এক্স এজেন্ট – ২৫

পঁচিশ

‘তুমি কি ইইজির নাম শুনেছ?’ জানতে চাইল তাতভ বেযুখফ।

‘ওটা ইলেকট্রোএনসেফ্যালোগ্রাম- মগজের ইলেকট্রিকাল অ্যাক্টিভিটি।’

‘জানো অনেক,’ প্রশংসার সুরে বলল বেযুখফ, ‘উনিশ শ’ চব্বিশ সালে ওটা আবিষ্কার করেন জার্মান বিজ্ঞানী হ্যান্স বার্জার। প্রথমবারের মত বুঝতে পারেন মগজে রয়েছে আলফা ও বিটার তরঙ্গ। একবার ওপরে ওঠে, আবার নেমে আসে।’ আরেক ঢোক ভোদকা গিলে বলল বেযুখফ, ‘উনিশ শত ঊনসত্তর সালের দিকে অদ্ভুত এক আবিষ্কার করলেন উদ্যমী বিজ্ঞানী এবারহার্ড ফেট। তিনি আমেরিকার বায়োফিযিসিস্ট ও নিউরোসায়েন্টিস্ট। প্রথমবারের মত বাঁদরের মগজে যুক্ত করলেন মেশিন। ওই ইন্টারফেস টেকনোলজির ফলে নিয়ন্ত্রণ করা গেল বাঁদরের মগজের নিউরন। ওটাকে নির্দেশও দিতে পারলেন তিনি। অর্থাৎ, দূর থেকেও নিয়ন্ত্রণ করা গেল মগজকে। বিষয়টার নাম দেয়া হলো বায়ো-মেডিকেল টেলিমেট্রি। দারুণ এক খেলা পেয়ে এদিকে মনোযোগী হলেন বিজ্ঞানীরা। ডেলগাডো নামে এক বিজ্ঞানী প্রথম আবিষ্কার করলেন মগজ নিয়ন্ত্রণ করার মেশিন।’

চুপচাপ শুনছে রানা।

তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে ওকে দেখে নিয়ে নিকোলভের দিকে তাকাল বেযুখফ। নীরবে যেন বলছে: এ তো দেখি কিছুই জানে না! আবারও রানার দিকে তাকাল সে। ‘পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে হোসে ডেলগাডো ছিলেন ইয়েল-এর নিউরোসায়েন্স রিসার্চার। দেখতে ছিলেন স্টার ট্রেকের মিস্টার স্পকের মত- ঠিক যেন যমজ ভাই। লিখলেন ফিজিকাল কন্ট্রোল অভ দ্য মাইণ্ড: টুয়ার্ডস্ এ সাইকোসিভিলাইযড় সোসাইটি নামে একটি বই। নাম থেকে কিছু বুঝতে পারছ? বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই বাঁদর নিয়ে গবেষণা করছিলেন তিনি। ওয়াএয়ারলেস রেডিয়ো ব্যবহার করে জানোয়ারের মগজ নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর কথা মত চলতে বাধ্য করতেন ওগুলোকে। তাঁর বিখ্যাত গবেষণার কার্যকারিতা প্রমাণ করেন তিনি উনিশ শ’ তেষট্টি সালে। খেপে গিয়ে তেড়ে আসা এক ষাঁড়ের সামনে দাঁড়ান রিমোট কন্ট্রোল হ্যাণ্ডসেট হাতে। ওটা কাছে চলে এলে বাটন টিপে থমকে দাঁড় করিয়ে দেন। খুঁজলে ওই ভিডিয়ো পাবে ইউটিউবে। ওটা বোধহয় দেখো না। যাই হোক, ডেলগাডো ষাঁড় থামিয়ে দেয়ার কিছু দিন পর মানুষের মগজে প্রয়োগ করা হলো ওই টেকনোলজি। প্রথম থেকেই উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মগজ নিয়ন্ত্রণ করা। খুব গভীর আগ্রহ নিয়ে ডেলগাডোর এক্সপেরিমেন্ট দেখেছে সিআইএ। হয়তো ফাণ্ডও দিয়েছে।’

‘তারপর মানুষকে রোবট বানিয়ে দিল ডেলগাডো?’ বিরক্ত হয়ে বলল রানা।

মাথা নাড়ল বেযুখফ! ‘মানুষের মগজ অনেক জটিল। কাউকে দিয়ে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করাতে পারলেন না তিনি। তবে এ থেকে বেরোল অন্য বিষয়। নিয়ন্ত্রণ করা গেল মানুষের উত্তেজিত মগজের রাগ। একদম শান্ত হয়ে গেল খেপা মানুষ। প্রচণ্ড বাজে সাইকোও হলো ইঁদুর ছানার * মত নিরীহ। তিনি এক পরীক্ষার সময় দেখালেন, বাটন টিপে দেয়ায় গিটার বাজাতে বাজাতে হঠাৎই খেপে গেলেন এক মহিলা। পরক্ষণে ভীষণ রেগে গিয়ে আছাড় মেরে ভাঙলেন প্রিয় গিটার।

এসব ছিল গুরুত্বপূর্ণ সাইকিয়াট্রিক গবেষণার বিষয়। উন্মাদ রোগীকেও কড়া ওষুধ না দিয়ে ঠাণ্ডা করে দেয়ার উপায় জানা গেল। কিন্তু ডেলগাডো বুঝলেন, ভবিষ্যতে সমাজের ওপর এর কী প্রভাব পড়বে। তাই মেডিকেল জার্নালে লিখেছেন: নিজের মগজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না মানুষ। কাজেই ওটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ইলেকট্রনিকালি। ভবিষ্যতে সেনাবাহিনী ও সেনাপতিরা চলবে ইলেকট্রনিক স্টিমুলেশনের মাধ্যমে।’

এই বিষয়টি সম্পর্কে কোথাও কিছুই শোনেনি রানা। একটু বিস্মিত।

‘অবাক হচ্ছ, তাই না?’ শুকনো হাসল বেযুখফ। ‘এটা আরও বিস্ময়কর যে এসব বিষয়ে জানে মাত্র হাতে গোনা কিছু মানুষ। অবশ্য অন্যরা জানলেও কিছুই করতে পারত না। দু’হাজার এগারো সালে ডেলগাডো মারা যাওয়ার আগে লিখেছেন: কোনওভাবেই রুখে দেয়া যাবে না টেকনোলজির উন্নতি। যদিও এতদিনে নিশ্চিত হওয়া গেছে: ওটার কারণে ভয়ানক ক্ষতি হবে মানব সমাজের।’

চকচকে জিনিসটা বুড়ো আঙুল ও তর্জনী দিয়ে ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল রানা। ‘তো এটাই সেই মাইণ্ড কন্ট্রোল ডিভাইস?’

চোখে আতঙ্ক নিয়ে ছোট্ট ক্যাপসুলের মত ধাতব ডিভাইসটা দেখছে নিকোলভ ও বেযুখফ।

‘সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেটের স্পেশাল প্রজেক্ট ডিভিশনের জিআরইউ জেনারালোগো স্টাবার প্রথম আমলের সাইকোট্রনিক ওয়েপন প্রোটোটাইপ,’ বলল বেযুখফ। ‘আন্দাজ করি, ওটা তৈরি হয়েছে উনিশ শ’ পঞ্চান্ন সালে। সে আমলে অত্যাধুনিক ছিল। কী এক্সপেরিমেন্ট করেছে বা কাদের ওপর এটা প্রয়োগ করা হয়েছে, সবই ক্লাসিফায়েড। ডিভাইসের নাম এস. এম. ৬১৪৩। রিসার্চ প্রজেক্টের কোডনেম ছিল: অপারেশন মাস্টার্স!’

মৃদু মাথা দোলাল নিকোলভ। ‘হয়তো ভেবেছিল দারুণ নাম দিয়েছে রিসার্চ প্রজেক্টের।’

‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ধসে পড়ার পর সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স থেকে ফাঁস হয় এসব তথ্য,’ বলল বেযুখফ। ‘তবে অপারেশন মাস্টার্স-এর বিষয়ে অফিশিয়াল কোনও ডেটা নেই। উনিশ শ’ সাতান্ন সালে মস্কো শহরের জিআরইউ ল্যাবোরেটরি থেকে চুরি যায় ডিভাইস এস. এম. ৬১৪৩। কেঁপে ওঠে গোটা ক্রেমলিন। একদল অফিশিয়ালকে চরম শাস্তি দেয়া হয় সাইবেরিয়ায় পাঠিয়ে। এরপর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি ডিভাইস এস. এম. ৬১৪৩।’

‘মাইক্রোফিল্মের কথা বলো,’ বন্ধুকে বলল নিকোলভ।

‘ওটা জরুরি প্রমাণ,’ বলল বেযুখফ, ‘মাইক্রোফিল্মে রয়েছে ডিভাইস এস. এম. ৬১৪৩-এর অরিজিনাল ব্লু-প্রিন্ট, প্ল্যান, রিসার্চ নোট, গোপন কেস স্টাডি থেকে শুরু করে সব। ওগুলো তুলে নেয়া হয়েছে ওই কৌটার ভেতরের ফ্ল্যাশ ড্রাইভে।’

সবই শুনছে রানা। বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনওটাই করছে না। ‘তার মানে ল্যাবোরেটরি থেকে ওটা চুরি করে ব্রিটিশ এজেণ্ট জন গ্রাহাম?’

‘কাজটা করে একদল এজেণ্ট মিলে,’ বলল নিকোলভ। ‘তারা ক’জন ছিল, জানা নেই কারও। কীভাবে কী করেছে শুধু তারাই জানত। এরপর পেরিয়ে গেছে বহু বছর, সাধারণ মানুষ নিশ্চিত হতে পারেনি বাস্তবে ওই ডিভাইস আছে কি নেই। ইণ্টারনেটে ওটা নিয়ে আছে অদ্ভুত সব গুজব।’

‘সাদ্দাম হোসেনের মাস-ডেস্ট্রাকশন ওয়েপনের মত বলল বেযুখফ। ‘ওটা ছিল শুধু কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট। বুশের দুঃস্বপ্নের ভেতর।’

‘এই ডিভাইসের ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়,’ আপত্তি তুলল নিকোলভ। ‘ব্রিটিশ এজেন্টরা পেয়েছিল। ল্যাবের ভোজন ছিল তাদের গুপ্তচর। গোপনে ওটা বের করে এনে ঠিক জায়গায় রেখে দেয়া হয় নকল একটা। খুব কঠিন ছিল ডিভাইস এস. এম. ৬১৪৩ ইউএসএসআর থেকে সরিয়ে নেয়া। চারপাশে কেজিবির লোক। সবার ভেতর অবিশ্বাস। গ্রাহাম ভেবেছিল এস. এম. ৬১৪৩ কোথায় রেখেছে সেটা সহযোগী এজেন্টকে জানিয়ে দেবে কোডের মাধ্যমে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।’

‘তবে ডিভাইস এস. এম. ৬১৪৩. এসআইএস-এর হাতে পড়লেও ভাল কিছু হতো না,’ বলল বেযুখফ। ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কিছুই প্রকাশ করত না তারা। টেকনোলজিটা চেয়েছে ক্ষমতা হাতে পাওয়ার জন্যে। এ থেকে প্রমাণ হয়, মাইণ্ড কন্ট্রোলের ব্যাপারে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল’ রাশান বিজ্ঞানীরা। তাদের ধারে কাছে যেতে কয়েক দশক লেগেছে পশ্চিমাদের।’

‘তার মানে, তোমরা বলছ, এখনও এই ধরনের ডিভাইস তৈরি করছে বিজ্ঞানীরা?’ জানতে চাইল রানা।

‘না,’ মাথা নাড়ল বেযুখফ, ‘এটা এখন আদ্যি কালের বদ্যি বুড়ো হয়ে গেছে। এস. এম. ৬১৪৩ ছিল বর্তমান আধুনিক ডিভাইসের দাদার দাদা।’

‘তবে এটার অস্তিত্ব প্রকাশ পেলে পৃথিবী জুড়ে হৈ-চৈ শুরু হবে, আর সেটাই চাইছ তোমরা,’ বলল রানা।

‘ঠিকই ধরেছ,’ বলল বেযুখফ।

‘জীবনের ওপর ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়ে এত দূর এসেছি,’ বলল নিকোলভ। ‘যখন তখন প্রাণের চেয়েও প্রিয় মেয়েটা সহ খুন হব। আসলে আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমার কথাটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ, রানা?’

‘এই যে, নাও,’ নিকোলভের হাতে ধাতুর টুকরোটা দিল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘তবে তোমাদের কাহিনীর ভেতর রয়ে গেছে বড়সড় একটা খুঁত। যা বলেছ, সবই কিন্তু আন্দাজে ভর করে। সত্যিকারের কোনও প্রমাণ নেই। ডিভাইস এস. এম: ৬১৪৩ হয়তো নকল জিনিস। একই কথা খাটে মাইক্রোফিল্মের বিষয়ে। তোমরা এতক্ষণ যা বললে, সেগুলো কেন বিশ্বাস করবে মানুষ?’

‘তা হলে তোমাকে বলছি আরেকটা ঘটনা,’ বলল বেযুখফ।

‘সেটা শুনলেই সব বিশ্বাস করে নেব?’ বলল রানা। ‘বিশ্বাস-অবিশ্বাস তোমার ব্যক্তিগত বিষয়। তবে তোমার কান আছে। মগজটাও বাড়িতে রেখে আসোনি। সব জানলে বুঝে নিতে পারবে সত্য আসলে কোন্‌টা।

‘ঠিক আছে, বলো,’ দীর্ঘশ্বাস গোপন করল রানা।

ছাব্বিশ

এবার এমন এক কাহিনী বলতে লাগল তাতভ বেযুখফ, যে বিষয়ে কিছুই জানে না রানা। বহু বছর আগের কথা। ওই লোকের নাম অ্যালেক্স বার্টোস। চেক নাগরিক। এ ঘটনার সঙ্গে নিকোলভের কী সম্পর্ক, প্রথমে বুঝে পেল না রানা।

ষাট দশকের শেষদিকে কোল্ড ওঅরের জন্যে তখন টালমাটাল গোটা পৃথিবী। পৃথিবী। ইউএসএসআর-এ তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন লিয়োনিড ব্রেযনেভ। তাঁর বিরুদ্ধে খেপে গেছে চেক নাগরিকরা। সবার দাবি, তাদের দেশে বন্ধ হোক সোভিয়েত রিপাবলিকের বাড়াবাড়ি। চলছে গণতান্ত্রিক আন্দোলন। হাতে-পায়ে রাশানদের পরিয়ে দেয়া শেকল ছিঁড়বে যেভাবে হোক। গণতান্ত্রিক শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক দলের প্রখ্যাত নেতা ছিলেন অ্যালেক্স বার্টোস। তিনি সুস্থ থাকলে বদলে যেত ওই দেশের ভবিষ্যৎ। বীর হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকত তাঁর নাম।

কিন্তু নানান ঘাত-প্রতিঘাতে তা আর হয়ে উঠল না। উনিশ শ’ আটষট্টি সালের আগস্ট মাসে প্রাগ শহরে আন্দোলনকারীদের ওপর যুদ্ধের ট্যাঙ্ক চালিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট লিয়োনিড ব্রেযনেভ। লৌহ মুষ্টি ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণে আনলেন বিরোধী দলের সদস্যদেরকে। বাধ্য হয়ে আত্মগোপনে গেলেন জনপ্রিয় নেতা অ্যালেক্স বার্টোস। তবে একসময়ে গোপন আস্তানা থেকে বেরোতেই হলো পেটের আলসারের চিকিৎসার জন্যে। ডাক্তাররা বলে দিলেন, অপারেশন করতে হবে। ওটা ছিল সহজ একটা অস্ত্রোপচার। কিন্তু এরপর থেকেই শুরু হলো নেতা অ্যালেক্স বার্টোসের বিপদ।

সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে ভাবলেন সেরে গেছে আলসার। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর টের পেলেন, কী যেন বদলে গেছে তাঁর ভেতর। ঝাপসা হয়ে গেছে অনেক স্মৃতি। মগজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে যুক্তি। শারীরিকভাবেও বোধ করলেন অসুস্থ। দেখা দিল চোখের সমস্যা। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে রাতের ঘুম। বদলে গেল হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন। তাঁর মনে হলো এসব হচ্ছে মাথার ভেতরে কিছু বদলে যাওয়ায়। যদিও এসবের কোনও কারণ তিনি বুঝলেন না।

ক্রমেই হলেন আরও অসুস্থ। কানে শুনতে লাগলেন রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সির মত আওয়াজ। প্রায় পাগল হয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। তাঁর মনে হলো, হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে সব সমস্যা। অপারেশনের সময় তাঁকে অজ্ঞান করা হয়। ভাবলেন, তখনই তাঁকে দেয়া হয়েছে অদ্ভুত কোনও ড্রাগ। আর ওটার জন্যেই দেখা দিয়েছে এসব সিম্পটম। যে ডাক্তার তাঁর অপারেশন করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে আলাপ করলেন অ্যালেক্স বার্টোস। ডাক্তার অতি তাড়াহুড়ো করে বলে দিলেন, আসলে শারীরিকভাবে তিনি চমৎকার আছেন, কোথাও কোনও সমস্যা নেই।

এ কথা মেনে নিলেন না অ্যালেক্স বার্টোস। গেলেন প্রাগের এক ক্লিনিকে। সেখানে তাঁকে দেখলেন ডক্টর বেনিডিক্ট চালুপনিক। মাথার এক্স-রে করে চমকে গেলেন দু’জনই। বার্টোসের মাথায় রয়েছে ধাতুর অস্বাভাবিক একটা টুকরো। দৈর্ঘ্যে বড়জোর সাত মিলিমিটার। চওড়ায় চার মিলিমিটার। ওটা যে গোপনে মগজের কাছে কপালের হাড়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, তাতে সন্দেহ থাকল না ডক্টর বেনিডিক্ট চালুপনিকের। এ-ও বুঝলেন, ওটা ঢোকানো হয়েছে নাকের ফুটো ব্যবহার করে। কোনও ধরনের অপারেশন হয়নি মাথায়। ফলে বাইরে থেকে কাটাছেঁড়া নেই।

ভীষণ ভয় পেলেন অ্যালেক্স বার্টোস। ডক্টরকে অনুরোধ করলেন জিনিসটা বের করে দেয়ার জন্যে। বিস্মিত বেনিডিক্ট চালুপনিক বললেন তাঁকে সতর্ক থাকতে। এ-ও জানালেন, সর্বোচ্চ মেডিকেল কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট পাঠাবেন তিনি।

তবে কয়েক সপ্তাহ গেলেও যখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন না ডক্টর চালুপনিক, উনিশ শ’ ঊনসত্তর সালের মে মাসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন অ্যালেক্স বার্টোস। এবার অবাক হতে হলো তাঁকে। আবারও এক্স-রে করে ডাক্তার বললেন, এক্স-রে রিপোর্ট একদম স্বাভাবিক। কোথাও কোনও সমস্যা নেই। অথচ, প্রথম এক্স-রে ফোটোতে ছিল ধাতুর টুকরো। বার্টোস তর্ক জুড়লে ডাক্তার মিথ্যাচার করলেন, তাঁর সঙ্গে নাকি এ বিষয়ে আগে কোনও কথাই হয়নি বার্টোসের।

খেপে গিয়ে আইনের সাহায্য নেবেন বলে ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এলেন রাজনৈতিক নেতা। তবে আসলে কিছুই করার ছিল না তাঁর। যুক্তি হারিয়ে যাচ্ছিল মস্তিষ্ক থেকে। হতাশ হয়ে শুরু করলেন অতিরিক্ত মদ্যপান। মাঝে মাঝে দেয়ালে ঠুকতেন মাথা। ভাবতেন ঝাঁকি খেয়ে নাক দিয়ে বেরোবে ধাতুর টুকরো। ঘুমিয়ে পড়লে দেখতেন ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন। সর্বক্ষণ মনে হতো তাঁর উচিত আত্মহত্যা করা। প্রায় পাগল হয়ে গেলেন তিনি।

‘এসব কোথাও লেখা হয়েছে?’ জানতে চাইল রানা।

‘পুরোটা খুলে বললে সবই বুঝবে,’ বলল বেযুখফ।

উনিশ শ’ ঊনসত্তর সালের জুন মাসের আঠারো তারিখে খুনের উদ্দেশে গুলি করা হলো অ্যাডাম সারমাককে। তিনিও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষের বড় নেতা। প্রতিটি বক্তৃতায় থাকত সোভিয়েত শাসনের দুর্নীতির কথা। প্রাগ দখলের সময় রাশান একটি ট্যাঙ্ক আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন তিনি উনিশ শ’ আটষট্টি সালে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন অ্যালেক্স বার্টোস।

কিন্তু উনিশ শ’ ঊনসত্তর সালের জুন মাসে সারমাকের পেটে দু’বার গুলি করে এক খুনি। বেঁচে যান সারমাক। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, পিস্তল হাতে পালিয়ে গেছে খুনি। ওদিকে পরদিন সকালে এক নর্দমার ভেতর পাওয়া গেল অ্যালেক্স বার্টোসকে। পরনে নোংরা, ছেঁড়া পোশাক। পাশেই গুলি ভরা রিভলভার। তিনি বারবার দাবি করলেন, ওই অস্ত্র জীবনেও দেখেননি। তবে চেম্বারে ছিল খরচ করা দুটো গুলির খোসা। জেরার সময় জানালেন, গত রাতে অ্যাডাম সারমাকের বাড়ির ধারেকাছেও যাননি। গত কয়েক মাস তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও নেই। পরে বলেছিলেন, দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেন না কারও ক্ষতি করবেন তিনি। বাদ থাকুক প্রিয় বন্ধু অ্যাডাম সারমাক।

গ্রেফতার করতে পুলিশ আসছে জেনে চেকোস্লোভাকিয়া ছেড়ে জার্মানির ফ্র্যাঙ্কফুর্টে পালিয়ে যান তিনি। বুঝে গিয়েছিলেন যে ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁকে দিয়ে খারাপ কাজ করাচ্ছে তাঁরই মাথা। তাঁর প্রতি সমবেদনা রয়েছে এমন এক সার্জেনকে খুঁজে পান তিনি। ডাক্তার কনরাড ব্যাটডর্ফ ঠিক করেন অপারেশন করবেন বার্টোসের মাথায়।

তেরোই সেপ্টেম্বর রোগীর মাথা থেকে বের করা হয় ওই ডিভাইস। অথচ, তার সাড়ে তিন মাস আগে চেক ডাক্তার বলেছিল বার্টোসের মাথায় অস্বাভাবিক কিছুই নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় এক্স-রে দেখে ডক্টর ব্যাটডর্ফ জানান, কপালের হাড়ে যুক্ত ছিল সাত মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের একটি ধাতুর টুকরো। চওড়ায় ছিল চার মিলিমিটার। আগে কখনও ওই ধরনের জিনিস দেখেননি তিনি। পরীক্ষায় দেখা যায়, ওটা ছিল কোনও ধরনের হাই-ফ্রিকোয়েন্সি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ট্র্যান্স-পণ্ডার বা খুদে রেডিয়ো রিসিভার। কোনও পাওয়ার সেল ছিল না। কাজ করত দূরের রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সির নির্দেশ অনুযায়ী। মগজে তৈরি করত সতেরো থেকে চব্বিশ কিলোহার্টয পাওয়ার।

চেক ডাক্তারের মত করে তথ্য গোপন না করে অদ্ভুত এক ষড়যন্ত্রের কথা প্রচার করলেন জার্মান ডাক্তার। এটাও বললেন, রোগীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেআইনীভাবে ওই ডিভাইস বসিয়ে দেয়া ভয়ানক অপরাধ। ওদিকে তখনও অ্যালেক্স বার্টোসকে খুঁজছে পুলিশ। নিরাপত্তার জন্যে ট্রেনে করে সুইট্যারল্যাণ্ডে যাওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। তার আগে পরিচয় হয়েছে জার্মান এক রিপোর্টারের সঙ্গে। উনি ছিলেন স্টার্ন পত্রিকার প্রতিবেদক। বলেন, প্রমাণ দেখাতে পারলে পত্রিকায় প্রকাশ করবেন, ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বার্টোসের বিরুদ্ধে। ঠিক হলো যুরিখে দেখা হবে দু’জনের।

‘কিন্তু বাস্তবে তা আর হলো না,’ বলল বেযুখফ। ‘সুইট্যারল্যাণ্ডে পৌঁছুবার আগেই সীমান্তে গ্রেফতার হলেন অ্যালেক্স বার্টোস। বিচারের মুখোমুখি করতে তাঁকে ফেরত নেয়া হলো চেকোস্লোভাকিয়ায়।’

ওদিকে প্রাগে যাওয়ার সময় হারিয়ে গেল ওই ডিভাইস। কিছুই প্রমাণ করতে পারলেন না জার্মান সাংবাদিক। অ্যালেক্স বার্টোসের দেশ ত্যাগের কয়েক ঘণ্টা পর ফ্র্যাঙ্কফুর্টে বাড়ির সামনে ছয় চাকার এক ট্রাকের নিচে পড়ে খুন হলেন ডাক্তার কনরাড ব্যাটডর্ফ। ওই যন্ত্রদানব নিয়ে পালিয়ে যায় ড্রাইভার। এরপর তাঁর অফিসে খুঁজে পাওয়া গেল না ডাক্তারি রিপোর্ট, চিঠি ও ডিভাইসের ফোটোগুলো। অপারেশনের সময় যে নার্স সহায়তা করেছিল, তাকে বদলি করে দেয়া হলো অন্য এক হাসপাতালে। তার ক’দিন পর চিরকালের মত গায়েব হয়ে গেল সেই নার্স।

‘জার্মান সাংবাদিক ঠিক করলেন, যে যাই বলুক, ওই কাহিনী তিনি লিখবেন,’ বলল বেযুখফ। ‘কিন্তু পত্রিকার মালিক কোনও ব্যাখ্যা না দিয়েই চাকরি থেকে তাঁকে ছাঁটাই করে দিলেন। এরপর কয়েক মাস গবেষণা করে জার্মান ভদ্রলোক লিখলেন: শেকলে বাঁধা মন: ভবিষ্যতের বিপদ। কিন্তু চলল না বইটা। এরপর উনিশ শ’ একাত্তর সালের আগস্টে একটা সুইমিং পুলে ডুবে মারা গেলেন জার্মান সাংবাদিক।’

দু’ হাজার চোদ্দ সালে নব্বুই বছর বয়সে মারা যান অ্যাডাম সারমাক। মৃত্যুর দিনেও বলেছেন, তাঁর বন্ধু অ্যালেক্স বার্টোস তাঁকে গুলি করতে পারেন না। যদিও ফরেনসিক রিপোর্ট ও সাক্ষীদের কারণে বিশ বছরের জেল হয় বার্টোসের।

‘আসলে তোমার মগজ অন্য কেউ দখল করলে কিছুই করার থাকে না,’ রানাকে বলল বেযুখফ। ‘মগজের কথা শুনবে তোমার দেহ। কী করছ তাও টের পাবে না। অপরাধ করলেও জানবে না কিছুই।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘আরেকটা প্রশ্ন জাগে মনে,’ বলল বেযুখফ। ‘সত্যিই কি উনিশ শ’ সত্তর সালে অ্যাডাম সারমাককে খুন করতে চেয়েছে সোভিয়েত সরকার? সেক্ষেত্রে পরে কেন সে চেষ্টা করল না? আমার ধারণা, তাকে শেষ করতে চাওয়া হয়নি। বাস্তবে মাইণ্ড কন্ট্রোল কাজ করছে কি না, বুঝতে চেয়েছিল সরকার। অ্যাডাম সারমাক ছিল ল্যাবোরেটরির ইঁদুরের মত।

‘প্রিয় বন্ধুকে খুন করানো সম্ভব হলে, বুঝতে হবে যে- কাউকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেয়া যাবে,’ বলল নিকোলভ।

‘অ্যালেক্স বার্টোসের কী হয়েছিল?’ জানতে চাইল রানা। ‘ভদ্রলোক বারবার বলেছেন, তিনি গুলি করেননি। জেলখানার ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছেন মানুষটা। তাই চলে নানান রকম সাইকিয়াট্রিক চিকিৎসা। পাঠিয়ে দেয়া হয় মানসিক এক অ্যাসাইলামে। তাঁর ওপর চলল ড্রাগ ও ইলেকট্রোশকের অসহ্য নির্যাতন। কয়েক সপ্তাহ পর ভুল করল এক মেডিকেল কর্মী। চালিয়ে দিল হাই ভোল্টেজের কারেন্ট। হার্ট অ্যাটাকে মরলেন অ্যালেক্স বার্টোস। তাঁর কাহিনী ওখানেই শেষ।’

‘কিন্তু আমাদের গল্প ওখানেই শেষ নয়, শক্ত হাতে ধাতব ডিভাইস ধরেছে নিকোলভ। ‘এবার সময় হয়েছে সব প্রকাশ করে দেয়ার।’

‘তোমরা চাও সেই জার্মান সাংবাদিকের কাজটা শেষ করতে?’ জানতে চাইল রানা। ‘রেডিয়োর মাধ্যমে দুনিয়ার মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেবে এ কাহিনী? …হয়তো পারবে। ইণ্টারনেটের নিউয আউটলেট এসবের গন্ধ পেলে গোটা ব্যাপারটাকে ভাইরাল করবে।

‘চেষ্টা করতে তো দোষ নেই,’ বলল বেযুখফ।

মাথা দোলাল নিকোলভ।

‘তারপর কী করবে?’ পালা করে ওদেরকে দেখল রানা। তোমাদের কাহিনী চাপা পড়বে হাজার কোটি টন নতুন খবরের নিচে। তদন্ত হবে না কোনও। লক নেস বা ভিনগ্রহী গিরগিটির গল্পের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে না কেউ।’ ত

‘খবরদার! ভিনগ্রহের গিরগিটি নিয়ে ঠাট্টা নয়! রেগে গিয়ে বলল তাতভ বেযুখফ, ‘ওরা কিন্তু সত্যিই আছে।’

‘ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ, ধরে নিলাম ওরা আছে,’ মৃদু হাসল রানা। পরক্ষণে বলল, ‘যদি মনে করে নিই আজ রাতে সত্যি বলেছ, তো এবার কী করবে তোমরা? সেই জার্মান সাংবাদিকের মত প্রকাশ করে দেবে সব? কিন্তু এরপর নিরাপত্তা পাবে কোথা থেকে? আজ হোক, কাল হোক, বা কয়েক মাস পরে নদী বা সাগরে ভেসে উঠবে তোমাদের লাশ। এদিকটা ভেবে দেখেছ?’

‘মনে করেছিলাম আমাদের দিকটা বুঝবে,’ ফ্যাকাসে হলো নিকোলভ। ‘গোপন এসব তথ্য ফাঁস না করে উপায় নেই। মানুষ জেনে যাক কী ঘটছে পৃথিবী জুড়ে। ডিভাইস এস. এম. ৬১৪৩ আসলে আণবিক বোমার চেয়েও বিপজ্জনক।’

‘ওই বোমা ফাটলে খুন হবে তোমরা,’ মন্তব্য করল রানা। ‘আর এ কারণেই খুব জরুরি ইউনাকে ফ্রান্সে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেজন্যেই আমি এখানে এসেছি।’

‘তুমি বোধহয় আমার কথা বুঝতে পারোনি?’ রেগে গেল নিকোলভ। ‘মস্কো পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারবে না তুমি!’

‘সেটা আমি বুঝব,’ শান্ত স্বরে বলল রানা। ‘তোমরা আছ বাজে ঝামেলার ভেতর। এতে নাক গলাতে চাই না। তবে ‘ তোমাদের উচিত হয়নি ইউনাকে এসবে জড়িয়ে নেয়া।’

‘আমিও তা চাইনি,’ বলল নিকোলভ, ‘জেনেবুঝে কেউ নিজের মেয়েকে এত বড় বিপদে ফেলে? আমি কি পশু?’

‘পশু নও, নিরেট বোকা,’ বিরক্ত স্বরে বলল রানা।

‘সব দোষ আমার প্রাক্তন স্ত্রী তামারার। সে-ই তো আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইল ইউনাকে। এরপর হয়তো আমার কোনও অধিকারই থাকবে না ওকে এক নজর দেখার।’

‘তোমার কথা ঠিক হলে, ইউনার পরের জন্মদিন আসার আগেই তুমি পৃথিবীতে থাকছ না,’ হঠাৎ বলে উঠল তানিয়া আজোরভ। আবার তাকাল জানালা দিয়ে দূরে।

রানাকে দেখল নিকোলভ। চোখদুটো স্থির হলো টেবিলের ওপর। ওখানে বন্দুক ও রাইফেল। এক্স এজেন্ট বুঝতে চাইছে রানার আগে ওখানে পৌঁছুতে পারবে কি না।

‘ভুল হবে, বলল রানা। ‘তার চেয়ে ভেবে দেখো, কীভাবে এই বিপদ থেকে ইউনাকে বাঁচাবে।’

‘রাতের আঁধারে তোমার হাতে ওকে তুলে দেব?’ মাথা নাড়ল নিকোলভ। ‘আমি তো তোমাকে চিনিই না।’

‘ফোন করো লুকা ব্রেনেভকে,’ বলল রানা। ‘উনি বলে দেবেন আমি কে।’

‘তুমি পাগল নাকি?’ বলল বেযুখফ। ‘লুকা ব্রেনেভ নিজেই তো বর্তমান পৃথিবীর ভয়ানক ক্ষমতাশালী ইবলিশ। শয়তানির শেষ নেই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আর জার্মানির চ্যান্সেলারের সঙ্গে মিলে করে বেড়াচ্ছে পৈশাচিক সব কুকীর্তি। আমরা এখানে আছি সেটা সে টের পেলে, দু’ঘণ্টার মধ্যে খুন হব।’

বেযুখফকে পাত্তা না দিয়ে নিকোলভের দিকে তাকাল রানা। ‘কথা দিচ্ছি, নিরাপদে থাকবে ইউনা। আমরা মস্কো যাওয়ার আগেই টারমাকে থাকবে জেট বিমান। কয়েক ঘণ্টার ভেতর ফ্রান্সে পৌছুবে ইউনা। সেটাই ভাল হবে ওর জন্যে। এখানে রয়ে গেলে যে-কোনও সময়ে বিপদে পড়বে ও।’

একঘণ্টার বেশি আলাপচারিতা করেছে ওরা।

সবার বক্তব্যের পর এখন ঘরে নেমেছে থমথমে নীরবতা।

পাশের বেডরুমের দরজা থেকে এল মৃদু আওয়াজ। আবছা আলোয় করিডোরে বেরোল ইউনা। চোখে দুশ্চিন্তা।

‘কতক্ষণ ধরে সব শুনছ, সোনাপাখি?’ নরম সুরে বলল নিকোলভ। ·

ঝড়ের বেগে এ ঘরে ঢুকল ইউনা। ঝুঁকে গেছে দুই কাঁধ। থরথর করে কাঁপছে নিচের ঠোঁট। যে-কোনও সময়ে কেঁদে দেবে। ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল বাবাকে। রানা বুঝল, নিকোলভকে ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নয় মেয়েটা। আবেগের কারণে কুঁচকে গেল ওর বাবার গাল। বুকের ভেতর শক্ত করে ধরেছে মেয়েকে। বিড়বিড় করল, ‘কিচ্ছু হবে না, সোনাপাখি!’

‘আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না, বাবা!’ ডাচ ভাষায় বলল ইউনা, ‘ওদেরকে চলে যেতে বলো। আমি ওদের সঙ্গে কোত্থাও যাব না!’

‘যাওয়াই ভাল, সোনা,’ অশ্রু চেপে বলল নিকোলভ, ‘আম্মু খুব চিন্তা করছে। অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে। একটু ভেবে দেখো, সোনা। বাবা মস্ত ভুল করেছে তোমাকে এখানে এনে।’

‘কিন্তু বেযুখফ আঙ্কেল আর তোমার সঙ্গে থাকব আমি!’ তানিয়ার দিকে তাকাল রানা। বুঝে গেছে, সহজ হবে না ইউনাকে রাজি করানো।

মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে নিকোলভ। নীরবে ফুলে ফুলে কাঁদছে ইউনা। আবারও ঘেউ-ঘেউ শুরু করেছে হাউণ্ড টোমা। ছাউনির পাতলা আবরণ আড়াল করছে না বিকট হুঙ্কার। জানালা দিয়ে অন্ধকারে তাকাল বেযুখফ। চোখে-মুখে অস্বস্তি।

হঠাৎ করেই ইউনার দিকে তর্জনী তাক করল তানিয়া। রানাকে বলল, ‘দেরি না করে ওকে নিয়ে চলুন।’

ইউনা আর নিকোলভকে সময় দেবে, ঠিক করেছে রানা। পরে কবে বাপ-মেয়ের আবারও দেখা হবে, তা অনিশ্চিত। একবার মেয়েটাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর সম্ভবত বাকি জীবন রানাকে ঘৃণা করবে ইউনা। কিন্তু আর কী করতে পারে রানা?

‘কুকুরটাকে ধমকাতে হবে, দাড়িগুলোকে শোনাল বেযুখফ, ‘ছায়া দেখলে, হাওয়া বইলে, মুরগি একটু কঁক করলে… সবকিছুতেই ওর আপত্তি।’

বেযুখফের কথার জবাব দিল না কেউ। আছে

হঠাৎ রাতের নীরবতা ভেঙে শক্তিশালী পটকা ফাটার মত আওয়াজ হলো। আকাশে জ্বলে উঠল ফ্লেয়ারের উজ্জ্বল আলো। থরথর করে কেঁপে উঠেছে খামারবাড়ির জানালার চৌকাঠ। পরক্ষণে দরজা ভেঙে ঝড়ের বেগে হলওয়েতে ঢুকল সশস্ত্র তিনজন লোক। পরনে কালো ট্যাকটিকাল অ্যাসল্ট গিয়ার। একইসময়ে দপ্ করে নিভে গেল সব বাতি। খামারবাড়ি ডুবে গেল ঘুটঘুটে অন্ধকারে।

ঘরে ছুটোছুটির আওয়াজ।

চিৎকার করল কে যেন।

পরের সেকেণ্ডে গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র।

সাতাশ

তিনটা ক্যামোভ কেএ২২৬টি হেলিকপ্টারে করে পাঁচ মাইল দূরে নেমেছে একুশজনের অ্যাসল্ট টিম। কমাণ্ডারের নির্দেশে হালকা চালে দৌড়ে তাতভ বেযুখফের খামারবাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে সবাই। হেলিকপ্টারে করে এলে দূর থেকেই শোনা যেত ইঞ্জিন ও রোটরের বিকট আওয়াজ। রওনা হওয়ার আগে এলাকার টপোগ্রাফি, বুঝে নিয়েছে কমাণ্ডার ও তার বিশ সৈনিক। একপাশে জঙ্গল ভরা পাহাড়ি এলাকা। নিচে উপত্যকা। সেখানেও ঘন অরণ্য। মাঝে ছোট্ট খামার। যে যার মত ট্রুপাররা বুঝে নিয়েছে নন-লিথাল ওয়েপন ওয়াএয়ারলেস টেযার গান। ওটা ছুঁড়ে অজ্ঞান করা হবে নিকোলভ ও তার মেয়েকে। বাধ্য হলে ব্যবহার করা হবে নাইন এমএম গ্লক অটোমেটিক পিস্তল ও এ. ই. কে- ৯১৯ কাশতান সাবমেশিন গান। আজকাল ওটা ব্যবহার করছে রাশান স্পেশাল ফোর্স। অস্ত্রের সঙ্গে আছে সাইলেন্সার, লেযার ও ট্যাকটিকাল লাইট।

বাংলাদেশ আর্মির প্রাক্তন মেজর মাসুদ রানা সুযোগ পেলে ঝামেলা করবে, তাই সঙ্গে আছে আগ্নেয়াস্ত্র। ব্রিফ করার সময় সৈনিকরা পড়েছে তার ডোশিয়ে। ওই লোক পৃথিবীর নামকরা ক’জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধার একজন। কাজেই ছোট্ট এই ‘ অপারেশনেও কমাণ্ডার নিয়েছে বিশজন সৈনিককে। মাসুদ রানা না থাকলে দুই লোক আর এক পিচ্চি মেয়েকে তুলে নিতে লাগত বড়জোর চারজন। ব্রিফিঙের সময় বলা হয়েছে, ঝুঁকি না নিয়ে প্রথম সুযোগেই খতম করতে হবে মাসুদ রানাকে।

টার্গেট যোনে পৌঁছে অ্যাসল্ট প্ল্যান ফাইনালাইয করেছে কমাণ্ডার। ঘেউ-ঘেউ করা এক কুকুর ও ভীত কয়েকটা ছাগলের ম্যা-ম্যা ছাড়া চারপাশ নীরব। বাড়ির ভেতর নড়ছে না কেউ। একটু পর পর রেডিয়োতে মিশন চিফের সঙ্গে আলাপ করছে কমাণ্ডার। বস্ আছেন বহু মাইল দূরে কমাণ্ড সেন্টারে। তবে স্যাটেলাইট ফিডের মাধ্যমে বিশাল স্ক্রিনে দেখছেন প্রতিটি দৃশ্য। খামারের দক্ষিণে দানবের মত মাথা তুলেছে কালো পাহাড় ও টিলাটক্কর। ওদিকটা রেকি করতে চারজনকে পাঠিয়ে দিয়েছে কমাণ্ডার। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে তারা জানাল, টিলার মাথায় একটা কালো মার্সিডিয।

শেষবারের মত অস্ত্র পরীক্ষা করল ট্রুপাররা। তৈরি হলো খামারবাড়িতে হামলা করার জন্যে। সামনের ইউনিটে তিনজন। দায়িত্ব মাসুদ রানাকে শেষ করা। এরপর বন্দি করা হবে জীবিত সবাইকে। খামারের উঠানে আছে দ্বিতীয় ইউনিট। ইশারা পেলে কাজে নামবে তারা। প্রত্যেকের চোখে মিলিটারি স্ট্যাণ্ডার্ড নাইট ভিশন গগল্স্। একজনের কোমরে ঝুলছে শক্তিশালী সেডেটিভ ড্রাগ ভরা সিরিঞ্জের থলি। ইঞ্জেকশন দিলে কয়েক সেকেণ্ডে ঘুমিয়ে পড়বে তাতভ বেযুখফ, অ্যান্টোনিন নিকোলভ ও বারো বছর বয়সী ইউনা নিকোলভ।

এক এক করে মুহূর্ত গুনছে সৈনিকরা। কারও মুখে রা নেই। গ্লাভ্স্ পরা হাতে রেডিয়ো রিমোটের লাল বাটন টিপল কমাণ্ডার। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হলো মার্সিডিযের ফিউয়েল ট্যাঙ্ক। শকওয়েভে দুলে উঠল গাছপালা। ছিটকে আকাশে উঠল আগুনের কমলা ফুটবল। কয়েক মুহূর্ত বিরতির পর খামারবাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল তিনজনের অ্যাসল্ট টিম। তখনই রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে

ফাটানো হলো বোমা। বিস্ফোরিত হয়েছে খামারবাড়ির বৈদ্যুতিক ট্র্যান্সমিটার। দপ্ করে নিভে গেছে সব আলো।

বাড়ির ভেতর অ্যাসল্ট টিমের অটোমেটিক ওয়েপনের খ্যাট-খ্যাট আওয়াজ।

সবাই চমকে গেল বন্দুকের বুম-বুম আওয়াজ শুনে। কয়েক সেকেণ্ড পর কড়াৎ-কড়াৎ শব্দে গর্জে উঠল হাই- ভেলোসিটি রাইফেল।

উঠানে চোখ বিস্ফারিত করে কমাণ্ডারের দিকে তাকাল ট্রপের ক’জন। নির্দেশ পেলেই এখন ছুটে ঢুকবে খামারবাড়ির ভেতর।

গুলির আওয়াজে কমাণ্ডার বুঝেছে, হার মেনে নেয়নি মাসুদ রানা।

‘যা! যা! যা!’ তারস্বরে চেঁচাল কমাণ্ডার।

তীর বেগে হলওয়েতে ঢুকল কয়েকজন ট্রুপার। নাইট ভিশন গগলসের কারণে দেখছে ভুতুড়ে সাগর-সবুজ রঙের আসবাবপত্র। নিজেও বাড়িতে ঢুকল কমাণ্ডার। হাতের অস্ত্র তাক করছে এদিক থেকে ওদিকে। কিন্তু আশপাশে অপরিচিত কেউ নেই। হলওয়েতে কয়েক পা এগোতেই বুটে ঠেকল ভারী, নরম কী যেন। মুখ নিচু করে কমাণ্ডার দেখল, মেঝেতে পড়ে আছে প্রথম ইউনিটের নেতা। লাশের বুক ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়েছে গুলি। একটু দূরেই দলের অন্য দু’জন। বন্দুকের গুলিতে মাথার অংশ উধাও। ছিঁড়ে গেছে গলার ওপরের দিক। কারও কাজে আসেনি বুলেটপ্রুফ ভেস্ট। দলনেতার সাবমেশিন গান কোথাও নেই!

কমাণ্ডার চারপাশ ভালভাবে দেখার আগেই তাকে পাশ কাটাল সৈনিকরা। টার্গেট এখন পাঁচজন। মাসুদ রানা, অ্যান্টোনিন নিকোলভ, তাতভ বেযুখফ, ইউনা নিকোলভ এবং তানিয়া আজোরভ। কিন্তু এ ঘর ছেড়ে সরে গেছে তারা। আগে যে তারা এখানে ছিল, তার প্রমাণ হিসেবে রয়েছে মোচড়ানো খবরের কাগজ, খালি ভোদকার বোতল, চারটে শট গ্লাস, পুরনো আমলের ডাবল ব্যারেলের শটগান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাইফেল। শেষের দুটো পড়ে আছে মেঝেতে। নল দিয়ে এখনও বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল কমাণ্ডার। তারপর তার মনে পড়ল, এই বাড়ির পেছনে কোনও দরজা নেই।

অর্থাৎ, এখনও ভেতরে রয়ে গেছে টার্গেট। ভারী গলায় দলের উদ্দেশে বলল সে, ‘খুঁজে বের কর্ ওদেরকে!’

.

মাসুদ রানার যুক্তি সহজ। একদল সশস্ত্র লোক কারও বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়লে, বাড়ির মালিকের অধিকার আছে নিজেকে রক্ষা করার। তাই বিদ্যুৎ বেগে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে রানা। মুহূর্তে পৌছে গেছে টেবিলের পাশে। তুলে নিয়েছে বেযুখফের পুরনো বন্দুক। ওটার গুলিতে মরেছে সামনের দু’জন। তখনই ফুরিয়ে গেল গুলি। পরের সেকেণ্ডে মসিন নাগান্ট রাইফেল ব্যবহার করেছে রানা। দুই বুলেটের আঘাতে মারা গেছে তৃতীয়জন। কিন্তু লিভার টানতে গিয়ে রানা বুঝল, গুলির খোসা আটকে গেছে ইজেক্টর-এ। এখন ওই রাইফেল বড়জোর কাজ দেবে ক্রিকেট খেলায়। পরের দেড় সেকেণ্ডে আবারও সশস্ত্র হয়ে নিয়েছে রানা। তারপর নিকোলভ, ইউনা, বেযুখফ ও তানিয়াকে তাড়া দিয়ে নিয়ে ঢুকে পড়েছে বাড়ির আরও ভেতরে। তখনই হুড়মুড় করে বাড়িতে ঢুকল আক্রমণকারী দলের অন্যরা।

কোথায় আছে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই রানার। শুধু এটা বুঝেছে, হামলাটা হয়েছে হঠাৎ। যেভাবেই হোক ওদেরকে খুঁজে নিয়েছে এরা। কাজেই প্রথমে প্রাণ বাঁচাতে হবে, পরে সুযোগ পেলে জেনে নিতে হবে এরা কারা, কোন্ দিকে গেলে বাঁচা যাবে।

।বিদ্যুৎ নেই। বাড়ির ভেতরে অন্ধকার। তবে রানার জোগাড় করা সাবমেশিন গানের নলের ওপর জ্বলছে ট্যাকটিকাল রশ্মি। সেই আলোয় এগোল ওরা। সংকীর্ণ প্যাসেজ পেরোতেই সামনে পড়ল ছোট্ট কিচেন। কুবাস পেয়ে নাক কুঁচকে গেল রানার। প্রায় অন্ধকারে দেখল নোংরা কিচেনে রয়ে গেছে বাসি তরকারির আবর্জনা। রানার পাশেই নিকোলভ। শক্ত হাতে ধরেছে ইউনার ডান কবজি। যে-কোনও সময়ে কেঁদে উঠবে মেয়েটা, তাই আরেক হাতে চেপে ধরে আছে ওর মুখ। মহুয়া ফল খেয়ে মাতাল হওয়া ভালুকের মত টলতে টলতে কিচেনে ঢুকল বেযুখফ। সবার শেষে ভেতরে পা রাখল তানিয়া। দরজা বন্ধ করে চাবি মেরে পুরনো আমলের লোহার তালা আটকে দিল রানা।

বেশিক্ষণ টিকবে না উনিশ শতকের এই তালা। কিচেনের আরেক পাশে প্রাচীন এক ইলেকট্রিক স্টোভ দেখে ওটা হ্যাঁচকা টানে দেয়ালের সকেট থেকে উপড়ে আনল রানা। লিনোলিয়াম মেঝেতে ছেঁচড়ে নিয়ে রাখল দরজার সামনে। ওটা কাজ করবে ব্যারিয়ারের মত। চারপাশে তাকাল। কিচেনে কোনও জানালা বা দ্বিতীয় কোনও দরজা নেই। মৃদু স্বস্তি বোধ করল। ভেতরে ঢুকতে হলে ব্যবহার করতে হবে একমাত্র দরজাটা। পরক্ষণে বুঝল, খারাপ দিক, ছোট্ট ঘরে আটকা পড়েছে ওরা!

এবার কী করবে ভাবছে রানা, এমনসময় শুনল প্যাসেজে বুটের ভারী শব্দ। গায়ের জোরে কবাটে ধাক্কা দিল কেউ। পরক্ষণে এল দ্বিতীয় ঘা। থরথর করে কেঁপে উঠেছে দরজার চৌকাঠ। যে-কোনও সময়ে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকবে হামলাকারীরা। কিছুক্ষণের জন্যে তাদেরকে নিরস্ত করতে সাবমেশিন গান থেকে দরজা লক্ষ্য করে তিনটে গুলি পাঠাল রানা। কাঠ ভেদ করে ওদিকে গেছে বুলেট। কাশতান সাবমেশিন গান খাটো ও মোটা অস্ত্র। ব্যবহার করে কম শক্তির নাইন এক্স এইটিন এমএম ম্যাকারভ কার্ট্রিজ। ওটা সাধারণ নাইন এমএম প্যারাবুলাম বুলেটের চেয়ে কম গতির। তবে করেছে নিজের কাজ। দরজার ওদিক থেকে ধাক্কা থেমে গেছে।

খপ্ করে কাঁধ ধরে নিকোলভকে দরজার সামনে থেকে সরাল রানা। এখন যে-কোনও সময়ে ওদিক থেকে আসবে গুলি। পেরোল কয়েক মুহূর্ত। রানার মনে পড়ল, নিকোলভ বলেছিল তাকে জীবিত চায় ওরা। বোধহয় মিথ্যা বলেনি সে। সেক্ষেত্রে এখন কী করবে তার শত্রুরা?

ব্যবহার করতে পারে টিয়ার গ্যাস অথবা স্টান গ্রেনেড।

নিজে হলে সাধারণ একটা দরজার কাছে হার মেনে নিত না রানা। এরাও বসে থাকবে না।

ভীষণ ভয় পেয়েছে ইউনা। বাবা জড়িয়ে ধরেছে ওকে। ইল মাছের মত গা মোচড়াচ্ছে মেয়েটা। নিকোলভ ভয় পাচ্ছে যে-কোনও সময়ে ব্যথা পাবে ইউনা। অন্ধকারে ছেড়ে দেয়াও সম্ভব নয়। ট্যাকটিকাল আলোয় বেযুখফকে দেখল রানা।

ভয় পেয়েছে লোকটা। চলে গেল কিচেনের কাউন্টারের পাশে। ওখান থেকে নিল করাতের মত দাঁতওয়ালা একটা ছুরি। নানাদিকে ওটা দোলাতে শুরু করেছে খ্যাপাটে লোকটা। রাশান ভাষায় চিৎকার করে উঠল: ‘সাহস থাকলে আয়, শালারপো-শালারা! কুত্তার বাচ্চা! হারামজাদারা!’

বেযুখফের চেয়ে ঢের বেশি ট্রেইণ্ড লোককেও বোকামি করতে দেখেছে রানা। কেউ কেউ তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিজের বা দলের অন্যদের জখম করেছে। বাইরে একদল সশস্ত্র লোক। এখন ছোট্ট কিচেনে এদিক ওদিক ছোৱা চালাতে গিয়ে যে-কাউকে আহত করতে পারে বেযুখফ।

দুই কদমে তার মুখোমুখি হলো রানা। বামহাতে নিল অস্ত্র। ওটার নলের ওপর আলো। ডানহাতে বেযুখফের কবজি মুচড়ে ছোরাটা কেড়ে নিল ও। গেঁথে দিল কিচেনের ওঅর্কটপে। সাবমেশিন গানের নল ঠেসে ধরল লোকটার থুতনির নিচে। নিচু স্বরে বলল, ‘মাথা ঠাণ্ডা রাখো। নইলে খুন হবে আমার হাতে।’

হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেল রাশান। চুপচাপ ফোঁস- ফোঁস শ্বাস ফেলছে। দুই ঠোঁটের কোণে জমেছে সাদা ফেনা।

ব্যাটার হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে নাকি? ভাবল রানা।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল বেযুখফ।

তিনি সুস্থ থাকলে বদলে যেত ওই দেশের ভবিষ্যৎ। বীর হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকত তাঁর নাম।

কিন্তু নানান ঘাত-প্রতিঘাতে তা আর হয়ে উঠল না। উনিশ শ’ আটষট্টি সালের আগস্ট মাসে প্রাগ শহরে আন্দোলনকারীদের ওপর যুদ্ধের ট্যাঙ্ক চালিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট লিয়োনিড ব্রেনেভ। লৌহ মুষ্টি ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণে আনলেন বিরোধী দলের সদস্যদেরকে। বাধ্য হয়ে আত্মগোপনে গেলেন জনপ্রিয় নেতা অ্যালেক্স বার্টোস। তবে একসময়ে গোপন আস্তানা থেকে বেরোতেই হলো পেটের আলসারের চিকিৎসার জন্যে। ডাক্তাররা বলে দিলেন, অপারেশন করতে হবে। ওটা ছিল ওটা ছিল সহজ একটা অস্ত্রোপচার। কিন্তু এরপর থেকেই শুরু হলো নেতা অ্যালেক্স বার্টোসের বিপদ

সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে ভাবলেন সেরে গেছে আলসার। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর টের পেলেন, কী যেন বদলে গেছে তাঁর ভেতর। ঝাপসা হয়ে গেছে অনেক স্মৃতি। মগজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে যুক্তি। শারীরিকভাবেও বোধ করলেন অসুস্থ। দেখা দিল চোখের সমস্যা। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে রাতের ঘুম। বদলে গেল হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন। তাঁর মনে হলো এসব হচ্ছে মাথার ভেতরে কিছু বদলে যাওয়ায়। যদিও এসবের কোনও কারণ তিনি বুঝলেন না।

ক্রমেই হলেন আরও অসুস্থ। কানে শুনতে লাগলেন রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সির মত আওয়াজ। প্রায় পাগল হয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। তাঁর মনে হলো, হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে সব সমস্যা। অপারেশনের সময় তাঁকে অজ্ঞান করা হয়। ভাবলেন, তখনই তাঁকে দেয়া হয়েছে অদ্ভুত কোনও ড্রাগ। আর ওটার জন্যেই দেখা দিয়েছে এসব সিম্পটম। যে ডাক্তার তাঁর অপারেশন করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে আলাপ করলেন অ্যালেক্স বার্টোস। ডাক্তার অতি তাড়াহুড়ো করে বলে দিলেন, আসলে শারীরিকভাবে তিনি চমৎকার আছেন, কোথাও কোনও সমস্যা নেই।

এ কথা মেনে নিলেন না অ্যালেক্স বার্টোস। গেলেন প্রাগের এক ক্লিনিকে। সেখানে তাঁকে দেখলেন ডক্টর বেনিডিক্ট চালুপনিক। মাথার এক্স-রে করে চমকে গেলেন দু’জনই। বার্টোসের মাথায় রয়েছে ধাতুর অস্বাভাবিক একটা টুকরো। দৈর্ঘ্যে বড়জোর সাত মিলিমিটার। চওড়ায় চার মিলিমিটার। ওটা যে গোপনে মগজের কাছে কপালের হাড়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, তাতে সন্দেহ থাকল না ডক্টর বেনিডিক্ট চালুপনিকের। এ-ও বুঝলেন, ওটা ঢোকানো হয়েছে নাকের ফুটো ব্যবহার করে। কোনও ধরনের অপারেশন হয়নি মাথায়। ফলে বাইরে থেকে কাটাছেঁড়া নেই।

ভীষণ ভয় পেলেন অ্যালেক্স বার্টোস। ডক্টরকে অনুরোধ করলেন জিনিসটা বের করে দেয়ার জন্যে। বিস্মিত বেনিডিক্ট চালুপনিক বললেন তাঁকে সতর্ক থাকতে। এ-ও জানালেন, সর্বোচ্চ মেডিকেল কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট পাঠাবেন তিনি।

তবে কয়েক সপ্তাহ গেলেও যখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন না ডক্টর চালুপনিক, উনিশ শ’ ঊনসত্তর সালের মে মাসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন অ্যালেক্স বার্টোস। এবার অবাক হতে হলো তাঁকে। আবারও এক্স-রে করে ডাক্তার বললেন, এক্স-রে রিপোর্ট একদম স্বাভাবিক। কোথাও কোনও সমস্যা নেই। অথচ, প্রথম এক্স-রে ফোটোতে ছিল ধাতুর টুকরো। বার্টোস তর্ক জুড়লে ডাক্তার মিথ্যাচার করলেন, তাঁর সঙ্গে নাকি এ বিষয়ে আগে কোনও কথাই হয়নি বার্টোসের।

খেপে গিয়ে আইনের সাহায্য নেবেন বলে ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এলেন রাজনৈতিক নেতা। তবে আসলে কিছুই করার ছিল না তাঁর। যুক্তি হারিয়ে যাচ্ছিল মস্তিষ্ক থেকে। হতাশ হয়ে শুরু করলেন অতিরিক্ত মদ্যপান। মাঝে মাঝে দেয়ালে ঠুকতেন মাথা। ভাবতেন ঝাঁকি খেয়ে নাক দিয়ে বেরোবে ধাতুর টুকরো। ঘুমিয়ে পড়লে দেখতেন ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন। সর্বক্ষণ মনে হতো তাঁর উচিত আত্মহত্যা করা। প্রায় পাগল হয়ে গেলেন তিনি।

‘এসব কোথাও লেখা হয়েছে?’ জানতে চাইল রানা।

‘পুরোটা খুলে বললে সবই বুঝবে,’ বলল বেযুখফ।

উনিশ শ’ ঊনসত্তর সালের জুন মাসের আঠারো তারিখে খুনের উদ্দেশে গুলি করা হলো অ্যাডাম সারমাককে। তিনিও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষের বড় নেতা। প্রতিটি বক্তৃতায় থাকত সোভিয়েত শাসনের দুর্নীতির কথা। প্রাগ দখলের সময় রাশান একটি ট্যাঙ্ক আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন তিনি উনিশ শ’ আটষট্টি সালে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন অ্যালেক্স বার্টোস।

কিন্তু উনিশ শ’ ঊনসত্তর সালের জুন মাসে সারমাকের পেটে দু’বার গুলি করে এক খুনি। বেঁচে যান সারমাক। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, পিস্তল হাতে পালিয়ে গেছে খুনি। ওদিকে পরদিন সকালে এক নর্দমার ভেতর পাওয়া গেল অ্যালেক্স বার্টোসকে। পরনে নোংরা, ছেঁড়া পোশাক। পাশেই গুলি ভরা রিভলভার। তিনি বারবার দাবি করলেন, ওই অস্ত্র জীবনেও দেখেননি। তবে চেম্বারে ছিল খরচ করা দুটো গুলির খোসা। জেরার সময় জানালেন, গত রাতে অ্যাডাম সারমাকের বাড়ির ধারেকাছেও যাননি। গত কয়েক মাস তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও নেই। পরে বলেছিলেন, দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেন না কারও ক্ষতি করবেন তিনি। বাদ থাকুক প্রিয় বন্ধু অ্যাডাম সারমাক

গ্রেফতার করতে পুলিশ আসছে জেনে চেকোস্লোভাকিয়া ছেড়ে জার্মানির ফ্র্যাঙ্কফুর্টে পালিয়ে যান তিনি। বুঝে গিয়েছিলেন যে ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁকে দিয়ে খারাপ কাজ করাচ্ছে তাঁরই মাথা। তাঁর প্রতি সমবেদনা রয়েছে এমন এক সার্জেনকে খুঁজে পান তিনি। ডাক্তার কনরাড ব্যাটডর্ফ ঠিক করেন অপারেশন করবেন বার্টোসের মাথায়।

তেরোই সেপ্টেম্বর রোগীর মাথা থেকে বের করা হয় ওই ডিভাইস। অথচ, তার সাড়ে তিন মাস আগে চেক ডাক্তার বলেছিল বার্টোসের মাথায় অস্বাভাবিক কিছুই নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় এক্স-রে দেখে ডক্টর ব্যাটডর্ফ জানান, কপালের হাড়ে যুক্ত ছিল সাত মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের একটি ধাতুর টুকরো। চওড়ায় ছিল চার মিলিমিটার। আগে কখনও ওই ধরনের জিনিস দেখেননি তিনি। পরীক্ষায় দেখা যায়, ওটা ছিল কোনও ধরনের হাই-ফ্রিকোয়েন্সি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ট্র্যান্স-পণ্ডার বা খুদে রেডিয়ো রিসিভার। কোনও পাওয়ার সেল ছিল না। কাজ করত দূরের রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সির নির্দেশ অনুযায়ী। মগজে তৈরি করত সতেরো থেকে চব্বিশ কিলোহার্টয পাওয়ার।

চেক ডাক্তারের মত করে তথ্য গোপন না করে অদ্ভুত এক ষড়যন্ত্রের কথা প্রচার করলেন জার্মান ডাক্তার। এটাও বললেন, রোগীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বেআইনীভাবে ওই ডিভাইস বসিয়ে দেয়া ভয়ানক অপরাধ। ওদিকে তখনও অ্যালেক্স বার্টোসকে খুঁজছে পুলিশ। নিরাপত্তার জন্যে ট্রেনে করে সুইট্যারল্যাণ্ডে যাওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। তার আগে পরিচয় হয়েছে জার্মান এক রিপোর্টারের সঙ্গে। উনি ছিলেন স্টার্ন পত্রিকার প্রতিবেদক। বলেন, প্রমাণ দেখাতে পারলে পত্রিকায় প্রকাশ করবেন, ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বার্টোসের বিরুদ্ধে। ঠিক হলো যুরিখে দেখা হবে দু’জনের।

‘কিন্তু বাস্তবে তা আর হলো না,’ বলল বেযুখফ। ‘সুইট্যারল্যাণ্ডে পৌঁছুবার আগেই সীমান্তে গ্রেফতার হলেন অ্যালেক্স বার্টোস। বিচারের মুখোমুখি করতে তাঁকে ফেরত নেয়া হলো চেকোস্লোভাকিয়ায়।’

ওদিকে প্রাগে যাওয়ার সময় হারিয়ে গেল ওই ডিভাইস। কিছুই প্রমাণ করতে পারলেন না জার্মান সাংবাদিক। অ্যালেক্স বার্টোসের দেশ ত্যাগের কয়েক ঘণ্টা পর ফ্র্যাঙ্কফুর্টে বাড়ির সামনে ছয় চাকার এক ট্রাকের নিচে পড়ে খুন হলেন ডাক্তার কনরাড ব্যাটডর্ফ। ওই যন্ত্রদানব নিয়ে পালিয়ে যায় ড্রাইভার। এরপর তাঁর অফিসে খুঁজে পাওয়া গেল না ডাক্তারি রিপোর্ট, চিঠি ও ডিভাইসের ফোটোগুলো। অপারেশনের সময় যে নার্স সহায়তা করেছিল, তাকে বদলি করে দেয়া হলো অন্য এক হাসপাতালে। তার ক’দিন পর চিরকালের মত গায়েব হয়ে গেল সেই নার্স।

‘জার্মান সাংবাদিক ঠিক করলেন, যে যাই বলুক, ওই কাহিনী তিনি লিখবেন,’ বলল বেযুখফ। ‘কিন্তু পত্রিকার মালিক কোনও ব্যাখ্যা না দিয়েই চাকরি থেকে তাঁকে ছাঁটাই করে দিলেন। এরপর কয়েক মাস গবেষণা করে জার্মান ভদ্রলোক লিখলেন: শেকলে বাঁধা মন: ভবিষ্যতের বিপদ। কিন্তু চলল না বইটা। এরপর উনিশ শ’ একাত্তর সালের আগস্টে একটা সুইমিং পুলে ডুবে মারা গেলেন জার্মান সাংবাদিক।’

দু’ হাজার চোদ্দ সালে নব্বুই বছর বয়সে মারা যান অ্যাডাম সারমাক। মৃত্যুর দিনেও বলেছেন, তাঁর বন্ধু অ্যালেক্স বার্টোস তাঁকে গুলি করতে পারেন না। যদিও ফরেনসিক রিপোর্ট ও সাক্ষীদের কারণে বিশ বছরের জেল হয় বার্টোসের।

‘আসলে তোমার মগজ অন্য কেউ দখল করলে কিছুই করার থাকে না,’ রানাকে বলল বেযুখফ। ‘মগজের কথা শুনবে তোমার দেহ। কী করছ তাও টের পাবে না। অপরাধ করলেও জানবে না কিছুই।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘আরেকটা প্রশ্ন জাগে মনে,’ বলল বেযুখফ। ‘সত্যিই কি উনিশ শ’ সত্তর সালে অ্যাডাম সারমাককে খুন করতে চেয়েছে সোভিয়েত সরকার? সেক্ষেত্রে পরে কেন সে-চেষ্টা করল না? আমার ধারণা, তাকে শেষ করতে চাওয়া হয়নি। বাস্তবে মাইণ্ড কন্ট্রোল কাজ করছে কি না, বুঝতে চেয়েছিল সরকার। অ্যাডাম সারমাক ছিল ল্যাবোরেটরির ইঁদুরের মত।

‘প্রিয় বন্ধুকে খুন করানো সম্ভব হলে, বুঝতে হবে যে- কাউকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেয়া যাবে,’ বলল নিকোলভ। ‘অ্যালেক্স বার্টোসের কী হয়েছিল?’ জানতে চাইল রানা।

‘ভদ্রলোক বারবার বলেছেন, তিনি গুলি করেননি। জেলখানার ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছেন মানুষটা। তাই চলে নানান রকম সাইকিয়াট্রিক চিকিৎসা। পাঠিয়ে দেয়া হয় মানসিক এক অ্যাসাইলামে। তাঁর ওপর চলল ড্রাগ ও ইলেকট্রোশকের অসহ্য নির্যাতন। কয়েক সপ্তাহ পর ভুল করল এক মেডিকেল কর্মী। চালিয়ে দিল হাই ভোল্টেজের কারেন্ট। হার্ট অ্যাটাকে মরলেন অ্যালেক্স বার্টোস। তাঁর কাহিনী ওখানেই শেষ।’

‘কিন্তু আমাদের গল্প ওখানেই শেষ নয়,’ শক্ত হাতে ধাতব ডিভাইস ধরেছে নিকোলভ। ‘এবার সময় হয়েছে সব প্রকাশ করে দেয়ার।’

‘তোমরা চাও সেই জার্মান সাংবাদিকের কাজটা শেষ করতে?’ জানতে চাইল রানা। ‘রেডিয়োর মাধ্যমে দুনিয়ার মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেবে এ কাহিনী? …হয়তো পারবে। ইণ্টারনেটের নিউয আউটলেট এসবের গন্ধ পেলে গোটা ব্যাপারটাকে ভাইরাল করবে।’

‘চেষ্টা করতে তো দোষ নেই,’ বলল বেযুখফ।

মাথা দোলাল নিকোলভ।

‘তারপর কী করবে?’ পালা করে ওদেরকে দেখল রানা। ‘তোমাদের কাহিনী চাপা পড়বে হাজার কোটি টন নতুন খবরের নিচে। তদন্ত হবে না কোনও। লক নেস বা ভিনগ্রহী গিরগিটির গল্পের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে না কেউ।’

‘খবরদার! ভিনগ্রহের গিরগিটি নিয়ে ঠাট্টা নয়!’ রেগে গিয়ে বলল তাতভ বেযুখফ, ‘ওরা কিন্তু সত্যিই আছে।

‘ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ, ধরে নিলাম ওরা আছে, মৃদু হাসল রানা। পরক্ষণে বলল, ‘যদি মনে করে নিই আজ রাতে সত্যি বলেছ, তো এবার কী করবে তোমরা? সেই জার্মান সাংবাদিকের মত প্রকাশ করে দেবে সব? কিন্তু এরপর নিরাপত্তা পাবে কোথা থেকে? আজ হোক, কাল হোক, বা কয়েক মাস পরে নদী বা সাগরে ভেসে উঠবে তোমাদের লাশ। এদিকটা ভেবে দেখেছ?’

‘মনে করেছিলাম আমাদের দিকটা বুঝবে,’ ফ্যাকাসে হলো নিকোলভ। ‘গোপন এসব তথ্য ফাঁস না করে উপায় নেই। মানুষ জেনে যাক কী ঘটছে পৃথিবী জুড়ে। ডিভাইস এস. এম. ৬১৪৩ আসলে আণবিক বোমার চেয়েও বিপজ্জনক।’

‘ওই বোমা ফাটলে খুন হবে তোমরা,’ মন্তব্য করল রানা। ‘আর এ কারণেই খুব জরুরি ইউনাকে ফ্রান্সে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেজন্যেই আমি এখানে এসেছি।’

চ্যা’তুমি বোধহয় আমার কথা বুঝতে পারোনি?’ রেগে গেল নিকোলভ। ‘মস্কো পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারবে না তুমি!’

‘সেটা আমি বুঝব,’ শান্ত স্বরে বলল রানা। ‘তোমরা আছ বাজে ঝামেলার ভেতর। এতে নাক গলাতে চাই না। তবে তোমাদের উচিত হয়নি ইউনাকে এসবে জড়িয়ে নেয়া।’

‘আমিও তা চাইনি,’ বলল নিকোলভ, ‘জেনেবুঝে কেউ নিজের মেয়েকে এত বড় বিপদে ফেলে? আমি কি পশু?’

‘পশু নও, নিরেট বোকা, বিরক্ত স্বরে বলল রানা। ‘িসব দোষ আমার প্রাক্তন স্ত্রী তামারার। সে-ই তো আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইল ইউনাকে। এরপর হয়তো আমার কোনও অধিকারই থাকরে না ওকে এক নজর দেখার।’

‘তোমার কথা ঠিক হলে, ইউনার পরের জন্মদিন আসার আগেই তুমি পৃথিবীতে থাকছ না,’ হঠাৎ বলে উঠল তানিয়া আজোরভ। আবার তাকাল জানালা দিয়ে দূরে।

রানাকে দেখল নিকোলভ। চোখদুটো স্থির হলো টেবিলের ওপর। ওখানে বন্দুক ও রাইফেল। এক্স এজেন্ট বুঝতে চাইছে রানার আগে ওখানে পৌঁছুতে পারবে কি না।

‘ভুল হবে,’ বলল রানা। ‘তার চেয়ে ভেবে দেখো, কীভাবে এই বিপদ থেকে ইউনাকে বাঁচাবে।’

‘রাতের আঁধারে তোমার হাতে ওকে তুলে দেব?’ মাথা নাড়ল নিকোলভ। ‘আমি তো তোমাকে চিনিই না।’

‘ফোন করো লুকা ব্রেনেভকে,’ বলল রানা। ‘উনি বলে দেবেন আমি কে।’

‘তুমি পাগল নাকি?’ বলল বেযুখফ। ‘লুকা ব্ৰেযনেভ নিজেই তো বর্তমান পৃথিবীর ভয়ানক ক্ষমতাশালী ইবলিশ। শয়তানির শেষ নেই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আর জার্মানির চ্যান্সেলারের সঙ্গে মিলে করে বেড়াচ্ছে পৈশাচিক সব কুকীর্তি। আমরা এখানে আছি সেটা সে টের পেলে, দু’ঘণ্টার মধ্যে খুন হব।’

বেযুখফকে পাত্তা না দিয়ে নিকোলভের দিকে তাকাল। ‘কথা দিচ্ছি, নিরাপদে থাকবে ইউনা। আমরা মস্কো থেকে যাওয়ার আগেই টারমাকে থাকবে জেট বিমান। কয়েক ঘণ্টার ভেতর ফ্রান্সে পৌঁছুবে ইউনা। সেটাই ভাল হবে ওর জন্যে। এখানে রয়ে গেলে যে-কোনও সময়ে বিপদে পড়বে ও।’

একঘণ্টার বেশি আলাপচারিতা করেছে ওরা।

সবার বক্তব্যের পর এখন ঘরে নেমেছে থমথমে নীরবতা।

পাশের বেডরুমের দরজা থেকে এল মৃদু আওয়াজ। আবছা আলোয় করিডোরে বেরোল ইউনা। চোখে দুশ্চিন্তা।

‘কতক্ষণ ধরে সব শুনছ, সোনাপাখি?’ নরম সুরে বলল নিকোলভ।

ঝড়ের বেগে এ ঘরে ঢুকল ইউনা। ঝুঁকে গেছে দুই কাঁধ। থরথর করে কাঁপছে নিচের ঠোঁট। যে-কোনও সময়ে কেঁদে দেবে। ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল বাবাকে। রানা বুঝল, নিকোলভকে ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নয় মেয়েটা। আবেগের কারণে কুঁচকে গেল ওর বাবার গাল। বুকের ভেতর শক্ত করে ধরেছে মেয়েকে। বিড়বিড় করল, ‘কিচ্ছু হবে না, সোনাপাখি!’

‘আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না, বাবা!’ ডাচ ভাষায় বলল ইউনা, ‘ওদেরকে চলে যেতে বলো। আমি ওদের সঙ্গে কোত্থাও যাব না!’

‘যাওয়াই ভাল, সোনা,’ অশ্রু চেপে বলল নিকোলভ, .’আম্মু খুব চিন্তা করছে। অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে। একটু ভেবে দেখো, সোনা। বাবা মস্ত ভুল করেছে তোমাকে এখানে এনে।’

‘কিন্তু বেযুখফ আঙ্কেল আর তোমার সঙ্গে থাকব আমি!’

তানিয়ার দিকে তাকাল রানা। বুঝে গেছে, সহজ হবে না ইউনাকে রাজি করানো।

মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে নিকোলভ। নীরবে ফুলে ফুলে কাঁদছে ইউনা। আবারও ঘেউ-ঘেউ শুরু করেছে হাউণ্ড টোমা। ছাউনির পাতলা আবরণ আড়াল করছে না বিকট হুঙ্কার। জানালা দিয়ে অন্ধকারে তাকাল বেযুখফ। চোখে-মুখে অস্বস্তি।

হঠাৎ করেই ইউনার দিকে তর্জনী তাক করল তানিয়া। রানাকে বলল, ‘দেরি না করে ওকে নিয়ে চলুন।’

ইউনা আর নিকোলভকে সময় দেবে, ঠিক করেছে রানা। পরে কবে বাপ-মেয়ের আবারও দেখা হবে, তা অনিশ্চিত। একবার মেয়েটাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর সম্ভবত বাকি জীবন রানাকে ঘৃণা করবে ইউনা। কিন্তু আর কী করতে পারে রানা?

‘কুকুরটাকে ধমকাতে হবে,’ দাড়িগুলোকে শোনাল বেযুখফ, ‘ছায়া দেখলে, হাওয়া বইলে, মুরগি একটু কঁক করলে… সবকিছুতেই ওর আপত্তি।’

বেযুখফের কথার জবাব দিল না কেউ।

হঠাৎ রাতের নীরবতা ভেঙে শক্তিশালী পটকা ফাটার মত আওয়াজ হলো। আকাশে জ্বলে উঠল ফ্লেয়ারের উজ্জ্বল আলো। থরথর করে কেঁপে উঠেছে খামারবাড়ির জানালার চৌকাঠ। পরক্ষণে দরজা ভেঙে ঝড়ের বেগে হলওয়েতে ঢুকল সশস্ত্র তিনজন লোক। পরনে কালো ট্যাকটিকাল অ্যাসল্ট গিয়ার। একইসময়ে দপ করে নিভে গেল সব বাতি। খামারবাড়ি ডুবে গেল ঘুটঘুটে অন্ধকারে।

ঘরে ছুটোছুটির আওয়াজ।

চিৎকার করল কে যেন!

পরের সেকেণ্ডে গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র।

২৮

তিনটা ক্যামোভ কেএ২২৬টি হেলিকপ্টারে করে পাঁচ মাইল দূরে নেমেছে একুশজনের অ্যাসল্ট টিম। কমাণ্ডারের নির্দেশে হালকা চালে দৌড়ে তাতভ বেযুখফের খামারবাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে সবাই। হেলিকপ্টারে করে এলে দূর থেকেই শোনা যেত ইঞ্জিন ও রোটরের বিকট আওয়াজ। রওনা হওয়ার আগে এলাকার টপোগ্রাফি বুঝে নিয়েছে কমাণ্ডার ও তার বিশ সৈনিক। একপাশে জঙ্গল ভরা পাহাড়ি এলাকা। নিচে উপত্যকা। সেখানেও ঘন অরণ্য। মাঝে ছোট্ট খামার। যে যার মত ট্রুপাররা বুঝে নিয়েছে নন-লিথাল ওয়েপন ওয়াএয়ারলেস টেযার গান। ওটা ছুঁড়ে অজ্ঞান করা হবে নিকোলভ ও তার মেয়েকে। বাধ্য হলে ব্যবহার করা হবে নাইন এমএম গ্লক অটোমেটিক পিস্তল ও এ. ই. কে- ৯১৯ কাশতান সাবমেশিন গান। আজকাল ওটা ব্যবহার করছে রাশান স্পেশাল ফোর্স। অস্ত্রের সঙ্গে আছে সাইলেন্সার, লেযার ও ট্যাকটিকাল লাইট।

বাংলাদেশ আর্মির প্রাক্তন মেজর মাসুদ রানা সুযোগ পেলে ঝামেলা করবে, তাই সঙ্গে আছে আগ্নেয়াস্ত্র। ব্রিফ করার সময় সৈনিকরা পড়েছে তার ডোশিয়ে। ওই লোক পৃথিবীর নামকরা ক’জন দুর্ধর্ষ যোদ্ধার একজন। কাজেই ছোট্ট এই অপারেশনেও কমাণ্ডার নিয়েছে বিশজন সৈনিককে। মাসুদ রানা না থাকলে দুই লোক আর এক পিচ্চি মেয়েকে তুলে নিতে লাগত বড়জোর চারজন। ব্রিফিঙের সময় বলা হয়েছে, ঝুঁকি না নিয়ে প্রথম সুযোগেই খতম করতে হবে মাসুদ রানাকে।

টার্গেট যোনে পৌঁছে অ্যাসল্ট প্ল্যান ফাইনালাইয করেছে কমাণ্ডার। ঘেউ-ঘেউ করা এক কুকুর ও ভীত কয়েকটা ছাগলের ম্যা-ম্যা ছাড়া চারপাশ নীরব। বাড়ির ভেতর নড়ছে না কেউ। একটু পর পর রেডিয়োতে মিশন চিফের সঙ্গে আলাপ করছে কমাণ্ডার। বস্ আছেন বহু মাইল দূরে কমাণ্ড সেন্টারে। তবে স্যাটেলাইট ফিডের মাধ্যমে বিশাল স্ক্রিনে দেখছেন প্রতিটি দৃশ্য। খামারের দক্ষিণে দানবের মত মাথা তুলেছে কালো পাহাড় ও টিলাটক্কর। ওদিকটা রেকি করতে চারজনকে পাঠিয়ে দিয়েছে কমাণ্ডার। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে তারা জানাল, টিলার মাথায় একটা কালো মার্সিডিয।

শেষবারের মত অস্ত্র পরীক্ষা করল ট্রুপাররা। তৈরি হলো খামারবাড়িতে হামলা করার জন্যে। সামনের ইউনিটে তিনজন। দায়িত্ব মাসুদ রানাকে শেষ করা। এরপর বন্দি করা হবে জীবিত সবাইকে। খামারের উঠানে আছে দ্বিতীয় ইউনিট। ইশারা পেলে কাজে নামবে তারা। প্রত্যেকের চোখে মিলিটারি স্ট্যাণ্ডার্ড নাইট ভিশন গগল্স্। একজনের কোমরে ঝুলছে শক্তিশালী সেডেটিভ ড্রাগ ভরা সিরিঞ্জের থলি। ইঞ্জেকশন দিলে কয়েক সেকেণ্ডে ঘুমিয়ে পড়বে তাতভ বেযুখফ, অ্যান্টোনিন নিকোলভ ও বারো বছর বয়সী ইউনা নিকোলভ।

এক এক করে মুহূর্ত গুনছে সৈনিকরা। কারও মুখে রা নেই। গ্লাভ্স্ পরা হাতে রেডিয়ো রিমোটের লাল বাটন টিপল কমাণ্ডার। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হলো মার্সিডিয়ের ফিউয়েল ট্যাঙ্ক। শকওয়েভে দুলে উঠল গাছপালা। ছিটকে আকাশে উঠল আগুনের কমলা ফুটবল। কয়েক মুহূর্ত বিরতির পর খামারবাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল তিনজনের অ্যাসল্ট টিম। তখনই রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ফাটানো হলো বোমা। বিস্ফোরিত হয়েছে খামারবাড়ির বৈদ্যুতিক ট্র্যান্সমিটার। দপ্ করে নিভে গেছে সব আলো।

বাড়ির ভেতর অ্যাসল্ট টিমের অটোমেটিক ওয়েপনের খ্যাট-খ্যাট আওয়াজ।

সবাই চমকে গেল বন্দুকের বুম-বুম আওয়াজ শুনে।

কয়েক সেকেণ্ড পর কড়াৎ-কড়াৎ শব্দে গর্জে উঠল হাই- ভেলোসিটি রাইফেল।

উঠানে চোখ বিস্ফারিত করে কমাণ্ডারের দিকে তাকাল ট্রপের ক’জন। নির্দেশ পেলেই এখন ছুটে ঢুকবে খামারবাড়ির ভেতর।

গুলির আওয়াজে কমাণ্ডার বুঝেছে, হার মেনে নেয়নি মাসুদ রানা।

‘যা! যা! যা!’ তারস্বরে চেঁচাল কমাণ্ডার।

তীর বেগে হলওয়েতে ঢুকল কয়েকজন ট্রুপার। নাইট ভিশন গগলসের কারণে দেখছে ভুতুড়ে সাগর-সবুজ রঙের আসবাবপত্র। নিজেও বাড়িতে ঢুকল কমাণ্ডার। হাতের অস্ত্র তাক করছে এদিক থেকে ওদিকে। কিন্তু আশপাশে অপরিচিত কেউ নেই। হলওয়েতে কয়েক পা এগোতেই বুটে ঠেকল ভারী, নরম কী যেন। মুখ নিচু করে কমাণ্ডার দেখল, মেঝেতে পড়ে আছে প্রথম ইউনিটের নেতা। লাশের বুক ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়েছে গুলি। একটু দূরেই দলের অন্য দু’জন। বন্দুকের গুলিতে মাথার অংশ উধাও। ছিঁড়ে গেছে গলার ওপরের দিক। কারও কাজে আসেনি বুলেটপ্রুফ ভেস্ট। দলনেতার সাবমেশিন গান কোথাও নেই!

কমাণ্ডার চারপাশ ভালভাবে দেখার আগেই তাকে পাশ কাটাল সৈনিকরা। টার্গেট এখন পাঁচজন। মাসুদ রানা, অ্যান্টোনিন নিকোলভ, তাতভ বেযুখফ, ইউনা নিকোলভ এবং তানিয়া আজোরভ। কিন্তু এ ঘর ছেড়ে সরে গেছে তারা। আগে যে তারা এখানে ছিল, তার প্রমাণ হিসেবে রয়েছে মোচড়ানো খবরের কাগজ, খালি ভোদকার বোতল, চারটে শট গ্লাস, পুরনো আমলের ডাবল ব্যারেলের শটগান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাইফেল। শেষের দুটো পড়ে আছে মেঝেতে। নল দিয়ে এখনও বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল কমাণ্ডার। তারপর তার মনে পড়ল, এই বাড়ির পেছনে কোনও দরজা নেই।

অর্থাৎ, এখনও ভেতরে রয়ে গেছে টার্গেট। ভারী গলায় দলের উদ্দেশে বলল সে, ‘খুঁজে বের কর্ ওদেরকে!’

.

মাসুদ রানার যুক্তি সহজ। একদল সশস্ত্র লোক কারও বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়লে, বাড়ির মালিকের অধিকার আছে নিজেকে রক্ষা করার। তাই বিদ্যুৎ বেগে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে রানা। মুহূর্তে পৌঁছে গেছে টেবিলের পাশে। তুলে নিয়েছে বেযুখফের পুরনো বন্দুক। ওটার গুলিতে মরেছে সামনের দু’জন। তখনই ফুরিয়ে গেল গুলি। পরের সেকেণ্ডে মসিন নাগান্ট রাইফেল ব্যবহার করেছে রানা। দুই বুলেটের আঘাতে মারা গেছে তৃতীয়জন। কিন্তু লিভার টানতে গিয়ে রানা বুঝল, গুলির খোসা আটকে গেছে ইজেক্টর-এ। এখন ওই রাইফেল বড়জোর কাজ দেবে ক্রিকেট খেলায়। পরের দেড় সেকেণ্ডে আবারও সশস্ত্র হয়ে নিয়েছে রানা। তারপর নিকোলভ, ইউনা, বেযুখফ ও তানিয়াকে তাড়া দিয়ে নিয়ে ঢুকে পড়েছে বাড়ির আরও ভেতরে। তখনই হুড়মুড় করে বাড়িতে ঢুকল আক্রমণকারী দলের অন্যরা।

কোথায় আছে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই রানার। শুধু এটা বুঝেছে, হামলাটা হয়েছে হঠাৎ। যেভাবেই হোক ওদেরকে খুঁজে নিয়েছে এরা। কাজেই প্রথমে প্রাণ বাঁচাতে হবে, পরে সুযোগ পেলে জেনে নিতে হবে এরা কারা, কোন দিকে গেলে বাঁচা যাবে।

বিদ্যুৎ নেই। বাড়ির ভেতরে অন্ধকার। তবে রানার জোগাড় করা সাবমেশিন গানের নলের ওপর জ্বলছে ট্যাকটিকাল রশ্মি। সেই আলোয় এগোল ওরা। সংকীর্ণ প্যাসেজ পেরোতেই সামনে পড়ল ছোট্ট কিচেন। কুবাস পেয়ে নাক কুঁচকে গেল রানার। প্রায় অন্ধকারে দেখল নোংরা কিচেনে রয়ে গেছে বাসি তরকারির আবর্জনা। রানার পাশেই নিকোলভ। শক্ত হাতে ধরেছে ইউনার ডান কবজি। যে-কোনও সময়ে কেঁদে উঠবে মেয়েটা, তাই আরেক হাতে চেপে ধরে আছে ওর মুখ। মহুয়া ফল খেয়ে মাতাল হওয়া ভালুকের মত টলতে টলতে কিচেনে ঢুকল বেযুখফ। সবার শেষে ভেতরে পা রাখল তানিয়া। দরজা বন্ধ করে চাবি মেরে পুরনো আমলের লোহার তালা আটকে দিল রানা।

বেশিক্ষণ টিকবে না উনিশ শতকের এই তালা। কিচেনের আরেক পাশে প্রাচীন এক ইলেকট্রিক স্টোভ দেখে ওটা হ্যাঁচকা টানে দেয়ালের সকেট থেকে উপড়ে আনল রানা। লিনোলিয়াম মেঝেতে ছেঁচড়ে নিয়ে রাখল দরজার সামনে। ওটা কাজ করবে ব্যারিয়ারের মত। চারপাশে তাকাল। কিচেনে কোনও জানালা বা দ্বিতীয় কোনও দরজা নেই। মৃদু স্বস্তি বোধ করল। ভেতরে ঢুকতে হলে ব্যবহার করতে হবে একমাত্র দরজাটা। পরক্ষণে বুঝল, খারাপ দিক, ছোট্ট ঘরে আটকা পড়েছে ওরা!

এবার কী করবে ভাবছে রানা, এমনসময় শুনল প্যাসেজে বুটের ভারী শব্দ। গায়ের জোরে কবাটে ধাক্কা দিল কেউ। পরক্ষণে এল দ্বিতীয় ঘা। থরথর করে কেঁপে উঠেছে দরজার চৌকাঠ। যে-কোনও সময়ে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকবে হামলাকারীরা। কিছুক্ষণের জন্যে তাদেরকে নিরস্ত করতে সাবমেশিন গান থেকে দরজা লক্ষ্য করে তিনটে গুলি পাঠাল রানা। কাঠ ভেদ করে ওদিকে গেছে বুলেট। কাশতান সাবমেশিন গান খাটো ও মোটা অস্ত্র। ব্যবহার করে কম শক্তির নাইন এক্স এইটিন এমএম ম্যাকারভ কার্ট্রিজ। ওটা সাধারণ নাইন এমএম প্যারাবুলাম বুলেটের চেয়ে কম গতির। তবে করেছে নিজের কাজ। দরজার ওদিক থেকে ধাক্কা থেমে গেছে।

খপ্ করে কাঁধ ধরে নিকোলভকে দরজার সামনে থেকে সরাল রানা। এখন যে-কোনও সময়ে ওদিক থেকে আসবে গুলি। পেরোল কয়েক মুহূর্ত। রানার মনে পড়ল, নিকোলভ বলেছিল তাকে জীবিত চায় ওরা। বোধহয় মিথ্যা বলেনি সে। সেক্ষেত্রে এখন কী করবে তার শত্রুরা?

ব্যবহার করতে পারে টিয়ার গ্যাস অথবা স্টান গ্রেনেড।

নিজে হলে সাধারণ একটা দরজার কাছে হার মেনে নিত না রানা। এরাও বসে থাকবে না।

ভীষণ ভয় পেয়েছে ইউনা। বাবা জড়িয়ে ধরেছে ওকে। ইল মাছের মত গা মোচড়াচ্ছে মেয়েটা। নিকোলভ ভয় পাচ্ছে যে-কোনও সময়ে ব্যথা পাবে ইউনা। অন্ধকারে ছেড়ে দেয়াও ‘সম্ভব নয়। ট্যাকটিকাল আলোয় বেযুখফকে দেখল রানা। ভয় পেয়েছে লোকটা। চলে গেল কিচেনের কাউন্টারের পাশে। ওখান থেকে নিল করাতের মত দাঁতওয়ালা একটা ছুরি। নানাদিকে ওটা দোলাতে শুরু করেছে খ্যাপাটে লোকটা। রাশান ভাষায় চিৎকার করে উঠল: ‘সাহস থাকলে আয়, শালারপো-শালারা! কুত্তার বাচ্চা! হারামজাদারা!’

বেযুখফের চেয়ে ঢের বেশি ট্রেইণ্ড লোককেও বোকামি করতে দেখেছে রানা। কেউ কেউ তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিজের বা দলের অন্যদের জখম করেছে। বাইরে একদল সশস্ত্র লোক। এখন ছোট্ট কিচেনে এদিক ওদিক ছোরা চালাতে গিয়ে যে-কাউকে আহত করতে পারে বেযুখফ।

দুই কদমে তার মুখোমুখি হলো রানা। বামহাতে নিল অস্ত্র। ওটার নলের ওপর আলো। ডানহাতে বেযুখফের কবজি মুচড়ে ছোরাটা কেড়ে নিল ও। গেঁথে দিল কিচেনের ওঅর্কটপে। সাবমেশিন গানের নল ঠেসে ধরল লোকটার থুতনির নিচে। নিচু স্বরে বলল, ‘মাথা ঠাণ্ডা রাখো। নইলে খুন হবে আমার হাতে।’

হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেল রাশান। চুপচাপ ফোঁস- ফোঁস শ্বাস ফেলছে। দুই ঠোঁটের কোণে জমেছে সাদা ফেনা।

ব্যাটার হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে নাকি? ভাবল রানা।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল বেযুখফ।

দরজার কাছ থেকে সরে গেছে শত্রুরা। নিশ্চয়ই স্থির করছে এরপর কী করবে। বেশিক্ষণ সময় পাবে না রানা। এরই ভেতর খরচ করেছে সাবমেশিন গানের তিন ভাগের এক ভাগ বুলেট। একবার ম্যাগাযিন খালি হলেই অস্ত্র বলতে থাকবে হাঁড়িকুঁড়ি, তরকারি ও মাংস কাটার ছুরি।

চারদেয়াল ইঁটের। মাথার ওপরের ছাত ভারী কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি। মেঝে পাথরের স্ল্যাবের। কোনওদিক দিয়েই বেরোবার উপায় দেখছে না রানা।

‘তাতভ, তোমার গোপন ঘর!’ নিচু স্বরে বলল নিকোলভ।

২৯

বোধহয় নিকোলভের কথা বুঝতে পারেনি বেযুখফ। তবে হঠাৎ ঘুমন্ত কারও মুখে বালতি ভরা ঠাণ্ডা পানি ঢাললে যেমন চমকে ওঠে, সেভাবে ঝাঁকি খেল সে। বিড়বিড় করল, ‘আমার গোপন ঘর!’

‘ওটা কোথায়?’ জানতে চাইল রানা। যে-কোনও সময়ে দরজা ভাঙবে সশস্ত্র আততায়ীরা। তাদেরকে ঠেকাবার মত যথেষ্ট গুলি বা লোকবল, কোনওটাই রানার নেই।

টলতে টলতে অন্ধকার ঘরের আরেক দিকে গেল বেযুখফ। তার ওপর ট্যাকটিকাল রশ্মি ফেলল রানা। আবছাভাবে দেখল, সিঙ্কের পাশে একটা কাবার্ডের সামনে ঝুঁকল লোকটা। টান দিয়ে খুলল একটা ড্রয়ার। ভেতরে কনুই পর্যন্ত ভরল। শক্ত হাতে ধরেছে ভারী কিছু। একটা ক্লিক আওয়াজ পেল রানা। বেযুখফ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুই হাতে টান দিতেই কবজায় ভর করে সরে গেল কাবার্ড। এতে কী লাভ, বুঝে পেল না রানা। কিন্তু তখনই ওর চোখে পড়ল, কাবার্ড যেখানে ছিল, সেই মেঝেতে তৈরি হয়েছে ম্যানহোলের সমান একটা গর্ত।

যত্নের সঙ্গে কেটে নেয়া হয়েছে মেঝের ফ্ল্যাগস্টোন। ওখানে রয়েছে ধাতুর তৈরি স্লাইডিং ট্র্যাপডোর। নিচে কী আছে বোঝার উপায় নেই। টান দিয়ে ট্র্যাপডোর সরাল বেযুখফ। নিচে বৃত্তাকার কালো গর্ত। ওদিক দিয়ে নেমে যেতে পারবে মোটা বেযুখফ। সাবমেশিন গানের আলোয় রানা দেখল, গর্তের একপাশে রাং মই। তিনফুট নিচে চওড়া হয়েছে জায়গাটা।

গর্তে নামার পর কোনদিকে যেতে হবে, জানা নেই রানার। তবে বুঝে গেল, ওপরে না থেকে নিচে নেমে যাওয়াই উচিত।

‘চলো,’ তাড়া দিল রানা। আলো ফেলল গর্তের ভেতর। ইউনাকে ছেড়ে দিল নিকোলভ। ইশারা করল নেমে পড়ার জন্যে। বিস্ফারিত হয়েছে মেয়েটার চোখ। তর্ক করার সাধ্য নেই। একবার দেখল চকচকে অ্যালিউমিনিয়ামের রাং মই, তারপর নেমে গেল নিচে। ওর পর গেল নিকোলভ। তারপর ধীর ভঙ্গিতে গর্তে নামল বেযুখফ। ওর ওজনে ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ তুলল মই। অধৈর্য হয়ে অপেক্ষায় থাকল রানা।

‘আমার এসব ভাল লাগছে না,’ বিড়বিড় করল তানিয়া। মাথা নাড়ল বারকয়েক।

‘আর কোনও উপায় নেই,’ বলল রানা। ‘জলদি নামো!’

চেহারায় আপত্তি নিয়ে নেমে গেল তানিয়া। ওর পর বসে পড়ে মইয়ে পা রেখে তরতর করে নামল রানা। নিচে মাঝারি গুদামঘরের মত জায়গা।

রানাকে পাশ কাটিয়ে গর্ত বরাবর থামল বেযুখফ। ওপর থেকে ঝুলছে দড়ি। ওটা টেনে দেয়ায় মাথার ওপরে কিচেনের কাবার্ড আটকে গেল ঠিক জায়গায়। ট্র্যাপডোরের নিচের হ্যাণ্ডেল টান দিতেই পিছলে জায়গামত বসে গেল গোপন দরজা। ওপর থেকে কেউ দেখবে না ওই গর্ত। নিচ থেকে দুটো ভারী ছিটকিনি লাগিয়ে দিতেই বদ্ধ জায়গায় বন্দি হলো ওরা।

অন্ধকারে চারপাশে তাকাল রানা। কিছুই দেখতে পেল না।

‘আলো জ্বেলে নিতে হবে,’ বলল নিকোলভ।

কথা শেষ হতে না হতেই জ্বলে উঠল গ্যাস কার্ট্রিজ ক্যাম্পিং লণ্ঠন। জোর আলো দিচ্ছে ওটা। রানা বুঝে গেল, বাড়ির তলে মাটি খুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে এই সেলার বা ডাগ আউট। চারদেয়াল শক্ত মাটি ও পাথরের তৈরি। সিমেন্টের মেঝেতে মোটা কাঠের খুঁটি। কিচেন ও পাশের ঘরের মেঝের ওজন নিচ্ছে ওগুলো।

‘তুমি তৈরি করেছ?’ বেযুখফের কাছে জানতে চাইল রানা।

ওপর-নিচ মাথা দোলাল বেযুখফ। সামনে বাড়িয়ে দিল দুই দানবীয় হাতের তালু। ওখানে বড় বড় কড়া। তাকে মনে হলো খুব গর্বিত। এ কাজ শেষ করতে তার লেগেছে অন্তত কয়েক মাস। জায়গাটা বড় ওয়াইন সেলারের মত। তবে এখানে গুদাম করা হয়েছে অন্য জিনিস। দেয়ালে দেয়ালে র‍্যাক ভরা জরুরি রসদ। কয়েক ট্রাক টিনের খাবার ও বড় কয়েকটা ব্যারেলে রয়েছে পানি। মার্কার পেন দিয়ে লেখা কতদিন ভাল থাকবে ওগুলো। কয়েকটা ক্রেট-এ সার্ভাইভাল গিয়ার, পানি পিউরিফিকেশন ট্যাবলেট, আগুন ধরাবার ইকুইপমেন্ট, ব্যাটারি ও যন্ত্রপাতি। রানা আরও দেখল একটা হ্যাযম্যাট সুট ও কয়েকটা গ্যাস মাস্ক। বুঝে গেল, মাথার ওপর আণবিক বোমা না ফাটলে এ রসদে ওদের চলবে অন্তত কয়েক মাস।

ঠিক সময়ে সেলারে নেমেছে ওরা। ওপরে আবছা আওয়াজ, যেন আসছে বহু দূর থেকে। র‍্যাম দিয়ে গুঁতো মারা হলো কিচেনের দরজায়। মৃদু আওয়াজ পদশব্দের। কিচেনে ঢুকেছে অ্যাসল্ট টিম। নিশ্চয়ই বিস্মিত- কোথায় গেল মানুষগুলো?

তবে হামলাকারীরা নিরেট গাধা নয়। সময় নিয়ে কিচেনের প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করবে তারা। বুঝে যাবে কোথায় আছে রানারা। তখন ফ্ল্যাগস্টোন উপড়ে হুড়মুড় করে নামবে নিচে।

বেযুখফের গোপন আস্তানায় নেমে বড়জোর কয়েক মিনিট বাড়তি সময় পেয়েছে, বুঝল রানা। খারাপ দিক হচ্ছে, এখান থেকে বেরোতে পারবে না ওরা।

‘ইঁদুরের ফাঁদে আটকা পড়েছি,’ বলল রানা। ‘নাকি তোমার আস্তিনে নতুন কোনও কৌশল আছে, বেযুখফ?’

‘পালিয়ে যাওয়ার পথ না রেখে ঘর তৈরি করেছি ভেবেছ?’ একটু দূরের ছায়া দেখাল বেযুখফ। তাক থেকে নিল আরেকটা গ্যাস লণ্ঠন। ওটা ‘হুফ!’ শব্দে জ্বলে উঠতেই রানা দেখল, কোন্ পথে সরানো হয়েছে টনকে টন পাথর ও মাটি। কিচেনের ভেতর দিয়ে না নিয়ে পুরু মাটির দেয়াল খুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে বেযুখফ। দেয়াল বা ছাত যেন ধসে না পড়ে, সেজন্যে ওজন রাখতে ব্যবহার করেছে কাঠের খুঁটি। সুড়ঙ্গের মেঝে ধীরে ধীরে উঠেছে সমতলের দিকে। কী ভয়ানক পরিশ্রম করে মাটি-পাথর খামারের নানাদিকে সরিয়েছে লোকটা, ভাবতে গিয়ে অবাক হলো রানা।

সুড়ঙ্গের ভেতর বেযুখফ বসিয়ে নিয়েছে ভারী ধাতব দরজা। ওটা মেডিইভেল আমলের কামারদের তৈরি, ভাবল রানা। সরাসরি রকেট লাগলেও ভাঙবে না। কবাটের একপাশে মোটা ছিটকিনি। কয়েক পা সরে বোল্ট খুলে কবাট সরাতে চাইল রানা। ক্র্যাচ-ক্রোঁচ আওয়াজে খুলল দরজা। কয়েক বছর পর সেলারে ঢুকল তাজা বাতাস।

‘ভাবিনি কোনওদিন এ পথ ব্যবহার করতে হবে!’ বিড়বিড় করল বেযুখফ।

গোপন কক্ষ এবং সুড়ঙ্গ খুঁড়ে নেয়ার পর বাইরে বেযুখফ রেখেছে মাঝারি ড্রেনের মত জায়গা। বিশেষভাবে খেয়াল না করলে কেউ বুঝবে না, ওটা কী। চারপাশে ঝোপঝাড়।

সবার আগে ড্রেনের মত জায়গাটা দিয়ে অস্ত্র হাতে বেরোল রানা। সরাতে হলো ছাগলের ভুসি রাখার পুরনো কয়েকটা বস্তা। একদিকে দেয়াল, তিনদিকে ঘন ঝোপ। আকাশে মিটমিট করছে কোটি নক্ষত্র। বাড়ির সামনে হৈ-চৈ করছে অ্যাসল্ট টিমের কয়েকজন। রেডিয়োর খড়-খড় শুনল রানা। এদিক ওদিক ছুটছে সশস্ত্র দু’চারজন। প্রচণ্ড খেপে ঘেউ-ঘেউ করছে শিকারি কুকুরটা।

সাবমেশিন গান হাতে ঝোপের মাঝ দিয়ে এগিয়ে বাড়ির কোণে থামল রানা। সতর্ক চোখে তাকাল চারপাশে। বাতাসে রাবার ও ফিউয়েল পোড়ার কটু গন্ধ। দক্ষিণে টিলা থেকে প্রথমবারের মত খামারবাড়ি দেখেছিল রানা। চূড়ার কাছে জ্বলছে কালো মার্সিডিয। ধোঁয়া ঢেকে দিয়েছে ওদিকে আকাশের তারা।

তারা। বাড়ির পাশে জ্বলছে বৈদ্যুতিক ট্র্যান্সমিটার। নানাদিকে কমলা ফুলকি ছিটকাচ্ছে ক’টা পুরু বিদ্যুৎবাহী তার। দুই বিস্ফোরণের আওয়াজ কীসের, বুঝল রানা। বোমা ব্যবহারের পর পর সদর দরজা ভেঙে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে অ্যাসল্ট টিম।

জ্বলন্ত মার্সিডিযের দিকে চেয়ে মন খারাপ হলো রানার। ওই গাড়ির ভেতর ছিল ওর ব্যাগ, যন্ত্রপাতি আর লুকা ব্রেযনেভের দেয়া নগদ পাঁচ লাখ রুবল। টাকা নিয়ে আফসোস নেই। কিন্তু ওই ব্যাগটা ছিল ওর বহু দিনের সঙ্গী।

এক এক করে সেলার থেকে বেরিয়ে এসেছে সবাই। নিরাপদে পৌঁছে গেল রানার পাশে। যত হৈ-চৈ, তার বেশিরভাগ বাড়ির ভেতর ও সদর দরজার কাছে। অ্যাসল্ট টিমের কমাণ্ডার দলের কাউকে বাড়ির কোণ ঘুরে এদিকটা দেখতে বললে শুরু হবে বড় ধরনের ঝামেলা। একা হলে ভাবত না রানা, কিন্তু ওর অদক্ষ দলে রয়েছে আতঙ্কিত এক বাচ্চা মেয়ে, দুই নার্ভাস লোক ও নীরব এক মহিলা ডিটেকটিভ। অবস্থা আত্মবিশ্বাসী হওয়ার মত নয়।

ইউনা নিজেকে সামলে নিয়েছে বুঝে মৃদু স্বস্তি পেল রানা। গম্ভীর হয়ে গেছে মেয়েটা। হয়তো ভাবছে, এম টেন ফেডারেল হাইওয়েতে কত বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে বাবাকে। চোখ তুলে নিকোলভকে দেখল ইউনা। ডাচ ভাষায় বলল, ‘এরা কি আমাদের ক্ষতি করতে এসেছে?’

মেয়ের ঠোঁটে আঙুল রাখল নিকোলভ। ‘শশ্। ওদেরকে তোমার কোনও ক্ষতি করতে দেব না।’

‘টোমার কী হবে?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল ইউনা।

‘আটকে রাখলে না খেয়ে মরবে,’ রানার দিকে তাকাল নিকোলভ।

‘খিদে লাগলে মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে যাবে,’ বলল রানা। ওর মন এখন ব্যস্ত পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা তৈরির কাজে।

রানার কাঁধে ঠোকা দিল বেযুখফ। আঙুল তুলে দেখাল পশ্চিমে ছাগলের খোঁয়াড়। ওদিকেই সবচেয়ে কাছে জঙ্গল। ফিসফিস করল রাশান, ‘একবার ফাঁকা জায়গা পেরোলে পৌঁছুতে পারব আমার ট্রেইলারে।’

‘এরই ভেতর ওটা খুঁজে বের করেছে কি না, তা বুঝবে কী করে?’ জানতে চাইল রানা।

‘ওদের সাধ্য নেই যে ওটা খুঁজে বের করবে।’

চিন্তায় পড়ে গেছে রানা। ওদিকে গেলে পেরোতে হবে পুরো উঠান। দেখা যাবে খামারবাড়ির সদর দরজা থেকে। বিদ্যুৎ নেই বলে অন্ধকারে ডুবে আছে বাড়ি। কিন্তু কয়েকজন ভিড় করেছে দরজার কাছে। জ্বলন্ত গাড়ি বা বৈদ্যুতিক ট্র্যান্সমিটারের আগুন আলোকিত করেছে উঠান। ভাগ্যদেবী সহায়তা না করলে নির্ঘাত ধরা পড়বে ওরা। আবার এ-ও ঠিক, বেশিক্ষণ নিরাপদে থাকতে পারবে না এখানে। মন্দ বলেনি বেযুখফ।

সিদ্ধান্ত নিতে মাত্র তিন সেকেণ্ড ব্যয় করল রানা। কিন্তু ওই তিন সেকেণ্ড ঢের বেশি বেযুখফের জন্যে। রানাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নয় মাসের গর্ভবতী মহিলার অনুকরণে ছুট লাগাল সে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *