এক ধরনের বিপন্নতা – ৩

তিন 

অন্ধকারে বাড়ি ফিরল শীতল। কিন্তু আজ তেমন ক্লান্ত নয়। রুবি উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছিল। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল ভোম্বল কড়া নাড়লেই লাফিয়ে গিয়ে দরজা খুলবে। ভোম্বলকে চমকে দেবে খুব। আর আজ তাকে আদরও করবে খুব। 

শীতল কড়া নাড়ল। রুবির বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। একটা প্রবল উত্তেজনায় সে অস্থির হয়ে উঠল। না সে যাবে না। কেন, ভোম্বল আসতে পারে না? রুবি শুয়ে রইল। ভোম্বল ঘরে এলেই রুবি তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভোম্বল মিছিমিছি রাগ করে আছে। কাল কেন ওর ঘরে এল না? তা হলেই তো সব জানতে পারত ভোম্বল। ভোম্বল এমন বোকার মতো কাণ্ড করবে এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে রুবির। 

করবী গিয়ে দরজা খুলে দিল। তার হাতে টর্চ। শীতল ভিতরে ঢুকে একটু দাঁড়াল। করবী দরজা বন্ধ করে এগিয়ে গেল। শীতল রুবির ঘরের দিকে একবার চেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। 

রুবি বুঝতে পারল ভোম্বল তার ঘরের সামনে দাঁড়াল। বেজায় বুক টিপটিপ করছে তার। উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে রুবি। ‘ভোম্বল কী এনেছিস’ বলে সাড়া দিলেই সে জানে ভোম্বল তক্ষুনি তার ঘরে ঢুকে পড়বে। কিন্তু কই, কাল তো চকোলেট আনতে বলেছিল। ভোম্বল তো তা দেয়নি। রেখে যায়নি তার ঘরে। আজ কলেজ থেকে ফিরে রুবি ভোম্বলের টেবিলের উপরেই তা পড়ে থাকতে দেখেছে। সকালে তাকে ডেকে সেটা দিতে পারত না ভোম্বল? যত কথা বলার দায় কি তার? ডাকবে না সে ভোম্বলকে। কক্ষনো না কক্ষনো না। রুবি উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। ভোম্বলের পায়ের শব্দ রুবির দরজার সামনে থেকে সরে গেল। রুবি ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। 

করবী রান্নাঘরে যাবার পথে অন্ধকারে শীতলের দরজার কাছে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। এই অন্ধকারে বাড়ির স্তব্ধতাটা কেমন যেন ভারী ভারী ঠেকে। করবী ঘরের হ্যারিকেনের আলোয় দেখল দেওয়ালে শীতলের বিরাট ছায়াটা দৈত্যের মতো নড়াচড়া করছে। ছায়া-দৈত্য জামা খুলল, গেনজি খুলল, কাপড় ছেড়ে লুঙ্গি পড়ল। তারপর ছাড়া কাপড়-জামা একপাশে রেখে রোজকার মতোই চাপা খুলে গেলাসের জলটা পুরো খেয়ে ফেলল। তারপর রোজকার মতোই চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরাল। গরম লাগে না শীতলের? করবীর মনে পড়ল শীতলকে সে কখনও হাতপাখার বাতাস খেতে দেখেনি। ওর কি গরম লাগে না? না, হাতপাখা চালাতে ক্লান্তি লাগে? করবী কি শীতলকে একটু পাখা করবে? এই প্রথম করবীর শীতলকে একটু যত্ন করতে ইচ্ছে করছিল। পাখাটা নিয়ে এগিয়ে যাবার বাসনাও এক লহমায় তার মনে উদয় হল। পরক্ষণেই করবীর মনে হল কী উদ্ভট কথাই না সে আজ ভাবছে। 

শীতল সিগারেটটা শেষ করে হঠাৎ উঠে দাঁড়াতেই করবী আড়াল থেকে স্যাঁৎ করে সরে যেতে গেল। 

শীতল বলল, ‘কে? 

শীতল ভেবেছিল রুবি। তার বুকের রক্ত ছলাত করে উঠেছিল। করবী দাঁড়িয়ে গেল। 

একটু ইতস্তত করে করবী নিচু স্বরে বলল, ‘আমি।’

‘করবী।’ হতাশ হল শীতল। চুপ করে রইল। 

করবী জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু লাগবে?’ 

‘না।’ শীতলের বিষণ্ণতা করবীর কান এড়াল না। ‘চান করব এখন! 

করবী রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। রুবি আজ না খেয়ে বসে আছে। তিনজনের খাবার সাজাতে লাগল করবী। রুবি হটেলে সিট ঠিক করে এসেছে, রবিবারে চলে যাবে, এবং শীতল এ ব্যাপারে কিছুই জানে না, করবীর মুখ থেকে প্রথম শুনল শীতল, রুবির মুখ থেকেও নয়, এতে শীতলের কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। এটা করবী ধরে নিয়েছিল। কিন্তু সেটা যে এত বড় একটা আঘাত হয়ে শীতলের বুকে বাজবে তা বুঝতে পারেনি। করবী শীতলের সেই বিবর্ণ মুখখানা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। খবরটা করবীর মুখ থেকে শোনামাত্র শীতলের মুখ থেকে সমস্ত রক্ত যেন কে শুষে নিয়েছিল। সব থেকে ভয় পেয়েছিল করবী শীতলের নিথর চোখ দুটো দেখে। যেন মরা কাতলার চোখ। আজ সারা দিন সেই মরা মাছের স্থির চোখ দুটো করবীকে এই একা বাড়িতে যেন তাড়া করে ফিরেছে। অবিশ্যি শীতল শান্তভাবেই সব মেনে নিয়েছে। ওর কর্তব্যাদি যথা নিয়মে পালন করে গিয়েছে শীতল। সকালে সময় মতো উঠেছে, বাজারে গিয়েছে করবীর ফর্দ নিয়ে। ফর্দ মিলিয়ে জিনিস এনেছে। তারপর অফিসে বেরিয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, পরিবর্তন একটা হয়েছে বই কী। আজ সকালের চা-টা করবীকে করতে হয়েছে। করবী চা নিয়ে শীতলের ঘরে যেতেই শীতল শুধু ওকে এক নজর দেখে নিয়েছিল। একটা কথাও জিজ্ঞেস করেনি। শীতল আর রুবিতে রোজ সকালে হুটোপুটি বাধে। ছেলেমানুষের সঙ্গে ছেলেমানুষি করতে শীতলের আর জুড়ি দেখেনি করবী। শীতল যে রুবির সমবয়সী নয়, সে যে রুবির চাইতে বয়সে অনেক বড়, এ বোধ রুবির হয়েছে কি না করবীর সন্দেহ। রুবিকে দিয়ে একদিনও সে শীতলকে তুমি বা আপনি বলাতে পারেনি। রুবি আর শীতল এখন দুজনেই দুজনকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। কী করে ওরা পারছে এটা করবীর বুদ্ধির বাইরে। 

টেবিলে খাবার সাজিয়ে করবী ভাবল রুবিকে এখন ডাকা দরকার। সে জানে শীতলের আসবার সময় হয়ে গিয়েছে। 

রুবি তার বালিশে সমানে মুখ ঘষে চলেছে। আর নিজের মনেই বিড়বিড় করে বকছে। ভাল হচ্ছে না ভোম্বল। তুই আমাকে ভালবাসিস নে, একটুও না। সে আমি বুঝে গিয়েছি। বেশ। আমি তো চলে যাব পরশু। আর আসব না। আপদের শাস্তি হবে। তখন তোরা মনের সুখে থাকিস এ বাড়িতে। তুই আমাকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছিস ভোম্বল। আমার কিছু হয়ে গেলে তুই-ই পস্তাবি। আমি কিন্তু সাংঘাতিক কিছু করে ফেলতে পারি। যারা মেডিকেল পড়ে তারা অনেক কিছু জানে। যার সম্পর্কে তোর কোনোই ধারণা নেই ভোম্বল। মানুষের কত রকমে মৃত্যু হয় আমরা তা জানি জানিস। কত রকমের বিষ, কত রকমের ঘুমের ওষুধ। ঘুমের আগে খেয়ে শোও, আর সে ঘুম ভাঙবে না। কিংবা বিষ নাই বা হল, ঘুমের ওষুধ নাই বা হল, স্রেফ একটা সিরিজ, তাই যথেষ্ট জানিস? ভেইনের মধ্যে সূঁচ ফুটিয়ে একটা এয়ার বা পুশ্ করে দাও। শেষ। 

রুবি ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। করবী ঘরে ঢুকল। রুবি মাথা তুলল না। সে জানে এ মা। তুমি রুবির চোখ সাত পর্দা কাপড় দিয়ে বন্ধ করে দাও না, ও ঠিক বুঝে ফেলবে, কে মা আর কে ভোম্বল। ওর সর্বশরীরে সে ভোম্বলের উপস্থিতি টের পায়। সেই ভোম্বল ওকে ভালবাসছে না, ওকে ডাকছে না, ওকে আদর করছে না। রুবির কী যে যন্ত্রণা হচ্ছে তা সে বোঝাতে পারছে না। 

করবী ডাকল, ‘রুবি, খেতে চলো।’

‘না না না।’ রুবির কান্নার বেগ বেড়ে গেল। 

‘কী ছেলেমানুষি করছ রুবি। করবী শান্তভাবে বলল, ‘একবার তুমি ওকে দারুণ কষ্ট দিয়েছ কাল। কথাটা আমাকে দিয়ে না বলিয়ে তুমি নিজে বললেই ভাল করতে। এখন চলো, ওকে বলো, সব ঠিক হয়ে যাবে। 

‘না না না। আমি যাব না।’ রুবি নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে। 

‘তুমি খাবে তো?’ করবী জিজ্ঞেস করল। 

‘না, খাব না।’ রুবির কথা ক্রমশ কঠিন হয়ে আসছে। 

‘সে কী কথা? সারা বিকেল তুমি নিজে রান্নাবান্না করলে। বললে ও এলে খাবে। এখন বলছ খাব না?’ করবী বিমূঢ় হয়ে গেল। 

‘আমার খেতে ইচ্ছে নেই।’

‘কেন, শরীর খারাপ? 

‘আমাকে বিরক্ত কোর না।’

করবী এবার বিপন্ন হয়ে পড়ল। টেবিল সাজিয়েছে তিনজনের। অথচ রুবিই থাকবে না। খাবার সময় রুবি থাকা শীতলের কাছে যে কী তা ভালই জানে করবী। কিন্তু এ মেয়েকে ওঠানো যাবে বলে তো মনে হচ্ছে না। 

করবী অসহায়ভাবে বলল, ‘ও কিন্তু বসে আছে রুবি।’

‘বেশ তো থাকুক না বসে। সব কষ্ট আমি একাই ভোগ করব, না?’ 

‘ও কিন্তু খুব দুঃখ পাবে।’ করবী মিনতি করল। 

‘বেশ হবে। ভোম্বল তখন অন্যকে কষ্ট দেবার মজাটা টের পাবে।’

‘যে তোমাকে এত ভালবাসে তাকে এমন কষ্ট দেওয়া কি ঠিক? 

‘তোমার আবার ভোম্বলের জন্য প্রাণ কাঁদতে শুরু করল কবে থেকে? তা এত যে আজ ওর হয়ে ওকালতি করছ, তা কই, আমার দিকটা তো একটুও ভাবছ না। আমাকে যে কষ্ট দিচ্ছে সেটার বুঝি সাতখুন মাফ। 

‘চলো রুবি, খাবে চলো।’

‘বলেছি তো খাব না।’ শুকনো গলায় রুবি তার অনড় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল।

‘যা ভাল বোঝো করো তোমরা। আমার ভাল লাগছে না।’ করবী বেরিয়ে গেল। 

ভোম্বল আমি তোর মুখ দেখব না। দরজায় খিল তুলে দিয়ে রুবি বিছানায় এসে উপুড় হয়ে পড়ল। দমকে দমকে কাঁদতে কাঁদতে বলল, না না, জীবনে না। 

করবী অপরাধীর মতো একা ফিরে গেল খাবার টেবিলে। কোনও কথা বলল না। দেখল শীতল শুধু ওর মুখের দিকেই আজ চাইল। রুবির চেয়ারের দিকে ফিরেও চাইল না। 

শীতল কিছু জিজ্ঞেস করছে না দেখে অহেতুক এক উদ্বেগ করবী বোধ করতে লাগল। 

‘শুয়ে পড়েছে। খেতে চাইল না।’ করবী কৈফিয়ত দিল। 

কিন্তু শীতল কিছু জিজ্ঞেস করছে না কেন? করবীর আদৌ ভাল লাগছে না ব্যাপারটা। কেমন ভয়-ভয় করছে তার। শীতল কিছু একটা বললে সে যেন স্বস্তি পায়। 

‘শরীর টরীর খারাপ হয়েছে বোধ হয়। করবী করুণভাবে বলল। ‘আমাকে তো কখনওই কিছু বলতে চায় না। নিজের লোক থাকতে বাইরের লোকের কাছে বলতে যাবেই বা কেন?’ পরিবেশটা হাল্কা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করল করবী। 

খেতে খেতে শীতল মুখ তুলে করবীর দিকে চাইল। যেন করবীর কথাটা ভাল করে তার কানে যায়নি। 

‘বাইরের লোক! শীতল প্রশ্ন করল। কে? 

‘কেন, আমি।’ করবী ঠাট্টা করতে গেল। কিন্তু পারল না। অভিমানে তার স্বর ভারী হয়ে এল। ‘তোমার আর রুবির মধ্যে কোনওদিনও তো আমার জায়গা হল না।’ 

করবীর এই ধরনের কথায় শীতল রীতিমত বিস্মিত হল। সে করবীর দিকে চাইল। এ কী। করবীর চোখ দুটো চিকচিক করছে। 

গাঢ় স্বরে করবী বলল, ‘আমাকে তো তোমরা বাইরেই রেখে দিলে।’

শীতল কি কানে ঠিক শুনছে? চোখে ঠিক দেখছে? এত বছর পরে করবী—শীতল মরীচিকা দেখছে না তো? আবার চাইল শীতল! 

ততক্ষণে করবী সামলে নিয়েছে। আবার স্বস্থানে ফিরে গিয়েছে। ঢুকে গিয়েছে রুবির মা’র, অনিলের বিধবার শক্ত খোলসটার ভিতরে। এখন করবী আবার সেই পরিচিত গৃহকর্ত্রী। অসম্ভব সংযত এবং শান্ততার প্রতিমূর্তি। শীতল কি তবে এই বয়সে আবার তার কবিতা লেখার কল্পনা-ব্যাধির দ্বারা নতুন করে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। কালও খাবার সময় একবার করবীকে তার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখেছিল। তার কী হয়েছিল সে আজও জানে না। করবী যেন উদ্বেগে অধীর হয়ে তার কাছে ছুটে এসেছিল? এসেছিল কি? তার কপালে করবী যেন তার হাতের কোমল স্পর্শ রেখেছিল? সত্যিই কি রেখেছিল? সে কেন করবীর হাতখানা ধরেছিল? ধরেছিল কি? নিশ্চয়ই। না হলে করবীর হাত যে রুবির হাতের মতো মোলায়েম এ অনুভূতি তার কোত্থেকে হল। কল্পনা? মরীচিকা? সবই মায়ার খেলা? 

শীতল রীতিমত বিভ্রান্ত বোধ করতে লাগল। সে মাথা নিচু করে খেয়ে চলল। ‘আজকের রান্না সব রুবি করেছে। শীতলের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল না দেখে করবী ক্ষুণ্ণ হল। 

‘সন্ধেবেলায় বললাম কলেজ থেকে ফিরে কিছু খেলি না, এত কাজ করলি, এখন খেয়ে নে না। বলল এখন নয়, এক সঙ্গে খাব।’

শীতলের খাওয়া মাঝপথে থেমে গেল।

‘এখন ডাকতে গেলাম, বলল খাব না। করবী বিপন্নভাবে শীতলের দিকে চাইল। শীতল মুখ তুলে তারই দিকে চেয়ে আছে। ‘আমি ওকে ঠিক বুঝতে পারিনে।’

রুবি না খেয়ে আছে। এ খবর তো জানত না শীতল। আর সে কিনা রুবির রান্না করা জিনিসগুলো গোগ্রাসে গিলে চলেছে। শীতল খুব বিচলিত বোধ করল। সে কী করবে বুঝতে পারল না। বিভ্রান্ত হয়ে করবীর দিকে চাইল। 

‘এখন তুমি যদি ওকে তুলে আনতে পারো।’

এক লাফে উঠে পড়ল শীতল। লম্বা লম্বা পা ফেলে রুবির ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। 

ভোম্বল এসেছে। নির্ভুলভাবে টের পেল রুবি। প্রবল উত্তেজনা তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। সেই সঙ্গে প্রবল কান্না তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। বালিশটা আঁকড়ে ধরে সে বাবা বাবা বাবা বলে ডেকে চলল। থরথর করে কাঁপছে রুবি। বাবা বাবা বাবা। 

ভোম্বল। আমি কোথায়? শীতল চমকে পিছন ফিরে দেখল গাঢ় অন্ধকার। একটা উত্তেজনা তার শরীরে ভর করল। রুবি! ভোম্বল! রুবি! ভোম্বল! রুবি কোথায় তুমি? আমাকে দেখতে পাচ্ছিস নে ভোম্বল? আমি তো তোর কাছে। কাছে। কাছে। কাছে। 

থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বাঁ হাত দিয়ে দরজাটা ঠেলল শীতল। দরজা বন্ধ!

‘রুবি!’ 

রুবি প্রচণ্ডভাবে কাঁপছে। সে এক লাফে দরজাটা খুলে ফেলতে চাইল। ভোম্বল। ভোম্বল। ভোম্বলের বুকে সে আছড়ে পড়তে চাইছে। 

‘রুবি। দরজা খোলো। 

‘না না না।’

ভোম্বল ভোম্বল। তুই আমাকে তুলে নে। তুই আমাকে কোলে নে ভোম্বল। রুবি কোথায় তুমি? 

ভোম্বল ভো—ম—বো–ল। কোথায় আমি? 

আদি গঙ্গার ধারে এক পোড়ো শিবমন্দিরের ধুতরো ঝোপের পাশে রুবির ছোট্ট গোলাপি ফ্রকটা এক ঝলক দেখতে পেল শীতল। ভো—ম–বো–ল। শীতল ছুটল। রুবির ফ্রকটা মন্দিরের কোণ ঘেঁষে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভো—ম–বো–ল। ভো—ম–ব–বো–ল। শীতল খুঁজছে রুবিকে। 

‘রুবি। বেরিয়ে এসো।’ শীতল অসহায়ভাবে রুবির দরজায় ঘা দিল। 

‘না না না না না। আমি যাব না।’ রুবি বালিশে উপুড় হয়ে কাঁদছে। রুবির শরীরটা প্রবল আবেগে ভেসে চলেছে ভোম্বলের দিকে। রুবি বালিশটা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকল। 

‘রুবি।’ শীতলের কাতর মিনতি। 

পলকা-ডটের ম্যাকসি-ঢাকা রুবির পাতলা কিশোরী শরীরটা হরিণের মতো দৌড়চ্ছে বোটানিক্যাল গার্ডেনের বটগাছটার দিকে। 

ভো—ম–বো-ল। ধর আমাকে। 

বটের ঝুরির আড়ালে লুকিয়ে পড়ল রুবি। 

‘রুবি বেরিয়ে এসো।’ এবার রুবির দরজাটা দু হাতে ঠেলতে লাগল শীতল। 

বেরিয়ে এসো। দরজা খোলো। 

রুবির উপর যেন কোন মন্ত্র কাজ করছে। সে বিছানায় উঠে বসল। 

তোমায় আদর করব রুবি। 

ভিতরে আয় ভোম্বল। রুবির বুকটা দ্রুত ওঠা নামা করছে। দরজার দিকে অপলক চেয়ে আছে রুবি। 

আমাকে আর কষ্ট দিও না রুবি। 

আয় ভোম্বল। রুবি উঠে দাঁড়াল। তুই আমাকে নে। রুবির ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। তার আঁচল খসে গিয়েছে। রুবি শীতলকে জড়িয়ে ধরবে বলে দু’হাত দরজার দিকে বাড়িয়ে দিল। থরথর করে তার সারা শরীর কাঁপছে। 

রুবি! হাঃ হাঃ হাঃ। রুবিকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে শীতল। 

ভোম্বল! হাসছে রুবি। ভাল হবে না। 

শীতল রুবিকে বুকে চেপে ধরে চরকির পাক ঘোরাচ্ছে। হাঃ হাঃ হাঃ। 

ভোম্বল ভাল হবে না। পড়ে যাব। ভোম্বল, পড়ে যাব। 

শীতল আরও জোরে পাক দিচ্ছে। আরও জোরে। হাঃ হাঃ হাঃ। 

ভোম্বল! চোখ বুজে শীতলের গলা আঁকড়ে ধরেছে রুবি। শাড়ি খুলে যাবে, শাড়ি খুলে যাবে ভোম্বল। নতুন শাড়ি। ন্যাংটো হয়ে যাব ভোম্বল। তখন দেখবি। 

আরও আরও জোরে শীতল পাক খেতে লাগল। রুবি ভয়ে চেঁচাতে লাগল। শীতল হাসতে লাগল জোরে। ভোম্বল ভোম্বল থাম থাম থাম— 

‘রুবি।’ দরজায় দুম দুম দু’ হাতের কিল মারল শীতল। সব কোলাহল নিমেষে থেমে গেল। দরজায় ধাক্কার শব্দে চমকে উঠল রুবি। দু পা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। 

‘রুবি। দরজা খোল। 

রুবি যেন হুঁশ ফিরে পেল। মুহূর্তে বিছানায় গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে বলতে লাগল, ‘না না, যাব না। তোর মুখ আমি দেখব না। বাবা বাবা আহ আহ আহ–

রুবির কান্নার বাঁধ বুঝি ভেঙে গিয়েছে। 

ঝপ করে আলোগুলো জ্বলে উঠল। বিদ্যুৎ এসে গিয়েছে। বাড়ির সব বাল্ব কটা শীতলকে দেখে যেন এক সঙ্গে বিদ্রুপ করে হেসে উঠল। শীতলের শরীরে আর এক ফোঁটা জোর নেই। ওর সব শক্তি যেন কোনও অদৃশ্য ফুটো দিয়ে শরীর থেকে চুঁইয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। ডান হাতটা চড়চড় করছিল। অবাক হয়ে হাতটা তুলে শীতল দেখল এঁটো। ওর মনে পড়ল ওরা খেতে বসেছিল। শীতলের খাবার ইচ্ছে আর মনেই এল না। সে টলতে টলতে বারান্দা দিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। 

করবী দেখল আলোকিত বারান্দা দিয়ে একটা মরা মানুষ হেঁটে আসছে। যার মুখটা কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি। মৃত মাছের দুটো হিম চোখ তাতে বসানো। করবীকে পাশ কাটিয়ে লোকটা বেসিনে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিল। তারপর নিজের ঘরে ঢুকে গেল। তার পিছনে পড়ে রইল অর্থভুক্ত খাবার থালা আর করবী। করবীর চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। 

.

শীতলের মনে হল সবটাই যেন স্বপ্ন। তার ডাকে রুবি দরজা খুলল না, খেতে এল না, তার প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা রুবি স্বপ্নেই শুধু দেখাতে পারে। শীতল তা হলে স্বপ্নই দেখছে। সে খানিকটা স্বস্তি পেল। সিগারেট ধরাল। একটু হালকা মনে সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে টেবিলে দেশলাইটা রাখতে গিয়ে শীতল দেখল চকোলেটের মোড়কটা এখনও পড়ে আছে। রুবি নেয়নি। স্বপ্ন? সিগারেটটা তেতো হয়ে উঠল। রুবি চকোলেট নেয়নি। শীতল অসহায়ভাবে শূন্যতাবোধের কাছে আত্মসমর্পণ করল। 

শীতল। 

মা। 

শীতল মায়ের মুখের কাছে মুখ এগিয়ে দিল। হাসপাতালের ফ্রি ওয়ার্ডের নোংরা বিছানা থেকে অসুখের গন্ধ শীতলের নাকে এসে লাগল। 

শীতল। 

অসুখের গন্ধটা মা’র জরাজীর্ণ শরীর থেকেই আসছিল। 

আমার বিয়েতে খুব একটা ধূম হয়েছিল। 

শীতল অবাক হয়ে মায়ের মোমের মতো মুখের দিকে চাইল। 

সাত দিন ধরে নহবত বেজেছিল তোদের বাড়িতে। 

মায়ের গলার আওয়াজ প্রায়ই নেমে যাচ্ছিল। জল চাইছিল মা। আর তার হাত থেকে কী তৃপ্তি করেই না জল খাচ্ছিল। 

রোশনাইও হয়েছিল জবর। তোর বাপের বাড়ির সবাই টাকা ওড়াতে ওস্তাদ। কাউকে তো আর রোজগার করে খেতে হয়নি। 

মা আবার জল চাইল। খেল। 

তোর মুখে-ভাত হয়েছিল রুপোর বাসনে, তোর সে ফটো দেখেছিস? 

শীতল বলল, না। 

তা হলে বোধহয় হারিয়ে গিয়েছে। কিংবা হয়ত তোদের বাড়ির কোথাও আছে।

মা চুপ করে কী ভাবতে লাগল। 

তোর দেখতে ইচ্ছে হয় না? শীতল অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। 

তোর দেখতে ইচ্ছে করে না, শীতল? কী? 

তোদের বাড়ি। 

মা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। একটু জল চাইল ফের। মা এত কথা বলে না। মা এসব কথা তার সঙ্গে কখনও বলেনি। সব কিছু ঝড় ঝাপটার আড়ালে রেখেছিল তাকে। 

না। 

না? কেন? 

জানিনে। আমার কখনও ইচ্ছে হয়নি। 

শীতল, আমি আর বাঁচব না। অধিকার আদায়ের জন্য সারা জীবন লড়াই করলাম। সারা জীবন হেরেই গেলাম। তবু লড়ে গেছি। আত্মীয়রা শত্রু হয়েছে। বন্ধুরা পথে বসিয়েছে। 

তোমার এখানে কষ্ট হচ্ছে মা! 

আমি এখানে ভালই আছি। আমি মরে গেলে তুই যাস ওদের কাছে। তোর যদি ইচ্ছে হয়। 

সেই রাত্রেই মারা গিয়েছিল মা। শীতল কিন্তু ফিরে যায়নি কারও কাছে। অধিকার আদায়ের ব্যাপারেও মাথা ঘামায়নি। সে মেসে গিয়ে উঠেছে। মা ওকে তুই বলত, আর বলে রুবি। শীতল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রুবির সঙ্গে ওর মায়ের আরও একটা মিল খুঁজে পেল শীতল। দুজনেই বড্ড একরোখা। 

হঠাৎ আজ মায়ের কথাই বা এমন মনে পড়ছে কেন? মা কি ভাবছে কোথাও যে শীতল তার দায়িত্ব পালন করেনি। তাকেও পথে বসিয়েছে তার ছেলে। শীতল এটা জানে যে, মায়ের শেষ সম্বল ছিল তার গহনা। সে যখন ছোট তখন একদিন সেসব তাকে দেখিয়েছিল। বলেছিল, দ্যাখ শীতল, এটা দিয়ে আমার শাশুড়ি আমার মুখ দেখেছিলেন। তোর বউয়ের মুখ আমি এটা দিয়ে দেখব। শীতলকে পড়াতে আর মামলার খরচ জোগাড় করতে সে-সবই মাকে বেচতে হয়েছে। গহনাটা থাকলে রুবিকে সে দিত। 

রুবি, রুবি। শীতল আর্তনাদ করতে লাগল। তুমি আজ আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছ কেন? 

ভোম্বল। অনেক শান্ত হয়ে উঠেছে এখন রুবি। বিছানার উপর উঠে বসেছে। অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছে সে। রাত্রি অনেক হয়েছে। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। সে কী করবে বুঝতে পারছিল না। ভোম্বল, আমি মাফ চাইছি। আমার অন্যায় হয়েছে। আমি দরজা খুলে দিয়েছি। আমার খুব খিদে পেয়েছে। ভোম্বল, আমি আজ সারাদিন খাইনি। রুবি আশা করেছিল, ভোম্বল এবার এসে যাবে। খুবই খিদে পেয়েছে রুবির। ভোম্বল তো জানে রুবি খায়নি। মা নিশ্চয়ই তাকে বলেছে। তবে? কিন্তু কী করে জানবে ভোম্বল যে, সে দরজার খিল খুলে দিয়েছে? রুবি মুশকিলে পড়ল। দরজাটা শব্দ করে খুলে দেবে? হ্যাঁ, সেই ভাল। সেই সঙ্গে আলোটাও জ্বেলে দিক না। সে উঠল, একটু ভাবল। আবার বসে পড়ল। তার জল-তেষ্টা পেয়েছে। মাকে জল দিতে বলবে? নাকি নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে জল খেয়ে আসবে? ভোম্বলকে সে জানে। সে ঘুমোয়নি। বই পড়ছে। ভোম্বলের ঘরের সামনে দিয়েই রান্নাঘরে যেতে হয়। ভোম্বল ওকে দেখে নিশ্চয়ই ডাকবে। কিন্তু ভোম্বল যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়। যদি কথা না বলে? রুবির উৎসাহ খানিকটা কমে গেল। 

মা বলল, ভোম্বল, মায়ের মুখ থেকে তুই আমার হসটেলে যাবার খবর পেয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিস। মা বলল, ভোম্বল, অন্ধকারকেই মনে মনে শোনাতে লাগল রুবি, কথাটা তোকে আমারই বলা উচিত ছিল। মানছি সে কথা। মানছি আমার দোষ হয়েছে। আমি যে হসটেলে যাব, আমি হসটেলে যেতে চাইছি, আমার যে এক্ষুনি এ বাড়ি ছাড়া দরকার, একথা তোকে আগেই জানান উচিত ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ একটা সিট খালি হয়ে গেল। সুপারিনটেনডেন্ট আমাকে তক্ষুনি ডেকে বললেন, তুমি নিয়ে নাও। অনেক ক্যানডিডেট। এটা ফসকে গেলে আর কবে খালি হবে কে জানে? আমি কোনও কিছু না ভেবেই নিয়ে নিলাম। তোকে বলবার, তোর অনুমতি নেবার সময় পর্যন্ত পেলাম না। তাই আমি তোকে জানাতে পারিনি। 

তোকে জানাতে আমি সাহস পাইনি ভোম্বল। দু’হাতে মুখ ঢেকে রুবি কাতরে উঠল। তোকে আমি ভয় পাচ্ছি ভোম্বল। তোকে ভয় পাচ্ছি। প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা রুবির হৃৎপিণ্ডটাকে যেন মুচড়ে দিল। ওর চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগল। আমার পালানো দরকার ভোম্বল, তোর কাছ থেকে আমার এখন পালানো দরকার। 

হঠাৎ রুবি চমকে উঠল। এ কী বলছে সে। তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল। এমন কথা তো সে ভাবেনি। ভাবতে চায়নি। রুবি হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল। সেই মুহূর্তে দরজা খুলে গেল। ভোম্বল। রুবির বুকের রক্ত ছলাত করে উঠল। সমস্ত শরীরে এক প্রবল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। রুবি অস্থির হয়ে ভোম্বলের বুকে ঝাঁপ দেবার জন্য উঠে দাঁড়াল। 

করবী সুইচটা টিপে দিতেই ঘরে আলো ছড়িয়ে পড়ল। রুবি বিস্ফারিত চোখে করবীর দিকে চেয়ে রইল। এক মুহূর্ত। তারপরই সে দৌড়ে গিয়ে করবীকে জড়িয়ে ধরল। 

থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে করবীর বুকে মুখ গুঁজে রুবি আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, আমি এখন কী করব মা? 

রুবির চোখ মুখ কণ্ঠস্বরে এমন একটা অস্বাভাবিক কাতরতা ফুটে উঠল, যা আগে আর কখনও করবী দেখেনি। এ যেন এক নতুন রুবি। আর্ত, বিপন্ন, অসহায়। করবী বিচলিত হয়ে উঠল। সে রুবিকে নিয়ে খাটে বসল। তারপর রুবির গায়ে মাথায় চুলে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। রুবিকে এমন করে করবী কখনও কাছে পায়নি। রুবির আর তার মধ্যে শীতল উপস্থিত ছিল এক অলঙ্ঘ্য প্রাচীর হয়ে। আজ সে তার রুবিকে, তার মেয়েকে ফিরে পেল। খুশি হল। শীতলের মধ্যে কী যেন একটা জাদু ছিল। সেই জাদুতে সে মোহগ্রস্ত করে রেখেছিল রুবিকে। রুবির জন্যেই শীতল এ বাড়িতে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিল। রুবি তার মেয়ে, কিন্তু সে শীতলের বাধ্য হয়ে উঠেছিল। আজ সেই মেয়ে তার কোলে আশ্রয় নিয়েছে। শীতল করবীর কাছে আজ হেরে গেল। জয়ের আনন্দে সে মেয়েকে আরও জোরে চেপে ধরল। 

‘চল, খাবি চল। করবী আস্তে করে রুবিকে বলল। 

মায়ের বুকে মুখ গুঁজে রুবি আশ্রয় পেল বটে কিন্তু এটাও বুঝে গেল, এটা একটা অচেনা বন্দর। তার উত্তেজনা কাটতে লাগল ক্রমশ। তার শরীর এবং মন শিথিল হয়ে আসতে লাগল। সে এলিয়ে পড়তে লাগল করবীর কোলে। 

করবী বলল, ‘খাবি চল।’

‘এখন থাক। পরে খাব।’ রুবি যেন ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যেতে যেতে কথা বলছে। 

‘আগে খেয়ে নে। পরে ঘুমাবি। করবী ব্যস্ত হয়ে উঠল। ‘আমি বরং এখানেই নিয়ে আসি। খাইয়ে দিই, ঘুমিয়ে পড়িসনে। 

রুবি শুয়ে রইল। করবী ওর মাথায় একটা বালিশ গুঁজে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ল। 

রুবি ডাকল, ‘মা।’

‘কী?’ 

রুবি বলল, ‘বোসো।’

‘দাঁড়া, খাবারটা আনি।’

‘তুমি বোসো মা।’

করবী বসল। ‘কেন? 

রুবি চুপ করে থাকল।

করবী বলল, ‘কিছু বলবি?’ 

রুবি সরে এসে করবীর গায়ে গা ঠেকিয়ে শুয়ে থাকল। করবী মেয়ের চুলগুলোয় আঙুল চালাতে লাগল। তার নিজেরও এখন শান্তি লাগছে। 

‘ভোম্বল খুব রেগে আছে, না?’ অনেকক্ষণ ধরে ইতস্তত করে বলে ফেলল রুবি। 

‘ও খুব দুঃখ পেয়েছে রুবি।’ ক্লান্তস্বরে করবী বলল। 

রুবি তা বোঝে। মায়ের উরুর উপর একখানা হাত এলিয়ে দিল রুবি। তার শরীরের কোথাও কণামাত্র চঞ্চলতা জাগল না। 

আমার অন্যায় হয়েছে ভোম্বল। 

‘ও খেতে বসে শুনল তুই খাসনি।’

আমিও খাইনি ভোম্বল। 

‘অমনি উঠে চলে এল তোকে ডাকতে।’

মা কি ওকে দোষ দিচ্ছে? 

‘কত ডাকল। তুই উঠলি না।’

মা ওকে দোষ দিচ্ছে। 

‘ফিরে গিয়ে আর খেল না। হাত ধুয়ে ঘরে চলে গেল।’

আমি যে তোর জন্য রেঁধেছিলাম ভোম্বল। 

‘কাল যে তোর কী হল? কেন তুই নিজে ওকে বললি না, তুই হসটেলে যাবি। কাল আমার মুখে কথাটা শুনে ওর মুখটা যেন কেমন হয়ে গেল। যেন মরা মানুষের মুখ।’

ভোম্বল ভোম্বল। 

‘আমি ভয় পেয়ে গেলাম। 

আমি জানি আমি জানি আমি জানি। 

‘সব কথাই তো তুই ওকে বলিস। ওর সঙ্গেই তো তোর যত কথা। এটাই বা বলতে তোর আটকাল কেন?’ 

রুবি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে একটা অবলম্বন খুঁজছিল। 

‘বড় একচোখো মা তুমি। আমার দোষটাই শুধু বড় করে দেখতে পারো। ভোম্বলের প্রমোশন হয়েছে সে খবরটা সে নিজের মুখে আমাকে বলেছে? সেটাও তো মা আমাকে তোমার মুখ থেকেই শুনতে হয়েছে।’ রুবি এতক্ষণে পাল্টা দেবার সুযোগ পেল। ‘কিন্তু তা নিয়ে কি আমি অনর্থ বাধিয়েছি?’ 

তুই কেন কাল আমার ঘরে ঢুকলি না ভোম্বল? আমি তোর কাছে মাফ চেয়ে নিতাম। আমি সারারাত দরজা ভেজিয়ে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম মা’র মুখে কথাটা শুনে তুই আর স্থির থাকতে পারবিনে। আমার কাছে ছুটে আসবি। 

‘আমি কি ভোম্বলের জন্য আজ রান্না করিনি? ওর সঙ্গে খাব বলে বসে থাকিনি?’

তোর প্রমোশনের খবরটা দেবার জন্যও তো আসতে পারতিস? আমার চাইতে মা তোর আপন হল? 

‘খুব তো তোমার ওর হয়ে তখন থেকে ওকালতি করছ। এসব কথা তোমার ওকে বলতে পারছ না? 

হঠাৎ আক্রমণে করবী হকচকিয়ে গেল। কী সব বলছে রুবি। ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? কাল থেকে যে কী ঘটছে এ বাড়িতে তার কোনও খেই পাচ্ছে না করবী। সে যেন অথৈ জলে পড়ে গিয়েছে। 

‘রুবি!’ করবী ঝাঁঝালো স্বরে বলল, ‘কী সব বলছিস যা তা।’ 

মাকে রাগতে দেখে রুবিও রেগে গেল। ‘আমি ঠিক বলছি। আমাকে ঘাঁটিও না।’ 

রুবির মুখে এ ধরনের কথা শুনে করবী কী বলবে ভেবে পেল না। তার কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। 

মাকে নিরুত্তর দেখে রুবি আরও হিংস্র হয়ে উঠল। 

হিসহিস করে রুবি বলল, ‘তুমি ভোম্বলকে ও ও করো কেন? ওর নাম ধরে ওকে তো কোনওদিন ডাকতে শুনিনি? 

অ্যাঁ। কী কী বলল রুবি। কথাটার মানে বুঝতে পারছে না করবী। ওর বোধ বুদ্ধি কিছুই কাজ করছে না। রুবির কথাগুলো আবছা আবছা হয়ে ওর মগজে ঢুকছে। এ সব কথার কী উত্তর হতে পারে? কোনও উত্তর আছে কি? কোনও দিন তো ভেবে দেখেনি। ভাববার দরকার হতে পারে, তাও তো ভাবেনি। শীতলকে সে মেনে নিয়েছে। লোকে যেমন ভাগ্যকে মেনে নেয়। 

অনিলের অফিসের চক্কোত্তিবাবু বলেছিলেন, তোমার ভাশুরকে আমরা চিঠি দিয়েছি মা জব্বলপুরে। তিনি চিঠি পেয়েই এসে পড়বেন। কিন্তু যতক্ষণ তিনি না আসছেন ততক্ষণ কী হবে তাই ভাবছি। তুমি ছেলেমানুষ। এই কচি বাচ্চা নিয়ে একা কি থাকতে পারবে? 

করবী অসহায়ভাবে সেই একমাত্র ভরসার দিকে তাকিয়ে ছিল। 

তোমার বাপের বাড়িতে কেউ নেই তো বলছ। 

চক্কোত্তিবাবুকেই তার বাবা বলে মনে হচ্ছিল। 

এই ছেলেটি আপাতত এখানে থাকুক মা। এ শীতল। খুব ভাল ছেলে! তোমার কোনও অসুবিধে হবে না, তারপর তোমার ভাশুর এসে যা ব্যবস্থা করেন তাই হবে। 

চক্কোত্তিবাবুর ব্যবস্থাই মেনে নিয়েছিল। সেই থেকে শীতল এ বাড়িতে। করবীর জব্বলপুরের ভাশুর আসেননি। মনি অরডার করে কিছু টাকা পাঠিয়েছিলেন। শ্রাদ্ধের খরচ। চিঠিতে জানিয়েছিলেন, অত দূর থেকে তাঁর পক্ষে কলকাতায় আসা সম্ভব নয়। শীতল রয়ে গেল। রুবিই তাকে রেখে দিল। শীতলকে ডাকাডাকির কোনও প্রশ্নই ওঠেনি। রুবিই তো শীতলের সর্বক্ষণের দখল নিয়ে ছিল। কুড়ি বছরের নিস্তরঙ্গ সংসারে সকলেরই সবাইকে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। 

রুবি দেখল ওর মা স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। চোখে-মুখে অসহায় বেদনার ভার। অনুশোচনায় রুবির মনটা খাঁ খাঁ করে উঠল। 

‘মা!’ 

মা আমাকে মাফ করো। 

রুবি ধড়মড় করে উঠে বসল। মা নড়ল না। 

মা। 

আমি অন্যায় করেছি মা। 

করবীর অপলক চোখ দুটো অকস্মাৎ টলটল করে উঠল। ওর ঠোঁট দুটো কাঁপছে! 

‘মা!’ রুবি মাকে ঠেলা দিতেই করবী রুবিকে জড়িয়ে ধরল। 

‘রুবি! রুবি! রুবি!’ একটা প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতা করবীকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াতে লাগল। তার হাত থেকে বাঁচবার জন্য রুবিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে লাগল। 

.

হঠাৎ যদি মারা যাই কোনও দুর্ঘটনায় তা হলে এদের কী হবে? এই চিন্তাটা টু মেরে শীতলের ঘুম ভাঙিয়ে দিল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা স্বপ্ন দেখছিল শীতল। দত্তপুকুরে তাদের পিকনিকের স্বপ্ন। অনিল তাকে বোঝাচ্ছিল, কেন এখনই তার একটা জীবন-বিমা করে ফেলা দরকার। অনিল প্রচলিত অর্থে মিশুকে নয়, বেশি বকবক করতেও পারে না, কিন্তু সার কথা গুছিয়ে বলতে এমন পটু লোক আজও সে দ্বিতীয় কাউকে দেখল না। অনিলের কথা শুনলেই তার মধ্যে সত্য আছে বলে মনে হয়। অনিলই প্রশ্ন তুলেছিল, আজ যদি হঠাৎ মারা যান কোনও দুর্ঘটনায়, তা হলে আপনার পরিবারের কী হবে? এই প্রশ্নটাই মনুষ্য সমাজের একটি মৌলিক প্রশ্ন! মানুষ শুধুমাত্র নিজের জন্য বাঁচে না, অন্যের জন্যও বাঁচে। পরিবার, সমাজ এসব সৃষ্টি হয়েছে ব্যক্তি-মানুষের সিকিউরিটির প্রয়োজনে। এই মূল তত্ত্ব জীবন-বিমারও ভিত্তি। অনিলের কথায় শীতল, যদিও তার পরিবার ছিল না, তবুও অ্যাকসিডেনট কভার করে পঁচিশ হাজার টাকার বিমা করেছিল। 

তার মানে শীতল আজ দুর্ঘটনায় মারা গেলে রুবি পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবে। কেন না রুবি তার নমিনি। শীতল ঠাণ্ডা মাথায় খতিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ তার মাথায় ঝাঁ করে একটা প্রশ্ন খেলে গেল। নমিনি ফর্ম ভর্তি করার সময় রিলেশনের ঘরে ঝোঁকের মাথায় লিখে দিয়েছিল ডটার। এ নিয়ে কোনও বিপত্তি হবে না তো? টাকা পাবে তো রুবি? শীতল একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন। সে কি তবে কথাটা কেটে দেবে? কী তবে লিখবে? 

আর তার আগেই যদি সে মরে যায়? তখন কী হবে? শীতলের অস্বস্তি বাড়তে লাগল। সে নিজেকে বোঝাতে লাগল, তার স্বাস্থ্য তো খারাপ নয়, সে হঠাৎ মরতে যাবে কেন? অনিলের স্বাস্থ্যই বা কী এমন খারাপ ছিল। তিন বছরে একদিনের জন্যও অনিল অফিস কামাই করেছে বলে তার মনে পড়ে না। এর উপরও ছিল তার বিমা আর শেয়ারবাজারের পরিশ্রম। শেয়ার খুব ভাল বুঝত অনিল। যেসব নতুন কোম্পানির শেয়ার সে করবীর জন্য কিনে রেখে গিয়েছে জলের দামে, আজ তার দাম অনেক চড়া। প্রত্যেকটি কোম্পানি আজ লব্ধপ্রতিষ্ঠ। অনিলের দূরদৃষ্টি দেখে সে বিস্ময় মেনেছে। আর শীতল? সে কিনা একটা জীবন-বিমার নমিনি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু যতই বিষয়বুদ্ধি প্রখর থাক অনিলের, তাকে মরতে তো হয়েছে। দু মিনিটে মারা গিয়েছিল অনিল। করবী বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কতটুকু ছিল করবী তখন। ওরা যখন খবর পেয়ে অফিস থেকে এসে হাজির হল তখন করবীর যে মুখখানা দেখেছিল শীতল, সেটা প্রায় একটা বালিকার মুখই বলা চলে। শোকের চাইতে সে মুখে বিহ্বলতাই ছিল বেশি। আজ করবীকে বেশ ভারিক্কি দেখায়! ফিফথ ইয়ারে মেডিকেল পড়া মেয়ের মা সে। আজ তার চোখে কিশোরী বধূর বিমূঢ়তা আশা করা যায় না। তবু কাল খাবার সময় করবীর চোখে সেই বিহ্বল দৃষ্টি দেখেছে শীতল। খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিল করবী। শীতল আজ সারাদিন হঠাৎ হঠাৎ তার কপালে সেই উদ্বিগ্ন হাতের কোমল স্পর্শ অনুভব করেছে। 

রুবি নিজেই শীতলের সঙ্গে তার সম্পর্ক পাকা করে নিয়েছে। বাবা। শীতল, রুবির বাবা। করবীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুবি তার গোঁ ছাড়েনি। আজও শীতল তার বাবা। শুধু কৌশল বদলেছে রুবি। তার মাকে আর প্রকাশ্যে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে না। তবে রেগে গেলে বা কোনও কারণে করবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চাইলে তার রণধ্বনি হিসাবে রুবি শীতলকে করবীর সামনেই বাবা বলে ডাকে। করবী অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে। বিব্রত বোধ করে। বিরক্তিও প্রকাশ করে। 

শীতল উঠল। একটা সিগারেট ধরিয়ে সেই নিশুতি রাতে জানালার ধারে চলে গেল। রাস্তার ওদিকে নর্দমার ধারে একটা ইট বার করা পাঁচিলের পাশে একটা 

বুনো বাসকের ভিজে ঝোপের উপর তীব্র বিজলি ঠিকরে পড়ছে। একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে বাতাসের মোলায়েম দমকায় বাসকপাতাগুলো ঘাড় হেলিয়ে চিকচিক করে উঠছে। একটা পোসটার। বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে বাজারি প্রচার ব্যর্থ করুন। 

অনিল হঠাৎ মরেছে। আমিও মরতে পারি। অস্থির বাসকঝোপের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে শীতল সিগারেট টানতে লাগল। ভিজে বাতাসের মৃদু দমক তার মুখে চোখে লাগতে লাগল। করবীর হাতের স্পর্শ শীতলের কপালে তাজা হয়ে উঠতে লাগল। করবীর বিমূঢ় মুখখানা ভিজে বাসকের ভিজে পাতার আরশিতে থর থর করে কাঁপতে দেখল শীতল। 

আমিও যদি হঠাৎ মরি, তোমাদের কী হবে? শীতলের সিগারেটের আগুন উজ্জ্বল হল একবার। 

অবিশ্যি টাকা পয়সার ব্যাপারে অসুবিধে কিছু নেই। সে-সব চক্কোত্তিদাই গোছগাছ করে দিয়ে গিয়েছেন। করবীর মুখখানা কাঁপতে কাঁপতে পাতাগুলোর উপর স্থির হল। পরমুহূর্তেই বাতাসের দমকায় আবার তা ভেস্তে গেল। দ্যাখো করবী, দিনকাল কেমন পালটেছে। আজ চকোত্তিদার মতো একটা লোক পাবে অফিসে? কিংবা অনিলের মতোই ধরো? এরা কেউই তো মহামানব কি দেবতা ছিল না। ছাপোষা কেরানিই তো সব। অনিল ধরতে গেলে নিঃস্বার্থভাবে কারও জন্যই কিছু করেনি। সহকর্মীদের পলিসি করে দিয়েছে, তার কমিশন পেয়েছে। শেয়ার কিনিয়ে দিয়েছে, তারও কমিশন সে পেয়েছে। কিন্তু যা করেছে তা দায়িত্ব নিয়ে করেছে। কাউকে সে কখনও বাজে পরামর্শ দেয়নি। এ জিনিস আজ কোথায় গেল? 

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। করবীর মুখখানা পাতা থেকে বৃষ্টির মধ্যে উঠে এল। 

চক্কোত্তিদা দিনের পর দিন হাঁটাহাঁটি করে অনিলের বাকি বকেয়া আদায়, তা লগ্নির ব্যবস্থা করা, সাকসেশন সারটিফিকেট বের করা, আয়করের ঝামেলা, ডিউটির ঝামেলা, মিউনিসিপ্যালিটির ঝামেলা, সাত সতেরো কত কী সব হাঙ্গাম মিটিয়ে এই যে তোমাদের থিতু করে দিয়ে গেলেন, যে দায়িত্ব নিয়ে তিনি এসব তোমাদের জন্য করেছেন, তাঁর নিজের মেয়ের জন্যও ঠিক এইভাবেই সব করতেন। এই ধরনের লোক আজ আমাদের অফিসে কে যে আছেন, তা জানিনে। 

শীতল পোড়া সিগারেটটা ফেলে দিল। একটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে ঝোপের মধ্যে ঢুকল। 

ধরো, হঠাৎ আমি মরে গেলাম। তোমরা অফিসে খবর দিলে। কে আজকে ছুটে আসবে? অফিসের কেতাই বদলে গিয়েছে। 

বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা চড় চড় করে ঝরে পড়তে পড়তে এক সময় করবীর মুখটাকে মুছে দিল। 

অবিশ্যি আমাদের মতো লোক যাদের সহায় কম, সম্বল কিছু আছে, তাদের ভরসা সৎকার সমিতি। আজ টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করছ, কাল হয়ত চার্জ দিলে মড়া পোড়াবার লোকও ভাড়া পাবে। চাই কি পরশু মড়া-কান্না কাঁদবার লোকও ভাড়া পাওয়া যাবে। 

হঠাৎ শীতল দেখল কটা লোক মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে গরুর মাংস বোঝাই একটা ঠেলা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলেছে। মাথায় তাদের চটের বস্তা বাঁধা। অনাবৃত একটা মাংসের স্তূপ রাস্তার আলোয় চকচক করে উঠল। ঠেলাওয়ালাদের বৃষ্টি-ধোয়া মাংসপেশীর প্রত্যেকটি ভাঁজ শীতলের চোখের সামনে আলাদা আলাদা করে ভেসে উঠল। 

সভ্যদেশে সব কিছুই ভাড়া পাওয়া যায় করবী। ভাড়া যায় না কেবল মানুষের উত্তাপ। তাজা মানুষের জগৎ ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। ভাবতেই কেমন যেন ভয় লাগে। 

শীতল চেয়ারে এসে বসল। এলোমেলো বাতাসের ধাক্কায় বাইরে বৃষ্টি তখন এদিক ওদিক ছুটছে। 

অনিল যা রেখে গিয়েছে সে-সব নিয়ে করবীদের কোনও অসুবিধে হবে না। শীতলের বিমার টাকা রুবি পাবে। যাতে গোলমাল না হয় শীতল তা দেখবে। সে আবার একটা সিগারেট ধরাল। ঠাণ্ডা মাথায় বিষয় সম্পত্তির বিলি বন্দোবস্ত করতে হলে সিগারেট না হলে কীভাবে চলবে। শেয়ার নেই, অন্য কোনও সম্পত্তিও নেই শীতলের। ইনসিওরেনসের ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছে। রুবি। ডটার। এই ব্যাপারে যাতে ফ্যাকড়া না ওঠে তার জন্য শীতল না হয় যোগীনের পরামর্শ নেবে। হ্যাঁ, যোগীন। যোগীনই তো আছে এখনও পুরনো দুনিয়ার এক ডোডো পাখি। যার উপর ভরসা রাখা যায়। সব শুনে যোগীন হয়তো ঠাট্টা করবে। বলবে, না বিইয়ে কানাইয়ের মা–না, তুই হলি কানাইয়ের বাবা। একটা বুদ্ধি বাতলে দেবে যোগীন। 

নিশ্চিন্ত হল শীতল। সে যেন যোগীনের পরামর্শ পেয়েই গিয়েছে। সিগারেটে টান দিল শীতল। 

আর রইল প্রভিডেনট ফানড। তোমাকেই আমার নমিনি করব। তা-ই আমার ইচ্ছে করবী। কিন্তু রিলেশান? 

শীতল ভাবনায় পড়ল। 

কী লিখব আমি? 

শীতলের ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে ভাবল। কূল কিনারা কিছুই পেল না। 

তুমি আমার কে করবী? 

কোনও সম্পর্ক আছে কি? শীতল একবার করবীর উদ্দেশে, একবার নিজের দিকে প্রশ্ন দুটো ছুঁড়ে দিল। কোনও উত্তর এল না। শীতল আবার আতান্তরে পড়ল। 

এটা জানা দরকার। না হলে পরে এ নিয়ে যথেষ্ট ঝামেলা হতে পারে। শীতল ভেবেছিল তার সঙ্গে পরিবারের সব কিছু ঢুকে বুকে গিয়েছে। তা যে যায়নি সেটা টের পেল তার এক কাকার শ্রাদ্ধের চিঠি পেয়ে। লোকটা তার কাকা কি না জানে না। তবে পদবি আর পৈতৃক বাড়ির ঠিকানা যখন এক, তখন বিরাশি বৎসর বয়সে সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্ত লোকটিকে সে তার কাকা বলেই ধরে নিয়েছিল। বলাই বাহুল্য শীতল ভাগ্যহীনদের দায় উদ্ধার করার জন্য কোনও আগ্রহ বোধ করেনি। প্রশ্ন হচ্ছে তার অফিসের ঠিকানায় চিঠিখানা পৌঁছল কী করে? ঠিকানা ওরা পেল কী করে? 

শীতল এই নিয়ে মনে মনে অনেক তোলপাড় করেছে। কিন্তু কোনও হদিশই পায়নি এই রহস্যের। যে চিন্তাটা তাকে সর্বদাই ভাবিয়ে তুলেছে তা এই, ওরা তার: গতিবিধির সব খবর রাখে। করবীর খবর রাখে, রুবির খবর রাখে। তার বিমাপলিসির খবর রাখে। কে তার নমিনি, সে খবর রাখে। প্রভিডেনট ফানডের খবরও রাখে। 

ওরা বড় মামলাবাজ করবী। সেই জন্যই গোড়া থেকে আট-ঘাট সব বেঁধে রেখে যেতে হবে। যাতে আমি মারা গেলে ওরা তোমাদের কিছুমাত্র ঝামেলায় ফেলতে না পারে। আমার রোজগারের পয়সা ওদের হাতে গিয়ে পড়ুক, এ আমি চাইনে। আমি চাই আমার ভালবাসার লোকেরাই তা পাক। 

কথাটা ঝোঁকের মাথায় মনে উদয় হয়ে থাকবে শীতলের। কিন্তু মনে হতেই শীতল থ মেরে গেল। করবী কি তার ভালবাসার লোক? পাগল ছাড়া এসব চিন্তা আর কার মাথায় আসবে। 

শীতল যে করবীকে তার প্রভিডেনট ফানডের নমিনি করতে চাইছে, সে কি জানে করবী তা পছন্দ করবে কি না? 

না। 

সে কি জানে করবী এতে বিব্রত বোধ করবে কি না? 

না। 

সে কি জানে করবী তা প্রত্যাখ্যান করবে কিনা? 

না। 

সে কি জানে করবী যদি এটা গ্রহণ করেও, ভূয়া দাবিদারের হাত থেকে তা রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ লড়ে যাবে কিনা? 

না। 

যেমন তার মা লড়ে গিয়েছিল স্বামীর সম্পত্তির অধিকার আদায়ের জন্য? শীতল! 

যেমন করবী লড়ে যাবে অনিলের সম্পদ রক্ষার জন্য? 

শীতল! 

তার মায়ের আওয়াজ এত ক্ষীণ হয়ে এসেছে যে ডাকগুলো তার কানে ঢুকছিল না। শুনতে পাওয়া মাত্র শীতল তার মায়ের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল। 

মা কিছু বলবে? 

বিছানার সঙ্গে লেগে গিয়েছে মা। আজ বোধহয় জমাদারনি পেচ্ছাবের বোতলও দেয়নি। বিছানার ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগছে শীতলের। 

শীতল, হাতখানা এগিয়ে দে তো বাবা। 

শীতল মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। মায়ের মুঠিবদ্ধ হাত শীতলের হাতের মুঠোয় ঢুকে গেল। 

নে ধর। দুটো মাকড়ি। এই শেষ, আর কিচ্ছু নেই। 

মা শ্রান্ত হয়ে চোখ বুজল। 

আমার সৎকার করবি। শ্রাদ্ধ করবি। তাই ও দুটো রেখেছিলাম। তুই একা এসব করবি। তারপর তোর মুক্তি। যা ভাল বুঝিস করিস। 

শীতল মাকড়ি দুটো না দেখেই পকেটে রেখে দিল। মা যে দেখছিল জুলজুল করে, শীতল তা খেয়াল করেনি। 

ট্যাকে রাখ বাবা। সাবধানে রাখ। 

শীতল মাকড়ি দুটো পকেট থেকে বের করে ট্যাকে রাখল। তারপর মা চোখ বুজল। 

আজ আমার একটা কিছু হবে শীতল। একটু জল দে বাবা। 

জল খেয়ে মা চাঙ্গা হল। শীতলের হাতটা ধরল। 

আজ দুপুরে একটা ডোম এসেছিল জমাদারনির সঙ্গে। 

বিছানাটা হাতড়াল। আঁচলের গিঁঠগাঁট খুলে সব দেখল। খুঁজে পায়নি।

মায়ের মুখে ক্ষীণ একটা বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল। 

ওরা আগেই টের পায়। যারা মরবে ওরা তাদেরই বিছানা হাতড়ায়। 

মা ঠিকই বলেছিল। সেই রাতেই তার মৃত্যু হয়। মায়ের সেই চেহারাটা চোখে ভেসে উঠল শীতলের। শুকনো চিমড়ে একটা যেন মমি। কিন্তু কী তেজ। তেজ বজায় রেখেই মা চলে গিয়েছে। 

কী পেলে মা? শীতল একদিন জিজ্ঞেস করেছিল। সেই একদিন। আর কখনও না। 

মা বলেছিল, নিজের উপর শ্রদ্ধা। 

শীতল সেদিন মানে বোঝেনি। সে মায়ের মুখখানা এখন মনে আনবার চেষ্টা করল। 

মায়ের হাসপাতালে শোয়া চিমড়ে মুখটা ভেসে উঠল তার মনে। 

মা দেখি আজকাল প্রায়ই আসছে। 

‘ভোম্বল।’ একটা চাপা ডাক শীতলের কানে বহুদূর থেকে এসে ঘা মারল। 

মা এ ডাকটাও জেনে ফেলেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস শীতলের বুক ঠেলে বেরিয়ে এল। 

রুবি দেখল, শীতল সাড়া দিল না। সে ইতস্তত করতে লাগল। বাথরুমে এসেছিল রুবি। ঘরে ফেরার পথে শীতলের ঘরে উকি দিয়েই দাঁড়িয়ে গেল। শীতল জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। রুবি দরজার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে শীতলকে দেখতে লাগল। কাল থেকে তার সঙ্গে শীতলের একবারও দেখা হয়নি। রুবির মনে হল, এর মধ্যেই ভোম্বল একেবারে বুড়িয়ে গিয়েছে। রুবির বুকটা হু হু করে উঠল। কী যন্ত্রণা কী যন্ত্রণা তার বুকে। রুবি দেখল ভোম্বল এসে চেয়ারে বসল। শূন্য দৃষ্টিতে সিলিং-এর দিকে চাইল। রুবি দেখল তার ভোম্বলের সেই ক্লান্ত শীর্ণ ভাবলেশহীন মুখের বোবা দৃষ্টির সামনে আজ সে আর নেই। এই ঘর, ঘরের দেওয়াল ভেদ করে আলোর সীমানা ডিঙিয়ে ভোম্বলের দৃষ্টি চলে গেছে কোথায় কোন দূরে। মাঝে মাঝে ঠোঁট নড়ছে ভোম্বলের। যেন কারও সঙ্গে কথা কইছে, যেন কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করছে, যেন কারও কোনও কথার জবাব দিচ্ছে। ভয় করতে লাগল রুবির। ভোম্বলকে ভূতে পায়নি তো? রুবি ছুটে ওর মার ঘরে যেতে চাইল। মাকে ডেকে আনতে চাইল। কিন্তু দেখল, ওর পা দুটো মেঝেয় পুঁতে গিয়েছে। 

‘ভোম্বল।’ ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল রুবি। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল না আর।

‘ভোম্বল! থরথর করে কাঁপতে লাগল রুবি! 

‘ভোম্বল।’ শেষ পর্যন্ত একটা ক্ষীণ আওয়াজ বুক চিরে বের করতে পারল রুবি। 

রুবি দেখল শীতল তার দিকে চাইছে, কিন্তু তার উদাস দৃষ্টি রুবিকে যেন চিনতে পারছে না। যে দৃষ্টি রুবিকে দেখামাত্র শিকারি বেড়ালের চোখের মতো চিকচিক করে উঠত সেটা কোথায় গেল? 

‘ভোম্বল!’ শীতলকে তার দিকে চাইতে দেখে রুবি ঘরের ভিতর দু’পা এগিয়ে এল। ভোম্বল! আমি! চিনতে পারছিস না আমাকে? 

‘রুবি!’ শীতল সাড়া দিল। কিন্তু সে ডাকে আমন্ত্রণ নেই। এ যেন অন্য কারও গলা। 

রুবি থমকে দাঁড়াল। ভোম্বল কি অসুস্থ। ভোম্বল ডাকছে না কেন তাকে? টানছে না কেন? রুবির চোখ ফেটে জল আসছে। কিন্তু না, সে কোনও দুর্বলতা দেখাবে না ভোম্বলের সামনে। ভোম্বল তো চায় না তাকে। রুবির কেমন একটা কষ্ট হতে লাগল। ফিরে যাবে নিজের ঘরে? যা সে কখনও করেনি। ঝাঁপিয়ে পড়বে ভোম্বলের উপর? ঝাঁপিয়ে গুঁতিয়ে ভেঙে দেবে ভোম্বলের ঘোর? যা করাই রুবির স্বভাব। রুবি কিছু বুঝতে পারছে না। তবু শীতলের দিকে দু’পা এগিয়ে গেল রুবি। একদম চাইছিল না। তবুও গেল। কে যেন তাকে ঠেলে দিচ্ছে। 

এখন রুবি শীতলের একেবারে মুখোমুখি। এবং তাদের চারপাশে গভীর এবং হিংস্র এক রাত্রি। আর কিছু নেই। রুবি কথা কইছে না। শীতল কথা কইছে না। অসম্ভব ভারী এক স্তব্ধতা দুজনের উপরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। ছিঁড়ে পড়লেই দুজনে একেবারে পিষে যাবে। অসহ্য একটা চাপে ক্রমেই কাতর হয়ে পড়ছে রুবি। ভোম্বলই তাকে উদ্ধার করতে পারে। 

রুবি কাতরভাবে ডাকল, ‘ভোম্বল।’ ডাকটা কেমন খসখসে হয়ে বেরুল রুবির গলা দিয়ে। 

রুবি দেখল ভোম্বল এবার চাইল তার দিকে। এবার ভোম্বলের চোখে দপ করে জেগে উঠল সেই অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। প্রচণ্ড সেই চুম্বকের টানে রুবির শরীরের সমস্ত অণু পরমাণু ছটকে ছিটকে বেরিয়ে পড়তে চাইল। 

‘রুবি!’ ভোম্বল ডেকেছে তাকে। চিনেছে তাকে। কেমন করে রুবি এখন ধরে রাখবে নিজেকে? কেমন করে রক্ষা পাবে? 

‘ভোম্বল।’ রুবি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। 

ভোম্বল। রুবি পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল। ভোম্বল, তুই আমাকে ছেড়ে দে। আমি পালাই। 

রুবির ঠোঁট দুটো থরথর করে অবিরত কাঁপছে। বলিষ্ঠ দুটো ঠোঁটের আশ্রয় চাইছে সুস্থির হবার জন্য। 

তোর কাছ থেকে আমার পালানো দরকার ভোম্বল। তুই কি বুঝিসনে? 

‘রুবি।’

শীতলের ডাকে তুফান উঠেছে রুবির দেহে। তার কঠিন বুক দুটো উঠছে আর নামছে। নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবার ইচ্ছাটা এই তুফানে হু হু করে পাক খাচ্ছে। ঝড়ে-পড়া হালভাঙা অসহায় একটা জাহাজ, রুবি, এই তুমুল মাতাল রাতে নাকানি চুবানি খেতে খেতে চুম্বক পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়ার জন্য অনিবার্যভাবে এগিয়ে চলেছে। কাছে কাছে ক্রমশ কাছে। 

ভোম্বল, তুই দ্যাখ, তুই দ্যাখ, আমি এখন কত বড় হয়েছি। 

রুবি কাতরভাবে বলতে চাইছে। কিন্তু এই তুলকালাম তুফানে তার সব কথা কুটি কুটি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ শুনতে পাচ্ছে না। 

আমি বড় হয়েছি ভোম্বল। এখন আমি বুঝতে শিখেছি। তোকে বুঝি। মাকেও বুঝতে পেরেছি। আমি শুধু তোর নই ভোম্বল, আমার মা’ ও তোর। 

রুবি কেঁদে ফেলল। 

তুই আমাকে ছেড়ে দে ভোম্বল। আমি পালাই এ বাড়ি থেকে। আমি কেন হটেলে যাচ্ছি তুই কেন তা বুঝিসনে? 

‘রুবি।’

পাহাড়টা কী বিরাট। কী কালো। কী ভীষণ। কী প্রচণ্ড তার টান। কত কাছে। 

রুবি! রুবি! রুবি! 

গর্জনে রুবির কানে তালা লেগে যাচ্ছে। 

তুই অন্ধ, তুই অন্ধ, তুই অন্ধ, তুই কিচ্ছু দেখতে পাসনে ভোম্বল। তুই কিচ্ছু বুঝিস নে। 

শেষবার সে জানাতে চাইল তার মিনতি। তুই আমাকে পালাতে দে ভোম্বল।

তারপর আছড়ে পড়ল শীতলের বুকে। হাউ হাউ করে রুবি কেঁদে উঠল।

শীতলের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে কাতরাতে লাগল। ‘বাবা! বাবা। বাবা।

শীতলের ক্ষুধিত দৃষ্টি তখন দরজায়। করবী দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখে বেদনা, ঈর্ষা, ক্ষুধা, মায়া-মমতা পর্যায়ক্রমে তরঙ্গ তুলে চলেছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *