এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – ৯

পরিশিষ্ট – স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাপর্ব 

মেজর জেনারেল মঈন-উল হোসেইন চৌধুরী (বীর বিক্রম) এর বক্তব্য 

১৩ই মে সংখ্যা বিচিত্রায় প্রকাশিত ‘ভিন্নমত’ শীর্ষক কলামে লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী আবদুর রকীব (অবঃ) বর্ণিত ১৯৭১ সালের ২৫-২৮শে মার্চ সময়ে ঘটিত জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টের ঘটনাবলির বিবরণ সম্পর্কে আমার কিছু বক্তব্য আছে। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর বিদ্রোহের ইতিহাসের সঠিক প্রতিফলন হোক এটা নিশ্চিতকরণের জন্যেই আপনার পত্রিকা মারফত এ বিষয়ে আমার বক্তব্য প্রকাশ করতে চাইছি। 

কর্নেল রকীব এবং আমার বিবরণের পার্থকের কারণ মূলত একটাই। সেটা হচ্ছে যে ২৫ থেকে ২৮শে মার্চ—এই চারদিন তাঁর কমান্ডিং অফিসার থাকাকালীন সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি কখনোই পুরোপুরি তাঁর আয়ত্তে ছিল না। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যখন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসার, জেসিও ও সৈনিকেরা জন্মভূমি স্বাধীন করার আহ্বানে জীবনপণ যুদ্ধ করার শপথ নিয়েছিল—সেই ক্রান্তিলগ্নে কর্নেল রকীবকে আমাদের সংগ্রামের অকুণ্ঠ সমর্থক হিসেবে পাইনি। তাই স্বীয় পদমর্যাদা-বলে তিনি আমাদের মাঝে থাকলেও সংগ্রামের পরিকল্পনা এবং যুদ্ধকৌশল নির্ধারণে কখনও তাঁকে আমাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত করতে সাহস পাইনি। বস্তুত যখন দ্বিতীয় বেঙ্গলের বিদ্রোহের সূচনা ১৯ মার্চের ঘটনাবলির মাধ্যমে ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে তখন হঠাৎ করে কমান্ডিং অফিসার হিসাবে তাঁর ২য় বেঙ্গলে বদলি আমাদের সকলের মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছিল। মেজর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) শফিউল্লাহ, ক্যাপ্টেন (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) নাসিম, ক্যাপ্টেন (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) আজিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন (বর্তমানে কর্নেল) এজাজ, লেফটেন্যান্ট (বর্তমানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) ইব্রাহিম এবং আমার (তৎকালে মেজর মঈন) মধ্যেই আমাদের পরিকল্পনা সীমাবদ্ধ থাকত। 

বিদ্রোহের বীজ ৭ মার্চ থেকেই বপিত হয়ে গিয়েছিল— যখন শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক বক্তৃতার কিছুক্ষণ আগে তদানীন্তন কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল মাসুদুল হাসান খান (অঃ) -এর অফিসে বসে আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম যে শেখ সাহেব স্বাধীনতার ডাক দিলে ২য় বেঙ্গল তাঁর আহ্বানে সাড়া দেবে। একই সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা, সৈন্য চলাচল এবং মোতায়েনের মোটামুটি একটা রূপরেখাও ম্যাপ দেখে আমরা খাড়া করে ফেলেছিলাম। ১৯ মার্চ থেকেই বুঝে ফেলেছিলাম যে মরণকামড় দেয়া ছাড়া হানাদার বাহিনীর আর গত্যন্তর নেই এবং তখন থেকেই ক্যাপ্টেন নাসিম, আজিজ, এজাজ, লেফটেন্যান্ট ইব্রাহিম এবং আমি পালাবদল করে রাত্রে জয়দেবপুর চৌরাস্তা এবং আশপাশের এলাকা টহল দিতাম। রেজিমেন্ট-এর জেসিও এবং এনসিওরা, যেমন সুবেদার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সম্মানিত ক্যাপ্টেন) নুরুল হক, সুবেদার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সম্মানিত ক্যাপ্টেন) মান্নান, সুবেদার চাঁদ মিয়া (বর্তমানে মৃত), সুবেদার (বর্তমানে সম্মানিত ক্যাপ্টেন) গিয়াস, সুবেদার (শহীদ) আবুল বাশার, সুবেদার মেজর শফিউল্লাহ (বর্তমানে সম্মানিত অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন), সুবেদার ওয়াজিদ আলী ও জাফর এবং অন্যান্যরা আমাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে বিশদভাবে অবহিত ও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯ তারিখের ঘটনার পরপরই আমরা জয়দেবপুরের ইলেকট্রিক সাপ্লাই অফিস এবং টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং সেইদিনই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীবৃন্দ এবং শ্রমিকনেতাদের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগও স্থাপন করি। উপরোক্ত সকল ব্যবস্থাই লেঃ কর্নেল মাসুদ-এর অবগতি ও সমর্থনের মাঝে করা হয়। 

এবারে ২৫ মার্চের কথায় আসি। তাঁর বক্তব্যে এমনই প্রতীয়মান হচ্ছে যে ২৬ তারিখ গোটা দিনে রেডিও মারফত ইয়াহিয়া খাঁর ভাষণ এবং কারফিউ জারি সম্পর্কিত খবর ছাড়া তাঁরা কিছু জানতেন না। ২৭ মার্চ সকালে সৰ্বপ্ৰথম রাজেন্দ্রপুর অ্যামুনিশন ডিপোতে গিয়ে আঁচ করতে পারলেন যে ‘পাকিস্তানীরা মিলিটারী একশনে অবস্থা আয়ত্তে আনছে না বরং মারণযজ্ঞে নেমেছে।’ পাকিস্তানিদের মিলিটারি অ্যাকশন এবং মারণযজ্ঞের মধ্যে প্রভেদ কোথায় এ প্রশ্ন ছাড়াও তথ্যগতভাবে তাঁর এই উক্তি মেনে নিতে পারছি না। আমদের পূর্ববর্তী কমান্ডিং অফিসার কর্নেল মাসুদ মারফত ক্যাপ্টেন আজিজ ২৬ তারিখ ভোরবেলায়ই জানতে পারেন ঢাকাতে সৈন্য নেমেছে। মেজর জিয়াউর রহমানের (পরলোকগত রাষ্ট্রপতি) নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিদ্রোহ সম্পর্কেও আমরা ঐ সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মারফত শুনি। দুপুরের মধ্যেই অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল রেজা খুব সম্ভব ২৬ তারিখ লোক মারফত ঢাকার তাণ্ডবলীলা সম্পর্কে অমাদের কাছে খবর পৌঁছান। ২৬ তারিখ রাত্রেই বিদ্রোহ করব কি না এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার পর সাব্যস্ত হয় যে লোকবল, অস্ত্রবল, গোলাবারুদ, Support Equipment ইত্যাদি না নিয়ে খালিহাতে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো অর্থই হয় না এবং এর ফলশ্রুতি হিসেবেই সম্ভব হয় গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানা লুণ্ঠন— সুবেদার চাঁদ মিয়ার নেতৃত্বে যার Strong room-এ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিপুল পরিমাণ রাইফেল এবং জয়দেবপুর থেকে হালকা কামান, মর্টার, মেশিনগান, গোলাবারুদ এবং যানবাহন ইত্যাদি নিয়ে আসা সম্ভব হয় যা দ্বারা কালক্রমে বিভিন্ন বাহিনীকে সুসজ্জিত করে তোলা হয় এবং যাঁরা ময়মনসিংহ ও অন্যান্য এলাকায় দীর্ঘকাল ধরে পাকিস্তান বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে রাখতে সক্ষম হন। 

২৭ তারিখ রাত্রে টঙ্গীতে পাকিস্তানিদের আক্রমণের পরে যে দৃশ্যের অবতারণা তিনি করেছেন তাও সঠিক নয়। তিনি ব্যতীত রেজিমেন্টের অন্য কারো ‘মৌন’ হয়ে থাকার অবকাশ বা কারণ ১৯ তারিখেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর আচার-আচারণ ও দোটানা ভাব শুরু থেকেই আমাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছিল। 

২৮ মার্চ মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল যাত্রার প্রাক্কালে ইউনিফরমের ব্যাপারে লেফটেন্যান্ট মুর্শেদকে সাক্ষী মেনেছেন। প্রকৃতপক্ষে ২৪ তারিখ থেকেই লেঃ মুর্শেদ টাঙ্গাইলে অবস্থান করছিলেন এবং মেজর শফিউল্লাহর মাধ্যমে তাঁকে আমরা ২৮ তারিখ রাত্রে রেজিমেন্ট-এর প্রধান দলটি ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে টাঙ্গাইলে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য খবর পাঠাই। যাই হোক, সকালবেলা মেজর শফিউল্লাহ্ জয়দেবপুর থেকে যাত্রা করার পরেই ঠিক হয় যে কর্নেল রকীব সন্ধে সাতটার দিকেই বেরিয়ে যাবেন এবং তাঁর জন্য বিকেল ৫টা থেকে হাবিলদার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার) সাইদুল হক চালিত একটি জিপগাড়ি জয়দেবপুর পোস্ট অফিসের পেছনে অপেক্ষা করতে থাকে। জিপচালককে টাঙ্গাইলের পথ ধরতে আগে থেকেই নির্দেশ দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন আজিজকে (যিনি বিকেল থেকেই চৌরাস্তার মোড়ে সশস্ত্র অবস্থায় পাহারা দিচ্ছিলেন) বলা হয় যে জিপটি অন্য কোনো পথ ধরলে যেন বাধা দেয়া হয়। সন্ধে ৬টার দিকে তাঁর সঙ্গে আমি জয়দেবপুর রাজবাড়ির গেট পর্যন্ত হেঁটে আসি এবং বিদায় নিই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমরা তাঁর বেসামরিক পোশাক পরে থাকার ব্যাপারে যদিও খুবই ক্ষুব্ধ ছিলাম এ নিয়ে বাগ্‌ বিতণ্ডা করার মতো মানসিক অবস্থা কারো ছিল না। পাকিস্তানি অফিসারদের সাথে আমি ছাড়া ক্যাপ্টেন নাসিম ও এজাজ বসে খাচ্ছিলাম। মেসে থাকাকালেই সর্বপ্রথম গুলিবিনিময়ের শব্দ শোনা যায়। Wireless সেট-এ কর্তব্যরত পাকিস্তানি সৈন্যরা হঠাৎ ভীত-চকিত হয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে এবং আর কিছুক্ষণ পরেই মেসের ভেতরে এবং বাইরে পাকিস্তানি এবং আমাদের সৈন্যদের মধ্যে গুলিবিনিময় শুরু হয়ে যায়। রাত্র ন’টার দিকে যখন প্রায় সমস্ত রেজিমেন্ট জয়দেবপুর ত্যাগ কলে চলে গেছে, কর্নেল রকীবের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে আমি সর্বশেষে জয়দেবপুর ত্যাগ করি এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আজিজ এবং তাঁর সাথের সৈন্যগণকে চৌরাস্তা থেকে তুলে নিয়ে টাঙ্গাইলের পথে যাত্রা করি। বলা বাহুল্য যে ২য় বেঙ্গলের সামরিক এবং এমনকি বেসামরিক কর্মচারীদের মধ্যে কর্নেল রকীব ছাড়া এমন দ্বিতীয় কোনো বাঙালি ছিলেন না যিনি আমাদের সঙ্গে জয়দেবপুর ত্যাগ করতে পারেননি। 

২৯ তারিখের ঘটনার কথা আমাদের জানার কথা নয় তবে অগণিত প্রাণদানের বিনিময়ে এবং শুধুমাত্র ২য় বেঙ্গলেরই শতাধিক শহীদের রক্তের বিনময়ে অর্জিত স্বাধীনতার উন্মেষলগ্নে ১৬ই ডিসেম্বর যখন ২য় বেঙ্গলের অধিনায়ক হিসেবে ঢাকায় প্রবেশ করি তখন যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানি অফিসারদের সঙ্গে আলাপ করে অন্যান্য ঘটনার মধ্যে ২৯ তারিখের জয়দেবপুরের ঘটনাবলি সম্পর্কেও অবহিত হই। তাঁদের বক্তব্য উল্লেখ করে এই বিবরণের কলেবর বৃদ্ধি করা আমার অভিপ্রায় নয়। 

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক বিতর্কের ঝড় এই ১২ বছরে বয়ে গেছে। আজ নতুন করে এই নিয়ে যশ ও খ্যাতির লড়াইয়ের মারপ্যাঁচ আর এক দফা হয়ে যাক—এই রকম উদ্দেশ্য নিয়ে যেমন আমার বক্তব্য লিখতে বসিনি ঠিক তেমনি যখন প্রভাববিস্তারের বুনো লতার বাঁধনে দেখি—মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বিপন্ন করার প্রয়াস তখন স্বভাবতই নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকতে বিবেকের কাছ থেকে বাধা আসে। মুক্তিযুদ্ধের বিশ্লেষণ বিভিন্ন মতবাদ এবং দৃষ্টিকোণ থেকেই হয়েছে – শুধু এই সত্যটাই বোধহয় আজ পর্যন্ত অক্ষত থেকে গেছে যেসব বীর দেশমাতৃকার সন্তানেরা আমাদের দেশের পটভূমিকায় সর্বকালের সর্ববৃহৎ সামাজিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা অবস্থার প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে নয় বরং স্বেচ্ছায় আদর্শ ও দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে মুক্তিযুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে অজানার পথে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। 

সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১২ বর্ষ, ৯ সংখ্যা, ২২ জুলাই, ‘৮৩, ৫ই শ্রাবন, ১৩৯০। 

জয়দেবপুর : ’৭১ মাৰ্চ 

রাত প্রায় নয়টা। গোলাগুলির তাণ্ডব থেমে গেছে। বিজলিবাতি নেই বলে গভীর অন্ধকারে ডুবে আছে জয়দেবপুরের প্রাচীন রাজবাড়ি—দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাসস্থান। আমি অপেক্ষমাণ জিপটিতে উঠে জয়দেবপুর চৌরাস্তার দিকে যেতে বললাম হাবিলদার সাইয়েদুল হককে। দেখলাম লেঃ কঃ রকীব শেষ পর্যন্ত আসেননি। চৌরাস্তার মোড় থেকে আমি ক্যাপ্টেন আজিজকে উঠিয়ে নিলাম। নির্দেশ অনুসারে গোলাগুলীর সময়ে বাহিনীর সকল সৈন্যকে পূর্বনির্দিষ্ট স্থানে একত্র হয়ে একসঙ্গে টাঙ্গাইলের পথে অগ্রসর হবার নির্দেশ আগেই দেয়া ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই রওয়ানা হলো এবং পথে যোগদান করলো গাজীপুর ও রাজেন্দ্রপুরের সৈন্যদল। স্বল্পতম রক্তব্যয়ে পাকসৈন্যের বিরুদ্ধতা ভেঙে সমস্ত সৈন্য, ভারী ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ও রসদসামগ্রী নিয়ে আমরা জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হতে পারলাম বলে অত্যন্ত স্বস্তিবোধ করছিলাম। সংগ্রাম প্রস্তুতির অতিবাহিত দিনগুলোর উৎকণ্ঠা, রক্তপাতের শঙ্কা, ব্যর্থতার বিপদ সরে গিয়ে জন্ম নিল সশস্ত্রসংগ্রামের উদ্দীপনা, বিজয়ের প্রতিজ্ঞা ও সুবর্ণদিনের স্বপ্ন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের সশস্ত্ৰ অভ্যুত্থান ও অবদান স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গৌরবময় অধ্যায়। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের উপর প্রকাশিত কিছু পুস্তক আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। লেখকগণ প্রধানত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি। তাই পুস্তকগুলো ইতিহাস না হয়ে জীবনী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জাতীয় পুস্তক প্রকাশনা অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক। সঠিক ইতিহাস রচিত হবার জন্য এ সমস্ত পুস্তক ও প্রবন্ধের তথ্য ও বর্ণনা ঐতিহাসিকদের বিশেষ কাজে লাগবে। তবে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিলেন তাঁদের পক্ষে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তিগোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে উঠে ইতিহাস লেখা অত্যন্ত দুরূহ। একটি উদাহরণ মনে পড়ছে-যিনি কোনো নাটকে অংশগ্রহণ করেছেন, তার পক্ষে নিজে কতটুকু দক্ষতা ও কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তার বিচার সঠিক হয় না। যাঁরা দর্শক তাঁরাই নায়কের সার্থকতা বিচার করতে পারেন। 

এই প্রসঙ্গে আমি আরও একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সকল বীর সৈনিক অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের অনেকে এখনও জীবিত আছেন। উৎসাহী ইতিহাস লেখক তাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে বহু সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। আর কিছু বছর পর তা আর সম্ভব হবে না। 

দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর হিসেবে আমি প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সশস্ত্রসংগ্রামে লিপ্ত হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। ভবিষ্যতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস প্রণয়নে সাহায্য হতে পারে এই বিশ্বাসে ব্যাটালিয়নের ‘ওয়ার ডায়েরি’ থেকে কিছু ঘটনা তুলে ধরছি। ‘ওয়ার ডায়েরি’ থেকে তুলে ধরা ঘটনাবলি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের স্বাধীনতাযুদ্ধের ভূমিকার উপর আলোকপাত করবে। 

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের গড়িমসি দেখে আমরা বাঙালি সৈন্যরা অনেকেই বিক্ষুব্ধ ছিলাম। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পায় ১৬৯টির মধ্যে। ফলে ৩১৩টি আসনবিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় ও সরকার গঠনের অধিকার লাভ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে জয়লাভ করে। ৬ দফায় রাষ্ট্রের ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব ছিল। নির্বাচনের ফলাফলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এতদঅঞ্চলের জনগণ ৬ দফার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ভাগ-বাঁটোয়ারা চায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বিরতিহীন বঞ্চনার ফলে এই অবস্থার জন্ম হয়। পাকিস্তানের ইয়াহিয়ার সরকার মনে করেছিল নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। কিন্তু ফলাফল অন্যরূপ হওয়ায় তাদের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। কাজেই সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করার গোপন আঁতাঁত করছিল। 

পাকিস্তানের সামরিক শাসক আমাদের দমন করবার উদ্দেশ্যে পাশবিক সামরিক শক্তি প্রয়োগের জন্য সময় নিচ্ছে বলে আমাদের আশঙ্কা দৃঢ় হচ্ছিল I এই উদ্দেশ্যে বাঙালি সৈন্যদের বিভক্ত করে যে আমাদের আক্রমণ-ক্ষমতা তিরোহিত করবে সে সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব আরবাব ভারতীয় আক্রমণের ধুয়া তুলে 

দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ানকে ভাগ করে একটা কোম্পানি টাঙ্গাইল ও আরেকটি ময়মনসিংহে পাঠিয়ে দিলেন। টাঙ্গাইল কোম্পানির অধিনায়কত্ব দেয়া হলো পাকিস্তানি মেজর কাজেম কামালকে। এই কোম্পানিতে সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় একশতের মতো। ময়মনসিংহে যে কোম্পানি পাঠানো হলো তার অধিনায়ক ছিলেন মেজর নুরুল ইসলাম (এখন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল)। 

ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে যে কোম্পানি দুটি পাঠানো হয়, তার হেডকোয়ার্টারস করা হয় টাঙ্গাইলে, আর মেজর সফিউল্লাহকে (বর্তমানে রাষ্ট্রদূত ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। জয়দেবপুর সদর দফতরে ব্যাটালিয়ানের অবশিষ্ট প্রায় চারশত সৈন্য রয়ে যায় এবং ব্যাটালিয়ান কমান্ডার ছিলেন লেঃ কঃ মাসুদুল হোসেন খান। 

১ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সহসা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ পিছিয়ে দিলেন। ফলে দেশের সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। ১ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত যে গুমোট অবস্থার সৃষ্টি হলো সারাদেশে, জয়দেবপুরের সামরিক ঘাঁটিতেও তার প্রতিফলন ঘটলো। যদি ৭ মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তা হলে পাকিস্তান বাহিনী সামরিক পদক্ষেপ নেবে। এক্ষেত্রে আমাদের বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। প্রস্তুতি ছাড়া বিদ্রোহের ফল ভয়ঙ্কর হবে একথা স্মরণ রেখে আমরা ক্রমে ক্রমে প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম। 

ইতিমধ্যে পাকিস্তানে অবস্থানরত সৈন্যবাহিনীতে পরিবর্তন আসলো। ইন্টার্ন কমান্ডে লেঃ জেঃ সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের বদলে লেঃ জেঃ টিক্কা খান যোগদান করলেন। বিদায়ের পূর্বে লেঃ জেঃ ইয়াকুব হেলিকপ্টারে জয়দেবপুরে আসলেন লেঃ জেঃ টিক্কা খান ও মেঃ জেঃ খাদেম হোসেন রাজার সাথে। আমি মেঃ জেঃ খাদেম হোসেন-এর এডিসি ছিলাম একসময়। কথা প্রসঙ্গে উনি আমাকে ছুটিতে যেতে চাই কি না জানতে চাইলেন। এতে আমার সন্দেহ ঘনিভূত হলো যে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ছুটির প্রয়োজন হলে আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে লিখবো বলে জানালাম। ইতিমধ্যে ২য় লেঃ এম. এ. মান্নানকে ৫৭ ব্রিগেডের সদর দফতরে লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে নিয়ে যাওয়া হলো। ২য় লেঃ ইব্রাহিমকেও টেনিং-এর নামে একই সদর দফতরে বদলি করা হলো। আমি লেঃ কঃ মাসুদুল হোসেন খানকে এইসব পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত দিলাম। আমাদের সাথে পাকিস্তানি অফিসার ছাড়া সৈন্য ও বেসামরিক কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ জন। যাতে তারা কোনোপ্রকার সন্দেহ না করে সেজন্য আমরা বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছিলাম। ইতিমধ্যে আমাদের ব্রিগেড সদর দফতরের ব্রিগেড মেজর খালেদ মোশাররফকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় আনা হলো আর্মার্ড কোরের অফিসার লেঃ জাফরকে। 

বাঙালি মেজরদের মধ্যে আমি অবিবাহিত ছিলাম। এ জন্য সহকর্মী ক্যাপ্টেন নাসিম (বর্তমানে মেজর জেনারেল), ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান (বর্তমানে মেজর জেনারেল), লেঃ এজাজ (বর্তমানে কর্নেল) এবং ইব্রাহিম (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার)-এর সাথে সবসময় জয়দেবপুরেই থাকতাম। লেঃ কঃ মাসুদ ও মেজর সফিউল্লাহ বিবাহিত ছিলেন। তাঁরা তাঁদের পরিবারের সঙ্গে রাত্রিতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে থাকতেন। সৈনিকদের সঙ্গে থাকায় আমাদের পক্ষে তাদের সঠিক মনোভাব অনুভব করা সম্ভবপর হয়েছিল। ১ মার্চের পর থেকে আমি বাস্কেটবল খেলার মাঠে সুবিধামতো সরাসরি কথাবার্তা বলে সৈন্যদের মনোভাব যাচাই করছিলাম। এরপর ৫ মার্চ বাস্কেটবল খেলাশেষে শ্মশান ঘাটে সিনিয়র জেসিওদের সাথে খোলাখুলি অবস্থায় আলোচনা করি ও লেঃ কঃ মাসুদকে আলোচনার ফলাফল অবহিত করি। ৭ মার্চ সকালে আমি ব্যাটালিয়নের ইনটেলিজেন্স হাবিলদার মুসাব্বিরকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অপারেশন মনচিত্রসমূহ আমাকে দিতে বলি এবং এই মানচিত্র নিয়ে লেঃ কঃ মাসুদের সাথে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের কার্যক্রম আলোচনা করি। আলোচনা অনুসারে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য সার্বক্ষণিক সশস্ত্র পাহারা মোতায়েন করা হলো জয়দেবপুর চৌরাস্তায়, সিনেমা হলে ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। এইসব সৈন্যরা সকলেই ছিল বাঙালি। গোপনে তাদের মোতায়েন করা হয়। এদিকে মেজর সফিউল্লাহ শ্বশুরের মৃত্যুসংবাদে দু’দিনের ছুটিতে ১০ মার্চের দিকে টাঙ্গাইল থেকে কুমিল্লায় যান। ছুটির পর টাঙ্গাইল যাবার পথে তিনি জয়দেবপুরে আসলে লেঃ কঃ মাসুদ তাঁকে জয়দেবপুরে থেকে যাবার নির্দেশ দিলেন। 

১৫ মার্চের পর আরেকটি ঘটনার সূত্রপাত হলো। কিছুদিন পূর্বে ৩০৩ কেলিবার রাইফেল বদলিয়ে নতুন চাইনিজ রাইফেল দেয়া হয়েছিল। পুরনো রাইফেলগুলো জমা দেয়ার প্রস্তাব সত্ত্বেও ঢাকা সদর দফতর এগুলো নিতে বিলম্ব করে। ১৫ মার্চে ব্রিগেড সদর দফতর সহসা ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে এই সমস্ত অস্ত্র ফেরত দেবার নির্দেশ দিল। এই নির্দেশ স্বল্প সময়েই বাঙালি সৈন্যদের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার হয়ে পড়ে যে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করা হচ্ছে। সুযোগ ও সুবিধা পেলে পাকিস্তানিরা যে নিয়ন্ত্র করতে চাইবে সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ ছিল না। নিরস্ত্র করতে চাইলে যে বিদ্রোহ ঘটবে, তা তারা বুঝতে পেরেছিল। পুরনো অস্ত্র জমা দেয়ার বিষয়টি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় বিক্ষুব্ধ জনসাধারণ ঢাকা-জয়দেবপুর সড়কে ৪০ থেকে ৫০টি ব্যারিকেড স্থাপন করে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে লেঃ কঃ মাসুদ জানালেন, অস্ত্র নিয়ে এ মুহূর্তে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া বিপজ্জনক হবে। ঢাকা সদর দফতর এর মধ্যে সম্ভবত: অন্য কিছুর আন্দাজ পেল। তারা কড়া হুকুম দিল : “বলপূর্বক ব্যারিকেড সরিয়ে ঢাকায় অস্ত্র জমা দিতে হবে।” 

ইতিমধ্যে আমার সহকর্মীরা এবং আমি যারা রাতে জয়দেবপুরে থাকতাম তারা লেঃ কঃ মাসুদের জ্ঞাতসারে রাত্রিকালীন প্রহরা দ্বিগুণ করে দিলাম। আমরা সবাই ব্যক্তিগত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সঙ্গে রাখতাম। জনতার আক্রমণের ভয়ে ব্যক্তিগত অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমরা সাথে রাখি বলে পাকিস্তানিদের বলা হয়েছিল। পাকিস্তানিরাও অবশ্যই আমাদের ব্যাখ্যা যে বিশ্বাস করত তা মনে হয় না। কিন্তু মুখে কিছু বলত না। হয়তোবা তারা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যাতে অগ্নিতে পরিণত না হয়, সেইদিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। 

আমাদের ওরা সন্দেহের চোখে দেখছিল তাই আমাদের ব্রিগেড সদর দফতর কর্তৃপক্ষ অনুমান করলো যে আমরা ব্যারিকেড সরানোর জন্য বল প্রয়োগ এড়িয়ে চলছি। ১৯ মার্চ ব্রিগেড কমান্ডার আরবাব একটি বৃহৎ রক্ষীদল নিয়ে জয়দেবপুরে আসবেন এবং আমাদের সাথে মধ্যাহ্নভোজন করবেন বলে জানালেন। তিনি নির্দেশ দিলেন যে, আমার অধীনস্থ কোম্পানি রাস্তায় ব্যারিকেড সরিয়ে এগিয়ে এসে ব্রিগেড কমান্ডারকে নিয়ে যাবে। আমি বুঝলাম যে আমার আনুগত্য পরীক্ষিত হচ্ছে। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আমরা আগেই যোগাযোগ স্থাপন করেছিলাম। ব্যারিকেড সরানোর ব্যাপারে আমি তাঁদের সাথে যোগাযোগ করলাম এবং দূত মাধ্যমে জানালাম যে অসময়ে আমরা কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চাই না। কোনো প্রকার বলপ্রয়োগ ব্যতিরেকেই রাস্তার ব্যারিকেড সরানো সম্ভব হলো। ব্রিগেডিয়ার আরবাব যে এখানে আসবেন সে খবর জনতা আগে জানত না। উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার সশস্ত্র রক্ষীদল নিয়ে জয়দেবপুরে আসার খবর তীরবেগে ছড়িয়ে পড়লো। জনতা মনে করলো, বাঙালিবাহিনীকে নিরস্ত্র করা হচ্ছে। ফলে জয়দেবপুর বাজারের কাছে রেল ক্রসিং-এ তারা প্রথম ব্যারিকেড স্থাপন করলো একটি লম্বা মালগাড়ি লাইনের উপর দাঁড় করিয়ে। তারা ইঞ্জিনটা সরিয়ে ফেললো এবং রেল লাইনের নিচ থেকে স্লিপার সরিয়ে নিল। 

ব্রিগেডিয়ার আরবাব আমাকে পুনরায় বলপূর্বক ব্যারিকেড সরানোর নির্দেশ দিলেন। এটি ছিল আমার জন্য আরেকটি বিরাট পরীক্ষা। ব্রিগেডিয়ার আরবাব তাঁর সঙ্গে ৭০ জন সৈন্য এনেছিলেন এবং প্রত্যেকেরই হাতে ছিল হাল্কা মেশিনগান। আমাকে ব্যারিকেড সরাবার নির্দেশ দিয়ে ব্রিগেডিয়ার আরবাব সাথের রক্ষীসহ আমার সৈন্যবাহিনীর সাথে সাথেই ব্যারিকেডের দিকে অগ্রসর হলেন। রাজবাড়ির সদর দরজা থেকে ব্যারিকেডের দূরত্ব ছিল মাত্র কয়েকশো গজের মতো। আমার বুঝতে বাকি ছিল না যে ব্রিগেডিয়ার আরবাবের রক্ষীরা ব্যারিকেড না উঠালে মেশিনগান দিয়ে গুলি ছুড়তে পিছপা হবে না। আমার জন্য এটা অগ্নিপরীক্ষার শামিল হলো। আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছে মোতালেব ও হাবিবুর রহমানসহ উপস্থিত নেতাদের বাংলায় বললাম “আমি বাঙালি, আমার সাথের সৈন্যরাও বাঙালি। তবে এখানে যে অন্যান্য সৈন্য রয়েছে তারা বিশেষ রণসজ্জায় সজ্জিত, সামান্য উসকানিতে চরম রক্তক্ষয় হতে পারে। আমাদের উপর বিশ্বাস রেখে ব্যারিকেড সরিয়ে নিন।” নেতাদের কথা জনতা মেনে নিল না। আমাদের ব্যাটালিয়ান কমান্ডার লেঃ কঃ মাসুদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার আরাবাব ক্রুদ্ধস্বরে লেঃ কঃ মাসুদকে বললেন, “মইন কেন আপসের কথাবার্তা বলছে?” আরও বললেন, ‘প্রয়োজন হলে তিনি নিজেই সৈন্যবাহিনীর কমান্ড নিবেন।’ এমন সময় জনতার মধ্য থেকে গুলির শব্দ শোনা গেল। সতর্ক করবার জন্য গুলি ছুড়বার পূর্বাভাস হিসেবে আমি আমার কোম্পানির হাবিলদার নূর মোহাম্মদকে মাটির দিকে গুলি ছুড়তে বললাম। ব্রিগেডিয়ার ক্ষিপ্ত হয়ে আমার দিকে চেঁচিয়ে বললেন, “ফায়ার ফর অ্যাফেক্ট।” আমি তাঁর হাবভাব দেখে বুঝতে পারলাম যে, উনি আমাদের আনুগত্য যাচাই করতে এই অবস্থার সৃষ্টি করেছেন এবং আমাকে কোনো সময় দিতে চাচ্ছিলেন না যাতে আমি জনতাকে বুঝিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের সরিয়ে দিতে সক্ষম হই। 

ইতিমধ্যে আরও একটি ঘটনার খবর আসলো। টাঙ্গাইলে আমাদের যে কোম্পানি ছিল তারা একটি তিন টনের ট্রাক জয়দেবপুরে পাঠিয়েছিল। সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে এই ট্রাকটি পাঁচজন সৈন্যসহ জয়দেবপুর বাজারে পৌঁছালে জনতা তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে চারজনকে ধরে নিয়ে যায়। একজন কোনোক্রমে পালিয়ে এসে ঘটনার বিবরণ দেয়। এই পাঁচটি অস্ত্র ছিল এসএমজি। জনতার মধ্য থেকে কম করে একটি অস্ত্র ব্যবহার করবার চেষ্টা চলছিল। জনতার একটি অংশ আমার কোম্পানির পাকিস্তানি সুবেদার মোহাম্মদ আইয়ুবের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে সুবেদার আইয়ুব গুলি চালায়। ব্রিগেডিয়ার আরবাব পুনরায় আমাকে “অ্যাফেক্টের” জন্য গুলি চালাতে বললেন। পরিস্থিতির আরও অবনতি যাতে না ঘটে তার জন্য আমি বাংলায় শূন্যে ও মাটিতে গুলি ছুড়তে বললাম। জনতা ক্রমে ক্রমে সরে গেল। ব্রিগেডিয়ার আরবার ঢাকায় ফিরে গিয়েই লেঃ কঃ মাসুদের কাছে জানতে চাইলেন যে এত গুলি চালানো সত্ত্বেও মাত্র দুজন নিহত হলো কেন? আমি লেঃ কঃ মাসুদ সাহেবকে জানালাম যে আমাকে যদি ঢাকায় সরিয়ে নেয়া হয় তা হলে আমি যাবো না। এবং আমি যে পরিকল্পনা সৈন্যদের মনোভাব জানতে পেরে আপনাকে জানিয়েছি তা বাস্তবায়িত করবো। পরে জানতে পেরেছি জিওসি মেঃ জেঃ খাদেম হোসেন রাজা, আমি যার এ.ডি.সি. ছিলাম। তাঁর বাধাদানের জন্য ব্রিগেডিয়ার আরবাব আমার প্রতি কোনো ‘অ্যাকশন’ নিতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, আমি একসময়ে তাঁর ছাত্রও ছিলাম এবং আমাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক পরিচয় ছিল। 

ঐদিন সন্ধ্যায় জয়দেবপুরে কারফিউ ঘোষণা করা হলো এবং দুটি কোম্পানি ও হেডকোয়ার্টার কোম্পানিসহ কারফিউ রক্ষার জন্য জয়দেবপুর বাজার, চৌরাস্তা এলাকা ইত্যাদি স্থানে মোতায়েন করা হলো। আপাতত: কারফিউ ২১ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ করা হলো। পরিস্থিতির উন্নতি হলে কারফিউ উঠিয়ে নেবার চিন্তা করা হবে। ১৯ মার্চ লেঃ কঃ মাসুদকে জানালাম বিদ্রোহের পক্ষে জে.সি.ও., এন.সি. ও ও সিপাহিদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। ইতিমধ্যে এমপি শামসুল হক (পরে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত), আজিজুল হাকিম মাস্টার, স্থানীয় নেতা হাবিবুল্লাহ ও শ্রমিকনেতা মোতালেব লেঃ কঃ মাসুদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে বসলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৯ মার্চ রাতে আমি যখন কারফিউ এলাকায় কর্মরত ছিলাম তখন এমপি শামসুল হকের (পরে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত) সাথে বাজারে আমার বিস্তারিত আলাপ হয়। আমি তাঁকে ইঙ্গিত দিই যে আমরা দেশবাসীর সাথে রয়েছি। কোন সময় ও কীভাবে কার্যক্রম নেয়া হবে তা আমরা সময়মত জানাবো। খেয়াল রাখবেন যে জনতা যাতে পরিস্থিতির অবনতি না ঘটায়, কেননা এতে পাকিস্তান বাহিনী আমাদের প্রস্তুতির পূর্বেই আঘাত হানতে সমর্থ হবে। 

ব্রিগেডিয়ার আরবাব জয়দেবপুরে এসেছিলেন সৈন্যবাহিনীর অবস্থা দেখতে। তিনি পরিষ্কার ধারণা নিয়ে গেলেন যে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করা সহজ হবে না। পাকিস্তানের মেজর সালেক তার ‘Witness to Surrender’ গ্রন্থের ৭৯ পৃষ্ঠায় এ-কথা উল্লেখ করেছেন। ব্রিগেডিয়ার আরবাব আরও বুঝতে পারলেন যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ সত্ত্বেও বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা জাতিভাই’র প্রতি গুলি চালাবে না। কারফিউ বলবতের নামে আমার ও অন্য চারজন অফিসারের সিপাহি অর্ডারলিদেরও স্টেনগান ও রাইফেল দেয়া হলো। তারা এই স্টেনগান ও রাইফেলসহ বাহিনী পরিত্যাগ করে জনতার সঙ্গে যোগ দেয়। 

টাঙ্গাইলে অবস্থানরত কোম্পানি কমান্ডার অফিসার ছিলেন পাকিস্তানের মেজর কাজেম কামাল। আরেকজন পাকিস্তানি অফিসার ক্যাপ্টেন নোকভি সেখানে কর্মরত ছিলেন। দুজন পাকিস্তানি অফিসার সেখানে থাকা আমরা নিরাপদ মনে করিনি। ক্যাপ্টেন নোকভিকে লেঃ কঃ মাসুদের মাধ্যমে জয়দেবপুরে আসতে বলা হলো এবং বিভিন্ন অজুহাতে তাকে জয়দেবপুরে রাখা হলো। পরিকল্পনা অনুসারে লেঃ মোর্শেদ (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার)কে টাঙ্গাইলে পাঠানো হলো এবং যাওয়ার পূর্বে তার অংশের সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা আমি তাকে জানালাম। 

১৯ মার্চে আমাদের বাহিনীর কার্যকলাপে পাকিস্তানিদের কাছে পরিষ্কার হলো যে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে বিদ্রোহের অবস্থা বিরাজ করছে (‘Witness to Surrender’ দ্রষ্টব্য)। পাকিস্তান বাহিনীর কর্মকর্তারা লেঃ কঃ মাসুদকে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। ২৪ মার্চ আমাদের জানানো হলো যে ব্রিগেডিয়ার এম. আর. মজুমদার, তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টার কমান্ডার, তিনি ২৫ তারিখ সকালে জয়দেবপুরে ব্যাটেলিয়ান দরবার করবেন। তিনি জানালেন যে লেঃ কঃ মাসুদকে সরিয়ে আরেকজন বাঙালি অফিসার লেঃ কঃ রকীবকে নিয়োগ করা হয়েছে। লেঃ কঃ মাসুদকে সরিয়ে নেবার জন্য আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে কেননা তাঁর প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা ছিল। 

দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ প্রস্তুতির দ্রুত সম্পাদন করার প্রয়োজন দেখা দিল। আমি, ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন নাসিম ও ক্যাপ্টেন এজাজ সৈন্যবাহিনী ও সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করছিলাম। নতুন অধিনায়ক লেঃ কঃ রকীব বিদ্রোহের ব্যাপারে কতখানি আগ্রহান্বিত সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না। মেজর মোহাম্মদ সফিউল্লাহ টাঙ্গাইলে না যাওয়ায় অবশ্য প্রস্তুতির সপক্ষে কাজ করবার সুবিধা হয়েছিল। প্রয়োজনীয় সতর্কতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আমরা সার্বক্ষণিক বিশ্বস্ত সৈন্যদের নিয়োগ করেছিলাম। আমরা সতর্কতার সঙ্গে কাজ করেছিলাম এইজন্য যে সদর দফতর ছাড়াও রাজেন্দ্রপুর অমুনিশন ডিপো এলাকায় কিছু পাকিস্তানি সৈন্য ছিল। আমাদের আরেকটি সমস্যা ছিল যে দেশের অন্যত্র যেসব বাঙালি বাহিনী ছিল-যেমন যশোরে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়ান, রংপুরে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং কুমিল্লায় ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট, তাঁরা যে কী করতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারস ঢাকার সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল না, কেননা ব্রিগেড হেকোয়ার্টারস আমাদের ওয়ারলেস সেটের চ্যানেল পরিবর্তন করে দিয়েছিল যাতে আমরা কোনো সংবাদ ‘ইন্টারসেপ্ট’ করতে না পারি। তা ছাড়া ওয়ারলেস সেট চালনা করত পাকিস্তানিরা। নিজেরা না গিয়ে পাকিস্তানি মেজর লতিফ, যার চেহারা বাঙালিদের মতো, তাকে পাঠানো হলো। সাথে গেল বাঙালি ড্রাইভার, যাকে বলে দেওয়া হলো মেজর লতিফ কী করে সেটা ফিরে এসে জানাতে। মেজর লতিফকে এইজন্য পাঠানো হয়েছিল যে বাঙালি ভেবে পাকিস্তানি সৈন্যরা তার সাথে প্রাথমিক ব্যবহার কীরকম করে এবং তার পাকিস্তানি পরিচয় জানবার পর মেজর লতিফ আমাদের সম্পর্কে কী বলেন। আমরা যে শঙ্কা করেছিলাম তাই ঘটলো। টঙ্গীতে পাহারারত পাকিস্তানি সৈন্য তাঁকে বাঙালি ভেবে বন্দুক উঁচিয়ে তাদের কমান্ডারের কাছে নিয়ে যায় এবং মেজর লতিফ আমরা কে কোন ঘরে থাকি তার একটা নকশা পাকিস্তানি কমান্ডারের কাছে দেয়। এসব ঘটনা ড্রাইভারের কাছ থেকে জানতে পারলাম। 

২৮ মার্চে আমরা প্রকাশ্য বিদ্রোহ করে জয়দেবপুর ত্যাগ করবো বলে নির্ধারণ করলাম। আমাদের যে প্লাটুন দুটি অর্ডিনেন্স ফ্যাক্টরি ও রাজেন্দ্রপুর অ্যামুনিশন ডিপোতে ছিল তাদের এবং মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স কনস্টাবুলারির ৭০ জনের মতো বাঙালি সৈন্য ঐ এলাকায় ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হলো। সৈনিকদের পরিবারকে সরিয়ে নেয়ার জন্য ইউনিটের মওলানাকে ভার দেয়া সাব্যস্ত হলো। সিদ্ধান্ত হলো যে পাকিস্তানী অফিসারদের বন্দি করে কোয়ার্টার গার্ডস সেলে রাখা হবে। ঠিক সন্ধে সাড়ে সাতটায় নির্ধারিত স্থানে সমস্ত সৈন্য জড়ো হবে এবং টাঙ্গাইল অভিমুখে যাত্রা করা হবে। গাজীপুর ও রাজেন্দ্রপুরে ক্যাপ্টেন আজিজকে পাঠানো হলো সিদ্ধান্ত জানাতে যে ২৮ মার্চ রাত্রিতে বিস্ফোরক দিয়ে ডিপোর দরজা ভেঙে চাইনিজ রাইফেলগুলো শ্রমিকনেতা মোতালেবের মাধ্যমে জনতার মধ্যে বিতরণ করা হবে। আমাদের উপদেশমতো ২৮ তারিখে সকাল দশটায় নতুন কমান্ডার লেঃ কঃ রকীব দরবারে জানালেন যে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে আমাদের সৈন্যরা ভীষণ চাপের মুখে রয়েছে। ফলে কিছু সৈন্য টাঙ্গাইলে পাঠাতে হচ্ছে। দিনের মধ্যভাগে মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল অভিমুখে চলে গেলেন। সাথে গেলেন ত্রিশজনের মত সৈন্য, কিছু অস্ত্র, একটা ডজ গাড়ি ও জিপ। মেজরদের মধ্যে আমি রয়ে গেলাম পরিকল্পনা অনুসারে অবশিষ্ট তিনশোর অধিক সৈন্য নিয়ে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করতে। 

এ পর্যন্ত আমরা প্রকাশ্যভাবে আদেশ অমান্য করিনি। লেঃ কঃ রকীবের উপর আমরা ভরসা পাচ্ছিলাম না। পরিকল্পনার বিস্তারিত বিষয় নাসিম, আজিজ, এজাজ ও ইব্রাহিমের মধ্যেই সীমিত রাখা হল। ২য় লেঃ ইব্রাহিমকে অ্যাডজুটেন্ট অফিসে বসিয়ে রাখা হলো, অবস্থা যে স্বাভাবিক এরকম একটা ধারণা সৃষ্টি করতে এবং পাকিস্তানী অফিসাররা যাতে টেলিফোন ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে। আমি মূল কোঅর্ডিনেশন করার কাজ হাতে রাখলাম। জয়দেবপুর চৌরাস্তার মোড়ে মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রসহ এক প্লাটুন সৈন্য মোতায়েন করা হলো। দুপুরের দিকে ইউনিটের মওলানার সঙ্গে আমি সৈনিকদের পরিবারকে ছয় মাইল দূরে একটি গ্রামে পাঠিয়ে দিলাম। রসদপত্র, অস্ত্রশস্ত্র ও সৈনিকদের টাঙ্গাইল যাত্রার জন্য আমাদের ইউনিটের গাড়ি ছাড়াও আরও গাড়ির প্রয়োজন ছিল। মেশিনটুলস ফ্যাক্টরির শ্রমিকনেতা মোতালেবের সঙ্গে লেঃ ইব্রাহিমকে যোগাযোগ করতে বলা হলো। মোতালেব ফ্যাক্টরির কয়েকটি ট্রাক ও মাইক্রোবাস জোগাড় করে দিলেন। 

ইতিমধ্যে আমাদের কার্যকলাপে পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যরা বিদ্রোহের আন্দাজ করেছে বলে লেঃ কঃ রকীব জানালেন ও বিদ্রোহের সময় পিছিয়ে দিতে চাইলেন। ইতিমধ্যে আমাদের ময়মনসিংহ কোম্পানি সেখান থেকে জানালো যে ২৭/২৮ মার্চ রাত্রিতে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ময়মনসিংহের ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলসের উপর হামলা চালিয়েছে। লেঃ কঃ রকীবের প্রস্তাব মানা সম্ভব ছিল না কাজেই ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান দুপুরের দিকে গাজীপুর ও রাজেন্দ্রপুরে গিয়ে নায়েব সুবেদার আবদুল মোমেন (শহীদ) যিনি রাজেন্দ্রপুরে ছিলেন এবং সুবেদার চান মিঞা (এখন মৃত) যিনি গাজীপুরে ছিলেন তাদেরকে নির্দেশ দিয়ে আসলেন। পরিকল্পনা অনুসারে গাজীপুর ও রাজেন্দ্রপুরে বিদ্রোহ ঘটলো। গাজীপুর অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করা হলো। জয়দেবপুরে আমাদের নির্দেশমতো সন্ধ্যা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হলো। ক্যাপ্টেন আজিজ একটা প্লাটুন নিয়ে বেরিয়ে চৌরাস্তার মোড়ে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন সম্ভাব্য পাকিস্তানী আক্রমণ রুখতে। অন্ধকারে সৈন্য বাহিনী, পূর্বনির্দেশ অনুসারে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। সাড়ে সাতটার ভেতরে আমাদের সবারই জয়দেবপুর পরিত্যাগ করার কথা। কিন্তু লেঃ কঃ রকিব যাত্রার সময় পিছিয়ে দেবার প্রস্তাবে কিছু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে কিছু সৈন্যের প্রস্তুতিতে বিলম্ব ঘটলো। আমি অনতিবিলম্বে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলাম। অবস্থার আঁচ করে দু’জন পাকিস্তানী সৈন্য তাদের ওয়ারলেস জীপ থেকে আমাদের পাহারারত সৈনিকদের প্রতি গুলি বর্ষন শুরু করলো। ফলে আমাদের সৈন্যরা পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয় এবং পাকসৈন্যদের নিরস্ত্র করা হয়। এ সময়ে অন্ধকারে আমি দেখলাম ক্যাপ্টেন নকভীকে অফিসারদের মেসের উপরতলায় চলে যেতে। আমাদের অধিনায়ক লেঃ কঃ রকিবকে কাছাকাছি দেখলাম না। টংগীতে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্য যে কোন সময় জয়দেবপুর অভিমুখে আসতে পারে বলে মনে করছিলাম। লেঃ কঃ রকিবকে নিয়ে যাবার জন্য জীপসহ সাইদুল হককে নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করতে বলা ছিল। সৈন্যদের প্রতি নির্দেশ ছিল যে আক্রান্ত হলে তারা শ্মশান ঘাটে সমবেত হবে। অন্যথায় বয়েজ হাই স্কুলের ময়দানে জমায়েত হবে। গোলাগুলি শুরু হওয়ায় কিছু সৈন্য শ্মশান ঘাটে জমায়েত হয় এবং আগেই যারা বেরিয়ে এসেছিল তারা স্কুল ময়দানে যায়। দুই স্থানেই সিপাহী পাঠিয়ে যোগাযোগ করে স্থান ত্যাগ করবার সময় আমি ড্রাইভার হাবিলদার সাইদুল হককে দেখে অবাক হলাম। সিদ্ধান্ত অনুসারে তার ছয়টার দিকেই লেঃ কঃ রকিবকে নিয়ে লে যাবার কথা ছিল। সাইদুল জানালো যে উনি আসেননি। ক্যাপ্টেন এজাজ লেঃ কঃ রকিবকে খুঁজলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উনাকে পাওয়া গেল না। পরে শুনেছিলাম যে উনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন। 

আর দেরী করা সম্ভব ছিল না। অতঃপর আমি সাইদুল হকের জীপে উঠে চৌরাস্তা থেকে ক্যাপ্টেন আজিজকে উঠিয়ে নিলাম। সৈন্যবাহিনী ইতিপূর্বেই তাদের সকল অস্ত্রশস্ত্র, ভারী কামান, রসদ, ঔষধ-পত্র, সামরিক বাহিনীর গাড়ী, আর, আর, জীপ, মর্টারস ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। পাকিস্তানের সৈন্যরা যাতে বাধা দিতে না পারে তার জন্য সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র আমাদের পক্ষে সাথে নেওয়া সম্ভব হলো না সেগুলি আমরা ফায়ারিং পিন সরিয়ে নিয়ে অকেজো করে ফেললাম। অনতিবিলম্বে রাজেন্দ্রপুর ও গাজীপুর এর দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈন্য ও ডিফেন্স কনসটাবুলারির ৭০ জন বাঙালী সৈন্যসহ আমরা টাঙ্গাইলের পথে রওয়ানা হলাম। টাঙ্গাইলে পৌঁছে ক্যাপ্টেন মোর্শেদের কাছে জানতে পারলাম যে মেজর শফীউল্লাহ্ ময়মনসিংহে চলে গেছেন। পথে জনসাধারণ জানালো যে আমাদের কিছু সৈন্য মুক্তগাছার দিকে গেছে। এটা আমাদের পরিকল্পনার বাইরে ছিল। মুক্তগাছায় যেয়ে আমরা মেজর শফীউল্লাহকে নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে যাত্রা করলাম। ময়মনসিংহে জমায়েত হয়ে আমরা কমান্ড নিংন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করলাম এবং বাঙালী অফিসারদের মধ্যে মেজর শফীউল্লাহ সবচাইতে সিনিয়র হওয়ায় ব্যাটালিয়ান কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন পর্যায় শুরু হলো। 

সাপ্তাহিক বিচিত্রা, বিজয় দিবস সংখ্যা, ৯০; ১৯ বর্ষ, ৩১ সংখ্যা: ১৪ ডিসেম্বর, ‘৯০; 

হে স্বাধীনতা তোমাকে পাওয়ার জন্য 

স্বাধীনতা রক্তক্ষয় ব্যতিরেকে আসে না। কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় “তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্য আর কতবার তাসতে হবে রক্তগঙ্গায়”। বিনা রক্তক্ষয়ে পৃথিবীতে কোনো স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। নেপোলিয়ান বলতেন (Give me blood I will give you free-dom) আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। তবে এই রক্তক্ষয় সুপরিকল্পিত হতে হবে। লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে, স্থিরচিত্তে এবং সুনিশ্চিত পরিকল্পনার মাধ্যমে রক্তদানের প্রস্তুতি নিতে হবে স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে। পরিকল্পনাহীন চেষ্টায় কেবল অর্থহীন রক্তই ক্ষয় হয়। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সনে যে বিজয় অর্জিত হয় তা এনেছে অনেক রক্তের বিনিময়ে। বাংলাদেশের নবীনদের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ধারণা নেই, তাই স্বাধীনতার মূল্যবোধকে উজ্জীবিত রাখা এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের প্রেরণার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসকে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধকরণ ও সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। 

আজকাল কোনো কোনো মহলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে প্রকৃত দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখার মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের স্বল্পতার জন্যই এ-রকম ঘটছে বলে আমি মনে করি। তাই মুক্তিযুদ্ধের তথ্যনির্ভর ইতিহাস প্রণয়ন করা ও জনসমক্ষে তুলে ধরা প্রয়োজন। 

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্রবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসার ও অন্যান্য সদস্য, যথা সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসারবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং পাশাপাশি তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকদের নিয়ে সংগঠন গড়ে তোলা এবং অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদসামগ্রী জোগাড় করবারও পদক্ষেপ নেয়। সশস্ত্র বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসার সময় আমাদের নিয়মিত বাহিনীকে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয় তাতে আমাদের অনেক বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো নষ্ট হয়। তবে জয়দেবপুরে অবস্থানত সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরিকল্পিত ও অক্ষত অবস্থায় আনতে পেরেছিল। কুমিল্লায় অবস্থানরত ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল, রংপুরে ৩য় বেঙ্গল ও চট্টগ্রামে অবস্থিত ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মোটামুটি ভালো অবস্থায় ছিল। কিন্তু যশোরে অবস্থিত ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেকেই বিদ্রোহকালে শহীদ ও গ্রেফতার হন। এ রেজিমেন্টকে নতুন করে সংগঠিত করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এ ছাড়া বিডিআর, পুলিশ ও আনসারবাহিনীর যাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ এড়িয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, তাঁদের সকলকে মুক্তিযুদ্ধের নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডভুক্ত করে পাকিস্তানের সুসজ্জিত ও ব্যাপক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মোকাবেলা করবার জন্য শৃঙ্খলাবদ্ধ করা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল। এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, পরিকল্পনায় সৈন্য পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ সহজ মনে হয়, কিন্তু বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ দুঃস্বপ্নের মতো। 

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে আমাদের রসদ, গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের কোনো নিয়মিত ব্যবস্থা ছিল না। আমরা যে-সমস্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম তা নিয়মিত দীর্ঘযুদ্ধের জন্য অপর্যাপ্ত ছিল। তাই প্রথম পর্যায়ে অস্ত্রসংগ্রহের জন্য উদ্যোগ নেয়া ছিল অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়া ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণের জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে রণকৌশলের জন্য আমরা ‘সেট পিস’ (Set Piece) যুদ্ধ পরিহার করতে চেষ্টা করি। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের জন্য আমরা স্বাভাবিকভাবেই মূলত গেরিলা পদ্ধতির আশ্রয় নিই। এর উদ্দেশ্য ছিল শত্রুবাহিনীর মনোবল ভেঙে ফেলা ও সরবরাহব্যবস্থা বিনষ্ট করা। গত ভিয়েতনাম যুদ্ধে গেরিলা-পদ্ধতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মিত বাহিনীর ৬ লক্ষ সৈন্যকে নাজেহাল করে মনোবল ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের মনোবল ক্রমে ক্রমে এমনই ভেঙে পড়ে যে ভিয়েতনামের মুক্তিবাহিনী তাদেরকে ছোট ছোট সম্মুখসমরে পরাজিত করে এবং অবশেষে মার্কিন সৈন্যরা হটে যেতে বাধ্য হয়। পরে চূড়ান্ত পর্যায়ে ভিয়েতনামের নিয়মিত বাহিনী সায়গন দখল করে নেয়। 

স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে প্রাথমিক পর্যায়ের পর আমরা পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে মোকাবেলার জন্য প্রচলিত ছোট ছোট ‘সেট পিস’ (Set piece) যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। আমি দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে ময়মনসিংহ পরে সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করি। সমস্ত যুদ্ধকালীন সময়ে তেলিয়াপাড়ার আশপাশে দ্বিতীয় বেঙ্গলের মূল ছাউনি ছিল। আমি জুন মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত নিয়মিত বাহিনীর কিছু অংশ নিয়ে মুকুন্দপুর, হরসপুর ও মনতলা এলাকায় সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইওয়েতে পাকিস্তান বাহিনীকে পর্যুদস্ত ও যোগাযোগব্যবস্থা নষ্ট করায় নিয়োজিত ছিলাম। তদানীন্তন সংসদ সদস্য কর্নেল (অবঃ) রব ১২ জুন হরসপুরে এসে আমাকে জানালেন যে মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল (অবঃ) ওসমানী আমাকে সত্ত্বর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কলকাতায় যেতে বলেছেন। তিনি আমাকে আরও জানালেন যে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসা ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। মাত্র একজন অফিসার ক্যাপ্টেন হাফিজ একশো পঞ্চাশ জনের মতো সৈন্য নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। ১ম রেজিমেন্টকে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য আরও লোকবল ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে যে নয়জন তৎকালীন মেজরকে কেন্দ্র করে নিয়মিত মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে তাঁরা হচ্ছেন মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সফিউল্লা, মেজর মীর শওকত আলী, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর ওসমান চৌধুরী, মেজর নাজমুল হক, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর সাফাত জামিল এবং মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। এরপর আগস্ট মাসে তিনজন মেজর পাকিস্তান বাহিনী ত্যাগ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। তাঁরা ছিলেন মেজর মঞ্জুর, মেজর তাহের ও মেজর জিয়াউদ্দিন। উক্ত অফিসারবৃন্দের তৎকালীন এবং বর্তমান অবস্থানের একটি তালিকা সংযুক্ত করা হলো : 

তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্তব্যরত এই বারোজন মেজরই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন 

১। মেজর জিয়াউর রহমান (পরে লেঃ জেনারেল) – ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট – প্রয়াত রাষ্ট্রপতি 

২। মেজর শফিউল্লাহ (পরে মেজর জেনারেল) – ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট -অবসরপ্রাপ্ত (বর্তমানে রাষ্ট্রদূত) 

৩। মেজর মীর শওকত আলী (পরে লেঃ জেনারেল) – ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট অবসরপ্রাপ্ত – (বর্তমানে এমপি)

৪। মেজর খালেদ মোশাররফ (পরে মেজর জেনারেল) – ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট – প্রয়াত 

৫। মেজর ওসমান চৌধুরী (পরে লেঃ কর্নেল) – ইপিআর – অবসরপ্রাপ্ত 

৬। মেজর নাজমুল হক, আর্টিলারি ইপিআর – শহীদ

৭। মেজর নূরুল ইসরাম (পরে মেজর জেনারেল) – ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট  – অবসরপ্রাপ্ত 

৮। মেজর সাফাত জামিল (পরে কর্নেল) ৪র্থ বেঙ্গল – অবসরপ্রাপ্ত 

৯। মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী – (বর্তমানে মেজর জেনারেল) – বর্তমানে রাষ্ট্রদূত (ডেপুটেশনে) 

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে ১৯৭১-এর আগস্ট মাসে যে তিনজন মেজর যোগ দেন : 

১০। মেজর মঞ্জুর (পরে মেজর জেনারেল) – প্রয়াত

১১। মেজর তাহের (পরে কর্নেল) – প্রয়াত

১২। মেজর জিয়াউদ্দিীন (পরে লেঃ কর্নেল) – অবসরপ্রাপ্ত

মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবসরপ্রাপ্ত ছুটি ভোগের সময় স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেন। পরে সামরিক বাহিনী থেকে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। 

এই বারোজনের সঙ্গে অফিসার পর্যায়ে ছিলেন আরো অনেক ক্যাপ্টেন ও লেফটেন্যান্ট। তাঁরাও মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করার জন্য বিশেষ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মেজর ও ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীতে কয়েকজন বাঙালি লেঃ কর্নেল পর্যায়ের অফিসারও ছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন কারণে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগদান করতে সক্ষম হননি। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রারম্ভেই নিয়মিত ব্যাটালিয়ান তৈরি করা, প্রশিক্ষণ দেয়া, সেক্টর ভাগ করা ইত্যাদি প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অভিজ্ঞতার জন্য আমাকে ও শাফাত জামিলকে সেক্টর কমান্ডে না রেখে দুটি নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডে শত্রুর সরাসরি মোকাবেলার জন্য অগ্রগামী অবস্থানে রাখা হয়। আমাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তাঞ্চল গঠন করা ও সেগুলি আয়ত্তাধীন রাখা। ফলে আমাকে কয়েকবার পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করতে হয়েছিল। 

পূর্বে বলেছি যে জুন মাসের দিকে আমাকে যশোর থেকে আগত প্ৰথম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সংগঠিত করবার ভার দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পাকিস্তান আমলে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার একসময়ে ছিলেন কর্নেল ওসমানী। এই বাহিনীর প্রতি তাঁর যথেষ্ট দুর্বলতা ছিল। আমি কোনো সময় প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলাম না। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীর ইচ্ছায় ও মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থে আমি প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ড গ্রহণ করতে রাজি হলাম। 

জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসার সময় আমরা যাবতীয় ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ফেলে এসেছিলাম। শুধু অস্ত্র, গোলাবারুদ, সামরিক যানবাহন ও সামরিক পোশাক নিয়ে বেরিয়ে আসি। তাই আমার সাথে বেসামরিক কোনো পোশাক ছিল না। কর্নেল ওসমানীর সাথে দেখা করবার জন্য আমাকে ভারতের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ভারতের মধ্য দিয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য কর্নেল রব আমাকে বেসামরিক কাপড় ও আগরতলা থেকে কলকাতায় যাবার জন্য দিলেন প্লেনের টিকেট। আমি ‘মেজর ব্যানার্জি’ এই ছদ্মনামের টিকেটে কলকাতায় আসলাম। সেখানে জাকির খান চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রাক্তন উপদেষ্টা ও মন্ত্রী, একটা বুশ শার্ট, ট্রাউজার ও জুতা কলকাতার নিউমার্কেট থেকে কিনে দিলেন এবং হাতে ৫০টি ভারতীয় মুদ্রা দিলেন। স্মৃতি হিসেবে এই শার্ট ও ট্রাউজারটি আমি এখনও রেখে দিয়েছি। 

১৩ জুন রাতে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে যুদ্ধ ও কৌশলাদি সম্পর্কে আলোচনা হলো। আমি পূর্বাঞ্চলের সুবিধা ও অসুবিধার কথা বললাম। আমাদের প্রস্তুতির পর্যায়ও জানালাম। কর্নেল ওসমানী বললেন যে, প্রথম রেজিমেন্টকে গঠন করা হয়েছে এবং উক্ত রেজিমেন্টের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার জন্য ভাবনাচিন্তা করে আমাকে ভার দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বললেন যে, মেজর শাফাত জামিলকে ৩য় ও ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) আমিনকে ৪র্থ রেজিমেন্টের ভার দেয়া হয়েছে। এই তিনটি রেজিমেন্ট নিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের কমান্ডে জেড ফোর্স গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আলোচনার সময়ে মুক্তিবাহিনী প্রধানকে আমি আমার মতামত জানালাম যে, সুসজ্জিত পাকিস্তান বাহিনীর মোকাবেলায় আমাদের এখনও সরাসরি সংঘর্ষে অবতীর্ণ হওয়ার সময় আসেনি। কেননা আমাদের বাহিনীতে অনেক নতুন সদস্য আছে যারা এখনও সম্মুখযুদ্ধে অভিজ্ঞ নয়। এমতাবস্থায় সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হলে আমাদের লোকক্ষয় ও মনোবল ভেঙে পড়তে পারে। 

আমি কলকাতা থেকে গৌহাটি হয়ে আসামের গারো পাহাড়ের সীমান্ত অঞ্চলে আসলাম। আমার সৈন্যদের অবস্থান ছিল মানকা চরের নিকটবর্তী তেলতালা এলাকার গভীর জঙ্গলে। প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম রেজিমেন্ট নিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের কমান্ডে জেড ফোর্সের সংগঠন ও প্রশিক্ষণ শুরু হলো। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টে অফিসারদের মধ্যে ছিলেন লেফটেন্যান্ট মান্নান, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন হাফিজ, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন ও ফ্লাইট লেঃ লিয়াকত। অফিসারসহ এই বাহিনীর মোট সদস্যসংখ্যা ছিল ৮৫০ যার মধ্যে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার, শ্রমিক ও ছাত্ররাও ছিলেন। আমি ১৭ জুন থেকে সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষণ আরম্ভ করলাম। বিভিন্ন অস্ত্রচালনা থেকে শুরু করে সত্যিকার গোলাগুলির (Live Firing) মধ্যে অগ্রসর হবার প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা হলো। 

আমরা ছিলাম এক গহিন জঙ্গলে যেখানে সরবরাহ ছিল অত্যন্ত দুরূহ। আমাদের অবস্থান থেকে সবচাইতে নিকটবর্তী শহর ছিল ‘তুরা’ যার দূরত্ব ছিল প্রায় ৩০ কিলোমিটার। নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চল ছিল আমাদের খাদ্যক্রয়ের স্থান। অন্যান্য রসদপত্র ও সামগ্রী তুরা শহর থেকে সংগ্রহ করা হতো। এই অঞ্চলে ভারতীয় 101 Communication Zone কমান্ড করতেন মেজর জেনারেল গুরবত সিং গিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি গুরুতররূপে আহত হন। তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। সমস্ত বাধা বিপত্তির মধ্যেও গারোপাহাড়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আমরা প্রশিক্ষণ পূর্ণ উদ্যমে চালিয়ে যাচ্ছিলাম। 

জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মেজর জিয়া আমাকে বললেন যে, পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি কামালপুর সম্মুখ যুদ্ধ করে দখল করতে হবে এবং ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে যুদ্ধে যেতে হবে। আমি তাঁকে বললাম যে, এ পর্যায়ে বড় আকারে Set Piece যুদ্ধে আমাদের যাওয়া ঠিক হবে না। আরও অধিক যুদ্ধ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমরা যেভাবে হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে ছোট ছোট দল দিয়ে আক্রমণ করছি এটা আরও কিছুদিন চালিয়ে যেতে হবে। আমি আরও বললাম যে, কোম্পানির (৯৫০ জন সম্মিলিত) শক্তির উর্ধ্বে Set Piece আক্রমণে যাওয়া এই পর্যায়ে আত্মঘাতি হবে। পুরো ব্যাটালিয়নকে অধিক সজ্জিত পাকিস্তানী ব্যাটালিয়ানের সামনে পাঠানো ঠিক হবে না। এতে সমগ্র ব্যাটালিয়ানের যুদ্ধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আমার যুক্তি মেজর জিয়া গ্রহণ করলেন বলে মনে হল না। কোম্পানী পর্যায়ের আক্রমণের নেতৃত্ব দেয় কোম্পানী অধিনায়ক। কোম্পানী পর্যায়ের উর্ধ্বে আক্রমণ না করার কথা বলায় আমার মনে হল যে মেজর জিয়া হয়তো ভাবতে পারেন আমি নিজে আক্রমনের নেতৃত্বে দিতে চাই না। কেননা ব্রাটালিয়ান পর্যায়ে যুদ্ধ করলে অবশ্যই আমাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। আমাদের প্রস্তুতি পর্যায়ে ও যুদ্ধের কলাকৌশল বিবেচনা করেই আমি এ কথা বলেছিলাম। যা হউক আমি আমার উচ্চ কমান্ডের নির্দেশ মেনে নিলাম। 

কামালপুরে পাকিস্তান সৈন্য বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ও ই পি এ এ এফ (ইষ্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স) এর দুই প্লাটুন এই ঘাঁটিতে ছিল। এই ঘাঁটিটি সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এই স্থানটি জামালপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকার যোগাযোগ সড়কের উপর অবস্থিত ছিল। আক্রমণ প্রস্তুতির অংগ হিসাবে রেকি (Recommaissance) করবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। সুযোগ বুঝে এই কাজ করবার জন্য ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও লেঃ মান্নানের নেতৃত্বে ছয় জন সৈন্য সহ একটি দল ঘঠন করা হলো। আক্রমণের দিক নির্ণয়, বাংকারের অবস্থান, কতজন সৈন্য থাকতে পারে, কি জাতীয় অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার হতে পারে, কোথাও মাইনফিল্ড ও অন্যান্য বাধাবিপত্তি আছে কিনা ইত্যাদি বিষয় জানাই লি উক্ত রেকির উদ্দেশ্য। কয়েকদিন ধরেই এই সমস্ত প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। আক্রমনের তিন দিন আগে আমাদের রেকি দলটি পাকবাহিনীর ক্লোজ-আপ নেবার জন্য খুব কাছে আসে এবং অন্ধকারে ঘাঁটি এলাকার ভিতরে ঢুকে পড়ে। এই সময় একটি পাকিস্তানী পাহারাদার সৈন্যের সামনা সামনি পড়ে যাওয়ায় তাকে আক্রমণ করে রেকি বাহিনী মেরে ফেলে ও তার রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে চলে আসে। 

এরকম একটা ঘটনা ঘটবে তা আমি চাইনি। কেননা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ অতর্কিতে পাকিস্তান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানো। এই ঘটনার ফলে পাকিস্তান সৈন্যরা নিকটেই আমাদের অবস্থানের আভাস পায় এবং অতর্কিত আক্রমনের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে সতর্ক হয় ও প্রস্তুতি নিতে সুযোগ পায়। রেকি করবার পরে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও লেঃ মান্নান আক্রমনের পক্ষে মতামত দেন। এরপর আমরা দীর্ঘ বৈঠকে সকল সম্ভবতার কথা আলোচনা করি ও আক্রমনের বিস্তারিত পরিকল্পনাপ্রনয়ণ করি। বৈঠক কালে মাটির উপর এলাকার একটি মানচিত্র প্রণয়ন করা হয়, ঘাঁটি আক্রমনের অংশগুলি চিহ্নিত করা হয় এবং রাত সাড়ে তিন ঘটিকা, ৩১ জুলাই অভিযানের সময় ও তারিখ নির্ণয় করা হয়। 

পূর্ব নির্দ্ধারিত আক্রমনের রাত্রে মেজর জিয়া সহ ব্যাটালিয়ন নিয়ে আমাদের আস্তানা ছেড়ে পাকিস্তানী অবস্থানের দিকে যাত্রা করি এবং রাত্রি দুইটার দিকে পাকিস্তানি ঘাঁটি থেকে এগার/বারশো গজ দূরে বাঁশ ঝাড় ও ঝোপের ভিতরে একত্রিত হই। আক্রমণে অগ্রসর হবার পূর্বে আমরা সেখানে পরিকল্পনা চুড়ান্ত করে নেই। প্রস্তুতিপর্ব ৩০/৪০ মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ করা হয়। এখান থেকে একটি কোম্পানী ক্যাপ্টেন মাহবুব (শহীদ)-এর নেতৃত্বে শত্রু কোম্পানীর পিছনে ডানদিকে প্রায় ৮০০ গজ দূরে অবস্থান নিয়ে আমার আদেশের অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়। অন্য দুটি কোম্পানি যথাক্রমে ক্যাপ্টেন হাফিজ ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন-এর নেতৃত্বে ছয়শো গজের মতো এগিয়ে গিয়ে একটি কেটে নেয়া পাট-ক্ষেতের মধ্যে অবস্থান নিতে নির্দেশ দিলাম। ফ্লাইট লেঃ লিয়াকত, লেঃ মান্নান ও আমার ওয়ারলেস অপারেটরসহ আমি তাদের সঙ্গে একই স্থানে অবস্থান নিলাম। এদিকে বৃষ্টি হওয়ার জন্য পাটক্ষেতের মধ্যে প্রায় এক ফুটের মতো পানি জমে ছিল। এই প্রাকৃতিক ঘটনাটি আক্রমণের বিশেষ ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। এই মুহূর্তে আক্রমণ স্থগিত রাখারও কোনো উপায় ছিল না। কেননা পূর্ব ব্যবস্থা অনুসারে আমাদের অবস্থান নেবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাহাড়ে বসানো হালকা কামানের গোলাবর্ষণ শুরু হলো। সঙ্গে সঙ্গে শত্রু বাহিনীও তাদের কামানের গুলিবর্ষণ আরম্ভ করলো। এতে আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে, তারা আমাদের আক্রমণ প্রতিহতের জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। একথাও বোঝা গেল যে তারা ইতিমধ্যে সৈন্যসংখ্যা ও গোলাবর্ষণক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। এতৎসত্ত্বেও আমি আমার সৈন্যদের অগ্রসর হবার জন্য নির্দেশ দিলাম। তখন রাত্রি প্রায় সাড়ে তিনটা। দুটি কোম্পানির একটি ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন ও আরেকটি ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে শত্রুর ঘাঁটির দিকে দ্রুতবেগে বীর বিক্রমে অগ্রসর হল। সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে দুই প্লাটুনের মতো সৈন্য সুরক্ষিত শত্রুঘাঁটিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। যত সময় যেতে লাগলো শত্রুর গোলাগুলির মাত্রা ততই বেড়ে চললো। আমি দেখতে পেলাম যে, আমাদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। এদিকে কামালপুরে শত্রুব্যূহের মধ্যে হাতাহাতি এমনকি বেয়নেটের ব্যবহারও শুরু হল। 

আমি আমাদের আক্রমণরত সেনাবাহিনীকে নির্দেশ প্রদান ও সমন্বয় রক্ষা করবার জন্য নিকটস্থ একটি ছোট গাছের আড়াল থেকে বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করছিলাম। এই সময় একজন আহত সৈন্য আমাকে জানায় যে, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন শত্রু-ঘাঁটির ভিতরে শাহাদত বরণ করেছেন এবং তাঁর সাথে অনেক সৈন্যও হতাহত হয়েছেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, সালাউদ্দীনের কোম্পানির আর বিশেষ যুদ্ধক্ষমতা নেই। তাই আমি বেতার মাধ্যমে ক্যাপ্টেন মাহবুব, যাকে শত্রুঘাঁটির ডানদিকে পিছনে আমার আদেশের অপেক্ষায় থাকতে বলেছিলাম, তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলতে চেষ্টা করলাম যে সে যেন এখন তার দিক থেকে শত্রুঘাঁটির উপর আক্রমণ আরম্ভ করে। 

কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর না পাওয়ায় আমি ওয়ারলেস অপারেটরকে নিয়ে একটু খোলাস্থানে সরে গিয়ে আবার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করলাম। এই সময় আমার ওয়ারলেস অপারেটর মেশিনগানের একঝাঁক গুলিতে শাহাদত বরণ করে এবং ওয়ারলেস সেট অকেজো হয়ে যায়। আমি পুনরায় গাছের আড়ালে এসে চিৎকার করে আদেশ দিতে থাকলাম। ইতিমধ্যে চারদিকে ভোরের আলো ফুটে উঠলো। একটু দূরে দেখি ক্যাপ্টেন হাফিজও আহত হয়ে পড়ে রয়েছেন। আমি উপায়ান্তর না দেখে ফ্লাইট লেঃ লিয়াকত ও অন্যান্য আহত সৈনিকদের উদ্ধারকাজ আরম্ভ করার জন্য নির্দেশ দিলাম। শত্রুদের গোলাগুলির তীব্রতা পূর্ণভাবে চলছিল। এই সময় মেজর জিয়া এসে আমার সাথে যোগ দিলেন। লেঃ মান্নানও আহত অবস্থায় আমার নিকটে আসলেন এবং জানালেন যে, চারদিকে আমাদের অনেক আহত সৈন্য পড়ে রয়েছে। আমরা সকলে গোলাগুলি বর্ষণের মধ্যেই আহতদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে শুরু করলাম। শত্রুর জনবল, অস্ত্রবল ও পাকা বাংকারে অবস্থানের ফলে আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণ ও অনেক প্রাণের বিনিময় সত্ত্বেও শত্রুকে পরাজিত করে ঘাঁটিটি নিজ দখলে আনা সম্ভব হয়নি। 

বীরের মতো যুদ্ধ করে আমাদের অমিতবিক্রমী যোদ্ধাদের অনেকেই একে একে শাহাদত বরণ করেন। যুদ্ধশেষে দেখা যায় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনসহ বাংলার অকুতোভয় ৩৫ জন দামাল সন্তান মাতৃভূমির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন এবং ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লেঃ মান্নানসহ আরও ৫৭ জন আহত হয়েছন। 

পাকিস্তানের মেজর সালেক তাঁর ‘Witness to Surrender’ গ্রন্থে দাবি করেছেন যে এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ২০০ সৈন্য মারা যায়। এতেই এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও রক্তক্ষয় সম্পর্কে ধারণা করা যায় এবং শত্রুপক্ষেরও ক্ষয়ক্ষতির আভাস পাওয়া যায়। আহতদের নিয়ে আস্তানায় ফিরে আসার সময় দুটি পাকিস্তানি হেলিকপ্টারকে সম্ভবত তাদের যুদ্ধে মৃত ও আহত সৈন্যদের নেবার জন্য আসা যাওয়া করতে দেখলাম। পরের দিন ভারতীয় আর্মি প্রধন জেনারেল মানিকশ হেলিকপ্টারযোগে জেডফোর্স হেডকোয়ার্টার্সে আসেন এবং আমাদের সাহসিকতার বিশেষ প্রশংসা করেন। তিনি একপর্যায়ে বলেন যে, পাকিস্তানের মতো সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধারা যে এরকম সাহিসিকতার সাথে সম্মুখযুদ্ধ করতে পারেন তা তিনি ভাবতে পারেননি। 

এই ঘটনাটি আমি এইজন্য উল্লেখ করতে চাই যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে কেবল বিজয়ের ঘটনাই উল্লেখ করার প্রবণতা দেখা যায়। আমার মতে এতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের প্রতিফলন হয় না। কোনো একটি বিশেষ সংঘর্ষে পরাজিত হওয়ার অর্থ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরাজিত হওয়া নয়। প্রতিটি সংঘর্ষের মূল্যায়ন এই দৃষ্টিকোণ থেকে করতে হবে যে, আমাদের যোদ্ধারা কী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, কর্তব্যে কতটা নিষ্ঠা নিয়ে সাহস, মনোবল ও স্বাধীনতায় কতটুকু বিশ্বাস রেখে অনিশ্চয়তার পথে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। 

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে এটিই ছিল সুপরিকল্পিত উল্লেখযোগ্য সম্মুখযুদ্ধ। এই অভিযানটি আমাদের জন্য যুদ্ধের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা প্রদান করে এবং শত্রুকে সরাসরি আক্রমণ করতে প্রেরণা যোগায়। এই যুদ্ধে আমাদের সৈন্যরা যে বীরত্ব প্রদর্শন করেন এবং হাসিমুখে স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়ে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ দিন যে অবিশ্বাস্য আত্মদানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তারই নীরব সাক্ষী জামালপুরের উত্তরে ছোট্ট গ্রাম কামালপুর। 

সাপ্তাহিক বিচিত্রা, বিজয় দিবস সংখ্যা ১৯ বর্ষ, ৪৬ সংখ্যা, ২৯ মার্চ ৯১। 

রক্ত, স্বাধীনতা ও ইতিহাস 

জুন ১৯৭১। রাজশাহীর সীমান্তবর্তী রোহনপুর আর্মি ক্যাম্প। হাতবাঁধা এক কিশোরকে পাকবাহিনীর এক মেজরের সামনে আনা হল। তার চোখ-মুখ ফোলা, জায়গায় জায়গায় আঘাতের দাগ এবং নির্যাতনের চিহ্ন সুস্পষ্ট। মেজর সাহেবকে জানানো হল যে গত কয়েকদিন বহু চেষ্টা সত্ত্বেও এই ‘মাক্ষিটা’ (পাকিস্তানিরা স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে থেকেই বাঙালিদের মাছি ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে মজা পেত) কিছুতেই মুখ খুলছে না। মেজর যেন একবার শেষ চেষ্টা করে দেখেন। ভীতি প্রদর্শন এবং নির্যাতনেও কাজ হয়নি দেখে মেজর নতুন কৌশল প্রয়োগ করার প্রায়াসে তাকে সহানুভূতিসূচক গলায় বললেন যে সময়ে তার মা-বাবার কাছে থাকার কথা, সে-সময় কতগুলি বদমাশ লোকের প্ররোচনায় বিপথগামী হয়ে সে তার ‘মুসলমান ভাইদের’ বিরুদ্ধে লড়ছে। এদের অবস্থান সম্পর্কে যদি সে খোঁজ দেয় তবে তিনি নিজে তার বাড়ি ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। একথার পর সে কিশোর দুহাতে মাটিকে আলিঙ্গন করে সেই হাত ঠোঁটে স্পর্শ করল। তারপর উঠে শান্ত স্বরে বলল–‘আমি এখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আমার রক্ত নিশ্চয়ই পবিত্র মাতৃভূমির স্বাধীনতাকে আরো কাছে নিয়ে আসবে।’ ছেলেটিকে এরপর বাইরে নিয়ে যাওয়া হল এবং কিছুক্ষণ পরে একঝাঁক গুলির শব্দ শোনা গেল। 

এটা কোনো কাল্পনিক ঘটনার বর্ণনা নয়। আবেগআক্রান্ত কোনো বাঙালির লেখা মুক্তিবাহিনীর প্রশংসার গল্প নয়। পাকিস্তান বাহিনীর সংবাদ সংযোগ অফিসার, মেজর সালেক স্বভাবসিদ্ধ নিয়মে বাঙালির বহু বীরত্বগাথা চেপে গেলেও উপরোক্ত ঘটনা বোধ করি তাঁর দোষভারাক্রান্ত কলমের অজান্তেই এসে তার বইয়ে স্থান পেয়েছিল। অবশ্য শেষরক্ষা তিনি করেছেন— গুলির আওয়াজ উহ্য রেখেছেন। 

এই মৃত্যু বীরের মৃত্যু। এ তো জীবনভিক্ষা নাকচ হওয়া, কুঁকড়ে পড়ে থাকা মৃত্যু নয় বা অতর্কিত গুলি লেগে লুটিয়ে পড়া মৃত্যুও নয়, স্থিরচিত্তে, কাপুরুষতা পায়ে ঠেলে, আদর্শের ঝাণ্ডা সমুন্নত রেখে মৃত্যুকে নির্ভীক আলিঙ্গন। এ মৃত্যু তাই অনন্য, অম্লান। 

কী মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিল এ কিশোর যে মন্ত্রাদর্শে বলীয়ান হয়ে জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য ভাবতে বুকে এতটুকুও কাঁপন ধরেনি তার? এই মন্ত্রই ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্পৃহা জাগরূক রাখার পেছনের প্রধান শক্তি। এ মন্ত্র হচ্ছে আপন ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের প্রতি বাঙালির সহজাত বিশ্বাস। তাই জীবন-মৃত্যু সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কর্তব্য নির্ধারণে কোনো সংশয়ের দোলাই তার মনে জাগেনি। বাঙালি মানসের সবচেয়ে বড় সম্পদের মধ্যে একটি হচ্ছে এই বিশ্বাস। যুগ যুগ ধরে এ বিশ্বাস তাকে যুগিয়েছে সংগ্রামী প্রেরণা অন্যায়ের সঙ্গে যুঝবার মনোবল। স্মরণাতীতকালের কথা বাদ দিয়ে তাই শুধু ইংরেজ এবং পাকিস্তান আমলেই এর একটা খতিয়ান নিয়ে দেখা যাক। 

ইংরেজরা ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানে নিশ্চিন্তে রাজত্ব করে গেলেও এই বাংলার মাটিতে প্রতিনিয়ত বাধা পেয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সংগঠিত বিদ্রোহের বীজ এই পাবনা-রংপুরের ক্ষেতমজুরেরাই সর্বপ্রথম রোপন করে গেছে। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্যান্য ভারতীয় রেজিমেন্টে বিদ্রোহ বিক্ষিপ্তভাবে হলেও, ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে প্রত্যেকটি বাঙালি রেজিমেন্টে বিদ্রোহ হয়েছে। বাংলার সন্ত্রাসবাদী দল ব্রিটিশ রাজার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। প্রাণের ভাষায় কথা বলার আন্দোলনে নির্ভীক আত্মত্যাগ এদেশেই ঘটেছে। দেখা গেছে ঐ কিশোরের মতো হাজার হাজার প্রাণের প্রত্যক্ষ এবং সুমহান আত্মদান। এই আত্মদান যদি সংশয়মুক্ত না হত বা কোনো বিক্ষিপ্ত বা খণ্ডিত ঘটনা হত, বা পরোক্ষ আত্মদান হতো, তব ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের ধারা নিঃসন্দেহে অন্য খাতে প্রবাহিত হতো। 

আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ তুলনামূলক বিচারে স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল সত্য, তাই বলে পৃথিবীর অন্যান্য স্বাধীনতাযুদ্ধের তুলনায় কম রক্তক্ষয়ী হয়নি। এর প্রধান কারণ হিসেবে আগেই বলা হয়েছে যে মুক্তিবাহিনীতে যারা যোগ দিয়েছিল, তারা অবস্থার প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে নয় বরং স্বেচ্ছায় আদর্শ ও দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করেই যোগ দিয়েছিল। আজ পেছনে দৃষ্টিপাত করে এও সত্য বলে প্রতীয়মান হয় যে এই প্রচুর রক্তক্ষরণ, এই তুলনাবিহীন আত্মত্যাগ হানাদার বাহিনীর মনোবল গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল এবং তাদের কথিত ‘মাছির’ হাতে তাদের লজ্জাকর পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। এই রক্তক্ষরণ না হলে তাদের ইংরেজ-ভূষিত ‘জাতযোদ্ধার’ শ্রেষ্ঠত্ব ১৬ ডিসেম্বর চিরতরে রমনার রেসকোর্স ময়দানে কবরস্থ হতো না। এবং অন্যদিকে এও আজ বিচারসাপেক্ষ যে মুক্তিবাহিনী নিষ্ঠা এবং ত্যাগের এই অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন না করলে মিত্রবাহিনী আমাদের সাহায্যে করে এবং কতটুকু এগিয়ে আসত? 

মুক্তিযুদ্ধের দুই-একটা বিবরণ তুলে ধরা বোধহয় প্রয়োজন, যেখানে মুক্তিবাহিনীর জয় এবং পরাজয় দুটোরই দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। 

জামালপুরের উত্তরে অবস্থিত ছোট একটি গ্রাম নাম কামালপুর, এইখানে মুক্তিবাহিনীর অবিশ্বাস্য আত্মদানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল জুলাই মাসের শেষ দিনটিতে। কামালপুরে শক্ত ঘাঁটি গেড়েছিল শত্রুরা। রাত তিনটার সময় মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে। কিন্তু শত্রুর অস্ত্রবল এবং জনবলের দরুন সেই আক্রমণ ও অগ্রযাত্রা সুসংহত করা সম্ভব হয়নি অনেক প্রাণের বিনিময়েও। বীরের মতো যুদ্ধ করে আমাদের অমিতবিক্রমী যোদ্ধারা একে একে মৃত্যুবরণ করতে থাকেন। যুদ্ধশেষে দেখা যায় বাংলার অকুতোভয় ৩৫ জন দামাল সন্তান মাতৃভূমির সম্মানে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এবং ৫৭ জন আহত হয়েছেন। 

আবার ৩০ নভেম্বর তার ঠিক উল্টোটা ঘটে। আখাউড়া সীমান্তের ঘাঁটিদখলের যুদ্ধ দুইদিন স্থায়ী হয় এবং সে যুদ্ধে আমাদের বীর সন্তানরা উপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়। যুদ্ধশেষে দেখা যায় আখাউড়া থেকে ঢাকা আসার পথ প্রায় উন্মুক্ত এবং সেখান থেকে শুরু হয় হানাদার বাহিনীর পশ্চাদপসরণ এবং মুক্তিবাহিনীর বিজয়গৌরবে ঢাকার পথে অগ্রযাত্রা, এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বীরযোদ্ধারা ১২ জন হানাদারকে খতম করা ছাড়াও ৩ জনকে বন্দি করতে সক্ষম হয়। 

এ দুটো যুদ্ধের বর্ণনা প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে এই ঘটনা কোনো মেজর সালেকের বইয়ে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি বা ডি কে পালিত বা সুব্রামনিয়াম এর বইয়ে স্থান পায়নি। অবশ্য না পাওয়ারই কথা। পাকিস্তানিরা তো আর শত্রুর জয়গান লেখার জন্য বই প্রকাশ করেনি, বিশেষ করে সেই শত্রুর হাতে যখন সে পরাজিত। তা ছাড়া বাঙালিদের প্রতি তাদের জাত ক্রোধ এবং অবজ্ঞার কথা তো কারো অজানা নয়। আর ভারতীয়রাই বা বাঙালির বীরগাথায় তাদের বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি করতে যাবে কেন। হবে বইকী, তবে সেই বই সত্যিই যদি কোনোদিন লেখা হয়। আজ ক্ষুব্ধ হতে হয় এই দেখে যে সেই গৌরবোজ্জ্বল যুদ্ধের এত বছর পরেও সে কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়নি। ক্ষুব্ধ হতে হয় এই ভেবে যে সে স্মৃতি আজ জীর্ণ মলিন এবং অচিরেই স্মৃতির অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। কিন্তু কেন হয়নি সেটারও একটা কারণ আছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পরে বাঙালি আত্মগর্বে এমনই বিভোর ছিল যে স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়নের প্রয়োজন মনে করেনি। ইতিহাসের অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের ভাগ্যে কিন্তু এ দৈন্যের মুকুট জোটেনি। ইতিহাসের পথে বেশি 

পেছনে যাওয়ার দরকার হয় না। আজ থেকে মাত্র কয়েক দশক আগে ফ্রান্সে ঘটেছিল এ ঘটনা। মিত্রবহিনীর সাহায্যে ফ্রান্সের মুক্তিবাহিনী তাদের দেশ শত্রু কবলমুক্ত করেছিল। আজ সেখানে গ্রামে স্মৃতিস্তম্ভে উৎকীর্ণ আছে সেই বীর শহীদদের নাম। সেখানে বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে আজও তাদের নামে গান রচিত হয়। তাদের বীরত্বকীর্তির কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। সেসব যুদ্ধক্ষেত্র আজ তাদের তীর্থস্থান এবং এই বীরযোদ্ধাদের জীবনী আজ তাদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত। মুক্তিবাহিনীর সেই কীর্তিআলেখ্য আজ তাদের পূর্বপুরুষের আত্মদানকে মহিমামণ্ডিত করে আর তাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার প্রেরণা জোগায়। অথচ আজ বিক্ষুব্ধচিত্তে আমাদের দেখতে হয় পালিত ও সুব্রামনিয়াম যে বই লিখেছেন সেখানে তাঁদের নিজেদের বীরত্বকীর্তি আমাদের চেয়ে বেশি লেখা হয়েছে। তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবে আমাদের নিজেদের লেখা বইয়ে আমাদের তরুণদের বীরগাথা নিশ্চয়ই তার স্বীয় মর্যাদায় আসীন হবে। আমাদের যোদ্ধাদের সেই বীরত্বকীর্তি আমাদেরকে কুণ্ঠিত করে। আজ আমরা ভেবে দেখি না যুদ্ধে পরাজয় ঘটলে চিরতরে এক দাসত্বশৃঙ্খলে বাঁধা বাঙালি জাতির বংশধর জন্ম নিত। আর সেই শৃঙ্খল পায়ে নিয়েই তারা মৃত্যুবরণ করত। এই কুণ্ঠার ফলস্বরূপ বাঙালি জাতি সর্বাপেক্ষা গৌরবের বস্তুটি নিয়ে গর্ব করতে ভুলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে সে না লিখেছে কোনো কালজয়ী সাহিত্য, না সৃষ্টি করেছে কোনো হৃদয়স্পন্দন থামানো ভাস্কর্য, না পদ্মা-মেঘনার তরঙ্গে ছড়িয়ে দিয়েছে দিগন্তপ্রসারী কোনো সুর। এখনও দেখতে হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক, যশ ও খ্যাতির লড়াইয়ের মারপ্যাঁচ, বারেবারে নতুন করে ইতিহাস লেখা হচ্ছে আর বারেবারে সেই ইতিহাসের পাতা বদলে নতুন পাতার সংযোজন ঘটছে। প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কি কোনোদিনই লেখা হবে না? রাজশাহীর সীমান্তবর্তী আর্মিক্যাম্পে যে কিশোর একঝাঁক গুলির সামনেও মাথা নোয়ায়নি সে কোন মায়ের আদরের দুলাল তা আমরা আজও জানতে পারলাম না। এ দৈন্য আমরা রাখব কোথায়! এ লজ্জা ঢাকব কী দিয়ে! 

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যদি আবার লেখা হয় তবে তা যেন বস্তুনিষ্ঠ এবং পক্ষপাতহীন হয়। এই অমিততেজী দেশমাতৃকার ছেলেরা কী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, কর্তব্যে কতটা নিষ্ঠা নিয়ে, সাহস, মনোবল ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস কতটা দৃঢ় রেখে অনিশ্চিতের পথে ঝাঁপ দিয়েছিল—আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর যেন সেই মূল্যায়নে স্থান পায়। হাজার হাজার শহীদের মতো তা হলে ঐ কিশোরের আত্মাও হয়তো সেদিন শান্তি পাবে। 

সাপ্তাহিক বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস ৮৯; বিশেষ সংখ্যা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *