একূল-ওকূল
“নিশুতপুর আর রফিগঞ্জের সীমানা নির্দেশ করছে যে বিশাল মাঠটা, তারই একপাশে রয়েছে নিশুতপুরের কবরখানা আর অন্যপাশে রফিগঞ্জের শ্মশান। অবাক কাণ্ড এই যে, নিশুতপুরের বাসিন্দারা প্রায় সকলেই হিন্দু আর রফিগঞ্জে বাস মুসলমানদের। শোনা যায়, দেশভাগের সময়কার এক করুণ কাহিনি জড়িয়ে আছে এই দুই গ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে। একসময়ে এই দুই গ্রামের মানুষ পাশাপাশি বন্ধুর মতো বাস করতো। তখন দুই গ্রামেই ছিল প্রায় সমপরিমাণ হিন্দু-মুসলমানের বাস। ঈদে আর দুর্গাপূজায় ছিল দুই সম্প্রদায়ের সমান অংশীদারী। দেখে বোঝার উপায় ছিল না, ঈদের দিন ঝলমলে পোশাকে হেসে গড়িয়ে পড়া ছেলেটির নাম রাঘব রায়। আর দুর্গাপূজার অঞ্জলির জোগাড় করতে ব্যস্ত মেয়েটি হল আনোয়ার আলির ছোট কন্যা শগুফতা। তাই সেই সময় অভিভাবকদের চোখের আড়ালেই একটু একটু করে তৈরি হচ্ছিল যে গল্প, কে জানত তার পরিণতি বেশ কয়েক দশক পরেও তটস্থ করে রাখবে দুই গ্রামের মানুষকে।
একসঙ্গে খেলতে খেলতে বড়ো হওয়ার পথেই কী করে যেন হৃদয়ের একূল-ওকূল দুকূল ভেসে গেল দুই কিশোর-কিশোরীর। নিশুতপুরের জমিদার বংশের কিশোর পুত্র রাঘব প্রেমে পড়ল তাদেরই লেঠেল রফিগঞ্জের আনোয়ার আলির কন্যা শগুফতার। হিজাবের বাধা পার করে চার চোখের সংঘর্ষে ছিটকে গিয়েছিল ধর্মীয় বেড়াজাল। যদিও আগেই বলেছি, ধর্মীয় বেড়াজাল যত না ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল বিলুপ্তপ্রায় জমিদারির অহংকার, সামাজিক অবস্থানগত বাধা। কিন্তু পোশাক-আশাক, চিন্তা-ভাবনায় আদ্যন্ত আধুনিক, স্কুলে পড়া রাঘব বাবার অহংকারের ছিটেফোঁটাও নিজের মধ্যে প্রবেশ করতে দেয়নি। পড়াশোনার অবকাশে বৃদ্ধ পিতার অমতে সে তার উচ্চবংশীয় আভিজাত্যকে পিছনে ফেলে বেরিয়ে পড়ত মেঠো বন্ধুদের সঙ্গে। কখনো মাইলের পর মাইল তাদের পাশে হেঁটে পৌঁছে যেত কোনও বাউল মেলায়, কখনো বা দুপুরে কোনও গরীব চাষা-বন্ধুর সঙ্গে তার বাড়িতেই গুগলি-সেদ্ধ আর নুন দিয়ে দুটি মোটা চালের ভাত খেয়ে গামছা পেতে শুয়ে পড়ত তাদের দাওয়ায়।
শক্তসমর্থ চেহারার আনোয়ার আলি রাঘবের জন্মের বহু আগে থেকেই জমিদারবংশের লেঠেল। রাঘব কেন, রাঘবের তিন দাদাও তার কোলে পিঠে মানুষ। আনোয়ারের তৃতীয় স্ত্রীর কনিষ্ঠতম সন্তান হল শগুফতা। আনোয়ারের সেজপুত্র আব্বাস ছিল রাঘবের গলাগলি বন্ধু। কাজেই আনোয়ারের মাটির বাড়িতেও যাতায়াত ছিল রাঘবের। আনোয়ারের অন্দরমহলে পরদাপ্রথা প্রচলিত ছিল ঠিকই, কিন্তু বাকি দুই স্ত্রীর মতো তার তৃতীয় স্ত্রী রাবেয়াও যখন চল্লিশ বছর বয়স হওয়ার আগেই মারা যায়, তারপরে অন্দরের আব্রু রক্ষার ভার পড়েছিল বছর পনেরোর শগুফতার উপরেই। মাথার উপরে চার দাদা ও বাবা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে যেন তার কিশোরীসুলভ প্রগলভতা পরদাপ্রথার কাঠিন্যকে একটু আলগা করে দিয়েছিল। আনোয়ারও বোধহয় বয়সকালের কনিষ্ঠ সন্তান একমাত্র কন্যা শগুফতাকে একটু বেশিই স্নেহ করতো। স্নেহের রন্ধ্রপথেই প্রবেশ করেছিল প্রশ্রয়। স্নেহ হয়তো তার ছিল উভয়পক্ষের প্রতিই। রাঘবকেও কম ভালোবাসতো না আনোয়ার। মেয়ের সঙ্গে তার মেলামেশা চোখে পড়েনি এমনটাও নয়। তবে বাপের মন তো, কন্যার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হয়তো নিজের অজান্তেই কোনও বড়ো স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল আনোয়ার।”
এই পর্যন্ত বলে একটু জল খেল খুড়ো। আমরা চার বন্ধু খুড়োর প্রায় গা ঘেঁষে বসেছি এতক্ষণে। খুড়োর গল্প বলার কায়দা এত আকর্ষণীয় যে, মনে হচ্ছিল চোখের সামনে ঘটতে দেখছিলাম ঘটনাগুলো। বয়স হয়েছে খুড়োর। একটানা কথা বলে হাঁপিয়ে যায়। খুড়ো একটু দম ফেলুক, এই সুযোগে আমাদের এই গণ্ডগ্রামে আসার কারণটা একটু বলে নিই। আমরা চার বন্ধু কলেজ থেকেই হরিহর আত্মা। একে অপরের জীবনের সব ঘটনাই মনে হয় জানি। মেসে একই ঘরে একসঙ্গে থেকেছি অন্তত পাঁচ বছর। বছর দুয়েক হল যে যার পথ খুঁজে নিয়েছি। চারজনই মোটামুটি ভালো চাকরি করি। আমি থাকি ব্যাঙ্গালোরে। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থায় মাঝারি পদে কর্মরত।
নিশান থাকে জয়পুরে, প্রমিত আর সাহেব কলকাতায়। সাহেবের দেশের বাড়ি হল নিশুতপুর। ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারে অবস্থিত এই গ্রামটির আসল ঠিকানা উহ্যই থাক। সাহেবের কলেজ লাইফ কলকাতায় কাটলেও স্কুলজীবন এই নিশুতপুরেই। ওর মুখেই অনেকদিন আগে শুনেছিলাম নিশুতপুরের কবরখানা আর রফিগঞ্জের শ্মশানের গল্প। এখন এই দুই সৎকার স্থানই পরিত্যক্ত। মানুষ এখন শেষ শান্তির জন্য খুঁজে নিয়েছে অন্য ঠিকানা। কিন্তু বিশেষ বিশেষ রাতে নাকি মাঠের দু-পাশে মুখোমুখি অবস্থিত দুই ধর্মের দুই শেষ শয্যা জেগে ওঠে, আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে, অব্যক্ত আকুতিতে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে রাতের নিস্তব্ধতা। যারা মাঠের ধারে কাছে থাকে, তাদের কানে ভেসে আসে নারী পুরুষের মিলিত স্বরের কান্নার সুর। দুই গ্রামে বিরাজ করে এক আতঙ্কের আবহ।
বছরে একদিনই এরকম হয়। আস্তে আস্তে গ্রাম দুটো খালি হতে শুরু করেছে। যাদের উপায় আছে, তারা শহরের দিকে বাড়িঘর নিয়ে চলে যাচ্ছে। আর যাদের নেই; তারাও অন্তত ছেলেপিলেদের পাঠিয়ে দিচ্ছে শহরে। এভাবেই সাহেবের বাবা-মা আর জেঠু-জেঠি দেশের বাড়ি আগলে পড়ে আছেন। সাহেব আর ওর তুতো ভাইবোনরা সকলেই শহরে। এতদিন পর বিভিন্ন কারণে চার বন্ধু প্রায় একইসঙ্গে ছুটি পেয়ে কমবয়সের কৌতূহল মেটাতে চলে এসেছি নিশুতপুরে। আমি, প্রমিত আর নিশান সাহেবকে আড়াল করে ঠিক করেছি রাতে একবার অন্তত ওই শ্মশান আর কবরখানা দর্শনে যাব। সাহেব আর ওর বাড়ির লোক জানলে বেরোতে দেবে না। তাই ওদের লুকিয়েই বেরোতে হবে। তার আগে এর গল্পটা জানা জরুরী,যেটা সাহেব আমাদের খুব ভালোভাবে বলতে পারেনি। আর ওর বাড়ির লোককে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল না। তাহলে হয়তো ওঁরা আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য আঁচ করে ফেলতেন। আর সেটা আমরা চাইনি। তাই সাহেবের বাড়ি থেকে কয়েক পা দূরের চায়ের দোকানের বিক্রেতা বৃদ্ধ খুড়োকেই বেছে নিয়েছিলাম।
আজ সকালেই এসে পৌঁছেছি এখানে। খুড়োর বিক্রিবাট্টা যখন শেষের মুখে, রাত আটটা নাগাদ চারমূর্তি গল্প শুনতে খুড়োর দোকানে উপস্থিত হয়েছি। অক্টোবরের প্রথম দিক। শহরে ঠান্ডা না পড়লেও গ্রামে রাতের দিকে বেশ একটা শিরশিরে ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ নিয়ে জমে উঠল খুড়োর গল্প।
“এভাবেই কেটে গেল দু-চারটে বছর। মাতৃহীন শগুফতার বিবাহের প্রসঙ্গ বারবার উঠতে থাকলেও বাস্তবায়িত হচ্ছিল না উদ্যোগের অভাবে। রাঘব স্কুল শেষ করে কলেজে। তার বৃদ্ধ পিতা এখন শয্যাশায়ী। বড়োদাদা নীতীশ দেখাশোনা করে জমিদারীর সামান্য যা কিছু কাজকর্ম। এমন সময় এল সেই সর্বনাশের দিন। ভাগ হয়ে গেল বাংলা। এতদিন ধরে পাশাপাশি বাস করছিল যে মানুষগুলো সহোদর ভাইয়ের মতো, রাতারাতি একে অপরের রক্তের পিয়াসী হয়ে উঠল। বাইরের পৃথিবীতে ঘটে-চলা ঘটনাবলীর গনগনে আঁচ স্পর্শ করল নিশুতপুর আর রফিগঞ্জকেও। হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বে রক্ত ঝরলো দুই গ্রামের পথে ঘাটে। পাশের বাড়ির মানুষকেও আর বিশ্বাস করছিল না কেউ। এমন পরিস্থিতিতে জানি না কীভাবে নিশুতপুর হয়ে গেল হিন্দুর, আর রফিগঞ্জ মুসলমানের। নিশুতপুরের মুসলমানরা গিয়ে ঘর বাঁধল রফিগঞ্জে আর রফিগঞ্জে পুরুষানুক্রমে বাস করে আসা হিন্দুদের নতুন সংসার হল নিশুতপুরে। শুধু বদলানো গেল না শ্মশান আর কবরখানার অবস্থান। তারা নিজেদের পুরোনো জায়গায় বসে বুক চাপড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
এমনই এক থমথমে সন্ধ্যায় একদল উন্মত্ত জনতা রাঘব আর শগুফতাকে আবিষ্কার করল ওই শ্মশান আর কবরখানার মাঝের মাঠে। একে অপরের আলিঙ্গনে, যেন শেষবারের মতো তারা ছুঁয়ে নিচ্ছে পরস্পরকে। জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপর। টেনে ছিঁড়ে নিল যেন বনস্পতির দেহ থেকে ব্রততীকে। রাঘবকে টেনে নিল মুসলমানের দল রফিগঞ্জের দিকে আর শগুফতাকে হিন্দুর দল নিশুতপুরের দিকে। শোনা যায়, আনোয়ার নাকি চেষ্টা করেছিল তার লেঠেলের বিদ্যা কাজে লাগিয়ে রাঘবকে বাঁচানোর। কিন্তু বুড়ো হাড়ে খুব বেশিক্ষণ যুঝতে পারেনি। উন্মত্ত জনতা তাকেও পিটিয়ে হত্যা করে। তারপর রফিগঞ্জের শ্মশানে জ্বলে উঠেছিল একটা চিতা, যাতে হাত-পা বেঁধে জীবন্ত চড়ানো হয়েছিল একটি সদ্যযুবককে, যে শুধু ভালোবাসতেই জানত। অন্যদিকে শগুফতার উপরে চলেছিল অমানুষিক নির্যাতন। পাঁচজন, দশজন, না বিশজন-কতজন মিলে ওর নব্যযুবতী দেহটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ করেছিল, তা বোধহয় নিজেও গুণে শেষ করতে পারেনি মেয়েটা। গোনা শেষ হওয়ার আগেই হয়তো ওর দু’চোখের আলো নিভে গিয়েছিল। মরে যাওয়ার কতক্ষণ পরে ওরা সেটা টের পেয়েছিল জানি না, তবে যখন টের পেল, তখন নিশুতপুরের কবরে কোনওরকমে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল দেহটাকে। সেটা ছিল বছরের এমনই একটা সময়। ঈদ আর দুর্গাপূজার মাঝামাঝি। ঠিক কোন তিথি বা নক্ষত্র ছিল, তা তো কেউ খেয়াল করেনি; কিন্তু সেই থেকে প্রতি বছর এই সময়ে কোনও একদিন ওই কবর আর শ্মশান রাতে জেগে ওঠে। পৈশাচিক আর্তনাদ আর কান্নায় ভরে ওঠে দুই গ্রামের আকাশ বাতাস। যেন সত্তর দশকেরও বেশি সময় ধরে দুই প্রেমিক-প্রেমিকার বুকফাটা যন্ত্রণা তাদের মৃত্যুর তিথিতে শব্দে প্রকাশ পায়।”
খুড়োর গল্প শেষ। রাত অনেক হয়েছে। আমরাও যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছি গ্রামের থমথমে রাতের মতো। সাহেবের বাড়িতে ফেরার পথে আকাশে তাকিয়ে দেখলাম একফালি চাঁদ যেন আতঙ্কে সিঁটিয়ে রয়েছে। দু-তিনদিন হল ঈদ গেছে। দুর্গাপুজো প্রায় এসে গেছে। এমনই কোনও এক দিনে বিনা অপরাধে কেবল অমানুষিক হিংসার বলি হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল দুই সদ্য যুবক-যুবতী। সাহেবকে বললাম বাড়িতে গিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। আমরা তিনজন সিগারেট ধরিয়ে বাড়ির বাইরের রাস্তায় পায়চারি করতে লাগলাম। মাথাটা কেমন ভারী ভারী ঠেকছে। সাহেব একটু ইতস্তত করলেও শেষপর্যন্ত কিছু না বলে বাড়িতে চলে গেল। আমাদের সিগারেট যখন প্রায় শেষের পথে, তখন হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দে একসঙ্গে তিনজন চমকে পিছনের দিকে তাকালাম। কেউ যেন গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। প্রথমে একটা নারীকণ্ঠ, তারপর এক থেকে দুই, দুই থেকে শত শত নারী-পুরুষের সম্মিলিত গলার স্বর। বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ-বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। অদ্ভুতভাবে কোথা থেকে কুয়াশা নেমে এসেছে চারিদিকে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে চাঁদও। আমাদের মধ্যে প্রথম নড়ে উঠল প্রমিত। আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, “চল্’।
কোথায় যাব জানি না। কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকারে কুয়াশার পরদা ভেদ করে আওয়াজ লক্ষ্য করে ছুটে চললাম তিন বন্ধু। কতদূর ছুটেছি জানি না। এসে থামলাম এক ধূ ধূ প্রান্তরে। এখানে কুয়াশা আরও ঘন। কান্নার শব্দও এখন আরও বেশি স্পষ্ট। যদিও মনে হচ্ছে শব্দটা যেন দরজা জানলা আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ কোনও ঘরের মধ্য থেকে ভেসে আসছে। অর্থাৎ শব্দটার ফ্রিকোয়েন্সি মোটেই তীক্ষ্ণ নয়, ভোঁতা। আমাদের মনে হল আমরা এসে দাঁড়িয়েছি নিশুতপুরের কবর আর রফিগঞ্জের শ্মশানের মাঝখানে। যদি খুব গুলিয়ে না ফেলি, তবে আমাদের বাঁদিকে নিশুতপুর আর ডানদিকে রফিগঞ্জ। নিশানের গলা থেকে একটা চাপা স্বরে আমার চটকা ভাঙল। তাকিয়ে দেখি, মাঠের দু’দিক থেকে কুয়াশা দিয়ে তৈরি কিছু অবয়ব যেন হাওয়ায় ভেসে ভেসে আসছে। তাদের প্রত্যেকটি একইরকম, তা সত্ত্বেও প্রতিটিকে আলাদাভাবে বোঝা যাচ্ছে। নিশুতপুরের দিক থেকে কিছু, আবার রফিগঞ্জের দিক থেকে কিছু। অবয়বগুলোর চোখমুখ কিছু বোঝা না গেলেও মুখের কাছটায় একটা গোল ছিদ্রমতো, যেন চিৎকার করার জন্য হাঁ করেছে। শব্দটা এখন ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। দু’পাশ থেকে ভেসে এসে অবয়বগুলো মাঠের মাঝখানে এসে জড়ো হচ্ছে। সেখানে যেন একে অপরকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছে তারা। হঠাৎ আমার মনে হল, এখানে আর থাকা ঠিক নয়। একটা কনকনে শীতলতা আমাদের জড়িয়ে ফেলছে পাকে পাকে। নিঃশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। ভারী হয়ে এসেছে আশেপাশের বাতাস। মনে হল, এত বছরের এই রহস্য আমরা তিন শহুরে মানুষ জেনে ফেলি, এ যেন গ্রামের প্রকৃতি চাইছে না। কোনওরকমে কীভাবে ওখান থেকে ফিরে এলাম, তা চাইলেও বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সাহেব, ওর বাবা আর জেঠু আমাদের খোঁজে এদিকেই আসছিলেন। প্রায় হতচেতন অবস্থায় আমাদের পেয়েছিলেন তাঁরা।
পরদিনই ফিরে এসেছিলাম। হৃদয়ের কোন অভ্যন্তর থেকে একটা অনুভূতি উঠে মনটাকে ভারী করে তুলেছিল। মনে হয়েছিল, ওরা আসলে দাঙ্গায় মৃত মানুষগুলির বা দুই প্রেমিক-প্রেমিকার আত্মা নয়, ওরা এককালে দুই গ্রামের মধ্যেকার ভালোবাসার আত্মা। ওরা মাঝে মাঝে জেগে ওঠে মৃত মনুষ্যত্বের আখ্যান শোনাতে। আজও হয়তো ওই কবরের কোনও প্রান্তে ঈদের রাতে রংবেরঙের জামা পরে বন্ধুদের সঙ্গে মেতে ওঠে রাঘব। শ্মশানের মধ্যে সংগোপনে জ্বলে ওঠে অষ্টমীপুজোর যজ্ঞের আগুন, আর সেই আগুনের আঁচ আড়াল করে দেয় কিশোরী শগুফতার প্রথম প্রেমের স্পর্শে লজ্জারাঙা মুখ। কিছুই আসলে হারায়নি, কিছুই হারায় না। প্রকৃতি তার রহস্যময় আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখে মানুষের ইতিহাস। আর আমরা কখনো কখনো সেই ইতিহাসের ছোঁয়াটুকু পাই মাত্ৰ।