একা হয়ে যাওয়া

একা হয়ে যাওয়া – উপন্যাস – মতি নন্দী

সকালে দাড়ি কামাবার সময় তরুণকান্তি টেলিভিশনে খবর দেখেন। খাওয়ার দালানের বেসিনের উপর আয়না। টেলিভিশন সেটটা ডানদিকে একটা চাকালাগানো টেবলের উপর, মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে তাকালেই ছবি দেখা যায়, তাই দেখছিলেন।

সকাল আটটা—এখন আর আজকের খবর কী করে দেবে, সবই গতকালের বাসি, তরুণকান্তি তাই দেখছেন। এই সময় খবরের কাগজটা পড়ে নেয় ছেলে মৃণালকান্তি, কেন না তাকে পৌনে দশটায় আহিরিটোলা ফেরিঘাটে গিয়ে লঞ্চ ধরে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন ধরতে হবে। মৃণালকান্তি ট্রেনে চল্লিশ কিলোমিটার যাবে, তারপর দেড় কিলোমিটার ট্রেকারে এবং মধুসূদন বিশ্বাস সেন্টিনারি কলেজে সে সাড়ে বারোটায় ক্লাসে ঢুকবে। কলেজটির এখন বয়স আটচল্লিশ। মৃণালকান্তি এখানে ইতিহাসের শিক্ষক গত দু—বছর।

তরুণকান্তি টিভিতে খবর দেখতে দেখতে ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন, সেফটি রেজারটা গালের থেকে সরিয়ে রেখে চেঁচিয়ে ছেলেকে ডাকলেন, ‘মিনু মিনু, শিগগিরি আয়, দেখে যা।’

ঘর থেকে খবরের কাগজ হাতে মৃণালকান্তি বেরিয়ে এল যখন, শববাহী কাচের গাড়িটার পিছন দিক, মুখ আঁচল চেপে ফোঁপানো মাঝবয়সি দুজন মহিলা আর শোক প্রকাশের জন্য ব্যাঙের মতো মুখ করা কয়েকটা লোককে তখন দেখা গেল একঝলক।

‘ইসস, অম্বিকা লাহিড়ী কাল দুপুরে মারা গেল! আগে জানলে নার্সিং হোমে যেতুম।’ তরুণকান্তির স্বরে আপশোস, ‘নিশ্চয় কাল সন্ধের খবরে দেখিয়েছে।’

মৃণালকান্তি বলল, ‘দুপুর থেকে ওয়ান—ডে ম্যাচটা যদি না দেখতে তা হলে খবরটা মিস করতে না। কিন্তু নার্সিং হোমে যাওয়ার কি খুবই দরকার ছিল? খুব কি বড়ো সাহিত্যিক! ইদানীং তো ওঁর লেখা পড়া যায় না, লোকে বলত।’

‘লোক?’ তরুণকান্তি বিরক্ত চোখে তাচ্ছিল্যভরে বললেন, ‘লোক না পোক। লোকের কথা শুনে সাহিত্য শিল্পের জাত বিচার হয় নাকি?’ আবার তিনি গালের উপর অসমাপ্ত কাজটা শেষ করায় মন দিলেন। ছেলের মুখ অপ্রতিভ হয়ে যাওয়াটা লক্ষ করেছিলেন। মনে একটা খচখচানি শুরু হয়ে গেল। গলার স্বর এতটা রুক্ষ না করলেই হত।

মৃণালকান্তি যখন ভাত খেতে বসেছে, খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে টেবলে ছেলের মুখোমুখি বসে বললেন, ‘ছবিটা ওর যৌবনকালের, এখনকার নয়। আমি প্রথমে যখন দেখি তখন এইরকম চেহারা ছিল।’

তরুণকান্তি খবরের কাগজের ষোলো পাতাটা একটু তুলে ধরলেন। মৃণালকান্তি একবার তাকিয়ে খাওয়ায় মন দিল। ছেলের নিরাসক্ত মুখ দেখে তরুণকান্তি খচখচানিটা আবার টের পেলেন। রান্নাঘর থেকে বাটিতে মাছের ঝোল এনে টেবলে রাখল মৌসুমী। তরুণকান্তি ছেলের সঙ্গে রফা করার একটা সুযোগ চাইছিলেন, পুত্রবধূকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘বউমা তুমি তো গল্প উপন্যাস পড়োটড়ো। অম্বিকানাথের লেখা কেমন লাগে?’

খবরের কাগজে অম্বিকা লাহিড়ীর মৃত্যুসংবাদটা দেখা হয়ে গেছে মৌসুমীর। শ্বশুরের প্রশ্নটার একটা প্রাসঙ্গিকতা আছে এটা সে বুঝল কিন্তু তাকে কেন জিজ্ঞাসা করা ‘কেমন লাগে?’ তাই সে অবাক হয়ে সব দিক বজায় রেখে বলল, ‘ভালোই তো। বেশ ঝরঝরে গদ্য, টানা গল্প বলে যাওয়া। খুব স্মার্ট সংলাপ, ওঁর যে বয়স আশির কাছাকাছি একদমই বোঝা যায় না লেখা থেকে।’

তরুণকান্তির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘ঠিক এইজন্যই ওঁর প্রথম উপন্যাস পড়েই, নামটা বোধহয় ‘গ্রীষ্মের দুপুর’, তখন কলেজে পড়ি, ওঁর ভক্ত হয়ে যাই। বাম ঘেঁষা লেখা, স্ট্রাইক চলছে এমন এক কারখানার শ্রমিক আর তার পরিবার নিয়ে লেখা। তখনও জানতুম না উনি আমাদের পাড়ার ব্যানার্জিদের দূরসম্পর্কের জামাই। পাড়ার কালীপুজো উদবোধনে ওঁকে একবার আমরা আনিয়েছিলাম। সুন্দর একটা বক্তৃতা দিলেন। তারপর ব্যানার্জিরা নিয়ে গেল খাওয়ার জন্য। আমরা দু—তিনজন, যারা ওঁর ভক্ত সঙ্গে গেলুম। ওঁকে একেবারে শোওয়ার ঘরে খাটে বসানো হল। উনি বালিশটা বগলে নিয়ে খাটে পা ছড়িয়ে কাত হয়ে গল্প শুরু করলেন। একেবারে ঘরোয়া। চলে আসার আগে প্রণাম করলুম। তখন দেখলুম পায়ের নখগুলো বেশ বড়ো আর ময়লা, আর গোড়ালিতে লম্বা লম্বা ফাটার দাগ আর ফাটার মধ্যেও ময়লা জমে। লোকে তো আর পা দেখে না তাই পায়েরও যত্ন নেয় না। যারা ধুতি আর চটি পরে তাদের কিন্তু নেওয়া উচিত। আজ যখন টিভি ক্যামেরা ওঁর পা দেখাল ক্লোজআপে, তখন কী আশ্চর্য, সেই ফাটা গোড়ালিই দেখতে পেলুম। এত বছরেও ওঁর হুঁশ হয়নি, তাঁর শরীরে একটা অপরিচ্ছন্ন জায়গা রয়ে গেছে।’ বেশ হতাশ হয়েই তিনি কথা শেষ করলেন।

‘কিছু একটা গলদ ওঁর রয়ে গেছিল।’ মৃণালকান্তি মুখ থেকে মাছের কাঁটা বার করতে করতে বলল।

‘কী গলদ?’ তরুণকান্তি প্রশ্ন করলেন।

‘বড্ড বেশি লিখতেন। যতটা পুঁজি তার থেকে বেশি খরচ করতেন।’

রান্নাঘর থেকে ইন্দ্রাণী চেঁচিয়ে বললেন, ‘মিনু আর ভাত দেব?’

‘না।’ উত্তর দিয়ে মৃণালকান্তি নিজেকে বলল, ‘এক গাদা ভাত খেয়ে দৌড় দিয়ে লঞ্চে ওঠা তারপর দৌড়ে গিয়ে ট্রেন ধরা। পারা যায় না।’

খাওয়া দ্রুত শেষ করে সে উঠে পড়ল। মৌসুমী থালাবাটি তুলে নিয়ে রান্নাঘরের এক ধারে রাখতে গেল। তরুণকান্তি ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজটা খুলে চোখের সামনে ধরলেন।

ধুতি পরতে পরতে মৃণালকান্তি বলল, ‘পঞ্চাশটা টাকা দাও তো, আজও মাইনে পাওয়া যাবে কি না জানি না।’

মৌসুমী বলল, ‘পঞ্চাশ হবে না, গোটা কুড়ি দিতে পারি।’

‘তা হলে মা—র কাছ থেকে চেয়ে দাও। বলো আমি ধার চাইছি, শোধ দিয়ে দেব। কাছাটা গুঁজে কোঁচার দৈর্ঘ্য ঠিক করায় সে ব্যস্ত হল। ভ্রূ কুঁচকে কী ভেবে ঝুলটা বাড়িয়ে আঙুল ঢেকে দিল।

‘মা পঞ্চাশটা টাকা দিন। ধার।’ মৌসুমী মৃদু কুণ্ঠিত স্বরে বলল।

ইন্দ্রাণী শুধু বললেন, ‘আবার!’

শোওয়ার ঘরে এলেন, পিছনে পুত্রবধূ। চাবি ঢুকিয়ে দেরাজ খুলতে খুলতে বললেন, ‘কী কলেজ রে বাবা, মাইনে ঠিক সময়ে দেয় না! ছেড়ে দিক এমন চাকরি, অন্য কলেজ দেখুক।’

টাকাটা এনে স্বামীর হাতে দিল মৌসুমী। মুখ থমথমে।

‘মা কিছু বলল?’

‘অন্য কলেজ দেখতে বললেন।’ শুকনো স্বর মৌসুমীর।

বাইরে ইন্দ্রাণীর খিঁচিয়ে বলা কথা শোনা গেল। ‘রমার মা, আবার তুমি দাদার বেরোনোর সময় ঘর মুছতে এসেছ? কতদিন বলেছি ঝাঁটা, খালি বালতি দেখে বাড়ি থেকে বেরোলে অকল্যাণ হয়। দাঁড়াও এখন, আগে দাদা বেরোক।’

রমার মা সকালে এসে বাসন মেজেই অন্য দুটো বাড়ি দৌড়য় কাজ সারতে। তারপর ফিরে এসে ঘর ঝাঁট ও মোছার কাজ করে। সাধারণত সে মৃণালকান্তি বেরিয়ে যাবার পরই আসে, আজ সময়ের হিসেবে ভুল করে ফেলেছে।

‘তা হলে মাকেই বল অন্য কলেজটা দেখে দিতে।’ কথাগুলো বলে পোর্টফোলিও ব্যাগটা তুলে চট করে আয়নায় মুখ দেখে নিয়ে, মৌসুমীর ঠোঁটে আলতো চুমু দিয়ে পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে গেল। ওদের বিয়ে হয়েছে এগারো মাস। গাঢ় চুম্বন ক্রমশ আলতো হয়ে আসার পর্যায়ে পৌঁছেছে।

.

মৌসুমী বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। স্বামী ক্যানসারে মারা যেতে ইউনিয়নের চেষ্টায় হৈমন্তী স্বামীর ব্যাঙ্কের অফিসেই যখন চাকরি পায় মৌসুমী তখন পাঁচ বছরের। অভিভাবকহীন হয়েই সে বড়ো হয়েছে। ঘরে বেশিরভাগ সময় একা, দ্বিতীয় মানুষ বলতে ছিল দিনরাতের এক বৃদ্ধা কাজের লোক—সতীমাসি। সঙ্গীহীন মৌসুমী ধীরে ধীরে জেদি, একরোখা, চাপা স্বভাবের হয়ে ওঠে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে ওঠে সুমুখশ্রী, লাবণ্যময়ী ও গড়নে সুঠাম এক তরুণী। স্বাভাবিকভাবেই কলেজে কয়েকজন ছেলে তার ঘনিষ্ঠ হতে চায়। মৌসুমী তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তাদের সে বন্ধু হিসাবে ভাবতে রাজি তার বেশি আর কিছু নয়। তাই শুনে সবকটি ছেলেই পিছিয়ে যায়। বাংলা অনার্সের ছাত্রী মৌসুমী পড়াশুনোয় ছিল সাধারণ মানের, তবে পাশ করেছিল অনার্স সহ দ্বিতীয় বিভাগের উঁচু দিকে থেকে।

তার বিয়েটা সম্বন্ধ করে বা প্রণয়জনিত কারণে হয়নি। ভবানীপুরে ব্যাঙ্কের এক সহকর্মীর ছেলের বউভাতে মেয়ে—সহ হৈমন্তী নিমন্ত্রিত হয়ে যান। নিমন্ত্রিত ছিল তরুণকান্তিও সপরিবারে। নববধূকে যে বড়ো ঘরে বসানো হয়েছিল সেখানেই বসেছিল নিমন্ত্রিত মহিলারা। ইন্দ্রাণীর পাশেই বসেছিলেন হৈমন্তী। রজনীগন্ধা, বেল, জুঁই আর সেন্টের গন্ধের সঙ্গে ভ্যাপসা গরমে হৈমন্তীর গা গুলিয়ে উঠেছিল। বিড়বিড় করে বলে ওঠেন, ‘নাহ আর বসা যায় না, মাথা ধরে যাবে।’

‘ঠিক বলেছেন’, ইন্দ্রাণী বলে ওঠেন। ‘চলুন বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।’

দুজনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছেন, তখন মৌসুমী মায়ের কাছে এসে বলে, ‘মা তুমি এখানে? আমি সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমাদের ক্লাসের বিনীতার সঙ্গে দেখা হল। পাশের বাড়িতেই থাকে, আমি এখন ওদের বাড়িতে যাচ্ছি। পাঁচ মিনিট। তুমি আবার যেন খোঁজাখুঁজি শুরু করে পুলিশে খবর দিয়ো না।’ বলেই সে দ্রুত চলে যায়।

ইন্দ্রাণী দেখছিলেন টকটকে লাল সিফনের শাড়িতে জড়ানো ছিপছিপে সুঠাম দেহের ফর্সা মেয়েটিকে। আয়ত চোখ, টিকলো নাক, শাঁখের মতো গলা, খইয়ের মতো দাঁত আর মিষ্টি স্বর। তিনি মুগ্ধ হলেন।

‘মেয়ে বুঝি!’ বলাটা নিরর্থক বুঝেই তিনি যোগ করেন, ‘ওরা ক—ভাইবোন?’

‘আমার এই একটিই সন্তান। এবার বিএ পাশ করল।’

‘আরও পড়বে?’

‘যদি ইচ্ছে হয় পড়বে। পড়াশুনোর ব্যাপারে কখনো নাক গলাইনি, ছেলেমেয়ের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করায় আমি বিশ্বাসী নই। আমি চাই বিয়ে দিয়ে দিতে। একা মানুষ, দেখার কেউ নেই, যা দিনকাল পড়েছে ঘরে রাখতে অস্বস্তি হয়। ওকে বলেওছি, জবাব এক কথা, বিয়ে তো যখন তখন করা যায়, এত ব্যস্ত হবার কী আছে?’

‘ছেলে দেখেছেন?’

‘দেখার সময় কোথায় আমার! ওই অফিসের দু—তিনজনকে বলে রেখেছি। ভাবছি এবার ওকে বলব, নিজের পছন্দের কাউকে যদি বিয়ে করতে চাস তো করে ফেল।’ হৈমন্তী হাসলেন, নিরুপায়ের হাসি। ‘মেয়ে বিয়ে করে একটা ছেলেকে সঙ্গে করে এনে বলবে, মা তোমার জামাই আনলুম, অমন বিয়ে আমি মেনে নিতে পারব না।’

‘আমার জাঠতুতো দেওর এমনটা করেছিল, চল্লিশ বছর আগে। ঘোমটা দেওয়া সিঁথিতে সিঁদুর লেপা শাঁখাপরা একটি মেয়েকে এনে বলল, মা তোমার দাসী এনেছি। মা তো ভিরমি খেয়ে পড়ল। ডাক্তার ডাক, ডাক্তার ডাক, হুলুস্থুলু কাণ্ড। এখন আর ওভাবে লুকিয়ে বিয়ে করে না কেউ, বলেকয়েই করে।’

হৈমন্তী জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা থাকেন কোথায়?’

‘আহিরিটোলায়। আপনি?’

‘এখানেই, ভবানীপুরে। যার বউভাত সে আমার কলিগের ছেলে।’

‘ও হল আমার খুড়তুতো বোনের ছেলে, আপনার কলিগ হলেন আমার ভগ্নিপতি। এতক্ষণ কথা বললুম, আপনার নামটি কিন্তু জানা হল না ভাই। আমার নাম ইন্দ্রাণী, পদবি চাটুজ্জে।’

‘আমি হৈমন্তী মৈত্র। এইরকম অনুষ্ঠানে এলে একটা লাভ হয়, নতুন নতুন লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়।’

ব্যস্ত হয়ে তখন এলেন ছেলের মা। ইন্দ্রাণীকে বললেন, ‘ন—দি এবার বসে পড় ছাদে পাত খালি হয়েছে। মিসেস মৈত্র আপনিও। মেয়ে কোথায়?’

‘পাশেই বন্ধুর বাড়িতে গেছে। চলুন দিদি, ছাদের কাজটা সেরে ফেলি। মৌসুমীর জন্য অপেক্ষা করে কাজ নেই, কাল আমার অফিস আছে।’

‘তাই চলুন, আমারও সকালে রান্নার তাড়া আছে। ছেলেকে ন—টার মধ্যে ভাত দিতে হবে।’

তিনতলায় পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া হয় বিয়ের জন্য। চারতলায় ছাদ। ওঁরা দুজন ছাদে এসে দেখেন, খাওয়ার টেবিলে জায়গা পাবার জন্য মিউজিক্যাল চেয়ার চলছে।

‘মা এই যে এখানে।’ মৌসুমী দাঁড়িয়ে উঠে হাত নাড়ছে। তার পাশে একটা খালি চেয়ার দখল করে রেখেছে মায়ের জন্য।

হৈমন্তী বিব্রত হয়ে বলল, ‘মৌ এনাকে বসার একটা চেয়ার দেখে দে।’

‘আপনি আমারটায় বসুন, আমি একটা জায়গা দেখে নিচ্ছি।’ ইন্দ্রাণীকে হাত ধরে বসাল মৌসুমী।

এই সময় চেয়ার দখলটা অতি দ্রুতবেগে করে ফেলতে হয়। মৌসুমী তাই করল। সে দেখল উলটো দিকের সারিতে একটা খালি চেয়ার। ঠেলেঠুলে গিয়ে সেই চেয়ারে বসতে যেতেই পাশের চেয়ারে বসা যুবকটি বলল, ‘এখানে লোক আছে।’

‘কোথায় লোক?’ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মৌসুমী বলল।

যুবকটি আঙুল তুলে দেখাল। মৌসুমী দেখে বলল, ‘উনি তো আমার চেয়ারে বসেছেন, আমিই ওঁকে বসতে দিয়েছি, এই চেয়ারে আমি বসব।’ প্রায় ঝগড়ার সুরে বলল মৌসুমী। ম্রিয়মাণ যুবক মন দিল বেগুনভাজায়।

ইন্দ্রাণী লক্ষ করলেন, সুরূপা একটি মেয়ের পাশে তার ছেলেকে উজ্জ্বল ও সুদর্শন দেখাচ্ছে। দেখে গভীর তৃপ্তি অনুভব করেন এবং তখনই একটা ইচ্ছা তার মনে জাগল। পাশে ঝুঁকে বলেন, ‘আপনার মেয়ের পাশে যাকে দেখছেন ওটিই আমার ছেলে। একমাত্র সন্তান, আপনার মেয়ের মতোই।’

হৈমন্তী বারকয়েক তাকিয়ে দেখে নিলেন ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবি পরা গৌরবর্ণ, রমণীসুলভ সুকুমার মুখশ্রীর যুবকটিকে। তারপর বলেন, ‘আপনার ছেলে কী করে?’

‘প্রফেসার। কলেজে পড়ায়।’ ইন্দ্রাণীর কণ্ঠে এমন একটা স্বর ছিল যেটা একটা খাদের মধ্যে ধ্বনিত হওয়া শব্দের মতো শোনাল। রোমাঞ্চিত হলেন হৈমন্তী।

‘কোন কলেজে? কী পড়ায়?’

‘এই তো সবে এক বছর হল পাশ করে বেরোল, ইতিহাস পড়ায়। এখন মফস্সলের একটা কলেজে আছে বলদেবপুরে। বেশি দূর নয়, লোকাল ট্রেনে এক ঘণ্টা হাওড়া থেকে।’

ব্যস! এই খবরটুকুই যথেষ্ট মনে হল হৈমন্তীর। তিনি আর কিছু জিজ্ঞাসা করার দরকার বোধ করলেন না। ‘প্রফেসার’ শব্দখণ্ডটি ঠং ঠং করে তার মাথার মধ্যে বেজে যেতে লাগল।

পাতে চাটনি পড়ার পর হৈমন্তী বললেন, ‘আমার মেয়েকে তো দেখলেন, কেমন লাগল?’

ইন্দ্রাণী ইতিপূর্বে নেওয়া বাসনাটি কীভাবে প্রকাশ করবেন মনে মনে তাই নিয়ে অস্বস্তি বোধ করছিলেন, হৈমন্তীর প্রশ্নটায় হাঁফ ছাড়লেন। ‘কেমন লাগল’ কথাটা তিনি এর আগে তিনবার শুনেছেন এবং প্রতিবারই বলেছেন ‘ভালোই তো’। তারপর কন্যাপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন পছন্দ হয়নি। কিন্তু এখন পছন্দটা তো নিজেই আগ বাড়িয়ে মনে মনে করে ফেলেছেন। কেমন লাগল মানে পছন্দ হয়েছে কি না জানতে চাইছে মেয়ের মা। তার মানে সম্বন্ধের প্রস্তাবটা দেওয়া, তবে কিনা তার উত্তরের উপর সেটা নির্ভর করছে। ইন্দ্রাণী গম্ভীর হয়ে গেলেন, মেয়ের মায়ের কাছে ছেলের মায়ের যতটা ব্যক্তিত্ব বিচ্ছুরণ করতে হয় গলার স্বরে তার চেষ্টা করে, এঁটো তর্জনীটা তুলে বললেন, ‘বেশ ভালোই তো। গায়ের রং, গড়ন, পেটন, হাইট, গলার স্বর, মাথার চুল, বিএ পাশ—রান্নাটা বোধহয় জানে না।’

‘না, না, জানে।’ ব্যগ্র উৎকণ্ঠা নিয়ে হৈমন্তী বললেন, ‘মৌ খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারে। আমার অফিসের রান্না কতদিন তো ওই করে দিয়েছে।’

‘ভালো।’ ইন্দ্রাণী চাটনি মাখিয়ে আঙুলটা চুষে নিয়ে বললেন, ‘অফিসের রান্না আর লোকজনকে খাওয়ানোর রান্না তো এক জিনিস নয়। এসব রান্না শিখতে হয়। আমি শিখেছি শাশুড়ির কাছে, তিনি শিখেছিলেন তার শাশুড়ির কাছে, এভাবেই আমাদের বংশের একটা খাওয়ার রুচি তৈরি হয়েছে। বাপের বাড়ির রান্না শিকেয় উঠে গেছে। আপনার মেয়ে সেটা পারবে তো! যদি পারে তা হলে আমাকে একটা ফোন করবেন।’

দুজনের মধ্যে একবারও বিয়ের কথা কেউ তুললেন না। দুজনেই যেন জেনে গেছেন—তাদের মনের ইচ্ছাটা কোন পথ ধরে চলেছে। দুজনেই যেন জানে কথাটা একবার পাড়লেই অপরজন রাজি হয়ে যাবে। দুজনেই জানে, এটা হল শুধুই প্রাথমিক সম্মতিপর্ব, তারপর হবে লাখ কথা এবং এন্তার দাবিদাওয়ার সমাধান হলে তবেই দু—হাত এক হবে।

‘আপনার কাছে কলম আছে?’

‘আছে।’ হৈমন্তী বাঁ হাতে ধরা ছোট্ট হাতব্যাগ, যেটা সর্বদা হাতে রাখেন, সেটা এঁটো হাতেই খুলে কলম বার করলেন। খাওয়ার পর হাত মোছার জন্য কাগজের রুমাল রাখা ছিল, সেটা টেনে নিয়ে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনার নম্বরটা বলুন।’

মেট্রোয় ফেরার সময় ইন্দ্রাণী তরুণকান্তিকে বললেন, ‘মিনুর জন্য মেয়ে দেখলুম, আমার খুব পছন্দ হয়েছে, বারিন্দির বামুন, তা হোক। মেয়ের মা ফোন করবে কালপরশুই, ভালো করে কথা বোলো।’

‘মিনু মেয়ে দেখেছে?’ অবাক তরুণকান্তি মাথাটা পরিষ্কার রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত হলেন।

‘নিশ্চয় দেখেছে, ওর পাশে বসেই তো খাচ্ছিল।’

ফোনটা এল পরশু দুপুরেই। অফিস থেকে হৈমন্তী জানায় ‘মৌসুমী বলেছে পারবে, যদি আপনি শিখিয়ে দেন।’

‘নিশ্চয়ই দেব। আমার শাশুড়ি তো তাই করেছিলেন। আপনি তা হলে সামনের রবিবার আমাদের বাড়িতে আসুন। নিজের চোখে দেখে যান ছেলের বাড়ি ঘরদোর…না, না, আমার কোনো দরকার নেই আপনার বাড়ি দেখার, মিনু তো আর থাকতে যাবে না আপনার সংসারে।’

রবিবার দুপুর শেষে হৈমন্তী এলেন এক বাক্স সন্দেশ হাতে নিয়ে। ঘুরে দেখলেন ইন্দ্রাণীর সঙ্গে পুরোনো একশো বছরের বাড়ি। মোটা দেওয়াল, কাঠের কড়িবরগা, খড়খড়ির পাল্লার জানলা। রাস্তার উপর বারান্দায় ঢালাই লোহার নকশাকাটা রেলিং, বারান্দাটাকে ধরে রেখেছে দেওয়ালে আঁটা লোহার ব্র্যাকেট।

তরুণকান্তি বললেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে হৈমন্তীকে ‘তখন আমার বাবার সদ্য বিয়ে হয়েছে। এখানে তখন সরু সরু রাস্তা বড়োবাজার পোস্তা গেছে। লরি আর মোষের গাড়ির যেতে খুব অসুবিধে হত তাই সি আই টি নতুন চওড়া রাস্তা তৈরি করল বাড়ি ভেঙে। যাদের বাড়ি ভাঙা পড়ল তারা টাকা পেয়ে কলকাতার বাইরের দিকে, কেউ হাওড়ায় কেউ দক্ষিণেশ্বরে বাড়ি করে কিংবা কিনে চলে গেল। আমাদের বাড়িটা বেঁচে গেল কান ঘেঁষে। শুধু গাড়ি বারান্দাটার খানিকটা ভাঙা পড়ল। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেটা সেই ভাঙা বারান্দার অংশ। এরকম ঘটেছে অনেক বাড়ির। এই আমাদের পাশের দত্তবাড়ি। ওদের তো আধখানা বাড়িই ভেঙে ফেলা হল ফুটপাথ বার করার জন্য। বেআব্রু হয়ে গেল বাড়িটা। ছাদে চলুন দেখাচ্ছি।’

তরুণকান্তি ছাদে নিয়ে এলেন হৈমন্তীকে, সঙ্গে ইন্দ্রাণী। ছাদের তিনদিকে পাঁচিল। পাঁচিলের ধারে গিয়ে হৈমন্তী ঝুঁকে দেখতে লাগলেন। জন্ম থেকেই তিনি ভবানীপুরে লালিত। উত্তর কলকাতা দেখেছেন বাসে বা ট্যাক্সিতে যেতে যেতে। আজই প্রথম তিনি কলকাতার প্রাচীনত্বকে কাছের থেকে চাক্ষুষ করছেন। যে বাড়িটিকে দত্তবাড়ি বলে তরুণকান্তি দেখালেন সেটি দেখে অদ্ভুত লাগল হৈমন্তীর। চারতলা বাড়িটা যেন চাকলা করে বঁটি দিয়ে কাটা একটা ওল। বিবর্ণ লালচে শুকিয়ে আসা ঘায়ের মতো, বৃষ্টির জলের ঝাপটায় বালি বেরিয়ে এসেছে। দেওয়ালের দু—ধারের ঘরে দুটো করে জানলা, মাঝে দালান দেখা যাচ্ছে। দোতলার বাঁদিকের ঘরের জানলার পর্দা সরিয়ে একটি অল্পবয়সি বউ কৌতূহল নিয়ে প্রায় কুড়ি গজ দূর থেকে হৈমন্তীকে লক্ষ করছে। এই কুড়ি গজে রয়েছে খোলার চালের একটি বস্তি।

ইন্দ্রাণী বললেন, ‘দত্তরা এখানকার নামকরা বনেদি পরিবার। এখন অবস্থা পড়ে গেছে। ভাইয়ে—ভাইয়ে ঝগড়া, সম্পত্তি নিয়ে মামলা—মোকদ্দমা। ওটি ছোটোবউ।’

বউটি বুঝতে পারল ওরা তার দিকে তাকিয়ে। পর্দা নামিয়ে দিল। হৈমন্তী এধার ওধার চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন, একটু হতাশই হলেন।

‘গঙ্গা এখান থেকে কত দূরে?’

তরুণকান্তি জানালেন, ‘হেঁটে মিনিট পাঁচেক।’

হৈমন্তী বললেন, ‘তাহলে তো আপনারা রোজই গঙ্গাস্নান করতে পারেন।’

ইন্দ্রাণী হাসতে হাসতে বললেন, ‘এত বছর বিয়ে হয়েছে। আমি তিন—চার বারের বেশি গঙ্গাচ্চচান করিনি। যা নোংরা জল, তা ছাড়া সাঁতার জানি না। যদি ডুবে যাই! তবে বান দেখতে অনেকবার গেছি। একবার গেছি চক্ররেল কেমন চলছে দেখতে। চলুন এবার নীচে যাই।’

মৃণালকান্তি বাড়ি ছিল না দুপুর থেকে। এইমাত্র ফিরল। ইন্দ্রাণী ডাকলেন তার ঘরে। ‘মিনু শুনে যা, ইনি হলেন মৌসুমীর মা আর এই হল আমার ছেলে।’

ইতস্তত করছিল মৃণালকান্তি নমস্কার না প্রণাম কোনটা করবে, মা—র চোখের ইশারায় দ্বিতীয়টিই করল। হৈমন্তী এই প্রথম কাছের থেকে দেখলেন হবু জামাইকে। তার মনে হল ছেলেটি দুবলা, লাজুক, মুখের আদল মায়ের মতো, চাহনিতে নম্রতা। ওর গলার স্বর কেমন, তা শোনার জন্য তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সেদিন বউভাতে চেয়ারে বসা নিয়ে মৌ তোমাকে কিছু বোধ হয় বলেছিল। আমাকে ও পরে বলল। লজ্জা পেয়েছে। তুমি কিছু মনে কোরো না।’

ব্যস্ত হয়ে মৃণালকান্তি বলল, ‘না না কিছু মনে করিনি। আমি তো ব্যাপারটা ভুলেই গেছি। নেমন্তন্ন বাড়িতে ওরকম একটু—আধটু হয়েই থাকে।’

হৈমন্তী সন্তুষ্ট হলেন কণ্ঠস্বরে। কলেজে পড়ায়, ক্লাসে লেকচার দিতে হয়। উচ্চচারণ এমন মার্জিত স্পষ্ট না হলে চলবে কেন!

‘বাড়ি থেকে কখন কলেজে বেরোও?’ কিছু একটা বলতে হবে তাই হৈমন্তী প্রশ্নটা করলেন বাক্যালাপ চালু রাখার জন্য।

‘সাড়ে ন—টায় বেরোই। প্রথম ক্লাসটা সাড়ে বারোটায়।’

‘তিন ঘণ্টা আগে, অত সকাল সকাল বেরোও!’ হৈমন্তী অবাক হলেন।

মৃণালকান্তি ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। হৈমন্তী দেখলেন সাজানো দাঁত এবং মাড়ি বেরোল না। হাসিটা ভালো।

‘তিন ঘণ্টাতেও এক একদিন সাড়ে বারোটার ক্লাস মিস করি। তিন রকম বাহনে আমাকে যেতে হয়। প্রথমে লঞ্চে হাওড়া স্টেশন, যদি জোয়ার থাকে তা হলে লঞ্চ পনেরো মিনিটের পথ নেবে পঁচিশ মিনিট। তারপর ট্রেন। লেট থাকতে পারে, বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে, লাইনে বসে পড়ে নানান তুচ্ছ কারণে অবরোধ হতে পারে। এই সব কারণের কিন্তু বাপ—মা নেই। ধর্ষণ, ডাকাতি, পঞ্চায়েত ইলেকশনে ফলস ভোট, গলায় দড়ি, বিদ্যুৎ না থাকা, মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি—সে যে কত রকমের অজুহাত হতে পারে রেল লাইনে বসে পড়ার তার ইয়ত্তা নেই। ট্রেন যদি গড়গড়িয়ে চলে তো ভালো। তারপর ট্রেকারে এক মাইল। যাতায়াত করে দুটি মাত্র ট্রেকার। স্টেশনে নেমে দেখলেন একটিও নেই। এবার কী করবেন?’ মৃণালকান্তি ছুড়েই দিল প্রশ্নটা হবু শাশুড়ির দিকে।

হৈমন্তী মজা পাচ্ছিলেন, তার মনে হচ্ছিল ছেলেটির রসবোধ আছে, কথা বলতে ভালোবাসে, বাস্তব জ্ঞানটাও ভালো, এ ছেলে মফস্সল কলেজ থেকে একদিন কলকাতায় কোনো কলেজে চলে আসবে, নয়তো ডিফিল করে যাবে মফস্সলের কোনো ইউনিভার্সিটিতে, এমন কথাই বলেছে তার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার।

গাছে না উঠতেই এককাঁদি এই অধৈর্য তত্ত্বে তিনি একদমই বিশ্বাসী নন। অতএব মৃণালকান্তির মফস্সল কলেজে ‘প্রফেসর’ থাকাকে সবুরের অফলিত মেওয়া হিসাবেই ধরে নিচ্ছেন।

মৃণালকান্তির কথা শুনতে শুনতে হৈমন্তীর মুখে মৃদু হাসি ফুটেছিল। সেটা লক্ষ করে ইন্দ্রাণী বললেন, ‘এবার কাজের কথাটা হোক। মিনু তুই এখন ঘরে যা।’

মৃণালকান্তি নিজের ঘরে চলে যাবার পর ইন্দ্রাণী স্বামীকে বললেন, ‘তুমিই বলো।’

তরুণকান্তি কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। কপালের থেকে চুলের রেখা পিছনে সরে গেছে যতদূরে, সেখানে হাত বুলোলেন, তারপর বললেন, ‘মেয়ে তো ওনার মানে আমাদের পছন্দ হয়েছে, মনে হয় ছেলেকেও আপনি পছন্দ করেছেন।’ তিনি তাকিয়ে রইলেন মেয়ের মায়ের দিকে।

হৈমন্তী ঘাড় নেড়ে অস্ফুটে বললেন, ‘হ্যাঁ’।

‘তা হলে আমরা নেক্সট স্টেপ যেতে পারি। পাকা দেখা আর বিয়ের দিন ঠিক করা। তাড়াহুড়োর কিছু নেই । আমাদের দুই পরিবারেরই একমাত্র সন্তান। বুঝতেই পারছেন দুজনেই খুব আদরের। এই বিয়েতে পাড়া—প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের না ডেকে আমরা থাকতে পারব না। এই ডাকার মানে, বিয়ে আর বউভাতের জন্য খরচ, সেটা কিন্তু মোটেই কম নয়। এর জন্য টাকার জোগাড় রাখতে হয়। মিসেস মৈত্র আপনি কি এজন্য প্রস্তুত?’ বলার ভঙ্গি হৈমন্তীকে বুঝিয়ে দিল তরুণকান্তি কথাগুলো সাজিয়ে রেখেছিলেন।

‘আমি আমার সাধ্যের মধ্যে প্রস্তুত।’ হৈমন্তী হাসলেন এবং হাসিটা মোলায়েম ঠেকল না হবু বেয়াই ও বেয়ানের কাছে। তা হলেও তাঁরা হৈমন্তীর ‘সাধ্যের মধ্যে প্রস্তুত’কে নিয়ে জানতে চাইলেন না কতটা প্রস্তুত।

হৈমন্তী বললেন, ‘বিয়েতে যা দিতে—থুতে হয় সেসব তো দেবই। আপনাদের এ ছাড়াও কোনো দাবিদাওয়া থাকলে বলতে পারেন। মৌয়ের বাবা নেই, তিনি থাকলে যে—খরচ করতেন তা তো আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তবু গা সাজিয়ে দিতে না পারলেও বারো ভরির গয়না দেব, খাট—বিছানা, আলমারি দেব। এ ছাড়াও ফুলশয্যার তত্ত্ব, বিয়েতে লোক খাওয়ানো, ছেলের ঘড়ি বোতাম আংটি—।’ তরুণকান্তিকে হাত তুলতে দেখে হৈমন্তী থমকে গেলেন।

‘আপনি তো চাকরি করে সংসার চালান এতসব দেবেন কী করে?’ প্রশ্ন এবং বিস্ময় তার চোখে।

‘মৌয়ের বাবা কিছু টাকা রেখে গেছেন, লাইফ ইনসিয়োরেন্স থেকেও কিছু পেয়েছিলাম সেটা রেখে দিয়েছি, আমার বারো ভরি সোনা। তা ছাড়া আমিও প্রতি মাসে কিছু কিছু করে জমিয়েছি, দরকার হলে পি এফ থেকে তুলব। সব মিলিয়ে মোটামুটি পেরে যাব, সংসার তো আমার খুব বড়ো নয়। খরচ যা হয়েছে তা শুধু মৌয়ের পড়াশুনোর জন্য, ওর বিয়েটা হয়ে গেলে আমি তখন একা, ঝাড়া হাত—পা।’ হৈমন্তী হাসলেন ম্লানভাবে।

বিয়ের এই দেনা—পাওনা ব্যাপারটা নিয়ে স্বামী—স্ত্রী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, একা চাকরি করে মেয়ের মা এতগুলো বছর চালিয়েছেন এজন্য নিশ্চয় তাকে কষ্ট করতে হয়েছে। যা কিছু সঞ্চয় করেছেন তা যদি মেয়ের বিয়েতেই নিঃশেষ করে ফেলেন, তা হলে জীবনের বাকি দিনগুলো তো আরও কষ্ট করে কাটাতে হবে।

‘পেনশন একটা পাবেন বটে কিন্তু তাতে কতটা সুরাহা হবে সে তো নিজেকে দিয়েই বুঝেছি। বাড়ির ট্যাক্স থেকে পুজোর চাঁদা প্রতিটি ব্যাপারে খরচ বেড়েছে।’ তরুণকান্তি স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘মৌসুমী তো আর ছেলে নয় সে মায়ের ভরণপোষণ করবে, বিয়ে হলে তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, বাপের বাড়ির কোনো দায় ওর উপর থাকবে না। ভেবে দ্যাখো, মিনু যদি মেয়ে হত তা হলে আমার অবস্থাটা কী দাঁড়াত? তা ছাড়া এই যে মেয়ের বাড়ি থেকে জিনিসপত্তর নেওয়া এটা তো নিজেদের ছোটো করা।’

ইন্দ্রাণী এই বক্তৃতার চাপে সংকুচিত হতে হতেও মাথা তোলার চেষ্টায় তার যুক্তিটা দেখাবার চেষ্টা করেছিলেন, ‘যদি ওরা দিতে চায় নেব না কেন? সমাজে তো এইরকম দেওয়া—নেওয়া চলে। ওরা যদি ওদের মেয়েকে সাজিয়ে দিতে চান তা হলে আমরা আপত্তি করার কে? সংসারে একটা লোক এলে খরচ বাড়ে না? ওদেরও তো খরচ কমবে। তা ছাড়া খালি হাতে বউ এলে লোকে কী বলবে?’

‘লোক না পোক।’ সুযোগ পেলেই তরুণকান্তি কথাটা বলে দেন। ‘লোকের কথা শুনে চললে দুনিয়ায় বাস করা যায় না।’

মুখ ভার করে ইন্দ্রাণী বলেছিলেন, ‘এতকাল ধরে দুনিয়ায় লোক বাস করে এল আর তোমারই অসুবিধে হচ্ছে।’

‘হ্যাঁ হচ্ছে।’ তরুণকান্তি রুক্ষস্বরে বলেছিলেন, ‘দুনিয়াটা আর আগের মতো নেই, বদলে গেছে, আমাদেরও বদলাতে হবে। যদি ওঁরা মেয়েকে গয়নাগাটি দিতে চান দেবেন, তার বেশি আর কিছু নয়। না খাট—বিছানা, না টিভি, ফ্রিজ—ওসব আমাদের আছে।’

‘মিনুকে যদি কিছু দিতে চায়?’

‘ওটা মিনুর ব্যাপার। যদি নিতে ইচ্ছে করে নেবে।’

ইন্দ্রাণী স্বামীর এই কথাটা মনে রেখেছিলেন। হৈমন্তীকে যখন তরুণকান্তি বললেন, ‘এতসব দেবেন কী করে?’ এবং হৈমন্তী যখন জানালেন এতসব দেবার জন্য তার সঞ্চয়ের কথা, ইন্দ্রাণী তখন বললেন, ‘মেয়ের বিয়েতে সবই খরচ করে দেবেন, এটা কীরকম কথা! না না অত খরচ করতে যাবেন না, নিজের জন্য কিছু রাখুন। আমাদের যা খাট বিছানা চেয়ার টেবিল তাতে আশা করি আপনার মেয়ের অসুবিধে হবে না।’

‘না, না, অসুবিধে হবে কেন? সাধারণ গেরস্তভাবেই ও মানুষ হয়েছে। যেকোনো অবস্থার সঙ্গে মৌ মানিয়ে নিতে পারে। এই গুণটা আমার মেয়ের আছে। তা হলে আমি কি ধরে নিতে পারি আপনাদের চাওয়ার কিছু নেই।’ হৈমন্তী মৃদু স্বরে জানতে চেয়ে দুজনের মুখের দিকে প্রত্যাশাভরে তাকালেন।

‘আমার বা আমার স্ত্রীর চাওয়ার কিছু নেই। না যৌতুক না পণ। আংটি, ঘড়ি, খাট, বিছানা, কোনো জিনিসপত্তর নয়। স্ট্রিক্টলি বারণ।’ তবে ছেলের কিছু চাওয়ার থাকতে পারে, এই বাক্যটি অনুক্ত রাখায় কয়েক সেকেন্ড তরুণকান্তি মনে একটা খচখচানি বোধ করলেন, তবে সেটা ঢেকে গেল একটা ফুরফুরে সুখে। কাজের মতো একটা কাজ তিনি করলেন, জীবনে এই প্রথম। সাধারণ স্তর থেকে নিজেকে তুলতে পেরেছেন। হৈমন্তীর চোখে কৃতজ্ঞতার হালকা ছায়া ভেসে যেতে দেখে তিনি আনন্দ ও সুখ দুটোই বোধ করলেন।

‘বিয়ের দিনক্ষণটা আপনিই ঠিক করে আমাদের জানাবেন, পাকাদেখার কোনো দরকার আছে বলে তো মনে হয় না।’ তরুণকান্তি বললেন।

‘আপনি যা বলবেন সেইরকমই হবে।’

ইন্দ্রাণী বললেন, ‘ব্যস্ত হবেন না। গুছিয়ে জোগাড়যন্ত্র করতে সময় লাগবে। আমাদের তাড়া নেই।’

‘তা হলে এবার আমি আসি।’ উঠে দাঁড়ালেন হৈমন্তী।

‘আপনি যাবেন কীভাবে, মেট্রো দিয়ে?’ তরুণকান্তি জানতে চাইলেন।

‘ট্যাক্সিতেই যাব।’ হৈমন্তী এখন খুশির মেজাজে। কয়েকটা টাকা বেশি খরচ হবে। হোক। ব্যাঙ্কের চাকরিটা পাওয়ার চিঠি হাতে নিয়ে ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরছিলেন, তারপর আজ পেলেন। এই নিশ্চিন্তি। ঘর থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়ালেন।

‘দাঁড়ান। মিনু আপনার সঙ্গে যাক, ট্যাক্সি ধরে দেবে।’ তরুণকান্তি ব্যস্ত হয়ে বললেন। ইন্দ্রাণী দ্রুত গেলেন মৃণালকান্তির ঘরে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে হৈমন্তী পিছু ফিরে মুখ তুলে দেখলেন বারান্দায় স্বামী—স্ত্রী দাঁড়িয়ে। ইন্দ্রাণী হাত নাড়লেন। হৈমন্তীর মনে হল বাড়িটার মতো এরা তত পুরোনো নয়। মৌয়ের অসুবিধা হবে না মানিয়ে নিতে। সদর দরজার পাশে দুটো ঘর। মাথায় সাইনবোর্ড। দরজা বন্ধ সাইনবোর্ড থেকে হৈমন্তী বুঝলেন একটিতে বসেন হোমিয়োপ্যাথি ডাক্তার, অন্যটি ইলেকট্রিক্যাল দ্রব্য সারাইয়ের।

মৃণালকান্তি বলল, ‘আমাদের ভাড়াটে। খুব ধরাধরি করায় বাবা বছর দুয়েক হল ওদের দিয়েছে। নয়তো খালিই পড়েছিল।’

বড়ো রাস্তায় খদ্দেরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল একটা ট্যাক্সি। মৃণালকান্তি বলল, ‘ভাগ্য ভালো। আজ রবিবার বলে পেলুম, অন্য দিন হলে এত সহজে ট্যাক্সি মিলত না।’

মৃণালকান্তি প্রণাম করতেই হৈমন্তী স্মিত হেসে মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘থাক বাবা দীর্ঘজীবী হও, সুখে থাকো।’

বাড়ি ফেরার সময় রমার মায়ের সঙ্গে রাস্তায় তার দেখা হল। কৌতূহলে টসটস করছে রমার মা—র মুখ। ‘দাদাবাবু আজ যার আসার কথা ছিল আপনাকে দেখতে ইনিই কী সেই?’

‘হ্যাঁ।’

‘খুব সুন্দর দেখতে তো, মেয়েও নিশ্চয় সুন্দরী হবে।’

‘হতে পারে।’ মৃণালকান্তি এড়িয়ে যেতে চায় এই স্ত্রীলোকটিকে। এ—বাড়ির হাঁড়ির কথা সে—বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ায় রমার মা যে অতীব পারদর্শী, সেটা সে জানে। সে চায় না তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে এই খবর পাড়ায় এখনই ছড়িয়ে পড়ুক। কিন্তু এখন বুঝে গেল খবরটা আর গোপন থাকল না। শকুনের মতো ওর দৃষ্টি। তল্লাটে কখন কোথায় কী ঘটনা তৈরি হচ্ছে, কে কী বলল বা করল, সব যেন ও টের পায় বা শুনতে পায়। তারপরই ঝাঁপিয়ে খবর থেকে নাড়িভুঁড়ি বার করে ছড়িয়ে দেয়। মৃণালকান্তির এক এক সময় মনে হয় রমার মাকে পুলিশের চরের কাজ নিতে বলবে।

বাড়ি ফিরতেই ইন্দ্রাণী বললেন,’দেখলুম রমার মাকে তোর সঙ্গে কথা বলতে।’

‘জিজ্ঞেস করল, ইনিই কী সেই যার আসার কথা ছিল। তুমি বুঝি ওকে বলেছিলে ওই ভদ্রমহিলা আজ আসবেন?’

‘বলেছিলুম, তাতে হয়েছে কী? একদিন তো সবাই জানতেই পারবে। ও তো এবার এসে জিজ্ঞাসা করবে বিয়েতে দাদাবাবু কী কী পাবে। যা যা বলব দু—দিনের মধ্যে পাড়ার লোক জেনে যাবে।’

‘কী কী পাব?’ মৃণালকান্তির মুখে কৌতুক মেশানো কৌতূহল।

‘ঘর ঠান্ডা করার যন্ত্র, ফ্রিজ, টিভি, পাউরুটি সেঁকা আর খাবার গরম করার আর টিভিতে সিনেমা দেখার যন্তর, তা ছাড়া বক্সখাট, স্টিলের আলমারি, খাওয়ার টেবিল, সোফা, স্টিলের বাসনের সেট—’

‘বলো কী!’ মৃণালকান্তির চোখ বিস্ফারিত। ‘মোটরগাড়ি দেবে না?’

‘না, অতটা বললে লোকে বিশ্বাস করবে না’ ইন্দ্রাণী হেস উঠলেন।

‘সত্যি সত্যিই কি এত দেবে বলেছে?’

‘দিতে চেয়েছে তবে এতসব নয়। রমার মাকে বলার জন্য বাড়িয়ে বলতে তো হবে।’

‘কিন্তু লোকে যখন দেখবে অতসব জিনিস এল না, তখন?’ মৃণালকান্তির চোখে আতঙ্ক ফুটল।

ইন্দ্রাণী হাসতে শুরু করলেন। ডান হাতের তর্জনীটা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, ‘একটা জিনিসও আসবে না। তোর বাবা সব বাতিল করে দিয়েছে।’ বলেই গম্ভীর হয়ে গেলেন।

মৃণালকান্তি বলল, ‘বাতিল মানে, নেবে না?’

‘হ্যাঁ, আমরা নোব না। ওরা বারো ভরি সোনার গয়না, খাট, বিছানা, আলমারি দেবেন তা ছাড়া বরাভরণ, ফুলশয্যার তত্ত্ব, নমস্কারি শাড়ি এসব যা যা দিতে হয় দেবেন। তোর বাবা শুনে বলল, মেয়েকে যা দিতে চান দেবেন তবে আমরা কোনো পণ—যৌতুক বা জিনিসপত্তর নোব না। আমরা মানে তুই বাদে আমরা দুজন। তোর তো খুব ভালো একটা ঘড়ির শখ ছিল, সেটাই বলব দিতে।’

শুনতে শুনতে মৃণালকান্তির দৃষ্টি স্থির হয়ে এল। যখন সে ভাবতে শুরু করে তখন তার চোখের মণি নড়ে না। বলল, ‘দিতে হবে না ঘড়ি। কিছুই না নিলে ওরা ক্ষুণ্ণ হতে পারেন, ভাববেন দয়া দেখাচ্ছে। ওই বরাভরণে জামা, জুতো যা দেবে সেটুকু মাত্র নেব, ব্যস। আর রমার মাকে কী বলবে সেটা ঠিক করো।’

‘বললুম তো, মেয়েপক্ষ এই এই দেবে বলেছে। শুনেই দাদাবাবু বলল একটাও কিছু নোব না, আমরা কি ভিখিরি? শ্বশুরবাড়ির দেওয়া জিনিস নিয়ে ফুটুনি করব? তুই বরং একবার ওকে শুনিয়ে এসব বলিস।’

মৃণালকান্তিকে আর বলতে হয়নি। রমার মা বিকেলে কাজে এল না। বারো বছরের রমা সন্ধ্যাবেলায় এসে বলল, ‘মা—র পা ভেঙেছে। সাবান জল দিয়ে দত্তবাড়ির সিঁড়ি ধুচ্ছিল। পিছলে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। মা কাজে আসতে পারবে না যতদিন না পা জোড়া লাগে।’

শুনেই ইন্দ্রাণীর মাথায় বাজ পড়ল। জ্বরজারি নয় যে দু—চারদিন পরে আসবে। ‘তা হলে কাজ করবে কে? মাকে বল একটা কাউকে ঠিক করে দিতে আর বাসনগুলো তুই মেজে দিয়ে যা।’

বিয়ের কয়েকদিন আগে পাঞ্জাবির মাপ দিতে আর জুতো কিনতে মৃণালকান্তিকে নিয়ে হৈমন্তী দোকানে গেলেন। সঙ্গে নিলেন অফিসের তরুণ সহকর্মী দাশগুপ্তকে। সে হালের ফ্যাশনট্যাশনে খুব রপ্ত। দাশগুপ্ত ওদের নিয়ে গেল শেক্সপিয়র সরণিতে চর্মদ্রব্যের এক দোকানে, এখানে বিদেশি জিনিস পাওয়া যায়। মৃণালকান্তির পাম্পশু চাই ধুতির সঙ্গে পরার জন্য। চটির দাম দেড় হাজার টাকা। দেখেই সে বুঝে নিল পাম্পশু—র দাম দুই—আড়াই হাজারের কমে হবে না। সে আড়চোখে বগলে ব্যাগ চেপে রাখা ভাবী শাশুড়ির দিকে তাকাল। হৈমন্তী তখন চোখে মুগ্ধতা মাখিয়ে ব্যাকেটে ঝোলানো খয়েরি রঙের চামড়ার একটা পোর্টফোলিও ব্যাগের দিকে তাকিয়ে। মৃণালকান্তির চোখও ঝকঝক করে উঠেছে। হৈমন্তী ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘আমাদের ইংরিজির প্রফেসার এইরকম একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে কলেজে আসতেন। তুমি ধরো তো এটা।’ মৃণালকান্তি ভূতে পাওয়ার মতো ব্যাগটা হাতে ধরল। ঘাড় কাত করে হৈমন্তী দেখলেন, হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মুখে।

‘দাশগুপ্ত, দ্যাখো তো, এবার প্রফেসার বলে মনে হচ্ছে কি না!’

.

মৃণালকান্তি পোর্টফোলিয়ো ব্যাগ হাতে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে ব্যাজার বোধ করল। মা কথাটা বউকে বলতে গেল কেন, ‘অন্য কলেজ দেখুক’, বলার মানেটা কি মা বোঝে? অন্য কলেজেই যদি পাওয়া যায় তা হলে মরতে তিন রকম বাহনে চড়ে দু—ঘণ্টা রাস্তা ঠেঙিয়ে ‘মধু’ কলেজে যাব কেন?

বি কে পাল অ্যাভেনু ছেড়ে মৃণালকান্তি আহিরিটোলা স্ট্রিটে ঢুকল। এই রাস্তাটি সোজা চলে গেছে গঙ্গার পাড়ে। তারপর বাঁদিকে কিছুটা হাঁটলে লঞ্চঘাট, তারপর নিমতলা শ্মশান। গঙ্গা পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তাটির দু—ধারে বাজার বসে সরু করে দিয়েছে। তার মধ্যে দিয়ে অটোরিকশাগুলোর ভ্রূক্ষেপহীন দ্রুতগতির যাতায়াত, ভাঙা রাস্তায় জমে থাকা জল ও কাদা, ট্যাক্সি, মন্থরগতির বৃদ্ধা, উবু হয়ে দরদাম করা ক্রেতা, আনাজের খোসা আর পাতা, মাছের আঁশটে গন্ধ, টানা একটা শব্দের আস্তরণে ঢাকা এই রাস্তা, দু—ধারে পলি জমা একদা চওড়া খালের মাঝখান দিয়ে সংকীর্ণ নালার মতো এই রাস্তাটা কোনোক্রমে মানুষ আর গাড়ি ঠেলে নিয়ে চলেছে।

ধবধবে ধুতি—পাঞ্জাবি, ঝকঝকে বিদেশি পোর্টফোলিয়ো ব্যাগটি জলকাদা ও ধাক্কাধাক্কি থেকে সামলে, বিশেষ করে জুতোর ঔজ্জ্বল্য, মৃণালকান্তি যখন ঘাটে এসে টিকিট কাটছে তখন দেখল বাগবাজার থেকে যাত্রী বোঝাই লঞ্চটি জেটিতে ভিড়ছে। এরপর দৌড়। যত লোক নামল তার দ্বিগুণ লঞ্চে উঠল। ঠেলাঠেলি করে ওঠার কিছুক্ষণ পর মৃণালকান্তির হুঁশ হল সে কারও পা মাড়িয়ে দিয়েছিল। আশপাশের কয়েকটি মুখ দেখে নিয়ে সে বুঝল এরা কেউ নয়। তার দিকে তাকিয়ে কেউ রাগি চোখে মুখ বিকৃত করছে না। আশ্বস্ত হয়ে সে ঘড়ি দেখল। ভাটার টানে লঞ্চ নির্দিষ্ট গতিতেই চলছে, ঠিক সময়েই পৌঁছে ট্রেনটা পেয়ে যাবে। হাওড়া ব্রিজের তলা দিয়ে যাবার সময় প্রতিবারের অভ্যাসমতো ব্রিজের তলাটা দেখল।

মৃণালকান্তি ছ—নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছানো মাত্র একটা ট্রেন ঢুকল। এটাই যাবে বলদেবপুর। সে তাড়াহুড়ো না করে ট্রেনে উঠল এবং বসার জায়গা পেল যা সচরাচর অন্যান্য দিনে পায় না। এবার সে সকাল থেকে এখন পর্যন্ত গত কয়েক ঘণ্টাকে ফিরে দেখার অবকাশ পেল এবং একবার মাত্র হোঁচট খেয়ে দেখল মসৃণভাবে বাকি সময়টা কাটাতে পেরেছে। হোঁচটটা মায়ের ওই কথাগুলো ‘অন্য কলেজ দেখুক’ আর মৌসুমীর থমথমে মুখ। এসবও মুছে যাবে যদি গত মাসের টাকাটা আজ পাওয়া যায়। কলেজে পৌঁছেই কালোবাবুর কাছে যেতে হবে। কালোবরণ ঘোষ ক্যাশিয়ার, সহৃদয় মানুষ। ক্যাশে টাকা থাকলে এবং প্রিন্সিপ্যাল বঙ্কিম সাহার অনুমতি পেলে সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দেন। উনি বলেছিলেন তেরো—চোদ্দো তারিখে একবার আসুন। আজ তো তেরো!

বলদেবপুর বর্ধিষ্ণু এবং প্রাচীন জায়গা। মধুসূদন বিশ্বাস জমিদার ও ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর বাড়িটিও বিশাল। সেই বাড়ির লাগোয়া হয়েছে সিনেমা হল এবং বাসস্ট্যান্ড, সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়ে থাকে সার বেঁধে। ট্রেকার ছাড়ে এখান থেকেই। মৃণালকান্তি প্রথম চার দিন রিকশাতেই কলেজ গিয়েছিল। পঞ্চম দিনে রিকশার টায়ার ফেটে যাওয়ায় তাকে বাকি পথ হেঁটে কলেজে যেতে হয়। বঙ্কিম সাহা বলেছিলেন, ‘শুরুতেই লেটে আসা আরম্ভ করলেন!’ তার মুখভাব আর গলার স্বরে মৃণালকান্তির বুক দুরদুর করে উঠেছিল। অনেক যোগাযোগের সূত্র ধরে হাঁটাহাঁটি করে কাজটা সে পেয়েছে। চাকরিটা স্থায়ী নয়, প্রিন্সিপ্যালের মর্জির উপর তাকে টিকে থাকতে হবে এটা সে জেনে গেছে।

ট্রেন সময়মতো চলেছে। মৃণালকান্তির টেনশন হয়নি, যা অন্যান্য দিনে হয়। কলেজে ঠিক সময়েই পৌঁছতে পারবে, এই সম্ভাবনাটায় হালকা লাগছে তার নিজেকে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে তার প্রথম কাজ বলরামের পুষ্প ভ্যারাইটি স্টোর্স থেকে চারটি ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুট কেনা। তিনটের সময় সে বিস্কুট এবং এক গ্লাস জল খাবে। বলরামের ছেলে কিশোর, কলেজে উচ্চচ মাধ্যমিকের ছাত্র। এই তল্লাটে উচ্চচ মাধ্যমিক পড়ার স্কুল নেই তাই মধু কলেজে পড়াতে রাজি হয়। এমন দায়িত্ব এ রাজ্যের বহু কলেজ নিয়েছিল, পরে ছেড়েও দিয়েছে কিন্তু মধু কলেজ ছাড়েনি তাই এগারো—বারো ক্লাস এই কলেজে রয়ে গেছে।

বলরাম খাতির করে মৃণালকান্তিকে। তার ছেলেকে আলাদাভাবে অঙ্ক শেখাবার জন্য অনুরোধ করেছে কয়েকবার। মৃণালকান্তি তাকে বলে দিয়েছে, ‘প্রাইভেট কোচিং আমি করব না।’ বলরাম তবুও হাল ছাড়েনি।

আজ বলরামের দোকানে দাঁড়ানো মাত্র সে মৃণালকান্তিকে বলল, ‘স্যার কলেজে আজ ঝামেলা হতে পারে, হায়ার সেকেন্ডারির প্রি—টেস্টে যে সাতটি ছেলে তিন—চারটি বিষয়ে পাশ করেনি তাদের টেস্টে বসতে দিতে হবে, এই দাবিতে ইউনিয়ন নাকি আজ প্রিন্সিপ্যালকে ঘেরাও করবে বলে ছেলের কাছে শুনেছি।’

দু—দিন আগে মৃণালকান্তিও স্টাফ রুমে শুনেছে এইরকমই একটা কথা। তার সহকর্মীদের কথাবার্তা থেকে বুঝেছিল ছাত্রদের দাবি বঙ্কিম সাহা মেনে নেবেন না। ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারি ধীরাজকে সে মনে মনে ভয় পায়। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। ইউনিয়ন দখলের ইলেকশন জিততে ছুরি বার করেছে, বোমা ফাটিয়েছে, বিরোধী প্রার্থীদের বাড়িতে গিয়ে তাদের বাবা—মাকে বলে এসেছে ছেলের শ্রাদ্ধের জন্য পুরুত ঠিক করুন। মৃণালকান্তির ভয়ের আর একটা কারণ, ফেল করা সাতটি ছেলের অঙ্কের খাতা সে দেখেছে, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চচ যে পেয়েছে তার নম্বর সতেরো। বঙ্কিম সাহা তাকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, ‘করেছেন কী? আট, ছয়, দশ এসব কী নম্বর দিয়েছেন? আপনিই তো অঙ্ক শিখিয়েছেন! এত কম নম্বর পেলে তো আপনারই বদনাম হবে।’

‘যদি হয় তো হোক।’ মৃণালকান্তি বলেছিল। ‘শুধু আমিই তো কম নম্বর দিইনি। ইংরেজি, বাংলা, বিজ্ঞান এগুলোতেও তো ফেল করেছে। ক্লাসে তো এদের মুখই দেখতে পাই না। এদের অ্যানসার পেপারগুলো আপনি নিজে একবার দেখুন। স্যার, এরা টেস্ট পরীক্ষায় বসার উপযুক্তই নয়। ডাহা ফেল করবে।’

বঙ্কিম সাহা গম্ভীর মুখে টেবলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘খাতাগুলো আমি দেখব, ধীরাজকেও দেখাব।’

তিন দিন পর মৃণালকান্তি প্রিন্সিপালকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘স্যার খাতাগুলো দেখলেন?’

‘দেখেছি, ঠিকই নম্বর দিয়েছেন। ধীরাজকেও দেখতে বলেছিলুম।’

‘কী বলল ধীরাজ?’

‘যেমনই অ্যানসার করুক না কেন ওরা গরিবের ছেলে পাশ করিয়ে দিতে হবে। ও খাতা না দেখেই বলেছে।’

‘পাশ করিয়ে দেবেন?’

‘দেখি।’

মৃণালকান্তি তখনই বুঝে গিয়েছিল একটা গণ্ডগোল ধীরাজরা পাকাবে। এটাই ওরা চায়। ম্যানেজিং কমিটি ওদের বিরোধী রাজনীতি করা লোকদের হাতে। এটা এখন হবে রাজনৈতিক লড়াই।

বলরামের চোখে উৎকণ্ঠা। বলল, ‘আজকের দিনটায় কলেজে নাই গেলেন। কিছু একটা হয়েটয়ে যদি যায়।’

মৃণালকান্তি বলল, ‘কিছু তো নাও হতে পারে। গিয়ে দেখব ঝামেলা মিটে গেছে। মিছিমিছি ভয় পেয়ে একটা দিন কেন নষ্ট করব। দিন বিস্কুট।’

ভয়ের থেকেও সে এখন মরিয়া। কালোবরণকে তার চাই। তেরো—চোদ্দো তারিখ বলেছে। প্রিন্সিপালকে তো দোতলায় তার ঘরে ঘেরাও করবে। অফিসঘরটা একতলায়। সেখানে নিশ্চয় কাজকর্ম যেমন চলে চলবে। মৃণালকান্তি ঘেরাও শব্দটি শুনেছে,কাগজে পড়েছে, কখনো চোখে দেখেনি। এটা যে কী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সেটা তার ধারণায় ছিল না। ট্রেকার না পেয়ে সে একটা রিকশায় উঠে কলেজ রওনা হল।

কলেজের কাছাকাছি আসতেই সে দেখল ছাত্ররা রাস্তায় জটলা করে রয়েছে। রিকশা থেকে মৃণালকান্তি নেমে পড়ল। তার মনে হচ্ছে কলেজে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে। একটি ছেলেকে ডেকে বলল, ‘ব্যাপার কী তোমরা এখন কলেজের বাইরে যে!’

হাসিমুখে ছেলেটি বলল, ‘সকাল দশটায় কলেজে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্সিপালকে তার ঘরে ঘেরাও করেছে ধীরাজরা, সত্যবাবু, মন্মথবাবুরা তখন ওর সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন তাঁরাও ঘেরাও হয়ে গেছেন। আপনি যাবেন না স্যার গেলে আপনাকেও ঘরে ঢুকিয়ে আটকে দেবে।’

‘অফিসঘরটাও কি ঘেরাও হয়েছে?’

‘খোলেইনি তো ঘেরাও করবে কাকে?’

মৃণালকান্তি বুকের থেকে সবটুকু বাতাস বেরিয়ে গেল। শ্বাস নিতে গিয়ে ব্যথা উঠল। সে কলেজের দিকে এগোল। ছেলেটির কথা সত্যি কি না স্বচক্ষে দেখে যাচাই করবে। একফালি জমি পেরিয়ে কলেজের কোলাপসিবল গেট। দোতলার বারান্দায় ছেলেরা ভিড় করে। হই—হট্টগোল চলছে। মৃণালকান্তি একজনও শিক্ষককে দেখতে পাচ্ছে না। স্টাফ রুমটা দোতলায়। হয়তো সেখানে তাঁরা বসে আছেন।

মন্থর পায়ে সে দোতলায় উঠে এল। দোতলার করিডরে গিজগিজে ভিড়। প্রিন্সিপালের ঘর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে। স্লোগান চলছে। মৃণালকান্তির কানে ছেঁড়াছেঁড়া শব্দ ‘অন্যায় জুলুম’, ‘গরিব ছাত্র’ ‘কলেজ বনধ’ ভেসে এল।

স্টাফ রুমে শান্তি গাঙ্গুলি আর প্রিয় চৌধুরি বসে। তাঁকে দেখে যেন তাঁরই প্রতীক্ষা করছেন এমনভাবে সমস্বরে তাঁরা বলে উঠলেন, ‘আসুন।’

শান্তি গাঙ্গুলি বললেন, ‘অফিসঘর কি খোলা দেখলেন?’

‘বন্ধ।’

প্রিয় চৌধুরি বললেন, ‘বলছে দাবি মেনে না নিলে সারারাত ঘেরাও করে রাখবে। সত্যবাবু আর মন্মথবাবু কেন যে তখন প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকতে গেলেন! সত্যবাবুর আবার হাই ব্লাড প্রেশার। এইরকম পরিস্থিতিতে ওঁর কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। ধীরাজকে কি বলব ওকে ছেড়ে দিতে?’ অনুমোদনের জন্য তিনি দুজনের মুখের দিকে তাকালেন।

‘লাভ হবে না। যদি পুলিশ ডাকে তা হলে উদ্ধার পেতে পারে।’ শান্তি গাঙ্গুলি বললেন, ‘তবে তাতে আগুনে ঘি পড়বে, ঘেরাওটা তখন ধর্মঘট হয়ে যাবে।’

‘তখন তো মারা পড়ব আমরা গেস্ট লেকচারাররা।’ প্রিয় চৌধুরী শুকনো হাসলেন, ‘নো ওয়ার্ক নো পে। দাবিটা তো সামান্য, ক—জনকে পাশ করিয়ে দিলে কলেজের কী এমন ক্ষতি হবে!’

বেয়ারা বিনয় ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কি বসে থাকবেন?’

‘তা হলে আর কী করব?’ মৃণালকান্তি বলল।

‘বাড়ি চলে যান। ক্লাস তো হবে না মিছিমিছি সময় নষ্ট করছেন।’

‘তা হলে।’ শান্তি গাঙ্গুলি উঠে পড়লেন। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে প্রিয় চৌধুরি তিক্তস্বরে বলল, ‘ওনার আর কী, কলেজ খোলাই থাকুক আর বন্ধ থাকুক ফুলটাইম লেকচারার, মাস গেলে তো হাজার বিশেক টাকা গ্যারান্টেড। ক্লাস পিছু দিনে আমাদের মতো পঁচাত্তর টাকার জন্য উঞ্ছবৃত্তি করতে তো হয় না ওনাকে। শুনেছি বর্ধমানের বাড়িতে কোচিং স্কুল খুলে ফেলেছেন। তাতে কত হাজার টাকা কামাচ্ছেন কে জানে!’

চোখে সহানুভূতি নিয়ে মৃণালকান্তি চুপ করে প্রিয় চৌধুরির মনের জ্বালার তাপ অনুভব করল। কথাগুলো তো তার নিজেরও।

‘জানেন মৃণালবাবু, ছোটো ছেলেটার টাইফয়েড হল এক হপ্তা কলেজে আসতে পারিনি, সাড়ে চারশো টাকা লস হল। আঠারোশো টাকা থেকে অতগুলো টাকা চলে গেলে কী থাকে বলুন? পাঠশালার মাস্টারেরও অধম আমরা।’

মৃণালকান্তি ঢোঁক গিলল। বাড়ির কেউ এখনও জানে না তার এই অধমত্ব। সবাই জানে সে গরিব দুঃস্থ এক মফস্সল কলেজের প্রফেসার যে—কলেজ প্রফেসারদের ঠিক সময়ে মাইনে দিতে পারে না। তার ভাগ্য ভালো সংসারটা এখনও ব্যাঙ্কের রিটায়ার্ড অফিসার বাবাই চালাচ্ছে। পেনশন পোস্ট অফিসের সুদ আর দোকানভাড়ার টাকায়। ভয় মৌসুমীকে নিয়ে। সে এখনও জানে তার স্বামী প্রফেসার। কথাটার অর্থ কি ও জানে?

‘মৃণালবাবু প্রাইভেট টিউশনি শুরু করুন। আপনি তো ভাগ্যবান মশাই, টুয়েলভে অঙ্ক করান আর বিএ ক্লাসে ইতিহাস পড়ান, আমার ডাবল রোজগার করেন। অনেক ছাত্র পেয়ে যাবেন, শুরু করুন শুরু করুন।’ বলতে বলতে প্রিয় চৌধুরি উঠে দাঁড়ালেন। ‘চলুন ওদিকে কী হচ্ছে একবার খোঁজ নেওয়া যাক।’

মৃণালকান্তির কানে ক্ষীণভাবে একটা ঈর্ষার সুর ছুঁয়ে গেল। দুটো বিষয় পড়ালে রোজগার তো দ্বিগুণ হবেই আর কে না আয় বাড়াতে চায়। বিএ—তে তার স্পেশাল পেপার ছিল অঙ্ক, অনার্স ছিল ইতিহাসে। যজ্ঞেশ্বরবাবুর মেয়ে একটি ছেলের সঙ্গে নিরুদ্দেশ হওয়ায় তিনি কলেজে আসছিলেন না, পরপর তিন দিন টুয়েলভ ক্লাসে অঙ্ক পড়ানো যায়নি। চিন্তায় পড়ে যান বঙ্কিম সাহা। মৃণালকান্তি নিজের থেকেই তাঁকে বলে, ‘স্যার যদি বলেন তো আমি অঙ্কের ক্লাসটা নিতে পারি। বিএ—তে আমার স্পেশাল পেপার অঙ্ক ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে লেটার পেয়েছি।’ প্রিন্সিপ্যাল সেই দিনই তাকে ক্লাস নিতে পাঠান। মৃণালকান্তি যখন অঙ্ক পড়াচ্ছে তখন তিন মিনিট ক্লাসের দরজায় এসে তিনি দাঁড়ান, দেখেন, শোনেন এবং ফিরে যান। সেই দিনই তিনি মৃণালকান্তিকে ডেকে বলেন, ‘কাল থেকে আপনি ইলেভেন—টুয়েলভে অঙ্ক করান। ক্লাস পিছু চল্লিশ টাকা পাবেন। রাজি থাকেন তো করুন।’ সে ঘাড় নেড়ে বলেছিল ‘করব।’ তাকে হপ্তায় দশটা অঙ্কের ক্লাস নিতে হয়। আয় বাড়ল। এটাকেই প্রিয় চৌধুরি বললেন, ‘ডবল রোজগার’।

স্টাফ রুম থেকে দুজনে বেরিয়ে এসে দেখল ছাত্রদের উত্তেজিত মুখ। মৃণালকান্তির মনে হল এমন মুখ যে দেখেছে ফুটবল ম্যাচের শেষ মুহূর্তে মাঠের গ্যালারিতে। বদ্ধ জলাশয়ে যেন ঢিল পড়েছে। একটা ঘটনা ঘটেছে, যে ঘটনার মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য ভরা আছে। সেটাকে খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে অথচ ভয়ও হচ্ছে। রোমাঞ্চক উত্তেজনার ঘোর চোখেমুখে। প্রিন্সিপালের ঘর থেকে ধীরাজের ধমক শোনা গেল। কী বলছে বুঝতে পারল না মৃণালকান্তি।

‘তোমাদের দাবির কত দূর কী হল?’

নিরীহ ধরনের যাকে জিজ্ঞাসা করলেন প্রিয় চৌধুরী সেই ছেলেটি অপ্রতিভ হয়ে বলল, ‘জানি না স্যার, আমি এইমাত্র আসছি।’ বলেই সরে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে আর একটি ছেলে, দেখতে সপ্রতিভ, বলল, ‘প্রিন্সিপ্যাল বলেছেন সাতজনকে পাশ করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা বিবেচনা করবেন তবে পাশ কোর্সের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের ফি মকুব করতে পারবেন না, ছাত্রদের ভরতির কনসেশন দেবেন না। উনি কিন্তু অনেককে কনসেশন দিয়েছেন, পার্টির নেতাদের চিঠি নিয়ে যারা এসেছে তাদের দিয়েছেন অথচ প্রকৃত গরিব ঘরের ছেলেরা পায়নি। এটা তো পক্ষপাতিত্ব, নয় কি?’ তারা দু—জন অস্বস্তিতে পড়ে চুপ করে রইল। ছেলেটি বলে চলল, ‘আপনারা তো দেখছেন গ্রামের ছেলেই বেশিরভাগ, গ্রামের স্কুলে কী পড়ানো হয় তাও জানেন। একটু সহানুভূতি নিয়ে তো এদের দেখা উচিত। এভাবে ফেল করিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয়?’

প্রিয় চৌধুরি চিমটি কাটলেন মৃণালকান্তির কনুইয়ে। ‘চলুন মৃণালবাবু, মনে হচ্ছে সমস্যাটা এখুনি মিটবে না, ঘেরাও চলবে।’ সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে গলা নামিয়ে তিনি বললেন, ‘আমাদেরই টাকা দিতে পারে না ঠিক সময়ে আর কনসেশন দেবে!’

‘ওঁরা কতক্ষণ ঘেরাও হয়ে থাকবে? সত্যবাবুর শরীর তো ভালো নয়।’ মৃণালকান্তির স্বরে উদবেগ।

‘শরীরটরির নিয়ে ওরা মাথা ঘামায় না। দাদারা বলে দিয়েছে ঝামেলা পাকাও, আন্দোলন করো, তাতে দু—একটা মরলে আন্দোলনটা ঝড়ে পরিণত হবে। দোষটা কলেজের ঘাড়ে ফেলা যাবে। কলেজ বন্ধ থাকবে মরবে পার্ট টাইম শিক্ষকরা। মৃণালবাবু কোমরে গামছা বাঁধার জন্য তৈরি হন। এখন যাবেন কোথায়?’

‘স্টেশনে।’

‘চলুন একটা রিকশা নেওয়া যাক শেয়ারে যাওয়া যাবে।’

প্রিয় চৌধুরি যাবেন হাওড়ার উলটো দিকে জৌগ্রামে, ট্রেনে আধ ঘণ্টার পথ। রিকশা থেকে নেমে তিনি গেলেন প্ল্যাটফর্মে, মৃণালকান্তি এল বলরামের দোকানে। দোকানটির সম্মুখভাগ বেশি বিস্তৃত, কাচ ও কাঠের তৈরি কাউন্টারটিও চওড়া। শুধু মনোহারী জিনিসই নয়, নানাবিধ খেলনা ও উপহারসামগ্রী, কিছু গল্প—উপন্যাসের বই, নিরীহ ওষুধপত্রও বিক্রি হয় বেবি ফুড, লিপস্টিক, বিস্কুট, বডি লোশনের সঙ্গে। জিনিস বিক্রির জন্য আছে দুজন কর্মচারী। পুষ্প ভ্যারাইটি বলদেবপুরের অন্যতম সমৃদ্ধ দোকান এবং বলরাম রায় বৈষয়িক বুদ্ধিতে অত্যন্ত দড়, সম্পন্ন কৃষিজীবী। বর্গাদারদের অভাবের সুযোগ নিয়ে তাদের কিছু টাকা ধরিয়ে বা জমির আংশিক মালিকানা দিয়ে একটু একটু করে নথিভুক্ত জমি হাতিয়ে এখন সে ধানের বড়ো ব্যবসায়ী। তার প্রবল ইচ্ছা বা সাধ ছেলে কিশোরকে গ্র্যাজুয়েট করবে, বংশে যা কেউ হয়নি।

মৃণালকান্তি কাউন্টারের উপর পোর্টফোলিয়ো ব্যাগটি রাখল।

বলরাম হেসে বলল, ‘ঝামেলা চলছে? কলেজ করা হল না।’

‘না। মনে হয় কিছুদিন চলবে।’ মৃণালকান্তির স্বরে হতাশা, সেটা লক্ষ করল বলরাম।

‘তা হলে কী করবেন? বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ভেতরে এসে বসুন।’

ট্রেনের অনেক দেরি, বিস্কুটগুলোও খেতে হবে। মৃণালকান্তি কাউন্টারের ওধারে গিয়ে টুলে বসল। ব্যাগ থেকে বিস্কুট বার করে বলল, ‘এক গ্লাস জল হবে?’

জলের গ্লাস কাউন্টারের উপর রেখে বলরাম বলল, ‘এখন কী করবেন?’

জল খেতে খেতে মৃণালকান্তির মনে হল এই লোকটা জানে সে গেস্ট লেকচারার। বোধ হয় জানে ক্লাস পিছু সে কত টাকা পায়। বোধ হয় জানে সামার ভেকেশনে, পুজোর ছুটিতে, সেকেন্ড ইয়ার আর থার্ড ইয়ারে যখন ছাত্র থাকে না তখন ক্লাসও থাকে না। ক্লাস না থাকলে, বলরাম নিশ্চয় খবর রাখে এইসব মাস্টাররা তখন দয়ার পাত্র হয়ে ওঠে।

‘কী আর করব! আসব কলেজে, ক্লাস হলে করব, না হলে চলে যাব।’

‘চলে যাবার আগে কয়েকটা টাকা রোজগার করে তারপর চলে যান।’

বলরামকে মিটমিটিয়ে হাসতে দেখে মৃণালকান্তি বুঝে গেল ও কী বলতে চায়।

‘কিশোরকে অঙ্কে পণ্ডিত করে দেওয়া?’

‘এই তো ধরেছেন কথাটা। শুধু কিশোর কেন আরও কয়েকটা ছেলে জুটিয়ে দেব। অঙ্ক বড়ো জটিল সাবজেক্ট, হায়ার সেকেন্ডারির অঙ্ক তো কড়াকিয়া গণ্ডাকিয়া নয়! হেল্প না পেলে মাথায় ঢোকে না। আমার বারবাড়ির একতলার দালানে ধানের বস্তাগুলো সরিয়ে জায়গা করে দেব। আপনি কোচিং খুলে ফেলুন। ভাড়া দিতে হবে না। কিশোর বলছিল আপনি নাকি দারুণ সহজ করে বোঝান।’

প্রিয় চৌধুরির কথাগুলো মৃণালকান্তির মাথার মধ্যে ঝনাত করে উঠল—’প্রাইভেট টিউশনি শুরু করুন—কোমরে গামছা বাঁধার জন্য তৈরি হোন।’ মা—র কথাটাও মনে পড়ল, ‘অন্য কলেজ দেখুক।’ মুখ নীচু করে মৃণালকান্তি এক মিনিট ভাবল, মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে বলল, ‘ঠিক আছে, করব।’

‘তা হলে দুটো দিন সময় দিন গুছিয়েগাছিয়ে নেবার জন্য। একটা ব্ল্যাকবোর্ড তো লাগবেই। মাদুরে বসবে ছেলেরা, বাড়িতে চেয়ার আছে, ইলেকট্রিক আলো আছে। কলেজ করে চলে আসবেন। মাইনেটা কলকাতার মতো নিলে কিন্তু হবে না, বেশিরভাগ তো গরিব ঘরের ছেলে।’

‘বলরামবাবু, আমাকে কি শ—পাঁচেক টাকা এখন দিতে পারবেন?’

ক্লান্ত করুণ স্বরে বলল মৃণালকান্তি।

‘কেন দিতে পারব না, এটা কী একটা কথা হল!’

.

বলরাম যখন মৃণালকান্তিকে বলল, ‘আজ কলেজে ঝামেলা হতে পারে’ সেই সময় মৌসুমী রান্নাঘরের তাক থেকে কৌটো, শিশি—বোতল নামিয়ে ঝাড়মোছ করছিল। ইন্দ্রাণী পরিষ্কার করছিলেন গ্যাস বার্নারটা। মাসে একবার তাঁরা এই কাজটা করেন। দত্তবাড়ির দোতলার ঘরে হঠাৎ পুরুষের গলায় একটা ক্রুদ্ধ গর্জন আর মেয়ে গলায় চিৎকার উঠল।

‘অই আবার শুরু হল, ক—দিন বন্ধ ছিল, ভাবলুম শান্তিতে থাকা যাবে।’ ইন্দ্রাণী নির্বিকার মুখে হাতের কাজ করে চললেন।

মৌসুমী জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। দত্তবাড়ির দোতলার ঘরের জানলাটা তাদের রান্নাঘরের জানলার প্রায় মুখোমুখি, মাঝখানে একতলা নীচু খোলার চালের ঘর। গর্জন ও চিৎকার থামছে না, সঙ্গে শব্দও হচ্ছে। যে—কেউই শুনলে বুঝবে একজন আর একজনকে প্রহার করছে।

‘ওদের বাড়িতে তো এত লোক, কেউ কিছু বলে না? এসে অন্তত থামাতে তো পারে!’

‘থামাবে কী? সবাই তো চাঁদুর মতোই বউ ঠ্যাঙানে। ওর বাবাও চাঁদুর মাকে পেটাত। ওই ঘরেই ওরা থাকত। তোমার মতো রান্নাঘর থেকে বিয়ের পর প্রথম দিন দেখে আমি তো ভয়ে কাঁটা হয়ে গেছলুম। কেমন জায়গায় বিয়ে হল রে বাবা! তোমার শ্বশুরকে বলতেই বলল, ‘পরের বাড়িতে যা হচ্ছে হোক তোমাকে তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। যখন ওরকম হবে তখন জানলাটা বন্ধ করে দেবে।’ আমি তাই করতুম।’ ইন্দ্রাণী কথাগুলো বলে জুড়ে দিলেন, ‘তুমিও তাই করবে।’

ঠিক তখনই মৌসুমী দেখল চাঁদুর বউ ঘর থেকে ছিটকে বারান্দায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তার মনে হল চাঁদুর লাথি খেয়েছে বউটি অথবা গলাধাক্কা।

‘ইসস, দেখুন মা দেখুন, বউটার অবস্থা দেখুন।’

‘তুমি দেখ গে, আমার অনেক দেখা আছে। জানলা থেকে সরে এসো বউমা।’ নির্দেশটা দিলেন গলা চড়িয়ে একটু অধৈর্য স্বরে।

মৌসুমী সরে এল। আড়চোখে দেখল বউটি উবু হয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুজে বারান্দায় বসে। জামা পরতে পরতে চাঁদু ঘর থেকে বেরিয়ে তার পাশ দিয়ে নীচে চলে গেল।

‘বউটা তো মা বাপের বাড়ি চলে যেতে পারে।’

‘তা তো পারেই। গেছলও দু—বার।’

‘আপনি জানলেন কী করে?’

‘রমার মা থাকতে জানার অভাব হয়। দু—বারই ওর বাবা—মা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। বাপের বাড়ি তো কলুটোলায়, বেশি দূর নয়। বাবার সোনার গয়নার দোকান বউবাজারে। চার বোন তিন ভাই ওরা। ওই বড়ো মেয়ে। অবস্থা বেশ ভালোই।’

‘দেখতেও ভালো, বয়স তো খুবই কম। তা হলে এমন অত্যাচার হয় কেন?’ মৌসুমী অবাক হয়ে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে রইল।

‘টাকা চায়। এটা তুমি বুঝবে না। তোমার মায়ের কাছে আমরা টাকা চাইনি, কোনো কিছুই চাইনি।’ ইন্দ্রাণীর গলায় প্রচ্ছন্ন গর্ব। ‘মিনুর বাবা তোমার মাকে কী বলেছিলেন নিশ্চয় তুমি শুনেছ।’

ইন্দ্রাণী পুত্রবধূর মুখভাব লক্ষ করলেন। দেখে সন্তুষ্ট হলেন। মনে মনে বললেন, মেয়েটা ভালো, পছন্দে ভুল করিনি। মিনুর বাবাও তাই বলে, মা—মেয়ে দু—জনেই কৃতজ্ঞ রয়েছে।

‘চাঁদু লোকটা কী করে?’

‘ওদের সর্ষের তেলের আড়ত আছে পোস্তায়, পাশের বস্তিটা ওদের, গোটা দুয়েক বাড়িও আছে, ছিল পাঁচ—ছটা। একে একে বিক্রি করেছে, এ ছাড়া কিছু করে বলে তো জানি না, আর যা করে সেটা বলার মতো নয়—গুন্ডামি, মস্তানি। ওর একটা দল আছে ইলেকশনের সময় টাকা নিয়ে কাজ করে, শুনেছি রাস্তার বাজারে তোলা আদায়ের কাজও করে।’

ইন্দ্রাণী হাতের কাজ শেষ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মৌসুমী জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। বউটি একইভাবে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে রয়েছে। দেখে ওর মায়া হল, বেচারা, কত দিন ধরে এভাবে মার খাচ্ছে কে জানে! খবরের কাগজে রোজই তো একটা দুটো খবর থাকে গৃহবধূ হয় আগুনে পুড়েছে, নয়তো গলায় দড়ি দিয়েছে, কখনোবা বাচ্চচাকে বিষ খাইয়ে নিজেও খেয়ে মরেছে।

দুপুরে মৌসুমী একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। দুপুরে সে ঘুমোয় না। রান্নাঘরে ঠক করে বাসন সরানোর শব্দ হল। সে দ্রুত উঠে এসে দেখল একটা শালিক ভাত খেতে থালায় উঠেছে। তাকে দেখে পাখিটা জানলা দিয়ে উড়ে গেল। বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সে জানলার কাছে এল। আপনা থেকেই চোখ চলে গেল দত্তবাড়ির বারান্দায়। ঘরের জানলাটা খোলা, পর্দাটা সরানো। ঘরের ভিতর খাটের এক দিকের বাজু আর সিলিংয়ে ঝোলানো পাখাটা দেখা যাচ্ছে।

তাকিয়ে দেখেই মৌসুমী আর্তনাদের মতো চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই এই কী করছ, কী করছ। নামো নামো, শিগগির নামো।’

বউটি টুলের উপর দাঁড়িয়ে একটি ওড়না ছুড়ছে পাখা লক্ষ্য করে। ওড়নার অন্য প্রান্ত গলায় বাঁধা। মৌসুমীর চিৎকার শুনে থতমত হয়ে বউটি ভীত চোখে তাকাল। তাড়াতাড়ি টুল থেকে নেমে এসে জানলা বন্ধ করে দিল। থরথর করে কাঁপছে মৌসুমীর গোটা শরীর। বউটি কি আবার টুলে উঠবে! বাড়ির দোতলা তিনতলার বারান্দায় লোক নেই। দুটো ঘরের জানলা খোলা কিন্তু সে কারও নাম জানে না যে চেঁচিয়ে ডেকে বলবে কী কাণ্ড হতে চলেছে তাদের বাড়িতে।

দু—হাতে জানলার গরাদ ধরে সে দাঁড়িয়ে রইল। কাউকে দেখতে পেলে ডেকে বলবে দোতলা ঘরের বউ গলায় ফাঁস লাগাচ্ছে শিগগির ওকে ধরে ফেলুন। বন্ধ জানলার ওধারে এখন কী হচ্ছে কে জানে! আবার কি ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ার চেষ্টা শুরু করবে? কতক্ষণ লাগবে পাখার হাঁড়িটায় ওড়না জড়াতে? সময়ের হিসেব করল মৌসুমী। বড়োজোর দু—মিনিট। গলায় ফাঁস তো আগেই দিয়ে রেখেছে। টুলটা এবার পা দিয়ে ফেলে দেওয়া তারপর দম বন্ধ হয়ে মরে যেতে কতক্ষণ লাগবে? এক মিনিট দু—মিনিট তিন মিনিট—গুনতে গুনতেই মৌসুমীর চোখ বিস্ময়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল।

বউটি ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এসে তাদের রান্নাঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়াল। মৌসুমী জানলা দিয়ে হাত বার করে নাড়তে নাড়তে চেঁচিয়ে বলল, ‘না, না, কোরো না।’

বউটি ক্লান্তভাবে মাথাটি হেলিয়ে দিল, একচিলতে হাসি খেলে গেল ঠোঁটে। আঁচল দিয়ে মুখ মুছল। মৌসুমীর মনে হচ্ছে ও ভীষণ নার্ভাস। বোধহয় বুঝতে পেরেছে যমের বাড়ি থেকে ফিরে এল। সে আবার বারণ করার ভঙ্গিতে দু—হাত নাড়ল। এখন তার নিজেরই নার্ভাস লাগছে। বাধা পাওয়ায় রেগে গিয়ে যদি আবার চেষ্টা করে? বউটি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠল যেটা আগের নির্বোধ—হাসিটার মতো নয়, এতক্ষণে নিশ্চয় মাথায় সাড় ফিরে এসেছে নইলে এমনভাবে হাসতে পারত না। একটা জীবন রক্ষা করার আনন্দ এখন মৌসুমীর চেতনাকে ধুইয়ে দিচ্ছে, তার মনে হল বউটির সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে বেঁচে থাকার থেকে কাম্য আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু কী করে কথা বলা যায়? ওদের বাড়িতে তাকে শ্বশুর—শাশুড়ি যেতে দেবেন না আর ওর পক্ষেও এ বাড়িতে আসা সম্ভব নয়। ওদের ঘরে টেলিফোন আছে কি?

মৌসুমী হাত তুলে চেঁচিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও।’ তারপর ছুটে শোবার ঘরে এল। খাতা থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে দ্রুত লিখল—যদি টেলিফোন থাকে তা হলে এই নম্বরে এখুনি আমায় ফোন কর। কথাগুলোর নীচে বড়ো অক্ষরে তাদের নম্বরটা লিখল।

এবার এটা ওর কাছে পৌঁছে দিতে হবে এবং গোপনে। একমাত্র উপায় ছুড়ে দেওয়া। অতদূর পর্যন্ত চেঁচিয়ে কোনোভাবে কথা হয়তো পাঠানো যায় কিন্তু এই কাগজটা? ঘরের চারধারে তাকাল সে ভারী একটা কিছুর খোঁজে। যা কিছুই চোখে পড়ল সবই হালকা, তাই দিয়ে ছুড়ে দিলে অতদূর পৌঁছবে না। কাশির সিরাপের খালি শিশিটা দেখে তার মনে হল বোধহয় এটায় চলবে। হাতে নিয়ে শিশিটার ওজন অনুমান করে দেখল বেশ ভারীই। কাগজটা ভাঁজ করে তার মধ্যে ঢুকিয়ে সে রান্নাঘরে এল। পলিথিনের থলিগুলো একধারে জড়ো করে রাখা তারই একটার মধ্যে শিশিটা ভরে প্যাঁচাল, রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধল। জানলা দিয়ে দেখল বউটি এখনও দাঁড়িয়ে, মৌসুমী ছাদে যাবার জন্য সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়ে শ্বশুরের ঘরের ভেজানো দরজাটা সামান্য খুলে দেখে নিয়ে ছাদে উঠে গেল।

ঢিলটিল সে কোনোদিন ছোড়েনি। তার ভয় হল যদি শিশিটা দত্তবাড়ির বারান্দা পর্যন্ত না পৌঁছয়, যদি নীচের বস্তির খোলার চালের ওপর পড়ে! সে হাত তুলে পলিথিনের মোড়কটা বউটাকে দেখিয়ে ছোড়ার ভান করে বুঝিয়ে দিল এটা এখন ছুড়ব।

পাঁচিল থেকে দু—পা পিছিয়ে এসে একটু জোরে এগিয়ে গিয়ে মৌসুমী প্রাণপণে ছুড়ে দিল। বউটির চোখে বিস্ময়, কিন্তু মৌসুমী চোখে ভয় নিয়ে দেখল মোড়কটা দোতলার বারান্দার রেলিংয়ে লেগে ঠকাস একটা শব্দ করে নীচে পড়ে গেল। বউটি নীচে একবার তাকিয়েই সিঁড়ির দিকে ছুটল।

দুরু দুরু বুকে মৌসুমী অপেক্ষায় রইল। কী আছে নীচে? গলি? লোক চলছে? যদি কেউ ওটা তুলে নেয়? এক মিনিটের মধ্যেই বউটি উঠে এসে নিজের ঘরে ঢুকে গেল, হাতে মোড়কটা। মৌসুমীর বুক থেকে পাষাণভারটা নেমে গেল।

পর্দা সরিয়ে জানলায় মুখ দেখাল বউটি, হাতের কাগজটা নাড়িয়ে ফোন করার ভঙ্গিতে কানের পাশে মুঠো রাখল। মৌসুমী ছুটে নেমে এল দোতলায়।

টেলিফোনটা খাওয়ার টেবলের পাশে একটা টুলের ওপর। সে চেয়ারে বসা মাত্র ফোন বেজে উঠল। ‘ক্রিং’ শব্দ হতেই সে রিসিভার তুলে নিল। বেশিক্ষণ বাজলে শ্বশুর বা শাশুড়ির ঘুম ভেঙে যেতে পারে।

চাপা স্বরে মৌসুমী বলল, ‘কে বলছেন?’

‘আমি পার্বতী। আমাকে ফোন করতে বলেছেন। আপনার নাম কী?’

‘মৌ, মৌসুমী। কতদিন আপনার বিয়ে হয়েছে?’

‘তিন বছর, মাধ্যমিক পাশ করতেই বিয়ে হয়।’

মৌসুমী বুঝল ওর বয়স মোটামুটি কুড়ির আশেপাশে। তার থেকে দু—তিন বছরের ছোটোই হবে। পার্বতীকে ‘তুমি’ বলা যায়।

‘কতদিন ধরে মার খাচ্ছ? তোমার স্বামীকে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কিছু বলে না?’

‘না, বলে না। প্রথমদিন মার খেয়ে ছুটে বড়ো জা—র ঘরে ঢুকেছিলুম, আমাকে ঠেলে বার করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।’

‘তোমার বর তোমায় মারে কেন?’

‘বিয়ের আগে বাবার কাছে এক লাখ টাকা চেয়েছিল একজনের সঙ্গে বখরায় হেলথ ক্লাব করবে বলে। বাবা বলেছিল, অত টাকা এখুনি দিতে পারব না। মেজো বোনের বিয়ের কথাবার্তা তখন চলছিল, বড়দা ডাক্তারিতে ভরতি হবে। মা—র কিডনি অপারেশন হবে তখন অনেক টাকার দরকার। বিয়ের পর এরা টাকা চাইতে শুরু করে। বাবা পঁচিশ হাজার দেয়। তারপর আর দিতে পারেনি, শুরু হয় মারধর।’

‘তুমি বাপের বাড়ি গিয়ে থাকো না কেন?’

‘দু—বার চলে গেছলুম, বাবা থাকতে দিতে রাজি নয়, বলে, এত টাকাপয়সা গয়না দিয়ে বিয়ে দিলুম সে কি বাপের বাড়িতে থাকার জন্য? মা বলল, শ্বশুরবাড়িই মেয়েদের ঘর। লাথি—ঝাঁটা খেয়েও ওখানে পড়ে থাকবি। ভাই কী বলব, এইসব শুনে ঘেন্না ধরে গেল নিজের ওপর। মা বলল, তোর দাদাদের বিয়ে হবে, তাদের বউয়েরা তোকে তো দাসী করে রাখবে, আমরা আর ক—দিন তারপর তোকে দেখবে কে? মাকে গায়ের কাপড় খুলে মারের দাগগুলো দেখালুম, বললুম ও বাড়িতে আমাকে আর যেতে বলো না, এবার আমি ঠিক মরে যাব।’

মৌসুমী কান্না চাপার শব্দ পেল। কী বলে সান্ত্বনা দেবে সে ভেবে পেল না। নিজেকে সামলে নিয়ে পার্বতী আবার বলতে শুরু করল, ‘জানেন আমার পেটে একটা বাচ্চচা এসেছিল, সাত মাসে সেটা নষ্ট হয়ে যায় ওর ঘুসি খেয়ে। আজও পেছন থেকে এমন একটা লাথি মারল যে ছিটকে ঘরের বাইরে পড়ে গেলুম।’

‘দেখেছি সেটা। তুমি এখন চুপচাপ থাক। ঝগড়াঝাঁটি করে বরকে চটিয়ে দিয়ো না। তোমার ফোন নম্বরটা দাও। কখন ফোন করব?’

‘এই রকম সময়ে করবেন, আমিও করব। আজ আপনি যদি না চেঁচিয়ে উঠতেন তা হলে ঠিক আমি ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়তুম। এইভাবে বেঁচে থাকতে আর ইচ্ছে করে না।’

‘এখন কী ইচ্ছে করছে?’

উত্তরের জন্য উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করল মৌসুমী। কিছুক্ষণ পর ক্ষীণ স্বরে পার্বতী বলল, ‘হ্যাঁ,’ আর একটু পর বলল, ‘কতদিন ইচ্ছে করবে জানি না। এ বাড়িতে কেউ আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না, আমার বাইরে বেরনো বারণ। মাঝে মাঝে মনে হয় যেদিকে দু—চোখ যায় চলে যাই।’

‘তোমার ফোন নম্বরটা এখনও বলনি। দাঁড়াও কাগজ আনি।’

মৌসুমী ঘর থেকে খাতা আর কলম নিয়ে এসে দেখল শাশুড়ি কলঘরে যাচ্ছে। সে রিসিভার তুলে বলল, ‘বলো।’ নম্বরটা লিখে নিয়ে বলল, ‘আজ এই পর্যন্ত, এখন আমি ফোন রাখছি।’

‘কে ফোন করেছিল বউমা?’ ইন্দ্রাণী কলঘর থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমার এক বন্ধু।’

রাত্রে বিছানায় শুয়ে মৌসুমী বলল, ‘আজ একটা ব্যাপার হয়েছে।’

মৃণালকান্তি অবাক হয়ে বলল, ‘ব্যাপার! আমারও তো আজ একটা হয়েছে। আগে শুনি তোমার ব্যপারটা।’

মৌসুমী তার সঙ্গে পার্বতীর টেলিফোনে যেসব কথাবার্তা হয়েছে তা বলল। মৃণালকান্তি ভারী স্বরে বলল, ‘তুমি একটা প্রাণ বাঁচিয়েছ। কাজটা খুব ভালো, তবে পার্বতীর ওই ভাবে বাঁচতে কতদিন ইচ্ছে করবে জানি না। ব্যাপারটা কিন্তু খুব গোলমেলে। এদের মতিস্থিরতা খুব কম, এরা খুব ইমোশনাল হয়, হয়তো কালই দেখবে ঝুলে পড়েছে।’

শুনেই মৌসুমীর বুকের ভিতরটা বসে গেল, নিজেকে সাহস জোগাবার জন্যই যেন বলল, ‘ও নিঃসঙ্গ বলেই এত ডিপ্রেশনে ভুগছে, জীবন সম্পর্কে এমন নেগেটিভ মনোভাবের খপ্পরে পড়েছে। আমি ভাবছি এবার থেকে ওর সঙ্গে কথা বলব। আচ্ছা তুমি ওর স্বামীকে চেনো? তোমার পাশের বাড়িরই তো ছেলে।’

‘চাঁদু আমার থেকে বয়সে একটু বড়ো। মাধ্যমিকটা টুকে পাশ করেছে তারপর আর পড়া এগোয়নি, পাড়ার ছেলে হলেও আড্ডাটা দিত অন্য পাড়ায়। এখানে ও মনের মতো বন্ধু পায়নি। রাস্তায় দেখা হলে, ‘কেমন আছিস’, আলাপটা ওই পর্যন্ত। যারা লেখাপড়া করত তাদের ও দু—চক্ষে দেখতে পারত না, আমাকে তাই খুবই অপছন্দ করে। ওদের বাড়ির শিক্ষাদীক্ষা কালচার কেমন সেটা তো পার্বতীর কথা থেকেই বুঝে গেছ। খুব বড়ো ধরনের মাস্তান না হলেও আমাদের আর আশপাশের মধ্যবিত্ত পাড়ার পক্ষে যথেষ্ট ভয়াবহ, ক্ষতিকর। ঘরের মধ্যে চাঁদু কাকে মারধর করছে তাই নিয়ে ওকে ঘেন্না ছাড়া আর কী করতে পারি!’

‘পার্বতী কোর্টে যেতে পারে। স্বামী অত্যাচার করে বলে ডিভোর্স চাইতে পারে খোরপোশ সমেত।’

অত্যাচার যে করে তার প্রমাণ দিতে হলে সাক্ষী দরকার। একজন সাক্ষীকেও পার্বতী কোর্টে নিয়ে যেতে পারবে না। তার থেকে বরং তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো ওর কোনো প্রেমিক ছিল কি না। যদি থাকে তা হলে খোঁজ নিতে বলো সে এখনও আনম্যারেড কি না, যদি আইবুড়ো থেকে থাকে তা হলে এক্ষুনি যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রেমটা ঝালিয়ে নেয়। তারপর বাড়ি থেকে টুক করে কেটে পড়ে প্রেমিককে বিয়ে করে ফেলুক। ছেলেপুলে নেই অসুবিধে হবে না। হেসো না, এমন ঘটনা এই পাড়াতেই ঘটেছে, তা না হলে বুদ্ধিটা আমার মাথায় এল কী করে?’

‘ডিভোর্স না করেই আবার বিয়ে করা যায় নাকি?’

‘না, না, আগে ডিভোর্স।’

‘মামলাটা এখানে থেকেই করবে?’

‘তা কেন, বাপের বাড়িতে গিয়ে সেখান থেকে করবে।’

‘বাপ—মা করতে দেবে না।’

‘দেবে, দেবে, আগে নিজের বিয়ের ব্যবস্থাটা করে ফেলুক তখন দেবে।’

.

‘পার্বতীর কথা থাক এবার বলো তোমার আজ কী ব্যাপার হয়েছে।’

মৌসুমী পাশ ফিরে স্বামীর বুকের উপর হাত রাখল। মৃণালকান্তি চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর অধৈর্য হয়ে মৌসুমী বলল, ‘কী হল, চুপ করে আছ কেন?’

‘বলছি। তোমাকে যে পাঁচশোটা টাকা দিলুম, কীভাবে টাকাটা পেয়েছি জান?’

‘না বললে কী করে জানব!’

‘প্রাইভেট টিউশনি কখনো করব না, মন দিয়ে ছাত্র পড়াব, নিজে পড়াশুনো করব, ফাঁকি দেব না পড়াতে—আমার এই প্রতিজ্ঞা বিক্রি করে টাকা এনেছি।’ মৃণালকান্তি উত্তেজিতভাবে উঠে বসল। ‘আমি তোমাদের ঠকিয়েছি। আমি মোটেই প্রফেসর নই, গেস্ট লেকচারার, অতিথি—শিক্ষক, কী গালভরা একটা নাম। যেকোনো সময় কলেজ আমায় ছাঁটাই করে দিতে পারে। এসব তোমরা জানতে না, তোমরা খোঁজখবর করনি।’

‘কে বলল আমরা করিনি!’ মৌসুমী ছাড়া গলায় বলল। ‘মা অফিসের একজনকে দিয়ে মধুসূদন বিশ্বাস কলেজে দু—তিনজনের কাছে খোঁজ নিয়েছিল। তোমার চাকরি সম্পর্কে সব শুনেও মা রাজি হয়েছে। আমিও সব শুনেছি। মাইনে প্রায় কিছুই নয়, তাতে কী হয়েছে, বিয়ের জন্য ওটাই কি একমাত্র ক্রাইটেরিয়া?’

‘কী বলছ, রোজগারটাই তো আসল জিনিস!’ মৃণালকান্তিও অবাক হল। সে আশা করেনি তার বউ এমন সহজভাবে ব্যাপারটা নেবে।

‘রোজগার তো লোক ঠকিয়ে বহু লোক করে, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ টাকা করে, শুধু তারাই কি ভালো লোক, ভালো জামাই, ভালো স্বামী? মা বলেছিল ‘মৌ তোকে একটা সৎ ছেলের হাতে দিতে চাই, একটা ভদ্র শিক্ষিত ঘরে দিতে চাই, তুই সুখে থাক আজীবন। বেশি আকাঙ্ক্ষা বেশি লোভ করিসনি।’ মৃণাল, আমি আকাঙ্ক্ষা করি কিন্তু লোভী নই।’ মৌসুমী অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে খুঁজল মৃণালকান্তির হাত। সেটা পেয়ে আঁকড়ে ধরে বলল, ‘তোমার বোধহয় ভয় হত?’

‘কীসের ভয়?’

‘প্রফেসর নও এটা যদি জেনে ফেলি!’

‘হ্যাঁ হত। বুকের মধ্যে একটা জায়গা সবসময় কুঁকড়ে থাকত। সবার কাছে নানাভাবে চাপা দেবার চেষ্টা করে গেছি, মা এখনও জানে না। বাবা জানে আমি ফুলটাইমার নই, সামান্য টাকা পাই, তাই ইলেকট্রিক বিলের টাকা ছাড়া আর কিছু চাননি আমার কাছে। ওটাও নেন আমার মুখরক্ষার জন্য, যাতে আমি ভাবি, সংসারে কিছু দিচ্ছি। কিন্তু আমি জানতুম না তুমিও আমায় এত দিচ্ছ।’

‘কী দিচ্ছি?’

মৃণালকান্তি জবাব দিতে গিয়ে চুপ করে গেল।

‘বলো না, কী দিচ্ছি।’ স্বামীর ঊরুতে চিমটি কাটল মৌসুমী।

‘সহানুভূতি। এটা যে কী বিরাট ভরসা আর সাহস এখন আমাকে দিল, কী যে হালকা লাগছে নিজেকে! তুমি যে আমার পাশে প্রথম দিন থেকেই আছ এটা জানতুম না। বুক থেকে একটা পাষাণভার নেমে গেল।’

মৌসুমীর হাতের তালু নিজের বুকে চেপে ধরে মৃণালকান্তি বলল, ‘দেখো।’

মৌসুমী বুকে হাত বুলিয়ে বলল, ‘সেই জায়গাটা কই যেখানটা সবসময় কুঁকড়ে থাকত?’

‘ভালো করে না খুঁজলে পাবে কী করে?’

‘তা হলে খুঁজি।’ মৌসুমী গলা ধরে স্বামীকে টেনে আনল বুকের উপর।

‘আমি কিন্তু আর প্রফেসর নই এখন থেকে অতিথি—শিক্ষক। মনে থাকবে?’

.

পরদিন মৌসুমী দুপুরে ফোন করল। একবার বাজতেই রিসিভার উঠল তাইতে সে বুঝল পার্বতী ফোনের অপেক্ষায় ছিল।

‘কে, পার্বতী? আমি মৌ, আর গোলমাল হয়নি?’

‘হয়নি।’

‘একটু তাড়াতাড়ি উত্তর দেবে। শ্বশুর—শাশুড়ি ঘুমোচ্ছে, ওরা জানে না তোমার সঙ্গে কথা বলেছি, তবে আমার বরকে জানিয়েছি। শোনো পার্বতী তোমার কোনো দেবদাস আছে?’

‘মানে!’

‘মানে কখনো প্রেম করেছ?’

ওধারে চুপ। মৌসুমী বুঝল প্রশ্নের উদ্দেশ্যটা বুঝতে চাইছে। কিছু একটা ব্যাপার একসময় কারও সঙ্গে ছিল। লজ্জায় বলছে না।

‘কী হল চুপ কেন, আরে বলো বলো আমার সময় কম।’

‘হ্যাঁ।’ অস্ফুটে বলল পার্বতী। ‘তবে ওপর ওপর। কেন জিজ্ঞেস করছেন?’

‘ওই যে বললে যেদিকে দু—চোখ যায় চলে যেতে ইচ্ছে করে। তাই একটা মতলব আমার বরের মাথায় এসেছে। এ ছাড়া তোমার পক্ষে বাঁচার আর কোনো রাস্তাও দেখছি না। শোনো তোমাকে সাহসী হতে হবে, বেপরোয়া হয়ে একটা কাণ্ড করে ফেল তো।’

‘কী করব?’ গলাটাকে উৎসুক মনে হল মৌসুমীর।

‘সে লোকটা কে যার সঙ্গে ওপর ওপর মানে, কীরকম ওপর ওপর? তোমার কি মনে হয় এখনও সে তোমাকে মনে রেখেছে?’

‘জানি না। বিয়ের আগে বাড়িতে ফোন করত, দাদার সঙ্গে খুব ভাব ছিল, আমাদের পাশের পাড়ার। অন্য কেউ ফোন ধরলেই দাদাকে চাইত।’

‘চিঠিপত্র দিত?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি দিয়েছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার কাছে ওর চিঠি আছে?’

একটু চুপ থেকে, ‘আছে।’

‘একসঙ্গে কোথাও গেছ?’

‘দু—বার সিনেমায়, ম্যাটিনি শোয়ে। তা ছাড়া স্কুলে যাবার সময় ও সঙ্গে সঙ্গে যেত।’

‘কতদিন এটা চলছে?’

‘ক্লাস এইট থেকে।’

‘শোনো পার্বতী, ওর বাড়ির লোকজন, অবস্থা কেমন? বিয়ে—থা হয়ে গেছে কি না জান?’

‘হয়নি। ওরা দুই ভাই, ও বড়ো, আর আছে বাবা মা। নিজেদের বাড়ি। বি এ পাশ। ছিট কাপড়ের দোকান আছে হাতিবাগানে। রাধা সিনেমার কাছে । দোকানটার নাম ‘ভগবতী’। ওর ঠাকুরমার নাম। ‘দ্রুত বলে গেল পার্বতী।

‘ওর নাম কী?’

‘প্রসাদ, ওরা বসাক।’

‘আমি যদি গিয়ে প্রসাদের সঙ্গে কথা বলি তাতে তোমার আপত্তি আছে?’

‘কী জন্য কথা বলবেন?’

‘তোমাকে বিয়ে করার জন্য।’

‘আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘হোক না, আবার করবে। মেয়েরা কি দু—বার বিয়ে করতে পারে না? পার্বতী, এই যে মার খাচ্ছ, আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ এসব তো উচিত নয়। তোমার লেখাপড়া বেশিদূর নয়, ভালো কোনো কাজ তুমি পাবে না যে ডিভোর্স করে আলাদা থাকতে পারবে। হ্যাঁ, তোমাকে এই স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবেই চিরকালের মতো। তুমি নিশ্চয় এই লোভী নিষ্ঠুর লোকটাকে ভালোবাস না।’

‘না। একদমই না। আমি যদি বিধবা হয়ে যাই তা হলে সুখে থাকব। ভগবানের কাছে এই প্রার্থনাই করি আমাকে বিধবা করে দাও।’ মৌসুমী এই প্রথম পার্বতীকে উত্তেজিত গলায় কথা বলতে শুনল। তার মনে হল কথাগুলো সে অন্তর থেকে বলল।

‘বিধবা হতে হবে না, সধবা থাকারই চেষ্টা করো! তোমার একটা আশ্রয় চাই। দেখি প্রসাদ সেটা দিতে পারে কিনা। ও কখন দোকানে থাকে জানো?’

‘তখন তো সকালে ওর বাবা দোকান খুলত, ও যেত দুপুরে, খেয়েদেয়ে সন্ধেবেলায় ভাই যেত। দু—জন কর্মচারী ছিল। আচ্ছা দিদি আপনি কবে যাবেন ওর সঙ্গে দোকানে দেখা করতে?’

‘দেরি করব না, কাল দুপুরেই তিনটে নাগাদ যাব। এখন ফোন রাখছি অনেকক্ষণ কথা হল।’

পরদিন দুপুর তিনটেয় মৌসুমী বাড়ি থেকে বেরোল। ইন্দ্রাণীকে বলে রেখেছিল হাতিবাগানে যাবে ব্লাউজের কাপড় কিনতে। অটোরিকশা নেবে কি না একবার ভেবে নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করল। মিনিট দশেক পর হাতিবাগানের মোড়ের কাছে পৌঁছে সে অবাক হয়ে দাঁড়াল। ঢাকাই শাড়ি পরা, ঘোমটা দেওয়া শ্যামবর্ণা মিষ্টিমুখের যে বউটি ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে, ওই তো পার্বতী! কী আশ্চর্য ও এখানে কেন? প্রসাদের সঙ্গে দেখা করবে বলে!

‘তুমি বাড়ি থেকে এত দূরে একা এসেছ? সাহস তো কম নয়! বাড়ির কেউ জানে?’

‘পাগল। চুপি চুপি বেরিয়ে পড়েছি। আমি কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা করব না। একবার শুধু ওকে দেখব বাইরে থেকে।’ পার্বতী হাসল।

ঝকঝক করে উঠল মুখটি। ‘একা বেরিয়েছি জানলে কপালে মার আছে।’ আবার সে হাসল।

‘দোকানটা নিশ্চয় তুমি আগে দেখেছ।’

‘দেখেছি।’

‘তা হলে দূর থেকে আমায় দেখিয়ে দাও। আর প্রসাদকে দেখতে কেমন?’

‘ফর্সা। বাঁদিকে পাট করে আঁচড়ানো চুল। ফুল হাত সাদা শার্ট পরত, এখনও পরে কি না জানি না—।’

‘ব্যস, ওতেই হবে।’

পার্বতী পনেরো গজ দূর থেকে ‘ভগবতী’কে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে, সামনে মুখ তুলে সোজা হেঁটে চলে গেল, মৌসুমী দোকানে ঢুকল। ডানদিকে ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির মতো লম্বা কাউন্টার, তার পিছনে দেওয়ালে দুই থাকে কাচের শো—কেস। নানা রঙের দামি ব্লাউজের কাপড় পাকিয়ে রিল করে এবং ভাঁজ করে সার দিয়ে দাঁড় করানো। কাউন্টারের উপর স্তূপ করা শার্ট ও ট্রাউজার্সের কাপড়। আর একদিকে বেডকভার ও পর্দার কাপড়। ফ্লুরোসেন্ট আলো কাচে প্রতিবিম্বিত হয়ে ঘরটা ঝকমকে দেখাচ্ছে। দিনের এই সময়ে দোকানে ক্রেতা কম থাকে, ভগবতীতে এখন একজনও খদ্দের নেই। মৌসুমী খুশি হল।

কাউন্টারের লোকটি এগিয়ে এল। এ যে প্রসাদ নয় দেখেই মৌসুমী বুঝল। বরং কাউন্টারের শেষ প্রান্তে মাথা নামিয়ে খবরের কাগজ পড়া টুলে বসা লোকটিকেই তার মনে হল প্রসাদ। গায়ের রং, চুল আর শার্ট পার্বতীর বলা বর্ণনারই মতো। লোকটি তাকে একবার দেখে নিয়ে আবার পড়ায় মন দিল।

‘ব্লাউজের কাপড় চাই রানি রঙের।’

কর্মচারীটি একটি কাপড় জড়ানো রিল বার করে গড়িয়ে দিয়ে মেলে ধরল। মৌসুমী আঙুল ঘষে কাপড়ের মসৃণতা পরখ করে বলল, ‘মিটার কত করে?’

‘আশি টাকা।’

‘এর থেকে ভালো আছে?’

ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটি আর একটা রিল বার করছে। মৌসুমী তখন চট করে দেখে নিল কাগজ—পড়া লোকটিকে। হাতে কাগজ ধরে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে।

‘এটা দেখুন একশো টাকা মিটার।’

পঁচাশি সেন্টিমিটার ব্লাউজের কাপড় কিনে লোকটির কথামতো বিলটা হাতে নিয়ে মৌসুমী দাম দিতে সরে গেল কাগজপড়ার দিকে। দাম দিয়ে খুচরো ফেরত নিয়ে সে ঝুঁকে বলল, ‘আপনি কি প্রসাদবাবু?’

খুবই অবাক হয়ে প্রসাদ বলল, ‘হ্যাঁ’।

‘আপনি পার্বতীকে চেনেন?’

ভ্রূ কুঁচকে উঠল প্রসাদের, ‘চিনি। কেন?’

ফিসফিস করে মৌসুমী বলল, ‘পার্বতীর খুব বিপদ আপনার সাহায্য দরকার।’

‘বিপদ! আমার সাহায্য? কী ব্যাপার বলুন তো? আপনি কে?’

‘আমি ওর পাশের বাড়িতে থাকি। আমার নাম মৌসুমী। আপনি কি শুনেছেন ওর স্বামী লোকটি কেমন?

‘আহিরিটোলায় আমার চেনাশোনা অনেক লোক আছে তাদের কাছ থেকে আর আমার বন্ধু পার্বতীর দাদা পূর্ণেন্দুর কাছ থেকে যা শুনেছি তাতে তো ও একটা রাসকেল। বরং জানোয়ার বললেই ঠিক বলা হয়।’

মৌসুমী কর্মচারীটির দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করল। প্রসাদ তা লক্ষ করে বলল, ‘আপনি ভেতরে এসে কথা বলুন।’

কাউন্টার ঘুরে মৌসুমী ভিতরে গেল। প্রসাদ একটা টুল এগিয়ে দিতে সে দরজার দিকে মুখ করে বসল।

‘আপনি ঠিকই শুনেছেন লোকটা একটা জানোয়ারই। আমাদের বাড়ি থেকে ওদের ঘরটা দেখা যায়। দেখি তো পার্বতীকে যে কী মার মারে, দেখে শিউরে উঠতে হয়!’

মৌসুমী দেখল প্রসাদের মুখে বেদনার ছায়া পড়ল। খবরের কাগজটা মুঠোয় পাকিয়ে দুমড়ে ফেলল। ‘কেন, কেন এই অত্যাচার?’

‘টাকার জন্য।’

‘আমিও তাই শুনেছি পূর্ণেন্দুর কাছে।’

‘অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পার্বতী গলায় দড়ি দিচ্ছিল, আমি দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে না উঠলে ও ঠিক ঝুলে পড়ত। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।’ মৌসুমী তখন দেখল বড়ো করে ঘোমটা দিয়ে পার্বতী দোকানের সামনে দিয়ে চলে গেল। চট করে একবার দোকানের ভিতরে তাকিয়েও নিল।

‘ওকে এখন বাঁচাতে হবে আর আপনিই তা পারেন। আপনি কি ওকে অন্তর থেকে ভালোবেসেছিলেন?’

প্রসাদ আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল কে জানে! একটার পর একটা বিস্ময়ের ধাক্কায় সে বিভ্রান্ত হয়ে চলেছে।

‘ওসব কথা এখন আসছে কেন, পার্বতী এখন পরস্ত্রী।’

‘ওকে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আর আপনিই পারেন ওকে বার করে আনতে।’

স্থির চোখে তাকিয়ে রইল প্রসাদ। মৌসুমী অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। দু—জন মহিলা ক্রেতা দোকানে ঢুকল। অবশেষে প্রসাদের চোখ নড়ে উঠল, পলক পড়ল।

‘বেরিয়ে এসে ও যাবে কোথায়?’

‘বাপের বাড়িতে। ওকে যাতে থাকতে দেয় সেই ব্যবস্থাটা আপনাকে করতে হবে আপনার বন্ধুকে বলে। হয়তো জানেন দু—বার ও বাপের বাড়িতে এসে আশ্রয় চেয়েছিল, বাবা—মা ফিরিয়ে দেয়। এবার যাতে ফিরিয়ে না দেয়ে সেটা আপনি করুন আর একটা কাজ করুন, মানবতার খাতিরে করুন, পার্বতীর ডিভোর্সটা। একজন উকিলের সঙ্গে কথা বলা দরকার, সেটাও আপনাকে করতে হবে।’

‘এতসব কাজ আমাকে কেন করতে হবে, আর কি লোক নেই?’ প্রসাদ অধৈর্য বিরক্ত গলায় বলে দাঁড়িয়ে উঠল। খদ্দেররা দাম দিতে এসেছে প্রসাদ সরে গিয়ে কাউন্টারের ড্রয়ার খুলল। মৌসুমী উঠে দাঁড়াল।

‘আপনার টেলিফোন নম্বরটা দিন পরে কথা বলব। যদি পার্বতীর সঙ্গে কথা বলতে চান তা হলে ওর নম্বরটাও দিতে পারি।’

‘দরকার নেই।’ প্রসাদ খবরের কাগজের ওপর দিকের সাদা অংশে তার মোবাইল ফোনের নম্বর লিখে ছিঁড়ে দিল। ‘রাত দশটার পর আর সকাল বারোটার আগে দরকার হলে করবেন।’

‘আমার সুবিধে দুপুরে। তখন তো দোকানেই থাকবেন।’ হাতব্যাগে কাগজের টুকরোটা রেখে ফিসফিস করে মৌসুমী বলল, ‘পার্বতী আপনাকে এখনও ভালোবাসে। আপনার চিঠিগুলো ও রেখে দিয়েছে।’ বলেই সে দরজার দিকে এগোল। দোকান থেকে বেরোবার সময় ফিরে পিছনে তাকিয়ে দেখল প্রসাদ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

বেরিয়ে এসে পার্বতীকে দেখতে পাচ্ছে না মৌসুমী। এদিক—ওদিক তাকিয়ে খুঁজল। ধরে নিল বাড়ি চলে গেছে। এতদূর তো একাই এসেছে একাই ফিরে যেতে পারবে, তা ছাড়া লুকিয়ে বেরিয়েছে, তাড়াতাড়ি ওর ফিরে যাওয়াও উচিত।

হাতিবাগান মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরেই সে দেখল ট্রাম স্টপে পার্বতী দাঁড়িয়ে। মুখ বিব্রত, থমথমে।

‘এখানে তুমি আর আমি খুঁজছি কোথায় গেলে!’

‘আমার এভাবে সিনেমা হলের সামনে হাঁটাহাঁটি করাটা ঠিক হয়নি। দুটো লোক পাশে এসে এমন অসভ্য কথা বলল আমি ভয় পেয়ে গেছলুম।’

‘কী অসভ্য কথা বলল?’ হাঁটতে হাঁটতে মৌসুমী বলল।

‘সে আমি বলতে পারব না। আমাকে খারাপ মেয়ে ভেবেছিল। যা লজ্জা করল। আমাকে দেখে কি রাস্তার মেয়ে মনে হয়?’

‘একদম নয়। লোকগুলোই খারাপ। এত দামি ঢাকাই শাড়ি রাস্তার মেয়ের পাবে কোথায়?’

‘এ শাড়িটা কেন পরেছি জানো? ও এটা দিয়েছিল আমার বিয়েতে।’

আড়চোখে ঝট করে মৌসুমী ওর মুখটা দেখে নিল। পার্বতীর চোখে আলো।

‘অনেকক্ষণ তোমরা কথা বলেছ, কী বলল?’

‘বিশেষ কিছু বলল না, শুনে গেল। বললুম পার্বতীকে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, ওর দাদাকে বলে বাপের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিন, ওর ডিভোর্সটাও যাতে হয় সেই চেষ্টাও করুন। বলল, এসব কাজ আমাকে করতে হবে কেন?’

কিছুটা হাঁটার পর পার্বতী বলল, ‘তুমি আর কিছু বলনি?’

‘আর কী বলব?’

‘ডিভোর্সের পর আর যেটা করতে হবে।’

‘না। দোকানে খদ্দের আসতে শুরু করল তখন ওসব বলার সুযোগ ছিল না। হুট করে কি সিরিয়াস কথা বলা যায়? ফোন নম্বর নিয়েছি, ফোনেই বলব।’

.

স্টেশনেই একটি ছেলে বলল, ‘স্যার যাচ্ছেন কোথায়, কলেজ তো বন্ধ।’

মৃণালকান্তি অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী! এখনও ঘেরাও চলছে?’

‘ঘেরাও তো রাত দশটায় পুলিশ এসে ভেঙে দিয়েছে। সত্যবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়াতে ওঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরই ম্যানেজিং কমিটির কেউ পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ প্রিন্সিপাল আর মন্মথবাবুকে ঘর থেকে বার করে নিয়ে আসে। আজ কলেজে এসে দেখলুম গেটে একটা নোটিশ লটকানো, অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ রাখা হল। আপনি আর গিয়ে কী করবেন, পরের ট্রেনেই বাড়ি ফিরে যান।’

বর্ধমানের ট্রেন আসছে। ছেলেটি ছুটল ট্রেন ধরতে। সত্যরঞ্জন ঘোষের বাড়ি বলদেবপুরেই। মৃণালকান্তির প্রথমেই মনে হল ওঁকে একবার দেখে আসা উচিত। তারপরই মাথায় ঘা দিল ছেলেটির কথাগুলো। অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ রাখা হল। তার মানে অফিসঘরও বন্ধ। কালোবাবুর সঙ্গে কবে দেখা হবে তার ঠিক নেই।

বলরামের দোকানের দিকে সে হাঁটতে শুরু করল। এখন এই লোকটিই তার ভরসা। ভাগ্যিস, কাল সে ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিল। এখন তো এই প্রাইভেটে ছেলে পড়ানোই তাকে বাঁচাবে। বলরাম এর মধ্যে কী ব্যবস্থা করল সেটার খোঁজ নেওয়া দরকার। করিতকর্মা লোক। বলা মাত্র হাতে পাঁচশো টাকা ধরিয়ে দিয়েছে যখন টাকাটা তুলে নেবার জন্য তখন চেষ্টা তো করবেই। কোচিংয়ের জন্য ঘর দিচ্ছে, ছাত্রও জুটিয়ে আনবে শুধু কিশোরকে গ্র্যাজুয়েট করার জন্য। হোক গ্র্যাজুয়েট।

 দোকানে এসে মৃণালকান্তি আবার অবাক হল। লাল কালিতে বড়ো অক্ষরে লেখা একটা পোস্টার দরজায় সেঁটে ঝুলিয়ে দেওয়া—’ছাত্রদের জন্য সুখবর। অঙ্ক ও ইতিহাস শিক্ষার মহা সুযোগ। মধুসূদন বিশ্বাস সেন্টিনারি কলেজের সুযোগ্য ও শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক শ্রীমৃণালকান্তি চ্যাটার্জি, এমএ (গোল্ড মেডেলিস্ট) কলেজ ছুটির পর সপ্তাহে দু—দিন একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রদের অঙ্ক ও ইতিহাস কোচিং করবেন। অনুসন্ধান করুন এই দোকানে।’

‘গোল্ড মেডেলিস্ট’ দেখে মৃণালকান্তির কান গরম হয়ে উঠল। বলরাম বলল, ‘ঘর রেডি, ব্ল্যাক বোর্ড আজই পেয়ে যাব, রংটা শুকোতে দু—দিন সময় লাগবে। চেয়ার আছে, শেতলপাটিও আছে, টেবিলের কি খুব দরকার?’

‘হলে ভালো হয়, কিন্তু এটা কী লিখেছেন, ‘গোল্ড মেডেলিস্ট’? আমি গোল্ড কেন ব্রোঞ্জেরও মেডেল পাইনি।’

বলরাম ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, ‘চুপ চুপ। গ্রামেগঞ্জে এসব ভালো খায়, ইমপ্রেসড হয়। ওই যে শুভেন্দু ডাক্তার ওর এম বি বিএস—এর পাশে যে ডিজিএফ, ডিএমএস লেখা—এই নামে কোনো ডিগ্রি আছে নাকি? দেখুন গিয়ে চেম্বার ছাপিয়ে বাইরের রাস্তায় রুগি বসে।’

‘ওর এম বিবিএস—টা তো সত্যি।’

‘আপনার এমএ—টাও তো সত্যি। আপনি কি এখন কলেজে যাবেন? যা শুনছি তাতে কলেজ খোলার জন্য আন্দোলন হবে। আর সত্য ঘোষ যদি মরে—টরে যায় তা হলে এ কলেজ কত মাস যে বন্ধ থাকবে কেউ বলতে পারবে না। যত বন্ধ থাকবে তত আপনার কোচিংয়ে ছাত্র আসবে, ওদের তো পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। আপনি ইংরেজি পড়াতে পারবেন? পারলে আপনারও রোজগার তিনগুণ বেড়ে যাবে।’

মৃণালকান্তি দ্রুত ভেবে নিল। বলরাম মন্দ পরামর্শ দেয়নি। সে বলল, ‘ভেবে দেখি। মাধ্যমিকের ইংরিজিটায় মনে হয় অসুবিধে হবে না, চালিয়ে দিতে পারব। ক্লাস ফাইভে এ বি সি ডি শেখা মাস্টারদের থেকে তো ভালো পারব। আপনাকে পরে জানাব। কিশোর কোথায়, সত্যবাবুর বাড়িটা চিনিয়ে দিত। ওকে একবার দেখে আসা উচিত।’

‘চলুন, আমি ওঁর বাড়ি চিনি, আমিও দেখে আসি। কয়েকবার ওঁর কাছে হাঁটাহাঁটি করেছি। সায়েন্সের লেকচারার। ইচ্ছে ছিল কিশোরকে ওর কাছে দিই। আসলে ওঁকে দিয়েই কোচিং খোলাব ভেবেছিলুম। আজ সকালে যা শুনলুম মনে হয় না উনি আর টিউশনির বাড়তি ধকল নিতে পারবেন।’ চলতে চলতে বলছিল বলরাম। হঠাৎ উত্তেজিত উৎসাহভরে সে বলে উঠল, ‘ভালোই হয়েছে। ওনার গোটা বারো ছাত্র আছে। সেগুলোকে আমাদের অঙ্কের কোচিংয়ে আনতে পারলে অনেক টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

সত্য ঘোষের বাড়িটি একতলা। বাড়ির বাইরের দেওয়ালের আধখানায় প্লাস্টার হয়েছে। ছাদের কংক্রিট ঢালাইয়ের লোহার শিকগুলো এক হাত বেরিয়ে। টাকা জমিয়ে জমিয়ে সত্যবাবু বাড়িটি বানাচ্ছেন। এখন সকাল—বিকেল—রাত্রি তিন শিফটে পড়াচ্ছেন। রান্নাঘরের টালির চালটা এই মাসেই পাকা করবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন।

খাটে চিত হয়ে শুয়েছিলেন। ওদের দু—জনকে দেখে কাত হয়ে বিছানায় চাপড় দিয়ে সত্য ঘোষ বললেন, ‘বসুন, বসুন। কী পাপের ভোগ দেখুন, প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে আর মন্মথবাবুকে আর তখনই ধীরাজ হুড়মুড় করে দলবল নিয়ে ঢুকে পড়ল। তোরা তো প্রিন্সিপালকে ঘেরাও করতে এসেছিস আমাদের তা হলে ছেড়ে দে। দিল না। বললুম ডায়াবিটিস, ব্লাডপ্রেশার হাই, ইসকেমিক হার্ট। কে শোনে সে কথা! প্রিন্সিপাল জল খেতে চাইলেন, দিল না। মন্মথবাবু বাথরুম যেতে চাইলেন, দিল না। আমি পাখা চালাতে চাইলুম, দিল না। উৎকট বীভৎস গুমোট একটা পরিস্থিতি আর সেই সঙ্গে কানের পাশে স্লোগান।’

মৃণালকান্তি বলল, ‘বেশি কথা বলবেন না। এখন আপনার দরকার বিশ্রাম আর ঠিকমতো ওষুধ খেয়ে যাওয়া।’

বলরাম বলল, ‘দীর্ঘ বিশ্রাম। কম করে তিন মাস। কলেজে ছুটি নিন। বাড়িতে কোচিং বন্ধ করুন।’

‘ছুটি নিলে খাব কী? আঠারো বছর আগে মাসে একশো টাকায় ঢুকেছিলুম পার্ট টাইম লেকচারার হয়ে, আজও তাই। টাকাটা একটু যা বেড়েছে। গাধার মতো টিউশনি করে গেছি দিনে আট—ন ঘণ্টা। তার ফল এখন ফলছে। এত রকমের রোগ দেহে বাসা বেঁধেছে। এই কোচিংই আমার সংসারকে বাঁচিয়ে রেখেছে আর বলছেন কিনা বিশ্রাম নিতে! কথা কম বলতে?’ রাগ ক্ষোভ হতাশা সত্যবাবুর কথাগুলো থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরে পড়ল।

‘ডাক্তার দেখিয়েছেন?’ মৃণালকান্তি নরম গলায় সহানুভূতি দেখাল।

‘শুভেন্দুবাবু এসেছিলেন। প্রেশার মেপে বললেন নার্সিং হোমে ভরতি হয়ে যান, এখানে নয় শ্রীরামপুরে। অত পয়সা কোথায় যে নার্সিং হোমের টাকা গুনব। ভাবছি সরকারি হাসপাতালে ভরতি হব।’

বলরাম আঁতকে উঠল, ‘না, না, তার থেকে বাড়িতেই থাকুন সেবাযত্নটা অন্তত পাবেন।’

ফিরে আসার সময় বলরাম বলল, ‘তিন মাস কেন, তিন বছর বিশ্রাম নিলেও আর আগের মতো পারবেন না, অবশ্যি যদি বেঁচে থাকেন। মৃণালবাবু, আমার দালানটা বেশ বড়ো একসঙ্গে জনাতিরিশ বসতে পারবে। চলুন দেখবেন চলুন, এখনও তো দেখলেন না।’

‘তাই চলুন। অনির্দিষ্টকালটা যে কত দিনের জন্য কে জানে!’

.

সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে এল মৃণালকান্তি। নিজের ঘরে চা খেতে খেতে সে মৌসুমীকে বলল, ‘কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে ম্যানেজমেন্ট কমিটি। চিন্তায় পড়ে গেছলুম, উদ্ধার করল বলরাম।’ মৌসুমীকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘যে কোচিং সেন্টারটা খুলব বলেছিলুম তার ঘর রেডি করে ফেলেছে বলরাম। লোক বটে একখানা, ওখানে সবথেকে বেশি ছাত্র পড়ায় আমাদের কলেজেরই সত্য ঘোষ, ফিজিক্সের লেকচারার, আমার মতোই পার্ট টাইমার। ভদ্রলোক কাল ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেছলেন। হার্টের রুগি চাপ সহ্য করতে পারেননি। অজ্ঞান হয়ে যান। ওঁকে দেখতে গেছলুম, সঙ্গে ছিল বলরাম। যা দেখলুম তাতে মনে হল না আবার আগের মতো কাজ করতে পারবেন। বলরামটা একটা শকুনি। নজর ভাগাড়ের দিকে, ভাগাড় মানে টাকা।’ খালি কাপটা মৌসুমীর হাতে দিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পাশবালিশটা জড়িয়ে ধরল মৃণালকান্তি। ‘ভালো কথা, ওখানে ইংরিজি মাস্টারের ভালো ডিমান্ড আছে। পড়ালে বেশ কিছু ছাত্র পাওয়া যাবে। তুমি কেমন ইংরিজি জান?র্’

‘কেন আমাকে দিয়ে পড়াবে?’

‘না, না, তুমি ওখানে যাবে কেন। তোমার কাছ থেকে স্কুলের ইংরিজির এখনকার ব্যাপারটা বুঝে নিতুম। কতকাল আগে পড়েছি, বারো—চোদ্দো বছর তো হবে।’

‘বলরামকে শকুন বলছ কিন্তু এই লোকই তোমার ত্রাণকর্তা হয়ে এখন দেখা দিয়েছে। এদের নিয়ে ঠাট্টা করো না। ওর গাইডেন্সেই চলার চেষ্টা করো। আমাদের এটাও কিন্তু টিকে থাকার লড়াই।’ কথা বলতে বলতে মৌসুমীর চোখ পড়ল মৃণালকান্তির ব্যাগটায়। ‘এ কী চুনের দাগ লাগল কী করে?’ শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘষে চুন তুলে বলল, ‘এটা সবসময় হাতে রাখবে।’

‘রাখব। তোমার পার্বতীর খবর কী?’

‘ওহ, বলতে ভুলে গেছি, আজ দুপুরে দেবদাসের দোকানে ব্লাউজপিস কিনতে গেছলুম।’

‘তুমি কিছু বললে?’

বললুম ওকে উদ্ধার করুন নইলে ও মরে যাবে, এখনও আপনাকে ভালোবাসে, এইসব। লোকটা মানে প্রসাদ বসাক দেখলুম চাঁদুকে জানে। চাঁদুর সম্পর্কে খবর রাখে। বলল, ও তো রাসকেল জানোয়ার।’

‘তাই নাকি! তা হলে উদ্ধার করতে এগোবে?’

‘কথা শুনে তো মনে হল না। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, এত কাজ আমাকে কেন করতে হবে, আর লোক নেই? পার্বতীর ফোন নম্বরটা নিল না, তার মানে কথা বলতে চায় না। তোমার কী মনে হচ্ছে?’

‘বোধহয় প্রেমট্রেম উবে গেছে। আর এটাও তো এক ঝামেলার ব্যাপার। মামলা—মোকদ্দমা, টাকা খরচ, দৌড়োদৌড়ি, কে আর পুরোনো প্রেমের জন্য এসব ঝক্কি পোয়াতে চাইবে!’

উদবিগ্ন স্বরে মৌসুমী বলল, ‘তা হলে পার্বতীর কী হবে?’

শিথিল গলায় মৃণালকান্তি বলল, ‘কী আর হবে, যেমন চলছে তেমনই চলবে। তুমি যেমন ফোনে কথা বলছ তেমনই কথা বলবে আর গলায় দড়ি দিতে দেখলে চিৎকার করে থামিয়ে দেবে। এ ছাড়া আর কী তুমি আমি করতে পারি? নিজের বাবা—মাই যদি ওর পাশে দাঁড়াতে না চায় আমরা তো পর।’

মৃণালকান্তির কথা শেষ হতে—না—হতেই দত্তবাড়ির দোতলা থেকে চাঁদুর কর্কশ চিৎকার আর বাসন ছোঁড়ার শব্দ উঠল।

‘ওই শুরু হল।’ মৌসুমী ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গেল। পার্বতীর ঘরের জানালা বন্ধ দেখে ফিরে এল।

‘দেখতে পেলে?’ মৃণালকান্তি হাতের ম্যাগাজিনটা নামিয়ে জানতে চাইল।

‘জানলা বন্ধ। কাল ফোন করব।’

পরদিন দুপুরে মৌসুমী ফোন করল।

‘কাল কী হয়েছিল? জানতে পেরেছে কি কোথায় গেছলে?’

‘না জানে না। রান্নায় নাকি নুন বেশি হয়েছে, আসলে নুন ঠিকই ছিল। মারধোর করার জন্য একটা ছুতো দরকার তো। দিদি ওর কাছ থেকে যে টেলিফোন নম্বরটা আনলে সেটা দেবে? আমি নিজে ওর সঙ্গে কথা বলব।’

প্রসাদের মোবাইল নম্বর দিয়ে মৌসুমী বলল, ‘দুপুরে কোরো তখন দোকানে থাকে।’

দিন তিনেক পর পার্বতী ফোন করল দুপুরে। মৌসুমী তখন টিভি দেখছিল শব্দ কমিয়ে। ফোনটা কাছেই ছিল, দ্বিতীয় রিং হবার আগেই তুলে নিয়ে ‘হ্যালো’ বলল।

‘পার্বতী।’

‘খবর কী?’

ওধারে চুপ।

‘আরে খবর কী, ফোন করেছিলে দেবদাসকে?’

‘হ্যাঁ’। মৌসুমী ফোঁপানির শব্দ পেল। বুঝে নিল প্রসাদ নির্ঘাত বলেছে এত লোক থাকতে আমি কেন? বা এই রকম কিছু।

‘পরে কেঁদো, এখন বলো কী বলেছে?’

‘বলেছে অল্প বয়সে যা হয়েছে ওসব কেউ মনে করে রাখে না। ওরকম একটু—আধটু সবার জীবনেই ঘটে আবার ভুলেও যায়, তুমিও ভুলে যাও। বলল আর যেন ফোন না করি ওকে। দিদি আমি বিশ্বাস করেছিলুম ও আমাকে ভালোবাসে। এখন দেখছি ভুল ভেবেছিলুম—ভুল ভুল ভুল। মানুষ কীভাবে যে বদলে যায়!’

‘তা হলে তুমিও এবার বদলে যাও। সবথেকে ভালো হয় তুমি একা হয়ে যাও।’

‘তাই যাব।’ পার্বতী ফোন রেখে দিল।

মৌসুমী বিষণ্ণ বোধ করতে লাগল। টিভি বন্ধ করে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে শুরু করল নিজের বলা ‘একা হয়ে যাও’ কথাটা নিয়ে, কথাটা আলটপকা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কিন্তু এর কোনো মানে হয়? চেষ্টা করলেই কি একা হওয়া যায়? এজন্য মনের বিশেষ একটা অবস্থা তৈরি হওয়া দরকার সেটা পার্বতী পাবে কী করে? একা তো জগৎসংসার স্বামী স্বজনদের কাছ থেকেই হয়ে যাওয়া নয়, নিজের কাছ থেকেও একা হয়ে যাওয়া, এটা হতে পারার ক্ষমতা পার্বতীর নেই। সুতরাং যন্ত্রণার মধ্যে ওকে আজীবন বাস করতে হবে। এইরকম ভাবতে ভাবতে মৌসুমী ঘুমিয়ে পড়ল, বহুদিন পরে দুপুরে।

বিকেলে ঘুমটা ভেঙে গেল বিরাট একটা হইচইয়ের আওয়াজে।

‘ও বউমা শিগগির এসো, দেখে যাও।’

ইন্দ্রাণীর উত্তেজিত ডাক শুনে মৌসুমী ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। শাশুড়ি রান্নাঘর থেকে ডাকছেন। সে দ্রুত রান্নাঘরে গেল। শাশুড়ি জানলায় দাঁড়িয়ে।

‘দেখো দেখো, বউটার কাণ্ড দেখো!’

মৌসুমী যা দেখল তা স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মতো। দোতলার দু—ধারের ঘরের মাঝের বারান্দায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের একদিকে লাল শাড়ি পরা পার্বতী, হাতে টিন, তাই থেকে কেরোসিন বা পেট্রোল ঢালছে বারান্দায় ছড়িয়ে ছড়িয়ে। আগুনের আর একদিকে দাঁড়িয়ে তার মেজো জা সঙ্গে দুটি ছোটো ছেলে। ওরা আগুনের ভয়ে চিৎকার করছে। পাশের বস্তির লোকেরা মুখ তুলে চেঁচাচ্ছে ‘দমকল ডাকুন, দমকল, নইলে সারা বাড়ি পুড়ে যাবে।’

মৌসুমী দেখল পার্বতী ঘরে ঢুকে দু—হাত ভরতি শাড়ি জামা প্যান্ট এনে আগুনে ছুড়ে দিল। আগুন আরও দাউদাউ করে উঠল। পার্বতী আবার ঘরের ভিতর গেল।

এবার টানতে টানতে যে জিনিসটা আনল তা দেখে মৌসুমী মুখে হাত চাপা দিয়ে দমবন্ধ হওয়া মানুষের মতো আর্তনাদ করে উঠল। জিনিসটা চাঁদু।

মৃত চাঁদুর দেহটা আগুনে ঠেলে দিয়ে ঘরে থেকে বিছানার চাদর বালিশ এনে চাঁদুর উপর রাখল। তিনতলা থেকে লোক নেমে এসেছে, একতলা থেকেও উঠে এসেছে। জা আর তার দুই ছেলেকে তারাই সরিয়ে নিয়ে গেল। পার্বতীর হাঁটাচলার মধ্যে মৌসুমী উন্মত্ততার কোনো চিহ্ন খুঁজে পেল না।

দমকলের ঘণ্টি শোনা গেল। উপরতলা আর নীচের তলা থেকে বালতি করে জল এনে ততক্ষণে আগুন নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। পার্বতী তখন শান্ত পায়ে রেলিংয়ের কাছে এসে দু—হাত মাথার উপর তুলল, যেভাবে পদক গলায় ঝুলিয়ে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বিজয়ীরা দু—হাত তোলে। চেঁচিয়ে কী যেন বললও। মৌসুমী শুনতে পেল শুধু একটি শব্দ—’বিধবা’ আর দেখতে পেল মেঝেয় কাত হয়ে পড়ে থাকা চাঁদুকে।

পার্বতীর কাঁধ ঝুঁকে পড়েছে। অবসন্ন শরীরটাকে ধীরে বসিয়ে দিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিল। দুই হাঁটুর মধ্যে মুখটা গুঁজে রাখল। এবার ওকে ঘিরে দাঁড়াল বাড়ির ও বাইরের কয়েকটা লোক। পার্বতীকে কিছুক্ষণ পর মৌসুমী দেখতে পেল ওরা যখন দুটি বাহু ধরে ওকে ধীরে ধীরে নীচে নিয়ে গেল।

‘বিশ্বাস করতে পারছি না বউমা, এ কী দৃশ্য দেখলুম! কল্পনাতেও এমন ঘটনার কথা ভাবতে পারব না। এই দেখো এখনও আমার হাত—পা কাঁপছে।’ ইন্দ্রাণী দুটো হাত বাড়িয়ে ধরলেন। মৌসুমী দেখল সত্যিই আঙুলগুলো থরথর করছে। তরুণকান্তি বাড়ি নেই , চন্দননগরে বন্ধুর বাড়িতে গেছেন।

‘ওকে এখন কী করবে বউমা?’

‘পুলিশ হয়তো এসে গেছে। ওই দেখুন বলতে বলতেই—’

ওরা দেখল খাঁকি আর সাদা পোশাকে চার—পাঁচজন পুলিশ বারান্দায়। দু—জন ঝুঁকে রয়েছে দাঁদুর উপর বাকিরা ঘরে ঢুকেছে। একজন ঘর থেকে বেরিয়ে এল একটা বঁটি হাতে।

‘আর দেখতে হবে না। চায়ের জল বসাও।’

চা খেতে খেতেই এসে গেল রমার মা।

‘গেছলে নাকি ও বাড়িতে?’ ইন্দ্রাণী জানতে চাইলেন।

‘যাব না!’ রমার মা ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ‘ও বাড়ির দুটো ঘরে কাজ করি, যাব না? তোমরা তো সবই রান্নাঘর থেকে দেখেছ আমি দেখেছি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। এই এত কাছের থেকে।’ হাতটা বাড়িয়ে সে চার হাত দূরের একটা জায়গা দেখাল।

মৌসুমী বলল, ‘আমরা সব দেখিনি, ঘরের মধ্যে কী হয়েছে আমরা জানি না। পুলিশকে দেখলুম একটা বঁটি হাতে বেরোল।’

রমার মা গলা নামিয়ে গোপন খবর দেওয়ার মতো করে বলল, ‘আরে ওই বঁটি দিয়ে তো বউদি দাদাবাবুর নলিটা কেটেছে। দুপুরে বাড়ি এল মদে চুরচুর হয়ে। দোতলাতে উঠতে গিয়ে সিঁড়িতে পড়ে যায়। মেজো বউদি ধরে তোলে। ঘরে এসে বিছানায় ধপাস করে পড়েই বেহুঁশ। তখনই তো গলায় বঁটিটা বসায়, কী সাহস বলো তো! তুমি আমি পারব স্বামীকে এভাবে খুন করতে! তারপরই তো রান্নাঘর থেকে কেরোসিন তেলের টিনটা আনল। কালকেই আমি টিন ভরতি তেল এনে দিয়েছি, সবটা ঢেলেছে।’

‘ওকে পুলিশ নিয়ে গেছে?’ ইন্দ্রাণী বললেন।

‘যাবে না তো কি রেখে দিয়ে যাবে? শান্তশিষ্ট লক্ষ্মীমেয়ের মতো গুটিগুটি গিয়ে জিপে উঠল। আর দাদাবাবুকে কাটাছেঁড়া করতে নিয়ে গেল।’

রাত্রে মৃণালকান্তি বউয়ের পাশে শুয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা খুব ট্র্যাজিক, মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে, তোমার হচ্ছে না?’

মৌসুমীর মনে হল প্রশ্নটার জবাব না দিলেও চলে। সে বলল, ‘ও বিধবা হতে চেয়েছিল, সফল হল। অনেকেই কিছু একটা করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেও করে ফেলে, তারা কখনো একা হতে পারে না। পার্বতী কিন্তু সত্যিই আজ একা হয়ে গেল, নিজের কাছেও।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *