একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশশ বাহাত্তর
আজ বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাভাষী মানুষ বাহান্নর শহীদদের স্মরণ করছেন। একটি জনযুদ্ধে জয়ের আনন্দ নিয়ে, একটি নতুন সম্ভাবনাময় শোষণমুক্ত সুসভ্য সমাজ সৃজনের দৃঢ় আকাক্ষা স্পন্দিত অন্তরে- একটি প্রবল, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি ফ্যাসীবাদী সেনাবাহিনীর নির্মম নৃশংস ইতিহাসের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ডের করুণ বেদনায় আপুত বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাভাষী মানুষ- সমগ্র বাঙালি জাতি রাইফেল, কামান, মেশিনগান ধরা কড়পরা হাত, বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বিসর্জিত প্রাণ শহীদদের অন স্মৃতির প্রতি সম্মাননায় পরস্পর যুক্ত করেছেন। অপরিসীম স্পর্ধা বিনয়ে প্রশান্ত করেছেন, গর্বিত মস্তক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় অবনত করেছেন। জয় হোক বাংলাভাষার, জয় হোক বাংলাভাষীর । জয়ী হোক বাংলাভাষার অপরূপ গতিভঙ্গিমা, জয় হোক বাংলার লক্ষ স্বাধীনতাপ্রেমিক শহীদের অন্তরের অনিভন্ত কামনা।
আটই ফাল্গন তথা একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে বিজয়ের, জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পথে রক্তলাল তোরণদ্বার। আমাদের জাতির অন্তরে সঞ্চিত অগ্নিপ্রভ স্বদেশপ্রেমের প্রখর জ্বালামুখ, আমাদের জাতীয় অন্তরে সঞ্চিত অমৃতধারার সংলাপিত ঝরনা। বিগত বিশ বছর ধরে প্রতিটি বছর এই দিনে আমরা সবান্ধবে সমবেত হয়ে এই দিনটির জ্বলন্ত সূর্যের কাছে কায়মনোবাক্যে উজ্জ্বল জীবনের, সুন্দর জীবনের বর প্রার্থনা করেছি। অত্যাচারী শাসকের রক্ত চোখের কুটিল-দৃষ্টি এবং কুটির রেখা দেখে আমরা ভীত হইনি, সন্ত্রস্ত হইনি। অত্যাচার, অপমান, লাঞ্ছনাগঞ্জনার চণ্ডাল রাজত্বে বাস করেও আমরা এই দিনটিতে অত্যন্ত প্রসন্নভাবে উদার মন এবং বিশুদ্ধ আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের হয়ে, বাংলাভাষার সমস্ত মানুষের হয়ে বড় কিছু মূল্যবান কিছু, জীবনের মতো প্রিয় সূর্যের মতো জ্বলন্ত কিছুর কামনা করেছি। গোটা বছর আমরা মূক পশুর জীবনযাপন করেছি, মানুষী প্রেরণার প্রমিথিয়ান শিখায় দগ্ধ হয়েছে আমাদের অন্তর্লোক, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছে আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব। প্রতি বছর এই দিনটিতে আমাদের অন্তরের অবরুদ্ধ কামনা ময়ূরের মতো কলাপিত হয়ে উঠেছে, ক্ষোভ বজ্র নিমেষে ফেটে পড়েছে, আনন্দধারা দিগন্তরেখার ধারে ধারে অভিসার করেছে। আমাদের কবিতার প্রতীক চিত্রকল্প আকাশের নক্ষত্রমালার মতো জ্বলজ্বলে হয়ে ফুটেছে, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা দোলায়িত ধানের সবুজ শীষের মতো দুলেছে, ডগায় ডগায় হাওয়া লাগা কচি পাটের চারার মতো আন্দোলিত হয়েছে। নারকীয় ষড়যন্ত্র এবং পৈশাচিক নির্যাতনের মধ্যে বাস করেও এই দিনটিতে আমরা বাংলাভাষার স্বাধীনতার দাবিতে বিসর্জিত প্রাণ শহীদদের ত্যাগের বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ হিসেবে কথা কয়েছি, গান গেয়েছি, বেদনার্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছি। আমাদের শ্রম কল্পনা ও সংঘ শক্তির উপর ভরসা করে মেরুদণ্ড সোজা রেখে সমস্ত পৃথিবীর প্রতি মৈত্রীদৃষ্টি সম্প্রসারিত করেছি। এই দিনটিতে আমরা উৎসবের আসর জমিয়েছি। আদ্যিকালের প্রাগৈতিহাসিক চেতনা থেকে উৎসারিত আদিমতার ছাপ আঁকা যুথবদ্ধ উৎসব নয়। এই উৎসবের দিনের স্রষ্টা আমরা নিজেরাই, আমাদের সুসভ্য মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার তীক্ষ্ণ তাগিদ থেকে, আমাদের তরুণের লাল খুন থেকে উঠে এসেছে এই উৎসব আমাদের জনজীবনে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আমরা গাঢ় গভীর স্বরে শপথের বাণী উচ্চারণ করেছি, ধৈর্যের সঙ্গে শক্তি সঞ্চয়ের প্রেরণা নিয়েছি, আঘাত খেয়েও আঘাত করার প্রচণ্ড স্পর্ধা বুকে লালন করেছি। জল যে পথে যায় রক্ত সে পথে যায় না, কেননা রক্ত জলের চাইতে গাঢ় এবং ঘন। আমরা শহীদের রক্তের উপর আস্থা স্থাপন করেছি, প্রতি বছর সে আস্থা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে। বাহান্নর রক্ত গোটা জাতিকে আরো রক্তদানের পথে ধাবিত করেছে। বাহান্নর উৎসর্গিত প্রাণ আরো প্রাণকে উৎসর্গের পথে ডেকে নিয়ে গেছে। সে প্রাণের সীমা নেই, সংখ্যা নেই। ভেদ নেই স্ত্রী পুরুষ, জাত নেই হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান। বয়স নেই আতুর ঘরের শিশু, থুথুরে বুড়ো, শ্যামল বটের মতো উঠতি বয়সের তরুণ যুবা। বাহান্ন থেকে বাহাত্তর আমাদের জাতীয় চেতনার উন্মেষের রক্ত সূত্রটি পাহাড়িয়া নদীর মতো বেঁকে বেঁকে এগিয়ে এসেছে, রক্তে আরো রক্ত মিশেছে, প্রবাহ খরতর হয়েছে, তাতে তরঙ্গ ভেঙেছে, জোয়ার ফুলেছে, নামহারা বাংলাদেশের মানুষের ধমনীর নিঃসরিত খুনে মেঘনার স্রোত বয়েছে। এই রক্তের দরিয়ার উপকূলে আভাসিত হয়েছে বিগত বিশ বছরের প্রতিটি ফাল্গুনের উন্মথিত আকাক্ষা, উজাগর চেতনার স্বরূপ স্বাধীন স্বদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আমাদের কল্পনার রত্নভাণ্ডার, স্বপ্নের মুকুল, চিন্তার চিত্রশালা, আবেগ প্রবাহের মধুভাণ্ড, গোপন বেদনার চিনাংশুকের শাড়ি,বাংলাভাষার স্বাধীনতা সংগ্রামে বিসর্জিতপ্রাণ শহীদদের অম্লান স্মৃতির প্রতি পুস্পাঞ্জলি প্রদান করছি। আমরা শহীদের রক্তে আস্থা স্থাপন করে ভুল করিনি। শহীদের রক্ত আমাদেরকে সঠিক পথেই পরিচালিত করেছে। শুধু আমরা নই, ওপার বাংলায় আমাদের ভাষার ভাই এবং সংস্কৃতির অঙ্গজ সন্তান বঙ্গবাসী এবং বঙ্গভাসী জনগণ ইতিহাসে অভূতপূর্ব বাঙালিজাতির একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার দিনে, ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মৃতি তর্পণ করছেন। আমরা পশ্চিম বাংলার ভাইদের প্রতি আজ বহুদিনের অর্গলবদ্ধ প্রীতি এবং সম্প্রীতির দুয়ার উন্মুক্ত করব। বাংলাভাষাভাষী জগতে অমর হোক, শহীদের স্মৃতি অক্ষয় হোক। বাঙালির কাব্যলোক, গল্পলোক, কল্পলোক, সঙ্গীত লোক এবং সাহিত্য সৃজনকে প্রাণের মুক্তি পিপাসা, জীবনের বিচিত্র জিজ্ঞাসা, সুর-তান লয়ে রূপে রসে ছন্দে ধ্বনিত হয়ে উঠুক।
উনিশশ বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। নিজেদের ভেতরের ব্যাপার নিয়ে এত বেশি মগ্ন থাকতে হয়েছে যে, আমাদের ভাষা আন্দোলনের যে একটা আন্তর্জাতিক তাৎপর্য আছে সেদিকে তাকিয়ে দেখার মতো সুস্থির চিত্ত কখনো হতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ভাষাদীন’ জাতি তার ভাষায় কথা বলতে পারে না, কারণ তাকে সব সময় একটা না একটা শক্তিশালী জাতির ভাষায় কথা বলতে হয়, কাজ কারবার চালাতে হয়, মনের ভাব প্রকাশের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে হয় । এটা কোনো জাতি শখ করে করে না, বাধ্য হয়েই করে। আফ্রিকা এশিয়ার দেশগুলিতে ইংরেজি, ফ্রেন্স, ডাচ প্রভৃতি ইউরোপীয় ভাষাসমূহের যে প্রসার ঘটেছে তার মূলে যতটা জবরদস্তি, তার ছটাক পরিমাণও জ্ঞান কিংবা সৌন্দর্যপ্রীতি নেই । যুগে যুগে আমরা দেখেছি বিজয়ী বিজিত জাতির কাঁধে তার ভাষা শিক্ষার দায় চাপিয়ে দিয়েছে। চিরায়ত সাম্রাজ্যবাদের যুগ এখন অবসিত। কিন্তু পচা আদার ঝাঁঝের মতো ভাষার সাম্রাজ্যবাদী ভঙ্গি এখন কোথাও কোথাও নাক উঁচিয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো দেশে কেবল সংখ্যাধিক্যের জোরে কোনো কোনো ভাষা সংখ্যালঘু ভাষাগুলো গ্রাস করার জন্য হাঙরের মতো মুখ ব্যাদান করছে। বাংলাদেশের আন্দোলনের ফলে দুটো বিষয়ই পরিষ্কার হয়েছে। একটি হলো, একটি জাতির ভাষা যতই অসমৃদ্ধ হোক না কেন দৃঢ়ভাবে ইচ্ছে করলে এ ভাষার সাহায্যেই জাতি কাজ কারবার চালাতে পারে এবং গভীর নিষ্ঠায় জাতির সামগ্রিক সৃষ্টিশক্তি নিয়োজিত করলে ঐ ভাষাকেই সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে বিকশিত করে তোলা সম্ভব । অন্যটি একটি দেশের অভ্যন্তরে একটি ভাষা, রাষ্ট্র শক্তির আনুকূল্যে প্রবল হয়ে অন্যান্য ভাষাগুলোর প্রাণশক্তি রুদ্ধ করে ফেলে, আস্তে আস্তে তখন ভাষাগত সংখ্যালঘু ‘ভাষাদীন’ হয়ে দাঁড়ায়। ডারুইনের মতে, ব্যবহারের অভাবে মানুষের লেজ খসে গেছে, তেমনি ব্যবহারের অভাবে ভাষার প্রাণশক্তি থিতিয়ে আসবে তা বিচিত্র কি। একটি ভাষার বিকাশ রুদ্ধ করে একটা জাতিকে চিরকালের জন্য বামুন করে রাখা সম্ভব। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এই ‘ভাষাদীন’ মানুষদের হাতে একটা শক্তিশালী অস্ত্র তুলে দিয়েছে। আমাদের আশপাশের দেশসমূহে যে তার প্রভাব গভীরভাবে পড়েছে বিগত কয়েক বছরের ঘটনাতেই তার প্রমাণ মেলে। উনিশশ বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করেছে, বুকের রক্ত ঢেলে মুখের ভাষার ইজ্জত রক্ষা করার হিম্মত থাকলে যে কেউ ঐ ভাষাকে আশ্রয় করেই জগতে নিজের পরিচয় ফুটিয়ে তুলতে পারে।
উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি আমলে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার স্বীকৃতি মিলেছে। সেটা কি সত্যিকারের স্বীকৃতি? প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ উপনিবেশবাদের মতো ভাষারও সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং উপনিবেশবাদ রয়েছে। পাকিস্তানি আমলে বাংলাভাষা কখনো গণতান্ত্রিক মর্যাদা লাভ করেনি। সমুদ্রের জল থেকে যেমন নীলকে হেঁকে আলাদা করা যায় না, তেমনি একটি জনগোষ্ঠীর থেকে তার ভাষাকেও আলাদা করা অসম্ভব। একটি জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, জলহাওয়া, মৃত্তিকা, নদনদী, কল্পকথা, রূপকথা কত কিছুর মধ্যে শিকড়িত একটি ভাষা। বটবৃক্ষের মূল ঝুরি কেটে কাণ্ড এবং ডালপালাকে যদি বটবৃক্ষ বলে অভিহিত করা যায়, তাহলে পাকিস্তানি আমলের বাংলাও মূলহীন ডালপালাসর্বস্ব রাষ্ট্রভাষাই ছিল। আমরা কি বাংলা ভাষায় বাঙালি ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করতে পেরেছি? আমরা কি বাঙালির সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য, শৈল্পিক ঐতিহ্যের সঙ্গে বর্তমানের সাধনার সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছি? আমরা কি নির্ভাবনায় বাঙালি মনীষীদের রচনা পড়তে পেরেছি? না স্বাধীনভাবে বিচার করতে পেরেছি? আমরা কি বাংলাভাষায় একখানি বই লিখে জীবনবিরোধী ধর্মীয় জাড্য কুসংস্কারের মরচেয় প্রচণ্ড আঘাত করে বাঙালি জাতির সংস্কার মুক্তি সাধন করতে পেরেছি? আমরা কি একখানি বই লিখে বাংলার সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের জীবনের চারপাশ ঘিরে যে ষড়যন্ত্রের জাল, তা কি মুক্ত আলোকে দৃশ্যমান করে তুলতে পেরেছি? আমরা কি বহতা নদীর মতো সৃষ্টিশীলতার আমেজবাহী একখানা সাময়িকপত্র দীর্ঘদিন ধরে চালাতে পেরেছি? এসব কিছুই আমরা পারিনি। তবু বাংলা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানি সংস্কৃতির প্রবক্তাবৃন্দ, যারা ইকবালকে চালু করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের বদলে, সুসভ্য মানুষের জন্য দোভাষী পুঁথি আমদানি করেছেন, জঙ্গিলাট আয়ুব খা-ও কবিতার রসিক একথা অপরকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন, মহাপুরুষ, আদমজী-দাউদেরা সাহিত্যের সমঝদার এ কথা ভুল করে ঠিক ঠাউরেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করি। পুষ্প চন্দন বর্ষিত হোক শিরে, তাদের পদোন্নতি ঘটুক সরকারের পররাষ্ট্র বিভাগে। তারা বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তর খোঁচাখুচি করেছেন এবং সাফল্যজনকভাবে অনেকগুলো চক্ৰ উপচক্রের জন্ম দিতে পেরেছেন দয়া করে তারা বিশ্রাম করুন । আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ। বাঙালি সংস্কৃতিকে ক্ষমা করে সত্যি মহত্ত্বের পরিচয় দেবেন, রক্তস্নাত বাঙালি জাতি এটা স্বাভাবিকভাবেই আশা করে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, যদি অসুবিধা না হয় আমাদের সংস্কৃতির প্রাক্তন মুরুব্বিদের কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিন। দেশে থাকলে তাদের ক্লান্ত মস্তকগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে। যাবজ্জীবন ধরে সাম্প্রদায়িকতার বেসাতি করে যাদের নাম ধাম খ্যাতি এবং পদোন্নতি, তারা যদি পুরনো আসনগুলোতে নড়ে চড়ে ফের বসেন তাহলে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভরাডুবি হবে।
বাংলাদেশে একটি নতুন রেনেসাঁর সূত্রপাত হতে চলেছে। চারিদ্র্যের দিক দিয়ে উনিশ শতকের কলকাতা শহরকেন্দ্রিক বাংলার যে প্রাণজাগরণ তার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। বস্তুত সকল রেনেসাঁর মধ্যে একটা ভাবগত সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায় । মানুষের মানুষী অস্তিত্বের নতুন মূল্যায়ন; ধর্মীয় সামাজিক ইতিনেতি সকল সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে জীবনের প্রকৃত সংজ্ঞায়নই হলো রেনেসাঁর মূল বৈশিষ্ট্য। সূর্যের নিচে মানুষের সমাজের প্রকৃত স্থান কোথায় শিল্প সাহিত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের নিরিখে আবিষ্কার করে মানুষের চিন্তাপদ্ধতির মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন সাধন করাই রেনেসাঁর কাজ। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় অন্ধকারে সংলপ্ত ইউরোপে এমনটি ঘটেছে। এমনটি ঘটেছে উনিশ শতকের বাংলায়। বৃক্ষ সমাজের মতো অনড় অটল বাঙালি সমাজ থেকেই বেরিয়ে এল প্রতিভার মিছিল। বেরিয়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন ধরনের মানুষ। বুকে বিদ্রোহের ধিকিধিকি আগুন, চোখে নতুন আকাক্ষার ঝলকানি, মাথায় নতুন একটি জগৎ সৃজনের পরিকল্পনা। এখন আমরা যে সময়টিকে বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলে থাকি রেনেসাঁর প্রেরণায় তার আঁশ শাষ পুষ্ট, হৃৎপিণ্ড ধমনীতে ছন্দায়মান নতুন জীবনবোধের প্রেরণা।
ইউরোপীয় রেনেসাঁ জগতের শুদ্ধভাবের বিকাশের ক্ষেত্রে, পশু মানুষকে বোধসম্পন্ন উন্নত দেবধর্মী মানুষ হিসেবে রূপায়ণে, জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টিতে, শিল্পকলার লাবণ্য সঞ্চারের মধ্য দিয়ে যন্ত্রবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিদ্যায় উৎকর্ষ সাধনে, শিল্পবিপ্লবে, সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় শক্তিসমূহের রাজ্য বিস্তার, পরবর্তীকালে রুশ বিপ্লব এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য এশীয় দেশের সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক বিপ্লবে অনেক কিছুই দান করেছে। উনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁ অন্তত কতিপয় বাঙালি মনের সংস্কার মুক্তি সাধন করেছে। তথাকথিত প্রাচ্য দর্শনের বর্বর অন্ধকার ঠাসা মনকে বাংলার কতিপয় মানুষ উনিশ শতকের শুরু থেকেই জ্ঞানের প্রখর সূর্যের আলোর দিকে ফিরিয়েছিলেন। তার কথা শিক্ষিত সংস্কৃতিবান বাঙালির কাছে নতুন করে বলে লাভ নেই। বাঙালি ধর্মীয় মোহ ছেড়ে সাহিত্য সৃজনে মন দিল। সে সাহিত্য কালের কণ্ঠে ইন্দ্রমনির হারের মতো অনেকদিন দুলবে । বাঙালি কালাপানির সীমানা ডিঙিয়ে গেল। বাঙালি বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকল, বাঙালি নতুন সমাজ রচনায় ব্রতী হলো, নতুন রাষ্ট্রের বুনিয়াদ স্থাপনের জন্য শক্তি নিয়োগ করল । আজকের বাংলা কেন, স্থূল অর্থে সমগ্র ভারতে যা হয়েছে তা উনিশ শতকের বাংলার, রেনেসাঁসের প্রেরণা থেকেই সম্ভাবিত হয়ে উঠেছে। প্রতিটি প্রতিশ্রুতিবান সকালের তেজীয়ান সূর্য যেমন অপরাহে ক্লান্ত ছায়া মেলে দেয়, তেমনি প্রতিটি রেনেসাঁর আলোকতরঙ্গও নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অন্ধকারের সাগরে অবগাহন করে । রেনেসাঁর মূলমন্ত্র জ্ঞানই শক্তি বিকশিত হওয়াই জ্ঞানের ধর্ম। কিন্তু ধর্মীয়, সামাজিক, শ্রেণীগত, জাতিগত অহংবোধে পীড়িত মানব সমাজ জ্ঞানকে সেবাদাসী করতে গিয়ে নিজের সমাধি রচনা করেছে। আলোকিত গ্রিসকে দাসভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা হত্যা করেছে, সুসভ্য ইউরোপকে ধনতান্ত্রিক শোষণ ব্যবস্থা কোণঠাসা করে এনেছে। উনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁসের প্রাণসম্পদ এবং ভাবসম্পদ এখন অবসিত হয়ে এসেছে। আমরা আজ উনিশশ বাহাত্তর সালের শুরুতে দাঁড়িয়ে এ কথা যদি বলি, আশা করি অন্যায় করব না।
বাংলাদেশে যে একটি নতুন রেনেসাঁ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার ব্যাপ্তি এবং গভীরতা অনেকদূর। তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিপূর্ণ এবং সুবলয়িত। কেননা উনিশ শতকের রেনেসবোধের বিকাশ হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের লৌহ কাঠামোর অভ্যন্তরে । সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কখনো চায়নি সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বিকাশ হোক। তাই উনিশ শতকী রেনেসাঁ অনেকগুলো বিশ্ববিশ্রুত মনীষার সৃষ্টি করলেও সমাজের সাধারণ মানুষকে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত মানুষকে জ্ঞানের ভোজে আমন্ত্রণ জানায়নি এবং সুন্দর জীবনবোধে উদ্দীপিত করতে পারেনি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে নবজাগরণের যে ক্ষেত্র আভাসিত হয়েছে তাতে কোনো বিধি-নিষেধের বালাই নেই। বাংলাদেশের গণসংগ্রামের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়, জ্ঞান সমাজের সকল মানুষের জন্য এবং সকল মানুষের সুন্দরের বোধে উদ্দীপিত হওয়ার অধিকার জন্মগত। বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর, সকল স্তরের মানুষ গণসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে, প্রাণ দিয়ে রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছে যে, সুন্দর উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, সমৃদ্ধ মানবসমাজ সৃজন এবং নতুন একটি দীপ্ত ধারার সভ্যতা নির্মাণ করার জন্য নিজের যা কিছু মূল্যবান বিসর্জন দিতে পারে।
বাংলাদেশের গণসংগ্রামকে কেউ কেউ বলেছেন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রম সংশোধন, কেউ কেউ বলেছেন বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর । এসবের কতটুকু সত্যি কতটুকু মিথ্যা সে বিষয়ে আলোচনা না করেও একটি কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়, ইতিহাসে এই প্রথম বাঙালি জাতি নিজে একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিল, ইতিহাসে বাংলা ভাষা এই প্রথম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেল। এটা আপনি আপনি ঘটেনি। যে পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে, প্রাণ দিতে হয়েছে স্মরণকালের ইতিহাসে তার জুড়ি নেই। এজন্য বাংলার প্রতিটি মানুষ, সর্বস্তরের মানুষ অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত কারণেই গর্ববোধ করতে পারে। এই গর্ববোধই বাংলাদেশে নবযুগ এবং নবজাগরণের গতি-প্রকৃতি বেগ আবেগ সঞ্চার করবে। এ ফাঁকা আশাবাদ নয়। কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদও নয়। ইতিপূর্বে লড়য়ে হিসেবে বাঙালিরা সুদক্ষ এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করার কোনো সুযোগ-সুবিধা জাতি হিসেবে পায়নি। যখনই প্রয়োজন বাধ্য করেছে তাদেরকে, বলতে গেলে খালি হাতেই লড়াই করতে হয়েছে এশিয়ার একটি দুর্ধর্ষ বাহিনীর সঙ্গে। বন্ধু দেশগুলো সাহায্য করেছেন, তাদের ধন্যবাদ। কিন্তু একটি সমগ্র জাতির স্বাধীনতার জন্য, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মরণের এই যে সরল এবং বীরত্বব্যঞ্জক প্রস্তুতি তা না থাকলে কোনো সাহায্যই কাজে আসত না। প্রয়োজনের তাগিদেই বাঙালিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস দর্শনেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতেই হবে। এ কঠিন কাজ। কিন্তু নতুন ইতিহাস সৃজনের কোনো সহজ পন্থা এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। আগে অভাব যে পরিমাণে বোধ করেছি এখন তা একশ গুণ বেশি তীব্রভাবে অনুভব করছি। কারণ দাসজাতির অভাব অল্প, তার ক্ষমতাও অল্প। আমরা আমাদের ক্ষমতা উপলব্ধি করেছি এবং অভাবটাও তীক্ষ্ণভাবে অনুভব করছি। গলদ কোথায় ধরতে পারছি। আগে আমরা কিসে আমাদের মঙ্গল এবং কিসে আমাদের অমঙ্গল ভাবতে পারতাম না। এখন সে বাধা অপসারিত। তেইশ বছরের পাকিস্তানি শাসন একটা দুঃস্বপ্ন। এখন থেকে সচেতনভাবে, সক্রিয়ভাবে আমাদের মঙ্গলামঙ্গল বিবেচনা করতে পারব এবং অপরকে নিজের কল্যাণ ভাবনায় ভাবিত করে তোলার পথে কেউ বাধা দিতে হইচই করে ছুটে আসবে না। অন্য দশটি স্বাধীন সমৃদ্ধিশালী জাতির মতো আমরাও মাথা তুলে দাঁড়াবো। জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, প্রযুক্তিবিদ্যা কোনো দিকে কোনো জাতির চাইতে পিছিয়ে থাকব না। আমরা সমাজ এবং সমাজ আদর্শকে নতুনভাবে ঢালাই করব- যেমনটি আমাদের মন চায়, সাধ্যে কুলায়। জীবনবিরোধী সমাজবিরোধী সকল অন্ধ তামসিক শক্তির বিরুদ্ধে আমরা ক্ষমাহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমরা কারো মতো হব না, আমরা আমাদের মতো হব। আমরা কারো
অনুকরণ করব না, নিজেদের সৃষ্টিশক্তি বিকশিত করে তুলব। আমরা আমাদের মতো করে কাব্য লিখব, সাহিত্য করব, ইতিহাস সাধনা করব, দর্শন চর্চা করব, বিজ্ঞানের চর্চায় মন দেব। এক কথায় পৃথিবীর সমাজ বিপ্লবগুলোর এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের ইতিহাসের সারাৎসার মন্থন করে, প্রয়োজনীয় শ্রম, ত্যাগ এবং তিতিক্ষা সয়ে সবকিছু সম্মিলিত জীবনধারার অনুকূল করে গড়ে তুলব। মেঘনা পদ্মা-বিধৌত এই পাললিক ভূমিতে বাংলার সংস্কৃতি বাঙালির ঐতিহ্যে নতুন রক্ত মুকুল মেলবে। এই বাংলাদেশে বাঙালির বিজ্ঞান সাধনার ফসল আকাশ স্পর্শ করবে। সত্য ভাবার, সত্য বলার এবং সত্য আবিষ্কার করার কত বলিষ্ঠ চিত্তের প্রয়োজন আজ সব চাইতে বেশি। মিথ্যার সঙ্গে যারা আপোস করে কথায় কথায়, তাদের দিয়ে একটি জাতির মোড় ফেরানো যায় না। আমাদের জ্ঞানী-গুণী এবং বিদ্বজ্জনমণ্ডলী পরম নির্ভয়ে সত্য আবিষ্কারে স্বাধীনভাবে মন দিলে তাদের সাধনার মধ্য থেকেই জাতির সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। আজকে মনের সে স্বাধীনতা চাই এবং চাই সে সাহসিকতা। দাসসুলভ মনোবৃত্তি দিয়ে কখনো একটি স্বাধীন জাতির চিত্তবৃত্তিতে বেগ জাগানো যায় না। প্রকৃত মানসিক স্বাধীনতা এবং দুর্মর সত্য অন্বেষাই বাঙালির প্রতিটি ভাবুককে ভাবিত করুক, প্রতিটি কর্মীকে কর্মক্ষেত্রে তাড়িত করুক। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ভাষা আন্দোলনের শহীদদের অম্লান স্মৃতি বুকে নিয়ে এটাই কামনা করছি।
আমাদের নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তিভূমি ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্র । গণতন্ত্রের দাবিতে উপনিবেশবাদী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমরা গত তেইশ বছর ধরে কঠোর কঠিন মরণপণ সংগ্রাম করে আসছি। সমাজতন্ত্র আমাদের সামাজিক অর্থনৈতিক অসাম্য দূরীভূত করার প্রাগ্রসর দাবি। ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের সভ্য মানুষ হিসেবে বসবাস করার প্রাথমিক অভিজ্ঞানপত্র। এগুলো বাইরের কোনো দেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। আমাদের সামাজিক জীবনের বাস্তব দাবি থেকেই এগুলোর উৎপত্তি। যারা সমাজতন্ত্রের জন্য লিখবেন, ভাববেন, যারা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাইবেন এবং যারা সাম্প্রদায়িকতার রূপ ব্যাধিকে সমূলে উৎপাটিত করে সুন্দর সুসভ্য মানুষদের একটি সমাজ এই বাংলাদেশে কায়েম করার জন্য সমস্ত মানুষের হয়ে চিন্তা করবেন তাদের সে স্বাধীনতা যেন থাকে। এই গ্যারান্টি আমরা আজ সরকারের নিকট নিশ্চিতভাবে চাই, এই অধিকার আমাদের জন্মগত অধিকার। আমরা মনে করছি যে যুগের অবসান হয়েছে যখন আবদুল মোনেম খানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের ধমক দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং গীতাঞ্জলী রচনার নির্দেশ দিতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে একটি অসভ্য, অন্ধকার যুগের অবসানকালে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-পরিজনের বিয়োগ বেদনা বুকে নিয়ে আজ জয়ধ্বনি করছি।
বল ভাই মাভৈঃ মাভৈঃ
নব যুগ ঐ এল ঐ
সমস্ত বর্বর চেতনা, চিন্তা এবং অশালীন মনোবৃত্তির অবসান হোক।
১৯৭২