এক ধরনের বিপন্নতা – ২

দুই 

শমিতা বেশ তুখোড় মেয়ে। কাঁটায় কাঁটায় আটটা, অফিসে এসে হাজির হয়েছে। বেশ মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘এবার নিশ্চয়ই অভিনন্দন জানাতে পারি, কী বলেন? 

শীতল এক নজর শমিতাকে দেখে নিল। তারপর শান্তভাবে তাকে ধন্যবাদ জানাল। শমিতা বলল, ‘এখন চলুন আমার ঘরে। 

শীতল ওর টেবিলটার দিকে চাইল। কুড়ি বছর এই এক টেবিলে। ঘরের এই একই কোনায়। এটা ছিল শীতলের আশ্রয়। তার দুর্গ। তার বাঁধা কাজ সে যথাযথ করে যেত। তাই সে কোনও সমস্যা সৃষ্টি করেনি, তাই সে কোনওভাবেই কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। এই অফিসের বৈশিষ্ট্যহীন সব আসবাবের সেও যেন একটাতে পরিণত হয়েছিল। তাকে যারা চিনত, চক্কোত্তিদা, হঠাৎ চক্কোত্তিদার কথা মনে পড়ল, তারা সব কবেই রিটায়ার করে চলে গিয়েছে। কজনই বা বেঁচে আছে আজ? 

‘দশটায় বস্ আসবেন।’ শমিতা যেতে যেতে বলল।’তখন আপনার ওরিয়েনটেশন হবে।’

কথাটা চক্কোত্তিদাই বলেছিল। তাকের উপর গাদা করা ফাইলের দিকে আঙুল দেখিয়ে, তখন সে সদ্য ঢুকেছে, চক্কোত্তিদা বলেছিল, এই যে সব তেজপাতার বস্তা দেখছ না ভায়া, সারাজীবন ধরে আমরা এই পর্যন্ত জমিয়ে যেতে পেরেছি, এবার তুমি জমা করবে, তারপর জমা করবে তোমার পরে যারা আসবে তারা। দারুণ ব্যাপার, অ্যাঁ। 

‘বস্ আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী, নতুন লোক নিয়ে কাজ পারবেন তো?’ শমিতা বলল, ‘কেন পারব না? এটা তো একটা চ্যালেঞ্জ।’

কী হবে জিজ্ঞেস করছ ভায়া? কী আবার হবে। মালিকের জিনিস, ইচ্ছে হলে মালিক ওই সব দিয়ে কোনদিন হয়ত পোঁদ পুঁছবে। অ্যা। হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ। 

চক্কোত্তিদা অনেকদিন রিটায়ার করে গিয়েছেন। মালিক কথাটাও তাদের শব্দভাণ্ডার থেকে বাতিল হয়ে গিয়েছে। এখন সবাই বলে বস্। 

‘বসুন।’ শমিতা এয়ার কুলারের মুখটা আরও খুলে দিল। রুমাল বের করে মুখ গলা ঘাড়টা মুছে ফেলল। 

‘কী গরম, না?’ শমিতা হাসল। ‘মাঝে মাঝে মনে হয় র‍্যাট রেস। কী, কথা বলছেন না যে? কালকের হ্যাংগওভার কি এখনও চলছে না কি?’ 

‘কালকের হ্যাংগওভার।’ শীতল প্রাণপণে নিজেকে টেনে তোলবার চেষ্টা করল, ‘তা বলতে পারেন। সত্যি বলতে কি আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছি মিস 

‘আমি ডাইভোরসি।’ শমিতা শান্তভাবে বলল। 

শীতল অপ্রস্তুত। ‘সরি, আমি বুঝতে পারিনি।’

‘এখন তো বুঝতে পারলেন। নাউ কল মি প্রপারলি।’ 

শমিতা কি অপমানিত হল? শীতল বুঝতে পারল না। এই তো সবে শুরু। হেনস্থার এখনই হয়েছে কী? তার মন কু গাইতে থাকল। বিপন্নভাবে সে শমিতার দিকে চাইল। শমিতার মুখে গাম্ভীর্য থমথম করছে। 

‘কী হল, চুপ করে রইলেন কেন? আপনার সামনে এক পারটি এসেছে। তিনি মহিলা এবং ডাইভোরসি এবং অত্যন্ত টাচি। তাকে প্রপারলি অ্যাড্রেস করুন।’

হঠাৎ শীতলের সন্দেহ হল, শমিতা তার সঙ্গে রসিকতা করছে। তার মনের উপর থেকে চাপ কিছুটা কমল। এবং শীতল অবাক হয়ে দেখল, এটা তার খারাপ লাগছে না। সে চুপ করে বসে রইল। 

শমিতা হেসে উঠল। ‘আপনার উইট টেসট করছিলাম। খুবই পুওর। বস্ হলে বলতেন,’ শমিতা পুরুষের স্বর নকল করে বলল, ‘নট ইভেন আপটু টু স্টারস।’

শমিতা সিগারেট এগিয়ে দিল। শীতল প্যাকেট থেকে একটা তুলে নিল। শমিতা লাইটার ওর দিকে এগিয়ে ধরল। বলল, ‘বলুন থ্যাংকস। 

শীতল বলল, ‘আগে ধরাই।’

‘ওটা সিগারেটের জন্য। ধরাবার জন্য আলাদা। সেটা পরে। ম্যানারস তো দেখছি কিছুই জানেন না।’ শমিতা লাইটার জ্বালল। 

শীতল সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘কেরানির ওসব দরকারে লাগে না। থ্যাংকস।’

‘আপনি আর কেরানি কোথায়? এখন তো একজিকিউটিভ উইথ অল্ দি পারকুইজিটস। আপনার ফোন নমবরটা বলুন তো। টুকে রাখি।’

‘আমাদের বাড়িতে ফোন নেই।’

‘আমাদের মানে?’ শমিতা ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। ‘মিসেস ছাড়া আর কে আছেন বাড়িতে?’ 

শীতল তার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আর –এক মেয়ে।’

বলার সঙ্গে সঙ্গে শীতল তীব্র যন্ত্রণার কামড় খেল মনে। জ্বালা এখনও কিছুমাত্র কমেনি। 

‘লাকি।’ শমিতা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে একটু হাসল। ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার।’

শীতল অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করতে লাগল। সে চাইছিল শমিতা কথা বলুক। শীতলকে আরও একটু নাস্তানাবুদ করুক। শীতলের মনটা সে আটকে রাখুক। 

‘আপনার বাড়িতে কে আছেন আর? 

‘আমি আর আমার টেলিফোন।’ শমিতা হাসল। ‘আমি আপনার মত লাকি নই।’

শীতলের মনে হল শমিতাও তা হলে একা। শমিতাকে তার একই গোত্রের বলে মনে হতে লাগল। শমিতার সান্নিধ্যে আসার কারণে এতক্ষণ ধরে তার মনে একটা অস্বস্তি খচখচ করছিল। সেটা এখন যেন মিলিয়ে যেতে লাগল। 

‘আপনি আমার চাইতে কম লাকি তা কে বললে? কথা বলতে ভালই লাগছে শীতলের। আপনার সঙ্গী-ভাগ্য দেখে আমার তো ঈর্ষা হচ্ছে।’

শীতলকে হঠাৎ এতগুলো কথা এক সঙ্গে বলতে শুনে শমিতা অবাক হল। সে শীতলের কথা ধরতেও পারল না। 

‘তার মানে? আমার সঙ্গী আবার কোথায় দেখলেন?’ 

‘কেন, আপনার টেলিফোন?’ 

‘অ্যাঁ–।’ শমিতার মুখ হাসিতে ভরে উঠল। ‘আপনার পেটে পেটে এত।’ শমিতা হাসতে লাগল। ‘আবার ঠাট্টা হচ্ছে।’

‘সত্যি বলছি। আপনার সঙ্গী-ভাগ্য খুব ভাল।’ শীতলের কথায় একটুও ঠাট্টা প্রকাশ পেল না। ‘টেলিফোন সঙ্গী হিসেবে খুব বিশ্বস্ত।’ শীতলের আন্তরিকতা শমিতাকে স্পর্শ করল। ‘আপনাকে কখনওই ও ঠকাবে না।’

শমিতা শীতলকে দেখছিল। শেষদিকে শীতলের গলা ভারী হয়ে এল, শমিতা তাও লক্ষ করল। তার মনে হল কথাটা মন্দ বলেনি শীতল। এ বিষয়ে তো সন্দেহ নেই যে, মানুষের সঙ্গ থেকে টেলিফোনের সংসর্গে ঝঞ্ঝাট কম। বেশ আছি। শমিতা নিজেকেই ভোলাতে গেল। কিন্তু দেখল একটা ভারী নিঃশ্বাস তার বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সেটা সে হতে দিল না। কিন্তু শীতলের সামনে এখন সে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। এ তো বড় সাংঘাতিক লোক। কাছে আসতে না আসতেই তোলপাড় বাধিয়ে দিচ্ছে। শমিতা ভাবল, লোকটাকে বেশি প্রশ্রয় দেওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। 

শীতল আবার চুপ করে গিয়েছে। স্তব্ধতা দুজনকেই পীড়া দিতে লাগল। শীতল চাইছিল শমিতা কথা বলুক। শমিতা চাইছিল শীতল কথা বলুক। শমিতার বুঝতে দেরি হয়নি যে, লোকটা তার গাম্ভীর্যের নীচে একটা তীব্র বেদনার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। তা বেড়াক না। 

তাতে শমিতার বিচলিত বোধ করার কী আছে? না, শমিতা বিচলিত বোধ করছে এ কথা বোধ হয় ঠিক না। কিন্তু সে কি কিছুটা অশান্ত হয়ে উঠছে না এখন? শমিতা সিগারেটের প্যাকেটটা বের করল। শীতলকে একটা সিগারেট কি দেবে? টেলিফোন আপনাকে কখনওই ঠকাবে না। শীতলের এই মন্তব্যই শমিতার মনের স্থিরতা নষ্ট করেছে। এর অর্থ তো স্পষ্ট যে, মানুষ তাকে ঠকাবে। 

‘সিগারেট? ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত প্যাকেটটা এগিয়েই দিল শমিতা। 

মানুষ তাকে ঠকাবে নয়, মানুষ তাকে ঠকিয়েছে। জিতু তাকে ঠকিয়েছে।

‘না।’ থেমে যাচ্ছিল শীতল, হঠাৎ মনে পড়ায় তাড়াতাড়ি করে বলল, ‘থ্যাংকস।’ তারপর শমিতার দিকে চেয়ে হাসল। 

শেষ পর্যন্ত জিতুর কাছে তাকে ঠকতে হল। তবে আর বিশ্বাস কার উপর রাখবে শমিতা? টেলিফোন সঙ্গী হিসাবে খুব বিশ্বস্ত। ঠাট্টা করেনি শীতল। একটা সত্যকেই উচ্চারণ করেছে। মানুষের উপর যে বিশ্বাস রাখা যায় না, শমিতার চাইতে এ কথা আর কে জানে। জিতু, এ চিট। 

‘থ্যাংকস।’

শীতল লোকটা জ্ঞানী। নিশ্চয়ই অনুরূপ অভিজ্ঞতা ওরও হয়েছে। ওরা দুজন তা হলে একই ঝাঁকের পাখি। 

‘ইউ আর ওয়েলকাম। আমি তবে একটা ধরাই?’ 

‘ইউ আর ওয়েলকাম।’

শমিতা হেসে উঠল। লোকটা মোটেই বোকা নয়। এই আবিষ্কার শমিতাকে স্বস্তি দিল। মনের মেঘটা যেন সিগারেটের এক রাশ ধোঁয়া হয়েই শমিতার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। শমিতা সকৌতুকে শীতলের মুখের দিকে চেয়ে রইল। বলল, ‘ইউ আর স্মার্ট। দেখলে বোঝা যায় না।’ 

‘ইউ আর ওয়েলকাম।’

শমিতা এবার শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। শীতল অনুভব করল শমিতার হাসিটা সংক্রামক। তার মধ্যেও সংক্রমণ শুরু হয়েছে। রুবিই শুধু এমনভাবে মাঝে মাঝে হাসে। এবং সে সংক্রামিত হয়। করবীকে হাসতে সে বড় একটা দেখেনি। শীতল হাসতে লাগল। 

হাসি থামলে শীতল গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমার কাছে এক পার্টি এসেছেন, তিনি মহিলা এবং ডাইভোরসি এবং টাচি। কী বলে ডাকলে তাকে প্রপারলি ডাকা হবে? 

লোকটা সত্যিই স্মার্ট। অথচ শীতলের স্মার্টনেসে পিনটুদের মতো চালিয়াতি নেই। শমিতা বিচার করে রায় দিল। আসলে সরলতাটাই শীতলের আকর্ষণ। শমিতা আবার হেসে ফেলল। 

বলল, ‘আপনি আমাকে শমি বলবেন। এখানেও আমাকে সবাই শমি বলে। আমি আমার নামে পরিচিত হতেই ভালবাসি। আপনাদের বিধানে এদেশে মেয়েদের ল্যাজ বদলাতে হয়। আমার বাবা ছিলেন সিংহ। আমার স্বামী সেনগুপ্ত। তাই আমাকেও সেনগুপ্ত হতে হয়েছিল। এখন আমার ল্যাজে আবার সিংহ ফিরে এসেছে।’ 

শমিতা সিগারেটই ফুঁকুক আর কথায় কথায় ইংরেজিই ঝাড়ুক ওর মধ্যে কপটতা নেই। কথাবার্তাও সোজা এবং পরিষ্কার। শীতল শমিতার হাবভাব খুঁটিয়ে লক্ষ করতে লাগল। গোড়ার দিকে যে আড়ষ্টতা শীতলের ছিল তা কেটে গিয়েছে, এটা শীতল লক্ষ করল। 

‘আচ্ছা, আমার সম্পর্কে আপনার এসেসমেনট কী?’ শমিতা শীতলের দিকে চেয়ে রইল। 

‘কী করে বলব?’ শীতল হাসল। 

‘হোয়াট ডু ইউ মিন কী করে বলব? বলতে হবে। বলাই তো আপনার কাজ। আমাদের কোম্পানি তো এর উপরেই বেঁচে আছে। বস্ বলেন, উই মাসট থ্রাইভ অন হিউম্যান উইকনেসেস। মানুষের উইকনেস কোথায়, তার মনের নরম জায়গাটা কোথায়, ত্বরিতগতি সেটা খুঁজে বার করাই আমাদের চাকরি। সো দ্যাট উই ক্যান সেল ইট টু দি মারকেট অ্যাহেড অব আওয়ার রাইভ্যাল্স। 

শীতল এই প্রথম তার কাজের একটা হদিস পেল। মানুষের দুর্বলতা বুঝে বাজাৱে বেচা, এই তাদের ব্যবসা। প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে শমিতা। 

‘বুঝেছেন?’ 

‘অর্থাৎ আমার কাজ হচ্ছে, আমাদের ক্লায়েনটের—’  

‘আমরা অ্যাকাউনট বলি।’ শমিতা বাধা দিল। 

‘আমাদের অ্যাকাউনটের দুর্বলতা কোথায় সেটা চটপট আবিষ্কার করে ফেলতে হবে—’  

‘বস্ চান কমপিউটার লাইক এফিসিয়েনসি।’ শমিতা সিগারেটে টান দিল।

‘তারপর আমাদের অ্যাকাউনটের দুর্বলতা দোহন করে করে—’ 

‘হ্যাঁ, বুঝেছেন। আপনি খুব তাড়াতাড়ি শিখতে পারেন দেখছি।’

‘লাইক এ কমপিউটার? 

শমিতা হ্যাঁ বলতে গিয়েও থমকে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, কমপিউটারকে কি কোনও কিছু শিখতে হয়?’ 

‘সে তো আপনারই জানার কথা। কমপিউটারের ব্যাপার স্যাপার আমি কিছুই জানিনে।’

শমিতা বলল, ‘সত্যি কথা বলতে কী, আমিও জানিনে। বস্-এর এ বিষয়ে দারুণ নলেজ। উনিই রিয়েল কমপিউটার এজ-এর লোক। ওঁর ধ্যান জ্ঞান ক্রিয়া কর্ম চলা ফেরা সব কিছুই কমপিউটার ওরিয়েনটেড। তেমনি ওর মাথায় আইডিয়াও খেলে অসাধারণ। সে-সব আইডিয়া দারুণ থ্রিলিং। একবার কী বলেছিলেন জানেন? 

শমিতার উৎসাহ ওর বয়েসটাকে যেন কমিয়ে দিল অনেকটা। 

‘বস্ বলেছিলেন, জানেন শমি, কমপিউটারের প্লাস পয়েনটস সবই আছে। সেভিং ওয়ান। নেই শুধু ইনডিভিজুয়ালিটি। মানুষের যেটা ওনলি প্লাস পয়েনট। মানুষের আর যা যা আছে, সব বোগাস। এখন ধরুন, মানুষের ইনডিভিজুয়ালিটি যদি কমপিউটারের চরিত্রে আরোপ করা যেত তা হলে এই পৃথিবীতে এই ইনএফিসিয়েনট ইনডিসিপ্লিনড মানুষগুলোকে কোনও কাজে আর দরকারই হত না। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে জানেন। যদি টপ সায়েনটিসট আর টেকনোলজিসটদের দিয়ে একটা পুরুষ কমপিউটার বানানো যায় যার মানুষের মতই প্রজনন ক্ষমতা থাকবে। রাইট? তবে তাকে দিয়ে নারীর গর্ভসঞ্চার করানো যেতে পারে। রাইট? এবং এক হিউমাপিউটারের জন্ম দেওয়া যেতে পারে। রাইট? এই হিউমাপিউটারই হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর বাসিন্দা। কমপিউটারের ড্যাম এফিসিয়েনসির সঙ্গে ড্যাম ইনডিভিজুয়ালিটির ড্যাম ম্যারেজ। রাইট? অ্যানড দ্যাট ইজ দ্য হিউমাপিউটার। এ কমপিউটার উইথ ইনডিভিজুয়ালিটি।’

‘বস্-এর সে কী এনথু।’ শমিতা বলল, ‘বললেন, নাউ শমি হোয়াট ডু ইউ থিংক? সত্যি কথা বলতে কী, আইডিয়াটা আমার খু-উ-ব অরিজিন্যাল ঠেকেছিল। আপনার কী মনে হয় শীতল?’ 

শমিতার মুখে অস্তরঙ্গ ডাক শুনে শীতল হঠাৎ চমকে উঠেছিল। শমিতা টের পেল না।

শীতল বলল, ‘খুবই মৌলিক ভাবনা।’

‘তাই না? আমিও বকে একজ্যাকটলি এই কথা বলেছি। বলেছি, ইউ হ্যাভ দ্য বেল্ট অব এ গ্রেট সায়েনটিস্ট। বস্-এর সঙ্গে আপনার পটবে দেখছি।’ শমিতা যেন নিশ্চিন্ত হল। ‘বস্ লাইক-মাইনডেড লোক খুব পছন্দ করেন।’

তারপর শমিতা হাসল। ‘মৌলিকতার এখনই কী দেখলেন। সবটা শুনুন, তবে তো আপনার প্রপার আইডিয়া হবে।’ শমিতা আরেকটা সিগারেট ধরাল। ‘তারপর বস্ সরাসরি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি বিশ্বের প্রথম হিউমাপিউটারের মা হিসেবে নিজেকে ভলানটিয়ার করতে রাজি আছি কি না?’ 

‘অ্যাঁ!’ শীতল স্তম্ভিত হয়ে গেল। শীতল দেখল ওর অবস্থা দেখে শমিতা হাসছে। কিন্তু তাতে ব্যঙ্গের লেশমাত্র নেই। অত্যন্ত তৃপ্তিকর এক হাসি। শমিতা যেন সত্যিই গর্বিত বোধ করছে। 

‘কী, এখন কী মনে হচ্ছে?’ শমিতা যেন নিজের পদোন্নতির সংবাদ শোনাচ্ছে।

‘অ্যাঁ হ্যাঁ, দারুণ।’ শীতল চমক ভেঙে বলল। ‘একটা সিগারেট দেবেন? 

‘নিন না।’ শমিতা প্যাকেটটা ওর সামনে টেনে দিয়ে লাইটার জ্বেলে ধরে রইল।

সিগারেটে টান দিয়ে ধাতস্থ হল শীতল। ‘থ্যাংকস।’ ধোঁয়া ছাড়ল লম্বা। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘তা এই অফারে আপনি কী বললেন?’ 

‘নিজেই আন্দাজ করুন, কী বলতে পারি? শমিতাকে ওর দিকে আগ্রহভরে চেয়ে থাকতে দেখল শীতল। 

‘আপনি বললেন, হাউ থ্রিলিং। থ্যাংক ইউ বস্। আমি রাজি।’ শীতল বোধ করছিল সে ভিতরে ভিতরে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে। 

‘আপনার বুদ্ধি আছে। ফুল মার্কস। আমি ঠিক ওই কথাই বলেছি।’ শমিতা হাসছে। 

শমিতা শীতলকে বাঁদর নাচাচ্ছে হঠাৎ এইরকম একটা ধারণা শীতলকে পেয়ে বসল। তাকে মেয়েরা এত নাচায় কেন? এমন কী, সেদিনের ওই পুঁচকে মেয়ে রুবি, সেও তাকে নাচিয়েছে। শীতলের এই হঠাৎ পরিবর্তন তার চোখে মুখে এমনই প্রকট হয়ে উঠল যে, শমিতা সতর্ক হবার চেষ্টা করল। 

শমিতা গলার স্বর পালটে বলল, ‘কেন বলেছিলাম জানেন? 

শীতল কঠিন স্বরে বলল, ‘একটা প্রোমোশনের জন্য। 

‘আপনি তো প্রায় সর্বজ্ঞ দেখছি। তবে মিঃ নো-অল, এটা ফসকে গেল। শমিতার স্বর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে। তার দুটো চোখ তীব্র হয়ে জ্বলছে। সে লাইটারের শিখার দিকে চেয়ে আছে। সে হাসল। শীতলের মনে হল ওর হাসিটা লাইটারের শিখারই সমগোত্রীয়। 

‘গেস্। আরেকটা চানস দিলাম।’

‘কিছু টাকা বাড়াবার জন্য।’ শীতল প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতায় সর্বস্ব পণ করে নেমে পড়ল। ‘বেতন, ডি-এ অথবা কোনও অ্যালাউয়েনস।’

ফুঁ দিয়ে লাইটারের শিখাটা নেবাতে চেষ্টা করল শমিতা। পারল না। বলল, ‘এবারও মিস। আচ্ছা, আরেকটা চানস।’ শীতলের দিকে শমিতা আর চাইছেই না। 

‘পাবলিসিটি।’ শীতল চাবুক চালাল। ‘বিশ্বের প্রথম কমপিউটারের ঔরসজাত শিশুর গর্ভধারিণী।’ 

শমিতা লাইটারের শিখায় ফুঁ দিল জোরে। নিবল না সেটা। 

‘কাগজের হেডলাইন। প্রথম পাতায় ছবি ‘ 

শমিতা আবার ফুঁ দিল। লাইটারের শিখা লুটিয়ে পড়েও দাঁড়িয়ে গেল। 

‘রেডিও ইন্টারভিউ। টিভি। আত্মজীবনীর একসক্লুসিভ সিরিয়ালাইজেশনের জন্য দাদন প্রাপ্তি।’ শীতল ঘেমে উঠল। শীতল কিঞ্চিৎ ক্লান্ত এখন। 

শমিতা লাইটারের ঢাকনা চাপা দিয়ে হঠাৎ শিখাটাকে খুন করল। 

শীতল হঠাৎ দুই করতলে মুখ ঢেকে কাতর স্বরে বলে উঠল, ‘আমি আন্তরিক দুঃখিত শমি। আমাকে মাফ করুন।’ 

শমিতা হাসল। তারপর সে বলল, ‘মেয়ে, বিশেষত যদি ডাইভোরসি হয়, তবে তার অবস্থা লুটের মালের মতো হয়। আপনার ক্ষমা চাইবার প্রয়োজন নেই শীতল। এই দুনিয়া বড় শক্ত জায়গা। আমার পক্ষে তো আরও। বাঁচবার জন্য এখানে প্রত্যেককেই কৌশল ঠিক করে নিতে হয়।’ 

শমিতা থামল। টেলিফোন বাজল। 

শমিতা বলল, ‘আমার কনফারমেশন দরকার ছিল।’

টেলিফোন আবার বাজল। শমিতা ফোন তুলে বলল, ‘ইয়েস? …হ্যাঁ, রেবা। ….মর্নিং, হ্যাঁ। …এখানেই আছেন। … আচ্ছা।’

শমিতা টেলিফোন রেখে আস্তে করে বলল, ‘তিন বছর ঝুলে আছি। এই সব চাকরিতে কনফারমেশানটা বড্ড জরুরি।। আমরা আবার একজিকিউটিভ। ইউনিয়নের প্রোটেকশন নেই। কাজেই মান অপমানটাকে আমি একটু দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নিন, চলুন, বস্ এসে গিয়েছেন। আমার ধারণা আপনাকে ওঁর পছন্দ হবে। আপনি আমার হেলপের উপর নির্ভর করতে পারেন। বি চিয়ারফুল।’

.

ওদের অফিসটা যে এত বড় সেটা যেন আজই প্রথম টের পেল শীতল। বসের ঘর থেকে বেরতেই তাঁর সেকরেটারি নখে রং লাগাতে লাগাতে শীতলের দিকে চাইল। রুবির বয়সীই হবে। 

হেসে বলল, ‘কনগ্রাচুলেশনস কাকাবাবু।’

কাকাবাবু! শীতল অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে চাইল। চিনতে পারল না। কার মেয়ে? তাকে কাকাবাবু বলবে এমন তার নিজের কেউ তো এই দুনিয়ায় নেই। রুবিকে কাকাবাবু বলাতে কত চেষ্টা করেছিল করবী। পারেনি। মামাবাবুও না। রুবি বুঝি বুলি একটাই শিখেছিল—বাবা। রুবির কথা এখন থাক। সন্ত্রস্ত হয়ে শীতল রুবিকে তখনকার মত ঝেড়ে ফেলতে চাইল। কিন্তু এ মেয়েটি কে? 

শীতল বলল, ‘ধন্যবাদ। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক—’  

মেয়েটি ফিস ফিস করে বলল, ‘আমি রেবা। বি কে চক্কোত্তির মেয়ে। বাবা আপনার সেকশনেই কাজ করতেন।’ 

চক্কোত্তিদার মেয়ে। শীতল রেবার মুখ খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। বটে। 

‘আপনি বাবার শ্রাদ্ধে তো আমাদের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। বাবাকে দেখতেও যেতেন।’

‘হ্যাঁ তা গিয়েছি। উঃ সে কতদিনের কথা। ওঁর একটা মেয়ে তখন স্কুলে পড়ত। টফির খুব ভক্ত ছিল। তার জন্য টফি নিয়ে যেতাম। চক্কোত্তিদা ধমকাতেন তাকে। সেই কি তা হলে—’ 

শীতল ইতস্তত করতে লাগল। বুঝতে পারল না কথাটা কীভাবে শেষ করবে। শূন্য স্থানে কী বসাবে? তুমি না রেবা। মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত কি না সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে সে আপাতত পৌঁছুতে পারছে না। 

মেয়েটি লাজুক হেসে বলল, ‘সে-ই আমি। এখনও আমি টফির ভক্ত।’

রুবিও কি কম ভক্ত ছিল। কিন্তু রুবির কথা এখন থাক। রেবাকেও তার ভাল লেগে গেল। 

এখন নিজের পুরনো জায়গায় এসে সে হাসল এবং স্বস্তি পেল। এতক্ষণে তার মনে হল সে অফিসে এসেছে। সে বাস্তব জগতে এসেছে। এতক্ষণ সে যেন স্বপ্নের ঘোরে ছিল। এতক্ষণ সে এই অফিসের যে অঞ্চলে ঘুরছিল সেটা তার পক্ষে বিদেশ। 

পেমেনটের নৃপতি হাঁফাতে হাঁফাতে এল। বলল, ‘দাদা, বুড়া বয়সে অ্যাকেরে জ্যাক পট মাইরা দিলা। অ্যারেই কয় উস্তাদের মাইর। রাজত্ব পাইলা লগে হুনতাছি আবার রাজকন্যাও আছে। অখন তো ডবল খাওয়াইতে লাগব। আচ্ছা ক্যামনে এ কাম করলা দাদা কও তো?’ 

নৃপতি সরখেল বছর চারেকের জুনিয়ার। শীতল তার নাম জানে। এক অফিসে কাজ করে। মাইনের দিন ক্যাশ কাউন্টারে যা দেখা হয়। এ ছাড়া কোনও যোগাযোগ নেই। 

‘কী দাদা, ভোম মাইরা রইলা ক্যান? কী কোনও রসের ব্যাপার? বিদ্যাসুন্দরের কায়দা ধরছিলা বোধ হয়। কী, বিদ্যারে কি লোডেড কইরা দিছ, না বসের লোড নিজের ঘাড়ে তুইলা নিছ? এইরকম কিছু একটা হইব। নইলে যে হালা (শীতল বুঝল বস্-এর কথা বলছে। ওদের এদিকে শালা মানেই বস্) অ্যামুন চিপপুস, হে তুমারে ডাইকা লইয়া রাজ্যপাটে বসাইয়া দিল, তুমি অ্যামুন গুণের নিধি, এ তো মনে লয় না।’ নৃপতির সাফ কথা। ‘কিছু অ্যাকটা ব্যাপার আছে। তুমারে কইয়া গেলাম দাদা, বাইর আমি করমুই করমু। ধর্মের কল বাতাসে লড়বই। 

নৃপতি যেতে না যেতেই ফোন। সেকশনের ফোন ওরই টেবিলে। শীতল ভয়ে ভয়ে ফোনটা তুলল। ফিনানস কনট্রোলের সেনশর্মা। ওর চাইতে সাত আট বছরের জুনিয়ার। 

‘দাদা, এইমাত্র অরডারের কপি পেলাম। কনগ্রাচুলেশন। একটা অ্যারিসট্রোক্র্যাট কিন্তু পাওনা হল দাদা। গরিবকে মাইরি বঞ্চিত কোরো না। আমরা শ্লা তো আর জায়গা মতো লুবরিকেট করতে পারব না, তাই উপরে ওঠাও হবে না।’

সেনশর্মা এক সময় খুব টিপটপ থাকত। অফিসে ওই প্রথম বেলবটস। তারপর থেকে আর দেখা সাক্ষাৎ হয় না। হঠাৎ ওর চক্কোত্তিদার কথা মনে হতে লাগল। এই টেবিলে থেকেই উনি অবসর নিয়েছিলেন। তারপর বসতেন নিত্যানন্দদা। তিনি ও এখানে থেকেই রিটায়ার করেন। তারপর কুঞ্জদা আর গোপীবল্লভদা। তারপর এসেছিল শীতল। তাদের সেকশনে এটাকে বলা হয় পিজরাপোল। চক্কোত্তিদা বলতেন, বুঝলে ভায়া, এই টেবিলে বসলেই দেখবে কত নিশ্চিন্ত। সব চুলবুলোনি দেখবে বন্ধ হয়ে যাবে। কেবল মনটা বলবে, হরি দিন তো গেল সন্ধে হল পার করো আমারে। কাউকে খারাপ দেখতেন না চক্কোত্তিদা। কারও ভাল হলে আন্তরিকভাবে খুশি হতেন। খোঁজ খবর নিতেন সকলের। উৎসাহ ছিল কত। যতদিন বেঁচে ছিলেন, তিনি তাদের সেকশনের বার্ষিক পিকনিক চালু রেখে গিয়েছিলেন। 

কিন্তু রেবার মনটা এমন হল কেন? কী বা ওর বয়েস। কাকাবাবু, শমি সিনহার সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন। শীতলের কানে রেবার ফিসফিস কথা বেজে উঠল। লোককে বড্ড একসপ্লয়েট করেন উনি। রেবার বাবার মুখ দিয়ে এ ধরনের কথা কখনওই বের হত না। রুবি সে তুলনায় এখনও অনেক বেশি তাজা আছে। সে এখনও অনেক ছেলেমানুষ আছে। কিন্তু এখানে রুবির কথা আসছে কেন? তাকে কিছুতেই সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না। শীতল বেশ বিপন্ন বোধ করতে লাগল। রেবাও কি এই অল্প বয়সেই র‍্যাট রেসে জড়িয়ে পড়ল? 

‘কী রে, অফিসে যে শোরগোল তুলে দিয়েছিস?’ যোগীন হাসতে হাসতে এসে ওর সামনে বসল। শীতলের খুব ভাল লাগল। এই অফিসে একই দিনে দুজনে ঢুকেছে। সেই থেকে দুজনে বন্ধুত্ব। একসময় দুজনে নিত্য মাদ্রাজি কাফেতে টিফিন সারত। এখন কালে ভদ্রে দেখা হয়। যোগীনের কাজ বেড়েছে। পারসোনাল ডিপারমেন্ট-এর হ্যাপা অনেক। যোগীনের পদও খুব দায়িত্বপূর্ণ। খেটে উঠেছে যোগীন। সন্ধেবেলায় ল পড়ে পাশ করেছে। লেবার ল-এ খুবই ভাল। ম্যানেজমেন্টও পাশ করেছে। তবে বেশ বুড়োটে হয়ে গিয়েছে। কে বলবে এখন যে, এই অফিসে এক সময় ওরা দুজন কাব্যচর্চা করত। 

‘তাই তো দেখছি।’ শীতল হাসল। ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ।’

‘বুড়ো তো আমি। তোকে বুড়ো কে বলবে? যোগীন সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল। 

‘তারপর,’ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে যোগীন বলল, ‘সকাল থেকে ছোবল টোবল কেমন খেলি।’ 

‘ইউজুয়াল।’ শীতল হাসল। ‘তুই যখন এলিই, তোকে একটা জিনিস দেখাই। জিনিস-পত্র গোছাতে গিয়ে এটা কাল পেয়েছি। কোন তলায় পড়ে ছিল।’

শীতল নিচু হয়ে টেবিল হাতড়াতে লাগল। টেলিফোন বেজে উঠল। শীতল বলল, ‘দ্যাখ তো কার? 

ফোন তুলে যোগীন বলল, ‘হ্যালো। হ্যাঁ উনি আছেন। ধরুন। 

শীতল একটা খাতা আর একটা ফোটোগ্রাফ টেবিলের উপর তুলে ফোন ধরল। ‘হ্যাঁ বলছি। …বেশ। …না হ্যানড ওভার এখনও করিনি। …আচ্ছা। লানচের পরেই বসব। … লানচ? একটু ধরুন। ফোনে হাত চাপা দিয়ে শীতল বলল, ‘সময় আছে আজ? মাদ্রাজি হবে?’ যোগীন ঘাড় নাড়ল। শীতল ফোনে বলল, ‘সরি, আজ আমি ব্যস্ত। …আচ্ছা। ঠিক আছে। আজকেই বসব।’ 

‘তা হলে শোন, এখন উঠি।’ যোগীন উঠে দাঁড়াল। ‘কাজ সেরে রাখি গে।’

‘এইটে দ্যাখ।’ শীতলও উঠল।

বেয়ারা এসে বলল, ‘বড়বাবুর তলব।’ 

‘যাচ্ছি। যাও।’ 

‘এখনও পাওয়ার দেখাচ্ছে?’ খাতাটা হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করল যোগীন। 

‘হ্যাঁ।’ শীতল হাসল।

‘তবে আজ একটু টাইট দে।’

‘তুইও যেমন।’

‘ফণা তুলতে দোষ কী? তুই তো আর ছোবল দিবি না।’ খাতাটা টেবিলের উপর রেখে দিল যোগীন। তারপর যেতে যেতে বলল, ‘যত্ন করে রেখেছিস তো বড়।’ 

খাতা সম্পর্কে যোগীনের অনাগ্রহ শীতলকে দুঃখ দিল। বলল, ‘অযত্নে ছিল, তাই আছে।’

যোগীন হাসল। ‘তবে সেইভাবেই আবার রেখে দে।’

.

‘এই যে মওহায়’ মিঃ বটকিষ্টো নানডি সেকশন ইন চারজ নামাঙ্কিত টেবিলের কাছে আসতেই শীতল নন্দীর খ্যানখেনে আওয়াজ শুনতে পেল। ‘একজন কেষ্টবিষ্ট নাকি হতে চলেছেন এ অফিসে, অ্যাঁ।’ নন্দী শীতলের পাঁচ বছরের জুনিয়ার সেই কারণেই কি না কে জানে শীতলকে অপমান করার কোনও সুযোগই সে ছেড়ে দেয় না। 

শীতল শাস্তভাবে বলল, ‘আমি তো তা-ই জানি।’

‘তা-ই নাকি?’ নন্দী চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তা যখন হবেন তখন হবেন। এখন মালিকের কাজটা তো তুলে দিন।’

শীতল বলল, ‘কোনও ফাইল আমার কাছে পেনডিং নেই। সব আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন সেগুলো বুঝে নিয়ে আমাকে তাড়াতাড়ি রিলিজ করুন। 

‘মওহায় কি ম্যানেজিং ডিরেকটার হয়েচেন। অ্যাঁ?’ 

‘না।’ শীতল হাসল। 

‘যাক, নিশ্চিন্ত হলাম। নন্দী টাইয়ের গেরোটা একবার নাড়াচাড়া করল। পাইপটাও হাতের তালুতে ঠুকে নিল। বোঝা গেল বস্ পাইপ ধরেছেন। সেকশন ইন চারজ হবার আগে নন্দী ধুতি পরত। নন্দী একদিন শুনল, ছোকরা বস্ মনে করেন, ধুতি ইনএফিসিয়েনসির চিহ্ন। সেইদিনই নন্দী টাকা ধার করে টিফিনের সময় বেরিয়ে গেল। অফিসে ফিরল রেডিমেড স্যুট টাই পরে। প্রশ্নের মুখে পড়ে নন্দী সাফ জবাব দিয়েছিল, ইনএফিসিয়েনসির নামগন্ধও যাতে আছে আমি তাতে নেই মওহায়। বস্ পাইপ খায়, অতএব নন্দীও হাতের তেলোয় পাইপ ঠোকে। 

শীতল বলল, ‘নিশ্চিন্ত হলেন, বেশ কথা। এবার কেষ্টবিষ্টুটাকে বিদেয় দেবার ব্যবস্থা করুন।’ 

‘আপনার মুকের কতায় কাজ হবে? বলি অরডার কোতায়? 

শীতল চিঠিখানা বের করে নন্দীর হাতে দিল। বলল, ‘সইটা ভাল করে দেখবেন। আর ওই উইথ ইমিডিয়েট এফেকট কথাটা। 

নন্দী চিঠিটা একনজরে দেখে নিয়েই পারসোনেলে ফোন করল। ‘মিঃ সরকারের অরডারের কপি কোতায়? … পাঠিয়ে দিয়েচেন? সে কী মওহায়। ….তা দেখচি। …হ্যাঁ হ্যাঁ, অসুবিধে আবার কী। একুনি দিচ্ছি। হ্যাঁ হ্যাঁ।’

ফোন রাখতেই নন্দীর গলা বদলে গেল। ‘কেউ কেউ মওহায় শুধু কপাল নিয়ে জন্মায়।’ নন্দী ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে কপালে ঠুক ঠুক করে ঘা দিল। ওর পাঁচ আঙুলে পাঁচটা পাথর। ‘যেমন আপনি। পিজরাপোল থেকে প্রোমোশন? এ তো মওহায় মশান থেকে সিংহাসনে বসারই শামিল। অ্যাঁ। কপাল কপাল, মওহায় সবই কপালে করে। মাঝে মাঝে মনে হয় তবে এত সব করচি কেন? শাস্তরে বলেচে উদ্যোগিনং পুরুষ সিংহং। এত উদ্যোগ করলুম।’ দু’হাতের দশটা আঙুলের পাথরগুলো চোখের সামনে মেলে ধরল নন্দী। ‘তা কোতায় কী?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘ভগবান, শান্তর ধর্ম, জ্যোতিষ, দূর—দুনিয়ার অবিচার দেকে দেকে ভক্তি চটে যায় 

হঠাৎ যেন শীতলের দিকে নজর পড়ল নন্দীর। ‘যান মওহায়। দাঁড়িয়ে আচেন কেন? ফাইল টাইলের কতা ভাববেন না। এই অফিসেই তো রইলেন। পায়ে রাখবেন। 

শীতল বলতে চাইল, এই আপনি যেমন রেখেছিলেন? কিন্তু নিজেকেই ধমক দিল। নিঃশব্দেই সে তার টেবিলে ফিরে গেল। একটা সিগারেট ধরাল। তারপর ভাবতে লাগল তার সহকর্মীদের কথা। কেউ তার উপর খুশি নয়, হুল যে যতটা পারে বিধিয়েছে। যোগীনই কেবল খুশি। কেন, শমিতা? সে যে এই অফিসেই আছে, এতদিন সবাই যেন তা ভুলেই গিয়েছিল। অথচ রোজই দেখা হয়েছে এদের সঙ্গে। দু একটা কথাও হয়েছে। প্রতি বছর বিজয়ার কোলাকুলি সারার জন্য অজস্রবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে হয়েছে। হ্যাপি ক্রিসমাস হ্যাপি নিউ ইয়ার এমন কি পয়লা বৈশাখের শুভ নববর্ষও শুনতে হয়েছে। কিন্তু সে-সবই নিরুত্তাপ অভ্যাসের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। যেমন সে রোজ সই করে হাজরে খাতায়। কিন্তু আজ তার অকস্মাৎ পদ পরিবর্তন তাকে সব সহকর্মীর ঈর্ষাকাতর চোখের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকেই ক্ষুব্ধ শীতলের উপর। শীতল যেন ওদের প্রত্যেকের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে। যা ছিল প্রত্যেকেরই প্রাপ্য তা থেকে শীতলই যেন ওদেরকে বঞ্চিত করেছে। শীতল ওদের বিচারে আজ জঘন্য এক প্রতারক। ওদের মুখের গ্রাস সে কেড়ে নিয়েছে। শীতল দেখল সে কারও উপরই রাগ করতে পারছে না। সে দেখল তার মনে গ্লানি জমছে। শীতল জানে না, তাকে কোন গুণের জন্য প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। বস্-এর সঙ্গে স্বপ্ন সাক্ষাতেও সে তার প্রশ্নের জবাব পায়নি। বরং বস্-এর মুখে তার পোটেনশিয়ালিটির দারুণ প্রশংসা শুনে সে ঘাবড়েই গিয়েছে। তার সম্পর্কে যে অ্যাসেসমেনট জব-কনসালট্যানট ফার্ম পাঠিয়েছে, কী তা সে জানে না, তাতে বস্ তাকে জিনিয়াস বলেই ধরে নিয়েছেন। জসন আবিষ্কৃত তার গুণপনা সম্পর্কে বস্ যেরকম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন তাতে মাঝে মাঝে তার আশঙ্কা হচ্ছিল, এই বুঝি বস্ বিশ্বের হিউমাপিউটারের জন্মদাতা পিতা হিসাবে কোনও এক মেয়ে কমপিউটারের গর্ভে বীর্য নিষেকের যোগ্য প্রার্থী রূপে তাকে নির্বাচন করে বসবেন। শীতলের ভাগ্য ভাল, সেরকম কোনও প্রস্তাব বস্ তাকে দেননি। সে যখন জানল, তাকে সব চাইতে শক্ত অ্যাকাউনট শমি সিনহার সহায়তায় ট্যাকল করতে হবে, তখন সে খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করতে লাগল। অপরিসীম ছেলেমানুষি এবং প্রখর বিষয়বুদ্ধি দিয়ে গড়া এই আত্মপ্রত্যয়ী যুবকটিকে, যাকে সবাই বস্ বলে, দেখে শীতলের তেমন ভয় কিন্তু করল না। তেমনি আবার বস্ সম্পর্কে চট করে ভাল বা মন্দ কোনও ধারণাও গড়ে তুলতে পারল না। আসলে, সে স্বীকার করতে বাধ্য হল, এ ধরনের লোক সে আগে দেখেনি। 

শীতল বুঝতে পারেনি কখন সে খাতাটাকে টেবিলের উপর থেকে তুলে নাড়াচাড়া করতে শুরু করেছে। যুগলবন্দি। নামটা যোগীনের দেওয়া। ওদের দুজনের প্রতিভার স্বাক্ষর। মাদ্রাজি কাফেতে বসে প্রথম দু’বছরে ওরা টিফিনে কখনও বা ছুটির পরে যা নিয়ে মশগুল হয়ে থাকত, সেই স্বরচিত কবিতার এক নির্বাচিত সংকলন এই যুগলবন্দি। শীতল নাম দিতে চেয়েছিল দু’নয়ন। অত তুলতুলে নাম যোগীনের পছন্দ হয়নি। সে সুধীন দত্তের ভক্ত। দুজনের হস্তাক্ষরে সেদিনের সযত্নে রচিত পাণ্ডুলিপিটি আজ যথার্থই ধূসর। যোগীনও একবার উলটে দেখল না। ওদের কাব্যচর্চার উৎসাহে যখন পূর্ণ জোয়ার ঠিক সেই সময় যোগীন ভর্তি হল ল কলেজে। কিন্তু শীতল? সে কেন ছাড়ল ও পথ? সেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অফিস আর রুবি। অফিস মানে এই ঘরখানা। হ্যাঁ এই ঘর অর্থাৎ এই সেকশন আর রুবি, এই ছিল শীতলের জগৎ। আজ এই দুই-এর কাছ থেকেই সে সরে গেল। না রুবির কাছ থেকে সে যায়নি, রুবিই সরে গেল। রুবি বড় হয়েছে, নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার বয়েসও তার হয়েছে। নিক না সে সিদ্ধান্ত। কিন্তু রুবি তাকে গোপন করল কেন? এই কথাটা ভাবতেই তার যন্ত্রণা হচ্ছে। 

শীতল অন্যমনস্ক হতে চাইল। কাজকর্ম কিছু থাকলে এখন ভাল হত। শমিতা তাকে লানচ খেতে ডেকেছিল। গেলেই হত। কাউকে ওর এখন চাই। অকস্মাৎ শীতলের নজর পড়ল টেবিলের উপর রাখা ফটোখানার উপর। তুলে নিল। সেই কবেকার এক পিকনিকের ফটো। ওর চাকরিতে ঢোকার পরপরই কুঞ্জদা। স্বর্গে। নিত্যানন্দদা। খবর জানে না। পর পর দাঁড়িয়ে আছে লোকগুলো। চক্কোত্তিদা। স্বর্গে। শীতল যেন রোল কল করছে। বেয়ারা কীর্তিনিধি। স্বর্গে। তার পাশে কে উঁকি দিচ্ছে? ক্লাস ফোর স্টাফ। নামটা শীতলের মনে পড়ল না। প্রতিটি পিকনিকেই তো থাকত। কী নাম যেন? মনে আসছে না। কিছুতেই মনে আসছে না। শীতল বারবার মনে করার চেষ্টা করল। এটা যেন একটা জীবন মরণ ব্যাপার। নাঃ মনে পড়ল না। তার পাশে ব্যোমবাবু। খবর জানে না। ফুল – ফুল দিয়ে কী একটা নাম যেন ছিল ঝাড়ুদারটার। তার পাশে ধুতির উপর শার্ট গোঁজা হরিনাথ সাণ্ডেল। ওদের সেকশনের বড়বাবু, স্বর্গত। আজকাল কাগজে লেখে প্রয়াত। আজকাল ওদের অফিসে বড়বাবুও আর নেই, এখন সেকশন ইনচারজ। নন্দী নিজ খরচে একটা সাইনবোরড লিখিয়ে এনে ওর টেবিলে বসিয়ে রেখেছে। এ বিষয়ে নন্দীই ফারসট। ও বলে এফিশিয়েনসি। বড়বাবু বললে নন্দী অপমান বোধ করে। হরিনাথ সাণ্ডেল সম্মানিত বোধ করতেন। অতএব বড়বাবুও প্রয়াত। বিশেষত আমরা স্বাধীন হবার পরে। ফুলকো! মনে পড়েছে। ওর নাম ছিল ফুলকো। ফুলকো? সাণ্ডেল মশায়ের পাশে অনিল। স্বর্গে। শীতলের চোখ অনিলের চেহারার উপর আটকে গেল। অনিল। করবীর স্বামী। এই একবার সে সকলের পীড়াপীড়িতে পিকনিকে এসেছিল। তার চেহারাটা ভুলেই গিয়েছিল শীতল। কে তুলেছিল এই ফটো? শীতল মনে করার চেষ্টা করল। ফুলকিয়া! মনে পড়েছে ঝাড়ুদারটার নাম। না না ফুলকিয়া নয়, ফুলকারি। হ্যাঁ এইবার ঠিক। ফুলকারি। চক্কোত্তিদাকে দাহ করার সময় শ্মশানে সে-ই হাউ হাউ করে কেঁদেছিল। ফুলকারি। স্বর্গে। তার ছেলে এখন এখানে কাজ করে। ঝাড়ুদার নয়। ডেসপ্যাচের ক্লাস থ্রি স্টাফ। 

বস্ ওকে বলেছিলেন, হিডেন ট্যালেনট। লুকিয়ে থাকা প্রতিভা। আসলে এই অফিসে অনিলই ছিল সর্বার্থে লুকোনো প্রতিভা। অনিলের এই নিতান্ত সাধারণ গোবেচারা চেহারা দেখে ওর প্রকৃত পরিচয় পাওয়া কারও পক্ষে সাধ্য নয়। শীতলের চাইতে অনিল ছিল বছর পাঁচেকের বড়। অফিসে ছিল আট বছরের সিনিয়ার। ওদের ছিল স্রেফ মুখের পরিচয়। কিন্তু অনিল কোনও সুযোগেরই অপব্যবহার করত না। শীতলকে একটা মোটা টাকার বিমা করিয়ে দিয়েছিল। এমনভাবে বলেছিল অনিল যে, তার কোনও আপত্তিই টেকেনি। অনিল শুধু বিমার দালালিই করত না, ও ছিল ঝানু শেয়ারের দালালও। ফুলকারিকেও অনিল বিমা করিয়ে দিয়েছিল, সেই বিমার কল্যাণেই ওর ছেলে আজ লেখাপড়া শিখে এই অফিসের ক্লাস থ্রি স্টাফ। সাণ্ডেল মশাই, চক্কোত্তিদা, না জানি আরও কত জনের শেষ বয়সের হিল্লে করে দিয়েছিল বিমা করিয়ে, আর সলিড সব শেয়ার কিনিয়ে দিয়ে। অনিল হঠাৎ মারা যাবার পর এসব কথা সে শুনেছিল ওদেরই মুখ থেকে, যারা অনিলের কাছ থেকে উপকার পেয়েছিল। 

অনিলের ছবিটার দিকে শীতল একদৃষ্টিতে চেয়েছিল। আমার পলিসির নমিনি এখন রুবি, অনিলবাবু। আমাদের সম্পর্ক? শীতল নিঃশব্দে বলল, আমি লিখেছি ডটার। ভুল লিখেছি? শীতল খুব ক্লান্ত বোধ করল। হঠাৎ তার মনে হল তার একটা বিকল্প আশ্রয় চাই। তাজা আশ্রয়। রুবির বিকল্প। 

টেলিফোন তুলে শমি সিনহাকে ইতস্তত করে বলল, ‘আপনার যদি অসুবিধে না হয় তবে লানচটা একসঙ্গে হতে পারে।’

‘বা রে, আমি যে আরেকজনকে কথা দিয়ে ফেললাম।’ শমি একটু থামল। ‘আমি পিনটু মিত্তিরের সঙ্গে ওদের ক্লাবে যাচ্ছি।’ শীতল বুঝতে পারল শমি হাসল। ‘অ্যানড থ্রি উইল মেক এ ক্রাউড। সরি।’

লানচ থেকে ফিরেই শমি সিনহা ওকে ডেকে নিয়ে গেল। একটা ঘরে ঢুকে বলল, এই ঘরটাই আমাদের হবে। কাল পরশু আমরা শিফট করব। আজ চলুন আমার ঘরেই বসি।’

ওরা দুজনে শমির ঘরে ফিরে এল। শমি বেশ ঘেমে উঠেছে। রুমাল বার করে মুখ ঘাড় মুছে ফেলল। 

‘উঃ কী নুইসেনস।’ শমি বিরক্তি প্রকাশ করল। একে এই রকম গরম। তারপর আবার লোড শেডিং। এয়ার কন্ডিশনে এসে শমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। পিনটুদের ক্লাবটা—উঃ, একেবারে ফারনেস। হরিবল্। এবার শীতলের দিকে চেয়ে শামি হাসল। ‘পিনটুরা কিন্তু আপনার সম্পর্কে খুব জেলাস জানেন।’

শীতল উৎসুক হল। ‘পিনটুরা মানে?’ 

‘আওয়ার আদার কলিগস। ওদের সিদ্ধান্ত হল, আপনি একটা ফ্লপ।’ শমির কথায় শীতল দেখল তার মধ্যে একটা উত্তেজনা সঞ্চারিত হয়ে উঠছে। 

‘হয়ত ওরা ঠিক।’ শীতল যেন এতক্ষণে শমির উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে।

শমি শীতলের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাইল। তারপর মুখ টিপে হাসল। ‘সিগারেট?’

শীতল এবার অতি সহজে শমির প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে মুখে দিল। তারপর শমির দিকে ঝুঁকে লাইটার থেকে সিগারেট ধরাল। ‘থ্যাংকস।’ শমি নিজেও একটা সিগারেট ধরিয়ে হাসল। 

শমি বলল, ‘আপনারা পুরুষরা সব এক জাতের। এ বানচ অফ হিপোক্রিটস।’

এবার শীতল হাসল। ‘পুরুষ সম্পর্কে আপনার বিরূপতা অকারণ নয় তা জানি।’ এ কোন শীতল কথা কইছে। শীতলের নিজেরই অবাক লাগল। শমির ক্ষমতা আছে। 

‘কচু জানেন।’ শমি তিক্তভাবে হাসল। ‘আপনারা আঘাত করতে ওস্তাদ। পিন্‌টু কী জানতে চাইছিল জানেন?’ 

শীতল শুধু সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল। সে উত্তরটা শুনতে চাইছে। শীতলের নিস্পৃহতার খোলস ছেড়ে এক কৌতূহলী শীতল ক্রমশ জেগে উঠছে। 

‘কী, আপনার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে না?’ শমির কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। 

শীতল শান্তভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, হচ্ছে।’

‘আপনি যুধিষ্ঠির।’ শমির স্বরে স্বাভাবিকতা ফিরে এল, ‘অথবা গভীর জলের মাছ।’

শীতল হেসে ফেলল। ‘আপনার শাস্ত্রজ্ঞান অসাধারণ।’

এবার শমির হাসার পালা। শমি বলল, ‘পিন্‌টু জানতে চাইছিল, আপনার সঙ্গে আমার গোপন অ্যাফেয়ার কতদিনের? 

শীতল আবার হাসল। 

‘হাসছেন যে?’ 

‘অত্যন্ত সাধারণ প্রশ্ন। অরিজিনালিটি কিচ্ছু নেই। এই প্রশ্ন আমার এক কেরানি কলিগও আমাকে করেছেন। তিনি একজিকিউটিভদের চাইতে অনেক কম বেতন পান। কিন্তু কল্পনাশক্তি দুজনেরই সমান। এতে কী প্রমাণিত হয়?’ 

শমি রীতিমত অবাক হল। ফ্যালফ্যাল করে সে চেয়ে রইল শীতলের দিকে।

শীতল নিশ্চিত্ত মনে সিগারেটে টান দিল। তারপর বলল, ‘সিগারেটটার প্রতি দয়া করে অবিচার করবেন না, ওটা নিবে যাবে। 

শমি বলল, ‘থ্যাংকস।’ সে সিগারেটের গোল গোল ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। বলল, ‘কী প্রমাণিত হয়?’ 

শীতল বলল, ‘আমার কেরানি বন্ধুটির আই কিউ আপনার একজিকিউটিভ বন্ধুর আই কিউ-এর চাইতে কোনও অংশে কম নয়।’

‘আসলে ওরা সন্ত্রস্ত। রীতিমত স্কেয়ারড।’ শমি বলল। ‘আপনি ওদের কাছে ডার্ক হর্স।’

‘অর্থাৎ অজ্ঞাতকুলশীল।’

‘আপনার কিছুই ওরা জানে না। আপনি ওদের সমাজের কেউ না।’

‘অর্থাৎ সাদা কাক।’

‘কী বললেন, সাদা কাক?’ 

শীতল বলল, ‘এক রকম কাক আছে। রং একটু সাদা। অ্যালবিনো। ছেলেবেলায় একবার দেখেছিলাম। কোত্থেকে অমনি একটা সাদা কাক আমাদের আমগাছে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। অন্য কাকেরা তাকে দেখা মাত্র ঠোকরাতে আরম্ভ করল। 

‘আচ্ছা। তারপর কী হল?’ শমি যেন রূপকথা শুনছে। 

‘সাদা কাকটাকে ঠুকরে ঠুকরে শেষ করে দিল কালোরা।’

‘কাকগুলো বড় নিষ্ঠুর। 

‘কেই বা কম? মানুষ কি কম নিষ্ঠুর? 

‘তা যা বলেছেন। যাকে সহজে বুঝতে পারা যায় না, যে একটু অন্যরকম, মানুষও তার পিছনে লাগে, তাকে ঠোকরায়।’ শমিতা ম্লান হাসল। 

শীতল বলল, ‘এ অফিসে আপনিও তো একটা সাদা কাক।’

‘এই প্রফেশনেও আমরা মেয়েরা সাদা কাক। প্রতি পদে তাই পুরুষেরা ঠোকরাবার চেষ্টা করে। ভিতরেও বাইরেও।’ শমি তার সিগারেটটাকে দুটো আঙুলের ডগায় চেপে ঘোরাতে লাগল। ছোট করে ছাঁটা চুলের পশ্চাৎপটের উপর ভেসে থাকা শমির মুখটাকে যথেষ্ট ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ দেখাতে লাগল। 

শীতলও বিষণ্ণ বোধ করতে লাগল। 

শমি বলল, ‘আমি অনেকের চাইতে বেশি বিজনেস আনি। তার জন্য যথেষ্ট মাথা খাটাতে হয়। পরিশ্রমও হয় প্রচুর। কিন্তু বেনিফিট দেবার বেলায় পুরুষের সমান তো দেওয়া হয় না। হোয়াই দিস ডাবল স্ট্যানডার্ড? কারণ আমি মেয়ে। আবার দেখুন, আমি আপনি দুজনেই অতিরিক্ত বিজনেস এনে দিয়েছি। কোম্পানি বোনাস দিল দুজনকেই। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে ওটা ছিল আপনার প্রাপ্য। আর আমার ক্ষেত্রে আমি পেলাম কোম্পানি অর্থাৎ বস্-এর ফেভার। চমৎকার ব্যাপার। 

শমি আধ খাওয়া সিগারেটটা ছাইদানে গুঁজে আরেকটা নতুন ধরাল। ‘পিনটুর কথায় আমি কেয়ার করিনে। আই নো হিম। হি ইজ মিন অ্যাণ্ড ডার্টি। জিতু, আমার ফরমার হ্যাজব্যানড, জিতুর ও খুব ক্লোজ আমি তাও জানি।’

শমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ‘কিন্তু মেয়েদের সম্পর্কে সকলের বিচারই তো এই। এই যেমন আজ আপনার প্রমোশন অফিস সুদ্ধ লোকের রসনাকে ফ্রি রাইড দিয়েছে, তেমনি আমার ব্যাপারেও হত। আমার উন্নতির উৎস নিতান্তই যে আমার মাথা, এই সত্য পুরুষদের ব্যাপারে গ্রাহ্য হলেও মেয়েদের ব্যাপারে নয়। 

‘আমার সাফল্যের উৎস,’ শমি হিংস্রভাবে হাসল, ‘আমার অ্যানাটমির ঊর্ধ্বদেশে নয় তার বিপরীত প্রান্তে, এই হচ্ছে ওদের দৃঢ় বিশ্বাস। আমার ক্ষেত্রে এই হিসাব সহজে মেলানো যায়, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে?’ 

শমি বেশ তারিয়ে তারিয়ে হাসতে লাগল। ‘ওদের কী সমস্যায় আপনি ফেলেছেন, ভাবুন।’

‘আমি,’ শীতল দেখল ওদের দুর্দশায় সেও শমির মতো উল্লাস বোধ করতে শুরু করেছে, ‘ওদের এত উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠার জন্য খুবই লজ্জিত। কিন্তু—’ 

শীতলের কথার ধরনে শমির ক্ষোভ খানিকটা প্রশমিত হল। সে শীতলের দিকে প্রসন্ন চোখে চেয়ে রইল। 

‘ওদের হিসেব মেলাবার সুবিধের জন্য, শীতল গম্ভীরভাবে বলল, ‘আমি আমার অ্যানাটমি তো এখন বদল করতে পারব না। তাই ইচ্ছে থাকলেও ওদের বাধিত করতে পারলাম না। 

‘ইউ আর দ্য লিমিট।’ শমি দারুণভাবে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে সিগারেট এগিয়ে দিল। 

‘আবার সিগারেট?’ 

‘এটা বোনাস।’

‘প্রাপ্য হিসাবে পাচ্ছি, না এটা ফেভার হিসাবে পাচ্ছি?’

‘ইউ হ্যাভ আর্নড ইট।’

‘থ্যাংকস।’

‘ইউ আর ওয়েলকাম।’ 

শীতল এবার হাসল। ‘কত সিগারেট আপনি খান? ‘ 

শমি বলল, ‘ওরা যা-ই বলুক শীতল, আপনি কখনওই ফ্লপ হবেন না। আপনার চেহারা যা-ই বলুক ইউ হ্যাভ ট্যালেনটস।’ 

শীতল হাসল। শমির প্রশংসা তার ভাল লাগল। কোনও মেয়ে আজ পর্যন্ত তার সঙ্গে এইভাবে খোলাধুলি কথা বলেনি। না, করবী তো নয়ই। তা ছাড়া যে অভিজ্ঞতার থেকে এই ধরনের পরিণতি আসে, সেই অভিজ্ঞতা করবীর নেই। তাজ্জবের কথা, শীতল শমির প্রতি আকৃষ্ট বোধ করছে। নিতান্ত এক শারীরিক আকর্ষণ। শীতল সতর্ক থাকবার চেষ্টা করতে লাগল। 

শমি বলল, ‘উই উইল মেক এ শুড পেয়ার। ত 

শীতলের হঠাৎ খেয়াল হল একটা ছোট্ট ঘরে শুধু সে আর শমি। এবং খেয়াল হওয়া মাত্র তার শরীরটা শিরশির করতে লাগল। করবী তো এমন অনুভূতি তার শরীরে কখনও জাগাতে পারেনি। 

‘মেড ফর ইচ আদার?’ শীতল অতি কষ্টে কথাটা ছুঁড়ে দিতে পারল। শুধু সে আর শমি। 

‘আপনার অ্যাড্ সেন্‌স একেবারে সহজাত, শীতল।’ শমি উত্তেজিত হয়ে বলল। ‘আপনি অ্যাড-ম্যান হবার জন্যই জন্মেছেন।’

শীতলের পঁয়তাল্লিশ বছরের উপোসী শরীরে ক্ষুধার প্রবল জোয়ার এসে গেল।

‘উই আর মেড ফর ইচ আদার।’ শমি শীতলের দিকে একটু ঝুঁকে হাসল।

শীতল আর শমির মাঝখানে একটা মাত্র টেবিল। 

শমি বলল, ‘আমার কিন্তু একটুও সন্দেহ নেই। 

জোয়ারের প্রবল টানে শমির দিকে ভেসে গেল শীতল। 

‘কিন্তু যা-ই বলুন, আপনি কিন্তু খুব ডিসেপটিভ। উপরটা এত সাদামাটা—’

শমির হাত দুটো বড়ই লোভনীয়। কী হয়, যদি ধরি? 

‘একেবারে ডাল। জাত কেরানি।’

শমির কথা কোন দূর থেকে শীতলের কানে ভেসে এল। শমির শরীরটা শীতলের একেবারে মুঠোর মধ্যে। শমির সর্বশরীর একযোগে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তাকে। 

‘আপনি কী ভাবছেন, বোঝে কার সাধ্য। 

শমি, তুমি আমার। 

কে আপত্তি করেছে? 

শমি শমি আমি তোমাকে চাই। 

ইউ আর ওয়েলকাম। 

জোয়ারের ধাক্কায় ধাক্কায় শমির উপর আছড়ে পড়ছে শীতল। 

শমি হাসছে তার একেবারে মুখের উপর। দূর থেকে আরও দূর থেকে শমির কথা কানে আসছে শীতলের। 

‘কিন্তু আপনার ভিতরে আছে একটা ডাইনামো।’

শীতল উঠে দাঁড়াল, শমি উঠে দাঁড়াল। 

শীতল শমির মুখ থেকে সিগারেটটা যত্ন করে নিয়ে নিল। অ্যাশট্রেতে রাখল সেটা। 

জোয়ার, জোয়ার, প্রবল জোয়ার শীতলের শরীরে গর্জন করছে। শমি শমি শমি। ‘কী আমি ভুল বলছি শীতল?’ 

শীতল কোনও কথা না বলে শমির শরীরটা দু’হাতে তুলে নিল। 

এখানে নয় এখানে নয় শীতল, প্লিজ, বিছানা পাশের ঘরে। পাশের ঘরে। 

‘কী, আমার বকবকানিতে ঘুমিয়ে পড়লেন না কি? শমি হাসল। ‘হ্যাভ অ্যানাদার সিগারেট? 

শীতল ঠক করে মাটিতে নেমে এল যেন। তার হঠাৎ উম্মাদনা থিতিয়ে এল। নিজের মনের পরিচয় পেয়ে সে ধিক্কার দিল নিজেকে। শমি ডাইভোরসি না হলে তার সম্পর্কে এমন কথা ভাবতে পারত শীতল? নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগল তার। সেও তা হলে মিন অ্যানড ডার্টি। 

 ‘নাঃ আর সিগারেট নয়।’ শীতল ক্লান্তভাবে বলল। ‘আমি এত সিগারেট খাই না।

‘বেশ, তবে আমিই ধরাই। কী এত ভাবছিলেন?’ শমি সরলভাবে বলল। ‘ঐ সব ইতরদের কথা? সিগারেট ধরাল শমি। ‘আমি ইমিউনড হয়ে গিয়েছি। বদনামে আমি আর ডরাইনে। আপনারও সয়ে যাবে। 

শীতল কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। 

‘ওদের টার্গেট আপাতত আমি নই, এখন আপনি। আপনাকে ওরা ঠিক প্লেস করতে পারছে না।’ শমি সিগারেট টানতে লাগল। ‘দিন কতক জ্বালাবে ওরা।’

‘ওসব আমার ওব্যেস আছে।’ শীতল আন্তরিকভাবে বলল। ‘আমার মায়ের সম্পর্কেও বদনাম রটেছিল।’ কথাটা বলেই শীতল চমকে উঠল। যে কথা সে কাউকে বলেনি, সে কথা সে শমিকে বলতে গেল কেন? এটা যে সে বলে ফেলবে তাও তো সে ভাবেনি। শীতল বিস্মিত হল। শীতল তার মা’র মুখটা মনে করার চেষ্টা করল। রুবি আর করবীর মুখের সঙ্গে মিশাল দেওয়া একটা ছায়া-ছায়া মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। 

শীতল বলল, ‘ছোটবেলা থেকেই বদনাম আমার সঙ্গের সাথী। আপনাকে সেটা বোঝাবার জন্যই কথাটা বললাম। ভাববেন না শো অফ করছি।’

শমি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘সরি শীতল। আমি যদি আপনাকে আঘাত দিয়ে থাকি, আমি দুঃখিত।’

‘না না, এতে দুঃখ প্রকাশের কিছু নেই।’ শীতল বলল। ‘কথায় কথায় আমি কিছু মনেও করিনে। আমার বয়েসের কথাটা ভুলবেন না। পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছি। আমাদের দেশে নতুন করে কোনও কিছু শুরু করার বয়েস এটা নয়।’

‘বস্ তো বললেন, ইউ লুক ইয়াং।’ শমি শীতলকে একটু উৎসাহ দিতে চাইল।

‘বস্-এর কথা রাখুন। কথাটা বসকে বলছিনে, আপনাকে বলছি।’ শীতলের নিজের কানেই আওয়াজটা একটু কড়া শোনাল। সে লজ্জিত হয়ে সুর নামাল, ‘আপনি আমার সম্পর্কে কোনও ইলিউশন রাখবেন না। আমি আপনাকে বোঝাতে চাইছি শমি যে, আপনি বা আমি আমাদের যে-সব সহকর্মীর কথা উল্লেখ করলাম আমি তাদের কারও চাইতে উন্নত নই। ওদের কারও চাইতে আমার মন কম ডার্টি নয়। যা সত্য তা-ই বলছি। আমি বলতে চাইছি আমরা সবাই সাধারণ মানুষ শমি। আমাদের ভাল খারাপের মধ্যে ফারাকটা অল্পই।’

‘আপনি ওদের চেনেন না শীতল।’ শমিকে সে থামিয়ে দিল। 

‘আমরা কেই বা কাকে চিনি।’ শীতল বলল।

‘জব্‌সনই কি চিনিয়ে দিতে পারে?’ 

‘বকে কথাটা বলে দেখুন, বলবেন নিশ্চয়ই পারে।’

‘আপনি কী বলেন? 

‘দেখুন কিছু একটা পদ্ধতি যদি ওরা নাই-ই জানবে—’ 

‘উত্তরটা আপনি আপনার বসকে দিচ্ছেন না শমি। দিচ্ছেন আপনার এক কলিগকে।’

‘আমি জানিনে।’ শমি বিপন্ন হয়ে বলল। ‘সত্যিই জানিনে। অনেসট।’

শীতলের মুখের দিকে শমি চেয়ে থাকল। শীতল ওর কথা বিশ্বাস করল কি না তা বুঝতে পারল না শামি। 

শীতল শমির দিকে চেয়ে একটু হাসল। ‘মানুষকে আমরা কেউই ভাল জানিনে। আমাদের ধারণা যে, আমরা জানি।’

‘আপনি বড্ড সিনিক শীতল।’ শমি রায় দিল। 

‘সিনিক?’ শীতল বলল। ‘কী জানি, হবে।’ সে প্রসঙ্গ পালটাল। ‘আপনি পিনটুর প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, আমার সম্পর্কে পিন্টু আপনাকে যা বলেছিল তা আমার জানতে ইচ্ছে করছে কি না। তা-ই না?’ 

শমি বুঝতে পারল না শীতল এখন ও কথা তুলছে কেন? সে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। বলল, ‘হ্যাঁ। 

‘আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ হচ্ছে। সত্যি কথাই বলেছিলাম।’

‘হ্যাঁ, তা বলেছিলেন।’ শমির অস্বস্তি বাড়তে লাগল। শীতল কোথায় যেতে চাইছে? 

‘তাতে আপনি আমাকে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন।’

‘আমার অন্যায় হয়েছিল।’ শমি তাড়াতাড়ি বলে উঠল। ‘আমি অ্যাপলজি চাইছি।’ শমি সত্যিই খুব দুঃখিত। 

‘আরে ছি ছি’ শীতল সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। ‘আমি তার জন্য আপনাকে আদৌ দোষী করছিনে। কথাটা অন্য কারণে তুলছি। শুনুন আগে।’

শীতল হাসল। এবং শমি শীতলের হাসিতে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হল। 

শীতল বলল, ‘আমি আপনাকে বলেছিলাম, আমার মায়ের নামে বদনাম ছিল। তাই না?’ 

শমি আবার অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। শীতলকে এখন সে বুঝতে পারছে না।’হ্যাঁ।’ শমি শঙ্কিত হয়ে উঠছে। এবার কী বলবে শীতল? শমি তার স্নায়ুর 

উপর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করল। সে সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখল প্যাকেট খালি। অভ্যাস বশে বেল টিপে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বেয়ারা এল। 

শমি মোলায়েম করে বলল, ‘ভাই এক প্যাকেট সিগারেট এনে দাও। প্লিজ্‌। 

বেয়ারার উপস্থিতি শীতলকে যেন ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিল। সে আর শমি ছাড়া এ জগতে আরও লোক যে আছে সে-বিষয়ে সে যেন এই প্রথম অবহিত হল। শীতল অন্যমনস্ক হয়ে গেল। শমি ওকে সতর্কভাবে লক্ষ করছে। 

শীতল অতর্কিতে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপারটা জানবার ইচ্ছে আপনার হয়নি?’ 

হঠাৎ সমস্ত রক্ত শমির মুখে উঠে গেল। শীতল ওর কোনও গোপন পাপ যেন ধরে ফেলেছে। ঝপ করে আলো নিবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শমির দেওয়ালে বসানো, বাতিটা থেকে এক ঝলক আলো লাফিয়ে পড়ল শমির টেবিলে। তার মুখের এক পাশে। তার চুলে। 

শমি বলে উঠল, ‘কটা বাজল? তারপর ঘড়িটা দেখে বলল, ‘ঠিক পাঁচ। ঘড়ি মেলাতে খুব সুবিধে।’ 

বেয়ারা সিগারেট নিয়ে ঢুকল। শমির টেবিলে সিগারেট রেখে দুজনের দিকে একবার চাইল। একটু ইতস্তত করল। তারপর বলল, ‘দিদি, ছুটি হয়ে গেল। আপনারা কি থাকবেন? 

শমি বলল, ‘হ্যাঁ। তুমি চলে যাও।’

বেয়ারা বলল, ‘তা হলে আমি জগদীশকে বলে যাচ্ছি। চাবি ওর কাছে থাকবে।’ ব্যাপারটা শীতলের কাছে একেবারে নতুন লাগছে। তার পুরনো টেবিলে মোমবাতি আসত। চোখে আলো লাগছিল। চেয়ার টেনে একটু সরে বসল। দেওয়ালে শমির ছায়া পড়েছে। গোটা পরিবেশটাই শীতলের চোখে বদলে গেল। এ তার এতদিনের পরিচিত জগৎ নয়। একটা আনকোরা নতুন কোনও দুনিয়ায়, এক অবাস্তবতার মধ্যে সে ঢুকে পড়েছে। 

সে যেন থিয়েটার দেখছে। হ্যাঁ ঠিক, থিয়েটারই বটে। 

‘হ্যালো, শমি।’ দরজা ঠেলে মিঃ মজুমদারের প্রবেশ। তারপর কী রকম চলছে?’ 

‘প্রশান্ত,’ শমি বলল, ‘আমাদের নতুন কলিগ শীতল।’

‘ও হ্যাললো। আমি মজুমদার। অভিনন্দন অভিনন্দন মিঃ –’ 

শীতল বলল, ‘সরকার। ধন্যবাদ।’

শমি শীতলের দিকে চাইল। ওর আবছা মুখের কোনও ভাবান্তর শমির চোখে ধরা পড়ল না। 

‘হ্যালো শমি’ দত্তগুপ্তের প্রবেশ। 

‘চলি শমি। মিঃ সরকার। বা-ই!’ মজুমদারের প্রস্থান। 

‘হ্যালো সরকার।’ দত্তগুপ্তের সংলাপ। ‘আমি দত্তগুপ্ত! কাল চেনা পরিচয় হবে। অবিশ্যি শমি যদি অ্যালাউ করে। 

‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’ শমির সংলাপ। ‘শীতল আমাদের সহকর্মী, আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।’

‘তাই না কি? যাক আশ্বস্ত হওয়া গেল!’ দত্তগুপ্ত শীতলকে বলল, ‘আপনি চাঁদকপালে লোক মশাই।’

‘হ্যালো লাভ, পিনটু মিত্তিরের প্রবেশ। 

‘বা-ই।’ দত্তগুপ্তের প্রস্থান! 

‘শমি, আর ইউ ফ্রি দিস ইভনিং?’ পিনটুর সংলাপ। 

‘না। সরি।’ শমির কণ্ঠে কিঞ্চিৎ ঝাঁঝ ফুটল। 

‘তুমি কতক্ষণ ব্যস্ত থাকবে? ক্যান উই মিট লেট ইন দ্য ইভনিং?’ পিনটু স্মার্ট হবার চেষ্টা করছে। 

‘না। তোমার সঙ্গে আমার কখনও লেট ইভনিং-এ দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে?’ শমির ভঙ্গি আক্রমণাত্মক। 

‘হোয়াই আর ইউ সো অ্যাগ্রেসিভ টুডে? পিনটু কিঞ্চিৎ পিছু হটল। ‘কোনও দিন না হলেও আজ হতে দোষ কী?’ 

‘লেট ইভনিং-এ কারও সঙ্গে মিট করা আমার পেশা নয়। যাদের পেশা ইউ নো প্লেনটি অব দেম।’ শমি বলল। 

‘শমি শমি, প্লিজ, তোমার হল কী আজ?’ পিনটু আফসোস করল। ‘ইউ আর ব্রেকিং মাই হার্ট, লাভ?’ 

‘তা হলে যাও,’ শমি এবার হাসল, ‘গঙ্গায় গিয়ে ঝাঁপ দাও গিয়ে। প্লিজ পিন্‌টু, ডোনট বি এ পেস্ট।’ 

‘ইউ হ্যাভ নো রাইট টু ইনসালট্ মি লাইক দ্যাট্।’ পিনটু এবার রেগে গেল। ‘নাইদার হ্যাভ ইউ।’ শমি বদলা নিল। ‘আমি শীতলকে বলেছি সে-কথা। শুনে তোমার আই কিউ সম্পর্কে শীতলের পুওর ধারণা হয়েছে। 

‘কে শীতল? কী বলেছ তাকে?’ পিনটু শমির দিকে প্রায় তেড়ে গেল। 

শীতল বলল, ‘আজ্ঞে আমিই শীতল।’

পিনটু ওর দিকে চাইল। যেন এই প্রথম ওকে দেখছে। 

শীতল বলল, ‘শমি বলছিলেন আপনি আমার আর শমির মধ্যে গোপন প্রণয়, শমি যাকে বলেছিলেন অ্যাফেয়ার, কতদিন ধরে চলছে সেটা জানবার জন্য খুব কৌতূহল প্রকাশ করেছিলেন। ঠিক এই ব্যাপার আমার পূর্বতন ডিপার্টমেনটের এক কলিগও খুব ফ্রেনডলি ওয়েতে আমাকে আজ সকালে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাই আমি শমিকে বলেছিলাম এক একজিকিউটিভের কল্পনার দৌড় যদি এক কেরানির কল্পনার দৌড়ের সমান হয়, তা হলে সেই একজিকিউটিভ একজন কেরানির চাইতে বেশি বেতন পান কিসের জোরে?’ 

শমি খিলখিল করে হেসে ওর অপমানের জ্বালা ধুয়ে ফেলতে লাগল। 

তারপর শমি আবদার করল, ‘পিনটু, ইউ শুড ট্রাই টু শারপেন ইওর ইনটেলিজেনস বিফোর ইট ইজ টু লেট।’ তারপর গলায় আরও একটু আদর মিশিয়ে বলল, ‘ওল্ট ইউ ডু ইট ল-অ-ভ।’

পিনটু একবার শমির দিকে একবার শীতলের দিকে কড়া নজরে চেয়ে দাঁতে দাঁত চিপে বলল, ‘হাউ ডেয়ার ইউ—’  

তারপর দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল। 

শমি গলার স্বর চিকন করে টেনে টেনে বলল, ‘বাই, সি ইউ টুমরো ল-অ-ভ্!’ 

.

আর কেউ ঢোকেনি। এখন আবার ওরা দুজন। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ওরা আততায়ীদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পেরেছে। এখন ওরা পরিশ্রমে কাতর। নিঃশব্দে ওরা ওদের ক্ষতস্থান যেন চেটে চলেছে। ওদের দুজনের মুখেই সিগারেট। শীতল চেয়ে আছে শমির দিকে। শমির মুখের একপাশে আলো অন্যপাশে ছায়া। অদ্ভুত রহস্যময় মনে হচ্ছে তাকে। শীতলের মনে শমি সম্পর্কে একটা সহানুভূতির ভাব জেগে উঠছে। 

শমিই নীরবতা ভাঙল। ‘ওদের কথা ভাবছেন?’ 

‘না।’ শীতল সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, ‘ভাবছি সাদা কাকের কথা।’

‘সাদা কাক?’ মুহূর্তে বিভ্রান্ত হল শমি। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল। ‘ও সেই কাকটার কথা? 

‘আমি দুটো কাকের কথা ভাবছি।’ শীতলের স্বরে বিষণ্ণতা ঝরে পড়ল। বলল, ‘কাকের দলে যারা একটু অন্যরকম। 

শমি এবার শীতলের মুখের দিকে সরাসরি চাইল। শীতল একাগ্রচিত্তে তার সিগারেটের দিকে চেয়ে আছে। একটা হালকা ধোঁয়া উপরে উঠছে। শমি বলল, ‘দুটো কাক। একটা মেয়ে আর একটার পেডিগ্রি নেই। ত 

শীতল যেন আপন মনেই কথা বলছে, ‘এতক্ষণে একটা হিসেব পাওয়া গেল।’

শীতলের সিগারেট থেকে ধোঁয়া উঠছে। 

‘কিছুতেই হিসেবটা মিলছিল না।’ শীতলের স্বর ক্রমেই উদাস, ক্রমেই নিচু হয়ে আসছে। 

শীতল যেন তার আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেটের ধোঁয়াকেই তার কথা শোনাচ্ছে।’

‘কিসের হিসেব?’ শমিও আস্তে কথাটা বলল। 

শীতলের সিগারেটের ধোঁয়া কমে আসছে। শীতল সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়াটাকে উস্কে দিল। 

এবং সেইদিকে চোখ রেখে বলল, ‘আমার মায়ের সম্পর্কে আপনাকে একটা কথা বলেছিলাম।’

শমি এবার অস্বস্তি বোধ করছে। বার বার ঘুরে ফিরে এই কথাটা তুলছে কেন সে? 

শাতল তার মায়ের মুখটা আবার মনে আনতে চেষ্টা করল। সিগারেটের ধোঁয়ার আড়া, থেকেই যেন তার মায়ের মুখটা বেরিয়ে আসবে। 

শীতল আত্মগতভাবে বলল, ‘ওটা আমার গোপন কথা।’

আধো-আলো আধো-ছায়া দিয়ে গড়া শমির মুখ নারভাস হয়ে উঠেছে। অস্বস্তি চাপতে সে একটা নতুন সিগারেট ধরাল। লাইটারের আলো ফস করে জ্বলে উঠতেই শীতলের চোখে তার মায়ের মুখটা এক লহমায় ভেসে উঠল। এবং তার মায়ের মুখের সঙ্গে এবার শমির ছায়া দিয়ে ঢাকা মুখটার বেশ একটা মিল দেখতে পেল শীতল। এবং এই মুখটাকেই তার মায়ের আসল মুখ বলে মনে হতে লাগল তার। 

শীতল বলছে, ‘কখনওই এ কথা কাউকে বলিনি। আজ হঠাৎ আপনাকে বলে ফেললাম।’

শীতলের মুখ থেকে এমন একটা আন্তরিক স্বীকারোক্তি শমির অস্বস্তি বাড়িয়ে দিল। তার সারা শরীরে শীতলের কথাটা শিরশির করে ঘুরে বেড়াতে লাগল। শমির মনে অস্থিরতা জেগে উঠল। শীতল যেভাবে কথা বলছে তাতে তাকে বিশ্বাস না করে পারছে না শমি। কিন্তু পুরুষের কথা বিশ্বাস করার পরিণাম কী মারাত্মক হতে পারে, জিতু তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। শীতলকে যদি জিতু পিনটুর শ্রেণীতে ফেলতে পারত শমি তা হলে সে স্বস্তি পেত। শীতল ধূর্ত, গভীর জলের মাছ, হয়ত আরও বেশি শয়তান, শমি তার আত্মরক্ষার জন্য এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু শীতলের চোখে তার চোখ যখনই পড়েছে তখনই শমি শীতলের গভীর চোখের ভাষা বুঝতে পেরেছে। হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে লাভ নেই শমি, শীতলের চোখ দুটো তাকে বলছে, এ সত্য, এ সত্য। শমিকে শীতল বিচলিত করে তুলেছে। 

তবুও শমি হার মানতে চাইল না। 

‘আপনার আপনজনকেও এ কথা বলেননি?’ শমি খোঁচা দিতে চাইল। পারল না। 

‘আপনজন?’ শমি এবার মুহূর্তের জন্য শীতলের মুখে একটা বিমূঢ় ভাব দেখতে পেল। পরক্ষণেই সেটা মিলিয়ে গেল। শীতল বলল, ‘না, কাউকেই কোনও দিন বলিনি। আপনাকেও বলতে চাইনি। কিন্তু হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। আশ্চর্য।’

‘সত্যিই আশ্চর্য।’ শমি আন্তরিকভাবেই বলল। ‘কিন্তু কেন এমন হল?’ 

‘আপনাকে কথাটা বলা ইস্তক তো এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছিলাম।’ শীতল শান্তভাবে বলল। তার সিগারেট পুড়তে পুড়তে আঙুলের ডগার কাছে এসে গিয়েছে। সে ছাইদানে সেটা গুঁজতে গুঁজতে বলল, ‘উত্তর পেয়ে গিয়েছি।’ শীতল শমির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। হাসল। 

বলল, ‘দুটো সাদা কাক এই ধাঁধাটার উত্তর মিলিয়ে দিয়েছে। কে যে কখন কার মধ্যে মনের মানুষ খুঁজে পায় শমি সে বোধহয় নিজেও জানে না। আমরা কত অসহায়।’

শান্ত ভাবে বলা শীতলের এই সরল উক্তি শমির বুকের ভিতর তোলপাড় ঘটিয়ে দিল। বুকের অসহ্য ভারটা বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করল। শীতল দেখল শমির যে চোখে আলো পড়েছে সেটা চিকচিক করতে লেগেছে। সে শমিকে অপ্রস্তুত করতে চাইল না। ওকে সামলে নেবার সময় দেবার জন্য মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। 

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর শীতল বলে উঠল, ‘এখন যত ভাবছি মায়ের কথা ততই মনে হচ্ছে শমি, আমার মাও বোধ হয় একটা সাদা কাক ছিলেন।’

‘বোধ হয় নয় শীতল, আমি জানি আমি ডেফিনিট আপনার মাও সাদা কাকই ছিলেন।’ শমি যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার স্বর বেশ ভারি হয়ে উঠেছে। 

শীতল শমির এই আকস্মিক আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে চমকে উঠল।

‘কী করে এত নিশ্চিন্ত হলেন?’ শীতলের স্বরে বিস্ময়। 

‘আমাকে দিয়েই বুঝেছি।’ শমি নিঃসংশয়ে কথাটা উচ্চারণ করল। 

‘তাই হবে।’ শীতল বলতে লাগল, ‘আমার মা বিধবা হবার পর একমাত্র নাবালক ছেলের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তাকে নিজের মতো করে মানুষ করবেন বলে। শুধু খোরপোষ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবার লোক ছিলেন না তিনি। তিনি স্বাধীন হতে চেয়েছিলেন। বাবার একটা বাড়ি ছিল সাহেবপাড়ায়। তার অধিকার চেয়েছিলেন। লেখাপড়া বিশেষ জানতেন না। ভাল সেলাই জানতেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন, নিজের রোজগারে ছেলেকে ভাল ইস্কুলে পড়িয়েছেন। হাইকোর্টে মামলা চালিয়েছেন বাবার বন্ধু আমাদের উকিল কাকার সহায়তায়। মায়ের বয়স কম ছিল। রূপসী ছিলেন। বদনাম রটানো সহজ ছিল।’

শমি বাধা দিয়ে বলল, ‘পিনটুরা আমাকে বস্-এর কংকুবাইন বলে।’

শমির চোখ জ্বলজ্বল করছে। 

‘আমার উকিল কাকাই এই রটনা ছড়াতে সাহায্য করেছিলেন।’

শীতলের চোখে মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। সে যেন ইতিহাসের পাঠ্য থেকে একটা অংশ আউড়ে যাচ্ছে। 

‘তাঁর ইনটারেসট ছিল। তিনি মাকে বিট্রে করে কাকাদের জিততে সাহায্য করেছিলেন।’

শীতল হঠাৎ এ কাহিনীর ছেদ টেনে দিয়ে নিঃশব্দে সিগারেট টানতে লাগল। 

শমি শীতলের এই আচরণে একটা ধাক্কা খেল। সেও চুপ করে রইল। কিন্তু এখন এই হঠাৎ স্তব্ধতা তাকে পীড়িত করে তুলল। সে হাঁফিয়ে উঠল। এই নীরবতা যেন তার গলা টিপে ধরল। মুক্তিলাভের জন্য সে ছটফট করতে লাগল। 

একটু ইতস্তত করে শমি বলল, ‘আপনার মাকে আপনি খুব ভালবাসেন, না?’ 

‘কী জানি।’ শীতল হাসল। ‘চাকরি হয়ে অবধি তাঁর কথা কখনও মনে পড়েছে বলে তো মনে পড়ে না। আজই বা সে কথা মনে হল কেন, তাও বলতে পারিনে।’

সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে শীতল বলল, ‘এখন তবে ওঠা যাক? শমি ঘড়ি দেখে ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ। জগদীশকে ডাকি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *