০৫.
দোতলার বারান্দায় বসে শরদিন্দু কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলেন; তারপর ওপরে তেতলায় নিজের ঘরে চলে গেলেন। নীহার গেলেন গা ধুতে; গা ধুয়ে পুজোয় বসবেন। তনুশ্যাম বসে থাকল। তারা চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল বিকেলে, ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গিয়েছে।
দোতলার বারান্দায় এই বসবার জায়গাটুকুতে তনু দিনের বেশির ভাগ সময়টাই আজ কাটিয়ে দিল। সকালে অনেকটা বেলা পর্যন্ত বসে বসে কথা বলেছে, কাগজ দেখেছে, বই পড়েছে খানিকটা। বারান্দার রেলিংয়ের ওপর বসানো কাঠের পাল্লা আর শার্সি বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে আসছিল, এখন কিন্তু সবই প্রায় খোলা, বাতাস আসছে, মাথার ওপর পাখাও চলছে।
হাত কয়েক দূরে খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রিনি কিছু একটা ইস্ত্রি করছিল। ইস্ত্রি শেষ হলে সাজসরঞ্জাম নিয়ে সে তার ঘরের দিকে চলে গেল; সামান্য পরে ফিরে এসে তনুর মুখোমুখি দাঁড়াল।
একেবারে চুপটি করে বসে আছ যে–? রিনি শুধোল; একবার পার্ক স্ট্রিট গিয়েই হাঁপিয়ে পড়লে!
তনু রিনিকে দেখতে দেখতে বলল, না। চোখ দেখাবার পর মাথা ধরে যায়।
রিনি রগড় করে বলল, শির দরদ?
তনু হেসে ফেলে বলল, আমি তোমাদের কলকাতার বাঙালিদের চেয়ে খারাপ বাংলা বলি না।
তা দেখতেই পাচ্ছি। রিনি সোফার ওপর বসে পড়ল।
তনু রিনির হাসিভরা মুখ, ঝকঝকে চোখ, লতাপাতা করা ছাপা শাড়িটা দেখতে দেখতে তার বাঙালিত্ব প্রমাণ করার জন্যই যেন বলল, আমাদের ওখানে বাঙালি অনেক আছে। কলেজে তিন চার জন। গভর্নমেন্ট সারভিসে আছে আট দশ জন। বিজনেস আছে বাঙালির, সেলস-এজেন্ট কত আসে।
রিনি আগের মতোই মুখ করে বলল, তোমাদের ওখানে মানে পুরো মধ্যপ্রদেশ তো?
তনু সামান্য জোরেই হেসে ফেলল। বলার কিছু নেই। রিনি আজ সকাল থেকেই তার খুঁত ধরে তাকে খেপাবার চেষ্টা করছে। দু-চারটে শব্দ বা দু-চারটে কথায় কিছু হিন্দুস্থানি টান থেকে গেলে দোষের যে কী আছে তনু বুঝতে পারছেনা। রিনি যে নিজে চিঠিকে চিটি বলে তাতে কোনও দোষ নেই। আজ দুপুরে খাবার সময় টেবিলে বাবা, নীহারপিসি, রিনি আর তনু এই নিয়ে খুব হাসি-রগড়, মজা করেছে।
বাবাই সবচেয়ে মজার কথা বলেছিল। বলেছিল: নীহার তোমার আমার বাড়ি ছিল বিহারে, আমরা হলাম বেহারি বাঙালি, তুমি আমাদের দলে, রিনি হল পুরোপুরি কলকাতা। কলকাতাকে আমরা বলতাম, হালুম-হুঁলুমের দেশ, ওরা খেলুম, গেলুম, শুলুম করেই কাটায়। রিনি এখন বুঝে দেখুক কোন দেশেতে আছে।
তখনকার কথা মনে পড়ায় তনু একটু হাসল। রিনিদের কলকাতা হালুম-হুঁলুমের দেশ তবে!
তনু কিছু বলার আগেই রিনি বলল, মাথা ধরেছে বলে প্যাঁচার মতন মুখ করে বসে আছ! একটা ট্যাবলেট এনে দিই, খেয়ে নাও।
খেতে হবে তনু বলল, কপালটা ফেটে যাচ্ছে।
রিনি ওষুধ আনতে উঠি উঠি ভাব করছিল, তনু বলল, চোখের ডাক্তাররা চোখ নিয়ে টরচার করে, ভীষণ স্ট্রেন হয়।
আমায় চোখ শিখিও না, আমি চোখের ডাক্তারের মেয়ে।
জানি, তনু হাসল, শুনেছি আমি।
তা তোমার চোখের কথা গুপ্তসাহেব কী বললেন?
আমায় কিছু বলেননি। বাবার সঙ্গে কীসব কথা হয়েছে আসবার সময় ট্যাক্সিতে বাবা আর পিসি কথা বলছিল। মালুম হল, কমপ্লিকেটেড কেস। কী কী সব টেস্ট করতে হবে।
রিনিরও সেই রকম মনে হল। শরদিন্দুমামা এবং মার দু-একটা কথা শুনে, মুখ-চোখ দেখে তারও মনে হয়েছে, দুজনেই যেন খানিকটা মনমরা। তনুর সত্যিই খুব মাথা ধরেছে, না বেচারি খুব হতাশ হয়ে গেছে–মুখে সেটা বলছে না, রিনি বুঝতে পারল না, তবে চোখ দেখার সময় ডাক্তার যা করে তাতে ভাল চোখও টনটন করে ওঠে। মাথাও ধরে যায়। রিনি তনুর জন্যে মাথাধরার বড়ি আনতে উঠল।
তনু সোফার মধ্যে ডুবে পা টানটান করে বসে থাকল। বারান্দার ওপাশের বাতিটা নিবিয়ে দিয়েছে রিনি, এপাশেরটা জ্বলছে। খোলা শার্সি দিয়ে সামনের বাড়ির সিঁড়ির প্যাসেজটা চোখে পড়ে। বাতি জ্বলছে। চারপাশে একটা কলরব যেন ভেসেই আছে। বেজায় জোরে কোথাও রেডিয়ো বাজছে। রিনি একসময় বাহারি মাছ পুষেছিল, অ্যাকুরিয়ামটা এখন ফাঁকা, একপাশে রাখা আছে, তার মধ্যে কীসের এক গাছ পুঁতে রেখেছে রিনি, পাতাগুলো বাড়ছে বেশ।
রিনি ওষুধ এনে দিল, জলের গ্লাস।
তনু ট্যাবলেটটা খেয়ে ফেলল। পুরো গ্লাস জলও।
রিনি বসে পড়ল। মা পুজো সেরে এসে চা খাবে। তখন তোমার পিসিকে ম্যানেজ করতে পারলে এক কাপ চাও পেতে পারো। মাথা ধরা ছেড়ে যাবে।
তনু বলল, চা পেলে গ্র্যান্ড হয়।
হয় ঠিকই; কিন্তু তোমার পিসি তোমায় হরিণঘাটা খাওয়াতে চাইবে।
তনু বুঝতে পারল না। হরিণঘাটা কী?
হরিণের দুধ, রিনি মুখটা গম্ভীর করে বলল, কলকাতায় আমরা হরিণের দুধ খাই। বলে মুহূর্ত পরে গাম্ভীর্য হারিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, কলকাতার মানুষকে যা ছোটছুটি করতে হয় তাতে গোরুমোষের দুধে চলে না, বুঝলে।
তনু ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে হেসে ফুলেছিল: বলল, তুমি হরিণ দেখেছ?
অনেক।
কোথায় দেখেছ?
চিড়িয়াখানায়।
আমি হরিণের জঙ্গল দেখেছি। মোস্ট বিউটিফুল।
রিনি চোখের তারা বেঁকা করে নিরীহ গলায় শুধোল, হরিণের জঙ্গলে কারা থাকে।
তনু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। কারা?
মানে কী থাকে? শুধু হরিণ?
না শুধু হরিণ কেন! আরও জীবজন্তু থাকে। হরিণ বেশি।
তা হলে আর হরিণের জঙ্গল বলছ কেন, বলো জঙ্গলের হরিণ। বনে থাকে বাঘ, খাটালে থাকে মোষ, বলতে বলতে রিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তনুও হাসতে লাগল।
রিনি এবার অন্য কথা পাড়ল। পার্ক স্ট্রিটে তো গেলে চোখ দেখাতে: পার্ক সার্কাস কেমন লাগল?
তনু সকৌতুকে বলল, জাস্ট লাইক এ সার্কাস। গ্র্যাঞ্জার, ডেকোরেশান, লাইট, শো।
ইয়ার্কি?
ইয়ার্কি নয়। সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যাবার সময় আমি দেখেছিলাম। আসবার সময় চোখের যা হাল, চাইতে পারছিলাম না। বড় ভিড়, আর শব্দ।
বাঃ, সার্কাসে ভিড় হবে না। ওটা সাহেবপাড়া। তুমি যদি বড়দিনের সময় আসতে পার্ক সার্কাসের চেহারা দেখতে।
তনু তার দু হাত ঘাড়ের তলায় রেখে খানিকটা আরামের চেষ্টা করল। বলল, বাবা তোমাদের কলকাতা দেখে খুব অবাক হয়ে যাচ্ছে। বাবা যখন কলকাতায় থাকত স্টুডেন্ট লাইফে–তখন কলকাতা এরকম ছিল না। বাবা পিসিকে বলছিল, কলকাতার রাস্তায় বেরুলেই দম আটকে আসছে। বাবার।
মজার চোখ করে রিনি জিজ্ঞেস করল, তোমারও দম আটকে যাচ্ছে নাকি? তা হলে আগেভাগেই বলে রাখো, বাবা! এরপর তোমায় কলকাতা বেড়াতে নিয়ে গিয়ে আমি ফ্যাসাদে পড়ব নাকি?
তনু ঘাড় নাড়ল। আমার দেখতে ভাল লাগে বহুৎ। কিন্তু ক্রাউড দেখলে আমি নার্ভাস হয়ে যাই। আমার চোখের নার্ভগুলো সহ্য করতে পারে না, কেমন একটা ফিলিং হয়। বলতে বলতে তনু থামল, হঠাৎ বোধহয় কপালে তীব্র ব্যথা এসেছিল, চোখ বুজে কপাল কুঁচকে ব্যথাটাকে সে সইয়ে নিল। তারপর বলল, তোমাদের কলকাতায় ডবল ডেকার বাসগুলো দেখলে আমার ভীষণ ভয় হয়। মনে হয়, এই বুঝি সব চাপা পড়ল।
রিনি যেন তনুর ওপর করুণা করে হাসল। বলল, তুমি একেবারেই গাঁইয়া।
ট্রাম দেখতে আমার ভীষণ ভাল লাগে–তনু বলল, ভেরি নাইস। আজ আমরা যখন যাচ্ছিলাম, আসছিলাম–গাছপালার গা দিয়ে মাঠের পাশে পাশে ট্রাম যাচ্ছিল। খুব নাইস লাগছিল।
রিনি হাসল খানিকটা। বলল, তোমায় কলকাতা দেখাতে নিয়ে আমিই পড়ব বিপদে। তোমার যে কোনটা নাইস হবে আর হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে কে জানে! কলকাতার ট্রাফিক পুলিশও তোমার কাছে নাইস হয়ে যাবে হয়তো, কে জানে!
আমায় আগে তুমি প্ল্যানেটোরিয়ামটা দেখাও।
গেলেই হল একদিন, কাগজটা সকালে দেখে নিতে হবে, রোজ খোলা থাকে না।
তনু রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, খানিকটা অন্যমনস্ক। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি, বুঝলে রিনি, আমার খুব ইচ্ছে ছিল অ্যাস্ট্রনমি পড়ব। ছেলেবেলা থেকেই আকাশ, তারা, ওই এন্ডলেস স্পেস দেখতে খুব ভাল লাগে আমার। ইট অ্যাট্রাক্টস মি। আমার চোখের জন্যে আমি আকাশটাও ভাল করে দেখতে পেতাম না। তবু আমার ভীষণ ভাল লাগত। খালি চোখে আমরা দু হাজারের মতন তারা দেখতে পাই, বুঝলে। আমি কত পেতাম কে জানে। পাঁচশো, সাতশো হয়তো। একটা তারা আছে সাড়ে ছশো লাইট-ইয়ার দুরে, তার মানে এখান থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে, সেই তারাটা আমাদের সুর্যের চেয়ে একানব্বই হাজার গুণ আলো ছড়ায়। তুমি ইমাজিন করতে পারো? কত দূর থেকে এই আলো আসছে ভাবলে গায়ের মধ্যে তোমার শিউরে ওঠে না? আমার গা শিউরে যায়…বুঝলে রিনি, আমাদের এই জগৎটাই কত বড়, কত রকম মিষ্ট্রি এর মধ্যে। কিন্তু ওই যে মাথার ওপর এটারন্যাল স্পেস ওটা আরও মিস্টিরিয়াস। ভাবাই যায় না। তোমায় একটা কথা শোনাই, প্রতিদিন ওখানে কত কী ঘটে যাচ্ছে ভাবতে পারবে না। ওখানে–ওয়ান্ডর্স ইন দি মেকিং, ওয়ার্ডস ডেড অ্যান্ড অ্যারিড, হোয়ারলিং ফ্রাগমেন্টস অব ওয়ান্ডর্স–অল পাস অ্যাবাভ আস ফ্রম নাইট টু নাইট।
রিনি তনুর মুখ দেখছিল। তনু যতটা পেরেছে চোখের পাতা খুলে ফেলেছে কথা বলতে বলতে, মুখটি যেন আবেগে ভরে উঠেছে। গলার স্বর বড় সুন্দর। রিনি বলল, তুমি অ্যাস্ট্রনমি পড়লে না কেন?
এই চোখ নিয়ে? চোখের জন্যে আমার পড়াশোনাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তনু একটু থামল, তারপর আবার বলল, বাবা বটানির প্রফেসার, বাবার ইচ্ছে ছিল আমি বটানিটা যদি পড়তে পারি। তাও হল না।
তুমি এখন কী পড়ছ? ফিলজফি।
রিনি মুখ হাঁ করে চোখ বড় বড় করে অদ্ভুত এক মজার ভঙ্গি করে বলল, দর্শন! ও বাব্বা, তাই বললা; তুমি হলে ফিলজফার। তাই তোমার মুখে অত জ্ঞান। রিনি হাসতে লাগল।
তনু কেমন অপ্রস্তুত বোধ করে চুপ করে গেল। তার মুখেও স্নান হাসি।
রিনি বেশ নজর করে তনুকে দেখল। ঠাট্টাটা তনু ভাল মনে নেয়নি। কী ছেলে রে বাবা! রিনি বলল, বড় হয়ে তুমি তা হলে ফিলজফার হচ্ছ?
তনু রিনির দিকে তাকিয়ে বলল, না, আমি অন্ধ হচ্ছি।
এবার রিনি যেন রাগ দেখিয়ে তনুকে ভেঙাল, বলল, অত শখে কাজ নেই। তুমি ফিলজফারই হও, তাও তো অন্ধ হওয়া।
নীহার ততক্ষণে এসে পড়েছেন। তাঁর পুজোপাঠ শেষ হয়েছে। গা ধুয়ে, কাপড়জামা বদলে, পুজো সেরে আসতে আজ তাঁর বেশি সময় লাগল না। তাঁকে খুব শুভ্র সতেজ দেখাচ্ছিল। তনুদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে নীহার মেয়েকে বললেন, সারাদিন তুই কী যে হিহি করে হাসিস রিনি, দু দণ্ড শান্তিতে পুজো করাও দায় হল। অত হাসির কী হল?
রিনি বলল, যার পুজোয় মন থাকে সে হাসি শোনে না।
তুই থাম। আমায় জ্ঞান দিচ্ছে। আমি তোর পেটে জন্মাইনি, তুই আমার পেটে জন্মেছিস।
রিনি হেসে ফেলল। পরে বলল, তোমার চা করে দিই। বলে রিনি উঠে পড়ল। চোখ দেখিয়ে এসে তোমার শ্যামের মাথা ধরে গিয়েছে। একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছি। এক কাপ চা খেতে চাইছে।
নীহার তনুর পাশে এসে দাঁড়ালেন। তোর মাথা ধরেছে?
তনু ঘাড় নাড়ল।‘ যা করে ডাক্তাররা চোখ নিয়ে, মাথা ধরতেই পারে। তা তুই জামাকাপড় পরে বসে আছিস কেন তখন থেকে? যা হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে থাক খানিকটা, ধকল কাটলেই সেরে যাবে। বলে নীহার আদর করে তনুর মাথার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
রিনি আড়চোখে সেটা দেখল, দেখে চলে গেল। মার তনুশ্যাম এবাড়িতে এসেই মার কাছে তুই হয়ে গেছে। বলা যায় না, এরপর মা হয়তো তার শ্যামের মাথা টিপতে বসে যাবে!
তনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নীহার ডাকলেন, শ্যাম।
উঁ–
তোর চোখ ভাল হয়ে যাবে। কলকাতায় কত বড় বড় ডাক্তার আছে। তুই দেখ না, আমি সকলকে দিয়ে তোকে দেখাব। ভাবিস না। …যা হাতমুখ ধুয়ে নিগে যা।
তনু জামাকাপড় ছেড়ে, বাথরুম থেকে ফিরে এসে তার ঘরে বিছানায় শুয়ে ছিল। মাথার ব্যথাটা যে তার কাছে আরও অসহ্য হয়ে উঠেছে তা নয়, বরং রিনির কাছ থেকে অ্যাসপিরিনের বড়ি খেয়ে, ঠাণ্ডা জলে হাতমুখ ধুয়ে এসে এখন তার আরামই লাগছিল। কিন্তু শরীরটা কেমন ক্লান্ত লাগছিল তনুর। চুপ করে শুয়ে ছিল। শুয়ে শুয়ে এই ঘর দেখছিল, তাদের ঘরবাড়ির কথা ভাবছিল, চোখের ডাক্তারের চেম্বার, গুপ্ত সাহেবের জাঁদরেল চেহারা, আরও কত কী তার মাথায় আসছিল। হঠাৎ রিনির গলা কানে এল।
চা নিয়ে এসে রিনি বলল, এই যে ফিলজফার মশাই, উঠুন; চা নিন; দেখুন চায়ে চিনি হল, না নুন হল!
তনু বিছানার ওপর উঠে বসে চা নিল। তার পা খাটের পাশে ঝুলছে।
চা দিয়ে রিনি চলে গেল না। মার চা সে ওপরে দিয়ে এসেছে; চা আর পান। মা বলেছিল। শরদিন্দুমামার ইসবগুলের শরবত তৈরি করে মা নিজে ওপরে নিয়ে গেছে আগেই।
রিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঠাট্টা করে বলল, চায়ে চিনি-নুন ঠিক হয়েছে?
তনু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, নাইস।
তা হলে তুমি চা খাও, আমি যাই।
বোসো না। তুমি এখন কী করবে?
গ্রাস কাটিং।
গ্রাস!
ঘাস কাটব। রিনির গলায় হাসির দমক উঠল।
তনু হেসে ফেলল। তুমি হরবখত তামাশা করো।
হরবখতই করি।
বোসো না। তনু আবার বলল।
রিনি বাস্তবিকই যাবার জন্যে আসেনি। চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বসে বলল, আমি ঘাস কাটতে যাব শুনে তুমি ইয়ার্কি ভাবলে। জানো, আমায় গিয়ে এখন পড়তে বসতে হবে।
তনু অবাক হয়ে বলল, পড়তে বসা, আর ঘাস কাটা এক হল?
আলাদা হবে কেন! আমার কাছে দুই-ই সমান। আমি কি তোমার মতন স্টুডেন্ট? আমি বইয়ের পাতা খুলে কচকচ করে কাটব। ব্যাস…। পড়াশোনা আমার ধাতে সয় না। কী হবে পড়ে। আমার কাঁচকলা হবে। কারুরই কিছু হয় না আমাদের। এক্সামিনেশনের সময় কী টুকলি! সে-ঘটা তো দেখনি?
তনু হাসছিল। তুমি টোকো!
ওমা, টুকব না। কেনা টোকে! রিনি তনুর কথায় যেন একটু নাক সিঁটকে নিল।
তনু বলল, পেপারে দেখি, তোমাদের এখানে এক্সামিনেশনের সময় গোলমাল হয় বহুত?
রিনি বিনা প্রতিবাদে ঘাড় এক পাশে হেলিয়ে বলল, হয়। বহুত হয়। তোমাদের ওখানে হয় না?
হয়। কম হয়। তনু রিনির পা নাচানো দেখতে দেখতে বলল। রিনি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না, পা নাচায় অনবরত। তনুর এই বদঅভ্যাস একেবারে নেই। সে চুপচাপ বসে থাকার সময় মাঝে মাঝে ডান হাতটা মুখের কাছে নিয়ে দাঁতে নখ কাটে। তনু এবার জিজ্ঞেস করল, তোমার সাবজেক্ট কী?
আমার আলাদা কোনও সাবজেক্ট নেই। অনার্স-ফনার্স নেই, স্যার। আমার শুধু পাস।
অনার্স নাওনি?
আহা নিতে চাইলেই দিত আর কী! আমি চাইনি, ওরাও দেয়নি। লেখাপড়ায় আমার মাথা নেই। কী হবে আমার পড়ে! আমি দিদিমণিও হব না, চাকরিও করব না।
তনু হেসে ফেলে বলল, তা হলে তুমি কী করবে?
রিনি এমন সহজ প্রশ্নটা আগে নিশ্চয় ভেবে নেয়নি৷ জবাব দেবার সময় হঠাৎ কেমন থতমত খেয়ে গেল। তারপর বলল, কিছুই করব না। বলে একটু থেমে কী যেন ভাবল, বলল, বাবা থাকলে আমার এত সুখ আর হত না। আমায় ডাক্তারি পড়তে হত। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমায় ডাক্তারি পড়াবে। হয় আমায় ডাক্তারি পড়তে হত, না হয় বায়ো-কেমিস্ট্রি। বাবা বলত, আমাদে দেশে বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে কেউ ভাবে না। আমি বাবা, বায়ো-কেমিস্ট্রি যে কী তা একেবারে জানি না।
তনু বলল, আমিও ঠিক জানি না। বায়োলজি আর কেমিস্ট্রি মিলিয়ে সামথিং কিছু হবে। মালুম, ইট ইজ রিলেটেড টু মেডিক্যাল সায়েন্স।
সামথিং কিছু! ঘাড় দুলিয়ে ভেঙচে দিল রিনি, চোখ বাঁকা করে বলল, কী যে এক মালুম মালুম করো। ছাতু কোথাকার!
তনু হেসে উঠল।
রিনিও মুখ ভেঙিয়ে বলল। আমাকে তো তখন খুব হালুম হলুম করলে, তুমিও বা কোন দেশের বাঘ?
চায়ের কাপটা তনু নামিয়ে রাখল। তারপর বলল, তুমি ডাক্তার হলে রেপুটেশান হত। তোমার ট্যাবলেটটা ভাল। মাথা ধরা কমে এসেছে।
রিনি সামান্য চুপ করে থেকে জবাব দিল, বাবারই শখ ছিল আমায় ডাক্তারি পড়াবে। ডাক্তারি পড়লে আমি আই স্পেশ্যালিস্ট হতাম। অন্য কিছু আমি হতাম না। আমি আই স্পেশ্যালিস্ট হলে তোমার চোখ সারিয়ে দিতাম।
সরল মুখে হাসল তনু। ঠাট্টা করে নিজের কপালটা দেখাল। আমার কপাল খারাপ। বলে মুহূর্তখানেক পরে জিজ্ঞেস করল, পিসেমশায় অনেকদিন মারা গেছেন, না?
বাবা! বাবা মারা গেছে অনেকদিন। আমার তখন তেরো বছর বয়েস। সাত বছর হতে চলল। রিনি ধীরে ধীরে বলল, অন্যমনস্কভাবে।
তনু বলল, আমার মা মারা গেছে আরও আগে। আমার সাত কি আট বছর বয়েস তখন। বলে তনু যেন উদাস মুখ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। পরে বলল, নীহারপিসি আমার মাকে দেখেছে।
রিনি যেন তার বাবার কথা ভাবছিল। বলল, আমার বাবার ছবি তুমি দেখেছ। মার ঘরে আছে, আমার ঘরে আছে। আমার বাবাকে দেখলে তুমি অবাক হয়ে যেতে। কেমন লম্বা চেহারা, গায়ের রং ধবধব করত। বাবা যা মজা করতে পারত না, কী বলব! বাবা নীচের তলায় বসে হাসলে ওপরে আমরা শুনতে পেতাম। কী ভাল মানুষ ছিল বাবা, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
তনু রিনির কথা শুনতে শুনতে তার মার কথা ভাবছিল। তাদের বাড়িতেও মার ছবি আছে। মার কথা মনে পড়লে মার ছবির মুখটাই চোখের সামনে ভাসে। তনু বলল, আমার মার নাম ছিল পুষ্প পুষ্পলতা। মার রং ফরসা ছিল। মাথায় যা চুল ছিল–হাঁটু পর্যন্ত। লম্বা লম্বা চোখ। মা খুব বাইবেল জানত। আমায় কত গল্প বলত বাইবেলের।
রিনি বলল, তোমার মা কী করে মারা গেলেন?
তনু চুপ করে থাকল। তার চোখ-মুখের বিষণ্ণতা নজরে পড়ছিল। মাথার চুলে অন্যমনস্কভাবে হাত বুলিয়ে সে বলল, মার ডেলিভারি হচ্ছিল। কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, সাম কমপ্লিকেশানস। দুজনেই মারা গেল। আমি তখন খুব ছোট। আমার সব মনে নেই।
রিনি অপলকে তাকিয়ে তাকিয়ে তনুর কথা শুনছিল। তার পা নাচানো বন্ধ ছিল কিছুক্ষণ। হঠাৎ রিনি বলল, তোমার মা, আমার বাবা! অদ্ভুত, না?
তনু কিছু বলল না, রিনির দিকে তাকিয়ে থাকল।
রিনি বড় করে নিশ্বাস ফেলল। আবার তার পা নাচানো শুরু হয়ে গেল। ঘাড়ের পাশ থেকে চুলের বিনুনিটা বুকের কাছে এনে হাতের ঝাঁপটায় দুলিয়ে খেলার মতন করল, তারপর হেসে ফেলে বলল, কী রকম মজা দেখো, আমার মনে হচ্ছে, আমার বাবা আর তোমার মা এখন স্বর্গে খুব গল্প করছে।
বলে রিনি থামল, যেন স্বর্গের সেই গল্প করার আসরটা উঁকি মেরে দেখে নিল; তারপর তনুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলল, আর এখানে আমার মা আর তোমার বাবা তেতলায় বসে কথা বলছে। আমরাও বলছি–তুমি আর আমি। তিন জায়গায় তিন পেয়ার। কী অদ্ভুত, না?
তনু যেন খুব ধীরে মাথা দুলিয়ে জানাল, হ্যাঁ–বেশ অদ্ভুতই।
.