2 of 2

এক্সপ্রেস – নবনীতা দেব

এক্সপ্রেস – নবনীতা দেব

“এক্সপ্রেস, এক্সপ্রেস, উঠবেন না”—হাঁকতে হাঁকতে উর্ধ্বশ্বাসে বাসটি বেরিয়ে গেল। আর অপেক্ষমাণ জনতার একাংশ, আশ্চর্য কসরতে, চুম্বকের শরীরে ছিটকে লেগে যাওয়া পেরেকের মতো সেই বেগবান দৈত্যর অঙ্গ-লগ্ন হয়ে অদৃশ্য হলেন। তাদের আত্মপ্রসাদে উদ্ভাসিত মুখ কল্পনা করে, আমরা অকৃতকৰ্মারা, পরস্পরের দৃষ্টি এড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। ঘড়িটা সম্ভবত স্লো। নটা কুড়িরটা মিস করলে কেলেঙ্কারি। আটের-বি। পাঁচ নম্বর। রোদ্দুর এর মধ্যেই কী চড়া হয়ে উঠেছে। আবার আটের-বি। তারপর গোটা রাস্তাটা বেলা দুটোর লেকের মতো ফাঁকা। নিস্তব্ধ। কে বলবে আজ সোমবার, সকাল নটা কুড়ি, এটা রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। কবি হলে বলতুম, বয়স্কা কুমারীর শূন্য সিঁথির মতো ব্যর্থ প্রতীক্ষায় মাধুর্যলুপ্ত পথ। আপাতত মনে হচ্ছে, পিতৃদেব যথেষ্ট পয়সা না জমিয়ে বিশেষ ভুল করেছেন। গাড়ি না থাক, নিদেনপক্ষে একটা ট্যাক্সি করেও যদি, —আসছে, আসছে। অপেক্ষা করতে করতে প্রায় শ্মশানবৈরাগ্য উপস্থিত হয়েছিল যাঁদের, তাঁরা স্টেশনে ট্রেন ইন্‌ করার সময়ে কুলিদের মতো প্রাণচঞ্চল হলেন। দু নম্বর পাইকপাড়া, ভায়া ওয়েলেসলি। কতক উঠলেন। কতক রইলেন। তাঁদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। একজন পানের দোকানের দড়ি থেকে সিগারেট ধরালেন। হতাশা সুলক্ষণ। বাস এবার আসবেই। অন্তত ভদ্রলোকের সিগারেটটা ফেলিয়ে দেওয়ার জন্যও আসবে।

এলও। “এক্সপ্রেস, এক্সপ্রেস, লেভিজ উঠবেন না’’—ধুত্তোর উঠবেন না। কয়েকজন যাক-প্রাণ থাক-মান থিয়োরিতে বাসের সামনে বুক পেতে দিলেন, বাস থামল। দুধের ঘটিতে উথলে-ওঠা ফেনার মতো বাসের মুখে থরে থরে মানুষ জমে আছে। সর্বশরীরে সাহস সংহত করে তারই মধ্যে মিলিয়ে গেলাম সকলে, আমিও। অমনি মন্তব্য। ‘‘কলকাতায় এত বাস থাকতে এঁরা যে কেন এক্সপ্রেসে ওঠেন—” “আরে ভাই, বাসের একতলাটা তো ওঁদের জন্যেই” —‘‘লেডিজ স্পেশাল করে দিয়েও রক্ষে নেই” —যেন লেডিস স্পেশাল প্রচলনের কর্মকর্তা উনিই। “একেই গরম, তায় আপিসের ভিড়, এর ভেতরে লেডিজ উঠলে—”।

কখন যেন ভিতরে এসেছি, বসতেও পেয়েছি। এক পাশে ঘটি-পুটলি নিয়ে এক বৃদ্ধা, মনে হয় কালীঘাটযাত্রিণী। নামতে পারবেন তো? কালীঘাটে নামা কল্পনাতীত। অন্যপাশে ডালহৌসিগামিনী। কোলের ওপর লাইব্রেরির কোনা-মোড়া বই খোলা। সস্তা প্রেমের গল্প। চামড়ার ব্যাগটার পেট ফোলা। হয়তো টিফিন আছে।

একটু দূরে রড-ধারী এক মাদ্রাজি ভদ্রলোক উটের মতো মাথা বাড়িয়ে জানালা দিয়ে বহির্দৃশ্যে মন দেবার কষ্টসাধ্য প্রয়াস করছেন। প্রায়ই দেখা হয়। এ-বাসের একাধিক মুখের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় আছে। “দাদু, টিকিট হয়েছে?” “পালিয়ে যাচ্ছি না দাদু, পায়ের ব্যালান্সটা রাখতে দিন আগে, প্রথমেই পকেটের দিকে নজর?”

‘‘তিন আনা? ভাঙানি পরে দিচ্ছি, টিকিট ধরুন—’’ দু আঙুলের ফাঁকে বিচিত্র কায়দায় নোটটি ধরে কন্ডাক্টর টিকিট বাড়ালেন। তারপরেই হাঁক—‘‘পার্টনার, এক টাকার চেঞ্জ হবে?” “পুরনো হবে না, নয়া হবে—” সিড়ি থেকে জবাব এল। নয়া শুনলেই গা শিরশিরিয়ে ওঠে। রোজ বিতণ্ডা। রোজ গলাবাজি। শেষ পর্যন্ত সরকারের আদ্যশ্রাদ্ধে কণ্ডাক্টর-প্যাসেঞ্জারের পুনর্মিলন।

চোখ পড়ল ওপাশের ডবলসিটে। বইপত্র সামলে চশমাচোখে ছেলেটি কোনওরকমে দাঁড়িয়েছে। মাথা ছাদে ঠেকে যাচ্ছে। কচি গোঁফের রেখায় মুখখানা আরও কচি লাগে। ছেলেটি চোখ নামাল সামনে-বসা মেয়েটির চোখে। ওরা হাসল।

বাসটা এতক্ষণে হাজরায় বেঁকে হরিশ মুখার্জিতে ঢুকেছে। পাশের বৃদ্ধা হঠাৎ উঠে পড়লেন। “এই এই—আমি নামব। চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে। এটা কোথায় যাচ্ছে?” বাসসুদ্ধ হাঁক ছাড়ল—‘‘রোখো, রোখো,” বাস রুখল না। কন্ডাক্টর গর্জে ওঠেন, “কেন উঠেছিলেন? একশোবার বারণ করি, এটা এক্সপ্রেস। বসে থাকুন আপনি, ডালহৌসিতে নামবেন।”

“বুড়োমানুষ পথ চিনিনি বাছা।”

“পথ চেনেন না তো পথে বেরন কেন?” সকলে এবার বৃদ্ধার ওপর চড়াও। টিং টিং ঘণ্টা, বাস থামাও। তবু থামে না। বৃদ্ধা প্রায় কেঁদে ফেলেছেন, অনেকে চঞ্চল হন—‘‘সত্যি তো, আহা বুড়ো মানুষ।” বাস হঠাৎ থেমে এল। বৃদ্ধা তাড়াতাড়ি অগ্রসর হন। সামনের লোকেরা যথাসাধ্য সরেও গেলেন। কিন্তু মাত্র দু-তিন পা এগোন গেল। দরজা হনজ দূর অস্ত। বাস কিন্তু চলতেই থাকল। বৃদ্ধার জন্য নয়, থেমে আসার কারণ, ভবানীপুরের গোপালরা শয়ে শয়ে গোরু নিয়ে চরাতে চলেছেন গড়ের মাঠ অভিমুখে। গোরুর মিছিলে পথ বন্ধ। প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা। “ওঃ, এই এক ন্যুইসেন্স হয়েছে।” — ‘‘এটা কি এক্সপ্রেস, না, গোরুর গাড়ি?” “এক্সট্রা পয়সাটা ফেরত দেবেন দাদা। লেট করে দেওয়ার দরুন—” অতিরসিকতা কারুর। “ও নীলশার্টদাদা, ত্রিভঙ্গমুরারি পোজে দাঁড়ানো প্র্যাকটিশ করছেন, রাসপূর্ণিমার এখনও ঢের দেরি।” নীলশার্টদাদা বিরক্তমুখে, একটা অস্ফুট ইংরেজি মন্তব্য করে এগিয়ে গেলেন। কন্ডাক্টর বললেন, “গেটে ভিড় করবেন না, সামনের দিকে এগিয়ে যান।” চশমাচোখে ছেলেটি বিচলিত হয়ে গেটের দিকে তাকাল। তারপর মেয়েটির দিকে। আমি জানি ও এগিয়ে যাবে না। সবার চোখে বিদ্রুপ, কিছুটা ঈর্ষা সহ্য করে, ঘাড় গুঁজে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। দুজনের চোখে তাকিয়ে ওরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, বাস, ভিড়, অফিসটাইম, ধাক্কা, টিপ্পনী, গোরু, গরম, নয়াপয়সা, তাবৎ জগৎসংসার ভুলে যাবে। তারপর জি পি ও-তে মেয়েটির পার্শ্ববর্তিনী ছাতা সামলে নেমে গেলে, মেয়েটি, বৃষ্টির পরের আকাশের মতো ধবধবে হেসে সরে যাবে এবং ঘড়ির দিকে আর দরজার দিকে তাকিয়ে নিয়ে ছেলেটি ওর সবুজ শাড়ি ঘেঁষে বসবে।

“এই যে পরিমল, হয়ে গেছে কাজটা?” “না, আবার ইন্টারভিউ আছে আজ।” “একশো পঁচিশটা টাকার জন্য ঘুরিয়েই মারবে তোকে—” নাইলন-হাওয়াই শার্ট-পরা ছেলেটি মন্তব্য করল। অদৃশ্য পরিমলের প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না। পাশের সিটে দুটি ডালহৌসিগামিনী আলাপ করছেন—‘‘মায়ের অপারেশনে প্রচুর টাকা গেল, ব্যাঙ্কে কিছুই প্রায় নেই।” দুই ভদ্রলোক রীতিমতো উত্তেজিত—‘‘স্বীকার করি তোমাদের নেহরুর পরে কেউ নেই, কিন্তু সেখানেই তো নেহরু ফেলিয়োর।”

পি জি হাসপাতাল থেকে একটি শবযাত্রা বেরুচ্ছে, হিন্দুস্থানীদের। ‘‘রামনাম সাচ হ্যায়—”আবীর ছড়িয়ে ওরা প্রিয়জনকে নিয়ে চলেছে প্রিয়অভিসারে। খানিকটা উড়ন্ত আবীরে জানালার মোটা বিলিতি কাচ রঙিন হয়ে গেল।

“বড়দা, স্পিড দিন, এগারো এসে পড়েছে, বত্রিশও বেরিয়ে যাচ্ছে চৌরঙ্গী দিয়ে—” পিছনের নীল দৈত্যের দিকে তাকিয়ে কন্ডাক্টর সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। নিকেলের চশমাপরা, গেঞ্জি গায়ে, চল্লিশোর্ধ্ব সারথি সদম্ভে জবাব দিলেন, —‘‘আসুক গিয়া—আমারে ধরনের সাইধ্য নাই, পঙ্খীরাজের মতো উইড়্যা যামু, বিশ মিনিটে নিয়া ফেলুম অনে।”

অফিসযাত্রীদের আশ্বস্ত করে, এক্সপ্রেস এবার সত্যি স্পিড় দিয়েছে। রেসকোর্সের সমুখে এসেছে কি না। অলসচোখে চেয়ে দেখি সর্টস পরিহিতারা চুল উড়িয়ে গলফ প্র্যাকটিস করছেন। গোরুছাগল চরছে। দু ধারে ছড়ানো সবুজ কড়া রোদে ঝকঝকে সোনালি—বরং ওই মেয়েটির শাড়ির সবুজ অনেক সত্য, অনেক বেশি ঘাসের মতো, পাতার মতো—ওর চুলে চওড়া লালফিতে। চেয়ে চেয়ে হঠাৎ বালিগঞ্জ সারকুলার রোড মনে পড়ল।—কৃষ্ণচূড়ায় কৃষ্ণচূড়ায় রাস্তাটা অসহ্য সুচিত্র হয়ে আছে এখনও। যদিও বসন্ত গত।

২৭ জুলাই ১৯৫৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *