একা একা – ৯

০৯.

কয়েকটা দিন পরেই আবার: নীহার রান্নাঘরে কী একটা কাজ সারতে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে দেখলেন শরদিন্দু নীচে নেমে এসেছেন।

কোথাও বেরুচ্ছ নাকি?

মাথা নাড়লেন শরদিন্দু, কোথাও যাচ্ছেন না। বাইরে বেরুবার বেশভূষাও তাঁর নয়। বিকেলের পর আজকাল তিনি কিছুক্ষণের জন্যে রাস্তায় বেরোন। অল্প একটু পায়চারি করেন, চিলড্রেনস পার্কে দাঁড়িয়ে থাকেন সামান্য, সিগারেট-টিগারেট কিনতে এগিয়ে যান খানিকটা, ওষুধপত্রও কেনেন টুকটাক, তারপর আবার বাড়ি ফিরে আসেন।

আজ তিনি কোথাও বেরোননি। সকাল থেকেই শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। কাঁধের দিকে ব্যথা হয়েছে, মাথাটাও ধরাধরা।

শরদিন্দু বারান্দার বসার জায়গায় এসে বসলেন।

নীহার যাবেন গা ধুতে, তারপর পুজোপাঠ। শরদিন্দুকে বসতে দেখে তিনি কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন।

তোমার কি শরীরটা আরও খারাপ লাগছে? নীহার শুধোলেন।

না।

নীচে নেমে এলে হঠাৎ তাই ভাবলাম—

না, আমার কিছু হয়নি। এমনি এলাম।

নীহার বললেন, তুমি তা হলে বসো, আমি গা ধুয়ে নিই।

শরদিন্দু সোফায় বসে থাকলেন। নীহার নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন, প্রায় যখন ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত গিয়েছেন, শরদিন্দু ডাকলেন।

শ্যামরা কোথায় গিয়েছে?

নীহার চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়েই জবাব দিলেন, কোথায় আর যাবে? এদিকেই আছে কোথাও।

তোমায় কিছু বলে যায়নি?

বলল তো, বেড়াতে যাচ্ছি।

কলকাতায় এসে শ্যামের বাইরে ঘুরে বেড়ানোর নেশা হয়েছে, শরদিন্দু আস্তে করে বললেন। একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, কটা বাজল এখন? সে-দিনও ঝড়-টড় খেয়ে দেরি করে ফিরল।

সন্ধে তো হয়ে গিয়েছে। সাড়ে ছটা সাতটা হবে।

শরদিন্দু আর কিছু বললেন না। নীহার ঘরে ঢুকে গেলেন।

.

নীহার গা ধুতে চলে যাবারও পরে তনুরা ফিরল।

শরদিন্দু ছেলের সাজটা লক্ষ করলেন। তনু ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছে। অন্য রকম দেখতে লাগছিল, নতুন নতুন; ভালও লাগছিল। তনু যে কখনও ধুতি-পাঞ্জাবি পরেনি, তা নয়। খুব কম, বছরে এক-আধ দিন। নিজেদের বাড়িতে গেলে মাঝেসাঝে পরে। শখ করে। ধুতি পরার অভ্যেসটা করে উঠতে পারেনি বলে ধুতি পরলেই তাকে খুব আড়ষ্ট দেখাত। তনুকে আজ শুধু আড়ষ্ট দেখাল না, বাবুবাবু দেখাচ্ছিল।

রিনিকেও শরদিন্দু নজর করলেন; সাদা খোলের শাড়ি, পাড়টা সোনা রঙের, গায়ের জামাটা লাল, চুলের বিনুনিটা লম্বা হয়ে ঝুলে রয়েছে। রিনির পরিষ্কার মুখ, বড় বড় চোখ, নিটোল থুতনি, সারা মুখে খুব একটা খুশি মাখানো।

নীহারের সঙ্গে তাঁর মেয়ের যতটা মিল, আবার অমিলও ততটা। নীহারকে ওই বয়সে এতটা ছেলেমানুষ হয়তো দেখাত না, কিন্তু মেয়ের চেয়ে কম সুন্দর কি? শরদিন্দুর মনে হল না, নীহার কিছু কম সুন্দর ছিল।

রিনিকে সুন্দর হাসিখুশি সজীব দেখানোর জন্যে শরদিন্দু যে অখুশি হলেন তা নয়, কিন্তু তাঁর যেন কোথাও একটা আপত্তি ছিল। ছেলে ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছে বলে তাঁর নিশ্চয় অসন্তুষ্ট হবার কারণ নেই, তবু শরদিন্দু খুব প্রসন্ন হলেন না।

ছেলের দিকে তাকিয়ে শরদিন্দু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলে?

তনু রিনির দিকে তাকাল এক পলক, তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, রিনির বন্ধুর বাড়ি।

বন্ধুর বাড়িতে এত দেরি?

তনু আবার রিনির দিকে তাকাল। তারপর বাবাকে বলল, রিনির বন্ধু আমাদের সিনেমা দেখতে নিয়ে গিয়েছিল।

সিনেমা?

 তনু বলল, কাছেই। এই দিকেই।

শরদিন্দু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, সিনেমায় তোমার চোখে স্ট্রেন হয়। তুমি তো সিনেমা দেখ না। ডাক্তারের বারণ ছিল। একটু থামলেন শরদিন্দু। তারপর আবার বললেন, কলকাতায় তুমি সিনেমা দেখতে আসনি।

রিনি যেন খানিকটা চঞ্চল হল। তনুকে বাঁচাবার মতন ভাব করে বলল, বইটা খুব ভাল মামা। ওর চোখের কষ্ট হলে আমরা চলে আসতাম।

কথাটা শরদিন্দু যেন শুনলেন না। ছেলেকেই বললেন, তুমি চোখের ওপর বড় স্ট্রেন করছ, শ্যাম। এত ঘোরাঘুরি, বেড়ানো। ডাক্তার তোমায় চোখটা অ্যাডজাস্ট করে নিতে অ্যাডভাইস করেছেন। বাট দ্যাট ডাজ নট মিন দিস ওভার স্ট্রেনিং।

তনু চুপ। রিনিও চুপ। তনুকে আজ রিনি খুব মশলা-টশলা দিয়ে বিরাট একটা পান খাইয়েছে, তনুর ঠোঁট লাল হয়ে ছিল। রিনির ভয় হল, পানখাওয়া ঠোঁট দেখলে হয়তো মামা আরও কিছু বলবেন। সে চোখের ইশারায় তনুকে ঠোঁট চেপে রাখতে বলল।

শরদিন্দু অবশ্য ছেলেদের দিকে আর তাকাচ্ছিলেন না। অন্য দিকে তাকিয়েই বললেন, চোখ দুটো তোমার। তোমাকেই তার যত্ন নিতে হবে। আমি শুধু ডাক্তার দেখিয়ে আর কী করব বলো? তোমার নিজেরই কেয়ারফুল হওয়া উচিত।

রিনি তার ঘরের দিকে চলে গেল। তনুও আস্তে আস্তে সরে গেল। শরদিন্দু বারান্দায় চুপ করে বসে থাকলেন।

.

নীহার পুজোটুজো সেরে ফিরে এলেন। রিনি কাপড় বদলে মার চা করতে চলে গিয়েছিল।

নীহার বললেন, তোমার ইসবগুলের শরবতটা এনে দিই?

দাও।

 তুমি এখানেই বসবে? না ওপরে যাবে?

এখানেই বসি। শরদিন্দু বললেন প্রথমে। নীহার চলে যাচ্ছে দেখে আবার কী মনে করে বললেন, আমি ওপরেই যাচ্ছি।

.

নারানকে সিঁড়ির দিকের বাতিটা পালটে দিতে বলে রিনি তনুর ঘরে এল। তনু বিছানায় চুপ করে শুয়ে আছে। ঘরে নীল রঙের বাতিটা জ্বলছিল।

রিনি এসে বলল, তোমার মতন ক্যাবলা আর আমি দেখিনি।

তনু কোনও জবাব দিল না।

আমরা সিনেমায় গিয়েছি বলার কী দরকার ছিল? আশ্চর্য!

তনু বলল, বাবা জিজ্ঞেস করল, বলব না?

বলে কেমন শিক্ষাটা হল।

ঝুট বলব?

ইস রে আমার যুধিষ্ঠির! রিনি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, তুমি যুধিষ্ঠিরও নও। যুধিষ্ঠিরও তোমার চেয়ে বুদ্ধিমান ছিল। দরকার পড়লে, অশ্বত্থামা হত ইতি গজ বলতে হয় বুঝলে?

অশ্বত্থামা কী?

রিনি খিলখিল করে হেসে উঠল। তুমি অশ্বত্থামা জান না। কী বুদ্ধ রে?

 রিনি অশ্বত্থামার গল্পটা শুনিয়ে দিল। বলল, বুদ্ধি থাকলে সবই ম্যানেজ করা যায়, বুঝলে শ্যামচন্দর।

তনু বিছানায় উঠে বসেছিল। হাসছিল। বলল, তুমি পিসির কাছে যা বলো সবই অশ্বত্থামা?

 অনবরত বলি। তোমার পিসি কম চালাক নাকি? …দাও, চোখে ওষুধটা আগে দিয়ে দিই। রিনি ওষুধ খুঁজতে টেবিলের দিকে চলে গেল।

নীহারপিসি খুব ভাল।

হবে না? আমার মা!

 আমার বাবাকে কি তুমি খারাপ ভাবছ?

রিনি জিব কেটে ফেলল। এ রাম–তুমি কী?

 বাবাও খুব ভাল। তবে আমাকে নিয়ে বাবার সব সময়েই চিন্তা। বাবা বড় ভাবে।

রিনি ততক্ষণ ওষুধ এনেছে। চোখে ওষুধ দিয়ে দিল। তনু উঁচু মুখ করে থাকল, চশমাটা তার হাঁটুর পাশে। ওষুধের জন্যে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল তনুর।

তোমার চোখে কষ্ট হয়েছে সিনেমা দেখতে? রিনি জিজ্ঞেস করল!

না কষ্ট নয়। মাঝে মাঝে সাম সরট অফ ফিলিং হচ্ছিল, হয়তো নার্ভে লাগছিল।

তখন তো বললে না, বললে উঠে আসতুম।

তনু হাতের আঙুলে চোখের জল মুছল। আমি সিনেমা দেখি না। রেয়ার। আমাদের ওখানে একটা হাউস আছে। হিন্দি পিকচার্স হয় শুধু। বাংলা পিকচার দেখার আমার খুব ইচ্ছে ছিল। পিকচারটা ভেরি নাইস।

ঘোড়ার ডিম! তোমার কোনও টেস্ট নেই।

 এবারে জামা দিয়েই তনু চোখের জল মুছতে যাচ্ছিল। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে রিনি তার শাড়ির আঁচলটা দিয়ে জল মুছিয়ে দিল নিজেই।

তনু চশমাটা তুলে নিল। রিনি তখনও তনুর দিকে হেলে রয়েছে।

কী যেন দেখছিল রিনি তনুর মুখের দিকে তাকিয়ে। তোমার ঠোঁট দুটো কী লাল হয়ে রয়েছে।

পানটায় খুব টেস্ট ছিল।

তোমার ঠোঁট দুটোও ভাল। রিনি হেসে উঠল জোরে।

তনু যেন লজ্জা পেয়ে গেল। চশমাটা পরে নিয়ে রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার মুখ অনেকটা আমার মার মতন। লোকে বলে।

ছেলেরা মার মুখ পেলে সুখী হয়।

মেয়েরা?

বাপের মুখ। আমার খানিকটা মার খানিকটা বাবার। আমি হাফ সুখী হাফ অসুখী হব। রিনি মজা করে বলল, দেখছ না, হাফ হব বলেই বাবা মারা গেল।

তনু তখনও স্পষ্ট করে রিনির মুখ দেখতে পাচ্ছিল না; চোখের মধ্যে জল-জল ভাব রয়েছে। রিনির মুখ দেখতে দেখতে বলল, আমারই বা সুখী হবার কী আছে? আমার মা নেই, বাবা আমায় নিয়ে হরবখত ভাবেন, আমার চোখ হয়তো একদিন অন্ধ হয়ে যাবে।

রিনি যেন বুঝতেই পারেনি কী একটা কথা থেকে এই রকম কথা উঠতে পারে। অপ্রতিভ হয়ে বলল, যাঃ তাই কী হয়! তুমি যে কী বাজে কথা বলো। অন্ধ হওয়া অত সোজা।

তনু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। তার মুখখানি উদাস দেখাচ্ছিল।

 রিনি হঠাৎ তনুর গায়ে নাড়া দিয়ে বলল, কী ভাবছ? তুমি মাঝে মাঝে এমন মুখ করো মনে হয় সত্যিই ফিলজফার হয়ে গেছ।

তনু খুব আস্তে মাথা নাড়ল। না।

একদিন হবে। যখন বড় হবে বয়স হবে চুল পাকবে–তখন তনুশ্যাম মস্ত বড় ফিলজফার হয়ে যাবে। রিনি স্নিগ্ধ করে হাসল।

আমি কিছু হব না। তনু ঘাড় নাড়ল।

রিনি ঘাড় নাড়া দেখল তনুর। তারপর বিছানার কাছ থেকে সরে আসতে আসতে হেসে বলল, দরকার নেই হয়ে। তুমি শুধু শ্যাম হয়ে থেকো। কেমন?

ওষুধটা জায়গামতন রেখে দিল রিনি। রেখে দিয়ে ভাঙা-ভাঙা কীর্তনের সুরে গুনগুন করে গাইল: আমার শ্যামের কথা আর বলিস না সখি…।

তনু বলল, তুমি একটা গান গাও না রিনি।

না।

কেন?

আমার ইচ্ছে। বলে রিনি জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখল। তারপর সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে পাখাটা জোর করে দিল। আলোটা একবার নেবাল, আবার জ্বালাল। শেষে বলল, এখন আমার অনেক কাজ। রাত্তিরে তোমায় একটা ফার্স্ট ক্লাস গান শুনিয়ে দেব। শুনে ঘুমিয়ে পড়বে।

কী গান? তনু শুধোল।

রিনি হেসে উঠে বলল, খোকা ঘুমোল পাড়া জুড়লো বর্গী এলো দেশে– বলতে বলতে দমকা হাসিতে ঘর কাঁপিয়ে রিনি চলে গেল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *