০৭.
বাড়ির বাইরে এসে রিনি বলল, তোমার জন্যে কত দেরি হয়ে গেল। এখন একটু পা চালিয়ে হাঁটো।
দেরিটা কোথায় হয়েছে তনু বুঝতে পারছিল না। এখনও ভোরের ভাবটাই চারপাশে লেগে আছে। সবই পরিষ্কার, আলো সাদা হয়ে আছে। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকাই, বাড়ি-ঘরদোরের গায়ে যেন ঘুম জড়িয়ে আছে। কাক ডাকছিল। ভোরের বাতাসটা গায়ে লাগছিল তখনও। দুহাতে মাথার এলোমেলো চুলগুলোকে বশ করে নিতে নিতে তনু স্বাভাবিকভাবেই হাঁটতে লাগল।
রিনি বলল, তোমার কুম্ভকর্ণের ঘুম। দরজা ভেঙে ফেললেও তোমার ঘুম ভাঙে না।
তনু মাথা নেড়ে বলল, আমি দেরি করিনি। তুমি নক করার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়েছি।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়েছি রিনি তনুকে ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলল।
পথে মানুষজন বড় চোখে পড়ছিল না। দুধের একটা গাড়ি একেবারে একা, যেন একচ্ছত্র অধিপতির মতন সারাটা রাস্তাকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে চলে যাচ্ছিল। তনু দুধের গাড়িটা দেখতে দেখতে বলল, তোমাদের কলকাতাকে ভোরবেলায় খুব কোয়ায়েট দেখায়। বাবার কাছে আমি কলকাতার ভোরের গল্প শুনেছি। রাস্তায় জল দেয় পাইপে করে। এখানে দেয় না?
রিনি বলল, এদিকে দেয় না।
কোন দিকে দেয়? আমায় দেখাও না।
তুমি কি কলকাতায় রাস্তায় জল দেওয়া দেখতে এসেছ? একেবারে হাঁদা। রিনি বেশ জোরে জোরে হাঁটছিল। লেক পর্যন্ত যেতে হবে। খুব একটা দূর নয়, আবার একেবারে কাছেও নয়। গায়ের আঁচলটা সে পুরোপুরিই জড়িয়ে নিয়েছে। মাথার চুলগুলো তারও এমন কিছু পরিপাটি নয়। সকালের বাসি চেহারাটা তার নিজেরই বেশ লাগে দেখতে। তনুকেও চমৎকার দেখাচ্ছিল, ঘুমের রেশ এখনও তার চোখেমুখে জড়িয়ে আছে, গলার শব্দটাও ভারী ভারী শোনাচ্ছে।
এত সকালেও বুড়ো মতন এক ভদ্রলোক লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়েছেন। বোঝাই যায় লেকে বেড়াতে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে হাঁটছেন। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে চারপাশে একবার তাকিয়ে নিচ্ছেন। দেখলে মনে হয়, জায়গাটা তাঁর যেন খুব চেনা নয়, নতুন এসেছেন, দেখেশুনে পথ হাঁটছেন। কিন্তু তা নয়। রিনি জানে, ভদ্রলোক এ পাড়ারই। অনেক কাল ধরেই রয়েছেন। সুষমার কে যেন হন। এককালে সিনেমায় পার্ট করতেন। এখন অথর্ব। বার দুই স্ট্রোক হয়েছে। রিনির হঠাৎ মনে হল, ভদ্রলোক যেন রোজ সকালে উঠে পাড়াটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়ে বুঝতে পারেন, তিনি বেঁচে আছেন। কেন যে রিনির এমন মনে হল, সে বুঝল না।
এই, রিনি তনুকে ডাকল। ইশারায় ভদ্রলোককে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ওই যে বুড়ো ভদ্রলোক– উনি সিনেমা করতেন।
তনু দেখল। তার কোনও উৎসাহ জাগল না। রাধাচূড়া গাছের তলায় গায়ে গা লাগিয়ে দুটো কুকুর তখনও ঘুমোচ্ছ। মাথার ওপর কিছু চড়ুই আর শালিক ফরফর করে উড়ে ডাকাডাকি করতে করতে কোথাও চলে গেল। পানের দোকানের ঝাঁপ উঠছে। বাতি নেবাবার জন্যে একটা লোক আঁকশি হাতে এসে পড়ল।
খানিকটা পথ হেঁটে এল ওরা। ভোরবেলায় একটা ট্যাক্সি চলে গেল হুস করে, দু-চারজন করে তোক দেখা যাচ্ছে, সকলেই বোধহয় লেক আর লেকের আশেপাশে বেড়াতে চলেছে। দুটো ছেলে সাদা হাফপ্যান্ট টাওয়েল শার্ট পরে, কেডস পায়ে, জোড়া পায়ে আস্তে আস্তে ছুটতে শুরু করেছে, লেকে গিয়ে দৌড় শুরু করবে।
তনুর সবই ভাল লাগছিল। কলকাতায় এসে পর্যন্ত তার এত ভোর-ভোর ঘুম ভেঙে ওঠা হয় না। সকালের দিকে উঠে সে অবশ্য মাঝেমধ্যে রিনির সঙ্গে বাড়ির সামনে চিলড্রেনস পার্কে বেড়িয়েছে। আজই প্রথম সে আরও ভোরে উঠে লেকে যাচ্ছে।
রিনি এ রাস্তা ও রাস্তা দিয়ে পথ ছোট করে লেকের দিকে যাচ্ছিল না। সোজা যাচ্ছিল। যেতে যেতে পেট্রল পাম্পের সামনে এসে পৌঁছোল। সামনেই লেক। এক ভদ্রলোক মস্ত একটা অ্যালসেসিয়ান কুকুর সঙ্গে করে বেড়াতে বেরিয়েছেন। একটি বয়স্কা মহিলাকে তাঁর ছেলে বোধহয় গাড়ি চালানো শেখাচ্ছে। দুজনের মুখেই হাসি। যেন কোনও একটা মজার কাণ্ড হচ্ছে।
রাস্তা পেরুবার সময় চোখে পড়ল একটা বাস মাঝে মাঝে হেডলাইট মেরে হু হু করে ঝড়ের বেগে আসছে। ভোরের বাস রাস্তায় নেমে এল।
তনু অবাক হয়ে দেখল, ভোরবেলার লেকে বুড়োর অভাব নেই। এর মধ্যেই কত লোক জমে গেছে। একটা সুন্দর মতন ছেলে রেসিং সাইকেল চালাচ্ছিল বকের মতন ভঙ্গি করে। আকাশের তলা থেকে ভোর যেন কখন খসে গিয়ে সকাল দেখা দিয়েছে, পুবের দিকটা রাঙা হয়ে উঠল।
রিনি তনুকে নিয়ে জলের ধার ছুঁয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, নাও, এখানে অনেক সবুজ আছে, চোখ ভরে তাকিয়ে থাকো, জল আছে দেখো, ইচ্ছে হলে আকাশ দেখো।
তনু তার চশমার মোটা মোটা কাঁচ দুটো মুছে নিল। সকালের বাতাস এবং জলো হাওয়ায় তার কেমন একটু শীত শীত করল। রিনি মুখের সামনে হাত তুলে ছোট করে হাই তুলল একবার।
পাশাপাশি দুজনে হাঁটছিল। তনু বলল, তোমাদের এই লেক কত বড়?
অনেক। মেপে দেখিনি।
তুমি আমাদের বাড়িতে গিয়েছ? আমাদের নিজেদের বাড়ি?
রিনি বুঝতে পারল তনু তাদের মা বাবার বাড়ির কথা বলছে। গিয়েছি, ছেলেবেলায়। কেন?
ওখানে একটা ঝিল আছে। খুব বড়।
মার কাছে গল্প শুনেছি।
আমি অনেকবার গিয়েছি। লাস্ট ইয়ারেও একবার গিয়েছিলাম ঠিক এই সময়ে, সামারে।
রিনির বসতে ইচ্ছে করছিল। সে হাঁটতে হাঁটতে বসবার জায়গা বেছে নিচ্ছিল।
তনু নিজের মনেই বলল, আমাদের বাড়ি থেকে তোমাদের বাড়িটা জাদা দূরে নয়।
রিনি ঠাট্টা করে বলল, তোমার নীহারপিসির বাপের বাড়ির গল্প শুনতে শুনতে আমি মরে গেছি। তুমিও আবার গল্প শোনাবে? আমি এবার বসছি।
রিনি বসে পড়ল। তনু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখল কয়েক মুহূর্ত, তারপর সেও বসে পড়ল। তুমি নীহারপিসির কাছে আমাদের কথা কবে থেকে শুনছ?
অনেকদিন।
আমিও তোমাদের কথা শুনেছি। লাস্ট ইয়ারে বাবা নীহারপিসিকে চিঠি লিখল। বাবা আমায় নিয়ে কলকাতায় আসবে ভাবছিল।
তার আগেও চিঠি এসেছে। দু-একটা।
আমার কলকাতায় আসার খুব ইচ্ছে হত।
কেন? কলকাতা দেখতে?
হ্যাঁ, কলকাতা দেখতে। নীহারপিসিকে দেখতে, তোমায় দেখতে।
যাঃ!
কী?
তুমি ভীষণ মিথ্যেবাদী। তুমি আমার কথা কিছু জানতেই না তো দেখতে আসার ইচ্ছে হত!
প্রথমে রিনির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল তনু কয়েক পলক, তারপর মুখের দিকে চোখ রেখে হাসিমুখে বলল, আমি তোমার কথা শুনেছি। নীহারপিসি চিঠিতে তোমার কথা লিখত। বাবার চিঠি। আমি দু-চারটে চিঠি দেখেছি।
রিনির চোখের মণি দুটো কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল। তনুর চোখ, তার গলার নীলচে শির, পরিষ্কার দাঁত, এলোমলো চুল দেখতে দেখতে আচমকা কেমন হেসে উঠে মুখ ফিরিয়ে জলের দিকে তাকাল। বলল, আমাকে দেখবার ইচ্ছেটা কেন হত, শুনি?
তনু সহজভাবে বলল, আমরা কলকাতায় আসব বলে ঠিক হচ্ছিল, এলে তোমায় দেখব, তাই। বলে তনু যেন আরও কিছু বোঝাবার জন্যে বলল, আমাদের কোনও রিলেটিভ আর নেই, বুঝলে রিনি। নীহারপিসি, তুমি–তোমরা আমাদের নিজের লোক। বাবা তো নীহারপিসির কথা ভেবেই আমায় নিয়ে কলকাতায় এসেছে।
রিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, সূর্য উঠে আসছে। সাদা আকাশের পুব জুড়ে রেখার মতন যে-আলোটুকু ফুটেছিল তা আরও উজ্জ্বল হয়ে কিরণমালা হয়ে উঠল।
তনু ডান হাতটা মুখের কাছে এনে তার স্বভাবমতন নোখ কাটতে লাগল। সামনে তাকিয়ে সে জল দেখছিল, জল, আকাশ; কিছু সবুজও তার চোখে পড়ছিল। কোথাও যেন মোরগ ডাকছে, গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে রাস্তা দিয়ে, দূরের রেললাইন দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছিল।
বসে থাকতে থাকতে রিনি হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে তনুর দিকে তাকাল। তারপর খপ করে হাত বাড়িয়ে তনুর হাতটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে দিল। কী নোংরা অভ্যেস তোমার, সারাদিন দাঁতে করে নোখ কাটছ।
তনু যেন লজ্জা পেল। হেসে ফেলে বলল, অভ্যেস।
অ-ভ্যেস, রিনি তনুর গলা নকল করে ভেঙচাল। কচি খোকার অভ্যেস!
তনু হাসতে হাসতে বলল, তুমি যখন পা নাচাও? সেটা কী?
রিনি চোখ বেঁকিয়ে ধমক দেওয়ার গলা করে বলল, বেশ করি। পরের খুঁত ধরতে হবে না। নিজেকে শোধরাও।
তনু বলল, তুমি একেবারে আমাদের ফাদার নর্টনের মতন বললে। ফাদার আমাদের আরলি ইউরোপীয়ান ফিলজফারস পড়ান, পার্ফেক্ট ক্রিশ্চান। জেসাস এই ধরনের কথাবার্তা বলেছেন।
তুমি একেবারে যিশুর শিশু। নাও ওঠো। বাড়ি ফিরতে হবে না?
আর একটু বসে দুজনে উঠে পড়ল। তনু বলল, আমরা দুজনে সকালে রোজ এখানে বেড়াতে আসতে পারি।
তোমার কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙলে পারি। নয়তো পারি না। রিনি ঘাড় দুলিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল।
দুজনেই হাসছিল। কী যে ঘটে গেছে বোঝা গেল না, দুজনেই উঁচু গলায় হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দায় শরদিন্দু খাবার টেবিলের কাছে বসে চা খাচ্ছেন, নীহার উলটো দিকে চেয়ারে বসে। টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম রাখা আছে। তনু এবং রিনি হেসেই যাচ্ছিল।
শরদিন্দু মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। ছেলের মুখ দেখলেন, তারপর রিনির।
নীহার ছেলেমেয়ের এই অট্টহাসির অর্থ বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে ওদের দেখছিলেন। অত হাসির কী হল?
রিনি এমনিতেই বেশি হাসে। তার হাসি থামল না, সে তনুকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তনু প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছিল। দম নেবার জন্যে থামল।
নীহার বললেন, তোরা কি পাগল হয়ে গেলি? হল কী তোদের?
তনু এগিয়ে এসে চায়ের টেবিলে বসতে বসতে বাবার মুখের দিকে তাকাল। শরদিন্দু চায়ের কাপটা মুখের কাছে তুলে নিয়েছেন।
রিনি সোজা বেসিনের দিকে চলে গেল। কল খুলে হাতটা ধুয়ে নিল। হাসিটা তখনও ওর কণ্ঠনালী আর মুখের মধ্যে কাঁপছে যেন।
নীহার তনুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
কী হয়েছে রে?
তনু হাসি মুখে বলল, কুছ না। রাস্তায় একটা সিন হয়ে গেল।
রিনি ততক্ষণে টেবিলের কাছে এসে গিয়েছে। বলল, ওই যে এক খুব মোটা পাঞ্জাবি বুড়ি আছে না, আমরা যাকে মিসেস ফ্যাটি বলি, সেই বুড়ি কোথায় যেন যাবে। একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়েছে। এই তো আমাদের বাড়ির সামনে। ট্যাক্সির দরজা খুলে যেই না পা দিতে যাবে টায়ারটা ফেটে গেল। শব্দে আমরা চমকে উঠেছিলুম। রাস্তায় নোকজন দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বোমা-টোমার মতন শব্দ। তারপর ট্যাক্সিঅলা নেমে এসে দেখে পেছনের চাকার টায়ার ফেটে গেছে। ট্যাক্সিঅলা তখন এমন চোখ করে মিসেস ফ্যাটিকে দেখতে লাগল যে সবাই হেসে অস্থির। বুড়ি চটে টং…
সামান্য আগে একটা শব্দ নীহারেরও কানে গেছে। গল্প শুনে তিনিও হেসে ফেললেন। মুখে বললেন, যাঃ, তা ওই বুড়ির জন্যে টায়ার ফাটবে কেন, এমনিতেই ফেটে গেছে। তোরা যে কী হয়েছিস সব!
নীহার ছেলেমেয়েদের জন্যে চা ঢালতে লাগলেন। তনু হাত বাড়িয়ে সেঁকা রুটি মাখন টেনে নিল।
শরদিন্দু জিজ্ঞেস কললেন, কোথায় গিয়েছিলে?
লেকে বেড়াতে।
কখন বেরিয়েছিলে?
খুব সকালে।
এখন তো বেশ রোদ উঠে গেছে।
নীহার শরদিন্দুর মুখের দিকে তাকালেন। শরদিন্দুর মুখ শান্ত, খানিকটা যেন গম্ভীর, নির্লিপ্ত। অমন হাসির কথাতেও তিনি হাসেননি। নীহার যেন সামান্য অবাক হলেন।
তনুর হাত থেকে রিনি মাখন-মাখানো রুটিটা কেড়েই নিল। আমায় আগে চা দাও মা, আমার ভীষণ চা-তেষ্টা পেয়েছে। সকালে ওর জন্যে আমার ভাল করে চা খাওয়া হয়নি।
নীহার মেয়ের কাণ্ড দেখে ধমক-ধমক গলা করে বললেন, ও কী হল? তুই ওর হাত থেকে রুটিটা কেড়ে নিলি? নিজে তো দিব্যি রানির মতন বসে আছিস। ও মাখন মাখাচ্ছে আর তুই খাচ্ছিস?
রুটিতে কামড় দিয়ে রিনি বলল, তাতে কী হয়েছে। আর আমি যে কোন ভোর পাঁচটার আগে উঠে ওকে চা তৈরি করে খাইয়ে বেড়াতে নিয়ে গেছি? তার বেলা? বলে রিনি শরদিন্দুর দিকে তাকাল। সকাল বেলার লেকটা খুব ভাল, মামা। ওকে ডাক্তার সবুজ জিনিসের দিকে তাকিয়ে থাকতে বলেছে না, লেকে খুব সবুজ আছে, জল আছে, আকাশ রয়েছে; ওর খুব ভাল লেগেছে।
শরদিন্দু শুনলেন। রিনিকে দেখতে দেখতে তাঁর মনে হল, নীহার ওই বয়সে অনেকটা ওরই মতন ঝোঁক দিয়ে কথা বলত তর তর করে। রিনির মতনই হাসির স্বভাব ছিল। তবে রিনি যেন মাকেও হার মানায়।
একদিন আপনিও চলুন না। কত বুড়ো লোক বেড়ায়, রিনি বলল।
যাব, শরদিন্দু ছোট করে বললেন।
নীহার মেয়ের দিকে চা এগিয়ে দিয়ে হেসে বললেন, তোর কী মুখ রিনি, তোর মামা কি লেকে বেড়াবার মতন বুড়ো হয়েছে?
তোমার কী কথা মা! লেকে কি শুধু থুথুরে বুড়োরাই বেড়াতে যায়! কত লোকে যায়। ছেলেমেয়েরাও। তুমিও যেতে পারো। রিনিকে খুব ঝরঝরে, সজীব, স্ফুর্ত দেখাচ্ছিল।
তনু নীহারের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের বাড়ির সেই রানির ঝিলটা ও দেখেনি। সেটা আরও বিউটিফুল, না পিসি?
নীহার সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহ বোধ করে মাথা নাড়লেন। অনেক সুন্দর। জল কত চমৎকার দেখতে। রাশ রাশ পদ্ম আর শালুক ফুটে থাকে। ওপারে কেমন জলের মধ্যে চত্বর করে রাধাকৃষ্ণর মন্দির আছে, না রে শ্যাম?
রিনি আড়চোখে তনুর দিকে তাকাল, তারপর মার দিকে। শেষে শরদিন্দুর দিকে তাকিয়ে বলল, মার কাছে বাপের বাড়ির সবই ভাল, বুঝলেন মামা। বাপের বাড়ির আলু-পটল-বেগুন থেকে রাস্তার কুকুরটা পর্যন্ত। মা যা এক-একটা কথা বলে শুনলে হাসির চোটে দম বন্ধ হয়ে যায়। একদিন বলল, আমাদের ওখানে ধোপাগুলোর কি কাপড় কাঁচা, একটা শাড়ি কাঁচলে ধুলো ময়লা হিংসেয় মরে যায়। যেমন ওদের কাপড় কাঁচা, তেমনি ওদের দেখতে। বলতে বলতে রিনি আবার খিলখিল করে হেসে উঠল।
নীহার শরদিন্দুর দিকে তাকালেন, শুনছ মেয়ের কথা। একেই বলে কলকাতার মেয়ে। ওদের যা কিছু সব কলকাতায়। রোজ লাঠালাঠি আর খুনোখুনি। বলে চোখের ইশারায় শরদিন্দুর কনুইয়ের পাশে রাখা সকালের কাগজটা দেখিয়ে দিলেন। শরদিন্দুকেই বললেন, দাও না ওকে কাগজটা দেখুক একবার। ট্রাম পোড়ার ছবিটা দেখুক। সাত-আটটা মানুষ মরেছে কাল। আবার বলে কলকাতা!
রিনি শরদিন্দুর দিকে তাকাল। নু টোস্ট খাচ্ছিল, বাবার হাতের কাছে রাখা কাগজটার দিকে চেয়ে থাকল।
নীহার শরদিন্দুর জন্যে আর-এক কাপ চা ঢালতে লাগলেন।
রিনি হঠাৎ বলল, বরাবরই কি কলকাতায় এসব ছিল? আজকাল হয়েছে।
নীহার বললেন, আজকাল-আজকাল করিস না। কতদিন ধরে হচ্ছে হিসেব করে দেখ না।
রিনি বিরক্ত হবার ভাব করে বলল, তোমার এখানে তো হচ্ছে না।
হলেই হয়।
হোক আগে, তখন বোলো৷
তনু দু-ঢোঁক চা খেয়ে যেন গলা ভিজিয়ে নিল। বলল, কালকের পেপারেও আমি দেখেছি, চার পাঁচজন মারা গেছে।
শরদিন্দু একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলেন। কলকাতায় রোজ ডিস্টার্বেন্স হয়। আমরা বাইরে থেকে শুনতাম। এখানে এসে তো ভয় পেয়ে যাচ্ছি। আমার কলকাতায় আসতে সাহস হচ্ছিল না। তুমি লিখলে নীহার, সাহস করে এলাম।
রিনি মার দিকে মুখ করে বলল, তুমি মা, অকারণে মামাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ। বলে রিনি শরদিন্দুর দিকে তাকাল। আমাদের এই সাউথে কিছু হয় না, মামা। মার কথা বাদ দিন। আর কাগজে কত যে বাজে কথা লেখে।
শরদিন্দু উঠে পড়েছিলেন এমন সময় গলার শব্দে মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, গজেন। সিঁড়ির ধাপ শেষ করে বারান্দার মুখে উঠে এসে দাঁড়িয়েছেন, পরনে পাজামা, গায়ে একটা খদ্দরের মোটা পাঞ্জাবি। মিটমিট করে হাসছেন।
নীহার তাকালেন। ঠাকুরপো।
গজেন শরদিন্দুর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে মাথা দোলাচ্ছিলেন, যেন বলতে চাইছিলেন, এই যে কেমন আছেন।
রিনি খুশি হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, এই তোমার আসছে হপ্তা?
এগিয়ে আসতে আসতে গজেন বললেন, আসছে হপ্তায় আসব কী রে! তোর কাকি তো যাই-যাই করছিল।
নীহার অবাক হয়ে গজেনের দিকে তাকালেন। কী হয়েছিল বীণার?
সাংঘাতিক-সাংঘাতিক। গজেন সাংঘাতিকটা বোঝাবার জন্যে চোখ প্রায় বুজিয়ে মাথা দুলিয়ে এক ভঙ্গি করলেন।
রিনি গজেনকাকার জন্যে খাবার টেবিলে চেয়ার এগিয়ে দিতে লাগল।
অসুখ করেছিল? কী অসুখ? নীহার শুধোলেন।
অসুখ ঠিক নয়, উন্মত্ত। উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। ম্যাড…।
কী বলছ যা তা, নীহার অধৈর্য হয়ে বললেন, কী হয়েছিল। বীণার?
উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল।
নীহার এবার যেন খানিকটা আঁচ করতে পারলেন। তা হতে পারে। তুমি উন্মাদ করারই মানুষ।
আমি না, বউদি। আমি কিছু করিনি। অত রোকা আমি নই।
বলে গজেন শরদিন্দুর দিকে তাকালেন, আপনি তো বিজ্ঞ লোক, দাদা; আপনিই বলুন, কোন বোকা নিজের একটা চোখে খোঁচা মেরে অন্য চোখ দিয়ে দেখতে চায়।
বীণা চোখে খোঁচা মেরেছে? নীহার আবার অবাক হলেন।
আরে না না, বীণা মারবে কেন গজেন বললেন, আমি আমার কথা বলছি। তোমার বীণা হল বাদ্যযন্ত্র। বাঁধা সুরে থাকে। আমার সাধ্য কী তাকে খুঁচিয়ে দিই। ওসব ডেনজারাস ব্যাপারে আমি নেই।
নীহার হেসে ফেললেন। শরদিন্দু একবার ছেলেমেয়েদের দিকে তাকালেন, হাসিটা চেপে রাখতে হল।
নীহার বললেন, তোমার বৃত্তান্ত রাখো, কী হয়েছে বলো?
আর কী হবে! আমার সেই স্কুটার নিয়ে লেগে গেল। আমায় স্কুটার চড়তে দেবে না, শিখতেও দেবেনা। আমি বললাম, আলবাত আমি শিখব। আর যাবে কোথায়, তোমার বীণার হেড-স্কু ঢিলে হয়ে গেল। খেপে গিয়ে সারা বাড়ি নাচতে লাগল, কেঁদে-কেটে জামাকাপড় ছিঁড়ে তছনছ। তারপর বাই উঠল, বাপের বাড়ি চন্দননগরে চলে যাবে। সেই যাই-যাই অবস্থা আর থামতে চায় না। অনেক কষ্টে থামিয়েছি।
নীহার জোরে হেসে ফেললেন, এই তোমার যাই-যাই অবস্থা?
গজেন মিটমিট করে হাসতে লাগলেন।
রিনি খিলখিল করে হেসে উঠল। তনুও হাসছিল। শরদিন্দু না হেসে পারলেন না।
তা বীণাকে আজ আনলে না কেন? নীহার গজেনের জন্যে চা ঢালতে লাগলেন। রিনি সরলাদিকে ডাকতে লাগল, গজেনকাকার জন্যে কিছু খাবার-টাবার দিয়ে যেতে।
আজ ওর অফিসের কোন বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন। মুখে ভাত-টাত গোছের কিছু হবে।
আপনার গাড়ি চড়া তা হলে বন্ধ? শরদিন্দু বললেন।
এক্কেবারে, টোটালি।
রিনি বলল, মিথ্যে কথা।
মিথ্যে কথা!
আমি তোমায় স্কুটার চড়তে দেখেছি।
এ কী রে! মেয়েটা কী রে! য্যাঃ য্যাঃ—
তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে শিখছ?
গজেন এবার চারপাশে তাকিয়ে সকলের মুখ দেখে নিলেন। কী যে বলে মেয়েটা, আমার হাঁটুতে বলে চোট হয়ে গিয়েছে, পা নাড়তেই পারছিলাম না কদিন।
নীহার এবার বললেন, তাই বলল, ওই দু-চাকা চড়তে গিয়ে বুড়ো বয়সে পা ভেঙেছ। এখন বীণার নামে দোষ! …এসো, চা খেতে বসো।
গজেন যেন ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জার সঙ্গে হাসলেন, তারপর আস্তে আস্তে টেবিলে এসে বসলেন।
নীহারের চা ঢালা হয়ে গিয়েছিল। রিনি নিজের খাওয়া ফেলে রেখে গজেনকাকার জন্যে রুটিতে মাখন লাগাচ্ছিল। সরলাদি যতক্ষণ না আসে কাকা চা খাওয়া শুরু করতে পারে।
গজেন তনুর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, কী, তোমার চোখ কেমন?
তনু একটু হেসে মাথা হেলিয়ে বলল, ভাল।
বাঃ, বেশ! …আরও ভাল হয়ে যাবে। কলকাতা হল ডাক্তারের দেশ। বড়, মেজ, ছোট, হাতুড়ে এখানে সব রকম ডাক্তার পাওয়া যায়।
রিনি জোরে হেসে উঠল।
নীহার বললেন, শ্যামের টনসিলের গোলমাল আছে। কত ভোগান্তি বলো তো
গজেন চায়ে চুমুক দিয়ে বাঁ হাতটা সামান্য তুলে বললেন, আমার হাতে ভাল ই-এন-টি আছে, দেখিয়ে দেব।
রিনি হেসে বলল, তোমার সেই কম্বল-ডাক্তার, আমার গলা দেখেছিলেন? না বাবা, ওঁর কাছে নয়।
কেন, কেন?
কেন কী! গলা দেখলেই কাটতে চায়।
তোর কেটেছে?
অত সস্তা! কে দিচ্ছে গলা যে কাটবে।
শরদিন্দু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কম্বল-ডাক্তারটা কী?
গজেন বেশ সহজভাবেই বললেন, গায়ে ভীষণ লোম বলে আমরা তাকে কম্বল-ডাক্তার বলি।
উচ্চরাল হাসি উঠল বারান্দায়।
নীহার বললেন, তুমি এখন আছ তো ঠাকুরপো, আমি ওপাশটায় দেখে স্নানটা করে নিই। তোমার সঙ্গে দরকার আছে, পালিয়ে যেয়ো না।
আছি। আমি একেবারে ভাতটাও খেয়ে বেরুব। তুমি কাজকর্ম সারো গে যাও।
নীহার চলে যাবার আগেই সরলা এল। গজেনকে খাবার গুছিয়ে দিয়ে নীহার চলে গেলেন।
শরদিন্দুও উঠছিলেন, গজেন বললেন, এদের সঙ্গে একটু হুল্লোড় করে আপনার কাছে যাচ্ছি, দাদা।
হাসিমুখে শরদিন্দু বললেন, আপনি বসুন না। আমি তো আছি।
শরদিন্দু চলে গেলেন।
রিনি বলল, তুমি একে একদিন খেলা দেখাবে বললে যে!
সেই জন্যেই তো এলাম।
সেই জন্যে এলে?
কাল একটা বিগ গেম রয়েছে। মোহনবাগান ভার্সেস মহামেডান। চলে আয় তোরা।
আমি আবার কী যাব!
কেন! মেয়েরা ফুটবল খেলা দেখে না? তুই বলিস কী রে! পঞ্চাশ বছরের বুড়ি মোহনবাগানের গোল দেওয়া দেখে গ্যালারিতে এমন নৃত্য করতে লাগল যে পড়ে গিয়ে ঠ্যাং ভেঙে ফেলল। এ তো মাত্র গত বছরের ব্যাপার। কাগজে বেরিয়েছিল দেখিসনি?
থাক বাবা, আমি নাচতেও পারব না, পা ভাঙতেও পারব না। তুমি ওকেই নিয়ে যাও।
তুইও যাবি। কাল তিনটে নাগাদ তুই ওকে নিয়ে এসপ্লানেডে আয়। আমি এসে নিয়ে যাব। কোনও কষ্ট হবে না।
রিনি তনুর দিকে তাকাল। তারপর নাক কুঁচকে বলল, তোমায় আবার একলা কোথাও পাঠানোও মুশকিল। কিচ্ছু চেনো না।
গজেন খেতে খেতে মুখ তুলে দুজনকেই দেখলেন। হাসলেন যেন।
কাকা?
বল।
কাল তুমি কী লিখবে? রিনি হাসল।
কাল যদি ঝড়বৃষ্টি হয় তবে পর্জন্যদেব লাগাব, যদি কটকটে রোদ থাকে তা হলে দাবদাহ কিংবা মার্তণ্ডদেব-টেব একটা লাগাতে হবে।
রিনি খিলখিল করে হেসে উঠল।
গজেন বললেন, হাসির কিছু নেই রে! মাঠে এখন খেলা হয় না, ছাগল চরে। আমরা ভাষার হুঙ্কার-টুঙ্কার দিই, আর পাগলা ছোঁড়াগুলো ইট পাটকেল ছোড়ে। এই করেই কোনও রকমে কলকাতার মাঠ গরম করে রেখেছি। আর কদিন, তারপর মাঠ মরে যাবে, একেবারে ডেড। গজেনের গলায় এবার কেমন এক ক্ষোভ শোনা গেল।
খাওয়া শেষ হলে রিনি বলল, কাকা একটা ম্যাজিক দেখাও।
যাঃ, ম্যাজিক কীসের?
দেখাও, রিনি বায়নার মতন সুর করে বলল।
গজেন পকেট থেকে হালকা চকচকে সিগারেট কেস বের করলেন। দেশলাইটাও। কেস থেকে একটা সিগারেট নিয়ে মুখে দিলেন। দিনের বেলায় কী আর ম্যাজিক হয়! সিগারটেটা ধরিয়ে নিয়ে কেস থেকে সব সিগারেটগুলো টেবিলের ওপর ঢেলে দিলেন। কটা সিগারেট? দেখ, গুনে দেখ।
রিনি বলল, সাতটা।
একটা আমি খাচ্ছি।
তনু দেখছিল।
গজেন সিগারেট কেসটা দেখালেন। ফাঁকা। তারপর টেবিলের ওপর ছড়ানো সিগারেটগুলো আবার কেসে ভরে রাখলেন। কেসটা বন্ধ করতে করতে বললেন, রিনি, তুই এক-দুই গুনতে ভুলে গেছিস।
আ-হা! রিনি ঘাড় দুলিয়ে বলল। সে বুঝতে পারছিল কিছু একটা হচ্ছে।
গজেন কেসটা আবার খুললেন। তনুর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, তুমি এবার গুনে ফেলল। বলে কেস থেকে সব কটা সিগারেট আবার টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিলেন।
তনু গুনে দেখল, আট। রিনিও দেখল।
গজেন মিটমিট করে হাসছিলেন। আটটা ছিল, একটা আমি ধরিয়েছিলাম, সাতটা ছিল। আবার সেই আট হয়ে গেল! আবার সাত করতে পারি, ছয় পারি, পাঁচ পারি…করতে করতে ফক্কা করে দেব।
রিনি হাত বাড়িয়ে বলল। ইস, চালাকি! কেসটা আমায় দাও।
গজেন তাড়াতাড়ি কেসটা পকেটে পুরে ফেললেন। ম্যাজিক মানেই চালাকি! ম্যাজিকের জিনিস দেখাতে নেই।
তনু বেশ অবাক এবং খুশি হয়ে গজেনকে দেখছিল। বলল, নাইস।
রিনি বলল, এ খেলাটার নাম কী?
গজেন গম্ভীর হয়ে বললেন, এর আমি নাম দিয়েছি হারাধনের দশটি ছেলে।
রিনি খুব জোরে হেসে উঠল। তনুও শব্দ করে হাসতে লাগল।
গজেন হাসতে হাসতে বললেন, হারাধন দেখেই অত হাসছিস। দাঁড়া, এবার তোকে কেষ্টধন দেখাই।
গজেন পকেট থেকে ছোট্ট, আঙুলপ্রমাণ একটা বিচিত্র পুতুল বের করলেন। রং করা, চোখ মুখ ছোট-ছোট করে আঁকা।
পুতুলটা হাতের মুঠোয় নিয়ে গজেন বললেন, এই যে কেষ্টঠাকুর, এটা তিব্বত থেকে আনানো।
রিনি বলল, তিব্বতে আবার কেষ্টঠাকুর থাকে নাকি?
থাকে, থাকে; তিব্বতি কেষ্ট। এই কেষ্টঠাকুরের মজা হল, এ তোর যে কোনও একটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেবে। যদি হ্যাঁ হয় তবে ক্রস, যদি না হয় তবে শুন্য।
গুল! রিনি ফট করে বলে ফেলল।
গুল কী রে, এ হল গুলগুল। যা একটা কাগজ পেন্সিল নিয়ে আয়।
রিনি কাগজ কলম আনতে ছুটল।
গজেন তনুকে বললেন, এটা হল গালার পুতুল।
রিনি কাগজ কলম নিয়ে এল।
গজেন বললেন, একটা ছোট চিরকুট করে নে, নিয়ে তোর যা খুশি লেখ। লিখে কাগজ কলমটা তনুশ্যামের হাতে দে। তনুও লিখুক। অনলি ওয়ান কোশ্চেন, ওয়ান সেনটেন্স। নট মোর দ্যান ওয়ান।
রিনি কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে কিছু একটু ভাবল, তনুর দিকে তাকাল আড়চোখে, তারপর কাগজে লিখল।
তনুও মজা পাচ্ছিল। সেও লিখল।
গজেন বললেন, যার যার নিজের কাগজ দলা পাকিয়ে একটা মটর দানার মতন করে ফেলল।
রিনি টিপে টিপে দলা পাকাল। তনুও।
পুতুলটার পিঠের দিকে একটা ফুটো। গজেন দলা দুটো তার মধ্যে ফেলে দিতে বললেন। রিনিরা কাগজ ফেলে দিল।
পুতুলটা খানিক নেড়ে চেড়ে চোখ বন্ধ করে গজেন বললেন, রিনি, তোর লেখাটা আগে আমি তনুশ্যামের হাতে দিয়ে দিচ্ছি। আর তনুরটা দিচ্ছি তোর হাতে।
রিনি তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। না, না, তুমি দেবে না।
কেন, কেন?
না। কিছুতেই না।
গজেন বললেন, আহা, ডিস্টার্ব করিস না। খেলাটা হতে দে।
রিনি উঠে পড়েছে আগেই। ঘুরে এসে গজেনের হাত থেকে পুতুলটা কেড়ে নিতে গেল। তার আগেই গজেন তনুর হাতে একটা কাগজ দিয়ে দিয়েছেন।
রিনি প্রায় তনুর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার মুঠো থেকে কাগজটা কেড়ে নিয়ে পালিয়ে গেল।
তনু অবাক। গজেন মজার মুখ করে হাসছিলেন।
খানিকটা পরে গজেন শরদিন্দুর কাছে চলে গেলেন।
তনু আর বসে থাকল না। উঠল। উঠে নিজের ঘরে যাচ্ছে, দেখল রিনি বাইরে এসেছে। তনু রিনির দিকে তাকাল। বলল, তুমি কী লিখেছিলে?
রিনি তনুর মুখ দেখতে দেখতে খুব গম্ভীর হয়ে বলল, তোমায় বলব কেন? আমার যা খুশি লিখেছিলাম। বলেই হঠাৎ হেসে উঠল। তারপর চোখ টান করে বলল, আমি শ্যামের কথা লিখেছিলাম। ঘণ্টাশ্যামের!
.