এক খেলোয়াড়ের মৃত্যু
এই কাহিনি ভারতবর্ষের বুকে ঘটে যাওয়া এক অত্যন্ত বেদনার, নিদারুণ লজ্জার ঘটনার দলিল।
এই কাহিনি শুধুই দুঃখের নয়, লজ্জারও। এমন লজ্জা, যাতে আজও হেঁট হয়ে যায় আপামর এক—শো ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর মাথা।
না, এই ঘটনায় সেই অর্থে কোনো খুন ঘটেনি। কিন্তু ঘটেছিল একটি আত্মহত্যা।
মার্কিন লেখিকা সুজানা কাইসেন লিখেছিলেন, “Suicide is a form of murder – premeditated murder.”
ঠিক তাই। হোক আত্মহত্যা, কিন্তু সেই আত্মহত্যার পেছনে ছিল ক্ষমতা এবং অর্থকে কাজে লাগিয়ে তিলতিল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার অভিপ্রায়। তাই আইনের কচকচি ভুললে আমাদের মনের আদালতে এটা নিছকই খুন।
আসুন চলে যাই অতীতের এক সকালে। বেশিদিন আগের কথা নয়। মাত্র পঁচিশ বছর আগে।
দিনটা ছিল ১৯৯৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর।
হরিয়ানার পাঁচকুল্লা শহরের সেক্টর ছয়।
প্ল্যানড শহর, আমাদের কল্যাণীর আদলে সেখানে কৌণিক শেপে বিভিন্ন সেক্টরে বিভক্ত করা গোটা শহরটা। প্রতিটা সেক্টরেই চওড়া রাস্তাঘাট, ছবির মতো একতলা বা দোতলা বাংলো, সামনে কেয়ারি করা ফুলের বাগান।
নির্ঝঞ্ঝাট শান্ত এলাকা। এখানকার মানুষজনও নিজেদের জীবন নিয়েই ব্যস্ত। সাতসকালে পাড়ার দোকানে বসে চায়ের কাপে তুফান তোলার মতো সময় কারুরই নেই।
কিন্তু আজকের দিনটা ব্যতিক্রম।
বলতে গেলে গোটা সেক্টর ছয়—এর মানুষজন ভেঙে পড়েছে চাওড়া রাস্তার দু—পাশে। যারা একান্তই বেরোতে পারেনি, বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কৌতূহলী মুখে।
প্রত্যেকের মুখে চাপা আতঙ্ক, ফিসফাস গুঞ্জন।
একটু বাদেই গলির মুখে একটা ছোটো জটলা দেখা গেল। কিছু একটাকে কেন্দ্র করে কয়েক জন উর্দিধারী পুলিশ আসছে এদিকেই।
জনতা সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে পড়ল সেদিকে।
আরেকটু কাছে আসতেই বোঝা গেল, জটলার কেন্দ্রবিন্দুতে এক কিশোর। আজন্ম এই সেক্টর ছয়ের বাসিন্দা বলে সব প্রতিবেশীরাই জানে। ছেলেটার বয়স এখনও তেরো পুরে চোদ্দোয় পড়েনি, বাকি আছে কয়েক মাস।
জটলা আরও এগিয়ে আসতেই প্রতিবেশীরা সবাই চমকে উঠল। কারুর মুখে ফুটে উঠল সহানুভূতির অকৃত্রিম চিহ্ন, কেউ—বা সহ্য করতে না—পেরে ভ্রূ কুঁচকে মুখ ঘোরাল অন্যদিকে।
যে ফুলের মতো ছেলেটাকে বাড়ির পাশের বাগানে তারা বিকেল বেলা খেলতে দেখত, তার এমন অবস্থা দেখা কষ্টের বইকী!
ছেলেটা ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। তার হাতদুটো নাইলনের শক্ত দড়ি দিয়ে এমনভাবে পেছনদিকে বাঁধা, যে সেই বজ্রবাঁধনের ভারে সে নুয়ে পড়েছে সামনের দিকে। সেই অবস্থাতেও কবজিতে হাতকড়া পরানো।
পা—দুটোর দিকে তাকালে শিউড়ে উঠতে হয়। বুড়ো আঙুল দুটো বীভৎসভাবে থেঁতলে গেছে। সেখান থেকে ক্রমাগত বেরোতে থাকা রক্ত গোটা রাস্তায় ছাপ ফেলে চলেছে। ক্রমেই তার হাঁটার গতি মন্থর হয়ে পড়ছে, সে তাল রাখতে পারছে না চারপাশে বুহ্য গঠন করে চলতে থাকা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে।
পাশের এক ছোকরা সাব ইনস্পেক্টরের বোধ হয় সহ্য হল না এমন অবাধ্যতা। নিজের শক্ত বুট দিয়ে ছেলেটার নগ্ন পায়ের পাতা পিষে ধরল সে। অকথ্য একটা গালাগাল দিয়ে বলল, ”শালা ঘুমোচ্ছিস নাকি বে? চলতে পারছিস না?”
সাব ইনস্পেক্টরটির নাম প্রেম দত্ত। সে চারবছর চাকরি করছে, কিন্তু এমন মনের সুখে কাউকে পেটায়নি। গত দেড় মাস ধরে নিজের হতাশা, দুঃখ সব কিছুর ঝাল সে মেটায় হরিয়ানা পুলিশের এই বলির পাঁঠাটাকে দিয়ে।
কী যেন নাম এই আজব চিজটার? হ্যাঁ হ্যাঁ, আশু। আশু গিরহোত্রা। শালা গোটা ফ্যামিলিটাই বজ্জাত! শালাদের বড্ড রোয়াব, কিছুতেই কেসটা তুলবে না!
প্রেম দত্ত আবার নিজের সর্বশক্তি দিয়ে মুচড়ে ধরল তেরো বছরের আশুর হাত।
আশুর চেতনা অনেকক্ষণ আগে লুপ্ত হয়েছিল। তবু সে শারীরিক কষ্ট থেকেই বুঝি একটা আর্তনাদ করে উঠল। তার হাঁটুগুলো অনেকক্ষণ থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করছিল। প্রায় ছ—দিনের উপবাসে বিশ্রাম চাইছিল তারা। এবার পুরোপুরি কাজ বন্ধ করে দিল।
প্রেম দত্ত—সহ অন্যান্য পুলিশের রক্তচক্ষু বেমালুম উপেক্ষা করে আশু লুটিয়ে পড়ল পিচের মসৃণ রাস্তায়।
আশুর বাবা সুভাষ গিরহোত্রা পুলিশের পেছন পেছন আসছিলেন। তাঁর মুখে বহুদিনের না—কাটা দাড়ি। পরনে মলিন পোশাক। একঝলক দেখলে কে বলবে, এই মানুষটাই একটা সময় এক পোশাক পর পর দু—দিন পরতেন না?
গত তিনবছরে সাইক্লোন, টর্নেডো—র মতো বিধ্বংসী সব ঝড় বয়ে গেছে তাঁর ওপর দিয়ে।
তিনি কাতরভাবে অনুনয় বিনয় করছিলেন, ”আমার ছেলেটা বাচ্চা, ওকে এত কষ্ট দেবেন না? আপনাদের পায়ে পড়ছি …!”
কে শোনে তাঁর কথা?
আশু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চৈতন্য হারাতেই পুলিশের দল শশব্যস্তে তাকে উঠিয়ে নিল। দূরেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের জিপ। আশুকে এবার পাঠানো হবে হাসপাতালে।
সুভাষ গিরহোত্রা তাদের পিছু পিছু যাচ্ছিলেন, কিন্তু তারা রুক্ষভাবে তাঁকে সরিয়ে দিল, ”দূর হটো!”
আশুকে নিয়ে পুলিশভ্যানটা ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যেতেই এগিয়ে এল প্রতিবেশীর দল।
কিন্তু এই সর্বহারা বাবাকে তারা কী বলে সান্ত্বনা দেবে? গোটা এলাকায় যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে যেন মধ্যযুগের বাসিন্দা তারা, সব কিছু হয় কর্তার অঙ্গুলিহেলনে!
সুভাষ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই তাঁর নিজের বাড়ির দিক থেকে ছুটতে ছুটতে এলেন আনন্দ প্রকাশ।
আনন্দ আর সুভাষ দীর্ঘদিনের বন্ধু। দু—জনেই উচ্চপদস্থ চাকুরে, তাঁদের কন্যারাও হরিহর আত্মা।
আনন্দ এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ”সুভাষ, শিগগির তোমার বাড়ি চলো। এক্ষুনি! সর্বনাশ হয়ে গেছে!”
”কী হয়েছে?” সুভাষ ভীতকণ্ঠে জিজ্ঞাস করলেন।
আনন্দ আর সুভাষের বাড়ি একদম গায়ে গায়ে। এমন কী ঘটেছে সেখানে, যে আনন্দকে এইভাবে ছুটে আসতে হয়েছে?
সবচেয়ে বড়ো কথা, একজন জীবিত মানুষের জীবনে আরও কী সর্বনাশ ঘটার বাকি থাকতে পারে?
সুভাষ আর দ্বিরুক্তি না—করে আনন্দের পিছু পিছু ছুটলেন। সঙ্গে সঙ্গে ছুটল এলাকার আরও কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষজন।
বেশিক্ষণ নয়, মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সর্বনাশটা টের পেলেন সুভাষ। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আছড়ে পড়লেন নিজের বাড়ির বাথরুমের দরজায়।
বাথরুমের ভেতর রুচিকা পড়ে আছে। অচৈতন্য অবস্থায়। তার হাতে ধরা খালি কিটনাশকের শিশি।
চোখ দৃষ্টিশূন্য, গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে চোখের জল।
না। রুচিকা বাঁচল না। তামাম ভারতবাসীকে অপরিসীম লজ্জার মধ্যে ফেলে দিয়ে সে মারা গেল পরেরদিন।
মাত্র সতেরো বছর বয়সে শেষ হয়ে গেল একটা তাজা প্রাণ, অকল্পনীয় অত্যাচারের জাঁতাকলে চাপা পড়ে; ভারতীয় আইনব্যবস্থার প্রতি, স্বচ্ছতার প্রতি তীব্র উপহাস করে।
কে এই রুচিকা গিরহোত্রা?
কেন সে মাত্র সতেরো বছর বয়সেই শেষ করে দিল নিজেকে? কেনই—বা তার ছোটোভাইয়ের এই করুণ অবস্থা পুলিশের হাতে?
সেই হাড়হিম করা আপাত অবিশ্বাস্য ঘটনা জানতে চান?
আসুন চলে যাই আরও তিন বছর আগে।
ঘটনাস্থল একই।
হরিয়ানার পাঁচকুল্লা শহরের সেক্টর ছয়। সময়টা হল ১৯৯০ সাল।
ঝকঝকে একটা পরিবার। সুভাষ গিরহোত্রা স্থানীয় এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, তাঁর ফুলের মতো দু—টি ছেলে—মেয়ে—রুচিকা এবং আশু। রুচিকা অভিজাত স্যাক্রেড হার্ট স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী, আর তার ভাই আশু পড়ে ক্লাস সেভেনে।
রুচিকার যখন দশ বছর বয়স, তখনই সুভাষ গিরহোত্রার স্ত্রী এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। সুভাষ কর্মক্ষেত্রের চাপ সামলে একা বাবা—মার দায়িত্ব পালন করে বড়ো করে তুলছিলেন ছেলেমেয়েকে।
তাঁর এই কাজে আরও বেশি করে সাহায্য করতেন একদম পাশের বাড়ির আনন্দ প্রকাশের পরিবার। আগেই বলেছি, সুভাষ এবং আনন্দ ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু।
আনন্দ প্রকাশ ছিলেন হরিয়ানা স্টেট এগ্রিকালচার মার্কেটিং বোর্ডের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। কর্মক্ষেত্রে তিনি যেমন দক্ষ ছিলেন, তেমনই ছিলেন সামাজিক জীবনেও। তাঁর স্ত্রী মধু নিজের মেয়ে আরাধনার মতোই স্নেহ করতেন রুচিকা ও আশুকে।
এই কাহিনি বোধ হয় সবদিক থেকেই ব্যতিক্রম। এত লজ্জা এবং বেদনার মাঝেও যে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব আমরা বছরের পর বছর ধরে দেখবো, তাতে শ্রদ্ধায় মাথা নত করা ছাড়া উপায় নেই।
আনন্দ প্রকাশের মেয়ে আরাধনা ও সুভাষের মেয়ে রুচিকা ছিল হরিহর আত্মা। একই স্কুলে একই ক্লাসে তারা পড়ত। সারাক্ষণ তাদের একসাথেই দেখা যেত।
যেদিনকার কথা বলছি, সেদিন দুই বন্ধুরই খুব আনন্দ। বিশেষ করে রুচিকার।
প্রিয় বান্ধবীর গলা জড়িয়ে রুচিকা বলল, ”উফ আরাধনা, আমি তো ভাবতেই পারছি না রে! অবশেষে আমার এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে!”
আরাধনা মুচকি হেসে বলল, ”হুম, এইবার হরিয়ানার পাঁচকুল্লা থেকে ইন্ডিয়া একটা মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা পাবেই! তখন আর দেখে কে! ওহ, পর পর গ্র্যান্ড স্লাম, উইম্বলডন …!”
”ধ্যাত!” রুচিকা বান্ধবীকে থামিয়ে দিল, ”তোকে বলেছি না, আমার রোল মডেল নাভ্রাতিলোভা নয়। ওই যে নতুন জার্মান প্লেয়ার এসেছে না, আরে পর পর ইউ এস ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন সব হেলায় জিতছে …।”
”কে স্টেফি গ্রাফ?” আরাধনা চশমার ফাঁক দিয়ে তাকাল।
”হ্যাঁ হ্যাঁ, স্টেফি গ্রাফ, ও—ই আমার রোল মডেল। ওহ, কবে যে ওঁর মতো খেলতে পারব!”
রুচিকা প্রায় বছরতিনেক ধরে লন টেনিস খেলে। খেলে ভালো, কিন্তু তার চেয়েও সহস্রগুণ বেশি সে ভালবাসে খেলাটাকে। সত্যিকথা বলতে, সে হল টেনিস অন্ত প্রাণ। তাদের স্কুলে ব্যাডমিন্টন কোর্ট আছে। সে সেখানেই টেনিস প্র্যাকটিস করে।
কিন্তু যতই প্র্যাকটিস করুক, স্কুলে আর কতটুকু পরিকাঠামো রয়েছে যে তার আন্তর্জাতিক মানের স্কিল তৈরি হবে? ব্যাডমিন্টন কোর্টে কি আর টেনিস হয়? আলাদা করে তো কোনো কোচও নেই, সেই একজন গেম টিচার, যিনি সব খেলাতেই গাইড করেন।
এভাবে কি স্টেফি গ্রাফ হওয়া যায় নাকি! তবে, রুচিকার এতদিনের দুঃখ এবার দূর হতে চলেছে।
এক্ষুনি আরাধনার বাবা, মানে আনন্দ আঙ্কল এসেছিলেন, তিনিই সুখবরটা দিয়ে গেলেন।
”জানিস রুচিকা, আমাদের এখানে ইন্টারন্যাশনাল মানের টেনিস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হচ্ছে?”
রুচিকা আরাধনাদের বাড়িতেই বসেছিল, আনন্দ আঙ্কলের কথায় ও লাফিয়ে উঠল, ”মানে? এখানে? সত্যি বলছো আঙ্কল?”
”আরে সত্যি না—তো কী!” আনন্দ রুচিকার চোখের সামনে তুলে ধরেছিলেন হরিয়ানার স্থানীয় সংবাদপত্রটি, ”এই দ্যাখ, তাও আবার অন্য কোথাও নয়, এই সেক্টর ছয়েই।”
”কী বলছো!” উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছিল রুচিকার মুখ। কিশোরীমনের উচ্ছলতায় সে ভেসে যাচ্ছিল যেন।
”তবে আর বলছি কী! শম্ভু রাঠোর নামে একজন বয়স্ক আই পি এস অফিসার আছেন, আমাদের হরিয়ানা ক্যাডারেরই। ১৯৬৬ সালের ব্যাচ। তিনি লন টেনিস খুব ভালোবাসেন। নিজেও একসময় খেলতেন। বিভিন্ন রাজ্যে পোস্টেড ছিলেন, সম্প্রতি এখানে নিজের রাজ্যে ফিরে এসেছেন। এখন ডেপুটেশনে আছেন ভাকরা বিয়াস ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের ডিরেক্টর হিসেবে। এসেই ঠিক করেছেন তিনি হরিয়ানা লন টেনিস অ্যাসোসিয়েশন খুলবেন। আপাতত এই সেক্টর ছয়েই ওঁর বাংলোর পেছনে সরকারি জমিতে মাটির টেনিস কোর্ট বানানো হচ্ছে।” আনন্দ প্রকাশ খবরের কাগজ থেকে গড়গড় করে বলে গেলেন।
”আরে শম্ভু রাঠোরের মেয়ে তো আমাদের ক্লাসমেট, প্রিয়াঞ্জলী। আমাদের সেকশনেই পড়ে।” আরাধনা বলল, ”প্রিয়াঞ্জলীর বাবা টেনিস এত ভালোবাসেন জানতামই না, ইশ আগে বললেই তোর খেলাটা শুরু হয়ে যেত রে রুচিকা!”
”ও ঠিক আছে। বেটার লেট দ্যান নেভার!” রুচিকা উৎসাহে টগবগ করছিল, ”চল দু—জনেই কাল গিয়ে ভরতি হব।”
”আমি? আমি গিয়ে কী করব?” আরাধনা বলল। সে আবার একটু বইপোকা গোছের। বেশি খেলাধুলো পছন্দ করে না, বই পড়তে ভালোবাসে। তবে সে মাঠের বাইরে থেকে রুচিকাকে সর্বদাই উৎসাহ জোগায়।
”তোকেও খেলতে হবে।” রুচিকা আঙুল তুলে সাফ জানিয়ে দিল, ”দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছিস আর আমি একা কিছুতেই যাব না। তুইও যাবি বলে দিলাম, ব্যাস!”
আনন্দ প্রকাশ দুই বান্ধবীর কার্যকলাপ দেখে মিটিমিটি হাসছিলেন।
তিনি ভাবতেও পারেননি, সেদিন অন্তর্যামীও বোধ হয় হাসছিল অন্তরালে।
যাইহোক, পরেরদিন সুভাষ গিরহোত্রা রুচিকা এবং আরাধনাকে নিয়ে ওই নতুন অ্যাকাডেমিতে ভরতি করাতে গেলেন।
গোটা পাঁচকুল্লা থেকেই অনেক ছেলেমেয়েকে নিয়ে এসেছেন অভিভাবকেরা।
এখনও তেমন কিছু ইনফ্রাস্ট্রাকচার করা যায়নি, তবে ইনঅগু্যরাল সেশনে আই পি এস রাঠোর আশ্বাস দিলেন, ”আমি ভীষণভাবে চেষ্টা করছি, যাতে আমার রাজ্য থেকে ভবিষ্যতে ভালো ভালো প্লেয়ার উঠে আসতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী এবং ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। তাঁরাও খুব উৎসাহী এই প্রোজেক্ট নিয়ে।”
”স্যার।” হাত তুললেন একজন অভিভাবক, ”আপাতত কোচ ক—জন থাকবেন?”
”তিনজন।” রাঠোর বললেন, ”এ ছাড়া আরও দু—জনকে আমরা বিদেশ থেকে আনানোর চেষ্টা করছি। বড়ো ক্লে কোর্টটার পাশে আরও একটা ক্লে কোর্ট করার কাজ শুরু হবে। পঞ্চাশটা র্যাকেটের ইনভেন্টরি দিয়ে আমরা শুরু করছি।”
অভিভাবকরা হৃষ্টচিত্তে বাড়ি গেলেন। পরেরদিন থেকে সেখানে খেলতে শুরু করল একদল কচিকাঁচা। রাঠোর নিজেও খেলা শেখাতে লাগলেন। আপাতত তিনদিন খেলা হতে লাগল—মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি। সবাই প্রায় উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে—মেয়ে। সেই তিনটে দিন বিকেলে রাঠোরের বাংলোর সামনে সার দিয়ে তাদের গাড়ি দাঁড় করানো থাকে।
রুচিকা আর আরাধনাও আসে। আরাধনা একটু করে খেলেই বসে পড়ে। রুচিকা মনের আনন্দে র্যাকেট নিয়ে সারা কোর্টময় দাপিয়ে বেড়ায়।
রাঠোরের আই পি এস অফিসারস বাংলোর পেছনেই অ্যাকাডেমি। তিনি বাংলোরই পরিত্যক্ত একটা গ্যারাজে এই টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের অফিসঘর খুলে বসলেন। সন্ধ্যের পর নিজেই বসতে শুরু করলেন সেখানে। স্ত্রী আভা এবং কন্যা প্রিয়াঞ্জলীকে নিয়ে তাঁর সংসার। আভা নিজে একজন আইনজীবী।
এইভাবে মাসতিনেক কাটল। ইতিমধ্যেই রুচিকা নিজেকে একজন প্রতিশ্রুতিবান খেলোয়াড় হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। তিনজন কোচই রাঠোরের কাছে ফিডব্যাক দিয়েছেন, ”স্যার, রুচিকা গিরহোত্রা মেয়েটার সার্ভ খুব ভালো, স্ট্রোকগুলো তে বেশ জোর আছে জানেন। ফোরহ্যান্ডও ভালো মারে, ব্যাকহ্যান্ডটা একটু উন্নতি করলেই …।”
রাঠোর কৌতূহলী হয়ে কয়েক দিন ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন কে এই রুচিকা। তাঁর নিজের মেয়েরই সহপাঠিনী, এইবয়েসে এত ভালো খেলছে?
অবশেষে আগস্ট মাসের এক বিকেলে তিনি হঠাৎ গেলেন রুচিকার বাড়িতে। সেদিন ছিল শনিবার। আকস্মিক বাড়িতে একজন সিনিয়র আই পি এস অফিসারকে দেখে সুভাষ গিরহোত্রা অবাক। তাড়াতাড়ি তিনি বসতে দিলেন রাঠোরকে, ”বসুন স্যার! দাঁড়ান আমি একটু …।”
”ওসব কিছু লাগবে না মি গিরহোত্রা। আমি বসতে আসিনি। আমার একটা জরুরি মিটিং আছে, এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে।” রাঠোর বললেন।
পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে রাঠোরের সশস্ত্র দেহরক্ষী।
রুচিকা তার বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে ড্রয়িং রুমের সোফাটা দেখা যায়। তার মনে উৎকণ্ঠা, সে তো অ্যাকাডেমিতে কিছু করেনি! কী এমন ঘটল যে রাঠোর স্যার সটান বাড়ি চলে এলেন?
”আসলে—”রাঠোর গলা খাঁকারি দিলেন, ”রুচিকাকে আমরা এই কয়েক মাস ধরে নোটিশ করেছি। একজন ভালো প্লেয়ার হতে গেলে যা যা কোয়ালিটি দরকার, সব ক—টাই ওর মধ্যে আছে। একটু ঘষেমেজে নিলে হরিয়ানা তো দূর—গোটা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে ও। তাই আমরা ওর জন্য স্পেশাল ট্রেনিং—এর ব্যবস্থা করছি।”
”এ তো খুব ভালো খবর।” সুভাষ গিরহোত্রা গর্বিত মুখে দূরে দাঁড়ানো রুচিকার দিকে তাকান, ”আমাকে কী করতে হবে বলুন স্যার?”
”না না আপনাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমরাই করব।” রাঠোর উঠে দাঁড়ালেন, এবার বেরিয়ে যাবেন, ”কাল তো রবিবার, কাল আমরা অ্যাকাডেমিতে স্পেশালভাবে খোলা রাখব শুধু রুচিকার জন্য। আপনি ওকে পাঠিয়ে দেবেন, কেমন?”
”নিশ্চয়ই স্যার।” সুভাষ গিরহোত্রা কৃতজ্ঞতায় গলে গেলেন, ”একটু কিছু মুখে দেবেন না স্যার? প্রথমবার এলেন …।”
ততক্ষণে রাঠোর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন, বাইরে ওঁর সরকারি গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে।
পরের দিন রবিবার সকাল বেলা কথামতো রুচিকা গেল রাঠোরের অ্যাকাডেমিতে। সঙ্গে আরাধনাকেও নিল।
আরাধনা অবশ্য গাঁইগুই করছিল, ”আমাকে তো ডাকেনি, আমি কী করতে যাব?”
”তোকে বলেছি না?” রুচিকা চোখ পাকিয়েছিল, ”যেখানে আমি যাব, সেখানেই তুই যাবি।”
দিনটা ছিল ১৯৯০ সালের ১২ আগস্ট। রবিবার সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট সেরে দুই বন্ধু পিঠে র্যাকেট ঝুলিয়ে রওনা দিয়েছিল রাঠোরের অ্যাকাডেমিতে। কয়েক মিনিটের হাঁটা রাস্তা।
রাঠোর যে তিনজন কোচ নিযুক্ত করেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মি থমাস। থমাস হরিয়ানার বাইরে থেকে এসেছিলেন। সাময়িকভাবে তাঁর থাকার বন্দোবস্ত রাঠোর করেছিলেন নিজের বাংলোর ক্যাম্পাসে থাকা গেস্ট হাউসে।
রুচিকা আর আরাধনা অ্যাকাডেমিতে পৌঁছে কিন্তু কোনো কোচকেই দেখতে পেল না। এমনকী পাতলু বলে যে বেয়ারা ওদের বল এনে দেয়, সেও নেই।
আজ তো এমনিতে ছুটির দিন, কিন্তু রাঠোর স্যার যে বললেন আজ রুচিকার জন্য স্পেশাল ট্রেনিং?
আরাধনা ক্লে কোর্ট অবধি গিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, ”কী ব্যাপার বল তো, কাউকেই তো দেখছি না!”
রুচিকা ছটফটে স্বভাবের মেয়ে। তার মনে হচ্ছে এখনই ফাঁকা কোর্টে সার্ভ শুরু করে দেয়। সে বলল, ”চল খেলবি?”
”আরে দাঁড়া!” আরাধনা থামিয়ে দিল ওকে, রুচিকা সবসময়েই খলবল করে, সময়বিশেষে আরাধনাকেই রাশ টেনে ধরতে হয়, ”এখানে আমরা খেলতে শুরু করলে তো? ওদিকে হয়তো রাঠোর স্যার আর কোচরা অপেক্ষা করছেন তোর জন্য।”
”কোথায় অপেক্ষা করছেন?” রুচিকা ঠোঁট উলটে বলল, ”সব তো শুনশান!”
আরাধনা বলল, ”চল, অফিসঘরে গিয়ে দেখি।”
আগেই বলেছি, প্রাথমিকভাবে এই বাংলোর এক পরিত্যক্ত গ্যারেজকে এই অ্যাকাডেমির অফিসঘর করেছিল আই পি এস রাঠোর।
রুচিকা আর আরাধনা সেই ঘরে ঢুকতেই দেখল, রাঠোর টেবিলের উলটোদিকে বসে আছেন। ঘরে আর কেউ নেই।
এই যে রুচিকা!” মুখ তুলে তাকাতেই রুচিকার পাশে দণ্ডায়মান আরাধনার দিকে চোখ গেল রাঠোরের, ”তুমি, তোমার নাম কী যেন?”
”আরাধনা, আরাধনা প্রকাশ স্যার।” আরাধনা বলল।
”হুম আরাধনা। তোমাকেও কি স্পেশাল ট্রেনিং—এ ডাকা হয়েছে নাকি?” রাঠোর যেন বেশ অবাক হয়েছেন।
”না না স্যার।” আরাধনা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ”রুচি একা আসছিল, তাই আমিও এলাম। রুচির ট্রেনিং শুরু হলেই আমি প্রিয়াঞ্জলীর কাছে চলে যাব, গল্প করব। কোচেরা কোথায় স্যার?”
রাঠোরের নিজের কন্যা প্রিয়াঞ্জলী ওদেরই সহপাঠিনী, বাংলোতেই থাকে সে।
রাঠোর মাথা নাড়ালেন, ”বেশ বেশ। তা আরাধনা। তুমি এক কাজ করো, গেস্ট হাউস থেকে থমাস স্যারকে ডেকে আনো। আজ তো রবিবার, পাতলুও নেই, তাই খবর পাঠাতে পারিনি।”
”আমি এক্ষুনি যাচ্ছি স্যার!” আরাধনা ছুটে বেরিয়ে পেছনের দিকের গেস্ট হাউসে গিয়ে থমাস স্যারকে ডেকে আনতে গেলে সময় লাগার কথা সাকুল্যে পাঁচ মিনিট।
কিন্তু ছুটে গিয়েও আরাধনা অবাক হল। গেস্ট হাউস বন্ধ। বেল বাজিয়ে কোনো লাভ নেই। বাইরে থেকে তালা মারা।
হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেল, আরে থমাস স্যার নিজেই তো আগেরদিন বলেছিলেন, তিনি কয়েক দিনের জন্য ছুটিতে যাচ্ছেন!
রুদ্ধশ্বাসে ছুটল আরাধনা। কেন সে জানে না, একটা অশুভ বার্তা যেন তার অবচেতন মন বার বার পাঠাচ্ছিল মস্তিষ্কে।
ছুটে রাঠোরের গ্যারাজে ঢুকতে গিয়েই সে ভয়ে আতঙ্কে স্থবির হয়ে গেল।
এ কী দেখছে সে?
রাঠোরের চেয়ারের সামনের সেই বিশাল টেবিল, যার ওপর এতদিনের অব্যবহারে পড়েছে ধুলোর প্রলেপ। তার ওপরে রুচিকাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঠেসে ধরেছে পিতৃসম আই পি এস অফিসার রাঠোর।
রুচিকা ছটফট করছে, চিৎকার করে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না; কারণ তার মুখে একটা ন্যাকড়া গোঁজা।
রুচিকার নিম্নাঙ্গের স্কার্টের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে রাঠোরের হাত, অন্য হাত পিষে দিচ্ছে ওর স্তন।
রাঠোর কামে লাল হয়ে যাওয়া চোখদুটো যেন চাটছে তার সর্বাঙ্গ।
রাঠোরের পুরুষাঙ্গ উন্মুক্ত, নির্লজ্জভাবে সেটা ঘষা খাচ্ছে রুচিকার ঊরুতে।
”কী করছেন কী আপনি?’ আরাধনা চিৎকার করে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাঠোরের ওপর, এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে মারতে এক অসম লড়াইয়ে লিপ্ত হল ও, ”শয়তান! ছেড়ে দিন! ছেড়ে দিন ওকে এক্ষুনি! এক্ষুনি ছাড়ুন!”
আরাধনার এত দ্রুত প্রত্যাবর্তনে হকচকিয়ে গিয়েই কিনা কে জানে, রাঠোর ছেড়ে দিলেন রুচিকাকে, হাঁপাতে হাঁপাতে বসলেন নিজের চেয়ারে। লাল চোখে বললেন, ”তুমি বেরিয়ে যাও ঘর থেকে।”
”না যাব না!” আরাধনা আগুন চোখে বলল। ততক্ষণে সে দেখেছে তার খেলাপাগল সাধাসিধে বন্ধুটার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। চুল—মুখ বিধ্বস্ত।
”এর ফল কিন্তু ভালো হবে না!” আঙুল তুলে বললেন রাঠোর, ”তুমি জানো আমি কি হাল করতে পারি তোমাদের?”
আরাধনা একবার বন্ধুর দিকে তাকাল, আরেক বার রাঠোরের দিকে। পরক্ষণেই সে রুচিকার হাত হ্যাঁচকা মেরে টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটল বাড়ির দিকে।
বাড়ি গিয়ে প্রথমে রুচিকা কোনো কথা বলতে পারল না।
সে মা—মরা মেয়ে, ছোটো থেকে বাবার ভালোবাসা পেলেও কেমন যেন শিশুসুলভ। মা থাকলে বোধ হয় সে আরও বুঝদার হয়ে উঠত।
আরাধনার বুকে মাথা রেখে সে কেঁদে ফেলল হু হু করে।
আরাধনা চুপচাপ বন্ধুর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিল, ”যা হয়েছে ভুলে যা। ওই কুকুরটার কোনোদিনও মুখ দেখবো না আমরা আর। ওর মেয়ে আমাদের সঙ্গে পড়ে, আর ও কিনা … ছি ছি!”
রুচিকা সরল, আরাধনা তুলনায় অনেক পরিণত। কিন্তু বয়সটা তো দুজনেরই মেরেকেটে পনেরো। ওই বয়েসে প্রথমেই প্রতিরোধ ক্ষমতা আসে না, ভয়ে কুঁকড়ে যায় মানুষ। আড়ষ্টতায় কাউকে কিছু বলতেও পারে না। আর সেইজন্যই শিশুদের সফট টার্গেট করে বিকৃতকামেরা।
রুচিকা আর আরাধনারও তাই হয়েছে। তারা কাউকে খুলে বলতে পারেনি ব্যাপারটা। অবসাদে বিরক্তিতে দু—জনে একসাথেই থাকল সে রাতটা।
পরেরদিন সকালে ওরা কেউ খেলতে গেল না।
আরাধনা নিজের বাড়ি গিয়েছিল ফ্রেশ হতে, এসে দেখে নিজের বেডরুম বন্ধ করে রুচিকা বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে।
”আবার কাঁদছিস তুই? বোকা মেয়ে, তোর কী দোষ?” আরাধনা এগিয়ে এসে বলল, ”তোকে তো বলেছি, ওই জানোয়ারের মুখোমুখি হব না আর!”
রুচিকার কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গিয়েছে। সে বলল, ”কিন্তু আমার কোচিং? আমার কোচিং—এর কী হবে আরাধনা? থমাস স্যার বলেছিলেন ফিরে এসে ন্যাশনাল টিমে নাম পাঠাবেন আমার!”
আরাধনা চুপ করে গেল। একদিকে বন্ধুর সামনে সোনালী ভবিষ্যৎ, অন্যদিকে মানুষরূপী এক কুমির। কী করা যায়?
অনেক ভেবেচিন্তে সে বলল, ”এক কাজ করব শোন। আমরা আমাদের খেলার শিফট চেঞ্জ করে বিকেলে করে নিই। আজ কামাই হয়েছে হোক, কাল থেকে আমরা বিকেলে যাব।”
”সকালে খেলতে না—গিয়ে বিকেলে যাব? তাতে কী হবে?” চোখের জল মুছতে মুছতে বলে রুচিকা।
”রাঠোর সকালে থাকে। বিকেলে তো ও অ্যাকাডেমিতে থাকে না, অফিস, মিটিং এইসব করে। আমরা ওইসময় খেলতে গেলে দেখাই হওয়ার চান্স নেই।” আরাধনা বলল।
সেইমতো ঠিক হল।
পরেরদিন দুই বন্ধু মিলে বিকেলে খেলতে গেল। রুচিকা খেলা বড্ড ভালোবাসে, ক্রমাগত স্ট্রোক মারতে মারতে সত্যিই যেন দুঃখ অনেকটা ভুলল সে। রাঠোরকেও কাছেপিঠে দেখা গেল না।
সেদিন খেলতে খেলতে সন্ধ্যে প্রায় সাতটা বেজে গেল।
বেরোনোর সময় রাঠোরের বাংলোর পাশ দিয়েই বেরোতে হয়।
দু—জনে ঘেমেনেয়ে সেখান দিয়ে বেরোচ্ছে, এমন সময় পাতলু এসে ডাকল, ”রুচিকা কে তোমাদের মধ্যে?”
”আ—আমি!” আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল রুচিকা, ”কী হয়েছে?”
”স্যার এসেছেন। তোমাকে ডাকছেন অফিসঘরে।” পাতলু উত্তরের অপেক্ষা না—করেই চলে গেল।
রুচিকা চমকে তাকাল বন্ধুর দিকে। ওর চোখ ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গেছে।
আরাধনা কোনো কথা না—বলে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে চলল ওকে, ”চল তুই! এ তো দেখছি বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করল!”
সেদিন রাতেও দু—জনে ঘুমোতে পারল না। প্রতিদিন যদি রাঠোর এইভাবে রুচিকার শ্লীলতাহানি করতে শুরু করে, কী করে বাঁচাবে আরাধনা ওকে?
রুচিকা পাথর হয়ে জানলায় বসেছিল। বাইরে শুনশান রাস্তাঘাট, গভীর রাত।
আরাধনা বিছানায় ঠেস দিয়ে কী যেন ভাবছে।
রাত যখন তিনটে, তখন আরাধনা বলল, ”আমরা যে ব্যাপারটা কাউকে বলিনি, সেটাতে কি রাঠোর প্রশ্রয় পেয়ে গেল রুচি?”
রুচিকা চমকে তাকাল বন্ধুর দিকে। কোনো কথা বলল না।
জোরে জোরে মাথা নাড়ল আরাধনা, ”না। এইভাবে চলতে পারে না। একটা এত বড়ো পোস্টে চাকরি করা লোক দিনের পর দিন এমনভাবে অসভ্যতা করে যাবে, এটা সহ্য করা যায় না। কাল সকালেই আমরা বাবা—মাকে জানাব। তারপর দেখ না, ওর চাকরি গেল বলে!”
হায়! আরাধনা ভুল ভেবেছিল।
দেশটা যে ভারতবর্ষ! এখানে চোর, ধর্ষকরাই তো ঘোরে মাথা উঁচু করে। আর নির্দোষরা মরে গুমরে গুমরে।
পরেরদিন সকালে রুচিকা আর আরাধনা সুভাষ আর আনন্দকে সব খুলে বললেন। দুই বাবা প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেন না। তাঁরা দ্রুত প্রতিবেশীদের ডাকলেন নিজেদের বাড়িতে।
অধিকাংশই উচ্চবিত্ত। বেশিরভাগেরই বাড়ির ছেলে—মেয়ে ভরতি হয়েছে রাঠোরের টেনিস অ্যাকাডেমিতে।
সবাই মিলে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন, না। উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তার এমন কাজ কোনোমতে মেনে নেওয় যায় না। কেউ বললেন, ”চলুন লোকাল থানায় গিয়ে রিপোর্ট করি।”
আনন্দ প্রকাশ উড়িয়ে দিলেন প্রস্তাবটা, ”কী যে বলেন। আই পি এস অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ কোনো লোকাল থানা নেবে? কক্ষনো নেবে না।”
”তবে?”
”আরও উঁচু লেভেলে কাউকে ধরতে হবে।” আনন্দ স্থানীয় এক আইনজীবীর দিকে তাকালেন, ”আপনি একবার দেখুন না, আপনি তো মন্ত্রীলেভেলে অনেককে চেনেন।”
উকিলবাবু বাড়ি গিয়ে নিয়ে এলেন তাঁর টেলিফোন ডায়েরি। নম্বর খুঁজে খুঁজে একে—ওকে কিছুক্ষণ ধরে আনন্দের বাড়ির টেলিফোন থেকে ফোন করে জানালেন, ”মুখ্যমন্ত্রীর সচিবকে ফোন করলাম। কেউ তুলছেই না।”
হরিয়ানায় মুখ্যমন্ত্রী তখন হুকুম সিং। সুভাষ বললেন, ”না মুখ্যমন্ত্রী না হলেও যদি অন্য কোনো মন্ত্রী—টন্ত্রী …।”
উকিলবাবু বললেন, ”স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পৎ সিং আমার পরিচিত, দেখছি চেষ্টা করে।”
কিন্তু সম্পৎ সিংকেও পাওয়া গেল না। সবাই ভীষণ ব্যস্ত।
অবশেষে পরেরদিন অর্থাৎ ১৬ আগস্ট, ১৯৯০ তারিখে বহু চেষ্টার পর ওঁরা কয়েকজন দেখা করতে পারলেন স্বরাষ্ট্রসচিব জে কে দুগগলের সঙ্গে।
স্বরাষ্ট্রসচিব মন দিয়ে শুনলেন তাঁদের অভিযোগ। খোদ পুলিশের বড়োকর্তার বিরুদ্ধে এতবড়ো অভিযোগ, দুগগল সাহেব দেরি করলেন না। ১৭ তারিখ সকালেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পৎ সিংকে জানালেন পুরো ঘটনাটা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পৎ সিং ডাকলেন ডেপুটি জেনারেল অফ পুলিশ মি রাম রক্ষপাল সিং কে, ”আপনি ঘটনার তদন্ত শুরু করুন।”
আমাদের দেশে দু—বেলা দু—মুঠো পেটভরে খেতে না পাওয়ার লোক এত বেশি, যে সামান্য কিছু টাকা বা খাদ্যের বিনিময়ে তাদের দিয়ে যা—খুশি কাজ করিয়ে নেওয়া যায়।
পাঁচকুল্লাতে একটা বস্তি ছিল, নাম রাজীব কলোনি। রাঠোর কয়েকটা স্থানীয় মস্তানের সাহায্যে মোটা টাকা খাইয়ে রাতারাতি গোটা বস্তির লোকজনকে হাত করে ফেললেন।
রাঠোর যে কত বড়ো নির্দোষ এবং সাধু ব্যক্তি, তা জানাতে তারা দিন—রাত ধরনা দিতে বসল ডেপুটি জেনারেল অফ পুলিশ মি রাম রক্ষপাল সিং—এর অফিসের সামনে।
শুধু তাই নয়, টাকা খাইয়ে রাঠোর নিজের দেশের বাড়ি, আম্বালার নারায়ণগড় থেকেও লোক এনে সাজানো ধরনা শুরু করলেন।
”ন্যায়ের প্রতিমূর্তি, দেবতাস্বরূপ সৎ রাঠোর স্যারকে মিথ্যে কালিমালিপ্ত করা আমরা কিছুতেই মানব না। মানব না। মানব না।”
রাঠোর আকারে ইঙ্গিতে নিজের প্রভাব খাটিয়ে হাত করার চেষ্টা করলেন। ডিজিপিকেও।
কিন্তু ডেপুটি জেনারেল অফ পুলিশ মি রাম রক্ষপাল সিং টললেন না। টানা তিন সপ্তাহ পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চালিয়ে ৩ সেপ্টেম্বর তিনি রিপোর্ট পেশ করলেন দুগগল সাহেবকে।
রিপোর্টে পরিষ্কার লেখা ছিল, ”প্রাপ্তপ্রমাণের ভিত্তিতে আই পি এস রাঠোরকে এক্ষুনি গ্রেপ্তার করা হোক!”
দুগগল সাহেব সেই রিপোর্ট ফরোয়ার্ড করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পৎ সিং—এর কাছে। এবং, ঠিক এর পরেই শুরু হল প্রহসনের নির্লজ্জ নিদর্শন।
মন্ত্রী সম্পৎ সিং কিন্তু রিপোর্টটা পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তড়িঘড়ি পাঠালেন না। সেটাকে রেখে দিলেন ফাইলবন্দি করে।
এদিকে হঠাৎ করে ভোজবাজির মতো স্বরাষ্ট্রসচিব দুগগল সাহেব এবং ডেপুটি জেনারেল অফ পুলিশ মি রাম রক্ষপাল সিং—এর বদলির অর্ডার এসে গেল।
রাতারাতি তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হল ভিনরাজ্যে।
ডেপুটি জেনারেল অফ পুলিশ মি রাম রক্ষপাল সিং রিপোর্টে চাঁচাছোলা ভাষায় লিখেছিলেন, ”ওই ঘটনার পর থেকে স্থানীয় বিধায়ক জগজিৎ সিং টিক্কা—র লোকেরা প্রচুর দলবল নিয়ে রুচিকা গিরহোত্রার বাড়ির সামনে হল্লা করছে, তাদের হ্যারাস করছে। জগজিৎ সিং টিক্কা রাঠোরের মদতপুষ্ট লোক। ওকেও গ্রেপ্তার করা হোক।”
আর গ্রেপ্তার! কিচ্ছু হল না। এদিকে পরিস্থিতি মারাত্মক দিকে যেতে শুরু করল।
রাঠোর ছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী হুকুম সিং—এর ঘনিষ্ঠ, তাঁকে চটাবে কে? গ্রেপ্তারি তো দূর—কোনো অ্যাকশনই নেওয়া হল না।
ওদিকে রিপোর্ট জমা দেওয়ার ঠিক সতেরো দিন পরে, অর্থাৎ ২০ সেপ্টেম্বর সুভাষ গিরহোত্রা এক আশ্চর্য চিঠি পেলেন রুচিকার স্কুল স্যাক্রেড হার্ট থেকে।
”মাসিক ফিজ না দেওয়ার জন্য আপনার কন্যা রুচিকা গিরহোত্রাকে আমরা স্কুল থেকে সাসপেন্ড করছি।”
বিমূঢ় অবস্থায় সুভাষ ছুটে গেলেন স্কুলে। চারদিকে এত বিপদের মধ্যে এ আবার কী ঝামেলা!
অ্যাকাউন্টস সেকশনে ঢুকেই বললেন, ”কী ব্যাপার ম্যাডাম! ফি জমা দেওয়ার শেষ তারিখ তো সবে গতকাল পেরিয়েছে। আমি নানা ঝামেলায় একদম ভুলে গেছি, আমি এক্ষুনি টাকা জমা দিয়ে দিচ্ছি। লেট ফি কত আপনাদের?”
অ্যাকাউন্টস সেকশনে বসে থাকা সিস্টার কোনো উৎসাহ না দেখিয়ে নিজের কাজে মন দিলেন। সুভাষের মুহুর্মুহু চাপাচাপিতে একসময় দায়সারাভাবে বললেন, ”দেখুন মি গিরহোত্রা, আপনার মেয়েকে স্কুল থেকে পার্মানেন্টলি সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে আরও বিশদে জানার জন্য আপনি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলুন।”
কিন্তু সুভাষ প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেও স্যাক্রেড হার্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল সিস্টার সেবাস্টিনার দেখা পেলেন না। তিনি নাকি ভীষণ ব্যস্ত, দেখা করার সময় নেই।
বিধ্বস্ত অবস্থায় সুভাষ ফিরে এলেন বাড়িতে।
ততক্ষণে আনন্দ প্রকাশের স্ত্রী অর্থাৎ আরাধনার মা মধু বাড়িতে স্কুলের বিধিনিষেধ খুঁটিয়ে পড়ে ফেলেছেন।
সুভাষ আসতেই মধু বললেন, ”কী করে ওকে স্কুল রাস্টিকেট করতে পারে সুভাষজি? এই দেখুন, স্কুলের ব্রোশিয়োরে স্পষ্ট লেখা আছে, কোনো মাসে ফিজ জমা না—দিতে পারলে লেট ফাইন সমেত পরের মাসের ২০ তারিখ অবধি জমা দেওয়া যাবে। তার মধ্যেও কেউ ফিজ ক্লিয়ার না করলে তাকে স্কুল থেকে নোটিস পাঠানো হবে। সেই নোটিসেও কোনো কাজ না—হলে তখন তাকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না। সাসপেনসনের কোনো উল্লেখই নেই!”
সুভাষ ভেজা গলায় বললেন, ”বুঝতে পারছেন না ভাবিজি! এগুলো সবই রাঠোরের ষড়যন্ত্র! ও আমার মেয়েটাকে, আমাদের সব্বাইকে শেষ করে দিতে চাইছে!” তারপরেই বললেন, ”রুচি কোথায়?”
মধু বললেন, ”সকাল থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে ঘরে। অনেক কষ্টে এক গ্লাস দুধ খাইয়েছি। বাইরেও এম এল এ—র লোকগুলো এমন অশ্রাব্য কথাবার্তা বলে চেঁচাচ্ছে, যে ও দরজা খুলতে চাইছে না।”
”রুচি ওর স্কুলকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। ক্লাস ওয়ান থেকে পড়ছে ওখানে। এই খবরটা শুনলে তো আরও ভেঙে পড়বে!” অস্ফুটে বললেন সুভাষ।
আনন্দ প্রকাশ ইতিমধ্যে আর রাজনৈতিক মন্ত্রীদের ওপর ভরসা না—করে সোজা চলে গেলেন জেলাশাসক অর্থাৎ ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। স্কুল যে ইচ্ছাকৃতভাবে রুচিকাকে সাসপেন্ড করে স্বৈরাচারিতা দেখিয়েছে, সেই ব্যাপার লিখিত অভিযোগ জানালেন তিনি।
ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর কর্মচারীদের দিয়ে একটা এনকোয়ারি করলেন। সেই এনকোয়ারিতে উঠে এল অদ্ভুত তথ্য। এই মুহূর্তে স্যাক্রেড হার্ট স্কুলে মাসের পর মাস ফিজ জমা দেয়নি, এমন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৩৫। তাদের কাউকে বিতাড়িত করা হয়নি কখনো।
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, রুচিকা শুধু এই মাসেই ফিজ জমা দিতে দেরি করেছে, কিন্তু তারপরেও অন্তত আটজন ছাত্রছাত্রী ফিজ জমা দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো অ্যাকশন নেওয়া হয়নি।
আর মজার কথা, এই আটজনের মধ্যে রয়েছে আই পি এস রাঠোরের কন্যা প্রিয়াঞ্জলীও।
ম্যাজিস্ট্রেটের এনকোয়ারিতে এও জানা গেল, প্রিন্সিপাল সিস্টার সেবাস্টিনার নির্দেশেই রুচিকাকে তাড়ানো হয়েছে।
পরবর্তীকালে যখন দিনের পর দিন আদালত চত্বর ভেঙে পড়ত এই রুচিকা গিরহোত্রা কেসের শুনানিতে, তখন রাঠোরের পক্ষের আইনজীবীরা এই ইস্যুটাকেই তিল থেকে তাল করে দেখিয়েছিলেন, ”একটা ক্লাস টেনের ছাত্রীকে স্কুল থেকে সাসপেন্ড করছে। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে, মেয়েটার চরিত্র কতটা খারাপ! এই মেয়ে যে সম্মানীয় ব্যক্তিকে মিথ্যা অপরাধে ফাঁসাবে, তাকে আর আশ্চর্য কী!”
সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই হোক, নিজের সম্পর্কে এই সাজানো কুৎসা, এই তীব্র অপমান রুচিকাকে সহ্য করতে হয়নি। তার আগেই সে পাড়ি দিয়েছিল অন্যলোকে।
আসলে স্কুল থেকে রুচিকাকে তাড়ানো হয়েছিল রাঠোরেরই নির্দেশে। রাঠোর ভয় পাচ্ছিলেন, পাছে প্রিয়াঞ্জলীকে ক্লাসরুমে যদি রুচিকা কিছু বলে বসে!
স্কুলের এই ঘটনার পর রুচিকা আরও পালটে গেল।
সারাদিন হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকত সে, কারুর সঙ্গে কোনো কথা বলত না। আরাধনা এসে কত বোঝাত, ”চল। সামনের লনে একটু টেনিস খেলি। এই দ্যাখ, র্যাকেট এনেছি!”
রুচিকা শূন্যচোখে তাকিয়ে থাকত দূরে, যেন শুনতেই পেত না আরাধনার কথা।
এর মাঝেও দৈবাৎ নিতান্তই কোনো প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বেরোলেই বাইরে অষ্টপ্রহর দাঁড়িয়ে থাকা রাঠোরের দলবল রুচিকাকে কটূক্তি করত। চিৎকার করে যা তা কথা বলত রসিয়ে রসিয়ে।
রাঠোর সাদা পোশাকে কিছু পুলিশও মোতায়েন করেছিল রুচিকার বাড়ির চারপাশে, নজর রাখার জন্য। তারাও খৈনি খেতে খেতে বিশ্রীভাবে তাকাত; নানারকম অঙ্গভঙ্গি করত পনেরো বছরের কিশোরীটির দিকে।
ইতিমধ্যে সাইক্লোনের গতিতে গিরহোত্রা পরিবারে আছড়ে পড়তে লাগল একের পর এক ঝড়।
রুচিকার বাবা সুভাষ ছিলেন ইউকো ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। সুদক্ষ এবং সৎ কর্মী হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন তাঁর বিরুদ্ধে ঘুস নেওয়া, টাকাতছরূপ—সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ দায়ের হয়ে গেল থানায়।
রুচিকার ভাই, তেরো বছরের আশু শান্তশিষ্ট বালক, হঠাৎ তার বিরুদ্ধে এক সপ্তাহে পর পর পাঁচদিন পাঁচখানা ডায়রি রুজু হয়ে গেল—আশু নাকি বিরাট চোর। এরমধ্যেই পাঁচখানা বড়ো বড়ো চুরি করেছে।
এই প্রতিটা ডায়েরি থানায় রেজিস্টার করল সাব ইনস্পেক্টর প্রেম দত্ত। যার অপরিসীম নিষ্ঠুরতার কথা আগেই বলেছি।
আনন্দ প্রকাশ মিডিয়ায় চিৎকার করে বললেন, ”আদৌ কেউ থানায় এসে কোনো ডায়েরি করেনি। নিজে নিজে বানিয়ে বানিয়ে থানার রেজিস্টারে ওই ডায়েরি গুলো লিখেছে প্রেম দত্ত, রাঠোরের নির্দেশে। একটা তেরো বছরের বাচ্চাকে এইভাবে অভিযুক্ত করতে একটুও বাধছে না?”
আনন্দ সম্ভবত বুঝতেও পারেননি, এ সবে শুরু। বন্দুক এবার ঘুরবে তাঁরই দিকে।
আনন্দ ছিলেন হরিয়ানা স্টেট এগ্রিকালচার মার্কেটিং বোর্ডের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। এত বছরের চাকরিতে তাঁর একটাও কোনো খারাপ রেকর্ড ছিল না।
মিডিয়ায় ওই স্টেটমেন্টের পর ভোজবাজির মতো কুড়ি খানা অভিযোগ দায়ের হল তাঁর বিরুদ্ধে। আনন্দকে সাময়িকভাবে সাসপেন্ড করা হল, তাঁকে তাঁর নীচের পদ সুপারিনটেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ারে ডিমোশন করিয়ে দেওয়া হল। তারও কিছুদিন পরে তাঁকে স্বেচ্ছাবসরে বাধ্য করা হল।
আনন্দ হতবাক হয়ে গেলেও হাল ছাড়েননি। সরকারি আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি তার পরে প্রায় দেড় দশক লড়েছিলেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। পরবর্তীকালে কোর্ট তাঁকে নির্দোষ আখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছিল।
আনন্দের কন্যা আরাধনা ছিল রাঠোরের ওই কুকীর্তির একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। তাই তাকে রাঠোর কিছু করবে না—এমন ভাবাটাও ভুল। হাস্যকরভাবে একটি পনেরো বছরের কিশোরীর বিরুদ্ধে দশ দশখানা দেওয়ানি মামলা রুজু হল। আরাধনা নাকি রাঠোর এবং তাঁর পরিবারকে হেনস্থা করছে।
এমন মজার কথা খুব কমই শোনা যায় যে, একজন পনেরো বছরের মেয়ে জাঁদরেল বয়স্ক এক আই পি এস অফিসারকে হেনস্থা করছে!
যাইহোক, এই ঘটনার পর আরাধনা প্রায়ই রাস্তাঘাটে নোংরা ইঙ্গিত, অশালীন অঙ্গভঙ্গির সম্মুখীন হত। বাড়িতেও ফোন আসতে লাগল। কখনো হুমকি দিয়ে, কখনো যাচ্ছেতাই ভাষায়।
আরাধনাকে এই অত্যাচার বহুদিন সহ্য করতে হয়েছিল। শেষে তাকে অস্ট্রেলিয়ার এক প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়, আরাধনা অস্ট্রেলিয়া চলে যায়।
মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও আনন্দ এবং মধু প্রকাশ কিন্তু হাল ছাড়েননি। সুভাষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন এই অসম লড়াই। পরবর্তীকালে রুচিকার আত্মহত্যার পর প্রতিদিন তীব্রঅপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করতে না—পেরে সুভাষ যখন ছেলে আশুকে নিয়ে পাঁচকুল্লা ছেড়ে চলে যান, বছরের পর বছর আদালতে প্রায় চার—শোরও বেশি শুনানিতে সুভাষের হয়ে হাজিরা দিতেন এই প্রকাশ দম্পতিই!
রুচিকার পক্ষের আইনজীবী ছিলেন পঙ্কজ ভরদ্বাজ। তাঁর বিরুদ্ধেও থানায় ঝপাঝপ দুটো ডায়েরি দায়ের হয়ে গেল।
ইতিমধ্যে রাঠোরের পদোন্নতি হল। হ্যাঁ ঠিকই বলছি। এতকিছুর পরেও তাঁর কিন্তু অফিসে উন্নতিই হয়ে চলেছিল। রাঠোরকে হরিয়ানা স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের ভিজিল্যান্স টিমের প্রধান করে দেওয়া হল।
সেই ভার হাতে পেয়েই রাঠোর তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলা প্রতিটা লোকের বাড়ি রেইড করলেন। সেক্টর ছয় এর প্রায় প্রতিটা বাড়ির মানুষেরা, যাঁরা সুভাষকে সমর্থন করেছিলেন, হেনস্থা হতে লাগলেন রাঠোরের টিমের কাছে।
রুচিকা ক্রমশ মানসিক রুগি হয়ে যাচ্ছিল। ওর জন্য সবাইকে এসব সহ্য করতে হচ্ছে, ও—ই এসবের জন্য দায়ী, এসব কেবলই মনে হত ওর। তীব্র অন্তর্দহনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল ও।
দু—জন সাংবাদিক কাগজে রাঠোরের এইসব কীর্তি নিয়ে লিখছিল রুচিকার সুবিচারের আশায়, রাঠোর তাদের দু—জনের বিরুদ্ধেই এক কোটি টাকার মানহানির মামলা দায়ের করলেন। একজন উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তাকে নিয়ে এমন আজেবাজে লেখার সাহস তাদের হয় কী করে!
সবার কোমর মোটামুটি ভেঙে দিয়ে এবার রাঠোর তাকালেন রুচিকার একমাত্র ভাই আশুর দিকে।
২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩।
আশু গিয়েছিল বাজারে, একটা ফাউন্টেন পেন কিনতে। এখন যতই ডট পেন বেরোক, কালি পেনের তার খুব শখ। বাবা বলেছেন, এবার এইটে ওঠার সময় ভালো রেজাল্ট হলে ওকে একটা নামি কোম্পানির ফাউন্টেন পেন কিনে দেবেন।
এইসব ভাবতে ভাবতে ও রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছিল; কিন্তু শেষমেশ দোকানে পৌঁছোতেই পারল না। তার আগেই একদল সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে এসে টেনেহিঁচড়ে তুলল জিপ গাড়িতে। রাস্তার সমস্ত পথচারী অবাক হয়ে দেখল।
পুলিশের দল আশুকে নিয়ে সোজা চলে গেল মনসাদেবী এলাকায় অবস্থিত ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির স্টাফ অফিসে।
সেখানে তার ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাল সাব ইনস্পেক্টর প্রেম দত্ত আর অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর জয় নারায়ণ।
হাত—পা বেঁধে তাকে ফেলে রাখা হল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পায়ের পাতায় চাপিয়ে দেওয়া হল ভারী ধাতব পিণ্ড। তার ওপর অমানুষিক প্রহার।
কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হলেন রাঠোর স্বয়ং।
রাঠোরের নির্দেশে আগে থেকেই চারজন কনস্টেবল ভারী একটা রোলার নিয়ে এসেছিল। ‘রোলার’কে ওরা স্থানীয় ভাষায় বলত ‘মুসসল’; সেই মুসসল রাঠোর নিজের হাতে নির্মমভাবে চালিয়ে দিলেন আশুর পা এবং ঊরুর ওপর দিয়ে।
দু—দিন এইভাবে অত্যাচার চালানো হল। কিচ্ছু খেতে দেওয়া হল না আশুকে। তারপর রাঠোর আশুকে নিয়ে নিজে উপস্থিত হলেন রুচিকাদের বাড়িতে।
তখন বাড়িতে সুভাষ ছিলেন না। আশুর ব্যাপারে তিনি আর আনন্দ ছোটাছুটি করছেন দিন—রাত।
দরজা খুলে রুচিকা ভয়ে আতঙ্কে জমে গেল।
এক, ভাইয়ের অবস্থা দেখে। দুই, রাঠোরকে দেখে।
আশু তখন দাঁড়াতে পারছে না। তার পায়ের একাধিক হাড় ভেঙে গেছে। যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাচ্ছে সে।
রাঠোর বললেন, ”দেখছিস তো তোর ভাইয়ের অবস্থা? এখনও সময় আছে। কমপ্লেনটা উইড্র’ করে নে। না হলে কিন্তু তোদের সবাইকে তিলে তিলে শেষ করব আমি! সেদিন তো তোর সাথে একটু মজা করেছিলাম। এবার যেটা করব—সেটা ভাবতেও পারছিস না!”
রাঠোর চলে যেতে রুচিকা ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল হাউ হাউ করে। কাঁদতে কাঁদতে সেই কান্না পরিণত হল জান্তব অট্টহাস্যে।
সে হাসছে কেন?
আচ্ছা, সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে?
আশুকে এরপর আবার পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে গেল ১১ নভেম্বর। সেদিন সাদা কাগজে তাকে দিয়ে লিখিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হল, ”আমি আশু গিরহোত্রা স্বীকার করছি যে আমি এগারোটা গাড়ি চুরি করেছি!”
স্বীকার না—করে উপায় কী! দিনের পর দিন একফোঁটা খাবার নেই, সঙ্গে বেধড়ক মার, কতটা সহ্য হয় ওইটুকু শরীরে?
সেইসময় বিহারের এক দাগি আসামি, তার নাম গজেন্দর সিং, সে এগারোটা গাড়ি চুরি করেছিল। তাকে দিয়ে সাজানো সাক্ষ্য দেওয়ানো হল, ”হ্যাঁ, আমি আর হরিয়ানার আশু গিরহোত্রা মিলে এই কাজ করেছি।”
তাকে লোভ দেখানো হল, এমন বললে তোমার সাজা কমিয়ে দেওয়া হবে।
এরপরের ঘটনা প্রথমেই বলেছি। আশুকে সারা এলাকায় হাতকড়া পরিয়ে মারতে মারতে ঘোরানো হচ্ছিল।
রুচিকা ভেতরে ভেতরে অনেকদিনই মরে গিয়েছিল। অবশেষে ছোটোভাইয়ের অতটা কষ্টের দিনই সে বিষ খেল। মারা গেল পরের দিন, ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৯৩।
সেদিন রাঠোরের বাংলোয় রাতভোর পার্টি চলেছিল। আনন্দে। আপদ বিদায় হয়েছে।
রুচিকা কিন্তু মরে গিয়েও শান্তি পেল না।
রাঠোর বললেন, ”রুচিকার ডেডবডি ওর বাবার হাতে দেওয়া হবে না, যতক্ষণ—না ওর বাবা সাদা কাগজে সই করে।”
আশু কিন্তু তখনও কোনো বৈধ ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশ হেফাজতে। সে দিন—রাত অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকে লক আপে।
রাতের বেলা পুলিশরা সব মদ খেয়ে ওকে নগ্ন করে বেধড়ক পেটায়, উল্লাস করে।
ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও করা হল অদ্ভুত যোগসাজশ। সেখানে রুচিকার নাম পাল্টে করে দেওয়া হল, ‘রুবি গিরহোত্রা’, যাতে পরবর্তীকালে রাঠোর এই সুইসাইডে না জড়িয়ে পড়েন।
সুভাষ গিরহোত্রা এরপর আর পারেননি। কয়েক মাস পর মৃতপ্রায় আশু মুক্তি পেলে তাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, সিমলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে, পাহাড়ের কোলে।
তাঁর চাকরিও ততদিনে নানা অভিযোগে চলে গিয়েছিল। ছবির মতো পাঁচকুল্লার সেই সাধের বাংলোও জোরজবরদস্তিতে জলের দরে বেচে দিতে হয়েছিল।
হরিয়ানার মসনদে মুখ্যমন্ত্রী তখন ভজন লাল।
এর কয়েক মাস পর, রাঠোর অ্যাডিশনাল ডিজিপি পদে উন্নীত হলেন।
সেটা ১৯৯৪ সালের নভেম্বর মাস। এতবড়ো অভিযোগ, এত হাজার হাজার অপরাধ, রাঠোরের বিরুদ্ধে সামান্য কোনো শো কজও ফাইল করা হল না।
পূর্বতন ডিজিপি রাম রক্ষপাল সিং—এর সেই রিপোর্ট যেন হাওয়ায় উবে গেছে এর মধ্যে।
ভগ্ন বিধ্বস্ত সুভাষের হয়ে এবার হাল ধরলেন বন্ধু আনন্দ প্রকাশ। অনেক কষ্টে, অনেক সংগ্রাম করে অবশেষে তিনি মামলা করলেন পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা, দুটো রাজ্যেরই হাইকোর্টে।
সেটা ১৯৯৭ সাল।
১৯৯৮ সালের ২১ আগস্ট, হাইকোর্ট সি বি আই—এর হাতে দিলেন তদন্তের ভার। বিচারপতি বললেন, ”যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত করে চার্জশিট পেশ করুন আপনারা। ছ—মাসের মধ্যে হলে ভালো।”
যদিও সি বি আই—এর চার্জশিট পেশ করতে করতে এক বছরেরও বেশি সময় গড়িয়ে গেল।
ওদিকে ততদিনে হরিয়ানার সরকার বদলেছে। ক্ষমতায় এসেছে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোক দল, সংক্ষেপে আই এন এল ডি। মুখ্যমন্ত্রী ওম প্রকাশ চউতলা।
যখন সমান্তরালভাবে সি বি আই—এর তদন্ত চলছে রাঠোরের বিরুদ্ধে, তখনই অন্যদিকে আশ্চর্যজনকভাবে ওম প্রকাশ চউতালা রাঠোরকে রাজ্যের পুলিশ প্রধান করলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৯৯—এর নভেম্বর মাসে বিশেষ অবদানের কারণে রাষ্ট্রপতি মেডেলের জন্য রাঠোরের নাম রেকমেন্ড করে পাঠানো হল হরিয়ানা থেকে।
এই নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে একপ্রস্থ হইচই হল। একটা লোকের বিরুদ্ধে এতগুলো অভিযোগ, কী কার তাঁর নাম প্রেসিডেন্ট মেডেলে পাঠানো হয়?
তখন স্বরাষ্ট্রসচিব বীরবল দাস ধালিয়া। তিনি উড়িয়ে দিলেন সংবাদ মাধ্যমের বক্তব্য, ”কোথায় অভিযোগ? কোনো চার্জশিট আছে রাঠোরের বিরুদ্ধে?”
তখন কেন্দ্রে এন ডি এ সরকার। বিজেপি—র ভাইস প্রেসিডেন্ট শান্তা কুমার চিঠি লিখলেন মুখ্যমন্ত্রী চউতালাকে, ”এক্ষুনি রাঠোরের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া উচিত! পদোন্নতি তো নয়ই, সাসপেন্ড করুন ওঁকে।”
কে শোনে কার কথা!
কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে চউতালা গিয়ে নালিশ করলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর কাছে, ”দেখেছেন আপনার দলের লোক কিনা আমাকে হুকুম করছে? আমার রাজ্যে আমি কাকে শাস্তি দেব, কাকে প্রাইজ দেব, সেটা তো আমি বুঝব নাকি! এরকম করলে কিন্তু আমরা জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসব!”
তখন চউতালার আই এন এল ডি দলের সঙ্গে কেন্দ্রে জোট বেঁধে সরকার গড়েছিল বিজেপি।
কাজেই, বাকিটা বলাই বাহুল্য!
যাইহোক, ২০০০ সালের ১৬ নভেম্বর সি বি আই অবশেষে রাঠোরের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করল আদালতে।
চার্জশিট পেশ করা সত্বেও হরিয়ানা সরকার বহাল তবিয়তে রাঠোরকে রাজ্যের সর্বময় পুলিশ কর্তা পদে রেখে কাজ চালিয়ে যেতে লাগল।
আম্বালা শহরের সি বি আই স্পেশাল কোর্টে ১৭ নভেম্বর থেকে শুনানি শুরু হল। ততদিনে সুভাষ ছেলে আশুকে নিয়ে পাহাড়বাসী। চার—শো—এর ওপর শুনানিতে হাজির হতে লাগলেন আনন্দ প্রকাশ এবং মধু প্রকাশ।
পরে এই মর্মে আনন্দের স্ত্রী মধু বলেছিলেন, ”আমি আর আমার স্বামী একসঙ্গে গাড়িতে কোর্টে যেতে ভয় পেতাম। যদি রাঠোর দু—জনকেই মেরে ফেলে। তাই আলাদা আলাদাভাবে যেতাম। তবু হাল ছাড়িনি। রুচি তো আমার মেয়েই ছিল!”
আশ্চর্য বন্ধুত্ব! শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসার মতো উদারতা!
এদিকে সি বি আই—এর চার্জশিট শুধুমাত্র ৩৫৪ নম্বর ধারা—’যৌননিগ্রহ’কে হাইলাইট করেই দায়ের করা হয়েছিল। রাঠোরের ক্রমাগত লাঞ্ছনাতেই যে রুচিকা সতেরো বছর বয়সেই শেষ করে দিয়েছি নিজের জীবনটা, তা নিয়ে কোনো উল্লেখও ছিল না।
আনন্দ প্রকাশ ছাড়লেন না। ২০০১ সালের ৮ অক্টোবর ৩০৬ নম্বর ধারায় আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করলেন।
২৩ অক্টোবর সি বি আই আদালতের বিচারপতি জগদেব সিং ধঞ্জল বললেন, ”হ্যাঁ। ৩০৬ নম্বর ধারাও দাখিল করা হচ্ছে। সুভাষ গিরহোত্রা, আরাধনা, আনন্দ—সহ এমন প্রচুর মানুষের সাক্ষ্য আছে, যাঁরা বলছেন রাঠোরের দিনের পর দিন হ্যারাসমেন্টেই রুচিকা আত্মহত্যা করে।”
আবার শুরু নাটক।
এই বিবৃতির পরেই বিচারপতি জগদেব সিং ধঞ্জলকে তড়িঘড়ি বাধ্য করা হল স্বেচ্ছাবসরে।
তাঁর বদলে চেয়ারে আনা হল বিচারপতি কাঠুরিয়াকে। এর পেছনেও রয়েছে রাঠোরের কূট রাজনীতি। কাঠুরিয়া সেক্টর ছয়েই গিরহোত্রার প্রতিবেশী ছিলেন, এবং জমিজায়গা নিয়ে তাঁদের মধ্যে একবার বিবাদ হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এই কাঠুরিয়া রাঠোরের পুরনো বন্ধু। শুধু তাই নয়, সেই কুখ্যাত টেনিস অ্যাকাডেমির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন কাঠুরিয়া।
ফলে যা হওয়ার তাই হল। কাঠুরিয়া এসেই আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ ডিসমিস করে দিলেন, ”ধুর! কোনো লিখিত অভিযোগই তো নেই থানায়!”
এরপর শুরু হল তারিখ পে তারিখ! সামান্য ষোলোটা সাক্ষীর প্রসিকিউশন রেকর্ড কোর্টে সি বি আই পাক্কা সাত বছর সময় নিল। তারপর ডিফেন্স কাউন্সেল সময় নিল আরও সাত মাস।
এই সাত বছরে প্রত্যাশিতভাবেই রাঠোর থেমে থাকেননি। প্রভাবিত করতে চেষ্টা করেছেন বহু সি বি আই অফিসার এবং কর্তাদের। কিছুক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে সেই সৎ অফিসারটির বদলিতেও উঠে পড়ে লেগেছেন।
অবশেষে ২০০২ সালের মার্চ মাসে গোটা কর্মজীবন সুসম্পন্ন করে অবসর নিলেন তিনি। লাগল না একটা কালিরও দাগ।
একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ভুলে গেছি। প্রথম দিন থেকে শেষ পর্যন্ত রাঠোরের হয়ে প্রধান আইনজীবী কিন্তু ছিলেন আর কেউ নন, স্বয়ং তাঁর স্ত্রী আভা রাঠোর।
তিনি দিনের পর দিন স্বামীর হয়ে গলা ফাটাতেন আদালতে, বেমালুম মিথ্যা বলে যেতেন।
অবশেষে ২০০৯ সালের ২১ ডিসেম্বর সি বি আই আদালত রাঠোরকে দোষী সাব্যস্ত করল।
রাঠোরের এক হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করা হল ও ছ—মাসের জেল।
হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। এক হাজার টাকা জরিমানা আর ছ—মাস জেল মাত্র।
আনন্দ প্রকাশ ছাড়ার পাত্র নন। তিনি বললেন, ”মানে! মাত্র ছ—মাস জেল? এতকিছুর পরে? এ আবার কেমন শাস্তি!”
আবার চলল কিছুদিন টালবাহানা। এরই মাঝে একদিন, ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, রাঠোর কোর্ট থেকে বেরোচ্ছেন, এক যুবক হঠাৎ আদালত চত্বরে হামলা করল তাঁর ওপর। পুলিশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুরি দিয়ে রাঠোরের মুখ রক্তাক্ত করে দিল সে।
ছেলেটার নাম উৎসব শর্মা। বাড়ি বেনারসে। দিনের পর দিন খবরের কাগজে রাঠোরের বদমায়েশি পড়তে পড়তে সে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি, সোজা চলে এসেছে হরিয়ানা শাস্তি দেবে বলে।
পুলিশ দ্রুত উৎসবকে অ্যারেস্ট করল, রাঠোরকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। রাঠোর ছাড়া পেলেন কয়েক দিন পর।
ওদিকে আনন্দ প্রকাশের দাবিতে শেষে ২০১০ সালের ২৫ মে কারাদণ্ডের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হল আঠেরো মাস।
রাঠোর বসে রইলেন না, আপিল করলেন সুপ্রিম কোর্টে।
সুপ্রিম কোর্ট শাস্তি বহাল রাখল, কিন্তু মেয়াদ কমিয়ে আবার ছয় মাসই করে দিল। কারণ হিসেবে বলল, ”রাঠোরের বয়স হয়েছে। এই বৃদ্ধবয়সে ওঁর ছয় মাস কারাদণ্ডই যথেষ্ট!”
রাঠোরের মেয়ে, রুচিকার একদা সহপাঠিনী প্রিয়াঞ্জলী এখন নিজেও উকিল। মার সঙ্গে শেষের দিকে একসঙ্গে লড়েছে বাবার হয়ে।
রাঠোরের জেল খাটা কবেই শেষ, তিনি এখন পেনশন নিয়ে অবসর জীবন উপভোগ করছেন।
সবাই এখন প্রতিষ্ঠিত, শুধু খেলাপাগল রুচিকাই আর নেই! সে হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো।
আরাধনা ফিরে এসেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। সে এখন আম্বালায় একটি ইন্সটিটিউটের কর্ণধার। কিন্তু রুচিকে সে ভোলেনি। বৃদ্ধ বাবা—মার সঙ্গে দিন রাত গিয়ে পড়ে থেকেছে আদালতে, মুখ খুলেছে মিডিয়ার সামনে, সুবিচারের আশায়।
রাঠোর যেদিন শাস্তি পেল, সেদিন প্রিয় বান্ধবীর ছবি নিয়ে সে কেঁদেছে। রাঠোরের ওই সামান্য শাস্তিতে খুশি না হলেও মনকে প্রবোধ দিয়েছে এই ভেবে, যে ওর সরল খেলাপাগল বন্ধুটার আত্মা এতদিনে একটু হলেও হয়তো শান্তি পেল!
সত্যিকারের যোদ্ধা আনন্দ প্রকাশ মারা গিয়েছেন ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে।
রুচিকার ভাই আশু পরে বড়ো হয়ে বলেছে, ”আমাকে দিনের পর দিন না খাইয়ে পশুর মতো মারত ওরা। টানা দু—মাস অসহনীয় অত্যাচার চলেছে আমার ওপর। দিদি সুইসাইড করার পর আমাকে ছেড়ে।”
সুভাষ গিরহোত্রা কিচ্ছু বলেননি, শুধু বিড়বিড় করছিলেন, ”আমার ফুলের মতো মেয়েটাকে … যেভাবে তিলেতিলে … আর কারুর মেয়ের যেন এমন পরিণতি না হয়! কার কাছে যাব আমরা? পুলিশকর্তা যেখানে অপরাধী, মুখ্যমন্ত্রী যেখানে তাকে সাপোর্ট করছে? এটা কি সিস্টেম? যেখানে গোটা সমাজ আপনার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে, কী করে একা লড়বেন আপনি!”
এই একই প্রশ্ন আপনাকেও।
যেখানে ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’, সেখানে কীসের ন্যায়, কীসেরই বা অন্যায়!