৩০ জানুয়ারির অভিযান
রাতশেষে ৩০ জানুয়ারি সকালে পুলিশ এসে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর তারা ১২নং সেকশনে যায় এবং বিভিন্ন পয়েন্টে সৈন্য মোতায়েন করে। উদ্দেশ্য ছিল পুলিশ বাড়িঘরে তল্লাশি করে চিহ্নিত লোকজনকে গ্রেপ্তার করবে এবং সেনাবাহিনী তাদের সহায়তা করবে। সে অনুযায়ী কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি করা হয় এবং কয়েকজনকে আটকও করা হয়।
সকালবেলায় আমি লে. সেলিমকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ১২নং সেকশনে যাই। আমি সেকশনের মাঝামাঝি একটি উঁচু জায়গায় ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক কথাবার্তা বলি। লে. সেলিমও তখন আমার সঙ্গেই ছিলেন। এর মধ্যে সৈনিকদের খাবার নিয়ে ট্রাকও এসে পৌঁছে। এরপর আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমার ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা হই। লে. সেলিম মোর্শেদের সঙ্গে থেকে যান।
আমি ফিরে আসার আধঘণ্টা পর আনুমানিক ১১টার দিকে চতুর্দিকের বিভিন্ন বাড়িঘর থেকে অতর্কিতে একযোগে মোর্শেদের নেতৃত্বাধীন সৈন্য ও পুলিশের ওপর বিহারিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ফলে চারদিকের প্রচণ্ড আক্রমণের মাঝে পড়ে পুলিশ ও সৈন্যরা হতাহত হয়। তারা পাল্টা আক্রমণের তেমন কোনো সুযোগই পায়নি। লে. সেলিম, সুবেদার মোমেন, নায়েক তাজুলসহ অনেকে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। কোম্পানি কমান্ডার হেলাল মোর্শেদ আহত হন। তাঁর কাঁধে গুলি লাগে। আহত অবস্থায়ও সৈন্যরা পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে।
এদিকে সাড়ে ১১নং সেকশনে অবস্থান নেওয়া হাবিলদার বারকীর প্লাটুনের সৈন্যদের ওপরও বিহারিরা আক্রমণ চালায়। কিন্তু তারা সে আক্রমণ প্রতিহত করে এবং বিহারিদের অনেকে হতাহত হয়। বিহারিরা পুলিশ ফাঁড়ি দখল করতে ব্যর্থ হয় এবং পিছু হটে যায়। ওই ফাঁড়িতে ১০-১২ জন পুলিশও ছিল। সেখানে আমাদের কোনো সৈন্য বা পুলিশ হতাহত হয়নি।
এই আক্রমণের খবর শুনেই আমি আমার অধীনস্থ তৎকালীন মেজর মতিউর রহমানের (পরে মেজর জেনারেল, বর্তমানে মৃত) নেতৃত্বাধীন বি কোম্পানি নিয়ে ১২নং সেকশনের উল্টোদিকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কাছে অবস্থান নিই। সেখানে গিয়েই আমি প্রথমে ১২নং সেকশনের ভেতরে আটকে পড়া সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হই। এরপর মিরপুর এক্সচেঞ্জ থেকে সাড়ে ১১নং সেকশনে অবস্থিত পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন করে হাবিলদার বারকীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি। তখনও তার ওপর এবং আমাদের অবস্থান মিরপুর টেলিফোন এক্সচেঞ্জের দিকে লক্ষ্য করে বিহারিরা গুলি ছুড়ছিল। গোলাগুলির মধ্যে হাবিলদার বারকী আমাকে বিস্তারিত জানালো এবং বললো বিহারিরা তাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। আমি তাকে ওই অবস্থানেই থাকতে আদেশ দেই। এর পরপরই বিকেল ৪টার দিকে আমরা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ওপর এবং কাছাকাছি এলাকা থেকে ১২নং সেকশনের ওপর ভারী অস্ত্রশস্ত্র, মেশিনগান ইত্যাদি নিয়ে আক্রমণ চালাই। সন্ধ্যার পর যখন সশস্ত্র বিহারিরা বারকীর অবস্থানের দিকে আবার অগ্রসর হচ্ছিল তখন ৮১ মিলিমিটার মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করি। আধঘণ্টা এভাবে চলার পর বিহারিদের গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়।
রাতে বারকীকে তার সৈন্যদের নিয়ে সেখানেই থাকতে আদেশ দেই। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিহারিরা আবার থেমে থেমে আমাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে এবং বারকীর প্লাটুনের অবস্থান দখল করতে চেষ্টা করে।
পরদিন সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে আরো ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ আমার পুরো ব্যাটালিয়ন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলকে মিরপুরে নিয়ে আসি। সৈন্যদের চারদিকে সতর্কতার সঙ্গে মোতায়েন করার পর ১২নং সেকশনে যাই। দুজন ভারতীয় সিনিয়র সেনা অফিসারও আমার সঙ্গে যান। ১২নং সেকশনে গিয়ে একটি খোলা জায়গায় বিহারিদের বেশকিছু মৃতদেহ দেখতে পাই মৃতদেহগুলো একটা শামিয়ানার নিচে সারিবদ্ধভাবে রাখা ছিল এবং বেশকিছু মহিলা, যাদের বেশির ভাগ বৃদ্ধা, পাশে বসে কোরান তেলাওয়াত করছিলেন। আমি তাঁদেরকে পুরুষ লোকজন এবং অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তাঁরা কিছু জানেন না বলে জানান। ওইদিন পুরো ১২নং সেকশনে কোনো পুরুষ লোক ছিল না। রাতেই এরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়।
ওই সময় আমাদের সৈন্যদের কোনো মৃতদেহ দেখতে পাইনি। পরিস্থিতির কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ভেতরের দিকে খোঁজাখুঁজি করা সম্ভব হয়নি। ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদসহ আহতরা আগের রাতেই তাদের অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন পর্যন্ত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) কাজকর্ম শুরু হয়নি।
ওইদিন সকালেই তৎকালীন কর্নেল শফিউল্লাহ ও খালেদ মোশাররফ মিরপুর আসেন। আমরা আলোচনা করে ঠিক করি যে, পুরো মিরপুর তথা ১নং সেকশন থেকে পর্যায়ক্রমে ১২নং সেকশন পর্যন্ত অস্ত্রমুক্ত করতে হলে আরো সৈন্য প্রয়োজন। এ পরিপ্রেক্ষিতেই চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যারা কদিন আগে ঢাকায় এসে পৌঁছেছে, তাদেরকেও মিরপুরে নিয়ে আসা হয়। চতুর্থ বেঙ্গলকে ১, ২ ও ৬ নং সেকশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর আমার দ্বিতীয় বেঙ্গলকে দায়িত্ব দেয়া হয় ১০, ১১ ও ১২নং সেকশনের। আমাদের দায়িত্ব ছিল অস্ত্রউদ্ধার ও পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা।
প্রতিদিন সকালে সৈন্য মোতায়েন করে কারফিউ জারি করে সেকশনের লোকজনকে উন্মুক্ত স্থানে আসার জন্য এবং যার কাছে যেরকম অস্ত্র আছে তা নির্দিষ্ট স্থানে জমা করার জন্য বলা হতো। অস্ত্র, গোলাবারুদের অবস্থান পরীক্ষা করে দেখার জন্য বাড়িঘর খালি করতে বলা হতো। এতে কিছু স্থান থেকে বাধা আসে। আমরা তা শক্ত হাতে দমন করি। ৩০ তারিখের পর আমাদের কেউ হতাহত হয়নি। বরং আদেশ অমান্য করার কারণে তাদের অনেকেই হতাহত হয়। এভাবে আমরা ১০ দিনের মতো মিরপুরে তল্লাশি চালাই এবং বিস্তারিত পরিকল্পনা করে সমস্ত অবাঙালি এবং তাদের সহযোগীদের মিরপুর থেকে ঢাকার অদূরে মুড়াপাড়ায় একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে সরিয়ে নিই। পুলিশ বেছে বেছে কিছু রাজাকার ও তাদের সহযোগীদের গ্রেপ্তার করে। এভাবে প্রতিদিন মিরপুর থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। আমার এলাকা, বিশেষ করে ১১ ও ১২নং সেকশন থেকে কয়েক ট্রাক বিভিন্ন ধরনের সয়ংক্রিয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়। মিরপুরের অনেক বাড়িঘর ছিল দুর্গের মতো। শেষ পর্যন্ত মিরপুর এলাকাকে জনশূন্য করা হয়। এ সময় থেকেই ভারতীয়বাহিনী আস্তে আস্তে ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করে।
মিরপুর থেকে আমরা প্রথমবারের মতো ঢাকা সেনানিবাসের তৎকালীন আইয়ুব লাইন, বর্তমানে শহীদ মন্নান লাইনে এসে স্থায়ী হই। নায়েক মন্নান মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটের কাছে একটি চা-বাগানে পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধে শহীদ হন। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিক এবং একজন ভালো বাস্কেটবল খেলোয়াড়। ‘৭২-এ জেনারেল আইয়ুব খানের নামানুসারে দেওয়া আইয়ুব লাইনের নাম পরিবর্তন করে এই বীর সৈনিকের নামেই ওই লাইনের নামকরণ করা হয়।
সেনানিবাসে এসে মিরপুরে ৩০ জানুয়ারির হতাহতদের ব্যাপারে বিস্তারিত অনুসন্ধান শুরু করি। সেদিন বিহারিদের আক্রমণের মুখে বেঁচে যাওয়া সেনাসদস্যদের কাছ থেকে ঘটনার আদ্যোপান্ত শুনি। বিশেষ করে ডি কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদ ও প্লাটুন কমান্ডার হাবিলদার ওয়াজেদ আলী মিয়া বারকী ঘটনার বিস্তারিত জানান। বারকীর প্লাটুনের কোনো সৈন্য হতাহত হয়নি। তবে ১২নং সেকশনের ভেতরে অবস্থানকারী বাকি দুই প্লাটুনের প্রায় ৪২জন সেনাসদস্য নিহত হন। এ ছাড়া কর্তব্যরত বেশ কয়েকজন পুলিশও হতাহত হন। নিহত সেনাসদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সেকেন্ড লে. এস এম কামরুল হাসান সেলিম, সুবেদার আব্দুল মোমিন, হাবিলদার ওয়ালীউল্লাহ, হানিফ, নায়েক হাফিজ, তাজুল হক প্রমুখ। এ ছাড়া ক্যাপ্টেন মোর্শেদ ও নায়েক আমীর হোসেনসহ কয়েকজন আহত হন। নিহতদের মধ্যে লে. সেলিমসহ মাত্র কয়েকজনের মৃতদেহ দিন দুয়েক পর পাওয়া যায়। পুরো এলাকা জনশূন্য করার পরও বাকিদের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। ৩০ জানুয়ারি রাতেই সম্ভবত বিহারিরা সেগুলো সরিয়ে ফেলে।
প্রসঙ্গ জহির রায়হান
এদিকে ৩১ জানুয়ারি থেকে পত্রপত্রিকায় সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়ার খবর বের হতে থাকে। কিছু লোক, সম্ভবত তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব, মিরপুরে এসে তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন আমি তাঁকে নামে চিনতাম না বা তাঁর সম্পর্কে বিশেষ জানতাম না। এরই মধ্যে একদিন একজন পুলিশ কর্মকর্তা, যাঁর নাম আজ মনে নেই, সেনানিবাসে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি জহির রায়হানের ছবিও নিয়ে আসেন। তিনি সৈন্যদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য আমার অনুমতি চান। বিস্তারিত আলাপের পর আমি ওইদিন মিরপুরে উপস্থিত সৈন্যদের কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর কথা বলার ব্যবস্থা করে দিই। সেনাসদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তিনি আবার আমার অফিসে আসেন। আলাপে তিনি আমাকে জানান, ‘আপনাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এবং আমাদের তদন্তে মনে হচ্ছে জহির রায়হান সৈন্য ও পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের সময় বিহারিদের গুলিতেই নিহত হয়েছেন।’
অবশ্য এর আগেই আমরা যখন নিজেদের সদস্যদের হতাহতের খোঁজখবর তথা প্রাথমিক তদন্ত শুরু করি, তখনই সৈন্যদের সঙ্গে একজন বাঙালি বেসামরিক লোক নিহত হয় বলে তথ্য বেরিয়ে আসে। ঘটনা বিশ্লেষণে বোঝা যায় যে, তিনিই ছিলেন জহির রায়হান।
জহির রায়হানের মিরপুর যাওয়া নিয়ে অনেক ধরনের কথা প্রচলিত আছে। তবে এটা সত্যি যে, তিনি তাঁর ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজেই মিরপুর যান। ভোরবেলায় তিনি মিরপুরে গেলে সৈন্যরা তাঁকে ভেতরে যেতে বাধা দেয়। পরে সৈনিকেরা তাঁকে ২নং সেকশনে কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের কাছে নিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন মোর্শেদ তখন পুলিশ ও তাঁর প্লাটুন কমান্ডারদের নিয়ে সমন্বয় সভায় ব্যস্ত। ক্যাপ্টেন মোর্শেদকে তাঁর আসার উদ্দেশ্য জানানোর পর তিনি দূর থেকে সংশ্লিষ্ট সেনাসদস্যকে বলেন যে, ‘ঠিক আছে তিনি পুলিশের সঙ্গে ভেতরে যেতে পারেন।’ এই বলে ক্যাপ্টেন মোর্শেদ তাঁর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
প্রাথমিক তদন্তের সময় সাড়ে ১১নং সেকশনে মোতায়েন সৈন্যদের কয়েকজন জানান, সকাল সাড়ে ৯টা/১০টার দিকে তাঁরা হালকা-পাতলা গড়নের একজন বেসামরিক লোককে সাড়ে ১১ ও ১২নং সেকশনের মাঝামাঝি রাস্তায় একা একা হাঁটতে দেখেন। এ ছাড়া জহির রায়হানের ছবি দেখার পর সৈন্যদের কয়েকজন ওই রকম গড়নের একজনকে সেখানে দেখেন বলেও জানান। ১১টার দিকে বিহারিরা সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করে। অতর্কিত সেই আক্রমণে সৈন্যদের সঙ্গে তিনিও নিহত হন। তবে ঠিক কোন জায়গায় তিনি নিহত হন তখন তা সঠিক কেউ বলতে পারেনি। ৪২জন সেনাসদস্যের মধ্যে তিন-চারজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। জহির রায়হানসহ বাকি কারোই মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।
পিলখানায় সংঘর্ষ
মিরপুরের ঘটনার খুব সম্ভবত এক বা দুদিন পর আজিমপুরে অবস্থিত তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বিডিআর)-এর সদর দপ্তরে দারুণ অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তৎকালীন ইপিআর-এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন অনিয়মিত বাহিনী, যেমন টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী, মুজিববাহিনী ও অন্যান্য কিছু অনিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের জন্য এদের সবাইকে পিলখানায় জড়ো করা হয়েছিল। তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ও আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি নুরুজ্জামানকে (পরে ব্রিগেডিয়ার) এই বাহিনীগঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হওয়ায় সেনাবাহিনী থেকে অবসর পান। পরে তিনি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসে তিনি একবার সিলেটের তেলিয়াপাড়া সীমান্তে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এসে মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে দেখা করেন। দুমাস পর জুন মাসে তিনি সস্ত্রীক আগরতলায় যান এবং ভারতের হেজামারা নামক জায়গায় মেজর শফিউল্লাহর অধীনে ৩নং সেক্টরে যোগ দেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষদিকে মেজর শফিউল্লাহকে যখন ‘এস ফোর্সে’র কমান্ডার নিয়োগ করা হয় তখন নুরুজ্জামানকে ৩নং সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ঘটনার দিন পিলখানায় তিনি যখন সমবেতদের উদ্দেশে বক্তৃতা করছিলেন তখন সাবেক ইপিআরের সৈন্যগণ মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের পদ্ধতি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং একপর্যায়ে সেখানে সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে নুরুজ্জামান গুরুতরভাবে আহত হন এবং তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
পরিস্থিতি এতোই খারাপ হয় যে, মোহাম্মদপুরে অবস্থিত তৎকালীন মেজর জিয়াউদ্দিন (পরে লে. কর্নেল ও সর্বহারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত)-এর অধীনস্থ প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এসে পিলখানার আশপাশে অবস্থান নেয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব সশরীরে সেখানে যান এবং তাঁর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর তিনি বিডিআরকে নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন। সাবেক ইপিআরকে তাদের আগের অবস্থাতেই রাখা হয় এবং নাম পরিবর্তন করে বিডিআর বা বাংলাদেশ রাইফেলস করা হয়। পুলিশের জনৈক এসপি মুজিবুর রহমান কিছুদিনের জন্য এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান ছিলেন। পরে তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার সি আর দত্তকে বিডিআর-এর নিয়মিত মহাপরিচালক করা হয়।
এখানে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। ইপিআরের অধিকাংশ সদস্য বাঙালি ছিল। কিন্তু তাদের অফিসাররা পাকিস্তান আর্মি থেকে প্রেষণে আসত। বর্তমান বিডিআরের মতোই তাদের কাজ ছিল। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন পিলখানা আক্রমণ করে তখন পিলখানার বেশকিছু বাঙালি সদস্য নিহত হন এবং কিছুসংখ্যক পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। বাকি বেশিরভাগই বন্দি হন। যাঁরা সীমান্ত এলাকা এবং জেলা হেডকোয়ার্টারে ছিলেন তাঁদের বেশিরভাগই সরাসরি নিয়মিত বাহিনী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধে তাঁদের অবদান ছিল প্ৰশংসনীয়।
স্বাধীনতার পরপর ইপিআরের বন্দি সদস্যরা মুক্ত হয়ে অন্যদের সঙ্গে পিলখানায় এসে জড়ো হন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন সেক্টরে যাঁরা অনিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন তাঁরাও। নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যাঁরা যুদ্ধ করেছেন সেসব ইপিআর সদস্য তখনও পিলখানায় ফেরত আসেননি। নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গেই ছিলেন।
ওইদিন পিলখানায় যখন ইপিআর বিলুপ্ত করে অন্যান্য অনিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন পিলখানায় অবস্থিত এসব সাবেক ইপিআর-এর সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। যাহোক, পরে তাঁদের বিডিআর নামে পূর্বাবস্থায় রাখা হয় এবং পিলখানাই তাঁদের সদর দপ্তর হিসেবে থেকে যায়। পরে নিয়মিত বাহিনী তথা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন ইপিআর সদস্যরা বিডিআর-এ এসে যোগ দেন। যদিও কিছুসংখ্যক সদস্য, যেমন আমার অধীনে দ্বিতীয় বেঙ্গলে তিন কি চারজন ইপিআর সদস্য, স্থায়ীভাবে সেনাবাহিনীতে থেকে যান। এঁদের মধ্যে অন্তত দুজনের নাম আজও মনে পড়ে। তাঁরা হলেন, সুবেদার আখতার যিনি আখাউড়া যুদ্ধে আহত হন এবং নায়েব সুবেদার হেলাল।
রক্ষীবাহিনী গঠন
বাকি অনিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে পরে ‘রক্ষীবাহিনী’ গঠন করা হয়। এদের বেশিরভাগই ছিল কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী ও মুজিববাহিনীর সদস্য। ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামানকে তাদের প্রধান করা হয়। রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তর করা হয় শেরেবাংলা নগরে। ওই বাহিনীর পোশাক ছিল ভারতীয় বাহিনীর তৎকালীন পোশাকের মতো জলপাই রঙের। তাদের অধিনায়কদের লিডার বলা হতো। তাদের উপরে ছিলেন ডেপুটি ডাইরেক্টরস ও ডাইরেক্টর। তাঁদের সদস্যদের রক্ষী বলা হতো।
এখানে কাদেরিয়া বাহিনী ও মুজিববাহিনীর গঠন বিষয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। কাদের সিদ্দিকী ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সাবেক সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি টাঙ্গাইলে বেশ বড় ধরনের একটি অনিয়মিত বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ৯ মাস জুড়ে সখিপুর, ভুয়াপুরসহ টাঙ্গাইলের পুরো এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। স্বাধীনতার পর বেশ ঘটা করে তিনি ও তাঁর বাহিনী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। তাঁর সেই বাহিনীর সদস্যরাই রক্ষীবাহিনীতে যোগ দেন।
আরেকটি হলো, মুজিববাহিনী বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স। সংক্ষেপে বিএলএফ। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মে মাসের শেষ কিংবা জুনের প্রথম দিকে শেখ ফজলুল হক মনি (শেখ মুজিবের ভাগ্নে ও যুবনেতা), আবদুর রাজ্জাক (বর্তমানে মন্ত্রী), তোফায়েল আহমেদ (বর্তমানে মন্ত্রী) ও সিরাজুল আলম খানের (পরে জাসদ নেতা) উদ্যোগে এ বাহিনীর জন্ম হয়। এ বাহিনী অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার (৮ নং থিয়েটার রোড, কলকাতা) এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল অরোরার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। ভারতীয় এক্সটার্নাল ইন্টেলিজেন্স ও ‘র’-এর প্রধান এবং ভারতীয় মন্ত্রিপরিষদের অধীনস্থ সচিব আর এন কাও-এর অধীনে ভারতীয় স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এসএফএফ)-এর কমান্ডার মেজর জেনারেল এস এস ওবান এদের প্রশিক্ষণ ও পরিচালনের তত্ত্বাবধান করতেন। তাঁর মতে, মুজিববাহিনীর সদস্যদের নির্বাচন করা হতো চার যুব ও ছাত্রনেতার সুপারিশে। ভারতের একটি গোপন এলাকায় এদের ট্রেনিং দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (পরে লে. জেনারেল) টি এস ওবেরয়। প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল বি ডি কুশাল।
মিত্রবাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরার নিয়ন্ত্রণের বাইরে সরাসরি ইন্টেলিজেন্সের অধীনে এই বাহিনী গঠন করা ও তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারতীয় সেনা প্রশাসনে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া প্রবাসী মুজিবনগর সরকারও এ ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তবে কী পরিমাণ লোকজনকে এই বাহিনীর অধীনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তা আমার জানা নেই। ৯ মাসের যুদ্ধে আমার এলাকায় এই বাহিনীর কোনো কর্মতৎপরতা আমার নজরে আসেনি।
তবে মেজর জেনারেল এস এস ওবান যিনি নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই বাহিনীর সর্বময় সামরিক কর্তা ছিলেন বলে দাবি করেন, তিনি ১৯৮৫ সালে তাঁর লিখিত ফেনটমস অফ চিটাগং-দ্য ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ নামক গ্রন্থে বলেন যে, মুজিববাহিনী যুদ্ধের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে তাঁর নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় এসএফএফ-এর সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
এখানে এসএফএফ সম্পর্কে কিছু বলতে হয়। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনীর অধীনে এই ফোর্স গঠন করা হয়। এসএফএফ-এর বেশির ভাগ সদস্য ছিল উত্তর ভারতের উপজাতীয় সম্প্রদায়ের। মূলত গেরিলাযুদ্ধের জন্য এই বাহিনী গঠন করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই এসএফএফকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত করা হয়। এর মূল কারণ ছিল, ভারতের লুসাই পাহাড় অঞ্চলের উপজাতি মিজোরা তাদের আবাসভূমি মিজোরামের স্বাধীনতার জন্য ষাটের দশকের প্রথম থেকে লালডেঙ্গার নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে গেরিলাযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তাদের ঘাঁটি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সার্বিকভাবে সহায়তা করত। মূলত এই মিজোদের ঘাঁটি ধ্বংস ও তাদের দমন করার জন্য এসএফএফ-কে ওই অঞ্চলে নিয়োগ করা হয়। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে মিজোদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করে এবং তাদের সব ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়।
যাহোক আবার রক্ষীবাহিনীর কথায় ফিরে আসি। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে মূলত মুজিববাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে যে রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়, এস এস ওবান দাবি করেন, তাও তাঁর পরামর্শ ও সহায়তায় করা হয়। ওবান আরো দাবি করেন, রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের ভারতে নিয়ে প্রশিক্ষণ ও সাজসরঞ্জাম দেওয়ার ব্যাপারে তিনিই ভারত সরকারকে রাজি করান। তবে এটা সবাই জানে যে, রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের (লিডার) প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো ভারতে এবং সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো ঢাকাস্থ সাভারে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের তত্ত্বাবধানে। অফিসারদের এই ট্রেনিংয়ের মেয়াদ প্রথম দিকে ছিল আড়াই মাস। পরে তা বাড়িয়ে ছয়মাস করা হয়। প্রশিক্ষণশেষে তাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত করা হয়।
সমালোচনার মুখে রক্ষীবাহিনী
তবে একথা সত্যি, সে সময় আমাদের পুলিশবাহিনী তেমন সংগঠিত ছিল না। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর পরিস্থিতির কারণে সমাজে একশ্রেণীর সুযোগসন্ধানী লোকের উদ্ভব হয়। অনেকের হাতে অবৈধ অস্ত্র থাকায় কিছু-কিছু এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটে। তার ওপর গুপ্ত বামপন্থী দলগুলো পুলিশ ফাঁড়ি, থানা ইত্যাদি আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র লুট করত। তা ছাড়া খাদ্যগুদাম লুট, পাটের গুদামে আগুন দেওয়া, রাজনৈতিক, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর আক্রমণ ও তাঁদের হত্যা শুরু করে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রক্ষীবাহিনীকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে মোতায়েন করতে হয়। তাদের ওপর ভরসা করার একটা বড় কারণ, এই বাহিনীর সদস্যরা ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে রক্ষীবাহিনী দ্রুতই সমালোচনার সম্মুখীন হয়। তারা গুপ্ত বামপন্থী দলগুলোর সশস্ত্র আক্রমণের শিকারও হয়। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারাও অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখায়। তাই রক্ষীবাহিনী আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাত বলে অভিযোগ ওঠে। রক্ষীবাহিনীকে অনেকে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডার বলে ধারণা করতে শুরু করে। ফলে রক্ষীবাহিনী নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তথা পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীতে চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
এর প্রথম কারণ, রক্ষীবাহিনী অফিসারদের ভারতীয় উপদেষ্টাদের তত্ত্বাবধানে সামরিক প্রশিক্ষণ দান এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতো পোশাক গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ। তা ছাড়া সামরিক বাহিনীকে বঞ্চিত করে রক্ষীবাহিনীকে সরকার উন্নত বেতন, খোরাক, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে বলে প্রচারণা শুরু হয় যদিও সব অভিযোগ সঠিক ছিল না। তা সত্ত্বেও সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে বিরূপ ধারণা বদ্ধমূল ছিল।
রক্ষীবাহিনী নিয়ে বিভিন্ন স্তরে এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং সত্য-মিথ্যা নানারকম রটনার কারণে সরকারি প্রশাসনের ওপরও এর কালিমা পড়ে। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাদের কার্যকলাপের নানারকম সমালোচনা ও সময়ে সময়ে অতিরঞ্জিত খবর ইত্যাদি বের হতে থাকে। এতে করে জনগণের মনে রক্ষীবাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতার দ্রুত অবনতি ঘটে এবং তাদের ‘ইমেজ’ ক্ষুণ্ণ হয়। এই অবস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তায়ও চিড় ধরায়।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, পুনর্বাসন ও আইনশৃঙ্খলার দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটা সদ্যস্বাধীন দেশে আধাসামরিক কিংবা অন্য কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা গঠন করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে রক্ষীবাহিনী নিয়ে সে সময় দেশে যে বিতর্ক, সমালোচনা ও অবিশ্বাসের ধূম্রজাল তৈরি হয়েছিল তার জন্য দায়ী মূলত এর গঠনপ্রক্রিয়া। রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের ভারতে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং ভারতীয় অফিসারদের ঢাকায় এনে এ বাহিনীর সৈনিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাই এই বাহিনীকে নিয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্য দেয়। কারণ ১৯৭২ সাল থেকে ‘৭৫ সাল পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীকে যখন এই প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল তখন সেনাবাহিনী, বিডিআর এবং পুলিশকে বাংলাদেশের মাটিতে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর অফিসারদের প্রশিক্ষণের জন্য কুমিল্লায় মিলিটারি অ্যাকাডেমি (যা বর্তমানে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে অবস্থিত) স্থাপন করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব নিজে এর উদ্বোধন করেন। সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের চট্টগ্রামের ইবিআরসিতে ও পুলিশকে রাজশাহীর সারদায় এবং বিডিআরের সৈনিকদের পিলখানায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, এমনকি আমরা যারা সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ছিলাম তাদেরও অধীনস্থদের কাছ থেকে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো যে, অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের যখন দেশেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তখন রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের কেন ভারতে নিয়ে প্রাথমকি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে? এই প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আজ বলতে হয়, যারা সে সময় রক্ষীবাহিনীর সদস্য নির্বাচন, প্ৰশিক্ষণ, পোশাক ও পরিচালনা ইত্যাদির ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, হয়তো এ ধরনের একটি বাহিনী সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার প্রচণ্ড অভাব ছিল। অথবা সজ্ঞানে তাঁরা নিজেদের হীন স্বার্থে সরকারকে বিপথগামী করেছিলেন।
নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ ও প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসেই কর্নেল থেকে সরাসরি জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে ওসমানীকে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং কেবিনেট মন্ত্রী নিয়োগ করে বেসামরিক বিমান পরিবহণ, নৌচলাচল ও জাহাজ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে তাঁর মধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার একটা সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল। লে. কর্নেল রবকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কর্নেল ওসমানী ও লে. কর্নেল রব উভয়েই পাকিস্তান আর্মি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে বৃহত্তর সিলেট থেকে সাংসদ (এমএনএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পদোন্নতিপ্রাপ্ত লে. কর্নেল, কর্নেল ও পরে ব্রিগেডিয়ার শফিউল্লাহকে পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল করা হয় এবং সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমান এবং শফিউল্লাহ একই দিনে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুলে যোগদান করেন ও একই দিনে কমিশন পেয়ে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে নিয়োগ পান। (তখন নিয়মিত কমিশনের জন্য সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল দুবছর, পরে আমাদের সময়ে তা বাড়িয়ে আড়াই বছর করা হয়)। আর্মিতে অফিসারদের জ্যেষ্ঠতা নির্ণয় করা হয় তাঁদের সামরিক প্রশিক্ষণের সার্বিক ফলাফলের ভিত্তিতে। একই দিনে জিয়াউর রহমান ও শফিউল্লাহ কমিশন পেলেও প্রশিক্ষণের ফলাফলের ভিত্তিতে জিয়াউর রহমানকে জ্যেষ্ঠতা প্রদান করা হয়। জেনারেল জিয়া জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে আর্মিতে রেখে জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করায় নৈতিক দিক দিয়ে সেনাবাহিনী পরিচালনায় স্বভাবতই তাঁর দুর্বলতা থাকার কথা।
এ নিয়োগ সম্পর্কে পরবর্তীকালে আমি কথা প্রসঙ্গে জেনারেল রবকে জিজ্ঞাসা করি। উত্তরে তিনি আমাকে জানান, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সিনিয়র অফিসারদের তালিকা তিনি এবং জেনারেল ওসমানী নিয়ে গেলে শেখ মুজিব শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। এ ব্যাপারে তাঁর এবং জেনারেল ওসমানীর কোনো সুপারিশ ছিল না বলে তিনি আমাকে জানান।
সে সময় দেশে পাঁচটি ব্রিগেড ছিল। কোনো ডিভিশন ছিল না। ঢাকায় অবস্থিত ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর থেকে পদোন্নতি প্রাপ্ত লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন (পরবর্তীকালে সর্বহারা দলের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত)। চট্টগ্রামে কর্নেল শওকত, কুমিল্লায় ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান, যশোরে কর্নেল মঞ্জুর এবং রংপুরে লে. কর্নেল শাফায়াত জামিলকে ব্রিগেড কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। কয়েক দিন পরেই ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে উপসেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার ফলে তিনি ঢাকায় আর্মি হেডকোয়ার্টারে চলে আসেন। তখন আর্মি হেডকোয়ার্টারে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সিজিএস হিসেবে স্টাফ অফিসার ছিলেন। তখনও আমি সেই মেজর পদেই ঢাকা সেনানিবাসে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক।
স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে যে নয়জন তৎকালীন মেজরকে কেন্দ্র করে নিয়মিত মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে, জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী তাঁরা হচ্ছেন : মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মীর শওকত আলী, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর নাজমুল হক, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল ও মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। এরপর আগস্ট মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যে তিনজন মেজর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তাঁরা হলেন : মেজর আবুল মঞ্জুর, মেজর আবু তাহের ও মেজর জিয়াউদ্দিন।
পাকিস্তান আর্মিতে চাকরিরত নয়জন মেজর এবং পরে মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝিতে আগস্ট মাসে পাকিস্তান থেকে আগত তিনজন মেজর অর্থাৎ মোট ১২ জন মেজর স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাকি অফিসাররা ছিলেন ক্যাপ্টেন ও লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত। এ ছাড়া অবসরকালীন ছুটিতে থাকা অবস্থাতেই মেজর সি আর দত্ত স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হন এবং ওই পদেই অবসর গ্রহণ করেন।
আর্মি হেডকোয়ার্টারে সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ ও উপসেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার সম্পর্ক ভালো ছিল না। কারণ, জেনারেল জিয়ার সিনিয়রিটি ডিঙিয়ে জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর্মিতে সিনিয়রকে ডিঙিয়ে জুনিয়রকে সেনাপ্রধান করা হলে স্বভাবতই সিনিয়রকে অবসর দেওয়াই শ্রেয়। অন্যদিকে জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মধ্যেও সম্পর্ক ভালো ছিল না। তবে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে জেনারেল শফিউল্লাহর ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে ধারণা করা হতো। আর্মিতে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মর্যাদা-বৃদ্ধির লক্ষ্যে জেনারেল জিয়া ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং অন্য অফিসারগণ সর্বদা প্রচেষ্টা চালাতেন। এটা জুনিয়র অফিসাররাও জানতেন এবং ভালোভাবেই তা উপলব্ধি করতেন। ফলে জুনিয়র অফিসারগণ এর সুযোগ নিতে সচেষ্ট হতেন। এভাবে স্বাভাবিক আর্মি শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটে। যদিও শফিউল্লাহ ছিলেন সেনাপ্রধান তবু তিনি এদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হননি। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু সামরিক অফিসার ও সৈনিক কর্তৃক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়। মূলত গত ২৮ বছরে বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনীতে সেনাপ্রধানের কমান্ড ও কন্ট্রোল না থাকায় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, যা পুরো জাতিকে বারবার বিপর্যস্ত করেছে। তবে এসব দুঃখজনক ঘটনার দায় সেনাপ্রধানের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ওপরও বর্তায়।
এদিকে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানফেরত আর্মি অফিসারদেরও সিনিয়র-জুনিয়র’-সংক্রান্ত সমস্যা হয় মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সঙ্গে, যার প্রত্যক্ষ পরিণাম ১৯৮১ সালের জিয়া হত্যাকাণ্ড এবং পরে বহু মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের ফাঁসি ও আর্মি থেকে বহিষ্কারের ঘটনা।
১৯৭১-এ সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্ভব ঘটে। এ আর্মিকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা এবং সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলার জন্য দক্ষ ও বিচক্ষণ সামরিক নেতৃত্ব এবং দেশের রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের সদিচ্ছা এবং সহযোগিতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। আমি জেনারেল জিয়া ও জেনারেল শফিউল্লাহকে আগে থেকেই ভালোভাবে জানতাম। ১৯৬৯ সালে আমি যখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের এডিসি এবং পরে জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করি তখন থেকেই তাঁদের সঙ্গে পরিচিত। তা ছাড়া আমি স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে শফিউল্লাহর ‘এস ফোর্সের’ অধীনে দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলাম। জিয়ার অধীনেও আমি ‘জেড ফোর্সে’ কয়েক মাস প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলাম। তাই যুদ্ধকালে তাঁদের অনেক কাছ থেকে দেখেছি।
শফিউল্লাহ ও জিয়ার এ প্রভাববিস্তারের দ্বন্দ্ব চলাকালে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে শওকত, তাহের, জিয়াউদ্দিন এবং মঞ্জুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জিয়াকে সমর্থন দিতেন। তাঁরা মনে করতেন খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধানকে নানাবিধ বিষয়ে সমর্থনপূর্বক পরামর্শ দিচ্ছেন। এ নিয়ে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেন। আমার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল বেশির ভাগ পেশাগত। আমি সর্বদা এসব দলাদলি ও দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতাম। তাই বলতে দ্বিধা নেই, মুজিবহত্যার সময় আমি একজন সিনিয়র অফিসার অর্থাৎ কর্নেল এবং জিয়া-হত্যার সময় মেজর জেনারেল পদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ঢাকায় থাকা সত্ত্বেও আমাকে কোনো ঘটনায় সাক্ষী বা দোষী হিসেবে কিংবা অন্য কোনোভাবে জড়িত করা যায়নি। কারণ, এসব অপেশাদার কাজকর্মে আমি কখনো উৎসাহ বোধ করিনি এবং এ ব্যাপারে আমি অন্যদেরও নিরুৎসাহিত করতাম। আরেকটা বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য, কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন, যার পরিণতিতে জুনিয়র অফিসারগণও রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে আর্মিতে সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য উৎসাহিত এবং প্রভাবিত হতেন, যা সামরিক পেশা ও শৃঙ্খলার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এরকম কার্যকলাপ আর্মির ভাষায় অফিসারসুলভ আচরণ নয় এবং আর্মি আইনের ৫৫ ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধ।
সামরিক বাহিনীতে উচ্ছৃঙ্খলতা
১৯৭২ সালের জুন মাসের দিকে ঢাকায় বিমানবাহিনীর কিছু জুনিয়র ও নন-কমিশন্ড অফিসার তাদের বেতন, ভাতা, রেশন, পোশাক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। তারা বিমানবাহিনী প্রধান ও অন্যান্য অফিসারকে অন্তরীণ করে দাবিআদায়ের চেষ্টা চালায়। কারণ সে সময় বেতন ও আনুষঙ্গিক প্রাপ্ত সুবিধাগুলো ছিল অপ্রতুল। কিন্তু সামরিক বাহিনীতে এসব আন্দোলন বা বিদ্রোহ প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। শৃঙ্খলারক্ষার জন্য প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয়। তা না হলে সামরিক বাহিনী ও শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকে না। দুপুরবেলায় আমি যখন অফিস থেকে বাসায় ফিরি তখন আমাকে এ বিদ্রোহ সম্পর্কে জানানো হয়। ৪৬ ব্রিগেডের প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে এ উচ্ছৃঙ্খলতা দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমরা যথারীতি সেখানে গিয়ে এ উচ্ছৃঙ্খলতা দমনের ব্যবস্থা করি।
পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ঢাকায় রাখার জন্য কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে নির্মাণ করা হয়েছিল তৎকালীন সিগনাল অফিসার্স মেস। সেখানে বিমানবাহিনীর প্রায় ৪০০জন বিদ্রোহীকে আটক করে রাখা হয়। আটককৃত এসব লোকজন প্রায় সারারাত অনশন পালন করে। তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় এবং পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সকালেই তারা অনশন ভঙ্গ করে। এরপর নেতাগোছের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং পরে বেছে বেছে দায়ী কিছু ব্যক্তিকে কোর্ট মার্শাল করে চাকরিচ্যুত করা হয়। আমার মতে, শুধু চাকরিচ্যুতির ওই শাস্তি বিদ্রোহের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে এর পরও বিমানবাহিনীতে উচ্ছৃঙ্খলতার ঘটনা ঘটেছে।
রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে তাঁর সামরিক সচিব হিসেবে নিয়োগের জন্য সেনাপ্রধানকে মৌখিক নির্দেশ দেন। সেনাপ্রধান আমাকে সেখানে সত্বর যোগদান করতে বলেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন আমি ঢাকায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অধীনে কর্মরত। তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব হিসেবে বঙ্গভবনে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি আমাকে বঙ্গভবনের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান। বঙ্গভবনে তখন প্রশাসনব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। তিনি সেখানকার গাড়ি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ঢালাও অপব্যবহার ও অব্যবস্থা সম্পর্কে আমাকে বলেন। বঙ্গভবনের অনেক আসবাব ও তৈজসপত্র উধাও হওয়ার কিছু ঘটনাও তিনি আমাকে জানান। এসব নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে বেশ বিব্রত, হতাশ এবং উদ্বিগ্ন মনে হয়েছিল।
তিনি আমাকে নির্দেশ দেন, আমি যেন এসব আইনের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করি। রাষ্ট্রপতির নির্দেশ পেয়েই আমি কাজে লেগে পড়ি। আমি আইনানুযায়ী সবকিছু দেখাশোনার কাজ শুরু করি। বঙ্গভবনের সরকারি হিসাবপত্র থেকে সবকিছুতেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হই। হিসাবপত্র নিতে গিয়ে আমি লক্ষ করি, অনেক মূল্যবান আসবাবপত্র এমনকি বাসনকোসনও পাওয়া যাচ্ছিল না।
অল্প যে-কদিন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে আমি কাছ থেকে দেখেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে, তিনি চাইতেন রাষ্ট্রপতির অফিসের গাম্ভীর্য, স্বাতন্ত্র্য, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা যেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালিত হয়। তাঁর এই নীতিবোধের বিষয়গুলো আমার খুব ভালো লাগে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে আমার একটি আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে সম্পর্ক দীর্ঘদিন, এমনকি কর্মসূত্রে আমি দেশের বাইরে থাকার সময়ও বলবৎ ছিল।
যাহোক, আমি বঙ্গভবনে থাকাকালে একদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে নিচে যাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব আমাকে দেখে একটু মুচকি হাসেন এবং জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি এখানে কবে এসেছ?’ আমি সংক্ষেপে তাঁর প্রশ্নের জবাব দিই। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব হিসেবে আমার যোগদানের বিষয়টি হয়তো তিনি তখনও অবগত হননি বা হলেও তাঁর মনে ছিল না। তাই আমাকে বঙ্গভবনে দেখে তিনি একটু অবাক হয়েছিলেন বলেই আমার মনে পড়ে।
এর আগে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন গার্ড অফ অনার পরিচালনার সময়, ১২ তারিখ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর শপথের দিন বঙ্গভবনে (ওইদিনের জন্য আমি সামরিক সচিব হিসেবে কাজ করি) এবং রেসকোর্স ময়দানে আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। ততদিনে তিনি আমাকে বেশ ভালোভাবেই জেনেছেন বলেই আমার মনে হয়। বঙ্গভবনে সেদিনের দেখার সপ্তাহখানেক পর সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ আমাকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব আমাকে সামরিক বাহিনীতে রাখাই শ্রেয় বলে মনে করেন।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীচুক্তি কি গোপনীয় উপহার?
এর মধ্যে এক ব্যতিক্রমি ঘটনা ঘটে আর্মিতে। ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় ১৯৭২ সালের শেষদিকে নিজের নামে ‘হিডেন প্রাইজ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯ মার্চ ১৯৭২ তারিখে ২৫ বছর মেয়াদি স্বাক্ষরিত চুক্তিতে অনেক গোপন শর্ত আছে বলে প্রকাশ করেন এবং দাবি করেন সেগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। ওই প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি লেখেন, ‘উই গট ইন্ডিপেন্ডেন্স উইদাউট শেখ মুজিব অ্যান্ড ইফ নেসেসারি উই উইল ডিফেন্ড ইট উইদাউট হিম।’ সে লেখায় তিনি ওই চুক্তি বাতিলেরও দাবি করেন। এখনও আমার মনে আছে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীচুক্তি সম্পর্কে জিয়াউদ্দিনের লিখিত এ প্রবন্ধের বিপরীতে তখন কোনো সরকারি বক্তব্য রাখা হয়নি। চাকরিরত একজন সামরিক অফিসার ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অবস্থায় স্বনামে প্রবন্ধ লেখায় তা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওই প্রবন্ধ লেখার পর তিনি তাঁর অধীনস্থ অফিসারদের এ সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে বলে উত্তেজিত করতেন। ফলে ৪৬ ব্রিগেড তখন সরাসরি কঠোর সরকারি সমালোচনায় মুখর। এমনকি তখন সেখানে প্রায় বিদ্রোহের মতো পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল এবং যে-কোনো সময় গুরুতর সামরিক শৃঙ্খলাভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দেয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তখন বিদেশে ছিলেন। ফিরে এসে তিনি এসব জেনে জিয়াউদ্দিনকে ৪৬ ব্রিগেড থেকে সেনাসদরে বদলি করার আদেশ দেন এবং আমাকে ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। দিনের বেলায় আদেশ দিয়ে পরদিন সকালে আমাকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়। আমি তখনও বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ আমাকে জানালেন, আমি যেন রাষ্ট্রপতিকে আমার এ নতুন নিয়োগ সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করি 1
বঙ্গভবন থেকে আমাকে সরিয়ে নিলে রাষ্ট্রপতি মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারেন, এই ভেবে জেনারেল শফিউল্লাহ নিজে না বলে বিষয়টি আমাকে জানাতে অনুরোধ করলেন। আমি রাষ্ট্রপতিকে আমার বদলির বিষয়ে অবহিত করি। শুনে তিনি বেশ অসন্তুষ্ট হন এবং বলেন, আমার সামরিক সচিবের পদ কি গুরুত্বপূর্ণ নয়? আমি তাঁকে সবিনয়ে ৪৬ ব্রিগেডের শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়টি জানাই। বিস্তারিত জানার পর তিনি সেনাবাহিনীতে আমার ফেরত যাওয়ার বিষয়ে সম্মত হন। আমি মাত্র সপ্তাহ তিনেকের মতো রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব ছিলাম। আসলে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তখন আমার সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা পোষণ করতেন। তাই আমি সক্রিয়ভাবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জড়িত থাকি সেটাই তিনি শ্রেয় মনে করতেন।
এদিকে আমি এবং জিয়াউদ্দিন তখন সেনানিবাসের স্কুল রোডে (পরে শহীদ বদিউজ্জামান রোড এবং অতিসম্প্রতি স্বাধীনতা সরণি) পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। দুজনেই অবিবাহিত এবং ভালো বন্ধু ছিলাম। আমাদের খাওয়াদাওয়া প্রায়ই একসঙ্গে হতো। তিনি একজন সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক অফিসার ছিলেন, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। আমার বিশ্লেষণে তিনি একজন তত্ত্বীয় ও দার্শনিক সেনা-অফিসার ছিলেন। তিনি বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনীতি তথা চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ত্রো এঁদের দর্শনে হয়তো প্রভাবিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান থেকে এসে তিনি, তাহের ও মঞ্জুর স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেন। আমি যখন তাঁকে প্রশ্ন করি, ওই প্রবন্ধে লিখিত এতসব তথ্য তিনি কোথা থেকে পেলেন— উত্তরে তিনি আমাকে জানান, জেনারেল ওসমানী তাঁকে ওইসব তথ্য সরবরাহ করেন এবং তা তিনি বিশ্বাসও করতেন।