এক্স এজেন্ট – ৪৫

৪৫

করিডোরে এই দরজার কাছে থেমেই টের পেয়েছে রানা, বাজে তামাক পোড়া ওই বদগন্ধ ছড়াচ্ছে ডাক্তার অ্যাঞ্জেল নেবেসা। লাউঞ্জে মহিলা যাওয়ার পর ওই একই কুবাস ছিল তার পোশাকে।

রানা জেনে গেছে, এ ঘরেই রাখা হয়েছে ইউনাকে। তবে এখন হয়তো কেউ নেই। আবার থাকতে পারে বারোজন সশস্ত্র লোক। এ-ও হতে পারে, বহু আগেই জিম্মিকে নিয়ে ফ্যাসিলিটি ছেড়ে চলে গেছে ডাক্তার নেবেসা।

ইউনা আর ওই মহিলা আছে কি না, তা জানতে হলে খুলতে হবে সামনের এই দরজা।

বড় করে শ্বাস নিয়ে খুব সাবধানে দরজার কবাট সামান্য ফাঁক করল রানা। ওদিকে হলদেটে আলো। ভেতরে কেউ আছে। আগের চেয়ে বেড়ে গেছে তামাক পোড়া কটুগন্ধ। দরজা আরেকটু খুলতেই সাদা ল্যাব কোট পরা ঝাঁটার কাঠি ডাক্তার নেবেসার ওপর চোখ পড়ল ওর। দরজার দিকে পিঠ রেখে জানালা দিয়ে দূরে চেয়ে আছে সে। ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার আঁধার। মহিলার একহাত কোমরে। অপর হাতের সরু আঙুলের ফাঁকে জ্বলছে সিগারেট। সরু রেখায় কাঁপতে কাঁপতে ছাতের দিকে উঠতে গিয়েও জানালার ভাঙা কাঁচ দিয়ে আসা বাতাসে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে ধোঁয়া। ডাক্তার নামের কলঙ্কটার ল্যাব কোট থেকে সামান্য বেরিয়ে আছে নীরব এক ওয়াকি-টকি। কী এক গভীর চিন্তায় যেন হারিয়ে গেছে মহিলা। টের পায়নি খোলা হয়েছে দরজা।

ডাক্তার অ্যাঞ্জেল নেবেসা ঘরে একা নয়। জানালা থেকে কয়েক ফুট দূরে একটা চেয়ারে বসে আছে ইউনা, হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। উদাস ভঙ্গিতে জঘন্য গন্ধের সিগারেটের পেছনে ঠোঁট লাগল মহিলা। ইউনাকে ভীষণ ক্লান্ত ও হতাশ লাগল রানার। সরু দড়ি দিয়ে চেয়ারের সঙ্গে টানটান করে বাঁধা হয়েছে বেচারিকে

নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল রানা।

ঘুরেও চাইল না ডাক্তার নেবেসা। মৃদু আওয়াজে খড়-খড় করল তার রেডিয়ো। শব্দটা পাত্তা দিল না মহিলা।

তার দিকে এক পা এগোল রানা। লাল দুই ফোলা চোখে বিস্ময় নিয়ে ওকে দেখছে ইউনা। ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখল রানা। আওয়াজ কোরো না, বাছা!

আরেক পা এগোল রানা।

তখনই ঘরে কারও উপস্থিতি টের পেল ডাক্তার নেবেসা। ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল সে। বিরাট এক হাঁ করল চিলচিৎকার দেয়ার জন্যে। কিন্তু একলাফে তার সামনে পৌঁছে গেল রানা। পরক্ষণে ওর পিস্তলের নল সাঁই করে নামল মহিলার মাথার ওপর। ঠকাস্ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সাদা অংশ দেখিয়ে উল্টে গেল নেবেসার দুই চোখ। ধুপ্ করে মেঝেতে পড়ল মহিলা, অজ্ঞান। কড়াৎ করে কোমরের হাড় ফুটল।

দেরি না করে ইউনার হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে লাগল রানা। অবাক চোখে ওকে দেখছে মেয়েটা। বারকয়েক চোখ পিটপিট করে নিয়ে তাকাল মেঝেতে শয্যাশায়ী নেবেসার দিকে। ফ্রেঞ্চ ভাষায় নিচু গলায় জানতে চাইল, ‘মেরেই ফেলেছেন?’

‘শয়তানরা অত সহজে মরে না,’ ইউনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা সরু দড়ি খুলল রানা। ‘ধরে নাও, ঘুমের ভেতর স্বর্গ থেকে ইন্সট্রাকশন আনতে গেছে।’

‘নরক থেকে,’ মুখ বাঁকাল ইউনা। ‘বেটি মরলেই খুশি হতাম! অবশ করে দিয়েছে দুই হাত।’

‘হাত নাড়াচাড়া করো, রক্ত চলাচল চালু হলে ঠিক হয়ে যাবে। কেউ তোমাকে ব্যথা দেয়নি তো, ইউনা?’

মাথা নাড়ল মেয়েটা।

‘এবার মন দিয়ে আমার কথা শোনো,’ বলল রানা, ‘আগে জানতে হবে কোথায় আছে গার্ডরা। একজন আমার সমান লম্বা, অন্যজন বড় হনুমানের সাইয।’

‘একটু আগেও ছিল। খানিক পর পর এক চক্কর ঘুরে যায়। তবে এখন কোথায় আছে বলতে পারি না।’

সার্চ করার জন্যে ডাক্তার নেবেসার পাশে বসল রানা। ইনঅ্যাকটিভ হয়েছে মহিলার ওয়াকি-টকি। ওটা অন করে রেখে দেহটা তল্লাসী করল ও। সাদা ল্যাব কোটের পকেটে পেল মোবাইল ফোন ও ছোট চেইন দেয়া পাউচ। পাউচ খুলতেই দেখল ভেতরে দুটো সিরিঞ্জ আর দুটো ছোট ভায়াল ভরা তরল। লেবেলে লেখা: টেণ্টোবারবিটাল ও পটাসিয়াম ক্লোরাইড। প্রথমটা লাগে মানুষের মুখ খোলাতে। দ্বিতীয়টা ব্যবহার করা হয় দ্রুত হার্ট থামিয়ে দিতে। পাউচ ও মোবাইল ফোন নিজের কাছেই রাখল রানা।

‘ওটার ভেতর কী?’ ভুরু কুঁচকে পাউচ দেখাল ইউনা। ‘তেমন কিছু না,’ বলল রানা। ‘তোমার কাজে আসবে না।’

সত্যিকারের ডাকিনী এই ডাক্তার নেবেসা। ইউনার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলেই মেরে ফেলত।

মহিলার মগজে শোফেল্ডের চিপ আছে কি না কে জানে, ভাবল রানা। হয়তো নিজে থেকেই বেটি হয়েছে ভয়ঙ্কর পিশাচী। চিকন ঝাড়র কাঠির মত শরীরটা টেনে চেয়ারের কাছে নিল রানা। গদিতে তুলে শক্ত করে বাঁধল দড়ি দিয়ে। কাজ শেষে ঘরের চারপাশ দেখে নিল। একদিকে আকারে ছোট একটা দরজা। ওদিকে বোধহয় গুদাম।

‘আমরা এবার কোথায় যাব?’ জানতে চাইল ইউনা।

‘একমিনিট পর বলছি।’

এই জায়গাটা বিশ্রী। ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটে এখানে।’

আমারও ভাল লাগছে না,’ বলল রানা। ‘তবে ভেবো না, আজই ফিরব ফ্রান্সে।’

‘আমার সঙ্গে বাবাকে নেবেন না, রানা?’

‘আগে জানতে হবে তাকে কোথায় নিয়েছে,’ বলল রানা। এজন্যেই কথা বলব ডাক্তারের সঙ্গে। হয়তো জানে অনেক কিছুই। তার সঙ্গে কথা বলার সময় পাশের ছোট ঘরে থাকবে, ঠিক আছে?’

‘কিন্তু আমি ওখানে একা থাকতে চাই না।’

‘ইউনা, বড়দের কথা শুনতে হয়,’ বলল রানা।

‘আমি তো আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’

‘আপাতত, পারবে না…

রানা আর কিছু বলার আগেই বেজে উঠল ডাক্তার নেবেসার মোবাইল ফোন। ‘পাশের ঘরে যাও,’ মেয়েটাকে একটু কড়া সুরেই বলল ও।

‘কিন্তু যেতে হবে কেন?’

‘আমি বলেছি, তা-ই।’ বাচ্চাদের কাণ্ড! এখন কাঁদতে শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

এদিকে জ্ঞান ফিরছে নেবেসার। তার গালে হালকা কয়েকটা চড় দিল রানা। পিটপিট করে ওকে দেখেই মহিলার চোখে ফুটল ভয়। কাছ থেকে দেখতে সে আরও রুক্ষ। কপালে, চোখের কোণে, গালে গভীর ভাঁজ। রাজমিস্ত্রি যেমন দেয়ালের গর্ত সিমেণ্ট দিয়ে বুজে দেয়, প্রচুর স্নো-পাউডার দিয়ে ভাঁজ-খাঁজ সব ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করেছে মহিলা।

‘এখন শুধু আপনি আর আমি রয়ে গেলাম, ডাক্তার,’ কণ্ঠস্বরে মধু ঢেলে বলল রানা। ‘ঝপট্ বলে ফেলুন দেখি, নিকোলভ কোথায় আছে।’

‘জানি না,’ মাথা নাড়ল মহিলা। ‘তাকে কখনও দেখিনি।’ বছরের পর বছর অতি কমদামি সিগারেট ফুঁকে বিশ্রী কর্কশ হয়েছে তার কণ্ঠস্বর। সেই সঙ্গে অসহ্য দুর্গন্ধ! মুখ খুলতেই ‘ভক্’ করে এসে নক্-আউট পাঞ্চ মেরেছে রানার নাকে।

মনে মনে নিজের কান মলল রানা। খবরদার! আর কোনওদিন যদি তামাকের ধারে কাছে গেছিস…!

‘আমারও মনে হচ্ছিল ঠিক এ-কথাই বলবেন আপনি,’ নরম সুরে মহিলাকে বলল ও। ‘না জানলে আর বলবেন কী করে! তাই না? এবার ভাবুন দেখি কেমন লাগবে আপনার ওষুধ আপনারই শরীরে যদি পুশ করি?’ পাউচ তুলে দেখাল। ওটা থেকে নিল হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ আর পটাসিয়াম ক্লোরাইড। নিডল থেকে সরাল ক্যাপ। ভায়ালের রুপালি ফয়েলে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে টেনে নিল সাদাটে তরল। ওর কাজ দেখতে দেখতে পিং-পং বলের মত বড় হয়ে উঠল ডাক্তারের দুই চোখ।

‘আপনি তো জানেন না কোথায় নিয়েছে আমার বন্ধুকে, তাই না?’ মিষ্টি সুরে জানতে চাইল রানা।

হাঁ করে ঝড়ের বেগে মাথা নাড়তে লাগল বদমাশ ডাক্তার।

তার গা ঘেঁষে এল রানা। ‘নিডল শরীরে ঢুকলে কেমন লাগবে বলুন তো, ডাক্তার? আমি ভাল মানুষ। বাধ্য না হলে খারাপ কিছু করি না। কিন্তু ভাল মানুষও হঠাৎ করে রেগে যায়, যা খুশি করে বসে। তাই না? আমার এখন ওই হাল!’

‘সত্যিই, কসম, আমি জানি না!’

‘বাজে মেয়েলোকটার পেছনে খামোকা সময় নষ্ট করছেন,’ রানার পেছন থেকে এল চিকন কণ্ঠস্বর।

ঘুরে বসল রানা। ‘ইউনা, তোমাকে না বলেছি গুদামে অপেক্ষা করতে?’

‘ভেতরে খারাপ গন্ধ।’

‘কিছুক্ষণের জন্যে ওখানেই থাকো।’

‘কিন্তু সত্যিই যদি কিছু না জানে এ?’ বলল ইউনা। আঙুল তুলে দেখাল বুড়ি ডাক্তারনীকে। ‘ওই ডাইনীর কাছে ভয়ঙ্কর সব বিষ। চলুন, আমরা চলে যাই।’

বাচ্চা সামলে রাখা তোর কাজ নয়, মনে মনে নিজেকে বলল রানা। বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুমি ভাবছ শিখিয়ে দেবে আমাকে কখন কী করতে হবে?’

‘না, তা ভাবছি না,’ কাঁধ ঝাঁকাল ইউনা। ‘তবে আমি যা বলতে চাইছি, তা তো শুনছেন না আপনি…’

‘কী বলতে চাও?’ কঠোর হলো রানার কণ্ঠ।

‘আমি জানি বাবা কোথায় আছে।’

‘অ্যা? কী বললে?’ চমকে গেল রানা।

‘গার্ডদের কথা শুনেছি। ওরা রাশান ভাষায় কথা বলে। জানে না যে আমি ওই ভাষা শিখে নিয়েছি।’

রানার মনে পড়ল, ইউনার নানার দুর্গে মেয়েটার ঘরে রাশান সাহিত্যের প্রচুর বই দেখেছে। মেয়েটার মা বলেছিল, গোপনে রাশান ভাষা শিখছে বাবার জন্মদিনে তাকে চমকে দেয়ার জন্যে। উইলিয়াম শোফেল্ড আর তার দলের লোক জানে মেয়েটা ডাচ ভাষায় কথা বলে। কখনও ফ্রেঞ্চ বা ইংরেজি। তবে ভাবতেও পারেনি কান পেতে ওদের সব কথা শুনছে এবং বুঝতেও পারছে ইউনা।

‘খুলে বলো ঠিক কী বলেছে গার্ডরা,’ তাড়া দিল রানা।

‘পুরনো হাসপাতালে নিয়ে গেছে বাবাকে।’

‘পুরনো হাসপাতাল?’

‘হ্যাঁ। এটাই বলেছে।’ এবার ঝড়ের বেগে বলল ইউনা, ‘নিশ্চয়ই শহরের কোথাও আছে ওই হাসপাতাল। গার্ডরা আলাপ করছিল, ওখানে নিয়ে বাবাকে মারধর করবে। ওখানেই আছে ভ্যানকিন কাপরিস্কি নামের ভয়ঙ্কর এক লোক। তার কথা আগেও শুনেছি বেযুখফ আঙ্কেলের খামারে। বাবা আর উনি আলাপ করছিলেন। ভ্যানকিন কাপরিস্কির হয়ে আগে কাজ করত বাবা। পরে চাকরি ছেড়ে দেয়। আর সেজন্যেই এখন বাবার ক্ষতি করতে চাইছে লোকটা।’ মনে চাপ পড়েছে বলে গাল কুঁচকে গেল ইউনার। ‘আমার বাবাকে মারছে ওরা! বাবাকে বাঁচাতে হবে! রানা, আপনি পারবেন না বারাকে বাঁচাতে?’

রানা কিছু বলার আগেই ঘর ভরে গেল ক্ষ্যাপা বলদের বিকট এক কর্কশ, দীর্ঘ নিনাদে। কানের কাছে এমন ভয়ানক আওয়াজ শুনে আত্মা কেঁপে গেল রানার। বুঝে ফেলল, এই আওয়াজ পৌঁছে গেছে মস্তবড় দালানের প্রতিটা কোণে। ডাক্তারের মুখে প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিল রানা। আবার চেয়ারে এলিয়ে পড়ল অ্যাঞ্জেল নেবেসা। আবারও হারিয়েছে জ্ঞান। কুকুরের মত মুখের পাশে ঝুলছে লম্বা, সাদাটে প্ল্যাক-পড়া জিভ।

‘এবার কি সত্যিই মরেছে, ‘রানা?’ বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল ইউনা। বড় বড় চোখে দেখছে মহিলাকে।

কীসে যে বাচ্চারা কৌতূহলী হবে, তার হিসাব রাখবে কে!

‘আজকে বহু কিছু দেখেছ, আর না দেখলেও চলবে,’ বলল রানা। উঠে দু’হাত রাখল ইউনার দু’কাঁধে। নরম সুরে বলল, ‘পুরনো হাসপাতালের কথা বলো। জানতে হবে ওটা কোথায়। গার্ডদের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করো। তা হলে তোমার বাবাকে ওখান থেকে সরিয়ে নেয়া সহজ হবে।’

অশ্রুতে ভরল ইউনার দুই চোখ। আস্তে করে মাথা নাড়ল। ‘আর কিছু মনে নেই। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই ওটা চিনে নিতে পারবেন? আপনিই তো খুঁজে নিয়েছেন আমাকে।’

ইউনার কথা শুনে আশার দীপ জ্বেলেছিল রানা। আস্তে আস্তে নিভে গেল ওই আলো। ‘ইউনা, তোমার বাবা তো মস্কোর যে-কোনও জায়গায় থাকতে পারে।’

‘কিন্তু আপনি চাইলে খুঁজে নিতে পারবেন! নইলে তো বাবাকে মেরে ফেলবে শয়তানগুলো! রানা, আপনি…’ গলা বুজে আসছে ইউনার। হঠাৎ করেই ওর মুখে হাত চাপা দিল রানা। আবছাভাবে শুনতে পেয়েছে কিছু। বোধহয় কারও কথা বা ছুটন্ত পদশব্দ। দ্রুত আসছে এদিকে। এমন সময় জেগে উঠল ডাক্তার নৈবেসার রেডিয়ো। সম্ভবত গার্ড। ডাক্তার মহিলা চিৎকার করে সতর্ক করে দিয়েছে ওদের। যে- কোনও সময়ে হাজির হবে তারা।

ওয়াকি-টকি অফ করল রানা। নরম সুরে ইউনাকে বলল, ‘দরজার দিকে পিঠ রাখো। চোখ বুজে রাখবে। দুই হাতে চেপে ধরো দুই কান। দেরি কোরো না!’

রানার কণ্ঠে জরুরি সুর বুঝে ভয় পেয়েছে ইউনা। নীরবে মেনে নিল নির্দেশ। দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়াল।

পরক্ষণে একই সঙ্গে ঘটল দুটো ঘটনা।

প্রথমে দরজা খুলে ঝড়ের বেগে ঢুকল কালো পোশাক পরা দুই খুনে গার্ড। আর তখনই রানার পকেটে বাজল ডাক্তার নেবেসার কাছ থেকে নেয়া মোবাইল ফোন।

৪৬

ডাক্তার অ্যাঞ্জেল নেবেসা আর ইউনার সঙ্গে লাউঞ্জে গিয়েছিল যে দুই গার্ড, হাজির হয়েছে তারাই। বড়জন দৈর্ঘ্যে রানার সমান, অন্যজন নীচ চেহারার হনুমানের মত।

দড়াম করে দরজা খুলেই ব্রেক কষে থেমে গেছে তারা। চোখ পড়েছে চেয়ারে বাঁধা ডাক্তারের ওপর। আগে ওই চেয়ারে ছিল বাচ্চা মেয়েটা। ঝট্ করে রানার দিকে ঘুরল তারা, চোখে বিস্ময়। ভাবতেও পারেনি মুক্ত হয়ে ফ্যাসিলিটির যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাসুদ রানা। তাদের শোল্ডার হোলস্টারে রয়ে গেছে পিস্তল। ফলে সামান্য বাড়তি সুবিধা পাবে রানা। ওর দুই গ্র্যাচ পিস্তল ঝুলছে বেল্টে। ক্রস ড্র করতে পারবে ঝড়ের বেগে।

এক সেকেণ্ডের তিন ভাগের এক ভাগ সময়ে বিস্ময় কাটিয়ে উঠল দুই গার্ড। কুঁজো হয়ে জ্যাকেটের ভেতর হাত গুঁজল পিস্তলের জন্যে। দেরি করে ফেলেছে তারা। হোলস্টার পর্যন্ত হাত পৌছুবার আগেই বেল্ট থেকে হ্যাঁচকা টানে দুই গ্র্যাচ তুলে নিল রানা। বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছাড়াই দুই মাযল তাক করল দুই গার্ডের কপালে। পরক্ষণে টিপে দিল দুই ট্রিগার। লোকদু’জনের কপালে দেখা দিল একটা করে বড় লাল টিপ। খুলি ভেদ করেছে নাইন এমএম বুলেট। দরজার দু’দিকের দেয়ালে ছিটকে লাগল মগজ ও রক্ত। হাঁটু ভেঙে মেঝেতে পড়ল দুই লাশ। তখনও হোলস্টার থেকে বের হয়নি পিস্তল। কান থেকে হাত সরিয়ে ঘুরে দুই লাশ দেখল ইউনা।

‘ওদিকে দেখতে হয় না,’ নরম সুরে বলল রানা।

মনে হলো না ওর কথাটা মাথায় ঢুকেছে ইউনার।

ডাক্তার নেবেসার মোবাইল ফোন বাজছে প্যান্টের পকেটে, সামান্য দ্বিধা করে ওটা বের করে রিপ্লাই বাটন টিপল রানা। কানের কাছে শুনল নুড়িপাথরের মত কড়কড়ে রাশান কণ্ঠ: ‘কাপরিস্কি বলছি। কথা শুনতে পাচ্ছ, অ্যাঞ্জেল নেবেসা?’

এখনও হাঁ করে দুই গার্ডের লাশ দেখছে ইউনা। শুনতে পেয়েছে নীরব ঘরে লোকটার কথা। ওর চোখের সামনে তুড়ি বাজাল রানা। পরক্ষণে মেয়েটার কানে ধরল মোবাইল ফোন।

ভয়ে ফ্যাকাসে হয়েছে ইউনা। ফিসফিস করল, ‘ভ্যানকিন কাপরিস্কি। কথা বলতে চায় নেবেসার সঙ্গে!’

বিদ্যুদ্বেগে ভাবছে রানা। মনে পড়ল, মিস্টার ব্রেযনেভ বলেছিলেন ইউনা ভাল অভিনয় পারে।

‘ওর সঙ্গে কথা বলো,’ ফিসফিস করল রানা। ‘মনে করো তুমিই ডাক্তার নেবেসা।’

চোখ বিস্ফারিত হলো ইউনার। ‘কী বলব?’

‘সাধারণ কথা!’

একমুহূর্ত পর বড় করে শ্বাস নিয়ে এক হাতে ফোনের মাউথপিস ঢাকল ইউনা, তারপর ঠিক ডাক্তার নেবেসার অতিরিক্ত ধূমপানে ভারী, কর্কশ কণ্ঠে বলল: ‘হ্যাঁ, বলুন। আমি শুনছি।’

বুড়ির নিখুঁত, নকল গলা শুনে মৃদু হেসে ফেলল রানা।

‘হারামজাদিটাকে এখানে দরকার,’ বলল ভ্যানকিন। ‘লোক পাঠাচ্ছি।’

রানার দিকে চেয়ে চোখ নাচাল ইউনা।

ফিসফিস করল রানা, ‘ওকে বলো, যে-কোনও সময়ে শয়তান মেয়েটাকে নিয়ে যেতে পারেন।’

রাশান ভাষায় চাপা স্বরে বলল ইউনা, ‘যে-কোনও সময়ে শয়তান মেয়েটাকে নিয়ে যেতে পারেন।’

বিন্দুমাত্র সন্দেহ করল না ভ্যানকিন কাপরিস্কি। ক্লিক করে কেটে দিল লাইন।

আরও শুকিয়ে গেছে ইউনার চোখ-মুখ। ‘ভীষণ ভয় লাগছে!’

ওই লোক দলের কয়েকজন গুণ্ডাকে পাঠাবে,’ সহজ সুরে বলল রানা। ‘তবে ভয়ের কিছু নেই। তুমি না বড় হয়ে গেছ?’

‘আমাকে কেন ওখানে নিয়ে যেতে চায়?’

‘গেলেই দেখবে,’ বলল রানা। ‘আমিও যাব তোমার সঙ্গে।’ রানার বক্তব্যের গূঢ় অংশ বুঝে গেল মেয়েটা। পকেটে মোবাইল ফোন রাখল রানা। দু’হাতে ধরল ইউনার ছোট্ট দুটো মুঠো। ওগুলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। খুব নরম সুরে বলল রানা, ‘জানি তুমি খুব ভয় পেয়েছ। তবে এসবের ভাল দিকও আছে। ওরা না এলে কী করে জানব কোথায় তোমার বাবা। এবার সরাসরি নেবে আমাদের পুরনো হাসপাতালে। আর এটাও বোঝা যাচ্ছে, ক্ষতি হয়নি তোমার বাবার।’

আস্তে করে মাথা দোলাল ইউনা। চোখ থেকে বিদায় নিল ভয়ের রেশ। ‘সত্যিই বোঝা যাচ্ছে?’

‘এরা খারাপ লোক, ইউনা। খুনি। কিন্তু তোমার বাবার কাছে আছে জরুরি কিছু তথ্য। সেটা চাই ওদের। তাই চাইলেও তার বড় কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। এখন তোমাকে নিয়ে যেতে চাইছে, যাতে তার ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।’

চুপচাপ দাঁড়িয়ে যুক্তি দিয়ে রানার কথা বিচার করছে ইউনা। বুঝে গেল, কত বড় বিপদে পড়তে পারে। কয়েক মুহূর্ত পর নীরবতা ভেঙে জানতে চাইল, ‘আমাকে মেরে ফেলবে ওরা?’

শক্ত হাতে মেয়েটার হাত ধরল রানা, চোখ রাখল চোখে। আস্তে করে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, ইউনা। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না ওরা। বিপদ দেখলে তোমাকে আড়াল দেব। তবে খেয়াল রেখো: আমার কাছ থেকে দূরে সরবে না। মেনে নেবে প্রতিটা কথা। ঠিক আছে? তা হলে আর ভয় নেই।

নাক টানল ইউনা। পিটপিট করে দূর করল চোখের পানি। ‘ঠিক আছে। এখন কী হবে, রানা?’

ইউনার হাত ছেড়ে দিল রানা। পকেট থেকে নিল অ্যাঞ্জেল নেবেসার মোবাইল ফোন। ‘প্রথমে একজনকে ফোন দেব।’

‘তারপর?’

‘তারপর তুমি আর আমি শয়তান লোকগুলোর হাত থেকে উদ্ধার করব বাবাকে।’

‘সেটা কী করে করব?’ জানতে চাইল ইউনা।

‘তোমার নানা আমাকে বলেছেন তুমি নাকি ভাল অভিনয় জান। নিজেই দেখলাম, একটু আগে বোকা বানিয়ে দিলে ভ্যানকিন কাপরিস্কিকে। এক দিন হয়তো সিনেমার বড় নায়িকা হবে।’

‘হয়তো,’ লজ্জা পেয়ে লাল হলো ইউনার দুই গাল।

‘অন্তত আমার চেয়ে অনেক ভাল অভিনয় জানো তুমি। এবার আরেকবার সুযোগ পাবে অভিনয় করার। …আপত্তি নেই তো?’

কাঁধ ঝাঁকাল ইউনা। ‘না, নেই। তারপর?’

‘তারপর সোজা বাড়ি,’ বলল রানা, ‘তারপর থেকে চিরকাল সুখে শান্তিতে জীবন কাটবে তোমার।’

‘বাবারও? বাবাও সুখী হবে?’ জানতে চাইল ইউনা।

আদর করে বাচ্চা মেয়েটার মাথার চুল এলোমেলো করে দিল রানা। খুশি হয়ে হাসল ইউনা। বেচারির জন্যে বুকটা ভালবাসায় কানায় কানায় ভরে গেল রানার। মৃদু মাথা দুলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, ইউনা, বাবাও।’

ইউনার ভূমিকা ওকে বুঝিয়ে দিল রানা। সামনে কঠিন সময়, যে-কোনও মুহূর্তে হয়তো মরবে ওরা, তবুও রানার ভাবতে ভাল লাগল, অ্যান্টোনিন নিকোলভ ও ইউনাকে নিরাপদে ফ্রান্সে পৌঁছে দিয়েছে ও। মনে মনে বলল, অন্তরে আশার দীপ জ্বেলেই তো বাঁচে মানুষ!

৪৭

বিলিয়নেয়ার লুকা ব্রেযনেভের কাছে ফোন দিতেই ওদিক থেকে কল রিসিভ করলেন ভদ্রলোক। ইউনা কাছেই আছে জানলে কথা বলতে চাইবেন, তবে তাঁকে প্রশ্ন তোলার কোনও সুযোগই দিল না রানা। নানা-নাতনির কথা হয়তো মধুর হবে, কিন্তু এই মুহূর্তে ওর নিজের হাতে বাড়তি সময় নেই। পিঠ দিয়ে রেখেছে ইউনার দিকে। নিচু গলায় বলল, ‘রানা বলছি। বিমান পাঠান। বাড়ি ফিরছি।’

‘ইউনা ঠিক আছে তো?’ জানতে চাইলেন ব্রেযনেভ।

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। একটা ব্যাপারে সাহায্য লাগবে।’

‘বলো।’

‘আমাদের পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে। বিমানে করে আরও একজন ফ্রান্সে যাবে। আমাদের তিনজনকে এয়ারপোর্টে ঢোকার সুযোগ করে দিতে হবে। পারবেন না?’

‘অনায়াসে,’ বললেন ব্রেযনেভ। ‘রাশান এভিয়েশন মন্ত্রীকে দিয়ে বলিয়ে দেব। তোমরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলে প্লেনে উঠতে কেউ বাধা দেবে না।’

‘তা হলে পরে কথা হবে,’ বলে কল কেটে দিল রানা। বিপদের সময় ব্রেযনেভ নাতনির কুশল জানতে চাইলে মনোযোগ নষ্ট হবে, তাই অফ করে দিল মোবাইল ফোন।

‘এবার তৈরি হতে হবে,’ ইউনাকে বলল রানা।

মাত্র কিছুক্ষণ পর ওরা শুনল পরিত্যক্ত ফ্যাসিলিটির উঠানে ঢুকছে একটা গাড়ি। জানালা দিয়ে দেখল প্রায়ান্ধকারে এগিয়ে আসছে দুটো হেডলাইট।

ইউনাকে বুড়ো আঙুল দেখাল রানা। ‘তৈরি তো?’

নার্ভাস সুরে বলল মেয়েটা, ‘হ্যাঁ, রেডি।’ বসে পড়েছে আগের সেই চেয়ারে।

আপাতত আর কিছু করার নেই।

মামির মত করে ডাক্তার নেবেসাকে বেঁধে ছোট্ট গুদামে ফেলে এসেছে রানা। মহিলার মুখের ভেতর টেনিস বলের সমান কাপড়ের বল, টু শব্দের উপায় নেই। তার পাশেই রেখেছে দুই গার্ডের লাশ। বেঁটেজনের শার্ট খুলে ওটা দিয়ে ভালভাবে মুছেছে মেঝের রক্ত। চট্ করে চোখে পড়বে না কারও। নিজের ডেনিম শার্ট ও জ্যাকেট খুলে পরেছে লম্বা গার্ডের কালো পোলো-নেক সোয়েটার ও কালো নাইলনের জ্যাকেট। ইউনার জ্যাকেটের নিচে পরিয়ে দিয়েছে মৃত হনুমানের বুলেটপ্রুফ ভেস্ট। গলা পর্যন্ত চেইন টেনে দেয়ায় কেউ বুঝবে না ভেতরে ওই জিনিস আছে। প্রথমে আপত্তি তুলেছিল ইউনা, তবে রানা যখন বলল ওটা ওকে নিরাপদে রাখবে, তখন রাজি হয়েছে।

রানার মনে হচ্ছে, বুকে আশা নিয়ে প্রবল ঝড়ে ভাঙা নৌকা বাইছে ও উত্তাল সাগরে। হয়তো মস্তবড় ভুল করছে মেয়েটাকে বিপদের ভেতর নিয়ে। কিন্তু এ ছাড়া উপায় ও নেই। নিকোলভকে ফেলে যাওয়া অসম্ভব। সেক্ষেত্রে তাকে ভয়ানক কষ্ট দিয়ে খুন করবে কাপরিস্কির লোক। রানা জানে, উচিত ছিল মেয়েটাকে নিয়ে প্রথম সুযোগে রাশা থেকে বেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেক্ষেত্রে বাকি জীবন ওকে দোষ দিত ইউনা। নিজেও রানা ক্ষমা করতে পারত না নিজেকে। ইউনাও ভাবত সুযোগ থাকলেও ওর বাবাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেনি ও।

তার চেয়ে এটাই অনেক ভাল, প্রাণের ঝুঁকি নেবে ওরা।

দূরে দরজা খোলার আওয়াজ শুনল ওরা। এগিয়ে আসছে পদশব্দ। ইউনার কাঁধ চাপড়ে দিল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘মনে আছে তো কী বলেছি? আমার কাছ থেকে সরবে না। ভঙ্গি করবে ভীষণ ভয় পাচ্ছ। ওদেরকে বিশ্বাস করাতে হবে আমিও তাদের দলের লোক।

‘অভিনয় লাগবে না,’ ঢোক গিলল ইউনা, ‘এমনিতেই…’

‘ঠিক আছে তা হলে।’

‘আপনাকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করি, রানা। ভাল-মন্দ যা-ই ঘটুক, মেনে নেব। আর… আর… আপনাকে ধন্যবাদ!’

কথাটা শুনেই শিরশির করে উঠল রানার বুকের ভেতরটা। নতুন করে বুঝল, ভীষণ কঠিন দায়িত্ব চেপে বসেছে ওর কাঁধে। আরও শুকিয়ে গেল গলা। ইউনার দিকে চেয়ে ভরসা দেয়ার জন্যে হাসল। নিচু গলায় বলল, ‘সব ঠিক থাকবে, দেখো।’ ওই একই কথা কপচাল মনে মনে। ভাল করেই জানে, যে-মুহূর্তে আত্মবিশ্বাস হারাবে, শুরু হবে ওর পতন।

কাছে পৌঁছে গেছে পদশব্দ। কয়েক সেকেণ্ড পর খুলল কবাট। শ্বাস আটকে রেখেছে রানা। ধরে নিয়েছে বেযুখফের খামারে হামলাকারীরা ছিল কাপরিস্কির অন্য টিমের। এই নতুন দলের এরা কেউ চেনে না ওকে।

এবার দেখা যাবে হাতে নাতে!

ঘরে অপরিচিত তিনটা মুখ দেখল রানা। যা ভেবেছে, সে ধরনের লোকই-জ্যাকেট পরা লালচে তিন গরিলা। তাদের একজন দলনেতা। ভুরু কুঁচকে ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল সে। নিশ্চয়ই ভেবেছে এখানে থাকবে ডাক্তার অ্যাঞ্জেল নেবেসা। এটাও ভাবতে পারে, মাত্র একজন গার্ড পাহারা দিচ্ছে কেন!

ঘোঁৎ করে উঠল লোকটা, ‘ডাক্তার কই? অন্যরা?’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘আমি কী জানি! নিজের কাজ করছি।’

পরস্পরকে দেখল তিন ষণ্ডা। মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদেরকে। ইউনার সামনে গিয়ে থামল দলনেতা। খপ্ করে ধরল চিকন বাহু। কিন্তু লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে মাথা নাড়ল রানা। হাতে উঠে এসেছে নাইন এমএম গ্র্যাচ পিস্তল। পাথুরে চেহারা ওর। ইউনার ঘাড়ে ঠেকিয়ে দিল মাযল। মনে মনে বলল, ভয় পেয়ো না, ইউনা। সরি, এ ছাড়া উপায় নেই!

কাপরিস্কির লোকগুলোকে নীরবেই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে বিসিআই এজেন্ট: এই মেয়েটা আছে আমার দায়িত্বে!

তাতে খুশি হলো তারা। খামোকা ঝামেলায় পড়বে না বাচ্চা সামলাতে গিয়ে। হাতের ইশারায় দরজা দেখাল দলনেতা। ‘তা হলে চলো।’

সবার আগে ইউনাকে নিয়ে করিডোরে বেরোল রানা। পিস্তল তাক করেছে মেয়েটার মাথার দিকে। পাঁচ মিনিট পেরোবার আগেই দালান থেকে বেরিয়ে কালো এক মিনিভ্যানের কাছে পৌঁছুল সবাই। মৃদু আওয়াজে চলছে গাড়ির ইঞ্জিন। সন্ধ্যার বাতাস শীতল ও ভেজা-ভেজা। ঘন কুয়াশার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে সাদাটে, ম্লান চাঁদ।

গত পাঁচ মিনিটে বারকয়েক হাতঘড়ি দেখেছে রানা। একঘণ্টার জন্যে বাইরে গেছে শোফেল্ড। তার ফেরার সময় হয়ে এসেছে। লোকটা হঠাৎ হাজির হলে সর্বনাশ হবে ওর প্ল্যানের। ভ্যানের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পর মনে মনে হাঁফ ছাড়ল। এখন পর্যন্ত ভালই চলছে সব। তবে যে-কোনও সময়ে ঘুরে যেতে পারে ভাগ্যের চাকা। ভ্যানের ভেতর থাকতে পারে চেনা কেউ

মিনিভ্যানটা গ্যায সোবল। মস্কো শহরে জনপ্রিয়। তৈরি হয় গোর্কি অটোমোবাইল প্ল্যান্টে। এই মিনিভ্যানের ভেতরে রয়েছে তিন সারির সিট। অনেকটা মিনিবাসের মত। একদিকে স্লাইডিং ডোর। ইউনাকে নিয়ে পেছনের সিটে চাপল রানা, হাতে পিস্তল। ভালভাবেই নিজের অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে ইউনা। মাঝে মাঝে ভয়ে ভয়ে দেখছে রানাকে। গাড়িতে উঠল কাপরিস্কির তিন গুণ্ডা। ধুম শব্দে বন্ধ হলো স্লাইডিং ডোর। একটা কথাও বলল না কেউ। গেট পেরিয়ে রাস্তায় পড়ল ড্রাইভার। চালু করল ওয়াইপার। হাজার হাজার শিশিরকণা ছিটকে গেল উইণ্ডশিল্ড থেকে। মুহূর্তের জন্যে ঘোলাটে হলো হেডলাইটের আলো।

বোধহয় সংক্ষিপ্ত যাত্রা।

গাড়ি পৌছে গেল শহরের কিনারায়। বাঁকা পথে চলল মস্কো শহরের বুক চিরে। পেছনে পড়ছে একের পর এক গোলকধাধার মত রাস্তা ও মোড়। কোথায় চলেছে জানার উপায় নেই রানার। আরও কিছুক্ষণ পর পরিত্যক্ত এক পল্লীতে ঢুকল মিনিভ্যান। আশপাশে গাড়িঘোড়া নেই। একটু পর জং ধরা উঁচু এক গেটের সামনে থামল মিনিভ্যান। চেইন সরিয়ে গেট খুলল ভেতরের দুই গার্ড। তাদের কাঁধে ঝুলছে সাবমেশিন গান। আবারও রওনা হলো মিনিভ্যান। পেছনে আটকে দেয়া হলো গেট। মিনিভ্যানের হেডলাইটের আলো পড়ল ঝোপঝাড়ে ভরা উঠানে। বিশাল সব গাছের মাঝ দিয়ে রানা দেখল শত বছর আগের পুরনো এক ম্যানশন।

কয়েক সারি গাছের মাঝ দিয়ে গিয়ে পথ থেমেছে গাড়ি বারান্দায়। একসময় বিশাল ম্যানশন ছিল রাজকীয়। এখন দাঁত বের করা ইঁটের দেয়াল থেকে খসে পড়ছে চুন-সুরকি। রানা আন্দাজ করল, একসময় এই ম্যানশন ছিল ব্যক্তিগত কোনও ক্লিনিক, স্যানাটোরিয়াম বা রেস্ট হোম। মনে হয় বহু বছর ধরেই বাড়িটা অব্যবহৃত। অন্ধকারে হাঁ করে আছে ভাঙা জানালা। তবে চতুর্থতলার বোর্ড মেরে আটকে দেয়া জানালার ফাঁক দিয়ে আসছে হলদে আলো।

কেউ না কেউ ব্যবহার করছে পুরনো ম্যানশন। এখানে যাকে খুশি ধরে এনে নির্যাতন করতে পারে কাপরিস্কি

বাড়ির দরজায় অস্ত্র হাতে আরও দুই লোক। সামনের গেটে দু’জন। তিনজন মিনিভ্যানের ভেতর। এ ছাড়া রয়েছে ড্রাইভার। বাড়ির ভেতরে হয়তো আছে আরও অনেকে। ক্রমেই বাড়ছে শত্রু-সংখ্যা। ভ্যান থেকে নেমে পড়ল তিন ষণ্ডা। সিট ছাড়ল ড্রাইভার। ইগনিশন থেকে চাবি নিয়ে ব্লিপার ব্যবহার করে বন্ধ করল লক। চাবিটা রাখল জিন্সের প্যান্টের পকেটে। তাকে দোষ দিতে পারল না রানা। চারপাশে রয়েছে একদল খুনে বদমাশ।

ইউনার বাহু শক্ত হাতে ধরে দলের পেছনে চলল রানা। দু’একবার ঠেলা দিল মেয়েটার পিঠে। সবাইকে বোঝাচ্ছে, সে-ও তাদের দলের। দরজা ছেড়ে এগিয়ে এল দুই গার্ডের একজন। কড়া সুরে বলল, ‘এতক্ষণ লাগে পিচ্চি এক মেয়েকে ধরে আনতে!’ ইউনার হাত ধরতে গেল সে।

কিন্তু ভয়ানক কঠোর চোখে তাকে দেখল রানা। আস্তে করে মাথা নাড়ল। ‘এই মেয়ে আছে আমার দায়িত্বে আছে।’ পিস্তলের মাযল ঠেকিয়ে দিল ইউনার ঘাড়ে।

‘এই ব্যাটা বেশি সতর্ক,’ রানাকে দেখিয়ে বলল ড্রাইভার।

খলখল করে হাসতে শুরু করেছে কয়েকজন।

চোখে নরকের আগুন নিয়ে তাদেরকে দেখল রানা।

যখন তখন হাতাহাতি বা গোলাগুলি হতে পারে বুঝে নিজেদের সামলে নিল লোকগুলো। চোখ ফেরাল অন্যদিকে।

কাঁধ ঝাঁকাল দরজার কাছের গার্ড। ‘তুমি যা ভাল বোঝো!’

নার্ভাস চোখে রানাকে দেখল ইউনা। পাথুরে চেহারায় ওকে দেখছে রানা। তবে সবার চোখ এড়িয়ে মুহূর্তের জন্যে চোখ টিপল। সাহস দিতে গিয়ে এর বেশি কিছু করা সম্ভব নয় এখন। একটু পর হয়তো শুরু হবে গোলাগুলি, রক্তারক্তি ও খুনের ঘটনা। ইউনাকে এখানে এনে মনোকষ্টে আছে রানা। অবশ্য আপাতত কিছু করারও নেই ওর। পিছিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। ইউনার কাঁধে হাত রেখেছে রানা। পরিত্যক্ত বাড়িতে ঢুকেছে চারজন সশস্ত্র গুণ্ডা, পেছনে ওরা। ভেতরে বিষণ্ন, মরাটে পরিবেশ। নাকে লাগছে ছাতা পড়া, জোরালো বাসি গন্ধ। দূরে দূরে একটা-দুটো ন্যাংটো বাল্‌ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে হলদে আলো। মেঝেতে ও দেয়ালে পুরু ধুলো ও মরা পোকামাকড়। কাঠের পুরনো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে আবারও ইউনার কাঁধে হাত রাখল রানা। ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ তুলছে প্রতিটি ধাপ। সামনে চার ষণ্ডা। রানা বুঝে গেল, একটু আগে দেখা আলোকিত ঘরের দিকে চলেছে ওরা। ওটা চারতলায়। দেড়তলা ওঠার পর কয়েকবার মিটমিট করে উঠল বার্। ওপর থেকে এল কারও ব্যথাতুর চাপা আর্তনাদ।

ওই করুণ কণ্ঠ অ্যান্টোনিন নিকোলভের।

খিঁক-খিঁক করে হাসল কয়েকজন রাশান গুণ্ডা।

রানা টের পেল, আড়ষ্ট হয়েছে ইউনার দেহ। হোঁচট খেল বেচারি। মানসিক কষ্টে গলা থেকে বেরোল মৃদু কাতর ধ্বনি। মেয়েটাকে ঠেলে নিয়ে চলল রানা। ভয় পাচ্ছে, যে-কোনও সময়ে ওকে কিছু বলে বসবে ইউনা। সেক্ষেত্রে কী করবে ভেবে রেখেছে রানা। দেরি না করে খুন করবে সামনের চারজনকে। তারপর ফাঁকা কোনও ঘরে ইউনাকে রেখে একা যাবে নিকোলভকে মুক্ত করার জন্যে। জানা নেই ওপরে তারা ক’জন, বা সশস্ত্র কি না, তবে ও হাল ছাড়বে না। ফলে হয়তো বেঘোরে মরবে নিকোলভ, ইউনা আর ও নিজে।

এক এক করে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠতে গিয়ে ক্রমেই বাড়ছে রানার উত্তেজনা। মনে পড়ল না আগে কাউকে উদ্ধার করতে গিয়ে এ ধরনের কঠিন অবস্থায় পড়েছে!

৪৮

দেয়ালে ছাতা পড়েছে। সরু বারান্দায় বন্ধ এক দরজার তলা দিয়ে আসছে হলদেটে আলো। ওদিকেই চলেছে ওরা সবাই। হঠাৎ করেই দরজা খুলে বেরোল মোটা এক লোক। বয়স হবে পঁয়ষট্টির কাছাকাছি। মাথায় ছোট ছোট চুল। রুক্ষ, কুৎসিত চেহারা। কুঁতকুঁত করছে দুটো চোখ। একদিকের গালে ভেসে উঠেছে নীল রগ। যে কেউ বুঝবে, ভীষণ রেগেছে সে। চট্ করে দেখল হাতঘড়ি। রাশান ভাষায় ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল, ‘শুয়োরের বাচ্চারা, এতক্ষণ লাগে?’ নুড়িপাথর ঘষা খেলে এমন আওয়াজ হয়।

তাকে চিনল রানা। এ-ই ভ্যানকিন কাপরিস্কি। সে-ই আটকে রেখে নির্যাতন করছে অ্যান্টোনিন নিকোলভকে। মর্দা হাতির মতই মারকুটে ভাবভঙ্গি।

তাকে দেখে ভয়ে জমে গেছে ইউনা। সাধারণ পার্সেল এলে যে চোখে ওটাকে দেখে কেউ, সেই দৃষ্টিতে বেচারিকে দেখল কাপরিস্কি। পরক্ষণে আপাদমস্তক দেখল রানাকে। কয়েক মুহূর্ত কুঁতকুঁতে চোখে বুঝতে চাইল, কে এই লোক। মনে পড়ল না কিছু। এদিকে হৃৎপিণ্ডের কয়েকটা স্পন্দন মিস করেছে রানা। যে-কোনও সময়ে কাপরিস্কি বুঝবে, ও নকল লোক। এখুনি কেউ ওকে চিনতে পেরে চেঁচিয়ে উঠবে, কিংবা ভ্যানকিন নিজেই হয়তো চিনে নেবে ওকে!

অবশ্য, কয়েক সেকেণ্ডেই কেটে গেল বিপদ। রানার চেহারা মনে করার চেয়ে জরুরি কাজ পড়ে আছে লোকটার। রানা ও অন্যদেরকে অধৈর্য হাতে ইশারা করল: ভেতরে এসো!

ঘরে ঢুকে রানা বুঝল, প্রবেশ করেছে ছোটখাটো এক নরকে। আগেও এ ধরনের টর্চার চেম্বার দেখেছে। প্রতিবার মনে হয়েছে, কখনও যেন আর এমন জায়গায় পা রাখতে না হয়। পরিবেশ এমনই, আগে না এলেও ওর মনে হলো বহু মানুষকে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা দিয়ে তিলে তিলে খুন করা হয়েছে এখানে। রক্ত ও ঘামের পুরনো গন্ধ চারপাশে। দেয়াল ও মেঝেতে এখানে ওখানে লোহার কড়া। একসময় নিরীহ মানুষগুলোকে আটকে রেখে কষ্ট দিয়ে খুন করা হতো। তার আগে জেনে নেয়া হতো পেটের কথা। রানার মনে পড়ল একটা বইয়ের লাইন: পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো পেশা পতিতা বৃত্তি। দ্বিতীয় সারিতে আছে: চুরি-ডাকাতি থেকে শুরু করে এসপিওনাজ ও নির্যাতনকারীর কাজ।

কাপরিস্কিকে নিয়ে ঘরে আটজন লোক। চেয়ারে বন্দি নিকোলভ। রানার পেছনে দরজায় মিনিভ্যানের চারজন। তাদেরকে না ডিঙিয়ে বেরোতে পারবে না কেউ। শক্তহাতে ইউনার কাঁধ ধরেছে রানা। ঘরের মাঝে চেয়ারে হাত-পা বাঁধা নিকোলভকে দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। ফুঁপিয়ে উঠছে বারবার। বুকের কাছে ঝুলে গেছে বন্দির মাথা। একপাশ থেকে দেখা যাচ্ছে ফ্যাকাসে মুখ। বন্ধ করে রেখেছে দুই চোখ। চোখের নিচে কালির মত ঘন কালো দাগ। ভেজা পোশাক ও মাথা থেকে টপটপ করে পড়ছে পানি।

একপলকে চারপাশ দেখা হয়ে গেল রানার।

চেয়ারের ক্রোকোডাইল ক্লিপ থেকে কেব্‌ল্ গেছে মেঝের এক স্পিন্টার বক্সে। ওটার তার আবার গেছে দেয়ালের সকেটে। পাশে কন্ট্রোল ইউনিট হাতে দাঁড়িয়ে আছে ভ্যানকিনের এক লোক। চেহারাটা ক্ষুধার্ত শেয়ালের মত। রানার মনে হলো প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করছে সে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন। সামনেই কাঠের বড় বাক্সের ডালা খোলা। ভেতরে নানান ধরনের নির্যাতনের যন্ত্রপাতি। বোল্ট ক্রপার, ব্লো-টর্চ, আইস পিক ইত্যাদি। নিকোলভের পেছনে আছে স্যাডিস্টের মত চেহারার মোটা এক লোক, চেহারায় ফুর্তির ঝিলিক। রাবারের গ্লাভ্স্ পরা হাতে ধরে আছে এক বালতি পানি। একটু পর পর বন্দির গা ভিজিয়ে দিচ্ছে সে। রানা ধারণা করল, ওই পানিতে রয়েছে প্রচুর লবণ। চেয়ারের ধাতব অংশ থেকে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ছে ভেজা শার্ট ও প্যান্টে।

ঘরের অন্যরা নীরব দর্শক। ক’জন প্রায় ঘিরে রেখেছে তাদের চিফকে। দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে অলস চোখে শো দেখছে দু’জন। হাতে সিগারেট। হাতের কাছেই রেখেছে অস্ত্র। হয়তো ভাবছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈদ্যুতিক শকে আধমরা নিকোলভ লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের ওপর। দেয়ালের পাশে ঠেস দিয়ে রাখা কয়েকটা ব্যারেল কাটা শটগান ও সাবমেশিন গান। চেয়ারের কাঁধে ঝুলছে দুটো আগ্নেয়াস্ত্র। একমাত্র বালবের চারপাশে ধীর ভঙ্গিতে নেচে চলেছে সিগারেটের ধোঁয়ার দৈত্য। রানা বুঝে গেল, অনেকক্ষণ হলো চলছে নিকোলভের ওপর নির্যাতন। বিরক্ত হয়ে গেছে সবাই।

এ কথা মাথায় রেখেই খোলা হয়েছে টর্চারের যন্ত্রপাতি ভরা ক্রেট। যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজও শুরু করেছে তারা। তবে বেশি বাড়াবাড়ি করার সাহস পাচ্ছে না। খুব শক্ত লোক নয় নিকোলভ। আর ভয় সেখানেই। বেশি নির্যাতন করলে হয়তো মুখ খোলার আগেই টিকেট কাটবে ওপারের।

অবশ্য এখন পাল্টে গেছে পাশার দান।

ইউনাকে হাতে পাওয়ায় অনায়াসেই নিকোলভের ওপর চাপ তৈরি করতে পারবে ভ্যানকিন কাপরিস্কি। নিকোলভ একজন বাবা। তার চোখের সামনে একের পর এক পাষণ্ড ইউনাকে ধর্ষণ করলে সহ্য করতে পারবে না সে। কাজেই এবার বাধ্য হবে মুখ খুলতে। অবশ্য, এসব হওয়ার আগে অন্যকিছু ঘটবে। ইউনার ক্ষতি হওয়ার আগেই কাজে নামবে রানা। ওর কানে স্পষ্ট ভেসে এল বাচ্চা মেয়েটার বলা কথাগুলো: ‘আমাকে মেরে ফেলবে না?’

‘না, ইউনা,’ বলেছিল রানা। ‘কথা দিতে পারি, তোমার কোনও ক্ষতি হবে না। বিপদ দেখলে তোমাকে সরিয়ে নেব। আমার কাছ থেকে দূরে সরবে না। মেনে নেবে প্রতিটা কথা। তা হলে আর ভয় নেই।’

আরও মনে পড়ল নিকোলভের বলা কথা: ‘বন্ধু, এমন শপথ কোরো না, যেটা রাখতে পারবে না।’

অতীতের কথাগুলো চাবুকের মত লাগল রানার গায়ে। চেষ্টা করবে ঠিকই, কিন্তু সত্যিই কি কথা রাখতে পারবে ও? মন থেকে মুহূর্তে হারিয়ে গেল সমস্ত দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা। মগজের ভেতর নিঃশব্দে যেন চালু হয়ে গেছে অত্যাধুনিক রেসিং স্টপওয়াচ। একেকটা সেকেণ্ড ভাগ হচ্ছে অন্তত দশটা ভাগে। ধীর হয়েছে হৃৎপিণ্ড। যুদ্ধ আসন্ন হলে এমনই হয় ওর। তৈরি হয়ে যায় ওর গোটা অস্তিত্ব।

রানার হাত থেকে ছুটে বাবার কাছে যেতে চাইল ইউনা। কিন্তু কঠোর হাতে ওকে আটকে রাখল রানা। ওর কবজির ওপর টপটপ করে পড়ছে মেয়েটার চোখের জল। বেচারির অসহায় অবস্থা দেখে হো-হো করে হেসে ফেলল কাপরিস্কির ক’জন স্যাঙাৎ। আশা করছে ইউনার ওপর ভীষণ রেগে গিয়ে মারধর করবে রানা। তাতে বাড়বে মজা।

আস্তে করে চোখ মেলল নিকোলভ। ইউনাকে দেখেই মাথাটা নামল আবার বুকের কাছে। এত যন্ত্রণা সহ্য করেও হাল ছাড়েনি। তবে এবার বুক ভেঙে গেছে তার। কয়েক মুহূর্ত পর হঠাৎ করেই ধাতব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ঝটকা দিল সে। বেসুরো কণ্ঠে ডাকল, ‘ইউনা!’ ঝট্ করে তাকাল কাপরিস্কির দিকে। গলা ভেঙে গেল: ‘কাপরিস্কি! প্লিয! না! ওর ক্ষতি কোরো না! ওর তো কোনও দোষ নেই!’

‘উপায় রাখোনি, নিকোলভ,’ শান্ত স্বরে বলল কাপরিস্কি ‘অনেক দেরি করে ফেলেছ।’

রাগ-দুঃখ-ভয়-অপমানে বাচ্চার মত হাউমাউ করে কেঁদে উঠল নিকোলভ। কালি পড়া চোখে তাকাল রানার দিকে। অদ্ভুত চাহনি ফুটল চোখে। কালো পোশাক পরা যুবককে ভাল করেই চেনে সে। ইউনার ঘাড়ে পিস্তল ঠেসে ধরেছে রানা। ভুল দেখছে ধরে নিয়ে চোখ পিটপিট করল নিকোলভ। হাঁ করেও আবার বন্ধ করে ফেলল মুখ।

নিকোলভের অভিব্যক্তির পরিবর্তন দেখল না কাপরিস্কির দলের কেউ। কারণ সবার চোখ ইউনার ওপর। ভোল্টেজ কন্ট্রোল বক্স হাতে শেয়ালের মত চেহারার লোকটার দিকে চেয়ে নির্দেশ দিল কাপরিস্কি: ‘এবার মেয়েটার ওপর কাজ করতে হবে!’

খুশিতে বত্রিশটা দাঁত বেরোল স্টেপুরিনের। বসের নির্দেশ অবশ্য পালনীয়! কন্ট্রোল বক্স রেখে রানার কাছে এসে খপ্ করে ধরতে চাইল ইউনার বাহু।

ক্রেটের পাশে দাঁড়ানো লোকটাকে নির্দেশ দিল কাপরিস্কি: ‘অরলভ! এবার মেয়েটাকে নিয়ে একটা খেলা দেখাও দেখি!’

ক্রেট থেকে কাঁচির মত মালির ব্যবহৃত ঝোপ ছাঁটার যন্ত্র নিল অরলভ। ওটার হ্যাণ্ডেল নরম রাবারের তৈরি। ভাল করে ধরতে হয়, নইলে রক্তে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে যায় ও-দুটো। ক’বার কাঁচির মত ফলা খুলল আর বন্ধ করল সে। সরাসরি চেয়ে আছে ইউনার বুকের দিকে। চকচক করছে চোখ। জিভ দিয়ে একবার চেটে নিল দুই ঠোঁট।

রানার বুকের ভেতর স্টপওয়াচটা এখন জ্বলন্ত ফিউয। হিসহিস করে ছিটকে পড়ছে আগুনের ফুলকি। যে-কোনও সময়ে পৌঁছুবে ডিনামাইটের কাছে। তখনই উড়ে যাবে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। ঘনিয়ে এসেছে বিস্ফোরণের সময়!

ইউনার বাহু ধরে হ্যাঁচকা টানে ওকে নিজের দিকে নিল স্টেপুরিন। বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে চলল ঘরের মাঝে। কাঁদছে বাচ্চা মেয়েটা। সরে যেতে চাইছে হাত-পা ছুঁড়ে। এখন আর অভিনয় করছে না। এতই ভয় পেয়েছে যে ওকে দেখে মন খারাপ হয়ে গেল রানার। ধাতব চেয়ার ছেঁচড়ে এগোতে চাইল বন্দি নিকোলভ। কিন্তু ওটার চার পায়া গাঁথা রয়েছে মেঝেতে। ইউনাকে নিয়ে নিকোলভের কাছে পৌঁছে গেল স্টেপুরিন। কাঁচির মত ফলা বারবার খুলছে ও বন্ধ করছে অরলভ।

ক্র্যাচাক-ক্র্যাচাক-ক্র্যাচাক!

ইউনার খুব কাছে পৌঁছে গেল লোকটা। উত্তেজনায় বেরিয়ে এল দু’পাটি দাঁত। দারুণ মজা লাগবে মেয়েটার স্তনের বৃন্ত কেটে নিতে।

ওটাই ছিল অরলভের শেষ সচেতন চিন্তা। এবার কী করে দেখতে লোকটার দিকে সবার মনোযোগ। কেউ দেখল না বেল্ট থেকে দ্বিতীয় গ্র্যাচ পিস্তলটা নিয়েছে রানা। ওর হিসাব ঠিক হলে দুই পিস্তলের ম্যাগাযিনে রয়েছে চৌত্রিশটা বুলেট। চেম্বারে দুটো। রানা পলকের জন্যে ভাবল: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয় করা যাবে না, কিন্তু শুরু তো করা যাবে!

ডানহাতের পিস্তলের প্রথম গুলিতে উড়ে গেল অরলভের মাথার পেছনের বড় একটা অংশ। বামহাতের পিস্তলের বুলেট চুরমার করল স্টেপুরিনের কপাল।

পরমুহূর্তে চারপাশে নেমে এল সত্যিকারের নরক!

৪৯

সন্ধ্যার আগে প্রাক্তন ব্রিটিশ আর্মি কর্নেল শোফেল্ড রানাকে বলেছে, জরুরি কাজে একঘণ্টার জন্যে ফ্যাসিলিটি ছেড়ে যাচ্ছে। আসলে নামকরা এক রেস্তোরাঁয় চট করে ডিনারটা সেরে নেয়াই তার উদ্দেশ্য। পরিত্যক্ত মিলিটারি বেস থেকে বেরিয়ে তাকে শহরের কিনারায় তভারকয় বুলেভার্ডে ক্যাফে পুশকিনে এনেছে ড্রাইভার। ব্যস্ততা সত্ত্বেও সময়টা ভাল কেটেছে প্রাক্তন কর্নেলের। খাবার হিসেবে নিয়েছে ফেনেল ও লেবু দেয়া গ্রিল করা ট্রাউট ও হালকা সালাদ। পানীয় হিসেবে এক গ্লাস সাদা ওয়াইন সৌভিনন ব্ল্যাঙ্ক।

তাড়াহুড়ো করে পেটে কিছু দিয়েই আবার গাড়িতে চেপেছে সে। দুলছে মন। রাজি হবে তো মাসুদ রানা? নাকি হাসতে হাসতে মরতে চাইবে?

ঘটনা যা-ই হোক, মেনে নেবে শোফেল্ড। তবে রানার মত উপযুক্ত লোক হারালে রীতিমত মন খারাপ হবে তার। ওদিকে একবার এস. এম. ৬১৪৩ ডিভাইস আর মাইক্রোফিল্ম হাতে পেলে বাঁচিয়ে রাখবে না অ্যান্টোনিন নিকোলভ আর তার মেয়েকে। শেষ হয়েছে পৃথিবীতে তাদের প্রয়োজন।

যা করার করবে কাপরিস্কি। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে এমন এক বুদ্ধিমতী বাচ্চা মেয়েকে মরতে হবে বলে একটু খারাপই লাগছে শোফেন্ডের। তবে কী-ই বা করা! আগেও অনেককে সরিয়ে দিতে হয়েছে নিজের পথ থেকে।

মাসুদ রানা প্রস্তাবে রাজি না হলে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হবে অ্যান্টোনিন নিকোলভ, তাতভ বেযুখফ আর ইউনার খুনের দায়। অভাব হবে না প্রমাণের। পুলিশ সাইকোলজিস্ট বলবে, পোস্ট ট্রমার কারণে মাথা নষ্ট হয়ে যায় লোকটার। প্রত্যন্ত এলাকায় খামারে তিনজনকে পেয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছিল। পরে খুন করেছে নির্মমভাবে। সব প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে খামারবাড়ি। এরপর রাশা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে মরেছে মাসুদ রানা। অথচ, সে ফ্লেয়ার অপারেশনে যোগ দিলে হতে পারত দলের বড় একটা সম্পদ। দেখা যাক রাজি হয় কি না।

ফ্যাসিলিটির কাছে পৌঁছে গেল শোফেল্ডের গাড়ি। ফুরফুর করছে তার মন। কোথাও কোনও ছেঁড়া সুতো নেই।

কিন্তু মাত্র কয়েক মিনিট পর প্রাক্তন কর্নেলের মন থেকে হারিয়ে গেল সব ফুর্তি। দালানে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর মনে হলো, কোথায় যেন কী গোলমাল হয়ে গেছে।

কোথায় গেল ওরা- কুত্তার বাচ্চা গার্ডগুলো বা অন্যরা? হৃৎপিণ্ড লাফ দিচ্ছে বলে ধক-ধক করছে শোফেল্ডের বুক। দৌড়ে গিয়ে ঢুকল ডক্টর অ্যাঞ্জেল নেবেসার ঘরে। মহিলা বা ওই মেয়ে ভেতরে নেই! খালি পড়ে আছে চেয়ার!

দ্রুত পায়ে গুদামে ঢুকে সে দেখল মেঝেতে দুই গার্ডের লাশ। মাঝখানে শুইয়ে রাখা হয়েছে হাত-পা-মুখ বাঁধা ডাক্তার নেবেসাকে। ভীষণ ভয় পেল শোফেল্ড। ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পৌঁছে গেল বন্দি রানার সেলের সামনে। দরজা খুলতেই দেখল, ভেতরে মেঝেতে পড়ে আছে অজ্ঞান দুই গার্ড। তাদের একজনের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট। সব দুঃস্বপ্নের মত লাগল তার। গলা থেকে পেট পর্যন্ত শুকিয়ে গেল। চুনের মত হয়েছে মুখ। অ্যাসিডিটির কারণে শুরু হলো পেটে আলসারের ব্যথা। ওপরওয়ালার কাছে কী জবাব দেবে ভাবতে গিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। কোটের পকেট থেকে বোতল নিয়ে মুখে ফেলল নয়টা অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট। চিবাতে চিবাতে বের করল মোবাইল ফোন। বুঝে গেছে, এবার সর্বোচ্চ নেতাকে জানাতে হবে, ব্যর্থ হয়েছে সে। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল, যাতে তাকে খুন করার নির্দেশ না দেন চেয়ারম্যান।

খুব কম মানুষ সরাসরি ফোনে কথা বলতে পারে চেয়ারম্যানের সঙ্গে, তবে যারা পারে তাদেরই একজন উইলিয়াম শোফেল্ড। তাকে বলে দেয়া হয়েছে, প্রয়োজন ছাড়া যেন বিরক্ত করা না হয়। এ বিষয়টা অত্যন্ত জরুরি। কাঁপা হাতে মোবাইল ফোনের বাটন টিপে কল করল শোফেল্ড। ওদিক থেকে রিসিভ হতেই বলল, ‘স্যর, এত রাতে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত। তবে সামান্য পাল্টে নিতে হবে আমাদের প্ল্যান। আসলে… স্যর…’ ভড়ভড় করে সব খুলে বলতে লাগল শোফেল্ড।

তার কথা শেষে থমথমে কণ্ঠে বলল চেয়ারম্যান, ‘বলেছিলে ওদিকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে, কর্নেল শোফেল্ড।’

‘স্যর, যা ভেবেছি, তার চেয়ে অনেক বিপজ্জনক লোক ওই মাসুদ রানা,’ শোফেল্ডের মনে হলো নিজের মৃত্যুদণ্ড জারি করছে সে। মনের চোখে দেখল ইংলিশ কান্ট্রি হোমে বসে আছেন তার বস।

লং-ডিস্ট্যান্ট কল। ঝিরঝির আওয়াজ। ওদিক থেকে এল চেয়ারম্যানের মাপা বক্তব্য: ‘তা হলে যা ভেবেছ, তার চেয়েও যোগ্য ওই বাঙালি এজেন্ট। তোমার কাছ থেকে আরও সতর্কতা আশা করেছিলাম।’

‘এখনও তাকে ঠেকাতে পারব, স্যর,’ মরিয়া হয়ে বলল শোফেল্ড। ‘তবে সেজন্যে, আরও লোক চাই।’ চেয়ারম্যানের কাছে সাহায্য চেয়ে ভীষণ ভয় লাগছে তার। হয়তো এককথায় উনি বলে দেবেন, তুমি অযোগ্য। দায়িত্ব দিচ্ছি অন্য কাউকে। তার মানেই কোথাও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না সে। খুন হবে যে-কোনও সময়ে।

‘আমার ভুল না হলে, কর্নেল, আমাদের সমস্ত স্থানীয় অ্যাসেট ব্যবহার করেছ তুমি। তাতেই তো কাজ হওয়ার কথা।’

‘না, স্যর, রিজার্ভে রয়েছে আরও কয়েকজন, প্রায় কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে জানাল শোফেল্ড। ‘আমি কি তাদেরকে কাজে লাগাতে পারি?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল চেয়ারম্যান। ক’মুহূর্ত পর বলল, ‘ঝামেলায় ফেললে, শোফেল্ড। তোমার ব্যাপারে আমি খুব হতাশ। কমিটির অন্যরাও বিরক্ত হবে।’

ভুড়ভুড় শব্দ করল শোফেল্ডের পেট। অ্যাসিড পোড়াচ্ছে স্টমাক ওয়াল। নিচু গলায় বলল সে, ‘আরেকটা সুযোগ, স্যর… সব সামলে নেব।’

‘তো বাজে কথা না বলে নিজের কাজটা করে দেখাও,’ কড়া সুরে কথাটা বলে কল কেটে দিল চেয়ারম্যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *