একা একা – ২

০২.

শরদিন্দু তখনও আলস্য বোধ করছিলেন। বেলা পড়ে গিয়েছে, বিকেলেও হয়ে গিয়েছিল। ঘরের দরজাটা ভেজানেনা। মাথার দিকের জানলাটা বন্ধ, পাশের জানলা খানিকটা ভোলা, পরদা ঝুলছে গাঢ় রঙের। পরদার ওপর দিয়ে বিকেলের ঝিমোনো রোদ দেখা যাচ্ছিল।

অল্প করে দরজা খুলে নীহার ঘরে পা বাড়ালেন। তাঁর প্রথমে মনে হয়েছিল, শরদিন্দু ঘুমোচ্ছেন, পরে সিগারেটের গন্ধে বুঝলেন মানুষটি নিশ্চয় জেগে আছেন।

ঘুমোচ্ছ? নীহার বললেন। ঘুমন্ত মানুষকে কেউ ঘুমোচ্ছ বলে না, নীহার নিজেই যেন মনে মনে হাসলেন।

সাড়া দিলেন শরদিন্দু।

দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নীহার; সাড়া পাবার পর দরজার পাট খানিকটা খুলে দিলেন। চৌকাঠ থেকে রোদ অনেক দূরে সরে গেছে। ঘরের মধ্যে এগিয়ে এসে নীহার বললেন, ওপরের ঘরে শুতে কষ্ট হল? গরম পেলে খুব?

না। তোমাদের কলকাতায় আর গরম কোথায়! গরম আমাদের দিকে।

 তোমাদের ওদিকে তো বলো পাহাড়।

পাহাড় মানে পাঁচমারি হিলসের একটা রেঞ্জ। আমাদের ওখান থেকে মাইল দশা শরদিন্দু বিছানা থেকে সামান্য উঠে বালিশে ভর দিলেন। এম পির ক্লাইমেট সব জায়গায় এক রকম নয়। কোথাও কোথাও বেজায় গরম পড়ে, আমাদের বিহারের মতন। কোনও কোনও জায়গায় মডারেট ক্লাইমেট। তবে শীতটা বেশিই হয়।

নীহারের মনে হল ঘুম থেকে শরদিন্দু বেশিক্ষণ ওঠেননি৷ হাই তুলছেন বড় বড়। জল খাবে? নীহার জিজ্ঞেস করলেন।

দাও। তোমাদের ঠাণ্ডা-জল নয়।

 ঘরেই জলের পাত্র ছিল। নীহার জল গড়িয়ে দিলেন।

শরদিন্দু তৃষ্ণার্ত হয়েছিলেন; জল খেয়ে আরামের শব্দ করলেন। তারপর কী মনে করে বললেন, আমার পেটে কলকাতার জল পড়ল কত বছর পরে বলো তো?

নীহার মুচকি হাসলেন। সে তো তোমারই মনে রাখার কথা।

 শরদিন্দু যেন হিসেব করছিলেন নীহারের মুখের দিকে তাকিয়ে। বললেন, বছর আটাশ হবে। হবে না?

নীহার সায় দেওয়া ঘাড় নাড়লেন, ওই রকমই হবে।

 আমি কলকাতা ছাড়লাম, যুদ্ধের মাঝামাঝি। ফরটি টুয়ে, অগাস্ট রেভুলেশনের বছর।

ছিলেই বা কবছর। নীহার এবার মাথার দিকের জানলা খুলে দিচ্ছিলেন। পাশের জানলাও পুরোপুরি মেলে দিলেন। ঘরে পড়ন্ত বিকেলের স্বাভাবিক আলো এল।

শরদিন্দু বললেন, কলকাতায় আমার বছর চারেক থাকা। কলেজের কটা বছর। যুদ্ধ লেগে সব এলোমেলো হয়ে গেল; আমি হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলাম।

নীহার সবই জানেন। তাঁর কাছে শরদিন্দুর জীবনের অন্তত গোড়ার ছাব্বিশ সাতাশটা বছর নিজের জীবনের মতোই জানা। বিছানার পায়ের দিকের দেওয়াল ঘেঁষে মালপত্র ডাঁই করা আছে, সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন নীহার। তারপর বললেন, মুখ টুখ ধুয়ে এসো; চা খাও।

চা হয়ে গিয়েছে?

 হচ্ছে। পাঁচটা বাজতে চলল।

পাঁচ? …আমি বেশ খানিকটা ঘুমিয়ে নিয়েছি তা হলে! শরদিন্দু এবার ছোট মাপের হাই তুললেন। তুমি এত খাওয়ালে, খেয়েদেয়ে আমি সেই যে এসে ব্যাঙের মতন চিত হলাম, আর এপাশ ওপাশ করতে পারি না শরদিন্দু হাসতে গিয়ে কাশি বাধিয়ে ফেললেন।

নীহার মজা করে বললেন, তুমি আর খেলে কোথায়? মাছের কাঁটা বাছতে ভুলে গেছ, খাবে কী?

বিছানা থেকে নেমে পড়তে পড়তে শরদিন্দু বললেন, লোক আগে আমাদের ছাতু বলত, মনে আছে নীহার। এখন আবার বলে মাছু। কেন যে বলে কে জানে। তা মাড়ুদের দেশে থাকতে থাকতে মাছ খাওয়া ভুলে গিয়েছি। …তবে তুমি আজ যত রকম মাছ খাইয়েছ সব বলতে পারি।

নীহার হেসে বললেন, আচ্ছা,.সে আর বলবে কী? খাবার সময়েই তো আমরা বললাম।

শরদিন্দু ভুরু কুঁচকে বললেন, বললে নাকি! তবে তো আমার আর বলার উপায় থাকল না। পারশে মাছের ঝালটা আমার মুখে লেগে আছে এখনও। কত বছর পরে পারশে মাছ খেলাম। শরদিন্দু যেন ঝালের স্বাদটা এখনও জিবের কোথাও রেখে দিয়েছেন এমন এক মুখ করলেন।

নীহার বেশ শব্দ করেই হেসে উঠলেন। বুড়ো বয়সে কত যে করছ। যাও মুখ ধুয়ে এসো।

শরদিন্দু পরিতৃপ্ত মুখে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

সামান্য পরে শরদিন্দু ফিরে এসে দেখলেন নীহার ঘরে নেই। চশমাটা খুঁজে নিয়ে বেতের হেলানো চেয়ারটায় তিনি বসলেন। বেতের ওপর পাতলা গদি পাতা রয়েছে: তুলোর গদি। গদিটা নতুন নতুন লাগছে। একরঙা একটা পিঠ কাপড়ও রেখেছেনীহার। শরদিন্দুর মনে হল, তাঁর জন্যেইনীহারের এত ব্যবস্থা। জানলার গা ঘেঁষেই বসলেন শরদিন্দু। পাখাটা আগের মতন ঘুরে যাচ্ছে।

বাইরে নীহারের গলা পাওয়া গেল। তেতলায় পা দিয়ে ঝি কিংবা চাকরকে কিছু বলছিলেন হয়তো, তারপর ঘরে এলেন।

তোমাকে আর নীচে নামালাম না, চা নিয়ে এলাম নীহার বললেন। তাঁর হাতে শরদিন্দুর চা।

 শ্যাম কী করছে? শরদিন্দু জিজ্ঞেস করলেন।

চা খেয়ে এই তো উঠল,নীহার শরদিন্দুর চা ঢালতে ঢালতে বললেন, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট দেখছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে। কলকাতা দেখছে।

শরদিন্দু চায়ের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বললেন, ওর কলকাতা দেখার খুব সাধ ছিল।

কার না থাকে, তোমারও ছিল. নীহার যেন মুচকি হাসলেন, চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে শরদিন্দুর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। কলকাতায় পড়তে আসার জন্যে তোমার কী বায়না! আমার বাপু বেশ মনে আছে। জ্যাঠামশাইয়ের মোটে ইচ্ছে ছিল না তুমি কলকাতায় পড়তে আস। তিনি চাইছিলেন পাটনা পাঠাতে। কাছে হত। কলকাতা ওঁদের পছন্দ ছিল না। তা তোমার একেবারে ধনুকভাঙা পণ, সেই কলকাতাতেই এলে। জেদে তোমায় কে হারায়।

শরদিন্দু যেন পুরনো কথাটাকে তেমন করে গায়ে মাখলেন না, বললেন, আমি শখ করে কলকাতায় আসিনি। কলকাতায় পড়ার আমার খুব ইচ্ছে ছিল। পুরো সাধটা আর মিটল কই। তার আগেই পালাতে হল। বলে চায়ের কাপে মুখ দিতে গিয়ে বললেন, তোমার চা?

আমি সন্ধের আগে চা খেতে পারি না আর। বলে সামান্য সরে এসে জানলার পরদাটা আরও গুটিয়ে দিলেন নীহার। রোদ আসছে না। বাতাসই আসছিল। মধ্যে অম্বল-টম্বল নিয়ে খুব ভুগেছিলাম। আলসারের মতন হয়ে গিয়েছিল। ধরাকাটা করে থাকতে হত। বিকেলে চা খেলে বুকটা জ্বালাজ্বালা করে। সন্ধেবেলাতেই খাই।

শরদিন্দু আয়েশ করে ধীরে সুস্থে চা খেতে লাগলেন। নীহার বললেন, আমি ভাবলাম, তুমি বসে বসে চা খাবে, আমি তোমার মোটঘাট খুলে যা-যা দরকার বের করে গুছিয়ে দেব।

শরদিন্দু বললেন, দেবেখন; একটু বোসো৷

বসব তো। আমি বসে বসেই কাজ করব। আমার কি আর দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা আছে। দেখছ না, কেমন ভারী হয়ে গিয়েছি।

ভারী–? শরদিন্দু হাসি হাসি মুখ করলেন।

 মোটা বলবে তো? বলল। নীহার হাসলেন।

শরদিন্দুনীহারকে দেখতে লাগলেন। এই নীহারের সঙ্গে পুরনোনীহারের তুলনা করা ঠিক নয়, বয়স মানুষকে স্বাভাবিক ভাবেই বদলায়, কখনও কখনও অতিমাত্রায়, চেনাই যায় না। নীহারকে কিন্তু চেনা যায়। মুখের অদলবদল সত্ত্বেও আদলটি তেমন কিছু পালটায়নি। চৌকো ধরনের মুখে সামান্য চাপা থুতনি নীহারকে চিনিয়ে দিত, আজও দেয়। তফাতের মধ্যে, তখন যা ছিল ছিমছাম পরিষ্কার এখন তা ভরাট হয়ে গিয়েছে। সমস্ত মুখটাই প্রায় গোল দেখায়। নাকটি আরও ফুলে গিয়েছে, চোখ দুটি একেবারে সংসারী, মমতা মাখানো, মাসিপিসি ধরনের। নীহারের মাথার চুলও কোথাও কোথাও সাদাটে হয়ে আসছে। শরদিন্দুর মনে হল না, নীহারকে ঠিক মোটা বলা যায়, তবে বয়েসের মেদে কেমন এক গড়নভাঙা চেহারা হয়ে গিয়েছে নীহারের। নীহার এখনও সাদা থান পরে না, সরু কালো পাড়ের ধুতি পরে। হালকা হলুদ পাড়ের ধুতি পরে সে স্টেশনে গিয়েছিল। গায়ের জামা সাদা। গলায় সরু হার, হাতে সরু চুড়ি দু গাছা করে।

শরদিন্দু হেসে বললেন, তুমি আর মোটা কোথায়? ওই একটু..

নীহার হেসে জবাব দিলেন, মোটা নয়, তবে মোটামুটি–এই তো?

কথাটা উপভোগ করে শরদিন্দু হাসতে লাগলেন।

নীহার সামান্য অপেক্ষা করে বিছানার পায়ের দিকে এগিয়ে গেলেন, মালপত্রের কাছে। তুমি কি সমস্ত সংসার উঠিয়ে এনেছ?

বাইরে বেরুলে কখন কী লাগবে বোঝা তো যায় না, নীহার। আমি দরকারিগুলোই নিয়েছি।

 এত জিনিস তোমার দরকারি! মোটা মোটা বিছানাগুলো বয়ে এনেছ কেন? আমি না তোমায় বিছানাপত্র আনতে বারণ করেছিলাম।

শরদিন্দু কী যে বলবেন বুঝতে না পেরে বললেন, তুমি লিখেছিলে ঠিকই। তবে আমি ভাবলাম, বেডিং-ফেডিং নেওয়া ভাল, দরকারে কাজে লাগবে।

তোমার ওই রকম ভাবনা। আমার বাড়িতে আর দুজনের বাড়তি বিছানা নেই!

শরদিন্দু অপ্রস্তুত বোধ করলেন।  তুমি যে কী বলো! ব্যবস্থা যা করে রেখেছ এ একেবারে রাজসূয়…।

তোমাদের বিছানা আমি খুলছি না। কাল রোদে দিয়ে আবার সব বেঁধেবঁধে রেখে দিতে বলব নারানদের। বেডিংয়ের মধ্যে তোমাদের দরকারি যদি কিছু রেখে থাকো কাল বের করে নিয়ো।

কী আছে আমার ঠিক মনে পড়ছে না। কাল দেখব।

ওই বড় ট্রাংকটা কার? তোমারই তো?

আমার। খোকারটা বোধহয় নীচেই থেকে গেছে।

 আর-একটা ছোট ট্রাংক?

 ওতে আমার জিনিস রয়েছে।

কী জিনিস? চাবি কোথায় তোমার?

 চাবি জামার পকেটে।

 সুটকেসে কী আছে?

 খুচরো জিনিস। ওষুধপত্র আছে কিছু।

 তোমার ওষুধ?

হ্যাঁ।

কী অসুখ তোমার?

ডেফিনিট কিছু নয়। ওই জেনারেল কমপ্লেন। বয়স বাড়লে যা হয়। এখানে ওখানে ব্যথা, অল্পসল্প দুর্বলতা, মাঝে মাঝে ঘুম না হওয়া–এই আর কি! ওষুধ-টষুধ তেমন একটা কিছু নেই, ক্রুশনসল্ট, হজমের দু-চারটে ওষুধ। তবে মাঝে মাঝে নিশ্বাসের একটা কষ্ট হয়, ব্রিদিং ট্রাবল..

নীহার দু পা এগিয়ে শরদিন্দুর ঝোলানো কোটের পকেটে হাত ডোবালেন। চাবি খুঁজতে খুঁজতে বললেন, নিশ্বাসের কষ্ট ভাল নয়। এখানে বড় কাউকে দেখিয়ে নাও। বুক নিয়ে অবহেলা করতে নেই।

শরদিন্দু চা খেতে লাগলেন।

পকেট হাতড়ে চাবিটা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হল। নীহার চাবি নিয়ে সোজা বাক্সর সামনে মাটিতে বসে পড়লেন।

তোমার কটা কাপড়-চোপড় আগে বের করে দিই। কোন ট্রাংক খুলব বলো?

 শরদিন্দু বললেন, তুমি অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? আমি নিজেই বার করে নিতে পারতাম।

নীহার ট্রাংকের তালার সঙ্গে চাবি মেলাতে লাগলেন। কথার কোনও জবাব দিলেন না।

শরদিন্দু উঠে গিয়ে সিগারেট, লাইটার নিয়ে এসে আবার চেয়ারে বসলেন।

তোমায় দুটো পাজামা বের করে দিই, গেঞ্জিনীহার বললেন, কোন জামা পরবে? হাফ-হাতা ঢোলাগুলো?

দাও, যা হয় দাও; বাড়িতেই রয়েছি

নীহার বাক্স হাতড়ে কাপড়-চোপড় বের করতে লাগলেন।

সিগারেট ধরিয়ে নিলেন শরদিন্দু৷ আরও খানিকটা চা নিজেই কাপে ঢেলে নিতে নিতে বললেন, তোমাদের এই বাড়িটি বেশ। পাড়াটাও নিরিবিলি দেখছি।

নীহার হাতের কাজ সারতে সারতে জবাব দিলেন, নিরিবিলি আর কোথায়? এখন এখানে গায়ে গায়ে বাড়ি, একটুকরো জমি পড়ে নেই। কত লোক তরে এমনিতে পাড়াটা শান্ত-টান্ত। নীহার বাক্স হাতড়ে শরদিন্দুর পাজামা বের করে কোলের ওপর রাখলেন, একটা তোয়ালেও পাওয়া গেল। গেঞ্জি তাঁর চোখে পড়ছিল না।

শরদিন্দু নীহারকে দেখছিলেন। মাথার কাপড় নেমে কাঁধে পড়ে আছে। নীহারের চুল বেশ কোঁকড়ানো ছিল, এখন চুলের দীর্ঘতা কমে গিয়েছে, ঘনতা কমেছে, দু-এক জায়গায় ধূসর রং ধরেছে।

শরদিন্দুর মনে পড়ল নীহার একবার দুর্গামণ্ডপে পড়ে গিয়ে মাথার পেছনে কান ঘেঁষে বেশ জখম হয়েছিল। অনেকটা কেটে গিয়েছিল বেচারির। সেলাই পড়েছিল, জ্বর হয়েছিল বেশ। দাগটা নিশ্চয় এখনও আছে। শরদিন্দু প্রায় বলতে যাচ্ছিলেন কিছু, এমন সময় নীহার কথা বললেন।

নীহার বললেন, তুমি যদি আর দশ বারোটা বছর আগেও এখানে আসতে, ফাঁকা কাকে বলে বুঝতে পারতে! সন্ধের পর শেয়াল ডাকত। বিয়ের পর আমিই যখন এলাম, তখন সবে শ্বশুরমশাই একতলাটুকু করেছেন। আমাদের এই বাড়ি, আর ধরো আঙুলে গুনে তিনটে কি চারটে বাড়ি। রাজ্যের গাছপালা, বাদাড়, এঁদো পুকুর। অন্ধকার হল তো এই তল্লাট জুড়ে শুধু শিয়ালের ডাক, কানের পাশে ঝিঁঝি শুনছি সারাক্ষণ। ঘুটঘুট করত সব। ভয়ে আমি মরতাম বাপু। কী বিচ্ছিরি যে লাগত?

তোমার শ্বশুরমশাই না ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন?

ডিজাইনার; সাহেব কোম্পানিতে কাজ করতেন। আমি যখন বিয়ের পর এলাম, তখন তাঁর বাতে অঙ্গ পড়ে গেছে। ডান হাতটা আর তুলতেও পারেন না উঁচু করে। ওঁর মুখে শুনেছি, এই জমি উনি হাজার দেড়েক করে কাঠা কিনেছিলেন। অনেক আগেই। আমাদের বাড়ি যখন হচ্ছে তখনই জমির দর চার-টার হয়ে গেছে। এখন তো জমিই নেই। বছর কয়েক আগেও পনেরো আঠারো হাজার টাকা কাঠা হয়ে গিয়েছিল।

শরদিন্দু মোটামুটি নীহারের শ্বশুরবাড়ির কথা জানেন। নীহারের শ্বশুর মোটামুটি সচ্ছলই ছিলেন। মানুষটিও খুব ভাল ছিলেন নিশ্চয়, নয়তো কে আর ডাক্তার ছেলের বিয়েতে একটা পাই-পয়সাও দাবি জানায় না। শরদিন্দুনীহারের শ্বশুরকে দেখেননি। তবে সবই শুনেছেন। নীহারের শ্বশুর স্বাস্থ্য বদলাবার জন্যে মাস দুয়েকের জন্যে বাইরে বেড়াতে যান। জায়গাটা অবশ্য মধুবনী শরদিন্দু আর নীহারের জায়গা। নীহারের কাকার সঙ্গে ভদ্রলোকের পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। সেই সূত্র ধরেই নীহারের বিয়ে। শরদিন্দুর তখন মনে হত, পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে, ভদ্রলোক তাদের শহরে কেন জলহাওয়া বদলাতে এসেছিলেন? তিনি না এলেও কি ভাগ্যের অদলবদল কিছু হত? বোধহয় হত না।

নীহার কথা বললেন। শরদিন্দু মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, বাক্সর ডালা বন্ধ করেছেন নীহার।

এই বাড়ি নীহার বললেন, বারো আনাই শ্বশুরমশাই শেষ করে গিয়েছিলেন। তখন খরচপত্রও কম ছিল। বাবা নিজে সব জানতেন-টানতেন–তাঁর হাতে না হলে এ বাড়ি আর এমনটি হত না। বাক্সটায় তালা দিয়ে এবার স্যুটকেসটা টেনে নিলেন নীহার। খুললেন না। আমরা আর কতটুকু করেছি। এদিকে এই তেতলার ঘরটা আর ওদিকে দোতলার ছাদটাদ, বাকি কিছু টুকটাক করতে হয়েছে। বাড়িতে ভাড়াটে বসাতে হলে কিছু সুখসুবিধে দেখতে হয়।

তোমাদের ওপাশটায় পুরোটাই ভাড়া?

হ্যাঁ; দুঘর ভাড়াটে থাকে, নীচে আর ওপরে। ওদিকটা দোতলা। আর আমার এদিকে, নীচে গ্যারেজ আর খান-দুই ঘর নিয়ে মিসেস বাগচি নার্সারি স্কুল করেছেন। স্কুল আর কী, কাচ্চাবাচ্চা আসে কিছু পাড়ার, চেঁচামেচি করে, দোলনা দোলে, লাফালাফি করে খানিকটা, তারপর বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ির মা মাসিরা দুপুরে জিরোতে পারে নিঝঞ্ঝাটে তারই ব্যবস্থা। নীহার হাসলেন।

শরদিন্দু ঠাট্টা করে বললেন, তুমি নার্সারি স্কুলের প্রেসিডেন্ট?

 দূর দূর– নীহার মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। কোলের জিনিসগুলো ঘরের আলনায় গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, আমার নিজের দিকটায় আর ভাড়াটে বসাবার ইচ্ছে ছিল না। বড় ঝঞ্ঝাট করে। আগে বার-দুই ছিল। বাবা, সে কী বায়নাক্কা। তার ওপর হইচই, গণ্ডগোল। এ তোমার অনেক নির্ঝঞ্ঝাট। সকালের দিকে ঘণ্টা দুই-তিন, তারপর তো ফাঁকা।

কথা বললেন না শরদিন্দু; সিগারেট শেষ হয়ে এসেছিল, ছাইদান খুঁজতে লাগলেন। নীহারের চোখে পড়ল শরদিন্দু এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। নীহার ছাইদান তুলে নিয়ে টিপয়টা শরদিন্দুর চেয়ারের পাশে টেনে দিলেন।

এবার তোমার ওষুধপত্রগুলো বের করে রেখে দিই, নীহার বললেন।

থাক না, আমি নিয়ে নেব।

না না, ঘর জোড়া করে সব পড়ে আছে; পরিষ্কার করে দিলে তুমিও হাঁটাচলা করতে পারবে, দেখতে ভাল লাগবে। নীহার আবার মাটির ওপর বসে পড়লেন।

খানিকটা চুপচাপ থেকে শরদিন্দু বললেন, নীহার তুমি দেখছি বেশ ভাল ভাবেই হালটা ধরতে পেরেছে সংসারের, নয়তো কী যে হত…!

সুটকেসের চাবি বাছতে বাছতে নীহার শরদিন্দুর দিকে তাকালেন। মাথার কাপড় আর তিনি তুলে দেননি, সেই রকমই ঘাড়ের কাছে পড়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আমি না ধরলে আর কে ধরবে বলো? আমার আর কে ছিল? শ্বশুরমশাইয়ের ওই একটি মাত্র ছেলে, মেয়েটি বিয়ে থা করে তার বরের সঙ্গে সেই যে বিদেশ চলে গেল, আর ফিরল না। ফিরবেও না। আজকাল খোঁজখবরও করে না। বছরে এক আধখানা চিঠিও পাই না। শ্বশুরমশাই মারা যাবার পর আমরাই তো ওর সব ছিলাম। কী দোষ করেছি জানি না সম্পর্কটাও রাখল না আর।

শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কলকাতায় নীহার এতটা একা তাঁর যেন জানা ছিল না। কী মন করে জিজ্ঞেস করলেন, কলকাতায় তোমার শ্বশুরবাড়ির আরও আত্মীয়স্বজন ছিলেন শুনেছিলাম!

একেবারে নিজের কেউ নেই; জ্ঞাতিগোষ্ঠী আছে। আমার এক দেওর আছে, রিনির বাবার মাসতুতো ভাই; আর আছে এক বড় ননদ, ওদের জ্যাঠতুতো দিদি। দেওরটিই যা মাঝে সাঝে এসে খোঁজখবর করে যায়। সে বড় পাগলা। তেমন আপদে বিপদে সেই সম্বল। তবে গজেন ঠাকুরপো থাকে অনেক দুরে, পাতিপুকুরে। যখন তখন আসতে পারে না। ওদের ওদিকে আসা যাওয়াও মুশকিল, নিত্যি গণ্ডগোল। তা ছাড়া মানুষ আজকাল নিজেকে নিয়েই পারে না তো জ্ঞাতিগোষ্ঠী! নীহার কথা বলতে বলতে কাজ শুরু করলেন। ওষুধপত্রর শিশি, হট ওয়াটার ব্যাগ, এটা-সেটা বার করতে লাগলেন।

শরদিন্দু খানিকটা সোজা হয়ে বসলেন। শেষ বেলার এক ফলা আলো মেঝেতে পড়ে আছে, নীহারের বেশ কাছাকাছি। চারপাশে জিনিসপত্র ছড়ান। শরদিন্দু অলস চোখে নীহারকে দেখছিলেন: সব গোছগাছ শেষ না করে নীহার উঠবে না। এখনও যেন তার একরোখা ভাবটা রয়েছে।

ওরা কেউ আসে-টাসে? শরদিন্দু জিজ্ঞেস করলেন, দুলালদা, মণি?

দাদা গত বছর এসেছিল একবার। মণিরা তো দিল্লি চলে গেছে..বাপ-মা যতদিন থাকে ততদিন মেয়েদের বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক, তারপর সবাই ভুলে যায়, বুঝলে না। মা মারা যাবার পর আমিও আর ওদিকে যাই নি।

শরদিন্দু ঠাট্টা করে বললেন, বাপের বাড়ির দোষ দিয়ো না, নীহার। এই তো আমি এলাম। তোমার বাপের বাড়ির মানুষ।

নীহার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। কাঁধ, ঘাড়, গলা খানিকটা মোটা হয়ে যাওয়ায় এখন ভাল করে ঘাড় ফেরাতে পারেন না। সামান্য পাশ ফিরেই বসতে হল। বললেন, তা ঠিক। তবে কত বছর পরে তার হিসেবটা করো।

কত বছর? শরদিন্দু নতুন করে সময়টার হিসেবটা করলেন না। হিসেব করাই আছে। আস্তে করে বললেন, বছর কুড়ি।

তার বেশি ছাড়া কম নয়। তোমায় আমি শেষ দেখেছি, রিনি যখন কোলে। মার কাছে গিয়েছিলাম। তুমি এসেছিলে ছুটিতে। শ্যাম তখন বছর চারেকের। তাই না?

শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে বললেন, হ্যাঁ। তাই হবে।

বউদিকে সেই আমি প্রথম দেখলাম। কী সুন্দর মানুষ ছিল বউদি। কী কপাল তোমার অমন বউটিকে হারালে।

শরদিন্দু নীরব থাকতে থাকতে এক সময় নিশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার কপালটাই বা ভাল কোথায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *