এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – ৭

ছলনা ও চাতুর্য দিয়ে এরশাদ জিয়ার আস্থাভাজন হন 

এদিকে এরশাদ ধীরে ধীরে জিয়ার কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বস্ততা ও আস্থাভাজন হওয়ার পথ করলেন। ছলনা ও চতুরতার মাধ্যমে এরশাদ জিয়ার খুব প্রিয়পাত্র হলেন। জিয়াও তাঁকে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। একসময় জিয়া এরশাদকে সেনাপ্রধান করে নিজে ওই পদ থেকে সরে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। এ পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বে জিয়া একদিন আর্মি হেডকোয়ার্টারের সামনের লনে হাঁটতে হাঁটতে কথা প্রসঙ্গে আমার মতামত জানতে চাইলেন। আমি জেনারেল মঞ্জুরকে সেনাপ্রধান করার কথা বললাম। জিয়া আমার ওই মতামতকে অন্যভাবে নিলেন। ভাবলেন, আমি আর মঞ্জুর একই পক্ষের। তাই জিয়া আমার দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ করে বললেন, তোমরা দুজনেই চিফ হবে, তবে অপেক্ষা করতে হবে। শুধু আমি নই, জিয়ার অন্যান্য সুহৃদ, শুভাকাঙ্ক্ষী, অনুগত ও বন্ধুবান্ধবরা এরশাদকে সেনাপ্রধান করার বিপক্ষে ছিলেন। এরশাদ তখন জিয়া সরকারের দুর্নীতি দমনের (কো-অর্ডিনেশন সেল) প্রধান সমন্বয়কারী, অথচ তাঁর বিরুদ্ধেই অনেক দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীতে কথাবার্তা হতো। এ ছাড়া তাঁর নৈতিক চরিত্র নিয়ে অনেক কানাঘুষা ছিল। সেনাবাহিনীতে এসব নিয়ে তখন কথাবার্তা হতো। এতকিছু সত্ত্বেও জিয়া ১৯৭৯ সালের ২৯ এপ্রিল এরশাদকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান করেন। সেনাপ্রধান হওয়ার পর এরশাদ অত্যন্ত সুকৌশলে পদক্ষেপ নিতে লাগলেন। তাঁর নিজের পছন্দের লোকদের গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বসম্পন্ন পদগুলোতে বহাল করলেন। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পার্বত্য বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি করা হলো। কৌশলে স্পর্শকাতর পদগুলো থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে দেওয়া হলো। সেনা ও সামরিক গোয়েন্দা বিভাগগুলোতে তিনি নিজের কাছের লোকদের নিয়োগ করলেন। পরে ক্ষমতাদখলের সময় এসব লোক তাঁকে সহায়তা করে এবং তাঁর রাজনীতির দোসর হয়। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো লে. জেনারেল মহব্বত জান চৌধুরী, যিনি পরে মন্ত্রী হন। বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য নিজের পছন্দমতো লোকদের পাঠিয়ে তাঁর প্রতি আনুগত্যের জন্য পুরস্কৃত করতেন। আর্মি হেডকোয়ার্টারের একজন পিএসও হিসেবে এসব বিষয়ে আমার সঙ্গে তাঁর পরামর্শ করার কথা। কিন্তু এরশাদ সেটা এড়িয়ে যেতেন। 

মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি 

‘৮০ থেকে ‘৮১ সালের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পোস্টিং দেওয়া হয়। এটা ছিল একটা কষ্টকর স্থান এবং সেনাবাহিনীতে এটা ‘হার্ড স্টেশন’ নামে পরিচিত। বিষয়টি নিয়ে আমি এরশাদের সঙ্গে কথা বলি। ওইসব পোস্টিং রাষ্ট্রপতি জিয়ার ইঙ্গিতেই হচ্ছিল বলে তিনি আমাকে বোঝাতে চান। এরপর আমি বিষয়টি রাষ্ট্রপতি জিয়ার দৃষ্টিতেও আনি। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে পোস্টিং পাওয়া ওইসব মুক্তিযোদ্ধা অফিসার স্বাভাবিক কারণে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের তৎকালীন জিওসি মে. জেনারেল আবুল মঞ্জুরের অধীনে ছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৮১ সালে জিয়াহত্যার পর সেনাবাহিনী থেকে প্রকাশিত তথাকথিত শ্বেতপত্রে এত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘জড়ো’ করার জন্য জেনারেল মঞ্জুরকে দোষারোপ করা হয়। অথচ প্রকৃত সত্য হলো, আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকেই ওই সেনা-অফিসারদের বদলি করা হয়েছিল। আইন অনুযায়ী এক্ষেত্রে জিওসির বিশেষ কিছু করণীয় ছিল না। 

জিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে শীতলতা 

এদিকে আমি বিদেশ থেকে আসার আগেই অনেকগুলো বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থানের কোর্ট মার্শাল ও ফাঁসির হুকুম হয়ে গিয়েছিল। এদের কাগজপত্র দেখে মনে হয়েছে, তারা সত্যিকারভাবে ন্যায় বিচার পায়নি। তড়িঘড়ি করে তাদের বিচার করা হয়। সমস্ত পরিস্থিতি অনুধাবন করে ১৯৮০ সালে আমি জিয়াকে একটি চিঠি লিখি। আমি মনে করেছিলাম, এত ব্যস্ততার মধ্যে জিয়াকে হয়তো কথা না বলে চিঠি লেখাই সমীচীন হবে। কারণ ব্যস্ততার ফাঁকে হয়তো তিনি চিঠিটা পড়ে বিস্তারিত অবহিত হবেন। চিঠিটা আমি নিজহাতে তাঁকে দিই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জিয়া চিঠিটার বিষয়বস্তু নিয়ে আমার সঙ্গে কোনো আলাপ করেননি এবং উত্তরও দেননি। 

জিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ক্রমেই অবনতি হচ্ছিল। মূলত আমি সবসময় সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ও এর সার্বিক স্বার্থের ওপর জোর দিয়েছি। আমি সরল মনে জেনারেল জিয়াকে রাজনীতিতে না জড়ানোরও পরামর্শ দিয়েছিলাম। কেননা, মার্শাল ল’ ও অন্যান্য কারণে কিছু সামরিক কর্মকর্তা দুর্নীতি এমনকি চাকরিরত অবস্থাতেই সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছিলেন। এসব বিবেচনা করে একদিন বঙ্গভবনে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি ও আর্মির বিদ্যমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা করি। আলোচনার এক পর্যায়ে আমি জেনারেল জিয়াকে অনুরোধ করি যে, দেশে একটা সাধারণ নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পুরোপুরি সেনাবাহিনীতে ফিরে আসুন। আমি তাঁকে এও বলেছিলাম, এভাবে যদি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন, তা হলে জনগণের মাঝে সেনাবাহিনী সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হবে। জেনারেল জিয়া তখন এসব ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। 

আমি ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো আমার প্রস্তাব ভালোভাবেই গ্রহণ করেছেন। আমার ওই ধারণা আরো বদ্ধমূল হলো এই কারণে যে, জিয়া পরে এ সম্পর্কে জেনারেল এরশাদ ও নুরুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করেন। এঁরা দুজনই জিয়াকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে জড়ানোর ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন বলে আমার মনে হতো। বাস্তবতা হলো, জিয়ার রাজনীতিতে জড়ানোর ব্যাপারে আমার নেতিবাচক মনোভাব এবং মিটিংয়ে তাঁর সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার সাদেকের ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথনের ফলস্বরূপ তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। 

এখানে বলতে হয়, ১৯৭৭ সালের অক্টোবরের অভ্যুত্থান ও সেনাবিদ্রোহ এবং অন্যান্য উচ্ছৃঙ্খলতার প্রেক্ষাপটে জিয়া আমাকে লন্ডন থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন আমার ওপর জিয়ার আস্থা ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, সেনাবাহিনীতে কোনো গ্রুপিং বা দলাদলির সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত নই। পরে রাজনীতিসংক্রান্ত কার্যকলাপের প্রতি আমার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমার প্রতি তিনি আস্থা অব্যাহত রাখতে পারেননি। 

১৯৮১ সালের এপ্রিল মাসে আমি ক্যাডেট কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হিসেবে সস্ত্রীক চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগদান করি। রাতে জিওসি জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে ব্যক্তিগত নৈশভোজে অংশগ্রহণ করি। সেখানে আলাপচারিতায় মঞ্জুরের স্ত্রী জিয়ার ওপর খুব বিরক্তি প্রকাশ করেন। তিনি অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় খোলামেলাভাবে সরকার ও সেনাকর্তৃত্বের সমালোচনা করতে শুরু করেন। এতে আমি ও আমার স্ত্রী অস্বস্তি বোধ করছিলাম এবং অন্য প্রসঙ্গ টানতে চেষ্টা করি। যাহোক খাওয়াদাওয়ার পর আমরা চলে আসি। কিন্তু সামরিক গোয়েন্দারা অতিরঞ্জিত ও কাল্পনিকভাবে সাজিয়ে সেই নৈশভোজের কথা সেনাপ্রধান এরশাদ ও জিয়ার কানে তোলে। 

আমাকে বগুড়ায় ও মঞ্জুরকে ঢাকায় বদলি 

এর কয়েকদিন পরেই এরশাদ আমাকে জানালেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার নির্দেশে আমাকে ঢাকায় অ্যাডজুটেন্ট জেনারেলের পদ ছেড়ে বগুড়াতে জিওসি হয়ে চলে যেতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে আমি জানতে চাইলাম, আর কার পোস্টিং হয়েছে। এরশাদ উত্তরে বললেন, জেনারেল মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় স্টাফ কলেজে বদলি করা হয়েছে এবং আমার বর্তমান অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল পদ আপাতত খালি থাকবে এবং লে. জে. এরশাদ নিজেই সে দায়িত্ব পালন করবেন। 

আর্মি হেডকোয়ার্টারের পিএসও (অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল) থাকাকালে আমাকে প্রায়ই তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে হতো। কিন্তু জেনারেল এরশাদ সেনাপ্রধান হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে আমার তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হতো না এবং আমিও নিজে থেকে কোনোরকম যোগাযোগ রাখা থেকে বিরত থাকতাম। অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অফিসিয়ালি আমার তেমন দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার কথাও নয়। তা ছাড়া অফিসিয়াল প্রয়োজন ছাড়া রাষ্ট্রপতি কিংবা মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ সামরিক আচারে অবাঞ্ছনীয়। 

১৯৮১ সালের মে মাসে জিয়া নিহত হওয়ার পাঁচদিন পূর্বে বগুড়া সেনানিবাসে বদলির আদেশ পেলাম। বদলির আদেশ পেয়ে আমি চিফ অফ স্টাফ জেনারেল এরশাদকে রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক জেনারেল জিয়ার সঙ্গে আমার সৌজন্য সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করি। আমি তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করি যে, বদলি রহিত করার কোনো তদবির নিয়ে আমি রাষ্ট্রপতি জিয়ার কাছে যাচ্ছি না। ঢাকা থেকে যাওয়ার আগে সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে চাই। তবে আমার এই ইচ্ছা অবশ্যই ছিল যে, সাক্ষাতের সুযোগে আর্মির অব্যবস্থা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অসন্তোষের বিষয়ে জিয়াকে অবহিত করব। 

প্রথমে জেনারেল এরশাদ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে রাজি হলেন না। আমাকে বললেন, নিজেই যেন সাক্ষাতের ব্যবস্থা করি। কিন্তু আমি রাষ্ট্রাচারের নিয়মকানুনের উপর জোর দেওয়ায় দুদিন পর জেনারেল এরশাদ ৩০ মে বিকেল বেলায় প্রেসিডেন্টের বাড়িতে আমার সঙ্গে জিয়ার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল এরশাদ আমাকে এও জানালেন যে, রাষ্ট্রপতি জিয়া চান আমি যেন খুব তাড়াতাড়ি বগুড়ায় যোগদান করি। আমি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা হওয়ার দুএকদিন পরেই বগুড়ায় চলে যাব বলে এরশাদকে জানাই। কিন্তু জিয়ার সঙ্গে আমার সেই সাক্ষাৎ আর হলো না। আগের রাতেই তিনি নিহত হন। সেকথায় পরে আসছি। 

এদিকে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের ব্যবস্থা হওয়ার পর আমি জেনারেল মঞ্জুরকে চট্টগ্রামে ফোন করি। জেনারেল মঞ্জুর ফোনে আমাকে এমন ইঙ্গিত করলেন যে, রাষ্ট্রপতি জিয়া নিশ্চয় ভাবেন আমরা দুজন এক পক্ষের, বিশেষ করে তাঁর রাজনৈতিক ও সমসাময়িক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে। এজন্যই আমাদের বদলি করে দিলেন। 

যাহোক আমার বগুড়ায় বদলির খবরে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা এ সিদ্ধান্তে হতাশ হন। কারণ, সেনাসদরে চারজন পিএসও-এর মধ্যে তখন আমিই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল ছিলাম। সেনাপ্রধান এরশাদসহ বাকি সবাই অমুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান-প্রত্যাগত। 

জিয়ার হত্যাকাণ্ড ও এরশাদের তৎপরতা 

৩০ মে শুক্রবার আমি তখনও বিছানায় শোয়া। ভোরেই আমার সহকর্মী আর্মি হেড-কোয়ার্টারের পিএসও জেনারেল নুরুদ্দিন (বর্তমানে মন্ত্রী) ফোন করে আমাকে সত্বর সেনাসদরে যেতে বললেন। সেসঙ্গে জানালেন, জেনারেল জিয়া চট্টগ্রামে নিহত হয়েছেন। আমি তাড়াতাড়ি ইউনিফর্ম পরে সেনাসদরে উপস্থিত হই। সেখানে গিয়ে দেখি জেনারেল এরশাদ আগেই উপস্থিত হয়েছেন। এরশাদ ছিলেন সামরিক পোশাক পরিহিত এবং ধীর, স্থির ও শান্ত। আমার পরে সেনাসদরে এলেন আরেক পিএসও জেনারেল মান্নান সিদ্দিকী (পরে এরশাদ সরকারের মন্ত্রী)। আমরা জেনারেল এরশাদকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কী হবে? জেনারেল এরশাদ সরাসরি কোনো উত্তর দিতে চাননি, বরং পরোক্ষ ইঙ্গিতে সামরিক আইন জারির কথা বললেন। আমরা বললাম, সামরিক আইন জারির কোনো যুক্তি বা অবস্থা এখন নেই। উপ-রাষ্ট্রপতি সাত্তার আছেন। তিনি তখন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, তখনও পর্যন্ত জেনারেল এরশাদ উপ-রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে জিয়া নিহত হওয়ার খবর জানাননি। আমরা বলার পর জেনারেল এরশাদ গেলেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। 

সকাল ৯টার দিকে জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রাম থেকে আমাকে ফোন করলেন। আমি তখন জেনারেল নুরুদ্দিনের কক্ষে। জেনারেল মঞ্জুর আমাকে আমার অফিসকক্ষে না পেয়ে জেনারেল নুরুদ্দিনের কক্ষেই ফোন করেন। ফোনে মঞ্জুর বললেন, ‘জেনারেল জিয়ার নিহত হওয়ার ব্যাপারে পরে বিস্তারিত জানাবেন। কিন্তু এ মুহূর্তে সবাই যেন শান্ত থাকে। ঢাকায় আর যেন রক্তক্ষয়, সংঘর্ষ ইত্যাদিতে কেউ জড়িয়ে না পড়ে। আমি আর বলতে পারছি না, অসুবিধা আছে।’ এরপর ফোন লাইন কেটে যায়। অনেক পরে ১৯৯০ সালে আমি জানতে পারি, জেনারেল মঞ্জুর তখন জুনিয়র অফিসারদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ও চাপের মধ্যে ছিলেন 

জিয়াহত্যার ব্যাপারে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তাঁর এ লেগ্যাসি অফ ব্লাড বইতে (পৃ. ১৬৯) জেনারেল মঞ্জুর ও জেনারেল শওকতের ষড়যন্ত্রের আভাস দিয়ে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাঁদের উভয়ের সম্পর্ক ভালো ছিল না তা আমি আগেই বলেছি। একইভাবে ওই বইয়ে বলা হয়, জেনারেল মঞ্জুর ঢাকায় একাধিকবার ফোন করেছেন এবং আমি তাঁর ফোন পেয়ে অস্বস্তি বোধ করেছি বা হতবাক হয়েছি— এটাও সম্পূর্ণ বানোয়াট। আমি এসব ঘটনার সাক্ষী। জেনারেল এরশাদের শাসনামলে এসব ভুল তথ্য আর্মিতে মুক্তিযোদ্ধা-বিরোধীরা ম্যাসকারেনহাসকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সরবরাহ করে। বইটি পড়লেই এর উদ্দেশ্য বোঝা যায়। 

হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে খালেদ ও মোজাফ্ফর যা বলেন 

এ ছাড়া আমি যখন থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (১৯৮৯-৯৩) তখন জিয়াহত্যায় অভিযুক্ত অন্যতম পলাতক আসামি মেজর খালেদ ব্যাংককে ছিলেন। অপর পলাতক আসামি মেজর মুজাফ্ফর ছিলেন ভারতে। ভারত থেকে এসে মেজর মুজাফ্ফরও খালেদকে নিয়ে ব্যাংককে আমার সঙ্গে দেখা করেন। জিয়াহত্যার বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের সঠিক তথ্য জানার ইচ্ছা আমার ছিল এবং সেরূপ চেষ্টাও করি। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় আমি যা জেনেছি তা সংক্ষেপে এরকম : মতি, মাহাবুব ও খালেদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ২৪ ডিভিশনের জুনিয়র অফিসাররা জিওসি জেনারেল মঞ্জুরের অজান্তে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে সার্কিট হাউস থেকে অপহরণ করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল— জিয়াকে চাপ দিয়ে বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়, 

বিশেষ করে সেনাপ্রধান এরশাদসহ অন্যান্য দুর্নীতিপরায়ণ সামরিক অফিসার এবং পাকিস্তানপন্থী শাহ আজিজ ও অন্য দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করানো। কারণ এরশাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হয়রানি, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ঢালাওভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করাসহ সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের বিভিন্নস্তরের ব্যাপক দুর্নীতি নিয়ে জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ ছিল। মূলত এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাদের ওই উচ্ছৃঙ্খল বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। 

বিদ্রোহের সেই রাতে বেশ ঝড় হচ্ছিল এবং জিয়া সার্কিট হাউসের দোতলায় ঘুমিয়ে ছিলেন। ভোর ৪টার দিকে অফিসাররা অতর্কিতে সার্কিট হাউস আক্রমণ করে। ওই আক্রমণের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, তাতে কোনো সৈনিক, জেসিও বা এনসিওকে সরাসরি জড়ানো হয়নি। জুনিয়র অফিসাররা নিজেরাই দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রথমে সার্কিট হাউসে রকেট ল্যাঞ্চার নিক্ষেপ করে। পরে এক গ্রুপ গুলি করতে করতে ঝড়ের বেগে সার্কিট হাউসে ঢুকে পড়ে। গুলির শব্দ শুনে জিয়া রুম থেকে বের হয়ে আসেন এবং কয়েকজন অফিসার তাঁকে ঘিরে দাঁড়ায়। ওই সময় লে. কর্নেল মতিউর রহমান মাতাল অবস্থায় টলতে টলতে জিয়া কোথায়, জিয়া কোথায়’ বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসে এবং পলকেই গজখানেক সামনে থেকে তার চাইনিজ স্টেনগানের এক ম্যাগজিন (২৮টি) গুলি জিয়ার উপর চালিয়ে দেয়। অন্তত ২০টি বুলেট জিয়ার শরীরে বিদ্ধ হয় এবং পুরো শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। উপস্থিত অন্য অফিসাররা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে যায়। তারা কোনো গুলি ছোড়েনি। শুধু দুএকজন অফিসার ‘কী করছেন, কী করছেন’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। কিন্তু ততক্ষণে প্রেসিডেন্ট জিয়া মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। 

লে. কর্নেল মতির ক্ষোভের কারণ ছিল ভিন্ন 

থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত থাকা অবস্থায় ঢাকায় এলে (১৯৯১ সালে) আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে মেজর খালেদ ও মুজাফফরের সঙ্গে আমার আলোচনা বিস্তারিতভাবে অবহিত করি। যেসব অফিসারের উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয় তাঁদের মধ্যে একমাত্র মেজর খালেদ ও মেজর মুজাফ্ফরই তখন জীবিত ছিলেন। লে. কর্নেল মতিউর রহমান এবং লে. কর্নেল মাহবুব দুজন পালিয়ে যাওয়ার সময় মানিকছড়ির কাছে গোলাগুলিতে নিহত হন। মুজাফ্ফর ও খালেদ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে মুজাফফর ভারতে এবং খালেদ ব্যাংককে চলে যান। বাকিদের কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালে খালেদ ব্যাংককে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান এবং তাঁর লাশ ঢাকায় পাঠানো হয়। 

বস্তুত ঘটনার পরদিন মঞ্জুরের সঙ্গে কথা হওয়ার পর আমি বুঝতে পারি, মঞ্জুর জিয়াহত্যার সঙ্গে জড়িত নয় এবং পরে মেজর খালেদের কাছ থেকেও জানতে পারি যে, আমার ধারণাই সঠিক। আমার মনে হয়, জিয়াকে হত্যার পেছনে লে. কর্নেল মতির ক্রোধ ও আক্রোশের কারণ ছিল অন্যত্র। ১৯৮১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে আমেরিকাতে সামরিক প্রশিক্ষণে মনোনয়নের জন্য তৎকালীন লে. ক. মতিউর রহমান, লে. কর্নেল ইমামুজ্জামান (বর্তমানে মেজর জেনারেল) ও পাকিস্তান-প্রত্যাগত লে. কর্নেল সাখাওয়াত (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার)সহ ৫ জনকে একত্রে সেনাসদরে বাছাইয়ের জন্য ডাকা হয়। এঁদের মধ্যে সাখাওয়াত ছিলেন ১০ মার্চ ১৯৮১ সালে এরশাদ কর্তৃক মনোনীত একটি কোর্ট মার্শালের প্রসিকিউটর, যেখানে ষড়যন্ত্র ও অভ্যূত্থান পরিকল্পনার দায়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লে. ক. নুরুন্নবী বীর বিক্রম, কর্নেল দিদার ও একজন বেসামরিক ব্যাংকার মনির হোসেনের বিচার হয়েছিল। কোর্ট মার্শালে লে. ক. নুরুন্নবীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত এবং এক বছরের কারাদণ্ডের শাস্তি দেওয়া হয়। দিদারকে ১০ বছরের জেল এবং মনির হোসেনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সেনাপ্রধান ইমামুজ্জামান ও মতিকে বাদ দিয়ে সাখাওয়াতকে আমেরিকায় প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করেন, যদিও যোগ্যতাবলে বাকি এক অফিসার সাখাওয়াতের চেয়ে ভালো ছিল বলে অনেকের ধারণা। মনোনয়ন না পেয়ে মতিউর রহমান অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হন এবং ওইদিনই বঙ্গভবনে গিয়ে জিয়ার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সাদেকের সঙ্গে দেখা করেন। মনোনয়নে অনিয়মের কথা তিনি সরাসরি জেনারেল সাদেককে বলেন। তিনি আরো অভিযোগ করেন, মুক্তিযোদ্ধা অফিসারগণ আর্মিতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে জানানোর জন্য জেনারেল সাদেককে অনুরোধ করেন। জিয়াহত্যার পরদিন সকালেই কথা প্রসঙ্গে জেনারেল সাদেক আমাকে মতিউর রহমানের ক্ষোভের বিষয়টি অবহিত করেন। জেনারেল সাদেক আরো বলেন, মতিই সম্ভবত জেনারেল জিয়াকে হত্যা করেছে। 

মঞ্জুর জিয়া হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিলেন না 

আমি ভালোভাবেই জানতাম, রাষ্ট্রপতি জিয়াহত্যা কোনো পরিকল্পিত সামরিক অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহ ছিল না। এটা ছিল কিছু তরুণ সেনা অফিসারের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবং তা ক্ষমতাদখলের জন্য ছিল না। রাষ্ট্রপতি জিয়াহত্যার পর জেনারেল মঞ্জুরের অধীনস্থ অফিসারগণ যখন তাঁর কাছে গিয়ে এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানান, তখন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একজন ডিভিশন কমান্ডার হিসেবে তিনি ওই ঘটনার দায়দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন। তাঁর অধীনের অফিসারগণ যদিও তাঁর অজান্তে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তবুও একজন সামরিক অধিনায়ক হিসেবে তাঁকেই ওই ঘটনার জন্য দায়ী করা হতো। তা ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডে তিনি যে জড়িত নন, সহজভাবে তা বিশ্বাসযোগ্য হতো না। অথচ জেনারেল মঞ্জুরকে পলাতক অবস্থা থেকে ধরে এনে কোনো তদন্ত ছাড়াই সুপরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রপূর্বক ঠাণ্ডা মাথায় অন্তরীণ অবস্থাতেই হত্যা করা হয়। হত্যার পর তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে জিয়াহত্যার জন্য দায়ী করা হয়। জেনারেল মঞ্জুরকে অন্তরীণ অবস্থায় হত্যার কারণ হলো, নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার হলে জিয়াহত্যার ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত প্রকাশ পেয়ে যেত। আর তাঁকে হত্যা করা না হলে ভবিষ্যতে অনেকের স্বার্থসিদ্ধির পথ হতো কণ্টকময়। 

৩০ মে জিয়াহত্যার পর সেনাসদরে আমার সঙ্গে মঞ্জুরের ফোনে কথোপকথন থেকে আমি বুঝতে পারি তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই অধিনায়ক হিসেবে তাঁকে এই হত্যাকান্ডের দায়িত্ব বহন করতে হচ্ছিল। আমার এই ধারণা আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারে সেনাপ্রধান এরশাদসহ আমার অন্য সহকর্মী, পিএসওদের সামনে ব্যক্ত করি। কিন্তু তাঁরা বিভিন্নভাবে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বেই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। 

এ ছাড়া বেশ তড়িঘড়ি করেই ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মঞ্জুরকে জড়িত করে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচারণা শুরু হয়ে যায়। যদিও আমি মতপ্রকাশ করি যে, কোনোপ্রকার খোঁজখবর না করেই রেডিও-টিভিতে এরকম প্রচারণা ঠিক নয়। 

মঞ্জুর যে জিয়াহত্যায় জড়িত ছিলেন না তা আরো দুটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। ৩০ মে ভোরে যখন মঞ্জুরকে জিয়াহত্যার খবর দেওয়া হয় তখন তিনি বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী যখন শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন তখন তাঁরা স্লিপিং ড্রেস পরা ছিলেন। 

আরেকটি ঘটনা হলো, ওই হত্যাকাণ্ডের সময় দুজন অফিসার, একজন পুলিশ ও চারজন গার্ড রেজিমেন্টের সদস্য মারা যান। ঢাকা থেকে যাওয়া প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্টের আহত ও নিহত সৈন্যদের পেনশনাদির জন্য পরে তাদের ইউনিটে একটি লোকাল কোর্ট অফ ইনকোয়ারি করা হয়। অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে সেই কোর্ট অফ ইনকোয়ারির রিপোর্ট আমার গোচরে আসে। ওই রিপোর্টে গার্ড রেজিমেন্টের দুজন সদস্যের বক্তব্য বেশ প্রণিধানযোগ্য। তাদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, জিয়াহত্যার পর বিদ্রোহীরা গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যদের সার্কিট হাউস থেকে একটি গাড়িতে করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে যান। বিদ্রোহে জড়িত অফিসাররা তাঁদের গাড়িতে তোলার আগে এই বলে হুঁশিয়ার করে দেন যে, সেনানিবাসে যাওয়ার পর তাঁরা যেন কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলেন। তবে যদি জিওসি জেনারেল মঞ্জুর এসে তাঁদের কাছে সার্কিট হাউসের ওই রাতের ঘটনা জানতে চান তা হলে তাঁরা যেন বলেন, “ঝড়বৃষ্টি এবং অন্ধকারের কারণে কারা গোলাগুলি করেছে আমরা দেখিনি।’ 

মঞ্জুরহত্যা ছিল পরিকল্পিত 

এসব ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, জেনারেল মঞ্জুরের অজ্ঞাতসারেই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। বস্তুত জিয়াহত্যার পর থেকেই জেনারেল এরশাদ ক্ষমতাদখলের পাঁয়তারা শুরু করেন। তৎকালীন কিছু-কিছু রাজনীতিবিদের আনাগোনাও শুরু হয়ে যায় সেনানিবাসে। আর এসব লোকের ক্ষমতার পথ কণ্টকহীন করতেই বলির পাঠা হতে হয় জেনারেল মঞ্জুরকে। অথচ সেনাবাহিনীতে রটানো হয় যে, মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সিপাহিরা হত্যা করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মঞ্জুর হত্যার খবর পাই আমার তৎকালীন সহকর্মী সিজিএস মেজর জেনারেল নুরুদ্দীনের কাছ থেকে। ঐদিন দুপুরে তাঁর অফিসে আমি নিজ থেকে যখন মঞ্জুর সম্পর্কে জানতে চাই তখন তিনি আমাকে বলেন, মঞ্জুরকে স্কট করে সেনানিবাসের ভিতর দিয়ে অন্তরীণ করার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় সৈনিকরা তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করেছে।’ এর আগ পর্যন্ত আমি জানতাম, মঞ্জুরকে আটক করে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মূলত জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে ক্ষমতালোভী, উচ্চাভিলাষী, ষড়যন্ত্রকারী ও কিছু অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে। এটা সুদূরপ্রসারি ষড়যন্ত্রের ফল। বর্তমানে মঞ্জুর হত্যা মামলা আদালতে বিচারাধীন। 

আর্মির মুক্তিযোদ্ধা অফিসার নিধনের নীলনকশা 

দুই-তিন দিনের মধ্যে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আমি দেখলাম জিয়া-হত্যার সুযোগে জেনারেল এরশাদ ও অমুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র কয়েকজন অফিসার মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের শায়েস্তা ও সেনাবাহিনী থেকে অপসারণের ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছেন। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের এরা সন্দেহ ও হয়রানি করতে লাগল আরো বেশি করে। তারা আমাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আমার বাসার চারদিকে সিভিল ড্রেসে ডিজিএফআই-এর লোকজন লাগানো হলো। খোলাখুলিভাবে আমাকে অনেকটা নজরবন্দির মতো রাখা হলো। জেনারেল জিয়া নিহত হওয়ার পর বিচারপতি সাত্তার যদিও রাষ্ট্রপতি ছিলেন, কিন্তু কার্যত এরশাদ সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেলেন। তিনি নিজের লোকদের পছন্দমাফিক গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল করে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের কোণঠাসা করতে লাগলেন বিনা বাধায়। 

জেনারেল এরশাদের আদেশে জিয়াহত্যার পর গ্রেপ্তারকৃত অফিসারদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো যাতে করে তাদের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল করা যায়। তদন্ত কমিটি গঠন করার সময় যখন তদন্তের বিষয় নিশ্চিত করার আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল তখন আমি প্রস্তাব দিই যে, কী কারণে অফিসাররা ওই বিদ্রোহ করল তাও এ তদন্তের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অকারণে কখনও বিদ্রোহ হয় না। কিন্তু তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ আমার ওই প্রস্তাব অনুমোদন করেননি। তাই অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে ওই তদন্তের আদেশে আমার স্বাক্ষর করার কথা থাকলেও আমি তা করতে অস্বীকৃতি জানাই। ফলে জেনারেল এরশাদ নিজেই ওই তদন্ত আদেশে স্বাক্ষর করেন। খুব তাড়াহুড়া করেই তদন্ত কমিটি গঠিত হলো। তৎকালীন মেজর জেনারেল (বর্তমান অবঃ) মোজাম্মেলের সভাপতিত্বে তদন্ত অনুষ্ঠিত হলো। তদন্তে ৩৩ জন অফিসার ও দুজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারকে কোর্ট মার্শাল করার জন্য সুপারিশ করা হলো। এরা প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তারপর তাদের কোর্ট মার্শালের জন্য একটি কোর্ট গঠন করা হলো। কোর্ট মার্শালের সভাপতি করা হলো তৎকালীন মেজর জেনারেল (বর্তমানে মৃত) আব্দুর রহমানকে। সব আইনকানুন ও নিয়মনীতি ভঙ্গ করে চট্টগ্রামের বেসামরিক জেলখানায় বিচারকার্য চলে। অভিযুক্তদের ভালোভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই বিচার করা হয়। তদন্তের সময় তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগও ওঠে। সামরিক আইন অনুযায়ী বেসামরিক আইনজীবীরাও এরকম কোর্ট মার্শালে অভিযুক্তদের পক্ষে কৌসুলি নিয়োজিত হতে পারেন। কিন্তু তাদের কোনোরূপ সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষ নিজেদের ইচ্ছামতো সেনাবাহিনীর অফিসার দ্বারা অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যবস্থা করে দেন। এতে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আগে থেকেই এ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এ প্রহসনের কোর্ট মার্শালে ১৩ জন অফিসারের ফাঁসি এবং ১৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারকে ইচ্ছাকৃতভাবে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, যাতে করে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক এনসিও ও জেসিওদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়। কেননা, জুনিয়র কমিশন্ড অফিসাররা সৈনিক থেকে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। 

আমার বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নিয়োগ 

যেহেতু আমি অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল তাই নিয়ম অনুসারে আমার সার্বিক তত্ত্বাবধানে কোর্ট মার্শাল হওয়ার কথা। অথচ, আমাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে না জানিয়ে এবং না জড়িয়ে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আইন ভেঙে ওইসব কোর্ট মার্শাল ও তদন্ত করা হয়। এদিকে আমার পেছনে সর্বক্ষণ গোয়েন্দা। আমার টেলিফোনে আড়িপাতা হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টা বাসাতে আমার চালচলন পর্যবেক্ষণের জন্য সামরিক গোয়েন্দারা গাড়িতে ওয়ারলেস লাগিয়ে পাহারা দিচ্ছে। একপর্যায়ে একদিন আমি গোয়েন্দাদের সার্বক্ষণিক পাহারায় অতিষ্ঠ হয়ে টেলিফোনে খুব রূঢ় ভাষায় সামরিক গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী (পরে এরশাদের মন্ত্রী) ও সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদকে বিষয়টি অবহিত করি। তাঁরা দুজন এমন ভান করলেন যেন তাঁদের অজান্তেই আমার ওপর নজরদারি হচ্ছে। বস্তুত তাঁদের অজান্তে এমনটি হবে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। 

জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ 

এদিকে অভিযুক্ত ওইসব মুক্তিযোদ্ধা আর্মি অফিসারদের নিকটতম আত্মীয়স্বজন আমার কাছে এসে তাঁদের খবরাখবর জানতে চাইতেন। কারণ, আমি তখনও অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল ও সেনাসদরে একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা পিএসও। তা ছাড়া সেনাসদরের অন্য অফিসাররা কোনোরূপ বিপদে জড়ানোর ভয়ে এসব লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে সাহস পেতেন না। কোর্ট মার্শাল আইনে অভিযুক্ত ১৩ জন অফিসারের ফাঁসির রায় হয়ে গেলে আমি জানতাম কোনো আপিলের সুযোগ না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে তাঁদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে। তাই শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি মনস্থির করলাম এ ব্যাপারে জেনারেল ওসমানীর সাহায্য নেব। যেহেতু আমার পেছনে সর্বদা গোয়েন্দা লাগানো, তাই খোলাখুলিভাবে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা না করে বিকল্প পন্থা খুঁজলাম। আমার আত্মীয় কায়সার রশীদ চৌধুরীর (স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ভাই, বর্তমানে প্রয়াত) ধানমণ্ডির ২নং সড়কের বাড়ির পেছনে আরেকটি বাড়িতে থাকতেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক (পরে রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব) মুফলেহ ওসমানী। তিনি জেনারেল ওসমানীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। দুই বাড়ির পেছনের দিকে শুধু একটা দেয়াল। একদিন আমি জেনারেল ওসমানীকে মুফলেহ ওসমানীর বাসায় রাত ১২টায় উপস্থিত থাকতে গোপনে খবর পাঠাই। রাতে আমি সেনাবাহিনীর গাড়ি নিয়ে কায়সার রশীদের বাড়িতে যাই। গোয়েন্দাদের দুটি গাড়ি সেনানিবাস থেকেই আমার পিছু নিল। আমি কায়সার রশীদের বাসায় প্রবেশ করি এবং পেছন দিয়ে দেয়াল টপকে মুফলেহ ওসমানীর বাড়িতে ঢুকি। আমি তাঁদের রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকি। মুফলেহ ওসমানীর স্ত্রী মিসেস শিরিন আমাকে ওই অবস্থায় দেখে আঁতকে ওঠেন। যাহোক, একটু পরে জেনারেল ওসমানী ওই বাসায় আসেন। 

আমার সঙ্গে কথা বলার সময় জেনারেল ওসমানীকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল এবং তিনি শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি মুফলেহ ওসমানীকে পাশের রুমে চলে যেতে বললেন। আমি কোনো ভূমিকা ছাড়াই তাঁকে সোজাসুজি অনুরোধ করি, সেই রাতেই তিনি যেন পত্রিকায় এই বলে একটি বিবৃতি দেন যে, ‘রাষ্ট্রপতি জিয়া-হত্যার কোর্ট মার্শালে সেনাবাহিনীর আইনকানুন ভেঙে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বিচার করা হয়েছে, যা ঠিক হয়নি। এই বিচার মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের শায়েস্তা করা ও চাকরি থেকে অপসারণ করার জন্যই করা হয়েছে।’ আমি তাঁকে আক্ষরিক অর্থে কাকুতি-মিনতি করে বোঝাতে চেষ্টা করি যে, মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের নিধনের জন্য প্রহসনমূলকভাবে ওই কোর্ট মার্শাল করা হয়েছে। তারা কোনো ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। তিনি আমার অনুরোধ উপেক্ষা করে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি দেশে হানাহানি শুরু করাতে চাও নাকি?’ আমি তাঁকে আশ্বস্ত করে বলি যে, শুধু সুবিচারের জন্য এবং নির্দোষ ছেলেদের জীবন বাঁচানোর জন্য আমি একটা উপায় খুঁজছি এবং আপনার কাছে এসেছি। এরপর তিনি উত্তেজিত হয়ে হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে বসলেন, ‘তা হলে তোমরা (মুক্তিযুদ্ধার) দুবছরের সিনিয়রিটি নিলে কেন? সেজন্যই আজ এত গণ্ডগোল হচ্ছে, তারা প্রতিশোধ নিচ্ছে’ ইত্যাদি। আমি প্রত্যুত্তরে বললাম, ওই প্রশ্নে যদি যেতে চান তা হলে তা পরে হবে। দয়া করে এই মুহূর্তে নিষ্পাপ প্রাণগুলো বাঁচানোর চেষ্টা করুন। 

আমি কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল ওসমানী ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে রেখে চলে গেলেন। তাঁর আচরণে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী করব কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এখনও মনে পড়ে, আমি হতবাক হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। উনি চলে যেতেই মুফলেহ ওসমানী রুমে এসে ঢুকলেন। মুফলেহ ওসমানীকে আক্ষেপ করে বললাম, ছেলেগুলোকে আর বাঁচানো গেলো না। তিনি বললেন, আমিও ভেবেছিলাম এপথে সফল হবেন না। তিনি আরো কিছু কথা বললেন, যা আজ আর বলতে চাই না। জেনারেল ওসমানীর নিকটাত্মীয়ের মুখে ওইসব কথা শুনে আমি ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। 

বিচার সম্পর্কে কোনো কথা না বলেও জেনারেল ওসমানী পরে বিবৃতি দিয়ে রাষ্ট্রপতি সাত্তারের কাছে ওদের প্রাণদণ্ড মওকুফের জন্য আবেদন করলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সাত্তার সে আবেদনে সাড়া দেননি, প্রাণদণ্ড মওকুফ করেননি। এদিকে জেনারেল এরশাদ ও তাঁর আর্মি সহচরগণ ক্যান্টনমেন্ট ও অন্যান্য জায়গায় প্রচার করতে লাগলেন যে, খালেদা জিয়া এ ফাঁসি তাড়াতাড়ি কার্যকর করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। খালেদা জিয়ার চারপাশে তখন এরশাদের লোকজন এবং তাঁকে ওঁরাই নিজেদের মতো করে খোঁজখবর দিচ্ছিলেন এবং বোঝাচ্ছিলেন। 

যাহোক, ঢাকার কয়েকজন আইনজীবী ওই কোর্ট মার্শাল ও এর রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। কিন্তু হাইকোর্ট সেই আপিল গ্রহণ করতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানায়। তখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে নানা অজুহাতে বিচারপতিদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছিল বলে শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলখানায় নির্দয়ভাবে দণ্ডপ্রাপ্তদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এমনকি ফাঁসির সময় তাঁদের নিকটতম আত্মীয়স্বজনকে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতেও দেওয়া হয়নি। ফাঁসির পর কোনো কোনো শহরে ছোটখাটো মিছিল, প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে দেশব্যাপী ব্যাপকভিত্তিক কোনো জোরালো প্রতিবাদ কিংবা প্রতিক্রিয়া হয়নি ওই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। সে সময় ওইসব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ছেলেমেয়ে ও পরিবার-পরিজন অসহায়ের মতো শহরে ঘোরাঘুরি করতেন। 

মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বিরুদ্ধে আরো পদক্ষেপ 

মুক্তিযোদ্ধানিধনের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহচরগণ পাকিস্তান-প্রত্যাগত মেজর জেনারেল (বর্তমানে অবঃ) সামাদকে সভাপতি করে প্রহসনমূলকভাবে মুক্তিযোদ্ধা আর্মি অফিসার ছাঁটাই করার জন্য একটি বোর্ড গঠন করেন। এ বোর্ডের মাধ্যমে আরো প্রায় ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে বিভিন্ন অজুহাতে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার পরিস্থিতির চাপে অবসর গ্রহণে বাধ্য হন। পরবর্তী সরকারসমূহ এসব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে কেন ও কী কারণে ফাঁসি, জেল ও চাকরিচ্যুত করা হলো তার কোনো নিরপেক্ষ তদন্তের আগ্রহ দেখায়নি কিংবা একটু উদ্বেগও প্রকাশ করেনি। এসব সরকার স্বাধীনতার বর্ষপূর্তিতে এবং অন্যান্য সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যর্থনা, সনদ বিতরণ ও তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে শুধু মোনাজাত, সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বস্তুত এটা এখন একটা উৎসবের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এসব ঘটনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান থেকে আগত কিছু উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসার মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদদের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের দুই বছরের জ্যেষ্ঠতা প্রাপ্তি, পদোন্নতি ইত্যাদির জন্য বিগত কয়েক বছরের সঞ্চিত ক্ষোভ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় রাষ্ট্রপতি জিয়াহত্যার অজুহাতে। যদিও জিয়াহত্যার সময় মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল ছিলেন একজন ডাক্তারসহ চারজন। আর পাকিস্তান থেকে ১৯৭৩ সালে আগতদের মধ্যে সেনাপ্রধান এরশাদসহ ছিলেন ১৪ জন জেনারেল। 

আগেই বলেছি, এসব ঘটনার প্রাক্কালে আমিই ছিলাম ঢাকা সেনাসদরে একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল। বাকি সবাই পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত। সুপ্রিম হেডকোয়ার্টারে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী। রাষ্ট্রপতি জিয়াহত্যার পর তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে লে. জেনারেল করা হলো এবং সেনাবাহিনী থেকে অবসর দিয়ে কায়রোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের জন্য তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো। জেনারেল মীর শওকতের অবসরগ্রহণের পর ডাক্তার মেজর জেনারেল শামসুল হক (পরে এরশাদের মন্ত্রী এবং বর্তমানে জাতীয় পার্টির সঙ্গে জড়িত) ছাড়া আমিই তখন আর্মিতে একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল। তদন্তের সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াহত্যায় আমাকেও জড়ানোর চেষ্টা চলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে জড়ানো সম্ভব হয়নি। যশোর থেকে জনৈক লে. কর্নেল মুজিবকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল এভাবে যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াহত্যার পরপরই আমি আর্মির মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের আরেকটা অভ্যুত্থানের জন্য সংগঠিত করতে চেষ্টা করি, যা ছিল ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। 

আর্মি হেডকোয়ার্টারে আমাকে মোটামুটিভাবে বিচ্ছিন্ন করা হলো। ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সভা, সিদ্ধান্ত ইত্যাদির কিছুই আমাকে জানানো হতো না। জিয়াহত্যার কোর্ট অফ ইনকোয়ারি এবং কোর্ট মার্শালের কাগজপত্রে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে যেমন আমার অভিমত নেওয়া হয়নি তেমনি মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের আর্মি থেকে ছাঁটাইয়ের জন্য যে তালিকা তৈরি করা হয় সে বিষয়েও আমার সঙ্গে আলাপ করা হয়নি। 

আগেই বলেছি, আমার পেছনে সর্বদা সামরিক গোয়েন্দা লেগে ছিল এবং টেলিফোনে আড়িপাতা হচ্ছিল। বস্তুতপক্ষে এসবের মাধ্যমে আমি হেডকোয়ার্টারে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে আমাকে অফিসের কোনো কাজকর্ম করতে না দেওয়ার জন্য এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছিল। একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন পেশাদার সৈনিক হিসেবে আর্মিতে আমার এরূপ অবস্থান অপমানজনক। ফলে কাজ করা দুঃসহ হয়ে উঠছিল। ওই পরিস্থিতিতে আমি সেনাপ্রধান এরশাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করি। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার করার মতো সদিচ্ছা তাঁর ছিল বলে আমার মনে হয়নি। 

বিমানবাহিনী প্রধান সদরুদ্দীনের পদত্যাগ 

ওই সময় বিমানবাহিনীর তৎকালীন প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীন বিমানবাহিনীর একজন সিনিয়র অফিসারের বদলির ফাইল নিয়ে রাষ্ট্রপতি সাত্তারের কাছে যান। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সাত্তার ওই বদলি অনুমোদন না করে ফাইলটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁর কাছে পাঠানোর জন্য বলেন। সদরুদ্দীন তাতে অপমানিত বোধ করেন এবং বলেন, সিনিয়র অফিসারদের বদলি সামরিক প্রধানরা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করেই করে থাকে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়ও তাই হয়েছিল। আমি বিমানবাহিনীর প্রধান এবং আপনি আমার সুপ্রিম কমান্ডার ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী, তাই বিষয়টি নিয়ে আপনার আমার সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করা উচিত। 

তার পরও রাষ্ট্রপতি সাত্তার ফাইলটি অনুমোদন করতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং বিরক্তির সঙ্গে ফাইলটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁর কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে উত্তপ্ত বাগবিতণ্ডা হয় এবং একপর্যায়ে সদরুদ্দীন ফাইলটি তাঁর সামনে ঠেলে দিয়ে বলেন, বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে আমার প্রতি যদি আপনার কোনো আস্থা না থাকে তাহলে আমি আর এই পদে থাকতে চাই না। আপনি অন্য একজন এয়ার চিফ নিয়োগ করুন। এই বলে তিনি রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ওইদিনই পদত্যাগ করেন। 

এ থেকে বোঝা যায় যে-সিনিয়র অফিসারের বদলির জন্য সদরুদ্দীন রাষ্ট্রপতি সাত্তারের কাছে গিয়েছিলেন তাঁর সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে কেউ আগেই অবহিত করেছিল যাতে ওই বদলি কার্যকর করা না হয়। যাহোক, পরে রাষ্ট্রপতি সাত্তার এরশাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সদরুদ্দিনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। 

সদরুদ্দীন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে জানতাম। তিনি অত্যন্ত সৎ, দক্ষ, দেশপ্রেমিক ও একজন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন অফিসার ছিলেন। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘অ্যান অনেস্ট ম্যান ডাজ নট মেক হিমসেলফ এ ডগ ফর দি সেক অফ এ বোন’। সৎ, সাহসী, দক্ষ ও চরিত্রবান লোকের মূল্যায়ন আমাদের সমাজে নেই। বর্তমানে তিনি আমেরিকায় বসবাস করছেন। 

প্রসঙ্গত বলতে হয়, সদরুদ্দীনের ঘটনার ঠিক ১৫ বছর পর ১৯৯৬ সালের মে মাসে দুজন অফিসারকে অবসর দেওয়ার একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ও সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের দ্বন্দ্বের ফলে দেশে এক সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রপতি বিশ্বাস সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের সঙ্গে আলোচনা না করেই দুজন অফিসারকে প্রশাসনিকভাবে বাধ্যতামূলক অবসর দেন। জেনারেল নাসিম এতে ক্ষুব্ধ হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে ওই আদেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। রাষ্ট্রপতি তাঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন এবং ওই দুই অফিসারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ তোলেন। 

তার পরের ঘটনা সবার জানা। জেনারেল নাসিম তাঁর তথাকথিত অনুগতদের বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে ঢাকায় জড়ো করার চেষ্টা করেন যা বিদ্রোহের শামিল। ফলস্বরূপ তাঁকে বরখাস্ত ও সেনাবাহিনীর দ্বারাই বন্দি করা হয়। তাঁর এই অনৈতিক কাজের জন্য আরো কয়েকজন অফিসারের চাকরি খোয়া যায়। 

অথচ সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল নাসিমের উচিত ছিল রাষ্ট্রপতি যেহেতু তাঁর ওপর আস্থা দেখাননি, এমনকি তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করেছেন; তখন একজন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন অফিসার হিসেবে তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করা। যেমনটি এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীন ১৫ বছর আগেই করেছেন। তা করলে জেনারেল নাসিমকে পরবর্তী সময়ের অপমানজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না এবং আরো অনেকগুলো অফিসারের চাকরিও যেত না। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত হয় আমার চাকরি 

যাহোক, আবার নিজের কথায় ফিরে আসি। পরিশেষে ‘৮১ সালের অক্টোবর মাসে আমার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। আমাকে প্রেষণে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের জন্য এ মর্মে রাষ্ট্রপতির এক আদেশ জারি করা হলো যে, ‘মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রমের চাকরি পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত “জাতীয় স্বার্থে” রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো। এদিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে আসছিল এবং বিএনপির প্রায় মন্ত্রী ও নেতারা এবং অন্য অনেক রাজনীতিবিদ ও মুখচেনা লোক সেনাপ্রধান এরশাদের কার্যালয়ে খোলাখুলিভাবে যাতায়াত করতে শুরু করল। এ থেকে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, সেনাপ্রধান এরশাদের ইঙ্গিতেই দেশ চলছিল এবং দেশের ক্ষমতা দখল তাঁর জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *