সিরাজ শিকদার : হত্যা না মৃত্যু!
১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসের শেষদিকে ঢাকায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা এবং বাংলাদেশ রেডক্রসের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার জনৈক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও তাঁর সঙ্গীরা মেজর শরিফুল হক ডালিমের স্ত্রীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে মেজর ডালিম তার কিছু সঙ্গী আর্মি অফিসার এবং সৈনিক নিয়ে গাজী গোলাম মোস্তফার বাসা আক্রমণ ও তচনচ করে। এর ফলে সামরিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে কয়েকজন অফিসারকে প্রশাসনিক আদেশে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মেজর শরীফুল হক ডালিম এবং মেজর এস এইচ এম বি নুর চৌধুরী। এঁরা দুজনই ১৯৭৫-এর আগস্ট মাসে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।
ওই বছরেরই শেষদিকে গুপ্তদল সর্বহারা পার্টির মূল নায়ক সিরাজ শিকদারকে চট্টগ্রামের গোপন আস্তানা থেকে পুলিশ তাঁর পার্টির একজন লোকের সহায়তায় গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় এবং কড়া নিরাপত্তায় ঢাকায় নিয়ে আসে। আগেই বলেছি, এ সর্বহারা দলে ঢাকা ব্রিগেডে আমার পূর্বসূরি লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন আহমেদ একজন উচ্চপদস্থ নেতা ছিলেন। তিনি আত্মগোপনপূর্বক পার্টির কাজকর্মে সক্রিয়ভাবে তৎপর ছিলেন। সিরাজ শিকদারকে ঢাকায় নিয়ে আসার দুই/তিনদিন পর এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে সিরাজ শিকদার নিহত হয়েছেন। এ সরকারি ভাষ্য তখন অধিকাংশ জনগণ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বিশ্বাস করেনি। সিরাজ শিকদারকে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে পুলিশ হেফাজতে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হতো এবং বিনা বিচারে হত্যার জন্য লোকজন সরকারকে দায়ী করত।
এ ব্যাপারে দ্য রেপ অফ বাংলাদেশ খ্যাত এবং লন্ডনের সানডে টাইমসের সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস (বর্তমানে প্রয়াত) তার লেখা দ্য লিগেসি অফ ব্লাড বইয়ের ৪৬ পৃষ্ঠায় সিরাজ শিকদারের ভগ্নীপতি (শামিম শিকদারের স্বামী) জাকারিয়া চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘হ্যান্ডকাপ পরিয়ে, চোখ বেঁধে রাতের বেলায় ঢাকার অদূরবর্তী কোনো এক জায়গায় নিয়ে গুলি করে সিরাজ শিকদারকে হত্যা করা হয়।’ উল্লেখ্য, এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ সালে বিশেষ মহলের সহায়তায় মাসকারেনহাসের ওই বইটি প্রকাশিত হয়। মাসকারেনহাসের সঙ্গে লন্ডনে আমার পরিচয়। এই লেখায় তাঁকে নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করবো।
সিরাজ শিকদার হত্যাকাণ্ড আসলেই রহস্যজনক। সত্যিকার ঘটনা যে কী ছিল বা তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী কে তা এখনও পরিষ্কার নয়। দেশে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড নিয়ে বর্তমানে তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু সিরাজ শিকদার হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো তদন্তের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ওই সময় ঢাকা ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে পুলিশের তৎকালীন একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সিরাজ শিকদার প্রসঙ্গে কথা বললে তিনি হঠাৎ বলে বসেন, ‘কর্নেল সাহেব, আমাদের এবং আপনাদের যুদ্ধের মধ্যে তফাত এটাই।’ শুনেই আমি চমকে উঠি, একটু হতভম্ব হয়ে পড়ি।
সিরাজ শিকদার সেদিনের গ্রাম গঞ্জ ও শহরে কিছু লোকের কাছে, বিশেষ করে যাঁরা সরকারি কর্মকাণ্ডে হতাশ ছিলেন, রবিনহুডের মতো এক আকর্ষক চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি ও তাঁর সঙ্গীদের ছদ্মবেশে অতর্কিত উপস্থিতি ও নিমেষে মিলিয়ে যাওয়া নিয়ে সে সময় বেশ মুখরোচক গল্প শোনা যেত। তাঁর দল সর্বহারা পার্টির সদস্যদের প্রচারপত্র বিলি, হঠাৎ চিকামারা ইত্যাদি এবং অতর্কিতে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা চালানো নিয়ে লোকজন, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত থাকত। এ রকম পরিস্থিতিতে ১৯৭৩ সালের বিজয়দিবসের আগের রাতে শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, সিরাজ শিকদার ও তাঁর দল এসে ঢাকায় সরকারবিরোধী লিফলেট প্রচার ও বিভিন্ন স্থানে হামলা চালাতে পারে। এই আশঙ্কায় শহরে রাতের বেলায় সাদা পোশাকে পুলিশ গাড়ি নিয়ে টহল দিতে থাকে।
গুলিবিদ্ধ শেখ কামাল
ওই রাতেই প্রধানমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, যিনি একজন ছাত্রনেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে প্রথম সামরিক অফিসার্স কোর্সে (শর্ট সার্ভিস-১) সামরিক প্রশিক্ষণ নেন ও যুদ্ধের সময় কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে কাজ করেন, তিনি ধানমণ্ডি এলাকার তাঁর সাতজন সমবয়সী বন্ধুকে নিয়ে একটি মাইক্রোবাসে শহরে টহলে বের হন। এক পর্যায়ে সিরাজ শিকদারের খোঁজে টহলরত স্পেশাল পুলিশ তাঁদের মাইক্রোবাসটি দেখতে পায় এবং সন্দেহ ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কোনো সতর্ক সঙ্কেত না দিয়েই অতর্কিতে মাইক্রোবাসের ওপর গুলি চালায়। এতে কামালসহ তাঁর ছয়জন সঙ্গী আহত হন। পরে পুলিশই তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। শেখ কামালকে পরে পিজি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
পরদিন সকালে আমি ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে বর্তমান মানিক মিয়া এভিনিউতে বিজয়দিবসের সম্মিলিত সামরিক প্যারেড পরিচালনা করি। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সালাম গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব অত্যন্ত গম্ভীর ও মলিন মুখে বসে ছিলেন। কারো সঙ্গেই তেমন কোনো কথাবার্তা বলেননি। তাঁর সঙ্গে সবসময়ই আমার একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। যখনই আমি তাঁর কাছে গিয়েছি, উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। কিন্তু ওইদিন তিনি আমার সঙ্গে কোনো কথাই বললেন না। ‘৭২-এর ১০ জানুয়ারির পর থেকে অনেকবার তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি। এতো মর্মাহত হতে আমি তাঁকে কখনো দেখিনি।
যাহোক, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কামালের সঙ্গে আমারও পরিচয় ছিল এবং তাকে আমি খুব ভালোভাবেই জানতাম। প্যারেডশেষে আমি তাকে দেখতে হাসপাতালে যাই। বেগম মুজিব তখন তাঁর পাশে বসে ছিলেন। কামালের কাঁধে গুলি লেগেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব কামালের ওই রাতের অবাঞ্ছিত ঘোরাফেরায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও মনঃক্ষুণ্ণ হন। প্রথমে তিনি তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যেতে পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানান। পরে অবশ্য বিকেলের দিকে তিনি কামালকে দেখতে যান।
এদিকে স্বাধীনতাবিরোধী ও আওয়ামী লীগ বিদ্বেষীরা এই ঘটনাকে ভিন্নরূপে প্রচার করে। ‘ব্যাংক ডাকাতি’ করতে গিয়ে কামাল পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে তারা প্রচারণা চালায় এবং দেশে-বিদেশে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে। যদিও এসব প্রচারণায় সত্যের লেশমাত্র ছিল না।
বাকশালের অভ্যুদয়
সে সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং দুর্নীতি, অরাজকতা, লুণ্ঠন ইত্যাদিতে দেশ ছেয়ে যায়। এটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, দেশের পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে হঠাৎ করে দেশে সরকারপদ্ধতির পরিবর্তন করেন। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতি প্রণয়ন করে তিনি নিজে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি এবং মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে নতুন সরকার গঠন করা হয়। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় শাসনব্যবস্থার আওতায় বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা ‘বাকশাল’ নামে দল গঠন করা হলো। সরকারের এ সিদ্ধান্তে দেশে-বিদেশে অনেকেই হতবাক হয়ে যায় এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের পাশ্চাত্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা মর্মাহত হয়।
অনেকে এমন মত পোষণ করতে লাগলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে শেখ মুজিব একটা নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর সারাজীবনের যে ত্যাগ-তিতিক্ষার জন্য তিনি জনগণের আপনজনে পরিণত হলেন, এই ব্যবস্থাকে তাঁরা সেই গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর চরম আঘাত বলে ভাবতে লাগলেন। সামরিক বাহিনীতেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলো। অনেকেই এই ভেবে অস্বস্তি বোধ করছিলেন যে, সামরিক বাহিনীর নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য আর থাকবে না এবং এই ব্যবস্থা সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক দলের একটা অঙ্গসংগঠনে পরিণত করবে।
জনসাধারণের মনেও ধারণা জন্মে যে, বাকশালের মাধ্যমে সামরিক-বেসামরিক তথা প্রশাসনের প্রতিটি স্তরকে একদলীয় রাজনীতির আওতায় আনা হবে। কারণ বাকশাল কায়েম করার পর গণ্যমান্য ব্যক্তি, যেমন সাংবাদিক, অধ্যাপক, ডাক্তার, বুদ্ধিজীবী এ ধরনের লোকজন তৎকালীন সংসদভবনে (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর অফিস ) লাইন ধরে শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিনন্দন জানাতে যান। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ লাইন ধরে সংসদভবনে যাচ্ছিল এবং টিভিতে তা সরাসরি প্রচার করা হচ্ছিল। সেই
দৃশ্য আমি আমার ঘরে বসে টিভিতে দেখেছি। আজও মনে পড়ে, স্বাধীনতার পর এতো হতাশা আমাকে আর কখনো গ্রাস করতে পারেনি। চাটুকারদের এই নির্লজ্জ মহড়া দেখে সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে আমি মানসিকভাবে অসুস্থ বোধ করছিলাম।
কিন্তু আমার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর এদেরই অনেককে আবার খন্দকার মোস্তাকের সঙ্গে টিভিতে দেখি। আজকের সমাজের অনেক চেনামুখকে সেদিন দেখলাম উৎফুল্লচিত্তে সেনানিবাসে উদ্দেশ্যহীন (!) ঘোরাফেরা করছেন। হায়রে আমার হতভাগা দেশ! আমার কেবলই মনে হলো, ভবিষ্যতে এই জাতির কপালে আরো অনেক দুঃখ আছে।
বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও সামরিক বাহিনীর তিন প্রধানকেও রাখা হলো। প্রতিটি জেলায় গভর্নর নিয়োগ করা হয়। গভর্নরের সংখ্যা ছিল ৬১ জন। ওই পদে মূলত আওয়ামী লীগ নেতা এবং কিছু প্রশাসনিক ও সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনী থেকে যাঁরা গভর্নর হয়েছেন তাদের বেশিরভাগ ছিলেন আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন। যেমন— সেনাবাহিনীর সিগনাল কোরে চাকরিরত কর্নেল আনোয়ারকে খুলনা অথবা যশোরের (স্পষ্ট মনে নেই) গভর্নর করা হলো। এই আনোয়ারের ভাই ছিলেন কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত একজন আওয়ামী লীগ এমপি
গভর্নরের অধীনে স্থানীয় সরকার প্রশাসন থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে ন্যস্ত করার পরিকল্পনা ছিল এবং ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ থেকে এ নতুন সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকরি হওয়ার কথা ছিল। এক সরকারি আদেশে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হলো। শুধুমাত্র চারটি সংবাদপত্রের প্রকাশনা বহাল রেখে বাকি সমস্ত পত্রপত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হলো। এ অবস্থায় দেশের সর্বস্তরে বাকশালবিরোধী চাপা ক্ষোভ বিস্তার লাভ করে। বাকশাল সরকারের এসব সিদ্ধান্তে সর্বত্রই এমনকি সামরিক বাহিনীতেও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিব ও তাঁর সরকার দ্রুতগতিতে যে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন, তা শেখ মুজিবকে অবহিত করার মতো সৎসাহস তাঁর কোনো উপদেষ্টা, পারিষদবর্গ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের ছিল না বলে আমার বদ্ধমূল ধারণা।
দুঃখজনক হলো, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ক্ষমতাসীনদের আশপাশে সেসব লোকজনই স্থান পায় যারা ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি যা শুনতে চান তাই শোনাতে পারদর্শী। এটাই হলো নেতৃত্বের দুর্বলতা যা আমাদের দেশের জন্য ক্রনিক প্রবলেম। অত্যন্ত কম বয়সেই এসব স্মুথ অপারেটরদের দেখার ও বোঝার সৌভাগ্য (!) আমার হয়েছে। কারণ পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের এডিসি হিসেবে এবং বাংলাদেশ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য অনেক ক্ষমতাবানকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে একটি প্রাসঙ্গিক প্রবাদ মনে পড়ে। জুলিয়াস সিজারকে একজন চাটুকার বলেছিল, ‘জাঁহাপনা, আপনাকে তোষামোদ (ফ্ল্যাটারি) করে খুশি করা যায় না, এটাই আপনার সবচেয়ে বড় গুণ। মজার ব্যাপার হলো, সিজার এই কথাতেই আমোদিত (ফ্লাটার্ড) হতেন সবচে বেশি। তাই তোষামোদকারীদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করা ক্ষমতাবানদের জন্য বেশ দুরূহ ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বাংলাদেশে এ ধরনের তোষামোদকারীদের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা তো করা হয়ই না বরং নেতারা এদের দ্বারা পরিবৃত থাকতে ভালোবাসেন এবং সবসময় তোষামোদকারী ও নিজের মনে গড়া স্বর্গরাজ্যে বিচরণ করেন।
সামরিক প্রতিনিধিদলের যুগোস্লাভিয়া ভ্ৰমণ
১৯৭৫ সালের জুন মাসের প্রথমদিকে যুগোস্লাভিয়ায় এক সামরিক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে সেনাপ্রধান আমাকে মনোনীত করেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন দলনেতা, মোট সদস্য ছিলাম আটজন। সামরিক অস্ত্রসংগ্রহ ছিল এ সফরের উদ্দেশ্য। আমরা সপ্তাহ দুয়েক যুগোস্লাভিয়ায় ছিলাম। মার্শাল টিটো তখনও সে দেশের রাষ্ট্রপতি। মার্শাল টিটোর যুদ্ধকালীন সহযোগী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক যোগাযোগ প্রধান জেনারেল পিটার মার্টিস এক অভ্যর্থনায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও আমার কাছে কথা প্রসঙ্গে জানতে চান, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোনো অন্তর্দ্বন্দ্ব বা কলহ-বিরোধ আছে কি না। এরপর নিজেই বললেন, যদি এ ধরনের বিরোধ থেকেই থাকে তবে সামরিক বাহিনীতে একতা, শৃঙ্খলা ইত্যাদি বজায় রাখা সরকারের জন্য কঠিন হবে। আমরা এ ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক জবাব দিতে সক্ষম হইনি। কারণ আমাদের সামরিক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত থাকায় একতার অভাব ছিল। তা ছাড়া মনে হলো, তিনি আমাদের সামরিক বাহিনী সম্পর্কে পূর্ব থেকেই সম্যক জ্ঞাত আছেন।
প্রসঙ্গক্রমে আমি একটা কাকতালীয় ঘটনার উল্লেখ করছি। ওই সামরিক প্রতিনিধিদলের আট সদস্যের মধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। যেমন : ১) খালেদ মোশাররফ, ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে সিপাহি বিদ্রোহের সময়, ২) গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনসার আহমদ চৌধুরী বিমানবাহিনীর ১৯৭৭ সালের অক্টোবরের বিদ্রোহে, ৩) এয়ার ভাইস মার্শাল বাশার, ১৯৭৭ সালে প্লেন দুর্ঘটনায় এবং (৪) কর্নেল নওয়াজিশ আলী, ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যা মামলায় কোর্ট মার্শালে ফাঁসিতে মারা যান।
আর্মিতে বিশৃঙ্খলার স্ফুরণ
যুগোস্লাভিয়া থেকে ফিরে যথারীতি আর্মি লগ এরিয়ার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এ সময়ে আর্মি হেডকোয়ার্টারে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োজিত তৎকালীন কর্নেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। উক্ত পদ শূন্য হলে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ আমাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেলেরও কাজ করতে বলেন। অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে কাজ করার সময় আর্মি শৃঙ্খলা এবং অন্যান্য বিষয় দেখে অত্যন্ত বিচলিত হই এবং আর্মিতে ঐক্যের মারাত্মক অভাব অনুভব করি। অধিনায়কগণ আর্মির শৃঙ্খলা ও অন্যান্য আইনকানুনের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে আমার মনে হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্ব তো ছিলই, সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধাগণ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, কোন্দল, দলাদলি ও পারস্পরিক রেষারেষিতে লিপ্ত ছিলেন।
আমার মনে হয়েছিল, সেনাবাহিনীকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার জন্য দক্ষ অধিনায়কত্ব, কঠোর নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলা প্রয়োগ করা দরকার। সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ অভ্যন্তরীণ এসব বিভেদ ও অনৈক্য দূর করতে সক্ষম হননি। তার ওপর তিনি কিছু সিনিয়র অফিসারের পুরোপুরি সহযোগিতা ও সমর্থন পাননি। মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র অফিসারদের রেষারেষি ছাড়াও পাকিস্তানফেরত অফিসাররা, বিশেষ করে যাঁরা সিনিয়র ছিলেন তাঁরাও সুযোগ বুঝে এই বিরোধকে উস্কে দিতেন। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের এসব দলাদলিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করেন।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা মনে করেন, দলাদলিতে উৎসাহিত করে তাঁরা সামরিক অফিসারদেরকে তাঁদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে সক্ষম হবেন এবং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারবেন। বিরোধীরাও মনে করেন তাঁরা এসব উস্কে দিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ক্ষমতায় যাবেন সামরিক বাহিনীর সহায়তায়। কিন্তু তাঁরা বুঝে উঠতে পারেন না যে, এটা সামরিক বাহিনী তথা দেশের জন্য কত ক্ষতিকর। এটা এমনকি দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ ১৯৯৬ সালের ২০ মে’র কথা বলা যায়। তৎকালীন সেনাপ্রধানসহ আরো কয়েকজন সিনিয়র অফিসার আর্মির নিয়মকানুন উপেক্ষা করে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে তথা নিজেদের অবস্থান, প্রমোশন, পোস্টিং ও অন্যান্য সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের স্বার্থে ওইসব অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাঁদেরকে দলাদলি, কোন্দল ইত্যাদি অপেশাদার কাজে উৎসাহিত করে। মূলত সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে সে সময় এমন ধারণার সৃষ্টি হয় যে, নিজের অবস্থান, প্রমোশন, পোস্টিং ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধার জন্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সুনজরে থাকা প্রয়োজন। এই অপেশাদার ও অনৈতিক প্রতিযোগিতার ফলে ১৯৯৬ সালের ২০ মে সেনাবাহিনী নিজেদের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যা দেশে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারত।
অভ্যুত্থানের আলামত
মনে পড়ে ১৯৭৫ সালের প্রথমদিকের কোনো এক সন্ধ্যায় আমি ও জেনারেল জিয়া স্কোয়াশ খেলে এসে জিয়ার বাসার সামনের লনে বসে গল্প করছিলাম। আগেই বলেছি, আমার ও জেনারেল জিয়ার বাসা সামনাসামনি। কথাবার্তাশেষে আমি উঠে বাসায় রওয়ানা হচ্ছিলাম। বাইরের গেটে এসে দেখি মেজর ফারুক একা দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে সে কী করছে জানতে চাইলে সে জানায়, উপ-সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছে। আমি আর কোনো কথা না বলে নিজের বাড়িতে চলে গেলাম। ফারুক তখন আমার সরাসরি অধীনে ছিল না। তা থাকলে তাকে হয়তো আমার আরো অনেক বিস্তারিত প্রশ্নের জবাব দিতে হতো। পরদিন আমি অফিসে জেনারেল জিয়ার কাছে বিষয়টি তুলি। তিনি আমাকে বললেন, ‘হ্যাঁ, ফারুক এসেছিল।’ সেইসঙ্গে এও জানান যে, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী অফিসারদের বলে দিয়েছেন, এভাবে জুনিয়র অফিসারদের তাঁর বাড়িতে আসা নিরুৎসাহিত করতে। জেনারেল জিয়ার সঙ্গে তাঁর ওই সাক্ষাতের বিষয়টি ম্যাসকারেনহাসের লিগেসি অফ ব্লাড বইয়ের ৫৪ পৃষ্ঠায় ফারুক বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি ঘটনার কথা বলতে হয়। ১৯৭৫ সালে, খুব সম্ভব জুলাই মাসের প্রথম দিকে, একদিন আমি বাস্কেটবল খেলা শেষ করে বিকেলবেলায় শহীদ মইনুল রোডে অবস্থিত আমার বাসায় ঢুকছিলাম। বাসার গেইটে মেজর রশিদ (মুজিব-হত্যার প্রধান অভিযুক্ত) আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছে। আলাপের শুরুতেই সে সেনাবাহিনী, রাজনীতি, বাকশাল ইত্যাদি সম্পর্কে উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে লাগলো। আমি তাকে তার ব্রিগেড অধিনায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিলকে এসব জানাতে বলি। আমি আইন অনুসারে যদি কোনো বিষয়ে সামরিক বাহিনীর কোনো ব্যক্তির ক্ষোভ কিংবা অভিযোগ থাকে তবে তা তার নিজ অধিনায়কের দৃষ্টিগোচরে আনার কথা। রশিদ ৪৬ ঢাকা ব্রিগেডের ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদস্য ছিল। শাফায়াত জামিলের আগে আমি ওই ব্রিগেডের অধিনায়ক ছিলাম।
আমি তৎক্ষণাৎ অনুধাবন করি, রশিদ হয়তো ভেবেছে, সম্প্রতি আমাকে ঢাকা ব্রিগেড থেকে বদলি করায় আমি হয়তো সরকারের ওপর মনঃক্ষুণ্ণ। তাই সে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আমাকে উত্তেজিত করতে সক্ষম হবে এবং আমি তার রাজনৈতিক অভিমতকে সমর্থন করবো। কিন্তু সে ভুল লোকটিকে বেছে নিয়েছিল। তবে ঘুণাক্ষরেও এটা বুঝতে পারিনি যে, সে বা তারা জঘন্য কোনো পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে।
ব্যক্তিগত জীবনে দুর্ঘটনা
এর কয়েকদিন পর জুলাই মাসের মাঝামাঝি ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রিগেড বাস্কেটবল টিমের সঙ্গে খেলছিলাম। খেলার মধ্যেই হঠাৎ করে আমি মাটিতে পড়ে যাই এবং চামড়া ছিঁড়ে পায়ের অ্যাঙ্কলের হাড় বের হয়ে যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারাই। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রাত দুটোর দিকে সার্জন কর্নেল আলী আমার পায়ে অস্ত্রোপচার করেন। পরের দিন সেনাপ্রধান ও উপসেনাপ্রধানসহ অনেক সামরিক ও বেসামরিক অফিসার, শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়স্বজন আমাকে দেখতে আসেন। এদিকে আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা (৩১ আগস্ট ১৯৭৫ আমার প্রথম সন্তান পিংকি জন্মগ্রহণ করে)। প্লাস্টার খোলার পর দেখা যায়, পায়ে ইনফেকশন আছে এবং ক্ষতের কারণে ঊরু থেকে চামড়া গ্রাফটিং করে জোড়া দিতে হবে। এর মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়া আরো কয়েকদিন আমাকে দেখতে হাসপাতালে আসেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবও টেলিফোন করে আমার স্ত্রীর কাছ থেকে আমার খোঁজখবর নেন। প্রায় তিন সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পর ১২ আগস্ট নিজ বাড়িতে ফেরত আসি। কিন্তু শরীর তখনও অত্যন্ত দুর্বল। হাসপাতাল থেকে লোক বাড়িতে এসে পায়ে ওষুধ ও ব্যান্ডেজ বদল করত। স্বভাবতই অফিসে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সে কারণে ওই সময় সেনাবাহিনীর ভেতরকার খবর বা বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি।
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব হত্যা
১৫ আগস্ট ভোরে আমার বাড়ির আর্মির টেলিফোনটি বেজে ওঠে। আমি তখনও বিছানায়। আমার স্ত্রী টেলিফোন উঠান এবং আমাকে জানান যে, মেজর জেনারেল জিয়া আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি টেলিফোন ধরামাত্রই জিয়ার কণ্ঠ শুনি। টেলিফোনের ওই প্রান্ত থেকে জিয়া বললেন, তুমি কিছু শুনেছো? আমাকে জবাব দেয়ার অবকাশ না দিয়েই তিনি ইংরেজিতে বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব হ্যাজ বিন কিল্ড।’ আমি হঠাৎ এতোই হতবাক হয়ে যাই যে, তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, তিনি কীভাবে এ খবর জানেন। উত্তরে তিনি জানান, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ তাকে এইমাত্র ফোনে জানিয়েছেন এবং সেসঙ্গে আমাকে তাড়াতাড়ি আর্মি হেডকোয়ার্টারে যেতে বলেছেন। আমার পায়ে তখনও ব্যান্ডেজ, চলাফেরায় অসুবিধা এবং শরীরও দুর্বল। তবুও আমি বিছানা থেকে উঠে আর্মি হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই। প্ৰায় চার সপ্তাহ পর আমি সামরিক পোশাক পরলাম। আমি এবং মেজর জেনারেল জিয়া সেনানিবাসে শহীদ মইনুল হোসেন রোডে মুখোমুখি বাড়িতে থাকতাম। তিনি ৬নং বাড়িতে (বর্তমানে খালেদা জিয়া থাকেন) এবং আমি ৭নং বাড়িতে থাকতাম।
জেনারেল রব ও মোতাহারউদ্দিন
আর্মি হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার জন্য গাড়ির অপেক্ষায় বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। দেখি, আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংসদ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রব (বর্তমানে মৃত) এবং তৎকালীন চা বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোতাহারউদ্দিন গাড়িতে করে আমার বাড়িতে উপস্থিত। আমি কিছু বলার পূর্বেই তাঁরা দুজনে আমাকে অনুরোধ করেন, আমি যেন তাঁদের সঙ্গে আমার বাড়ি সংলগ্ন পুরনো ডিওএইচএস-এ জেনারেল ওসমানীর বাড়িতে যাই। আমি তাঁদেরকে বলি, আমাকে আর্মি হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল ওসমানীর বাড়িতে আমার যাওয়া দরকার কেন তাও জানতে চাই। তাঁরা বললেন, জেনারেল ওসমানীকে এ পরিস্থিতিতে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগদান করা থেকে বিরত রাখার জন্য তাঁদের সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যেতে চান। আমি উত্তরে তাঁদের জানাই যে, জেনারেল ওসমানীকে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগদান করা থেকে বিরত রাখা হয়তো সম্ভব হবে না। কেননা আমি যতোটুকু জানি, স্বাধীনতাযুদ্ধের পর জেনারেল ওসমানী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ওই দপ্তর প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে রাখেন। এ ছাড়া বাকশাল গঠন করার পরেই তিনি মন্ত্রিসভা ও সংসদীয় পদ থেকে ইস্তফা দেন। তাই আমার ধারণা, খন্দকার মোশতাকের সরকার তাঁকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলে তিনি তা গ্রহণ করতে রাজি হবেন।
আমার এ মতামত শোনার পর জেনারেল রব ও মোতাহারউদ্দিন চলে যান। আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারের পথে যেতে থাকি। পথেই আমার সঙ্গে ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিলের দেখা। তাঁকে দেখে প্রথমেই আমি জিজ্ঞাসা করি, মুজিবহত্যায় জড়িত অফিসার ও সৈনিকদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন। উত্তরে তিনি আমাকে জানান, তাদের কয়েকজন ঘটনার পর সকালে তাঁর বাড়িতে দেখা করেছে। একথা শুনে আমি অবাক হই। তিনি আমাকে আরো বললেন, এখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে গেলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে। আমি বুঝতে পারলাম, তিনি তৎক্ষণাৎ এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস পাচ্ছেন না, যদিও আমি বলেছি, এটা তাঁরই ব্রিগেডের কাজ এবং তার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহের শামিল। যাহোক এর পর আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারে যাই।
কারা খুনি
আর্মি হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত হয়েই জানতে পারি, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ও উপসেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান দুজনেই তখন মেজর ডালিমের সঙ্গে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে গেছেন। হেডকোয়ার্টারে বসেই আমি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি, ১ম ল্যান্সারের মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান এবং ২য় ফিল্ড আর্টিলারির মেজর রশিদের নেতৃত্বে কিছু চাকুরিরত আর্মি অফিসার, কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার এবং সৈনিক রাতের বেলা নৈশ প্রশিক্ষণের ছলে নতুন বিমানবন্দরে জড়ো হয়। সেখান থেকে রাতে তারা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার, মন্ত্রী সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবার এবং শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর পরিবারকে স্ব স্ব বাড়িতে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
আমি ঢাকা ব্রিগেডের অধিনায়ক থাকাকালে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক প্রত্যক্ষভাবে আমার অধীনে কাজ করেছিল। আমি তাদের ভালোভাবেই জানি। এরা দুজনেই পাকিস্তান আর্মিতে স্বল্পমেয়াদি (ছয় মাসের) প্রশিক্ষণে ১৯৬৫ সালে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার। মেজর রশিদ ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষদিকে ঢাকায় ‘ছুটিতে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। মেজর ফারুক ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ বিজয়ের তিনদিন আগে যশোরে তৎকালীন মেজর মঞ্জুরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। আমি যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল তখন মেজর ফারুককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আমার কাছে ফাইল আসে। সে পাকিস্তানের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে থেকেও ৯ মাসেও স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগদান করেনি। দেশের স্বাধীন হওয়া যখন প্রায় নিশ্চিত তখন অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর যশোরে মুক্তিবাহিনীতে সে যোগদান করে। এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আমি তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হইনি। তাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মেজর ফারুক সামরিক বাহিনীতে স্বীকৃতি পায়নি। যদিও অনেক সিনিয়র অফিসার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য আমাকে সুপারিশ করেছেন, কিন্তু আমি তাতে রাজি হইনি। অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে বিষয়টি দেখার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর।
রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে
দুপুরের দিকে সেনাপ্রধান ও উপসেনাপ্রধান রেডিও স্টেশন থেকে আর্মি হেডকোয়ার্টারে ফেরত আসেন। তাঁরা আমাকে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানান। এর পরই তারা আমাকে বলেন, সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে প্রায় ১ হাজার অফিসার ও সৈন্য রয়েছে। তখন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আর্মির কোনো যোগাযোগ হয়নি। এদিকে গুজব ছিল, রক্ষীবাহিনী সশস্ত্র প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে আমি যেন সাভারে রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে গিয়ে তাদের বুঝিয়ে এ পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা এবং শান্তি-শৃঙ্খলাভঙ্গের কাজে যেন জড়িত না হয়, তার ব্যবস্থা করি। আমাকে আরো বলা হলো, আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সৈন্য ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদি করা হবে।
আমি তখন সাভারে রক্ষীবাহিনীর ডেপুটি ডাইরেক্টারস্ সরওয়ার হোসেন মোল্লা ও আনোয়ারুল আলমের (উভয়ে বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মরত) সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি তাঁদের জানাই যে, সাভারে এসে আমি রক্ষীবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে চাই এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের জানাতে চাই। সে মোতাবেক বিকেলবেলায় অসুস্থ শরীরে আমি কোনো সৈন্য ছাড়াই একটি জিপ নিয়ে সাভার রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে পৌঁছি। সেখানে রক্ষীবাহিনীর অধিনায়কগণ আমাকে অভ্যর্থনা জানান। আমি আমার বক্তব্যে রক্ষীবাহিনীকে দেশের এ দুর্যোগমুহূর্তে ধৈর্য ধরে শান্ত থাকতে অনুরোধ করি এবং তাদেরকে সামরিক বাহিনীতে আত্মীকরণ করা হবে বলে দৃঢ় আশ্বাস প্রদান করি। আমি তাদের উপদেশ দিই যে, আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা, কোনোপ্রকার উচ্ছৃঙ্খলতা, অশান্তি ও বিভেদ ইত্যাদিতে জড়িয়ে বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা যেন বিপন্ন না করি। ঘণ্টা দুয়েক তাদের সঙ্গে থাকার পর আমি সাভার থেকে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসি।
বিদ্রোহদমনের উদ্যোগ ছিল না
১৫ তারিখ রাত প্রায় দুটো পর্যন্ত আর্মি হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। ততোক্ষণে আমি এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে পারি। রাত দুটোর পর বাড়িতে আসি। যদিও আমি অত্যন্ত দুর্বল ও ক্লান্ত, শরীর অত্যন্ত খারাপ, তবুও আমার ঘুম আসছিল না। সর্বক্ষণ আমার এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কথা মনে হচ্ছিল। সৈনিক হিসেবে স্বাভাবিকভাবে আমি একজন সামরিক ইতিহাসের ছাত্র। এ বিষয়টি আমার খুবই প্রিয়। কাজের অবসরে দেশ-বিদেশের সামরিক ইতিহাস পড়া আমার নিয়মিত অভ্যাস। সামরিক বাহিনীতে যোগদান করা থেকে অদ্যাবধি আমি সামরিক ইতিহাস পড়ে আসছি। আমার জানামতে, এমন জঘন্য কলঙ্কময় ঘটনা কোনো দেশের সামরিক ইতিহাসে নেই। আমি অবাক হই যে, চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত গুটিকয়েক জুনিয়র অফিসার ঢাকায় এতো বড় একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে কীভাবে সক্ষম হলো। একজন পেশাদার সৈনিক হিসেবে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এক কথায় আমার অভিমত হচ্ছে, উচ্চপদস্থ অধিনায়কদের নিয়ন্ত্রণে বিপর্যয়ের জন্য এ ঘটনা ঘটা সম্ভব হয়েছে, যদিও তাঁরা পরে এ সম্পর্কে নানা গবেষণা, তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকেন।
এখানে বলতে হয়, যদি এই ঘটনার জন্য দায়ী অফিসার ও অন্যদের সামরিক আদালতে (কোর্ট মার্শাল) বিচার করার ব্যবস্থা হতো, তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দণ্ডবিধি আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিরূপে গণ্য হতেন : ১) যিনি বিদ্রোহ আরম্ভ করেন কিংবা বিদ্রোহে অন্যকে উৎসাহিত করেন অথবা ২) যদি উপস্থিত থাকেন এবং সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বিদ্রোহ দমন না করেন। এ আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডসহ অন্যান্য শাস্তির বিধান রয়েছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো বেসামরিক ব্যক্তি এই বিদ্রোহের কাজে জড়িত থাকলে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৭নং অনুচ্ছেদের ১৩৯নং ধারা অনুযায়ী তারাও সামরিক আদালতে বিচারের আওতায় আসবে।
তাই এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, চেইন অফ কমান্ডে মুজিবহত্যার ঘটনার পর মেজর রশিদ ও ফারুকের অধিনায়কগণও সামরিক আদালতে দোষীরূপে গণ্য হতেন। কেননা, আমার জানামতে, তারা তৎক্ষণাৎ এ বিদ্রোহদমনের জন্য মোটেই কোনো প্রচেষ্টা চালাননি।
মুজিব হত্যাকাণ্ড : কারণ অনুসন্ধান
গুটিকয়েক উচ্ছৃঙ্খল ও উচ্চাভিলাষী অফিসার কীভাবে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সক্ষম হলো তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমার বিশ্লেষণমতে, আমি অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে হত্যাকাণ্ডের কারণগুলো তুলে ধরছি।
ক) সে সময় দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। সামরিক বাহিনীতেও এর প্রভাব পড়ে। এমনকি ওইদিন অর্থাৎ ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে যদি আদেশ দেওয়াও হতো, সৈনিকেরা সে আদেশ কতোটুকু পালন করত তা নিয়ে অধিনায়কদের মনে বেশ সন্দেহ ছিল। অনেক সৈনিক তখন নিরপেক্ষ মনোভাব পোষণ করত বলে মনে করা হতো। তবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ঘটনায় সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও মর্মাহত হয়েছিলেন। তবে এই অজুহাতে অধিনায়কদের বিদ্রোহদমনের চেষ্টা না করা সামরিক আইনে গুরুতর অপরাধ।
খ) কোনোরূপ পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই না করে শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক পদে অদক্ষ, অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগদান।
গ) সেনাবাহিনীতে পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা এবং অযোগ্য অধিনায়কত্ব। তাই সহজেই হত্যাকারী অফিসারগণ নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য সাধারণ সৈনিকদের বিপথগামী করতে সক্ষম হন।
ঘ) এ পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পূর্বে নৈশ প্রশিক্ষণের নামে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিপুল সৈন্য নতুন বিমানবন্দরে জড়ো হলো। স্বভাবতই এ নৈশ প্যারেডের সময় ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারও এ প্রশিক্ষণে উপস্থিত থাকার কথা। অথচ আমার মনে হয় না, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের অফিসারগণ নৈশ প্যারেডে উপস্থিত ছিলেন।
ঙ) রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব সামরিক সচিব ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার। অথচ সে সময় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো স্থায়ী আদেশ (স্ট্যান্ডিং অর্ডার) ছিল বলে অদ্যাবধি জানা যায়নি।
চ) কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ১ম ফিল্ড আর্টিলারির সৈনিকদের ঢাকায় এনে রাষ্ট্রপতির বাড়িতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার বিষয়টি আমার কাছে বোধগম্য নয়। তা ছাড়া নিরাপত্তা ও আনুষ্ঠানিক গার্ড দুটোই ভিন্ন বিষয়। এ দুটোকে এক করার কথা নয়। ওই ১ম ফিল্ড আর্টিলারির তৎকালীন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ছিলেন ওই ইউনিটেরই অ্যাডজুটেন্ট। ফলে তিনি প্রহরারত সৈনিকগণকে ধোঁকা দিয়ে হত্যাকারীদের নিয়ে অনায়াসে রাষ্ট্রপতির বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়তে সক্ষম হন।
ছ) সেনানিবাসে এবং রাষ্ট্রপতির বাড়ির আশপাশে সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দাদের নজর রাখার কথা, বিশেষ করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এটা আরো জরুরি ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি যে, সে সময় সেনানিবাসে কিংবা রাষ্ট্রপতির বাড়ির আশপাশে গোয়েন্দা সংস্থার কেউ কর্তব্যরত ছিল।
পরিস্থিতির এই সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের পর মনে হচ্ছে, যড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা পূর্ব থেকে না জেনে থাকলেও নতুন এয়ারপোর্ট (বর্তমান বিমানবন্দর) থেকে যখন সৈন্যরা ট্যাঙ্ক ও কামান নিয়ে শহরের দিকে রওনা হলো তখনও গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা জানলে (যা উচিত ছিল) সতর্কতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এই বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব হতো না। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির নিজের পক্ষ থেকেই ফোন করে তাঁর ওপর আক্রমণের খবর সংশ্লিষ্টদের জানাতে হলো, যদিও ওই মুহূর্তে প্রতিরোধ প্রচেষ্টা চালানো হলে রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করা হয়তো সম্ভব হতো না। তবে খবর পাওয়ার পরপরই সামরিক আইনকানুন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে বিদ্রোহীদের দমনের জন্য সবরকম প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত ছিল। আর এটা না করা সামরিক আইনে অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য।
পরে শুনেছি, অনেকে মনে করতেন বা এখনও করেন, ওই সময় কোনোরকম ব্যবস্থা নিলে নিজেদের মধ্যে অনেক রক্তপাত হতো। কথা হলো, সামরিক শৃঙ্খলা আইনে এ ধরনের অজুহাত দেখিয়ে অধিনায়কদের নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো সুযোগ নেই।
খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বগ্রহণ
শেখ মুজিবের হত্যার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। সরকার গঠন করে তিনি ‘জয়বাংলা’ ধ্বনির স্থলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি প্রচলন করেন। বাংলাদেশবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী কিছু ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে বহাল করেন। এ সময় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে বেশ তৎপর হয়ে উঠলো।
ক্ষমতায় এসেই এই সরকার তাড়াহুড়ো করে সামরিক বাহিনীতে পরিবর্তন আনে। জেনারেল ওসমানীকে একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা করা হলো। উপসেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলো। আর পূর্বতন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য। তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে উপসেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হলো। এই নিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণে থাকাকালে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি কর্নেল থেকে দুটি পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হন যা সেনাবাহিনীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন তোয়াব স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো সময় জার্মানিতে ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে এসে বিমানবাহিনীর প্রধান করা হলো। বিমানবাহিনীর তৎকালীন প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের চাকরি রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো। বিডিআরের প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ পদে নিযুক্ত করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বহাল করা হলো। সামরিক বাহিনীর এসব পরিবর্তনে জেনারেল ওসমানী ও শেখ মুজিব হত্যাকারী মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর শরীফুল হক (ডালিম) এবং তাদের সহযোগীরা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। কারণ তখন এই অফিসারগণ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের আশপাশে থাকতেন।
মেজর রশিদ, ফারুক এবং তাদেরই সহযোগীদের হাবভাব ও চালচলন দেখে মনে হতো, দেশ এবং সেনাবাহিনী তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। মেজর ফারুক বঙ্গভবনের একটি কালো মার্সিডিজ গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াত। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় এবং অন্যান্য অনিয়মের অভিযোগ ছিল। খন্দকার মোশতাক এদেরকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য বঙ্গভবনেই থাকতে উৎসাহিত করতেন। এর মধ্যে তিনি সেনাবাহিনীর কোনো সুপারিশ ছাড়াই মেজর ফারুক ও রশিদকে লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি দেন। ডালিমকেও সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নিয়ে লে. কর্নেল করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে মোশতাক এক অধ্যাদেশ বলে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কোনোরূপ বিচার বা শাস্তি দেয়া যাবে না—এই মর্মে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেন।
সেনাপ্রধান পদে মেজর জেনারেল জিয়া
নতুন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান আমাকে স্থায়ীভাবে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল পদে কাজ করতে আদেশ দেন এবং রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে সত্ত্বর আত্মীকরণের কাজ শুরু করার জন্য বলেন। অবশ্য এ কাজটি অ্যাডজুটেন্ট জেনারেলেরই কাজ। এ কাজ নিয়ে আমাকে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। রক্ষীবাহিনীকে পুনর্গঠন করে সেনাবাহিনীতে ধাপে ধাপে আত্মীকরণের প্রক্রিয়া আরম্ভ করি। রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের সেনাবাহিনীতে স্বল্পমেয়াদি কমিশনে আত্মীকরণ করা হয়। অন্যান্যের মধ্যে এ কাজে আমাকে সহায়তা করতেন আমার ব্রাঞ্চের অধীনে পরিচালক লে. কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) ওয়াজিউল্লাহ। শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সময়ে রক্ষীবাহিনীর প্রধান (স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন) ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান দেশের বাইরে ছিলেন এবং ফিরে এসে তিনিও আমাকে এদের আত্মীকরণের কাজে সহায়তা করেন। এ আত্মীকরণপ্রক্রিয়া মোটামুটি সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়।
শেখ মুজিবের হত্যার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাধারণ অবস্থা ছিল বিভ্রান্তিমূলক। এ পরিস্থিতি নিয়ে আমি নিজেও বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় ছিলাম। এর মধ্যে একদিন মিলিটারি পুলিশ, যা অ্যাডজুটেন্ট জেনারেলের অধীনে, তাদের কয়েকজনকে আমার অজান্তে বঙ্গভবনে নিয়োগ করা হয়। পরে জানতে পারি, মেজর রশিদ ও মেজর ফারুকের আদেশে এই মিলিটারি পুলিশদের বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি রশিদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করি এবং তাদের সেনানিবাসে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিই। তাকে বলি যে, আমার অনুমতি ছাড়া মিলিটারি পুলিশকে কোথাও নিয়োগের প্রশ্নই ওঠে না এবং তৎক্ষণাৎ মিলিটারি পুলিশকে সেনানিবাসে ফেরত আনি।
নিরাপত্তাহীনতায় খালেদ মোশাররফ
এদিকে কিছু-কিছু সিনিয়র আর্মি অফিসার ফারুক-রশিদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। কারণ তাঁরা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোশতাকের ঘনিষ্ঠ সহচর। অন্যদিকে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়া মুজিবহত্যায় জড়িত অফিসার এবং অন্যান্যকে আয়ত্তে আনার জন্য কোনোরূপ সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিতে অপারগ ছিলেন। সম্ভবত তিনি নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে ব্যস্ত ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ যিনি আর্মিতে সিজিএস (চিফ অফ জেনারেল স্টাফ) ছিলেন তাঁর সঙ্গে সেনাপ্রধানের সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাই জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান হওয়ার পর তিনি আর্মিতে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন এবং কথা প্রসঙ্গে একদিন তা আমাকে বলেনও। কারণ আমি যতটুকু জানি, রাষ্ট্রপতি মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী জিয়াকে তেমন পছন্দ করতেন না। খালেদ মোশাররফ তাঁর অধিকতর পছন্দনীয় অফিসার ছিলেন। কিন্তু মেজর ফারুক-রশিদ এবং তাদের সহযোগীদের চাপে খন্দকার মোশতাক মুজিবহত্যার পর জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান করেন। সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে জেনারেল ওসমানী হয়তো তখন রাষ্ট্রপতির ওপর কোনোরূপ প্রভাব খাটাতে পারেননি।
সেনাবাহিনীর ২য় ফিল্ড আর্টিলারি ও ১ম ল্যান্সার, যারা সরাসরিভাবে ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল তারা, তখনও ফারুক-রশিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর্মিতে এ নিয়ে একটা অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান ছিল। ঢাকা ব্রিগেডের তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল এ নিয়ে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন ছিলেন। বস্তুত চারটি পদাতিক বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছাড়া বাকি দুটি তথা ২য় ফিল্ড আর্টিলারি ও ১ম ল্যান্সার তাঁর অধীনস্থ এলাকায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর থেকেই ব্রিগেড ও আর্মি হেডকোয়াটারের তত্ত্বাবধান ও আওতার বাইরে চলে যায় যা সেনাবাহিনীর জন্য অস্বাভাবিক ছিল। এ পরিস্থিতির কারণে তিনি সর্বদা ব্যক্তিগতভাবে বিব্রত ও উত্তেজিত থাকতেন।