এক ধরনের বিপন্নতা – ১

এক 

অকস্মাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। লোডশেডিং। তবু তার সামনে খোলা টাইপ করা চিঠিটা যেন জ্বলজ্বল করতে থাকল। 

কোম্পানি আনন্দের সহিত জানাইতেছে যে আপনাকে একজিউটিভ স্তরে উন্নীত করা হইল। এই নির্দেশ আগামী কাল হইতে বলবৎ হইবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। 

এই বয়ানের সঙ্গে তাকে এখন থেকে কী কী সুবিধাদি দেওয়া হবে, তারও ফিরিস্তি বিশদভাবে দেওয়া আছে। সেই অন্ধকারের মধ্যেও মনে মনে গড়গড় করে সে-সব পড়ে গেল। কেউ মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে গেল না। কেন না কেউ নেই। অফিসের ছুটি হয়ে গিয়েছে। একজিকিউটিভদের ঘরে অবশ্য মোমবাতি দেওয়া হয় না। এক ধরনের উজ্জ্বল ব্যাটারি-আলো সে-ঘরে জ্বলতে সে দেখেছে। কাল থেকে তার ঘর কখনই অন্ধকার হবে না। ভাবতেই তার কেমন অস্বস্তি বোধ হল। নিছকই অস্বস্তি। এমন ব্যাপারে সে অভ্যস্ত নয়। এই তবে শুরু? অসহায়ভাবে সে অন্ধকারকেই জিজ্ঞেস করল যেন। 

চিঠিখানা, সে টেবিলের দিকে চেয়ে দেখল, ততক্ষণে অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছে! করবী তাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিল। তার নিজেরও কিছু কেনাকাটা ছিল। একটু ভাল দোকানমাত্রেই সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে ঝাঁপ ফেলে দিচ্ছে আজকাল। গা এলিয়ে কেনাকাটা করা যায় না। ব্যাপারটা তাকে প্রতিদিন পীড়া দেয়। কিন্তু উপায় কী? এ হচ্ছে সময়ের ঘাড়ধাক্কা, এ তাকে খেতেই হবে। সে কেমন বিপন্ন হয়ে উঠল। 

ভোম্বল, চকোলেট ভুলবি না কিন্তু। 

কী হচ্ছে রুবি! বলেছি না, এখন বড় হয়েছ, গুরুজনকে সম্মান করে কথা কইবে। এখন তুই-ফুই কী? ও না তোমার বাপের বয়সী? 

যে মেয়ে বাবাকে ভালবাসে মা, সেই মেয়ে আদর করে তার বাবার সঙ্গে তুই-তোকারি করলে দোষ কী? 

অতঃপর করবী লাল হয়ে চুপ করে গেল। তার দিকে বিপন্ন হয়ে চাইল। আর হাতে ঘড়ি আঁটতে-আঁটতে রুবি ছুটল মেডিকেল কলেজে। আর বেরুবার মুখে করবী তাকে বলল, একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে? জরুরি কথা আছে। 

ওর ঘড়িতে রেডিয়াম নেই। বুঝতে পারল না ঠিক ক’টা বাজে। পুরনো হাতঘড়ি। এর মেরামতের পিছনে খরচ যা পড়েছে তা দিয়ে কবেই ভাল ঘড়ি কেনা যেত। কিন্তু ঘটনা এই যে, নতুন ঘড়ি কেনা হয়নি। কাজেই পুরনো ঘড়ির মেরামত খরচ আরও বেড়েই চলেছে। 

আসলে এটা এক ধরনের অভ্যাস। জের টেনে যাওয়ার অভ্যাস। মানুষের জীবনে, সে এবার দার্শনিক হল, হিসাবের খাতা একবারই খোলা যায়। জের টেনে চলাই মানুষের নিয়তি। 

সেই অন্ধকার ঘরের স্তব্ধতা ভেঙে টেলিফোন বেজে উঠতেই সে চমকে উঠল। একটু অবাক লাগল তার। তা হলে যন্ত্রসভ্যতার প্রাণ কলকাতায় এখনও ধুকপুক করছে! তার মানে কলকাতা চলছে! বা! তারিফ করল সে। ফোনটা তুলল না। তাকে এখন কে টেলিফোন করবে? এখানে? অবশ্যই রং নাম্বার। কিছুক্ষণ শব্দ করে আপনা থেকেই স্তব্ধ হয়ে গেল সেটা। হঠাৎ মনে হল তুললেই হত রিসিভারটা। হোক না রং নাম্বার। তবু তো এই নিঃসাড় অন্ধকারে মানুষের গলাটা শোনা যেত। হঠাৎ তার মনে হল তবে কি তার মনে ভয় জমছে? 

এবার সে উঠবার তাগিদ অনুভব করল। রাস্তার ভিড় নিশ্চয়ই এতক্ষণে কিঞ্চিৎ পাতলা হয়েছে। অতএব যানবাহনে একটু চেষ্টা করলে হয়ত ওঠা যেতে পারে। সে যে রোজ আটটায় অফিসে আসে আর দেরি করে ফেরে তা কাজ দেখাবার জন্য তত নয়, যত ভিড় এড়াবার জন্য। একটানা তেইশ বছর এই তার রুটিন। যেমন সে তার ঘড়িটা বদলাতে পারেনি, তেমনি এই রুটিনও সে বদলাতে পারেনি। এখন কি তার এই অভ্যাসেও ঘা পড়বে? একজিকিউটিভদের ঘরে যেমন ব্যাটারি-আলো, তেমনি তাদের রাহা খরচ বাবদ ভাতারও বরাদ্দ আছে। ট্যাকসি চড়বে সে? মিনিবাস ধরবে? তবে কি সে সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে পারবে? ফিরে কী করবে? কেন, তার কি কোনও আপনজন নেই? তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে চায় না সে? শুধু অফিসে আসা আর বাড়িতে ফেরা, এর মধ্যে ঘোরাফেরা করেই তার জীবনটা সে কাটিয়ে দেবে? না, তা কেন? সাধারণ আর পাঁচটা লোক যেমনভাবে জীবন কাটায়, সেও তা-ই করতে চায়। তা-ই তো করে। আপনজন নেই তার কে বললে? কেন, রুবি? তার মা করবী? আপনজন বলতে রুবির কথাই আগে মনে আসে। রুবি তার প্রাণ। রুবিই তাকে বেঁধেছে। করবীর কথা জানে না। রুবি যেমন তাকে প্রথম দর্শনেই ভালবেসে ফেলেছে, তেমনি সেও রুবিকে। 

দু বছরের রুবি তাকে দেখামাত্র তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল করবীর কোল থেকে। গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, বাবা, হামি। 

করবী অপ্রস্তুত। সেও বেশ বিব্রত। কিন্তু রুবি তার বুকে উঠে কেমন যেন এক তোলপাড় ঘটিয়ে দিল। সে পরম আদরে রুবির গালে একটা চুমু খেল। 

বাবা, হামি? আরেকটা গাল রুবি বাড়িয়ে দিল। 

আঃ রুবি, বিরক্ত কোরো না ওকে। এসো আমার কাছে। করবীর অস্বস্তি তার শোকসংহত কণ্ঠেও প্রকট হয়ে উঠেছিল। 

রুবি দু’ হাতে তার গলা জড়িয়ে বুকে বসে ছিল। কিছুতেই তার মায়ের ডাকে সাড়া দেয়নি। করবী বিপন্ন হয়ে বলেছিল, মেয়েটা বড় অবুঝ। 

আপনি ব্যস্ত হবেন না। ওকে আমার হাতে ছেড়ে দিন।

রুবি শক্ত আশ্রয়ের মর্ম বুঝেছিল। বলল, বাবা, মা অবুচ্।

করবীর মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। 

করবী রুবিকে বাবা-ডাক ছাড়াতে পারেনি। বলেছিল, রুবি, উনি তোমার বাবা নন। ওকে মামা বলবে। 

রুবি কিছুতেই ওকে মামা বলতে চায়নি। তুমি কাল মামা? 

ও বলেছিল, আমি সিংহের মামা। সিংহের মামা ভোম্বলদাস। 

এটা রুবির পছন্দ হয়েছিল। সেই থেকে সে রুবির ভোম্বল। রুবি চকোলেট নিতে বলেছে। সর্বনাশ, নাহুমের দোকান আবার বন্ধ হয়ে যায়নি তো? হঠাৎ ওর উঠবার তাড়া পড়ে গেল। আস্তে আস্তে হাতড়ে সে টেবিলের উপর থেকে চিঠিখানা তুলে নিল। ভাঁজ করল পাটে পাটে, তারপর হাতড়ে হাতড়ে খামটাও খুঁজে পেল। খামের ভিতরে চিঠিটা পুরে সে বুক-পকেটে রাখল। তক্ষুনি আবার টেলিফোন বাজতে শুরু করল। একটু ইতস্তত করে টেলিফোন তুলতেই ওপার থেকে শমিতা সিনহার গলা বেজে উঠল। উনি মিস কি মিসেস সে জানে না। জানে উনি একজন একজিকিউটিভ। 

‘হ্যালো–’ 

কিন্তু উনি কেন ফোন করছেন? 

‘হ্যালো।’ সে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না। এ সময় উনি কোত্থেকে। 

‘ও মা আপনি আছেন! 

‘হ্যাঁ, এইবার উঠছি। 

‘ভাগ্যিস, আরেকবার ট্রাই করলাম। একটু আগে রিং হয়ে গেল, অথচ কেউ ধরল না। তাই ভাবলাম, আপনি বুঝি চলে গিয়েছেন। তারপর ভাবলাম টেলিফোনের ব্যাপার তো, কোথায় বাজতে কোথায় বাজছে তার ঠিক কী! দেখি আরেকবার। তা ভাগ্যিস করেছিলাম। না হলে আজকের এমন একটা দিনে আপনাকে মিস করতাম তো? 

‘এমন একটা দিনে! তার মানে?’ 

‘জানি জানি। খোদ বসের মুখ থেকে শুনেছি। কনগ্রাচুলেশনস।’ 

‘কী ব্যাপার? এই মহিলা কেন?’ 

‘কী ব্যাপার, ডিসটার্ব করলাম না কি?’ 

আর দেরি করা উচিত হবে না। নাহুমরা দোকান বন্ধ করে দেবে। রুবি জানে সে চকোলেট চেয়েছে, কলকাতা রসাতলে গেলেও চকোলেট সে পাবে। ভোম্বলের কাছে আবদার করলে ভোম্বল সে আবদার রাখবেই, তাদের কুড়ি বছরের সম্পর্কের ইতিহাস এই রকম এক অটুট অবস্থার দৃঢ় বুনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ভাবতেই পারে না, এর অন্যথা হবে। 

‘না। এই ইয়ে। লোডশেডিং হয়েছে তো, কিছু দেখা যাচ্ছে না। টেবিল হাতড়াচ্ছি।’ জবাব দিয়েই সে বিরক্ত হল। নষ্ট করার মতো সময় তার হাতে নেই। তাকে এখন নিউ মার্কেটে ছুটতে হবে। যদিও সে তাড়াহুড়ো একদম পছন্দ করে না। 

‘লোডশেডিং-এর মধ্যে অফিসে কী হাতড়াচ্ছেন? অফিস সিক্রেট পাচার করছেন না কি?” 

সে চমকে উঠল। এই অভিযোগের মানে কী? ওকে কি এই অফিসে সন্দেহ করা হয় না কি? যথেষ্ট শঙ্কিত হয়ে উঠল সে। হাতে টেলিফোন না থাকলে সে হয়তো এই মুহূর্তে একটা সিগারেট ধরাত। নাকি ভদ্রমহিলা ওর সঙ্গে রসিকতা করছেন? কিন্তু সামান্য পরিচিত অধস্তন একজনের সঙ্গে এই বা কোন ধরনের রসিকতা? তবে কি বস্ ওকে স্পাইগিরি করতে রেখেছে? 

‘কী, ধরে ফেলেছি তো? কট রেড হ্যানডেড, অ্যাঁ?’ 

ভদ্রমহিলা কি হাসছেন? ওর মনে হল শমিতা সিনহার গলার আওয়াজ একটু যেন হালকা শোনাল। দুম করে তার রাগ চড়ে গেল। এবং সে অবাক হল। তারও রাগ হয়। এই আশ্চর্য আবিষ্কারে সে নিজেই অভিভূত হয়ে গেল। এই অনুভূতির কথা সে তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। এখন সে যেন তার আত্মনির্ভরতাও খুঁজে পেল। অফিস-সিক্রেট। আমার লোম! এই তেইশ বছর ধরে আমি যা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি তা শুধু বসের পোঁদ পৌঁছার কাজে লাগতে পারে, আর কিছুতে নয়, আর না হলে তা উইয়ে খায়। নিজের মনে খিস্তি করে সে খানিকটা হাল্কা হল। 

‘ধরেছেন ঠিক। আমার হাতের মুঠোয় আস্ত একটা টেলিফোন।’

শমিতার হাসির আওয়াজ এবার স্পষ্ট শোনা গেল। তা হলে রসিকতা। কিন্তু এই অবেলায় গায়ে পড়ে ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে রসিকতা জমাতে চাইছেন কেন? মতলব কী? 

টেলিফোন ছেড়ে দেওয়াটা একটু আগে ওর কাছে যতটা জরুরি বলে মনে হচ্ছিল, ও দেখল এখন আর সেটা তত জরুরি বলে মনে হল না। 

‘অফিস থেকে বলছেন?’ 

‘না। অফিস ছাড়াও আমার একটা ঠিকানা আছে।’ শমিতা হাসল। ‘বাড়ি থেকে বলছি।’

বাড়ি থেকে বলছি, শমিতার এই কথা তাকে আবার নারভাস করে দিল। শমিতাকে সে ভাল জানে না। যদিও শমিতার এখনকার কথার ধরন দেখে মনে হতে পারে তারা বোধহয় খুবই ঘনিষ্ঠ। একটা ত্যাঁদড় পার্টির অ্যাকাউনট সংক্রান্ত কাগজপত্রের ব্যাপারে ওকে শমিতার প্রয়োজন হয়েছিল। সেই যা ওদের আলাপ। সেই কাজও চুকে গিয়েছে। ব্যস, তা হলে আজ এত গায়ে পড়ে আলাপ কেন? 

‘হ্যালো! 

উদ্দেশ্যটা ঠিক ধরতে পারছে না। এ ধরনের ব্যাপারে সে কী করবে, চট করে বুঝতে পারে না। সে কি সাড়া দেবে, না, দেবে না? 

‘বলুন।’

‘কী হল আপনার? কথা বলছেন না কেন? শরীর ভাল তো?’ 

‘ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘কী বুঝতে পারছেন না?’ 

‘আমার উপর হঠাৎ এত অনুগ্রহের কারণ কী।’

শমিতা এবার চুপ করে গেল। সে ভাবল এবার শমিতা ফোন ছেড়ে দেবে। কিন্তু কানেকশন ছিন্ন হল না। 

ভারী গলায় শমিতা বলল, ‘কার অনুগ্রহের কথা বলছেন?” 

‘আমি চিঠিখানার কথাই ভাবছি।’

‘তা-ই বলুন।’ শমিতা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হালকা সুরে বলল, ‘অনুগ্রহ ফনুগ্রহ নয়, ও নিয়ে অনর্থক মাথা ঘামাবেন না। এ হচ্ছে জসনের চয়েস। আপনার কাজ, অ্যাপটিচিউড, সব খতিয়ে দেখে জব্‌-কনসালটানট জব্‌সন বলে দিয়েছে মিডিয়া হ্যান্ডলিং-এর যা পোটেনশিয়ালিটি আপনার মধ্যে আছে তা ফাইভ স্টার একজিকিউটিভের মতো। ইন ফ্যাক্ট আপনি এখন বসের একজন টপ ফেভারিট, তা জানেন? কিন্তু আমার কী মনে হয় জানেন? ইউ হ্যাভ টু ইমপ্রুভ ইওর ম্যানারস। এক ভদ্রমহিলা আপনাকে এত বড় একটা খবরের জন্য অভিনন্দন জানালেন আর আপনি তা গেরাজ্যিই করলেন না। আমি সত্যিই খুব দুঃখ পেয়েছি। 

শমিতার যেন আরও কিছু বলার ছিল, হঠাৎ থেমে গেল। শমিতার গড়গড় করে বলে যাওয়া কথাগুলো তার মনে বিশেষ কোনও ছাপ রাখতে পারল না। অধিকাংশ কথারই সে মানে জানে না বা তার এতদিনের অভ্যস্ত কেরানি-জীবনের অভিজ্ঞতায় এ সবের কোনও প্রয়োজনও পড়েনি। ও যেটা বুঝতে পারল এবং বোঝার পর অস্বস্তি বোধ করতে লাগল সেটা এই যে, তার এতদিনের পোষা অভ্যাসে এবার প্রতি পদে ধাক্কা লাগবে। সে বেশ বিপন্ন বোধ করতে লাগল। 

‘হ্যালো।’

‘বলুন।’

‘আপনি কি এখন ফ্রি আছেন? 

রুবির চকোলেট! সে ব্যস্ত হয়ে উঠল। সর্বনাশ! সে ভুলেই গিয়েছিল। এমন ব্যাপার আগে কখনও ঘটেনি। সাধারণত এসব কাজ সে সর্বদাই ধীরে-সুস্থে সারে। অফিসের ছুটির পর সবাই বেরিয়ে গেলে সে আগামী দিনের কাজকর্মগুলো একটা ফাইলে গুছিয়ে সকলের উপরে সেটা রাখে। তারপর তৃপ্তি সহকারে এক গ্লাস জল খায়। তারপর ধীরে-সুস্থে পথে বেরিয়ে পড়ে। বরদা বেয়ারা যতদিন না রিটায়ার করেছে ততদিন সে ঠিক সময় ঠিক জিনিসটা তার হাতের কাছে রেখে দিত। একদিনও কোনও জিনিস তার কাছে চাইতে হয়নি। 

‘না। আজ বিশেষ কাজ আছে। এখুনি বেরুব।’

তার পরে এল কীর্তিনিধি। সেও পুরনো লোক। ঘড়ির কাঁটার মতো কাজ করে গিয়েছে। 

‘ও। আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়ত ফ্রি আছেন।’

তার পরে এল ভানুপ্রতাপ। ম্যাট্রিক পাশ। 

‘আমারও এই সন্ধেটা ফ্রি ছিল। ভেবেছিলাম–‘

সে একেবারে নতুন। তবে তাকে- 

‘আমরা একসঙ্গে একটু বসে পরস্পরকে বুঝে নেব।’

কাজ বোঝাতে তেমন অসুবিধে হয়নি। 

‘আসল কথাটা বলি। বস্ আমাকে আর আপনাকে একটা নতুন অ্যাকাউনটে জুড়ে দিয়েছেন। অ্যাকাউনটটা বেশ বড়। পার্টি খুবই ত্যাঁদড়। একটা নিউজপেপার। অনেক হাত ফিরে এখানে এসেছে। আমাদের—’ 

নিরুদ্বিগ্নভাবে সে অবসরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আর কটা বছর পার করে দিতে পারলেই— 

‘সাকসেসের উপর আমাদের কেরিয়ার নির্ভর করছে। সত্যি বলতে কী, আমি একটু নারভাস বোধ করছি। বস্ তো বলেন—’  

কেল্লা ফতে হত। রুটিন বাঁধা জীবনে কোনও ঝক্কি নেই। এমন সময় জক্‌সন— ‘বস্ তো বলেন, চিন্তা কোরো না। তোমার সঙ্গে—’ 

হু ইজ জব্‌সন? তার মাথায় এই প্রশ্ন দড়াম করে ঘা মারল। 

‘একেবারে ফাইভ স্টার লোক দিচ্ছি—’ 

জসন তার উপর নজর দিল কেন? দুনিয়ায় কি লোকের এত অভাব পড়েছে? 

‘আপনি আমার অবস্থা বুঝুন। একে অ্যাকাউনট একেবারে আনকোরা নতুন, তার উপর যাঁর সঙ্গে কাজ করব তিনি যে কেমন লোক তা-ই এখনও পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না।’

শমিতা মিষ্টি হাসির শব্দটা ওর দিকে ঠেলে দিল। 

ওর উদ্বেগ বাড়তে লাগল। সে কি এখন পাবে চকোলেট? তার জীবনে এইটেই সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর সবই গৌণ। 

‘কাল অফিসে কথা হবে।’ তার কণ্ঠস্বরে কি কিঞ্চিৎ তীক্ষ্ণতা ফুটে উঠল? ‘আপনি কটায় আসেন? 

শমিতা বলল, ‘নটায়। আপনি?” 

‘আমি রোজ আটটায়।’

ও, তা বেশ, আমি কাল আটটাতেই এসে হাজির হব। এখন ছাড়ি?’ 

‘শুনুন? সে একটু ভাবল। 

‘কিছু বলবেন?’ 

‘আপনাকে ধন্যবাদ। 

শমিতা এবার জোরেই হাসল। ‘ইউ আর ওয়েলকাম। তারপর ফোন রেখে দিল। 

শীতল নিউ মার্কেট থেকে নাহুমের চকোলেট কিনে টালিগঞ্জের ট্রামে চেপে যখন বসল তখন একটু নিশ্চিন্ত হল। নিশ্চিন্ত এই কারণে যে, ট্রাম তার জীবনের মতো। কখনওই বেলাইনে চলে না। ট্রাম জীবনের মতো মানে এই নয় যে, তার জীবনটা সর্বদাই ট্রামের মতো ছক-বাঁধা সড়ক ধরে চলেছে। কিন্তু ট্রামের মতো বাঁধা নিয়মে চলাই তার জীবনের আদর্শ। 

শীতল দেখল তার পাশের লোকটা খিদিরপুরের টিকিট কাটল। যাক, খানিক পরেই জানালাটা পাওয়া যাবে তা হলে। সে মান্থলি দেখাল। একেবারে ডিপোয় গিয়ে নামবে। টালিগঞ্জের ট্রামে, বসে লোকে খিদিরপুরের টিকিট চাইছে, কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই ঘটনা শীতলকে নাড়িয়ে দিত। আপনি ভুল ট্রামে উঠেছেন। আপনি খিদিরপুরের ট্রামে উঠুন। কিম্বা বেহালার। আর নয় তো কালীঘাট ভায়া মোমিনপুর। শীতল তার পাশের সহযাত্রীর দিকে চাইল। খিদিরপুরের যাত্রী। এখন আর সে বিচলিত বোধ করে না। টালিগঞ্জের ট্রাম এখন খিদিরপুর মোমিনপুর দিয়ে ঘুরে ঘুরে যায়। পাতাল রেলের জন্য চৌরঙ্গীর লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার মানে ট্রামকেও তার গতিপথ পালটাতে হয়? 

অবিশ্যি তার ফল এই হয়েছে যে, বাড়ি পৌঁছুতে এখন তার রোজই দেরি হচ্ছে এক ঘন্টা দেড় ঘন্টা। অনেক সময় আরও দেরি হয়ে যায়। ডিপো থেকে ওদের বাড়িটাও অনেকটা দূর। সাইকেল রিকশা যথেষ্ট পাওয়া যায়। কিন্তু শীতল মিনিট পনেরো-কুড়ির পথ ধীরে-সুস্থে হেঁটে মেরে দিতেই পছন্দ করে। আলো থাকলে রুবি জেগেই থাকে। বরাবর ওর এই স্বভাব। যতদিন ছোট ছিল, ততদিন খাট থেকে নেমে আসত। ঝাঁপিয়ে উঠত ওর কোলে। গলা জড়িয়ে ধরে হামি খেত। তারপর জিজ্ঞেস করত, কী এনেছিস, ভোম্বল? একটা আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটিয়ে দিত রুবি। শীতলকে তাজা করে তুলত। সঙ্গে-সঙ্গে করবীর ধমকানি শুরু হত। ও কী অসভ্যতা রুবি। অ্যাঁ। মানুষটা সারাদিন পরে এল। একটু হাঁফ ছাড়তে দাও। ছিঃ। নামো। যত বড় হচ্ছ তত বোকা হচ্ছ। আর তোমারও বলিহারি! সারা গায়ে ঘাম প্যাঁচ-প্যাঁচ করছে। মেয়েকে এখনই আদর না করলে বুক ফেটে যাচ্ছিল! নাও, নামাও ওকে। বাসী কাপড় ছাড়ো। হাত মুখ ধোও। চা খাও। তারপর না হয় আদরের বন্যা বইয়ে দিয়ো। আজকাল বড় হয়েছে রুবি। গায়ে গতরে খুব বেড়েছে। তাই অনেক সংযত হয়েছে। আগের মতন লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে আর তার গায়ে ওঠে না রুবি। কিন্তু তাকে দেখামাত্র রুবির চোখে-মুখে যে দারুণ চাঞ্চল্য প্রকাশ পেতে থাকে তাতেই শীতল তার শরীরে রুবির দাপাদাপি পুরোমাত্রায় অনুভব করতে পারে। বাড়িতে আলো থাকলে রুবি আজও জেগে থাকে। আর আশ্চর্য, যত আস্তেই বাড়িতে ঢুকুক শীতল, রুবি তার ঘর থেকে সাড়া দেয়, কী এনেছিস, ভোম্বল? কী করে টের পায় মেয়েটা? জিজ্ঞেস করলে বলে, হাঁউ মাঁউ খাউ মানুষের গন্ধ পাঁউ। বুঝলি? লোডশেডিং হলে মেয়েটা আর জেগে থাকতে পারে না। বাড়ি ঢুকে রুবির সাড়া না পেলে জগৎটা শীতলের কাছে একেবারে শূন্য হয়ে যায়। 

মোমিনপুর থেকেই অন্ধকার শুরু হল। আমাদের ওদিকে আবার কী হয়েছে কে জানে? ডায়মনড হারবার রোড থেকে বাঁক নিয়ে ট্রামটা কাতরাতে কাতরাতে জজেস কোর্ট রোডে ঢুকল। মোড় ফেরার সময় ট্রামগুলো যে রকম আওয়াজ ছাড়ে তা কোনও অচেনা জন্তুর যন্ত্রণাকাতর চিৎকার বলেই শীতলের মনে হয়। 

‘কে বলবে এই একটু আগেই সন্ধে হল? মনে হচ্ছে কত যেন রাত হয়েছে।’

শীতলের পিছনের সীটে কারা কথা বলছিল। 

‘আমরা যে কলকাতা শহরে আছি এই সেনচুরিতে তাও কি মনে হচ্ছে?’ 

ট্রামটা যেন একটা আলোর ধারালো ছুরি। শীতলের মনে হল। জমাট অন্ধকারকে চিরতে চিরতে চলেছে। 

ওর পাশে বসা এক মহিলা বিড়বিড় করছিলেন, ‘গোপালনগরে লোডশেডিং হলেই হয়েছে! এরিয়াটা খুব খারাপ। আপনি কি গোপালনগর নামবেন? 

‘না।’ শীতল বলল। ‘একেবারে টারমিনাসে। 

‘তা হলে কী হবে? আমাকে আবার একটু ভিতরের দিকে যেতে হয় তো। প্রায়ই ছিনতাই হয়! ‘ 

‘ভয় নেই। কাউকে না কাউকে ঠিক পেয়ে যাবেন।’

আলিপুর রোড থেকে একটা ট্যাকসি বেপরোয়া বেরিয়ে আসতেই একেবারে ট্রামের সামনে পড়ে গেল। ‘বেটিচ্চো’ বলে ট্রামের ড্রাইভার ব্রেক কষে দুর্ঘটনাটা কোনও মতে এড়াল, কিন্তু সেই ধাক্কায় ট্রামের আলোও ঝপ করে নিবে গেল। ক্ষুব্ধ যাত্রীরা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল। শুধু শীতল ভাবল, যাঃ, রুবি আজ নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়বে। চকোলেটটা তাকে আর দেওয়া গেল না। 

এখন চতুর্দিকে অন্ধকার। আশপাশের বাড়ির কোনও কোনওটার জানালা দিয়ে আলোর রুগ্ন রশ্মি ছিটকে আসছে বটে কিন্তু অন্ধকার হটাবার কাজে কিছুমাত্র সাহায্য করছে না। ট্রাম থেকে কিছু ছোকরা হৈ হৈ করে নেমে গিয়েছিল অপরাধী ট্যাকসিটাকে ধরতে। সেটা চম্পট দেওয়ায় ওরা একটা মিনিবাসকে ধরেছে। তাদের মধ্যে তুমুল বচসা শুরু হয়েছে। মুহূর্তে রাস্তা জ্যাম। চারদিক থেকে আসা গাড়িগুলোর হেডলাইটের আলোয় জায়গাটার অন্ধকার অনেকটা দূর হল। তীব্র হর্নের শব্দ, জটলার চেঁচামেচি, সব মিলিয়ে সেখানে একটা প্রবল উত্তেজনা। 

সহযাত্রিণী শীতলকে বলল, ‘সর্বনাশ, মারপিট শুরু হবে নাকি?’ তার স্বরে একরাশ উদ্বেগ। শীতলের মনে পড়ল করবী তাকে একটু সকাল সকাল ফিরতে বলেছিল। 

কনডাকটর ড্রাইভারকে বলল, ‘ডিরেল হুয়া নেহি, ট্রওলি-সে তার ছুট্‌ গয়া হ্যায়।

করবী বলেছিল, কথা আছে। তার মানে, শীতল ভাবছিল, গুরুতর কোনও কথা।

‘সত্যি সত্যিই যে মারপিট শুরু হয়ে গেল, ও বাড়ুয্যে। চলো নেবে যাই।’ পিছনের সিট থেকে বিরক্ত এক আওয়াজ ভেসে এল। 

করবীর স্বভাবত শান্ত গলায় এমন একটা জরুরি ভাব ছিল যা শীতলকে কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। করবী এভাবে কথা সচরাচর বলে না। 

‘নাববে তো বলছ, তা নেবে এই অন্ধকারে যাবেটা কোন্ চুলোয়?’ 

ড্রাইভার বলল, ‘ঘর-সে খত আয়া। খেতি কো সত্যনাশ হো গয়া হ্যায়। যো কুছ লাগায়া থা, বিনা পানি সব কুছ জ্বল গয়া হ্যায়।’

ড্রাইভারের পিছনের সিটটা শীতলের দুর্গ। ঐ সিটের জানালার ধারে বসতে পাওয়াটা তার একটা পরম প্রাপ্তি। তাই খিদিরপুরের পর থেকে সে নিশ্চিন্ত মনেই আসছিল। 

‘শুনলেন তো!’ সহযাত্রিণীর উদ্বেগ তুঙ্গে। তার গলা কাঁপছে। 

করবীর কথাটা কী? কতটা জরুরি? আর সেটা শোনার জন্যই বা তাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে কেন? তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার প্রশ্ন এখন আর ওঠেই না। 

‘ইটা ফেঁকতা হ্যায়, ইটা ফেঁকতা হ্যায়, কেবিন মে ঘুস যাও! কনডাকটর ড্রাইভারের কেবিনে ঢুকে গেল। ‘এ সিকিন কেলাস, আও, কেবিনমে ঘুসো জলদি। হাঁ, আব বৈঠো।’ ওরা দরজা এঁটে দিল। চটপট সবাই ট্রামের জানালা বন্ধ করতে লাগল। দুমদাম শব্দ হতে লাগল। চেঁচামেচি। গাড়ির হেডলাইটগুলো এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল। আর্তস্বরে তাদের হর্ন বাজতে লাগল। পিছনে, লেডিস সিটে, ভীত আর্ত আওয়াজ উঠতে লাগল। একটা ছোট মেয়ে কেঁদে উঠল তারস্বরে। 

‘এইজন্যেই বলেছিলাম নেবে চলো। 

‘তা নেবে গেলেই পারতে।’

‘তা হলে আর ইট খেয়ে মাথা ভাঙত না।’

বাইরে কে যেন বাপ বলে ককিয়ে উঠল। এবং হুড়মুড় করে একদল ট্রামে উঠে এল। 

‘শালার রোয়াবি ছুটিয়ে দিয়েছি।’ উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়ছে ওরা। 

সহযাত্রিণী শীতলের হাত চেপে ধরে ‘পুলিস ডাকুন পুলিস ডাকুন’ বলে গোঙাতে লাগল। শীতল ভাবল, আবার হিস্টিরিয়া না হয়। 

‘আমিও ঝেড়েছি শালার তপিলে। সে শালা রগে উঠে গেছে। কী চেল্লাচ্ছে মাইরি।’

শীতল বলল, ‘আপনার কাছে রুমাল আছে?” 

‘পুলিস ডাকুন, পুলিস।’

‘তপিল রগে উঠে গেছে! তবে তো অটোমেটিক ফ্যামিলি প্ল্যানিং।’ ওরা হেসে উঠল জোরে। 

‘আপনার কাছে রুমাল আছে? শুনছেন?’ শীতল ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘শুনছেন?’ পাউডার, ঘাম আর চলতি একটা সেন্টের মেশানো গন্ধ তার নাকে লেগে গেল। ‘রুমাল আছে আপনার? রুমাল?’ 

‘চেল্লাসনি, এদিকে এসে যেতে পারে।’

সহযাত্রিণী সাড়া দিল, ‘রুমাল? রুমাল! ও, রুমাল। হ্যাঁ, আছে।’

‘এলে আবার ঝাড় দেব।’ 

‘এক কাজ করুন। পুরু করে ভাঁজ করে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরুন। 

‘না মাইরি, পিছিয়ে চল। হাওয়া সুবিধের নয়।’ ওরা দ্রুত মিলিয়ে গেল।

‘রুমাল ভাঁজ করে কামড়ে ধরব? কেন? 

‘ভাল হবে।’ 

শীতল ভদ্রমহিলার হাতের মুঠো খুলে রুমাল বার করে নিল। তারপর ভাঁজ করে সেটা তাকে ফিরিয়ে দিল। বলল, ‘নিন, যা বলছি করুন।’

‘আমি বাড়ি ফিরব কী করে?’ কাঁপা কাঁপা গলায় শীতলের সহযাত্রিণী প্রশ্ন করল।

শীতল বলল, ‘সকলে যেভাবে পৌঁছে যায়, সেইভাবে আপনিও যাবেন।’

পৌঁছনোর ব্যাপারটা বড় সমস্যা নয়, ঠিক সময়ে পৌঁছনোটাই সমস্যা। আজই করবী চেয়েছিল শীতল তাড়াতাড়ি ফিরুক। শীতল জানালা খুলে একবার বাইরেটা দেখে নেবে কি না ভাবল। উৎসাহ পেল না। ভদ্রমহিলা শীতলের গায়ে গা ঠেকিয়ে বসেছে। তার উপর যতটুকু হেডলাইটের আলো এসে পড়ছে, তার ততটুকুই দেখতে পাচ্ছে শীতল। পুরো চেহারাটা আন্দাজ করতে পারছে না। যতক্ষণ আলো ছিল ততক্ষণ নিজেকে নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল শীতল যে, তার পাশে কে বসেছিল তা খেয়ালই করেনি। সে এখন লক্ষ করল তার পাশে বসা মহিলার দেহ থেকে নির্গত উত্তাপ এবং গন্ধ তার আত্মগত ভাবনাটাকে ক্রমেই বিশৃঙ্খল করে তুলছে। তার মনটাকে অন্য দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। সে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। এ-ধরনের ঘটনা তার দৈনন্দিন জীবনের রুটিন বহির্ভূত। আর সেইটাই তার অস্বস্তির কারণ। 

আজ পর-পর এই ধরনের ঘটনাই ঘটছে। প্রথম ঘটনা কোম্পানির কাছ থেকে চিঠি পাওয়া। না, প্রথম ঘটনা ওটা নয়। বাড়ি থেকে বেরুবার মুখে করবীর সেই আহ্বানটাই প্রথম ঘটনা। এখন যতই সে ভাবছে ততই সে নিশ্চিত হচ্ছে যে, করবী তাকে সাংঘাতিক কিছু বলতে চায়। 

‘ওই শুনুন, পুলিসের হুইসেল। পুলিস এসে গিয়েছে।’ সহযাত্রিণী উৎসাহভরে বলে উঠল। সত্যিই ঘন-ঘন হুইসেল বাজতে শোনা গেল। ‘জানালাটা এবার খুলে দেবেন?’ ঝট-ঝট জানালাগুলো খুলে যেতে লাগল। জানালাটা খুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে সহযাত্রিণী শীতলের গায়ের উপর দিয়ে বাইরের দিকে হুমড়ি খেয়ে চাইল। একটা হেডলাইটের আলোয় তার মুখটা পুরো ভেসে উঠল শীতলের চোখে। 

করবীর অস্বাভাবিক ব্যাপারটাই আজকের প্রথম অস্বাভাবিক ঘটনা। করবীকে শীতল দীর্ঘদিন ধরে দেখছে। কোনও ব্যাপারে প্রস্তাবনা করা তার স্বভাববিরুদ্ধ। করবী সময়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। সময় হলে সে বিনা ভূমিকায় তার কথা বলে দেয়। হ্যাঁ, শীতল নিশ্চিত, এইটেই আজকের দিনের প্রথম ঘটনা যা তাকে বিচলিত করেছে। দ্বিতীয় ঘটনা–

‘আলো-ছায়ায় পুলিসদের অদ্ভুত দেখাচ্ছে। দেখুন।’

শীতল একবার ভাবল ভদ্রমহিলাকে ওর সিটটা ছেড়ে দেয়। কিন্তু উৎসাহ পেল না। সে ভাবতেই পারেনি, আজ যা ঘটছে এবং ঘটেছে এমন ঘটনা কখনও ঘটবে। অফিসের চিঠিটার কথাই ভাবো। সে কিনা অফিসের এক একজিকিউটিভ! ওটা হল দ্বিতীয় ঘটনা। তৃতীয় ঘটনা আরও অদ্ভুত। শমিতার টেলিফোন— 

‘আপনার কি মনে হয়, ট্রাম এখন চলবে?’ 

বলতে না বলতে ট্রামের আলো এক ঝলক জ্বলে উঠেই নিবে গেল। ট্রামসুদ্ধ সবাই আওয়াজ দিয়ে উঠল। বাইরে যারা ছিল তারা ভিতরে এসে ভিড় করল। 

‘একটু টিপ করে লাগা বাবা। আজকাল কনডাকটারগুলোও হয়েছে তেমনি! একেবারে ওয়ার্থলেস। আমাদের ছোটবেলায় দেখতুম ওদের হাতের কী টিপ। একবার। ওয়ান শট ওনলি। ব্যাস। তারে ট্রলি বসে গেল। আজকাল দ্যাখো। একবার এদিক একবার ওদিক। টিকি ধরে টানছে তো টানছেই। কানেকশন আর হয় না।’

শমিতার কথা শুনে মনে হল, শীতল মনে মনে বলল, আমার ব্যাপারে তার আগ্রহের অন্ত নেই। সে যেন আমার কতকালের অন্তরঙ্গ। এসব ব্যাপার ঘটছে কেন? নিজেকে প্রশ্ন করল শীতল। সে বেশ ভয় পেতে লাগল। মানুষ যখন কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি এসে পড়ে এবং কোনও সদুত্তর খুঁজে পায় না, শীতল আবিষ্কার করল, তখনই সে ভয় পায়। যেমন এখন। সে। 

রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। ট্রাম গোপালনগর ছেড়ে, হাজরার মোড় ছেড়ে, সাদার্ন মারকেটে চলে এসেছে। হাজরা থেকে রাসবিহারী আলো ছিল। এখন আবার অন্ধকার। শীতল আর তার ভয়। করবী কি রুবি সম্পর্কে তাকে কিছু বলতে চায়? রুবির সাক্ষাতে? হ্যাঁ, এটা সম্ভব। এটাই হবে। তাড়াতাড়ি ফিরতে বলার এ একটা কারণ হতে পারে। কারণ আলো না থাকলে আজকাল রুবি তার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারে না। ঘুমিয়ে পড়ে। আজকাল খুব খাটতে হয় রুবিকে। কোন্ সকালে সে বেরিয়ে যায়।  তারও অফিস যাবার আগে। করবী ওকে হসটেলে রাখতে চেয়েছিল। রুবি রাজি হয়নি। করবী এ-ব্যাপারে শীতলের সমর্থন চেয়েছিল। সব যুক্তি করবীর দিকে ছিল। কিন্তু শীতল রুবির মনে কষ্ট দিতে পারেনি। করবী তাকে ক্ষমা করেনি। সেই থেকে মা আর মেয়েতে এক বিরামহীন অঘোষিত লড়াই চলেছে। করবী কি তাকে ওর মন থেকে বাইরে ঠেলে দিয়েছে? করবীর মনে শীতল কি কখনও ঠাঁই পেয়েছিল? বাইরের থেকে কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু এটা ঠিক, করবীর কাছে সে কখনোই তেমন সহজ হতে পারে না। 

টেলিভিশান কেন্দ্রের কাছে আসতেই তার মনে হল, রুবিও দূরে সরে যাচ্ছে। এর মধ্যেই সে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। কথাটা মনে হতেই বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়তে লাগল তার মনে। এই রাত্রির মতো। এই গভীর অন্ধকারের মতো! 

ট্রাম ডিপোর মুখে এসে যখন নামল, ঈষৎ শ্রান্ত, দেখল সে একা। 

করবী দরজা খুলে দিল। বাড়িতে আলো জ্বলছে। শীতল এতক্ষণ যেন ভাসছিল, এবার পায়ের নীচে মাটি পেল। রুবি তা হলে জেগে আছে। নিশ্চিন্ত হল শীতল। করবী দরজা খুলে দিয়েই চলে যায়, আজ সে শীতলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দরজা ছেড়ে দিল। কী ব্যাপার? শীতল ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। তার মুখে কি কিছু লেগে আছে না কি? করবী অমন করে চাইল যে! শীতল এক ফাঁকে মুখে হাত বুলিয়ে নিল। 

রুবির ঘরের দরজা ভেজানো। অন্ধকার। রুবির পরিচিত ডাকটা সে শুনতে পেল না। 

তার ঘরের সামনে শীতল নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে পড়ল। চকোলেট রুবির মাথার কাছে রেখে আসবে কি না, ইতস্তত করল। 

‘ও ঘুমিয়ে পড়েছে।’ শান্তভাবে করবী বলল। সেই মুহূর্তে সব কিছু বিস্বাদ হয়ে গেল শীতলের কাছে। সারাদিনের ক্লান্তিকে এতক্ষণ সে যেন দু’হাতে ঠেকিয়ে রেখেছিল, এখন তা হুড়মুড় করে তার উপর লাফিয়ে পড়ল। কোনওমতে নিজেকে ঘরের ভিতর টেনে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারের উপর ধপ করে আছড়ে ফেলল। জুতো খুলে পায়ের চেটোয় হাত বুলোতে লাগল। ট্রাম ডিপো থেকে তাদের বাড়ি হাঁটাপথে পনরো মিনিট। না কুড়ি মিনিট? যেদিন যেমন সময় লাগে। সে হেঁটেই আসে। এখন তার মনে হতে লাগল দূরত্বটা যেন বেড়েই চলেছে। এই পথটুকু আসতে পনরো মিনিট নয়, বা কুড়ি মিনিট নয়, শীতল যেন তারা সারা জীবনটাই পার করে দিল। 

একটা হাই তুলল শীতল। জুতোর কাঁটায় লেগে গোড়ালি শুলুচ্ছিল। সে বুড়ো আঙুলের টিপ দিয়ে দিয়ে গোড়ালিটা মালিশ করে নিল। রুবি ঘুমিয়ে পড়ল এর মধ্যে? এবার উঠল শীতল। জামাকাপড় ছাড়তে লাগল। রুবির সঙ্গেও তার ব্যবধান বাড়তে লেগেছে। এই রুবিই না এক সময় তার গায়ে লেপটে থাকত। করবী দরজা খুলে দেওয়া মাত্রই না ঝাঁপিয়ে তার কোলে চড়ে বসত। গায়ে মাথায় জল ঢালতে ঢালতে শীতল তার শরীরে রুবির স্পর্শ পেতে লাগল। রুবির ধমনীর স্পন্দন পর্যন্ত শীতলের শরীরে আঁকা হয়ে আছে। মেডিকেল কলেজে ভর্তির আগে পর্যন্তও রুবি ছুটে এসে দুমদাম করে তার গলা জুড়িয়ে ঝুলে পড়ত। ভোম্বল, দ্যাখ তো সত্যিই কি আমার ওজন বাড়ছে? কিম্বা করবী যখন রান্নাঘরে ব্যস্ত তখন এক এক দিন কী হত রুবির, হঠাৎ পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরত আর চুমায় চুমায় অস্থির করে তুলত আর একটানা বলে যেত, বাবা, বাবা বাবা…শীতল তাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে আদর করে যেত। এক অদ্ভুত সুখানুভূতিতে তার মনটা ভরে উঠত। রুবি তাকে বাবা বললে করবী বিব্রত হত। রুবি যেদিন থেকে তা বুঝতে শিখেছে, আজ ছাড়া সেদিন থেকে কক্ষনো করবীর সামনে তাকে আর বাবা বলে ডাকেনি। এটাকে গোপন ব্যাপার করে তুলেছিল রুবি। করবীর সামনে তারা দুজন হয়ে পড়ত যেন এক গুপ্ত সমিতির সদস্য। রুবির দেহের সুগন্ধি উত্তাপ শীতলের শরীরে সঞ্জীবিত হয়ে উঠল। সে শরীর মুছতে মুছতে সিদ্ধান্ত নিল, রুবিকে সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কলেজ হসটেলেই রেখে আসবে। রুবি রাজি হতে চাইবে না। তবে শীতল যদি জোর করে রুবির আপত্তি টিকবে না। কেন যে সে করবীর যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাবে সায় দিল না তখন, এখন সে-কথা ভেবে তার আফসোস হল। এই কচি মেয়ের পক্ষে এত পরিশ্রম করা সম্ভব? 

আগে ওরা তিনজনেই এক সঙ্গে খেত। রাত্রির খাওয়াটা ছিল শীতলের সব চাইতে সুখের সময়। রান্নাঘরের এক পাশে ওদের ছোট একটা টেবিল। তার দু’দিকে বসত করবী আর শীতল। একেবারে মুখোমুখি। আর রুবি মাঝখানে, শীতলের কাছ ঘেঁষে। আর যত রাজ্যের গল্প বলত রুবি। তার স্কুলের গল্প, পড়ার বইয়ের গল্প, বন্ধুদের গল্প, বন্ধুদের মা বাবার গল্প। রুবির মুখে খই ফুটত একেবারে। এখন টেবিলে ওরা দুজন। সে আর করবী। মুখোমুখি। রুবির জায়গাটা খালিই পড়ে থাকে। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে রুবি বাড়ি ফিরেই খেয়ে নেয়। প্রথম দিকে রুবি তবুও এসে খাবার টেবিলে বসত তার জায়গায়। এখন তার পড়ার চাপ বেড়েছে। জায়গাটা তাই খালিই পড়ে থাকে। শীতল খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে রুবির খালি চেয়ারটার দিকে রোজই কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। 

‘রুবিকে ডাকব? 

শীতলকে হঠাৎ চমকে দিয়েছিল করবী। খাওয়ার টেবিলে কথা-টথা বিশেষ বলে না। খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে থাকে। 

‘কেন?’ 

‘তোমার অসুবিধে হয় তো। ডাকি না। বসুক এসে।’

‘অসুবিধে?’ নিজেই অবাক হয় শীতল। ‘না, অসুবিধে হবে কেন? ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘুমোক। 

নিজের দুর্বলতা ধরা পড়ে যাওয়াতে শীতল অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে। করবীর দৃষ্টিতে কোনও কিছুই এড়ায় না। এখন শুধু ছুটির দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে শীতল। একমাত্র ছুটির দিনেই রুবিকে আবার সে কাছে পায়। খুব সুখ পায় সে। ছুটির দিনে ওদের কোনও তাড়াহুড়ো নেই। ঘুম ভাঙার পরও শীতল চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে থাকে। রুবি চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। বড় হবার পর থেকে রুবি ছুটির দিনে সকালের চা বানানোর ভার নিয়েছে। চা নিয়ে শীতলের ঘরে ঢোকে রুবি। ওর শিয়রে এসে বসে। চুলে বিলি কাটে কিছুক্ষণ। বাবা। ফিসফিস করে ডাকে। শীতল সাড়া দেয় না। 

বাবা! শীতলের গালে গাল ঠেকায় রুবি। ওর বুকে মাথা রাখে। 

এ আমেজ ভেঙে দিতে চায় না শীতল। এই মুহূর্তগুলোর জন্যই না সারা সপ্তাহ সে তৃষিত চিত্তে অপেক্ষা করে থাকে। 

বাবা, চা?

হোক গে চা। 

চা ঠাণ্ডা হচ্ছে কিন্তু। 

হোক ঠাণ্ডা। শীতল ওঠে না। 

রুবির মেজাজও বদলাতে থাকে। একটানে শীতলের গা থেকে চাদরটা সরিয়ে ফেলে। কাতুকুতু দেয়। শীতলের কান ধরে টানে। ওর চোখে মুখে জলের ঝাপটা মারে। শীতলও উঠবে না। রুবিও ছাড়বে না। শীতল যেন রুবির ক্রীতদাস। শীতলের উপর ওর একচ্ছত্র অধিকার। 

হঠাৎ রুবি চেঁচিয়ে ওঠে, ভোম্বল, এইবার কিন্তু গায়ে গরম চা ঢেলে দেব। ওঠ বলছি। 

রুবি চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়াতেই শীতল রুবির হাতটা খপ করে টেনে নেয়, তারপর উঠে বসেই ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। রুবিও পাগলের মতো তাকে আঁকড়ে ধরে। তারপর মৃদুস্বরে একটানা ডেকে চলে, বাবা বাবা বাবা… 

শীতলের হৃদয়ে এই সময়ে ভালবাসা উথলে পড়ে। অনেক সময় নিজেকে সে সামলাতে পারে না। তার ভিতরের আবেগ এতই প্রবল হয়ে ওঠে যে, তার প্রচণ্ড চাপে চোখ দিয়ে জল বেরুতে থাকে। এই সব অমূল্য মুহূর্ত আছে বলেই না জীবনটাকে শীতলের এত দামি বলে মনে হয়। 

খাবার টেবিলে সে আর করবী। নিঃশব্দে খেয়ে চলেছে। খেতে খেতে শীতল রুবির ফাঁকা চেয়ারটার দিকে চাইল। তার দৃষ্টি সেখানেই আটকে রইল। রুবি! রুবি যেন বাতাসের মতো হাল্কা হয়ে গিয়েছে। রুবির মুখ থমথম করছে। রুবি কি এতক্ষণ কাঁদছিল নাকি? রুবি শীতলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। 

ভোম্বল, তুই আমাকে হসটেলে যেতে বলছিস? তুই? 

করবী খেতে খেতে মুখ তুলে দেখল, শীতল খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে রুবির চেয়ারের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। একটা তরল আবেগের ঢেউ শীতলের সারা মুখে খেলে বেড়াচ্ছে। 

ভোম্বল, তুই, শেষ পর্যন্ত তুই আমাকে হসটেলে পাঠাবার মতলব করছিস? 

শোনো রুবি, এখন তোমার হসটেলে থাকাই মঙ্গল। তোমার পড়ার চাপ বেড়েছে, মা চান তুমি রেজালট ভাল করো। 

ভাল রেজালট আমার মা চান? কেন, তুই চাস না আমি ভাল করি? 

আমি! হ্যাঁ আমিও চাই। 

না তুই চাস না। 

নিশ্চয়ই চাই। 

তবে কেন বললি, তোমার মা চান তুমি ভাল রেজাল্ট করো। কেন বললি না আমি চাই রুবি তুমি ভাল রেজালট করো। তুই তো জানিস তোর ইচ্ছে অনিচ্ছেই আমার কাছে শেষ কথা, তা হলে তুই কী চাস তা বললি না কেন? 

ও তো একই কথা রুবি। তোমার মা’র ইচ্ছে আর আমার ইচ্ছে কি আলাদা?

বাজে কথা বলিস না ভোম্বল, বাজে কথা একদম বলবি না। 

গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে এলে কেন? কোনটা বাজে কথা? 

আমার মা’র ইচ্ছে আর তোর ইচ্ছে কি এক? আমার মা অনেকদিন থেকেই আমাকে হসটেলে সরিয়ে দিতে চাইছে। তুই তো তা চাসনি। তুই আমাকে হসটেলে দিতে চাসনি বলেই তো এ বাড়িতে এখনও রয়ে গিয়েছি। 

এ বিষয়ে তোমার মায়ের সিদ্ধান্তই ঠিক ছিল রুবি। তা হলে তোমার কষ্ট অনেক কম হত। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। তোমার মায়ের কথাই আমাদের মেনে নেওয়া উচিত ছিল। এত যাতায়াতের ধকল তোমার সইবে না। তোমার শরীর ভেঙে যাবে। 

করবী অনেকক্ষণ ধরে শীতলকে দেখছিল। সেও এখন খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু তোর কী হবে ভোম্বল? 

করবী আস্তে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কি শরীর খারাপ?’ 

‘আমার?’ শীতল হাসল। ‘কেন?’ 

তোকে কে দেখবে ভোম্বল? 

আমাকে! মেয়েটা পাগল? কেন, তোমার মা? কেন, আমি। 

ছুটির দিনে ভোরে তোর কাছে কে চা নিয়ে আসবে, ভোম্বল? 

করবী বলল, ‘রাত হল। খেয়ে নাও।’

শীতল হাসল। 

তোকে কে অত আদর করবে ভোম্বল? 

করবী বলল, ‘খেতে যদি ভাল না লাগে, থাক। ওঠো। দুধ দেব গরম করে দেব? খাবে?’ 

শীতল হাসল। 

তোমার মন খারাপ করবে না বাবা? আমাকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে বাবা, ও বাবা? 

করবী দেখল শীতলের চোখ দুটো টলটল করছে। সে উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। শীতলেরও হার্ট অ্যাটাক হল নাকি? অনিলও এমন অতর্কিতে মারা গিয়েছিল। প্রায় ওর চোখের সামনে। কিছুই বুঝতে পারেনি। জল খেতে চাইল। জল এনে করবী দেখে অনিল ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই সে তাকে বিরক্ত না করে জল রেখে চলে গিয়েছিল। ডাক্তার এসে বলেছিলেন হার্ট অ্যাটাক। করবী কোনওমতে হাত ধুয়ে এসে ভিজে হাতটাই শীতলের কপালে চেপে ধরল। 

রুবি! শীতল চমকে উঠে দেখল করবী। রুবির চেয়ারের দিকে চাইল শীতল। ফাঁকা। একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসছিল। সে চেপে দিল। 

‘কী ব্যাপার!’ শীতল বিস্মিত। 

‘তুমি-তুমি ভাল আছ তো?’ করবী তার উদ্বেগ চাপা দিতে পারল না। সে হাতটা সরিয়ে নিয়েছে। 

‘কেন, আমার কী হয়েছে?’ শীতল অবাক হয়ে করবীর মুখের দিকে চাইল। কী ব্যাপার? করবী খাওয়া ছেড়ে উঠে এসেছে তার কাছে। কখন এল? তার কপালে নিশ্চয়ই হাত রেখেছিল। শীতল সেই স্পর্শ এখনও অনুভব করছে। 

করবী এখন বিব্রত। কেন সে এত উতলা হয়ে উঠল? ছিঃ! কী ভাবছে শীতল? অত ভয়ই বা পেল কেন? 

‘তোমাকে কেমন যেন দেখাচ্ছিল—’ 

কৈফিয়ত দিতে চেষ্টা করল করবী। 

শীতল দেখল করবীর মুখে অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠেছে। নাকের ডগায় ঘাম দেখা দিয়েছে। 

‘খাচ্ছিলে না—’  

করবী আমতা আমতা করছে। 

‘সাড়া দিচ্ছিলে না—’  

এবার শীতলের লজ্জা পাবার পালা। তার কি তবে সত্যিই কিছু হয়েছিল? 

‘আমি—আমি-আমি-আমার কেমন—’  

করবী আমার জন্য ভাবে। আমার জন্য তার উদ্বেগ হয়। 

‘কাঠের মূর্তির মত বসেছিলে আমার কেমন—’ 

শীতল খুবই অপ্রস্তুত বোধ করল। আমার জন্য করবী- 

‘এক দৃষ্টিতে চেয়েছিলে—’  

বিচলিত! আমার জন্যই— 

‘চোখের পলকও ফেলছিলে না। আমি—’  

করবী ভয় পেয়ে গিয়েছে! আমার ভাল মন্দ করবীকে বিচলিত করে তোলে। শীতল বুঝতে পারল, করবী এমনই নাড়া খেয়েছে যে, সে তার ভয়কে আর গোপন করে রাখতে পারেনি। তার কাঠিন্যের আবরণ ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছে। এ করবী ভয় পায়। তারই মতো আরও এক ভিতু। শীতলের এভাবে ভয় দেখানো উচিত হয়নি। করবী তার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু শরীরের কাছাকাছি নয়, তার চেয়েও যেন কাছে। করবীকে এত কাছে আর কখনও পায়নি শীতল। সে কেমন বিপন্ন হয়ে উঠল। 

‘করবী!’ শীতল নিজেই চমকে উঠল। এভাবে সে কি আর কখনও করবীকে ডেকেছে? 

করবীও যেন বিস্মিত হল। সে স্থিরদৃষ্টিতে শীতলের দিকে চাইল। এক ঝলক রক্ত তার বুক থেকে লাফিয়ে মুখে উপছে পড়ল। 

‘আমার কী হয়েছিল জানিনে। আমি কোথায় চেয়ে ছিলাম? 

মুহূর্তে করবী ফিরে গেল পুরনো করবীর মধ্যে। বলল, ‘রুবির চেয়ারটার দিকে।’

তারপর করবী তার চেয়ারে গিয়ে বসার জন্য পা বাড়াল। এবং শীতল কিছু না ভেবেই অদ্ভুত এক কাজ করে বসল। সে খপ করে করবীর একখানা হাত ধরে ফেলল। করবী দাঁড়িয়ে পড়ল। শীতল টের পেল করবীর হাতখানা ওর মুঠোর মধ্যে কাঁপছে। ঘামছে। 

‘করবী!’ বিপন্নভাবে ডাকল শীতল। যেন ডুবে যাবার ঠিক আগে সে করবীকে আশ্রয় হিসাবে পেল। 

‘আমার কী হয়েছিল আমি জানিনে, তবে শরীর টরীর খারাপ হয়নি। তুমি ভেব না।’

আমি কি করবীকে আশ্বস্ত করতে পারলাম? 

‘আজ একটা ঘটনা ঘটেছে অফিসে।’

করবী তার হাতটা টেনে নিল না। করবীর হাতটা নরম। রুবির হাত বলেই মনে হয়। করবী চেয়ে আছে শীতলের দিকে। 

‘তাতে হয়তো আমি একটু ভয় পেয়েছি।’

করবী এখন আর বিচলিত নয়। সে তার আগের সংযম ফিরে পেয়েছে। তবে তার দৃষ্টিটা অনেক কোমল। তা যেন শীতলকে সহানুভূতির সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করছে। 

‘হয়তো সেই কথা ভাবছিলাম। তাই অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে থাকব। এতে যে এমন একটা বিশ্রী অবস্থার সৃষ্টি হবে—তোমাকে বিচলিত করে তুলবে—’  

শীতল করবীর মুখের দিকে চাইল। করবীও। 

‘করবী, তুমি যে আমার জন্য এত ভাবো তা আজ জানলাম।’

শীতল ম্লান হাসল। 

করবী জিজ্ঞাসা করল, ‘অফিসে কী হয়েছে?’ 

শীতল ক্লান্তস্বরে বলল, ‘পদোন্নতি।’ সে হাসল। ‘ছিলাম গাদায় পড়ে থাকা কেরানি, হয়েছি একজিকিউটিভ অফিসার। লম্বা লাফ।’ 

করবী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর শান্তভাবে প্রশ্ন করল, ‘তুমি ভয় পেয়েছ?’

‘হ্যাঁ। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিনে। আমাকে এই অনুগ্রহ কেন? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছিনে। আমার ভাল লাগছে না ব্যাপারটা।’

‘যে তোমাকে প্রমোশন দিয়েছে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারো না?’ 

‘সে তো জব্‌সন।’ শীতল অসহায়ভাবে বলল। ‘তাকে পাব কোথায়?’

‘জবসন? তিনি কে? 

‘হয়তো ভগবান। ঠিক জানিনে। এইটুকু শুধু জানি যে, তিনিই আমার পদোন্নতির মূলাধার। আর সেই কারণেই তো আমার এত অস্বস্তি।’ 

করবী শান্তভাবে শীতলের মুঠো থেকে নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিল। শীতল দেখল মেয়েলি শরীরের যে ঘ্রাণটা এতক্ষণ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তা এখন দূরে সরে গেল। 

করবী নিজের চেয়ারে বসে বলল, ‘রাত হল। খেয়ে নাও।’ 

খেতে খেতে হঠাৎ শীতলের খেয়াল হল, সকালে করবী বলেছিল তার কী কথা আছে। ‘তোমার যেন কী বলবার ছিল?’ মুখ তুলে সে জিজ্ঞেস করল। 

শীতলের আচমকা প্রশ্নে করবী তার মুখের দিকে চাইল। কারও যদি কিছু বলার থাকে এ বাড়িতে তা সে-ই বলে। জিজ্ঞাসা করে না কেউ। আজকের ঘটনায় সব নিয়ম কি বদলে গেল? শীতল নিজের প্রগল্ভতায় লজ্জিত বোধ করল। সে চুপ করে খেতে লাগল। 

শীতলের খাওয়া দাওয়া সারা হলে করবী বলল, ‘কথাটা আমার নয়, কথাটা রুবির। তোমাকে কথাটা বলতে ওর সাহস হয়নি। আমাকে বলতে বলেছে। ও হসটেলে সিট পেয়েছে। রবিবার চলে যাচ্ছে। 

রুবি! হটেল! রবিবার তিনটে বুলেট বিদ্ধ করল শীতলকে। 

শীতল একটু কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল। যেন শ্মশানে শোয়া অনিলের মুখটাই। করবী খুব কষ্ট পেতে লাগল, একটা উদ্বেগ ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে থাকল যেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *