এক জোড়া জুতো
যা আশঙ্কা করেছিলেন, তাই হলো। কাম আর কাঞ্চন। মার মার, কাট কাট। একজন ভূত দেখেছিল। কেমন ভূত! তাদের বাড়ির হলঘরের দেওয়ালে মাঝরাতে একটা কাটা মুণ্ডের ছায়া। তার আবার ছাগল-দাড়ি। এপাশ থেকে ওপাশ, ওপাশ থেকে এপাশ ভেসে ভেসে যাচ্ছে, মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ—ফ্যা, ফ্যা। এখন ভূতের কাটা মুণ্ড নয়, আসল মানুষের আসলি মুণ্ডু—হাটে, বাটে, ঘাটে ‘টাকা টাকা’ করে ঘুরছে। শয়নে, স্বপনে ‘টাকা, টাকা’!
যে-দেশের মানুষ ইদানীং আমাদের ‘টাকা, টাকা’ করতে শিখিয়েছে, সারকথা বুঝিয়েছে—টাকাই সব, টাকায় সব হয়, সেই দেশেরই উপদেশ— “Money is a good servant, but a dangerous master.” টাকা ভৃত্য হিসেবে খুবই ভাল, কিন্তু প্রভু হিসেবে অতি ভয়ঙ্কর। “Put not your trust in money, but put your money in trust.” টাকার ওপর নির্ভরতা না রেখে, বরং টাকাকে নির্ভরতায় রাখ। ইউরোপের দার্শনিকরা, প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তিরা টাকায় থেকে টাকার যাবতীয় মহিমা বুঝেছিলেন বলেই হেনরি ফিল্ডিং এই কথাটি বলতে পেরেছিলেন—”If you make money your god, it will plague you like the devil.” টাকাকেই জীবনের ঈশ্বর করলে সেই টাকাই শয়তান হয়ে তোমাকে ভোগাবে অবশেষে। চেনে বাঁধা কুকুর, দেখা গেল চেনে বাঁধা প্রভু। কুকুরের হাতে চেন, প্রভুর গলায় বগলশ!
অনেক সংশয় নিয়ে মাস্টারমশাই জিজ্ঞাসা করলেন : “আজ্ঞা, যাতে অর্থ বেশি হয় এ-চেষ্টা কি করতে পারি?”
আমাদের ঠাকুর হলেন পূর্ণ বাস্তববাদী, পূর্ণ আধ্যাত্মিক পুরুষ। কাম আর কাঞ্চনকে তিনি কলির মায়া বলছেন। টাকায় কতকগুলো চাহিদা মিটতে পারে, এই পর্যন্ত। টাকার পিছন পিছন অহঙ্কার আসবে, বিপরীত ভোগেচ্ছা আসবে, কুসংসর্গ আসবে। সকলের চোখের সামনে, দেখতে দেখতে মানুষটা কেমন হয়ে যাবে। শেক্সপীয়র যেমন বলেছিলেন : “Things sweet to taste, prove in indigestion sour.” ভারি সুস্বাদু, বদহজমে অম্বল!
ঠাকুর বেঁধে দিলেন। টাকার দৌড়টা বেঁধে দিলেন। মাস্টারমশায়ের প্রশ্নের উত্তরে বললেন : “হ্যাঁ, পারা যায়। বিদ্যার সংসারের জন্যে পারা যায়। বেশি উপায়ের চেষ্টা করবে। কিন্তু সদুপায়ে। উপার্জন করা উদ্দেশ্য নয়। ঈশ্বরের সেবা করাই উদ্দেশ্য। টাকাতে যদি ঈশ্বরের সেবা হয় তো সে-টাকায় দোষ নাই।”
সংসার কাকে বলে! সে তো এক বিরাট ব্যাপার! জগৎ সংসার। এই সংসারের এক-একটি ‘ইউনিট’ হলো পরিবার—’ফ্যামিলি’। একটি আশ্রয়ে সম্পর্কিত কিছু মানুষ। অতীতের ইট দিয়ে গাঁথা আটচালা, তার নাম—আবাস, আবার তারই নাম বর্তমান। দরজা, জানালা হলো ভবিষ্যৎ। তার অর্গল হলো আদর্শ। এই আদর্শকে পাশ্চাত্যের এক বিখ্যাত মানুষ জর্জ হার্বার্ট পেরেকের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন : “For want of a nail the shoe is lost, for want of a shoe the horse is lost, for want of a horse the rider is lost.”
সামান্য একটি বস্তু—একটি পেরেক, সেইটির অভাবে ঘোড়ার ক্ষুরের নালটি খুলে পড়ে গেল। ঘোড়াটি অচল হলো। আর ঘোড়ার অভাবে আরোহীর গতি নষ্ট হলো। জীবনযুদ্ধ থেকে সে ছিটকে গেল, ডুবে গেল অনিশ্চয়তার দহে।
ঠাকুরের সহজ, সরল কথায় এই পেরেকটি হলো ঈশ্বরবিশ্বাস। ঈশ্বরই বস্তু, আর সব অবস্তু। ঠাকুরের সেই জুতো। “জুতো পরা থাকলে, কাঁটা বলে তার ভয় নাই। ঈশ্বর সত্য আর সব অনিত্য—এই বোধ থাকলে কামিনী-কাঞ্চনে আর ভয় নাই।” বিদ্যার সংসার হলো সেই সংসার, সেই পরিবার যে- পরিবারের সবাই জুতো পরে হাঁটে। যারা একই সঙ্গে জনকরাজার মতো দুখানা তলোয়ার ঘোরায়, একখানা জ্ঞানের, একখানা কর্মের। জ্ঞান-কর্মের সমন্বয়ের নাম বিদ্যা। বিদ্যার সংসারের জন্য অর্থের চেষ্টা করা যেতে পারে। সেই অর্থের ব্যবহার হবে অন্যরকম। কিরকম? “টাকায় খাওয়াদাওয়া হয়, একটা থাকবার জায়গা হয়, ঠাকুরের সেবা হয়, সাধু-ভক্তের সেবা হয়, সম্মুখে কেউ গরিব পড়লে তার উপকার হয়। এইসব টাকার সদ্ব্যবহার। ঐশ্বর্যলোভের জন্য টাকা নয়। দেহের সুখের জন্য টাকা নয়। লোকমান্যের জন্য টাকা নয়।” ঠাকুর বলছেন : “শরীর, টাকা, দেহসুখ, লোকমান্য—এসব অনিত্য, দিন দুই-তিনের জন্য।”
মিল্টন বুঝেছিলেন, কারণ, তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছিল— ‘Paradise Lost’। মিল্টন লিখছেন : “There is nothing that makes men rich and strong but that which they carry inside of them. Wealth is of the heart, not of the hand.“
টাকা আর অহঙ্কার যেন মাছ আর তার পিত্ত। ঠাকুর বলছেন, করতে নেই, অহঙ্কার করতে নেই—টাকার অহঙ্কার। “যদি বল আমি ধনী–তো ধনীর আবার তারে বাড়া, তারে বাড়া আছে। সন্ধ্যার পর যখন জোনাকি পোকা ওঠে, সে মনে করে, আমি এই জগৎকে আলো দিচ্ছি! কিন্তু নক্ষত্র যাই উঠল অমনি তার অভিমান চলে গেল। তখন নক্ষত্রেরা ভাবতে লাগল আমরা জগৎকে আলো দিচ্ছি। দেখতে দেখতে অরুণ উদয় হলো, সূর্য উঠছেন। চাঁদ মলিন হয়ে গেল খানিকক্ষণ পরে আর দেখাই গেল না।”
ঠাকুর আমাদের কী শেখাতে চাইছেন! এযুগে একটা কথা খুব চালু হবে— ‘Money Power’। আগেও মানুষ বিশ্বাস করত—টাকায় সব হয়। শেক্সপীয়র থেকে একটি উদ্ধৃতি—”For they say, if money go before, all ways do lie open.” বড়লোকের সংখ্যা কম ছিল, এখন প্রচুর। গুচ্ছের বড়লোক, চতুর্দিকে ধেড়ে ধেড়ে বাড়ি, পিল পিল করছে মোটরগাড়ি। আরো বাড়বে। টাকা হয়ে যাবে খোলামকুচির মতো। কেউ সৎ পথে বড়লোক, কেউ অসৎ পথে। অসৎ পথেই বেশি। মেরে-ধরে, খুন, রাহাজানি, বাটপাড়ি করে মানুষ বড়লোক হবে। বড়লোক হচ্ছে। সে কেমন, না রাজসিংহাসনে ছুঁচো। অতীতের রাজচিত্র ছিল, হাতির পিঠে কারুকার্যমণ্ডিত হাওদা। রাজছত্রের তলে খেতড়ির মহারাজা। রাজা অজিত সিংহ। তিনি কেমন রাজা! সিংহাসন ছেড়ে স্বামী বিবেকানন্দের পদপ্রান্তে জোড়হস্ত—প্রভু! আমাকে আশ্রয় দিন। দীক্ষাদান করুন। কেমন রাজা! দিনে রাজ্যশাসন, রাত্রিতে গুরু বিবেকানন্দের পদসেবা।
হাতির হাওদায় রাজবেশধারী কে চলেছেন? আলোয়ারের মহারাজা মঙ্গল সিংহ। কেমন রাজা! দেওয়াল থেকে যাঁর ছবি টেনে নামিয়ে তাঁরই রাজসভায় বসে স্বামীজী তাঁরই দেওয়ানকে বলেছিলেন : “ফেলুন এতে থুতু, ফেলুন।” মূর্তিপূজায় অবিশ্বাসী মঙ্গল সিংহ বলেছিলেন করজোড়ে : “স্বামীজী, আপনি এইমাত্র যেভাবে মূর্তিপূজার ব্যাখ্যা করলেন, সে-অর্থে আমি এযাবৎ কাউকে পাথর, কাঠ বা ধাতু পুজো করতে দেখিনি। আমি এ-তত্ত্ব জানতাম না; আপনি আমার চোখ খুলে দিলেন।”
স্বামীজী হাসছেন। মনে মনে ভাবছেন—আমার চোখ এক নিরক্ষর পৌত্তলিক ব্রাহ্মণ খুলে দিয়েছিলেন। তিনি এখন আমার হৃদয়ের বৈঠকখানায়। ফরসিতে তামাক টানছেন। বিষয়কে ভোগের আলবোলায় চড়িয়ে জ্ঞানের আগুনে টান। বৈরাগ্যের ধূমে ঈশ্বরের সুগন্ধে তোমার ঘর ভরে যাবে। তিনিই কলকাতার অন্যতম সেরা যুক্তিবাদী শিক্ষক মহেন্দ্রনাথকে এক ধমকে বুঝিয়েছিলেন : “মাটি কেন গো! চিন্ময়ী প্রতিমা।” নিরাকার, সাকারে কিসের ভেদ! সে-ভেদ তৈরি করছে কে? তোমার মন। তোমার তার্কিক মন, তোমার সঙ্কীর্ণ মন। “তিনি তো অন্তর্যামী।… তিনি কি জানেন না—তাঁকেই ডাকা হচ্ছে?… নানারকম পূজা ঈশ্বরই আয়োজন করেছেন। যার জগৎ তিনিই এসব করেছেন—অধিকারিভেদে।”
জ্ঞানীর ব্রহ্ম, যোগীর পরমাত্মা, ভক্তের ভগবান।
আলোয়ারের মহারাজা, খেতড়ির মহারাজা। সাহেবদের নিয়ে জঙ্গলে শিকার খেলেন। বাঈজী গান শোনান। সেই মহারাজরা করজোড়ে স্বামীজীকে বলছেন : “আপনি আমায় কৃপা করুন।” একালের হাতিরা চলে গেছে সার্কাসে। রাজার স্থান নিয়েছে ধনী ছুঁচো। দেশজুড়ে তামস তাণ্ডব।
ঠাকুর বসে বসে হাসছেন। ইশারায় ডাকছেন—চলে আয়! জুতো পরে যা, জুতো! এক জোড়া জুতো!