এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – ৬

জাতীয় নিরাপত্তার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদলের স্বার্থরক্ষা 

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার প্রতিনিধি হিসেবে ইউরোপের জার্মানি, সুইডেন, বেলজিয়ামসহ অন্যান্য দেশের দায়িত্ব অর্পিত ছিল আমার ওপর। আমার আসল ও প্রধান কর্তব্য ছিল জাতীয় স্বার্থ-সম্পর্কিত তথ্যসংগ্রহ এবং সরকারকে তা অবহিত করা। তা ছাড়া লন্ডন মিশনে তখন প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতিনিধি না থাকায় আমাকেই তা দেখাশোনা করতে হতো। ফলে সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রে আমার দায়িত্ব নির্ধারিত ছিল। বাংলাদেশে তখন জাতীয় গোয়েন্দা নিরাপত্তা প্রধান ছিলেন এ বি এস সাফদার এবং জনাব হুদা নামে পুলিশের এক কর্মকর্তা ছিলেন বহিবিষয়ক পরিচালক। 

লন্ডনে আমার চাকরির অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। বরং আমার ধারণা হয়েছিল, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা জাতীয় স্বার্থরক্ষা করার চেয়ে ক্ষমতাসীন সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। লন্ডনে ওই পদে থাকাকালীম আমি কোনো বিশেষ গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হওয়া বা নিজ দায়িত্বের কাজে গুরুত্ব দেওয়ার পরিবর্তে অনেক সময়ই ভিন্নরকম নির্দেশ পেয়েছি। বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর নজর রাখা, আওয়ামী লীগপন্থী, বিরুদ্ধবাদী ইত্যাদির ব্যাপারে উচ্চমহল ও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিতকরণের জন্য দেশ থেকে নির্দেশ দেওয়া হতো। ফলে আমার মনে হয়েছে, জাতীয় স্বার্থরক্ষাকারী এ সংস্থাটি তার নিজস্ব রূপ হারিয়ে ক্ষমতাসীন দলের একটি অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু ক্ষমতাসীন দলের সার্বিক স্বার্থরক্ষামূলক ভূমিকার কারণে ক্ষমতাসীনদের পছন্দের লোকদেরই এ ধরনের পদে নিয়োগ করারও প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। বস্তুতপক্ষে এর ফলে জনগণের টাকার অপব্যবহার করা হয়েছে এবং দেশের স্বার্থ ব্যাহত হয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ হিসেবে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এসব সংস্থার কার্যকলাপের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সেসব দেশে আইন রয়েছে এবং তা জাতীয় সংসদে সংশ্লিষ্ট কমিটির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে। 

ম্যাসকারেনহাস সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেননি

লন্ডনে থাকাকালীন আমার সঙ্গে বাংলাদেশবিষয়ক দুজন প্রথিতযশা বিদেশী সাংবাদিকের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। এদের একজন লরেন্স লিপশুলজ এবং অন্যজন অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস। লরেন্স লিপশুজলের লেখা ‘বাংলাদেশ দি আনফিনিশড রেজুলিউশন’ অনেকেই পড়ে থাকবেন। আমার মনে হয়, ওই বইতে অনেক তথ্য ভুল আছে এবং তাঁর মতামতের সঙ্গে আমি একমত নই। এ সম্বন্ধে লন্ডনে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে আমার বিস্তারিত আলাপ হয়েছিল। এমনকি তাঁর ওই বইয়ের ওপর আমাকে মতামত দেওয়ার জন্যও তিনি অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা, তাই কোনো মতামত দিতে অপারগতা জানাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যান্য ঘটনার প্রতি লিপশুলজের উৎসাহ থাকায় তাঁকে আমার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগত। তাঁর রাজনৈতিক ধ্যানধারণায় আমার মনে হতো তিনি মার্কসবাদী। অবশ্য তাঁর মা-বাবা অনেক ধনী ছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে লন্ডনে আমার পরিচয় হয়, যখন তাঁরা আমেরিকা থেকে সেখানে বেড়াতে আসেন। ঠাট্টাচ্ছলে আমি লিপশুলজকে প্রায়ই বলতাম, আমার মা-বাবা ধনী হলে আমিও তোমার মতো মার্কসবাদী হতাম। 

অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস বাংলাদেশে সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর লেখা রেপ অফ বাংলাদেশ বইটি এবং ‘৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকার জন্য তাঁর এই ব্যাপক পরিচিতি। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানের করাচিতে একটি পত্রিকায় কাজ করতেন। এপ্রিল মাসে পালিয়ে লন্ডনে এসে সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস, বর্বর হত্যাযজ্ঞের বিবরণী লিখে বিশ্ব জনমতকে সজাগ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশ সম্বন্ধে সানডে টাইমসে লিখতেন। 

আমি লন্ডনে যাওয়ার পর বছরখানেকের মধ্যে লন্ডনস্থ সোনালী ব্যাংক ইউনিয়ন ও ব্যবস্থাপনা পরিষদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধে। এর তদন্তের ভার দেওয়া হয় আমাকে। তদন্তের একপর্যায়ে সোনালী ব্যাংক ও ম্যাসকারেনহাসের কিছু তথ্য আমার নজরে আসে। ম্যাসকারেনহাস সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ২০ হাজার পাউন্ড ঋণ নিয়েছিলেন। পরে তা সুদসহ ২৪ হাজার পাউন্ডে দাঁড়ায়। সেদিনের হিসেবে এই টাকার অঙ্ক বেশ বড়। ঋণ দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের নির্দেশে। তাঁকে ওই ঋণ পরিশোধের কথা বলা হলে তিনি তা ফেরত দিতে পরোক্ষভাবে অস্বীকৃতি জানান এবং তাঁকে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ উপরমহলের নির্দেশে ওই অর্থ দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এসব বিষয় জানার পর এবং অন্যান্য আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণের পর তাঁর সম্পর্কে আমার ধারণা অনেকটা বদলে যায়। 

এ পর্যায়ে আমি সরকারকে অবহিত করি, তাঁকে যেন বাংলাদেশে তেমন গুরুত্ব দেয়া না হয়। পরে তাঁকে আর ঢাকাতে ততো গুরুত্ব কিংবা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি, যা বিদেশী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে সচরাচর দেওয়া হলো দেশে এলে। ম্যাসকারেনহাস সে সময় বাংলাদেশ থেকে ঘুরে গিয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে কর্নেল ফারুকের একটি সাক্ষাৎকার ছাপান। ওই সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য ছিল তদানীন্তন জিয়া সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করা। আমি দূতাবাসের প্রেস কাউন্সিলর মাহবুবুল আলমের মাধ্যমে (বর্তমানে ঢাকায় ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার সম্পাদক) সানডে টাইমস পত্রিকার সম্পাদককে স্বাধীনতার পরপর ম্যাসকারেনহাস বাংলাদেশ থেকে যে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছিলেন সে সম্পর্কে পরোক্ষভাবে অবহিত করি। এসব জানার পর সানডে টাইমস পত্রিকার প্রধান সম্পাদক তাঁকে আর বাংলাদেশ-সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে ওই পত্রিকায় লিখতে দেননি 

ইতিমধ্যে একদিন ম্যাসকারেনহাস প্রেস কাউন্সিলর মাহবুবুল আলমকে টেলিফোনে খুব রাগান্বিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তাঁর ভাষা ছিল ‘হোয়াই মইন ইজ ট্রাইং টু ওয়ারি মি?’ এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, পরবর্তী সময়ে ১৯৮৬ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকারের পরোক্ষ মদদে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ম্যাসকারেনহাস লেগ্যাসি অফ ব্লাড নামে আর একটি পুস্তক রচনা করেন। বইটি ভালোভাবে পর্যালোচনা করলে তাঁর লেখার উদ্দেশ্য ও প্রেরণা সহজেই অনুধাবন করা যায়। 

শেখ মুজিবের ছবিসম্বলিত টাকা পোড়ানো হয় 

১৯৭৬ সালের প্রথম দিকের একটা ঘটনার কথা এখানে বলতে হয়। ঢাকা থেকে নির্দেশ যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুজন প্রতিনিধি যাবেন বিশেষ কাজে, তাঁদের সহায়তা করতে হবে। ওই সময় লন্ডনের অদূরে মুদ্রা ছাপানোর কোম্পানি ব্রেডবারিতে ছাপানো শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি অঙ্কিত বিভিন্ন মানের নোটে কোটি কোটি টাকা জমা ছিল। ওই অর্থ পুড়িয়ে ফেলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই দুজন কর্মকর্তাকে লন্ডন পাঠানো হয়। তাঁরা গিয়ে যথারীতি কাজ শেষ করেন। দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে টাকা ছাপানো ও পোড়ানোর যাবতীয় খরচ বাংলাদেশ সরকারকেই বহন করতে হয়েছিল। 

লন্ডনে ভাসানীর চিকিৎসা 

‘৭৬ এর খুব সম্ভব মাঝামাঝিতে ঢাকা থেকে খবর আসে মওলানা ভাসানী অসুস্থ এবং চিকিৎসার জন্য তাকে লন্ডনে পাঠানো হবে। তাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। সরকারি খরচে লন্ডনে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য বলা হলো। কয়েকদিন পর ছেলে নাসের ভাসানী ও পার্টির নেতা আবদুস সাত্তারকে নিয়ে ভাসানী লন্ডনে আসেন। তাকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। আমি প্রায়ই তাকে দেখতে ক্লিনিকে যেতাম। তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হতো। দেশভাগের আগে তিনি যখন আসামে রাজনীতি করতেন তখন থেকেই সিলেটের আমার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনকে তিনি চিনতেন। ফলে তার সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, বিলেতের কলকারখানা, বিল্ডিং-ইমারত এসব আমাদের দেশের সম্পদ লুট করেই করা। তাই এগুলোর ওপর আমাদের হক আছে। লন্ডনে অবৈধ বাঙালিদের প্রসঙ্গ উঠলে তিনি বলতেন, বাঙালিদের অধিকার আছে এই দেশে থাকার এবং কাজ করার। বৈধ অবৈধ আবার কি? 

মওলানা ভাসানিকে আমি এর আগে কখনো সামনাসামনি দেখিনি। আমার মনে হয়েছে তিনি একজন ইন্টারেস্টিং পলিটিক্যাল পার্সনালিটি। আগে কখনও না দেখলেও ১৯৬৯ সালে আমি তার সম্পর্কে একটি গল্প শুনেছি । তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক এবং জিওসি মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা আমাকে ঐ গল্পটি বলেন। আমি তখন তার এডিসি। তবে যেহেতু মিলিটারি একাডেমিতে তার ছাত্র ছিলাম তাই আমাদের মধ্যে অত্যন্ত আন্তরিক ও খোলামেলা সম্পর্ক ছিল 1 

ঘটনাটি এরকম। ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ভাসানীকে বিষয়টি জানানো হলো। কিন্তু তিনি ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি। পরে সেনাবাহিনীর লোকজন গিয়ে টাঙ্গাইলের সন্তোষ থেকে তার কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। রাতে তৎকালীন ১৪ ডিভিশনের অফিসার্স মেসে (বর্তমানে আর্মি হেডকোয়ার্টার অফিসার্স মেস) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। বৈঠকে ইয়াহিয়া খান মওলানা ভাসানীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘মওলানা সাব, মাশরেকি (পূর্ব) পাকিস্তান মে হামকো কেয়া কেয়া এডমিনিস্ট্রেটিভ কাম করনা চাহিয়ে, জ্যেইসে ইহাকা লোক খোশ হো।’ ভাসানী উর্দুতে বললেন, ‘ইয়ে আপকো পাতা হোনা চাহিয়ে। কিউকে এডমিনিস্ট্রেশন আপকা কাম হে।’ ইয়াহিয়া খান হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘তো আপকা কাম স্রেফ এজিটেশন হ্যায়?’ ভাসানী মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, হামারা কাম এজিটেশন হ্যায়। 

এখানে বলতে হয়, এ ধরনের মিটিংয়ের আগে জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাধারণত মদ্যপান করতেন এবং এর প্রভাব তার কথাবার্তায় থাকত। আমার মনে হয়েছে, মওলানা ভাসানীর প্রতি উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের কিছুটা সহানুভূতি ছিল। খুব সম্ভবত তার ভারতবিরোধী এবং চীনপন্থী প্রীতির কারণে তাকে তারা কিছুটা পছন্দ করত। 

কর্ণেল তাহেরের ফাঁসি ও প্রতিক্রিয়া 

লন্ডনে থাকাকালীন আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে কর্নেল তাহেরের ফাঁসির প্রতিক্রিয়া। জিয়া যখন মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তাহেরের ফাঁসির আদেশ জারি করেন, লন্ডনে এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে এক বাঙালি মহিলা (তাঁর পরিচয় এখন মনে নেই) দূতাবাসের সামনে অনশন শুরু করেন। খবরের কাগজে তাঁর ছবি ছাপা হয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাহেরের ফাঁসি কার্যকর হয়। উল্লেখ্য, সামরিক বাহিনীতে উসকানি ও নাশকতামূলক কাজের জন্য ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর পর তাহের, জলিল, রবসহ জাসদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আটক করা হয়েছিল। মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে বিচার করে তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য স্থানীয় পত্রিকায় সরকারের সমালোচনা করা হয়। 

ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে আলোচনা 

লন্ডন থাকাকালীন অন্য একটি ঘটনাও উল্লেখ করতে চাই। বাংলাদেশের সাবেক আইন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন শেখ মুজিব হত্যার পর থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। আমি বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর মুফলেহ ওসমানীর (পরে রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব) মাধ্যমে অনুরোধ জানাই যে, তাঁর সঙ্গে আমি বাংলাদেশের সেই সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করতে চাই। তিনি প্রথমে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। পরে আমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর এবং বিশেষ করে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা সে হিসেবে দেখা করতে অনুরোধ জানানোর পর তিনি রাজি হন। আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট একটি কক্ষে দূতাবাসের কাউন্সিলর ওসমানীকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি 

আলাপের শুরুতেই তিনি জানতে চান, রাষ্ট্রপতি মুজিব হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কেন তৎকালীন সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না? একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ ব্যাপারে তিনি আমার অভিমতও জানতে চান। আমি তাঁকে বলি, রাষ্ট্রপতি মুজিব ও তাঁর পরিবার এবং আওয়ামী লীগের অন্য শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। আমি আরো বলি যে, সব রকমের হত্যাকাণ্ডের আমি বিরোধী। আমি সিরাজ শিকদার হত্যারও বিচার হওয়া উচিত বলে মত ব্যক্ত করি। তিনি উত্তরে আমার অভিমতের সপক্ষে সায় দেন। একপর্যায়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, বর্তমান সরকার যদি তাঁকে মন্ত্রিপরিষদে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানায় তবে তিনি তাতে যোগ দেবেন কি না। আমার প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে যান। আমার মনে হয়েছিল ওই সরকারের মন্ত্রিপরিষদে যোগ দিতে তিনি উৎসাহী ছিলেন না। 

লন্ডনে থাকাকালীন আমার সঙ্গে ভারতের নির্বাসিত নাগা বিদ্রোহী নেতা ড. ফিজুর সঙ্গে পরিচয় হয় (বর্তমানে তিনি প্রয়াত)। তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা মাধ্যমে ভারতে নাগাল্যান্ডের সশস্ত্র বিদ্রোহ সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে অবগত হই। নাগা নেতা ড. ফিজু যদিও দেখতে ছোটখাটো, হালকা-পাতলা গড়নের লোক এবং স্বল্পভাষী ছিলেন, তবু আমার মনে হয়েছিল তিনি অত্যন্ত তেজস্বী, বুদ্ধিমান ও আত্মনিবেদিত প্রকৃতির লোক ছিলেন। 

ঢাকা থেকে খবর পাই কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সভায় যোগদানের জন্য জিয়া লন্ডনে যাচ্ছেন। জিয়ার যাওয়ার কয়েকদিন পূর্বে বেসরকারিভাবে মওদুদ আহমেদ ও জাকারিয়া খান চৌধুরী লন্ডনে গিয়ে হাজির হন। আমার স্থলাভিষিক্ত অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল নুরুল ইসলাম এঁদের পাঠিয়েছেন লন্ডনে জিয়ার জন্য রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য। এজন্য দূতাবাসকে সবরকম সাহায্য করতে বলা হয়। 

লন্ডন-প্রবাসীদের ভূমিকা 

বিদেশে বসবাসকারী আমাদের নাগরিকদের জাতীয় রাজনীতিতে উৎসাহিত ও সম্পৃক্ত করার প্রবণতা প্রতিটি দলেরই রয়েছে। লন্ডনের ক্ষেত্রে এটা আরো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাঙালির বসবাস। ফলে প্রতিটি দলেরই প্রবণতা থাকে এখানে স্বীয় রাজনৈতিক দলের আধিপত্য বিস্তারের। প্রতিযোগিতা চলে ক্ষমতার, লড়াই চলে পেশির। আমি মনে করি, এ ধরনের প্রবণতা আমাদের দেশ তথা বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বার্থের ওপর বিদেশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এতে বিদেশে বসবাসকারী বাঙালিদের ঐক্যে ফাটল ধরে। ফলে বিদেশের মাটিতে সামগ্রিক স্বার্থ আদায়ের পরিবর্তে এরা নিজেদের দলীয় স্বার্থ আদায়ের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকে। মূলত কার্যক্ষেত্রে নিজেরা নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও হানাহানি করে বিদেশীদের চোখে নিজেদেরই হেয় করে তোলে। অন্যভাবে দেখতে গেলে, বিদেশে বসবাসকারী বাঙালিরা স্থানীয় রাজনীতিতে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা যে রাখে না তার পেছনে, আমার মতে, এটাও অন্যতম কারণ। 

একজন মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র সামরিক অফিসার ও সিলেটের লোক হিসেবে লন্ডনের প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে আমার একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আমার নিজের এলাকার অনেক লোক ইস্ট লন্ডন, বার্মিংহাম এসব এলাকায় থাকতেন। দলমত নির্বিশেষে আমি সবার কাছেই যেতাম এবং তাঁরাও আমাকে বেশ শ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন। জেনারেল জিয়ার আমলে আমি লন্ডনে থাকলেও তাঁরা কখনোই আমাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেননি। 

কমিউনিটি লিডার তসাদ্দক আহমদ চৌধুরী যিনি হাইকমিশনে তেমন একটা আসতেন না, তিনিও আমি থাকাকালীন আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং কমিউনিটির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। এ ছাড়া মোহাম্মদ গাউস খান, যিনি শেখ মুজিবের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানসহ সব নেতার সঙ্গেই আমার সুসম্পর্ক ছিল। 

তখন লন্ডনে মূলত প্রখ্যাত সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরীর সম্পাদনায় বাংলার ডাক এবং অলি আশরাফের সম্পাদনায় জনমত নামে দুটো পত্রিকা বের হতো। বাংলার ডাক ছিল আওয়ামী লীগপন্থী এবং ঘোর সরকারবিরোধী। সে সময় লন্ডনে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারের পক্ষে জনমত গঠনের ধুয়ো তুলে একটি বিশেষ মহল সরকারি মদদে আরেকটি বাংলা পত্রিকা বের করার পাঁয়তারা শুরু করে। জিয়ার ক্ষমতাগ্রহণের পর যারা বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধার আশায় তাঁর আশপাশে জড়ো হয় তারাই মূলত এর জন্য উঠেপড়ে লাগে। 

ঢাকা থেকে এ ব্যাপারে আমার মতামত চাওয়া হয়। আমি ওই পত্রিকা প্রকাশের ঘোর বিরোধিতা করি। কারণ সরকারের মদদপুষ্ট পত্রপত্রিকা দিয়ে জনমত গঠন করা কখনোই সম্ভব হয় না। বিশেষ করে লন্ডনের মতো জায়গায় যেখানে লোকজন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের সব ধরনের খোঁজখবর পায় এবং দেশের সঙ্গে প্রায় প্রতি সপ্তাহে তাদের যোগাযোগ হয় সেখানে এ ধরনের পদক্ষেপে হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। এ ধরনের প্রকল্পে সরকারি অর্থের যথেষ্ট অপচয় হয়। বস্তুত এ ধরনের কাজ কিছু লোককে ‘পাউন্ড কামানোর সুযোগ করে দেয়। আমি এর ঘোর বিরোধী ছিলাম। 

লন্ডন থেকে প্রেরিত বার্তায় আমি এও বলি যে, দেশের পরিস্থিতি যদি ভালো হয় তা হলে টাকা-পয়সা অপচয় করে লন্ডনে বাঙালি জনমত গঠনের প্রয়োজন হবে না। এমনিতেই জনমত তৈরি হবে। কারণ বাঙালিরা দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সবসময়ই খবর পায়। যাহোক, আমি যতোদিন লন্ডন দূতাবাসে ছিলাম ততোদিন এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবের মুখ দেখেনি। 

লন্ডনে থাকার সময় আমি প্রবাসীদের সবসময় দেশের দলীয় রাজনীতি করতে গিয়ে প্রবাসে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করতে উৎসাহিত করতাম। বরং তাদের স্থানীয় রাজনীতি ও কাউন্সিল ইত্যাদিতে নিজেদের স্থান করে নিতে উৎসাহিত করতাম। তবে আমার মনে হয়েছে সাধারণ প্রবাসীরা দেশের রাজনীতির প্রতি ততোটা উৎসাহী ছিল না। সুযোগসন্ধানী কিছু লোক সেখানে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের প্রয়াসে রাজনীতির খেলায় অবতীর্ণ হতো এবং নেতা, এমপি, মন্ত্রী ইত্যাদির সঙ্গে ওঠাবসা ও চলাফেরা করে লোকজনের কাছে নিজের ক্ষমতা জাহির করত। সেই সুবাদে, তারা মনে করত, দেশে এসেও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাবে। 

ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান প্রসঙ্গ 

তৎকালীন রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান শেখ মুজিব হত্যার সময়ে দেশের বাইরে ছিলেন। কয়েকদিন পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। তখন রক্ষীবাহিনীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণের প্রক্রিয়া চলছিল। ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি সরাসরি জড়িত ছিলাম, যা আগেই বলেছি। নভেম্বরের ৩ তারিখে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে যদিও ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান সরাসরি জড়িত ছিলেন না তবে বিভিন্নভাবে পরে তাঁকে এক্ষেত্রে সক্রিয় দেখা যায়। ৭ তারিখের অভ্যুত্থানের পর তিনি দেশত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। তবে তাঁর পরিবার তখন ঢাকায় ছিল। কিন্তু ঢাকায় এসে পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো সুযোগ তাঁর ছিল না। 

১৯৭৬ সালে তৎকালীন সিজিএস জেনারেল মঞ্জুর তাঁকে ভারত থেকে ফেরত আনার উদ্যোগ নেন। পরে তিনি ভারত থেকে সরাসরি লন্ডনে আসেন। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লন্ডনে আমি তাঁর দেখাশোনা করি এবং তাঁকে আমেরিকা পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। তিনি সেখানে তার শ্যালক আমেরিকায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে অবস্থান করেন। এরপর ঢাকা থেকে তাঁর পরিবার লন্ডনে আসে এবং পরে আমেরিকায় চলে যায়। বছরখানেক পর নুরুজ্জামানকে হংকং-এ এবং পরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে কনসাল জেনারেল নিয়োগ করা হয়। এরশাদের আমলে তাঁকে প্রথমে ফিলিপাইনে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এবং পরে রাষ্ট্রদূত করে কানাডায় বদলি করা হয়। ১৯৮৬ সালে আমি যখন সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তখন সেখানে ভারতীয় দূতাবাসে হাইকমিশনার হয়ে আসেন ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (র) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান দক্ষিণ ভারতীয় নাগরিক শংকর নারায়ণ। একদিন প্রসঙ্গক্রমে তিনি ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান। নুরুজ্জামান তখন কানাডাতে আমাদের রাষ্ট্রদূত। কিন্তু আমি তা না জানার ভান করে তাঁর সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাই। 

১৯৭৭ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা ও বগুড়া সেনানিবাসে এক সেনা-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অভ্যুত্থানে বেশকিছু সামরিক, বিশেষ করে বিমানবাহিনীর অফিসার নিহত হন। ওই ঘটনার দুদিন পর লন্ডনে তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল এরশাদের টেলিফোন পাই। তিনি ফোনে আমাকে জানান, রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান জিয়া আমাকে সত্বর ঢাকায় আসতে বলেছেন। আমি পরের দিনই আমার স্ত্রী ও কন্যাকে লন্ডনে রেখে ঢাকায় চলে আসি। 

জেনারেল জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরণ 

লন্ডন থেকে ফিরেই জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সেনানিবাসে তাঁর শহীদ মইনুল রোডের বাড়িতে দেখা করি। আমি আসার পূর্বেই ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েমকে সরিয়ে দিয়ে জিয়া নিজেই রাষ্ট্রপতি হন এবং একই সঙ্গে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। তাঁর সঙ্গে ঘণ্টা দুয়েকের মতো আলাপ করে বুঝতে পারি সেনাবাহিনীতে, বিশেষ করে ২ অক্টোবর ১৯৭৭-এ সংঘটিত অভ্যুত্থানের প্রভাব তখনও বিরাজ করছে। পরদিন সকালে সেনাসদরে গিয়ে এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি তখন উপ-সেনাপ্রধান। আমি সবকিছু পর্যবেক্ষণপূর্বক অনুধাবন করি, গত দুবছরে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা বা পরিবেশের খুব একটা উন্নতি হয়নি। সবকিছুই যেন আগের মতো। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে এবং দলাদলি বেড়েছে। অফিসাররা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে কনফিডেন্সের অভাব ছিল। 

এখানে প্রাসঙ্গিক হবে মনে করে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। লন্ডন থেকে দেশে ফেরার কয়েকদিন পর সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার অফিসকক্ষে বসে তিনি, আমি ও জেনারেল এরশাদ কথা বলছিলাম। জেনারেল জিয়া সে সময় আমাকে বললেন, লন্ডনে তোমার জায়গায় একজন যোগ্য অফিসার পাঠানো দরকার। কাকে পাঠালে ভালো হয় বলে তুমি মনে কর। আমি উত্তরে কর্নেল সাবিউদ্দীনকে (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার, আমেরিকায় বসবাস করেন) পাঠানোর সুপারিশ করি। সঙ্গে সঙ্গে উপ-সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ, যিনি আমার পাশে ছিলেন, বললেন, ‘তুমি জান না, হি ইজ নট আওয়ার ম্যান।’ আমি একটু হতবাক হলাম এবং তাঁকে বললাম, আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন তা আমি বুঝতে পারছি না। আমরা সবাই তো সেনাবাহিনীর লোক এবং আমাদের প্রধান কাজ দেশের প্রতি সর্বতোভাবে অনুগত থাকা। আমি একটু রূঢ় ভাষায়ই বললাম, ‘আই অ্যাম অলসো নট এনিবডিজ ম্যান, মাই লয়ালিটি ইজ টু মাই কান্ট্রি অ্যান্ড আর্মি।’ এ সময় জেনারেল জিয়া একটু উঁচুস্বরে চুপ করো, চুপ করো’ বলে আমাদের থামিয়ে দিলেন। 

কর্নেল সাবিউদ্দীনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত জানাশোনা ছিল না। আমরা একসঙ্গে কখনও চাকরি করিনি। তিনি ছিলেন সিগন্যাল কোরের একজন অফিসার। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা স্কুলের ইনস্ট্রাক্টরও ছিলেন একসময়। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগমনের পর তাঁকে ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের অধীনে প্রেষণে রক্ষীবাহিনীর পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হলে তিনিও আর্মিতে ফিরে আসেন এবং তখন সেনাসদরে চাকরিরত ছিলেন। গোয়েন্দাকাজে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য যোগ্যতা বিবেচনা করে আমি তাঁর নাম প্রস্তাব করি। যাহোক, পরে কর্নেল মোতাহের নামে আরেকজন পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসারকে লন্ডনে পাঠানো হয়। পরে তিনি কর্নেল হিসেবেই অবসর গ্রহণ করেন। 

মীর শওকত ও মঞ্জুরের দ্বন্দ্ব 

আমি মনে করি, সে সময়ে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের যে অভাব ছিল তার বহু কারণ ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সেনাবাহিনীতে নিজেদের প্রাধান্যবিস্তারের লক্ষ্যে জেনারেল মঞ্জুর ও জেনারেল মীর শওকত আলীর মধ্যে প্রতিযোগিতা। বস্তুতপক্ষে এঁরা দুজনেই মুক্তিযোদ্ধা। একজন আরেকজনের দীর্ঘদিনের পরিচিত। অথচ শুধু প্রাধান্যবিস্তারের প্রতিযোগিতার ফলেই দুজনের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় এবং সেনাবাহিনীতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। 

পাকিস্তানফেরত কিছু-কিছু অফিসার এই রেষারেষিকে জিইয়ে রাখতে সহায়তা করতেন। কারণ তাঁরা জানতেন এটা করতে পারলে তাঁদেরই সুবিধা। আমি ঢাকা আসার আগে সেনাপ্রধান জিয়া একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে জেনারেল মঞ্জুর ও মীর শওকতকে ঢাকা থেকে বদলি করেন। মীর শওকতকে যশোরের জিওসি এবং মঞ্জুরকে চট্টগ্রামের জিওসি করা হলো। মীর শওকতের স্থলাভিষিক্ত করা হলো মেজর জেনারেল শামসুজ্জামানকে। মঞ্জুরের স্থলে জেনারেল মান্নাফকে চিফ অফ জেনারেল স্টাফ করা হলো। এঁরা দুজনেই ছিলেন পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসার। 

সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ও ঐক্যের ক্রমাবনতির আরেকটা কারণ ছিল সেনাপ্রধান জিয়া সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ায় দেশের রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। ফলে সেনাবাহিনীর নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করা কিংবা খেয়াল রাখার অভিপ্রায় কোনোটাই তাঁর ছিল না। আমি আসার আগ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার নুরুল ইসলাম ছিলেন জিয়ার পিএসও এবং একই সঙ্গে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল। তিনি আর্মির কাজের চেয়ে জিয়ার রাজনৈতিক কাজ ও তাঁর জন্য দলগঠন নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে এই নুরুল ইসলামই লিবিয়া গিয়ে মুজিব হত্যাকারীদের ফরেন সার্ভিসে আত্তীকরণের ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ নেন। ফারুক-রশীদ ছাড়া বাকি সবাইকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণ করা হয়। রশীদ ও ফারুক লিবিয়ায় ব্যবসায় জড়িত ছিল বলে তারা ওই প্রস্তাবে সায় দেয়নি। যাহোক, সে সময় আমি জিয়াকে নিষেধ করি যেন এদের এভাবে বৈদেশিক চাকরিতে সুযোগ দেওয়া না হয়। কারণ, এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে বলে আমি তাঁকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাই। কিন্তু জেনারেল জিয়া সবকিছু উপেক্ষা করে নুরুল ইসলাম ও অন্যান্য কিছু লোকের সুপারিশে এদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণ করেন। 

মুজিব হত্যাকারীদের সঙ্গে আপস করিনি 

অদৃষ্টের খেলায় অনেক পটপরিবর্তন হয়েছে। আমাকেও সেনাবাহিনী ছেড়ে হতে হয়েছিল রাষ্ট্রদূত। কিন্তু নীতির প্রশ্নে এবং বিবেককে শুদ্ধ রাখার তাগিদে নিজের ভালোমন্দ তোয়াক্কা না করে পরবর্তী সময়েও নিজের অবস্থানে অটল ছিলাম। ১৯৭৬ সালে যেমন মুজিব হত্যাকারীদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণ না করার জন্য জিয়াকে অনুরোধ করেছিলাম তেমনি ১৯৮২ এবং ১৯৯৪ সালেও এদের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন করিনি। 

১৯৮২ সাল, এরশাদ তখন ক্ষমতায়। আমি ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। আলজেরিয়া থেকে মুজিবহত্যার সঙ্গে জড়িত তৎকালীন কাউন্সিলর মেজর মহিউদ্দীনকে (বর্তমানে কারারুদ্ধ) জাকার্তায় বাংলাদেশ দূতাবাসে বদলি করা হয়। আমি তাকে আমার দূতাবাসে নিতে অস্বীকৃতি জানাই। জেনারেল এরশাদের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ আর এস দোহাকে আমি সরাসরি বলি, দেশের রাষ্ট্রপতিহত্যার সঙ্গে জড়িত এসব উচ্ছৃঙ্খল অফিসারকে আমি আমার সঙ্গে চাকরি করতে দিতে রাজি নই। পরে ফিলিপিন থেকে তার স্থলে মোতাহার হোসেনকে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি ওআইসিতে চাকরি করেন। 

১৯৯৪ সালে আবারও একই রকম সমস্যায় পড়তে হয়। আমি তখন অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। বেগম খালেদা জিয়া সরকারপ্রধান। সে সময় মুজিবহত্যার সঙ্গে জড়িত লে. কর্নেল পাশাকে জিম্বাবুয়ে থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আমার অধীনে বদলি করা হলে আমি তাকে গ্রহণ করতে অপারগতা জানাই। পাশার বদলির আদেশ পেয়ে আমি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের (বর্তমানে প্রয়াত) সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। তাঁকে না পেয়ে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মহিউদ্দীন আহমদের (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ও নেপালে রাষ্ট্রদূত) সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে জানান, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মানবিক কারণে তাঁকে অস্ট্রেলিয়ায় বদলি করা হয়েছে। আমি তাঁকে বলি যে, আপনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিন, আমি কোনো অবস্থাতেই কর্নেল পাশাকে আমার দূতাবাসে নিতে রাজি ন‍ই। তিনি আমাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। ফলে আমি বিষয়টি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সরাসরি জানাই এবং আমার অবস্থান ব্যাখ্যা করি। তিনি বলেন, চিকিৎসার স্বার্থে তাকে সেখানে বদলি করা হয়েছে এবং আমাকে তা গ্রহণ করতে হবে। এর পরও আমি তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাই এবং বলি, প্রয়োজনে আমাকে দেশে নিয়ে আসতে পারেন। তিনি আমাকে এ বিষয়ে পরে জানাবেন বলে জানান। সপ্তাহখানেক পরে পাশার বদলির আদেশ প্রত্যাহার করা হয় এবং তার স্থলে জাপান থেকে মোস্তাকিমকে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি হংকং-এ বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল। 

যাহোক, সে সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার শেখ মুজিব হত্যায় জড়িত অফিসারদের ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বরের পর দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর তাঁরা মনে করেছিলেন দেশে আসতে পারবেন। কিন্তু জিয়া তাঁদের সে সুযোগ দেননি। তবে এদের মধ্যে ফারুক, রশীদ ও ডালিম সরকারের বিনা অনুমতিতে দুএকবার দেশে এসেছিল। কিন্তু বিভিন্ন উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে আবার তাদের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ফারুককে একবার গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। পরে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় ফারুক-রশীদদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়ে জিয়া বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবকে বরখাস্ত করেন। মোশতাকের সময় এরাই তাঁকে জার্মানি থেকে ডেকে এনে বিমানবাহিনীর প্রধান বানান। ফারুক-রশীদ ছাড়া মুজিবহত্যার সঙ্গে জড়িত বাকি সবাই চাকরি নেয়। এদের মধ্যে কমিশন্ড র‍্যাংকের নিচের কয়েকজন, যেমন হাবিলদার মারফত আলী শাহ ও মোঃ আবদুল বারীকে নিম্নপদে চাকরি দেওয়া হয়। 

ব্রিগেডিয়ার নুরুল ইসলামের সঙ্গে কাজী জাফর আহমদ, মওদুদ আহমেদ, ডা. মতিন, মশিউর রহমান এসব রাজনীতিবিদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং যাতায়াত ছিল। ফলে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা দেখার সময় তাঁর ছিল না। তিনি নিজেকেও একজন ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে তৈরি করছিলেন এবং পরে জিয়ার আমলে তিনি মন্ত্রীও হন। 

আর্মি আইন সংশোধন 

১৯৭৮ সালে জিয়া আর্মি আইন সংশোধন করে সেনাবাহিনীতে কর্মরত থেকেই রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করেন। জিয়ার বিপক্ষে জেনারেল ওসমানীকে দাঁড় করানো হয়। জিয়া বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এর আগের হ্যাঁ-না ভোটের তুলনায় ওই নির্বাচন নিরপেক্ষ ছিল। সরকারপ্রধান হিসেবে ১৯৭৭ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদানের লক্ষ্যে উপদেষ্টাদের পরামর্শে জেনারেল জিয়া হ্যাঁ-না ভোটের প্রহসন করেন। ওই নির্বাচনকে দেশে ও বিদেশে হাস্যকর নির্বাচন হিসেবে গণ্য করা হয়। অবশ্য সেনা আইন সংশোধন করে করা পরবর্তী নির্বাচনের সময় জিয়ার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল। 

আইন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন ড্রাফটিং ইন-চার্জ যুগ্মসচিব আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী আর্মি আইনের খসড়া নিয়ে আসেন যাতে করে জিয়া সেনাবাহিনীতে থেকেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। আমি তখন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে সামরিক আইনকানুন দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাই খসড়ার ওপর কুদ্দুস সাহেব আমার মন্তব্য জানতে চাইলে আমি বলি, ‘ফিল্ড মার্শাল’-এর স্থলে ‘মেজর জেনারেল’ শব্দ প্রতিস্থাপন করলেই তো হয়-এর জন্য খসড়া আইন তৈরির কী দরকার ছিল। তিনি আমার এ বক্তব্যে মনঃক্ষুণ্ণ হন এবং চলে যান। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানও ফিল্ড মার্শাল থাকাকালীন এক সামরিক আদেশবলে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী পরেও বিভিন্ন সংশোধনীর উদ্যোক্তা ছিলেন এবং এরশাদের আমলে সচিব ও বিচারক হন। 

এরশাদ জিয়াকে রাজনীতিতে উৎসাহিত করতেন 

ওই বছরই জিয়ার পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মদদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হলো জাগদল বা জাতীয় গণতান্ত্রিক দল। এদের সমন্বয়ে পরবর্তী সময়ে জিয়া গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা সংক্ষেপে বিএনপি। ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়ে শুরু হয় সংগঠনের কার্যক্রম। বিভিন্ন দল থেকে ছুটে আসে রাজনীতিবিদগণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় জাতীয় গোয়েন্দা নিরাপত্তা, সামরিক নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন আমলা, ব্যবসায়ী ও কিছু সাংবাদিকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনগোষ্ঠী। ক্ষমতার লোভে এবং বিভিন্ন সুবিধাপ্রাপ্তির আশায় নতুন ওই দলে অনুপ্রবেশ ঘটে অনেক ভুঁইফোঁড় নেতার। অনেক অখ্যাত অথচ হঠাৎ-ধনবান এবং কিছু স্বাধীনতাবিরোধী লোকজন ওই দলে ভিড়ে যায়। 

ব্রিগেডিয়ার নুরুল ইসলামের সঙ্গে মেজর জেনারেল এরশাদের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আমি যখন লন্ডন থেকে ঢাকায় আসি এরশাদ তখনও উপ-সেনাপ্রধান। এরশাদ ভারতে প্রশিক্ষণে থাকা অবস্থাতেই রাষ্ট্রপতি মোশতাক, ওসমানী, ফারুক ও রশীদের সমর্থনে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান এবং উপ-সেনাপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন। উপ-সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এরশাদ জিয়াকে রাজনীতিতে জড়ানোর জন্য উৎসাহিত করতেন। এর পেছনে লুকানো ছিল এরশাদের নিজের স্বার্থ এবং ভবিষ্যতের উচ্চাভিলাষী আকাঙ্ক্ষা। এ ছাড়া অন্যান্য কিছু সুবিধাবাদী, অপেশাদার সামরিক অফিসার ও তথাকথিত কিছু নেতা যাঁরা স্বাধীনতার পর রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেননি তাঁরা জিয়াকে রাজনীতিতে জড়ানোর জন্য উৎসাহ যোগাতেন। 

এরশাদের উচ্চাভিলাষ ও ক্রমোন্নতি 

জেনারেল এরশাদের সঙ্গে আমার পরিচয় বহুদিনের। ১৯৬৪ সালে এরশাদ যখন ক্যাপ্টেন, তখন আমি যশোরে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট। এরশাদকে অফিসার্স ট্রেনিং স্কুল থেকে স্বল্পমেয়াদি কমিশন্ড অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। এই অফিসার প্রশিক্ষণ স্কিম ছিল স্বল্প সময়ের জন্য। যুদ্ধের প্রয়োজনে ১৯৪৮ সালের কাশ্মীর যুদ্ধের পর ১৯৫০-এর প্রথম দিকে জরুরি ভিত্তিতে পাকিস্তানের কোহাট শহরে এ প্রশিক্ষণ চালু করা হয়েছিল। 

অফিসার্স ট্রেনিং স্কুল নামে ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মাত্র ৯ মাসের ট্রেনিংয়ের পর এদের স্বল্পমেয়াদি কমিশন দেওয়া হতো। বয়সসীমা এবং অন্য শর্তাবলি শিথিল করার কারণে অনেকে অন্য চাকরি ছেড়ে এতে যোগ দেয়। পরে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের আমলে ওই ট্রেনিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়া অধিকাংশকে লেফটেন্যান্ট, ক্যাপ্টেন ইত্যাদি পদে থাকাকালে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কারণ এদের ব্যাপারে শর্তই ছিল সরকার ইচ্ছা করলেই তাদের অব্যাহতি দিতে পারবে। স্কিম এক্স-এর অধীনে এরশাদের ব্যাচের অনেককেই মাত্র কয়েক বছর চাকরি করার পর অব্যাহতি দেওয়া হয়। 

১৩ বছর চাকরির পর ১৯৬৫ সালে এরশাদ মেজর পদে উন্নীত হন। একজন দক্ষ, চৌকস ও বিচক্ষণ সেনাকর্মকর্তা হিসেবে যদিও তাঁর সুনাম ছিল না, কিন্তু ‘চতুর সামাজিক যোগাযোগের’ ক্ষেত্রে তাঁর প্রচুর দক্ষতা ছিল। যেমন তিনি জেনারেল ওসমানীর প্রিয়পাত্র হতে পেরেছিলেন। পাকিস্তান-প্রত্যাগত এরশাদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৭৩ সালে। এরপর মাত্র সাত বছরে তিনি লে. কর্নেল থেকে তরতর করে লে. জেনারেল ও সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে যান। আর আট বছরের মাথায় তিনি সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। 

আমি আগেই উল্লেখ করেছি, তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অনৈক্যের একটা প্রধান কারণ ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা সেনা-অফিসারদের দ্বন্দ্ব। এরশাদ উপসেনাপ্রধান হওয়ায় এ সুযোগকে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে কাজে লাগান। তিনি এদের মধ্যে বিভেদের ফাটল সৃষ্টি করেন। মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের দাবিয়ে রেখে অমুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধার পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেন। তখন মেজর জেনারেল পদমর্যাদার সেনা অফিসারদের মধ্যে চারজন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এই চারজনের মধ্যে একজন ছিলেন ডা. শামসুল হক। বাকি তিনজন মীর শওকত, মঞ্জুর ও আমি। আবার এঁদের মধ্যে দুজন –শওকত ও মঞ্জুরের সম্পর্ক ভালো ছিল না, যা আগেই বলেছি। 

২৮ জন কর্নেলের পদোন্নতি 

রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য জিয়াকে এরশাদ খুব উৎসাহিত করতেন যা আগেই বলেছি। এরশাদ জিয়াকে প্রায়ই বলতেন, ‘আপনি সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে খুব জনপ্রিয়।’ অথচ আমার মতে, তখন জিয়ার জনপ্রিয়তা ক্রমাবনতির দিকে। সে সময়ের একটি ঘটনার কথা বলতে পারি যা সেনাবাহিনীতে বেশ অসন্তোষ সৃষ্টি করে। কোনোরকম যোগ্যতার বিচার না করেই জিয়া ২৮ জন কর্নেলকে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত করেন। এদের অনেকেই ছিল অযোগ্য ও অদক্ষ, যা নিয়ে সেনাবাহিনীতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় এবং জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এখানে তিনি সেনাবাহিনীর স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধু রাজনৈতিক স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেন। পদোন্নতিপ্রাপ্ত এ ২৮ জনের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার সাদেকুর রহমানও ছিলেন। এই কর্নেল সাদেক যখন বগুড়াতে অফিসিয়েটিং ব্রিগেড কমান্ডার তখন ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত বগুড়াতে সেনাবিদ্রোহ হয়। সে বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তান-প্রত্যাগত মে. জেনারেল লতিফ। জেনারেল লতিফ ওই বিদ্রোহের জন্য সাদেককেই দায়ী করেন। ব্রিগেডিয়ার পদে সাদেকুর রহমানের পদোন্নতির কথাবার্তা যখন চলছিল আমি তখন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল। সে হিসেবে আর্মি প্রমোশন বোর্ডের একজন সদস্যও। ফাইল পড়ার সময় জেনারেল লতিফের ওই মন্তব্য আমার নজরে আসে। কর্নেল সাদেক তখন জিয়ার সামরিক সচিব। ফলে জিয়াকে তোষামোদ করার উদ্দেশ্যে মন্তব্যকারী কর্মকর্তা জেনারেল লতিফ ও অন্যান্য কর্মকর্তা বোর্ড সভায় আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর প্রমোশন সমর্থন করে বসেন। মিটিংয়ে আমি সাদেকুর রহমান সম্পর্কিত জে, লতিফের ওই মন্তব্য জিয়ার দৃষ্টিগোচরে আনার চেষ্টা করি। জিয়া তখন রাগান্বিত হন এবং বিরক্তির সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে বলেন, তদন্ত রিপোর্টে কী আছে পড়ো। আমি তখন জিয়াকে ইংরেজিতে বলি, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আই অ্যাম ট্রাইং টু ডু মাই ডিউটি অ্যাজ অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল অ্যান্ড ইফ ইউ আর আনউইলিং টু হিয়ার হোয়াট ইজ রিটেন ইন দি কোর্ট অফ ইনকোয়ারি কনসারনিং ইওর মিলিটারি সেক্রেটারি আই ডুনট থিঙ্ক আই শুড সিট হিয়ার অ্যাজ এ মেম্বর অফ এ প্রমোশন বোর্ড।’ এই বলে আমি ফাইলটি বন্ধ করে ফেলি। পরে তিনি স্বর নিচু করে আমাকে পড়তে বলেন। আমি তা পড়ে শোনাই। এরপর তিনি সভা শেষ না করে উপ-সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদকে সভা পরিচালনার ভার দিয়ে চলে যান। জিয়া পরে ঐ ২৮ জনের সঙ্গে সাদেকের প্রমোশন অনুমোদন করেন। 

মজার ব্যাপার হলো, এ ধরনের মিটিংয়ের বিষয়বস্তু অত্যন্ত গোপন থাকার কথা। মিটিংয়ে সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থাকেন। শুধু সদস্য সচিব হিসেবে মাত্র একজন জুনিয়র অফিসার থাকেন। আর পদাধিকারবলে সচিব হিসেবে সে মিটিংয়ে তৎকালীন কর্নেল সুবেদ আলী ভূঁইয়াও ছিলেন। মিটিংয়ে আমি জিয়াকে সাদেকুর রহমান সম্পর্কে যা বলেছি সুবেদ আলী ভূঁইয়া তা সাদেকুর রহমানকে বলে দেন, যা গুরুতর বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধ এবং শাস্তিযোগ্য। সাদেক যেহেতু জিয়ার সামরিক সচিব তাই তাঁকে খুশি করার জন্য ভূঁইয়া তাকে মিটিংয়ের তথ্য দেন। সাদেকুর রহমান আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। মিটিংয়ে তাঁর পদোন্নতির ব্যাপারে আমার আপত্তির কথা শুনে তিনি আমার বাসায় আসেন এবং অনুযোগ করেন। সভার এসব গোপন সিদ্ধান্ত তাঁর জানার কথা নয়। আমি তার কাছে জানতে চাই, তিনি এসব কোথা থেকে জানলেন। অনেক পীড়াপীড়ির পর তিনি তৎকালীন কর্নেল সুবেদ আলী ভূঁইয়ার নাম বললেন। আমি বিষয়টি জেনারেল জিয়াকে অবহিত করি এবং সুবেদ আলী ভূঁইয়াকে অন্যত্র বদলি করার সুপারিশ করি। জিয়া আমাকে জানান, তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান এরশাদের সুপারিশেই সুবেদ আলী ভূঁইয়াকে আর্মি হেডকোয়ার্টারের সামরিক সচিবের মতো স্পর্শকাতর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাহোক, পরে তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয় এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয় তৎকালীন কর্নেল নাসিমকে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *