এক কম্বলের নীচে
মাঝে মাঝে মাঝ রাত্তিরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হঠাৎ ঝগড়া শুরু হবে, এ তো অতি স্বাভাবিক ব্যাপার।
বিয়ের প্রথম দু-বছর বাদ, সে তো একটানা পিকনিক। তারপর যদি একটি-দুটি সন্তান জন্মায়, তখন স্ত্রী তাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে কয়েক বছর। বাচ্চারা এই পৃথিবীতে জবর দখল করতে আসে, তাদের দাবিও থাকে অনেকরকম। ইংরেজিতে দাম্পত্য জীবনের সেভেন ইয়ার ইচ বলে একটি কথা আছে। তা নিয়ে একটা চমৎকার ফিলম হয়েছিল রূপসি-মোহিনী মেরিলিন মনরো-কে নিয়ে। বাংলায় বলা যায় এক দশকের গাঁট, সেটা পেরুলে স্বামী-স্ত্রীর জীবনটা হয়ে যায় নদীর মতন, কখনও প্রবল বর্ষায় খরস্রোতা, কখনও শীতকালের শীর্ণ, নিরুত্তাপ চেহারা।
কখনও ঝগড়া হয় না, সব সময় স্বামী আর স্ত্রীর হাসি মুখ, পরস্পরের মন জোগানো কথা, সে জীবন খুবই কৃত্রিম। আর সন্দেহজনক।
ঝগড়া তো হবেই। তবে ঝগড়া অনেক রকম। বেশির ভাগ ঝগড়াতেই আগুন থাকে না। আলেয়ার মতন হঠাৎ হঠাৎ দপ করে জ্বলে ওঠে, আবার সকাল হতে না হতেই মিলিয়ে যায়। আগুন-জ্বলা ঝগড়াই অনেক সংসার পুড়ে যায়। এ গল্প তাদের নিয়ে নয়।
অরূপ আর বিশাখার মাঝে মাঝে আলেয়া-ঝগড়া হয়। সবসময় নিজেদের বাড়িতেই। অন্য কোথাও বেড়াতে গেলে তারা সামলে সুমলে থাকে, বিশেষত কোথাও বন্ধু-বান্ধবের কাছে অতিথি হয়ে থাকলে বড়ো জোর একটু আধটু কথা কাটাকাটি পর্যন্ত চলতে পারে, তা ছাড়া একেবারে আদর্শ দম্পতির ছবি।
তবু একবার একটু বেশি ঝগড়াই হয়ে গেল।
আগে তার একটু পটভূমিকা দেওয়া দরকার।
অরূপের বন্ধু অগ্নিভ থাকে শিলচরে, ঠিক শহরে নয়, অদূরের চা-বাগানে। অনেকবার সে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, ঠিক সুযোগ হয়ে ওঠেনি, এবারে অরূপের অফিসের কাজে মণিপুর যেতেই হল। সুতরাং অতিরিক্ত কয়েকটা দিন বন্ধুর সঙ্গে কাটিয়ে আসা যেতেই পারে। বিশাখা কলেজে পড়ায়, তারও এখন ছুটি, ওদের ছেলে পড়ে নরেন্দ্রপুরে, সেই হস্টেলে থাকবে।
অগ্নিভ চা-বাগানের ম্যানেজার, তার অতি চমৎকার বাংলো, দু-তিনখানা গাড়ি ব্যবহার করতে পারে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা দারুন, অগ্নিভর স্ত্রীর স্বভাবটাই হাসি-খুশি, খুব ভালো গানও গায়। সুতরাং চারজনে মিলে বেড়ানো, আড্ডা, খাদ্য-পানীয়ের সদব্যবহারেই ছুটির কয়েকটা দিন কেটে যাওয়ার কথা। এর মধ্যে ঝগড়াঝাটির তো প্রশ্ন ওঠার কথাই নয়। তবু এক রাত্রে দরজা বন্ধ ঘরের মধ্যে দপ করে জ্বলে উঠল আলেয়া। এ আলেয়াতে বেশ আঁচও আছে।
ঝগড়ার উপলক্ষ্য একটা কম্বল।
দ্বিতীয় দিনে অগ্নিভ কাছাকাছি চা-বাগানের কয়েকজন বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেছিল সন্ধেবেলা। আরও তিনটি দম্পতি। সবাই উচ্চশিক্ষিত, উচ্চচাকুরে এবং উচ্চ বংশের মানুষ। কাবাব ও মাছভাজা সহযোগে প্রিমিয়াম স্কচ, চিতাবাঘ শিকারের গল্প (আসলে লিপার্ড), গান ও হাসি-ঠাট্টায় কেটে গেল কয়েক ঘন্টা, তারপর ডিনার। এসব জায়গায় এরকমই হয়ে থাকে।
অগ্নিভ আর রীতার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সওকত আর রোশেনারা। চেহারার দিক থেকে অন্তত এমন মানানসই স্বামী-স্ত্রী খুব কমই দেখা যায়। সওকত যেমন সুপুরুষ, রোশেনারা তেমনই রূপসি। যেন সিনেমার নারী-পুরুষ। বস্তুত চলচ্চিত্রে নায়ক নায়িকা না হয়ে ওরা দুজন কেন চা-বাগানের নিস্তরঙ্গ জীবনে দিন কাটাচ্ছে, তা বোঝা শক্ত।
রোশেনারা বসেছিল অরূপের পাশে। কেউ পাশে বসলে তার সঙ্গে একটু বেশি কথা বলা হয়েই যায়। আবার খানিকটা অস্বস্তিও বোধ করছিল অরূপ, এখন তিলোত্তমার মতন এক নারী তার সঙ্গে বেশি গল্প করছে, এতে অন্য পুরুষদের হিংসে হচ্ছে না তো? বিশাখা কি কিছু মনে করছে? অরূপ তো ইচ্ছে করে রোশেনারার পাশে বসেনি। একটি সুন্দরী মেয়ে পাশে বসলে উঠে যাওয়াটাও তো চরম অভদ্রতা।
সওকত ঘুরে ঘুরে গল্প করছে সকলের সঙ্গে, বিশাখার সঙ্গেও কী নিয়ে যেন আলোচনা করল খানিকক্ষণ। অরূপ এক জায়গাতেই বসে থাকে, সেটাই তার স্বভাব। রোশেনারা একবার উঠে গেল কী যেন কাজের কথা বলল রীতার সঙ্গে, আবার ফিরে এল অরূপের পাশে। অনেক চেয়ার ও সোফা খালি রয়েছে, রোশেনারা তো অন্য কারুর পাশে বসলেও পারত, তবু সে কেন আগের জায়গাতেই ফিরে এল, তা অরূপ কী করে জানবে? মেয়েটির কিন্তু তার রূপের জন্য একটুও গর্বের ভাব নেই, ন্যাকামিও নেই, যৌন ইঙ্গিতও ছড়ায় না, সোজাসুজি চোখের দিকে তাকিয়ে সহজভাবে কথা বলে।
রোশেনারা গানও জানে না। একটি নজরুল গীতি গাইতে গাইতে সে কথা ভুলে গিয়েছিল মাঝপথে।
অরূপের অনেক গান মুখস্থ থাকে, বিশাখা যখন গায়, অনেক সময় অরূপ কথা জুগিয়ে দেয়, সেই অভ্যেসে সে রোশেনারাকে ‘কাবেরী নদীর জলে কে গো’ গানটির দ্বিতীয় স্তবকের বাণী ধরিয়ে দিল, তখন অন্যরা বলল, আপনিও গান না ওর সঙ্গে, রোশেনারাও মিনতি করল দুজনে শেষ করল গানটা। ডুয়েট।
অরূপ রোশেনারার সঙ্গে সুর মিলিয়েছে, গলা মিলিয়েছে। কিন্তু সে একবারও রোশেনারার হাত স্পর্শ করেনি।
কিছুটা মদ্যপানের পর অন্য মেয়েদের একটু গা ছুঁয়ে কথা বলার ঝোঁক থাকে পুরুষদের, অরূপ কিন্তু নিজেকে সামলে রেখেছে। মাঝে মাঝেই তার চোখাচোখি হচ্ছিল বিশাখার সঙ্গে, বিশাখা অবশ্য কোনোরকম রাগের ভাব দেখায়নি। অরূপের মনে হল, তার বউও এখানে বেশ সুন্দর আছে।
ডিনারের পর বিদায় নেবার পালাতেও কিছু সময় কেটে যায়। গাড়িতে ওঠার আগেও থেকে যায় গল্পের রেশ। সবাই দাঁড়িয়েছে বাইরের চাতালে। এখানে উজ্জ্বল আলো থাকলেও একটু দূরেই মিশমিশে অন্ধকার। বেশ শীত পড়েছে। দূরে ডাকছে একটা রাত পাখি।
অতিথিরা চলে যাবার পরেই বিশাখা বলল, আমার খুব ঘুম পেয়ে গেছে, আমি শুতে যাচ্ছি।
অরূপ আর অগ্নিভ একটুখানি কনিয়াক নিয়ে আরও বসল খানিকক্ষণ। অরূপেরই চোখ ঢুলে এল আগে।
ওদের শুতে দেওয়া হয়েছে ডানদিকের একটি কোণের ঘরে। সে ঘরটি খুবই প্রশস্ত, সংলগ্ন বাথরুমটিই বৈঠকখানার মতন বড়ো। জানলা খুললেই দেখা যায় বাগান, দূরে পাহাড়ের পটভূমিকা। পাহাড়ের চূড়ায় একটা মন্দিরের আলো জ্বলে।
ঘরের মধ্যে একটা আবছা নীল আলো জ্বলছে। কম্বলে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে বিশাখা, সম্ভবত ঘুমন্ত। পা টিপে টিপে এসে, শব্দ না করে পোশাক বদলে ফেলল অরূপ, বাথরুম ঘুরে এসে শুয়ে পড়ল। কলকাতায় ঘুমের আগে কিছু না কিছু বই পড়া অভ্যেস, এখানে বিছানার পাশে আলো নেই। রাতও হয়েছে অনেক।
রাত পাখিটার ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল অরূপ।
কতক্ষণ পর কে জানে। কীসের যেন শব্দে ঘুম ভেঙে গেল অরূপের। কেউ কি কাঁদছে? কোনো নারীর আর্ত বিলাপ? নাকি এটা স্বপ্ন?
চোখ মেলে দেখল, বিছানার অন্য পাশে হাঁটুতে থুতনি দিয়ে বসে আছে বিশাখা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আপন মনে কী যেন বলছে!
ব্যস্ত হয়ে অরূপ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, মণি? পেট ব্যথা করছে?
বিশাখা কোনো উত্তর দিল না।
অরূপ গড়িয়ে কাছে এসে বিশাখার একটা হাত ধরে আন্তরিক উদবেগের সঙ্গে বলল, কী হয়েছে, কিছু কষ্ট হচ্ছে?
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তীব্র গলায় বিশাখা বলল, যাই হোক না, তাতে তোমার কী আসে যায়? আমি মরে গেলে তো তুমি খুশি হবে!
অরূপ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। প্রত্যেকের ঝগড়ার সূত্রপাত ঠিক এইভাবেই হয়। বিশাখা নিশ্চিত জানে, এই কথাগুলো অরূপের বুকে বিষের তিরের মতন বিঁধবে। মানুষ যে দোষ করে না, সেই দোষের অভিযোগ দিলে সবচেয়ে বেশি আহত হয়। বিশাখার মৃত্যু হলে কেন খুশি হবে অরূপ, সে কি অতটাই খারাপ লোক? বিশাখার বিরুদ্ধে তার তো তেমন কোনো অভিযোগ নেই। বিশাখাকে এখনও সে ভালোবাসে, হয়তো নতুন প্রেমিকার মতন নয়।
অরূপ আহত হলেও সংযত গলায় বলল, মরে যাবে কেন? কী অসুবিধে হচ্ছে, সেটা বলো।
বিশাখা বলল, তোমার জানার দরকার নেই। তুমি মদ খেয়ে মাতাল হবে, তারপর ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোবে, তাই ঘুমোও।
এটাও আর একটা বিষের তির। অরূপ নিয়মিত মদ্যপান করে বটে, কিন্তু বিশাখা ছাড়া তাকে আর কেউ মাতাল বলে না। সবাই বলে, অরূপকে কখনও বেচাল হতে দেখা যায় না। তাতে অরূপ গর্ব অনুভব করে। মাতাল শব্দটি সে অপছন্দ করে। এক একদিন হয়তো মাত্রা একটু বেশি হয়ে যায়। শরীর কিছুটা দোলে, কথা বলে উচ্চকণ্ঠে কিন্তু সে কারুর সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করে না, নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তি হারায় না, গালমন্দও করে না। মেজাজ ফুরফুরে হয়। তারপর তো সকলেই ঘুমোয়। কে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়, কে নিঃশব্দে, তা কে জানে? অরূপের নাক-ডাকা সম্পর্কে বিশাখা কখনও তেমন অভিযোগ জানায়নি। আজকাল বিশাখাও পিচ পিচ করে নাক ডাকে, ঘুম না এলে অরূপ তা শুনতে পায়। কিন্তু একবারও সে কথা বলেনি বিশাখাকে।
অরূপ বলল, আমি মোটেই মাতাল হইনি? তুমিও তো আজ দিব্যি জিন খাচ্ছিলে দেখলাম। দুবার না তিনবার নিলে?
বিশাখা কণ্ঠস্বরে অনেকখানি ঝাল মিশিয়ে বলল, তুমি দেখছিলে? আমার দিকে দেখার তোমার সময় ছিল? তুমি তো একজন সুন্দরীকে নিয়েই মত্ত হয়ে ছিলে।
অরূপের মনে মনে এই আশঙ্কাই ছিল। রোশেনারা। সে কেন অরূপের পাশে বসেছিল সারাক্ষণ, তার জন্য তো অরূপ দায়ী নয়! সে তো মহিলাকে ডাকেনি, টানাটানিও করেনি।
এবার কি একটু ঝাঁজ এসে গেল অরূপের গলাতেও? সে বলল, মত্ত হয়েছিলাম মানে? একজন পাশে বসলে, কথা বলব না?
বিশাখা বলল, শুধু কথা? চোখ সরাতেই পারছিলে না? তারপর হিন্দি সিনেমার নায়কের মতন মাঝপথে গান জুড়লে!
এরপর কথার পিঠে গরম গরম কথা। চাপা গলায় ঝগড়া।
এক সময় অরূপ আবার বিশাখার হাত ধরে বলল, এত রাত্তিরে এইসব কথা বলে কোনো লাভ আছে? শুধু শুধু ঘুম নষ্ট। শুয়ে পড়ো। কাল সকালে কথা হবে।
বিশাখা বলল, তুমি ঘুমোচ্ছিলে, ঘুমোও না। কে বারণ করেছে , আমি একটুও ঘুমোতে পারিনি এতক্ষণ। তুমি নেশার ঝোঁকে কম্বলটা টেনে নিচ্ছিলে বারবার। ওঃ, আমার ইচ্ছে করছে, এক্ষুনি কোথাও চলে যেতে, এরকম বিছানায় কেউ শুতে পারে। শীতে কাঁপছি! কাল সকাল হলেই আমি কলকাতায় ফিরে যাব। তুমি থাকো এখানে, সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে ফস্টিনস্টি করো, আমি এখন দেখতে খারাপ হয়ে গেছি—
অরূপ বলল, মণি প্লিজ। তুমি মোটেই দেখতে খারাপ হওনি। আমি তোমাকে আগের মতনই ভালোবাসি!
বিশাখা বলল, বাজে কথা বোলো না। পুরুষরা সবাই স্বার্থপর। টেনে নিয়ে নিজে ঘুমোচ্ছো, কার স্বপ্ন দেখছ, এদিকে আমি…
আসল সমস্যাটা কী তা হলে কম্বল নিয়ে?
এ কম্বলটা খুবই অভিনব। খাটটাই মস্ত বড়ো, অন্তত তিন-চারজন শুতে পারে। চারখানা মাথার বালিশ, দুখানা পাশ বালিশ, কিন্তু কম্বল একটি মাত্র। এত বড়ো কম্বল দেখাই যায় না। এবং মখমলের কভার, ভেতরে যে উল আছে তা বোঝাই যায় না, ভারি নরম আর আরামের। এ কম্বলের নীচে অন্তত চারজন শুতে পারে।
চা-বাগানের বাংলোয় নিশ্চয়ই আরও অনেক কম্বল আছে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর জন্য যে এই একটি মাত্র কম্বল দেওয়া হয়েছে, তা নিশ্চয়ই এই কম্বলটার বৈশিষ্ট্যের জন্যই।
মধ্য রাত্তির, বিবাদ এক সময় থেমে যাবেই। স্বামী আর স্ত্রী দুদিকে ফিরে শোবে, একসময় ঘুমিয়েও পড়বে।
কিন্তু অরূপের আর ঘুম আসে না।
মাতাল হওয়ার অভিযোগ তাকে কষ্ট দিয়েছে। একটি সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে মেতে উঠে নিজের স্ত্রীকে অবহেলা করার অভিযোগ সে মানতে পারেনি। অবশ্য এরকম অভিযোগ সে আগেও কয়েকবার শুনেছে প্রকারান্তরে।
সবচেয়ে বেশি আঘাত সে পেয়েছে স্বার্থপরতার কথা শুনে। সে স্বার্থপর? স্ত্রীকে শীতের কষ্ট দিয়ে সে একা কম্বল উপভোগ করেছে? অরূপের মতন পুরুষরা নিজের স্ত্রীর কাছেও শিভালরাস থাকতে চায়। নিজে কম্বল গায়ে না দিয়েও ছড়িয়ে দিতে চায় বিশাখাকে।
এক একজন পুরুষের শোয়াটা বেশ অদ্ভুত ধরনের হয়। ঘুমের মধ্যে তার সারা বিছানা ঘুরে বেড়ায়। পাশের লোকের গায়ে পা তুলে দেয়। বিয়ের আগে অরূপের এই দোষ খুবই ছিল। এখন শুধরে গেছে, বিশাখা কখনও অরূপের শোওয়া নিয়ে দোষ দেয়নি। কিন্তু কম্বল টেনে নেওয়া? কলকাতায় দুজনের জন্য আলাদা কম্বল থাকে। বিয়ের পরে প্রথম দিকে দুজনের আলাদা কম্বল, ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। ইদানীং দুজনে যখন শুতে যায়, মাঝে মাঝে শরীর নিয়ে মত্ততার পর, ঘুমোয় আলাদা আলাদা কম্বলে। শরীর-সুখের পর ঘুমের সুখ আরও বেশি। আলাদা কম্বলে ঘুমের সুখ অবধারিত।
ইদানীং শরীর নিয়ে মত্ততার রাত্রি ক্রমশ কমছে, বাড়ছে ঘুমের সুখের ব্যাকুলতা। ঘুম বিঘ্নিত হলে বিশাখার খুবই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। হয়তো সব মেয়েরই হয়।
এখন বিশাখার জন্য দুই-তৃতীয়াংশ কম্বল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, ঝগড়ার পর বিজয়িনী হয়ে ঘুমিয়েও পড়েছে বিশাখা, শুধু জেগে থেকে ছটফট করছে অরূপ।
এ জাগরণ অন্যরকম।
আমরা অনেক সময় ভাবি, সারারাত ঘুম আসছে না। আসলে, পুরোপুরি জাগ্রত থাকার বদলে এ এক ধরনের আধো-ঘুম। পাতলা পাতলা স্বপ্নের মধ্যে কেটে যায় সময়।
অরূপও আধা জাগ্রত অবস্থার মধ্যে অনবরত ভেবে যেতে থাকল একটাই কথা। সে স্বার্থপর? সে বিশাখার কাছ থেকে এত বড়ো কম্বলের অনেকটা কেড়ে নিয়ে নিজে ঘুমিয়েছে? বিশাখার অভিযোগ হয়তো পুরোপুরি মিথ্যে নয়, সে কি অন্যদিনের তুলনায় আজ বেশি মদ্যপান করে ফেলেছে। রূপসি রোশেনারা পাশে ছিল বলেই তার শরীর বেশি চনমনে হয়ে গিয়েছিল। এত বড়ো কম্বল, তবু ঘুমের ঘোরে সে বিশাখার গা থেকে টেনে নিয়েছিল অনেকখানি? হতেও তো পারে।
আধো ঘুমের মধ্যে অনুতপ্ত বোধ করল অরূপ। বিশাখাকে তার আরও ভালোবাসতে ইচ্ছে হল। কিন্তু এরকম ঝগড়ার পর হঠাৎ ভালোবাসার কথা ঠিক বিশ্বাসযোগ্যও মনে হয় না। মনে হয় যেন মন-জোগানো কথা।
হঠাৎ একটা যুক্তি মাথায় এসে গেল অরূপের।
হতে পারে সে আজ একটু বেশি মদ্যপান করে ফেলেছে। হতে পারে, নেশাগ্রস্ত ঘুমের ঘোরে সে বিশাখার গা থেকে কম্বল টেনে নিয়েছে। কিন্তু তার তো একটা সহজ সমাধানও ছিল। বিশাখা কেন তার দিকে সরে এল না? বিশাখা যদি তাকে জড়িয়ে ধরত, তাহলে তো দুজনের জন্যই প্রচুর কম্বল থাকত। কেন এল না বিশাখা? সে তো বিশাখার শত্রু নয়! শীত করলে বিশাখা তাকে জড়িয়ে ধরবে না কেন?
এক্ষুনি বিশাখাকে জাগিয়ে এই যুক্তিটা কি শোনানো যায়? কী উত্তর দেবে সে?
কিন্তু বিশাখা এখন দিব্যি ঘুমোচ্ছে। এখন তাকে জাগাবার প্রশ্নই ওঠে না।
অরূপের আধো-ঘুমের স্বপ্নটা ক্রমশ অন্য রূপ নিতে লাগল। সে দেখল, একটা বিশাল কম্বল, শত শত মাইল লম্বা, তার নীচে অনেক মানুষ। এরা কারা? এরা সারা দেশের মানুষ। এক কম্বলের নীচে শুয়ে আছে। কখনও কম্বলটা সরে গেলে সবাই কাছাকাছি এসে জড়াজড়ি করছে। হাসছে, গোর্খাল্যান্ড, কামতাপুরি, সুন্দরবনের মানুষ। কম্বলটা এক দিক থেকে অন্য দিকে বেশি করে গেলে সবাই হাসাহাসি করে ঠিক করে নিচ্ছে।
শেষ রাতের স্বপ্ন হঠাৎ তো থেমে যায় না, চলতেই থাকে। যারা এরকম স্বপ্ন দেখে, তারা জানে অন্যমনস্ক হয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলেও স্বপ্নটা চলতেই থাকে। অরূপ দেখতে লাগল, সারা আকাশ জুড়ে উড়ছে একটা কম্বল। রং বদলাচ্ছে, তবু প্রধানত নীল রঙের।
তারপর অরূপ দেখল, সারা পৃথিবী জুড়ে রয়েছে একটা নীল রঙের কম্বল, আকাশের বদলে, সেই কম্বলের নীচে পৃথিবীর সব মানুষ। আকাশের সেই কম্বল নিয়ে টানাটানি চলছে, আবার ঠিকঠাক করে নিয়ে খল খল করে হাসছে সব মানুষ, কালো, সাদা, খয়েরি রঙের মানুষ, ঝগড়া হচ্ছে, আবার মিটেও যাচ্ছে। মানুষ কাছাকাছি এলেই ঝগড়া মিটে যায়, দূরত্বই যত গণ্ডগোলের মূল।
আধো-ঘুমন্ত অরূপের ঠোঁটে উঠেছে হাসি, সে পৃথিবীর কী দারুণ একটা সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে আজ। আকাশটাকে সমগ্র মনুষ্যজাতির একটা কম্বল বলে ধরে নিলেই তো হয়। আর কক্ষনো ঝগড়া হবে না।
সকালে যখন অরূপের ঘুম ভাঙল, তখনও বিশাখা ঘুমন্ত, নিজের অজ্ঞাতেই সে জড়িয়ে আছে অরূপকে। শরীরে শরীর, বুকে বুক। অতবড়ো কম্বলটা পড়ে আছে খাটের নীচে।