এক জাহাজ ভূত
সাতানব্বই সালের সেই বড়ো ঝড়টার কথা বলছি গো! আমার শুয়োরের খোঁয়াড়ে চালা ছিল বিচালির। বিলকুল উড়ে গিয়ে পড়ল ল্যামপোর্ট বিধবার বাগানে। ঝড়ের পরে আমি বেড়ার এপার থেকে মাথা বাড়িয়ে ব্যাপারখানা দেখছি, বিধবাটা তেড়ে এল। ন্যাসটারশিয়ামের লতাগুলো চাপা পড়েছে দেখে তার মেজাজ ছিল বিগড়ে। এমনভাবে আমার তিনকুল উদ্ধার করতে লেগে গেল, যেন ঝড়টা আমিই ফরমায়েশ দিয়ে এনেছি ফেয়ারফিল্ড গাঁয়ে।
ওর সঙ্গে গলাবাজি করব পাল্লা দিয়ে, এমন গলা ভগবান আমায় দেননি। সুতরাং আপনমনে গজগজ করতে করতে আমি সরাইখানার দিকে পা বাড়ালাম। সেই যে ‘আঙুর ঝোপের শেয়াল’ নাম সরাইটার। ল্যামপোর্ট মহিলাটির অবিবেচনার কথা সবে সেখানে ফেঁদে বসেছি, সরাইওয়ালা হেসে বলল, ‘কালকের ঝড়ের কথা তো? বলো না, বলো না! আমার তো মবলগ গচ্চা যেতে বসেছে ওর দরুন।’
‘কী? তোমার আবার কী হল?’— প্রশ্ন করলাম কাজে কাজেই, ‘আর গচ্চা যেতে বসেছে বলে অত হাসিই বা কেন? এতকাল তো জেনেছি, লোকসানের মুখ দেখতে হলে লোকে না-হাসে কাঁদে বরং।’
‘আমিও কাঁদব, যথাসময়ে নিশ্চয়ই কাঁদব!’ বলল সরাইওয়ালা, ‘উপস্থিত হেসে নিই একটু। হাসির ব্যাপার একটা হয়েছে যখন, হেসে নিই যতক্ষণ পারি। তোমার তো বাপু, উড়েছে শুধু শুয়োরের ঘরের চালাখানি, দ্যাখো গিয়ে আমার বাগানখানা একবার। গোটা জাহাজ একখানা উড়িয়ে এনেছে, আমার অন্তত পঞ্চাশটা শালগমের দফা নিকেশ করে।’
‘জা—হাজ উড়িয়ে এনেছে?’— কথা বলতে গিয়ে হাঁ করে ফেললাম আমি।
‘বিশ্বাস হচ্ছে না?’— সরাইওয়ালা ক্ষুণ্ণই হল যেন, ‘চলো, চর্ম-চোখে দেখে আসবে চলো। পেল্লায় জাহাজ। মিশকালো জাহাজ। কামান-বন্দুকে সাজানো জাহাজ। আমার শালগম খেতের অর্ধেকটা চেপে বসে আছে, ডবল নোঙর ফেলে। বলছি তো, পঞ্চাশটা শালগম অন্তত বরবাদ গেল আমার। অথচ চাষে লোকসান হলে বউ এমন মন খারাপ করে! সে খবর পায়নি এখনও। যখন পাবে, এঃ, আজ বোধ হয় আর বরাতে লাঞ্চ নেই—’
কথা কইতে কইতে সরাইওয়ালা ঝাঁপ বন্ধ করেছে হোটেলের। কারণ আমি ছাড়া অন্য খদ্দের কেউ নেই এখন। গাঁয়ের গেরস্তরা সবাই ঘরের কাজে ব্যস্ত। কেউ চালে টালি বসাচ্ছে,কেউ ভাঙা বেড়া মেরামত করছে। ঝাঁপ বন্ধ করে সে আমায় নিয়ে চলল তার খামারে। বেশি দূর তো নয়, গলি দিয়ে গলি দিয়ে মিনিট পাঁচেকের পথ মাত্র।
যা বলেছে, একবর্ণও বাড়িয়ে বলেনি বেচারি। জলজ্যান্ত জাহাজই একখানা দাঁড়িয়ে রয়েছে বটে। এমন সেকেলে ঢং-এর জাহাজ, যা গত তিন-শো বছরের ভিতর একখানাও কেউ দেখেনি কোনো সমুদ্রে। খুঁটিনাটি সবই ঠিক ঠিক বলেছে, মিশকালো রং, কামান বন্দুক, ডবল নোঙর। ‘বেশ মজবুত চেহারা কিন্তু জাহাজটার’— বললাম আমি।
‘পাক্কা দু-শো টন।’— নিশ্বাস ফেলল সরাইওয়ালা, ‘ফেয়ারফিল্ডে যত ঘোড়া আছে, যত মানুষ আছে, সবই একসাথে কাঁধ লাগায় যদি, তবু এ জাহাজকে ঠেলে বার করতে পারবে না, আমার শালগম খেত থেকে।’
‘ঘোড়া আর মানুষ! না, তারা পারবে না’— স্বীকার করলাম আমি, ‘কিন্তু ভূতেরাও যদি জোটে তাদের সঙ্গে? এ-গাঁয়ে ভূতের সংখ্যা তো মানুষের চেয়ে বেশি!’
‘তা বেশি’— সরাইওয়ালা সায় দিতে বাধ্য হয়, ‘কিন্তু তারা কি আর জাতভাইদের ঠাঁইনাড়া করতে রাজি হবে? ও জাহাজও তো ভূতের!’
‘কীসে বুঝলে?’ আমি আশ্বাস দিতে চাই, না চেপে ধরতে চাই ওকে, তা নিজেই ভালো বুঝি না, ‘ঝড়ে ঘর থেকে চাল উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। আর সমুদ্র থেকে জাহাজ উড়িয়ে আনতে পারে না? খুব পারে। তেমন জোরালো ঝড় হলেই পারে। কাল অত বড়ো ঝড় যদি না-হয়ে যেত, তা হলে অবিশ্যি মানতেই হবে যে ভূতেই ওটা এনেছে, ভূতেরই ওটা জাহাজ।
কথাবার্তা চলেছে আমাদের, এমন সময় ডেকে একটা শব্দ শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি, কেবিন থেকে একটা মানুষ বেরুল, আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল বেশ শান্তভাবেই। লোকটার পোশাকের রং জাহাজের মতোই কালো, তবে তার উপর সোনালি লেস বসানো জায়গায় জায়গায়, যদিও সে লেস পুরোনো হতে হতে মরচে ধরে গিয়েছে। কোমর থেকে আবার তরোয়ালও ঝুলছে তার। পিতলের খাপে ঢাকা মস্ত তলোয়ার একখানা।
বেশ ভদ্রভাবেই লোকটি বলল, ‘আমি হচ্ছি ক্যাপ্টেন বার্থোলোমিও রবার্ট। এসেছি কিছু নতুন লোক জোগাড় করতে, তা তাদের সৈন্যই বলুন আর নাবিকই বলুন। বন্দর থেকে অনেক দূর এসে পড়েছি, কী বলেন?’
‘বন্দর?’— সরাইওয়ালা বলে উঠল, ‘সমুদ্র তো পঞ্চাশ মাইল এখান থেকে!’
ক্যাপ্টেন রবার্ট একটুও দমল না এ-কথা শুনে, ‘অত দূর? তা যাকগে, কিছু আসবে যাবে না তাতে।’
‘তার মানে? এইখানেই শিকড় গেড়ে বসে থাকা, নাকি?’— সরাইওয়ালার মেজাজ গরম হয়ে উঠেছে, ‘দেখুন মশাই, আমার জমিতে এসে বসেছেন, তা বসুন। মানুষের কাছেই মানুষ যায়। এমনকী, যারা এককালে মানুষ ছিল, এখন আর নেই, যায় তারাও। এসেছেন, নোঙর ফেলে বসেছেন, কিছুই বলছি নে আমি তাতে। কিন্তু ধরুন, এটা আমার শালগমের খেত, লোনা জলের দরিয়া নয়। ওই শালগমগুলো বেচে দু-পয়সা ঘরে আনার মতলব ছিল আমার বউয়ের।’
ক্যাপ্টেন পকেট থেকে একটা সোনার নস্যিদানি বার করল। এক টিপ নস্যি তা থেকে নিয়ে নাকে পুরল। তারপর হাত আর নাক দুটোই রেশমি রুমাল দিয়ে ঝাড়তে লাগল পুরোদস্তুর শহুরে কায়দায়। তারপর সে বললে, ‘মাত্র তো কয়েকটা দিন আমি থাকছি এখানে। তার দরুন কিন্তু নজরানা দিলে ভদ্রমহিলা যদি খুশি হন, আমার তা দিতে আপত্তি নেই!’
এই বলে ক্যাপ্টেন কোটের গলা থেকে মস্ত একটা সোনার ব্রুচ খুলে নিল, আর বিনা বাক্যব্যয়ে তা ছুড়ে ফেলে দিল সরাইওয়ালার পায়ের উপর। সে লোকটা তো লজ্জায় লাল একেবারে। ব্রুচটা তুলে নিয়ে ভারি কিন্তুভাবে বলল, ‘বউ যে গয়না ভালোবাসে না, এমন কথা পারি না বলতে। কিন্তু বিবেচনা করুন, আধবস্তা শালগমের আর কত দাম হত? তার দরুন এমন দামি একটা—’
ক্যাপ্টেন বেদম হেসে উঠল, ‘আরে মশাই, ঠেকে গেছি বিপদে। আপনাদের তোয়াজ না-করলে চলে কখনো?’— এই বলেই সে মিলিটারি কায়দায় পিছনে ফিরল আর কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে পা ফেলে ফেলে ঢুকল গিয়ে কেবিনে। আর আমরা? গলিপথ ধরে সরাইয়ের দিকে ফিরছি যখন, বন্ধু বলল, ‘ঝড়টা আমার পয় খুলে দিয়েছে, তাতে ভুল নেই। বউ কী খুশিই হবে!’
ওকে সরাইখানায় রেখে আমি বাড়ির পথ ধরলাম। পয় আমার কিন্তু খোলেনি। টম ল্যামপোর্ট যতদিন বেঁচে ছিল, সদ্ভাব রেখেছিল আমার সঙ্গে। কাল করলে মানুষটা মরে গিয়ে। ওর বিধবা বউটা দিন দিন মারমুখী হয়ে উঠছে যেন। এমনকী, আমার বেড়ালটা যদি ওর বাড়িতে কখনো গিয়েছে তো তুলকালাম ঝগড়া। অবশ্য, সে বেড়াল যে আমার বেড়াল কী করে হল, তা আমি কোনোদিন বুঝতে পারিনি। আমার বাড়িতে সে জন্মায়নি, তার মা কোনোদিন ত্রিরাত্রি বাস করেনি আমার বাড়িতে। সে ঘোরে-ফেরে পাড়ায় পাড়ায়, ভোজননং যত্র কুত্রাপি শয়নং হট্টমন্দিরে গোছের। তবে ওই এক কথা, পাড়া থেকে তাকে যদি ল্যামপোর্ট-বাড়িতে ঢুকতে হয়, যেতে হয় আমার বাড়ির উপর দিয়ে। সেই সুবাদেই দুঁদে বিধবাটা ওকে আমার বেড়াল বলে জাহির করতে চায়।
থাক সে দুঃখের কথা। সমূহ ঝামেলা সামনে। চালাখানা তুলে আনা চাই ওর বাগান থেকে। সেইটাই কঠিন কাজ। তারপর চালাখানায় চাট্টি নতুন বিচালি গুঁজে তাকে আবার শুয়োরের খোঁয়াড়ের মাথায় যথাপূর্ব স্থাপন করা চাই। সেটা কাজ এমন কঠিন নয় কিছু। আগেরটার তুলনায় পরেরটা জলবৎ তরল। ওই দজ্জাল মেয়েমানুষ, যার মুখে কোনো কথাই আটকায় না, তার বাগানে ঢুকবার কথা তার সামনে তুলবই যে কেমন করে, তা বুঝতে পারছি না।
এ গাঁয়ে যারা মরে, তারা মরেও মরে না অনেকেই। ভূত হয়ে ফিরে আসে। নিজের বাড়িতেই আসে অবশ্য, তবে শোবার ঘরে আর শোয় না। কোনো ভাঙাচোরা চিলের কুঠুরি থাকে যদি, আড্ডা নেয় সেখানেই। আর তা যদি না-হল, কোনো গাছের ডালে। সেখান থেকেই তারা সংসারের সঙ্গে ষোলো আনা যোগাযোগ বজায় রাখে, ছোটো-বড়ো সব কথাতেই নাক গলায়। অনেক লোকই এইরকমটা করে, কিন্তু করেনি আমার ভূতপূর্ব পড়শি টম ল্যামপোর্ট।
কেন যে করেনি, তাও বুঝতে পারি বই কী! জ্যান্ত থাকতে সে কম যন্ত্রণা পায়নি, ওই বউয়ের অত্যাচারে। মরে যদি বা রেহাই পেয়েছে, ভূত হয়ে আবার সে কি এখানেই ফিরে আসবে, আর এককিস্তি যন্ত্রণা সইবার জন্য? কদাচ না, ধড়ে একরত্তি বুদ্ধি থাকলে টম ল্যামপোর্ট তা কখনো করবে না! করেনি এযাবৎ। ভূত অবশ্য হয়েছে। কে আর না-হয়? কিন্তু হয়ে থাকলেও এ গাঁয়ে মুখ আর দেখায়নি টম। কিন্তু টম মুখ দেখায়নি যদিও, গাঁয়ের প্রত্যেকটা হ্যারি, ডিক, ডবসন তা দেখিয়েছে। বিকালে কবর দিয়ে এসেছি, রাত নয়টার ভিতরেই দেখিয়েছে। কবরের সাধ্য কী ওদের আটকে রাখার? দেহটাকেই তারা ধরে রাখে যাহোক করে, তা ছাড়া বাদবাকি আর সবকিছু সঙ্গে নিয়ে হ্যারি-ডিক-ডবসনেরা সটকে পড়ে কবরখানার বাইরে, গাছের ডালে নয়তো খেলার মাঠে নাচে গায় হুল্লোড় করে মনের আনন্দে।
ফেয়ারফিল্ড গাঁয়ের ইতিহাস যতদিন থেকে পাওয়া যায়, ততদিনই এই রেওয়াজই চলছে এখানে। শিকারের মরসুম যখন আসে, ফি বছরই রাতের বেলায় তিন-তিনটে শিকারি দল বেরুতে দেখি আমরা। একটা তালুকদার বাড়ি থেকে, একটা অ্যাটকিনসন খামার থেকে, আর একটা যে কোথা থেকে, তা কেউ ধরতে পারেনি আজও। বলা বাহুল্য, ওই তালুকদার বাড়ি আর অ্যাটকিনসন খামার সবই ভেঙেচুরে জঞ্জাল হয়ে রয়েছে, আজ কতকাল তা কে জানে! মানুষও নেই সেখানে, কুকুরও নেই। এই যারা শেয়াল-শিকারে সেজে বেরোয় সেখান থেকে, তারা সবাই ভূত। মানুষেরাও, কুকুরেরাও। ঘরে ঘরে মশাই এই ব্যাপার। কামার হিকরি সেবারে মৌফতে একটা মোহর পেয়ে গেল, সে গল্প না-জানে কে? ওর বাড়িতে নীচের ঘরে কামারশালা, উপরে ও থাকে। এখন রোজ রাত্রেই ও যখন টের পায়, নীচে দমাদ্দম হাতুড়ি পিটছে, কেউ কেউ বা খুট খুট করে ঘোড়ার পায়ে নাল পরাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে সেই ঘোড়া-ভূতেরা চিঁ হিঁ হিঁ করে ডেকেও উঠছে। হিকরি ঘুমোচ্ছে তাদের মাথার উপরে অকাতরে। তার ভয় পাবার কিছু নেই, কারণ নীচে কাজ করছে যে কামার, সেও এক ভূতপূর্ব হিকরি, বর্তমান হিকরির ঠাকুরদার বাবা। কামারশালের যন্ত্রপাতি নষ্ট করবে না বাবার ঠাকুরদা, তা বিলক্ষণ জানে বর্তমান হিকরি।
একদিন হল ভারি রগড়। বেজায় মাথা ধরেছে হিকরির, ঘুমোতে পারছে না একদম। তার উপরে, নীচে কাজ চলছে পুরোদমে। খুট খুট ডুং ডুং ধাড়াং ধাড়াং। যতক্ষণ পারল, সহ্য করল হিকরি। তারপরে হেঁকে উঠল, ‘আস্তে, আ-স্তে বাবার ঠাকুরদা, তা নইলে কাল থেকে আমি হাতুড়ি-মাতুড়ি সব উপরে নিয়ে আসব, তা বলে দিচ্ছি।’
আওয়াজগুলো তারপরে একটু কমেই গেল বোধ হয়। অন্তত হিকরি আর কিছু টের পায়নি, সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরদিন সকাল বেলায় কিন্তু নীচে নেমেই সে তুড়ি-লাফ খেতে লাগল। নেয়াইয়ের উপরে রয়েছে চকচকে একটা গিনি। ঠাকুরদার বাবা নাতির ব্যাটাকে ঘুস দিয়ে গিয়েছে যাতে রাতের কাজে বাগড়া না-পড়ে তার।
সেই গিনি? হিকরি তা না দেখিয়েছে কাকে? যদি না-দেখে থাকে কেউ, যাক না, কামারশালে গিয়ে দেখে আসুক! হিকরি ঘড়ির চেনে এঁটে রেখেছে গিনিটা।
এ তো গেল রাতের কথা। দিনের বেলাই কি ওদের পায়ে বেড়ি দিতে পারে নাকি কেউ? খবর পেলাম সেবার, আমাদেরই নোয়েল মারা গিয়েছে লড়াইয়ে। গাঁয়ের আরও ছেলেরা ছিল পলটনে, নোয়েলের কাটা মুণ্ডুটা খুঁজে পেয়েছিল, সেটা কবরও দিয়েছিল তারা। ধড়টা পায়নি। কী হল তার, জানেও না কেউ।
সেদিন হল কী, রাস্তার ধারের বড়ো ইঁদারা থেকে জল আনতে গেছি। বেলা তখন কত হবে? এই নয়টা কী সাড়ে দশটা। দেখি, ইঁদারার চারধারে পাকা বেদি আছে না উঁচু করে গাঁথা? দেখি, সেই বেদির উপরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মুণ্ডুকাটা নোয়েল। কী করে জানলাম, সে নোয়েল? অকাট্য প্রমাণ ছিল মশাই। নোয়েলের ডান পায়ে আঙুল ছিল ছ-টা। এই কাটামুণ্ডু কবন্ধের ডান পায়ের আঙুল আমি একটা একটা করে গুনে দেখেছিলাম, ছ-টা হয়েছিল।
বসে আছে নোয়েল, পা দোলাচ্ছে আরাম করে, উঠবার চাড় নেই। মাথা যদি থাকত কাঁধের উপর, রোদ লেগে তা গরম হতে পারত। উঠে পড়বার তাগিদ হত ওর। মাথা না-থাকার দরুন ঠান্ডা হয়ে বহাল-তবিয়তে ও বসে আছে, উঠবে কেন?
পাড়ার বাচ্চা এসে জুটেছে গোটাকতক। জল নিতে আসেনি তারা, মনের আনন্দে খেলা করছে নোয়েলের আশেপাশেই। নোয়েল যদি পা একটু জোরে দোলায়, এক্ষুনি ঠোক্কর লাগে কেটি র্যামেজের মাথায়। তা অবশ্য সে দোলাবে না জানি, নোয়েল বাচ্চাদের ভালোবাসত এক সময়।
সিঁড়িজুড়ে বসে আছে নোয়েল, উঁচু বেদিতে উঠতে আমার কষ্ট হল খুব। তা হোক, কী আর করা যাবে। দেশের জন্য মুণ্ডুটা দিয়ে এল যে লোক, তার একটা খাতির আছে তো। আমি বলতে পারলাম না যে, ‘তুই উঠে যা নোয়েল, আমি জল নেব—’
হ্যাঁ, এইরকমই জায়গা আমাদের ফেয়ারফিল্ড। ভূতে-মানুষে দিব্যি মিলেমিশে বাস করি এখানে। লন্ডনের কোনো লোক বিশ্বাস করছে একথা? কখখনো না। জানি তো। তাই আমাদের গাঁয়ের অবস্থানটা যে ঠিক কোথায়, ওইটি তাদের বলছি না কিছুতেই। তবে, এই পর্যন্ত বলতে বাধা নেই, কাছেপিঠেই আছি আমরা। লন্ডন থেকে সরকারি সড়ক ধরে সোজা যদি চলে যাও পোর্টসমাউথের দিকে, মাঝ পথেই পাশ কাটিয়ে যাবে ফেয়ারফিল্ডের। দেখতে অবশ্য পাবে না। একটা জঙ্গলের আড়াল আছে ওইখানটাতে।
কয়েক দিন গেল। অশান্তিতেই গেল। ল্যামপোর্ট স্ত্রীলোকটার কবল থেকে শুয়োরের ঘরের চাল উদ্ধার করতে পারিনি। ও দেবে না। ও মজা দেখছে। বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়েছি, ‘মিসেস ল্যামপোর্ট, মিসেস ল্যামপোর্ট’ বলে বলে। সে জবাব দেয়নি। ঘুরে গিয়ে সদরে কড়া নেড়েছি, সাড়া পাইনি। মজা দেখছে! ইতিমধ্যে ন্যাসটারশিয়ামের একটা নতুন কেয়ারি সে বানিয়ে ফেলার চেষ্টায় আছে। মাটি কুপিয়েছে, দেখেছি। কত বড়ো ফিচেল মেয়েমানুষ বুঝুন মশাই। তৈরি কেয়ারিটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তা যাক, তবু নিরীহ পড়শির চালাখানা ফেরত দেবে না। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ আর কী!
আমি আছি আমার নিজস্ব ঘরোয়া ঝামেলায় বিব্রত। ওদিকে ফেয়ারফিল্ডে কিন্তু আলোড়ন উঠেছে একটা, ওই ভূতুড়ে জাহাজ নিয়ে। ওর সেই ক্যাপ্টেন ভদ্রলোক নাকি—
কিন্তু কথাটা গোড়া থেকে বলাই ভালো। সরাইখানায় দেখা হল মুচি লিন্টনের সঙ্গে। সেই যে সরাইখানাটি আমাদের, গাঁয়ের এক ও অদ্বিতীয় সরাই, ‘আঙুর ঝোপে শেয়াল’ যার নাম।
আমাকে দেখেই লিন্টন জিজ্ঞাসা করল, ‘কয়েক দিন আসোনি বুঝি?’
সত্যিই আসিনি কয়েক দিন। শুয়োরের ঘরটা নতুন করে ঢাকতে হবে। কোথায় কাঠ, কোথায় গজাল, কোথায়-বা বিচালি এই বে-মরসুমে, তারই ধান্ধায় ঘুরেছি স্থানে-অস্থানে। কিন্তু গুছিয়ে-গাছিয়ে সে কৈফিয়তটা মুচি ভাইয়ের কাছে পেশ করবার সময় আমি পেলাম না। পহেলা প্রশ্নের পিঠ পিঠ এসে পড়ল তার দুসরা প্রশ্ন, ‘আমার সেই চারপুরুষ আগেকার ছোকরা জেঠার কথা জানো তো?’
‘জোশুয়া? সেই শিষ্টশান্ত ছোকরা? তাকে জানব না কেন?’— বললাম আমি।
কথা সত্যি। কেন জানব না? চর্মচক্ষে তাকে দেখিনি, কিন্তু সে যে আছে, সেকথা শুনে আসছি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই। প্রায় এক-শো বছর আগে সে মরেছে, কিন্তু একদিনের তরেও বাড়ি ছাড়া হয়নি। ছোকরা বয়সে মারা গিয়েছিল, কাজেই ভৌতিক মূর্তিও তার ছোকরার মতোই রয়ে গিয়েছে বরাবর। অত্যন্ত সুবোধ সুশীল ছেলে, গাঁয়ের ভিতর জ্যান্ত ছেলেদেরও উপদেশ দেয় অভিভাবকেরা, ‘দেখে শেখো, জোশুয়ার মতো ভালো ছেলে দেখতে চাই তোমাকে।’
সত্যিই আদর্শ তরুণ ওই জোশুয়া। রাত ন-টার ভিতরে ফিরবে, গুটিগুটি চলে যাবে তার নিজের ঘরে। সিঁড়ির মাথায় চিলে কুঠুরিটাই তার নিজস্ব স্থান। এক-শো বছর ধরে ওই ঘরই অধিষ্ঠান তার। কোনো ঝামেলাই নেই, কোনো উৎপাত করে না। সে যে আছে, তা বাড়ির লোকে ভুলেই যেত হয়তো, যদি না কাঠের সিঁড়িতে রাত্রি বেলায় এক একদিন ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ শোনা যেত তার ওঠা-নামার, আর যদি না পিছনের বাগানে ডাল ধরে তাকে দোল খেতে দেখা যেত মাঝে মাঝে দিনের বেলায়।
এহেন জোশুয়ার কথা আজ লিন্টন হঠাৎ তুলছে কেন, এমন তেতো গলায়?
‘জোশুয়া? সেই শিষ্টশান্ত ছোকরা?’— এইটুকুই শুধু বলেছিলাম আমি।
আর যায় কোথায়? মুচিভাই ফেটে পড়ল রাগে, ‘শি-ই-ষ্টো-ও শা-আ-ন্তো? ওরে আমার শিষ্ট শান্ত রে! সেদিন আর নেই শ্রীমান জোশুয়ার। এই এক-শো বছর বাদে বাছুরের শিং গজিয়েছে আজ। এখন শ্রীমান রাত তিনটের আগে বাড়ি ফেরেন না। মদে চুরচুর একদম, চালচলন যেন লাটের মতন। তার দাপাদাপিতে সারা বাড়ির ঘুম ভেঙে যায় সেই ভোর রাত্তিরে।’
আমি তো শুনে অবাক। ‘আরে না, না, তাহলে ও অন্য কোনো বদ ভূত। জোশুয়া হতেই পারে না ও। ছোকরা ভূতেদের মধ্যে জোশুয়ার মতো ভদ্র—’
‘আর ভদ্র!’— রাগের মধ্যেও দুঃখ জানায় লিন্টন, ‘মদে যাকে ধরে, সে আর ভদ্র থাকে কতক্ষণ? তোমাদের এই সরাইওয়ালাই যত নষ্টের মূল। গাঁয়ের সব জোয়ান ভূতকে রোজ দেখতে পাওয়া যায় তার শালগমের খেতে, ভূতের জাহাজে তাদের নেমন্তন্ন থাকে মদ খাওয়ার। সরাইওয়ালা যদি তার খেতে ও জাহাজকে নোঙর ফেলতে না-দিত!’
তারপরই উদয় হল কশাই এ্যালউইন। তারও নালিশ আছে। একই নালিশ। সেনলাকের লড়াইয়ে মারা পড়েছিল তার কোনো এক পূর্বপুরুষ। তারই উপরে অগ্নিশর্মা হয়ে রয়েছে কশাই বন্ধুআমার। ‘কুত্তার বাচ্ছা, কুত্তীর বাচ্ছা’ ছাড়া অন্য কথা নেই তার মুখে। সেনলাকের এই কাটা-সৈনিক মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে যখন, সে নাকি হামেশাই হুংকার ছাড়ে, ‘ব্রিটনস নেভার শ্যাল বি স্লেভস’ বলে। জাহাজে নাকি চাকরি পেয়েছে সে, ‘রুল ব্রিটানিয়া, ব্রিটানিয়া রুলস দ্য ওয়েভস।’
এরপর থেকে কান খোলা রাখলাম আমি। রোজই নতুন নতুন কাহিনি শুনতে পাই। গাঁয়ের ভূত-সমাজে শক্তসমর্থ পুরুষ যাদের কথা জানতাম, সবাইয়েরই অধঃপতনের কাহিনি। সারারাত ভূতের জাহাজে কাটিয়ে ভোররাত্রে তারা বাড়ি ফেরে, চূর-মাতাল অবস্থায়। ঘরে ঘরে বিপর্যয় কাণ্ড।
সবাই মিলে গঞ্জনা দেয় সরাইওয়ালাকে। সে যদি না ভূতের জাহাজকে ঠাঁই দিত নিজের বাগানে, এই অনর্থ ঘটতেই পারত না। খদ্দের সব চটে যায় দেখে বেচারা একদিন মরিয়া হয়ে হানা দিল গিয়ে বাগানে। আমাকেও নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে, সাহস পায়নি একা যেতে।
ক্যাপ্টেনকে ডেকে সে বলল, ‘এ তোমার কীরকম ব্যবহার ক্যাপ্টেন! গাঁয়ের ছেলেগুলোকে, তা হোক-না তারা ভূত, তবু গাঁয়েরই তো ছেলে। তাদের একধার থেকে মদ ধরিয়ে দিচ্ছ? আমার বউ ব্রুচ ফেরত দিতে চাইবে না, জানি বলেই তোমায় কিছু বলতে পারছি না, তা নইলে এক্ষুনি নোটিশ দিতাম, তুমি আমার বাগান থেকে জাহাজ তুলে নিয়ে যাও বলে।’
ক্যাপ্টেন ঠান্ডা হয়ে সব শুনল, তারপর মুচকি হাসল, ‘মশাই, আর রাগারাগি করবেন না। নোটিশও দিতে হবে না, ব্রুচ ও আমি ফেরত নেব না। আমার কাজ হয়ে গিয়েছে। কিছু সৈনিক জোটানোর আমার দরকার ছিল, তাই ওই লোভানি দিতে হয়েছে, নরকমহলের এক নম্বর চোলাইখানার ওই সোনালি রম। তা আমার কাজ হয়ে গিয়েছে, পেয়ে গেছি লোক। আজ রাত্রেই আমি চলে যাব আমার জাহাজ নিয়ে।’
ফিরে এলাম সরাইখানায়। ক্যাপ্টেনের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি আমরা, তাই কাউকে কিছু বলিনি গাঁয়ে। তবে আমি আর সরাইওয়ালা একসাথেই আছি। রাত্রে কী হয়, তাই দেখবার জন্য বসে আছি সরাইখানায়।
সন্ধ্যা হতে না-হতে শুরু হল ঝড় আর বৃষ্টি। আগে এক ঝড়ের রাতেই ওই ভূতের জাহাজ এসেছিল এ গ্রামে। আজ তো আবার শুরু হল ঝড়, দেখা যাক জাহাজ উড়ে যায় কি না এই ঝড়ে পাল তুলে দিয়ে।
যত রাত বাড়ে, দুর্যোগও বেড়ে চলে। শেষ রাতে জানালা দিয়ে দেখি, সত্যিই সেই কালো জাহাজ বিকট আওয়াজ তুলে আকাশপথে ভেসে যাচ্ছে আষ্টেপৃষ্ঠে পাল তুলে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল বলেই চোখে পড়ল জাহাজখানা। তা না-হলে আঁধার আকাশে কালো জাহাজ আড়ালে আড়ালেই উধাও হয়ে যেত।
সরাইওয়ালা নিশ্বাস ফেলল, স্বস্তির নিশ্বাস। তার বাগান খালাস হল এতদিনে। আমিও নিশ্বাস ফেললাম বটে, তবে সেটা দুঃখের। দুঃখ গাঁয়ের ভূতগুলির জন্য। ক্যাপ্টেন তাদের নিয়ে গেল। এ গাঁয়ের আনন্দও ফুরিয়ে গেল তাদের অন্তর্ধানে।
কিন্তু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবারও একটা সুযোগ আমি পেলাম, রাত ভোর হওয়ার পরে। সরাই থেকে বাড়ি ফিরেই দেখি, কালকের ঝড় মহৎ উপকার করে গিয়েছে আমার। দজ্জাল ল্যামপোর্ট বিধবাটার বাগান থেকে উড়িয়ে এনে আমার চালাখানাকে আবার শুয়োরের খোঁয়াড়ের মাথায় বসিয়ে দিয়েছে, যথাপূর্বং যথাস্থানং।