একা – ১১

এগারো

মাঝে মাঝে শ্মশানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবি। কারওকে বলবি না কোথায় যাচ্ছিস। এটা হল টোটকা দাওয়াই। নানা লোকে নানা কথা বলবে, জীবনসংগ্রাম, প্রতিযোগিতা, বাস্তবমুখীনতা। বলবে, বড়ো বড়ো চিন্তার প্রয়োজন নেই। মানুষের প্রয়োজন তিনটে—আহার, নিদ্রা, মৈথুন। পৃথিবীতে একবারই এসেছ। ভোগ করে যাও। তুমিই সব। এর বাইরে কিছু নেই। রোজগার করো, পারলে গাড়ি—বাড়ি করো। পারলে ক্ষমতা দখল করো, নেতা হও। ধান্দাবাজ হও, সুবিধেবাদী হও। যে লোকটা তোমার কাজে আসতে পারে, তাকে পাখি হয়ে ডিমে তা দেওয়ার মতো তা দাও। স্বার্থের ডিম ফুটে বাচ্চাটা বেরনো মাত্র খোলাটা ফেলে দাও। কৃতজ্ঞতার বোধটাকে মেরে ফেলে স্বার্থপর হও।

সব শুনে যাবে মন দিয়ে। কিন্তু মনে রাখবে, এরা দু—দিনের। মশা, মাছির মতো। কিছুকাল ভ্যান ভ্যান করে নিজেদের কলে নিজেরাই মরবে। সার্কাসের মেয়ে তারে উঠে খেলা দেখায়। খুব বাহবা, হাততালি। কতক্ষণের জন্যে! একসময় তাকে নামতেই হবে। নিজের ইচ্ছায় না নামলে দুম করে পড়ে যাবে। জীবনের সত্য একটাই, বিকাশ। ফুলের মতো ফুটে, সুগন্ধ ছড়িয়ে ঝরে যাও। যা দেওয়ার আছে দিয়ে যাও। সেবা, ভালোবাসা, আন্তরিকতা, সৎকর্ম, মানুষের আদর্শ, সৎ চিন্তার ফসল। জীবন হল একখণ্ড জমি। তুমি হলে কৃষক। কর্ষণ করো, বীজ ফেলো, জলসিঞ্চন করো। ফসল দান করে দাও আগামীকালকে।

শ্মশান তোমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে জীবনের পরিণতি। তোমাকে শেখাবে নিরাসক্তি। তুমি যে ক্ষণকালের বুদবুদ, এই সত্যটা তোমাকে শেখাবে। চিরকাল কেউ থাকেনি, থাকবেও না। দেবুদা এই সব কথাই আমাকে বলতে লাগলেন। হুহু করছে অন্ধকার রাত। সামনে প্রবাহিত গঙ্গার অস্পষ্ট শব্দ। যেন মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে একদল বৌদ্ধ শ্রমণ কোনো মঠের দিকে চলেছেন। মহাতীর্থের মহাযাত্রী সব। আমাদের পেছনেই জ্বলছে চিতা। প্রখ্যাত এক নটের কন্দর্পকান্তি দেহ পুড়ে ছাই হচ্ছে। রাতের পর রাত যিনি মানুষকে কাঁদিয়েছেন, হাসিয়েছেন।

দেবুদার একটা হাত আমার হাতে। দু—জনে বসে আছি পাশাপাশি। যেন কতকালের আত্মীয়। আমার সঙ্গে এই অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতার তো কোনো কারণ ছিল না। এত বড়ো এক মানুষ। গর্ব করার মতো তো অনেক কিছুই আছে দেবুদার। সারা বিশ্বঘোরা জ্ঞানী এক মানুষ। অর্থের কোনো অভাব ছিল না, আজও নেই। চারপাশে বড়ো বড়ো আত্মীয়—স্বজন। দেবুদা তাঁদের থেকে একটু দূরে—দূরেই থাকেন, কারণ তাঁরা বোঝাতে চান, তুমি জীবনটাকে নষ্ট করলে, পাঁচটা বাজে লোকের সঙ্গে মিশে। একটা সংসার করতে পারতে। বড়োঘরের সুন্দরী অহংকারী মেয়ের তো অভাব ছিল না। দু—একটা ছেলেমেয়ে। বিলেতে লেখাপড়া শিখে আসত। দেবু, তুমি কিছু লোফারদের সঙ্গে মিশে, বাউণ্ডুলে হয়ে জীবনটাকে এমন করে ফেললে পরিচয় দিতে লজ্জা করে। পানঅলা, বিড়িঅলা, চায়ের দোকানের বয়, ময়রা, মুদি তোমার প্রাণের বন্ধু। শেম, শেম!

‘বুঝলি, এতে আমার যে কী ভালো হয়েছে! বড়ো বড়ো চালের কথা। মানুষকে মানুষ মনে করে না। এত বড়ো বড়ো শরীর, এতটুকু এতটুকু মন। মানুষের শরীরে মুরগির হৃদয়। দেশের আশি ভাগ মানুষ কী ভাবে বেঁচে আছে সে খবর রাখে না। অলস। এই যে তোর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব, এটা ওরা ভাবতেই পারে না। আমার কেবল একটাই চিন্তা, তোর একটা রোজগার দরকার। একটা চাকরি।’

‘আমাকে ইটখোলায় একটা চাকরি দেবে বলেছে। কয়েক দিন করেও এসেছি।’

‘ওটা কোনো চাকরি নয়। ইটভাটায় সারাবছর কাজ হয় না। বর্ষাকালে বন্ধ থাকে, কাজ হয় না। তোকে অন্য কোথাও একটা ভালো চাকরি করে দিতে হবে। সংসার করতে হবে না? তোর তো আবার একজন প্রেমিকা আছে!’

‘ধুস, ও কিছু নয়। কয়েকদিন আমার মাথায় ভূত চেপেছিল। সে ভূত ছেড়ে গেছে।’

‘ছাড়ল কেন?’

‘ওর বাবা ব্যাবসা করে। এখন ছোটো ব্যাবসা। দেখতে দেখতে বড়ো হবে। তখন ভালো জায়গায় বাড়ি করে চলে যাবে। আমাকে তখন বড়োজোর জানলা—দরজা ঝাড়ার একটা চাকরি দিতে পারে।’

‘মেয়েটা তোকে কিছু বলেছে?’

‘সে কিছু বলেনি। তার হয়ে আমিই আমাকে বলেছি। বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরেই থাকছি, মুখোমুখি যাতে দেখা না হয়ে যায়।’

‘সংসারও করবি না, সন্ন্যাসীও হবি না, জীবনটা তাহলে কী রকম চেহারা নেবে?’

‘তোমার মতো।’

‘আমার মতো হবে না রে। আমার যে একটা রোজগার ছিল, আমাকে তো কোনো দিন বসে বসে খেতে হয়নি। দু—হাতে আয় করেছি, দুহাতে খরচ করেছি। সেই স্বাধীনতাটা আমার ছিল।’

‘আমি তাহলে কী করব? বয়েস তো বসে থাকবে না! তাহলে আবার কী আমি কোনো আশ্রমে চলে যাবো?’

‘দু—বেলা দু—মুঠো খাওয়ার জন্য আশ্রমে যাবি! তোর মধ্যে সত্যিই কী কোনো সন্ন্যাসীর নড়াচড়া টের পাচ্ছিস! সত্যি কথা বলবি, আমাকে মিথ্যা বলবি না।’

‘না, সন্ন্যাসী নেই। আমার খেতে ভালো লাগে, ঘুমোতে ভালো লাগে, লুকিয়ে—চুরিয়ে মেয়েদের শরীর দেখতে ভালো লাগে। অপরের সৌভাগ্যে আমার হিংসে হয়। আমার মধ্যে এ ভালো, ও খারাপ এই বোধও আছে। আর তোমার শুনলে খারাপ লাগবে, ইটভাটার এক কামিন মেয়েকে দেখে সাতটা দিন আমার পাগল—পাগল অবস্থায় কেটেছে। সে এক বিশ্রী রকমের কাম। আমার ভেতরে একটা লম্পট, একটা ভণ্ড বসে আছে। আমার চোখ পাপীর চোখ। আমার ভেতরটা খুব ময়লা। আবর্জনায় ভরা। নিজেকে আমি চিনতে পেরেছি। আমি সুযোগ পেলেই, যে—কোনোদিন একটা খারাপ কাজ করে ফেলব। ধরা না পড়লে আবার করব। সাহস বেড়ে যাবে, আবার করব। শেষে আমি এত খারাপ হয়ে যাব যে মার্কা—মারা খারাপরাও লজ্জা পাবে। আমার মন খুব দুর্বল। আমাকে লোভ দেখালেই আমি আর ধরে রাখতে পারব না নিজেকে। আমার ভাড়াটের ওই মেয়েটাই আমার পতনের কারণ হবে! দেবুদা, তুমি কি কামজয়ী হলে?’

‘আমার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরিষ্কার বলে গেছেন, ‘কাম জয় করা যায় না। শুধু মুখটা ঘুরিয়ে দিতে হয়।’ জল গড়িয়ে ওই দিকে যাচ্ছিল, আঙুল দিয়ে দাগ কেটে ধারাটা ঘুরিয়ে দাও। অন্য অনেক কাজের মধ্যে মনটাকে ফেলে রাখো। ঘরে একজন থাকলে আর একজন ঢুকতে পারে না। মন একটা ঘর।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *