এক গুরুতর মামলায় গোয়েন্দা দে এবং গোয়েন্দা দাঁ – হিমানীশ গোস্বামী
গোয়েন্দা দাঁ ফোন করলেন গোয়েন্দা দে-কে। বললেন, মশাই, খুব জরুরি দরকার, এক্ষুনি একবার আপনাকে আসতে হবে।
গোয়েন্দা দে বললেন, কী আশ্চর্য ব্যাপার জানেন, এই এক্ষুনি আমি আপনাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। আশ্চর্য নয় কি? এক্ষুনি আপনি একবার আসতে পারেন আমার এখানে? একজন মক্কেল এসেছেন, অসাধারণ এক সমস্যা নিয়ে।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, খুন, জখম, রাহাজানি, কিডন্যাপিং?
গোয়েন্দা দে বললেন, এখনও সেসব কিছু হয়নি—তবে সবই হওয়ার পথে। হ্যাঁ মশাই, ঠিকই বলছি—সবই হওয়ার পথে। আপনি একবার চলে আসুন।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, অসম্ভব!
গোয়েন্দা দে বললেন, কেন অসম্ভব? আপনার বাড়ি থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব…।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আধ মাইলও নয়। হাঁটাপথে দশ মিনিট লাগতে পারে বড়জোর। রিকশায় তিন মিনিট। সবই জানি মশাই, সবই জানি—কিন্তু আমার পা চলছে না। সেই বাত না কী হয়ে গোড়ালিতে প্রচণ্ড ব্যথা। দু-ঘণ্টায় ছ’টা অ্যাসপিরিন খেয়েছি, কিন্তু কিচ্ছু হচ্ছে না। আপনার সেই হোমিওপ্যাথির কীসব ওষুধ একবার দিয়েছিলেন না? সেবারে সেরে গিয়েছিল—সেই ওষুধ পাঠিয়ে দিন কাউকে দিয়ে, তারপর বিকেলের দিকে ভালো থাকলে যাব।
গোয়েন্দা দে বললেন, সে কী মশাই, আবার ওই বিশ্রী অসুখটা বাধিয়েছেন?—কথাটা বলে তিনি একটু উচ্চকণ্ঠে হাসলেন। বললেন, গতবার যখন আপনার পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা হয়েছিল, তখন আপনাকে যখন ওষুধ দিয়েছিলাম, আপনি কী বলেছিলেন মনে আছে?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, মনে নেই আবার? বলেছিলাম ওসব বুজরুকিতে আমার বিশ্বাস নেই।
গোয়েন্দা দে বললেন, তারপর আপনি ওষুধ খেয়েছিলেন অনিচ্ছার সঙ্গেই। খাওয়ার ছ’ ঘণ্টা পর ব্যথা কমে গেলে আপনি কী বলেছিলেন, মনে আছে?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, মনে নেই আবার? বলেছিলাম, ও-ওষুধ না খেলেও যে সারত না, তার প্রমাণ পাওয়া দরকার।
গোয়েন্দা দে বললেন, তাহলে এবারে সেই চেষ্টাই করুন না কেন? ওষুধ না খেয়ে দেখুন না কী হয়!
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, দোহাই দাদা, ওসব করবেন না। কবে কী বলেছিলাম, তা কি মনে করে রাখতে আছে? আচ্ছা, ওই যে মক্কেলের কথা বলেছিলেন, আর খুন রাহাজানি-টাহাজানির কথা বলছিলেন, সে-সম্পর্কে আর তো কিছুই বললেন না!
গোয়েন্দা দে বললেন, মক্কেল খুবই শাঁসালো। এবারে অবশ্য একটু দূরেই যেতে হচ্ছে আমাদের। পরশু বিকেলে প্লেন, একেবারে বোম্বাই। সেখানে তাজ হোটেল। তারপর দু-পাঁচদিন এদিক-সেদিক ঘুরে ফের আবার কলকাতায়। আর খরচ তাদের, এ ছাড়া দক্ষিণা নগদে সতেরো হাজার!
সতেরো হাজার শুনে গোয়েন্দা দাঁ ঢোক গিললেন। বললেন, স-তে-রো!
গোয়েন্দা দে বললেন, স-তে-রো।
গোয়েন্দা দাঁ জিগ্যেস করলেন, হা-জা-র?
গোয়েন্দা দে বললেন, হা-জা-র! ঘাবড়াবেন না—আধুনিক ভারতবর্ষে বহু বড়মানুষের দেখা পাবেন, যাঁদের কাছে এই টাকা একেবারে নস্যি!
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, শুনেই যে আমার পায়ের ব্যথা কমতে শুরু করেছে! যাক, আপনি ওষুধ নিয়ে আসছেন তো?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আসছি বিকেলের দিকে—তবে ওষুধ এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি। দিনে চারবার দশ ফোঁটা করে জলের সঙ্গে খাবেন।
বিকেলবেলা গোয়েন্দা দে ঢুকলেন শিস দিতে-দিতে। গোয়েন্দা দাঁ-কে দেখে বললেন, আছেন কেমন বলুন?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, চমৎকার! না মশাই, ওষুধের গুণ আছে। একটু আগেই ছাদে উঠেছিলাম।
কেন ছাদে কেন?
ঘুড়ি ওড়াতে, আবার কেন?
গোয়েন্দা দে বললেন, বয়েস কত চলছে আপনার?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, চুয়াত্তর। এ-বয়েস কি ঘুড়ি ওড়াবার পক্ষে খুবই বেশি?
গোয়েন্দা দে বললেন, তা ঠিক নয়—তবে হাত-পা ভাঙার পক্ষে বয়েসটা তেমন জুতসই নয়।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আমি আজ ছ’টা ঘুড়ি কেটেছি, আমার গেছে কেবল দু’খানা। এবার ব্যাপার কী বলুন।
গোয়েন্দা দে বললেন, একটা ব্যাপার করে ফেলেছি, মশাই, হয়তো অপরাধের মধ্যেই পড়ে সেটা। তবে কিনা, ব্যাপারটি অতি সামান্য—মানে কাজটি সামান্য, অথচ মুনাফা বেশি—সেজন্যে লোভ সামলাতে পারা গেল না। নিয়ে নিলাম কেসটা।
কেসটা কী, খুন-টুন?
গোয়েন্দা দে বললেন, এখনও খুন হয়নি—তবে মনে হয়, হবে একটা-দুটো। বিখ্যাত স্মাগলার গগনবিহারীর নাম শুনেছেন তো?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, গগনবিহারীর নাম শুনব না? সমস্ত ভারতবর্ষে তার অন্তত দুশো চেলা ছড়িয়ে রয়েছে, যার আয় মাসে কোটি টাকার ওপর, যার ব্যবসা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, চিন সীমান্ত জুড়ে। হেন জিনিস নেই যা ও স্মাগল করতে পারে না।
গোয়েন্দা দে বললেন, আমি অবশ্য অতটা জানতাম না। তবে এটা জানি, ওর দল মাসে দু-পাঁচটা প্রতিদ্বন্দ্বীকে খতম করে দেয়। গগনবিহারী লোকটি এক হিসেবে দারুণ নিষ্ঠুর। ক্ষমা কী তা সে জানে না। ছোট বয়েস থেকে পিতৃমাতৃহীন। বোম্বাইয়ের রাস্তায় তাকে কুড়িয়ে পেয়ে এক অনাথ-আশ্রমে কে ভরতি করে দেয়। বয়েস তখন তার দুই। তারপর ওই অনাথ-আশ্রম থেকেই তার চরিত্রের বিকাশ হতে থাকে। সেখানে সে একটা কুকুরকে বেঁধে একটা ছুরি দিয়ে তাকে কাটে, কেটে জীবন্ত অবস্থাতেই তার চামড়া ছাড়ায়। তখন তার বয়েস এগারো। ওই বয়েসেই সে আশ্রমের কাছে একটা ভয়ানক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, সাংঘাতিক!
গোয়েন্দা দে বললেন, সাংঘাতিক বলে সাংঘাতিক! যাই হোক, তার এই মধুর চরিত্রের জন্যে অনাথ-আশ্রমে তাকে নিয়ে হয় সমস্যা। সে জাগ্রত অবস্থায় কিছু-না-কিছু অন্যায় করতই। শাস্তিও পেত খুব। দু-হাত দু-পা বেঁধে দশ ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে পর্যন্ত রাখা হয়েছে তাকে। তাকে দু-দিন পর্যন্ত না খাইয়ে রাখা হয়েছে, কিন্তু চরিত্র তার সংশোধন হয়নি। অবশ্য সে অনাথ-আশ্রমে বেশিদিন আর থাকেনি। তার বয়েস যখন বারো, তখন সে হঠাৎ একদিন সেখান থেকে পালিয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আপনি দেখছি তার সব কথাই বেশ বিশদভাবে জানেন!
গোয়েন্দা দে বললেন, মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের পূর্বতন একজন অফিসার ঘোষালকে আজ ফোন করেছিলাম। ঘোষালকে মনে আছে আপনার? সেই যে বছর চল্লিশেক আগে বোম্বাইয়ের মালাবার হিলসের সেই পঞ্চাশ হাজার টাকার নেকলেস চুরির ব্যাপারে যিনি আমাদের তলব করেছিলেন। মনে আছে? থাকবেই তো। অতি সজ্জন ব্যক্তি। আজ তাঁকে ফোন করাতে, তিনি এসব কথা জানালেন। আরও কিছু জানাতেন, কিন্তু মাঝখান থেকে ফোনটা কেটে গেল, আর জোড়া লাগানো গেল না। যাই হোক, শিগগিরই তাঁর সঙ্গে দেখা হবে।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, ব্যাপারটা কী, মানে মামলাটা কী?
গোয়েন্দা দে একটু ইতস্তত করে বললেন, ব্যাপারটা আপনাকে বলতে একটু লজ্জা পাচ্ছি। মানে, আপনি ভাববেন, আমার এই অধঃপতন কেন হল?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, কী বললেন—আপনার অধঃপতন হয়েছে নাকি?
গোয়েন্দা দে বললেন, হ্যাঁ, হয়েছে! কিন্তু উপায় ছিল না। শুনুন তা হলে সবটা। আপনি জানেন, গগনবিহারী চোরাচালানকারীদের সর্দার। ভারতের সমস্ত চোরাই কারবার—বিশেষ করে ক্যামেরা, ঘড়ি, ক্যালকুলেটর, রেডিয়ো, টেপরেকর্ডার এ-সমস্তের অন্তত ত্রিশভাগ তার তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে। তার চক্র সমস্ত সীমান্তে সক্রিয়। তাকে চোরাইচালানের সম্রাট বললে অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু সম্প্রতি গগনবিহারীর গগনে মেঘের সঞ্চার হয়েছে। আর-একজন ওই একই গগনে উদয় হয়েছেন, তাঁর নাম রামখেল! নাম রামখেল হলেও লোকটি নাকি ধর্মে মুসলমান। তবে এসব ব্যবসায়ে হিন্দু-মুসলমান, খ্রিস্টান-ইহুদি সবাই সমান। এখন গগনবিহারীর সঙ্গে রামখেলের প্রচণ্ড বিরোধ চলছে। কয়েক মাস আগে লক্ষ্নৌয়ের কাছে একটা গুপ্ত গুদামে হানা দিয়ে পুলিশ উদ্ধার করেছিল প্রায় দেড়কোটি টাকার চোরাই মাল। এই মাল গগনবিহারীর। গগনবিহারীর দৃঢ় ধারণা, পুলিশকে এর খবর জানিয়ে দিয়েছে রামখেলই। সেই থেকে দু-দলের মধ্যে নানারকম সংঘর্ষ চলছে। আসল নেতারা যে-যার বহাল তবিয়তে রয়েছে। তাদের গায়ে কেউ আঁচড় পর্যন্ত দিতে পারে না, কিন্তু তাদের লোকজনের মধ্যে চলছে দারুণ রেষারেষি। বলা হয়, একটি বিমান দুর্ঘটনার মূলেও নাকি রামখেলের হাত ছিল। ওই বিমানে গগনবিহারীর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কলকাতা থেকে ওই বিমানটি যখন ওড়ে, তখন ওই বিমানটির একটি আসন খালিই যায়। সেদিন বিমানবন্দরের পথে ভি-আই-পি রোডে একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। তখন ভোরবেলা, যখন গগনবিহারীর ট্যাক্সি বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ একটা গাড়ি সেই গাড়িকে ওভারটেক করে পিস্তল দেখিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বাধ্য করে। তারপর গগনবিহারীর কাছ থেকে টাকা-পয়সা কী আছে ছিনতাই করতে এলে গগনবিহারী তার পকেট থেকে ‘সব টাকাই দিচ্ছি’ বলে একটা পিস্তল বের করে পরপর দুটি গুলি করে। রাস্তায় পড়ে থাকে দুই যুবকের মৃতদেহ। দুটি যুবক জানত না, কার সঙ্গে চালাকি খেলতে গিয়েছিল। যাই হোক, এরপর পুলিশের আগমন ঘটে এবং গগনবিহারী পুলিশের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডা করতে থাকে। কিন্তু পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়ে তাকে দেড় ঘণ্টা আটকে দেয়। তারপর গগনবিহারীকে খুব বাহবা দিয়ে যখন ছেড়ে দেয়। তখন নেপালের বিমান নেপালের পথে আকাশে উড়ে গেছে।
তারপর এল সংবাদ। আটত্রিশজন যাত্রীসমেত বিমানটি ভেঙে পড়েছে। কোনও মালপত্রের ভেতর টাইম বোমা ফেটে এই বিস্ফোরণ হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেল। গগনবিহারী মনে করল, তাকেই মারবার জন্যে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সে বেঁচে গেলেও এবং তার স্নায়ুর জোর বেশি হলেও তার মনের কোণে ভয় এসে বাসা বাঁধবার চেষ্টা করতে লাগল। সে ঠিক করল, রামখেলকে পৃথিবী থেকে বিদায় করতে হবে, নইলে তার জীবন নিরাপদ নয়। সে অবশ্য রামখেলের সঙ্গে দেখা করতে পারত। দেখা করে একটা মিটমাট করতে পারত, কিন্তু গগনবিহারীর চরিত্র মোটেই সেরকম নয়। সে স্থির করেই ফেলল, মারতে হবে রামখেলকে।
এবারে বলি রামখেলের কথা। রামখেলও ধোওয়া তুলসীপাতা নয়। খুনোখুনি সে-ও করেছে অনেক। রাজকোটের পুলিশ অফিসার সারোগীকে সে নিজের হাতে খুন করেছে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের মুখার্জিকে বোম্বাইয়ের শহরতলিতে গাড়িচাপা দিয়ে সে-ই মেরেছে। গোলাপ দেশমানেকে জলে ডুবিয়ে সে মেরেছে। তার কারণ গোলাপ দেশমানে পুলিশ অফিসার হয়েও তার দেওয়া জাপানি একটা টেলিভিশন সেট উপহার নিতে রাজি হয়নি। সঙ্গে অবশ্য একলক্ষ টাকার একটা তোড়াও ছিল, কিন্তু গোলাপ দেশমানে ছিল আদর্শবাদী যুবক। সে ভেবেছিল, সে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। কিন্তু বেচারা পারল না। মোট কথা, রামখেল অন্তত একডজন ভালো-ভালো অফিসার হত্যার জন্যে দায়ী। এ ছাড়া, গোষ্ঠী-সংঘর্ষে সে যে কত লোককে মেরেছে, তার হিসেব করা সম্ভব নয়।
গগনবিহারী রামখেলকে মারবার চেষ্টা করেছে দু-বার। দু-বারই সে ব্যর্থ হয়। তারপর তার কাছে এসে পড়ে নেপাল থেকে একজন সায়েব। জাতে সে মার্কিন। তার ধান্দা হচ্ছে, দেশে-দেশে কুখ্যাত গুণ্ডাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের খতম করে দেওয়া। ছদ্মবেশ ধারণে, চলনে-বলনে এই মার্কিন সায়েব অসাধারণ চতুর। বয়েস চল্লিশও হয়নি, কিন্তু এরই মধ্যে সে নাম কিনেছে খুব। এর আসল নাম কেউ জানে না, তবে সম্প্রতি এর নাম শিলিঞ্জার। মার্কিন দস্যু ডিলিনজারের সঙ্গে নামের মিল আছে। এর সুবিধে হল, সায়েব বলে সর্বত্রই তার অবারিত দ্বার। আমরা স্বাধীন হয়েছি অনেক বছর—কিন্তু এখনও সায়েব দেখলে আমাদের মনে দারুণ গদগদ ভক্তি জাগে। সে-সায়েব প্রচণ্ড অশিক্ষিত হতে পারে, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। আমাদের দেশে যাঁরা শিক্ষিত বলে পরিচিত, তাঁদেরও বেশ কিছু সংখ্যক ব্যক্তি সায়েব দেখলেই একেবারে যেন ক্রীতদাস হয়ে পড়েন। এ এক অদ্ভুত সমস্যা আমাদের দেশে। এরই সুবিধে নিয়ে শিলিঞ্জার এ-দেশে দারুণ সুবিধে করে নিয়েছে। সে থাকে নেপালে। এখন বোম্বাইতে রয়েছে। পরশু তার কাছে পৌঁছে দিতে হবে চারলক্ষ টাকা, একেবারে নগদে। সেই টাকা পেয়ে সে রামখেলকে খতম করে দেবে, এই তার প্রতিশ্রুতি।
গোয়েন্দা দাঁ প্রশ্ন করলেন, সব টাকাই কি নগদে দিতে হবে?
হ্যাঁ।
আর সব টাকা একসঙ্গে দিতে হবে, মানে, কাজ করবার আগেই শিলিঞ্জার যদি টাকা নেয়—শেষপর্যন্ত সে যদি প্রতিশ্রুতি পালন না করে, কিংবা ব্যর্থ হয়?
কথাটা ঠিক। এখানে গগনবিহারী একটা মারাত্মক অবিবেচনার কাজ করেছে। কোনও কৃষ্ণবর্ণ ব্যক্তি এরকম প্রস্তাব করলে গগনবিহারী হা-হা করে হেসেই উড়িয়ে দিত। কিন্তু যেহেতু শিলিঞ্জার একজন সায়েব—সে খুনে হোক, মিথ্যেবাদী হোক, কিচ্ছু এসে যায় না। চামড়ার রং সাদা যে তার!
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, এখন আমাদের এই নাটকে কোন চরিত্র?
গোয়েন্দা দে বললেন, আমরা হচ্ছি, ওই চারলক্ষ টাকার বাহক।
মানে?
মানে নগদ চারলক্ষ টাকা, একশো টাকার নোটে একটি সুটকেসে ভরে নিয়ে যেতে হবে এখান থেকে বোম্বাই। তারপর হোটেলে পৌঁছে গেলেই গগনবিহারীর লোক এসে ওই সুটকেস নিয়ে নেবে। ব্যস, ছুটি আমাদের!
এই কাজটা গগনবিহারী নিজেও তো করতে পারত?
পারত। কিন্তু সে কোনওরকম প্রমাণ রাখতে চায় না। তা ছাড়া, গগনবিহারীর সন্দেহ, সম্প্রতি কারা তার ওপর তীক্ষ্ন নজর রাখছে। সম্ভবত কোনও প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা, কিংবা পুলিশ। গগনবিহারী এমনভাবে কাজটা করতে চায় যে, তার ওপর যত সন্দেহই হোক না কেন, কেউ যেন কিছু প্রমাণ করতে না পারে।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, না, মশাই।
গোয়েন্দা দে বললেন, মানে?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, মানে অতি সহজ। এরকম কোনও কাজে আমায় জড়াবেন না। কী দরকার বলুন, সামান্য কয়েকটা টাকার লোভে এরকম অন্যায় একটা কাজে নিজেদের জড়ানো। হত্যার ব্যাপারে আমরা সাহায্য করছি, এটা ভাবতেও তো খারাপ লাগবে, লাগবে না?
গোয়েন্দা দে বললেন, দৃষ্টিভঙ্গির ওপর সব নির্ভর করে। এটা ঠিকই, আমরা একজনকে হত্যার ব্যাপারে সাহায্য করছি। কথাটা অন্যায় বলেননি কিছু। কিন্তু কাকে হত্যার জন্যে, সেটা ভেবে দেখেছেন কি? একজন এক নম্বরের খুনে, বদমায়েশ এবং সমাজ-শত্রুকে। রামখেলের মতো লোক এ-দেশে যত কমবে, তত এ-দেশের মঙ্গল।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, ঠিক কথা। কথাটা মন্দ বলেননি। কিন্তু আমরা বিচার করবার কে? আমরা ফাঁসির হুকুম দেওয়ার কর্তা হলাম কবে থেকে? হোক না রামখেল দারুণ পাপী, হত্যাকারী, বদমায়েশ। স্বীকার করলাম, তার মতো খারাপ লোক দুনিয়ার আর নেই। কিন্তু তাকে সরালেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? রামখেলের জায়গায় এসে যাবে লক্ষ্মণখেল, নয়তো রহিমখেল। খেলোয়াড়ের অভাব হবে কখনও? সমাজটাকে বদলাতে যদি দু-দশটা খুন করতে হয়, তা হলে আমি নিজের হাতে তা করতে রাজি, কিন্তু এ তো সম্পূর্ণ স্বার্থপরের মতো, নিজের আখের গোছানোর জন্যে একটা অন্যায় খুনকে আশকারা দেওয়া!
গোয়েন্দা দে বললেন, খুন তো আপনাকে নিজের হাতে করতে হচ্ছে না। আমাদের কাজ হচ্ছে, একটা সুটকেসকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। এর মধ্যে খুনের ব্যাপার আছে বা অতগুলো টাকা আছে তা আমাদের জানার কথাই নয়।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, না জানা থাকলে একরকম কথা, কিন্তু জানবার পর ব্যাপারটা তো আর অতখানি নিষ্পাপ থাকছে না! না মশাই, ওসব ঝুট-ঝামেলায় আমাকে আর জড়াবেন না। আমি ওতে নেই। বয়েস হয়েছে—এখন ওসব পাপ কাজ করতে আর মন সায় দেয় না।
গোয়েন্দা দে এ-কথায় গুম হয়ে গেলেন। বললেন, আপনি যা বলছেন, তাতে আমারও এখন কেমন-কেমন মনে হচ্ছে। সত্যি, কথাটা ভাবিনি এর আগে। বুঝলেন দাদা, চারদিকে অন্যায়, অবিচার, খুন-জখম এসব দেখে-দেখে বোধ হয় শুভবুদ্ধিও লোপ পেয়ে গেছে। আমি সত্যিই দুঃখিত দাঁ মশাই, সত্যিই দুঃখিত। তবে একটা কথা আছে। কথাটা আরে কিছু না—আমি সব কথা না ভেবেই রাজি হয়েছি, কথা দিয়েছি। এখন সমস্তই পাকা। এমনকী, অগ্রিমও নিয়েছি অনেকগুলো টাকা। এই অবস্থায় পিছোই-ই বা কেমন করে?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, সেটাও ঠিক। মক্কেলকে কথা দিয়ে তারপর ব্যাক আউট করা ঠিক হবে না। তবে একটা কাজ তো অনায়াসেই করা যায়—ব্যাপারটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগকে জানিয়ে দিলেই হয়। অর্থাৎ, আমরা সুটকেসটা পৌঁছে দেব ঠিকই—টাকাও নেব—এবং তারপর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ সুটকেস সমেত শিলিঞ্জারকে ক্যাঁক করে ধরলেই চমৎকার! আমাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে গগনবিহারীর, শিলিঞ্জারের সঙ্গে নয়। অতএব শিলিঞ্জার যদি ধরা পড়ে, তা হলে আমাদের দায়িত্ব থাকছে না।
গোয়েন্দা দে বললেন, কিন্তু শিলিঞ্জারকে ধরবার জন্যে অজুহাত কী? তার কাছে এক সুটকেস টাকা পাওয়া যেতে পারে—কিন্তু কাছে এক সুটকেস টাকা রাখা কি অপরাধ? তা ছাড়া, শিলিঞ্জার যথেষ্ট ঘুঘু লোক। শেষ পর্যন্ত সে পুলিশের জাল কেটে বেরোবেই। তারপর খোঁজখবর করতে-করতে যদি বুঝতে পারে এর মূলে আমরাই, তা হলে আমরা কি নিরাপদে থাকতে পারব? না, দাঁ মশাই, আপনার কথাটা তেমন কাজের নয়।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, তা হলে অন্য একটা উপায় বের করতে হবে।
কিন্তু কোনও উপায় তাঁরা বের করতে পারলেন না। তারপর দুজনে বসে তিনবার দাবা খেললেন। ন’টা বাজল। গোয়েন্দা দে বললেন, আজ উঠি। আপনি ভাবুন। যদি কার সকালের মধ্যে কিছু ভেবে বের করতে পারেন, তা হলে ফোন করুন। আর তা না হলে অগত্যা আমাদের বোম্বাইতেই যেতে হবে। মক্কেলকে খুশি তো করতে হবে!
গোয়েন্দা দাঁর রাত্রে প্রায় ঘুমই হল না। অনেকরকম দুঃস্বপ্ন তিনি দেখে ফেললেন। সকালে উঠে তিনি বিরস বদনে চা পান করতে-করতে ভাবলেন, উপায় কী—অধঃপতনের পথেই যেতে হবে। গোয়েন্দা দে-র ওপর তাঁর খুব রাগ হয়েছিল প্রথমে। পরে তাঁর ভেবে মনে হল, গোয়েন্দা দে-র খুব দোষ নেই। ক্লায়েন্ট হচ্ছে ক্লায়েন্ট। অর্থাৎ, মক্কেল হচ্ছে মক্কেল। মক্কেলের চরিত্র সাধু না হলে গোয়েন্দা কাজ নেবে না, এরকম নিয়ম হলে কোনওদিনই কি গোয়েন্দাগিরি করা সম্ভব হত? গোয়েন্দা দাঁ মনে-মনে হিসেব করে দেখলেন, তাঁরা যেসব মামলা হাতে নিয়েছেন, তার শতকরা নব্বুইভাগ ক্ষেত্রেই মক্কেলদের চরিত্রে কিছু-না-কিছু দোষ পাওয়া যায়। অতএব এই মামলার আর-একধাপ এগোনো কিংবা আর-একধাপ নীচের দিকে নামা। গত বছরের জানুয়ারিতে যে সুবিমলবাবুর দু-লাখ টাকা গায়েব হওয়ার মামলা হাতে নিয়েছিলেন, সেই সুবিমলবাবুই বা এমনকী সাধুপুরুষ? দু-লাখ টাকা আলমারি থেকে উধাও হয়েছিল। কিন্তু ওই দু-লাখ টাকা তিনি জমালেন কেমন করে? সুবিমলবাবুর যে ভেজাল তেলের কারবার আছে, সেটাও তো তিনি জানতেন। সেই ভেজাল তেলে যে বেশ কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেটাও তো ধরে নিতে হয়। কেউ হয়তো মারাই গেছেন। একহিসেবে সুবিমলবাবুও তো তা হলে সমাজবিরোধী। হয়তো হত্যাকারীও!
গোয়েন্দা দাঁ ডায়াল ঘুরিয়ে টেলিফোন করলেন গোয়েন্দা দে-কে। তিনি বললেন, রাজি!
গোয়েন্দা দে খুশি হয়ে বললেন, আমি আগেই জানতাম।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, কী আগেই জানতেন?
গোয়েন্দা দে বললেন, আপনি রাজি হবেন। আপনার পায়ের ব্যথা কেমন?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, চমৎকার। একেবারে সেরে গেছে।
গোয়েন্দা দে বললেন, ওষুধটা আরও তিনদিন চালিয়ে যান। এখন বোম্বাইতে কাজ অনেক না হলেও কিছু চলাফেরা করতে হবে। সঙ্গে ওষুধটা রাখবেন। নমস্কার।
গোয়েন্দা দাঁ যখন রিকশা করে ছোট একটা সুটকেস সঙ্গে করে গোয়েন্দা দে-র বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলেন, তখনও বোম্বাইয়ের বিমান ছাড়তে চারঘণ্টা বাকি। কিন্তু গোয়েন্দা দাঁ যখন যাচ্ছিলেন তখন তাঁর হঠাৎ মনে হল, কেউ বোধহয় তাঁকে অনুসরণ করছে। এটা তিনি বহুবারই লক্ষ করেছেন, কেউ তাঁকে অনুসরণ করলে তাঁর মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা গোলমালের সৃষ্টি হয়। একটা অস্বস্তিকর ভাব দেখা দেয়। এটার কারণ কী তিনি বুঝতে পারেন না। তাঁর এক বন্ধু বলেন, এ হল গিয়ে সেই ই-এস-পি-র ব্যাপার, যাতে কেবল অতীন্দ্রিয়তার কথা বলে সান্ত্বনাই পাওয়া যায়, বিষয়টি স্পষ্ট হয় না। তাঁর হঠাৎ মনে হল, এই কাজটিতে বিপদ আছে। বিপদ—বিপদ—বিপদ! তাঁর মনের মধ্যে কিছু ভয়ও ঢুকে গেল।
এরকম তাঁর আগেও হয়েছে কয়েকবার। সর্বদা নয়—কোনও-কোনও ক্ষেত্রে তিনি বুঝতে পারেন, একটা কিছু অশুভ ঘটতে যাচ্ছে। রিকশা চলতে-চলতে হঠাৎ তিনি একটু পিছনে তাকালেন। দেখলেন, একজন লোক সাইকেল চালিয়ে তাঁর পিছন-পিছন আসছে। লোকটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে সাঁত করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। মুখ ঘুরিয়ে নিলেও তার সাইকেল কিন্তু ঠিকই চলতে লাগল। গোয়েন্দা দাঁ শঙ্কিত হলেন। তাঁর বুকের মধ্যেটা কীরকম ধড়ফড় করতে লাগে। তাঁর গোড়ালির ব্যথাটাও মনে হল আবার শুরু হয়েছে। তিনি কোনওমতে গোয়েন্দা দে-র বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রিকশাওলাকে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিতেই সেই সাইকেলওলা তাঁর পাশ দিয়েই প্রায় বিদ্যুৎগতিতে বেরিয়ে গেল। গোয়েন্দা দাঁ গোয়েন্দা দে-র দরজার বেশ টিপলেন।
ভেতরে ঢুকে তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, বসার ঘরে বিরাট টেবিলের ওপর লাল রঙের একটা বেশ মজবুত বাক্স। সেটার গায়ে দুটো বড় তালা। তা ছাড়া, বেশ শক্ত ধরনের একটা শেকল দিয়ে সেটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো, তাতে আবার বড় তালা লাগানো। গোয়েন্দা দে গোয়েন্দা দাঁ-কে দেখে অভ্যর্থনা করলেন। বললেন, একটু আগেই এসে গিয়েছেন, ভালোই হয়েছে। দেখেছেন, বাক্সটি এমনভাবে সুরক্ষিত যে চাবি, ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে খুলতে হলে বোমা দরকার।
গোয়েন্দা দাঁ উদ্বিগ্নভাবে বললেন, কিন্তু হাজার গজ দূর থেকেই যে-কোনও গেঁয়ো মানুষও বলতে পারবে, একটা মাল বটে। সেটা ঠিক হয়নি।
গোয়েন্দা দে বললেন, তা যা বলেছেন। কিন্তু উপায় কী বলুন আর?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, কেন নীল রং কিংবা হালকা ছাই রঙা কোনও বাক্স কি বাজারে ছিল না?
গোয়েন্দা দে বললেন, লালটা বড্ড টকটকে। ঠিক বলেছেন। এটা আমার ভাবা উচিত ছিল।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, কী জন্যে জানি না, আমার মনে হচ্ছে, একটা বিপদ আমাদের সামনে আসছে।
গোয়েন্দা দে তাঁর পকেট থেকে ছোট্ট একটা পিস্তল বের করলেন। বললেন, এতে ছ’টা গুলি পোরা আছে।
গোয়েন্দা দাঁ তাঁর পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে বললেন, গুলি এতেও আছে, কিন্তু পঁচিশ বছর আগেকার—এর বারুদ অক্ষত আছে কি না কে জানে। হয়তো ভিজে হাওয়ার দাপটে এর পদার্থ বলে কিছু আর নেই।
গোয়েন্দা দে বললেন, পিস্তল আছে এটাই যথেষ্ট।
ঠিক এইসময় হঠাৎ জানলা থেকে একটা ছায়ামূর্তি যেন সরে গেল।
গোয়েন্দা দে তাড়াতাড়ি জানলার কাছে এসে দেখলেন। বললেন, একটা বছর বারোর ছোকরা হাফপ্যান্ট পরে পাঁই-পাঁই করে ছুটছে।
গোয়েন্দা দাঁ কোনও উত্তর না দিয়ে বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পরে বললেন, ব্যাপার সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না। পিছনে টিকটিকি লেগেছে। আমাদের ওপরে কেউ তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখছে।
গোয়েন্দা দে শিস দিয়ে গেয়ে উঠলেন, একটা নতুন হিন্দি ছবির গানের প্রথম লাইন।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আপনি দেখছি সম্পূর্ণ নিরুদ্বিগ্ন!
গোয়েন্দা দে তার উত্তর না দিয়ে শিস দিয়ে উঠলেন। গোয়েন্দা দাঁ তাঁর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন।
বোম্বাই বিমানবন্দরে নেমে বাইরে এসেই ট্যাক্সির সারি দেখে অবাক হয়ে গেলেন গোয়েন্দা দাঁ। প্রায় পনেরো বছর পর তিনি বোম্বাইয়ে এলেন। গোয়েন্দা দে বললেন, অবাক হয়েছেন দেখছি। কিন্তু মনে রাখবেন, এই শহরে পঁচিশ হাজারের ওপর ট্যাক্সি রয়েছে, কলকাতায় ট্যাক্সির সংখ্যা কুল্যে পাঁচ হাজারও হবে না।
এইসময় একটা ট্যাক্সি এসে সামনে দাঁড়াতেই গোয়েন্দা দে তাতে উঠতে যাবেন, কিন্তু তাঁকে প্রায় ধাক্কা দিয়েই একজন বদখত চেহারার লোক জোর করে সেটাতে উঠে পড়ে ড্রাইভারকে বলল, জলদি চালাও, আন্ধেরি!
সঙ্গে-সঙ্গে ট্যাক্সিটা হুস করে বেরিয়ে গেল। গোয়েন্দা দাঁ বললেন, এ তো অদ্ভুত! কলকাতায় অন্তত এত অভদ্রতা নেই, আপনি যাই বলুন।
দ্বিতীয় ট্যাক্সিতে অবশ্য নিরাপদেই ওঠা গেল। ‘তাজ’, সংক্ষেপে জানালেন গোয়েন্দা দে।
ট্যাক্সি ছুটে চলল খার, বান্দ্রা হাইওয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পর মহালক্ষ্মীর কাছে এসে হঠাৎ গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাতে উঠে পড়ল।
জায়গাটা খুব নির্জন নয়। অনেক লোকজন এসে গেল—সন্ধে তখন আটটা। গাড়িটা গিয়ে সজোরে ধাক্কা লাগাল একটা বাড়ির গায়ে। প্রচণ্ড আওয়াজ হল। গোয়েন্দা দাঁ এবং গোয়েন্দা দে দুজনেই অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
দুজনেরই জ্ঞান হল প্রায় একইসময়ে, হাসপাতালে। তখনই তাঁরা জানতে পারলেন, ড্রাইভারও আহত হয়ে ওই হাসপাতালেই অন্য ওয়ার্ডে রয়েছে। তার অবস্থা খুব ভালো নয়। সে নাকি প্রলাপ বকছিল—মাথায় তার চোট লেগেছিল, এখন তাকে ঘুমের ওষুধে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা দাঁ দুম করে খাট থেকে নেমে ডাক্তারকে প্রশ্ন করলেন, আমাদের জিনিসপত্র?
ডাক্তার বললেন, জিনিসপত্র? সে তো আমরা কিছু জানি না। হাসপাতালে ওই সময় যিনি ইমার্জেন্সি ডিউটিতে ছিলেন, তিনি বলতে পারবেন।
সঙ্গে-সঙ্গে গোয়েন্দা দে বললেন, চলুন, তা হলে ডিউটি অফিসারের কাছেই যাই।
ডাক্তার বললেন, আপনারা করছেন কী! আপনাদের দারুণ শক লেগেছে—এখন বিশ্রাম দরকার।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, মশাই, এখন বেশ আছি। আমাদের জিনিসপত্র আগে দরকার, নইলে সর্বনাশ।
ডিউটি অফিসার সচদেব খাতা খুলে দেখে বললেন, আপনাদের দুটো সুটকেস, দুটো পিস্তল, একটা হাতব্যাগ পাওয়া গেছে। তা ছাড়া দুটো ওয়ালেটও পাওয়া গেছে, তাতে নগদ তিন হাজার টাকা ছিল, আর ছিল ফিরতি বিমান টিকিট কলকাতার। কিছু ট্র্যাভেলার্স চেক।
গোয়েন্দা দে বললেন, আর-একটা ট্রাঙ্ক? ট্রাঙ্কের কথা লেখা নেই?
ডাক্তার সচদেব বললেন, নাঃ, আর বড় কিছুর কথা নেই। ছোটখাটো—বলপয়েন্ট পেন, একটা ছোট পেনসিল-কাটা ছুরি, দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম—এই সব।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আমাদের জিনিসগুলো কি পেতে পারি?
ডাক্তার সচদেব একটু হেসে বললেন, নিশ্চয়ই পেতে পারেন। আপনারা থানায় যান, সেখানে আপনাদের পরিচয় দিলেই সব পেয়ে যাবেন।
থানার অফিসার বললেন, আপনাদের খুব কষ্ট গেছে কাল। আপনারা এমনভাবে নেতিয়ে পড়েছিলেন যে, মনে হচ্ছিল আর বুঝি বাঁচবেন না। কিন্তু আজ সকালে আপনাদের বেশ তাজাই দেখা যাচ্ছে।
গোয়েন্দো দে বললেন, আমাদের জিনিসগুলি যদি দিতেন তো ভালো হত।
অফ কোর্স!—থানার অফিসার বললেন, সব জিনিসই আমরা যত্নে রেখে দিয়েছি।
লাল রঙের বড় ট্রাঙ্ক একটা কি পেয়েছেন?
না। লাল রঙের বড় ট্রাঙ্ক? ছিল নাকি?
ছিল, ট্যাক্সির পেছনে।
কিন্তু আমরা তো থানায় ট্যাক্সি এনে তার পেছনটাও খুলেছিলাম। সেখানে একটা টায়ার ছিল, এক বোতল কেরোসিন ছিল, আর ছিল এক বোতল দেশি মদ। এ ছাড়া আর তো কিছু ছিল না। ঠিক বলছেন, আপনাদের লাল রঙের একটা ট্রাঙ্ক ছিল?
গোয়েন্দা দাঁ অবসন্ন বোধ করছেন। এবার বোধহয় ভেঙে পড়বেন একেবারে।
পুলিশ অফিসার বললেন, ইস, আগে জানলে সুবিধে হত—আজ সকাল পর্যন্ত ট্যাক্সিটা এখানেই রাখা ছিল। এই তো ঘণ্টাখানেক আগে ট্যাক্সিওলা এসে সেটাকে নিয়ে গেছে। কিন্তু ঘাবড়াবেন না, তার ট্যাক্সির নম্বর আমাদের কাছে আছে। খুঁজে বের করতে ঘণ্টা-দুইয়ের বেশি লাগবে না। তবে গাড়ি রাস্তায় থাকলে কিছু দেরি হতে পারে।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, ট্যাক্সির ড্রাইভারের কিছু হয়নি?
পুলিশ অফিসার বললেন, ওকেও তো একই হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। ক্রমাগত ভুল বকছিল—মাথায় চোট লেগে। তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। সকালে এসে বলল, সে ভালো হয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে ট্যাক্সিটা ফেরত চায়। তা আমরা কোনও কথা না ভেবেই ট্যাক্সিটা ফেরত দিয়ে দিয়েছি। ওর বিরুদ্ধে তো কোনওরকম কেস ছিল না। একটা কেস ছিল, অসতর্কভাবে গাড়ি চালানো। তা নিয়ে একটা মামলা করা যেত অবশ্যই, কিন্তু সে পুলিশ ফান্ডে একশো টাকা চাঁদা দেওয়ায় মামলা করা হয়নি। তা, আপনারা কি তাকে সন্দেহ করছেন?
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, সন্দেহ? ও তো আর চুরি করেনি। ও নিজেই তো হাসপাতালে ছিল। চুরি করবার সুযোগই তো তার ছিল না।
গোয়েন্দা দে মনে-মনে কী যেন বিড়বিড় করে বললেন, কিন্তু কিছু শোনা গেল না। তারপর একটু উচ্চকণ্ঠে বললেন, না মশাই, ট্যাক্সি ড্রাইভারের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করতে চাই না, তবে আমাদের একটা লাল রঙের ট্রাঙ্ক খোয়া গেছে, এটা রেকর্ড করাতে চাই। লাল রঙের মোটামুটি ভারী ট্রাঙ্ক। একদিকে ত্রিশ ইঞ্চি, অন্য দিকে কুড়ি, আর পনেরো ইঞ্চি উঁচু। ভারী লোহার চাদরে তৈরি—তার গায়ে দুটো তালা। তার ওপর শক্ত শেকল দিয়ে জড়িয়ে একটা বড় তালা আটকানো। শনাক্ত করতে অসুবিধে হবে না।
পুলিশ অফিসার বললেন, তাতে কী ছিল?
গোয়েন্দা দে অম্লানবদনে বললেন, ডজন দুয়েক পুরনো পঞ্জিকা, কেজি-পাঁচেক খবরের কাগজ।
দামি কিছু ছিল না?
নাঃ, দামি কিছু ছিল না। তবে পুরোনো পঞ্জিকার দাম ভালোই পাওয়া দায়, যার দরকার তার কাছ থেকে।
থানার অফিসার সব লিখে নিলেন। তারপর গোয়েন্দা দে এবং গোয়েন্দা দাঁ-র জিনিসপত্র ফেরত দিয়ে একটা রসিদে সই করিয়ে নিলেন। রাস্তার বেরিয়ে গোয়েন্দা দে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বললেন, জুহু।
জুহুর কাছে ট্যাক্সি চলছে। হঠাৎ গোয়েন্দা দে একটা হোটেলের সামনে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে হোটেলে ঢুকেই বেরিয়ে এলেন। বললেন, আসুন, দাঁ মশাই, এটাতেই জায়গা আছে। দৈনিক দেড়শো টাকা—থাকা-খাওয়া সব। সমুদ্রের ভিউও মোটামুটি ভালো।
গোয়েন্দা দাঁ সুড়সুড় করে ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে এলেন।
হোটেলের চমৎকার ডবল-রুমে ঢুকে গোয়েন্দা দে কাচের জানলা খুলে দিলেন। প্রচণ্ড জোর হাওয়া ঘরে ঢুকে একেবারে যেন উড়িয়ে নিতে চাইল।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, এসবের অর্থ কী? এখন আমরা করব কী? পুলিশকে মিথ্যে কথা বলারই বা কী দরকার ছিল? চারলাখ টাকা কম নয়।
চারলাখ টাকা অনেক। ঠিক বলেছেন—বলে গোয়েন্দা দে একটা সিগারেট ধরলেন। তারপর বললেন, তবে কিনা, ধরুন, এককোটি টাকার তুলনায় এটা নস্যি। সবই আপেক্ষিক। গগনবিহারীর কাছে এ-টাকা হয়তো এক সপ্তাহের আয়—আমাদের কাছে এটা একটা বিরাট ব্যাপার!
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, কিন্তু পুলিশকে মিথ্যে কথা বলাটা কি ঠিক হল?
গোয়েন্দা দে বললেন, দাড়ি কামানোটা দরকার, কী বলেন? তারপর চান-টান করে একেবারে ফ্রেশ হয়ে হোটেল থেকে সমুদ্র দেখতে হবে!
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আপনি আমাকে সব কথা বলছেন না, বুঝতে পারছি। বেশ, তাই হোক। আমি এতে নেই। আমি আজই সন্ধের ট্রেনে কলকাতায় ফিরে যাব।
গোয়েন্দা দে বললেন, কেন? বিমানের টিকিটই তো রয়েছে। আজই বিমানে ফিরে যেতে পারেন। আমি আটকাব না।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, তবু আপনি সব কথা ভেঙে বলবেন না?
গোয়েন্দা দে বললেন, একটু ধৈর্য ধরুন। গুছিয়ে সব বলতে হবে তো! পরশু সন্ধেবেলা সেনগুপ্ত ট্রান্সপোর্টে একবার যেতে হবে। তার আগে যথাসম্ভব ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতে হবে। আর হ্যাঁ, দু-জায়গায় ফোন করতে হবে। ঘোষালকেও ফোন করে তার কুশল সংবাদ নিতে হবে। এবার আর তার সঙ্গে দেখা করা যাবে না মনে হচ্ছে।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতে হবে কেন? আমরা কী অপরাধ করেছি, মশাই, যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতে হবে? তা ছাড়া, তাজে আমাদের বুকিং ছিল, সেখানে না গিয়ে এত দূরে এই জুহুতেই বা কেন আমরা থাকব?
গোয়েন্দা দে বললেন, আপনার কথার উত্তর দিচ্ছি একে-একে। প্রথম কথা, আমাদের ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। তবে তাতে একটা রিস্ক আছে। ধরুন, আপনার বুকের মধ্যে দিয়ে তিনটে গরম গুলি সাঁ-সাঁ করে বেরিয়ে গেল, সেটা তো ভালো নয়। কিংবা ধরুন, আমার পায়ে গুলি লাগল…।
গোয়েন্দা দাঁ এ-কথায় খ্যাঁক করে উঠে বললেন, কেন, আপনার পায়ে গুলি লাগবে, আর কেনই বা আমার বুকে গুলি লাগবে?
গোয়েন্দা দে বললেন, ওটা কথার কথা। যাই হোক, আমি আপনার অন্য প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছি। তাজে বুকিং ছিল তাতে কী হয়েছে? একটু পরে ফোন করে সেটাকে ক্যানসেল করব। আর জুহুতে কেন থাকব? তা হলে শুনুন, আমার জুহু জায়গাটা চমৎকার লাগে, আর আমার মনে হয়, আপনারও ভালো লাগবে। এবারে আপনি চান-টান করে নিন, আমি গোটাকয়েক টেলিফোন করে নিই। আর-একটা কথা, আপনার ওষুধ খাওয়া হয়নি অনেকটা সময়। তাড়াতাড়ি এক ডোজ খেয়ে নিন।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হল চমৎকার। দু-রকম মাছ ছিল, এ ছাড়া কড়া করে ভাজা পমফ্রেট মাছ, সঙ্গে লেবুর টুকরো। পমফ্রেট মাছ খেতে হলে ভাজা খাওয়াই প্রশস্ত, ভাবলেন গোয়েন্দা দাঁ। চমৎকার—বোম্বাইয়ের হাওয়ায় বেশ খিদে হয় তো! একটু বেশিই খাওয়া হয়ে যায় দুজনের। কিন্তু এখন তো আর কোনও কাজ নেই, তাই বেশি খেলে ক্ষতিও নেই তেমন।
খাওয়ার পর দুজনেই ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল বিকেল প্রায় চারটেয়। সার্ভিসে টেলিফোন করে তাঁরা আনালেন চমৎকার দার্জিলিং চা আর চিজ স্যান্ডউইচ।
পায়ের অবস্থা কেমন?—গোয়েন্দা দে জিগ্যেস করলেন।
চমৎকার!
আর-একটু অন্ধকার হলে আমরা সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসব। এই সমুদ্র-সৈকত অতি চমৎকার।
সন্ধেবেলা দুজনে বেরোলেন। জুহু সমুদ্র-সৈকত তখন জমজমাট। ডাব, চিনাবাদাম, ভেলপুরি বিক্রির ধুম লেগে গেছে। আইসক্রিম, ঠান্ডা শরবত এসবেরও চলছে বেচাকেনা। কিন্তু মানুষজনের একটা দিকে ভ্রুক্ষেপ একেবারেই নেই। আইসক্রিমের ঠোঙা, ডাবের খোলা এসব নির্বিচারে ফেলা হচ্ছে সমুদ্রের বালিতে। সমুদ্র অবশ্য এতে রাগ করে না, কিন্তু সমুদ্রের ধারে যাঁরা বেড়াতে আসেন, সেই সব নরনারীর শতকরা নব্বুইজনই মনে করেন জায়গাটা নোংরা এবং শতকরা আটানব্বুইজনই নোংরা করতে সাহায্যও করেন।
চমৎকার কাটল সন্ধেটা। গোয়েন্দা দে ক্রমাগত এটা-সেটা কিনে খেয়েছেন, দাঁ-কে খাইয়েছেন। কিন্তু দাঁ-র মনে অস্বস্তি। তাঁর মনের মধ্যে কী যেন সর্বদাই খচখচ করছে।
বিপদ! হ্যাঁ, বিপদই হবে তাঁদের। তাঁর মন বলছিল, বিপদ হবে। বিপদ হয়েওছে। কিন্তু এর ওপর দিয়েই কি কেটে যাবে ফাঁড়া? আরও সাংঘাতিক কিছু কি হবে না?
গোয়েন্দা দাঁ চিন্তিত হয়েই রইলেন।
একটা দিন কেটে গেল এইভাবে। বিশেষ কোনও ঘটনাই ঘটল না। তাঁরা দুজন বেয়ারাকে দিয়ে দোকান থেকে দাবার সেট আনিয়ে খেলেছেন কয়েকবার।
প্লাস্টিকের সেট। কলকাতায় যার দাম ছ’ টাকা, এখানে তারই দাম নিয়েছে পনেরো টাকা। গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আসলে দাম একই, বেয়ারাকে দিয়ে কেনানোতে দাম বেশিই পড়ে।
গোয়েন্দা দাঁ ক্ষুণ্ণ হয়েছেন কথাটা শুনে। বলেছেন, তা একটাকা বেশি নিক না, নিক না ছ’ টাকা বেশি! তাই বলে একেবারে ন’ টাকা বেশি, এ যে সাংঘাতিক!
খুব খাওয়া-দাওয়াও হচ্ছে। প্রত্যেকবারই পমফ্রেট মাছ ভাজা বিশেষ করে অর্ডার দিয়ে আনিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা।
এইভাবে তৃতীয় দিন এল। সকালবেলা গোয়েন্দা দে বললেন, আজ সন্ধে আটটার সময় সেনগুপ্ত ট্রান্সপোর্টে যাব। তার আগে একবার তাজে যেতে হবে।
কেন, তাজ কেন?
চাবি সংগ্রহ করতে হবে না?
চাবি? কীসের চাবি?
কেন, টাকা ভরতি ট্রাঙ্কের?
কিন্তু সে-টাঙ্ক এখন কোথায়?
সে-ট্রাঙ্ক আসছে সেনগুপ্ত ট্রান্সপোর্ট মারফত। আর সেই ট্রাঙ্কের চাবি ইতিমধ্যেই ডাকে এসে গেছে।
গোয়েন্দা দাঁ হাঁ করে রইলেন। বললেন, তার মানে?
গোয়েন্দা দে বললেন, তার মানে অতি সহজ। আপনার সঙ্গে দেখা করার আগেই আমি দুটো কাজ করেছিলাম। একটা ট্রাঙ্কে টাকা ভরে সেটাকে সুজিতদের হাতে জমা করে দিয়েছিলাম। সুজিত হচ্ছে আমার বন্ধু অমলানন্দর ছেলে। বড় ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি রয়েছে তাদের। খুবই বিশ্বাসযোগ্য ওরা। তার ওপর সেটাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ইনশিয়োরও করিয়েছিলাম। খরচ সবসমেত পড়েছে যৎসামান্য—দুশো পঞ্চাশের কিছু ওপর। এইভাবে শত্রুপক্ষকে ধোঁকা দিয়েছি। তারা ভেবেছে, টাকা ভরতি রয়েছে আমাদের সঙ্গের ট্রাঙ্কে। ওর ওপরই তাদের ছিল নজর। আসল মাল যে লরিতে করে বিনা পাহারায় আসছে, সেটা তারা জানত না।
আর ওই লাল ট্রাঙ্কটা?
সেটা?—গোয়েন্দা দে হাসলেন। বললেন, ওর মধ্যে রয়েছে একগাদা পুরোনো পঞ্জিকা আর কেজি-পাঁচেক পুরোনো খবরের কাগজ! আমি পুলিশকে মিথ্যে বলিনি।
এরপর কী করবেন?—গোয়েন্দা দাঁ হতবুদ্ধি হয়েই প্রশ্ন করলেন।
আর কী করব? গগনবিহারীর লোক আমারই একটা চিঠি নিয়ে অপেক্ষা করবে সেনগুপ্ত ট্রান্সপোর্ট অফিসের সামনে। তার কাছ থেকে গগনবিহারীর রসিদ নিয়ে তার হাতে দিয়ে দেব ট্রাঙ্কটা। আর কী—তারপর কাজ শেষ! কাল ভোরের প্লেনে কলকাতা! না, কলকাতা নয়—ভুল বলেছি, দিল্লি। দিল্লিতে আমার শ্যালকের ওখানে তিন সপ্তাহ থাকব। আপনিও থাকবেন, আর তার মধ্যেই নিশ্চয় খবর পেয়ে যাব রামখেলের মৃত্যুর। শিলিঞ্জার যে-কাজে হাত দেয়, তা সে করেই। অতএব ওই ব্যাপারে আমরা নিশ্চিন্ত! এখন আমরা কলকাতায় গেলে বিপদ-টিপদ হতে পারে, কেন না, রামখেল লোকটি সুবিধের নয়। সে ব্যাপারটি জেনে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। কেন না, কলকাতা থেকেই তার চর আমাদের পেছনে লেগেছিল। তারপর বোম্বাই বিমানবন্দর থেকে তাজে যাওয়ার পথে কার-অ্যাক্সিডেন্টটাও।…সে অনেক কথা, কাল ভোরবেলা বিমানে বসে বাকিটা বলা যাবে।
বিমান চলেছে মেঘের মধ্যে দিয়ে।
গোয়েন্দা দে বললেন, দিল্লিতে থাকবার জন্যে গগনবিহারীর লোককে বলে আরও পাঁচ হাজারের ব্যবস্থা করেছি।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, চমৎকার করেছেন। কিন্তু আপনি আমাকে প্রথম থেকে সব কথা বলেননি কেন?
গোয়েন্দা দে বললেন, কারণ ড্রাইভার রামখেলেরই লোক। বোম্বাই বিমানবন্দরে দেখলেন না, যে-ট্যাক্সিটা আমরা প্রথমে নিতে যাচ্ছিলাম, সেটা কেমন কৌশলে রামখেলের লোক সরিয়ে দিল? এর কারণ, রামখেল আগেই খবর পেয়েছিল—কেমন করে আমার জানা নেই—যে, তাকে হত্যার জন্যে গগনবিহারী চেষ্টা করছে এবং আমাদের ওপর সে-ভার দেওয়া হয়েছে। সবসময় গগনবিহারীর ওপর তার লোক নজর রাখছে, এটাই সম্ভব। কোনওরকমে খবরটা তারা পেয়ে যাওয়াতে রামখেল আমাদের খতম করে দিতেই চেয়েছিল। আমার ধারণা, যেখানে ট্যাক্সিটার দুর্ঘটনা ঘটানো হয়, সেখানে তার লোকও প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু অন্যান্য লোকজন এসে পড়ায় তারা মারতে সাহস পায়নি। আমার মনে হয়, ড্রাইভারের হুকুমেই তারা আমাদের হয়তো খতম করত। কিন্তু ড্রাইভার দুর্ঘটনা ঘটাতে গিয়ে নিজেই আহত হয়ে পড়ে, ফলে সে আর তখন আদেশ দিতে পারেনি। গাড়ি থেকে লাল বাক্সটা বের করে নিয়ে তারা পালিয়ে যায়। তারা জানে, আমাদের মারা খুব কঠিন হবে না। কেন না, তাজে আমাদের বুকিং রয়েছে, সেটা নিশ্চয় তারা জানে। আমরা হাসপাতাল থেকে অত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাব সেটাও তারা আন্দাজ করতে পারেনি। আর শেষ পর্যন্ত আমরা যে তাজে উঠবই না, সেটাও তাদের হিসেবের বাইরে ছিল। অতএব, এ পর্যন্ত আমরা নিরাপদ।
গোয়েন্দা দাঁ জিগ্যেস করলেন, আপনি তা হলে আমার সঙ্গে কথা বলার আগেই সেনগুপ্ত ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে নোটের ট্রাঙ্কটিকে বোম্বাইয়ে পাঠিয়েছিলেন?
না, তা করিনি। আপনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পরই অবশ্য তা করেছিলাম। ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির রসিদটাও তাজের ঠিকানায় পাঠিয়েছিলাম চাবির সঙ্গে, পোস্ট অফিসের মারফত ইনশিয়োর করে। তারপর আপনার সঙ্গে দেখা করেছিলাম।
অর্থাৎ, আপনি ধরেই নিয়েছিলেন, আমি রাজি হব?
না। আমি ধরে নিয়েছিলাম আপনি রাজি না হতেও পারেন। সেক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা আমাকে একাই করতে হত। নয়তো তারক ধরকে ডাকতে হত।
তারক ধর? মানে যে-ছোকরা ডিটেকটিভির ড পর্যন্ত জানে না?
উপায় কী বলুন! আপনি রাজি না হলে একজনকে তো সঙ্গে নিতেই হত!
যেমন কিনা,—গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আপনি গগনবিহারীর কথায় রাজি না হলে, অন্য কেউ এই টাকাটা পৌঁছে দিত। তাই না?
ঠিক বলেছেন।—গোয়েন্দা দে বললেন।
আচ্ছা, আর-একটা কথার উত্তর দেবেন?—গোয়েন্দা দাঁ প্রশ্ন করলেন।
ছুড়ুন প্রশ্নটি, দেখি, উত্তর আমার জানা আছে কি না।
গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আচ্ছা মশাই, যদি শিলিঞ্জার সফল না হয়—মানে, রামখেলের খেল খতম করতে সে যদি সমর্থ না হয়, তা হলে আমাদের কী অবস্থা হবে?
গোয়েন্দা দে বললেন, অবস্থা একটু জটিল হবে নিশ্চয়। তা ছাড়া, এখন আমাদের বয়েস…আপনার চুয়াত্তর চলছে, আমার বাহাত্তর। দু-দিন আগে আর পরে, এই তো—সেজন্যে অত চিন্তা করি না আমি। তবে শিলিঞ্জারের ওপর বিশ্বাস রাখুন—ও ঠিক একটা ব্যবস্থা করবে।
মাসিক রোমাঞ্চ
পুজো সংখ্যা, ১৯৮০