একা একা – ৮

০৮.

কয়েকটা দিন কলকাতা গুম হয়ে থাকল। এমন গুমট আর গরম সচরাচর এখানে দেখা যায় না। সকাল থেকেই আকাশটা গনগনে হয়ে থাকে, দুপুরে গরম বাতাসের হলকা বয়ে যায়, রাস্তার পিচ গলছে, ট্রামলাইনে ছড়ানো যত বালি রাস্তায় ঘাটে উড়ে বেড়াচ্ছে, মনে হচ্ছিল প্রবল এক জ্বর নিয়ে কলকাতা বেহুঁশ হয়ে পড়েছে। তারপর আচমকা একদিন শেষ বিকেলে গঙ্গার কোল ঘেঁষে বিশাল এক কালবৈশাখী ছুটে এল। বৃষ্টি হল অফুরন্ত। বেহুশ ভাবটা কাটল কলকাতার। জ্যৈষ্ঠ মাস চলছে। আর বারকয়েক ঝড়ঝাঁপটা, তারপর বর্ষা নামবে।

সেদিনও সকাল থেকে মেঘলা। গাঢ় মেঘলা ছিল প্রথমটায়, বেলায় হালকা হল, দুপুর থেকে আবার মেঘলা।

দুপুরবেলায় রিনি বিছানায় শুয়ে খানিকক্ষণ আকাশপাতাল ভেবে হঠাৎ উঠে পড়ল। তনুর ঘরে এসে বলল, এই, ওঠো, জলদি।

তনু লাফ উইথ লিকক পড়ছিল। এমনিতেই তার হাস্যধ্বনি উঠছিল মাঝে মাঝে, রিনির আবির্ভাব এবং জলদি শুনে সে হেসে ফেলে বলল, ফরমাইয়ে জি?

রিনি নাক সিটকে বলল, তোমার জি-ফি রাখো। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো৷ চলো তোমায় ইউনিভারসিটি দেখিয়ে আনি।

অনু বলল, এই দুপুরে?

আজ সারাদিন মেঘলা স্যার, এখন বাইরে একবার দেখেছ? চমৎকার মেঘলা হয়ে আছে। তোমারই তো কলকাতা ইউনিভারসিটি দেখবার শখ। রোজ বলো। চলো, তোমায় ইউনিভারসিটি দেখিয়ে অন্য কোথাও যাব।

কোথায়?

সে যেখানে হোক। গঙ্গার ঘাটে যেতে পারি, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে যেতে পারি। যদি বৃষ্টি নেমে যায়, আরও মজা হবে। ..নাও, তাড়াতাড়ি নাও, আমি কাপড় বদলাতে যাচ্ছি।

তনু বই রেখে উঠে বসেছিল। বলল, পিসিকে বলে যেতে হবে না?

তোমার নীহারপিসি নাক ডাকছে। ওপরে মামাও ঘুমোচ্ছন। মাকে আমি কানে কানে বলে যাব। রিনি ব্যস্ত হয়ে চলে গেল, যেন বাইরের মেঘলা পালাবার ভয় রয়েছে তার, কিংবা মেঘলার পর যদি বৃষ্টি নামে সেই বৃষ্টি হারাবার জন্যে বেচারি বড় ব্যস্ত।

তনু চোখ-মুখ ধুয়ে পোশাকটা পালটাবার জন্যে উঠে পড়ল।

বাড়ির বাইরে এসে তনু দেখল, সত্যিই আকাশটা গাঢ় মেঘলা হয়ে আছে। তেমন গুমট নেই, গরমটা তার সহ্য না হওয়ার মতন নয়। আজকাল তাকে সমস্ত চোখ ঢেকে চশমা পরতে হয় না; তার দিনে-রাত্রের একই চশমা। চোখ যেন এটা মেনে নিতে শুরু করেছে। রাস্তায় নেমে তনুর হঠাৎ মনে পড়ল, তার দুপুরের ওষুধটা খাওয়া হয়নি।

রিনি, আমার একটা ভুল হয়ে গেল?

কী?

দুপুরের ওষুধটা খাওয়া হয়নি।

তুমি একেবারে শ্যামচাঁদই! …যাকগে, ফিরে এসে খেয়ো। আমরা সন্ধের আগেই ফিরে আসব।

হাঁটতে হাঁটতে তনু বলল, ইউনিভারসিটি এখন বন্ধ না?

গরমের ছুটি চলছে। তাতে তোমার কী? তুমি তো আর ইউনিভারসিটিতে পড়তে যাচ্ছ না, দেখতে যাচ্ছ।

তনু রিনির সঙ্গে তাল দিয়ে হাঁটছিল। বলল, বাবা পড়েছে। বাবার কাছে ক্যালকাটা ইউনিভারসিটির কত গল্প শুনেছি। বাবা তার ইউনিভারসিটির ব্যাপারে বহুত প্রাউড। …ইউ নো, বাবার এক প্রফেসার স্যার জগদীশকে দেখেছিলেন। …

রিনি আর কথা শেষ করতে দিল না তনুকে, একটা রিকশা ডেকে চেপে বসল। বলল, বাসস্টপে চলো।

বাসস্টপে নেমেই বাস পাওয়া গেল। দোতলা বাস। তনু ইতস্তত করছিল, তার আগেই রিনি একরকম তাকে ঠেলেই তুলে দিল। দিয়ে সোজা দোতলায়।

দোতলায় ভিড় নেই। দুপুরের বাস। পাশাপাশি বসল দুজনে। রিনি তনুকে জানালার ধারে বসাল, যেন বাচ্চা ছেলেকে জানালার ধার ঘেঁষে বসিয়ে কলকাতা দেখাচ্ছে।

লবঙ্গ খাবে?

 না। ঝাল।

কচি খোকা। এলাচ খাও। রিনি তার হাতব্যাগের মধ্যে থেকে এলাচ-লবঙ্গ বের করে মুঠোয় নিয়েছিল। এলাচ দিল তনুর হাতে। তারা খানিকটা এগিয়ে বসেছে। পেছনে দুসারিতে লোক নেই। পাশের সারিতে অবাঙালি কে একজন ঘুমঘুম চোখে চলেছে। তনু রিনি নিচু গলায় কথা বলছিল।

দোতলা বাসটা যেন মেঘলা পেয়ে বেশ আলস্যের সঙ্গে হেলে-দুলে চলেছিল। একটা ফুটপাথের গাছের মাথার ডালপাতাকে নাড়া দিয়ে চলে গেল। নিরিবিলি ট্রামরাস্তায় আপন মনে ট্রাম চলেছে। তনু আর রিনি কথা বলছে, থামছে, কথা বলছে, আবার থেমে যাচ্ছে।

রিনি তার হাতের ঘড়িটা দেখল। এখন প্রায় পৌনে তিন। পৌঁছতে পৌঁছতে তিনটে বেজে যাবে। আমরা চারটের মধ্যেই আবার ফিরব, বুঝলে; সোজা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। সেখান থেকে ছটা নাগাদ বাড়ি।

টিকিট কাটল রিনি। কোথায় উঠেছে তারা, আর আধখানা পথ পেরিয়ে টিকিট হল। টিকিট দুটো দুষ্টুমি করে তনুর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, রেখে দাও। তোমাদের এখতিয়ারপুর না ছাই কোথায়, সেখানে গিয়ে দেখবে মাঝে মাঝে। কলকাতার স্মৃতি!

তনু টিকিট দুটো বুক-পকেটে রেখে দিল। হাসল একটু।

রিনি বলল, কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে তুমি কী খাবে? কফি না শরবত?

শরবত।

 আইসক্রিম?

 না। …আমি একটা পান খাব।

পান।

 কলকাতার পান। তুমি সেদিন খাইয়েছিলে।

 বিড়ি খাবে না?

তনু এবার জোরে হেসে উঠল। এত জোরে হাসল যে তখনকার বাসের লোকজন যেন ওকে দেখতে লাগল। রিনি তনুর হাঁটুর ওপরে চিমটি কাটল। ফিসফিস করে বলল, একেবারে থার্ড ক্লাস।

.

মেডিকেল কলেজ পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে রিনি উঠে পড়ল। ওঠো।

বাস থেকে নেমে পড়ে রিনি তনুকে নিয়ে একপাশে দাঁড়াল। বাসটা চলে গেল। তার গায়ে গায়ে আরও একটা বাস। ডালহাউসির ট্রাম। রাস্তা ফাঁকা হবার জন্যে অপেক্ষা না করে বাঁ দিকের ফুটপাথ ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেল রিনি।

ওই দেখো আমাদের ইউনিভারসিটি, রিনি বলল। তার গলায় আবেগ নেই, আতিশয্য নেই; একেবারে সাদামাটা গলা। আঙুল তুলে শুধু বাড়িটা দেখাল।

তনু থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তার যেন পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছিল না। মাথা তুলে সে দেখছিল।

 রিনি এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিল। তনু একেবারে হাঁ করে আশুতোষ বিল্ডিংটা দেখছে। ওকে একবার ভেতর থেকে ঘুরিয়ে আনলে হয়, সামনের ফটক দিয়ে ঢুকে ওদিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হবে। রিনি নিজেই এদিকে তেমন একটা আসাযাওয়া করেনি। বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে শখ করে বেড়াতে এসেছে বার দুই-তিন, আর একবার এসেছিল শকুন্তলাদির সঙ্গে। শকুন্তলাদি তখন এম-এ পড়ত, কিসের একটা টাকা জমা দিতে এসেছিল ইউনিভারসিটিতে, রিনিকে সঙ্গে করে বেড়াতে নিয়ে এসেছিল। রিনির এটুকু বেশ মনে আছে, ওপাশে ফটক আছে বেরুবার।

চলো, ভেতরটা দেখিয়ে দিই– রিনি বলল তনুর জামায় সামান্য টান মেরে।

ফটকটা খোলা ছিল। ঢুকে পড়ল রিনিরা। তনু দেওয়ালের গায়ে বিশাল করে লেখা শ্লোগানগুলো পড়তে পড়তে এগুচ্ছিল।

তোমাদের ইউনিভারসিটির ওয়াল এ-রকম ডার্টি করে রাখে?

 রিনি ঠাট্টা করে জবাব দিল, আমরা বিপ্লব করি। তোমাদের মতন ছাতু নাকি?

 তনু এমন করে রিনির দিকে তাকাল যেন বিপ্লব কথাটার মানে বোঝার চেষ্টা করছে।

 রিনি তনুকে ঠেলা মারল, বলল, এখানে আগে সেনেট বিল্ডিং ছিল, খুব পুরনো; ভেঙে ফেলে নতুন সেনটিনারি বিল্ডিং হয়েছে।

বাবার কাছে গল্প শুনেছি। সেনেট খুব সুন্দর দেখতে ছিল।

 আমার মনে নেই তেমন। দেখেছি আগে। আমরা এদিকে আসিই না।

 ইউনিভারসিটিতে পড়বার সময় আসবে।

বয়ে গেছে আমার আসতে।

ভেতরে খুব একটা দাঁড়াতে দিল না রিনি তনুকে। নিতান্ত একবার চোখের দেখা দেখে তারা ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে এল। আবার ট্রামরাস্তা। বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রিট দিয়ে ঘুরে তারা পুবের দিকে চলে গেল। কফি হাউসটা দেখাল রিনি। তনু বইয়ের দোকান দেখছিল।

শরবতের দোকানে ঢুকে রিনি ঘড়ি দেখল। ইস, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তুমি একটু বসো, শরবত খাও। আমি পাশের দোকান থেকে গীতবিতানের একটা খণ্ড কিনে আনি।

শরবতটা পুরোপুরি খেল না রিনি, যেন বইটা কিনেই বাকিটুকু খাবে–খুব ব্যস্ত হয়ে চলে গেল। তনু বসে বসে শরবত খেতে লাগল। মাথার ওপর বনবন করে পাখা ঘুরছে, দোকানে মাত্র দু-চারজন লোক, বাইরের মেঘলা যেন আরও গম্ভীর হয়ে দোকানের মধ্যেটা ছায়ায় ভরে রেখেছে। আরাম লাগছিল তনুর। খুব শান্ত লাগছিল। কলকাতা বড় সুন্দর শরবত করে।

হঠাৎ যেন কী হল তনু বুঝতে পারল না, বিকট একটা শব্দে সে চমকে গেল। কাচের গ্লাস, টেবিলের ওপর পাতা সুন্দর কাঁচসব যেন একসঙ্গে কেঁপে উঠল। তনু বোকার মতন দোকানের মধ্যে তাকিয়ে রয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে আবার শব্দ। শব্দটা তনুর বুকে এসে ছিটকে লাগল যেন। দোকান থেকে কে একজন বেরিয়ে গেল হুড়মুড় করে, চেয়ার ঠেলার শব্দ, আবার একজন বাইরে ছুটল, দোকানের ভদ্রলোক কী বলছেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে, কেমন একটা ছোটাছুটির শব্দ বাইরে, অদ্ভুত এক কোলাহল, আবার শব্দ, পর পর, বার তিনেক। দোকানটা যেন হঠাৎ একেবারে কঁকা লাগল। সবাই বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তনুর বুক ধকধক করছিল, হাত-পা থরথর করে কেঁপে উঠল। তনুও হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। চেয়ারটা ঠেলতে গিয়ে সেটা উলটে গিয়ে শব্দ হল। রিনি, রিনি কোথায়? রিনির জন্যে তনু একেবারে অসহায় বোধ করতে লাগল। দোকানের ভদ্রলোক কলাপসিবল গেটটা বন্ধ করতে চাইছেন, পারছেন না, রাস্তার কিছু লোক দোকানের সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। রাস্তা দিয়ে তোক পালাচ্ছে, দোকানপত্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছে না তনু। একটা রিকশা পালিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে তনুর বুকের ভেতরটা কেমন যেন শব্দ করে দপদপ করছিল, গলা শুকিয়ে এসেছিল, সে ঘামছিল। চোখে যেন যন্ত্রণাও অনুভব করল তনু। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। একটা কুকুর ছুটে চলে গেল। কোথায় যে কী ঘটেছে কেউ বলতে পারছে না, নানা রকম শোনা যাচ্ছে।

রিনি যেন ছুটতে ছুটতে এসে পড়ল এই সময়। চোখ-মুখ উদভ্রান্ত, ভয়ে উৎকণ্ঠায় কথা বলতে পারছে না। এসে তনুর হাতটা ধরে ফেলল। শক্ত করে। তার হাত তনুর হাত দুই-ই কাঁপছিল, দুজনের হাতই গরম।

আর খানিকটা পরে লোকজন সরে যেতে লাগল। রিনি নেমে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার মনে পড়ল শরবতের পয়সা দেওয়া হয়নি। দুটাকার একটা নোট ফেলে দিয়ে রিনি আর দাঁড়াল না, তনুকে নিয়ে পথে নামল। তারপর প্রায় ছুটতে ছুটতে হ্যারিসন রোডের দিকে চলল।

ট্যাক্সিতে উঠে রিনি বড় করে নিশ্বাস ফেলল। আঁচলেই মুখ মুছল। বলল, বাব্বা! আর আমি এদিকে আসব না।

তনুর কাছে রুমাল ছিল না। তার সারা মুখে ঘাম, গলা ভিজে গিয়েছে। জামার হাতায় কপাল মুছছিল। রিনি তার রুমালটা দিল।

কী হয়েছিল? তনু জিজ্ঞেস করল।

কী আর, এখানে যা রোজ হয়! বোমা মারামারি হচ্ছিল।

কারা?

কে জানে! আমি বইটা কিনে বেরুব, এমন সময় বোমা ফাটল। দোকান থেকে বেরুতে দিচ্ছিল না। যত বলি, আমার লোক আছে, ততই তারা আটকে দেয়। তোমার জন্যে আমার যা ভয় করছিল!

আমারও…তুমি কোথায় চলে গিয়েছ আমি বুঝতে পারছিলাম না।

আমি তো মাত্র চার-পাঁচটা দোকান পাশে। আমায় আসতেই দিল না। রিনি রুমালটা ব্যাগের মধ্যে রেখে দিল। ওরা বলছিল মির্জাপুর স্ট্রিটে গোলমাল হচ্ছে।

কোথায়?

পাশের রাস্তাটাই নাকি মির্জাপুর স্ট্রিট।

আমার কান দুটো এখনও বন্ধ হয়ে আছে।

ট্যাক্সিটা পেয়ে বাঁচলাম। নয়তো ট্রামবাস বন্ধ হয়ে থাকতে পারত। কী জানি, বাবা। বলে রিনি তার হাতব্যাগ খুলল। টাকা-পয়সা গুনল। নিচু গলায় বলল, মার টাকা খুব খরচ করছি। বলে এবার সামান্য ফিকে করে হাসল।

খানিকটা এগিয়ে রিনি আবার বলল, আজ আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখা হবে না। চলো আমরা ওর আশেপাশে ঘুরে ওখান থেকে বাসে করে বাড়ি ফিরে যাব।

তনু একপাশে ঘাড় হেলিয়ে দিল।

.

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অনেকটা আগেই নেমে পড়েছিল রিনি। তারপর রাস্তা দিয়ে হাঁটল খানিকটা, খানিকটা মাঠ দিয়ে। বিকেল হয়ে গিয়েছে, মেঘলা আরও নিবিড় হয়ে এসেছে কখন। বৃষ্টি আসবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। বিরাট এক মেঘ মাথার ওপর চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বাদলা নয়, তবু বাদলা বাদলা গন্ধ উঠেছে কোথাও। মেমোরিয়ালের দিকে অনেক গাড়ি জমে যাচ্ছে।

রিনি বলল, দুর ছাই, আর পারছি না হাঁটতে। একটু বসি!

জায়গা বেছে রিনি বসল। পাশেই মস্ত একটা গাছ। রেড রোডে গাড়ির ভিড় বাড়ছে।

তনুও বসল। তার হাত-পা খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

 রিনি আবার ব্যাগ খুলে এলাচ-লবঙ্গ বের করল। তনুকে এক টুকরো এলাচ দিল। তোমায় পান খাওয়ানো হল না। পরে খাওয়াব।

তনু এলাচটা নিল।

তোমার এখনও ভয় করছে? রিনি শুধোল।

না।

বাড়িতে গিয়ে তোমার নীহারপিসির কাছে বোমা-টোমার গল্প কোরো না, তোমার পেটে আবার কথা থাকে না। মেয়েরাও তোমার চেয়ে ভাল।

তনু কিছু বলল না। তার বলবারই বা কী আছে। কী যে হয়ে গেল সে নিজেই বিন্দুমাত্র বুঝতে পারছে না। কেমন চমৎকার মেঘলা দুপুর, দোতলা বাসে চেপে কলকাতা দেখতে দেখতে রিনির সঙ্গে গল্প করতে করতে সে ইউনিভারসিটি দেখতে গিয়েছিল, ট্রাম বাস চলছে, মানুষজন হাঁটছে, বইপত্রর দোকান খোলা, শরবতের দোকানে বসে সে কলকাতার শরবত খাচ্ছিল, আর হঠাৎ পর পর শব্দ, হুড়োহুড়ি, মানুষজনের কোলাহল, ছুটতে ছুটতে রিনির এসে পড়া, তারপর দুজনে কোনও রকমে পালিয়ে এসে একটা ট্যাক্সি ধরা। ট্যাক্সিতে ওঠার পর তনু যতটা দেখেছে তার মনে হল না, কোথাও কিছু আটকে আছে, তাদের ট্যাক্সির রাস্তায় দোকানপত্র খোলা, লোকজন হাঁটছে, সবই স্বাভাবিক। অথচ ওরই মধ্যে কোথায় যেন কিছু হয়ে গেছে যা তনুরাই শুধু জানতে পেরেছিল, অন্য কেউ নয়।

রিনি বলল, ইস, আজ ইউনিভারসিটিতে না গেলে আমরা কত বেড়াতে পারতাম! সে দুপাশে দু হাত রেখে ঘাসের ওপর হাত বোলাচ্ছিল। মাঠের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা বাসে চেপে আমরা কত দূর বেড়িয়ে আসতে পারতাম।

কোথায়?

 ডায়মন্ডহারবার, বজবজ, যে কোনও জায়গায়।

 তোমাদের কলকাতা খুব পিকিউলিয়ার।

রিনি ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল। কেন?

 কেয়া মালুম। বাট ইট লুকস সো।

রিনি আবার ঘাড় ঘুরিয়ে সামনের মাঠ দেখতে লাগল। চুপ করে থাকল সামান্য। তারপর আবার বলল, আজকের মেঘলাটা খুব ফাইন, না?

বেশ।

তোমার চোখে খুব আরাম লাগছে না? ওই মেঘটা দেখেছ? একেবারে এপার-ওপার। কত বড়! মাইল দুই হতে পারে, কী বলো? তুমি তো আকাশ-টাকাশ তারাফারা ভালবাসো, বলতে পারো একটা মেঘ কত বড় হয়?

ছোট ছোটও হয়?

ছোটর কথা আমি বলছি না, বড়র কথা বলছি। তুমি যেমন মাইনাস টেন ইলেভেনের চশমা পরো, তোমার মাথাও সেই রকম মাইনাস।

তনু এবার একটু হাসল। মাথার মধ্যে যে হতচকিত, বিমূঢ় ভাব ছিল এতক্ষণ, তা যেন কেটে আসছে।

রিনি তনুর হাসি লক্ষ করে তার চোখ আড় করে চেয়ে থাকল। পিঠের চুল বুকের ওপর নিয়ে নিজেই চুলের গন্ধ শুকল। আজ তার চুলে বিনুনি নেই, এলো চুল, চুলের আগায় একটা ফাঁস দেওয়া। আকাশের দিকে আবার তাকাল রিনি। তারপর হেসে বলল, মেঘটার রং দেখেছ একেবারে তোমার মতন।

তনু কিছু বলল না, হাসল।

তোমার নাম তনুশ্যাম না হয়ে ঘনশ্যাম হল না কেন? আমাদের একজন ঘণ্টাশ্যাম ছিল। কলেজে ঘণ্টা বাজাত। রিনি খিলখিল করে হেসে উঠল।

তনু বলল, আমার নাম মা দিয়েছিল।

 রিনি কেমন একটু অপ্রতিভ হয়ে তনুকে দেখল, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল।

 দুজনেই চুপচাপ। ঘাসের ওপর কালচে ছায়া পড়ে গিয়েছে। জাহাজঘাটা থেকে ভোঁ এল। গাড়ি ছোটার বহরটা বেড়ে গেছে। মেমোরিয়ালের দিকে আরও ভিড় বাড়ছে।

বসে থাকতে থাকতে রিনি আলস্য ভেঙে হাই তুলল। তার সারা গা কেমন বেঁকে উঠেছিল হাই তোলার সময়। তনু সেটা দেখল।

এখন যদি একটু বৃষ্টি আসত, বেশ হত, না? রিনি বলল।

ভিজতাম।

অত সস্তা নয়, পাশে কেমন জাঁদরেল একটা গাছ দেখে নিয়ে বসেছি। ওর তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতুম।

তনু গাছটা দেখল। বড় গাছ। অজস্র পাতা আছে।

একটু ভিজলেই বা ক্ষতি কীসের? রিনি বলল, ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজতে আমার খুব ভাল লাগে।

বৃষ্টি হবে না।

কী করে বুঝলে? তুমি বৃষ্টি গুনতে পারো?

এ মেঘে বৃষ্টি হয় না।

 রিনি তনুর চোখ মুখ দেখতে দেখতে ঠোঁট উলটে বলল, কী আমার ভগবান রে।

তনু হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ভগবান কাকে বলে জানো?

না, আমি তোমার মতন ফিলজফার নই।

ফিলজফাররাও ভগবানকে জানেন না।

 তারা তবে কী জানে?

তারা মানে কী? সব ফিলজফাররাই কি ভগবান নিয়ে ভেবেছেন? কেউ ভেবেছেন কেউ ভাবেননি। ভগবান নিয়ে যাঁরা ভেবেছেন, তাঁরা বিশ্বাস করে নিয়েছেন, কোনও ক্লিয়ার ডেফিনেশান দেননি। গড ইজ কনসিভড।

তনু হয়তো আরও কিছু বলত, তার আগেই রিনি নাক, মুখ কুঁচকে বিরক্তির ভঙ্গি করে বলল, রাখো তো তোমার ভগবান-টগবান শুনতে আমার ভাল লাগে না। কী যে এক অভ্যেস করেছ, চান্স পেলেই জ্ঞান দিতে আস। আমায় তুমি জ্ঞান দেবে না।

তনু হেসে ফেলে চুপ করে গেল।

রিনি দুহাত মুঠো করে কিছু ঘাস ছিডল। বাতাসে উড়িয়ে দিল, হাঁটুর ওপর মুখ রেখে মাঠের ওপর চোখ নামিয়ে বসে থাকল খানিক। নিজের মনেই গুনগুন করে গাইল: মেঘের পরে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে; দুটি চরণ গেয়ে থেমে গেল। তারপর আকাশের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে হঠাৎ বলল, শোনো, আমরা খানিকটা হেঁটে যাব। হেঁটে হেঁটে সেন্ট ক্যাথিড্রাল পর্যন্ত যাব। তরপর ট্রাম, বাস ধরব। রাজি?

তনু বলল, আমি কী জানি! আমি কিছু চিনি না। তোমাকেই চিনি শুধু। যেখানে যাবে চলো।

 রিনি তনুর চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেমন লজ্জা পেয়ে গেল। মুখ ফিরিয়ে নিল। খানিকক্ষণ পরে উঠে পড়ল। চলো, বিকেল পড়ে যাচ্ছে।

.

দেরিই হয়ে গেল। সেন্ট ক্যাথিড্রাল পর্যন্ত হেঁটে আসতে সময় গেল। মেঘলা এখন আঁধার হয়ে এসেছে। রাস্তায় বাতি জ্বলে উঠল।

গাছ, ছায়া, রাস্তার আলো, নিরিবিলি পথ দিয়ে আসতে আসতে রিনি বলল, অনেক দেরি হয়ে গেল। আজ বাড়ি ফিরে তোমার নীহারপিসির বকুনি খেতে হবে।

তনু বলল, তুমি পিসিকে বলোনি?

বলেছি। ঘুমের মধ্যে শুনেছে মা। কী শুনেছে কে জানে।

সেন্ট ক্যাথিড্রালের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তনুরা শুনল গাছের পাতাগুলো হঠাৎ দমকা বাতাসে কেঁপে উঠছে। কয়েকটা শুকনো পাতা তাদের মাথা ছুঁয়ে উড়তে উড়তে মাটিতে গিয়ে পড়ল। বাতাসের দমকাটা থামল না। কোথা থেকে কিছু ধুলো উড়ে এল। গাছপালায় শন শন করে বাতাস এসে ঝাঁপটা মারছিল।

রিনি আচমকা তনুর হাত চেপে ধরল।

এই!

তনু ধুলো থেকে চোখ বাঁচাবার জন্যে মাথা নিচু করে ফেলেছিল।

ঝড় উঠেছে, রিনি বলল।

 হ্যাঁ।

বৃষ্টি আসতে পারে। একটু বৃষ্টি আসুক। আমরা ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরব। রিনি যেন আনন্দে গলে যাচ্ছিল।

বৃষ্টি এল না। আরও কিছু শুকনো পাতা উড়ে এসে তাদের মাথা মুখ গায়ে পড়ে আবার অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *