একা – ১২

বারো

পকেটে একটা চিঠি, পায়ের তলায় কলকাতা, চারপাশে ব্যস্ত ডালহৌসির অফিস পাড়া। চিঠিটা দেবুদা দিয়েছেন তাঁর বন্ধু কর্নেল চৌধুরীকে। কর্নেল সাহেব এক তাজা কোম্পানির ডিরেকটার। একবার কৃপাদৃষ্টিতে চাইলে আমার অবস্থা যে কতটা ফিরে যাবে তার কোনো ধারণা আমার নেই। যে খাটতে পারে, সৎ, কর্নেল তাকে রাজত্ব, রাজকন্যা দিতে প্রস্তুত।

বেয়ারা চিঠিটা নিয়ে ভেতরে গেল। ফিরে এলে বললে, ‘বসতে হবে।’

বসতে যখন হবে, বসেই পড়ি। চেয়ার গোটাকতক। দেয়ালে কিছু যন্ত্রপাতির ছবি। ট্র্যাকটার, পাওয়ার টিলার, লন মোয়ার। মাথার ওপর পাখা। মৃদু কিঁচ কিঁচ শব্দ। পাশের আর একটা ঘরে টাইপরাইটারের খটাস খটাস শব্দ। কেমন যেন মনমরা অফিস। তবে বেশ পরিষ্কার ঝকঝকে। বসে থাকতে খারাপ লাগছিল না। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর মনে হল, চাকরিটা আমি পেয়েই গেছি।

প্রায় একঘণ্টা, তারপর আমার ডাক পড়ল। প্রবীণ একজন মানুষ। পেটা কড়ার মতো স্বাস্থ্য। মাথার সমস্ত চুল ধবধবে সাদা। কার্পেটমোড়া মেঝে। পালিশ করা টেবিল।

—বোসো।

নমস্কার করেই ঢুকে ছিলুম। বসে আর একবার নমস্কার করলুম। ভদ্রলোকের চোখ দুটো অসম্ভব জ্বলজ্বলে। বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। অস্বস্তি হয়। মনে হয় ভেতরটা পড়ে ফেলছেন। বেশ কিছুক্ষণ কথা না বলে তাকিয়ে রইলেন। শেষে প্রশ্ন করলেন, —কী করো?

—কিছুই করি না।

—কেন করো না?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেলুম। কী বলব? কেন কিছু করি না? বলব, চাকরি পাই না? চাকরির চেষ্টা তো সে—ভাবে করিনি! ক—জনের কাছে গেছি? এই ভাবনার পর বললুম,—প্রয়োজন হয়নি।

—এখন হঠাৎ হল?

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল—বাঁচার শখ হয়েছে।

ভদ্রলোক চমকে উঠলেন—ব্যঙ্গ করছ?

—অভদ্র নই। আমি দেবুদার বন্ধু। এতকাল আমার জীবন কেবল মরে যাওয়ার কথা ভাবাত। কেবলই বলত, বেঁচে থেকে কী হবে! তোমার বাঁচার কোনো অধিকার নেই!

—কেন?

—সে এক প্রকাণ্ড ইতিহাস। অনেকটা পেছতে হবে। ধৈর্য থাকবে না আপনার। এখন মনে হচ্ছে, মরে গিয়ে পালাব কেন? অত ভয় কীসের? একবার চেষ্টা করে দেখি। আপনার কাছে আসতুম না, দেবুদাই পাঠালেন জোর করে। কোনো কিছু চাইতে আমার ভালো লাগে না, বিশেষ করে উপকার।

—তোমার কি এই ভাবেই কথা বলার অভ্যাস?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—তার মানে, এই পৃথিবীর তুমি কিছুই জানো না। এখানে মানুষের দুটো জাত, এক জাতের মানুষ চাইবে, তারা নীচু জাতের, আর এক জাতের মানুষ দেখবে, তারা উঁচু জাতের। এর বাইরে আর কিছু নেই। ব্রাহ্মণ, শূদ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এসব কিছুই নয়। তুমি আমার কাছে একটা চাকরি চাইতে এসেছ। তুমি প্রার্থী। তুমি ভিখিরি। তোমার মুখে সেই ভাবটা কোথায়? দীন, হীন ভাব! যাকে বলে, নতজানু হয়ে ভিক্ষাপ্রার্থনা! তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন বেড়াতে এসেছ। দুটো গল্প করে চলে যাবে। বড়ো দুঃখে আছি, বড়ো কষ্টে আছি, পরিবার—পরিজন না খেতে পেয়ে মরে যেতে বসেছে স্যার, দয়া করুন, কৃপা করুন—সেই ভাবটা তো তোমার নেই! ভয় না থাকলে চাকর হওয়া যায়?

—আমি তাহলে আসি।

—কেন? চাকরি চাই না?

—না পেলেও কিছু এসে যাবে না। আমি খেতেও পারি, আবার উপোসও করতে পারি। বেঁচে থাকার কৌতূহল আছে, মরে যেতেও ভয় পাই না।

—নাটক করতে বুঝি?

—এখনও করি। রোজই করি। প্রতি মুহূর্তে করি।

—এই মুহূর্তে তোমার পকেটে কত টাকা আছে?

—পাঁচ টাকা।

—আমার সামনে রাখো। হ্যাঁ, এইবার যাও।

দরজা পর্যন্ত যেতেই ডাকলেন,—শোনো। কী ভাবে যাবে?

—এখান থেকে হাওড়া, হাওড়া থেকে ট্রেনে।

—পকেট তো খালি!

—পা—দুটো তো আছে।

—হাঁটলে কতক্ষণ?

—পনেরো—কুড়ি মাইল, যতক্ষণ লাগে। পাঁচ—ছ—ঘণ্টা লাগবে।

—এই সময়টার কোনো দাম নেই?

—আছে, মাত্র তিন টাকা।

—আমার সময়ের দাম জানো?

—অনেক। এক মিনিটে হাজার টাকা। হয়তো তারও বেশি। আমি তিন টাকায় পাঁচ ঘণ্টা কিনব, আপনি কিনবেন পাঁচ লাখ টাকায়। ইচ্ছে করে এই দাম আপনি বাড়িয়েছেন, এখন নিজের ফাঁদে নিজেই পড়েছেন। যেটুকু যাচ্ছে সেটুকু অনেক নিয়ে যাচ্ছে। আপনার ক্ষতির আশঙ্কা অনেক বেশি। কিন্তু ব্যাগ, যেটাকে আপনারা ওয়ালেট বলেন, সেটার দাম একই রইল।

—তার মানে?

—আপনিও একটা ব্যাগ, আমিও একটা ব্যাগ। দুটোতেই সময় ভরা। আপনারটা ডলার, আমারটা টাকা। একদিন সব খরচ হয়ে যাবে। পড়ে থাকবে দুটো দেহ। এটাও ছাই, ওটাও ছাই। শেষটা অনেক আগে দেখতে পাওয়ার নামই দর্শন।

কর্নেল একটু হতভম্ব হলেন। মুখের ওপর এমন কথা কেউ কি তাঁকে বলেছে কোনো দিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *