শনির দশায় ভূমিষ্ঠ হতে হবে। সব মুখস্থ হয়ে আছে। দেখছিস তো।’
যোগীন দেখল শীতলের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। ওর মনে একটা প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে যেন। সে চুপ করে গেল। যেন শীতলকে সামলে নেবার জন্য সে সময় দিচ্ছে তাকে।
একটা গোটা সিগারেট শেষ করতে করতে শীতল সামলে নিল নিজেকে।
ক্লান্ত স্বরে শীতল জিজ্ঞেস করল, ‘এতদিন পরে এরা লোকটিকে চাইছেন কেন?
যোগীন বলল, ‘জয়েন্ট ফ্যামিলি এতদিনে ভেঙেছে। পারটিশন হবে। শীতলচরণ একজন আইনসঙ্গত শরিক।’
হঠাৎ শীতল যেন এক ঝটকায় নিজেকে গুছিয়ে নিল।
বলল, ‘আমি এক শীতলচরণ ঘোষ সরকার বটে। আমার পিতার নাম শিবচরণ এবং মাতার নাম হিরণ্যপ্রভা ওরফে আশালতাও বটে, লাবু কিনা মনে নেই। তবে আমার জন্ম তারিখ ম্যাট্রিকুলেশন সারটিফিকেট অনুসারে ১৯৩৪ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর। তারিখ কত মনে নেই। অফিসে থাকা সম্ভব। হ্যাঁ পাথুরেঘাটায় কোনও এক শিবালয়ের বাসিন্দা শিবকিংকরদের সঙ্গে আমার মা মামলা করে গিয়েছেন।’
শীতল থামল। যোগীন লক্ষ্য করল শীতলের চোখ মুখ হঠাৎ অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
শীতল বলে উঠল, ‘কিন্তু ওরা আমার ধরা-ছোঁয়া পাবে না।’
‘কেন?’ যোগীন সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল।
‘আমি যে সেই শীতলচরণ, তোমার জটাধর তা প্রমাণ করবেন কী দিয়ে? সমস্ত প্রমাণ আমি মায়ের সঙ্গে তার চিতায় তুলে দিয়েছি।’
হা হা করে শীতল হেসে উঠল। তারপর হঠাৎ আবার চুপ করে গেল। তুমি ভেবো না করবী। শীতল তাকে সাহস দিতে লাগল, জটাধর আমাকে তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। তোমার হয়ে আমি লড়ে যাব। তোমাদের ফেলে আমি পালাব না করবী। দেখছ তো মাকে ফেলে আমি পালাইনি।
আর তক্ষুনি শীতলের জরুরি কথাটা মনে পড়ে গেল।
‘যোগীন, করবীর ব্যাপারটা মিটিয়ে দে। যদি আমার কিছু করবার থাকে করে চলে যাই।’
‘করবীর ব্যাপার?’ যোগীন প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারল না। তার পরই তার মনে পড়ল। ‘ওঃ নমিনি। নো প্রবলেম। এক্ষুনি হয়ে যাবে।’
যোগীন বেল টিপল। বলরাম ঢুকল।
যোগীন বলল, ‘এর নমিনেশনটা ঠিকঠাক করে দাও।’
বলরাম শীতলকে বলল, ‘নমিনির নামটা বলুন স্যার।’
বলরাম নোটবুক পেন্সিল উচিয়ে খাড়া।
শীতল ধীর ভাবে বলল, ‘করবী গাঙ্গুলি।’
‘রিলেশন স্যর?’
শীতল কিছু বলবার আগেই যোগীন বলল, ‘এখন ওটা ফাঁকা রেখে দাও।’ যোগীনের মুখের দিকে শীতল চাইল। না, কথাটা সহজভাবেই বলেছে যোগীন। ‘এ ব্যাপারে, বলরামকে লক্ষ করে যোগীন বলল, ‘আইনের কথাটা যখন এই রকম যে, এমপ্লয়ি যেখানে ম্যারেড নয়, শুনে রাখো হে, ম্যারেড নয়, হি ক্যান নমিনেট এনি পারসন, তখন আর রিলেশনের ব্যাপারটার এই সব কেস-এ আর গুরুত্ব রইল না। যাও, সব তৈরি করে নিয়ে এসো।’
বলরাম চলে যেতেই শীতলও উঠল।
যোগীন বলল, ‘উঠছিস কি, বোস। ঝামেলাটা চুকিয়ে দিয়ে যা। একটা সই লাগবে।
শীতল অপ্রস্তুত হয়ে বসে পড়ল। যোগীন একটা সিগারেট এগিয়ে দিল। শীতল বিনাবাক্যব্যয়ে ধরাল সেটা। দুজনেই চুপ।
যোগীনই প্রথম মুখ খুলল।
‘একটা কথা বুঝতে পারছি না শীতল, তুই ওগুলো সব পুড়িয়ে ফেলতে গেলি কেন?
শীতল কথাটা ঠিক ধরতে পারল না। যোগীনের কথায় বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী আবার পুড়িয়ে ফেললাম?’
‘জরুরি কাগজপত্রগুলি।
সে কি আজকের কথা! তখন আমি কত ছেলেমানুষ। আমার বি-এ পরীক্ষার রেজাল্টই তখন বেরোয়নি। মা মারা গেল। মাথার উপর কেউ নেই। দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা। কী ভেবে কী করেছি তা কি জানি। তা ছাড়া অত সব কাগজপত্তর রাখতামই বা কোথায়? নিজের মাথা গোঁজবার ঠাঁই ছিল না, তা ছাড়া ওসব রেখেই বা কি চতুর্বর্গ ফল লাভ হত? শীতল এসব কথা যোগীনকে বলতে পারত। বলল না। কিছুক্ষণ ধরে সিগারেটের ধোঁয়ার এলোমেলো গতিবিধিই লক্ষ করে যাচ্ছিল।
‘ওসব কথা আমি কখনও ভাবিনি যোগীন।’ যা সত্য, শীতল তা-ই বলল। ‘আমি হয়ত ঠিক জানিওনে কেন ওসব পুড়িয়েছি।’ শীতলের স্বরে এক নৈর্ব্যক্তিক বিষণ্ণতা।
‘তবে’—শীতল মাঝপথে থেমে গেল। সে কিছু ভাবছে। এক মনে সিগারেট টানছে।
‘তবে?’ যোগীন জিজ্ঞেস করল।
‘এখন একটা কথা মনে হচ্ছে যোগীন।’ শীতল যোগীনের দিকে বিপন্নভাবে চাইল। ‘জানিনে সেটাও ঠিক কি না।’
শীতলের কানে এখন কোনও শব্দ ঢুকছে না কেন? যোগীনের ঠোঁট দুটো নড়তে দেখে শীতল বুঝল সে কিছু বলতে চাইছে। বলরাম ঢুকল। সে তাকে দেখল। কিন্তু কোনও আওয়াজ পেল না। বলরাম ফাইলটা তার সামনে রাখল। যোগীন তাকে কী বলল। বলরাম চলে গেল। ওরা কি এখন মূকাভিনয় শুরু করল না কি? না শীতলই কালা হয়ে গেল হঠাৎ? না সে তো কালা নয়। তার কানে চিতার আগুনের একটা জোরালো শব্দ সে তো শুনছে।
‘আমার এখন মনে হচ্ছে যোগীন,’ আগুনের গনগন গনগন আওয়াজ, মাঝে মাঝে কাঠের চটপট চটপট শব্দ, এ সব ছাপিয়ে শীতল তার নিরুত্তাপ গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে, ‘আমি বোধহয় আমার মাকে তার চিতা-শয্যায় আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলাম।’
‘বোধহয় তাকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলাম যে, তাকে আমি ছেড়ে যাব না।’
কারা যেন খুব দূরে মড়া-কান্না কাঁদছে। কে যেন অস্পষ্ট স্বরে তাকে বলছে, ‘খোকাবাবু কাগজগুলো দলা পাকিয়ে ছুড়ে মারো। না হলে এদিকে ওদিকে উড়ে যাবে যে। জানো না অগ্নির উপরে বায়ুর অধিষ্ঠান।’
শীতল বলছে, ‘আমার উপরে মায়ের কোনও ভরসা ছিল না যোগীন। মা প্রায়ই আমাকে বলত, তুই তোর বাবার মতই আয়েসি শীতল। এ সব ঝক্কি ঝামেলা পোয়ানো তোর কাজ নয়। আমাকে মরতে দে শীতল, ক’টা দিন সবুর কর, তারপর তুই তোদের বাড়ি চলে যাস। সুখে থাকবি। তার আগে আমার পিণ্ডিটা দিয়ে যাস।’ শীতল হাসল। বিষণ্ণতার ছোঁয়া কোথাও নেই তার চোখে মুখে। তার মুখটা এখন বৃষ্টি-ধোয়া পাতার মতো উজ্জ্বল।
শীতল বলছে, ‘পাছে কোনওদিন মার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেলি, তাই সে-পথ বন্ধ করার জন্যই সব দলিল পুড়িয়ে ফেলেছি। মামলার নথি চিঠি ফটো সব কিছু। মা নিজে চোখে সব দেখে গেছে।’
যোগীনের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাইল শীতল। তার কোনও উত্তেজনা নেই।
‘আমি একটুও আবোল তাবোল বকছিনে যোগীন।’ শীতল শাস্ত এবং গম্ভীর। ‘যা বলছি সত্যি।’
শীতল একটু থামল তারপর শুরু করল।
‘আমি গোল্লা পাকিয়ে পাকিয়ে কাগজপত্তর সব আগুনে ছুঁড়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা গোল্লা মায়ের কপালে গিয়ে ঠক করে লাগল। আর তারপরই সেই অসম্ভব কাণ্ডটা ঘটল। হাসপাতালের লোকেরা মায়ের চোখ দুটো বুজিয়ে দিয়েছিল। কাগজের গোলা কপালে লাগবার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চোখ দুটো খুলে গেল। মা পরিষ্কার আমার দিকে চাইল। ডান হাতখানা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। ঠোঁট ফাঁক করে আমাকে কিছু বলতে গেল। মা বলে চেঁচিয়ে আমি মাকে চিতা থেকে তুলতে গেলাম। একটা ডোম ছুটে এসে ‘করছ কী খোকা’ বলে আমাকে ধমক দিল। আমার হাতে এক ভারী বাঁশ ধরিয়ে দিয়ে বলল, বাঁশ মারো, বাঁশ মারো। তারপর আমার অপেক্ষা না রেখে চিতার উপর বাঁশ পেটাতে শুরু করল। মা উঠতে যাচ্ছিল। বাঁশ খেয়ে শুয়ে পড়ল। আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়ল এদিকে ওদিকে। দাউ দাউ করে কাঠ জ্বলে উঠল। মায়ের সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা।
শীতল ঝপ করে থেমে গেল। যোগীন ওর ভাবলেশহীন শাস্ত মুখখানার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। দুজনেই চুপ।
শীতলই কথা বলল, এবার সে শান্ত, ‘মা কি মরেছিল, না কি তাকে জ্যান্ত পোড়ালুম, তাও তো জানিনে।’
যোগীনের এবার অস্বস্তি হতে লাগল। সে সিগারেট ধরাল। দেশলাই ফস করে শব্দ করে উঠতেই শীতল তা শুনতে পেল। যোগীন শীতলের ফাইলটা ফস ফস করে দেখছিল। পাতার খসখসানিও বেশ শুনতে পেল শীতল। তার কান তো ঠিকই আছে। শীতল যেন আশ্বস্ত হল। যোগীন ফাইলটা শীতলের দিকে এগিয়ে দিল।
যোগীন বলল, ‘নে, সই কর।’
শীতল সই করে ফাইলটা ফেরত দিল।
যোগীন এবার একটু ইতস্তত করে বলল, ‘শীতল, হাবুলকে একটা ফোন করি?’
‘হাবুল!’ শীতল অবাক হল।
‘জটাই মিত্তিরের বড় ছেলে।’ যোগীন বলল, ‘ফার্মটা ওই দেখে। ফোনটা করি?’
‘কেন?’ শীতলের কথায় কিছুমাত্র উত্তাপ নেই।
‘ওদের জানিয়ে দিই।’ যোগীন কিছুটা আগ্রহ দেখাল। ‘বলি, ওদের শীতলচরণকে সম্ভবত পাওয়া গেছে।
‘কী হবে?’
‘কী হবে? যোগীন শীতলের প্রশ্নটাই নিজেকে করল যেন। ‘তোর কী হবে জানিনে, তবে ওদের একটা হেডেক হয়ত দূর হবে।’
শীতল হ্যাঁ না কিচ্ছু বলল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি চলি।’
শীতল ধীর পায়ে যোগীনের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যোগীন তার দিকে চেয়ে রইল। তারপর সিগারেটে একটা টান দিয়ে, টেলিফোনের ডায়াল খচ খচ করে ঘোরাতে লাগল।
.
৩
‘না পিনটু, ইউ আর রং। এর মধ্যে আমার কন্সপিরেসি কিচ্ছু নেই। শীতল ইজ নট মাই চয়েস। খোদ বস্ই ওকে বেছে নিয়েছেন।’
শমির বাঁ হাতে ফোন, ডান হাতে সিগারেট।
‘বাজে কথা বোলো না। শীতল ডিড ভেরি ওয়েল। ও ইয়েস। শোনো শোনো, মোহন ইজ এ ভেরি টাফ গাই। গ্লোভ ওকে ট্যাকল করার জন্য সুদর্শনের হাতে এই অ্যাকাউনট ছেড়ে দিয়েছিল। অ্যান্ড ইউ নো সুদর্শন। কেমব্রিজ ঘুরে আসা মাল। তোমার মত কলকাতা শহরের ইংলিশ মিডিয়ামওয়ালা নয়। তা সত্ত্বেও গ্লোভ মোহনকে তুষ্ট করতে পারেনি। শীতল মোহনকে ইমপ্রেস করেছে।’
শমি ব্যাপারটায় খুব মজা পাচ্ছে।
‘আহাহা, সিওর পিন্টু, সিওর। গো অ্যাহেড, আমি শুনছি।’
শমি একটা হিংস্র উল্লাসে সিগারেট টেনে চলেছে। চুপ করে সে পিনটুর কথা শুনছে।
‘আবার কনস্পিরেসি। তুমি কি এখন বামফ্রন্ট সরকারের মিডিয়া কনসালট্যানট হয়েছ? তবে? এত কনস্পিরেসি কনস্পিরেসি করছ কেন?’
‘আজ লানচে কার সঙ্গে ছিলে? বেশ একটু হয়েছে মনে হচ্ছে? মোহনের সঙ্গে? আহ–হা।’
শমি জোরে হেসে উঠল।
‘তাই বলো।’
শমি আবার একটা ধারালো হাসির খোঁচা মারল।
‘এই সামান্য ব্যাপারটা তোমাকে এতটা আপসেট করবে জানলে আমি না হয় বসকে তোমার সম্পর্কে তাঁর ওপিনিয়ান রিভাইজ করার জন্য একটা অনেসট অ্যাটেমপট করতাম।’
শমির গলায় সহানুভূতি ঝরে পড়ল।
‘হোয়াট ডু আই মিন বাই আপসেট? আমি যা জানি তা-ই বলছি, টু ওভারটার। বাংলা মানে উলটাইয়া ফেলা অথবা উলটাইয়া পড়া। টু মেক অর বিকাম ডিরেনজড ফিজিওলজিক্যালি অর্থাৎ দেহ এবং মনকে বিপর্যস্ত করে তোলা অথবা দেহমনে বিপর্যয় ঘটা। সাদা বাংলায় সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করা। প্লিজ ওয়েট পিনটু। আরও আছে। টু ডিসটার্ব টেমপার ডাইজেশান এটসেটরা। বাংলা মানে মেজাজ হজম প্রভৃতি বিগড়াইয়া—অ্যাঁ বুঝে গেছ? পিন্টু তুমি বাংলাও বুঝতে পারছ? জলি গুড।’
শমি প্রচণ্ডভাবে হাসছে। এতক্ষণ সে অবসাদে ডুবে ছিল। এবার সে ভেসে উঠতে চাইছে। পিনটুরা যখন ইচ্ছা তাকে পা দিয়ে মাড়াবে, এ আর হতে দেবে না শামি।
‘না পিনটু সরি, আমি এখন ব্যস্ত। শীতলের সঙ্গে কাজ করছি। শীতল? আছে বৈকি ঘরে? বাঃ, ফোনটা তো তুমিই করলে।’
কট করে কানেকশন ছিন্ন হয়ে গেল। যাক, আজ কিছু দেওয়া গেছে পিনটুকে। রোজ রোজ ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। শীতল তার হাতের একটা মোক্ষম অস্ত্র। শমি ফোন রেখে দিল। শীতল ঘরে ঢুকে শমিকে দেখেই অপ্রস্তুত হল। যেন লেটে অফিসে এসে দেখল হাজরে খাতা নিয়ে বসে আছে শমি। লাল কালির ঢেরা মারবে।
‘কী ব্যাপার? আপনার লানচ হয়ে গেল?’
শমি শীতলকে ঠাণ্ডা চোখে আপাদমস্তক দেখে নিল। শীতল এসে বসল। সত্যিই শমি এখন শীতলের মধ্যে কোনও বিশেষত্বই খুঁজে পেল না। নিতান্তই এক ছাপোষা কেরানি। তা হোক। শীতল তার হাতে অস্ত্র। তাকে যদি এই পুরুষের জগতে সারভাইভ করতে হয় তা হলে শীতলকে দিয়েই পিনটুদের ঠেকাতে হবে। প্লে ওয়ান এগেনসট দ্য আদার। শমি তার রণনীতি ঠিক করে ফেলেছে।
‘লানচ আবার কোথায় হল?’ শমি মোলায়েম ভাবে হাসল। ‘আমি তো ঘরেই বসে আছি। আপনার তো সময় হল না।’
‘সে কী?’ এবার শীতল সত্যিই অপ্রস্তুত হল। ‘আমার জন্য আপনার লানচ হল না!’
এই ধরনের কথা শীতল একেবারে নতুন শুনছে।
‘না ঠিক তা নয়।’ শমি ওজন করে কথা ছাড়ছে। ‘আপনার আর দোষ কী? জরুরি কাজ তো সেরে ফেলাই উচিত। আসলে একা একা—’
শমি হাসল।
‘কেমন যেন টায়ার্ড লাগে। এখন ভাবছি মোহনকে রিফিউজ না করলেই হত।’
‘হ্যাঁ, তা হলে আপনার খাওয়াটা হত।’
শীতল দেখছি কেবল খাওয়াই বোঝে।
‘না সেজন্য নয়।’ শমি একটু থামল। তারপর খুব তাক করে কথাটা ছাড়ল।’পিনটু মোহনের সঙ্গে লানচ খেয়েছে আজ জানেন?’
‘পিন্টু!’
শীতল ব্যাপারটা ধরতে পারল না প্রথমে। কে পিনটু? পরক্ষণেই পিনটু মুখুজ্জের চেহারাটা তার চোখে ভেসে উঠল। শীতল তার অন্যমনস্কতায় একটু লজ্জিত হল।
শীতল শুধরে নেবার জন্য বলল, ‘ও, পিনটু।’
‘পিনটুর হাতে মোহনকে এই সময় ছেড়ে দেওয়াটা বোধহয় ঠিক হল না।’
শমি যেন কত চিন্তিত।
‘পিনটু যেরকম ব্র্যাগ করছিল—’
কথাটা যাতে শীতলের মর্মে গিয়ে ঢোকে তার জন্য শমি একটু সময় দিল। শমি ধীরে-সুস্থে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করল।
শীতলকে বলল, ‘সিগারেট?’
‘না, থ্যাংকস।
শমি সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘বেছে বেছে মোহনের সঙ্গেই বা পিনটুর লানচ খাবার এত গরজ পড়ল কেন।’
‘খেয়েছে তা কী হয়েছে?’ শীতল শমির এত দুশ্চিন্তার কারণ কিছুই বুঝতে পারল না।
শীতলের কি বোধবুদ্ধির কিছুমাত্র বালাই নেই।
‘আপনিও বরং কিছু খেয়ে নিন।’ একটা অস্বস্তি শীতলের মনে খচখচ করছিল। ‘ধোসা খাবেন? মসলা ধোসা?’
শমি শীতলের মুখের দিকে চেয়ে তাকে যেন পড়বার চেষ্টা করল।
বলল, ‘থ্যাংকস।’
শীতল বলল, ‘খাবেন, না খাবেন না? ধন্যবাদ কিসের জন্য?’
শমি বলল, ‘আমার জন্য আপনি বড্ড ভাবছেন কিনা, ধন্যবাদ সেই জন্য।’
শীতল বোকা বনে গেল। শমি ততক্ষণে ফোনটা নিয়ে কানে তুলেছে।
অপারেটারকে শমি বলল, ‘পিনটুকে প্লিজ।’ কানেকশন পেতেই শমি বলল, ‘দ্যাখো পিনটু, মোহনের সঙ্গে তুমি লানচ খেয়েছ, এটাকে কোনও কোনও মহল ভাল চোখে না দেখতে পারেন। তোমার বেনিফিটের জন্যই এটা জানিয়ে রাখলাম।’
শমি এই ব্যাপারে এত বিচলিত বোধ করছে কেন? শমি কেন শীতলকে একটুও টলাতে পারছে না? শমি মনে মনে অস্থির হয়ে উঠতে লাগল।
‘এর মধ্যে আবার শীতলকে টানছ কেন পিনটু? শীতল এসব ব্যাপার গ্রাহ্যই করে না।’
হঠাৎ ওর নাম নিয়ে টানাটানি শুরু হল দেখে শীতল বিব্রত হয়ে উঠল।
‘শীতলের নামে আমার গায়ে ফোস্কা পড়ছে কেন? বিকজ হি ইজ মাই ফ্রেন্ড।’
এবার অন্তত শীতলের শান্ত ভাবটা খসে পড়া উচিত? শমি আড়চোখে শীতলের দিকে একবার চাইল।
‘অফকোরস হি ইজ মাই ফ্রেন্ড। হ্যাঁ। নিশ্চয়ই, কারণ তুমি শীতলকে ভয় পাচ্ছ।’
এ আবার কী শুরু হল? শীতল এসব বিষয়ে এতই অনভ্যস্ত যে, জেগে আছে না স্বপ্ন দেখছে তা-ই বুঝতে পারছে না।
‘না আমি ফ্রি নেই, সরি। না শনিবারেও না। শনিবার রাতে আমি শীতলকে খেতে বলেছি। কোথায় আরার? আমার বাড়িতে।
শীতল কি আমার উপর রেগে যাচ্ছে? শীতলের ইগো কি ফুলে উঠছে না? যা হোক কিছু একটা প্রকাশ করুক শীতল। শীতলের কি কোনও অনুভূতির বালাই নেই?
‘হাউ ডেয়ার ইউ!’
শমির কথাগুলো শীতলের কানে যাচ্ছে কিন্তু মানে বুঝতে পারছে না সে। শমি তাকে খেতে বলেছে? তার বাড়িতে? কখন?
‘আমার বিছানায় আমি কাকে তুলব সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার।’
শীতল দেখল অপমানে শমির মুখ কালো হয়ে উঠেছে। নাক ফুলে উঠেছে। মুখ চোখ লাল। শমি অত ধীর গলায় প্রত্যেকটি কথা অত স্পষ্ট করে উচ্চারণ করছে কী করে তাই ভেবে বিস্মিত হল শীতল।
‘দ্যাটস নান অফ ইয়োর বিজনেস। তুমি নিজের চরকায় তেল দাও। আর শোনো, তোমার চরকার তেল ফুরিয়ে এসেছে পিনটু। আগাম খবরটা দিয়ে রাখলাম, চেক্ আপ করে দেখতে পারো। হোয়াই ডোন্ট ইউ ট্রাই ইওর লাক ইন সাম আদার প্যাসচিওর?’
একটা হিংস্র নেকড়ের সঙ্গে এতক্ষণ লড়াই করছিল শমি। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছে বটে কিন্তু সেটাকে আপাতত তাড়াতে সক্ষম হয়েছে। আরেকটা বসে আছে ওই যে, তার সামনে। এটা শান্ত, ভদ্র, অর্থাৎ বোকা, ভিতু। শীতলের দিকে শমি চাইল, তবুও এটাও নেকড়েই।
অবাক হয়ে শীতল দেখছিল শমিকে। এই কি শমির জীবনযাত্রার রুটিন? না কি আমারই কারণে শমিকে খোয়ার সইতে হচ্ছে। কেরানি জীবনের রেষারেষি সে কম দেখেনি। কিন্তু তার রূপটা এত বিকট ছিল না। এরা বস্-এর একেবারে নজরের মধ্যে থাকে। তাই এদের খেয়োখেয়িটা এত উগ্ৰ।
‘কী, র্যাট রেসটা কেমন দেখছেন?’ শমি নিজেকে সামলে নিয়েছে। সে ঠাট্টা করছে। ‘এটা ফ্রি ফাইট। কোমরের নীচে হিট করা এখানে একেবারে জলভাত। হয় টিকে থাকুন আর না হয় আউট। সভ্যতা ভব্যতা আমাদের জগতে আউট অফ ডেট।’
শমি হঠাৎ দেখল শীতলের চোখ দুটো সমবেদনায় কেমন নরম হয়ে উঠেছে। শমির আত্মসংযমের বাঁধ প্রায় ভেঙে পড়ে আর কি। প্রচণ্ড চেষ্টায় শমি নিজেকে সামলে রাখল। এ পিনটুর চাইতেও সাংঘাতিক। একজন জুতিয়েছে, আরেকজন এসেছে তেলের বাটি নিয়ে।
টেলিফোন বাজল। শমি ধরল। তারপর শীতলকে বলল, ‘আপনার।’
টেলিফোন তুলে শীতল বুঝল যোগীন।
‘হাবুল মিত্তির টেলিফোন করেছেন?’ শীতলের বুক ধক করে উঠল। ‘কী চান ওরা?
‘আমার সঙ্গে দেখা করবেন? তুই বলিসনি আমার ইনটারেসট নেই। আমি হয়ত সে লোকও না।’
‘বলেছিলি? তবে? জটাই মিত্তির চাইছেন দেখতে?’
হঠাৎ শীতলের চোখে জটাধরের ঘাড়ছাঁটা শৌখিন মুখটা আবছা-আবছা ভেসে উঠল। আর আশ্চর্য, জটাধরকে দেখবার ইচ্ছাটা তার মনে দুনির্বার হয়ে উঠল।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে শীতল জিজ্ঞেস করল, ‘কবে?’
‘শনিবার বিকেলে? বেশ। তুই কোথায় থাকবি?… বেশ।
শীতল টেলিফোন রেখে দিল। শমি দেখল তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।
শমি বলল, ‘শনিবার সন্ধেয় আমার বাড়িতে। শীতল কিছু বলার আগেই শমি বলে উঠল, ‘আত্মরক্ষার্থে আপনার নামটা তখন মুখে আনতে হয়েছিল। তাই নেমন্তন্ন করতে হচ্ছে। আসুন বা না আসুন, সে আপনার ইচ্ছে। কিন্তু কথাটা ফাঁস করবেন না দোহাই।’
শীতল কিছুক্ষণ শমির দিকে চেয়ে রইল। তারপর ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘ঠিকানাটা দিন।