বিশ
‘ইউনা,’ নিচু গলায় তানিয়াকে বলল রানা। ‘ভয় পেয়েছে। তবে ওর কোনও ক্ষতি হয়নি।’
‘দেখতে দিন,’ হাত বাড়িয়ে দিল তানিয়া। তবে ওর হাতে বিনকিউলার দিল না রানা। চোখ বোলাচ্ছে খামারবাড়ির উঠানে। মোটা লোকটার হাতে জ্বলন্ত টর্চ। শান্ত হয়ে গেছে সে। চিরকালের জন্যে যেন চেঁচিয়ে চলেছে কুকুরটা।
ওটার নাম ধরে ডাকল লোকটা। ‘টোমা!’
পাত্তা দিচ্ছে না কুকুরটা।
রেগে গেল মালিক। তার ধমক শুনে ঘেউ-ঘেউ বন্ধ করল সারমেয়। লেজ নাচাতে নাচাতে হাজির হলো মালিকের কাছে। ওটার কলার চেপে ধরে উঠানের চারপাশ দেখল লোকটা। তারপর কুকুরটাকে নিয়ে বাড়ির দিকে চলল। দরজা থেকে পিছিয়ে গেল ইউনা। টোমাকে টেনে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল লোকটা। তার পেছনে ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজে দরজা বন্ধ করল নিকোলভ। অন্ধকার হয়ে গেল নীরব উঠান। চোখ থেকে বিনকিউলার নামিয়ে ঢালু জমি থেকে পিছিয়ে গেল রানা।
‘যাক, পাওয়া গেল ওকে,’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল তানিয়া, ‘দারুণ দেখিয়েছেন কিন্তু, কমরেড মেজর।’
‘এখনও মেয়েটাকে হাতে পাইনি,’ নরম সুরে বলল রানা। ‘এবার শুরু হবে আমাদের আসল কাজ।’
‘একটা চাষা, এক বিটনিক আর এক বাচ্চা মেয়ে- আপনার ভয় কীসের?’
‘বলিনি ভয় পেয়েছি,’ বলল রানা। ‘তবে বুলেট বলে খারাপ একটা জিনিস আছে। মানুষের ক্ষতি করতে পারে। শরীরে বাকশট বিঁধলেও ভাল লাগে না। গোটা শরীরে অসংখ্য ফুটো নিয়ে মস্কোয় পৌছুলে মহাবিরক্ত হবে তোমার ডিটেকটিভ এজেন্সি।’
‘আমার জন্যে অত ভাবতে হবে না। আমি তো জানতাম বিপদ, ঝুঁকি কিচ্ছু পরোয়া করেন না আপনি।’
‘একেবারে কিছুই পরোয়া না করলে এতদিনে সাড়ে- চারহাত মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকতাম।’
‘তা হলে এখন কী করবেন ভাবছেন?’
‘ওই বাড়িতে অন্তত দুটো আগ্নেয়াস্ত্র। ধরে নাও ওদের কাছে গুলিও আছে। এমন নয় যে আমাদের গ্রামীণ বন্ধু খরগোশ বা কাক কখনও মারেনি। আমরা হাজির হলে হয়তো দেরি করবে না ট্রিগার টিপতে। তা ছাড়া, তারা আছে আতঙ্কের ভেতর। ছায়া দেখলেও গুলি করবে। আমাদের বিপক্ষে কাজ করবে ওই কুকুরের কান ও নাক। সুতরাং ধরে নাও, চট্ করে মেয়েটাকে পাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ।’
‘আগেও এসব কাজ করেছেন।’
‘দু’একবার।’
‘তো কী করবেন ভাবছেন?’
‘তোমার সাহায্য লাগবে।’
‘শুনেছি আপনি একা কাজ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু বাস্তবে দেখছি অনেক সাহায্য লাগে আপনার। এবার কী করতে হবে আমার?’
‘তোমার লোভনীয় সঙ্গ পেলেই হবে,’ বলল রানা।
‘তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। ‘
‘তো চলো কাজে নামি। চেষ্টা করব আগামী ভোরের আগেই মেয়েটাকে ওর নানার জেট বিমানে তুলে দিতে।’
‘আর তার বাবা?’
‘তাকে নিয়ে ভাবছি না। খামারে থাকুক মুরগি, কুকুর আর ছাগল নিয়ে।’
প্রথমে কুকুর সামলাতে হবে, ভাবছে রানা। ওটাকে ডেকে নেয়ার সময় রাগ ছিল মালিকের কণ্ঠে। কারণ ছাড়াই হয়তো ঘেউ-ঘেউ করে কুকুরটা। বিষয়টা কাজে আসতে পারে।
আঁধার নেমেছে চারপাশে। গলায় বিনকিউলার ঝুলিয়ে গাড়ির কাছে ফিরল রানা। লক করল গাড়ি। ওটার ভেতর রয়ে গেল ব্যাগ ভরা জিনিসপত্র। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে খামারের দিকে নামতে লাগল রানা। পিছু নিয়ে তানিয়া বলল, ‘আমাকে আবার ছাগলের ধারে কাছে যেতে বলবেন না যেন।’
‘জীবনেও না।’
কয়েক মিনিট পর তারের বেড়ার পাশে পৌঁছল ওরা। দূর থেকে ঘুরে দেখল চারপাশ। কাঁটা গাছের কারণে পোশাক নষ্ট হলেও অভিযোগ তুলল না তানিয়া। একটু পর বাড়ির দিক থেকে এল হালকা হাওয়া। ওদের গায়ের গন্ধ পাবে না কুকুর। রেকির সময় রানা বুঝল, বাড়ির দু’পাশে বা পেছনে জানালা বা দরজা নেই।
ঢুকতে বা বেরোতে ব্যবহার করা হয় একমাত্র দরজাটা। খুশি হলো ও। ত্রিশ গজ দূরে ছাগলের খোঁয়াড়। ঝুঁকে মাটি থেকে পাথর তুলল ও। ওটা আকারে গল্ফ বলের সমান। আয়তাকার খোয়াড় ডুবে আছে অন্ধকারে। আন্দাজে ওদিকে পাথর ছুঁড়ল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর শুনল টিনের চালে ‘ঠং-ঠনাৎ!’ আওয়াজ। ম্যা-ম্যা করে ডেকে উঠল ছাগল- গুলো। চমকে গেছে গায়ের কাছে আওয়াজ শুনে। অতটা দূর থেকে পাথর পড়ার আওয়াজ শুনবে না বাড়ির কেউ কিন্তু শুনতে পেয়েছে শিকারি কুকুর। নতুন উদ্যমে চালু হলো ঘেউ-ঘেউ। উঠান দেখা যাবে এমন এক ঝোপে লুকিয়ে পড়ল রানা ও তানিয়া। বিনকিউলার চোখে লাগাল রানা।
‘ভাল সব খেলনা নেবে ছেলেরা,’ বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করল তানিয়া।
‘ঈর্ষা বড়ই খারাপ জিনিস, কমরেড, ফিসফিস করে মেয়েটাকে বলল রানা।
‘আমি খুশি হব কমরেড বলে না ডাকলে।’
‘আমিও খুশি হব মেজর বলে না ডাকলে।’
ক’মুহূর্ত পর খুলল বাড়ির দরজা। কথা বলছে নিকোলভ ও তার বন্ধু। বিস্ফোরণের মত আওয়াজ তুলছে কুকুরটা। দরজা থেকে সরে ছেড়ে দেয়া হলো ওটাকে। সরাসরি ছাগলের খোঁয়াড়ের দিকে ছুটল সারমেয়। আরও ভয় পেয়ে গেল নিরীহ ছাগল। আবার উঠানে বেরোল নিকোলভ ও তার বন্ধু। দু’জনের হাতে বন্দুক ও রাইফেল। অবশ্য মিনিট তিনেক পর বুঝল, ধোঁকা খেয়েছে কুকুরের চিৎকারে। রেগে গেল মোটা লোকটা। দ্বিগুণ জোরে কুকুরটাকে ডাকল। ছুটে তার কাছে ফিরল অনুগত প্রাণী। নিচু করে নিয়েছে মাথা। ভাবটা এমন: ‘ঠিক আছে, বাপ। না হয় একটু ভুলই হয়েছে; তাতে অত রেগে যাওয়ার কিছু নেই।’
ওটার কলার ধরে আবারও বাড়ির ভেতর ঢুকল লোকটা। পিছু নিল নিকোলভ। এখনও অস্বস্তি নিয়ে খোঁয়াড়ের ভেতর নড়াচড়া করছে ছাগলগুলো।
‘এসো,’ ফিসফিস করল রানা। তারের বেড়ার বাইরে রয়ে গিয়ে পুরো খামার চক্কর দিল ওরা। আবার থামল বাড়ির সামনের দিকের বেড়ার কাছে। পরিষ্কার দেখল জানালা ও দরজা। একটা পর্দা দেয়া জানালায় মৃদু আলো। অন্যটা থেকে বেরিয়ে হলদে উজ্জ্বল আলো পড়েছে গাড়ির ওপর। বিনকিউলার ব্যবহার করেও ইউনাকে কোথাও দেখল না রানা। তবে মেয়েটার বাবা বসেছে টেবিলের ধারে। চোখ বোলাচ্ছে সেই খবরের কাগজে। পাশে ভোদকার বোতল। একটু পর পর গ্লাসে ঢেলে ঢক করে গিলছে স্বচ্ছ তরল। তার হাতের নাগালের কাছেই সাইডবোর্ডে ঠেস দিয়ে রেখেছে পুরনো মসিন নাগাণ্ট রাইফেল। রানার মনে হলো, নিকোলভ আসলে সন্তুষ্ট এক পলাতক অপরাধী, যে ভাবছে: কেউ ধরতে পারবে না তাকে।
‘শেষবারে কাজ হওয়ার কথা,’ নিচু গলায় বলল রানা। ধুলো থেকে তুলল আরেকটা পাথর। পাথর। এবার ছুঁড়ল গাড়িগুলোর দিকে। ফোক্সভাগেন বিটলের নাকে লেগে ‘ঠং!’ করে উঠল পাথরের টুকরো। নতুন করে খামারবাড়ির ভেতর চালু হলো বজ্রপাতের মত আওয়াজ। সবার কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে কুকুরটা।
ঠাস্ করে খুলল বাড়ির দরজা। তীর বেগে ভেতর থেকে বেরোল শিকারি হাউণ্ড। সোজা গেল গাড়ির দিকে। সত্যিকারের ভাল পাহারাদার। এরপর কী ঘটবে বুঝতে পেরে বেচারার জন্যে দুঃখই লাগল রানার।
একুশ
মহাবিরক্ত হয়েছে ভারী গড়নের লোকটা। ঝড়ের বেগে দরজায় পৌঁছুল সে। পাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল বন্দুক। সামনে বেড়ে খপ্ করে ধরল কুকুরের কলার। গালি দিচ্ছে অনর্গল। টেনেহিঁচড়ে কুকুরটাকে নিল বাড়ির পাশের করাগেটেড টিনের ঘরের কাছে। একটু দূরে পিকআপ ও নিকোলভের ফোক্সভাগেন বিটল। টান দিয়ে ছাউনির দরজা খুলল লোকটা। আর তখনই পাথরের মূর্তির মত জমাট বেঁধে গেল মৃদু ক্লিক-ক্লিক আওয়াজ শুনে। পাঁচ হাত পেছনে কক করা হয়েছে বন্দুকের দুই হ্যামার!
শক্ত হাতে কুকুরের কলার ধরে ঘুরে তাকাল নিকোলভের বন্ধু। আতঙ্ক নিয়ে দেখল উঠানের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে কে যেন। অস্ত্র তাক করেছে তার দিকেই। ছায়ামূর্তির পাশে এসে দাঁড়াল আরেকজন। এই ছায়ামূর্তি নারীর। এইমাত্র এসেছে বেড়ার কাছ থেকে।
খামারবাড়ির ভেতর চেয়ার ছাড়ল নিকোলভ। তবে কয়েক মুহূর্ত পর আবারও বসে পড়ল। চুমুক দিল ভোদকার গ্লাসে। কুকুরের ঘেউ-ঘেউ পাত্তা না দিয়ে নতুন করে মনোযোগ দিল খবরের কাগজের পাতায়।
ওদিকে মোটা লোকটার ওপর থেকে চোখ সরাল না রানা। – নিচু গলায় বলল, ‘ছাড়বে না টোমাকে, কলার ছাড়লেই খুন হবে।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে,’ কাঁপা গলায় বলল মোটা লোকটা। খেপা জন্তুটার কলার ধরে রাখতে গিয়ে প্রচণ্ড টান পড়ছে তার হাতে।
‘লক্ষ্মী ছেলের মত ছাউনির ভেতর ওটাকে আটকে ফেলো,’ নির্দেশ দিল রানা। ‘কুকুরটাকে মেরে ফেলতে চাই না। তবে তোমার কথা আলাদা। কাজেই চালাকি করতে যেয়ো না।’
থরথর করে কাঁপছে লোকটার বাহু। যে-কোনও সময়ে ছুটে যাবে কুকুর। জোর করে ওটাকে ছাউনির ভেতর ভরল লোকটা। বন্ধ করল দরজা। প্রচণ্ড রাগে দরজার ওপর খামচি মারছে কুকুরটা। সেইসঙ্গে ভয়ঙ্কর গর্জন। কাঁপা দু’হাত মাথার ওপরে তুলে রানার দিকে ফিরল লোকটা। নিচু গলায় বলল, ‘দয়া করে গুলি করবেন না।’
তার বুকে বন্দুক তাক করেছে রানা। দুই হ্যামারের জন্যে রয়েছে আলাদা দুটো ট্রিগার। দুই আঙুলে দুই ট্রিগারের ওপর চাপ বাড়াল রানা। ‘নাম কী তোমার?’
‘তাতভ বেযুখফ,’ বেসুরো কণ্ঠে জানাল লোকটা।
‘বাচ্চা মেয়েটা কোথায়?’
বিস্ময় ও দ্বিধা ফুটল বেযুখফের চেহারায়। মাথার ইশারায় দেখাল পর্দা দেয়া জানালা। পুতিয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘বাচ্চা মেয়ে। দয়া করে ওর ক্ষতি করবেন না। শুনুন, প্লিয … ‘
‘চুপ! একদম চুপ! নইলে দু’টুকরো হয়ে যাবে,’ বলল রানা। ‘আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’
দরদর করে ঘামছে লোকটা। তার চেহারা দেখে রানার মনে হলো, যে-কোনও সময়ে ধপ্ করে মাটিতে বসে পড়বে সে। ‘আ… আপনারা… কী চান?’
মনে মনে হিসাব কষছে রানা। তানিয়াকে নিয়ে ঝড়ের বেগে বাড়ির ভেতর ঢুকলে হয়তো রাইফেল তুলে গুলি করবে নিকোলভ। হাতের কাছেই আছে ওটা। যে-কোনও দিকে যেতে পারে গুলি। হয়তো মারা পড়বে বাচ্চা মেয়েটা
সুতরাং, নিকোলভকে বের করে আনতে হবে বাড়ি থেকে।
বেযুখফকে বলল রানা, ‘নিকোলভকে ডাকো, বাইরে আসতে বলো।’
বাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে খবরের কাগজ পড়ছে নিকোলভ। টের পায়নি বাইরে কী ঘটছে। নতুন করে গ্লাসে ভরে নিল ভোদকা। ক্রমেই হয়ে উঠছে মাতাল। তবে রাইফেল এখনও হাতের নাগালে।
‘আপনারা আমাদেরকে খুন করবেন, তাই না?’ কাঁপছে বেযুখফের কণ্ঠ।
সত্যিই ভয় পেয়েছে, বুঝে গেল রানা। ভাবল, কী কারণে নিকোলভকে খুন করতে চাইবে কেউ? বিস্ময় চেপে রেখে বলল, ‘কথা না শুনলে আগে মরবে তুমি।
হাতের তালু দুটো সামনে বাড়াল লোকটা। চোখ পিটপিট করে পাপড়ি থেকে ঝরিয়ে নিল ঘামের ফোঁটা। ‘ঠি… ঠিকাছে। দয়া করে গুলি করবেন না। যা বলবেন, তাই করব। কী বলতে হবে আমাকে?’
‘বলবে: ‘অ্যাই, অ্যান্টোনিন, বাইরে এসে দেখো।’ কথা বলবে হালকা সুরে। সতর্ক করলে রেগে যাব!’ লোকটার দিকে বন্দুক তাক করে তানিয়ার দিকে তাকাল রানা। ‘মনে আছে, লেনিন বার-এ জাদু দেখিয়ে দিয়েছিলে? আবারও পারবে ওই একই কাজ করতে?’
জানালা দিয়ে আসা আলোয় চকচক করছে মেয়েটার চোখ। কাজে আসবে ভেবে খুশি।
‘তবে ক্ষতি করবে না নিকোলভের,’ সতর্ক করল রানা।
হালকা পায়ে দরজার পাশে গেল তানিয়া। পিঠ ঠেকিয়ে দিল দেয়ালে।
বেযুখফের দিকে ইশারা করল রানা। ‘শুরু করো।’
টলমল করে আলোকিত জানালার সামনে গেল বেযুখফ, আঙুলের গিঁঠ ব্যবহার করে টোকা দিল কাঁচে। ওই আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলল নিকোলভ। ওদিক থেকে চেয়ে আছে প্রিয় বন্ধু। ঢোক গিলল সে। চাপা স্বরে বলল, ‘বেরিয়ে এসো, অ্যান্টোনিন। একটা জিনিস দেখাব।’
রাইফেল হাতে টেবিল ছাড়ল নিকোলভ, সম্পূর্ণ সতর্ক।
সন্দেহ করেছে, বুঝে গেল রানা। এবার হয়তো মেয়েকে নিয়ে বাড়ির ভেতর রয়ে যাবে। অথবা, নায়কোচিতভাবে ছুটে বেরোবে বাইরে। মুখোমুখি হবে বিপদের।
অপেক্ষা করছে রানা।
সত্যিকারের হিরোর মত কাজ করল নিকোলভ। দড়াম করে খুলে গেল দরজা। লাফিয়ে বেরিয়ে এল সে। ব্যস্ত হাতে টানছে পুরনো আমলের রাইফেলের বোল্ট। একলোক বেযুখফের দিকে বন্দুক তাক করেছে দেখে আতঙ্কে বিস্ফারিত হলো তার দু’চোখ। ঝট্ করে রাইফেলের বাঁট কাঁধে তুলল। এবার গুলি করবে রানাকে। কিন্তু পেছন থেকে এল হ্যাঁচকা টান। পিছাতে বাধ্য হলো নিকোলভ। দক্ষ হাতে তার রাইফেল কেড়ে নিল তানিয়া আজোরভ। নিকোলভের পিঠে পড়ল কুঁদোর ঘা।
কাত হয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ল নিকোলভ। চোখ তুলে দেখল, মুখের বারো ইঞ্চি দূরে রাইফেলের মাযল। চিৎকার করে মেয়েকে সতর্ক করতে চাইল নিকোলভ, কিন্তু ঝড়ের বেগে পৌঁছে গেছে রানা। ডানহাতে চেপে ধরল তার মুখ।
বিস্ফারিত চোখে উঠে বসতে চাইল নিকোলভ। কিন্তু গলায় চাপ দিয়ে তাকে মাটিতে শুইয়ে রাখল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘অ্যান্টোনিন নিকোলভ, এখন আর চাইলেও পালাতে পারবে না। …এবার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেব। তবে চিৎকার করবে না। বাচ্চাটাকে ভয় দেখিয়ে দেয়ার কোনও মানে হয় না।’
ড্যাব-ড্যাব করে রানাকে দেখছে নিকোলভ। তুতলে উঠল, ‘আ… আ… আমি অ্যান্টোনিন নই। আপনি ভুল মানুষকে…’
‘মিথ্যা না-ই বা বললে, নিকোলভ,’ শান্ত স্বরে বলল রানা।
‘কে পাঠাল আপনাদেরকে খুন করতে?’ হঠাৎ রেগে গিয়ে জানতে চাইল নিকোলভ। ‘ভ্যানকিন কাপরিস্কি? ওকে বলবেন, ওটা বের করতে পারিনি। দূরে গিয়ে মরুক হারামজাদা! যা খুশি বলুন তাকে।’ পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছে সে। নরম সুরে বলল, ‘প্লিয, আমার মেয়েটার ক্ষতি করবেন না! পালিয়ে এসেছি বলে আমি দুঃখিত। ভীষণ ভয় পেয়েছি। তবে পরে…’
‘কী বের করতে পারোনি? কী বিষয়ে কথা বলছ?’ জানতে চাইল রানা।
দরজা দিয়ে আসা আলো আড়াল করল ইউনা। বেচারি ভীত এবং সন্ত্রস্ত্র। কেউ হুমকি দিচ্ছে ওর বাবাকে বুঝতে পেরে কেঁদে ফেলল। দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল রানার ওপর। কিল দেবে বিসিআই এজেন্টের বুকে। তবে খপ্ করে ওর ঘাড় ধরে পিছিয়ে নিল তানিয়া 1
‘মারবেন না ওকে!’ মুঠো পাকিয়ে সামনে বাড়ল বেযুখফ।
তার বুকে বন্দুক তাক করল রানা। ‘কারও ক্ষতি করতে আসিনি। না আপনার, না আপনার বন্ধুর মেয়ের। বুঝতে পারছি, অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে। আপনাদেরকে বলতে হবে বিষয়টা কী।’
বাইশ
অস্ত্রের মুখে নিকোলভ ও বেযুখফকে লিভিংরুমে নিল রানা। ইউনার পাহারায় রয়েছে তানিয়া। ঘরে টেবিল ছাড়া আসবাবপত্র বলতে কমদামি কয়েকটা চেয়ার ও একটা সোফা। ডেস্কে ছোট টিভি। রানা বন্দুক তাক করে রাখল, আর এ সুযোগে নিকোলভের দুই কবজি টিভির কেবল দিয়ে বাঁধল তানিয়া। একইভাবে বাঁধা হলো বেযুখফের কবজি। তাদের দু’জনকে সোফায় বসতে বলল রানা।
পাশাপাশি বসল দুই বন্ধু। টেবিলে বন্দুক ও রাইফেল রাখল রানা। দরকারে চট্ করে তুলে নেবে।
‘আপনাকে যদি ভ্যানকিন না পাঠিয়ে থাকে, তো কে?’ জানতে চাইল নিকোলভ। ‘আপনি কি পুলিশ?’
মৃদু মাথা নাড়ল রানা।
‘তা হলে আপনি কে?’
‘এসেছি তোমার মেয়েকে ফ্রান্সে ফেরত নেবার জন্যে, বলল রানা। ‘তুমি জানো, ওর নানা ক্ষমতাশালী মানুষ। তিনি ভাবছেন টাকার জন্যে নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করেছ তুমি।’
এ কথা শুনে চোয়াল ঝুলে গেল নিকোলভের। আপত্তির সুরে বলল, ‘ওই কাজ কেন করব? ও তো আমার মেয়ে!’
‘পরেরবার লুকিয়ে পড়ার আগে মেয়ের ভাঙা মোবাইল ফোনের কেসিং সরিয়ে রেখো,’ বলল রানা, ‘ওই সূত্র ধরেই এখানে এসেছি। ফোনের ভেতর ছিল ফোটো ও ভিডিয়ো। ঝামেলা হয়নি তোমাদেরকে খুঁজে নিতে। তোমাকে বুদ্ধিমান বলতে পারছি না।’
নীরবে কাঁদছে ইউনা। তাকে ধরে রেখেছে তানিয়া। নিকোলভের মেয়ে যে কিডন্যাপ হয়নি, সেটা বুঝতে সময় লাগেনি রানার। বাবার দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা, চোখে ভালবাসা।
নরম সুরে বলল রানা, ‘ইউনা, বুঝতে পারছি তুমি খুব ভয় পেয়েছ। শান্ত হও। একটা জিনিস দেখাব, তা হলেই বুঝবে মিথ্যা বলছি না।’ জ্যাকেটের পকেট থেকে ছবি বের করল রানা। ওটা লে ম্যান্সে তোলা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফোটো দেখল ইউনা। চোখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ। বুঝে গেছে, ওর মা ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না এ ছবি রানাকে।
তোমার মা চেয়েছেন যেন আমি এসে তোমাকে ফ্রান্সে নিয়ে যাই। খুব চিন্তার ভেতর আছেন তিনি।’
‘আমি আছি বাবার সঙ্গে! সেটা জানা থাকার কথা মা’র!’
‘তোমার বাবার জন্যেও দুশ্চিন্তা করছেন,’ নিকোলভকে দেখল রানা। ‘খুব কষ্টে আছেন তোমার নানাও। ভাবছেন, বড় ধরনের বিপদে জড়িয়ে গেছে তোমার বাবা।’
‘আমার মেয়ের কাছ থেকে দূরে থাকুন!’ রেগে গিয়ে বলল নিকোলভ। ‘ইউনা, এই লোকের একটা কথাও বিশ্বাস করবে না।
‘আমি তোমার বন্ধু, ইউনা,’ বলল রানা, ‘তোমার বাবারও। কারও ক্ষতি করতে আসিনি। যদিও তা বুঝতে পারছে না তোমার বাবা।’
একবার বাবাকে দেখল ইউনা, তারপর রানাকে। দ্বিতীয়বার দেখল ফোটো। এখন কাঁদছে না। লাল হয়েছে চোখ। অশ্রুতে ভেজা গাল। রানার কাছে জানতে চাইল, ‘নানা পাঠিয়েছেন আপনাকে?’
মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘তাঁর প্লেনে করেই রাশায় এসেছি। এবার তুমি আর আমি ফিরব ফ্রান্সে। ওখানে অপেক্ষা করছেন তোমার মা ও নানা। একবার ফিরলেই চড়তে পারবে তোমার পনিতে। ভেরোনিকা মোনিকে খুলে বলতে পারবে কত বড় অভিযানে গিয়েছিলে। আর ওই নিক ব্রাউনকেও বলতে পারবে সব।’
নিক ব্রাউনের কথা শুনে লজ্জায় লাল হলো ইউনার দুই গাল। জানতে চাইল ও, ‘আর বাবা? বাবা যেতে পারবে না?’
‘তোমার বাবা তো বাস করে রাশায়। আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না। তুমি তো বোধহয় এটা জানো?’
‘কিন্তু বাবার সঙ্গে থাকতে তো ভাল লাগছে আমার।’
‘পরে যে-কোনও সময়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারবে।’ নিজের কথাটা মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মত মনে হলো রানার।
‘ওর একটা কথাও বিশ্বাস করবে না, ইউনা!’ সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল নিকোলভ। কিন্তু পিঠের কাছে কেবল দিয়ে বাঁধা কবজি দুটো। কিছুই করতে পারবে না সে।
নিকোলভ ও বেযুখকে দেখল রানা। বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে কেউ খুন করতে পাঠালে এতক্ষণ বেঁচে থাকতে? ফালতু কথা বাদ দিয়ে বলো আসল ঘটনা কী।’
‘আমাদের মন নিয়ে খেলছ,’ ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল বেযুখফ। ‘ওটা পুরনো কৌশল।’
বাইরে ঘেউ-ঘেউ করছে কুকুর। ছাউনির পাতলা কাঠের দরজা আবছা করতে পারেনি গর্জন।
‘আমার নাম মাসুদ রানা,’ বলল রানা, ‘পুলিশ নই। কোনওকালেই ছিলাম না। বাংলাদেশের মানুষ। কাজ করি আধাসরকারি এক অফিসে। আমার বসের বন্ধুর অনুরোধে এখানে এসেছি তাঁর নাতনিকে তার মা’র কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে। এর ভেতর একতিল মিথ্যা নেই।’
তানিয়াকে দেখাল রানা। ‘ওর নাম তানিয়া আজোরভ। কাজ করে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিতে। ও-ই দেখিয়ে দিয়েছে নিকোলভের অ্যাপার্টমেণ্ট কোথায়। বাজে ঝামেলায় পড়েছ, নিকোলভ। আইন ভেঙে মেয়েকে নিয়ে উধাও হয়েছ বলে তোমার নামে পুলিশে নালিশ করবেন মিস্টার ব্রেযনেভ আর তাঁর ভাতিজি। ইউনা ফ্রান্সে পৌঁছুলেই হয়তো তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে আদালতে।’
‘আ… আমি ভাবিনি… যে,’ চুপ হয়ে গেল নিকোলভ।
‘নতুন করে আর কিছু ভাবতে যেয়ো না,’ একটু কঠোর সুরে বলল রানা। ‘যে কারণেই হোক, বিশেষ কাউকে ভয় পাও। তাই পালিয়ে এসেছ। একবারও ভাবোনি, তোমার পাগলামির কারণে নরকে বাস করছে মেয়েটার মা আর তার নানা। …কিন্তু কেন ভয় পেলে? কে ওই ভ্যানকিন? কী থেকে পালাতে চাইছ?’
চুপ করে রানাকে দেখছে নিকোলভ। থরথর করে কাঁপছে দুই গাল। চোখের কোণ লালচে। ধপ্ করে বসল সোফায়।
লোকটা ভয়ঙ্কর বিপদে আছে, তাতে ভুল নেই। ‘তোমাকে সহজে ছাড়বেন না লুকা ব্রেনেভ,’ বলল রানা। ‘ইউরোপের সেরা ধনী। রাশার ওপরমহলেও কানেকশন আছে। বছরের পর বছর জেল খাটতে হবে তোমার। কিন্তু অল্প যে ক’জন মানুষকে ব্রেনেভ বিশ্বাস করেন, তাদের ভেতর আমি একজন। নিজের ভাল চাইলে মুখ খোলো, বলা যায় না, হয়তো তোমাকে বিপদ থেকে বাঁচাতে পারব।’
রানাকে বিস্মিত করে হঠাৎ হো-হো করে হেসে ফেলল নিকোলভ। ‘হায়, ঈশ্বর! অবাক করলে, সত্যি কিছুই জানো না?’
খুলে বলো কী হয়েছে,’ বলল রানা।
আচমকা থামল নিকোলভের হাসি। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রানার চোখে। ‘নিজেকে এত বুদ্ধিমান ভাবলে নিজেই সব বুঝে নাও। তুমি আসলে অন্ধ ফকিরের মত। ভাবছ, ইউনাকে নিয়ে হাসতে হাসতে ফিরবে ফ্রান্সে।’
‘কাজটা কঠিন হওয়ার কথা নয়,’ বলল রানা। ‘এটা নিজের দায়িত্ব বলে মনে করছি।’
‘দেখভাল করবে ইউনার?’
‘নিরাপদে থাকবে আমার কাছে। কথা দিতে পারি।’
বাঁকা হাসল নিকোলভ। ‘কথা দিচ্ছ? কিন্তু তোমার কথার তো কোনও মূল্য নেই! তুমি গাধা বলেই জানো না কী ঘটছে। মস্কো পর্যন্ত পৌছুতেই পারবে না। দেশ ছেড়ে যাওয়া তো দূরের কথা। সর্বক্ষণ চারপাশে চোখ রেখেছে তারা। পালাতে পারবে না কোথাও।’
‘এই ‘তারা’টা কারা?’ জানতে চাইল রানা।
‘হ্যাঁ, ওরাই,’ বিড়বিড় করল বেযুখফ।
‘ধরা পড়বে,’ বলল নিকোলভ, ‘বোঝার আগেই খুন হবে। ইউনাকে তুলে নিয়ে যাবে তারা। তারপর বাধ্য করবে আমাকে আত্মসমর্পণ করতে। আর তার মানেই, খুন হব আমিও। তার আগে আমার পেট থেকে বের করবে সব। তুমি তো দেখি কিছুই জানো না!’
আবারও কাঁদছে ইউনা। তানিয়ার হাত থেকে ছুটে রানাকে পাশ কাটিয়ে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘পাপা, আমি চাই না কেউ মেরে ফেলুক তোমাকে!’
‘হাত খুলে দাও,’ রানাকে বলল নিকোলভ। ‘অন্তত একটু জড়িয়ে ধরতে দাও আমার মেয়েকে।’
পকেট থেকে ফোল্ডিং ছুরি নিয়ে নিকোলভের কবজির কে কেটে দিল রানা। হাত মুক্ত হতেই ইউনাকে বুকে জড়িয়ে ধরল নিকোলভ। নীরবে কাঁদছে সে। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘তোমার কোনও ক্ষতি হবে না, সোনাপাখি। কেউ কিছু করবে না। আমি আছি না!’
‘আমি তোমাদের ক্ষতি করতে আসিনি, সেটা বোঝাতে এটা করছি।’ বেযুখফের কবজির কেবলও কাটল রানা।
বিড়বিড় করে রানাকে ‘উজবুক,’ বলে কবজির রক্ত সঞ্চালন ঠিক করতে চাইল বেযুখফ।
বাইরে থেমেছে কুকুরের চিৎকার।
থমথম করছে চারপাশ।
মাঝে মাঝে দূর থেকে আসছে ছাগলের ম্যা-ম্যা ডাক।
‘এবার বলো,’ নিকোলভকে বলল রানা, ‘নইলে নির্যাতন করে পেট থেকে বের করব সব।’
পিটপিট করে চোখ থেকে অশ্রু সরাল নিকোলভ। ‘বন্ধু, সব জেনে নেয়ার আগে ভাবো, সত্যিই জানতে চাও কি না। একবার জানার পর পৃথিবীর কোথাও নিরাপদে থাকবে না তুমি। সত্যিই কি তা-ই চাও?’
‘এই ছাগলটাকে বিশ্বাস করি না,’ হিসহিস করে বন্ধুকে বলল বেযুখফ। ‘আমার ধারণা, এ ওদের দলেরই।’
তাকে পাত্তা না দিয়ে নিকোলভকে বলল রানা, ‘হ্যাঁ, শুরু করো।’
‘আমার অতীতে এমন কিছু আছে, সেটা তুমি জানো না,’ বলল নিকোলভ। ‘জানা নেই প্রায় কারও।’
‘যেমন?’
‘আমি যদি বলতে না চাই?’
‘বাধ্য হব আঙুল বাঁকা করে ঘি তুলতে।’
তীক্ষ্ণ চোখে রানাকে দেখহে নিকোলভ। কয়েক মুহূর্ত পর আঙুল চালাল ইউনার চুলের ভেতর। ভালবাসা নিয়ে চুমু দিল মেয়ের মাথার তালুতে। ‘সোনাপাখি, তুমি না বই পড়ছিলে? আপাতত ওই ঘরে কিছুটা সময় কাটিয়ে এসো। আমরা এবার আলাপ করব বড়দের বিষয় নিয়ে।’
‘ঠিক আছে,’ জ্যাকেটের কাঁধে চোখ মুছে বাবার বুক থেকে উঠে দাঁড়াল ইউনা। ওর দিকে চেয়ে হাসল তানিয়া। পাল্টা হাসল না মেয়েটা। বোবা চোখে দেখল বাবাকে, তারপর সরু প্যাসেজ পেরিয়ে একটা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল পাশের ঘরে।
দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শোনার পর রানার দিকে তাকাল নিকোলভ। নিচু গলায় বলল, ‘বুঝতে পারছি, আমার সম্পর্কে তোমাকে কী টাইপের ধারণা দিয়েছেন ব্রেযনেভ। তাঁর মনে হয়েছে, আমি দুনিয়ার সেরা ফালতু লোক। আমার মত বাজে লোক হয় না। ঠিক বললাম?’
‘ঠিক এভাবে কথাগুলো বলেননি,’ বলল রানা, ‘তবে এটা বলতে পারি, তোমাকে অপছন্দ করেন তিনি।’
‘আমি হয়তো চেয়েছি উনি যেন আমাকে বাজে লোকই মনে করেন? আমার প্রিয় প্রাক্তন স্ত্রীর বিষয়েও একই কথা বলব।’
নীরবে নিকোলভের দিকে চেয়ে রইল রানা। ‘কী কারণে তোমার স্ত্রী আর তার আত্মীয়স্বজনকে ভুল ধারণা দিলে?’
‘সত্য গোপন করতে,’ গর্বের সঙ্গে বলল নিকোলভ, ‘আগেই বলেছি, কিছু বিষয় চেপে রাখতে হয়েছে আমাকে।’
‘তা তো বটেই,’ বলল বেযুখফ।
মাথা দোলাল নিকোলভ। ‘এমন কী বহু বছর আমার এই প্রিয় বন্ধুর কাছ থেকেও সব আড়াল করেছি। কারণ আমার পেশাই ছিল তেমন। আমাদেরকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল তথ্য গোপনের জন্যে।’
‘এই লোককে এসব বলা ঠিক হচ্ছে না,’ থুতনি দিয়ে রানাকে দেখাল বেযুখফ।
‘উপায় নেই,’ বলল নিকোলভ, ‘সেক্ষেত্রে সে বুঝবে, কেন আমার মেয়ে ইউনাকে তার সঙ্গে যেতে দিতে পারব না।’
তেইশ
রাশান সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্ট ছিল সে, তা জানাল অ্যান্টোনিন নিকোলভ। বাদ পড়ল না জরুরি কিছু। ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভ হিসেবে তার কাজ ছিল কোড ক্র্যাক করা। অথচ কমপিউটার মেশিন এসে ওই কাজটাকে খেয়ে নিল। চাকরিতে উন্নতির বদলে একই জায়গায় আটকা পড়ল সে, ফলে হয়ে উঠল বীতশ্রদ্ধ।
‘বুঝলাম, এতদিন নষ্ট করেছি মূল্যবান সময়। চাকরি ছেড়ে দিলাম। ভুলে যেতে চাইলাম একসময়ে কাজ করেছি গুপ্তচর বিভাগে। কঠিন সব কোড ব্রেক করে তাক লাগিয়ে দিয়েছি…’
‘আমরা সবাই · দাবার বড়ে, অ্যান্টোনিন,’ বলল বেযুখফ। ‘নতুনভাবে গড়া হচ্ছে পৃথিবী। আগেও বলেছি, দুনিয়া চালাচ্ছে মানুষের বদলে অন্য এক প্রজাতি 1 নিষ্ঠুরতার খামতি নেই তাদের।’
‘লুকিয়ে থাকতে চাইলেও ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করল তারা,’ বলল নিকোলভ। ‘তারপর তাদের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে লুকিয়ে পড়লাম এখানে। একবার মাথা নাড়ল সে। বড় করে শ্বাস নিল। মনে পড়েছে, কীভাবে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এফএসবির এজেন্টরা। অচেনা এক সরকারি ভবনে আবারও দেখা হলো স্টেশন চিফ কাপরিস্কির সঙ্গে। দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হলো তার ঘাড়ে।
অ্যান্টোনিন নিকোলভকে খুব বুদ্ধিমান বলে মনে হচ্ছে না রানার। তবে যাকে কখনও সন্দেহ করা যায় না, সে-ই তো হতে পারে দক্ষ স্পাই। জানতে চাইল রানা, ‘তোমার কাছ থেকে কী চাইল কাপরিস্কি?’
‘জানাল পুরনো আমলের এক কাহিনী। ওই গল্প এক ব্রিটিশ গুপ্তচরের। কোল্ড ওঅরের সময় ধরা পড়েছিল মস্কো শহরে। সময়টা ছিল উনিশ শ’ সাতান্ন সালের শীতকাল। ওই গুপ্তচরের নকল নাম ইউরি সলোকভ। পাঁচ সপ্তাহ ছিল রাশার ভেতর। আসল নাম জন গ্রাহাম। সিক্রেট সার্ভিসে যোগ দেয়ার আগে ছিল আর্মির এসআইএস-এর ক্যাপ্টেন।
চুপ করে গেল নিকোলভ।
রানা জানতে চাইল, ‘ধরে নিচ্ছি, ওই গল্পের সঙ্গে সম্পর্ক আছে বর্তমানের।’
‘তা তো বটেই, মন দিয়ে শোনো। জন গ্রাহামকে গ্রেফতার করে লুবিয়াঙ্কা প্রিযনে নিল কেজিবির এজেন্টরা। প্রচণ্ড নির্যাতন করল তার ওপর। তবে জরুরি কিছু বলার আগেই মারা পড়ল সে। চাপা পড়ল গোটা বিষয়টা। এবার ফিরব বর্তমানে।’
বড় করে শ্বাস নিল নিকোলভ। রানার মনে হলো, সে ভাবছে তার দু’কাঁধে চেপে বসেছে দুনিয়ার সমস্ত ওজন। কয়েক মুহূর্ত পর আবারও মুখ খুলল নিকোলভ, ‘বেশ কিছু দিন আগে বুলডোজার দিয়ে পুরনো, পরিত্যক্ত এক এলাকার বাড়িঘর ভাঙতে গিয়ে এক দেয়ালের ফাটলে এনভেলপ পেল মজুররা। ওই এলাকা থেকেই গ্রেফতার হয় জন গ্রাহাম। এনভেলপে ছিল একটা ক্রিপটোগ্রাম। কোড বা সাইফার, যা-ই বলো ওটাকে।’
‘ওটার কারণে জড়িয়ে গেলে তুমি,’ বলল রানা।
‘ভ্যানকিন কাপরিস্কি দায়িত্ব দিল কোড ভাঙার জন্যে,’ তিক্ত স্বরে বলল নিকোলভ। ‘কিন্তু আমাকে কেন? … তার কারণ, চাকরি করার সময় আমি ছিলাম তার সেরা কোড ক্র্যাকার। কাজটা করিয়ে নেয়ার জন্যে আমাকেই পছন্দ করেছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, কোড ভাঙতে পারি বা না পারি, জারি হয়েছে আমার মৃত্যুদণ্ড। আমি এতই বোকা, এটা বুঝতে গিয়ে সময় লাগল। মনের একাংশ চেয়েছে সাইফারটা ক্র্যাক করি। মনে পড়েছিল সুদিনের সেই সময়। দিন-রাত লেগে থাকলাম সাইফার নিয়ে। এটা নিয়েও প্রায় পাগল হয়ে গেলাম।
‘তোমার কেমন লেগেছে বুঝতে পেরেছি, নিকোলভ থেমে যাওয়ায় বলল রানা।
‘এরপর ভেঙেও ফেললাম কোড।’ বিজয়ের সেই মুহূর্তের কথা ভেবে মৃদু হাসল নিকোলভ। পরক্ষণে ঝুঁকে গেল দুই কাঁধ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘কিন্তু ওটা কি বিজয় ছিল? না! সত্য জেনেছি। আর সেটা ভ্যানকিনকে জানালেই মরতে হবে আমাকে। যদি ব্যর্থ হতাম, গিয়ে বলতাম কোড ব্রেক করতে পারিনি, তা হলেও ব্যর্থতার জন্যে মরতে হতো।’
রানার চোখে তাকাল নিকোলভ। ‘এখন, রানা, সত্যটা প্রকাশ করলে তুমি নিজেও বাঁচবে না কোথাও গিয়ে। আসলে কিছু জানো না বলেই সুযোগ আছে বাঁচার। একবার সাইফারের ভেতর কী আছে জেনে গেলে ধরে নিতে পারো, জারি হয়ে গেছে মৃত্যুদণ্ড। অর্থাৎ, মরবে আমার মতই। ওটা প্রাচীন দানবের গল্পের মত। একবার তাকে দেখে ফেললে মরতেই হবে।’
‘তুমি বরং বলো কোডে কী ছিল,’ বলল রানা।
‘তুমি চাইবে প্রমাণ,’ বলল নিকোলভ, ‘সেটাও দিতে পারব।’ টেবিলের দিকে আঙুল তাক করল সে। ‘ওই যে ওখানে একটা খবরের কাগজ আছে। ওটা হাতে নাও।’
টেবিল থেকে খবরের কাগজ নিল তানিয়া। ভুরু কুঁচকে দেখল ওটা, তারপর ধরিয়ে দিল রানার হাতে। মুখে বলল, ‘ওটা মেট্রো মস্কো দৈনিক ট্যাবলয়েড পত্রিকা। স্থানীয় খবরের জন্যে বিখ্যাত। তারিখ গত সপ্তাহের।’
‘ওই ছবিটা দেখো,’ বলল নিকোলভ।
‘আমি তো বাবরি চুলের পপ স্টারকে দেখছি,’ বলল রানা।
‘ওটা নয়। নিচের দিকে। ছোট ছবি। সরু কলামের মাথায়।’
‘যাজক,’ ছবিটা দেখে নিয়ে বলল রানা।
‘হ্যাঁ, যাজক। মৃত একজন যাজক। পত্রিকা প্রকাশের একরাত আগে একটা সেতু থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয় তাঁকে। পুলিশ বলছে আত্মহত্যা।’
পাকা চুলের মানুষটির ছবি আবারও দেখল রানা। পোশাক থেকে’ বুঝল, তিনি ছিলেন ক্যাথোলিক যাজক। দেয়া হয়েছে সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট। আত্মহত্যা করেছেন বলে অত্যন্ত বিব্রত চার্চ কর্তৃপক্ষ। নিকোলভের দিকে তাকাল ও। ‘আত্মহত্যা করেছে একজন ক্যাথোলিক যাজক। তবে তার সঙ্গে তোমাদের কী সম্পর্ক?’
‘কারণ, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করার পর খুন হন তিনি, ‘ বলল নিকোলভ। ‘তাঁকে বলেছিলাম ওই কোডের ব্যাপারে।’
চুপ করে থাকল রানা।
‘জানতাম না এজন্যে খুন হবেন,’ মাথা নাড়ল নিকোলভ। ‘ভেবেছি, বুক হালকা হবে যাজকের কাছে সব খুলে বললে। মস্তবড় ভুল করেছি। আগেই চার্চের ওপর চোখ ছিল এফএসবির এজেন্টদের।’ ক্ষমা চাওয়ার মত করে দু’হাত জড় করল নিকোলভ। সাদা হয়েছে আঙুলের কড়া। চোখ বুজে কী যেন ভাবছে। রাগের ছাপ পড়ল চেহারায়। কয়েক মুহূর্ত পর চোখ মেলে তাকাল রানার দিকে। ‘খুব খারাপ লাগছে যে আমার দোষে মরলেন নিরীহ মানুষটা। তাঁকে সতর্ক করা উচিত ছিল। কিন্তু এত দ্রুত সব ঘটছিল, মাথা কাজ করেনি। গির্জা থেকে বেরিয়ে সোজা গেছি এয়ারপোর্টে। ওখান থেকে ইউনাকে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর ফিরেছি আমার অ্যাপার্টমেন্টে। পরদিন দুপুরে পত্রিকায় ওই ছবি দেখার পর বুঝলাম, আমরা আছি মহাবিপদে। সেদিনই ত্যাগ করলাম মস্কো।’
‘অ্যাপার্টমেণ্ট থেকে জরুরি কিছু নিয়ে রওনা হও,’ বলল রানা। ‘কিন্তু ওখানে ফেরার মত এত বড় ঝুঁকি নিলে কেন? পেছনে তো লেগে গেছে সরকারি খুনি।’
‘ভেবেছি এক কদম এগিয়ে আছি ওদের চেয়ে,’ বলল নিকোলভ, ‘ভেবেছি যথেষ্ট সতর্ক আমি। বুঝতে পারিনি কত বড় ভুল করছি। স্রেফ কপালের জোরে আসতে পেরেছি এখানে।’
নিকোলভ আরও কিছু বলবে বলে অপেক্ষা করছে রানা।
ধরার চেষ্টা করল তারা। একবার নয়, দু’বার। প্রথমবার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোবার একটু পরেই পিছু নিল কালো এক মার্সিডিয।’
‘ওরা সবসময় কালো মার্সিডিয ব্যবহার করে,’ মাথা নাড়ল বেযুখফ। ‘ওদের ধারণা: গোপন করার কিছুই নেই তাদের।’
ওরা নিজেরাও যে কালো মার্সিডিয চেপে এসেছে, কথাটা চেপে গেল রানা।
ওই অ্যাপার্টমেন্টের ওপর চোখ রেখেছিল,’ বলল নিকোলভ, ‘আমাকে ঢুকতে দেখেছে। বেরোতেও। অপেক্ষা করছিল সঠিক সময়ের জন্যে। ইঁদুর একবার খাঁচার ভেতর আটকা পড়লে যা হয় আর কী। হয়তো ভেবেছে আমার সঙ্গে অস্ত্র আছে। গুলি শুরু করতে পারি। বোধহয় এ কারণেই শহরের ভেতর কোণঠাসা করতে চায়নি। তা ছাড়া, সবার সামনে বাবা ও মেয়েকে কিডন্যাপ করলে ঝামেলা হবে, সেটাও হয়তো বড় কারণ।’
‘তাদেরকে ফাঁকি দিয়ে এখানে এলে,’ খেই ধরিয়ে দেয়ার জন্যে বলল রানা।
‘এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না। অনুসরণ করছিল কালো ওই গাড়ি। উপায় ছিল না পালিয়ে যাওয়ার। শহরের নানাদিকে গেছি। ভীষণ ভয় লেগেছে। একসময় ফুরিয়ে যাবে ফিউয়েল। তখন আমাদেরকে ধরবে তারা। নিয়ে গিয়ে শুরু করবে নির্যাতন। সেক্ষেত্রে ইউনার কী হবে? মনে হচ্ছিল, আটকা পড়েছি ক্ষুধার্ত সিংহের খাঁচার ভেতর। এগিয়ে চললাম সরাসরি লেফোর্টো রোড টানেলের দিকে। আর তার একটু পর ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। অবশ্য, এমন ঘটে ওই রোডে। যদিও কখনও কখনও…’
‘মূল বক্তব্যে ফেরো,’ বলল রানা।
‘যাচ্ছিলাম আশি কিলোমিটার বেগে। মেঝের সঙ্গে চেপে ধরেছি অ্যাক্সেলারেটর। পুরনো গাড়ি এর বেশি গতি তুলতে পারল না। আমাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে একের পর এক গাড়ি। কিন্তু পেছনে লেগে থাকল কালো মার্সিডিয। সামনের সিটে দুই এজেন্ট। ঠিক সেসময়ে গতি বাড়িয়ে আমার গাড়িটাকে পেছনে ফেলতে চাইল এক ড্রাইভার। অন্যদের চেয়ে বেশি ছিল তার গতি। গাড়িটা ছিল পোর্শা। বড়লোক কোনও বদ্ধউন্মাদ। ওরকম দামি ও দ্রুতগামী গাড়ি পেলে মাথা ঠিক রাখা কঠিন। মার্সিডিযকে পাশ কাটিয়ে সোজা নেমে পড়ল বন্যার ভেতর। ইয়াকুয়া নদী মাথার ওপরে। নানাদিকে ফুটো হয়েছে টানেল।
‘বলতে থাকো,’ বলল রানা।
‘পানিতে নামতেই পিছলে গেল পোর্শার চার চাকা। পাশেই সেই মার্সিডিয। চরকির মত চক্কর কেটে ওটার ওপর চড়াও হলো পোশা। ধুম করে পাশের দেয়ালে গিয়ে আছড়ে পড়ল মার্সিডিয। রিয়ারভিউ মিররে দেখলাম, একগাদা গাড়ি গুঁতো দিল পরস্পরকে। চারপাশে ছিটকে গেল ভাঙা বডি ও পার্ট। সাধ্যমত গতি তুলে টানেল থেকে বেরোলাম। মনে ভীষণ ভয়।’
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একবার মাথা নাড়ল নিকোলভ। ‘তীর বেগে বেরিয়ে এলাম শহর ছেড়ে। পেছনে আর ওই কালো মার্সিডিয দেখলাম না। ভেবেছি, এবারের মত বেঁচে গেছি। তবে এটাও বুঝলাম, এত সহজে ছাড়বে না তারা। চারপাশেই আছে তাদের লোক। চোখ রাখছে সবদিকে। এবার ফেডারেল হাইওয়ে থেকে নেমে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার হামলা করল ফিউয়েল নেয়ার সময়। যাওয়ার পথে ওই দোকান থেকে কিনেছি টুকটাক জিনিস। ওঅশরুমে গিয়েছিল ইউনা। বাইরে অপেক্ষা করছি, এমনসময় পার্কিং লট থেকে দালানে ঢুকল দুই লোক। চোখে কালো সানগ্লাস। খাটো চুল। বুঝলাম এরা ভ্যানকিনের গুণ্ডা বাহিনীর সদস্য। তাদের একজন বলল, ‘মিস্টার নিকোলভ, দয়া করে আমাদের সঙ্গে আসুন।’ টের পেলাম হারাতে চলেছি স্বাধীনতা। তবুও হাতে সময় পাওয়ার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, তারা কারা, কী চায়। বললাম, আইডি না দেখালে কোথাও যাব না। তখন তাদের একজন কোটের পকেট থেকে পিস্তল বের করল। আমার পেটের কাছে এমনভাবে ধরল, চট্ করে ওটা দেখবে না কেউ। চারপাশে তখন অনেক মানুষ। ভ্যানকিনের এজেন্ট বলল, ‘বাড়াবাড়ি করবি না, শালার পো!’ অন্যজন আঙুল ভুলে দেখিয়ে দিল বাইরে দাঁড়ানো কালো মার্সিডিয।’
‘ওদেরকে ফাঁকি দিলে কীভাবে?’ জানতে চাইল রানা।
‘ইউনার বুদ্ধির গুণে,’ বলল নিকোলভ। এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। ‘বাথরুম থেকে বেরিয়ে আমার দিকে আসার সময় দেখেছে গাড়ি থেকে নেমেছে তারা। তখনই আবারও ওঅশরুমে ঢুকেছে ইউনা। তারপর টয়লেটের সিটে উঠে সরু জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেছে বাইরে। এরপর সবার চোখ এড়িয়ে পৌছে গেল সার্ভিস স্টেশনের একপাশে। ওখানেই ছিল তাদের গাড়ি। এদিকে সময় নষ্ট করতে চাইছি আমি। ওদিকে কালো মার্সিডিযের দুটো চাকার বাতাস ছেড়ে দিল ইউনা। এরপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়ল। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল আমাকে আর ওই দু’জনকে। বাঁচান! আমার বাবাকে মেরে ফেলছে! ছিনতাইকারী!’
ওই কথা শুনে হুড়মুড় করে আমাদের দিকে ছুটে এল অন্তত ত্ৰিশজন লোক। স্টেশনের ক্যাশিয়ার মহিলাও দেখল ভ্যানকিনের লোকের হাতে পিস্তল। প্রাণপণে চিৎকার ছাড়ল সে। হয়তো ভেবেছে ডাকাতি করতে এসেছে তারা, অথবা সবাইকে খুন করতে এসেছে চেচেনের ইসলামি খুনি। ঘটনা যা-ই হোক, কমবয়সী এক যুবক হামলে পড়ল পিস্তলওয়ালার ওপর। যুবকের মুখে নল নামাল এফএসবির লোকটা। চারপাশে তখন হৈ-চৈ ও হুলুস্থুল। সেই সুযোগে ঘুরেই দৌড় দিলাম। তীর বেগে পৌঁছুলাম ফোক্সভাগেন বিটল গাড়ির পাশে। আগেই সিটে বসে আছে ইউনা। দেরি না করে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। পিছু নেয়ার চেষ্টা করল দুই খুনি। কিন্তু দুই চাকার ভেতর বাতাস নেই বলে বেশিদূর ধাওয়া করতে পারল না। কয়েক মাইল পর বড় সড়ক থেকে নেমে গেলাম আমরা। একটা খামারবাড়ির কাছে ট্রাক দেখে ওখানে থামলাম। বদলে নিলাম আমারটার নাম্বারপ্লেট। এরপর আর অনুসরণ করতে পারল না কেউ। টানা এগিয়ে সোজা এসে হাজির হলাম এখানে। পর পর দু’বার বেঁচেছি কপালের জোরে। আমার মনে হয় ঈশ্বর চেয়েছেন আমি যেন পালিয়ে যেতে পারি। রানা, তুমি দৈব ঘটনা বিশ্বাস করো?’
‘আমার মনে হয় ওপরওয়ালা নয়, তোমার মেয়ের গুণেই প্রাণে বেঁচে গেছ,’ বলল রানা।
‘তো এবার বিশ্বাস করলে যে একটা কথাও মিথ্যা বলিনি?’
‘তুমি বলছ, এক লোককে খুন করেছে রাশান সিক্রেট সার্ভিস। তারপর দু’বার চেষ্টা করেছে তোমাকে কিডন্যাপ করতে। তাদের উদ্দেশ্য তোমাকে নির্যাতন করে তথ্য সংগ্রহ করা। এটা চাইছে, কারণ কোল্ড ওঅরের একটা কোড রয়েছে তোমার কাছে। ওটার কারণে বিপদে পড়েছ তুমি আর ইউনা।’
‘সংক্ষেপে বললে তা-ই,’ বলল নিকোলভ!
‘এত মূল্যবান জিনিসটা আসলে কী?’ জানতে চাইল রানা।
ঘন ঘন মাথা নাড়ল বেযুখফ। কিন্তু পকেটে হাত পুরল নিকোলভ। বের করে আনল কী যেন। মুখে বলল, ‘শেষবারের মত বলছি, তুমি এসবে জড়িয়ে না গেলে হয়তো প্রাণে বাঁচবে। তবে একবার সব জেনে নেয়ার পর, মরবে করুণভাবে। আবারও ভাবো, বন্ধু, শেষকৃত্যটা কিন্তু তোমার।’
নিকোলভের হাতে পুরনো একটা তামাকের টিন দেখতে পেয়েছে রানা। জঙে ভরা ওটা। প্রায় হারিয়ে গেছে প্রস্তুতকারীর নাম। জিনিসটা বোধহয় কয়েক দশক ছিল ভেজা আবহাওয়ায়।
‘এই টিন ছিল মস্কোর এক পরিত্যক্ত ওয়্যারহাউসে,’
বলল অ্যান্টোনিন, ‘ওখানেই রেখেছিল জন গ্রাহাম। আর তারপর সে-রাতেই ধরা পড়ে সে। সাইফারে আছে সহজ দিক নির্দেশনা। যাতে লুকিয়ে রাখা জিনিসটা চট্ করে পেয়ে যায় তার সহযোগীরা। তবে সাইফার তারা পেল না বলে হারিয়ে গেল এটা।’
‘ভেতরে কী?’ জানতে চাইল রানা।
টিনের কৌটার ঢাকনি খুলল নিকোলভ। ভেতরে আধুনিক ফ্ল্যাশ ড্রাইভ। ওটা পঞ্চাশ বছর ধরে ওয়্যারহাউসে থাকার কথা নয়। জিনিসটার পাশেই ছোট্ট এক রোল মাইক্রোফিল্ম ও কাপড়ে মোড়া কিছু। কাপড় খুলে ভেতর থেকে তালুর ওপর কী যেন রাখল নিকোলভ। ধাতব জিনিসটা খুব ছোট। তবে রানার মনে হলো, ওটাকে দুর্মূল্য হীরার সমান গুরুত্ব দিচ্ছে এক্স এজেন্ট।
আস্তে করে ধাতব টুকরো রানার তালুতে রাখল নিকোলভ। ওটা চকচকে। দৈর্ঘ্যে বড়জোর আধ সেন্টিমিটার। মসৃণ। দেখতে ওষুধ কোম্পানির ক্যাপসুলের মত। ঠাণ্ডা। ওটার ওজন অতি সামান্য।
‘কংগ্র্যাচুলেশন্স, যোগ দিলে আমাদের দলে। খুব কম মানুষ ওই গ্যাজেট নিজ চোখে দেখেছে। আর দুর্ভাগ্য, ওটার ব্যাপারে সব জেনে গেছ বলে মরবে তুমি ভয়ঙ্করভাবে।’
‘এটা কী?’ জানতে চাইল রানা।
‘প্ৰমাণ,’ বলল তাতভ বেযুখফ।
নিকোলভ এবং তার বন্ধুকে দেখল রানা। গম্ভীর হয়ে গেছে তারা। ‘এটা কী ধরনের প্রমাণ?’
‘বহু বছর ধরেই সন্দেহপ্রবণ একদল মানুষ জোর দিয়ে বলছে, অস্তিত্ব আছে এর,’ বলল নিকোলভ, ‘এটা আসলে আতঙ্কজনক এক গ্যাজেট।’
‘দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র হয়েছে এটার জন্যে,’ বলল বেযুখফ।
তালুতে বসে থাকা মসৃণ, চকচকে গ্যাজেট আবারও দেখল রানা। মুখ তুলে দেখল নিকোলভ ও বেযুখফকে। তাদের চোখে দুশ্চিন্তা। চট্ করে পরস্পরকে দেখল তারা। বেযুখফ বলল, ‘সত্যিই সব খুলে বলবে, অ্যান্টোনিন?’
‘আমরা তো আগেই ঠিক করেছি, সব জানিয়ে দেব দুনিয়াকে,’ বলল নিকোলভ। ‘রানা প্রথমে জানলে কোনও ক্ষতি দেখি না।’
‘ওই মেয়ের কী হবে?’ আঙুল তুলে তানিয়াকে দেখাল বেযুখফ।
অনেকক্ষণ হলো ঘরের একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। চোখে-মুখে কীসের এক ঘোর।
‘তানিয়া আমার সঙ্গে এসেছে,’ বলল রানা। ‘আমাকে যা বলবে, সেটা ওকেও বলতে পারবে।
কুঁজো হয়ে বসল নিকোলভ। চোখে ভয়। একবার জানালা দিয়ে দূরে তাকাল। ভাবছে, যে-কোনও সময়ে রাতের আঁধারে হাজির হবে এফএসবির একদল খুনি এজেন্ট। কয়েক মুহূর্ত পর রানাকে বলল সে, ‘তুমি মাইণ্ড কন্ট্রোল সম্পর্কে কতটা জানো?’
চব্বিশ
ঘরে থমথমে পরিবেশ।
চুপ করে আছে রানা। ভুরু কুঁচকে নিকোলভ ও বেযুখফকে দেখছে তানিয়া। ভাবছে কী যেন।
‘হয়তো বলবে এটা মূল্যবান আর্টিফ্যাক্ট,’ অবশেষে মুখ খুলল রানা, ‘কোনও এলিয়েন স্পেসশিপের অংশ। ষাট বছর আগে পাওয়া গেছে সোভিয়েত টেরিটোরিতে। যেমন বলা হয় আমেরিকার রসওয়েল বা এরিয়া ফিফটি ওয়ানের বিষয়ে। এটা বিশেষ চিপ। তাতে রয়েছে এলিয়েনদের কোটি বছরের জ্ঞান। আর এজন্যেই শেষপর্যন্ত আণবিক বিপর্যয় আর উষ্ণায়ন ঠেকাতে পারবে মানুষ।’
‘আগেই বলেছি, অ্যান্টোনিন, একে এসব বলা অর্থহীন,’ রেগে গিয়ে বলল বেযুখফ, ‘কিছুই সিরিয়াসলি নিচ্ছে না।’
‘মাইণ্ড কন্ট্রোল হাসির ব্যাপার নয়, তা জানি,’ বলল রানা। ‘সবসময় হচ্ছে। পৃথিবীর অন্তত পঞ্চাশ কোটি মানুষ সবসময় দেখছে টিভি। কোকা-কোলার বিজ্ঞাপন শুরু হলে দেখছে গরমের ভেতর সৈকতে বসে তৃপ্তির সঙ্গে কালো তরল গিলছে কেউ। ফলে অর্ধেক দর্শক ভাবছে, তারও চাই ওই জিনিস। তাদের চারভাগের একভাগ তখনই টিভি ফেলে দৌড়ে গিয়ে দোকান থেকে কিনছে কোকা-কোলা। এর চেয়ে বড় মাইণ্ড কন্ট্রোল আর কোথাও নেই। তবে মানুষগুলোকে জিনিসটা কিনতে বাধ্য করছে না কেউ।’
‘ভুল বললেও সাধ্যমত চেষ্টা করেছ বোঝাতে,’ বলল নিকোলভ।
রানাকে দেখে নিয়ে বন্ধুর দিকে তাকাল বেযুখফ। ‘আমি বরং খুলে বলি, অ্যান্টোনিন। হয়তো বোঝাতে পারব।’
‘বলো, শুনতে তো দোষ নেই,’ বলল রানা।
‘বেযুখফ কিন্তু এ বিষয়ে এক্সপার্ট,’ বন্ধুর হয়ে বলল নিকোলভ, ‘কয়েক বছর গবেষণা করেছে। ওর চেয়ে বেশি জানে না কেউ।’
মাথা দোলাল রানা। ‘শুনছি।’
‘ফেইথ রেডিয়োর নাম শুনেছ?’ গম্ভীর চেহারায় বলল তাতভ বেযুখফ। ‘শর্টওয়েভে ট্র্যান্সমিট হয়। রাশা আর ইউরোপে ওই স্টেশনের অনুষ্ঠান শোনে দুই কোটি মানুষ।’ নিজের বুকে বুড়ো আঙুল দিয়ে টোকা দিল সে। ‘আমিই ওই রেডিয়োর মালিক, পরিবেশনাকারী এবং সিইও। যারা চিরকালের জন্যে এ পৃথিবীর সর্বনাশ চাইছে, তারা আছে ভীষণ ভয়ের ভেতর। বুঝতে পারছে, ফাঁস করে দেব সব ষড়যন্ত্র। গহীন জঙ্গলে আমার ট্রেইলার থেকে প্রচার করি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। সরকারের সাধ্য নেই আমাকে বন্দি করে।’
‘একটা ট্রেইলার থেকে অনুষ্ঠান প্রচার করো?’
গর্বের সঙ্গে মাথা দোলাল বেযুখফ। ‘অবশ্যই! এবং গোপনে অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছি গত কয়েক বছর ধরে। বহু খুঁজেও আমাকে পায়নি রাশান সরকার। ওদের চেয়ে ঢের বেশি বুদ্ধিমান আমি। নাকের পাশে হালকা টোকা দিল বেযুখফ।
কোঁচকানো প্যান্ট ও জাম্পার পরা লোকটার বুটের ওপর মুরগির পায়খানা। কেউ বলবে না, সে একজন সফল রেডিয়ো অনুষ্ঠান প্রচারক। নিরাপত্তার জন্যে তাকে হুমকি ভাববে না কোনও দেশের সরকার। রানা ভাবছে, মেয়েটাকে নিয়ে এই পাগলাগারদ থেকে বেরোতে পারলে দু’ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছুবে মস্কোয়। ইউনাকে নিয়ে উঠে বসবে ওর নানার জেট বিমানে। আর তারপর ফ্রান্সে গেলেই ওর দায়িত্ব শেষ। পরে নিকোলভ বা ব্রেযনেভই স্থির করবে যা করার। উন্মাদ বেযুখফের বক্তব্য শুনবে বলে কৌতূহল দেখিয়েছে, সেজন্যে এখন নিজেকে চাবকাতে ইচ্ছে হলো ওর।
‘মাইণ্ড কন্ট্রোল,’ জোর দিয়ে বলল বেযুখফ। ‘ওটা মগজ ধোলাই। জোরালো, সূক্ষ্ম প্ররোচনা। সেজন্যে চাই কূট কৌশল। নতুন করে শিখিয়ে দেয়া হয় কী করতে হবে। যা খুশি বলতে পারো ওটাকে, তবে মূল কথা হচ্ছে: সত্যিই আছে ওই যন্ত্র। কোকা-কোলা বিক্রির মত নয় ওটা। প্ৰথমে মনে হয় বৈজ্ঞানিক পন্থা নয়। আর সেজন্যেই ওই যন্ত্রটাকে মেনে নিচ্ছ না তুমি।’ আবার মেঝেতে থুতু ফেলল বেযুখফ। ‘তবে বিশ্বাস করো, সত্যিই ওটা আছে। আর তাই পাল্টে যাচ্ছে আমাদের চেনা পৃথিবী। বুঝতে চেষ্টা করো, যদি নিয়ন্ত্রণ করা হয় অন্যের মগজ, যা খুশি ভাবিয়ে নেয়া যায় তাকে দিয়ে, তখনই শুরু হবে পৃথিবীতে মহাবিপদ। ভোট কাকে দেবে, কাকে পছন্দ বা অপছন্দ করতে হবে, সব নিয়ন্ত্রণ করছে একদল নিষ্ঠুর পশু। বলে দিচ্ছে আমাদেরকে কিনতে হবে জেনেটিকালি মডিফায়েড ফসল। একই কারণে ক্ষতিকর ভ্যাকসিন বা সিরাম দিচ্ছি বাচ্চার শরীরে। কর্তৃপক্ষ বলে দিচ্ছে, আমাদের কপাল ভাল যে পুলিশি দেশে বাস করতে পারছি। • অথচ, সাধারণ মানুষের নেই কোনও স্বাধীনতা। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের মাথায় তারা ঢুকিয়ে দিচ্ছে, নিজে থেকে যেন কোনও প্রশ্ন না তুলি। কথাগুলো শুনতে কেমন লাগছে, মিস্টার রানা?’
‘আধুনিক বিশ্ব মোটামুটি এমনই,’ স্বীকার করল রানা।
‘আমরা বাস করি মগজ ধোলাই হওয়া এক সমাজে। কিন্তু এর চেয়েও ক্ষতিকর কিছু করছে তারা। ফলে বুদ্ধিমান মানুষ হচ্ছে রোবটের মত। বা তাদেরকে বলতে পারো এক ধরনের সাইবর্গ। তাকে দিয়ে করিয়ে নেবে যা খুশি।’
‘এমনই করছে নাকি ওরা?’ গম্ভীর চেহারা করল রানা। ‘বলছি, তার আগে এক ঢোক ভোদকা চাই,’ খুক-খুক করে কাশল বেযুখফ। তাকে বাধা দিল না রানা। টেবিলের কাছে গিয়ে ডিম রাখার কাপের মত দেখতে চারটে শট গ্লাসে ভোদকা ঢালল লোকটা। সবার হাতে ধরিয়ে দিল একটা করে গ্লাস। বাদ পড়ল না তানিয়া। নীরবে নিজের ড্রিঙ্ক শেষ করল রানা। ভাবছে, ওটা ভোদকা, নাকি পেট্রল গিলিয়ে দিল? সবকিছু অস্বাভাবিক লাগছে ওর। ইউনা মেয়েটাকে উদ্ধার করতে এসে এখন কিডন্যাপারদের সঙ্গে বসে ড্রিঙ্ক করছে!
‘আরেকটা নেব,’ গ্লাস ভরে নিয়ে ঢকঢক করে ভোদকা শেষ করল বেযুখফ। চোখে জল নিয়ে দেখল রানাকে। ‘এবার বলো, কে সবচেয়ে নিখুঁত খুনি?’
ক’মুহূর্ত ভেবে বলল রানা, ‘এমন একজন, যাকে সন্দেহ করা যায় না। জানা যায় না তার উদ্দেশ্য। মূল্যহীন সে। যে ধরা পড়লেও ক্ষতি নেই। বোঝা যাবে না কার হয়ে খুন করছে।’
‘ভুল,’ মাথা নাড়ল বেযুখফ, ‘সে হবে এমন একজন, যে নিজেই জানে না সে খুনি। খুনের পরেও কিছুই মনে পড়বে না।’ তিক্ত হাসল সে। ‘আর তা-ই হচ্ছে। মগজ ধোলাই অবৈজ্ঞানিক ভাবলেও আবিষ্কার করা হয়েছে ওটা। কয়েক দশক ধরেই ওই টেকনোলজি ব্যবহার করছে দুনিয়ার ক্ষমতাশালীরা। একটু খুলে বললে বুঝবে। ভূমিকা জানিয়ে দেয়ার পর শুরু করব। প্রথমে এল
প্রথমে এল সাইকোট্রনিক ওঅরফেয়ার ১০৩।’
‘আমি কিন্তু ইতিহাসের লেকচার শুনতে আসিনি, ‘ আপত্তির সুরে বলল রানা। ‘সংক্ষেপে বলো যা বলবে।’
‘কিন্তু ভূমিকা ছাড়া কিছুই বুঝবে না,’ বলল বেযুখফ। রানার দিকে তাকাল নিকোলভ। ‘প্লিয, ওর কথা শোনো। ভুল বলছে না ও।’
বড় করে শ্বাস ফেলল রানা। ‘ঠিক আছে। শোনা যাক।’
সোফার কোণে বসে বড় বড় চোখে ওকে দেখল বেযুখফ। ‘রানা, আগে বুঝতে হবে, কয়েক দশক আগেই তৈরি হয়েছে উপযুক্ত মাইণ্ড কন্ট্রোল মেথড। প্রথম থেকেই এজন্যে প্রতিযোগিতা করেছে পৃথিবীর বড় দেশগুলো। ঠিক যেমন করছে মহাকাশ অভিযান আর অস্ত্র ব্যবসার ব্যাপারে। তবে ইলেকট্রনিক যুগ আসার বহু বছর আগে মগজ ধোলাইয়ের জন্যে ব্যবহার হতো নানান ড্রাগ্স্। গোপনে গবেষণা করেছে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশা। তিরিশের দশকে আবিষ্কার হলো ড্রাগের ব্যবহার করে ইন্টারোগেশন টেকনিক। তখন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদিদের ওপর মাইণ্ড কন্ট্রোলের প্রতিক্রিয়া বুঝতে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে নাযিরা। এ কারণে পরে নুরেমবার্গ কোড অভ এথিক্স করা হলো, যাতে অনিচ্ছুক মানুষের ওপর অন্যায় গবেষণা করা না যায়। অবশ্য, উনিশ শ’ পঁয়তাল্লিশ সালের পর নিজেরাই নুরেমবার্গ কোড অভ এথিক্স মানল না বড় দেশগুলো। বিশেষ করে কোল্ড ওঅর শুরু হওয়ায় এলএসডি ব্যবহার করে মানুষের ওপর এমকে-আল্ট্রা মাই কন্ট্রোল প্রোগ্রাম চালু করল সিআইএ। ফলে বদ্ধ পাগল হলো বহু মানুষ। মারাও গেল অনেকে।
‘ক্যামেরনের কথাটা বলো,’ হঠাৎ করেই বলল নিকোলভ।
তার দিকে তাকাল রানা। ‘ক্যামেরন কে?’
মূদ মাথা দোলাল বেযুখফ। ‘বলছি। পঞ্চাশের দশকে ইউএস সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের হেড ছিল ওই লোক। সবাই ডাকত ডক্টর এয়ান ক্যামেরন বলে। সে নিয়ে এল অদ্ভুত এক থিয়োরি। ওটা নাকি সারিয়ে দেবে সব মানসিক রোগ। সহজ থিয়োরি- প্রথমেই পরিষ্কার করে দেবে মানুষের মন। সোজা কথায় যাকে বলে মগজ ধোলাই। তারপর সেখানে গেঁথে দেবে ভাল ভাবনা ও আচরণ। রোগী হবে দায়িত্বশীল মানুষ। সাধারণ মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষের ওপর গবেষণা চালাল সে। ফলে মানুষগুলো হয়ে গেল আলুভর্তার মতই নিরামিষ। এমনটা হয়েছিল দিনের পর দিন অতিরিক্ত এলএসডি দেয়ায়। সঙ্গে ছিল শক্তিশালী ইলেকট্রো-কনভালসিভ থেরাপি।
‘বুঝতে পেরেছ, রানা?’ বলল নিকোলভ। ‘ওরা ধাতব বেডে বেঁধে মানুষগুলোর ওপর চালাত শক্তিশালী বিদ্যুৎ।’
‘শিশুর মত করে দিত বয়স্কদেরকে,’, বলল বেযুখফ। ‘মাথা হতো সাদা কাগজের মত পরিষ্কার। অতীত স্মৃতি বলতে কিছুই থাকত না। এরপর নতুন করে তার মগজে গেঁথে দেয়া হতো নতুন তথ্য। থিয়োরিটিকালি এটা সম্ভব। শূন্য মস্তিষ্কের যে কাউকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেয়া যায়। যদি তার হাতে পিস্তল ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়: ‘নিজের মাথা উড়িয়ে দাও!’ দেরি না করে তা-ই করবে সে। বা যদি বলে: ‘যাও, গিয়ে খুন করো ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।’ তাই করবে। রোগীর মনেও পড়বে না মানুষটা তার চেনা না অচেনা কেউ। সোজা কথায় নির্দেশ পেলে নির্দ্বিধায় খুন করবে যে কাউকে।’
হাতের তালুতে রাখা ধাতব ডিভাইসটা দেখল রানা। ‘তবে এটাকে তো ড্রাগ বলে মনে হচ্ছে না।’
‘ঠিক,’ বলল বেযুখফ। ‘কিছু দিনের ভেতর গবেষকরা বুঝে গেল, শুধু কেমিকেল দিয়ে কাজ হচ্ছে না। তা ছাড়া, মানুষকে মানসিকভাবে নিঃস্ব করতে লাগে প্রচুর সময়। সেটা খুব নিষ্ঠুর কাজও। এসব ভেবে গবেষকরা খুঁজতে লাগল অন্য উপায়। কোল্ড ওঅরের সময় গবেষণা করেছে, কীভাবে হিপনোসিস ব্যবহার করে তৈরি করবে সুপার স্পাই। সে মিশনে গেলেও সঠিক সময়ের আগে জানবে না, কী করতে হবে তাকে। পরেও মনে পড়বে না বলে জিজ্ঞাসাবাদেও পেট থেকে বেরোবে না কিছু। কারণ, সচেতনভাবে কোনও অন্যায় করেনি সে। জানবেও না সে আসলে কে। নির্যাতনের শিকার হয়ে খুন হলেও প্রকাশ করতে পারবে না গোপন কিছু। এটা সম্ভব হলে সেটা হতো সোনায় সোহাগা। হিপনোসিস ও অন্যান্য টেকনিক ব্যবহার করে কীভাবে মগজ থেকে মুছে ফেলা যায় সব, তার পরীক্ষা করছিল সোভিয়েত রাশার গবেষকরা।’ রানার দিকে তাকাল বেযুখফ। ‘তুমি কি মস্কো শো ট্রায়ালের নাম শুনেছ?’
‘আবছাভাবে মনে পড়ছে,’ ক্লান্ত সুরে বলল বিরক্ত রানা।
মাথা দোলাল বেযুখফ। ‘তিরিশ দশকের শেষদিকে দলের বিরোধীদেরকে খতম করতে বিশেষ এক আদালত গড়েন স্টালিন। সেখানে এসে একের পর এক ক্ষমতাশালী লোক স্বীকার করতে লাগল, দেশের মহাক্ষতি করেছে সে। অভিযোগ ছিল দেশদ্রোহের। তবে মানুষগুলোকে ড্রাগ দেয়ার পর এমনভাবে হিপনোটাইয করা হয় যে, যা বলতে বলা হয়েছে, তাই বলেছে তারা। রাশার ওই রাজনীতিকরা হয়ে যায় এক ধরনের রোবট। কেউ হয় খুনি, কেউ গুপ্তচর। অথচ নিজেরাও জানত না কী করছে বা কী করতে হবে। সে-সময়ে এল আধুনিক এক টেকনোলজিকাল বিপ্লব। ফলে ইতিহাস হয়ে গেল ড্রাগ ও হিপনোসিস দিয়ে মন-নিয়ন্ত্রণের সব প্রচেষ্টা।
‘একটু সংক্ষেপে বললে ভাল হয়,’ বলল রানা।
‘আর বেশি সময় নেব না,’ বলল বেযুখফ। কড়া চোখে দেখছে রানাকে।