এক টুকরো সুন্দর

এক টুকরো সুন্দর

আজ দোলপূর্ণিমা। সুধার জন্মতিথি।

প্রিয়লাল আজ থেকেই সিগারেট ছেড়ে দেবেন।

ঘুম থেকে উঠেই বিছানার পাশের গোল টেবিলে দেখলেন ঢাকা-দেওয়া জলের গ্লাস, চশমা, ওষুধের বাক্সের পাশে সিগারেটের প্যাকেট। কাল থেকে ছবিটা পালটে যাবে।

কাল সকালে আর এটা থাকবে না।

সিগারেটের প্যাকেটটা খুললেন। গুনলেন। চারটে আছে। শেষ সিগারেটটা টেনেই প্যাকেটটা ফেলে দেবেন। ও-হো, নো-নো-নো। আজ থেকেই তো সিগারেট ছাড়ার কথা। তাই তো প্রমিস ছিল। তো হোয়াই আরেকটা আজ? নো সিগারেট টুডে। চারটেই ফেলে দেওয়া হবে। তবে সাক্ষী রেখে। বাথরুমে যাবার সময় একটু দরকার হয়। কাল রাতে শোবার আগে এসব ভেবেই জোলাপ খাওয়া হয়েছে।

এর আগেই বার চারেক সিগারেট ছাড়ার চেষ্টা করেছিলেন প্রিয়লাল। কিন্তু সকালের ব্যাপারটার জন্যই ধরতে হয়েছে। কিন্তু এবার নো কম্প্রোমাইজ। ওই বাহ্য-প্রক্রিয়া না হয়ে যাবে কোথায়?

প্রিয়লালের বয়েস এখন তিরাশি। গান্ধীজির বক্তৃতা শুনেছেন, শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে সুভাষবাবুর বক্তৃতাও। হিটলার জিতবে না চার্চিল জিতবে এ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরতেন। জাপানের আত্ম-সমর্পণের পর বাজি জিতে সাঙ্গুভ্যালিতে ফাউল কাটলেট আর ডেভিল খেয়েছিলেন। যাদের সঙ্গে বাজি ধরতেন, তারা কেউ আজ বেঁচে নাই। কিন্তু প্রিয়লালের বাঁচতে ইচ্ছে করে। বেঁচে আছেন বলেই না এই কম্পিউটার দেখে যেতে পারলেন, ঘোমটা এবং জড়তাহীন মেয়েদের, গড়িয়া অবধি মেট্রোরেলটা দেখে যাবার বড্ড শখ।

এমনিতে শরীরটা ঠিকই আছে। সুগার নেই, প্রেসারটা প্রায় ঠিকঠাক। শুধু সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে কষ্ট হয়। তা ছাড়া কাশি হচ্ছে প্রায়ই।ডাক্তার বলেছে সিগারেট ছাড়তে হবে।

প্রিয়লালের তিন ছেলে। বড়ছেলে ত্রিপুরায়, মেজো কেরালায়। ছোটছেলে অনিরুদ্ধ। এখানেই আছেন প্রিয়লাল। বাইশ বছরের পুরনো ফ্ল্যাট। নাকতলা অঞ্চলের প্রথম ফ্ল্যাটবাড়ি বলা যায়। লিফ্‌ট নেই।

এরই মধ্যে বেগ অনুভূত হল। জোলাপের গুণ। বাথরুম-পর্ব সমাধা হল সিগারেট ছাড়াই। প্রথম হার্ডল পেরিয়ে গেলেন। এবারে দাঁত মাজা। একটাও দাঁত নেই, তবু এই প্রক্রিয়াটাকে দাঁত মাজাই বলেন প্রিয়লাল। ডানহাতের তর্জনী, মানে দাঁতমাজার আঙুলে একটু টুথপেস্ট লাগিয়ে মাড়িতে ঘষলেন। ধুতির উপর পাঞ্জাবি এবং জহর কোট চাপালেন। মাফলারও। এখন ফাগুন। শীত কি আছে আর? গতকাল রাতে টিভি-তে শুনেছেন কলকাতার সর্বোচ্চ তাপমান ত্রিশ দশমিক পাঁচ, সর্বনিম্ন তেইশ। তেইশ কি ঠান্ডা? যাক, পরেই নেওয়া যাক। সর্দিকাশির ধাত। গত তিন মাসের অভ্যেস পালটাতে তো একটু সময় লাগবেই। বাঁদুরে টুপিটা বাদ দিয়েছেন দিন সাতেক হল। আস্তে আস্তে। তাই বলে সিগারেট আস্তে আস্তে নয়। ওটা হট করেই ছাড়তে হয়।

এবার দেওয়ালের দিকটায় গেলেন। দেওয়ালে একটা শ্বেতপাথরের স্ল্যাব। ওখানে সুধার ছবিটা আছে। ছবিটার সামনে একটা ছোট্ট গেলাস, একটা ছোট্ট রেকাবি। রেকাবিতে সন্দেশ রাখা হয়। সন্দেশটাকে ঘিরে থাকে কালো কালো পিঁপড়ে। কালো মোটা পিঁপড়েগুলোকে ‘দ্যাশের’ ভাষায় বলে ডোমা। প্রিয়লাল রেকাবিটাকে নাড়িয়ে দিলেন। ডোমাগুলি এদিক ওদিক ধায়। ধীরে ধীরে। যেন পাশের ঘরের নিদ্রাভঙ্গ না হয়। তারপর আড়মোড়া দেওন। সাবধানে। শরীর বেশি বক্র করলে পিঠে লাগে।

প্রিয়লালের সকালটা এরকম :

পাঁচটা চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ— টুথপেস্ট সহযোগে মাড়ি-মর্দন।

(দাঁতটা অকালে গেল। নো প্রবলেম। মাড়িতেই সজনে ডাটা খাই। আর্টিফিসিয়াল দাঁত পরি না)

ছয়টা— সিগারেট সহযোগে বাথরুমে প্রবেশ।

সোয়া ছয়টা— প্রাতঃভ্রমণে বাহির হওন। ভট্টাচার্য-মহাশয়, সরখেল-মহাশয়, মৈত্র-মহাশয় ইত্যাদির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, বাক্যালাপ। আজকে বুঝলেন, শীতটা বেশ উঁকিয়ে পড়েছে, কিংবা কুয়াশাটা আজ বড্ড ঘন ইত্যাদি আবহাওয়া সম্পর্কিত কথাবার্তার পর কারও কন্ঠে পুত্র-নিন্দা ও পুত্রবধূ-নিন্দা শ্রবণ। যেমন— গতকাল লুচি খেতে দিল, বুঝলেন, বিকেলের করা। চামড়ার মতো শক্ত। কিংবা— গতকাল, বুঝলেন, রাতে ঘুম হয়নি। এই জন্যই গ্যাস হয়েছে। ঘুম হবে কী করে? খুব অশান্তি গেছে যে! আমার বৌমা আমার স্ত্রীকে হিংসুটে বলেছে। স্ত্রী রাত্রে কিছুই মুখে দিল না।

সাতটা— মিঠাই দোকান থেকে সন্দেশ ক্রয়। দোকানের নাম সুস্বাস্থ্য। দোকানদারের নাম পটল। কী পটল, ভাল আছ! তোমার সন্দেশের সাইজ যে দিনে দিনে ছোট হয়ে যাচ্ছে…। ইত্যাদি।

সোয়া সাতটা— সুধারানির নৈশ পর্দা-উন্মোচন। বাসি সন্দেশটির পিঁপড়া-বিতাড়ন। সন্দেশটি নিজের মুখে দিয়ে এক গ্লাস জলপান। (আগে সন্দেশটি বাইরে কাককে দিতেন। স্ত্রীর প্রসাদ স্বামীর খাওয়া উচিত নয়, তাই। একদিন টেলিভিশনে কৃষ্ণকলি বসু প্রমুখ নারীবাদীর আলোচনা শুনে মত পালটাল। স্ত্রী যদি স্বামীর প্রসাদ খেতে পারে তবে স্বামী কেন… ইত্যাদি)

সাড়ে সাতটা— আত্মজীবনী রচনা শুরু। চা-পান।‘বৌমা, অনিকে একটু সকালে ওঠানো অভ্যেস করাও…ইত্যাদি।

সাড়ে নয়টা— ‘দাও, খবরের কাগজটা দাও।’ খবরের কাগজ পড়তে পড়তে মন্তব্য করা প্রিয়লালের অভ্যেস। ‘ডিক্টেটারশিপ দরকার’, ‘এদের লাইন দিয়া দাঁড় করাইয়া গুল্লি করা উচিত’, ‘আহ-হা মামার বাড়ির আব্দার আর কী’— এইসব হচ্ছে প্রিয়লালের পেটেন্ট মন্তব্য। মন্তব্য শুনলেই খবরের বিষয় সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে সামান্য জলযোগ-সহ আর এক দফা চা পান।

আজ কিন্তু ওই রুটিন-অনুযায়ী চলছেন না প্রিয়লাল। সকালবেলাতেই সুধারানির ছবির আবরণ সরিয়ে দিয়েছেন। প্রাতঃভ্রমণে গল্পগুজব করেননি। পটলার দোকান থেকে একটা নয়, তিনটে সন্দেশ কিনেছেন। ফুলওয়ালির কাছ থেকে কিনেছেন একগাছি রজনীগন্ধা আর কয়েকটা স্টিক।

প্রিয়লাল বাড়ি এসে মালাটি ছবিতে পরালেন। প্রতিবারই মালাটা দেবার সময় বিয়ের রাতের মালার কথা মনে পড়ে। তখন রজনীগন্ধার চল হয়নি। টগরের মালা ছিল। ছবির পাশে একটা পেতলের ফুলদানি থাকে। ফাঁকা। কালচে হয়ে গেছে। অনেক আগে মাঝে মাঝে কয়েকটা রোগা রজনীগন্ধা ফুলদানিতে থাকত। এখন আর থাকে না। একবার একগোছা প্লাস্টিকের ফুল ওখানে ভরে দিয়েছিল অনি। মানে অনিরুদ্ধ। প্রিয়লাল ওই প্লাস্টিক সরিয়ে রেখেছিলেন।

প্রিয়লালের পুত্রবধুর নাম অনুরাধা। ওদের স্বামী-স্ত্রী নামের ভারী মিল। অনি আর অনু। অনুরাধা, মানে অনু প্রিয়লালের ঘরে এসে দেখল যে ছবিতে মালা। ইস জন্মদিন, দু’বছর হল বিয়ে হয়েছে। গতবছরও দোলের দিন ছবিতে মালা ছিল। জিভ কাটল অনুরাধা। কাল রাত্রেই একটা ভাল মালা এনে রাখা উচিত ছিল। ওর যে কেন এসব মনে থাকে না।

চলে যাচ্ছিল অনুরাধা। প্রিয়লাল বলে— শোনো, বোসো একটু।

এখন কেন বসতে বলছেন। এখন তো আত্মজীবনী শোনার সময় নয়। অনুরাধা দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের বিছানাটার উপর শুয়ে আছে পুবের রোদুর। পুব আর দক্ষিণ খোলা ঘর।

— কী হল, বোসো।

—এখন যে চায়ের জল ফুটছে…

—চায়ের জল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত। পুবের জানালায় আঙুল দেখালেন প্রিয়লাল।

—দ্যাখো, ওই দ্যাখো, বসন্ত। দ্যাখো নিমগাছের কচি পাতা।

অনুরাধা বলল, ওকে বলব বাজার থেকে কচি নিমপাতা নিয়ে আসতে।

প্রিয়লাল বললেন, না না, খাবার জন্য নয়।

— তবে?

—তবে কিছু না। তোমার শাশুড়িও বুঝত না।

অনুরাধা বুঝতে পারল না। শুধু নিমগাছ দেখবার জন্যই কি ডেকেছেন? এদিকে চায়ের জল ফুটছে, মানে গ্যাস নষ্ট হচ্ছে। অনুরাধা উঠে দাঁড়ায়।

— যাচ্ছ কোথায়? বোসো, কথা আছে।

— চায়ের জল…

জল, না? — জলকে চল। বেলা যে পড়ে এল জলকে চল/ পুরনো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে/ কোথা সে ছায়া সখী অশথতল।

কী ব্যাপার? এটা কি অন্ত্যাক্ষরী খেলা চলছে নাকি?

এই লোকটাকে মাঝেমধ্যেই কীরকম পাগলামিতে পায়। অনুরাধা হাসি হাসি মুখ করে আঁচলের কোণ আঙুলে জড়াচ্ছে।

প্রিয়লাল বললেন, শোনো, ওই ঘরে যখন থাকো, তখন আলখাল্লা-জাতীয় যে ফ্রকটা, যার অপর নাম ম্যাক্সি, সেইটাই পরো। রাত্রেও সেইটাই পরো। আবার সামনে আসনের সময় খামোকা ওইডার উপর শাড়ি প্যাচানোর দরকারটা কী? তোমার মায়ের নির্দেশ আছে বুঝি? কোনও দরকার নাই। কোনও সংকোচ নাই। তোমার যা কমফরটেবল, তাই পরবা। বুঝলা। আমাদের দ্যাশের বাড়িতে, আজ হইতে সেভেনটি ইয়ারস ব্যাক, উর্ধ্বাঙ্গে কিছু পরার মানে ছিল মেমগিরি। তোমার শাশুড়ির জন্য আমি সেমিজ নিয়া যাইতাম। গন্ধ-তেল নিয়া যাইতাম, আজকাল তো তোমরা গন্ধ-তেল ইউজই করো না, তাই না? এনি ওয়ে, সম্মান দেখানোর জন্য শাড়ি প্যাচানোর দরকার নাই। বুঝলা?

কত বড় একটা ব্যাপার ঘটে গেল, অনি জানলই না। ঘুমুচ্ছে।

টুকুস করে পুবের জানলা দিয়ে খবরের কাগজ গলে পড়ল। ভোটের খবর। বয়েই গেল। অনুরাধা হালকা করে হাসল। নিমগাছের পাখিরা ডাকছে। অনুরাধা বলল, চা-টা নিয়ে আসি বাবা।

প্রিয়লাল বললেন, আরে আসল কথাটাই তো কওয়া হয় নাই, বৌমা, বস, বস।

অনুরাধা খাটের কোনাটায় প্রায় না বসার মতো করেই বসে যেন মান্য করার জন্যই শুধু।

প্রিয়লাল হাসে।

তখন প্রিয়লালের তামাটে রং-এর মাড়ি, জিভ, জিভের গায়ে আবছা লেপটে-থাকা সকালের খাওয়া কড়াপাকের সন্দেশের পাতলা অবশেষও হেসে ওঠে।

প্রিয়লাল বলে বৌমা, সেবার যখন খুব কাশি হল আমার, তুমি বাসক পাতা ছেঁচে দিলে, কমল না, ক্যাপসুল খেয়েও উপকার নাই, তুমি বললে, বাবা সিগারেটটা ছাড়ুন। কইছিলা তুমি! আজ থিকা, ফ্রম ভেরি টুডে, সিগারেটটা ছাড়লাম। যাও। খুশি তো?

অনুরাধা খুশি। কিন্তু প্রিয়লাল খুশির প্রকাশ দেখতে চাইছেন। কিন্তু অনুরাধা আঁচল উড়িয়ে একপাক ঘুরে নিতে পারে না। শ্বশুরমশাই। কিংবা ভেরি গুড বলে হাতটা এগিয়ে দিতে পারে না। অনুরাধা শব্দ না করে হাসল। বইমেলাতে কেনা ৫০১ মনোহর সত্য কথায় আছে মানুষের হাসিতে ৩০৫টা পেশি কাজ করে।

কী বউমা, খুশি না?

নিশ্চয়ই খুশি। কিন্তু প্রমিসটা স্টেডি তো?

ও ইয়েস। প্রমিস। ওই জন্যই তো। তোমায় ডাকলাম। প্রতিজ্ঞা করনের জন্য একজন তো সাক্ষী লাগে। প্রমিসটা তোমারেই করলাম। বুঝলা? গয়ায় একটা বটগাছ আছে। অক্ষয়বট। সেই অক্ষয়বটের কাছে পিতার নামে কোনও একটা প্রিয় ফল যে উৎসর্গ করে, সেই ফল জীবনে খায় না। জানো, সেই অক্ষয়বটের গল্প?

অনুরাধা উঠে দাঁড়ায়।

— ও হো, সরি সরি। চায়ের জল। যাও।

অনুরাধা যায়। ছশো নব্বই স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটে এই ঘর থেকে রান্নাঘর তত সাতখানা স্টেপ। সাত পা। প্যানে আর জল নেই। আবার জল দিতে হয়। চা তৈরি করে নিয়ে যায় প্রিয়লালের ঘরে। চা-টা চায়ের টেবিলে রাখতে গিয়ে অনুরাধা প্রিয়লালের মুখের দিকে তাকায়। হাসি বয়ে আনা ঠোঁট দুটো জোড়া লাগলেও দুই ঠোটের মাঝখানে তখনও হাসির ফাটল রয়ে গেছে। অনুরাধা চা রাখল। প্রিয়লালের এবার বলার কথা, অনিকে একটু সকালে ওঠা প্র্যাকটিস করাও। কিন্তু বললেন, অনি এখনও ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক। আজ ছুটির দিন…।

প্রিয়লাল আত্মজীবনী লিখছেন। প্রিয়লাল জানেন উনি কোনও ভিআইপি লোক নন। একেবারেই এনা-তেনা। এই লেখা কোনওদিন কোথায় ছাপাও হবে না। তবু এটা লিখতে ভাল লাগে। লেখা মানে পুরনো দিনের মানুষের কাছে যাওয়া, হারানো মানুষদের ফিরে পাওয়া। পুরনো দিনের সঙ্গে খেলা করা। প্রিয়লাল বড় বড় অক্ষরে লেখেন। চোখে ছানি। অনুরাধা জলখাবার দিতে এসে দেখে খাতাটা খোলা। ওই খাতায় অনুরাধারও অধিকার আছে। মাঝে মাঝে এমনও হয়, দুপুরের দিকটায়, প্রিয়লাল বলেন, অনুরাধা লেখে।

অনুরাধাকে খোলা খাতার সামনে দেখে প্রিয়লাল বললেন, আমার এখন আঠাইশ বছর বয়স চলতাছে। বুঝলা, আমি এখন কইলকাতা ক্রাউন বোর্ডিং-এ থাকি। পড়োনা বৌমা, ওইখানটা একটু পড়ো…

“আমি, নগেন্দ্র ও কামিনীকান্ত একই ঘরে থাকি। তৃতীয় তল-এ। নগেন্দ্র আমা হইতে কমপক্ষে পাঁচ বৎসরের ছোট হইলেও আমাদের সখ্য ভাব ছিল। তাহার বিবাহ স্থির হইল উত্তরপাড়ায়। সে আমাকে বাঙালদাদা ডাকিত। তাহার বিবাহে আমি সম্পূর্ণ কলকাত্তাই ভাষায় যে পদ্য ছাপাইলাম আজও তাহা বেশ মনে আছে।

কী হে ডিয়ার শুনছি নাকি

ম্যারেজ তোমার আজ

তাই মুখের কালার বদলে গেছে

হাফ হাসি হাফ লাজ…

অনুরাধা চায়ের কাপ নিয়ে এবার নিজের ঘরে যায়। অনিরুদ্ধ পাশ ফিরে শুয়েছে এবার। আজ ওর ছুটি। বড্ড পরিশ্রম ওর। সাড়ে সাতটায় ওঠে, তারপরই তাড়াহুড়ো করে পৌনে ন’টার মধ্যেই বেরুতে হয় ওকে। অনুরাধার এখন কী করা উচিত! আস্তে আস্তে জাগিয়ে দেওয়া ভাল? নাকি ঘরের পর্দাটা টেনে দিয়ে ঘরটা আর একটু আঁধার করে দেবে? কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল অনুরাধা। উঠে যাওয়া লুঙ্গিটা একটু নামিয়ে ঠিক করে দেবে? ঘুম ভেঙে যায় যদি? এভাবে যদি ভাঙে, যদি ওঠে, ভালই। তাই করল অনুরাধা। ঘুম ভাঙল না। শেষকালে টিভির উপরে নটরাজ মূর্তির কাছে পড়া থাকা চানাচুরের বয়াম আর কাচের গেলাসটা নিয়ে গেল রান্নাঘরে। ভাল করে ধুয়ে নিল। কী হবে জলখাবার? ছুটির দিনগুলোতে এরকম সমস্যা হয় অনুরাধার। কেন যে এরকম হয়। লাস্ট শনিবার ওরা শুয়েছিল রাত এগারোটার মধ্যেই। অনি ওকে টেনে নিয়েছিল। অনুরাধার তেমন সাড়া ছিল না। অনিরুদ্ধ দু-এক মিনিট পরে ছেড়ে দিয়ে বলেছিল, কী হল, তোমার ইচ্ছে নেই অনু? অনুরাধা কী করে বোঝাবে তখন ওর মন ছিল অন্য জায়গায়। রাত পোহালেই রবিবার। ও ভাবছিল রবিবারের জলখাবারের কথা। পরোটা না লুচি? পরোটা হলে আলু ডুমো ডুমো কাটা হবে। লুচি হলে ঝিরি ঝিরি। নাকি রুটি। গত রবিবার পরোটা হয়েছিল। রুটি হলে বাটি-চচ্চড়ি। মনে এইসব ভাবনা থাকলে ওইসব হয়?

সম্বন্ধ করা বিয়ে। খবর কাগজের। শাশুড়ি নেই জেনে মা বলেছিল— অনেক স্বাধীন থাকবি, কিন্তু ঝামেলাও আছে। তুই বুঝে দেখ। অনুরাধার মনে হয়েছিল কিছু ডিসিশন নিতে হবে, এই তো…

আজ নতুন কিছু করতে ইচ্ছে করছে অনুরাধার। শাশুড়ির জন্মদিন। রান্নার বইটা খুলল অনুরাধা। কচুরি করতে গেলে আগের দিন ডাল ভিজিয়ে রাখতে হয়। দহিবড়া? তাতেও ডাল ভিজোতে হয়। নান? — পাঁচশো ময়দার সঙ্গে আড়াইশো দই মেখে অন্তত ছ’ঘণ্টা রেখে দিন…। সকালে কি পকোড়া ভাল?…সিঙাড়া… ওই তেকোনা খোলটাই করা যাবে … উপমা…। উপকরণ সুজি, সরষে, কারিপাতা, আদা কুচি, পেঁয়াজ কুচি, কাজুবাদাম…। সবই আছে, শুধু কারিপাতাটা নেই। উপমা দু-চারবার খেয়েছে অনুরাধা, সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে। আর একটা মিষ্টি করলে কেমন হয়? মালপোয়া? দুধ, মৌরি, ময়দা, ঘি সবই তো আছে। ইস, রাত্রে যদি মনে পড়ত। সব গুছিয়ে রাখা যেত।

কাল খুব খুশির দিন গেছে ওর। ওর সব কথা শুনতে হয়েছে। সব আব্দার। সব অসভ্যতা। কাল ও একটা স্কুটার কিনল কিনা! চিত্তে মহরম। বিয়ের পর থেকেই শুনে আসছে— স্কুটার, স্কুটার। ‘বুঝলে অনু, পুরনো স্কুটার হার্গিস কিনব না। অশান্তি। ইনসেনটিভের টাকাটা পেলেই…’

টার্গেট ছাড়িয়ে বিক্রি না হলে ইনসেনটিভ হয় না। তাই টার্গেট ক্রস করার জন্য কয়েক মাস ভীষণ পরিশ্রম করেছে অনুরুদ্ধ। আঠারো হাজার টাকা ইনসেনটিভ পেয়েছে। বুঝলে, হুস হুস করে বেরিয়ে যাব স্কুটারে। তুমি ভয়ে জড়িয়ে ধরবে আমাকে। সল্টলেকে তোমার দিদির বাড়ি যাব। আমার বন্ধু অংশু, কী জমাটে ছেলেটা। এমন বেখাপ্পা জায়গায় থাকে, তিনবার বাস চেঞ্জ, কিন্তু দূরে নয় তেমন। একটা স্কুটার হলে…। স্কুটারটা কিনলে কিন্তু রোববার বিকেলে বেরোব। এভরি সানডে’।

সেই স্কুটার গতকাল কেনা হয়েছে। নিজে চালিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। আগে বন্ধুদের স্কুটারে চাপত। স্কুটারের সঙ্গে নিয়ে এসেছিল নতুন সালোয়ার কামিজ। খুব পছন্দ হয়েছিল অনুরাধার। ফলে একদম অন্য মুডে ছিল অনিরুদ্ধ। ওর ছোটবেলাকার স্ট্রাগলের কথা বলেছিল, সাইকেল চুরি যাওয়ার পর গভীর দুঃখের কথা বলেছিল। সব নিয়ে কাল রাতটা অন্যরকমের ছিল। ভাল লাগার। ভুলে যাবারও। তাই কিছুই গুছিয়ে রাখা হয়নি।

এই গোছানো নিয়ে অনির কত অভিমান। ও তো বোঝে না ব্যাপারটা। আজকাল শুতে এলে অনি জিজ্ঞাসা করে সব ‘খুচুর খাচুর’ শেষ হয়েছে? খাটের তলায় চোর আছে কি না দেখা হয়েছে, ফ্ল্যাশ ট্যাঙ্কের ভিতরে নেই তো? দেখা হয়েছে? আরে বাবা, খোঁটা মারলেই হবে! দিব্যি তো লুঙ্গিটুঙ্গি পরে নীল আলো জ্বালিয়ে সিগারেট খেয়ে একদম রেডি। কিন্তু অনুরাধা কি তক্ষুনি শুতে যেতে পারে? এক্সট্রা তরকারি ফ্রিজে ঢোকাতে হয়, গ্যাস ওভেন পরিষ্কার করতে হয়, চাবি ঘুরিয়ে সিলিন্ডার বন্ধ করতে হয়, দই পাততে হয়… অনুরাধার খুচুর খাচুর আর শেষ হয় না। কতদিন অনি কোলবালিশ জড়িয়ে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে রয়েছে। গা ধরে ঠেলা দিলেও অভিমান যায় না। এতই যদি ইয়ে, তা হলে আমার সঙ্গে একটু হাত লাগালেই তো পারো। তা করবে কেন, ব্যাটাছেলে না।

মালপোয়া ভাজতে ভাজতে অনুরাধা শুনল—‘ইস। এদের ইয়েটা কাইট্টা ফালাইতে হয়‘ খবর কাগজ পড়ছেন বাবা। কমেন্ট। জলখাবার নিয়ে প্রিয়লালের ঘরে গেল। খবর কাগজে শ্বশুর কর্তৃক পুত্রবধূ ধর্ষণের খবরে প্রিয়লালের চোখ। অনুরাধাকে দেখে প্রিয়লাল তাড়াতাড়ি কাগজটা উলটে রাখেন। বলেন, এইডা কি মালপোয়া?

— আজ্ঞে।

—বাঃ। আর এইডা কী?

—উপমা।

—কীসের? কীসের উপঅমা?

—ঝাল সুজি।

সুধা ওর জন্মতিথির দিনে এই কাণ্ডটা করত। নতুন নতুন পাক করত। কিন্তু মালপোয়াটা করতই।

— আচ্ছা, আমি যে মালপোয়া ভালবাসি তুমি কি কইরা জানলা?

—আমি তো এটা জানতাম না…

—সত্য?

—হ্যাঁ। সত্যি জানি না। ভালই হল।

—কী কইরা জানবা। অনির দশ বছরের মাথায় ওর মায়ের মৃত্যু। ওর কি মনে আছে এইসব? মনে থাকার কথা নয়। ভাল হইছে। মালপোয়াটা ভেরি গুড। একটু ক্ষীর পড়লে আরও বেটার হইত। হাজিরা ক্ষীর ছিল বিখ্যাত। নাটাগড়ের সন্তোষ হাজরার দোকানের মাখনের মতো ক্ষীর, বোঝলা, হাজরার নাম হইতেই ওই ক্ষীরের নাম হইল হাজিরা ক্ষীর…।

অনুরাধা উশখুশ করে। এবার যাই।

শোনো, শোনো, একটা মজার গল্প।

না বাবা, পরে শুনব। ওকে চা দিয়ে আসতে হবে…

যাও।

বুড়ো রাগ করল। কী করবে অনুরাধা। নইলে ও আবার রাগ করবে। অনুরাধা বলল, হাত খালি হলেই আসছি।

অনি এফ এম-এর রেডিয়ো মির্চি শুনছে। ভাল লাগল অনুরাধার। চা নিয়ে গেলে অনি হাত ধরে টানল। ম্যাক্সির উপর প্যাঁচানো শাড়িটার বাহুল্য দূর হল। অনুরাধা বলল, এখনও সেই গন্ধ। কালকের। অনিরুদ্ধ বলল, এখনও? কাল বেশি খেয়ে ফেলেছিলাম।

এরকম খেয়ো না। অনুরাধা বলল।

খাই কোথায়? দেখছ তো রেয়ার। কাল হুপে হয়ে গেছে। খুশিতে। ইনসেনটিভ কি এমনি এমনি দিয়েছে? আমাদের যে নতুন প্রোডাক্টটা, পেপসিন্‌স্‌, আমার রিজিওনে আমারই হাইয়েস্ট সেল। তা ছাড়া যত মেথোফেন হাইড্রোক্লোরাইড ফর্মুলার কাফ সিরাপ আছে, তার মধ্যে আমার এরিয়ায় আমার মার্কেট শেয়ার এখন ফটি পার্সেন্ট। আমাদের চিপ মার্কেটিং ম্যানেজার আমাকে পার্সোনালি কনগ্রাচুলেট করেছে। বুঝেছ! এই যে ইনসেনটিভটা পেলাম, ওটার জন্য মিত্রসাহেব ওপরমহলে রেকমেন্ড করেছিলেন। গ্ল্যাক্সোর মতন কোম্পানি ট্রাই প্রলিডাইন হাইড্রোক্লোরাইড-এর সঙ্গে মেথানল দেওয়া একটা নতুন প্রোডাক্ট এনেছে বাজারে। দারুণ বটলিং। ওরা ডাক্তারদের বোরোসিলের জার দিচ্ছে, আরও কত কী দিচ্ছে। ভেবেছিলাম ওদের সঙ্গে পারব না। আমি ডাক্তারদের কনভিন্স করলাম, বোঝালাম ট্রাই প্রলিডাইনের কোনও ফাংশন নেই…

এইসব হাবিজাবি শুনতে হয় অনুরাধাকে। বউ যে। অনুরাধা শুনছে আর মাথা নাড়ছে।

এবার অনিরুদ্ধ বলল, আজ সন্ধের সময় একটু মিত্রসাহেবের বাড়ি চলো।

মিত্রসাহেবের বাড়ি? আমি তো ওদের চিনি না। তারচেয়ে দিদির বাড়ি চলো, জামাইবাবুকে আবির মাখাব বেশ…।

না, মিত্রসাহেবের বাড়িতেই চলল। এতগুলো টাকা ইনসেনটিভ পাইয়ে দিলেন। যাওয়াটা ভদ্রতা নয়?

তো আমি কেন?

বাঃ! ফ্যামিলি নিয়ে যাওয়াটাই তো ভদ্রতা।

সে তো পরে একদিন গেলেও হয়। দোলের দিনেই যেতে হবে কী মানে আছে! বরং দিদির বাড়ি চলো। জামাইবাবুকে…

ঠিক আছে। তোমার কথাই থাক, তোমার দিদির ওখানেই চলো, জামাইবাবুকে আবির মাখাও… জামাইবাবুর হাতের আবির খাও…

বেরোনো মানে তো আবার দায়িত্ব। নিজেরা না হয় দিদির বাড়িতেই খেয়ে আসব, কিংবা বাইরে কোথাও। বাবা? দুপুরবেলা কিছু ব্যবস্থা করে রাখতে হবে।

এবার খবর কাগজটা অনিরুদ্ধ ভাগাভাগি করে পড়বে। তারপর দুপুরের রান্না জোগাড়।

কাগজটা আনতে প্রিয়লালের ঘরে যায় অনুরাধা। ম্যাক্সির উপর আর শাড়িটা প্যাঁচানো নেই।

প্রিয়লাল দেখলেন অনুরাধাকে। বললেন, বাঃ।

অনুরাধা মাথা নিচু করে।

প্রিয়লাল বললেন, হাতে সময় আছে একটু? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে পড়তে লাগলেন— “সেবার দেশে যাইবার সময় একটা কৌটা হিমানী কিনিলাম। রোল্ড গোল্ডের কয়েক গাছি চুড়ি এবং এরোপ্লেন-ভাঙা হাতা-খুন্তি ইত্যাদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র এরোপ্লেন-ভাঙা নামে পরিচিত ছিল। কলিকাতা হইতে ফিরিলে কী আনিয়াছি দেখিবার জন্য পাড়া-প্রতিবেশী ভিড় করিত। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল মুসলমান প্রতিবেশী। আমাদের চাষ ভাগে করিত। জহিরুদ্দিন চাচা। তাঁহার স্ত্রীকে বলিতাম বড় চাচি। তাঁর ছেলে আলিমুদ্দিন। তাঁহার সুন্দরী স্ত্রীকে বলিতাম ধলাভাবী। তাঁর স্বামী আলিমুদ্দিন আমার পিতার হোমিওপ্যাথিক ঔষধে বাঁচিয়া উঠিয়াছিল। আলিমুদ্দিন আমার পিতাকে বাপ ডাকিয়া সেই চিকিৎসার দক্ষিণা দিয়াছিল। আলিমুদ্দিন বাড়িতে খেজুর রস জ্বাল দিত। কতদিন ভাবীর হাতছানি পাইয়া কাঁঠাল পাতায় সদ্য-প্রস্তুত খেজুর গুড়ের চাঁচি খাইয়াছি। তাহারা সবাই আমি কী আনিয়াছি দেখিবার জন্য সমবেত হইলে আমি গোপনে হিমানীর কৌটাটি সরাইয়া রাখি। ব্যাগ হইতে একে একে জিনিসপত্র বাহির করি। কোনও প্রসাধন সামগ্রী না দেখিয়া আমার স্ত্রীর গোরা মুখ শুকাইয়া গেল। আমি মিঠা মিঠা হাস্য করিতে লাগিলাম। সেইদিন রাত্রে আমি হিমানীর কৌটাটি তাঁহার করকমলে প্রদান করিলাম। সে আনন্দে আপ্লুতা হইয়া গেল। তারপর হে-হে-হে…।”

অনুরাধা মুখ টিপে হাসে। বলে, এবার যাই।

রাস্তায় হোলি হ্যায় বেরিয়ে পড়েছে। পিচকিরি নিয়ে কয়েকটি বালক। অনুরাধা দুপুরের রান্না করে।

এইভাবে সন্ধে হয়। সন্ধের মুখে মুখে দুটো পাঁচতলা বাড়ির মাঝখান দিয়া চাঁদ ওঠে। প্রিয়লালের ঘরের পুবের জানালা দিয়ে ফাল্গুনের চাদ দেখা যায়। মৃদুমন্দ বাতাস। নিমগাছের পাতা নড়ে।

অনুরাধা সেজেগুজে ওই ঘরে আসে। বলে বাবা, বলেছিলাম না, দিদির বাড়ি যাব, এবার যাচ্ছি। আপনি ততক্ষণ টিভি দেখুন।

আজ ইচ্ছে করে না।

তা হলে গানটান শুনুন।

প্রিয়লাল বললে, বোসো, একটু বোসো। বেশি দেরি করাব না। বড্ড বোর করি, না? কাল থেকে আর করব না। প্রিয়লাল একটা ফুলস্কেপ কাগজ দেখান। কাঁপা অক্ষরে কিছু নাম। বললেন, দুপুরবেলায় বইসা বইস্যা একটা লিস্টি করতে ছিলাম। যাদের কাছে আমি ঋণী। এর মধ্যে অবশ্য মা-বাবাকে ধরি নাই। এক নম্বর পঞ্চানন। আমার বাল্যবন্ধু। আমাকে সাঁতার শিখাইয়াছিল। তারপর যোগেন্দ্র মিত্র। আমারে প্রথম রবিবাবুর বই পড়ায়। গোলাম মোস্তাফা। কবি গোলাম মোস্তাফা। আমারে উপদেশ দিছিলেন, অপসন দিয়া ইন্ডিয়ায় যাও। জহিরুদ্দিন, রায়টের সময় তাঁর ঘরেই….। পুলক সিংহ। আমার চাকুরিদাতা। এভাবে, পঁচিশ নম্বরে অনুরাধার নাম।

আজ একবারও ধূমপান করি নাই, বোঝলা, ওই দ্যাখো সিগারেটের প্যাকেট। সামনে আছে, তবু ফেলি নাই। তোমার সামনেই আমি এটা ফেলে দেব। এই বয়সে ক্যানসার হইলেই বা কী, না হইলেই বা কী, আর হার্ট অ্যাটাক হইলেই বা কী! আমি শুধু তোমার কথা রাখলাম।

অনির মা-ও ধূমপান ত্যাগ করার জন্য কত কইত, শুনি নাই। তোমার কথা শুনলাম। তোমার কাছে অনেক ঋণ। ঋণশোধের অন্য রাস্তা তো জানা নাই…।

প্রিয়লালের হাত অনুরাধার হাত ছুঁয়েছে। প্রিয়লালের চোখে জল।

বাইরে চাঁদ। অনিরুদ্ধ স্কুটার বের করেছে। বসেছে স্কুটারের উপর। স্টার্ট দিয়েছে। ঘড় ঘড় ঘড় ঘড়। আসলে অনুরাধাকে ডাকছে।

প্রিয়লাল বলেন, এইবার তোমারে সাক্ষী রাইখ্যা সিগারেটের প্যাকেটটা ফালাইয়া দিতাছি। দ্যাখো।

অনুরাধা বলল, ঠিক আছে, শেষ সিগারেটটা খেয়ে নিন। আজই শেষ।

তাই? কইতাছ? সো নাইস অফ ইউ। তা হলে ধরাই? দিস ইজ দি লাস্ট সিগারেট। সিগারেট ধরালেন প্রিয়লাল। প্যাকেটটা বাইরে ফেলে দিলেন। বললেন, তিনটা ছিল। ধোঁয়া ছাড়লেন। মুখে হাসি।

প্রিয়লাল বললেন, বৌমা, আমারে টেপ রেকর্ড চালাইয়া গান শুনতে কইলা। তুমিই একখান গান করো না ক্যান? তুমি তো গান করতা প্রথম প্রথম। তোমারে যে দেখতে গেছিলাম, তুমি কোন গানটা গাইছিলা মনে আছে? ‘ওই শুনি চরণধ্বনিরে শুনি আপনমনে।’ মনে আছে? একবার গাও না বৌমা। বহুদিন শুনি নাই।

অনুরাধা জানালায় হাত দেখায়। বলে দু’মিনিট। তারপর আস্তে আস্তে গেয়ে ওঠে— ‘ওই শুনি যেন চরণধ্বনিরে। শুনি আপনমনে/ বুঝি আমার মনোহরণ আসে গোপনে।’

স্কুটারের স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়।

অনুরাধার গান থামে না।

মেঝের ধুলোয় গড়াগড়ি যায় সকালের খবর কাগজ। খবরের কাগজের মন খারাপের খবর।

মাতৃশক্তি, অক্টোবর নভেম্বর ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *