১
চাঁদের আলোতে সর্পিল পাথুরে-পথ ভেঙে ওপরে উঠে চলেছে এক দীর্ঘদেহী অশ্বারোহী। সারা দেহ তার কালো মখমলের পোশাকে আচ্ছাদিত। কোমরবন্ধে ঝুলছে তরবারি, মাথায় উষ্ণীষ। তাঁর সাদা ঘোড়ার গা বেয়ে জ্যোৎস্নার আলো যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। প্রভুকে পিঠে নিয়ে ধীরে ধীরে সে ওপরে উঠছে। তার চলার ভঙ্গি জানান দিচ্ছে দীর্ঘ পথশ্রমে সে ক্লান্ত।
একটার পর একটা বাঁক অতিক্রম করে অবশেষে এক সময় সে উপস্থিত হল বিশাল দুর্গ-তোরণের সামনে। স্থানটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। দুর্গ- প্রাকার চাঁদকে আড়াল করে রেখেছে সেখানে।
অশ্বারোহী এসে ঘা দিলেন তোরণের বন্ধ কপাটে। ভিতর থেকে প্রহরীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল—’কোথা থেকে আসা হচ্ছে! পরিচয় কী?’
প্রহরীর কথায় উত্তর না দিয়ে আবার কপাটে ঘা দিলেন অশ্বারোহী। এবার বেশ জোরে, সেই শব্দে দুর্গ-তোরণের পাশের ঝাঁকড়া গাছটার মাথা থেকে ভয় পেয়ে ডানা ঝটপটিয়ে চাঁদের দিকে উড়ে গেল একটা রাতচরা পাখি। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল।
একটা অস্পষ্ট শব্দ করে তোরণের নীচের দিকের অংশ একটু ফাঁক হল এর পর, আর সেই ফোকর গলে বাইরে বেরিয়ে এল মশাল হাতে এক দ্বাররক্ষী। ভলো করে সে আগন্তুককে দেখবার জন্য মশালটা তাঁর মুখের কাছে তুলে ধরল, আর তার পরই চমকে উঠে কয়েক পা পিছু হঠে অশ্বারোহীর প্রতি সম্ভ্রমে মাথা নোয়াল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরঘর শব্দ তুলে খুলে গেল দুর্গ-তোরণ। ভিতরে প্রবেশ করলেন অশ্বারোহী। এরপর একটু থামলেন তিনি। পথের দু-পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে পদাতিক সেনার দল। অশ্বারোহীকে দেখে তারা মাথা নোয়াল। অশ্বারোহীও মাথা ঝুঁকিয়ে তাদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন, তারপর সামনে পথ ধরে চলতে শুরু করলেন। আর তার পিছন পিছন চলতে শুরু করল পদাতিক সেনার দল। পাথুরে-পথ ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলতে লাগল সেই মিছিল।
পথের দু-পাশে দুর্গ-প্রাকারের অলিন্দে পদচারণা করছে প্রহরীর দল। চাঁদের আলোতে তাদের বর্শার ফলাগুলো রুপোর মতো ঝকঝক করছে। মিছিল চোখে পড়তেই তারাও সেই অশ্বারোহীর উদ্দেশ্যে মাথা নোয়াচ্ছে ওপর থেকে।
এক সময় অশ্বারোহী এসে উপস্থিত হলেন এক প্রশস্ত চত্বরে। তার ডান দিকে ঘুমিয়ে আছে বিশাল এক প্রাসাদ। টান পড়ল লাগামে, ঘাড় ঘুরিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য একবার প্রাসাদের দিকে তাকালেন তিনি, মনে মনে কী যেন একটা চিন্তা করলেন, তারপর আবার এগিয়ে চলতে লাগলেন সোজা রাস্তা ধরে। যেদিকে চাঁদের আলোতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অস্পষ্ট এক মিনার।
কিছুক্ষণ পর অশ্বারোহী যেখানে গিয়ে থামলেন সেই জায়গাটা মশালের আলোয় আলোকিত। সারা রাত ধরে সেখানে কাজ করে চলেছে মজুরের দল। চারপাশে শুধু ছেনি-হাতুড়ির ঠক-ঠক শব্দ। পাথরের খণ্ড কুঁদে তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছে মজুর-শিল্পীরা।
আলোকিত এই চত্বরের মাঝখান থেকে আকাশের বুকে উঁচুতে আরো উঁচুতে ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এক বিশাল স্তম্ভ। যে-স্তম্ভ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষকে স্মরণ করাবে এক মহারানার বীর গাথা, স্মরণ করবে তাঁর শৌর্য-বীর্যের কাহিনি। অশ্বারোহী সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই থেমে গেল সব শব্দ, যে যেখানে কাজ করছিল সকলে হাতের যন্ত্র মাটিতে নামিয়ে রেখে, উঠে দাঁড়িয়ে মাথা ঝোঁকাল অশ্বারোহীর প্রতি, তারপর আবার তাঁর ইঙ্গিতে কাজ শুরু করল।
ঘোড়া থেকে মাটিতে নেমে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহী, তারপর খুলে ফেললেন মাথার ঝালর দেওয়া উষ্ণীষ। মশালের আলোতে স্পষ্ট হয়ে উঠল তাঁর মুখাবয়ব। তাঁর যৌবন অতিক্রান্ত হয়েছে বহুদিন। গালের দুপাশ বেয়ে নেমে আসা জুলপি আর পুরুষ্টু গোঁফে শুভ্রবর্ণের ছোপ লেগেছে। বাঁ-দিকের কপালের উপর একটা লম্বা কাটা দাগ সাক্ষ্য বহন করেছে অতীতের কোনও মহাসংগ্রামের। তাঁর টিকালো নাক, উজ্জ্বল চোখ, কঠিন চোয়াল পরিচয় দিচ্ছে এক দৃঢ় ব্যক্তিত্বের। এই রাজপুরুষ হলেন চিতোর অধিপতি মহারানা কুম্ভ, তপ্ত বালির সমুদ্র আর রুক্ষ পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা এক বিশাল রাজ্যের অধীশ্বর তিনি। এই রাজ্যের নাম—মেবার।
মহারানা কুম্ভ তাকিয়ে রইলেন সেই নির্মীয়মাণ স্তম্ভের দিকে। স্তম্ভ নির্মাণের কাজ প্রায় সমাপ্তির পথে। হাজার হাজার মজুরের কঠোর পরিশ্রমের ফলে চিতোরের আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এই স্তম্ভ। স্তম্ভগাত্রে ফলকের খোদাইয়ের কাজ চলছে এখন। তাঁর রাজ্যের শ্রেষ্ঠ ভাস্করদের মহারানা নিয়োজিত করেছেন এ কাজে।
দিন-রাত কাজের বিরাম নেই, পাথর কুঁদে ভাস্করের দল স্তম্ভগাত্রে ফুটিয়ে তুলছে বিভিন্ন দেবদেবীর আশ্চর্য সুন্দর সব ছবি। স্তম্ভের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল এক যুগ আগে। আর কয়েক মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হবে সব কাজ। মহারানা ইতিমধ্যে কুলপুরোহিতকে শুভদিন নির্বাচন করতে বলেছেন স্তম্ভ পূজার জন্য। তিনি মনে মনে ঠিক রেখেছেন—এ স্তম্ভ তিনি ওইদিন উৎসর্গ করবেন ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে।
স্তম্ভ থেকে কিছু দূরে ভগবান বিষ্ণুর মন্দির আছে। লোকে তাকে বলে কুম্ভশ্যাম মন্দির। যুবা বয়সে মহারানাই সে মন্দির নির্মাণ করান। গুর্জর ও মালবের দুই সুলতান যখন জোট বেঁধে চিতোর আক্রমণ করেন তখন কুম্ভশ্যাম মন্দিরের বিগ্রহর সামনে দাঁড়িয়ে মহারানা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন যে, যদি তিনি যুদ্ধে জয়লাভ করেন তাহলে তিনি স্তম্ভ নির্মাণ করে তা উৎসর্গ করবেন ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে। সেই যুদ্ধে অমিত পরাক্রমশালী দুই শত্রুর বিরুদ্ধে মহারানা শুধু জয়ীই হননি, মালবরাজ মোহম্মদ খিলজীকে যুদ্ধবন্দি রূপে চিতোরে এনেছিলেন ও তাঁকে নিক্ষেপ করেছিলেন চিতোর কারাগারে। ছয় মাস বন্দি থাকার পর মোহম্মদ খিলজী ক্ষমা প্রার্থনা করলে মহানুভব মহারানা মুক্তি দেন তাঁকে। দেবতার কাছে দেয়-প্রতিশ্রুতি পালন করতে ও যুদ্ধজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে মহারানা শুরু করেন স্তম্ভ নির্মাণের কাজ।
কিন্তু নির্মাণকার্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যত এগিয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা বাসনা গ্রাস করেছে মহারানাকে। সে বাসনা হল অমরত্বের। মহারানা জানেন, একদিন মহাকালের অমোঘ নিয়মে তাঁর পদচিহ্ন মুছে যাবে চিতোরের মাটি থেকে। ঠিক যেমন তাঁর পিতৃ-পিতামহদেরও চলে যেতে হয়েছে এ চিতোর গড় ছেড়ে। তাই মহারানা এ স্তম্ভের এমন রূপ দিতে চান যাতে তিনি যখন থাকবেন না সেই হাজার বছর পরেও মানুষ এ স্তম্ভের সামনে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে স্মরণ করবে মহারানাকে, স্মরণ করবে তাঁর কীর্তিকে। এই স্তম্ভই তাঁকে দেবে অমরত্ব, তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
প্রাসাদ ছেড়ে আজকাল প্রতি রাতেই প্রায় মহারানা এসে উপস্থিত হন এখানে। কিছুদিন ধরে রাতে ঘুম আসে না মহারানার। একলা কক্ষে পালঙ্কে শুলেই নানা ধরনের চিন্তা তাঁকে ঘিরে ধরে। তাই তিনি চলে আসেন এখানে। প্রহরের পর প্রহর জেগে দেখতে থাকেন, কীভাবে ভাস্করের দল প্রাণ সৃষ্টি করছে পাথরের গায়ে। তারপর এক সময় যখন আকাশের বুকে শুকতারা ফুটে ওঠে, গোমুখ কুণ্ডর দিক থেকে ভেসে আসে ঠান্ডা বাতাস, তখন প্রাসাদে ঘুমোবার জন্য ফিরে যান মহারানা। মহারানা দিন-কয়েকের জন্য দুর্গের বাইরে গেছিলেন কার্যোপলক্ষ্যে। সেখান থেকে দুর্গে প্রবেশ করেই তিনি আজ সোজা এখানে চলে এসেছেন।
ঘোড়া থেকে নেমে স্তম্ভর দিকে তাকিয়ে রইলেন মহারানা। কিছুক্ষণ আগেই শেয়ালের ডাক দ্বিতীয় প্রহরের কথা জানান দিয়েছে। সারা চিতোর এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জেগে আছে শুধু মজুর-ভাস্করদের দল, আর জেগে আছেন মহারানা।
কেল্লার মাথার ওপর আজ গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। মহারানার স্বপ্নের স্তম্ভ যেন হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাচ্ছে তাকে। অনতিদূরের কুণ্ড থেকে ভেসে আসছে ঠান্ডা বাতাস। মহারানার পথশ্রমের ক্লান্তি আস্তে আস্তে জুড়িয়ে যেতে লাগল।
স্তম্ভের দিকে চেয়ে প্রতিদিনের মতো মহারানা ভাবতে লাগলেন—’জীবন অনিত্য, একদিন আমাকেও এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে। চিতোরের সিংহাসনে বসবেন অন্য কেউ, পৃথিবী চলতে থাকবে তাঁর নিজের নিয়মে। সেদিনও আজকের মতো চিতোরগড়ের মাথার ওপর গোল চাঁদ উঠবে, গোমুখ কুণ্ড থেকে ভেসে আসবে ঠান্ডা বাতাস, রাত শেষ হলে পুবের আকাশ রাঙা করে সূর্যদেব উদয় হবেন, ময়ূরের কর্কশ ডাকে আর চিতোরেশ্বরী মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনিতে ঘুম ভাঙবে চিতোরবাসীর।—এসবই আগের মতো থাকবে, থাকব না শুধু আমি। সেদিন কি চিতোরের মানুষ মনে রাখবে আমাকে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে মুছে যায় সব কিছুই।
যাঁরা একদিন এই রুক্ষ মরু অঞ্চলে আস্তে আস্তে গড়ে তুলেছিলেন নগর-জনপদ-কেল্লা, রচনা করেছিলেন সভ্যতা, আর সেই সভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে ছিলেন শত্রুর সঙ্গে, তাঁদের ক’জনকেই বা মনে রেখেছে মানুষ? ক’জনই বা মনে রেখেছে মহারাজ খুমন, মহারাজ সমর সিংহ বা মহারানা হাম্বীরের নাম? অথচ এরাই একদিন তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন আজকের এই চিতোরগড়কে। তাঁরা আজ বিবর্ণ হয়ে যাওয়া পুঁথির পাতায় লেখা নাম মাত্র। রাজপরিবারের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে নিয়ম রক্ষার্থে উচ্চারিত হয় তাঁদের নাম। এঁদের মতো আমিও একদিন হারিয়ে যাব পৃথিবী থেকে। কিন্তু স্তম্ভের নীচে এসে দাঁড়ালে কি একবারও কারো মনে পড়বে না আমার কথা? এই স্তম্ভ দেখে ভিনদেশি কোনও পথিকের প্রশ্নের উত্তরে কি একবারের জন্যও উচ্চারিত হবে না আমার নাম? নিশ্চয়ই হবে।
‘যতদিন এই স্তম্ভ চিতোরগড়ের আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে ততদিন এই স্তম্ভই আমাকে অমর করে রাখবে, বেঁচে থাকবে মহারানা কুম্ভ, আজকের মতো সেদিনও এই স্তম্ভের দিকে তাকিয়ে আমার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধায় মাথা নত করবে ভবিষ্যতের মানুষ।’
স্তম্ভের দিকে চেয়ে এসব কথাই চিন্তা করতে লাগলেন মহারানা। প্রহর এগোতে লাগল, কিন্তু তিনি একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। ক্রমশই ছেনি-হাতুড়ির শব্দ কমে আসতে লাগল, তন্দ্রা নেমে আসতে লাগল পরিশ্রান্ত মজুরদের চোখে, নিভু নিভু হয়ে এল মশালের আলো। এক সময় দূর থেকে ভেসে আসা শিয়ালের ডাকে মহারানা বুঝতে পারলেন তিন প্রহর অতিক্রান্ত হল। আর কিছু সময় পরেই পুবের আকাশ লাল হতে শুরু করবে।
মহারানা আবার চেপে বসলেন তাঁর ঘোড়ার ওপর। প্রাসাদে ফিরে মহারানা যখন নিজের কক্ষে শয়ন করতে গেলেন তখন আকাশের শুকতারা ফুটে উঠেছে। ঠিক সেইসময় শুভ্রবসনা এক রমণী প্রাসাদ সংলগ্ন বাগিচায় প্রবেশ করলেন তাঁর পূজার ফুল সংগ্রহের জন্য।
২
মহারানার যখন নিদ্রাভঙ্গ হল তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। শ্বেত- পাথরের সূক্ষ্ম কাজ-করা জাফরির ফাঁক দিয়ে প্রবেশ-করা সূর্যকিরণে আলোকিত হয়ে উঠেছে মহারানার শয়ন কক্ষ। সোনার কাজ করা আসবাবের ওপর সেই আলো পড়ে ঝলমল করছে সারা কক্ষ।
ঘুম ভাঙার পর ধীরে ধীরে হাতির দাঁতের পালঙ্ক থেকে নীচে নামলেন মহারানা। এক ভৃত্য দাঁড়িয়ে ছিল দরজার সামনে। মহারানা পালঙ্ক থেকে নীচে নামতেই সে এসে পরিয়ে দিল ব্যাঘ্র চর্মের পাদুকা। মহারানা এসে দাঁড়ালেন অলিন্দে। সঙ্গে সঙ্গে বাজতে শুরু হল জয়ঢাক। এই ঢাক প্রত্যহ চিতোরবাসীকে জানান দেয় মহারানার নিদ্রাভঙ্গের কথা। মহারানা তাঁর দ্বিতল কক্ষ সংলগ্ন অলিন্দ থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন নীচে প্রতিদিনের মতো দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ। মহারানা নীচের দিকে তাকাতেই তাঁকে দেখতে পেয়ে তাঁর নামে জয়ধ্বনি করে উঠল তারা।
মহারানার পাশে তাঁর এক ভৃত্য এসে দাঁড়াল সোনার রেকাবিতে স্বর্ণ- মুদ্রা নিয়ে। সেখান থেকে একমুঠো মুদ্রা তুলে ছুড়ে দিলেন নীচে দাঁড়িয়ে থাকা গরিব মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে। তারা আরও একবার জয়ধ্বনি করে উঠল মহারানার নামে। এরপর মহারানা কক্ষে ফিরে এসে তৈরি হতে লাগলেন স্নানে যাবার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেহরক্ষী-পরিবৃত হয়ে প্রাসাদ থেকে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ পথে মহারানা যাত্রা করলেন সূর্যকুণ্ডের উদ্দেশ্যে। তাঁর পিছন পিছন চলতে লাগল তাঁর ভৃত্য ও সুবেশী রাজপুত রমণীর দল। তাদের হাতে সোনার থালায় মহারানার পোশাক, অলঙ্কার, সুগন্ধি ইত্যাদি।
বেশ কিছুক্ষণ সূর্যকুণ্ডের শীতল জলে অবগাহন করলেন মহারানা। তারপর উঠে দাঁড়ালেন শ্বেতপাথরের সিঁড়িতে। ভৃত্যের দল তাঁকে পরিয়ে দিল নতুন পট্টবস্ত্র। মহারানা সেখানে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ সূর্যমন্ত্র জপ করলেন। এর পর তাঁকে অলঙ্কার পরিয়ে দিতে লাগল দাসীরা, গায়ে মাখিয়ে দিতে লাগল সুগন্ধি। শুধু কর্ণকুণ্ডল দুটো নিজের হাতেই ধারণ করলেন মহারানা। কারণ তাঁর কান কেউ স্পর্শ করতে পারে না। সব শেষে রাজপুরোহিত সোনার থালার ওপর থেকে রেশমের আচ্ছাদন সরিয়ে রাজমুকুট তুলে নিয়ে মহারানার মাথায় পরিয়ে দিলেন। হাতির দাঁতের শিবিকা প্রস্তুত ছিল। মহারানা চেপে বসলেন তাতে।
মহারানা রাজপথের দু-পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে চললেন, তাঁর শিবিকা ঘিরে চলেছে তাঁর ব্যক্তিগত ভৃত্যের দল। তার মধ্যে আছে ছত্রবাহক, পাদুকাবাহক ইত্যাদিরা। আর চলেছে পঞ্চাশ জন রাজপুত দেহরক্ষী। মহারানা কেল্লার যেখানেই যান না কেন এই রক্ষীর দল ঘিরে রাখে তাঁকে। এমনিতে তারা অশ্বারোহী বাহিনীর সৈনিক। কিন্তু মহারানা যখন শিবিকা চেপে যান তখন এই রক্ষীর দল পদাতিক সৈনিক হিসাবে মহারানার সঙ্গে সঙ্গে যায়, তখন আর তারা ঘোড়া ব্যবহার করে না। এর একটা বিশেষ কারণ আছে, যেহেতু শিবিকার মধ্যে যে উচ্চতায় মহারানা বসে থাকেন তা অপেক্ষা ঘোড়ার পিঠের উচ্চতা বেশি, তাই সেখানে বসা মানে মহারানা অপেক্ষা উচ্চাসনে আসীন হওয়া। এ ব্যাপারটা তাই পরিহার করে তারা।
দুদিন কেল্লায় ছিলেন না মহারানা। চিতোর থেকে কিছু দূরে এক দুর্গম পর্বতের মাথায় এক ভয়ংকর দুর্গ নির্মাণ করিয়েছেন তিনি। সে- দুর্গের নামকরণ করা হয়েছে ‘কুম্ভমেরু’। অদ্যাবধি মহারানা কুম্ভ-নির্মিত সতেরোটি দুর্গের মধ্যে কুম্ভমেরুই সর্বশ্রেষ্ঠ।
হঠাৎই কার্যোপলক্ষ্যে মহারানা একাই চিতোর ছেড়ে রওনা হয়েছিলেন কুম্ভমেরুর উদ্দেশ্যে। গতকাল রাতেই আবার কাজ শেষ করে চিতোর ফিরেছেন। কিন্তু ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গেই মহারানার প্রত্যাগমনের সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে নগরীর সর্বত্র। তাই তাঁর যাত্রাপথের দুপাশে তাঁর দর্শন- লাভের জন্য দাঁড়িয়ে আছে নগরবাসীরা। মহারানাকে দেখে তারা হাত- জোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম জানাতে লাগল।
শিবিকা এগিয়ে চলতে লাগল। কোথাও তাঁর শিবিকার উদ্দেশ্যে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও আবার তার শিবিকা দেখে শঙ্খধ্বনি করছে রাজপুত রমণীরা। এসব দেখতে দেখতে চলতে লাগলেন মহারানা কুম্ভ।
কুম্ভশ্যাম মন্দিরের সামনে পৌঁছোতেই মহারানা নির্দেশ দিলেন—’থাম’, অমনি থেমে গেল শিবিকা। মহারানা শিবিকা থেকে নামতে পাদুকাবাহক নতজানু হল তাকে পাদুকা পরিয়ে দেবার জন্য। মহারানা তাকে ইশারায় সরে যেতে বললেন। তারপর রাজমুকুট খুলে ফেললেন মাথা থেকে। একজন ভৃত্যের হাতের সোনার থালায় সেই মুকুট রেখে মহারানা খালি পায়ে একাই প্রবেশ করলেন মন্দির-চত্বরে। শুধু তাঁর মাথার উপর বিরাট সোনার ছাতা ধরে চলল একজন ছত্রবাহক।
এ মন্দিরে বিষ্ণুর বরাহ অবতারের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন মহারানা। দরবারে যাবার আগে একবার সেই বিগ্রহ দর্শন করতে চান তিনি। মন্দির- চত্বর খুব মনোরম। চারপাশ নিস্তব্ধ। শুধু মাঝে মাঝে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে ময়ূরের ডাক। মূল মন্দিরে প্রবেশ করার আগে মহারানা থেমে যেতে বললেন ছত্রবাহককে। তারপর শ্বেতপাথরের সিঁড়ি বেয়ে একলা প্রবেশ করলেন মন্দিরের গর্ভগৃহে।
গর্ভগৃহের ভিতরটা আধো অন্ধকার। কষ্টি পাথরের বিষ্ণুমূর্তির সামনে জ্বলছে একটা ঘি-এর প্রদীপ। তারই হালকা একটা আভা ছড়িয়ে আছে চারপাশে, আর আছে ধূপের সুগন্ধ। মহারানা বিগ্রহের সামনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নতজানু হয়ে রইলেন, তারপর এক সময় ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মাথার উপর ঝুলছে বিরাট একটা সোনার ঘণ্টা। সেটা বাজাবার জন্য ডান হাতটা মাথার ওপরে তুললেন মহারানা, আর ঠিক তখনই তাঁর নজর পড়ল গর্ভগৃহর এক কোনায়।
মহারানা তাঁর হাতটা নীচের দিকে নামিয়ে নিলেন। কক্ষের সেই কোণে ধ্যানে বসে আছেন রাজমহিষী মীরা। নিরাভরণ দেহ, শুভ্র বস্ত্র, হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করা। তাঁর সামনের কুলুঙ্গিতে রাখা গিরিধারীর কষ্টিপাথরের ছোট্ট এক মূর্তি। মহারানা বুঝতে পারলেন তাঁর উপস্থিতি টের পাননি মীরা। লঘু পদে তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। প্রদীপের একটা মৃদু আভা এসে পড়েছে তাঁর দেহের ঊর্ধ্বাংশে। অনেক দিন পর কুম্ভ ভালো করে তাকালেন তাঁর স্ত্রীর মুখের দিকে। ঠিক কত দিন পর এত কাছ থেকে তিনি তাঁকে দেখছেন তা তিনি নিজেও মনে করতে পারলেন না। এক অদ্ভুত প্রশান্তি যেন ছড়িয়ে আছে মীরার মুখমণ্ডলে। এখনও তাঁর যৌবন পুরোপুরি অতিক্রান্ত হয়নি। কপালের সামনে দু-একটা কেশগুচ্ছ রুপালি বর্ণ ধারণ করেছে মাত্র। মৃদু নিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর উন্নত বক্ষ আস্তে আস্তে ওঠা-নামা করছে। �লিত বসনার বুকের ঠিক মাঝখানে টলটল করছে এক বিন্দু ঘাম।
কুম্ভ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তাঁর মহিষীর মুখের দিকে। মনে মনে তিনি ভাবতে লাগলেন—’যেখানে অন্য মহিষীরা রাজপ্রাসাদের অন্ত:পুরে ভোগ বিলাসে নিমজ্জিত, সেখানে মীরার কেন এত কৃচ্ছসাধন, কেন এত তপস্যা! কেন মীরা জাগতিক সুখ-দু:খ থেকে নিজেকে এতটা দূরে সরিয়ে নিল! সে কি আমার প্রতি অভিমানে! কিন্তু আমি তো কোনওদিন ওর প্রতি কোনও অমর্যাদা করিনি। এখনও দরবার কক্ষে রাজসিংহাসনের পাশে ফাঁকা পড়ে আছে প্রধানা মহিষীর সিংহাসন।
আজও সেই শূন্য সিংহাসনের মাথার ওপর চামর দুলায় দাসীরা। অন্য মহিষীরা বার বার অনুযোগ করছে এ ব্যাপারে। কিন্তু সে সিংহাসনে আজও অন্য কাউকে বসাতে পারিনি আমি। একটা কাজ অবশ্য করে ছিলাম আমি। তার গুরু রুইদাস চামরকে নিষেধ করেছিলাম অন্ত:পুরে প্রবেশ করতে। সে তো বংশপরম্পরায় চলে আসা নিয়মরক্ষার জন্য। তাই কি মীরা এতটা ক্ষুব্ধ হল আমার প্রতি? না কি অন্য কোনও কারণ আছে তার নিস্পৃহতার পিছনে? আমার প্রতি কেন এত শীতল মীরার দেহ-মন? আমি কি ওকে ঠিক বুঝতে পারলাম না, না কি মীরা বুঝতে পারল না মহারানার হৃদয়ের কথা! যে মীরা দশ-দশটা বছর বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছে আমার বাহুবন্ধনে, সে কেন আজ এসে দাঁড়ায় না আমার পালঙ্কের পাশে? তা হলে কি এই দেহ-মন সব মিথ্যে! সব সত্যি কি ওই কষ্টিপাথরের বোবা গিরিধারীর মূর্তি?’
মীরার মুখের দিকে চেয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিলেন কুম্ভ। হঠাৎ মীরা চোখ মেলে তাকালেন মহারানার দিকে। চিন্তাজাল তৎক্ষণাৎ ছিন্ন হল মহারানার। কয়েক মুহূর্ত মাত্র দৃষ্টি বিনিময় হল উভয়ের মধ্যে। মীরা উঠে দাঁড়াতে গেলেন স্বামীর চরণ স্পর্শ করার জন্য। কিন্তু মহারানা তার আগেই কয়েক পা পিছিয়ে এসে মাথার উপরের ঘণ্টাটা জোরে জোরে দুবার বাজালেন, তারপর মীরার দিকে দৃষ্টিপাত না করেই দ্রুত পদে ত্যাগ করলেন মন্দিরের গর্ভগৃহ।
মীরা যখন ধীর পায়ে গর্ভগৃহের দ্বারে এসে দাঁড়ালেন ততক্ষণে মহারানা চেপে বসেছেন তাঁর শিবিকাতে। বাহকের দল মহারানাকে নিয়ে রওনা হয়েছে দরবারকক্ষের অভিমুখে, দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে তাদের পদশব্দ।
বাইরের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মীরা। শূন্য মন্দির-চত্বরে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। মীরা আবার ফিরে গিয়ে দাঁড়ালেন গর্ভগৃহর সেই স্থানে, যেখানে একটু আগে দাঁড়িয়েছিলেন চিতোররাজ কুম্ভ। স্বামীর চরণচিহ্ন মাথায় ঠেকিয়ে প্রথমে প্রণাম জানালেন রাজমহিষী, তারপর আবার গিয়ে বসলেন সেই গিরিধারী মূর্তির সামনে। আস্তে আস্তে তাঁর চোখের পাতা বুজে এল।
কিছুক্ষণ পর দরবারকক্ষের ছাদ থেকে সারা চিতোরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ল বাদ্যযন্ত্রের শব্দ। দরবার শুরু হতে চলেছে। সে শব্দ আর কানে গেল না মীরার। তিনি তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়েছেন। তাঁর কানে তখন একটাই সুর, তা হল গিরিধারীর মনমোহিনী বাঁশির সুর, যা বিশ্ব চরাচর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে মীরার মনকে। তাঁর চোখের সামনে থেকে মুছে দিয়েছে পার্থিব সবকিছু।
৩
অনেক বছর পর আবার আজ এই মরুরাজ্যে বৃষ্টি নামতে চলেছে। ক’দিন ধরেই আকাশে আস্তে আস্তে জমতে শুরু করেছে জল-ভরা কালো মেঘ। তাই দেখে পেখম মেলেছে ময়ূরের দল। পায়ে তাদের সোনার ঘুঙুর বাঁধা। সেই শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে প্রাসাদ। সবার মনে খুশির বাতাস। অমন যে দুর্ধর্ষ রাঠোর সেনাবাহিনী, যাদের যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না, তাদেরও আজ গ্রামে ফিরে যাবার জন্য মন কেমন করছে। তাদের সর্দার রাঠোররাজের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন সৈন্যদের কয়েক দিনের ছুটি মঞ্জুরের আর্জি জানাতে। তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেছেন রাঠোর অধিপতি। যাদের এতদিন শুধু দেখা যেত নগরের কামারশালার আশেপাশে নতুন তরবারির খোঁজে অথবা বর্ম তৈরির জন্য, তারাই আজ নগদ মোহরের বিনিময়ে খরিদ করছে অলঙ্কার, রেশম বস্ত্র থেকে শুরু করে কাঠের খেলনা পর্যন্ত। তারপর তা বেঁধে-ছেদে চেপে বসছে ঘোড়ার ওপর। ঘোড়া ছুটিয়ে দিচ্ছে মরুরাজ্যে অবস্থিত নিজেদের ছোট ছোট গ্রামের দিকে। আকাশে মেঘ দেখে সেখানে তাদের প্রতীক্ষা করছে আপনজনেরা।
দ্বিপ্রহরে রাঠোররাজ চন্দ্রকান্ত মান্ডোর প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জল ভরা মেঘের খেলা দেখতে দেখতে ভাবছিলেন একজনার কথা। তিনি ঝুলকুমারী, রাঠোররাজের বাগদত্তা। রাঠোররাজ ভাবছিলেন, ঝালোয়ার প্রাসাদে কোনও নিভৃত কক্ষে বসে হয়তো তাঁরই কথা চিন্তা করছেন ঝুলকুমারী। ওই যে অনেক দূরে কালো রেখার মত পাহাড় দেখা যাচ্ছে তার ওপাশেই ঝালোয়ার রাজ্য। সেখানেও নিশ্চয়ই বৃষ্টি নামবে। মেঘের দল তো ভিড় করে আছে ওখানেও। মেঘের দিকে চেয়ে রাজকন্যা ঝুলকুমারীর কথা চিন্তা করতে করতে রাঠোররাজের মনে পড়ে গেল ‘মেঘদূতম’-এর সেই শ্লোক—
‘তম্পিন্নদ্রৌ কতিচিদবলবিপ্রযুক্ত স কামী
নীত্বা মাসান কনকবলয়ভ্রংশরিক্ত প্রকোষ্ঠ:
আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষনীয়ং দর্দশ:
রাঠোররাজ মনে মনে আবৃত্তি করে যেতে লাগলেন—
‘তস্য স্থিতা কথমপি পুর:—
কৌতুকধানহেতো
রন্তর্বাষ্পশ্চিরসনুচরো রাজরাজস্য দধৌ।…
মরুভূমির প্রখর সূর্য ফিকে হতে হতে এক সময় মুছে গেল আকাশের বুক থেকে। অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক। তারপর অন্ধকার আকাশ জুড়ে শুরু হল বিদ্যুতের নাচন, আর তার সঙ্গে মেঘের গুরু গুরু গর্জন। এ দৃশ্য মরুদেশে বড় দুর্লভ। তন্ময় হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন রাঠোররাজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল রুক্ষ মরুদেশের বুকে। প্রাসাদের ছাদে একলা দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলেন রাঠোররাজ। তিনি শুনতে পেলেন প্রাসাদের নীচ থেকে ভেসে আসছে কোলাহল। প্রাসাদের সমস্ত নরনারী আনন্দবিহ্বল হয়ে প্রাসাদ ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছে খোলা আকাশের নীচে। বৃষ্টির জলে সিক্ত করে নিচ্ছে নিজেদের দেহ-মনকে। এক সময় খুব জোরে বৃষ্টি পড়তে লাগল। রাঠোররাজ আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না সেই প্রবল বর্ষণের মধ্যে। ছাদ থেকে নীচে নেমে প্রবেশ করলেন নিজের কক্ষে। তারপর বাতায়নের সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনতে শুনতে আবার ভাবতে লাগলেন ঝুলকুমারীর কথা।
ঝালোয়ার রাজকন্যার সঙ্গে রাঠোররাজের বিবাহের প্রস্তুতি প্রায় সারা হয়ে গেছে। দিনক্ষণও একদম ঠিক। আর কয়েক পক্ষকাল পরেই ঝুলকুমারী এই মান্ডোর প্রাসাদে রানির বেশে পা রাখবেন। সেই শুভ দিনের প্রতীক্ষায় এখন দিন গুনছেন প্রাসাদের সকলে। সিংহল দ্বীপ থেকে আজই প্রাসাদে পৌঁছেছে একহাজার মঙ্গলশঙ্খ।
রানি যখন পদার্পণ করবেন এ প্রাসাদে, সেই শুভক্ষণে কুলনারীর দল ওই মঙ্গলশঙ্খে ফুঁ দিয়ে স্বাগত জানাবেন তাঁকে। মান্ডোররাজ তাঁর ভাবী রানির জন্য প্রাসাদ সংলগ্ন বাগিচাতে শ্বেতপাথরের এক মহল নির্মাণ করিয়েছেন। সেই বাগিচাতে রোপণ করা হয়েছে পারস্য থেকে সংগ্রহ করে আনা গোলাপ। বাগানে খেলে বেড়ায় আরাবল্লীর গহীন অরণ্য থেকে নিয়ে আসা হরিণশিশু, নেচে বেড়ায় সাদা ময়ূরের দল। মহল সংলগ্ন ছোট্ট পুষ্করিণীতে ঘুরে বেড়ায় রঙিন মাছের ঝাঁক। ক্লান্ত দিবাবসানে ওই বাগানেই রাঠোররাজ নিভৃতে প্রেমালাপে মত্ত হবেন ঝালোয়ার দুহিতার সঙ্গে।
আকাশে একসময় রুপার থালার মতো চাঁদ উঠবে, পারসীয় গোলাপের সৌরভ ছড়িয়ে পড়বে চারপাশে, তখন বাগানে শ্বেতপাথরের বেদির ওপর ঝুলকুমারীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে রাঠোররাজ শুনবেন তাঁর সুমধুর সঙ্গীত। তারপর কথা ও কাহিনিতে রাত যখন গভীর হবে তখন রাজপ্রাসাদের নরম বিছানায় রানিকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকবেন রাঠোররাজ।
আর তো মাত্র ক’টা দিন। কিন্তু তা-ও যেন কাটতে চাচ্ছে না রাঠোর অধিপতির। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রাঠোররাজের মনে হচ্ছিল এই অন্ধকারময় বৃষ্টির দিনে যদি ঘোড়া ছোটানো যেত তাহলে বড় ভালো হত। এরকম গোপন অভিসারে তিনি যে ইতিপূর্বে যাননি তা নয়, কিন্তু এখন সমস্যা হল, বিবাহের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেছে। রাঠোররাজ ঝালোয়ার প্রাসাদে অভিসারে গিয়ে যদি রাজকুমারীর কোনও সহচরীর হাতে ধরা পড়ে যান তবে লজ্জার আর শেষ থাকবে না। তাই এ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে রাঠোররাজকে। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন, আর তার পরেই তো…এই ভেবে নিজের মনকে প্রবোধ দিতে লাগলেন রাঠোর অধিপতি।
দুপুর বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল, বৃষ্টির বিরাম নেই। বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে ঝুলকুমারীর কথা চিন্তা করছিলেন রাঠোররাজ। হঠাৎ আকাশ বিদীর্ণ করে বিদ্যুৎ চমকাল। সেই আলোতে ক্ষণিকের জন্য অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হল রাঠোররাজের। চোখে পড়ল দূরের পাহাড়শ্রেণির মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক দুর্গ-প্রাকারের অস্পষ্ট ছবি। তারপর আবার তা হারিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে। খুব কাছেই কোথায় যেন বাজ পড়ল, থর থর করে কেঁপে উঠল সারা প্রাসাদ।
তড়িৎশিখার আলোতে ওই দুর্গ-প্রাকার চোখের সামনে ভেসে উঠতেই রাঠোররাজের মনে পড়ে গেল আরও এক জনের কথা,—তিনি ওই কুম্ভমেরু দুর্গের মালিক, এই মরু রাজ্যের অধীশ্বর মহারানা কুম্ভ। তাঁর কথা মনে আসতেই রাঠোররাজ ভাবলেন—এই বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় মহারানা এখন কী করছেন? হয়তো তিনি নিজের কক্ষে বসে বীণা বাজাচ্ছেন মগ্ন হয়ে।
বহুদিন আগে এইরকম এক বৃষ্টির রাতে রাঠোররাজকে সারা রাত ধরে তাঁর বীণা বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন মহারানা। সে কী অপূর্ব সুরের মূর্চ্ছনা! চোখ বন্ধ করলেই এখনও তা কানে বাজে রাঠোররাজের। তাই মহারানার কথা মনে পড়তেই রাঠোররাজের এ কথা মনে হল।
কুম্ভ চিতোরের মহারানা, আর চন্দ্রকান্ত ছোট্ট এক মরু অঞ্চলের শাসনকর্তা। বলতে গেলে নামেই তিনি রাজা। আসলে তিনি কুম্ভর অধীনস্থ এক সামান্য ভূস্বামী মাত্র, প্রজা বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু তাদের দুজনের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। রাঠোররাজের চেয়ে মহারানা বয়সে, ধনে, মানে, বিদ্যায় অনেক বড়। তবু কেন যেন এসবের ঊর্ধ্বে দুজনের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। আশেপাশের অনেক ভূস্বামী এ জন্য মনে মনে ঈর্ষাও করেন রাঠোররাজকে। কেউ কেউ আবার উপযাচক হয়ে গোপনে সাবধানও করেছেন রাঠোররাজকে, মহারানাদের মতিগতি বোঝা বড় দায়। কখন যে তাঁরা কার ওপর কূপিত হন বোঝা মুশকিল। তাই তাঁকে এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। রাঠোররাজ অবশ্য এসব কথায় কান দেননি কোনওদিন। মহারানার ওপর তাঁর অগাধ ভক্তি শ্রদ্ধা। কুম্ভও যথেষ্টই স্নেহ করেন চন্দ্রকান্তকে। এমনকী নিভৃতে যখন দুজনের মধ্যে আলোচনা হয় সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন বা অন্য কোনও বিষয়কে কেন্দ্র করে, তখন তাঁকে রাঠোররাজ মহারানা বলে সম্বোধন করলে অসন্তুষ্ট হন তিনি। তার চেয়ে রাঠোররাজের মুখ থেকে কুম্ভজি কথাটা শুনতেই বেশি ভালোবাসেন মহারানা। তাই একান্তে ওই নামেই তাঁকে সম্বোধন করেন চন্দ্রকান্ত।
রাঠোররাজের কুম্ভর প্রতি শ্রদ্ধার বিশেষ কারণ আছে। কুম্ভ শুধু এই দিগন্ত বিস্তৃত বালির সমুদ্রের অধীশ্বরই নন, তাঁর পাণ্ডিত্যও অগাধ। বহু গুণের অধিকারী মহারানা। শিল্পকলা ও সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ তাঁর। ‘গীতগোবিন্দ’-র এক আশ্চর্য পরিশিষ্ট রচনা করেছেন মহারানা, যা শুনলে মোহিত হয়ে যেতে হয়। একদিন তাঁর মুখ থেকে তা শুনেছেন রাঠোররাজ। রাঠোররাজের ইচ্ছা আছে কুম্ভজিকে তিনি অনুরোধ জানাবেন, যেন তিনি ঝুলকুমারীকে শোনান তাঁর এই অমৃত রচনা।
সাধারণত চিতোর প্রাসাদেই চন্দ্রকান্তকে ডেকে পাঠান কুম্ভজি। তারপর প্রহরের পর প্রহর দুজনের মধ্যে চলে নানা আলোচনা। যা অধিকাংশই শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ক। কুম্ভজিও যে মান্ডোর প্রাসাদে একেবারে আসেন না তা নয়। আসার আগে প্রতিবারই দূত মারফত তাঁর আগমনের খবর জানিয়ে দেন যাতে চন্দ্রকান্ত সেসময় কোনও কাজে ব্যস্ত না থাকেন। কিন্তু কিছুদিন আগে এক বিকালে চন্দ্রকান্তকে একেবারে অবাক করে দিয়ে একলা মহারানা এসে উপস্থিত হয়েছিলেন মান্ডোর প্রাসাদে। তড়িৎশিখায় চকিতের জন্য যে দুর্গ প্রাকার চন্দ্রকান্তর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল, সেই কুম্ভমেরু দুর্গ নির্মাণের তদারকির কাজে এদিকে এসেছিলেন কুম্ভজি। তারপর মনের খেয়ালে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন মান্ডোর প্রাসাদে। কিন্তু সেদিন যেন রাঠোররাজের কেমন বিষণ্ণ বলে মনে হয়েছিল কুম্ভজীকে। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। রাঠোররাজ একবার ভেবেছিলেন এর কারণ জিগ্যেস করবেন কুম্ভজিকে। কিন্তু সংকোচের কারণে শেষ পর্যন্ত তা আর জিগ্যেস করা হয়ে ওঠেনি চন্দ্রকান্তর।
কুম্ভজির কথা ভাবতে ভাবতে রাঠোররাজের মনে পড়ে গেল সে দিনের একটি কথা—। কথা বলতে বলতে সেদিন কুম্ভজি হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিলেন—’আচ্ছা পাষাণমূর্তি আর রক্তমাংসের মানুষের পার্থক্য কী?’
‘রক্তমাংসের মানুষের অনুভূতি আছে, সে নিজের ও অন্যের দেহ-মনের ক্ষুধা জাগিয়ে তুলতে পারে কিন্তু পাষাণমূর্তি তা পারে না। কারণ তার কোনও অনুভূতি নেই, জৈবিক তাড়না নেই।’—উত্তর দিয়েছিলেন চন্দ্রকান্ত।
রাঠোররাজের উত্তর শুনে কুম্ভজি বলেছিলেন—’আমিও তো তাই জানি, কিন্তু-।’ কথাটা আর শেষ করেননি কুম্ভজি। হঠাৎই থেমে গেছিলেন তিনি। আর তারপরই এ প্রসঙ্গ ছেড়ে চলে গেছিলেন অন্য প্রসঙ্গে।
সে দিন এই আপাত সরল অথচ অদ্ভূত প্রশ্নটা তাকে কেন করলেন কুম্ভজি। ওই প্রশ্নের মধ্যে কি অন্য কোনও তাৎপর্য লুকিয়ে ছিল, যা তাকে বুঝতে দিতে চাননি কুম্ভজি? নইলে কেনই বা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন তিনি? কেনই বা সেদিন তাঁকে বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল? অন্ধকারের মধ্যে একা একা এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলেন রাঠোররাজ চন্দ্রকান্ত।
খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় যখন শুতে গেলেন চন্দ্রকান্ত, বৃষ্টি তখন একটু ধরে এসেছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে বাঁকানো চাঁদের হাসি। নরম পালঙ্কে শুয়ে ঝুলকুমারীর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন চন্দ্রকান্ত।
৪
বৃষ্টি নেমেছে চিতোরগড়েও। আর তার সঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে মহারানার মনে। কেল্লার একেবারে শেষ প্রান্তে এক স্বচ্ছ জলাশয়ের মাঝখানে অবস্থান করছে ছোট্ট এক প্রাসাদ। নাম, জলমহল। জলমহল থেকে ধাপে ধাপে শ্বেতপাথরের সোপানশ্রেণি নেমে গেছে জলাশয়ের মধ্যে। এই স্থান বড় প্রিয় মহারানার। দুর্গ নগরীর কোলাহল এ পর্যন্ত এসে পৌঁছোয় না। মাঝে মাঝে শুধু দূর থেকে ভেসে আসে চিতোরেশ্বরী মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আর জলাশয়ের পদ্মবনে উড়ে বেড়ায় ভ্রমরের গুঞ্জন।
বেলা দ্বিপ্রহরে মহারানা একা জলমহলে বসে এক দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন জলাশয়ের দিকে। দুদিন ধরে সূর্যদেব মুখ লুকিয়েছেন মেঘের আড়ালে। বৃষ্টির যেন আর বিরাম নেই। বরুণদেব অকৃপণ হাতে জল সিঞ্চন করে চলেছেন তৃষ্ণার্ত মরুভূমির বুকে। আকাশ থেকে নেমে আসা বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা জলের ওপর পড়ে প্রতি মুহূর্তে রচনা করছিল নানা আলপনা।
মহারানা দেখছিলেন জলতরঙ্গের সেই ভাঙা-গড়ার খেলা। এ প্রাসাদকে লোকে বলে ‘পদ্মিনী মহল’। মহারানার পূর্বপুরুষ ভীমসিংহ এ প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তাঁর প্রিয়তমা, মহারানি পদ্মিনীর জন্য। এ প্রাসাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চিতোরের ইতিহাসের এক করুণ কাহিনিও। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে চিতোরের বুকে নেমে এসেছিল ধ্বংস লীলা, তার সূচনা এই জলমহল থেকেই হয়েছিল বলা যেতে পারে। সেসব মহারানা কুম্ভর জন্মের প্রায় দুশো বছর আগের ব্যাপার। কিন্তু সেদিনের সেই ইতিহাসের কথা স্মরণ করলে আজও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে মহারানার হৃদয়। বিশেষত, জলমহলের এই নির্জনতায় এসে বসলে তার বার বার মনে হয় হতভাগ্য রানি পদ্মিনীর আখ্যান—সিংহল রাজহামীরশঙ্কের অসামান্য রূপসি কন্যা পদ্মিনীকে রাজপরিবারের বধূ করে এনেছিলেন চিতোররাজ লক্ষ্মণ সিংহের কাকা ভীম সিংহ। কীভাবে যেন পদ্মিনীর রূপের কথা পৌঁছেছিল দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিনের কানে। তাঁকে পাবার লোভে আলাউদ্দীন অবরোধ করে বসলেন চিতোরগড়। অবশেষে চিতোররাজ লক্ষ্মণ সিংহের সঙ্গে সুলতানের চুক্তি হল—কেল্লায় প্রবেশ করে একবার মাত্র সুলতান দূর থেকে প্রত্যক্ষ করবেন রানির অপার সৌন্দর্য। আর তারপর দিনই তিনি ফিরে যাবেন দিল্লির পথে।
সুলতানের কথায় বিশ্বাস করে লক্ষ্মণ সিংহ তাকে কেল্লায় প্রবেশের অনুমতি দিলেন। সুলতানকে এনে রাখা হল জলমহলের বিপরীতে জলাশয়ের ধারে দূর্গপ্রাকার সংলগ্ন এক কক্ষে। সেই কক্ষে বিশাল এক দর্পণ এমনভাবে বসানো ছিল যে জলমহলের সোপানশ্রেণির শেষ ধাপে কেউ নেমে দাঁড়ালে স্বচ্ছ জলে তার যে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হবে তা ধরা দেবে কক্ষের দর্পণে।
সকাল থেকে দর্পণের দিকে চেয়ে বসেছিলেন সুলতান। তারপর দিনের শেষে এই জলমহলের শ্বেতপাথরের সোপানশ্রেণি বেয়ে ক্ষণিকের জন্য নীচে নেমে দাঁড়িয়েছিলেন সেই রূপসি নারী। মুহূর্তের জন্য খুলে ফেলেছিলেন তার অবগুণ্ঠন। অস্তাচলগামী সূর্যের লাল আভা এসে পড়েছিল তার মুখে। দর্পণের মাধ্যমে সুলতান প্রত্যক্ষ করেছিলেন যুবতী রানির অপার সৌন্দর্য। মাত্র এক মুহূর্তের জন্যই। তার পরক্ষণেই রানি অদৃশ্য হয়েছিলেন জলমহলের ভিতর। হয়তো মহারানা আজ যেখানে বসে আছেন সেখানে দাঁড়িয়েই রানি ক্রোধে-ঘৃণায়-অপমানে অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন সেদিন। সূর্যদেবও রানির অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে মুখ লুকিয়ে ছিলেন দূরের ওই পর্বতমালার আড়ালে। চারিদিকে নেমে এসেছিল ঘোর অন্ধকার। অন্ধকার নেমে এসেছিল চিতোরের ভাগ্যাকাশে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে পদ্মিনীর জীবনেও। জলমহলের সোপানশ্রেণিতে পদ্মিনীকে দেখার পর তাঁকে পাবার ইচ্ছা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল আলাউদ্দীনের।
মহারানা কুম্ভ গল্প শুনেছেন যে, দর্পণে পদ্মিনীর প্রতিবিম্বকে সত্যি মনে করে তাকে আলিঙ্গন করার জন্য নাকি দর্পণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কামুক সুলতান। ভেঙে খান খান হয়ে গেছিল সেই দর্পণ। আলাউদ্দীন কিন্তু তাঁর কথা রাখেননি। কয়েক মাসের মধ্যেই সুলতানের নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী আছড়ে পড়ে চিতোরে। তাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে ভীম সিংহ, লক্ষ্মণ সিংহের সাত পুত্রসহ চিতোরের বহু নামি-অনামি যোদ্ধা শহীদ হন যুদ্ধক্ষেত্রে। তবু প্রাণ থাকতে চিতোরের মানুষ রানি পদ্মিনীকে তুলে দেননি আলাউদ্দিনের হাতে। শেষ পর্যন্ত দুর্গের পতন যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে তখন অসহায় রানি মহারানা কুম্ভর প্রাসাদের নীচে এক ভূগর্ভস্থ কক্ষে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করলেন।
যে নারীদেহর জন্য সুলতানের মনে এত লালসা, সেই নারীদেহ মুহূর্তের মধ্যে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল চিতার আগুনে। যুদ্ধ শেষে রক্তে পিচ্ছিল পথ বেয়ে নগরীতে প্রবেশ করলেন বিজয়ী সুলতান। কিন্তু পদ্মিনীকে পাওয়া হল না তাঁর। চিতোর নগরীর যা কিছু সুন্দর ছিল সুলতানের ক্রোধের আগুনে ধ্বংস হল সব কিছু। শুধু তিনি ধ্বংস করলেন না এই জলমহল। যে জলমহলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে অস্তাচলগামী সূর্যের আলোতে একদা সুলতানকে দর্শন দিয়েছিলেন রূপসি রানি পদ্মিনী। কিন্তু কেন জলমহলের ধ্বংস করলেন না সুলতান? তাহলে সত্যিই কি পদ্মিনীর কথা ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রতি প্রেমের সঞ্চার হয়ে গিয়েছিল কামুক সুলতানের মনে? অসহায় রানির শেষ পরিণতি কি সিক্ত করেছিল দুর্ধর্ষ সুলতানের মন? জলমহলের বিষণ্ণতায় এ প্রশ্নগুলো বারবার ফিরে আসে মহারানা কুম্ভর মনে।
বৃষ্টিস্নাত জলমহলে একলা বসে আজ আরও এক জনের কথা খুব বেশি মনে পড়ছিল কুম্ভর। মনে পড়ছিল মীরার কথা। মনে পড়ছিল যৌবনের সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। সেসময় গ্রীষ্মকালটা এ প্রাসাদেই কাটাতেন মীরা। কুম্ভ কেল্লায় থাকলে রাজকার্য সমাপ্ত হলে দ্বিপ্রহরে চলে আসতেন জলমহলে। এখানে তাঁর প্রতীক্ষায় বসে থাকতেন মীরা। যদি কোনওদিন বিশেষ কারণে তাঁর জলমহলে আসা না-হত তাহলে পরদিন কত অনুযোগ শুনতে হত রানির কাছ থেকে। মুখ ভার হয়ে থাকত রাজমহিষীর, প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতেন মহারানা। তারপর এক সময় মান ভাঙত মহারানির। ওই শ্বেতপাথরের সোপানশ্রেণি বেয়ে দুজনে গিয়ে বসতেন জলাশয়ের ধারে। মহারানার বাহুবন্ধনে প্রেমালাপে মেতে উঠতেন রানি। মাঝে মাঝে রানি যখন খিল খিল করে হেসে উঠতেন তখন জলমহলের অলিন্দে বসে থাকা পায়রার দল ডানা মেলে উড়ে যেত আকাশের দিকে। তাই দেখে মহারানার মনে হতো মীরার হাসি যেন ছড়িয়ে পড়ছে দূরের ওই নীল আকাশের বুকে।
এক-একদিন গল্প করতে করতে সূর্য ঢলে যেত পশ্চিমে। আকাশে গোল চাঁদ উঠত, সেই চাঁদের প্রতিবিম্ব আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠত জলাশয়ের বুকে। জ্যোৎস্না চুঁইয়ে পড়ত ছোট্ট জলমহলের শ্বেতপাথরের স্তম্ভ থেকে। তখন কুম্ভর কোলে মাথা রেখে শুয়ে মীরা শুনত তাঁর বীণার ঝঙ্কার। রাত যত বাড়ত আস্তে আস্তে তাদের দুজনের মন থেকে মুছে যেত পৃথিবীর অন্য সব কিছুর অস্তিত্ব। জেগে থাকত শুধু দুটি মন আর দেহ। তারপর শেষ রাতে অনেক কষ্টে মীরার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে প্রাসাদে শুতে যেতেন মহারানা।
সেবার একবার এ রকমই বহু দিন পর বৃষ্টি নেমেছিল চিতোর গড়ের বুকে। মহারানা এমনই এক দ্বিপ্রহরে মীরাকে নিয়ে চলে এসেছিলেন এই জলমহলে। মহারানার হঠাৎ কী খেয়াল হয়েছিল—তিনি বৃষ্টিতে ভিজবেন। জলমহলের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে তিনি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শেষ ধাপে। অঝোর ঝরে বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন। তার সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলক ফালা ফালা করে দিচ্ছিল আকাশকে। বাজের গুরুগম্ভীর গর্জনে কেঁপে উঠছিল চারিদিক। বাজের শব্দকে খুব ভয় করত মীরা। স্বামীকে জলমহলের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে দেখে অগত্যা বৃষ্টির মধ্যে তাঁর পিছু পিছু নীচে এসে দাঁড়িয়েছিল রানি।
ঠিক সেই মুহূর্তেই কাছেই কোথাও প্রচণ্ড শব্দ করে একটা বাজ পড়েছিল। ভয় পেয়ে রানি জড়িয়ে ধরেছিল মহারানাকে। মহারানাকে জড়িয়ে ধরে থর থর করে কাঁপছিল রানি। বৃষ্টির ধারা তার চিবুক ছুঁয়ে তার বক্ষের বিভাজিকা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল আরও নীচের দিকে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে মহারানার ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছিল এক আদিম উষ্ণতার স্রোত। বেশিক্ষণ আর বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি মহারানা। সিক্ত অবস্থাতেই রানিকে নিয়ে শুতে গেছিলেন জলমহলের সুখশয্যায়। বিকাল গড়িয়ে কখন সন্ধ্যা নেমেছিল কিছুই খেয়াল ছিল না দুজনার। সন্ধ্যাবেলায় যখন মেঘের আড়াল থেকে চাঁদের ফালি উঁকি দিল তখন বিছানায় উঠে বসেছিলেন মহারানা।
আজ এতদিন পরে আবার জলমহলের বিষণ্ণতায় বসে মহারানার মনে পড়ে গেল ওই দিনটার কথা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা প্রশ্নের উদয় হল মহারানার মনে। আজ যদি তাকে এখানে ডেকে পাঠান তবে সে কি আসবে এখানে? ‘হ্যাঁ সে আসবে, সে আসবে মহারানা কুম্ভর ডাকে, স্বামী কুম্ভর ডাকে নয়।’—মনে মনে নিজেই নিজের প্রশ্নরই উত্তর দিলেন কুম্ভ। আর যদি সে মহারানার ডাকে আসেই বা, সে কি বয়ে আনতে পারবে সেদিনের সেই উত্তাপ, যা কুম্ভর শিরায় শিরায় জাগিয়ে তুলবে কামনার আগুন? সে কি সঙ্গে করে আনতে পারবে এমন কিছু, যা কুম্ভর শুষ্ক হৃদয়কে আবার সিক্ত করে তুলবে? মীরার সব কিছু তো আজ ওই কষ্টিপাথরের মূর্তির কাছে উৎসর্গীকৃত। ওই পাষাণমূর্তি ছাড়া সব কিছু জাগতিক বিষয় আজ মূল্যহীন তার কাছে।
পাষাণমূর্তি গ্রাস করে নিয়েছে মীরার সব কিছু, এমনকী দূরে সরিয়ে দিয়েছে স্বামী কুম্ভকেও। কুম্ভ কোনওদিন তো মহারানা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চাননি মীরার কাছে, থাকতে চেয়েছেন শুধু কুম্ভ হয়ে, রক্তমাংসের মানুষ হয়ে, আজীবন মীরার ভালোবাসার সঙ্গী হয়ে। নইলে কবেই তো তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারতেন কষ্টিপাথরের ওই গিরিধারির মূর্তি, গর্দান নেবার আদেশ দিতে পারতেন মীরার গুরু রুইদাসের অথবা নিদেন পক্ষে মীরার জন্য বন্ধ করে দিতে পারতেন কুম্ভশ্যাম মন্দিরের দরজা। এসব কিছুই তিনি করেননি। করেননি মীরাকে তিনি আজও ভালোবাসেন বলে, করেননি মীরার ওপর তিনি জোর করতে চান না বলে।
গ্রাম থেকে মীরা যেদিন রাজবধূ বেশে ভয় ভয় চোখে চিতোর গড়ের সিংহ দুয়ারে পা রেখেছিল সেদিন থেকেই কী কারণে যেন তার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছিল মহারানা কুম্ভর মনে। যা তিনি আজও কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। এমনকী মীরাকে বলতে পারলেন না—’তোমার এই নিষ্পৃহতা আসলে আমার প্রতি অবিচার, আমার ভালোবাসার প্রতি নির্দয়তা। মহারানা কুম্ভ একা নন, কিন্তু বড় একা। আর এই একাকিত্বের পূর্ণ দায়িত্ব তোমারও কারণ তুমি শুধু কৃষ্ণপ্রিয়া নও, তুমি কুম্ভরও প্রিয়া। কৃষ্ণপ্রেমে তুমি ভুলে যেতে পারো না আমাকে, অবজ্ঞা করতে পারো না রক্তমাংসের মানুষ কুম্ভর ভালোবাসাকে।’
একলা জলমহলে বসে এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই যেন মীরার প্রতি একটা তীব্র ক্ষোভ জন্ম নিল কুম্ভর মনে।
৫
তিন দিন ধরে বৃষ্টির পর আকাশে ঝলমলে রোদ উঠেছে। সকালবেলা মান্ডোর প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে পায়রা ওড়াচ্ছিলেন রাঠোররাজ চন্দ্রকান্ত। গেরোবাজ পায়রাগুলো আকাশের বুকে পাক খেতে খেতে উঠে যাচ্ছিল উঁচু থেকে আরও উঁচুতে। ময়ূরপঙ্খীগুলো আকাশে উড়তে পারে না। পেখম নাচিয়ে গলা ফুলিয়ে বকবকম-বকবকম করতে করতে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছিল রাঠোররাজের পায়ের কাছে। শৈশব থেকেই নানা ধরনের পায়রা পোষার নেশা রাঠোররাজের। সেই নেশাটা বড় বয়সেও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। মন মেজাজ ভালো থাকলে সকালবেলা ছাদে উঠে পায়রা ওড়ান তিনি, নিজের হাতে দানা খাওয়ান তাদের।
চন্দ্রকান্ত আকাশের দিকে পায়রা ওড়া দেখছিলেন এমন সময় এক ভৃত্য এসে খবর দিল—নীচে বার্তাবাহকের দল তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গেছিলেন চন্দ্রকান্ত। তিনি আজ তাদের উপস্থিত হতে বলেছিলেন প্রাসাদে। বিবাহের নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে তারা যাবে এই মরু অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় রাজ্যে। তার মধ্যে অনেককে পাড়ি দিতে হবে দু-তিন দিনের পথ। আজ সকালেই তাদের যাত্রা করা প্রয়োজন। তাই খবরটা শোনা মাত্রই রাঠোররাজ ছাদ থেকে নীচে নেমে চললেন তাঁর ছোট্ট দরবার কক্ষের দিকে।
দরবার কক্ষে প্রবেশ করে রাঠোররাজ দেখলেন তাঁর প্রধান বার্তাবাহক বৃদ্ধ বীরমল্লসহ অন্যান্য সকল বার্তাবাহকই উপস্থিত হয়েছে সেখানে। বীরমল্ল ছাড়া তাঁর অন্য অনুচরদের হাতে রাঠোররাজ তুলে দিলেন রেশম বস্ত্রের ওপর সোনার সুতোয় বোনা বিবাহের নিমন্ত্রণ পত্র। তাদের নির্দেশ দিলেন কাকে কোথায় যেতে হবে। রাঠোররাজের নির্দেশমতো নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে তারা কেউ জয়সলমের, কেউ অম্বর, কেউ বুঁদির দিকে ছুটল। সবাই চলে গেলে দরবার কক্ষে রইলেন শুধু রাঠোররাজ চন্দ্রকান্ত আর বীরমল্ল।
রাঠোররাজ বীরমল্লকে বললেন—’আপনাকে আমি নিমন্ত্রণ পত্র দিয়ে পাঠাব চিতোরের মহারানা কুম্ভর কাছে। তাঁকে বলবেন, তিনি বিবাহের দিন আমার সঙ্গে ঝালোয়ার প্রাসাদে উপস্থিত না হলে মনে বড় ব্যথা পাব আমি। এই বিবাহে তিনিই আমার অভিভাবকত্ব করবেন। মহারানার কাছে এই আমার প্রার্থনা।’
বীরমল্ল বললেন—’যে আজ্ঞে মহারাজ।’ এরপর রাঠোররাজ একটু যেন ইতস্তত করে বীরমল্লর উদ্দেশ্যে বললেন—’শুধু নিমন্ত্রণ পত্রই নয়, আরও একটা জিনিস আমি মহারানার উদ্দেশ্যে পাঠাব, তবে খেয়াল রাখবেন মহারানার হাতে পৌঁছোবার আগে অন্য কেউ যেন সেটা দর্শন না করেন। জিনিসটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত।’
রাঠোররাজের কথা শুনে বীরমল্ল ঘাড় নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলেন তাঁর নির্দেশ পালন করবেন তিনি। এরপর বীরমল্লকে দরবার কক্ষে তাঁর জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে চন্দ্রকান্ত রওনা হলেন প্রাসাদের দ্বিতলে তাঁর কক্ষের দিকে।
চন্দ্রকান্ত কুম্ভজিকে পাঠাবেন এক ছবি। এক বৃদ্ধ চিত্রকরকে দিয়ে রাঠোররাজ আঁকিয়েছেন ঝুলকুমারীর ছবি। কিছুদিন আগে কুম্ভজি যখন মান্ডোর প্রাসাদে এসেছিলেন তখন কথাপ্রসঙ্গে মান্ডোররাজ তাঁকে বলেছিলেন এই ছবির কথা। কুম্ভজি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ছবিটার ব্যাপারে। সেটা আঁকা সম্পূর্ণ হয়নি চিত্রকরের। কুম্ভজি বলেছিলেন অতি অবশ্যই রাঠোররাজ যেন তাঁকে ছবিটা দেখান। চিত্রকলার একজন বড় সমঝদার মহারানা। এবিষয়ে তাঁর খুব আগ্রহ। রাঠোররাজ তাঁকে কথা দিয়েছিলেন, আঁকা সম্পূর্ণ হলে ছবিটা তিনি চিতোর প্রাসাদে কুম্ভজির দেখার জন্য পাঠিয়ে দেবেন। দুদিন আগে চিত্রকর তার কাজ সম্পন্ন করে সে ছবি দিয়ে গেছেন রাঠোররাজের হাতে। ছবি অতুলনীয় হয়েছে ঠিকই, সত্যি কথা বলতে কী রাঠোররাজেরও ধারণা ছিল না বৃদ্ধর হাতের তুলিতে এত যাদু থাকতে পারে। কিন্তু ছবিটা যত ভালোই হোক না কেন, সর্বসমক্ষে ছবিটা দেখানোর ক্ষেত্রে একটা সমস্যা আছে। আসলে ছবি আঁকার নির্দেশ দেবার সময় রাঠোররাজ শিল্পীর স্বাধীনতায় কোনও হস্তক্ষেপ করতে চাননি। তিনি চিত্রকরকে তার নিজের মনের মতো করেই ছবিটা আঁকতে বলেছিলেন, আর তাঁর হাতে শুধু তুলে দিয়েছিলেন ঝুলকুমারীর মুখশ্রীর একটা কাঠ খোদাই প্রতিচ্ছবি। যাতে অদেখা ঝুলকুমারীর মুখশ্রী চিত্রকর আঁকতে পারে। যেহেতু ছবি আঁকা প্রসঙ্গে রাঠোররাজ শিল্পীকে অন্য কোনও নির্দেশ দেননি তাই চিত্রকর আপন মনের খেয়ালে এঁকেছেন সিক্ত বসনা ঝুলকুমারীর ছবি।
বৃদ্ধ চিত্রকর অদ্ভুতভাবে সে ছবিতে জাগিয়ে তুলেছেন সিক্তবসনা সুন্দরীর নারী দেহ। তাই ছবি দেখার পর রাঠোররাজ যেমন শিল্পীর নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়েছেন তেমনই একটু বিব্রত হয়েছেন। বেশ কয়েকবার তিনি চিন্তা করেছেন এ ছবি বয়:জ্যেষ্ঠ কুম্ভজীকে দেখানো ঠিক হবে কিনা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাঠোররাজ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ছবিটা তিনি দেখাবেন চিতোর রাজকে। কারণ তিনি কুম্ভজীকে কথা দিয়েছেন এ ব্যাপারে। ছবির প্রকৃত উৎকর্ষতার বিষয়েও কুম্ভজীর মতামত তাহলে জানতে পারবেন চন্দ্রকান্ত। সেই মতো তিনি পুরস্কারও প্রদান করতে পারবেন চিত্রকরকে।
নীচে দরবার কক্ষে বীরমল্লকে রেখে ওপরে উঠে চন্দ্রকান্ত প্রবেশ করলেন নিজের শয়ন কক্ষে। পালঙ্কের পাশেই রেশম বস্ত্রের আচ্ছাদন দেওয়া ছবিটা রাখা আছে। বেশ প্রমাণ মাপের তৈল চিত্র, প্রায় এক মানুষ হবে। চন্দ্রকান্ত গিয়ে দাঁড়ালেন তার সামনে, খুলে ফেললেন তার আচ্ছাদন। তারপর অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ছবিটার দিকে। রাঠোররাজের মনে হতে লাগল সত্যিই যেন সিক্তবসনা রাজকন্যা এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর সামনে। চিত্রকরের তুলির টানে আশ্চর্যভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর দেহের গোপন রেখাগুলি। ছবি নয়, এ যেন সত্যিই রাজকন্যার রক্তমাংসের জীবন্ত শরীর। যা আহ্বান জানাচ্ছে রাঠোররাজকে।
বেশিক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না চন্দ্রকান্ত। গরম রক্তের স্রোত জ্বালা ধরাতে শুরু করল তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। রাঠোররাজ আবার ঢেকে ফেললেন ছবিটা। শেষ বারের মতো তিনি আর একবার চিন্তা করলেন—কুম্ভজির কাছে এ ছবি পাঠানো কি ঠিক হবে? পরক্ষণেই আবার তিনি ভাবলেন—কুম্ভজির স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর। বিবাহের মাত্র কিছুদিন আর বাকি। বিবাহের পর কুম্ভজী যদি ছবিটা দেখতে চান আরও বিপদ হবে। কারণ, ঝুলকুমারী মান্ডোর প্রাসাদে আসার পর তাকে দেখাতে হবে ছবিটা। আর তা দেখার পর স্বাভাবিক কারণেই লজ্জাশীলা অন্যান্য নারীর মতই ঝুলকুমারীও নিশ্চয়ই চাইবেন না তার এ ছবি অন্য কোনও পর পুরুষ দেখুক। তখন উভয় সঙ্কটে পড়বেন রাঠোররাজ। কুম্ভজি না ঝুলকুমারী, কার ইচ্ছাকে তখন প্রাধান্য দেবেন চন্দ্রকান্ত। কাউকে মিথ্যা কথাও বলতে পারবেন না চন্দ্রকান্ত। কারণ জীবনে কাউকে কোনও দিন মিথ্যা বলেননি রাঠোররাজ। এ বিষয়ে তিনি নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। এসব ভেবে তাই রাঠোররাজ তাঁর পূর্বের সিদ্ধান্তই বহাল রাখবেন।
আচ্ছাদন সমেত ছবিটাকে নিজের হাতে রেশমের ফিতা দিয়ে ভালো করে বাঁধলেন তিনি। তারপর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীকে নির্দেশ দিলেন সেটা বহন করে তাঁর সঙ্গে দরবার কক্ষে যেতে।
ছবি নিয়ে দরবার কক্ষে পৌঁছোবার পর রাঠোররাজ রক্ষীকে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন, তারপর সেটা বীরমল্লর হাতে তুলে দিয়ে বললেন—’ছবিটা চিতোররাজের কাছে দিয়ে বলবেন তাঁর দেখার পর তিনি যেন ছবিটা আবার আপনার হাতে ফেরত পাঠিয়ে দেন। এ ব্যাপারে আরও একটা কথা আপনি তাঁকে জানাবেন, তা হল আমার অনুরোধ—তিনি যেন সর্বসমক্ষে এ ছবি না দেখেন।’
রাঠোররাজকে প্রণাম জানিয়ে ছবি আর রাঠোররাজের দেওয়া তাঁর বিবাহের নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে দরবার কক্ষ ত্যাগ করলেন বৃদ্ধ বার্তাবাহক বীরমল্ল। আর রাঠোররাজ সিঁড়ি ভেঙে চললেন আবার প্রাসাদের ছাদের দিকে। দেখতে, তার প্রিয় গেরোবাজগুলো ওড়া শেষ করে ঠিকমতো আবার ফিরে এসেছে কিনা। দূরের নবনির্মিত কুম্ভমেরু দুর্গে কয়েকটা বাজপাখি পুষেছেন মহারানা। মাঝে মাঝেই তারা তাড়া করে চন্দ্রকান্তর শখের পায়রাগুলোকে। রাঠোররাজ মনে মনে ভেবে রেখেছেন এবার কুম্ভজির সঙ্গে দেখা হলে বলবেন ব্যাপারটা। যাতে কুম্ভজি দুর্গরক্ষীদের নির্দেশ দেন যে সকালবেলায় তারা যেন ওই হিংস্র পাখিগুলোকে না ওড়ায়।
বৃদ্ধ বীরমল্ল প্রাসাদ ছেড়ে প্রথমে রওনা হলেন নিজের আস্তানার দিকে। চিতোর বেশ অনেকটা পথ। সেখানে রওনা হবার আগে আস্তানা থেকে ঘোড়া আর রসদ সংগ্রহ করে নিতে হবে। সাজ-পোশাকও পালটাতে হবে। কিন্তু একটা ব্যাপার তাকে পেয়ে বসল। রাঠোররাজ মহারানার কাছে কী এমন ছবি পাঠাচ্ছেন যে সর্বসমক্ষে তা না দেখতে অনুরোধ করেছেন মহারানাকে!
ঘরে ফিরে আসার পর বীরমল্ল আর নিজের কৌতুহল সংবরণ করতে পারলেন না। একটা গর্হিত কাজ করে ফেললেন বৃদ্ধ। ছবির আবরণ উন্মোচন করে ফেললেন তিনি। কয়েক মুহূর্তের জন্য মাত্র। আর তার পরেই আবার ঢেকে ফেললেন ছবিটা। মনে মনে বীরমল্ল ভাবলেন—’কাজটা আমার ঠিক হয়নি। রাজকুমারী ক’দিন পরেই আমাদের সকলের মা হবেন। কারণ রাজমাতা বহু দিন হল গত হয়েছেন। ঝুলকুমারীই পাবেন রাজমাতার সম্মান। তাই কৌতূহলের বশে তাঁর এ ছবি দেখা ঠিক হল না। ভগবান আমাকে ক্ষমা করুন।’
আর একটা কথা তিনি ভাবলেন, রাঠোররাজ কি এ ছবি মহারানার কাছে পাঠিয়ে ঠিক করেছেন? অবশ্য তার ভাবাভাবিতে কিছু এসে যায় না। বীরমল্ল নগণ্য দূত মাত্র। রাঠোররাজের আদেশ পালনই তার একমাত্র কর্তব্য। কাজেই ছবিটাকে আবার ভালো করে বেঁধে ছেদে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে বীরমল্ল রওনা হলেন চিতোরের উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যাবেলায় বীরমল্ল হাজির হলেন চিতোর প্রাসাদে। রক্ষীরা যখন তাকে নিয়ে মহারানার কক্ষে উপস্থিত হল তিনি তখন প্রস্তুত হচ্ছেন মন্ত্রণাসভায় যাবার জন্য। বীরমল্ল তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে নিমন্ত্রণ পত্র আর সেই ছবি তাঁর কাছে তুলে দিয়ে করজোড়ে ব্যক্ত করলেন সব কথা। কুম্ভ সব কথা শুনে বললেন—’তোমার রাজাকে বলো তাঁর আমন্ত্রণ রক্ষা করব আমি। বিবাহের দিন আমি যথা-সময়ে ঝালোয়ার প্রাসাদে পৌঁছে যাব। ঝালোয়ার রাজের কক্ষ থেকেও নিমন্ত্রণ পত্র এসে পৌঁছেছে আমার কাছে। আমার সঙ্গে যাবে পাঁচশত অশ্বারোহী। রাঠোররাজ যেন তাদের আহারের ব্যবস্থা করে রাখেন। তবে সময়াভাবে ছবিটা এখনই দেখা সম্ভব নয়। এটা আমি আমার কাছে রেখে দিলাম। দেখা হলে রাঠোররাজকে ফেরত পাঠিয়ে দেব।’ এই বলে মহারানা তাঁর একজন পার্শ্বচরকে ডেকে বীরমল্লকে একশো স্বর্ণমুদ্রা দেবার নির্দেশ দিয়ে কক্ষ ছেড়ে মন্ত্রণাকক্ষের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।
বীরমল্ল আর কিছু বলতে পারলেন না তাঁকে। স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করে বীরমল্ল আবার রওনা হলেন মান্ডোরের দিকে। আচ্ছাদিত অবস্থায় সেই ছবি রয়ে গেল মহারানার কক্ষে।
৬
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙল মহারানার। সূর্য তখন প্রায় মাথার উপর। সাধারণত ঘুম ভাঙতে এতটা দেরি হয় না মহারানার। আগের দিন সন্ধ্যা থেকে শেষরাত পর্যন্ত সীমান্ত-সমস্যা নিয়ে মন্ত্রণাকক্ষে জরুরি আলোচনা করেছিলেন মহারানা। মালব সীমান্তে কিছু গোলযোগ হচ্ছে। আলোচনা শেষ করে মহারানা যখন শয়নকক্ষে প্রবেশ করেছিলেন তখন পূবের আকাশ লাল হতে শুরু করেছিল।
ঘুম ভাঙতেই কুম্ভ বুঝতে পারলেন বড্ড বেশি বেলা হয়ে গেছে। তখনই তার চোখে পড়ল কক্ষের কোনায় রাখা রেশম বস্ত্রে মোড়া ছবিটা। মনে মনে ভাবলেন দরবার সাঙ্গ হলে দ্বিপ্রহরের আহারের পর ছবিটা নিয়ে দেখতে বসবেন তিনি। দেখতে হবে কেমন এঁকেছেন চিত্রকর, দেখতে হবে কাকে রানি করতে চলেছেন রাঠোররাজ।
কুম্ভ প্রস্তুত হতে শুরু করলেন স্নানে যাবার জন্য। দরজার বাইরে পর্দার আড়ালে তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে তাঁর ভৃত্য ও অঙ্গরক্ষকের দল। তাদের কথাবার্তার চাপা শব্দ কক্ষের ভিতর থেকে শুনতে পাচ্ছেন কুম্ভ। কক্ষের বাইরে পা রাখতেই অপেক্ষমান নারী-পুরুষের দল নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ করে মাথা ঝাঁকিয়ে প্রণাম জানাল মহারানাকে। অলিন্দ দিয়ে তাদের নিয়ে এগিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াতে যেতেই হঠাৎ মহারানার চোখে পড়ল রানিমহলের এক দাসী অলিন্দের এক কোনায় করজোড়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রানিমহলের দাসী এসময় এখানে কেন! অন্যদের একটু দূরে সরে যেতে বলে তাকে ডাকলেন মহারানা। দাসী তাঁর সামনে এসে প্রণাম জানিয়ে যে-কথা বলল তাতে চমকে উঠলেন কুম্ভ। মহারানি মীরা আজ রাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। কথাটা তাঁর কাছে এতটা আশ্চর্য লাগল যে নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলেন না কুম্ভ। এতদিন পর…।
দাসীকে তিনি কী বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না মহারানা। কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করে সামনের দিকে পা বাড়ালেন।
গোমুখকুন্ডের জলে স্নান সারার পর সূর্যমন্ত্র জপ করার সময় রোজকার সেই মন্ত্র যেন মাথার মধ্যে গুলিয়ে যাচ্ছিল মহারানার। সূর্যস্তব শেষ করে পালকিতে চেপে তিনি যাত্রা করলেন দরবারের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথের দু-পাশে প্রতিদিনের মতো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে নগরবাসী প্রণাম জানাচ্ছে মহারানাকে। সেসব যেন কিছুই আজ নজরে পড়ল না মহারানার। শুধু কুম্ভশ্যাম মন্দিরের পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার সে- দিকে তাকালেন তিনি।
দরবার কক্ষে বেশি ভিড়। বাদী-বিবাদী, সাক্ষী-দর্শক সবাই হাজির সেখানে। মহারানা সিংহাসনে গিয়ে বসতেই বিচার শুরু হল। ব্যাপারটা খুব গুরুতর। মহারানার জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম উদয়করন। যদিও সে উদা নামে বেশি পরিচিত। উদার স্বভাব চরিত্রের জন্য মাঝে মাঝেই বিব্রত হতে হয় মহারানাকে। বিভিন্ন অপরাধের জন্য বেশ কয়েকবার শাস্তি দিয়েছেন তিনি উদার সাঙ্গপাঙ্গদের। ভর্ৎসনা করেছেন উদাকেও। উদার দুই অনুচরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এক অল্পবয়স্কা বিধবার ওপর বল প্রয়োগ করেছে তারা। এ ব্যাপারে বসেছে বিচার সভা। মহারানা আগেই ঠিক করে রেখেছেন অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই দুই সঙ্গীকে কঠোর দণ্ড দিয়ে তিনি শিক্ষা দেবেন উদাকে। উদাও হাজির আছে দরবারে।
সওয়াল-জবাব চলতে লাগল। কিন্তু একটু পরেই যেন মহারানার কাছ থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল সব কথা। মহারানা ভাবতে লাগলেন অন্য কিছু। তাঁর মন চলে গেল অন্যখানে। এক সময় বাদ-বিবাদ শেষ হল। সবাই অধীর আগ্রহে তাকাল মহারানার দিকে, মহারানা কী নির্দেশ দেন তা শোনার জন্য। মহারানার কিন্তু খেয়াল নেই সওয়াল-জবাব শেষ হয়ে গেছে। মাথা নীচু করে কী যেন ভাবছেন তিনি।
নিস্তব্ধ সভাঘর। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাবার পর ব্যাপারটা মনে হয় কিছুটা আঁচ করতে পারলেন তাঁর পাশে বসা সেনাপতি। তিনি মৃদু কণ্ঠে ডাকলেন মহারানা। সম্বিত ফিরল মহারানার। যদিও এতক্ষণ কী কথা হচ্ছিল কিছুই কানে যায়নি মহারানার। সেনাপতির ডাক শুনে মাথা তুলতেই মহারানার চোখ পড়ল দরবারের একপাশে বসে থাকা উদার ওপর। সেদিকে তাকিয়ে মহারানা শুধু বললেন—পঞ্চাশ ঘা বেত। এই বলে সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কিন্তু, পঞ্চাশ ঘা বেত কাকে? বল প্রয়োগ প্রমাণিত হয়েছে মনে করে রাজকুমারের সঙ্গীদের? নাকি, মিথ্যা অভিযোগের জন্য সেই বিধবাকে? নাকি, সঙ্গীদের আচরণের জন্য স্বয়ং রাজকুমারকেই বেত মারতে বললেন মহারানা!
দরবারের কেউই মহারানার নির্দেশ বুঝে উঠতে পারল না। আর কোনও কথা না বলে মহারানা দরবার কক্ষ ত্যাগ করলেন। দরবার থেকে প্রাসাদে ফিরে এসে আহার সেরে পালঙ্কে শুয়ে পড়লেন কুম্ভ। অন্যদিনে তাঁর এ সময় ঘুম আসে। সারা রাত তো জেগেই কাটাতে হয় তাঁকে। কিন্তু বিছানায় শোবার পর দু-চোখের পাতা আজ এক করতে পারলেন না কুম্ভ। মনের মধ্যে একই চিন্তা তাঁর ঘুরপাক খেতে লাগল। এতদিন পর আজ হঠাৎ মীরা কেন তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী! তাহলে এত দিন পর সে কি সত্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছে? বুঝতে পেরেছে, ওই মূক-বধির পাথরের মূর্তির চেয়ে অনেক বেশি সত্য রক্তমাংসে গড়া মহারানার ভালোবাসা? নাকি জেগে উঠেছে তার উপবাসী শরীর? যে শরীরকে তৃপ্ত করার ক্ষমতা ওই কষ্টিপাথরের মূর্তির নেই।
কতদিন…মনে হয় এক যুগ হবে…মীরাকে নিজের বাহুবন্ধনে বন্দি করেননি মহারানা। আসলে কোনওদিন কোনও ব্যাপারে জোর করেননি কুম্ভ। মহারানার আরও বেশ কয়েকজন মহিষী আছেন। কিন্তু কুম্ভর সব সময় কেন যেন মনে হয় মীরা তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার চিন্তা-চাওয়া-পাওয়া সব কিছুই যেন বরাবরই অন্যরকম। সেই মীরা কি এত দিন পর আবার…। নিশ্চয় তাই। নইলে অন্য কোনও প্রয়োজনে তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হবার কথা নয় তার। মীরার যে-কোনও নির্দেশই তো মেনে চলেন প্রাসাদের অন্যান্যরা।
মীরার কথা বিভোর হয়ে ভাবতে ভাবতে এক সময় বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। সারাক্ষণ অন্ধকার। দূর থেকে ভেসে আসা চিতোরেশ্বরী মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনিতে কুম্ভ বুঝতে পারলেন সেখানে সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে। হঠাৎ দ্বারের কাছে মৃদু শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে সেদিকে তাকিয়ে বিছানায় উঠে বসলেন কুম্ভ। দ্বারের কাছে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক নারীমূর্তি। তাহলে সে কি উপস্থিত হল!
কুম্ভ প্রশ্ন করলেন, ‘কে ওখানে?’ নারীমূর্তির উত্তর শুনে কুম্ভর ভুল ভেঙে গেল। সে প্রাসাদের একজন দাসী। রোজকার মতো সে আজও মহারানার কক্ষে বাতি জ্বালাতে এসেছে। আজ এই অন্ধকার কক্ষই ভালো লাগছে মহারানার। তাই দাসীকে ফিরিয়ে দিলেন তিনি। তারপর আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। আকাশে চাঁদ উঠল। সেই চাঁদের আলো অলিন্দ বেয়ে খোলা দ্বারের ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে কক্ষের ভিতর। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলেন মহারানা। আর কতক্ষণ…।
ঠিক এমন সময় কক্ষের ভিতরে এসে প্রবেশ করলেন মীরা। কুম্ভ বিছানা ছেড়ে নীচে নেমে দাঁড়ালেন। রানির পরনে শুভ্র বস্ত্র। চাঁদের আলো তাঁর পিছন থেকে কক্ষে প্রবেশ করছে বলে তার মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তবু মহারানা চেয়ে রইলেন সেদিকে। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল এভাবে। এরপর মীরা মাটিতে ঝুঁকে পড়ে মহারানার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালেন। তারপর একই জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
কুম্ভ ভাবলেন এতদিন পর এভাবে হয়তো তার কাছে আসতে সংকোচ বোধ হচ্ছে রানির। তাই তিনি বললেন—’এতক্ষণ আমি তোমার প্রতীক্ষাতে ছিলাম। সংকোচ কোরো না। তুমি আজও আমার কাছে আগের মতোই আছ। আমি তোমার কাছে আজও মহারানা নই, শুধু কুম্ভ।’ এই বলে কুম্ভ আবার পালঙ্কের ওপর বসলেন।
অন্ধকারের মধ্যেও কুম্ভ বুঝতে পারলেন এবার তাঁর দিকে মুখ তুলে চাইল মীরা। কুম্ভ ভাবলেন, এবার হয়তো সে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁর কোলে, তারপর বাঁধ ভাঙা অশ্রুতে ভিজে যাবে তাঁর বুক। সারা রাত ধরে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে কুম্ভ সান্ত্বনা দেবেন তাঁকে। মীরা কিন্তু এগিয়ে এলেন না, শুধু তার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন কুম্ভ—’মহারানার কাছে আমার একটি নিবেদন আছে।’
‘কী সেই কথা? তোমার যে-কোনও অনুরোধ রাখার জন্যই আজও আগের মতোই প্রস্তুত চিতোরেশ্বর। কিন্তু তুমি কি ওখানে দাঁড়িয়ে বলবে সেই কথা!’ কুম্ভর এই কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন মীরা।
তারপর বললেন—’চিতোর ত্যাগ করে আমি কৃষ্ণভূমে চলে যেতে চাই মহারানা, দ্বারকাধীশই আমাকে ডাকছেন সেখানে। মহারানা আমাকে সেখানে যাবার অনুমতি দিন।’ কক্ষের মধ্যে বজ্রপাত হলেও মনে হয় এতটা চমকে উঠতেন না মহারানা। তাঁর স্বপ্নের জাল মুহূর্তের মধ্যে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল মীরার কথা শুনে। পালঙ্ক ছেড়ে নীচে নেমে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলেন তিনি। তারপর চিৎকার করে বলে উঠলেন—’দ্বারকাধীশই তোমার সব, আর তোমার স্বামী, সে কি কেউ নয়?’
‘আমার সব কিছুই আজ পরমপ্রেমময় গিরিধারীর চরণে নিবেদিত’—উত্তর দিলেন মীরা।
‘যদি আমি তোমাকে চিতোর ত্যাগের অনুমতি না দিই? এই মুহূর্ত থেকে আটকে রাখি এই কক্ষে?’
‘দেহকে আপনি আটকে রাখতে পারবেন মহারানা, মনকে নয়। দ্বারকাধীশের যদি ইচ্ছা থাকে তাহলে তিনি আমাকে একদিন ঠিক নিয়ে যাবেন সেই পুণ্যভূমে’—শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন মীরা।
কুম্ভ আর কিছু উত্তর দিতে পারলেন না। রাগে কাঁপতে কাঁপতে তিনি পালঙ্কের উপর বসে পড়লেন। এরপর কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন মীরা, তারপর মহারানার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে ধীরে ধীরে কক্ষত্যাগ করলেন।
মীরা চলে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ পালঙ্কে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলেন মহারানা। তারপর কক্ষ ত্যাগ করে প্রাসাদের নীচে নেমে একাই ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। স্তম্ভ-চত্বরের দিকে। কুম্ভশ্যাম মন্দিরের পাশ দিয়ে যাবার সময় শুধু তাঁর চোখে পড়ল একটা ছায়ামূর্তি মিলিয়ে যাচ্ছে মন্দিরের ভিতর। সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে তাকিয়ে ঘোড়ার গতি আরও বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
ক’দিন ধরে দরবারে বসেন না কুম্ভ। আত্মমগ্ন হয়ে নিজের কক্ষেই সারা দিন কাটান। মহামন্ত্রীকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে। শুধু রাত্রিবেলা প্রাসাদ ছেড়ে বাইরে বার হন তিনি। সোজা চলে যান স্তম্ভ-চত্বরে। সারারাত ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ দেখেন। তারপর শেষ রাতে আবার প্রাসাদে ফিরে আসেন কুম্ভ। মীরার সঙ্গে সেই দিন সাক্ষাতের পর একাকিত্ব যেন আরও বেশি গ্রাস করেছে মহারানার মনকে। আরও একটা ব্যাপার কানে এসেছে কুম্ভর। যা মীরার ঘটনার পর আরও একবার ক্ষতবিক্ষত করেছে তাঁর হৃদয়কে। সে-ঘটনা হল মাস ছয়েক আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন কুম্ভ। সেসময় এক বৈদ্য ব্রাহ্মণ কুম্ভর চিকিৎসার ভার নেন। কিন্তু তার ঔষধ সেবন করার পর থেকেই আরও যেন দুর্বল হয়ে পড়তে থাকেন মহারানা। মন্ত্রীর সন্দেহ হয় ব্যাপারটাতে। শেষ পর্যন্ত তিনি ধরে ফেলেন যে ঔষধ সেবন করানোর নামে ধীরে ধীরে তাঁকে বিষ সেবন করাচ্ছিলেন ব্রাহ্মণ। মহারানা তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। সেই দণ্ড কার্যকর করার জন্য দিন-দু-এক আগে যখন তাঁকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয় তখন মৃত্যুর আগে সে জানায় যে মহারানার চিকিৎসার অছিলায় তাঁকে বিষ প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং যুবরাজ উদয়করন। তাঁর দেওয়া বিষাধার স্বরূপ এক অঙ্গুরীয়ও ব্রাহ্মণ তুলে দেন সেনাপতির হাতে। ব্রাহ্মণের কথা যে মিথ্যা নয় তা অঙ্গুরীয় দেখে বুঝতে পেরেছেন কুম্ভ। কারণ, নাগোর রাজ্য জয় করে আসার পর মহারানা নিজ হাতে ওই অঙ্গুরীয় একদিন উপহার দিয়েছিলেন পুত্র উদাকে।
পুত্র উদা ছোটবেলা থেকেই উচ্ছৃঙ্খল, বেয়াদপ প্রকৃতির, তা বলে সে সিংহাসনের লোভে পিতাকে পর্যন্ত হত্যার চেষ্টা করতে পারে এতটা কল্পনা করতে পারেননি মহারানা। শিসোদা রাজপরিবারে এ-ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। ঘটনাটা শোনার পর এখনও অবশ্য তিনি উদাকে কিছু বলেননি। রাজপরিবারের কলঙ্ক যাতে বাইরে ছড়িয়ে না পড়তে পারে তাই ঘটনাটা তিনি গোপন রাখতে বলেছেন সেনাপতিকে। এই অমার্জনীয় অপরাধের সাজা অবশ্যই তিনি যুবরাজকে দেবেন। তবে তা দেবেন অন্য অছিলায়।
৭
সন্ধ্যাবেলায় নিজের কক্ষে একলা বসেছিলেন কুম্ভ। কিছুক্ষণ আগে দাসী এসে কক্ষে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। নিজের ক্ষতবিক্ষত মনটাকে একটু অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য কুম্ভ স্মরণ করছিলেন তাঁর ফেলে আসা যৌবনের কথা। বহু যুদ্ধের সফল রণনায়ক কুম্ভের দেহে অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন আছে। সেইসব-হ্নিগুলির উপর পরম মমতার হাত বোলাতে বোলাতে কুম্ভ চলে যাচ্ছিলেন অতীতের সেই যুদ্ধক্ষেত্রে, যার সাক্ষ্য আজও বহন করে চলেছে এইসব ক্ষতচিহ্ন, স্মরণ করাচ্ছে কুম্ভর শৌর্য-বীর্যের কথা।
ঠিক এমন সময় এসে উপস্থিত হলেন মহামন্ত্রী। কক্ষে প্রবেশ করার পর মহারানার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে তিনি তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। মহামন্ত্রী নারায়ণ সিংহের বয়স কুম্ভর থেকে সামান্য বেশি হবে। ছেলেবেলায় এক সময় তিনি ছিলেন কুম্ভর খেলার সঙ্গী। কুম্ভ সিংহাসনে বসার পর তাঁকেই তিনি নির্বাচন করেন মহামন্ত্রী হিসাবে। সে নির্বাচনে কোনও ত্রুটি ছিল না। ছেলেবেলা থেকে আজও যে কুম্ভর প্রতি একই রকম বিশ্বস্ত। তাঁর হাতে চিতোর গড়ের ভার দিয়ে জীবনের অনেকটা সময় যুদ্ধক্ষেত্রে কাটিয়েছেন কুম্ভ। আজও চিতোরগড়ে তাঁর অবর্তমানে নারায়ণ সিংহই সবকিছু দেখভাল করেন। কুম্ভও তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান ও গুরুত্ব দেন।
নারায়ণ সিংহ তাঁর সামনে দাঁড়াতেই কুম্ভ বললেন—’আপনি আসন গ্রহণ করুন। তা হঠাৎ এ সময়ে। কোনও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আছে নাকি? ভীলরা কি আবার খেপে উঠেছে?’
নারায়ণ সিংহ হেসে বললেন—’না না, সেসব কিছু নয় মহারানা। আসলে ক’দিন ধরে আপনি একলা কাটাচ্ছেন। তাই দরবারের কাজ শেষ হলে মনে হল—যাই একবার মহারানার সঙ্গে দেখা করে আসি। ধৃষ্টতা মাপ করবেন, মহারানা কি বিষণ্ণ?’
কুম্ভ বুঝতে পারলেন তিনি ধরা পড়ে গেছেন মহামন্ত্রীর কাছে। তাই তিনি মনের ভাব গোপন না করে বললেন—’যাঁর স্ত্রী তাঁকে ত্যাগ করতে চাচ্ছে, পুত্র সিংহাসনের লোভে হত্যা করতে চাচ্ছে তাঁর তো বিষণ্ণ থাকাটা স্বাভাবিক।’
কুম্ভর কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন নারায়ণ সিংহ। তারপর বললেন—’আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি মহারানা। কিন্তু আপনি এসব যত বেশি চিন্তা করবেন ততই বিষণ্ণতা আপনাকে গ্রাস করবে। যা আপনার আর চিতোরগড় উভয়ের পক্ষে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। জগৎ সংসারে এসব ঘটনা আপনি আমি না চাইলেও তা বিধাতা-পুরুষের নির্দেশে ঘটে চলে। আপনি বরং মনটাকে শান্ত করুন মহারানা। প্রয়োজনে মৃগয়া কিংবা অন্য আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা করুন।’
নারায়ণ সিংহের কথা শুনে মহারানা বললেন—’কথাটা আপনি খারাপ বলেননি মন্ত্রী, দেখি কী করা যায়!’ নারায়ণ সিংহ মহারানাকে প্রণাম জানিয়ে বিদায় জানাতে যাচ্ছিলেন হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল একটা ব্যাপার। যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা মানসিক অবস্থার কারণে এক’দিনের মধ্যে একবারের জন্যও মনে আসেনি মহারানার।
নারায়ণ সিংহ বললেন—’আর তিন দিন পর মান্ডোররাজের বিবাহের দিন। আপনি সেখানে উপস্থিত হবেন তো মহারানা?’ কথাটা শুনে চমকে উঠলেন মহারানা।
তারপর বললেন—’দেখেছেন তো। আমি একেবারে ভুলতে বসেছিলাম ব্যাপারটা। আপনি স্মরণ না করিয়ে দিলে কী বিপত্তিটাই না হত! কী ভাবতেন মান্ডোররাজ! আমি অবশ্যই সেখানে যাব। মান্ডোররাজ তাঁর বিবাহে আমাকে অভিভাবকত্ব করার অনুরোধ জানিয়েছেন। পাঁচশো অশ্বারোহী আমার সঙ্গে যাবে ঝালোয়ার প্রাসাদে চন্দ্রকান্তের বিবাহবাসরে। আর একটা কথা, পিছোলা হ্রদের তীরে যে ভূখণ্ড আমি ভীলদের থেকে অধিকার করেছিলাম তা নবদম্পতিকে উপহার দিতে চাই আমি। আপনি তার জন্য প্রয়োজনীয় আদেশনামা তৈরি করুন। এ ছাড়া দশ সহস্র স্বর্ণমুদ্রাও আমি তাদেরকে উপহার দেব। যাত্রাকালে সব কিছু যেন তৈরি থাকে।’
‘যে আজ্ঞে’—বলে মহারানাকে প্রণাম জানিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলেন মন্ত্রী নারায়ণ সিংহ।
নারায়ণ সিংহ চলে যাবার পরই কুম্ভর মনে হল সেই ছবিটার কথা। ঘরের এক কোনায় আগের মতোই রাখা আছে ছবিটা। কুম্ভ সেখানে উঠে গিয়ে ছবিটা এনে রাখলেন পালঙ্কের উপর, তারপর খুলে ফেললেন ছবির আচ্ছাদন। বেশ কিছুক্ষণ ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কুম্ভ। শিল্পরসিক কুম্ভ জীবনে বহু ছবি দেখেছেন, কিন্তু এত আশ্চর্য ছবি কোনওদিন দেখেননি। এ যেন ছবি নয়, রক্তমাংসে গড়া জীবন্ত নারীমূর্তি! চিত্রকরের তুলির টানে সিক্ত বসনার দেহের প্রতিটা খাঁজ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এমনকী চিবুক, ঘাড়, �লিত বক্ষ ও নাভিমূলের গায়ে আঁকা টলমল জলবিন্দুগুলোও যেন এখনই ঝরে পড়বে। তার মুখশ্রীও অদ্ভুত সুন্দর-দীর্ঘল চোখ, টিকালো নাক আর গোলাপের পাপড়ির মতো রক্তিম ঠোঁট। গালে তার পদ্মরাগের আভা। দেহবর্ণ কাঁচা সোনার মতো। সত্যিই কি কোনও নারী এত সুন্দর হতে পারে?
মনে মনে চন্দ্রকান্তর পছন্দের তারিফ করলেন কুম্ভ। আর তারিফ করলেন নাম-না-জানা সেই চিত্রকরের। যে তার রং আর তুলিতে বন্দি করেছে ঝুলকুমারীকে। ঝুলকুমারীর শরীরের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলার জন্যই যে চিত্রকর তাকে সিক্তবসনা রূপে এঁকেছেন তা বুঝতে অসুবিধা হল না অভিজ্ঞ কুম্ভর।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন কুম্ভ। তারপর পালঙ্ক থেকে নীচে নেমে ছবিটা উন্মুক্ত অবস্থাতেই দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। ভাবলেন কাল দিনের আলোতে আর একবার তিনি ভালো করে দেখবেন, তারপর সেটা পাঠিয়ে দেবেন মান্ডোরে। ছবিটা দেখার পর মনটা একটু ভালো হয়ে গেল কুম্ভর।
সেদিন আর স্তম্ভ পরিদর্শনে গেলেন না কুম্ভ। খাওয়া সেরে অনেকদিন পর রাতে নিজের পালঙ্কে শুয়ে পড়লেন তিনি। মাঝরাতে এক দু:স্বপ্ন দেখলেন কুম্ভ। তাঁর পুত্র উদা তাঁকে ছুরি দিয়ে হত্যা করতে আসছে। তিনি কাছে আসতে নিষেধ করছেন কিন্তু ছুরি হাতে উদা ক্রমেই আরও কাছে এগিয়ে আসছে। এক সময় সে নিরস্ত্র কুম্ভর একদম কাছে এসে তাঁর বুক লক্ষ্য করে ছুরি চালাল। ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করে উঠলেন কুম্ভ। আর তারপরেই তাঁর ঘুমটা ভেঙে গেল।
কুম্ভ দেখলেন তিনি পালঙ্কে শুয়ে আছেন। ঘামে ভিজে গেছেন তিনি। রাত কত প্রহর হল ঠিক ঠাহর করতে পারলেন না। আবার তাঁর মনে ভিড় করে এল সেইসব চিন্তা—সিংহাসনলোভী কুচক্রী পুত্র উদার চিন্তা, চিতোর ত্যাগে ইচ্ছুক মীরার চিন্তা। এসব ভাবতে ভাবতে মাথা একসময় গরম হয়ে উঠল কুম্ভর। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ ছটফট করার পর উঠে বসলেন তিনি। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নজর পড়ল ছবিটার উপর।
কক্ষের মধ্যে একটা প্রদীপ জ্বলছে। তার আলো গিয়ে পড়েছে ছবিটার উপর। সেই আলোতে ঝুলকুমারীর ছবি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সিক্তবসনা ঝুলকুমারী যেন হাজির হয়েছে কুম্ভর শয়নকক্ষে। ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কুম্ভর দেহের ভিতর এক অন্যরকম অনুভূতি শুরু হয়।
তার মনে হল ওই গোলাপের মতো ওষ্ঠ, সিক্ত বস্ত্রের মধ্যে থেকে জেগে ওঠা ভারী স্তনযুগলের চন্দ্রমল্লিকার অস্ফূট কুঁড়ির মতো শীর্ষদেশ, ক্ষীণ কটিদেশের মধ্যভাগে সুগভীর নাভিমূল, উন্মুক্ত সিক্ত ঊরু—এ সবই যেন আহ্বান জানাচ্ছে তাঁকে। অন্যসব চিন্তা ধীরে ধীরে মুছে গেল কুম্ভর মন থেকে। জেগে রইল সেই নারী। সারারাত ধরে সেই ছবির দিকে চেয়ে বসে রইলেন। ভোরের প্রথম আলো যখন গবাক্ষের শ্বেতপাথরের জাফরির ফাঁক দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল তখন সম্বিত ফিরল কুম্ভর।
সেদিন ভোরেই স্নান সেরে নিলেন মহারানা। মেজাজটা তাঁর আজ হালকা লাগছে। মন থেকে সব হতাশা মুছে গেছে এক রাতে। দুটো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজের মনে। তার একটা পূরণের জন্য স্নান সেরে ফিরে আসার পর তিনি নিজের কক্ষে ডাক পাঠালেন সেই দাসীকে, যে ক’দিন আগে মীরার সাক্ষাৎ করতে আসার খবর জানাতে এসেছিল মহারানাকে।
দাসী আসার পর কুম্ভ তাকে বললেন—’রানিকে বলো, তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন মহারানা। তবে তার শর্ত একটাই, কাল সূর্যোদয়ের পূর্বেই তাকে ত্যাগ করতে হবে চিতোর গড়। নইলে চিতোর ত্যাগের সুযোগ হারাবেন তিনি।’
মহারানার বার্তা নিয়ে দাসী চলল কুম্ভশ্যাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে। দাসী চলে যাবার পর কুম্ভ এসে দাঁড়ালেন আয়নার সামনে। বেশ ভালো করে দেখতে লাগলেন তাঁর ঝুলপিতে, পুরুষ্কু গোঁফে, চুলে ঠিক কতটা পাক ধরেছে। কিছুক্ষণ পর তিনি ডেকে পাঠালেন সেনাপতিকে।
পরদিন সন্ধ্যায় আকাশে সবে মাত্র চাঁদ উঠেছে। ঘড়-ঘড় শব্দে খুলে গেল দুর্গের বিশাল তোরণ। পঞ্চাশ জন সুশিক্ষিত অশ্বারোহী বার হল দুর্গ থেকে। তাদের সবার আগে ধবধবে সাদা ঘোড়ার পিঠে পুরোদস্তুর সামরিক পোশাক পরা মহারানা কুম্ভ। ঘোড়ার খুরের শব্দে রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সর্পিল গিরিপথ বেয়ে দ্রুত বেগে নীচে নামতে শুরু করল সেই অশ্বারোহী সেনাদল।
৮
কুম্ভমেরু। গাছপালা খাড়া পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত ভয়ংকর দুর্গ। দিবারাত্রি খোলা তরবারি হাতে পাহারা দেয় রক্ষীদল। মহারানা কুম্ভর নির্দেশ ছাড়া স্বয়ং মৃত্যু-দেবতাও নাকি প্রবেশ করতে পারে না সেই দুর্গে। কোনও পথিক যদি পথ ভুলে চলে আসে দুর্গ প্রাকারের কাছাকাছি সঙ্গে সঙ্গে পাহারাদার রক্ষীদের কর্কশ চিৎকার শোনা যায়—’তফাত যাও’। আর সেই নির্দেশ না শুনলে পরমুহূর্তেই দুর্গ প্রাকারের ওপর থেকে নেমে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বিষাক্ত তির।
সেই পাষাণপুরীতে বন্দি এক রাজকন্যা। তাঁর নাম ঝুলকুমারী। তাকে হরণ করে কুম্ভমেরুতে বন্দি করে রেখেছেন মহারানা কুম্ভ। মুক্তির শর্ত একটাই, বিবাহ করতে হবে মহারানা কুম্ভকে। কিন্তু জীবন থাকতে মহারানার এ প্রস্তাবে সম্মতি দিতে পারবেন না রাজকুমারী। তার চেয়ে ঘাগরার মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছুরি বসিয়ে দেবেন নিজের বুকে। এ কাজটা হয়তো আরও আগেই করে ফেলতেন ঝুলকুমারী। কিন্তু করতে পারেননি একজনের কথা ভেবে।
দিনের বেলা দুর্গর শীর্ষদেশে দাঁড়ালে দূরে চোখে পড়ে এক প্রাসাদের চুড়ো। ঝুলকুমারী জানেন সেই প্রাসাদে আজও তাঁর প্রতীক্ষায় রয়েছেন একজন। হতে পারে তিনি নামেই রাজা, আসলে তাঁর পিতা ঝালোয়ার-রাজের মতো সামান্য ভূ-স্বামী মাত্র। তবুও তাঁকেই তিনি দেহ-মনে বরণ করে নিয়েছেন নিজের স্বামী রূপে। মহারানা কুম্ভর মতো বিশাল সাম্রাজ্যের পরিধি হয়তো তার নেই, কিন্তু তাঁর ভালোবাসা? সে শত সাম্রাজ্যের অনেক অনেক বেশি দামি। তাঁর কথা ভেবে আজও নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁর বাগদত্তা। মহারানার শত প্রলোভন সত্বেও তিনি সম্মত হননি তাঁর প্রস্তাবে।
রাজকুমারীর দেহ-মনও আস্তে আস্তে ভেঙে পড়েছে, সারাদিন অন্ধকার কক্ষে কাটাবার ফলে চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ হয়ে আসছে। তবুও নিজের ভালোবাসায় অবিচল ঝুলকুমারী। হয়তো কোনওদিন তিনি এসে দাঁড়াবেন তাঁর সামনে, তাঁকে মুক্ত করে নিয়ে যাবেন এই পাষাণপুরী থেকে।
সূর্য ডোবার পর চারপাশে যখন অন্ধকার নেমে এল পাথুরে মেঝের থেকে উঠে দাঁড়ালেন ঝুলকুমারী। কক্ষের কোনায় গিয়ে চকমকি পাথর ঠুকে জ্বালালেন পিতলের সেই বিরাট প্রদীপটা। তারপর সেই জ্বলন্ত প্রদীপ মাথার উপর তুলে ধরে কক্ষ ত্যাগ করে ধীর পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে শুরু করলেন দুর্গের মাথায়। সেখানে ওঠার পর প্রতিদিনের মতোই সেই প্রদীপ স্থাপন করলেন দুর্গের শীর্ষবিন্দুতে। কুম্ভমেরুতে আসার পর প্রতি রাতে এমনভাবে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন ঝুলকুমারী। যাতে কিছুদূরে মান্ডোর প্রাসাদে তাঁর প্রতীক্ষায় রাঠোররাজ এই দীপ শিখা দেখে বুঝতে পারেন এখনও জীবিত আছে তাঁর বাগদত্তা, এখনও সে আত্মসমর্পণ করেনি চিতোরেশ্বর মহারানা কুম্ভর কাছে।
প্রদীপটা রেখে সেদিনও দূরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলেন ঝুলকুমারী। ওই অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক ছোট্ট প্রাসাদে তাঁরই কথা চিন্তা করছেন এক নি:সঙ্গ অসহায় মানুষ। দুজনের মধ্যে ব্যবধান কত কাছের, অথচ কত দূরের। কুম্ভমেরু থেকে মান্ডোর প্রাসাদের দূরত্ব কয়েক যোজন, কিন্তু মহারানা কুম্ভর ইচ্ছায় সে-পথের ব্যবধান সহস্র যোজনেরও বেশি।
কয়েকদিন পর মনে হয় অমাবস্যা। আকাশে শুধু সরু এক ফালি চাঁদ অসহায়। অন্যদিন প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত এমনিই দূরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে রাঠোররাজের কথা চিন্তা করেন ঝুলকুমারী। কিন্তু প্রতিদিনই তাঁর জীবনশক্তি যেন কমে আসছে। ক’দিন ধরে ভালো করে দাঁড়াতে পারছেন না তিনি। তাই কিছুক্ষণ দুর্গশীর্ষে দাঁড়িয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে অন্ধকার রুক্ষ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আবার নিজের কক্ষে প্রবেশ করলেন ঝুলকুমারী। পাথুরে মেঝেতে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলেন নিজের ভাগ্যের পরিহাসের কথা, রাঠোররাজ চন্দ্রকান্তর কথা।
হঠাৎ কক্ষের বাইরে ক্ষীণ পদশব্দ শোনা গেল, ফুটে উঠল মৃদু আলোকরেখা। তাই দেখে উঠে বসলেন ঝুলকুমারী। মনে মনে ভাবলেন—তাহলে সে কি আজ সত্যিই এসেছে! এসেছে তার প্রিয়তমাকে মুক্ত করে নিয়ে যাওয়ার জন্য! কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঝুলকুমারীর সে ভুল ভেঙে গেল। কক্ষের বাইরে অলিন্দ বেয়ে সেই আলোর রেখা ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে এগিয়ে এসে স্থির হল কক্ষের প্রবেশপথের সামনে।
ঝুলকুমারী দেখলেন দ্বারের সামনে মশাল হাতে এসে দাঁড়িয়েছেন মহারানা কুম্ভ। দীর্ঘদেহী কুম্ভর ছায়া এসে পড়েছে কক্ষের শেষ প্রান্তে যেখানে ঝুলকুমারী বসে আছেন সেই পর্যন্ত। তাঁকে দেখা মাত্রই চমকে উঠলেন ঝুলকুমারী। হাতের স্পর্শ দিয়ে অনুভব করে নিলেন তাঁর কোমরে লুকানো ছুরিটা ঠিক স্থানে আছে কিনা। সেরকম হলে মহারানা কক্ষে প্রবেশ করে তাঁকে স্পর্শ করার আগেই তিনি তীক্ষ্ণ ছুরি বসিয়ে দেবেন নিজের বুকে। প্রাণ থাকতে কুম্ভর আলিঙ্গনে বন্দি হবেন না ঝুলকুমারী।
কুম্ভ কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করলেন না। সেখানে দাঁড়িয়েই মশালের আলোটা উঁচু করে তুলে ধরলেন। যাতে সেই আলোকরশ্মি গিয়ে পড়ে কক্ষের শেষ প্রান্তে এক কোনায় বসে থাকা ঝুলকুমারীর দেহে।
বেশ কয়েক মুহূর্ত মশালের আলোকে ঝুলকুমারীকে নিরীক্ষণ করার পর কুম্ভ বললেন—’তুমি কি তোমার মত পরিবর্তন করেছ রাজকুমারী?’ ঝুলকুমারী কোনও উত্তর দিলেন না। মাথা নীচু করে বসে রইলেন। কুম্ভ এবার বললেন—’তোমার কোনওদিন কোনও অমর্যাদা হতে দেব না রাজকুমারী। রাজদরবারে আমার সিংহাসনের পাশে যে সিংহাসনে একদিন মহারানি মীরা বসতেন সেই সিংহাসনেই তোমাকে বসাব আমি। তোমার গর্ভে যদি পুত্রসন্তান জন্মায় তাহলে সে-ই হবে চিতোরের রাজসিংহাসনের মালিক। তুমি শুধু একবার সম্মত হও আমার প্রস্তাবে।’
কথাগুলো বলার সময় অনুরোধের সুর ফুটে উঠল মহারানার কণ্ঠে। তাঁর কথা শুনে ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকালেন ঝুলকুমারী। তারপর ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন—’আমাকে প্রলোভন দেখাবেন না মহারানা, রাঠোররাজ ছাড়া অন্য কারো গলায় বরমাল্য দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।’
‘যদি আমি তোমাকে জোর করি?’—প্রশ্ন করলেন কুম্ভ।
‘জোর করে হয়তো আপনি আমার দেহ পেতে পারেন মহারানা, কিন্তু মন নয়। সে মন আমি সমর্পণ করেছি রাঠোররাজকে। মন বিনা দেহ পেয়ে আপনি কী করবেন মহারানা! সে তো মৃতদেহেরই সামিল।’
ঝুলকুমারীর কথা শুনে একটু চমকে উঠলেন মহারানা। কিছুদিন আগে এক রাতে চিতোর প্রাসাদে ঠিক একই রকম কথা মহারানা শুনেছিলেন আরও এক নারীর মুখ থেকে—’দেহকে আপনি আটকে রাখতে পারবেন মহারানা, মনকে নয়।’
ঝুলকুমারীর কথা শুনে হঠাৎই যেন মহারানার মনে পড়ে গেল তাঁর কথা। কিছু যেন চিন্তা করলেন মহারানা। তারপর ঝুলকুমারীর উদ্দেশ্যে বললেন—’মহারানি মীরা কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর হয়ে আমাকে ত্যাগ করেছেন, পুত্র উদা সিংহাসনের লোভে আমাকে হত্যা করতে চায়। আমি আজ বড় নি:সঙ্গ। তুমি আমাকে নি:সঙ্গতা থেকে মুক্তি দাও রাজকুমারী।’
মহারানার কণ্ঠে এবার স্পষ্ট বেদনার সুর ফুটে উঠল। হয়তো তা কয়েক মুহূর্তের জন্য স্পর্শ করল ঝুলকুমারীর মনকেও।
ঝুলকুমারী বললেন—’আপনার বেদনা আমি অনুভব করতে পারছি মহারানা। কিন্তু আমি নিরুপায়। মহারানা আমাকে ক্ষমা করুন।’
ঝুলকুমারীর কথা শুনে মহারানার কণ্ঠে ক্ষোভ আর হতাশা ঝরে পড়ল। তিনি বলে উঠলেন—’কী আছে ওই রাঠোররাজের কাছে? তারচেয়ে আমি ধনে, মানে, জ্ঞানে, বিদ্যায় অনেক বড়। তবুও তুমি…।’
ঝুলকুমারীর মুখে ফুটে উঠল ম্লান হাসি। তিনি বললেন—’তা আমি জানি মহারানা। কিন্তু তার কাছে এমন এক জিনিস আছে যা অন্য কারও কাছে নেই।’
‘কী তা! যা স্বয়ং চিতোরেশ্বর কুম্ভর কাছেও নেই!’—একটু বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন কুম্ভ।
‘সে আমার প্রেম’—মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিলেন ঝুলকুমারী।
কুম্ভ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন তাঁর কথা শুনে। তারপর ধীর পায়ে হাঁটা শুরু করলেন অন্যদিকে। আবার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গেল কক্ষ। তার মধ্যে বসে ঝুলকুমারী আবার ভাবতে শুরু করলেন রাঠোররাজের কথা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকদণ্ডি বেয়ে নীচে নেমে যাওয়া ঘোড়ার খুরের শব্দে দুর্গের সবাই বুঝতে পারল কুম্ভমেরু ত্যাগ করে মহারানা রওনা হলেন চিতোরের দিকে।
সেদিনও সন্ধ্যাবেলায় মান্ডোর প্রাসাদের ছাদে উঠে দূরে অন্ধকারের মধ্যে জেগে থাকা আলোক বিন্দুর দিকে চেয়েছিলেন চন্দ্রকান্ত। আজ প্রায় তিন মাস হয়ে গেল প্রতি রাতেই রাঠোররাজ এমনই ভাবে চেয়ে থাকেন কুম্ভমেরুর দিকে। তারপর রাত কেটে গিয়ে যখন পূর্বের আকাশ লাল হতে শুরু করে, ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় ওই দীপশিখা, তখন ছাদ থেকে নীচে নেমে আসেন রাঠোররাজ। সারাটা দিন একলা বসে চিন্তা করেন দূরের ওই পাষাণপুরীতে বন্দি তাঁর বাগদত্তার কথা, তার ভাগ্যের পরিহাসের কথা। কখনও বা একাকী রোমন্থন করেন চন্দ্রালোকে ঝালোয়ার প্রাসাদে অভিসারের সুখস্মৃতি।
তারপর এক সময় দিন কেটে গিয়ে সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করে। চন্দ্রকান্ত অধৈর্য হয়ে ওঠেন কখন সন্ধ্যা নামবে, কখন ওই দূরের অন্ধকারের মধ্যে তার প্রেমের দীপশিখা জ্বলে উঠবে বলে। এভাবেই দিন কাটে রাঠোররাজের। রাঠোররাজ দূরের আলোকবিন্দুর দিকে চেয়ে ভাবছিলেন নিজের অসহায়তার কথা। তিনি সামান্য ভূস্বামী মাত্র। কীভাবে তিনি মৃত্যুপুরী থেকে উদ্ধার করে আনবেন তাঁর প্রিয়তমাকে! উদ্ধার তো দূরের কথা, ওই পাষাণপুরীতে কেমনভাবে দিন কাটাচ্ছে রাজকুমারী সে খবর পাওয়াও দুষ্কর। তাঁর কথা ভাবতে ভাবতে জলে ভিজে উঠল রাঠোররাজের দু-চোখ। ঠিক এমন সময় খস খস শব্দ শুনে পিছনে ফিরে তাকালেন রাঠোররাজ। দেখলেন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন বীরমল্ল। তাকে দেখে চন্দ্রকান্ত বুঝতে পারলেন নিশ্চয় কোনও সংবাদ আছে। চোখের জল মুছে বীরমল্লকে তিনি উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করলেন—’তাঁর কি কোনও সংবাদ পেলেন আপনি?’
বীরমল্ল বললেন, ‘না রাঠোররাজ। তবে আমার কাছে অন্য সংবাদ আছে—মহারানা চিতোরে যে স্তম্ভ নির্মাণ করাচ্ছিলেন তার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর তিনদিন পর সেই স্তম্ভ দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে চলেছেন মহারানা। সেই দিন চিতোরে যে উৎসব হবে তা উপলক্ষ্যে আগের দিন রাতে অধিকাংশ রক্ষীই কুম্ভমেরু ত্যাগ করে এক রাতের জন্য চিতোরে উপস্থিত হবে। সে সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। আপনাকে মুক্ত করে আনতে হবে ঝালোয়ার কন্যাকে।’
রাঠোররাজ বললেন—’বিশাল ওই দুর্গে কোথায় তিনি বন্দিনী আমার তো তা জানা নেই। তাঁর সন্ধান আমি কীভাবে পাব! তাঁকেও তো প্রস্তুত থাকতে হবে আমার জন্য। কিন্তু কীভাবে তিনি পাবেন সেই খবর?’
বীরমল্ল বললেন, ‘সে ব্যবস্থাও আমি ভেবে রেখেছি। আপনি শুধু আমাকে এমন একটা পায়রা দিন যে কুম্ভমেরু থেকে পথ চিনে উড়ে আসতে পারবে মান্ডোর প্রাসাদে। আপনার বার্তা আপনি তার পায়ে বেঁধে দিন। আমি সে পায়রা পৌঁছে দেব রাজকুমারীর কাছে। কুম্ভমেরু থেকে মান্ডোরে ফিরবার সময়ে সে-ও নিশ্চয়ই বহন করে আনবে রাজকুমারীর বার্তা।’
চন্দ্রকান্ত বললেন—’কিন্তু সেই পায়রা আপনি তাঁর কাছে পৌঁছোবেন কী করে?’
বীরমল্ল বললেন, ‘আমি কাল কুম্ভমেরুতে উপস্থিত হব বণিকের ছদ্মবেশে। চিতোরের উৎসবে যোগ দিতে যাবার জন্য রক্ষীদের সাজ-পোশাক অলঙ্কার ইত্যাদি কেনার প্রয়োজন আছে। কয়েকদিন ধরেই বেশ কয়েকজন বণিক দুর্গে প্রবেশ করেছে এইসব বিক্রির জন্য। তাদের দলের সঙ্গে দুর্গে প্রবেশ করব আমি।’
রাঠোররাজ বললেন—’বেশ, কাল প্রত্যুষে আমি আপনার হাতে তুলে দেব চিঠি আর পায়রা। এ কাজে যদি আপনি সফল হন তাহলে আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব আমি।’ এই বলে গভীর আবেগে রাঠোররাজ জড়িয়ে ধরলেন বীরমল্লর হাত।
সারারাত জেগে ঝুলকুমারীর উদ্দেশ্যে চন্দ্রকান্ত লিখলেন মর্মস্পর্শী চিঠি। তাঁর ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠল রাজকুমারীর প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভালোবাসার কথা, বিরহযন্ত্রণার কথা। লিখলেন তাঁর অসহায়তার কথা, লিখলেন ঝুলকুমারী যেন প্রস্তুত থাকেন, কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁকে মুক্ত করে নিয়ে আসবেন রাঠোররাজ।
৯
পরদিন ভোরে রাঠোররাজ বীরমল্লর হাতে তুলে দিলেন একটা সাদা পায়রা। তার ডানার নীচে লুকানো রইল ঝুলকুমারীর উদ্দেশ্যে লেখা সেই চিঠি। বীরমল্ল তা নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে বণিকের ছদ্মবেশে রওনা হলেন কুম্ভমেরুর দিকে।
তখন বিকাল। দিনান্তে সূর্যের রক্তিম আভা এসে পড়েছে ঝুলকুমারীর কক্ষের সামনের অলিন্দে। আর কিছুক্ষণ পরে অন্ধকার নামবে। ঝুলকুমারীকে প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে যেতে হবে দুর্গশীর্ষে। কিন্তু আজই হয়তো শেষ দিন। শরীর ভেঙে পড়েছে রাজকুমারীর, ভালো করে দাঁড়াতে পারছেন না তিনি। অতএব ভারী পিতলের জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে দুর্গশীর্ষে হয়তো আর ওঠা হয়ে উঠবে না ঝুলকুমারীর। তাঁর পরমায়ু বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। কক্ষে বসে প্রদীপ জ্বালাবার জন্য সলতে পাকাচ্ছিলেন ঝুলকুমারী।
শেষ বিকেলের বিষণ্ণ আলো তাঁর মুখে। কোথায় গেল তার সেই অপরূপ সৌন্দর্য। তার চোখ কোটরগত, গালের রক্তিম আভা উধাও হয়ে রক্তহীন ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে, জট পড়েছে তাঁর রেশমের মতো চুলে, কণ্ঠার হাড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দিনের আলোতে কোনওদিন তাঁর কক্ষে আসেননি মহারানা। এলে হয়তো তাঁকে বিবাহের বাসনা এখনই ত্যাগ করতেন। এই পাষাণপুরী শুষে নিয়েছে রাজকুমারীর সব সৌন্দর্য। দেহের ভিতর প্রাণটা শুধু অতি কষ্টে টিকে আছে। কাঁপা কাঁপা হাতে সলতে পাকাতে পাকাতে একটা কথা শুধু ভাবছিলেন ঝুলকুমারী—মৃত্যুর আগে একবারের জন্যও কি সে এসে দাঁড়াবে না আমার সামনে?
হঠাৎ একটা ঝট পট শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকালেন ঝুলকুমারী। দেখলেন কক্ষের সামনে অলিন্দে এসে বসেছে একটা সাদা পায়রা। এতে অবাক হলেন রাজকুমারী। কুম্ভমেরুতে কোনও পায়রা নেই। বাজপাখির ভয়ে একটা চড়ুই পাখি পর্যন্ত প্রবেশ করে না এই দুর্গে। তাহলে পায়রা কীভাবে এল? সে কি পথ ভুলে প্রবেশ করেছে এই মৃত্যুপুরীতে?
ঝুলকুমারী দেখলেন সে খালি ডানা ঝাপটাচ্ছে, কিন্তু উড়তে পারছে না। সে-ও কি তবে ঝুলকুমারীর মতো এই পাষাণপুরীতে বন্দিনী? বাঁধা আছে তার ডানা? ‘তবে তাকে ডানা খুলে মুক্ত করে দিই আকাশে। নইলে এই মৃত্যুপুরীতে সে-ও আর বেশি দিন বাঁচবে না।’
তাকে মুক্ত করার জন্য রাজকুমারী অতিকষ্টে অলিন্দে এসে ধরে ফেললেন পায়রাটাকে। রাজকুমারী দেখলেন তিনি যা ভেবেছেন ঠিক তাই। পায়রার ডানা দুটো বাঁধা। রাজকুমারী তার বাঁধন খুলতে যেতেই চোখে পড়ল তার পালকের নীচে সযত্নে বাঁধা আছে একটা ভাঁজ করা কাগজের টুকরো। সেটা দেখা মাত্রই তিনি পায়রাটাকে নিয়ে অলিন্দ ছেড়ে ভিতরে প্রবেশ করে দ্বারের আগল টেনে দিলেন। তারপর জ্বালালেন প্রদীপ। আলোকিত হয়ে উঠল কক্ষ। কাগজের টুকরোটা নিয়ে তার ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলেন তিনি। আর তার পরেই চমকে উঠলেন। এ যে রাঠোররাজের হস্তাক্ষর। চিঠিটা বুকে জড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। তারপর পড়তে শুরু করলেন সেই চিঠি।
চোখের জলে ভেসে যেতে লাগল তার বুক। চিঠি পড়া শেষ হলে রাজকুমারী চোখের জল মুছে ভাবতে বসলেন কীভাবে রাঠোররাজের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখবেন তিনি? তার কাছে তো কাগজ, কালি, লেখনী কিছুই নেই! কিছুক্ষণ ভাববার পর ঝুলকুমারী একটা উপায় বার করলেন। কোমর থেকে ছুরি বার করে রাজকুমারী চিরে ফেললেন তার বুক। টপ টপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল সেখান থেকে। ছুরির ডগাতে সেই রক্ত নিয়ে ঝুলকুমারী রাঠোররাজের চিঠির ওপরে বড় বড় হরফে লিখলেন গুটি কয় কথা—’জীবন মরণে আমি তোমারই থাকব রাঠোররাজ। মহারানা কোনওদিনই পাবে না আমাকে। আমৃত্যু ঝুলকুমারী তার প্রিয়তমের প্রতীক্ষায় থাকবে।’
চিঠি লেখা শেষ হলে সেই চিঠি আবার বেঁধে দিলেন পায়রার ডানার ভিতরে। ঝুলকুমারী এরপর পায়রাটাকে কক্ষের ভিতরে রেখে ঝুলন্ত প্রদীপ মাথায় তুলে নিয়ে টলমল পায়ে চললেন দুর্গের ছাদে। আজ তার বড্ড দেরি হয়ে গেছে। রাঠোররাজ নিশ্চয় মান্ডোর প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে ওই প্রদীপশিখা দেখার জন্য প্রতীক্ষা করছেন।
পরদিন ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙল ঝুলকুমারীর তখন গবাক্ষ দিয়ে ভোরের আলো এসে প্রবেশ করেছে কক্ষে। সেই আলোকেরশ্মি দেখে বাইরের খোলা আকাশে উড়ে যাবার জন্য ডানা ঝাপটাচ্ছে পায়রাটা। ঝুলকুমারী উঠে বসতে গেলেন কিন্তু তাঁর দেহে যেন শক্তি নেই। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর উঠে বসলেন তিনি, তারপর এক সময় উঠে দাঁড়ালেন। পায়রাটাকে নিয়ে দেয়ালে ভর দিয়ে দ্বারের আগল খুলে অতি কষ্টে উপস্থিত হলেন অলিন্দে। মাথার উপর চোখে পড়ল সুনীল আকাশ।
অনেকদিন পর এমন নীল আকাশ দেখলেন ঝুলকুমারী। মনে হল সে যেন হাতছানি দিচ্ছে তাঁকে। কিন্তু বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না তিনি। তাঁর শরীরের সব শক্তি যেন নি:শেষ হয়ে আসছে। বাঁধন খুলে দিয়ে তিনি নীল আকাশের বুকে উড়িয়ে দিলেন পায়রাটা। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে মাথার উপর আকাশে এক পাক খেয়ে দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেল সে। কোনওরকমে তাঁর শীর্ণ দেহটা নিয়ে কক্ষের ভিতর প্রবেশ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ঝুলকুমারী।
মান্ডোর প্রাসাদে ফিরে যাবে বলে দিক নির্ধারণের জন্য যখন কুম্ভমেরুর মাথায় পাক খাচ্ছিল পায়রাটা, তখন এক ছোট্ট ঘটনা ঘটল। দুর্গের এক রক্ষী প্রতিদিনের মতো সেদিনও খুলে ছিল শিকারি বাজের খাঁচা। কুম্ভমেরুর আকাশে পায়রাটাকে উড়তে দেখে বাজ তাড়া করল তাকে। কোনওরকমে পায়রাটা বাজের হাত থেকে রক্ষা পেল ঠিকই। কিন্তু পালাতে গিয়ে দিক ভুল করে ফেলল সে। মান্ডোরের দিকে না গিয়ে সে সোজা উড়ে গেল চিতোরের দিকে। ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে সে আশ্রয় নিল চিতোর গড়ের সবচেয়ে উঁচু স্থান, একেবারে কুম্ভ-নির্মিত স্তম্ভের শীর্ষদেশে।
দ্বিপ্রহরে পাত্র-মিত্র সভাসদ পরিবৃত হয়ে মহারানা মনে মনে এ স্তম্ভের নাম ঠিক করে রাখলেন—’বিজয় স্তম্ভ’। কুম্ভর মন আজ খুশিতে ভরে উঠেছে। তাঁর স্বপ্ন আজ বাস্তবের রূপ নিয়েছে। চিতোর গড়ের আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তাঁর স্বপ্নের সৌধ, মহারানার অক্ষয়কীর্তি। যা মৃত্যুর পরেও অমর করে রাখবে মহারানা কুম্ভকে। হাজার বছর পরেও মানুষ এই স্তম্ভর নীচে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধায় মাথা নত করবে কুম্ভর উদ্দেশ্যে।
স্তম্ভ-চত্বরে দাঁড়িয়ে পরদিন যে যজ্ঞানুষ্ঠান হবে সে বিষয়ে সভাসদদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন মহারানা। মাঝে মাঝে হাসি তামাসাও করছিলেন তার সঙ্গীদের সঙ্গে।
ঠিক সেই সময় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে স্তম্ভর মাথায় এসে বসল সেই পায়রাটা। মহারানা তাকে দেখতে পেয়ে বললেন—’এ আবার কোথা থেকে এল!’ মহারানার কথা শুনে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিদূষক বললেন—’ও মনে হয় স্বয়ং ধর্মরাজ, পায়রার রূপ ধরে আপনাকে আশীর্বাদ জানাতে এসেছেন।’
মহারানা তার কথা শুনে বললেন—’দেখবেন, কাল যখন আমি যজ্ঞ করতে বসব তখন উনি আবার ওপর থেকে আশীর্বাদস্বরূপ আমার মাথায় বিষ্ঠা ত্যাগ না করেন।’
মহারানার রসিকতায় সভাসদদের দল হেসে উঠলেন।
আরও কিছুক্ষণ সভাসদ-পরিবৃত হয়ে মহারানা দাঁড়িয়ে রইলেন সেই স্থানে। কাল ভোর থেকেই চিতোরবাসীরা মেতে উঠবে উৎসবে। স্তম্ভ-চত্বরেও প্রচুর লোক সমাগম হবে। মহারানা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা কাল তিনি দান করবেন গরিব-দু:খীদের। কী কী কাজ বাকি আছে সেসব আলোচনা তিনি সেরে নিলেন মন্ত্রীদের সঙ্গে।
তারপর স্তম্ভ-চত্বর ত্যাগ করে ঘোড়ার পিঠে চেপে ফিরে চললেন প্রাসাদের দিকে। পথে পড়ল কুম্ভশ্যাম মন্দির। একটা নি:সঙ্গ ময়ূর শুধু বসে আছে তার প্রাচীরের ওপর। কয়েক মুহূর্তের জন্য সেখানে থামলেন কুম্ভ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার রওয়ানা হলেন প্রাসাদের উদ্দেশ্যে।
প্রাসাদে ফিরে নিজের শয়নকক্ষের পালঙ্কে শুয়ে কী কী কাজ বাকি রয়ে গেল তা চিন্তা করতে লাগলেন মহারানা। একটা জরুরি কাজ অবশ্য বাকি আছে মহারানার। আজ রাতে তিনি যাবেন কুম্ভমেরুতে। শেষ বারের মত তিনি ঝুলকুমারীকে প্রশ্ন করবেন, তিনি তাঁর প্রস্তাবে সম্মত কিনা। যদি তিনি সম্মত হন তাহলে তিনি আজই সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন চিতোরে। আর যদি তিনি সম্মত না হন তাহলে তাঁকে মুক্তি দেবেন কুম্ভ। তাঁকে আর জোর করে ধরে রাখবেন না মহারানা।
নিজের জীবনে আর কোনও কলঙ্ক রাখতে চান না কুম্ভ। সব কিছু তিনি আজ মুছে ফেলতে চান। এমনকী মীরার প্রতিও তাঁর আজ আর কোনও রাগ ক্ষোভ নেই। হয়তো সে আজ চিতোরে থাকলে ভালো হত। কুম্ভশ্যাম মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মুহূর্তের জন্য এ কথাটাই মনে এসেছিল কুম্ভর। কুম্ভ স্থির করেছেন, যে-ক’টা দিন তিনি আর বাঁচবেন সে-ক’টা দিন তিনি অতিবাহিত করবেন চিতোর গড়ের মানুষের কল্যাণে। যাতে মহারানা হাম্বীরের মতো চিতোর গড়ের মানুষের হৃদয়ে গাঁথা হয়ে যায় তার নাম।
পালঙ্কে শুয়ে নানা কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন মহারানা কুম্ভ। যখন তাঁর ঘুম যখন ভাঙল তার অনেক আগেই সন্ধ্যা নেমে গেছে। ঘুম ভাঙার পর তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হতে শুরু করলেন দুর্গ ছেড়ে বাইরে যাবার জন্য।
১০
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই মান্ডোর প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে কুম্ভমেরুর দিকে পায়রা আসার প্রতীক্ষা করেছিলেন রাঠোররাজ চন্দ্রকান্ত। কিন্তু এক সময় সকাল গড়িয়ে দুপুর হল, দুপুর গড়িয়ে বিকাল হল কিন্তু পায়রা ফিরে এল না। তাহলে কি ঝুলকুমারী বার্তা পাঠালেন না! নাকি পথ ভুল করল পায়রা! এমন তো হবার কথা নয়। রাঠোররাজের মন ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠল। এক সময় শেষ বিকালের লাল আলোটুকুও মুছে গেল আকাশের বুক থেকে। রাঠোররাজ বুঝতে পারলেন তাঁর পায়রা আর ফিরবে না।
অন্ধকার নেমে আসার পরও রাঠোররাজ তাকিয়ে রইলেন কুম্ভমেরুর দিকে। প্রতিদিনের মতো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে ওই বুঝি কুম্ভমেরুর শীর্ষে জ্বলে উঠল সেই অনির্বাণ দীপশিখা। কিন্তু সেদিন কোনও আলো জ্বলে উঠল না কুম্ভমেরুতে। অনেকক্ষণ ধরে সেদিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করার পর এক সময় চন্দ্রকান্ত ছাদ থেকে নীচে নেমে এলেন। তারপর পোশাক পালটে প্রবেশ করলেন প্রাসাদেরই এক কক্ষে। সেখানে দেওয়ালের গায়ে ঝোলানো আছে বিভিন্ন রকমের তরবারি। এসব অস্ত্র কোনও দিন ব্যবহার করেননি চন্দ্রকান্ত। কারণ তিনি কোনওদিন যুদ্ধেই যাননি। জীবন কাটিয়েছেন তিনি পায়রা উড়িয়ে, কাব্য আর সঙ্গীত চর্চা করে। তরবারি ধরার কোনও প্রয়োজন হয়নি তার, দেওয়ালে ঝোলানো অস্ত্রগুলো তাঁর পিতা পিতামহের-আমলের।
এক সময় চিতোরের রানাদের হয়ে এসব অস্ত্র-হাতেই যুদ্ধে যেতেন তাঁরা। দীর্ঘ দিনের অব্যবহারের ফলে তাতে মরচে ধরে গেছে। তারই একটা খুলে নিয়ে কোমরে বেঁধে নি:শব্দে প্রাসাদ ছেড়ে ঘোড়ায় চেপে চন্দ্রকান্ত রওনা হলেন কুম্ভমেরুর দিকে। মনে মনে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, ঝুলকুমারীকে না নিয়ে এ প্রাসাদে ফিরবেন না তিনি।
ঠিক একই সময় কালো ঘোড়ায় চেপে চিতোর ছেড়ে কুম্ভমেরুর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন আরও একজন। চিতোর থেকে কুম্ভমেরুর দূরত্ব অনেকটা। কালো ঘোড়ার সওয়ার হিসাব করে দেখলেন প্রথম প্রহর নাগাদ তিনি পৌঁছে যাবেন কুম্ভমেরুতে। সূর্যোদয়ের আগেই তাঁকে আবার ফিরে আসতে হবে চিতোরে। কিন্তু তিনি কি একা ফিরবেন?
আকাশে আজ চাঁদ নেই, চারপাশে শুধু জমাট বাঁধা অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে দুই অশ্বারোহীই আপন আপন চিন্তা নিয়ে এগিয়ে চললেন কুম্ভমেরুর দিকে।
চন্দ্রকান্তই আগে উপস্থিত হলেন দুর্গের কাছে। এত বড় দুর্গ যেন অন্ধকারের মধ্যে একদম মিশে গেছে। দুর্গ-প্রাকারের ওপরে শুধু দু-এক জায়গায় মশালের আলো ক্ষীণভাবে জ্বলছে। এ মৃত্যুপুরী আজ প্রহরী শূন্য। প্রধান তোরণের সামনে বসে শুধু ঢুলছে দুজন দ্বাররক্ষী। অন্ধকারের মধ্যে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠে তিনি কুম্ভমেরুর পেছনের প্রাকারের নীচে এসে দাঁড়ালেন। তারপর একটা স্তম্ভের আড়ালে ঘোড়া বেঁধে রেখে দুর্গ-প্রাকারের পাথুরে দেওয়ালের খাঁজ বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলেন। এক সময় তিনি পা রাখলেন কুম্ভমেরুর ভিতরে। শত দু:খের মধ্যেও এবার মনে মনে কুম্ভর উদ্দেশ্যে হাসলেন রাঠোররাজ।
তিনি শুনেছিলেন কুম্ভর অনুমতি বিনা স্বয়ং যমরাজও নাকি এ দুর্গে পা রাখতে সাহস করেন না। ঝুলকুমারী বন্দি আছেন দুর্গের মাথায় এক কক্ষে। বীরমল্লর দেওয়া পথনির্দেশ মতো অন্ধকার হাতড়ে পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে একের পর এক কক্ষ-অলিন্দ অতিক্রম করে এক সময় পৌঁছে গেলেন সেই কক্ষের সামনে। তার ভিতর জমাট বাঁধা অন্ধকার বিরাজ করছে। নিস্তব্ধ অন্ধকার সেই কক্ষে প্রবেশ করে চন্দ্রকান্ত প্রথমে ভাবলেন কক্ষ চিনতে তিনি ভুল করেননি তো!
মৃদু স্বরে তিনি বললেন—’ঝুলকুমারী, আমি এসেছি।’ কিন্তু কোনও উত্তর ভেসে এল না অন্ধকারের মধ্য থেকে। চন্দ্রকান্তর কাছে একটা ছোট প্রদীপ ছিল। চকমকি পাথর ঠুকে চন্দ্রকান্ত জ্বালিয়ে ফেললেন প্রদীপটা। একটা মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়ল কক্ষে। রাঠোররাজ দেখতে পেলেন পাথুরে মেঝের উপর পড়ে আছে ঝুলকুমারী। প্রদীপ তাড়াতাড়ি মাটির ওপর নামিয়ে রেখে চন্দ্রকান্ত দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলেন ঝুলকুমারীর দেহ। বলতে লাগলেন—’ঝুলকুমারী-প্রিয়তমা! চোখ খোলো! দেখো আমি তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে এসেছি।’
ঝুলকুমারী চোখ খুললেন না। তাঁর শুষ্ক কোটর থেকে ঝরে পড়ল শুধু কয়েক ফোঁটা জল। ওই জলবিন্দু ক’টা মনে হয় রাঠোররাজের জন্যই সঞ্চয় করে রেখেছিলেন ঝুলকুমারী। রাঠোররাজ বারবার তাঁর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন, চুম্বন করতে লাগলেন তাঁর ওষ্ঠে, কপালে, এক সময় তাঁর খেয়াল হল বরফের মতো ঠান্ডা ঝুলকুমারীর দেহ।
রাত্রি এক প্রহর নাগাদ মহারানা কুম্ভ এসে উপস্থিত হলেন কুম্ভমেরুতে। তিনি প্রথমে দুর্গে প্রবেশ করলেন না। হঠাৎ তার মনে ইচ্ছে হল, ভিতরে প্রবেশ করার আগে দুর্গের চারপাশটা একবার ঘুরে দেখা যাক। দুর্গ-প্রাকারকে বেড় দিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন তিনি। দুর্গের পিছনে এসে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল তাঁর ঘোড়া। সে আর কিছুতেই নড়তে চায় না। খালি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে পা ঠুকতে লাগল আর ঘাড় নাড়তে লাগল। কিছুদিন ধরেই গরম হয়ে আছে কুম্ভর ঘোড়া। অভিজ্ঞ কুম্ভ বুঝতে পারলেন নিশ্চয় কোনও ঘোটকীর গন্ধ পেয়েছে সে। তাই সে আর এগোতে চাচ্ছে না। কিন্তু এত রাতে এখানে ঘোটকী কোথা থেকে আসবে!
অন্ধকারের মধ্যে চারিদিকে দেখবার চেষ্টা করলেন কুম্ভ। ঠিক এমন সময়ে একটা থামের আড়ালে মৃদু খস খস শব্দ শুনে সেদিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। দেখতে পেলেন থামের আড়ালে বাঁধা আছে ঘোটকী। সঙ্গে সঙ্গে কুম্ভ বুঝতে পারলেন, তাকে এখানে বেঁধে রেখে দুর্গ-প্রাকার বেয়ে নিশ্চয় কেউ কুম্ভমেরুতে প্রবেশ করেছে। কিন্তু সে কে! কুম্ভ আর দেরি করলেন না, নিজের ঘোড়ার পিছনে চাবুক চালিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটলেন কুম্ভমেরুর প্রবেশপথের দিকে।
ঘোড়ার খুরের শব্দে তন্দ্রা ভেঙে গেল দ্বাররক্ষীদের। তারা দেখল মহারানা কুম্ভ এসে দাঁড়িয়েছেন দুর্গ-তোরণের সামনে। বিস্মিত দ্বাররক্ষীরা সঙ্গে সঙ্গে খুলে দিল তোরণ। ভিতরে প্রবেশ করে লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে মহারানা ছুটলেন ওপরে যাবার রাস্তায়। ঝুলকুমারী যে কক্ষে বন্দি আছেন সেই কক্ষ সংলগ্ন অলিন্দে উপস্থিত হয়ে একটু থমকে দাঁড়ালেন। কক্ষের ভিতর থেকে ভেসে আসছে একটা হালকা আলো। মহারানা নি:শব্দে গিয়ে দাঁড়ালেন কক্ষের সামনে।
মহারানা দেখলেন, মাটির ওপর বসে ঝুলকুমারীর দেহ কোলে নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁর কণ্ঠে চুম্বন করছেন রাঠোররাজ। কিন্তু তাঁরা কেউই নড়ছেন না। ঠিক যেন চুম্বনরত পাথরের মূর্তি তাঁরা। মুহূর্তের পর মুহূর্ত কেটে যেতে লাগল মহারানা তাকিয়ে রইলেন সেই পাথরের মূর্তি-যুগলের দিকে। এক সময় নিজের অজান্তেই চৌকাঠ ডিঙিয়ে প্রবেশ করলেন কক্ষের ভিতর।
মহারানার ছায়া গিয়ে পড়ল মূর্তিযুগলের চুম্বনরত মুখের ওপর। আর সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে তাকালেন রাঠোররাজ। ঝুলকুমারীর দেহ মাটিতে গড়িয়ে পড়ল কোল থেকে। মহারানা বুঝতে পারলেন ও-দেহে আর প্রাণ নেই।
মহারানাকে দেখতে পেয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন রাঠোররাজ। জ্বলে উঠল তাঁর দুই চোখ। বিদ্যুৎগতিতে কোমর থেকে তরবারি খুলে নিয়ে রাঠোররাজ আক্রমণ করলেন তাঁকে। মহারানা কৌশলে এড়িয়ে যেতে লাগলেন রাঠোররাজের তরবারির আঘাত। অপটু হাতে পাগলের মতো মহারানাকে লক্ষ্য করে তরবারি চালাতে লাগলেন রাঠোররাজ। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলেন না মহারানা। তরবারির আঘাত এসে লাগল তাঁর বাহুতে। ভোঁতা তরবারির আঘাতে তেমন কিছু ক্ষতি হল না মহারানার, কিন্তু রক্তপাত হতে শুরু করল তাঁর বাহু থেকে। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না মহারানা। তাঁর রাজরক্ত টগবগ করে উঠল। তিনি কোষমুক্ত করলেন নিজের তরবারি।
রক্ত দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে গেছিলেন রাঠোররাজও। তিনি আবার মহারানাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হতেই বিদ্যুৎগতিতে রাঠোররাজের কণ্ঠনালি ছিন্ন করে বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল মহারানা কুম্ভর তরবারি। প্রিয়তমা ঝুলকুমারীর দেহর পাশে গড়িয়ে পড়ল রাঠোররাজের দেহ। মহারানা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন সেখানে। তারপর ধীরে কক্ষ ত্যাগ করলেন। কেউ কিছু জানল না। শেষ রাতে নি:শব্দে চিতোরে ফিরে এলেন মহারানা।
ভোরবেলা গোমুখ কুণ্ডের পবিত্র জলে স্নান সেরে সূর্য-প্রণাম করে মহারানা পদব্রজে চললেন স্তম্ভ-চত্বরে। চিতোরের সমস্ত মানুষ ভোরবেলা উপস্থিত হয়েছেন সেখানে। রক্ষী-পরিবৃত হয়ে মহারানা স্তম্ভ-চত্বরে প্রবেশ করতেই সকলে মহারানার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। নীল আকাশের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মহারানা কুম্ভর অতুলনীয় কীর্তি—বিজয় স্তম্ভ। আগামী দিনের পৃথিবীকে সে স্মরণ করাবে মহারানার শৌর্য-বীর্যের গৌরব গাথা।
স্তম্ভের ঠিক নীচেই যজ্ঞস্থল। মহারানা সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই রাজপুরোহিত তাঁর কপালে এঁকে দিলেন চন্দনের টিকা। যজ্ঞে বসার আগে তরবারি শুদ্ধ করতে হবে। সেনাপতি নারায়ণ সিংহ মহারানার তরবারি খাপ থেকে টেনে বার করতেই হঠাৎ তার চোখে পড়ল তার গায়ে লেগে থাকা শুকনো রক্তের দাগ। তা কারো চোখে পড়ার আগে মন্ত্রী তাড়াতাড়ি পবিত্র গঙ্গাজল দিয়ে মুছে ফেললেন সেই দাগ। বেজে উঠল শঙ্খধ্বনি, যজ্ঞস্থলে বসলেন মহারানা। মন্ত্রোচ্চারণ করতে শুরু করলেন রাজপুরোহিত। জ্বলে উঠল যজ্ঞের আগুন।
দীর্ঘক্ষণ ধরে চলল যজ্ঞ, পূজাপাঠ। এক সময় হাজার শঙ্খধ্বনির মধ্যে মহারানা এ স্তম্ভ উৎসর্গ করলেন ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে। এক সময় সম্পন্ন হল সব কাজ।
যজ্ঞের আগুন তখন নিভু নিভু। মহারানা উঠে দাঁড়াতে যাবেন ঠিক এমন সময় স্তম্ভের মাথার উপর থেকে মহারানার সামনে খসে পড়ল একটা মৃত পায়রা। এ পায়রাকেই মহারানা কাল স্তম্ভের মাথার উপর উড়ে এসে বসতে দেখেছিলেন। মহারানা দেখতে পেলেন মৃত পায়রার দেহ থেকে বেরিয়ে পড়েছে একটা কাগজের টুকরো। সেটা নিয়ে তার ভাঁজ খুলে ফেললেন মহারানা। তাঁর চোখের সামনে ফুটে উঠল রাঠোররাজের উদ্দেশ্যে লেখা ঝুলকুমারীর সেই চিঠি। শব্দগুলো মনে মনে পাঠ করলেন মহারানা। তারপর সেই কাগজের টুকরো যজ্ঞের আগুনে নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়ালেন।
সমবেত চিতোরবাসী চিৎকার করে বলে উঠল—জয় চিতোরেশ্বরের জয়, জয় মহারানা কুম্ভর জয়।
ঠিক তখন চিতোর থেকে অনেক দূরে বৃন্দাবন নামে এক প্রাচীন জনপথের পুণ্য ধূলিকণা পায়ে মেখে পথে পথে মীরা গেয়ে বেড়াচ্ছেন—
‘সাজন সুধ জ্যো জানে লীজে হো।
তুমি বন মেরে অন্তর ন কোঈ।।
…মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর
মিল বিছুড়ন নহি কীজে হো।।’