এক ঘোড়াভূতের গল্প
বৃষ্টিটা যেন পাহাড়ের এ-পিঠে ওত পেতে ছিল। চূড়াটা পেরিয়ে যেই রেমন্ড দুই পা নেমেছে এধারে, ঝিরঝির বারিধারে মুখ-মাথা ভিজিয়ে দিল তার। কোটের কলারটা উঁচু করে তুলে দিয়ে রেমন্ড দাঁড়িয়ে পড়ল অমনি, তাকাল সমুখপানে। থাকে থাকে নেমে গিয়েছে পাহাড়, প্রতি থাকে অগুন্তি খরগোশের গর্ত। উপত্যকা পর্যন্ত তাকে নামতে হয় যদি, পা ফেলতে হবে অত্যন্ত সাবধানে। নইলে? নইলে গর্তে পড়ে পা ভাঙবে, এই আর কী!
বড্ডোই বেশি দূর এসে পড়েছে রেমন্ড। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে শহরতলির পিচঢালা গলি ছেড়ে, এ-খামারের গেট আর সে-আবাদের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দিয়ে, একেবারে চষা খেতের মুলুকে হাজির হয়েছে সে, খেয়ালই ছিল না এতক্ষণ। এখন মনটা তিতো, কারণ জুতোয় কাদা লেগেছে, পেন্টুলানেরও হাঁটু পর্যন্ত ছোটো ছোটো কাদার ছোপ। তার চেয়েও বড়ো কথা, হাওয়ায় একটা ভিজে ভিজে মিইয়ে-পড়া আমেজ টের পাওয়া যাচ্ছে, যার মানে হল এই যে, যেকোনো মুহূর্তে শুরু হয়ে যেতে পারে একটা মুষলধার বর্ষণ। গা সিরসির করে উঠল হঠাৎ। সতর্ক হতে হল, ঠান্ডা লেগে না-যায়।
তবে এটা ঠিক যে, এই জায়গাটার উপরে তার তাক রয়েছে ঢের দিন থেকে। ছবি আঁকে সে। ছেলেবেলায় এদিকটাতেই থাকত। প্রতি ইঞ্চি জায়গাই চেনা এখানকার। এই পাহাড়চূড়া থেকে নীচের ওই উপত্যকার ছবিটা তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে পারলে দেখবার মতো জিনিসই হবে একখানা। মতলবটা অনেকদিনের, তা বলে আজই চলে আসবে এখানে, একথা বেড়াতে বেরুবার আগে সে মোটেই ভাবেনি। বর্ষা হামেশাই হচ্ছে, ঋতুটা না-পালটানো পর্যন্ত এখানে এসে ছবি আঁকা তো সম্ভবই নয়।
হ্যাঁ, দৈবাৎই এসে পড়েছে, বলা যেতে পারে। ওই তো সেই সুপরিচিত দৃশ্য। গভীর উপত্যকা, জনপ্রাণী কোথাও নেই, মাঠগুলো রিক্ত, মাটি ভিজে, যেন প্রাচীন একটা শুকিয়ে-যাওয়া হ্রদের তলায় বৃষ্টি পড়েছে এক পশলা।
কোথাও কিছু না। অবশ্য কোনো কিছুর প্রত্যাশা নিয়ে সে আসেওনি। তবু, এসে যখন পড়েছে, যে-ছবি সে আঁকবে, তার প্রেরণাবাবদ যাহোক-কিছু অনুভূতি তো প্রাণে আসা উচিত! কীরকম অনুভূতি? তা অবশ্য সে বলতে পারে না। ওটা ফরমায়েশ দিয়ে বানাবার বস্তু তো নয়!
তাহলে অপেক্ষা করে দেখতে হয়! নীচের ওই বেড়াগুলো, ওদের প্রতি বাঁক প্রত্যেক মোড় রেমন্ডের চেনা। ওই দূরবর্তী খামারবাড়িটাতে সদর গেট পাথরের তৈরি, লোহার দরজা বসানো তাতে। এই খরগোশের গর্তে আকীর্ণ পাথুরে তাকটা, যার উপরে এই মুহূর্তে সে দাঁড়িয়ে আছে, এটার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা কুড়ি বছরের পুরোনো। এ-সবের কোনো কিছুই কি কোনো সাড়া আজ জাগাবে না তার প্রাণে?
নাঃ। কোনো সাড়াই জাগে না। কুড়ি বছর আগের রেমন্ড, আর আজকের এই রেমন্ড। এদের ভিতর পার্থক্য অনেকখানি। এ-মুলুক আর চিনতে পারছে না তাকে। পুরোনো আলাপী বলে স্বীকার করছে না মোটেই। না, এ দেশ ওকে আপন বলে গ্রহণ করতে রাজি নয়। তেমনই আবার রেমন্ডও বুঝি রাজি নয়—
না, নিজের মনের দিকে তাকিয়ে রেমন্ডও এ দেশকে ঠিক আপন বলে মেনে নিতে পারে না। নাড়ির যোগ নেই। এ যেন তিন পুরুষের ছেড়ে-আসা মুলুকে ফের একবার বেড়াতে আসা। জমিজায়গা যদি এখনও কিছু বজায় থেকে থাকে, তাই বেচে-কিনে দু-পয়সা পকেটস্থ করার একটা চেষ্টা করা। নাঃ দরদ নেই। আছে বিরক্তি। আছে ধূমায়মান অসন্তোষ। জুতোর কাদা, পেন্টুলানের হাঁটু পর্যন্ত কাদার ছোপ, বৃষ্টি নামছে তিরের ফলার মতো গায়ে বিঁধে যাওয়ার জন্য, আকাশ ঘোলাটে, পথ কাদায় ভরতি, বড়ো রাস্তা পাক্কা দুই মাইল এখান থেকে, এক হাঁটু কাদা না-ভেঙে কোনো দিক দিয়েই সেই বড়ো রাস্তায় পৌঁছোনোর উপায় নেই। কারণ আছে বই কী অসন্তোষের!
ফিরে যাবে রেমন্ড? যে পথে এসেছে সেই পথ দিয়ে? অথবা এগুতেই থাকবে সমুখপানে? এগিয়ে গেলে, ওই যে খামারবাড়িটার পাথুরে গেট আর লোহার দরজা এখান থেকেই চোখে পড়ছে, ওই বাড়িতে সে পৌঁছে যেতে পারে, এক মাইল বা সোয়া মাইল হাঁটলে। আর বড়ো রাস্তাটাও ঠিক ওই বাড়িরই ওপাশটাতে। মোড় খেতে খেতে প্রায় বৃত্তাকারেই রাস্তাটা ঘুরে এসেছে কিনা! যার ফলে, এই মুহূর্তে রেমন্ড এমন একটা স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে সমুখে হাঁটলেও সে বড়ো রাস্তায় গিয়ে পড়তে পারে, পিছনে হাঁটলেও তাই।
কিন্তু সমুখে এগুনোর অসুবিধে আছে একটা। আগের দিনে ওই খামারের মালিক পরিবারে রেমন্ড ছিল অতিঅন্তরঙ্গ লোক। এখন, এত বৎসর পরে, এইরকম কাদার ভূত সেজে যদি সে হঠাৎ গিয়ে দেখা দেয় সেখানে, অনেক কৈফিয়ত আর জবাবদিহির দায়ে সে ঠেকে যাবে। অন্য একটা সম্ভাবনাও না-আছে, তা নয়। বহু বৎসর ওখানকার কোনো খবর রেমন্ড রাখে না। এমনও তো হতে পারে যে, ইতিমধ্যে হাতবদল করেছে খামারটা! তাহলে তো পড়ন্তবেলায় রেমন্ড ওখানে গিয়ে অপরিচিত লোকের ভিতরেই পড়ে যাবে। তারা হয়তো খারাপ লোকও হতে পারে। রেমন্ডকে অনধিকার প্রবেশের দায়ে ফেলে অপমানও করতে পারে, পুলিশেও দিতে পারে।
উঃ, দূরদিগন্ত থেকে বৃষ্টিটা সাঁ সাঁ করে ছুটে আসছে দেখ। ভাঙা ভাঙা ধোঁয়াটে-সাদা স্তম্ভের মাথায় মাথায় একটা চলমান জলপ্রপাত যেন। গাছগাছালি খামারবাড়ি সবই ঝাপসা দেখাচ্ছে তার আড়ালে পড়ে।
এমন রাগ হচ্ছে নিজের উপরে! এই কাদার ফাঁদে পা দেওয়া চরম মূর্খতা হয়েছে তার। রাগ হচ্ছে এই অপয়া জায়গাটার উপরেও, যেখানে এসে পড়ার দরুনই তার মতো একটা করিৎকর্মা লোককে এমন কাদার সং সাজতে হয়েছে। কী করে বেরুনো যায় এ-ফাঁদ থেকে এখন? কী করে? কী করে? উপায় খুঁজবার জন্যই সে ঘুরপাক খেতে লাগল চারদিকে। হঠাৎ একটা দিকে কী যেন কী ধরা পড়ে গেল তার চোখের কোণে। অমনি পঞ্চেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল তার। ঘুরপাক বন্ধ করে রেমন্ড সেই বিশেষ দিকটাতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।
সমুখের চষা-খেতের উপর দিয়ে পাহাড়ের দিকে দৌড়ে আসছে একটা ঘোড়া। পাতলা চেহারার একটা কালো ঘোড়া। মাথা নীচু করে ঘাড় লম্বা করে। রেমন্ডের চট করে মনে হল, কী জানো? মনে হল, শিকার ধরবার জন্য বেড়াল বা শেয়াল একটা, বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে ছুটে আসছে যেন।
রেমন্ড দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু অংশটাতে। তার ডাইনে-বাঁয়ে দুই দিকেই গিরিশির ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে খানিকটা। কিন্তু ডাইনের দিকে আন্দাজ শো-তিনেক গজ দূরে চূড়া দেখা যায় আরও একটা, তার উপরে আবার বেশ কিছু গাছগাছালিও আছে বড়ো বড়ো। রেমন্ডের চোখের সামনেই ঘোড়াটা দৌড়ে গিয়ে সেই চূড়াতে উঠে পড়ল, দাঁড়াল একটা ফাঁকা জায়গায়, কালো আকাশের ঠিক নীচে সেই কালো ঘোড়া। দুইয়ের মাঝে ব্যবধান শুধু ধূসর বর্ষার নিশ্ছদ্র দীর্ঘ ধারা।
দাঁড়াল— কতক্ষণ? কয়েক পলকের জন্যই দাঁড়াল। দুঃস্বপ্নে দেখা হিংস্র বাঘের মতোই সেই মুহূর্তে ভয়াল দেখাল তাকে। তারপরই আর এক দৌড়ে সে অন্যদিক দিয়ে নেমে গেল পাহাড়ের গা বেয়ে। রেমন্ড বেশ সহজভাবে নিতে পারছে না ঘোড়াটাকে। কয়েক সেকেন্ড সে চক্রবালরেখার দিকে তাকিয়ে রইল প্রত্যাশীর দৃষ্টি দিয়ে। কেমন যেন তার মনে হচ্ছে এবারে ঘোড়াটাকে সে আকাশের মাঠেই ধাবমান দেখতে পাবে। কিন্তু ঘোড়ার চিন্তা ছেড়ে নিজের মাথা বাঁচাবার চিন্তা এবারে পেয়ে বসল তাকে, মাথায় জল যা পড়ছে এবারে, তা দস্তুরমতো বরফজল। দূরে আর দৃষ্টি চলে না। নিরেট ধূসর দেয়ালের মতো চারদিকে তাকে ঘিরে রেখেছে ওই বৃষ্টি।
হাত দিয়ে গলাবন্ধ চেপে ধরেছে রেমন্ড, মুখখানাকে তারই ভাঁজের ভিতরে যথাসম্ভব নামিয়ে দিয়ে সে দৌড়োতে লাগল। পাহাড়চূড়ার পিছন দিকটা, অর্থাৎ শহরের দিকটায় মুখ করে সে ছুটল যথাসম্ভব জোরকদমে। কিন্তু জুতোর ভিতর পচপচ করছে জল, পদক্ষেপের সঙ্গেসঙ্গে জল ছিটকে উঠছে মাথা পর্যন্ত, সাধ্য কী যে বেশি জোরে দৌড়োবে?
পাহাড়টা ঢেউখেলানো। পিঠটা ধীরে ধীরে চাগিয়ে উঠেছে কুঁজের আকারে, মাঠগুলোর মাথার উপরে ঝুঁকে ঝুলে রয়েছে সুপ্ত শিশুর মুখের উপরে স্নেহাতুরা জননীর মতো। ওই মাঠগুলোর ওপাশে নদী, সেই নদীর পুল পেরুলেই শহর।
কিন্তু শহর, সে তো ঢের দূর, তার চিন্তা করা নিরর্থক এখন। মাথা গুঁজবার ঠাঁই একটাই চোখে পড়ছে এখন। পাহাড়ের ওই কুঁজের নীচে থেকে দুই দিকে দুটো বন বিস্তৃত রয়েছে নীচের মাঠ পর্যন্ত। একটা অবিচ্ছিন্ন বন নয়, কারণ মাঝখানে ছেদ রচনা করেছে বেশ বৃহৎ একখণ্ড অনাবাদি ভূমি।
দুটো বন, তাদের মধ্যে নিকটে যেটা, সেখানে আশ্রয় নেবার চেষ্টা করা স্রেফ বোকামি হবে। কারণ, দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে, বনটা নিছক ছোটো ছোটো আগাছা আর কাঁটাঝোপে ভরতি। ফাঁকা জায়গা যতগুলো নজরে পড়ছে, সব শেয়ালের গর্তে এবড়ো-খেবড়ো। তার চেয়ে ওই ওধারের বনটা— খুব বড়ো গাছ না-থাকলেও গাছ আছে ওখানে। বস্তুত হাতে-বসানো ক্ষুদে-ওকের একটা আবাদই ওটা। হোক ক্ষুদে, একা রেমন্ডের ছয় ফুট মাত্র দেহটাকে লুকিয়ে রাখার জায়গা ওরা দিতে পারবে নিশ্চয়ই। সেই দিকেই পা চালিয়ে দিল রেমন্ড।
প্রথম বনের মাথার উপর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে সে পাহাড়ের মাথা থেকে নীচে নামল। আঃ, কতকটা রক্ষা! বৃষ্টির হাত থেকে না-হোক, বাতাসের হাত থেকে ও বেঁচেছে। ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের গা এখানে, সেই ঘাসের ভিতর দিয়ে পথ করে করে ওকে যেতে হচ্ছে। গতি কাজেই তত দ্রুত নেই আর। ওকের আবাদে কাঁটাগাছের বেড়া আবার, সেটা পেরুতে গিয়ে দুই হাতে রক্তপাতই হল খানিক। অবশেষে ওক গাছের প্রথম সারি। ছোটো গাছ সব, ডালপালা কম। তবু, বৃষ্টিটা আবার চেপে আসতেই সে নিকটতম গাছটার তলায় ঢুকে পড়ল। ডালপাতা তেমন নেই, কিন্তু গাছের কাণ্ডটা হেলানো। রেমন্ড গিয়ে বসে পড়ল সেই হেলানো জায়গাটার তলায়।
দৌড়োদৌড়ি অনেক হয়েছে, রেমন্ড হাঁপাচ্ছে তখন। উবু হয়ে সে বসেছে দুই হাঁটুর উপরে থুতনি রেখে আর চোখের দৃষ্টি বৃষ্টিধারার উপরে নিবদ্ধ রেখে। অবিরাম বৃষ্টি, যাকে বলে বেড়াল কুকুর বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টির মতো ধূসর তার রং, তির্যক রেখায় ডালপালা ভেদ করে অদূরের কাঁটাঝোপগুলোর ভিতরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এতক্ষণে রেমন্ডের মনে হল, বিপদটা কেটেছে তার। চারিদিকে শুধু বৃষ্টিরই শব্দ, ঝমঝম, টপটপ, কুলকুল, কতরকম। সেই বহুবিচিত্র শব্দগুলো একহয়ে মিশে যাচ্ছে, যেমন করে ইট, চুন, সুরকি, সিমেন্ট একহয়ে মিশে যায় দুর্ভেদ্য দেয়ালে। সেই দেয়ালের আবেষ্টনে রেমন্ড এখন— হ্যাঁ, আশ্চর্য লাগে শুনতে, রেমন্ডের মনে হচ্ছে সে এখন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। আশ্চর্য! গায়ের জামা এতক্ষণ লাগছিল বরফের মতো ঠান্ডা, এখন ধীরে ধীরে তারাই যেন একটু একটু করে গরম হয়ে উঠছে। বেশ এক ধরনের আরাম লাগছে রেমন্ডের, অবশ্য ভেবে দেখবার মতো শক্তি তখন ওর মগজে থাকলে ও বুঝতে পারত যে ওই আরামবোধটাই হল অসাড় হয়ে যাওয়ার পূর্বলক্ষণ।
গুঁড়ির নীচে রেমন্ড, গুঁড়ির উপরে ডালপালা নেমে এসেছে নানা পরিমাপের স্থূল বা সূক্ষ্ম কোণ রচনা করে। ডালপালাকে দেখাচ্ছে চকচকে কালো, পালিশ-করা লোহা মতো। তাদের ডগা থেকে, তাদের প্রত্যেকটা ভাঁজ আর বাঁক থেকে জল ঝরছে ঝরঝর, গুঁড়ির ডালের উপরে স্বচ্ছ সাদা শত শত খাত রচনা করে। ডালের ফাঁকে ফাঁকে কদাচিৎ কখনো বহুদূরের শহরের আংশিক একটা চেহারা হয়তো চোখে পড়ছে ক্ষণিকের তরে, তারপরই মিলিয়ে যাচ্ছে আবার, একটানা বৃষ্টির দোলায়মান বিবর্ণ যবনিকার অন্তরালে।
রেমন্ড ভাবে, চলে যদি এই বৃষ্টি অনন্তকাল, দোষ কী? যতক্ষণ চলবে এই ধারাবর্ষণ, কোনো কিছুই করবার নেই তার, বেওজর ছুটি একদম। দৈনন্দিন জীবনধারা থেকে ততক্ষণ সে বিচ্ছিন্ন, কালপ্রবাহের কোনো ঢেউ তাকে স্পর্শ করবে না। বৃষ্টি থামলেই তো ছেঁড়া সুতো জোড়া লাগিয়ে আবার তাকে হাঁটুসমান কাদা ঠেলে পথ চলতে হবে। জুতোর ভিতর জল করবে পচপচ আর নতুন দামি পোশাকটার বারোটা বেজে যাওয়ার দুঃখে মন করবে খচখচ?
হঠাৎ তার গা সিরসির করে উঠল। হাঁটু দুটো আরও টেনে নিয়ে এল রেমন্ড বুকের ভিতর, তাতে যদি শীতের ভাবটা কাটে। হঠাৎ ঘোড়াটার কথা মনে পড়ে যায় কেন তার? ঘাড়ের চুল কয়েকটা কি খাড়া হয়ে উঠছে নাকি? ভয়? ভয় পাচ্ছে নাকি রেমন্ড? কীরকম তড়তড় করে ঘোড়াটা পাহাড়চূড়ায় উঠে পড়েছিল, আর অবারিত আকাশের নীচে বাঘের মতো হিংস্র দেখাচ্ছিল তাকে, সব মনে পড়ে যাচ্ছে কেন?
নাঃ, মোটেই আর ভাববে না ওকথা রেমন্ড। ঘোড়া-টোড়া তো আকছারই মাঠে-গোঠে ছুটে বেড়ায়! এতে আর অস্বাভাবিক কী আছে?
নেই? আছে বোধ হয়। ঘোড়ারা খামোকা বাদলা দিনে পাহাড়ের চূড়ায় চড়ে বসে না, মানুষের দিকে আগুন চোখে তাকায়ও না। কোন পথে উঠল, এ্যাঁ? এই যে বনটাতে বসে আছে রেমন্ড, এবং মাথার উপরে ওই যে কুঁজো পাহাড়, ওই পথেই তো? কী জানি কেন, ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের বাঁ-দিকে গাছের ফাঁকে ফাঁকে দৃষ্টি চালিয়ে দিল রেমন্ড।
বনের শেষে, পিছন থেকে সাদাটে পাংশু আলোর ফালি একটা এসে পড়ছে যেখানে, কালো ঘোড়াটা ওক গাছের তলায় ঠিক দাঁড়িয়ে আছে, মাথা উঁচু আর কান খাড়া করে, হিংস্র দৃষ্টি ঠিক রেমন্ডের উপরেই নিবদ্ধ করে।
ঘোড়া যখন নিরুপায় হয়ে বৃষ্টিতে ভেজে, সে যেন হুঁশপবন হারিয়েই বসে থাকে আধাআধি, পিছনের এক পা উঁচু করে তোলে, মাথা নীচুপানে নামিয়ে দেয়, চোখ থাকে আধবোজা। এইভাবেই সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে, বৃষ্টি যতক্ষণ না-থামে। এ-ঘোড়া তো মোটেই তেমন নয়। একাগ্র মনোযোগ দিয়ে এটা দেখছে রেমন্ডকে, দাঁড়িয়ে আছে টান-টান হয়ে, ঠিক যেমন বাঘ দাঁড়ায় শিকারের উপরে লাফ মারবার আগে।
রেমন্ডের শিরার ভিতরে রক্ত যেন জমে যেতে চাইছে। কী করে সে এখন? ওটাকে তাড়াবার চেষ্টা? পাগল আর কী! বন থেকে বেরিয়ে ছুট মারা, তাই বা কী করে করে সে? বৃষ্টি যে ঝমঝম ঝরছেই! ঘোড়াটা— ধুত্তোর, ওর কথা আর মোটেই ভাববে না রেমন্ড। বনটায় তো জায়গা ঢের, ঘোড়ার আর তার দু-জনার জায়গা তো অনায়াসেই হতে পারে এখানে! থাকুক-না ও!
হঠাৎ, মাটি কেঁপে উঠল! ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে ঘোড়া। গাছের ডালে ডালে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে প্রকাণ্ড জানোয়ারটা ধেয়ে আসছে ঠিক এদিকপানেই। গাছের গুঁড়ির তলা থেকে সাঁ-করে উঠে দাঁড়াল রেমন্ড, ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, একেবারে তার উপরেই এসে পড়েছে দানো-ঘোড়াটা। গলা লম্বা করে বাড়িয়ে দেওয়া, কামড়াবার জন্যে বড়ো বড়ো দাঁত বার করা— বড়ো বড়ো হলদে হলদে দাঁত। আর ওর চোখ? যেন রক্ত বেরুতে চাইছে ওর দু-চোখ ফেটে। রেমন্ড তিরবেগে ঘুরে গিয়ে গাছের পিছনে দাঁড়াল। তারপর তিরবেগে ছুটতে লাগল পাহাড়ের উপরপানে।
পাহাড়ের উপরপানে, মানে শহরের উলটো দিকে। দিগ্বদিক জ্ঞান হারিয়ে রেমন্ড ছুটল। এক-একবার পিছন ফিরে তাকায় যখন, ঘোড়াটাকে দেখতে পায়ই। জানোয়ারটাও ছুটছে সমানভাবে, তেমনই রক্তচক্ষুতে আগুন ঝরিয়ে, তেমনই হলদে দাঁত বার করে। পাথর কুড়িয়ে কুড়িয়ে এক-একবার সে ঢিলও মারছে ওটাকে, সে-ঢিল লাগছেও ওর গায়ে, কিন্তু গা থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে কই? সব ঢিল যেন সেঁধিয়ে যাচ্ছে ওর গায়ের ভিতরে, যেমন করে বুলেট ঢোকে রক্তমাংসের দেহে। কিন্তু বুলেট ঢোকা, আর পাথর ঢোকা কি এককথা হল? তা ছাড়া বুলেটের ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝরে, পাথর যেখান দিয়ে ঢুকছে, সেখানে রক্ত কই?
ছুটছে রেমন্ড, ছুটছে আর পিছন ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। কতবার হোঁচট খেল, কতবার পড়তে পড়তে বেঁচে গেল, কতবার পড়ে গিয়েও উঠল আবার, তার হিসাব কে রাখে? কতক্ষণ যে সে এমনিভাবে ছুটেছিল, তার হুঁশ নেই রেমন্ডের। হুঁশ হল, যখন এক যুগ আগের পরিচিত সেই খামারবাড়ির পাথুরে গেটের ভিতরে গিয়ে সে আছাড় খেয়ে পড়ল। সূর্য তখন ডোবে-ডোবে।
পুরোনো লোকেরাই আছে খামারবাড়িতে। তারা চিনল বই কী রেমন্ডকে। চিনল, ঘরে নিয়ে তুলল, পোশাক বদলে দিল। আর বলল, ‘বড়ো বেঁচে গিয়েছ আজ। বছর পাঁচেক আগে এক ঘোড়সওয়ার পথিক এমনই এক বাদলা দিনে বজ্রাঘাতে মারা যায় ওই উপত্যকায়। পথিকটা ভূত হয়েছে কি না, জানিনে, তাকে দেখেনি কেউ এযাবৎ। কিন্তু ঘোড়াটা যে হয়েছে ভূত, তা তো চোখেই দেখলে। এমনই বাদলা দিনে ওর ছুটোছুটির অন্ত থাকে না। তখন যাকে দেখতে পায়, তাকেই তাড়া করে। দুই-একজন মারাও গিয়েছে, পালাবার সময় পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে।’