এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – ৩

৪৬ ব্রিগেডে নতুন দায়িত্ব 

পরদিন সকালে আমি ৪৬ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যাই এবং লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে জানাই, তাঁর জায়গায় আমাকে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। জিয়াউদ্দিন এ সম্পর্কে মোটেই অবহিত ছিলেন না। আমি লিখিত আদেশ দেখালে তিনি চেয়ার ছেড়ে টেবিলের উল্টোদিকে গিয়ে বসেন। হলিডেতে প্রবন্ধ লেখার জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে কি না জিয়াউদ্দিন আমার কাছে তা জানতে চান। আমি উত্তরে বলি, এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। এরপর আমি তাঁর কাছ থেকে দায়িত্বভার গ্রহণ করি এবং কাগজপত্র বুঝে নিই। তিনি তখন ছুটির দরখাস্ত দিয়ে আমাকে তা সেনা সদরে পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ করেন। আমি ফোনে সেনাপ্রধানকে আমার দায়িত্বভার নেওয়ার বিষয়ে অবহিত করি। তাঁকে জিয়াউদ্দিনের ছুটির কথাও বলি। 

কয়েকদিন পর জিয়াউদ্দিন ছুটিতে চলে যান। ছুটিতে গিয়ে তিনি আর আর্মিতে ফেরত আসেননি। পরে তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। তখন ৪৬ ব্রিগেডের অধীনে ৪ হাজারের বেশি অফিসার ও সৈন্য ছিল। এর অধীনে প্রধান ইউনিট ছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল, চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল, ১৬ ইস্ট বেঙ্গল, ২ ফিল্ড আর্টিলারি ও প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সার। 

উল্লেখ্য, জিয়াউদ্দিন লে. কর্নেল র‍্যাঙ্কে থেকেই ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, যদিও এ পদে একজন ব্রিগেডিয়ারের থাকার কথা। কিন্তু যুদ্ধের পরপর আমাদের অনেককেই বাস্তব কারণে উপরের র‍্যাঙ্কের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। 

দায়িত্ব নেওয়ার পর সেদিনই আমি ব্রিগেড স্টাফ অফিসারদের আমার কক্ষে ডাকি এবং সব অফিসারকে ২ ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে দুই ঘণ্টার মধ্যে জড়ো হতে বলি। হঠাৎ ব্রিগেড কমান্ডার বদল হওয়ায় সবাই অবাক হয়েছে বলে মনে হলো। তারা তৎক্ষণাৎ পরিবর্তিত পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেনি। ঢাকা ব্রিগেড তথা ৪৬ ব্রিগেডের আওতাধীন সব ইউনিটের অফিসাররা ওই স্থানে জড়ো হলে আমি তাদের উদ্দেশে ৪০ মিনিটের মতো ভাষণ দিই। ওই বক্তৃতায় আমি ৪৬ ব্রিগেডকে পেশাদার, বলিষ্ঠ, গতিশীল, দৃঢ়, নিয়মানুবর্তী ও সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলার পদক্ষেপসমূহ বর্ণনা করি। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করি, এ ব্রিগেড হবে সম্পূর্ণ দলাদলিমুক্ত, প্রত্যেক অফিসার ও সৈনিকের জন্য আইন হবে সমভাবে প্রযোজ্য। রাজনৈতিক আলোচনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করি। কেউ ইউনিটের বাইরে ব্রিগেড কিংবা সেনাসদরে যেতে চাইলে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিতকরণপূর্বক অনুমতিসাপেক্ষে যেতে হবে এই মর্মে নির্দেশ প্রদান করি। কেউ যেন অধিনায়কদের বৈধ আদেশ অমান্য করার মতো মনোভাব পোষণ না করে সে ব্যাপারেও তাদের হুঁশিয়ার করে দিই। যদি কেউ সামরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিই। আমি তাদের আরো বলি, সেনাবাহিনীতে সবাই স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে যোগদান করেছেন। কাউকে জোর করে ধরে এনে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়নি। ফলে কারো পছন্দ না হলে, এভাবে চাকরি করতে না চাইলে তারা যেন সামরিক পোশাক ছেড়ে দিয়ে তা করে, চাকরিতে থেকে নয়। 

ঠিক এভাবে আমি ঢাকা ব্রিগেডের বিভিন্ন ইউনিটের জেসিও/এনসিও এবং সিপাহিদের পরিষ্কার ও সোজাভাবে বলি যে, সিপাহি থেকে শুরু করে অধিনায়ক পর্যন্ত সকলের জন্য আইন সমভাবে প্রযোজ্য হবে। প্রয়োজনে উচ্ছৃঙ্খলতা কঠোর হস্তে দমন করা হবে। একইভাবে হুঁশিয়ার করি যে, যদি কোনো অধিনায়ক কোনো পর্যায়ে অবৈধ আদেশ দেন তা যেন তারা অগ্রাহ্য এবং প্রত্যাখ্যান করে। আমি সহজভাবে তাদের সামনে কিছু অবৈধ আদেশের দৃষ্টান্ত তুলে ধরি। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, আমিই সম্ভবত প্রথম বাঙালি সামরিক অফিসার যাকে পাকিস্তান সামরিক অ্যাকাডেমি কাকুল-এ শৃঙ্খলার দায়িত্বে ব্যাটালিয়ন সার্জেন্ট মেজর হিসেবে ১৯৬৪ সালে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাই শৃঙ্খলার জন্য কী কী করা প্রয়োজন এবং কীভাবে তা প্রয়োগ করতে হবে সেসব প্রশিক্ষণ ও আইনকানুন প্রয়োগের ব্যাপারে আমি অভ্যস্ত ছিলাম এবং নিজের ওপরও আস্থা ছিল। 

শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেম সামরিক বাহিনীর ভিত্তি। উচ্ছৃঙ্খল সামরিক বাহিনী রাস্তার দাঙ্গাবাজদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। তারা একটা দেশকে যে-কোনো সময় ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীতে আইনকানুন প্রয়োগ করতে আমি সবসময় দ্ব্যর্থহীন ছিলাম। ৪৬ ব্রিগেডে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও দ্বিধাবোধ করিনি। আমি ব্রিগেডের সব ইউনিটে পুরোদমে প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করি। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার রাতে প্রশিক্ষণের প্রথা চালু করি। এ প্রশিক্ষণ ভোর পর্যন্ত চলত। ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে শুরু করে প্রত্যেক ইউনিটের এই প্রশিক্ষণ-পদ্ধতিতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। প্রশিক্ষণকালীন সব অফিসার ও সৈন্যকে উপস্থিত থাকতে হতো এবং কার্যক্রমে সরেজমিনে উপস্থিত থেকে অংশগ্রহণ করতে হতো। এতে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগই রাখিনি। আমার ওই সামরিক কার্যকলাপে কিছু সিনিয়র অফিসার অসন্তুষ্ট ছিলেন। হয়তো আমার ব্রিগেডে তাদের কিছু জুনিয়র প্রিয়পাত্রের এসব পছন্দ হতো না। তারা সেসব সিনিয়রদের কাছে গিয়ে নালিশ করত। তাঁরা মনে করতেন, আমি খুব বেশি চাপ প্রয়োগ করছি। 

তবে আমি আর্মিতে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য কোনোকিছু করতে কখনো উদ্যোগী হইনি। সর্বদা আর্মি শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার ওপর জোর দিয়েছি। এমনকি স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীনও আমার অধীনস্থ অফিসার এবং সৈনিকগণকে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও আইনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে শ্রদ্ধাশীল হতে সর্বদা উপদেশ দিয়েছি এবং প্রয়োজনে তা পালন করতে বাধ্য করেছি। ফলে আমার অধীনে সে সময় কোনো উচ্ছৃঙ্খলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হলো, ‘৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমার অধীনস্থ দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢাকায় প্রবেশ করলেও কোনো পরিত্যক্ত দোকানপাট বা ঘরবাড়িতে লুটপাট কিংবা অন্য কোনো অনৈতিক বা অবৈধ কার্যকলাপের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে ছিল না। বলতে দ্বিধা নেই, এই লেখা লিখতে বসে আজ সেসব সৎ সৈনিকের কথা মনে পড়ে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠছে। ঢাকায় সে সময়কার লুটপাটের কথা অনেকেরই মনে আছে এবং এ লেখায় আগেই আমি তা বর্ণনা করেছি। 

ইউনিটগুলোতে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা ঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে কি না তা যাচাই করার জন্য একদিন ভোরে আমি জয়দেবপুরস্থ ১৬ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরিদর্শনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, ভোরে প্রশিক্ষণ চলাকালে কোনো অফিসার উপস্থিত নেই। তখন সেখানে উপস্থিত সুবেদার মেজরকে বলে আসি, অধিনায়ক যেন আমার সঙ্গে ঢাকায় ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে এসে দেখা করেন। বলেই আমি জয়দেবপুর থেকে ঢাকায় চলে আসি। অধিনায়ক দুপুরবেলায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য এলে তাঁকে নির্দেশ দিই তাঁর সমস্ত অফিসার ও সৈনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পায়ে হেঁটে যেন সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ব্রিগেড মাঠে এসে উপস্থিত হন। তাঁকে আরো বলি সেখানে রাতের খাবারের ব্যবস্থা থাকবে। পরদিন সকালে তারা পায়ে হেঁটে আবার জয়দেবপুর যাবে। 

আমি এই দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি শুধু এজন্য যে, আর্মিতে আইনশৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা যেন ঠিক থাকে তার যথার্থ বিকাশের স্বার্থে। অন্য কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়। এখানে একটি সামরিক প্রবাদ উল্লেখ করা প্রয়োজন-‘কম্যান্ড ইজ সিম্পল ইন কনসেপশন বাট ডিফিকাল্ট ইন এক্সিকিউশন’। সামরিক বাহিনীতে আদেশ দেওয়া সহজ, কিন্তু বাস্তবে তা পালন করানো সহজ নয়, বিশেষ করে যুদ্ধ কিংবা কোনোরকম সমস্যা প্রাণপণ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে, যার প্রমাণ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে অসংখ্য রয়েছে। 

মুক্তিযুদ্ধের সাহসিকতা পদক 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের কার্যালয় ছিল কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অধিনায়ক কর্নেল ওসমানী থাকতেন এবং তাঁর অফিসও সেখানেই ছিল। সে সময় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান এক অধ্যাদেশবলে সাহসিকতা পুরস্কার পদক প্ৰবৰ্তন করেন। সবাইকে এ মর্মে তিনি একটা বিজ্ঞপ্তি বিলি করেন। সাহসিকতার জন্য পদকগুলো নিম্নরূপ মর্যাদাভিত্তিক ছিল : ১) বীরশ্রেষ্ঠ, ২) বীর উত্তম, ৩) বীর বিক্রম এবং ৪) বীর প্রতীক। 

যুদ্ধ চলাকালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাংলাদেশ সরকার তাৎক্ষণিকভাবে সাহসিকতার পদকে ভূষিত করেন। তবে সে সময় কোনো মেডেল বা সনদপত্র ছিল না। শুধু পত্রের মাধ্যমে জানানো হতো। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে অধিনায়কদের তাঁদের অধীনস্থ অফিসার, সৈনিক ও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার বিষয়ে লিখিত আকারে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য বলা হয়। যুদ্ধের সময়ও কিছু-কিছু প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল। স্বাধীনতার পরপর ঢাকায় মিন্টো রোডের একটা বাড়িতে কর্নেল ওসমানী থাকতেন। সেখানে কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার মিলে সাহসিকতার পদকের তালিকা তৈরি করেন। কর্নেল ওসমানীর স্বাক্ষরে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ মুজিবের অনুমোদনের পর সে তালিকা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ওই তালিকা দেখে মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়র অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কারণ, সব সেক্টর কমান্ডারকে বীর উত্তম খেতাবে (জীবিতদের জন্য সর্বোচ্চ খেতাব) ভূষিত করা হয়েছে। অথচ বেশির ভাগ সেক্টর কমান্ডারের সদর দপ্তর ছিল ভারতের অভ্যন্তরে এবং যুদ্ধের নয়মাস তাঁরা সেখানেই কাটিয়েছেন। তাঁরা কোথায় বীরত্ব দেখালেন তা নিয়ে কানাঘুষা শুরু হল। 

সেক্টর কমান্ডারদের দায়িত্ব ছিল প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা, যুদ্ধ পরিচালনা, প্রশাসন, নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে। ফলে সব সেক্টর কমান্ডার যে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন তার কোনো লিখিত প্রমাণ বা প্রতিবেদন ছিল না। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে অনেকের নিয়োগও বিতর্কিত ছিল। কারণ এক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা ও নিয়মনীতির কোনো বালাই ছিল না। নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডারগণ, যাঁরা সম্মুখসমরে নয়মাস যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন তাঁদের অনেককেই উপযুক্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। 

তা ছাড়া এমনও হয়েছে যে, সরাসরি বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না এমন কিছু ব্যক্তিকেও সাহসিকতার পুরস্কার দেওয়া হয়। যারা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যথা পরিকল্পনা, প্রশাসন, প্রচার, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন তাঁদের সাহসিকতার পদক দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বরং তাঁদেরকে অন্য কোনো পদক যথা প্রশাসনিক পদক দেওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। সেটা অন্যান্য দেশেও প্রচলিত। কারণ, এসব কাজ সাহসিকতার পর্যায়ে পড়ে না। 

সাহিসকতার এ পদক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় একজন ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে আমি তা নিয়ে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করি। তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে নিয়ে যান। আমি প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে অবহিত করি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পদকতালিকা রহিত করার আদেশ দেন। এ রহিতাদেশ পরের দিনই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু কয়েক দিন পর ওই রহিতাদেশ বাতিলপূর্বক আগের পদকগুলোই বহাল রাখা হয়। 

পরে জেনেছি ওই তালিকা বহাল রাখার জন্য স্বার্থান্বেষী মহল থেকে জোর প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। পরে আমি যখন বাংলাদেশ আর্মির অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হই তখন এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র খুঁজে সাহসিকতা পদকপ্রাপ্ত অনেকেরই লিখিত প্রতিবেদন (Citation ) পাইনি। শুধু একটা নামের তালিকা ও সরকারি গেজেট ছিল। উল্লেখ্য, এ পদকপ্রাপ্তির সুপারিশের সঙ্গে সাহসিকতার প্রকৃত ঘটনার উল্লেখ্য ন্যূনপক্ষে দুতিনজন চাক্ষুষ সাক্ষী, বক্তব্য ইত্যাদির এবং এর পরে প্রয়োজনে অনুসন্ধান করে যাচাই করার ব্যবস্থা থাকাই নিয়ম। তার পরেই যথাযথ নিরীক্ষার ভিত্তিতে সাহসিকতা পদক পাওয়ার কথা। অথচ স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য পদক দেওয়া হয়েছে এমন ব্যক্তিদেরও, যাঁরা যুদ্ধের নয়মাস বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেননি। 

মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র ও ফ্রাইডে ফাইটার 

ঠিক এমনিভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র ইস্যু ও বিতরণ নিয়ে অনেক অনিয়ম করা হয়। এ নিয়ে এমন হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেজন্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা আজও ক্ষুব্ধ। যাচাই না করে ঢালাওভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র দেওয়া হয় দেশের লোক থেকে শুরু করে ভারতে অবস্থানকারী শরণার্থী পর্যন্ত— যুদ্ধে যাদের কোনো প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অবদান ছিল না। এমনকি সময়ে সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কর্মকর্তা করা হয় এমন সব ব্যক্তিকে যাঁদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ কিংবা কোনো ভূমিকা ছিল না। খুব বেশি ত্যাগ করলে তাঁরা দেশত্যাগ করে শরণার্থী হয়েছিলেন। এঁদেরকে শুধু রাজনৈতিক কারণে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হতো এবং তাঁরা অবাধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সনদপত্র বিতরণ করতেন। 

এজন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ওপর সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের কোনো শ্রদ্ধা তৈরি হয়নি। দেখা গেছে, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কর্মকর্তারও পরিবর্তন ঘটেছে। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে জেনারেল এরশাদ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান উপদেষ্টা যদিও আমরা তিনজন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ঢাকায় চাকরিরত ছিলাম। এরপর এরশাদকে সেনাপ্রধান করা হলে আমাকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। আমি দুতিন দিন মুক্তিযোদ্ধা সংসদে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করি এবং নেতাদের জানাই যে, এটাকে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে যা যা প্রয়োজন সবকিছু করা হবে। প্রকৃত প্রতিনিধি বাছাইয়ের জন্য আমি অচিরেই নির্বাচন দেওয়ার কথা বলি। 

এর কদিন পর জেনারেল এরশাদ আমাকে জানান, রাষ্ট্রপতি জিয়া মনে করেন যেহেতু অ্যাডজুটেন্ট জেনারেলের কাজ ছাড়াও আমি ক্যাডেট কলেজ, সেনাকল্যাণ সংস্থা ইত্যাদিতে দায়িত্ব পালন করি, তাই মুক্তিযোদ্ধা সংসদে হয়তো বেশি সময় দিতে পারব না। সপ্তাহখানেক পার না হতেই সরকারি আদেশবলে আবার জেনারেল এরশাদকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। 

বস্তুত তিন-চারদিন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কাজকর্ম দেখার সুযোগে যা বুঝতে পেরেছি তা হলো, যাঁরা এই সংসদটির বিভিন্ন পদ দখল করে আছেন তাঁরা সরকার থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতেই ব্যস্ত। আমি এটা বন্ধ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। যেমন—পরিত্যক্ত কিছু শিল্পকারখানা সংসদকে সরাসরি বরাদ্দ করা। বিভিন্ন জনকে পারমিট দেওয়া ইত্যাদি কিছু ফাইল আমার কাছে এসেছিল সুপারিশের জন্য। কিন্তু এসবে আমি কোনো সাড়া দেইনি। 

এখনও নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর প্রক্রিয়া চলছে। নিজের কথা বলতে পারি। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের দুজন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সনদপত্র পাওয়ার পরও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদনপত্রে ছাপানো ফর্ম (আপিল ফর্ম) সরকারিভাবে আমার কাছে পাঠানো হয়। সেই ফর্মটি অবশ্য আমি পূরণ করিনি। এসব অবমাননাকর পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে এখন নিজেকে একজন সাহসিকতা পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ হয়। 

এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। যুদ্ধের প্রয়োজনে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে নিয়মিত বাহিনীর জন্য নতুন লোকবলের দরকার হয়। উপযুক্ত লোক না পেয়ে শরণার্থী শিবির ও অন্যান্য উৎস থেকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের নিয়মিত বাহিনীতে নিতে বাধ্য হই। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের অনেকেই নিয়মিত বাহিনীতে যোগ দিয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু সেক্টরের অধীনে অনিয়মিত বাহিনীতে কাজ করতে উৎসাহী ছিল। একদিন কথা প্রসঙ্গে এ বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের দৃষ্টিগোচর করি। শুনে তিনি অবাকই হলেন। 

অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা সনদধারী লোকজন সর্বত্র, সর্বক্ষেত্রে। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফ্রিডম ফাইটারদের কটাক্ষ করে সংক্ষেপে ‘এফএফ’ অর্থাৎ ‘ফ্লাইডে ফাইটার’ কিংবা ‘১৬ ডিভিশন’ বলে অভিহিত করতেন অনেকে। কারণ আমাদের বিজয়দিবস ছিল ১৬ ডিসেম্বর এবং তার পরদিন ছিল শুক্রবার। 

খাদ্যসংকট ও অস্ত্রউদ্ধার 

১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ঢাকা সেনানিবাসের আর্মি হেডকোয়ার্টার অফিসার মেসে আমার বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও বিয়েতে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন এবং বেশকিছু সময় অনুষ্ঠানে কাটান। এত ব্যস্ততার মধ্যে তিনি আমার বিয়েতে সময় দেওয়ায় আমি সত্যিই অভিভূত হই। আমার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর হৃদ্যতা অনেকেই লক্ষ করেন। বিয়ের জন্য আমি একদিন ছুটি নিয়েছিলাম। পরদিন আমি কাজে যোগদান করি। কারণ, তখন দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, চোরাচালান এবং খাদ্যাভাব দেখা দেয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের রাস্তাঘাট এবং পরিবহণব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। তাই ঠিকমতো খাদ্যশস্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। সেজন্য চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্রবন্দর থেকে দেশের সর্বত্র খাদ্য সরবরাহের কাজেও আর্মিকে নিয়োজিত করা হয়। এর অংশ হিসেবে আমার ব্রিগেডও নারায়ণগঞ্জ, পোস্তগোলা ইত্যাদি স্থানে মালামাল খাদ্যগুদামে আনা-নেওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিল। 

দেশে তখন পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র ছিল। অথচ তা ভালোভাবে উদ্ধার করা হয়নি। খাদ্য পরিস্থিতি জরুরিভাবে মোকাবিলায় রেশনকার্ড পদ্ধতি চালু ছিল। কিন্তু অনেক ভুয়া রেশনকার্ড দেওয়া হয়েছিল এসব ভুয়া রেশনকার্ড উদ্ধারের কাজও আমার ব্রিগেডের ওপর ন্যস্ত ছিল। 

একদিন আমি সেনাবাহিনীর কার্যক্রম প্রত্যক্ষভাবে দেখার জন্য বিজয়নগরের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন সেখানে কর্তব্যরত আর্মি কমান্ডার আমাকে জানান, ওই এলাকায় একটি বিল্ডিঙের দোতলায় অবস্থিত যুবলীগের অফিসে অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ আছে। তাঁদের সঙ্গে একজন ম্যাজিস্ট্রেটও ছিলেন। আমি তখন নির্দেশ দিই, ম্যাজিস্ট্রেট যেন আর্মির সহায়তায় যুবলীগ অফিসে এসব অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সন্ধান করেন। যুবলীগের অফিসে তখন তালা লাগানো ছিল। তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে প্রাপ্ত সামগ্রীর তালিকা তৈরিসহ সবকিছু আইনানুযায়ী ঠিকমতো করার জন্য তাঁদের নির্দেশ দিই। 

ম্যাজিস্ট্রেট আর্মির সাহায্যে তালা ভেঙে অফিসের ভেতরে প্রবেশ করেন এবং ১২টি ডিপি (ড্যামি প্র্যাকটিস) ৩০৩ রাইফেল উদ্ধার করেন। এই রাইফেলগুলো বেসামরিক ব্যক্তিদের কাছে থাকার কথা নয়। প্রশিক্ষণের কাজে এ ধরনের অস্ত্র সামরিক ও পুলিশবাহিনীতে ব্যবহার করা হয়। যাহোক, এ রাইফেলগুলো জব্দ করা হয়। পরে জানতে পারি ওইদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রী ঢাকার তৎকালীন জেলা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াৎ (পরে সচিব) এবং পুলিশের এসপি মাহবুবউদ্দিন (পরে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী)-কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে জানান, ঢাকা শহর থেকে অবৈধ অস্ত্রউদ্ধারের ভার সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত। তারই অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী যুবলীগ অফিস তল্লাশির নির্দেশ দেয়। 

এর কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় কথা প্রসঙ্গে এ বিষয়টি আমি নিজেই উত্থাপন করি। তিনি হেসে জানতে চান, ওই তল্লাশির সময় কোনো অস্ত্র পাওয়া গেছে কি না। আমি জবাবে বলি, ১২টি ড্যামি প্র্যাকটিস রাইফেল পাওয়া গেছে যা শুধু প্রশিক্ষণের কাজে সামরিক ও পুলিশবাহিনীতে ব্যবহৃত হয়। প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে আর কোনো মন্তব্য করেননি। 

১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন 

১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন দেশে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়। এ সাধারণ নির্বাচনেও আর্মিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যবহার করা হয়। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত রব-জলিলের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ভোটে কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে। সে সময় জোর গুজব ছিল যে প্রত্যেক সেনানিবাসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে, প্রচুর ভোট পাওয়ার কথা কিন্তু কারচুপির মাধ্যমে তাদের হারানো হয়েছে। মূলত দেশে যে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান ছিল তার প্রভাব আর্মিতেও পড়ে। সেজন্য আমি সর্বদা সতর্ক ছিলাম। জাসদ ও অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক দল আর্মিতে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের লক্ষ্যে আর্মি সম্পর্কে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিত 

সে সময় ঢাকার বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় জাসদ নেতা মেজর জলিল তাঁর বক্তৃতায় জোর গলায় দাবি করেন, ‘আর্মিও আমাদের সঙ্গে আছে’। কদিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি জলিলের বক্তৃতার বিষয়টি শুনেছি কি না। আমি তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করি যে, আমার অধীনস্থ অফিসার ও সৈনিকদের প্রতি আমার আস্থা আছে এবং তাদের কাছে এ ধরনের বাগাড়ম্বরের কোনো গুরুত্ব নেই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আর্মিতে জাসদের রাজনীতি সক্রিয় কি না? 

আমি উত্তরে বলি, কমান্ডারগণ যদি অরাজনৈতিক, দক্ষ এবং পেশাদার হন তবে তাঁর অধীনস্থ অফিসার ও সৈনিকগণ রাজনীতিতে জড়াবে না এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সামরিক আইনে গুরুতর অপরাধ। মূলত সেনাবাহিনীকে অরাজনৈতিক রাখার দায়িত্ব সরকার ও সংশ্লিষ্ট কমান্ডারদের। মনে হয়, এ উত্তরে তিনি খুশি হয়েছিলেন। 

সাধারণ নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে। জাসদ, অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক দল এবং পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক নেতারাও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি করে ২৯৩ আসন পেয়েছে বলে জোরালো অভিযোগ উত্থাপন করে। অবশ্য এ অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিযুক্ত সামরিক বাহিনীর অফিসারগণও কোনো কোনো স্থানে ভোট কারচুপি হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে এ নির্বাচনে কারচুপি না হলেও আওয়ামী লীগ অন্তত ২৮০টি আসন অনায়াসে লাভ করতে সক্ষম হতো। 

আজ মনে পড়ে, মুজিবহত্যা মামলার অন্যতম আসামি তৎকালীন মেজর রশিদ ওই নির্বাচনের সময় টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতার নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। নির্বাচন চলাকালে তিনি ওই নেতার আগ্রহে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে যাওয়ার জন্য আমার অনুমতি চান। কথা বলার সময় এ কাজে তাঁর মধ্যে একধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত উৎসাহ টের পাই আমি। সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁকে বলি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনোরকম সমস্যা হয়ে থাকলে তিনি যেন উক্ত নেতাকে বলেন থানার সাহায্য নিতে। আমি তাঁকে আরো বলি, একমাত্র পুলিশ ব্যর্থ হলেই সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করবে। যাহোক, আমার আদেশ পেয়ে তিনি নিবৃত্ত হন। উক্ত নেতা ওই আসন থেকে জয়লাভ করেন। 

এদিকে গোপন বামপন্থী রাজনৈতিক দলসহ সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি নির্বাচনের পর গ্রামেগঞ্জে পুলিশ, রক্ষীবাহিনী ও আওয়ামী লীগের সদস্যদের ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি করে। এতে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ঘটে। সে সময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয় খাদ্যাভাব। ফলে পরিস্থিতি কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া স্বাধীনতার পরে অধিকাংশ লোকজনের আকাশচুম্বী আশা-আকাঙ্ক্ষা মেটানো বাস্তব কারণেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এই পরিস্থিতির দায় বহন করতে হয়েছিল সরকারকে। 

পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের প্রত্যাগমন 

১৯৭৩ সালের শেষের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদে কর্মরত বাঙালি অফিসার ও সদস্যদের পাকিস্তান থেকে ফেরত পাঠানো হয়। এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৩ হাজারের মতো। এসব সামরিক লোকজনকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী তথা সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হলো কোনোরূপ ব্যাপক যাচাই-বাছাই ছাড়াই। ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পূর্বে যুদ্ধবন্দি হিসেবে পাকিস্তানের বিভিন্ন শিবিরে এদের রাখা হয়েছিল। প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম পর্যায়ে এদের বেশির ভাগকে ঢাকাতেই রাখা হয়। ফলে প্রশাসনিক, থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য বিষয়ে অসুবিধা দেখা দেয়। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক সরকারি আদেশে সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে সরকারি চাকরিজীবী মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়। তা ছাড়া সামরিক বাহিনীতে চাকরিরত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩-এর মধ্যে প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে পদোন্নতি ও বিভিন্ন উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৭০ সালে আমি ছিলাম মেজর। যুদ্ধের সময় আমি মেজর পদে থেকেই একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের অধিনায়কত্ব করি এবং বিভিন্ন সম্মুখসমরে নেতৃত্ব দিই। ‘৭২ সালের অক্টোবরে আমাকে লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি দিয়ে ব্রিগেড কমান্ডার করা হয়। দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে পূর্ণাঙ্গ কর্নেল হই এবং ওই পদে থেকেই ব্রিগেড কমান্ড করি। পাকিস্তানফেরত অফিসারগণ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের দুই বছরের জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতিকে সহজে মেনে নিতে পারেননি। অথচ নিয়মানুযায়ী যাঁরা পাকিস্তান বন্দিশিবিরে স্থায়ী পদে না থেকে অস্থায়ী পদে ছিলেন তাঁদেরকে পূর্বতন স্থায়ী পদে অর্থাৎ এক র‍্যাঙ্ক নিচে নিয়োগ করার কথা, অস্থায়ী পদের বিপরীতে নয়। যেমন, যিনি পাকিস্তান বন্দিশিবিরে অস্থায়ী মেজর ছিলেন তাঁকে নিয়মানুযায়ী তাঁর পূর্বতন স্থায়ী পদ অর্থাৎ ক্যাপ্টেন হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়ার কথা। নিয়ম থাকলেও পাকিস্তানফেরত অফিসারদের ক্ষেত্রে তা অনুসৃত হয়নি। উপরন্তু পাকিস্তানফেরত অফিসারদের মধ্যে অনেকেই দু-তিন বছরের মধ্যে মেজর থেকে ব্রিগেডিয়ার পর্যন্ত পদোন্নতি লাভ করেন। উদাহরণস্বরূপ তৎকালীন লে. কর্নেল এরশাদ (পরে রাষ্ট্রপতি) পাকিস্তান থেকে ফেরত আসার মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনটি পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হন। শান্তিকালীন সময়ে এরকম পদোন্নতি নজিরবিহীন। তার ওপর এ সময়ে তিনি কোনো পর্যায়ে অধিনায়কত্বও করেননি। তবুও পাকিস্তানফেরত অনেক সামরিক অফিসার মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রিটি ও পদোন্নতি মনেপ্রাণে মেনে নেননি যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনায়। 

ওয়াসিউদ্দিনকে নিয়ে গুজব 

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকিস্তানফেরত সিনিয়র আর্মি অফিসার ছিলেন লে. জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন ও মেজর জেনারেল এম আই করিম। পাকিস্তান আর্মিকে সহযোগিতা করার জন্য মেজর জেনারেল এম আই করিমকে চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়। পাকিস্তান থেকে ফেরত আসার দিন লে. জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে বিমানবন্দরে জেনারেল ওসমানী অভ্যর্থনা জানান। ওসমানী উদ্যোগী হয়ে তাঁকে মন্ত্রী ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করান। ফলে সেনানিবাসে জোর গুজব ছড়িয়ে পড়ে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর স্থলে লে. জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে সেনাপ্রধান করা হবে। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেন এ সম্পর্কে আমি কিছু জানি কি না। উত্তরে আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানি না বলে জানাই। তিনি আমাকে এ সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য বলেন। আমি টেলিফোনে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির বাসভবনে ওই রাতেই দেখা করি। আমি তাঁকে জানাই যে, আর্মিতে জোর গুজব, জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে সেনাপ্রধান করা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জানতে চান, আমি কোথা থেকে এ খবর পেলাম। একটু থেমে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন পরীক্ষিত খাঁটি দেশপ্রেমিক বাঙালিই কেবল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেনাপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এরপর আমি সেনানিবাসে চলে আসি এবং মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার আলোচনার বিষয়ে অবহিত ও আশ্বস্ত করি। 

মুক্তিযোদ্ধা অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্ব 

যাহোক, ওই আত্তীকরণের পর থেকে পাকিস্তান-প্রত্যাগত ও মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের মতো অবস্থা বিরাজ করছিল। প্রত্যাগত অফিসাররা সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারছিলেন না। যদিও তারা চাকরির খাতিরে বাহ্যিকভাবে অধিনায়কত্ব মেনে নিচ্ছিলেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সমালোচনা করতেন এবং তাঁদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট থাকতেন। এ ধরনের অবস্থা সেনাবাহিনীর ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য মোটেই সহায়ক ছিল না। 

আত্তীকরণের ফলে সৃষ্ট মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্ব, বাসস্থান, পোশাক, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির স্বল্পতাহেতু সামরিক বাহিনীতে তখন কিছুটা অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে খাদ্যাভাব, পরিবহণ সংকট, যোগাযোগ অব্যবস্থা ও জরুরি পণ্যসামগ্রী আমদানির ব্যয় মেটানোর কারণে সামরিক বাহিনীতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া তৎকালীন বেসামরিক নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ সামরিক বাহিনীতে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন এ অজুহাতে যে, সামরিক বাহিনীতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে অন্যান্য আধাসামরিক বাহিনী তথা পুলিশ, বিডিআর, আনসার ইত্যাদি বাহিনীকেও দিতে হবে। মনে পড়ে, তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার (পরে মেজর জেনারেল, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) সি আর দত্ত একদিন অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে আমাকে জানান, বেসামরিক প্রশাসনের জনৈক সচিব এক নীতিনির্ধারণী সভায় অত্যন্ত খেদের সঙ্গে বলেছেন, সামরিক বাহিনীর ক্যান্টিন স্টোর ডিপার্টমেন্ট (সিএসডি)-এ কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যাবে না। তা করলে আনসার, বিডিআর ও রক্ষীবাহিনীকে একই সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। সে সময় সামরিক বাহিনীতে এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। সব দেশেই সামরিক বাহিনীর সিএসডিতে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আর্মিকে সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে প্রশিক্ষণে রাখা অধিনায়কদের জন্য সহজসাধ্য ছিল না। 

মিশরের ট্যাঙ্ক 

১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত মাঝারি ধরনের ভারী ৩০টি রাশিয়ান টি-৫৪ ট্যাঙ্ক বাংলাদেশকে উপহার দেন। আমি তখনও ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার। এ ট্যাঙ্কগুলো নিয়ে আসার জন্য তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে একদল সামরিক প্রতিনিধিদল মিশর সফরে যান এবং ট্যাঙ্কগুলো জুন ও জুলাই মাসে ঢাকায় এসে পৌঁছে। একদিন কথা প্রসঙ্গে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ট্যাঙ্কগুলোকে উত্তরবঙ্গের রংপুর সেনানিবাসে পাঠানোর প্রস্তাব করি। কারণ ঢাকায় এ ধরনের ট্যাঙ্ক রাখার প্রয়োজন নেই এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ারও সুযোগ-সুবিধা নেই। এ ছাড়া পাকিস্তান আমলে আনীত প্রথম ট্যাঙ্কগুলোও সার্বিক বিবেচনাপূর্বক রংপুরে পাঠানো হয় এবং সেখানে ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টও ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমার কথার কোনো গুরুত্ব দেননি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ১৯৭৫ সালে মুজিবহত্যার সময় ওই ট্যাঙ্কগুলোই ব্যবহার করা হয়েছিল। অবশ্য এর আগেই আমাকে ঢাকা ব্রিগেড থেকে সরিয়ে লগ এরিয়ার অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, পাকিস্তান থেকে প্রথম যখন এ অঞ্চলে ট্যাঙ্ক আনা হয় তখন আমি ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক প্রধানের এডিসি। 

প্রথম ল্যান্সারে অব্যবস্থা 

প্রসঙ্গত বলতে হয়, ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার থাকাকালে ১৯৭৩ সালের সম্ভবত জুলাই মাসের কোনো একদিন ভোরে অতর্কিতে আমি আমার অধীনস্থ প্রথম ল্যান্সার (ট্যাঙ্ক ইউনিট) পরিদর্শনে যাই। এ ইউনিটে মুজিবহত্যাকারী মেজর ফারুক (পরে লে. কর্নেল) তখন কর্মরত ছিল। আমি যখন ইউনিট পরিদর্শনে যাই তখন প্রশিক্ষণ চলার কথা। অথচ গিয়ে দেখতে পাই, ইউনিটের লোকজন ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করছে : কেউবা গাছের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ইউনিটে তখন ৮০০/৯০০ সৈন্য। আমি তাদের বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে আমার অফিসে ফেরত আসি এবং ইউনিটের অধিনায়ককে আমার অফিসে ডেকে এনে এ অব্যবস্থার জন্য লিখিত কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিই। বলা বাহুল্য, তাঁর জবাব সন্তোষজনক ছিল না। 

কয়েক দিন পরে যখন তাঁর পদোন্নতির জন্য আর্মি প্রমোশন বোর্ডের মিটিং চলছিল সেনাপ্রধানের সভাপতিত্বে, তখন আমি তার লে. কর্নেল পদে পদোন্নতির জোরালো বিরোধিতা করি। অবশ্য তাঁর কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী বোর্ড-সদস্য পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করেন। ঐ অফিসার ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের কোহাট থেকে স্বল্পমেয়াদি কমিশন পান। সে হিসেবে জ্যেষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁর ইউনিটে বিশৃঙ্খলা থাকায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে আমি তাঁকে পদোন্নতি পাওয়ার অযোগ্য মনে করি এবং বোর্ডে বিরোধিতা করি। ফলে বোর্ডকে তাঁর প্রমোশন স্থগিত রাখতে হয়। অবশ্য পরে ডিসেম্বর মাসে আমার উত্তরসূরির সুপারিশে তিনি লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি পান। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঐ অফিসারের অধীনস্থ অফিসার ফারুক ট্যাংক নিয়ে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবহত্যায় অন্যতম ভূমিকা পালন করে। তবে ঘটনার সময় ফারুকের সেই অধিনায়ক নৈমিত্তিক ছুটিতে ছিলেন। 

দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা 

১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি থেকে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি, বিতরণ এবং আনুষঙ্গিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা ক্রমাবনতির দিকে যেতে থাকে। সে বছর বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কোনো কোনো স্থানে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা বিরাজমান ছিল। খাদ্যশস্য অন্যান্য পণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম সাধারণ জনগণের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। এ পরিস্থিতিতে বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা মওলানা ভাসানী সরকারের বিরুদ্ধে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ফলে রাজনৈতিক মঞ্চ আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ অনশনের কারণে মওলানা ভাসানীর শারীরিক অবস্থা ক্রমশ দুর্বল হয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় উপনীত হলো। ফলে সর্বত্র এই আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে, যদি অনশনে মওলানা ভাসানীর মৃত্যু ঘটে তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সামরিক বাহিনীতেও এর প্রভাব পড়ে। তৎকালীন সেনাপ্রধান আমাকে ঢাকা সেনানিবাসের সৈন্যদের মনোবল সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বললেন। আমি তাঁকে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে বলি। কারণ, আমি পূর্ব থেকেই এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলাম। আমি নিয়মিত আমার অধীনস্থ ইউনিট কমান্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করতাম। তাদেরকে সর্বদা চেইন অফ কমান্ড ঠিক রেখে সতর্ক থাকতে হুঁশিয়ার করি এবং ইউনিটে যেন কোনোরূপ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার লাভ না করে সে ব্যাপারে নির্দেশ দিই। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের অনুরোধে মওলানা ভাসানী অনশন ভঙ্গ করেন। কিন্তু তখনও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমাবনতির দিকে যাচ্ছিল এবং জনগণের মধ্যে অস্থিরতা ও হতাশা বিরাজ করছিল। 

এ সময় সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে বিপুল পরিমাণ পাট ও চাল ভারতে চলে যাচ্ছিল। আর ভারত থেকে আসত কাপড়সহ অন্যান্য তৈরি জিনিস। এমনিতেই সে বছর দেশে খাদ্যশস্য কম উৎপাদিত হয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের দাম প্রায় ৫ গুণ বেড়ে যায়। এ অবস্থায় ঘাটতি মেটানোর জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাংলাদেশের সঙ্গত কারণেই ছিল না। দামবৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট বিরূপ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ বাকিতেও খাদ্যশস্য কিনতে পারছিল না। এদিকে কিউবায় পার্ট রপ্তানির অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রও খাদ্যসাহায্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়। 

বৈশ্বিক এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশে বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চোরাচালান, অরাজকতা ইত্যাদি। তার ওপর ছিল জাসদের গণবাহিনী ও সর্বহারা পার্টির গুপ্ত হামলা, অগ্নিসংযোগের মতো ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে হুহু করে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। 

‘৭৪-এর অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ খাদ্য আমদানির লক্ষ্যে কোনো দেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি সই করতে পারেনি। কিন্তু পরে যখন চুক্তি সই হয়েছে বা খাদ্য এসেছে ততোদিনে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। বিদেশী পত্রপত্রিকার খবরে এতে ২৫ হাজার থেকে ৫ লাখ লোক মারা গেছে বলে বলা হলেও কোন সূত্র থেকে এ ধরনের হিসাব পাওয়া গেছে তা পরিষ্কার ছিল না। যাহোক ‘৭৪-এর ডিসেম্বরে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। 

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর প্রথম তিন বছরে বাংলাদেশ ২.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বৈদেশিক সাহায্য পায়। (সূত্র : আইডিএস বুলেটিন, জুলাই ১৯৭৭, ভল্যুম ৯, ইংল্যান্ড)। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ২৩ বছরেও এতো সাহায্য পায়নি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম জার্মানি মার্শাল প্ল্যানের আওতায় যে বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছিল তাও এই অঙ্কের চেয়ে কম। কিন্তু বাংলাদেশ এই বিপুল পরিমাণ সাহায্য যথাযথভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। 

ঢাকা ব্রিগেড থেকে বদলি 

১৯৭৪ সালের মার্চ মাসের শেষদিকে একদিন সকালে অফিসে গিয়ে আমি টেবিলের ওপর একটি চিঠি দেখতে পাই। তা ছিল সেনাসদর থেকে পাঠানো ছোট একটা সাংকেতিক ইংরেজি বার্তা। বার্তার তর্জমা হলো : ঢাকা ব্রিগেড থেকে আমাকে কুমিল্লায় অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে কমান্ডান্ট হিসেবে বদলি করা হয়েছে। রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে আমার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। কর্নেল শাফায়াত একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি মেজর ছিলেন এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে যুদ্ধে যোগদান করেন। তৎকালীন কর্নেল জিয়াউর রহমানের ‘জেড ফোর্স’-এর অধীনে তিনি ছিলেন ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আর আমি ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক। অবশ্য ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার মেজর জিয়াউদ্দিন পাকিস্তান থেকে আগস্ট মাসে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলে আমি ২য় ইস্ট বেঙ্গলে পুনরায় যোগদান করি অধিনায়ক হিসেবে। 

কর্নেল শাফায়াত পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে আমার পরিচিত। চাকরিতে তিনি আমার ছয় মাসের জ্যেষ্ঠ। তাঁর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। ঢাকা ব্রিগেডের দায়িত্ব নিতে তিনি যখন আমার কাছে আসেন তখন তিনি বেশ সংকোচ বোধ করছিলেন। তিনি আমাকে বলেন, ঢাকা ব্রিগেডের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরমেশনে বদলির জন্য তিনি তদবির, সুপারিশ ইত্যাদির আশ্রয় নেননি। আমি তাঁর কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করি। 

আমি আমার আকস্মিক বদলি সম্পর্কে সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলি। স্বভাবতই আর্মিতে এ ধরনের বদলি সম্পর্কে সেনাপ্রধান কর্তৃক আমাকে পূর্বেই অবহিত করার কথা। তিনি জানান, তাঁর কোনোরূপ সুপারিশ ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ বদলির আদেশ হয়েছে। আমি তাঁকে সবিনয়ে জানাই, যদিও আমি পূর্ণাঙ্গ কর্নেল এবং বাংলাদেশ সামরিক অ্যাকাডেমিতে ওই পদের বিপরীতেই আমাকে বদলি করা হয়েছে, কিন্তু গত দুই বছর যাবৎ আমি অফিশিয়েটিং ব্রিগেডিয়ার হিসেবে কাজ করে আসছি। ব্রিগেডিয়ার পদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেহেতু আমার এ বদলি কোনো পেশাগত অযোগ্যতা বা অদক্ষতার কারণে নয়, সেহেতু কর্নেল হিসেবে মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগদান করা পদাবনতিরই শামিল। তা ছাড়া সম্প্রতি আমার ঊর্ধ্বতন রিপোর্টিং কর্মকর্তা উপসেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান আমার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (যা আর্মিতে দেখিয়ে স্বাক্ষর নেওয়াই নিয়ম) আমাকে একজন ‘অসাধারণ দক্ষ অধিনায়ক’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। 

আমার বক্তব্য শুনে সেনাপ্রধান বললেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করে তিনি আমাকে জানাবেন। দুদিন পর তিনি আমাকে জানালেন, ঢাকাতে প্রথমবারের মতো ‘লজিস্টিক এরিয়া কমান্ড’ গঠিত হচ্ছে এবং আমাকে তার অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ করা হবে, যে পদ ব্রিগেডিয়ার-এর মর্যাদাসম্পন্ন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানান, আমার বদলি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যখন তাঁকে বললেন, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, দেশের এ পরিস্থিতিতে আমাকে ঢাকা ব্রিগেডে রাখাই সমীচীন হবে। কেননা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে আমি ঢাকায় এবং সে সময় থেকে একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলাম। পরে আবার ঢাকাতেই আমাকে ঢাকা ব্রিগেডেরই অধিনায়ক নিয়োগ করা হয়। ঢাকায় আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাপ্রধান হয়তো আমাকে ঢাকা ব্রিগেডেই রাখা সমীচীন মনে করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এর উত্তরে বলেন, রাজনৈতিক স্বার্থে এ বদলি প্রয়োজন ছিল, যার অর্থ সেনাপ্রধান বুঝে উঠতে পারেননি বলে আমাকে জানান। 

আমি আমার নতুন কর্মস্থল ঢাকা সেনানিবাসে লগ এরিয়ার অধিনায়ক হিসেবে যোগদান করি। এ লগ এরিয়া ছিল সম্পূর্ণ নতুন। তাই আমি এ নতুন সংস্থাকে গড়ে তোলার কাজে সম্পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করি। তবে প্রায় বিকেলবেলায় আমার নিয়মিত অভ্যাসমতো বিভিন্ন সেনা ইউনিটে গিয়ে জুনিয়র এবং নন-কমিশন্ড অফিসার এবং সৈনিকদের সঙ্গে বাস্কেটবল খেলতাম। বাইরে আমি এমনিতেই খুব কম যেতাম। শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ছাড়া অন্যদের সঙ্গে আমার তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *